1 of 3

ফিলিস্তিন এক টুকরো মাটির নাম

আমি যদি ইহুদি হতাম, হাজার বছর ধরে যারা বাস করছে একটা জমিতে, তাদের উচ্ছেদ করে, উদ্বাস্তু করে, আমি আমার ঘর বাড়ি, বা আমার শহর বা আমার দেশ সে জমিতে নির্মাণ করতাম না। যদি ইজরাইলি হতাম, আমি বিক্ষোভ করতাম ইজরাইল রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নীল নকশার বিরুদ্ধে। আমি যদি ফিলিস্তিনি হতাম, পেট্রোল বোমা, রকেট, ইট পাটকেল, বোতল, পটকা ছুড়তাম না একটি রাষ্ট্রের দিকে যে রাষ্ট্রের দখলে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির বোমা, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র, যুদ্ধজাহাজ এসব তো আছেই, দক্ষ সেনাবাহিনী. নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী সবকিছুই মজুত, এমনকী পারমানবিক অস্ত্রও হাতের নাগালে, যে রাষ্ট্র যে কোনও প্রতিবেশির বস্তিতে সন্ত্রাস চালাতে, তাদের ঘর বাড়ি ইস্কুল হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিতে দ্বিধা করে না, বোমা ছুড়ে শত শত শিশুকে হত্যা করতে দু’বার ভাবে না। আমি যদি ফিলিস্তিনি মুসলিম হতাম, আমি আত্মঘাতী বোমা হতাম না, হওয়ার ইন্ধন কাউকে জোগাতাম না। আমি হয়তো ফিলিস্তিনেই বাস করতাম না। যখনই ইজরাইলের বিমান হামলা দেখি, কামান দাগানো দেখি, শত শত নিরপরাধ মানুষের মরে যাওয়া দেখি, আমি ঠিক বুঝে পাই না, কী করে মানুষগুলো জীবনের এত ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ওই এক টুকরো মাটি কামড়ে পড়ে আছে। জীবনের চেয়ে তো মাটি বড় নয়। জন্মের ভূমি ছেড়ে, পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া নয়। বাঁচার জন্য চিরকাল মানুষ ভিটে মাটি ছেড়েছে। আমার যদি নিরাপদ কোনও দেশে চলে যাওয়ার উপায় না থাকতো, আমার চোখের সামনে যদি দেখতাম আমার নিরপরাধ মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে , যদি দেখতাম যতবারই আমি ঘর বাড়ি তৈরি করছি ততবারই সব ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, জানিনা কী হতো, আমি না হলেও আমার মতো অবস্থা যাদের হয়েছে, তাদের অনেকেই হয়তো হামাসের মতো সন্ত্রাসী হতো। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ বোধহয় তাই হয়। যখন টিভিতে ভয়ংকর সন্ত্রাসের দৃশ্য দেখি, মৃত্যু আর ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে বসে থাকা সব হারানো মানুষদের দেখি, আমি নিজেকে কল্পনা করি ওদেরই একজন হিসেবে। হামাসের আচরণ তখন আমি বুঝি কতটা রাগ থেকে উঠে আসা। বুঝি যে পিএলও, হামাস, হিজবুল্লাহ এই দলগুলো এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। কিন্তু যুদ্ধ তো এক বিন্দু অ্যান্ট আর বিকট অ্যান্টইটারে হতে পারে না। রাষ্ট্রের বুলডোজার বিদ্রোহী দলের অহংকার গুঁড়ো করে দেয়। হামাস জানে সব। জেনেও তবে নিরপরাধ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু ঠেকাতে আপোস করছে না কেন, কেন ওই রকেট ছোড়া বন্ধ করছে না? আর কত মৃত্যু দেখতে হবে আমাদের, আর কত শিশু হত্যা, আর কত রক্ত, আর কত বীভৎসতা?

জন্মের পর থেকে শুনছি ফিলিস্তিনিদের অত্যাচার করছে ইজরাইল নামের দেশ। কেউ কিছু বললেই তা বিশ্বাস করে ফেলার লোক নই আমি। বড় হয়ে ইজরাইল আর ফিলিস্তিনের ইতিহাস, সন্ত্রাস, জমিজায়গার মাপজোক, আরব রাজনীতি, নানান চুক্তি সব কিছু জেনেছি। এক পক্ষের কথা শুনিনি, দু পক্ষের কথাই মন দিয়ে শুনেছি। ফিলিস্তিনি বাচ্চাদের ধরে ধরে ইহুদিদের ঘৃণা করার জন্য, আত্মঘাতী বোমা হওয়ার জন্য ফিলিস্তিনি বিদ্রোহীরা যে চাপ সৃষ্টি করে, তার নিন্দা করেছি। নিন্দা করেছি দীর্ঘকাল যাবৎ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইজরাইলের চালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাসের। আমার নিন্দায় নিশ্চয়ই কোনওকিছুর পরিবর্তন হবে না। লক্ষ মানুষ নিন্দে করছে তাতেও ওদের কিছু যায় আসে না। সেদিন ইজরাইলের দেওয়ালে লেখা দেখে চমকে উঠলাম, ‘ফিলিস্তিনি আরবদের গ্যাস চেম্বারে পাঠানো উচিত’। নাৎসিরা ইহুদিদের মেরেছে গ্যাস চেম্বারে। পৃথিবীর ইতিহাসে ওর চেয়ে কলংকময় নৃশংসতা আর কিছু নেই। অথচ গ্যাস চেম্বার থেকে বেঁচে এসে ইহুদিরাই যদি অন্যকে গ্যাস চেম্বারে পাঠাতে চায় তবে বাকরুদ্ধ হবো না তো হবো কী! মানবতা জানিনা কোথায় কবে হারিয়ে গেছে। ইহুদিদের যারা অমানুষিক নির্যাতন করেছে, ষাট লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে, সেই নাৎসিদের কাছে ইহুদিরা শিখে এসেছে কী করে বর্বর হতে হয়। বর্বরতা ওরা দেখাচ্ছে তাদের ওপর যাদের ঘর বাড়ি ভেঙে জায়গা জমি দখল করে নিজেদের বসতি স্থাপন করেছে। সব ইহুদি জিওনিস্ট নয়, অনেক ইহুদি আছে যারা জিওনবাদের ঘোর বিরোধী। তারা চায় না হাজার বছর ধরে যেখানে বাস করছে, সেখানকার পাট চুকিয়ে তল্পি তল্পা নিয়ে বহু দূরে কোনও এক জায়গায় যেখানে হাজার বছর ধরে যারা বাস করছে, তাদের জায়গা দখল করে নেবে, কারণ ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে, এই জায়গাটা কোনও এককালে তাদের পূর্ব পুরুষের ছিল। কত শত জাতির পূর্ব পুরুষই না বাস করেছে ওই অঞ্চলে। এক জাতকে উচ্ছেদ করে আরেক জাত দখল করেছে। ক্যানানীয়, মিশরীয়, অ্যাসিরিও,ব্যাবিলনীয়,ম্যাসেডনীয়,রোমান, বাইজাইনটান, ওথমান এলো, দখল করলো, গেলো। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ এলো, এলো জিওনবাদী ইহুদি। সামান্য ওইটুকু মাটিতে মানুষের প্রচুর রক্ত গড়িয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস বড় রক্তক্ষয়ী। কিন্তু এখন তো জানি সভ্য হয়েছি। আদৌ কি সভ্য হয়েছি? ভবিষ্যতের মানুষ হয়তো বলবে, মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠিয়েছি বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কতটা অসভ্য আর বর্বর ছিলাম!

ইজরাইল এখন ভয়ংকর ডাইম বোমা ফেলছে গাজায়। মুখে ডিপ্লেটেড ইউরোনিয়াম লাগানো বোমাও ফেলছে। যে বোমা আমেরিকা ইরাকে ফেলতো। দুটো বোমাই ক্যানসার রোগ ছড়ায়। ইজরাইলি বোমারু বিমান হামলায় এ ক’দিনে দু’শর ওপর ফিলিস্তিনি মারা গেছে আর দু’হাজারের মতো আহত হয়েছে, আর হামাসের রকেটে একজন ইজরাইলির মৃত্যু হয়েছে। এসব দেখতে দেখতে বড় হচ্ছি আমরা। আমরা সম্ভবত ধারণাই করে নিয়েছি ফিলিস্তিনিরা মরতে মরতে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইজরাইলীরা নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাস করতে পারবে আরব ভুখণ্ডে। ছোটবেলায় একটা কথা শুনতাম, জোর যার মুল্লুক তার। ফিলিস্তনের ব্যাপারে এইটে বেশ খাটে। সম্ভবত সব জায়গাতেই এই ঘটনা ঘটে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না। আজকাল গুছিয়ে বুঝিয়ে মিথ্যে বলাটা বেড়েছে। লোকের চোখে ধুলো দেওয়াটা বেড়েছে। যারা জোর দখল করে, তারা আইন মানে না। টাকা আর মারণাস্ত্র থাকলে আইন অবশ্য তাদের না মানলেও চলে।

ইজরাইল আর ফিলিস্তিনকে দুটো রাষ্ট্র করে দাও। ইরাককে ভেঙে টুকরো টুকরো করো। সাদ্দাম হোসেনকে হঠিয়ে তার গুষ্ঠিসুদ্ধ খুন করে, লক্ষ ইরাকীকে মেরে, যা কিছু ইতিহাস ঐতিহ্য তার প্রায় সব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে আমেরিকা ইরাককে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছে। গণতন্ত্রের হাল দেখলে দুঃখে রাগে ফেটে পড়ি। এখন ইরাকে জাতপাত গোষ্ঠী গোত্র নিয়ে খুনোখুনি চলছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো কখনও কি ভালোর জন্য পা দিয়েছে কোনও অঞ্চলে? ধর্মের ডোবায় ডুবিয়ে রেখেছে মুসলিম দেশগুলোকে। একসময়, অবিশ্বাস্য লাগে যে, এসব দেশেই প্রগতিশীল মুক্তচিন্তকরা সমাজতন্ত্র আর সেকুলারিজমের আদর্শ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন প্যান আরব ন্যাশানিস্ট মুভমেন্ট। সেসবের অস্তিত্বও বোধহয় এখন আর নেই। ধর্ম গেড়ে বসলে মুক্তচিন্তা জবাই হয়ে যায়।

আমি যদি ইজরাইলি ইহুদি হতাম বা ফিলিস্তিনি মুসলমান হতাম, আমি ওই মাটি ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যেতাম, এই পৃথিবী তো আমারই পৃথিবী, কোথাও না কোথাও তো জায়গা হতো আমার। মানুষের মধ্যে এত কাড়াকাড়ি, মারামারি, এত রক্তারক্তি, হিংসেহিংসি, খুনোখুনি দেখলে মানুষ হওয়ার লজ্জায় মুখ লুকোই। চিরকালই মানুষ ভালো ভাবে বাঁচার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য জায়গা বদলেছে। না হয় বদলালাম। গ্রীনল্যাণ্ডে এস্কিমোদের সঙ্গে বাস করলাম।

জায়গার জন্য লড়াই করলাম, আত্মঘাতী বোমা হয়ে দুটো লোককে মেরে ফেললাম, বা বোমা ফেলে নগর ধ্বংস করে দিলাম, প্রতিবেশিদের পিঁপড়ের মতো পিষে ফেললাম —-মানুষের ইতিহাস এ নিয়ে গৌরব করবে না। গৌরব করবে যদি আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভেদ বৈষম্য ভুলে পাশাপাশি বাস করি, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, উদারতা আমাদের যদি মানুষ হিসেবে আরও বড় করে, আমাদের ভিন্নতাগুলো যদি আমাদের দলিত না করে, বরং আমাদের সমৃদ্ধ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *