1 of 3

যাই বল নইপল

নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই নইপল যদি ভেবে থাকেন যা ইচ্ছে তা-ই লিখেই পাঠককে তুষ্ট করতে পারবেন, তবে ভুল। ভারতের বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত যে লেখকরা ইংরেজিতে উপন্যাস লেখেন, তাঁদের লেখা নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই এ দেশে। উপন্যাস পাঠযোগ্য না হলেও ‘আহ্‌ দারুণ দারুণ’ বলার যথেষ্ট লোক এখানে মেলে। কারণ একটিই, ইংরেজি ভাষাটির প্রতি অন্ধ অনুরাগ। যেন ইংরেজিতে কথা বলতে আর লিখতে পারলেই একটা সাংঘাতিক কিছু প্রকাণ্ড কিছু বিরাট কিছু হয়ে গেল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলায় বা অন্য ভারতীয় ভাষায় তুলনায় অনেক লেখকই অনেক ভাল উপন্যাস লেখেন। কিন্তু ইংরেজি নয় বলেই সেই সব লেখকের সেই সব অসাধারণ উপন্যাস ভারতের গণ্ডির বাইরে বেশি কোথাও যায় না বা যেতে পারে না। ভি এস নইপলের ‘ম্যাজিক সিডস’ (পিকাডর) নামের উপন্যাসটি যদি বাংলায় লেখা হত এবং লেখকের নাম যদি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নইপল না হত, কেউ পুঁছতও না। আর, ইংরেজিতে যাঁরা লেখেন, তাঁদের লেখার প্রেক্ষাপট যদি পশ্চিমের বদলে পুব হয়, চরিত্রগুলি যদি খানিকটা অচেনা অচেনা হয়, সংস্কৃতি যদি কিছু এক্সোটিক হয় তবে আর কথাই নেই। পোস্টকলোনিয়াল লিটারেচারের ভীষণ ডিমাণ্ড এখন।

নোবেল পুরস্কারের একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে সুইডেনের স্টকহোল্‌ম শহরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠান হয় ২০০১ সালের শেষ দিকে। গুন্টার গ্রাস, নাদিন গর্ডিমার, সিমুস হিনেয়ের সঙ্গে আমাদের বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নইপলও ছিলেন। তিনিই একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি আফগানিস্তানে আমেরিকার বোমা ফেলার পক্ষে ভয়াবহ সমর্থন জানিয়েছিলেন। নইপল চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত নেওয়ায় বিষম বিশ্বাসী। কোনও সুস্থ মানুষকে এমন ভাবে সন্ত্রাসের পক্ষ নিতে আমি দেখিনি আগে। তিনি তাঁর ‘অ্যামঙ্গ দ্য বিলিভারস: অ্যান ইসলামিক জার্নি’ (১৯৮১) আর ‘বিয়ণ্ড বিলিফ: ইসলামিক এক্সকারসান অ্যামঙ্গ দ্য কনভারটেড পিপলস’ (১৯৯৮) বই দুটোতে ইসলাম সম্পর্কে বালখিল্য সব মন্তব্য করতে দ্বিধা তো করেনইনি, এমনকী এমনও বলেছেন, দেয়ার প্রবাবলি হ্যাজ বিন নো ইম্পিরিয়ালিজম লাইক দ্যাট অব ইসলাম অ্যাণ্ড অ্যারাবস। মধ্যপ্রাচ্যের শিরদাঁড়া গুঁড়িয়ে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা, দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে নির্বিচারে শোষণ চালিয়ে গেছে, তেলের লোভে কামড়ে ধরেছে অন্য দেশের মাটি, যে কোনও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শরীরে আগুন ধরিয়েছে, সেকুলার মুভমেন্টকে নস্যাৎ করেছে, তা এডওয়ার্ড সাইদের চোখে পড়ে, নইপলের চোখে পড়ে না। দুই লেখকের মধ্যে পুরো এক ভুবন তফাত। নাইপল ভাল লেখক হতে পারেন, তাঁর লেখার ধরন আকর্ষক হতে পারে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি খুব গভীরে খুব দূরে যেতে পারে না। তিনি যথেষ্ট যুক্তি না দেখিয়েই কটু মন্তব্যে পারদর্শী। এমনকী ভয়ঙ্কর সব কথা দিব্যি উচ্চারণ করতে পারেন। এই তো সে দিন সেপ্টেম্বরে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বললেন, পৃথিবীর কিছু দেশকে ধ্বংস করে দেওয়া উচিত। সৌদি আরব। ইরান।

উন্নাসিকতা তাঁকে বিবেকবুদ্ধিহীন করে তোলে। যে দেশে গুজরাতের মতো দুর্ঘটনা ঘটে, সে দেশে বেড়াতে এসে তিনি অনায়াসে সংখ্যালঘু মুসলমানের বিরুদ্ধে মন্দ কথা বলতে দ্বিধা করেন না। ইংল্যাণ্ডে, যেখানে বর্ণবাদ, জাতপাত নির্মম ভাবে বিরাজ করছে, বাদামি আর কালো রঙের মানুষদের জীবন নাশ করে দিচ্ছে, সেখানে বসে তিনি সাদা বর্ণবাদীদের মতোই মাল্টিকালচারালিজমের বিরুদ্ধে মন্দ কথা বলেন। ইংল্যাণ্ডে অভিবাসীদের সম্পর্কে নইপলের কথা: ওদের কোনও অধিকার নেই বলার যে আমি এই দেশ চাই, আমি এই দেশের আইন এবং নিরাপত্তা চাই, কিন্তু আমি অামার মতো করে বাঁচতে চাই। গুজরাতি, মাদ্রাজি, বিহারি সংস্কৃতির চর্চা ওখানে চলবে না। যারা বাঙালি, তাদের বাঙালিত্ব বিসর্জন দিয়ে তিনি ইংরেজের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বলছেন। নইপল ভুলে যান পৃথিবীর ইতিহাসই এমন, খাদ্যের খোঁজে জীবিকার খোঁজে উন্নততর জীবনলাভের আশায় মানুষ চিরকালই পরস্পরের সঙ্গে মিলেছে মিশেছে। সংস্কৃতির যে বিবর্তন ঘটেছে, প্রতিনিয়ত ঘটছেই এবং এটিকে যে দাবিয়ে রাখার কোনও উপায় নেই, তা শুধু নির্বোধরাই মানে না। নইপল হয়তো ভুলে যান যে নিজে তিনি ত্রিনিদাদ থেকে ইংলণ্ডে আসা ইমিগ্রান্ট। এত দিনে ইংরেজের চেয়ে বেশি ইংরেজ হয়েছেন, কিন্তু সকলে তা হয় না বা হতে চায় না। নইপলের জেদ দেখে মনে হয়, স্বৈরাচারে বিশ্বাস তাঁর, গণতন্ত্রে নয়। মানুষের ইচ্ছের শরীরে শিকল পরিয়ে দিতে তিনি মোটেও কুণ্ঠিত হন না, দেখে বিস্ময় জাগে। সম্ভবত দাসপ্রথাতেও তাঁর খুব একটা আপত্তি নেই।

কালো আফ্রিকানদের কোনও সংস্কৃতি নেই, বলেছেন নইপল। তাঁর এই অগভীর এবং অশালীন মন্তব্য বড় অশ্লীল শোনায়। কেবল আফ্রিকানদের ক্ষেত্রে নয়, জঙ্গল বা জংলি শব্দটি তিনি পুরো তৃতীয় বিশ্বের জন্য ব্যবহার করেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ক্যারিবিয়ান কবি ডেরেক ওয়ালকট বলেছেন, কালোদের সম্পর্কে নাইপল যে কুৎসিত মন্তব্য করেছেন তা যদি তিনি ইহুদিদের সম্পর্কে করতেন তবে ক’জন লোক তাঁর এই বাকস্বাধীনতা সহ্য করত? নইপলের দীর্ঘ কালের বন্ধু পল থেরো তাঁর বইয়ে নইপল সম্পর্কে লিখেছেন, আমি তাঁর ট্যালেন্টকে খুব অ্যাডমায়ার করতাম, আফটার আ হোয়াইল আই অ্যাডমায়ার্ড নাথিং এলস। ফাইনালি আই বিগ্যান টু ওয়াণ্ডার অ্যাবাউট হিজ ট্যালেন্ট, সিরিয়াসলি টু ওয়াণ্ডার, এবং সন্দেহ শুরু হল যখন তাঁর শেষ বইটি পড়তে গিয়ে পৃষ্ঠা কেবল বাদ দিয়ে গিয়েছি। আগে হলে, মনে করতাম, এ আমার দোষ। নাউ আই নিউ দ্যাট কুড বি মনোম্যানিয়াক ইন প্রিন্ট দ্যাট হি ওয়জ ইন পারসন।

পুঁজিবাদে বিশ্বাসী মানুষ আমি অনেক দেখেছি, কিন্তু নইপলের মতো এত কঠোর পুঁজিবাদী কাউকে দেখিনি। তিনি ইয়োরোপের ওয়েলফেয়ার স্টেটের তীব্র নিন্দা করেছেন। প্রতিটি নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রের বিনা পয়সায় শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদির ব্যবস্থা, বেকার ভাতা, তাঁর বিশ্বাস, মানুষ নয়, দৈত্য তৈরি করছে। নতুন প্রজন্ম হাত পা গুটিয়ে এখন ওই সুবিধে পাওয়ার আশায় বসে থাকবে বলে তিনি মনে করেন। যার টাকা আছে, সে অন্ন বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্যের সুবিধে পাবে, সুখ শান্তি স্বস্তি পাবে, আর যার টাকা নেই, সে কিছুই পাবে না, উদ্বাস্তু উন্মূল হয়ে জীবনযাপন করবে, ভুগে মরবে, পচে মরবে— এই হল আমাদের নোবেল বিজয়ীর বিশাল মস্তিষ্ক থেকে প্রসূত প্রণম্য প্রস্তাব!

প্রায় ৪৩ বছর আগে ছাপা হওয়া নইপলের ‘আ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ বইটির মান এ বছরের ম্যাজিক সিডস-এর চেয়ে উন্নত ছিল। লেখকের লেখার মান যদি দিন দিন ওপরে না উঠে নীচের দিকে নামে, নামতেই থাকে, তবে আশঙ্কা হয় লেখক হিসেবে তাঁর হয়তো দেওয়ার আর কিছু নেই। ম্যাজিক সিডস উপন্যাসটি আত্মপরিচয় এবং আদর্শ নিয়ে, যে দুটো বিষয় জীবনকে গড়ে তোলে বা ধ্বংস করে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র উইলি চন্দ্রনকে আমরা প্রথম দেখি ‘হাফ আ লাইফ’ উপন্যাসে, যেটি বছর তিন আগে প্রকাশ পেয়েছিল। নইপল অবশ্য অস্বীকার করেছেন, হাফ আ লাইফ বইটির সঙ্গে ম্যাজিক সিডস-এর কোনও সম্পর্ক নেই।

উইলির জন্ম ভারতে, তিরিশের দশকে। ভারত থেকে তিনি এক সময় লণ্ডন পাড়ি দেন। ওখানে গল্পের একটি বই বার করেন, আনা নামের এক মেয়েকে বিয়ে করে আফ্রিকায় চলে যান। যৌনজীবনের আকর্ষণই তাঁর কাছে তখন প্রধান ছিল। নিচু জাতের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য তাঁকে নানা ঝুটঝামেলা পোয়াতে হয়। নিজের পরিবেশ আর বাবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া উইলি এখন বউ ছেড়ে আফ্রিকার জীবন ছেড়ে ইয়োরোপে চলে এসেছেন, ম্যাজিক সিডস-এ এসে বার্লিন শহরের রাস্তায় গোলাপ বিক্রি করছেন অস্ত্র কিনবেন বলে। বোন সরোজিনীই উইলিকে উদ্বুদ্ধ করেন ভারতের বিপ্লবী দল কান্দাপল্লীতে ভিড়তে। এ বইতে উইলিকে ইয়োরোপ থেকে ভারতে যেতে দেখি। ভারতের মাওবাদী সন্ত্রাসী দলে যোগ দিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে দেখি। অস্পৃশ্যদের পক্ষে বিপ্লব করতে গিয়ে উইলি নানা রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কয়েক বছর জেলও খাটেন। এবং এক সময় তাঁর মনে হয়, এই বিপ্লব আসলে অর্থহীন। এই বিপ্লব গ্রামের নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য, যাদের জন্য, আমরা বলি যে আমরা লড়াই করছি, সত্যিকার কিছুই করতে পারে না। বইয়ের শেষে এসে তিনি ঘোষণা দিয়ে দেন, ইট ইজ রং টু হ্যাভ অ্যান আইডিয়াল ভিউ অব দ্য ওয়ার্লড। কেন ভুল, কী কারণ, কিছুরই ব্যাখ্যা তিনি দেননি। বিপ্লবে আস্থাহীন উইলি ফিরে যান লণ্ডনে। ওখানেই তিনি জীবনের মানে খুঁজে পান। নইপলের ক্ষুদ্র খাঁচায় বন্দি উইলি, খুব বেশি দূর তিনি যেতে পারেন না। খুব বেশি কিছু ভাবতেও পারেন না। দেখেশুনে যে কারওর মনে হতে পারে সে-ও খাঁচায় বন্দি। থেকে থেকে বইটি বন্ধ করে শ্বাস নিতে হয় মুক্ত হাওয়ার। ম্যাজিক সিডস পুরনো সব দর্শনে ভরপুর। নইপলের বয়স এখন বাহাত্তর, সম্ভবত, বয়স হলে, চার দিক যখন ভেঙে পড়তে থাকে, দর্শনই ভরসা। জেলের দেওয়াললিখন পড়িয়ে তিনি তাঁর উইলিকে শেখান, ট্রুথ অলওয়েজ উইনস, অ্যাঙ্গার ইজ আ ম্যান’স গ্রেটেস্ট এনিমি, টু ডু গুড ইজ দ্য গ্রেটেস্ট রিলিজন, ওয়ার্ক ইজ ওয়রশিপ, নন-ভায়োলেন্স ইজ দ্য গ্রেটেস্ট অব অল রিলিজনস।

বইয়ের দীর্ঘ দীর্ঘ সংলাপ পড়তে পড়তে মনে হয় বুঝি বাচালের রাজ্যে এসে পড়েছি। কী জানি, স্ত্রী নাদিরার বেশি কথা বলার রোগ দেখতে দেখতেই বোধহয় নইপল তাঁর চরিত্রদের বাচাল বানিয়েছেন। তাঁর আগের বইগুলোয় যা আছে, যা পড়ে তাঁকে পাঠক বাহবা দিত, সে সব নেই এই বইয়ে, শ্লেষ নেই, ধারালো ছুরির মতো শব্দ নেই, বাক্য নেই। তাঁর গদ্যে এখন পুনরাবৃত্তি, অতিকথন, তাঁর গদ্য এখন ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর। নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলেই নইপল যদি ভেবে থাকেন যা ইচ্ছে তা-ই লিখেই পাঠককে তুষ্ট করতে পারবেন, তবে ভুল। জীবন নিয়ে এখন যদি তিনি সিরিজের তৃতীয় উপন্যাসটি লেখেন, আমার মনে হয় না পাঠক খুব জানতে আগ্রহী হবে উইলি কেমন আছে, কী করছে। উইলি এমন একটি চরিত্র যে পাঠককে আকর্ষণ করে না, পাঠকের মনে কোনও কৌতূহল জাগায় না। সে সহজেই অনুমান করে নিতে পারে যে সত্তরোর্ধ উইলি এখন লণ্ডনের কাছে কোনও ছোট শহরের কোনও ছোট বাড়িতে বসে ছোট ছোট গল্প উপন্যাস লিখছেন, আর নিজের ছোটখাটো ভারী শরীরটিকে লাঠিতে ভর করিয়ে এনে লনের চেয়ারে বসিয়ে দিচ্ছেন বিকেলে, চা খেতে খেতে প্রায় বোজা চোখে কাউকে দেখছেন তিনি, কথা বলছেন অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের বিপক্ষে, গালাগালি দিচ্ছেন পৃথিবীর সব বিপ্লবকে, ধনী এবং শক্তিমানের গুণগান গাইছেন, সন্ধে নেমে এলে স্ত্রী পাশে এসে বলছেন, উইলি, ঘরে চল, এখন বিশ্রাম না নিলে শরীর খারাপ করবে। উইলি ওঠেন, স্ত্রীকে ক্রাচের মতো ব্যবহার করে তিনি ঘরের দিকে হেঁটে যান।

সৌজন্যে : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ আশ্বিন ১৪১১ রবিবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *