কীটনাশকের কীর্তি
বাবা রমিজালী মিঞা,
পত্রে শত ২ দোয়া জানিবা পর সমাচার এই যে প্রায় মাসাধিককাল তুমার কুনরূপ সোম্বাদ না পাইয়া দুচ্চিন্তিত আছি। সোমাচার ইহা জানিবা যে তুমার ভইন অছিমুন্নেছা গত সমবার দিবাগত রাত্রে পোকের অউসুদ খাইয়া মরিয়া গিয়াছে 1 দারগা পুলিশে একুনে ৩ তিন টাকা কম ২৫০ টাকা খরচ হইয়া গিয়াছে।
এই পর্যন্ত পড়ে সোনামিয়া ড্রাইভার ব্রেক কষে। ছোটো ছোটো কাঁচা অক্ষর, পোস্টকার্ড তিলপরিমাণ জায়গা নষ্ট করা হয় নি। রমিজের বোনের মৃত্যুসংবাদ পড়ে প্রথমেই তার হোঁচট খাওয়ার কথা, তবে কি-না এই হাতের লেখার মতো পড়াটাও তার তোতলা-তোতলা, তাই শব্দের দিকে মনোযোগ থাকে বেশি, কুঁতে কুঁতে বানান করে পড়তে পড়তে পুরো বাক্য কি বাক্যের মানে সঙ্গে সঙ্গে বোঝা তার আর হয়ে ওঠে না। এখন একটি মৃত্যুসংবাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটের প্রসঙ্গ যে সংঘাত তৈরি করেছে, তাতে তার মাথায় লাল সিগন্যাল জ্বলে উঠেছে 1 এই কয়েকটা লাইন বিড়বিড় করে ফের পড়ে সোনামিয়া তাকায় রমিজ আলির দিকে।
ট্রাকের পাদানিতে দাঁড়িয়ে রমিজ আলি তার চিঠি-পড়া শুনছে। বিকালবেলার রোদ শিরীষ গাছ ছুঁয়ে নেমে তার মুখে ডোরাকাটা আলোছায়া ফ্যালে; তাই, রমিজ আলির চোখে কি ঠোঁটে একটু কাপন থাকলেও মুখের গোটা পাড়ায় কেমন সাড়া পড়েছে বোঝা মুশকিল। সোনামিয়া থতমত খায়, আত্মহত্যা করেছে—সেই মেয়েটি তাহলে কে? রমিজ আলির চোখমুখঠোঁটে সে সাড়া দ্যাখার চেষ্টা করে, ‘তর বইনে মনে লয় মইরা গেছে। তুই কিছু জানস না?’
‘না। পড়েন।’ রমিজ আলির এরকম বাষ্পহীন গলার জবাব শুনে সোনামিয়ার অস্বস্তি হয়। বোনের আত্মহত্যার বিষয়টি রমিজ আলিকে অনুভব করানো খুব জরুরি—এই বিবেচনা তার তেলমবিল-শোষা গর্দানে খামচা-খামচি করলে সে বলে, ‘তর বইনে মনে লয় র্যাটম উটম কি এনড্রিন ঊনড্রিন খাইছে। কতো বড়ো বইন?’
‘বিয়া দিছিলাম তিন মাস।’
‘তর বড়ো না?’
‘হ।’ রমিজ তাড়া দেয়, ‘পড়েন।’
সোনামিয়া ফের প্রথম থেকে পড়তে শুরু করলে রমিজ আলি বাধা দেয়, ‘এইগুলি তো পড়ছেন।’
সোনামিয়াকে সুতরাং পড়তে হয় পরবর্তী বাক্য, ‘আরও জানিবা যে মিরধাবাড়ির আছমত আলির পাওনা ২৪৫ টাকার জন্য দুইশত পাচ্চাল্লিশ টাকার জন্য বার ২ তাগাদা দিতাছে, তাগাদার জন্য হাটে যাওন একরূপ অসম্ভাব হইয়া পরিয়াছে। পুলিশ দিয়া বেইজ্জত করিবে এইরূপ সাসাইয়া বেড়ায়।’ সোনামিয়া একটু বিরতি দেয়, ‘আসমত আলি ক্যাঠা? ট্যাকা পাইবো তর বাপের কাছে?
‘পাইতে পারে, আমরা হ্যাগো জমিন করি। পড়েন।
‘পড়ি।’ সোনামিয়া তাকে গাড়ির ভেতরে আসতে বলে, ‘তুই এহেনে আয় না।’ পাশের সিটে বসার জন্য রমিজকে এরকম আমন্ত্রণ সে কখনো করে না। ট্রাক চালানো শেখাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রমিজ আলিকে দিয়ে সে হাতপা টেপায়, আরো কিছু করতে ইচ্ছা করলে গাড়ির যন্ত্রপাতির নাম আওড়ায়—কিন্তু সেসব আদর সোহাগ গ্যারেজের ওপরতলায় তার থাকার ঘরে। ট্রাকের এই ড্রাইভারের আসন তার পবিত্র জায়গা, আকামের সঙ্গীকে এখানে ঢোকাতে সোনামিয়ার বাধে। এখন তার এই হঠাৎ-উদারতায় রমিজ সাড়া দেয় না, পাদানিতে দাঁড়িয়েই সে তাড়া দেয়, ‘পড়েন না। সায়েবরে চা দিতে হইবো।’
চিঠি পড়া শেষ হলে পাদানি থেকে নেমে রমিজ চলে যায় বাড়ির মূল দালানে। সিঁড়ি পেরিয়ে নেট-ঘেরা চওড়া বারান্দা। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে সায়েবের মেয়ে, এই বারান্দায় বসেই গল্প করতে করতে বাপে-বেটিতে চা খাবে। বিবিসায়ের এসে পড়লে অবশ্য একটু ভেতরে গিয়ে খাবার টেবিলে বসতে হবে, চায়ের সঙ্গে নাশতা থাকলে যেখানে সেখানে খাওয়া দাওয়া বিবিসায়েবের পছন্দ নয়। নতুন সাদা গাড়িটা নিয়ে বিবিসায়ের বেরিয়ে গেলো একটু আগে। সায়েব এখন একা এবং বেশ ঢিলেঢালা। তাকে কিছু বলতে হলে এটাই সবচেয়ে ভালো সময়।
পাজামা পাঞ্জাবি পরে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে সায়ের খবরের কাগজ পড়ছিলো, তার পায়ের কাছে শুয়ে রয়েছে বাড়ির প্রধান এ্যালসেশিয়ানটি, সায়েব তার পিঠে খালিপায়ের মিষ্টি মিষ্টি চাপ দিচ্ছিলো। স্প্রিঙ লাগানো দরজা ঠেলে রমিজ আনিকে বারান্দায় উঠতে দেখে কুকুর গরর্ গরর আওয়াজ করে। কাগজের আড়ালে মুখ রেখেই সায়েব বলে, ‘একটু পরে চা দিস। শাম্মী আসুক।’
‘স্যার, আমার বইনে–
কিন্তু কুকুরের গর্র্ গরর কথায় তার আওয়াজ চাপা পড়ে। ওকে দেখে কুকুর ঘন ঘন ল্যাজ নাড়ে, সর্বাঙ্গ কাঁপায় এবং গলার অনেকটা ভেতর থেকে একইরকম ধ্বনি অবিরাম ছাড়তে থাকে। ধ্বনির এই একটানা গতি সায়েবের পছন্দ নয়। স্বরকে আদুরে রেনজের মধ্যে রেখে সায়ের আপত্তি জানায়, ‘নো, জিপসি নো।’
এতোক্ষণ সায়েরের মনোযোগ ছিলো কেবল খবরের কাগজে, এখন কুকুরের দিকেও তার নজর। সায়েবের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কিংবা অন্তত খবরের কাগজ থেকে তার মনোযোগ সরাবার জন্য কিংবা কী করবে বুঝতে না পেরে রমিজ আলি কুকুরকে ডাকে, জিপসি চলো।’
জিপসি এক ডাকে উঠে দাঁড়ায়। সায়েব তখন ঘেউ করে ওঠে, ‘ওকে ডাকছিস কেন?’
রমিজ সঙ্গে সঙ্গে তার আহ্বান প্রত্যাহার করে নেয়, ‘বসো জিপসি, বসো। তবে ওর গলা সায়েব বা এ্যালসেশিয়ানের মতো গম্ভীর নয় বলে এই নির্দেশে মিনতির ভাব। জিপসি তবু দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়তে শুরু করলে রমিজ ভয় পায়। সায়ের চোখ ছোটো করে জিপসিকে দ্যাখে, রমিজকে হঠাৎ জিগ্যেস করে, ‘জিপসিকে খেতে দেয় কে?’
‘জি আমি দেই।’ ঘাবড়ে গিয়ে এই মিথ্যা কথাটি বলে রমিজ বরং সায়েবের সুবিধা করে দেয়, ‘তোর তো খেতে দেওয়ার কথা নয়, এই ডিউটি আবদুলের না? ওর খাবার কি নিজেই খেয়ে নিস?’
কয়েক বছর এই বাড়ির ভাত পেটে পড়ায় রমিজ একটু মোটা হয়েছে বৈ কি! জিপসির রোগা শরীর ও নিজের মোটা গতরের কারণে সে বেশ জড়সড় হয়। এখন বোনের আত্মহত্যা ও টাকার কথাটা তোলে কী করে? কুত্তার বাচ্চা জিপসি আজ সব বরবাদ করে দিলো। নইলে সায়েব কিন্তু হঠাৎ করে মেজাজ খারাপ করার লোক নয়। ১টা কাপড়ের মিল, ১টা কাচের কারখানা, শোনা যাচ্ছে ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরি করে ফরেনে পাঠাবে — টাকাপয়সা বলো, গাড়ি বলো, বাড়ি বলো, চাকরবাকর বলো, কুকুর বিড়াল বলো—কোনো লেখাজোকা নাই। কিন্তু বাড়ির বলো ভেতর ঢুকলো তো মাটির মানুষ। এই মেয়ের মুখে জোর করে কেকের টুকরা গুঁজে দিচ্ছে, ক্লাস টেনে পড়া ছেলের পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে বলছে, খিদে পেলে কিছু খেয়ে নিও, যেখানে সেখানে খাবে না কিন্তু। চাকরবাকর ড্রাইভার দারোয়ানের সঙ্গে খ্যাচাখেচি করার অভ্যাস তার নাই বললেই চলে। তাদের একটু আধটু চুরি কি ফাঁকি টের পেলেও সেদিকে চোখ ফিরিয়ে থাকে। কাউকে পছন্দ হলো না তো পুরো মাসের বেতন দিয়ে তাকে ছাঁটাই করে দেয়। এই অপ্রিয় কাজটিও সরাসরি নিজে করে না, সিনিয়ার কোনো চাকর কি ড্রাইভার দারোয়ান দিয়ে করিয়ে নেয়। বিবিসায়ের কাউকে বেশি বকাবকি করলে সায়েব বরং ভ্রূ কোঁচকায়, ‘চ্যাঁচামেচি করে শরীর নষ্ট করার মানে হয়? কাজ না করলো তো পাছায় দুটো লাথি দিয়ে বের করে দাও।’—এখন রমিজ আলি তার সবুজ ডোরাকাটা লুঙির তলায় পাছা একটুখানি চুলকে নেয়।
খবরের কাগজের পাতা এদিকে ওদিক করতে করতে সায়ের স্বর নামিয়ে বলে, চুরি করবি না, কিছু খেতে ইচ্ছা করলে পয়সা চেয়ে নিস।’
এই স্পষ্ট আহ্বান সত্ত্বেও রমিজ সাড়া দিতে পারে না। এই কুত্তা হারামজাদা সব নষ্ট করে দিলো। অথচ সময় চলে যাচ্ছে হু হু করে, সন্ধ্যা পর্যন্ত আরিচার বাস পাওয়া যাবে, এখানেই যদি ৭টা বেজে যায় তো আজ আর যাওয়া হলো না। এখন বোনের মৃত্যুর খবর না দিয়ে সায়েবের কাছে টাকা চায় কী করে? আবার বোন কীভাবে মারা গেলো সেই ঘটনাটি ছাপিয়ে ওঠে জ্যান্ত অসিমুন্নেসার এই স্থির এই অস্থির চেহারা। মরেও অসিমুন্নেসার ছটফটানি ব্যারাম সারে না, তার কালো রোগা আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছে রমিজের ঠোঁট, সেইসব আঙুল সরিয়ে দেওয়ার জন্য রমিজ ঠোঁট কাপায়। ঠোঁট থেকে বোনের আঙুল সরানো এবং সায়েবের কাছে টাকা চাওয়া —উভয় উদ্দেশ্যে সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে যাবে, স্যার আমার বইনে মইরা গেছে চিঠি আসছে, পোকের ওষুদ খাইয়া মরছে, পুলিশের খরচ গেছে তিনশো ট্যাকার উপরে নাকি আরো শখানেক টাকা বেশি চাইবে —আল্লার কসম স্যার, বিশ্বাস না পান তো এই যে চিঠি আসছে দ্যাখেন—চিঠি কি আর সায়েব সবটা পড়বে? — ভয় হয় সায়ের যদি জিগ্যেস করে ওষুধ খেয়ে মরলো কেন?—তাই তো, বুবু পোকার ওষুধ কেন খায় সেই কৈফিয়ৎ এখন সে কী করে দেয়? বুবুর স্বামী হাফিজুদ্দি ঠিক বলতে পারে বৌ তার পোকার ওষুধ খায় কেন? মিরধাবাড়ির ম্যাট্রিক পাসকেও জিগ্যেস করলে হয়। হাফিজুদ্দি ও ম্যাট্রিক পাসের সঙ্গে জোটে অসিমুন্নেসার বাপ, তার পিছে উঁকি দেয় অসিমুন্নেসার মা, ম্যাট্রিক পাসের বাপ কিসমত হাজি, ধলেশ্বরীর তীরে ম্যাট্রিক পাসের সাজানো গোছানো মনিহারি দোকান, দোকানের পাশে বড়ো রাস্তায় বাস যাচ্ছে, বাস বোঝাই মানুষ—সবই এলোমেলোভাবে চলে যায়, নানা ঢেউয়ের ওপর ওঠানামা করে, স্রোতের ওপর দিয়ে ঢেউ চলে যায়, ১টা থেকে ১টা আলাদা করা যায় না। এর সঙ্গে যায় শালার টাইম। সময় যায়। টাকা আর চাওয়া হয় না। না, সরাসরি টাকা চাওয়াই ভালো, টাকা চাইলে সায়েব সব জিগ্যেস করবে, তখন যা বলার এমনি বলা হবে, রমিজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবে, এতো চিন্তাভাবনার দরকার হবে না। সায়েবের পায়ের নখে চোখ রেখে ‘সায়েব আমারে কিছু ট্যাকা দিতে হইবো, আমার বইনে মইরা গেছে’—এই কথা বলার জন্য রমিজ ঠোঁট খুলছে এমন সময় দেওয়ালের ঘড়িতে কলের পাখির ডাক বেজে ওঠে। শেষ ডাকটির জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়। ৫ বার ডেকে পাখি থামে। এই ফাঁকে রমিজ তার বাক্যটিকে সম্প্রসারিত করবার সুযোগ পায়, তবে হারামজাদা পাখি সব তছনছ করে দিয়েছে বলে কথাবার্তা যা বলবার সবই ফের প্রথম থেকে ঠিকঠাক করতে অনেকটা সময় নষ্ট হলো। সায়েব, বাড়ি থাইকা চিঠি আইছে, পোকের ওষুদ খাইয়া আমার বইনে মইরা গেছে, আমারে আইজ বাড়ি যাইতে হইবো, কিছু ট্যাকা দ্যান, দারোগা পুলিশের খরচ যোগাইতে বাবার চাইরশো টাকার উপরে করজো হইছে’–কিন্তু কথা শুরু করার আগেই মাইকে হুংকার দেয় আসরের আজান। আজানে তার শোক সংগঠিত হয় না, কিংবা এর পরিচিত টানা ধ্বনি অসিমুন্নেসাকে তাদের কাছ থেকে চিরকালের জন্য টেনে নেওয়ার ব্যাপারটিকে আরো তীক্ষ্ণ করে বাজায় না। বরং সাজানো গোছানো সব কথা লণ্ডভণ্ড করে দিলে তাকে ফের প্রথম থেকে বাক্য তৈরির কসরত চালাতে হয়। কিন্তু এর মধ্যে সায়েবের হাত থেকে খবরের কাগজ পড়ে যায় মেঝেতে। সায়েবের মৃদু নাক ডাকে। রমিজের এবারের প্রতীক্ষা সায়েবের জাগরণের তরে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সায়েবের তন্দ্রা ভাঙে, কিন্তু সেটা গাড়ি বারান্দায় লাল টয়োটো করোলার প্রায়-নিঃশব্দ আবির্ভাবের ফলে। সায়েবের মেয়ে এসে পড়েছে। রমিজ আলি ছাড়ে না, বরং নতুন করে তৈরি হওয়ার উদ্যোগ নেয়। আপার মুড আজকাল সবসময়ই ভালো। ইউনিভার্সিটিতে নতুন ঢুকেছে, সব ব্যাপারেই তার হৈচৈ, পায়ের নিচে স্প্রিঙ ফিট করা, ইচ্ছা হলেই তিড়িং বিড়িং করে ওপরে উঠছে নিচে নামছে; এদিক হেলছে, ওদিক দুলছে। বাপের সঙ্গে গলায় গলায় খাতির। মেয়ের সঙ্গে চা খাবে বলেই সায়েব কোনো কোনো বিকালবেলা এই বারান্দায় বসে। এই মেয়ের কল্যাণেই বাড়ির লোকজন মাঝে মাঝে বিকালবেলা অন্তত ঘণ্টা দুয়েক সায়েবকে এখানে দেখতে পায়। আরো আগে, এই ধরো বছরখানেক আগেও সন্ধ্যাবেলাটা কিন্তু সায়ের ঘরেই কাটাতো, সন্ধ্যার পর মেহমানরা আসতো, এখানেই জমে উঠতো প্লেটের কাটার বোতলের গ্লাসের টুংটাং বোল। আজকাল ওসব চালান হয়ে গেছে সোনারগাও পূর্বাণী শেরাটনে। কতো সব হোটেল, কী সুন্দর সুন্দর নাম, ড্রাইভারদের মুখে শুনতে শুনতে রমিজের মুখস্থ হয়ে গেছে। এইসব হোটেলের কথা অসিমুন্নেসাকে বলা হলো না। বুবুটা ঢাকার কথা শুনতে বড়ো ভালোবাসে। গুলিস্তান, শিশুপার্ক, নিউ মার্কেট, স্টেডিয়াম, হাইকোর্টের মাজার—কোনোদিন ঢাকায় না এসেও এইসব জায়গা বুবুর জিভে লেগে থাকে থুথুর মতো। মিরবাবাড়ির ম্যাট্রিকপাস তার বুবুর চোখের মণিতে দাঁড়িয়ে কালো দোহারা শরীরটা এমনভাবে দোলায় যে তাকে মুছে ফেলার জন্য রমিজের আঙুলগুলো শিরশির শিরশির করে। কিন্তু সায়েবের মেয়ের সরব হাজিরা ঘটায় তার আঙুল টাঙুল যেখানে থাকার সেখানেই থাকে এবং ঐগুলোকে ঐভাবে রেখেই রমিজ নেমে আসে গাড়ি-বারান্দায়।
ধিনিক ধিনিক নাচতে নাচতে মেয়ে ছোট্টো ধাক্কায় দরজা ঠেলে উঠে আসে নেটঘেরা বারান্দায়। তার পিছে পিছে রমিজ। সায়েবের মেয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে এসে সটান বসে পড়ে বাপের পায়ের কাছে কার্পেটের ওপর। বসেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আব্বু, তুমি না কী যে করো! তোমাকে কতোবার বললাম আজ আমাদের ফাইন্যাল। তোমার কিচ্ছু মনে থাকে না, আর ইউ গ্রোইং ওল্ড? কথাকলিতে আমার পারফরম্যান্স বেস্ট, এই দ্যাখো মেডেল, হান্ড্রেড পার্সেন্ট গোল্ড। আমার আইটেমের এন্টায়ারটা ভিডিও করেছে, নেক্সট ওয়েনজড়ে ছয় নম্বর ‘চ্যানেলে দ্যাখাবে, এটা আবার মিস করো না কিন্তু।’ বেগুনি সিল্কের ফিতায় বাঁধা সোনার মেডেল দ্যাখানো শেষ হলে তার কাঁদো কাদো ভাব কাটে এবং সঙ্গে সঙ্গেই গলায় ওঠে নতুন ঢেউ, এটা একেবারে আলাদা কিসিমের। ‘আব্বু, আজ না আরেকটু হলেই মরে যেতাম। ভাগ্যিস মরিনি!’ তারপর পুরো ৫ মিনিট সে মাঝে মাঝে বাঙলা ভেজাল দেওয়া ইংরেজি ঝাড়ে। তা এই বাসায় রমিজের অনেকদিন তো হয়ে গেলো, দিব্যি বুঝতে পারে যে শিল্পকলা এ্যাকাডেমি থেকে ফেরার সময় কাকরাইলের মোড়ে একটা ট্রাক সাঁ করে চলে গেছে তার গাড়ির গা ঘেঁষে, ইঞ্চিখানেক এদিক ওদিক হলে এতোক্ষণ তার লাশ চলে যেতো পিজি হাসপাতালে। শুনে সায়েব মতিন ড্রাইভারকে ডেকে আনার জন্য রমিজকে হুকুম দিলো। তার মানে ১ মাসের বেতন দিয়ে আবদুল মতিনকে বিদায়। কিন্তু সায়েবের মেয়ের দয়ার শরীর, না আব্বু, গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি নিজেই। ড্রাইভারকে স্টিয়ারিং দিয়েছি ট্রাক চলে যাবার পর। তাতে অবশ্য রমিজ আলির ভয় কাটে না। কাঁদো কাঁদো গলায় নাচে মেডেল পাওয়ার খবর এবং মহা উল্লাসে প্রায়-এ্যাকসিডেন্টের বিবরণ দেয় যে মেয়ে তাকে ঠিকমতো ঠাহর করাই রমিজের পক্ষে শক্ত ঠেকে। তাকে আবার শুরু থেকে কথা তৈরির উদ্যম নিতে হয়। সায়েবের মেয়ে লাফ দিয়ে উঠে ড্রইং রুম পেরিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে রেফ্রিজারেটার খুলে বোতল বার করে ঢকঢক করে পানি খায়। সায়ের এখান থেকেই ধমক দেয়, শাম্মি, খালি পেটে পানি খায় না। মেয়ে তখন বেরিয়ে আসে
কোকাকোলার বোতল খুলতে খুলতে। সায়েব বলে, এখন কোক খেও না, এ্যাসিড হবে।’ তবু ২/৩ টোক কোকাকোলা গিলে ‘ওঃ আব্বু!’ বলে মেয়ে ফের ভেতরে যায়, বেরিয়ে আসে লিচুর গোছা হাতে। ১টা লিচুর বোটার দিকে খোসা ছাড়িয়ে ঠোঁটজোড়া ছুঁচলো করে সবটা লিচু সে মুখের ভেতর টেনে নেয় চুকচুক আওয়াজ করে। এই চুকচুকটা এমনি তীক্ষ্ণ যে শুধু লিচু খেয়ে সায়েবের মেয়ে এর ধার ক্ষয় করতে পারে না, অসিমুন্নেসার তেঁতুল চোষাতেও এর প্রতিধ্বনি সমান জোরে বাজে। তাই এই বাড়িতে, এই কার্পেটে তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে অসিমুন্নেসা হেসে গড়িয়ে পড়ে। তার চুকচুক আর চটাৎ চটাৎ তেঁতুল খাওয়া আর থামে না। ম্যাট্রিক পাস কী যে রঙের কথা বলে আর তাই শুনে অসিমুন্নেসা চলকে চলকে হাসে। -অ বুবু মায়ে ডাকে, মায়ে কহন থাইকা ডাক পাড়ে হোনস না? –না তার ডাকাডাকিতে বুবু সাড়া দেয় না। বরং তেঁতুলের চুকচুক আর চটাৎ চটাতের ফাঁকে নালিশ করে, ‘মায়ে না আমারে এককেরে ফুরসৎ দিবার চায় না, জানেন? এতো কাম করলে মানষে বাঁচে?’ মিরধাবাড়ির ম্যাট্রিক পাস হাসতে হাসতে বলে, তর এতো কাম করনের দরকার কী।’—তা মা আর কী করবে? মিরধাদের রান্নাঘরের বারান্দায় পড়ে আছে একগাদা এঁটো বাসনকোসন, উঠানে পড়ে আছে সেদ্ধ করার জন্য ধানের স্তূপ। এতো কাজ কি মা একহাতে সারতে পারে? –এ ছাড়া আরো আছে। মিরধাদের পোয়াতি বৌটা কাল ভাত খায়নি, পান্তা পড়ে আছে এক গামলা, একা খেতে কি মায়ের মন টানে?–আরো আছে। —মিরধাদের ম্যাট্রিক পাসের সঙ্গে মেয়েকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে মায়ের বুক টিপটিপ করে। তা মায়ের ডাকটা তখন যদি বুবুর কানে যায়! অ বুবু! মায়ে ডাকে, বুবু সাড়া দেয় না। অ বুবু! বাজানে ডাকে, বুবু সাড়া দেয় না। বাশের থামের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রমিজ। ধলেশ্বরী থেকে বাতাস আসে। ইলিশের গন্ধ চোঁয়ানো বাতাসে রমিজের খিদে পায়। বুবুর লালচে-কালো চুল ওড়ে পাটের ছেঁড়া আঁশের মতো। বুবুর সাড়া পাওয়া যায় না।
‘চা দাও।’
বিবিসায়ের কখন এসে পড়েছে রমিজ খেয়াল করেনি। তার এই সংক্ষিপ্ত নির্দেশে তেঁতুলতলায় ঝড় ওঠে এবং সব এলোমেলো হয়ে যায়। তবে এই ঝড়ের সঙ্গে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া রমিজের মাথায় নতুন সুড়সুড়ি তোলে; বিবিসায়েবকে বলতে পারলে কাজ হয়। গুছিয়ে বলতে হবে। — কী বলবে?–না, আম্মা, আমারে কয়টা ট্যাকা দিতে হয়। কেন?–আমার বইনে মারা গেছে পোকের ওষুদ খাইয়া। কীভাবে মরলো?—কারণটা বলা মুশকিল। জি, বাজানে চিঠি লেখছে, পোকের কেন?–হঠাৎ করে মাথাটা খুলে গেলো ওষুদ বলে খাইছিলো। রমিজের।–মিরধাবাড়ির ম্যাট্রিক পাসের কথা ভালো করে বলতে পারলে বিবিসায়েবের মন ভেজানো কোনো কঠিন কাজ নয়। তো সে লোক করলোটা কী?–সে তো অসিমুন্নেসাকে মারধোর করেনি, কিংবা বিয়েও করেনি যে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দ্যাখাবে। যেসব মেয়েমানুষের ওপর জুলুম হয় তাদের বাঁচাবার জন্য বিবিসায়ের বড়ো উদগ্রীব। কিন্তু ম্যাট্রিক পাসের জুলুমের কথা কী বলবে? এক বলা যায় হাফিজুদ্দির কথা। অসিমুন্নেসা হলো হাফিজুদ্দির বিয়ে করা বৌ, অথচ হাফিজুদ্দি তাকে ঘরে নেবে না। এটা জুলুম হলো না? হাফিজুদ্দির শয়তানির কথা শুনলে বিবিসায়ের এমন চটবে যে হারামজাদাকে শেষপর্যন্ত জেলের ভাত খেতে না হয়! বিবি সায়েবকে তো ওরা চেনে না। বিবিসায়েবদের একটা দলই আছে শুধু পুরুষমানুষের জুলুম বন্ধ করার জন্য। এই যে ভাত খেয়ে ভর দুপুরবেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলো, অন্তত কয়েকটা মিটিং না সেরে ফিরলো না। রমিজদের মতো গরিব গরবা ছোটোলোকদের মেয়েদের নিয়েই বিবিসায়েবদের সমিতির মাথাব্যথা বেশি। সমিতির সব ভালো ভালো বড়ো বড়ো ঘরের বিবিসায়েরা, ফর্সা ফর্সা মেয়েরা বড়ো রাস্তার মোড়ে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে বস্তিতে যাচ্ছে: ঘরে ঘরে খোঁজখবর নিচ্ছে, কোন রিকশাওয়ালা বৌকে রেখে হাওয়া হয়ে গেছে, বন্যায় গ্রাম থেকে ভেসে আসা কোন মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করে শাসাচ্ছে, হয় বৌকে নাও, না হলে খোরপোষের ব্যবস্থা করো। শয়তান রিকশাওয়ালা তালাক দিয়ে শেষপর্যন্ত প্রাণে বাঁচে। এক শালা দিনমজুর রোজ ভোরবেলা উঠেই বৌকে বেদম পেটায়, বিবিসায়েবদের পাট্টি তাকে এ্যায়সা ধমক লাগায় যে পরদিন বৌ পেটাবার দায়িত্ব সেরেই ব্যাটা কোথায় উধাও হয় যে তার আর উদ্দিশ মেলে না। পুরুষমানুষের জুলুম ঠেকাবার জন্য বিবিসায়েরা চাঁদা তুলে কোটকাছারি পর্যন্ত করে। একবার অনেক টাকা তুলে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে এলো, ঐ টাকা দিয়ে প্রেসিডেন্ট গরিব দুঃখী মেয়েমানুষদের ওপর জুলুম ঠেকাবে। রমিজ সেদিন টেলিভিশনে দেখলো, প্রেসিডেন্ট আর কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বিবিসায়ের তার সমিতির মহিলাদের নিয়ে কীসব কথা বললো, কেউই কিন্তু সেভাবে হাসছিলো না, মনে হয় মেয়েমানুষদের ওপর জুলুমের কথা মনে থাকায় সবারই মন খারাপ ছিলো। তো কথা শোনা গিয়েছিলো খালি প্রেসিডেন্টের, টেলিভিশনে গেলে আর কেউ মনে হয় কথা বলতে পারে না। বিবিসায়ের কিন্তু মিটিং টিটিঙে খুব সুন্দর বলতে পারে। পুরুষমানুষের শয়তানি বন্ধ করার ফন্দি শেখার জন্য বিবিসায়ের একেকবার বিলাত লন্ডন এ্যামেরিকা বোম্বাই কোথায় কোথায় যায়, তো একবার ফিরে এসে এই বাড়িতেই মিটিং করলো; খবরের কাগজের লোক, টেলিভশনের লোক, রেডিওর লোক এসেছিলো, বিবিসায়ের যে কী সুন্দর কথা বললো সে না শুনলে বিশ্বাস হবে না। এমনিতে কড়া লোক, তার দিকে তাকানো কঠিন, কিন্তু এটুকু কড়া না হলে জুলুম বন্ধ করবে কী করে? হাফিজুদ্দিকে যদি একবার এখানে এনে বিবিসায়েবের সামনে ফেলা যায় তো শালার হাড্ডিমাংস এক করে বস্তায় পুরে তেঁতুলতলায় পুঁতে রাখার সুবিধা হয়। কিন্তু তেঁতুলতলা দখল করে থাকে শালা ম্যাট্রিক পাস। এবার রমিজ একটু দমে গেলো। ম্যাট্রিক পাস শিক্ষিত লোক, তার ওপর জমিজমা, হালগোরু, কিষাণপাট, সিঙাইড়ে মনিহারির দোকান, পাটের আড়ত। — তাকে ধরা কি সোজা কথা?–তা বিবিসায়েবের খাতির তো আরো কতো বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে। বিবিসায়েবের কাছে টাকা চেয়ে নিয়ে সোজা থানায় গিয়ে হুকুম করো দারোগাকে, কী?–না বিবিসায়েবের হুকুম, মানে তোর বাপের হুকুম, বাপের বাপ মন্ত্রী প্রেসিডেন্টের হুকুম, ধরে নিয়ে আয় শালা মৃধাবাড়ির ভাদাইম্যা শয়তানটাকে। ওদের তেঁতুলতলাতেই এনে দে। তারপর শালার চুলের মুঠি ধরে প্রথমেই নাকে ধমাধম কয়েকটা ঘুষি লাগাও। লাগাও ঘুষি। লাগাও। নাকের হাড্ডি ভেঙে গুঁড়ো করে দাও। শুওরের বাচ্চা নিশ্বাস নিবি কী করে দেখবো। ঘুষি লাগালেও শয়তানটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না রমিজ, কারণ লোকটা হাজার হলেও ওদের মনিব বললেই চলে। হঠাৎ কী মনে করে লক্ষ করলে তার হাত জমে যায়, সে ঘুষি লাগাচ্ছে কার মুখে? এ লোকটা কে? হাফিজুদ্দির মুখ রক্তে ভেসে যায়, কালো মুখে লাল রক্ত নিয়ে সে একটানা গোঙায়। পুলিসের লোক মিরধাবাড়ির টাকা খেয়ে কাকে নিয়ে এসেছে? ওদের সঙ্গে কি পারা যায়? পুলিস না পাঠিয়ে সে নিজেই যদি ধরতে চায় তো ম্যাট্রিক পাসের কি আর নাগাল পাবে? তাকে ধরবে কীভাবে?—
ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে কী করছো? চা দাও।’ রমিজের সামনে থেকে মৃধাবাড়িকে মার দেওয়ার সম্ভাব্য রিহার্সেল সমূলে উপড়ে ফেলে বিবিসায়ের নিচু ও ঠাণ্ডা স্বরে বলে, ‘চা দাও।’
.
রাত্রে খেতে বসে সোনামিয়া জিগ্যেস করে, ‘ট্যাকা পাইছস?’
রমিজ মাথা নাড়লে ফের বলে, সায়ের কী কয়?’ রমিজ তবু কিছু না বললে ড্রাইভার বলে, ‘বাড়ি যাইবি না?’ জবাব না দিয়ে রমিজ সোনামিয়ার পাতে ভাত
বাড়ে। কয়েক গ্রাস খেয়ে সোনামিয়া মেঝের কোণে মশা-মারা কয়েলের ওপর রাখা প্যাকেটের দিকে বাঁ হাতের তর্জনী নির্দেশ করে, ‘তর বইনে মনে লয় ঐগুলি খাইছিলো।’ জিনিসটা হাতে নিয়ে রমিজ দেখলো র্যাটমের প্যাকেট। ঘরে ইঁদুরের উৎপাত বলে রমিজকে দিয়েই ড্রাইভার আনিয়ে নিয়েছে। প্যাকেটের ওপর রঙিন ছবি। ছবিতে কাদের চেহারা? কারা? কাদের ছবি? রমিজ তন্ময় হয়ে দেখতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যে ছবির বিষয়বস্তু আকার পায়। চিৎপটাং হয়ে পড়ে রয়েছে ইঁদুর, আরশোলা, মাকড়শা, ছারপোকা, মশা এবং মাছি। দেখতে দেখতে ছবির অধিবাসীরা একটু আধটু নড়াচড়া করে। ঠিক নড়াচড়া নয়, মনে হয় আর কেউ ঢুকে পড়ায় তাদের মরা শরীরগুলো আপনাআপনি সরে সরে যাচ্ছে। আগন্তুককে জায়গা করে দিলে গভীর পানির নিচে একটি মুখ মাছের মতো ভেসে বেড়ায়। এটা কী? ধ্যাবড়ানো ছবির এলিয়েপড়া পোকামাকড়ের ফাঁকে ফাঁকে, কখনো ওপরে কখনো নিচে ঐ জীবটি একাই কিলবিল করে। আর সব পোকামাকড়ের মতো সে মরেনি, মরলে তার নড়াচড়া বোঝা যাচ্ছে কী করে? একেকবার থিতু হতে হতে ফের ছড়িয়ে পড়ে। ঐ জীবটিকে সনাক্ত করার জন্য খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে যাচ্ছে। আরশোলার শুঁড়ের মতো কালচে-লাল ধারালো চুল, গায়ের রঙ ইঁদুরের চামড়ার মতো ছাই ছাই। কে? এটা কার মুখ?
‘তর বইনের কী হইছিলো রে?’ সোনামিয়ার এই প্রশ্ন কানে গেলেও বাক্যটি ঐ ছবির মতোই তার কাছে অস্পষ্ট ঠেকে। সন্ধ্যাবেলা সোনামিয়া কাপ্তান বাজার থেকে বাঙলা মদ টেনে এসেছে, তার মুডটা ভালোই ছিলো। কিন্তু রমিজের একটানা নীরবতায় তার মেজাজ খিচড়ে আসে। ছোঁড়াটা আদর বোঝে না। সেই কি-না তার চিঠি পড়ে দিলো, চিঠিতে এতো সাঙ্ঘাতিক খারাপ খবর,–তা কি পরামর্শ করবে, উপদেশ চাইবে, দুটো সান্ত্বনার কথা শুনবে,–তা না, ছ্যামরা তখন ঘাড় ত্যারা কইরা রোয়াবি মারে। রাগ করে মাছের দ্বিতীয় টুকরাটিও সোনামিয়া বাটি থেকে নিজের পাতে ঢেলে নেয়। অথচ রমিজ আলির তরকারিও কিন্তু এই বাটিতেই ছিলো। খাওনের দিকে গেরাইম্যাটার লালচ এট্টু বেশি। —তার নিজের মাছগোশতের টুকরা টাকরা দিয়েই তো সোনামিয়া রাত্রে রমিজকে নিজের ঘরে শোয়াতে পারে। তা দ্যাখো, ছোড়া আজ পাঙাস মাছের টুকরার দিকে ফিরেও তাকায় না। এই উদাসীনতায় সোনামিয়ার রাগ বাড়ে; রাগে রাগে নেশাও বাড়তে পারে। কিংবা নেশাই হয়তো তার রাগকে উস্কিয়ে দিচ্ছে। রাগে ও নেশায় তার মুখ ছোটে, ‘এই খানকির বাচ্চা তর মায়েরে বাপ। এমুন নবাবি দ্যাহাস ক্যালায়? তর বইনের কি হইছিলো আমি জানি না, না? গেরাইম্যা মাগীগো আমার বহুত চিনা আছে, বুঝলি? টিরিপ লইয়া আরিচা নগরবাড়ি দুইদিন তিনদিন কইরা থাকি না? ক, থাকি না? দুইটা ট্যাকা দিয়া পাটের খ্যাতের মইদ্যে লইয়া খানকিগুলিরে খালি ঠাপাও, খালি ঠাপাও! সোনামিয়ার প্রায়-চিৎকার তার মাথায় ধাক্কা খেলে সেখানে রক্তের কুলুকুলু আওয়াজ শোনা যায়। কয়েক মুহূর্তে এই আওয়াজ শোঁশোঁ গোঙানিতে পরিণত হলে রমিজের হাত কাঁপে। সোনামিয়ার ভাত ও পাঙাস মাছ ঠাসা মুখে পোকামারা ওষুধ জুত করে চেপে ধরতে পারলে এই কাঁপুনিটা থামে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না, ফলে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে গোঙানি হুংকার হয়ে মাথায় এমন তোলপাড় তোলে যে কান তো কান, তার চোখজোড়া পর্যন্ত ছিটকে পড়ার দশা ঘটে। র্যাটমের প্যাকেটের ছবিতে লুকোচুরি খেলতে থাকা চলমান জায়গায় অসিমুন্নেসা তখন স্পষ্ট চেহারা দখল নিয়েছে। আরশোলার শুঁড়ের মতো চুল দৈর্ঘ্যে ও পরিমাণে বাড়তে বাড়তে অন্যান্য জীবজন্তুকে ঢেকে ফেলে। মাকড়সার ৮টি পা দিয়ে গড়া হয় বুবুর চোখ, কান, নাক প্রভৃতি। ইঁদুর তার সমস্ত ছাইরঙ নিঃশেষে ঢেলে দেয় বুবুর গায়ে। মাশামাছিছারপোকার ভূমিকা যে কী ছিলো বোঝার আগেই রক্তের ধমক নেমে আসে চোখে এবং লাল টকটকে চোখে তার ধাক্কা সামলানো তখন দায়।
রাত্রে সিঁড়ির নিচে নিজের বিছানায় শুয়েও চোখের খচখচ আর কাটে না। এর ওপর চিৎ হয়ে শোবার ফলে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত রক্তের দাপট ছড়িয়ে পড়ছে, শরীরের সব জায়গায় কেবল শোঁশোঁ আওয়াজ। কে জানে সোনামিয়া হয়তো ঠিকই বলেছে, অসিমুন্নেসাকে নষ্ট করার কাজটি মিরধাবাড়ির ম্যাট্রিক পাস বোধ হয় পাটখেতেই সম্পন্ন করেছিলো। রমিজদের ঘরের ভিটার লাগোয়া কাঁঠালতলার জমিতে এবার পাটও হয়েছিলো খুব ভালো। রমিজের দাদী ঐ পাট দ্যাখার জন্যই কলাপাতার পর্দার এপারে এসে দিনমান হাঁটু ভেঙে বসে থাকতো, মরার দিনও সারাটা সকাল কোঁকাতে কোঁকাতে পাড়াশুদ্ধ মানুষকে পেটের ব্যথার কথা জানান দিয়েছিলো ওখানে বসেই। ক’বছর আগে দারুণ খরা গেলো, রমিজের বাপ ঐ জমি বেচে দিলো মৃধাদের কাছে। তা মৃধারা দাম যাই দিক আর রমিজের দাদী ঐ জমি আর কাঁঠালগাছ নিয়ে যতোই প্যানপ্যান করুক, ঐ সময় ঐ
সময় ঐ টাকাটা না পেলে বাড়িশুদ্ধ সবাইকে না খেয়ে মরতে হতো। আবার ঐ জমির বর্গা কিন্তু কিসমত মৃধা রমিজের বাপ ছাড়া আর কাউকে দেয়নি। রমিজের বাপের হাতে ঐ জমিতে পাট যা হয় দূর থেকে মনে হয় যেন সবুজ মেঘের পাঁজা। বুবুকে নিয়ে ম্যাট্রিকপাস চলে গিয়েছিলো সেই মেঘের আড়ালে রমিজের দাদার লাগানো কাঁঠালগাছ কেটে কিসমত মৃধা নিজের পুরনো জমির সীমানা ঘুচিয়ে দিয়েছিলো—বোধ হয় সেই জায়গাটায়। মগরেবের আজানের ঠিক আগে আগে ওরা ওখানে ঢোকে, জায়গাটা সাফ করে নিতে নিতে আজান শুরু হয়। তারপর ঠাসবুনুনি পাটখেত ছেঁকে আসা আজানের ঝাপসা শাসন এবং আজানে পাল খাটিয়ে আসা থিকথিকে অন্ধকারে নোয়ানো পাটগাছের ওপর শুয়ে থাকে অসিমুন্নেসা খাতুন। শেকড়বাকড় শুদ্ধ উপড়ে তোলা কাঁঠালগাছের লুপ্ত ছায়ায় শুয়ে রয়েছে অসিমুন্নেসা, চিৎপটাং শোয়া, তার সারা গায়ে কোনো জামাকাপড় নাই। লজ্জাশরমের বালাই নাই, বেহায়া বেশরম বোনের গলা টিপে ধরার জন্য রমিজের আঙুলগুলো নিসপিস করে। অতো বড়ো বাড়ির ছেলে, তার ওপর ম্যাট্রিকপাস, তার তেরছা হাসি দেখে বুবু একেবারে উতলা হয়ে উঠলো! মৃধাবাড়ির কয়েক পুরুষের চাকর ওরা, মৃধাদের জমি বর্গা নিয়ে, ওদের জমিতে খেটে, ওদের বাড়িতে বৌঝিদের খাটিয়ে এরা মানুষ। সেই বাড়ির ছেলের সঙ্গে বুবুর অতো মাখামাখি কিসের? কাজকাম সেরে ম্যাট্রিক পাস কেটে পড়লো, তখন তার আর দ্যাখাই পাওয়া যায় না। তার বাপ নিজেই অসিমুন্নেসার বিয়ের উদ্যোগ নিলো হাফিজউদ্দির সঙ্গে। হাফিজুদ্দির বাপ ছিলো মৃধাদের বছর-কামলা, কিসমত হাজির কিছু অধিকার তো তার ওপর আছেই। কিসমত হাজি তার ম্যাট্রিক পাসকে দোকান করে দিয়েছে সিঙাইড়ে, হাফিজুদ্দি ঐ দোকানে কাজ করে। তার চালচলন একটু আলাদা; সিঙাইড় বাস স্ট্যান্ডের কাছে সাজানো গোছানো দোকানে বসে দাঁড়িয়ে সে টর্চলাইট, টর্চের ব্যাটারি, তেল সাবান, কাগজ পেন্সিল বেচে, কতো দেশের মানুষের সঙ্গে তার জানাশোনা, ওঠাবসা। মাথায় তার কালো চুলের ঢেউ তেলে চকচক করে, গায়ে শার্ট, পরনে পরিষ্কার লুঙি, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল, খালি পায়ে তাকে দ্যাখাই যায় না। এমন বরের সঙ্গে বুবু ঘর করতে পারলো না তো তার কপালে পোকার ওষুধ ছাড়া আর কী জুটবে? বিয়ের পর বুবুকে কিন্তু খুশি খুশিই লাগতো, হাফিজুদ্দিকে তার মনে হয় পছন্দই হয়েছিলো -তা হোক, তাই বলে বিয়ের পর বুবুর অতো সতীপনা দ্যাখাবার দরকার কী ছিলো? বুবুর বিয়ের দিন পনেরো পর এক ভরদুপুরে ম্যাট্রিকপাস তার ঘরে গেলে বুবু নাকি দরজা খোলেনি। তারপর দোকানের মাল কেনার জন্য হাফিজুদ্দিকে ম্যাট্রিক পাস পাঠিয়ে দেয় মানিকগঞ্জ, বুবু তবু দরজা খোলে না। এতেও দমে না গিয়ে হাফিজুদ্দিকে ঢাকা পাঠানো হয়, এবার অনেক মাল কিনতে হবে, দুই রাত থাকবে বাইরে। ভয় পেয়ে বুবু চলে এলো বাপের বাড়ি। কোত্থেকে যে কী হলো, হাফিজুদ্দি বাড়ি ফিরে বলে পাঠালো যে অসিমুন্নেসাকে আর ঘরে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, এরকম ছিনালমেয়েমানুষ নিয়ে সে ঘর করতে পারবে না। বাজানের অনেক ঘোরাঘুরির পর হাফিজুদ্দি বলে পাঠায় যে শ্বশুর যদি একটা সাইকেল কিনে দেয় তো সে বিবেচনা করে দেখবে। আর মৃধাদের ম্যাট্রিক পাস তো বাজানের সঙ্গে দ্যাখাই করলো না, শোনা যায় এদিক ওদিক সে ফতোয়া ঝেড়ে বেড়াচ্ছে যে, চাকর বলে হাফিজুদ্দি কি মানুষ নয়? তার কি আখেরাত নাই? বিয়ের আগে যে মেয়ে পেট বাধিয়ে বসে তার সঙ্গে সে হাফিজুদ্দিকে ঘর করতে বলে কোন বিবেচনায়? –তা বুবু অতো সতীপনা দ্যাখালে তো মৃধার পোলা তার ওপর একটু ঝাল ঝাড়বেই। বুবুর পেটে তারই বীজ, তার দোকানের পয়সায় বুবুর খাওয়াপরা, আর তাকে এড়াতে সে কি-না চলে আসে বাপের বাড়ি! সে ছাড়া বুবুর গতি আছে? — মাসখানেক আগে রমিজ বাড়ি গেলে বাজান এমন ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে যে মৃধাবাড়ি না গিয়ে তার উপায় থাকে না। মেলা সাধ্যসাধনার পর ম্যাট্রিক পাসের সঙ্গে তার দ্যাখাও হয়. কিন্তু আসল কথা আর বলা হয় না। ইরি ধানের ফলন নিয়ে কথা হয়, রমিজের সায়েবের কারখানায় বাল্ব তৈরি হবে শুনে ম্যাট্রিক পাস তার দোকানে বাল্ব আমদানি করার সংকল্প ঘোষণা করে,–আরে গ্রামে তো ইলেকট্রিক লাইট এসে যাচ্ছে, ঢাকার ইনজিনিয়ার বন্ধু ম্যাট্রিক পাসকে নিজে বলেছে,–ধলেশ্বরীর ভাঙনে সিঙাইড় শেষপর্যন্ত টেকে কি-না এ নিয়ে লোকটা কতো হা হুতাশই না করে; কিন্তু বুবুর কথা আর পাড়া হলো না। আজ এতো চেষ্টা করেও সায়েবের কাছেও কথাটা তোলা গেলো না। বিকালবেলা কয়েকটা টাকা পেলে এতোক্ষণ বাড়ি পৌঁছে যেতো। বাড়ি তো তেঁতুলতলা দিয়েই যেতে হয়। তেঁতুলতলায় বুবু নাই। এতো রাত্রে বুবু ওখানে আসবে কেন? বুবু কৈ? হঠাৎ করে বুবু জ্বলে ওঠে দপ করে। সেই তাপে রমিজের চোখের কোণে বাষ্পের কুঁড়ি শুকিয়ে যায়। জ্বলে ওঠা বুবুর আঁচে বুবুকে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে রমিজ বেশ ধাঁধায় পড়ে, এভাবে কোথায় কবে যেন বুবুকে দ্যাখা গেছে। কবে? কোথায়? বিছানায় উঠে বসে লুঙির ট্যাকে গোঁজা র্যাটমের প্যাকেটটা বার করলো। ওপরের বারান্দা থেকে আলো আসছে, সিঁড়ি ধরে নামতে নামতে আলোর তেজ অনেকটা কম। ঝাপসা আলোতে পোকার ওষুধের প্যাকেটে লেবেল জুড়ে ইঁদুর, আরশোলো, মাকড়সা, মশা, মাছি ও ছারপোকার পাশে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকে অসিমুন্নেসা। এখন অসিমুন্নেসাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে—এমন লালচে কালো চুলের রাশি আর কার হবে? না, এইসব পোকামাকড়ের মধ্যে এতো চুল কেবল বুবুর মাথাতেই আছে। তেঁতুল চুষতে চুষতে এরকম ছুঁচলো ঠোঁট করতে পারে আর কে? কে করতে পারে? — ছবি এলোমেলো হয়ে যায় এবং বুবুর ঠোঁটের এলাকা ফর্সা হতে থাকে। এই ফর্সা রঙ ঠোঁটের আশেপাশে চিবুক, গাল, নাক প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে লিচু খাওয়ার চুকচুক আওয়াজ শোনা যায়। লিচু খাওয়া শেষ হলেই যাতে এই ঠোঁটজোড়া নিশ্চিহ্ন না হয় সেজন্য রমিজ প্রাণপণে ওখানে কোকা-কোলার বোতল ঢুকিয়ে দেয়। কোকা-কোলার বোতল অল্পক্ষণের চুমুকে শেষ হতে না হতে ওখানে লাগে পানির বোতল। সায়েবের মেয়েকে এখানে রেখে বুবুকে ছবি থেকে সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে রমিজ একজোড়া ফর্সা ঠোঁটে লিচু, কোকা-কোলা ও পানির সরবরাহ অব্যাহত রাখে। এজন্য প্যাকেটটা সে ধরেছে তার মুখের একেবারে সামনে। রমিজের নিশ্বাসের শিখায় ঐ নাক, ঠোঁট, চিবুক ও গালে গাঢ় নীল রঙের পড়ে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই ম্লান আলোতেও পরিষ্কার হয়ে যায় যে ঐ মুখ আসলে অসিমুন্নেসার। বিষের থকে তার চেহারা নীল হয়ে আরো কালো দ্যাখাচ্ছে। তা পোকার ওষুধে এতোই যদি হয় তো সায়েবের মেয়ের ঠোঁটজোড়ায় ঐ জিনিস গলিয়ে দিলেই হলো। তারপর দ্যাখো না, তার এই ফর্সা গালে, সোনালি নাকের ডগায়, লিপস্টিক ঘষা ঠোঁটে কী করে গাঢ় নীলের পাকা ছোপ লেখা হয় এবং ঠোঁটের ফাঁক কোনোদিন জোড়া না লাগে। দ্যাখো না, তখন দ্যাখা যাবে আঠারো বছরের ধিঙি মেয়ে টাইট প্যান্ট পরে আর ছেলেদের মতো করে বুকের দুটো বোতাম খুলে টেনিস খেলে কী করে, শরীরের সঙ্গে পাজামা কামিজ সেঁটে কী করে ইউনিভার্সিটি যায়, কী করে বছরের একদিন লালপাড় হলুদ শাড়ি পরে লাল টয়েটো হাঁকিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার রঙ ফলাতে যায় রমনা পার্কে, তখন দ্যাখা যাবে সখের খালি পা কী করে অর্ধেক হেঁটে আর অর্ধেক গাড়ি করে চলে যায় মেডিক্যাল কলেজের ওখানে শহীদ মিনারে, তখন দ্যাখা যাবে শবেবরাতের দিনে ঘোমটা মাথায় কী করে আল্লারসুলের গান করে টেলিভিশনে, ফের পর দিনই পাছা দুলিয়ে তিড়িং বিড়িং নাচে, তখন দ্যাখা যাবে কী করে বাপের গলা জড়িয়ে হাসে, এই কাঁদে, এই সোহাগ করে—সব দ্যাখা যাবে, সব!
সায়েবের মেয়ের এই পরিণতি দেখতে দেখতে রমিজ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে এবং হাতের মুঠোয় কীটনাশকের প্যাকেট নিয়ে সিঁড়ির তলা থেকে এসে দাঁড়ায় সিঁড়ির গোড়ায়। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে তার সময় লাগে ৭ সেকেন্ডেরও কম।
টানা বারান্দায় প্রথম ঘরটার পাশে সায়ের বিসিসায়েবের শোবার ঘর, তারপর ডানদিকে একটি গলি মতো, গলির ভেতর মুখোমুখি কয়েকটা ঘরে দুই ছেলের আলাদা আলাদা পড়ার, বসার ও শোবার ঘর। এদের মধ্যে বড়োটা চলে গেছে এ্যামেরিকা, ছোটোটা আজ সকালে ইনডিয়া গেছে ক্রিকেট খেলা দেখতে। গলিটা ডানদিকে রেখে এগুলে সায়েবের মেয়ের পড়ার ঘর এবং শেষ ঘরটিতে থাকে সায়েবের মেয়ে। ঘরের দরজা ভেজানো, ঠেলতেই খুলে গেলো। ঘরের ভেতর ঢুকতে চোখে পড়ে ব্যালকনিতে আলোর নিচে ডেক চেয়ার, চেয়ারের হাতলে বই। চেয়ারটা খালি। ঘরের ভেতর কেউ নাই। বিছানা ফাঁকা। ছোটো সোফা ফাঁকা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুল ফাঁকা। রমিজ আলি এদিকে দ্যাখে, ওদিক দ্যাখে, তার হাতের বন্ধ মুঠি আরো আঁটো হয়, মেয়েটিকে দ্যাখার সঙ্গে সঙ্গে জাপটে ধরে তার ঠোঁটজোড়া ফাঁক করে ওষুধটা সম্পূর্ণ ঢেলে দিতে হবে। গেলো কোথায়?—চারদিকে ভালো করে খেয়াল করলে লাগোয়া বাথরুমে অবিরাম পানি ঝরার আওয়াজ পাওয়া যায়। শোবার আগে সায়েবের মেয়ে গোসল করছে। —কইরা ল, নাহাইয়া ল মাগী, জীবনের লাহান নাহাইয়া ল।—এই উত্তেজনা তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে রমিজ আলি বেশ বিপদেই পড়ে; সারা শরীর তার কাঁপে। অনেক কষ্টে পাজোড়া দাঁড় করিয়ে রাখা যায়। ডান হাত ঝুলে থাকে পোকা-মারা ওষুধের ভারে, ঐ হাতের তেজে ঠিক থাকে বাম হাত। মুশকিল হয় তোর চোখজোড়া নিয়ে। নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে সে দুটো কেবলি এদিক ওদিক ঘোরে। হাল্কা গোলাপি রঙের দেওয়াল, জানালার গাঢ় লাল পুরু পর্দা, ঘোলা কাচ ও কাঠের পল্লার ওপারে সূক্ষ্ম নেট, এদিকে ড্রেসিং টেবিল, তার ওপর নানান সাইজ ও নানান রঙের শিশিবোতল ও কৌটা, গাঢ় খয়েরি রঙের গদি লাগানো সোফা, কাঠের চেয়ারে ছড়ানো ছবিওয়ালাপত্রিকার খোলা পাতা; তারপর ওয়াড্রোব, বিছানা, বিছানার পাশে টিপয়, টিপয়ের ওপর এলোমোলোভাবে রাখা ছোটোবড়ো টাকার নোট, ঘড়ি এবং বিকালবেলার সেই বেগুনি ফিতায় বাঁধা সোনার মেডেল। টাকা, ঘড়ি এবং সোনার মেডেল। — রমিজ আলির চোখজোড়া এখানে এসে আটকে যায়, তার চোখে এখন কেবল টাকা, ঘড়ি এবং সোনার মেডেল। কপাটখোলা দরজার মতো চোখে এসে লাগে হুহু বাতাস, তার চোখ ফের খচখচ করে। সেগুলোকে সামলাতে রমিজ প্রথমে মেডেল তুলে নিয়ে রেখে দিলো তার বাম হাতের মুঠোয়। মেডেল পেয়ে মাগী মনে হয় জগৎ জয় করে এনেছে।— এবার রমিজের চোখ থেকে সরলরেখা ধরে আলো বেরিয়ে ঘড়ি ও টাকার নোটের ওপর ঠিকরে পড়ে। ওগুলো নেওয়া কি ঠিক হবে?–মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতের দুটো আঙুল খুলে ঘড়ি তুলে নিয়ে সে রেখে দিলো লুঙির ট্যাকে। টাকাগুলো নেবে কি-না সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বাথরুমের দরজা খুলে গেলো।
সায়েবের মেয়ের গুনগুন করা তখনো অব্যাহত ছিলো। রডলাইটের আলোয় তার সদ্য-ধোয়া মুখ ঝকঝক করে, লিপস্টিক ছাড়া ঠোঁটজোড়া ইঁটচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে। তাতে রমিজের কিছু এসে যায় না, এর ভেতর পোকার ওষুধ গুঁজে দিতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সায়েবের মেয়ের পরনে নতুন ধরনের পোশাক, লম্বা আলখেল্লার মতো, পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা। তার এরকম পোশাকের সঙ্গে রমিজ পরিচিত নয়, দিনরাত তো শরীরের যতোটা পারে কাপড়ের বাইরে রাখার সাধনাই করে যাচ্ছে, আর দ্যাখো ঘুমোতে যাবার আগে কীরকম ঢেকেঢুকে এসেছে। এদের খাসলত বোঝা বড়ো দায়। তা এখন অতো বোঝাবুঝির সময় কৈ? দরকারই বা কী? রমিজ এক পা এগোতেই সায়েবের মেয়ে থমকে দাঁড়ায়, ঐ মুহূর্তে সে বসতে যাচ্ছিলো ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে। কয়েক পলক রমিজের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘তুই? কী ব্যাপার?’ রমিজ আর এক পা বাড়াতে সায়েবের মেয়ে ‘আম্মু’ বলে চিৎকার করে ওঠে। ভয়ে কিংবা এতোক্ষণ গুনগুন করে সুর ভাজার ফলে তার গলার জোর ক্ষয় হয়ে গেছে, এই ঘরের বাইরে যাবার মতো ক্ষমতা তার শব্দের নাই। তার বাপ-মা থাকে আরো কয়েক ঘর পরে; তার বাবা কিছুক্ষণ আগে ঘরে ফিরেছে টলতে টলতে, মা শুয়েছে সেডাকসেন-১০ খেয়ে, এ বাড়ির ওষুধপত্র তো রমিজকেই কিনে আনতে হয়। —নাঃ। তবু বিশ্বাস নাই। দেরি করা মানেই ঝুঁকি নেওয়া। মাগীকে ধরে, এক্ষুনি, এই মুহূর্তে ধরে তার পাতলা ও ফ্যাকাসে ফর্সা মুখে পোকার ওষুধ চালান করে দেওয়ার মোক্ষম সময় চলে যাচ্ছে। — এইবার মাগী তরে বাঁচায় ক্যাডা। রমিজের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ। এক হাতে পোকা মারা ওষুধ, অন্য হাতে সোনার মেডেল, রমিজ আলী হরণ করে নিয়েছে তার নাচে কৃতিত্বের সাক্ষীকে।—অহন নাচবার তো দূরের কথা, হাঁটবার নি পারস? মুখের মইদ্যে চাবাইয়া চাবাইয়া চাপা নি মারবার পারস। লুঙির ট্যাকে গুঁজে রাখা সায়েবের মেয়ের হাতঘড়ি। —জিন্দেগিতে টাইম বাইন্দা আর রঙ নি করবার পারস?—কিন্তু ঘড়ি দখল করে নিলেও রমিজের সময় চলে যাচ্ছে। সময় বয়ে যায়। তার মাথায় তেঁতুলগাছের ঝাঁকড়া শরীর, পাটখেতে বিলি কাটতে কাটতে সমূলে উপড়ে ফেলা দাদার হাতে লাগানো কাঁঠালগাছের লুপ্ত ছায়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মৃধাবাড়ির ম্যাট্রিক পাস। মগরেবের আজানে অন্ধকার গাঢ় হয়। বুবু কৈ যাও? ও বুবু! বুবুকে ডাকতে ডাকতে তার গলা কাঠ হয়ে যাচ্ছে, বুবু নাই—জ্যাতাও নাই, মরাও নাই। রমিজের মাথা ভার হয়ে আসছে, আর বসে থাকা যায় না।— না আর না। –সায়েবের মেয়ের ঠোঁটের সুড়ঙ্গ দিয়ে সমস্ত ভার গলিয়ে না দিলে বুবুকে ঠাঁই দেবে কোথায়।
কীটনাশকের প্যাকেট খুলতে খুলতে রমিজ ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলে গলা থেকে অস্পষ্ট হাওয়া বার করে সায়েবের মেয়ে সরে যায় বিছানার দিকে, রমিজ বিছানার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতে সে সরে পড়েছে ওয়াড্রোবের কাছে। তার বড়ো বড়ো চোখের লাল রেখা উপরেখায় বুবুর লালচে চুলের কয়েকটি শিখা দপ করে জ্বলে উঠলেও এক পলকেই নিভে যায়। এই বিভ্রম থেকে রেহাই পেয়ে পোকার ওষুধ মেয়েটির ঠোঁটে গুঁজে দেওয়ার অবিচল লক্ষে রমিজ লাফ দিলে সায়েবের মেয়ে চলে গেলো ব্যালকনিতে। কীটনাশকের প্যাকেট ধরা হাত উঁচু করে রমিজ ব্যালকনিতে ছুটলো। ব্যালকনিতে সে পৌঁছতে না পৌঁছতে সায়েবের মেয়ে ঘরে ঢুকলো, চট করে একটা শর্টকাট মেরে দরজা দিয়ে সটকে বারান্দা ধরে রওয়ানা হলো সায়ের বিবিসায়েবের ঘরের দিকে। এখন তার গলা খোলে, তার চিৎকার এখন স্পষ্ট। তার আর্তস্বরে সাড়া দিয়ে প্রধান এ্যালসেশিয়ানের নেতৃত্বে এই বাড়ির নানা জাতের, নানারঙের, নানা বয়সের ও নানা আকারের কুকুরের ঘেউঘেউ এবং সায়েববিবিসায়েবের, চাকরবাকর, ঝিচাকরানি, ড্রাইভার, বাবুর্চি, দারোয়ান, মালী, বয়বেয়ারার হুংকার, আর্তনাদ, হাহাকার, চ্যাঁচামেচি প্রভৃতি একই তালে ও ভিন্ন ভিন্ন লয়ে গোটা বাড়ি, এমন কি পাড়াটাকে মাত করে তোলে।
বিবিসায়ের ক্ষোভ প্রকাশ করে যে সায়েবের লাই না পেলে বাড়ির চাকরবাকর এরকম বাড়াবাড়ি করার সাহস পায় না। তার মতে রমিজের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তার আফসোস, এই ছোটোলোকের দেশে আইনকানুন বড়ো শিথিল, ২/৪ বছর জেল খেটেই শয়তানটা পার পেয়ে যাবে। তবে বিবিসায়েবের ছোটোমামা না চাচাতো ভাই ও মেজোচাচা না বোনের ভাশুর যথাক্রমে পুলিস ও মিলিটারির বেশ বড়ো বড়ো সায়েব। তাদের দিয়ে থানায় টেলিফান করিয়ে দিলে ওদের নিয়ম মতো হারামির বাচ্চাকে সম্পূর্ণ মেরে ফেলে বস্তায় ভরে, বস্তার সঙ্গে ইট বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা যায়। এতেও অবশ্য তার উপযুক্ত শাস্তি হয় না। কিন্তু উপযুক্ত শাস্তিটা কী সে সম্বন্ধে বিবিসায়ের স্পষ্ট করে কিছু জানে না বলে ব্যাপারটা ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের পদমর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি সম্বন্ধে যথাযথ অবহিত থাকলেও দেশের আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের ওপর সায়েবের আস্থা তেমন মজবুত নয়। আইনকানুন একটু আধটুও থাকলে তার ব্যবসা বাণিজ্য, এতোদিন লাটে উঠতো। পুলিসে খবর দিয়ে লাভ নাই, তাতে বাড়ির স্ক্যান্ডাল। বরং মারধোর যা করা হলো তা খুব সন্তোষজনক না হলেও চলনসই তো বটেই। আগামীকাল কাচের কারখানা থেকে সর্দার গোছের কোনো শ্রমিককে নিয়ে এসে ফাইনাল টাচ দিয়ে ব্যাটাকে চিরকালের জন্য পঙ্গু করে ফেললে ইবলিসটা যে কোনো অপকর্ম করার ক্ষমতা চিরকালের জন্য হারাবে। তাতে সায়েবের সামাজিক দায়িত্ব পালন করা হয়। তবে রাত্রি অনেক হলো বলে কাজটা স্থগিত থাকে। আপাতত গ্যারেজের ভেতর তালা বন্ধ করে রেখে আগামীকাল চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে যে যার ঘরে চলে যায়।
গ্যারেজের ভেতর বাঁদিকে একটা থামের সঙ্গে রমিজের দুই হাত বাঁধা। কুণ্ডলী পাকানো শরীরে সে বসে রয়েছে। লাল টয়েটো গাড়ির পেছনের চাকার মাডগার্ডে তার মাথা ঠেকানো। গ্যারেজে তালা লাগাতে এসে সোনামিয়া রমিজ আলির পাশে বসে। —নাঃ! ছ্যামরাটারে বেশি মাইর দেওয়া হইছে। —হুজুগে পড়ে ও রাগের মাথায় এবং খানিকটা কর্তব্যের টানেও বটে, অন্যান্যদের সঙ্গে সোনামিয়াও বেশ কয়েকটা লাথি মেরেছে। এতোটা না করলেও চলতো। গলার স্বর অনেকটা নরম করার সাধনা চালায় সোনামিয়া, তুই এইটা কী করলি, এ্যা?’ জবাব না পেয়ে ফের বলে, ‘এইটা করলি কী, কতো?’ এরপর জবাব পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে সে বলে, ‘সায়েবরে ভালো কইরা কইলেই ট্যাকা পাইতিস। বুঝাইয়া কইছিলি?’
‘বিয়ানে গেছিলাম তো। বুবুর কথা কইতে দেয় না, কী করুম? হাফিজুদ্দি ভাইজানরে অরা হাবিজাবি কী কইছে, মায়ে কয় তাবিজ করছে। ট্যাকার কথা কইলে সায়েবে আমারে–টানা কোঁকানিতে রমিজের প্রলাপ লুপ্ত হলে সোনামিয়া হাসে, অভিজ্ঞ টাইপের সংক্ষিপ্ত হাসির আভাস। রমিজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে আফসোস করে, তুই যে গেরাইম্যা ঐ গারাইম্যাই রইয়া গেলি। আরে তর বইনের উপরে ক্যাঠায় কৈ কী জুলুম করছে তুই তার বদলা লইবি সায়েবের মাইয়ারে বেইজ্জত কইরা? বইনের মরার খবর পাইলি, আর লগে লগে গেলি এই আকাম করবার?’ তার হাত রমিজের পিঠ বেয়ে নিচে নামতে গেলে কোমরের ওপর লাথি খেয়ে ফুলে ওঠা জায়গায় ঘষা লাগে এবং রমিজ হঠাৎ মাডগার্ড থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। খামের ধাক্কা খেয়ে মাথাটা ফেরত এলে চোখের সামনে অজস্র বুদবুদ দ্যাখা যায়। কোনো বাষ্প তৈরি না করে সেইসব বুদবুদ মিলিয়ে গেলে ঘাড় ঘুরিয়ে সোনামিয়ার দিকে তাকিয়ে রমিজ থুথু ছোড়ে। কাটাছেঁড়া ও ভাঙাচোরা ঠোঁটজিভদাঁত দিয়ে থুথুর দলা এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ে, তেমন আওয়াজও হয় না, রক্তমাখা থুথু মুখ থেকে বেরিয়ে খানিকটা জায়গা ভিজিয়ে দেয়, সোনামিয়ার মুখ কিংবা শরীরের প্রধান বা গৌণ অংশ স্পর্শ করতে তা ব্যর্থ হয়। তবে তার থুথুর স্পিড ছিলো, নইলে গাড়ির মাডগার্ডের এদিকটায় না লেগে ওপারে পড়লো কী করে? রমিজের থুথুর লক্ষ সম্বন্ধে সোনামিয়া অনুমান করতে পেরেছে কি-না বোঝা মুশকিল। তবে এবার চলে যাবার জন্য সে উঠে দাঁড়ায়, ‘তরে কাউলকা সায়েবে যে কী করে আল্লাই মালুম। সায়েবের মাইয়া এমুন ডরাইয়া গেছে, নিজের ঘরে যাইতে পারে না। বিবিসায়েবের লগে শুইয়া রইছে, জ্বরজুর আইছে, মনে লয়।’ সোনামিয়ার এই শেষ তথ্যাটি ফের শোনাবার জন্য রমিজ সামনের দিকে একটু ঝোঁকে। তালা লাগিয়ে বেরিয়ে যাবার পর সোনামিয়ার একটি বাক্য ধ্বনি পায় এবং রমিজ শোনে, ‘সায়েবের মাইয়া কেমুন আঁতকাইয়া উঠতাছে, বিবিসায়েবের লগে শুইয়া রইছে, বিবিসায়েবে কান্দতাছে।’—সোনামিয়া কী বললো? তাহলে সায়েবের মেয়ে কি একেবারে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লো? তার ফ্যাকাসে ফর্সা ঠোঁটজোড়া কি নীল হয়ে গেছে? তার গায়ে রঙ কি এখন কালো? সে শুয়েছে কোথায়? ইঁদুর আর মাকড়সা আর তেলাপোকা আর মশা মাছি ছারপোকার সঙ্গে একই আসনে? তাহলে বুবু? সায়েবের মেয়ে কি বুবুর সঙ্গে শুতে পারে? সায়েবের মাইয়া ভ্যাটকাইয়া শুইয়া থাকলে বুবু তাইলে কৈ?—তাহলে?—বুবু কি ঐ আসন থেকে নেমে গেলো? তার মানে বুবু খালাস পেয়েছে?—চোখ খুললে দিব্যি দ্যাখা যায় সায়েবের মেয়েকে পোকামাকড়ের পাশে ছিটিয়ে রেখে বুবু কেটে পড়েছে। ‘বুবু। অ বুবু!’—বুবু গেলো কোথায়?–বুবু বুবু রে!’–এবার বুবুর সাড়া পাওয়া যায়, ‘ভাত খাইবি?’ হঠাৎ করে ভাত খাওয়ার সম্ভাবনা দ্যাখা যাওয়ায় বুবুর গলায় ভাতের হাঁড়ি বলকাবার আওয়াজ ওঠে, ‘রমিজ, জলদি আয়, মায়ে কতোটি পাত্তা লইয়া বইয়া রইছে।’ কী ব্যাপার? না, মৃধাবাড়ির মেজোবৌ গতরাত্রে ভাত খায়নি, তাদের রান্নাঘরে গামলাভরা পান্তাভাত। নুনমরিচপেঁয়াজ দিয়ে, লেবুপাতা দিয়ে চটকানো পান্তা, ঘন ভাতের মাড়ের মতো পানি।— ‘অ বুবু, মায়ে মাখছে, না রে?’—না, বুবু নিজেই মেখেছে। বুবু তো মাকে দেখে দেখেই শিখেছে। মায়ে কয়, ত্যালমরিচপিঁয়াজ দিলে যা খাইবা তাই মজা হইবো। মায়ে কয়, বড়োলোকের বৌঝিরা বান্দনের কী জানে? মায়ে কয়, অগো সালুন মজা হয় কি রান্দনের গুণে? তয়?—অগো খালি ত্যালমরিচ— পিঁয়াজরসুনের কারবার।–তা বড়োলোকের বাড়ি থেকে সরানো তেল-নুনপেঁয়াজরসুন দিয়ে রাঁধা সুঁটকি দিয়ে মায়ের হাতে মাখানো কড়কড়া ভাত খেতে গিয়ে প্রতি গ্রাসের পর রমিজ বলবেই, ‘কী মজা হইছে রে বুবু, নারে?’—বেশি কথা বললে বিপদ, এক সানকিতে খাচ্ছে, একজন কথা বললেই আরেকজন কয়েক গ্রাস বেশি খেয়ে ফেলে। এই নিয়ে বুবুর সঙ্গে কতো ঝগড়া, কতো মারামারি। মা কিন্তু সবসময় টানে রমিজের দিকে, মাইয়ামানষের অতো লালচ ক্যান রে? সবুর না থাকলে কিয়ের মাইয়ামানুষ?’ বড়ো হতে হতে বুবুর খাওয়ার লালচ কমে গিয়েছিলো। তখন তার অন্যরকম সব সখ। রমিজ ঢাকায় আসার পর থেকে বুবুটা ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে গেলো। কয়েক মাস পর পর বাড়ি গেলে বুবুকে আর চেনা যেতো না। বাড়তে বাড়তে সে কি-না নিউমার্কেট বায়তুল মোকাররম ছুঁতে চায়। আর বিয়ের পর তো গুলিস্তানে সিনেমাই দেখতে চাইলো। সেবার রমিজকে বলে কী, তর দুলাভাইয়ে কইছে, আমারে একবার ঢাকা লইয়া যাইবো; আমারে তুই গুলিস্তান হলে বই দ্যাহাইতে পারবি? টিকিটের দাম যা লাগে তর দুলাভাইয়ে দিবো, তুই আমাগো লগে যাইবি আর টিকিটটা কিন্যা দিবি। গুলিস্তানে বই দ্যাহস নাই? রাজ্জাক ববিতারে দ্যাখছস? হাছাই? জ্যাতা দ্যাখছস? আমারে একবার দ্যাহাইতে পারবি?’ অসিমুন্নেসার দীর্ঘ প্রশ্নমালার জবাবে রমিজ চুপ করে থাকলেও অসিমুন্নেসার উৎসাহ কমে না, মৃধাবাড়ির মেয়েদের কাছে হোক আর হাফিজুদ্দির কাছে হোক কিংবা ম্যাট্রিকপাসের কাছে হোক—সিনেমার কতো লোকজনের নামই না সে শুনেছে। এবার গেলে রমিজ আলি ঠিক বলবে, হ্যাঁ, ববিতা রাজ্জাক শাবানা জসিম —সবাইকে সে দেখেছে, তা একরকম জ্যান্ত দ্যাখাই বলা চলে। দেখলে ক্ষতি কী? সে দেখলে বুবুরও দ্যাখা হয়। গত মাসে যখন বাড়ি যায় কী ঝামেলা চলছিলো, সব তো বুবুকে নিয়েই, কিন্তু হলে কী হবে, বুবুর উতলা উতলা ভাবটা তখনো কাটেনি। রমিজ তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ছে, মা ঘরে ছিলো না, অসিমুন্নেসা বললো, ‘আরেকটা দিন থাকলে কী হয়?’ ‘না রে, যাই গিয়া, সায়েবে আবার চেতবো, একটা ঘাপলা বাধাইয়া বইবো।’—ঢাকাইয়া কথা শুনতে বুবু কী মজাই যে পায়! বলে, ‘তুই এইগুলি কী কথা কস বুঝি না। কোনো কথা বুঝতে না পারার মধ্যে যে এতো সুখ তা বুবু ছাড়া আর কে জানে? সোনামিয়া, মতিন ড্রাইভার— এদের কাছে কতো নতুন নতুন কথা শোনা যায়, এবার বাড়ি গিয়ে ঢাকাইয়া বোল শোনাতে শোনাতে বুবুর কানজোড়া কানায় কানায় ভরে দেবে। বুবুর জন্য আরেকটা কাজ করা দরকার। বিয়ের কয়েক মাস আগে বুবু আবদার করেছিলো, ‘অ রমিজ, ঢাকা থাইকা আমারে একটা শ্যাম্পু আইনা দিতে পারবি?’—এসবের নাম বুবু শিখলো কোত্থেকে? মৃধাবাড়ির বৌঝিরা বুঝি বলে? তা শ্যাম্পু এখন রমিজ পায় কোথায়? শ্যাম্পু খুঁজতে না খুঁজতে গ্যারেজের মাঝখানে সাদা গাড়িটার ছাদে সায়েবের মেয়ের ড্রেসিং টেবিলের একটুখানি সেট হয়ে যায়, সেখানে হাজার রকমের শিশিবোতল, কৌটা, টিউব। ওখান থেকে আন্দাজে মান্দাজে কয়েকটা তুলে নিলেই তো হয়। তবে এর ভেতর শ্যাম্পু কোনটা? শ্যাম্পু সে চেনে কী করে? পাগলের মতো সে শ্যাম্পু খুঁজছে, শ্যাম্পু খুঁজছে তো ঐ চান্সে সায়েবের মেয়ে ঘর থেকে দৌড়ে পালায় ব্যালকনিতে, ব্যালকনি থেকে ঘর হয়ে বারান্দায় গিয়ে চিৎকার শুরু করলে রমিজের ঘাড়ে পিঠে পেটে মুখে জিভে কাটা ও খ্যাতলানো জায়গায় চিনচিন করে ওঠে। তার ওপর সবাই মিলে নুনের ছিটা দিতে শুরু করলে বসে থাকাটা অসহ্য ঠেকে।—মা কী সুন্দর গাঁদাপাতা ছেঁচে লাগিয়ে দেয়—অ মা, অমা-মা গেছে মৃধা বাড়ি, ফিরতে অনেক দেরি মণকে মণ ধান পড়ে রয়েছে উঠানে, আজ সময় কোথায় মায়ের? বুবু গাঁদাপাতা ছেঁচে দিতে পারে না? তার কিছু হলে বুবু কিছুই করতে পারে না, খালি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। তো বুবু একবার তার খ্যাতলানো পায়ে ফুঁ দিয়েছিলো, কবেকার সেই ফুঁ পা থেকে উঠতে উঠতে রমিজের সারা গায়ে শিরশির করে উঠছে, এমন কি চোখজোড়া পর্যন্ত উঠে খচখচ করা চোখের খরা কাটায়। প্রথমে চোখে একটু ধোয়া লাগার মতো হয়েছিলো, তারপর পানি পড়তে শুরু করে। চোখের পানিতে নেমে বুবু ডুব সাঁতার দেয়। বুবুর পাশে কী? —ওগুলো তেলাপোকা না? মশা না? মাছি না? মাকড়সা না? ছারপোকা না? ইঁদুর না?—তার হাত বাঁধা বলে চোখের পানি মোছার জো নাই। তবে কায়দা করে চোখ খোলা রাখলেও কয়েকবার চোখের পাতা পিটপিট করলে বুবুকে রেখে আর সব জীবজন্তুকে চোখ থেকে মুছে ফেলা যায়। তখন বুবু থাকে একা। ঐসব পোকামাকড়ের পাশে রমিজ তো ফেলে রেখে এসেছে সায়েবের মেয়েকে, ঐগুলোর পাশে সে বেটি চিৎপটাং হয়ে শুয়ে রয়েছে। নইলে বুবুকে খালাস করা যায় কী করে? শালার সায়েববিবিসায়ের এখনো বুঝতে পারেনি, বুঝবে, সবই বুঝবে। আরেকদিন কায়দা করে বিবিসায়েবের মুখে পোকার ওষুধ ঢুকিয়ে দেবে, আরেকদিন সায়েবের মুখে, আরেকদিন আরেকদিন। তারপর বোঝো ঠেলা, সোয়াগের বেটির পাশে ভ্যাটকাইয়া থাকো, পোকের লগে কীড়ার লগে ল্যাপ্টালেপ্টি কইরা জিন্দেগি কাটাও। চোখজোড়া রমিজের সটান খোলা। না, চোখ বন্ধ করা চলবে না, একবার চোখ মুনজাইছো কি পোকা আর কীড়ার লগে বুবুরে রাইখা সায়েবের মাইয়া পলাইয়া যাইবো, কৈ পলাইবো আর দিশা পাইবা না।—না, বুবুকে আর পাঠাচ্ছে না। বুবু তেঁতুলতলায় থাক, বাড়ির বাইরে কলাপাতার পর্দার এপারে বসে দাদীর কাছে কাঁঠালতলার জমিতে দাদার পাট ফলাবার গপ্পো শুনুক, মায়ের হাতে চেলাকাঠের বাড়ি খেয়ে উঠানে চুলার পাশে লুটিয়ে পড়ে কাঁদুক, ঢাকা থেকে শ্যাম্পু আনার জন্য রমিজের কাছে মিনতি করুক। বুবুকে দেখতে দেখতে রমিজ বুবুর সঙ্গে মৃধাবাড়ি যায়, মা ডেকে পাঠিয়েছে, এক গামলা পান্তাভাত নুনমরিচপেঁয়াজ দিয়ে লেবুপাতা দিয়ে চটকানো মা এটা করে ওটা করে আর দ্যাখে ওরা এলো কি-না। কতোদিন আগেকার পাত্তার পেঁয়াজমরিচের ঝাঁঝে রমিজের নাক জ্বলে, চোখ জ্বলে, চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করলে সে ফুঁপিয়ে কাঁদে, ‘বুবু, অ বুবু!’ কান্নায় তার গলা বন্ধ হয়ে এলেও সে বুবুকে ডাকে, ‘অ বুবু! আমারে একবার কইলি না ক্যান?’ অনুপস্থিত অসিমুন্নেসার প্রতি এই প্রশ্ন বারবার করেও সে খান্ত দেয় না, আমারে একবার ডাইকা কইলি না ক্যান?’ অসিমুন্নেসা তাকে কী বলবে? বললেই রমিজ কী করতে পারে?–আর কিছু না হোক সায়েবের মেয়েকে পোকামাকড়ের সঙ্গে এক বিছানায় শুইয়ে বুবুকে খালাস করে নিয়ে বয়স উজিয়ে সে সোজা চলে যেতে পারে কোরবান মেম্বারের বাড়ি। তাদের যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো বলে ভাইবোনের কপালে গম জুটেছিলো মোটে দেড় সের। কালো কালো গমে কিসের সাদা গুঁড়ো, বিদ্যাশ কী রকম ঝাঁঝালো গন্ধ, মেম্বার সবাইকে ভরসা দিলো, ‘এইটা কিছু না, থাইকা জাহাজে আইছে, বহুত দিন লাগছে তো, গমে পোক না লাগে তাই ওষুদ দিছে।’ মা ভালো করে ধুয়ে আটা কুটে রুটি করলো, তবু গন্ধ কিন্তু ছিলোই। বুবু একটা রুটিও খেতে পারেনি। তাই নিয়ে মায়ের কতো কথা, ‘মাইয়া মানুষের অতো ফুটানি ভালো না!’ বুবু খালি গজগজ করে, ‘কোরবান মেম্বরের বাপের মুখের মইদ্যে ওষুদ হান্দাইয়া দেওন লাগে তয় ব্যাডায় বোঝে কী খাইলো।’ তা মেম্বরের বাপ না থাকলে কী হয়, রমিজ এবার গিয়ে কোরবান মেম্বারের মুখে পোকার ওষুধ কোরবান মেম্বারের মুখে পোকার ওষুধ ঠিক দিয়ে আসবে। সায়েবের মেয়েকে দিলো না? শালার ওষুদের ঝাঁঝ কী! বুবুর আর দোষ কী? রমিজও এখন ঐ ওষুদ কি আর নিজের মুখে তুলবে?—এতোদিন পর হাওয়ায় হাওয়ায় পোকার ওষুধের তীব্র গন্ধ এই গ্যারেজের ভেতর গলগল করে ঢুকছে ধোঁয়ার মতো। এই ধোঁয়ায় চোখ দিয়ে নতুন ধারায় পানি ঝরতে শুরু করে। রমিজ ডুকরে কাঁদে, ‘বুবু! বুবু রে! বুবু।’ রমিজ কাঁদতেই থাকে, কেবলি কাঁদে 1 কাঁদতে কাদতেই বুবুকে স্পষ্ট চেহারায় দেখতে পায়, অসিমুন্নেসাকে দ্যাখে আর চোখ উজাড় করে কাঁদে। এইভাবে রাত কাবার হয়। কাঁদতে কাঁদতে চোখজোড়া নুনমরিচপেঁয়াজলেবুপাতা চটকানো পান্তাভাত খাওয়া পেটের মতো আরাম হলে নোনতা ও কুসুম গরম পানির ওমে ভোরের দিকে রমিজের চোখ জুড়ে ঘুম নামে।