মেসোপটেমিয়ার মহাকাব্য গিলগামেশ

মেসোপটেমিয়ার মহাকাব্য গিল্‌গামেশ্‌

হোমারের দুটি মহাকাব্যের প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এক অনামিক রচয়িতার রচনা পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য, গিল্‌গামেশ্। মেসোপটেমিয়ার উরুক শহরে এটি রচিত বলেই মনে হয়। এক দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনি, সঙ্গে নৈতিকতা ও এক গভীর বিষাদেরও কাহিনি এতে সম্পৃক্ত। আসিরিয়ার রাজা অসূরবনিপালের ছিল সংগ্রহ ও সংকলনের নেশা, সুবৃহৎ সেই সংকলিত গ্রন্থাগারের ভাণ্ডারের মধ্যে ছিল পৃথিবীর এই প্রথম মহাকাব্য, গিল্‌গামেশ্। সংকলনের অল্প পরেই এই অজ্ঞাত কবির মহাকাব্যটি এমনকী এর নায়কের নামও লুপ্ত হয়ে যায়। মাত্র উনিশ শতকে বেশ কয়েকজন মনীষীর ঐকান্তিক চেষ্টায় এই মহাকাব্যটি খণ্ড খণ্ড ভাবে সংগৃহীত হয়। উদ্ধারকর্তাদের প্রথম ও প্রধান নাম ক্যামবেল টমসন; ১৯২৮ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে তিনি এর খণ্ডগুলি সংগ্রহ করেন ও অনুবাদও করেন। আরও আধুনিককালে পেনসিলভ্যানিয়ার অধ্যাপক স্যামুয়েল ক্রেমার এটির অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তাঁর গবেষণায় মহাকাব্যটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের রচনা বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি অস্টিন লেয়ার্ড এক বন্ধুর সঙ্গে সিংহলে গিয়েছিলেন, অন্য কাজে। বিলম্ব হওয়ার ফলে সিংহলের কথা ওঁরা ভুলেই যান ও বছর কয়েক পর ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এনে পৌঁছে দেন বহু আসিরিয় ভাস্কর্যের নিদর্শন ও অজস্র পাথরের টালির ওপর লেখা এক কাহিনি। বর্তমানে এগুলির সংখ্যা পঁচিশ হাজারেরও বেশি। পাথরের ওপর ধাতুর কলমে কৌণিক কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা। ওই অঞ্চলে মহাকাব্যটি লুপ্ত হলেও অন্যত্র এর উল্লেখ ও ছোটখাটো উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায়, এটি অন্তত মৌখিক ভাবে, কাছাকাছি জনগোষ্ঠীগুলোতে চালু ছিল এবং এর মধ্যে এশীয় প্রভাব ছিল যথেষ্টই

মেসোপটেমিয়ার প্রথম সাক্ষর জাতি ছিল সুমেরীয়রা। গিল্‌গামেশ্ উরুকের মহা প্লাবনের পরবর্তী পঞ্চম রাজা বলে উল্লিখিত। এঁর মৃত্যুর পর নানা কারণে এঁর জীবন ক্রমে ক্রমে মহাকাব্যের বিষয়বস্তু হয়ে উঠল। ঘটনাবহুল সুদীর্ঘ এই জীবনকাহিনি সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গিলগামেশ্ কাহিনি অবলম্বনে মোট পাঁচটি রচনা পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে ‘গিলগামেশের মৃত্যু’ শুধু সুমেরীয় ভাষাতেই পাওয়া যায় এবং এটি মহাকাব্য গিল্‌গামেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।

কাহিনিটি লিপিবদ্ধ হয় অসংখ্য পাথরের টালিতে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি নিনেভেতে প্রত্নখননে এগুলির আবিষ্কার ও উদ্ধার হয় এবং পরে রলিনসন বাগদানে এটির লিপি পাঠ করেন। স্মিথ পাঠোদ্ধার করছিলেন, করতে করতেই আলোপ্পোর কাছে রোগে ও অনাহারে তাঁর মৃত্যু হয়। এ সব সত্ত্বেও ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার পাথরের চতুষ্কোণ খণ্ড আবিষ্কার হয়েছিল, যেগুলি পেনসিলভ্যানিয়া ও ইস্তাম্বুলে দান করে দেওয়া হয়। এই সুবৃহৎ মহাকাব্যের হাজার হাজার শিলাখণ্ডের মধ্যে বেশ কয়েকটি একটি জাহাজডুবিতে ডুবে যায়; সেগুলি আর পাওয়া যায়নি। তবু বাকিগুলি নিয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য যে পাওয়া যায়, এটা সৌভাগ্যের কথা।

সত্যমিথ্যা জানাবার সুযোগ নেই, কিন্তু উরুকের কোনও রাজার নাম যে গিলগামেশ্ ছিল, এ সত্য মহাকাব্যের। পরবর্তী সাহিত্যে গিলগামেশ্ পাতালের বিচারপতি, মহাকাব্যে তাঁর মা এক দেবী, যাঁর কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন আশ্চর্য সৌন্দর্য, শক্তি এবং চঞ্চলতা। মানুষ পিতার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন মরণশীলতা। মা তাঁর জীবনে অপেক্ষাকৃত গৌণ চরিত্র, কখনও সখনও তাঁর সঙ্গে গিল্‌গামেশের সাক্ষাৎ ও আলোচনা হত, এই পর্যন্ত। পিতা কোনও মর্ত মানুষই হবেন, কিন্তু মাঝে মাঝে মানসিক সংকটে তিনি ‘লুন্ডব্লান্ডা’-কে পিতৃরূপে, অথবা পিতৃস্থানীয়রূপে ডাকেন। এই গিগামেশ্ দুই তৃতীয়াংশ দেবতা, এক তৃতীয়াংশ মানুষ। সে ঘুরে বেড়াত জন্তুদের মধ্যে, অত্যন্ত উদ্ধত বেপরোয়া ভাবে। কিন্তু তার হৃদয়ের আর্তি ছিল একটি মানুষ বন্ধু পাওয়ার জন্যে, একটি ভাইয়ের মতো বন্ধুর জন্যে। এ জন্যে সে দেবতাদের অনুনয় করত। দেবতারা তার প্রার্থনা পূর্ণ করলেন, এনকিডুকে সৃষ্টি করলেন, গিলগামেশের সোদরোপম বন্ধু হিসাবে। এই এনকিডু স্বাস্থ্যবান, বীর এবং স্থির। দেবী ইশতার তাকে পাওয়ার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠলেন এবং এনকিডু তাঁর কামনা চরিতার্থ করলেন। এক সপ্তাহ তাঁরা উন্মাদনায় কাটানোর পর এনকিডু তাঁকে ত্যাগ করে এলেন। ফিরে যখন এলেন, তাঁর জীবজন্তু বন্ধুরা তাঁকে পরিহার করতে লাগল, তখন তিনি গিগামেশের কাছে এলেন। গিলগামেশ্ অত্যন্ত সমাদরে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। দুই বন্ধুতে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাতেন। পরম আনন্দে।

অনেক দেবতা গিল্‌গামেশের আশ্চর্য শৌর্য ও শক্তির জন্য তাঁকে ঈর্ষা করতেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে তাঁর শান্তিক্ষয়ের জন্য কৌশলে তাঁকে এক গণিকার কাছে পাঠালেন। কিন্তু গিল্‌গামেশের যৌন উগ্রতা এত প্রবল ছিল যে কুমারী, সধবা ও বিধবার আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। এ আর্তনাদ যখন দেবতাদের কানে উঠল তখন তাঁরাও বিচলিত হলেন। এ দিকে এনকিছু গিল্‌গামেশের সান্নিধ্য হারিয়ে খুবই বিমর্ষ বোধ করলেন। একা একা বনে বনে ঘুরে ঘুরে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। এনকিডু কেঁদে কেঁদে শীর্ণ হয়ে যেতে লাগলেন এবং দেবতাদের ওপর দোষারোপ করতে লাগলেন, লঘুপাপে গুরুদণ্ডের জন্যে। ক্রমে ক্রমে শীর্ণ হতে হতে একদিন তাঁর মৃত্যু হল। গিল্‌গামেশ্ বন্ধুর উদ্দেশ্যে উচ্চৈস্বরে বিলাপ করতে লাগলেন। দিনের পর দিন যেতে যেতে মৃতদেহের শরীরে যখন কীট দেখা গেল তখন তিনি একটি রাজকীয় অন্ত্যেষ্টির আয়োজন করলেন। তারই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হল এক উৎসব। তারপর গিল্‌গামেশ্ এনকিডুর দেহ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। দেহটি অলংকারে মুড়ে দিলেন এবং সমাধির অভ্যন্তরে নামিয়ে দিলেন।

এই বার শুরু হল গিল্‌গামেশের অশান্ত বিলাপ, যা কোনও প্রবোধই মানল না। তিনি নিরন্তর কেঁদেই চললেন। দিনের পর দিন উচ্চৈস্বরে আর্ত বিলাপ করার পরে গিগামেশ্ সিদ্ধান্ত নিলেন, মৃত্যুকে জয় করতে হবে, এবং অনন্ত জীবন লাভ করতে হবে। একজনই অমরত্বের অধিপতি, তাঁর কাছে গিয়ে অমৃত ছিনিয়ে আনতে হবে। এর জন্যে প্রথম কাজই হল যে, এর উপায় বিধান করতে পারে, তেমন লোকের সন্ধান করে তার নির্দেশ মতো চলে অমরত্ব লাভ করা। এনকিডুর মৃত্যুতে তিনি জানলেন তাঁকেও একদিন এ ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে এবং শেষ পরিণতি সমাধিতেই। এইটে কোনও মতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বলে মৃত্যুকে জয় করার এই প্রয়াস। গিল্‌গামেশ্ শক্তিমান এবং স্বেচ্ছাচারী ছিলেন বলে দেবতারা তাঁকে শাস্তি দিলেন। এনকিডুর মৃত্যু সেই শাস্তি। গিল্‌গামেশের কাছে এনকিছু ছাড়া জীবন দুর্বহ। তাই তিনি যে-কোনও মূল্যে বন্ধুর শেষ পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করে মৃত্যুকে জয় করে দেবতাদের মতোই অমর হবেন— এই সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তার জন্যে যে-কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু এনকিডুর মৃত্যুর পরে গিল্‌গামেশের নিঃসঙ্গতার নীরব আর্তনাদ বুকে চাপা রইল। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ‘উতনাপিতিম্’– যাকে লোকে ‘দূরের মানুষ’ বলে, তাঁর কাছে যাওয়ার। সেই দিকে যেতে যেতে তাঁর দেখা হল অর্ধ-দেবী সিদুরির সঙ্গে, যিনি সুরা নির্মাণ করতেন। সিদুরি গিলগামেশেকে পথের নির্দেশ দেবেন। সিদুরির কাছে গিল্‌গামেশ্ নিজের শৌর্য নিয়ে বড়াই করলেন, বললেন বনের সব সিংহ তিনি মেরেছেন এবং হুম্বাবা’ নামের যুদ্ধে হারিয়ে হত্যা করেছেন। কিন্তু সিদুরি তাঁকে স্পষ্টই বলে দিলেন যে, তাঁর অমৃত অন্বেষণে ব্যর্থ হতে বাধ্য কারণ, দেবতারা অমৃতকে নিজেদের জন্যেই সংরক্ষণ করেছেন, অতএব গিল্‌গামেশের উচিত ভোগবিলাসের জীবন বেছে নেওয়া। কিন্তু গিল্‌গামেশ্ তাঁর সংকল্পে অটল। তিনি সিদুরিকে রাজি করালেন পথের নদীটি পেরোবার জন্যে একজন মাঝির সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিতে। শেষ পর্যন্ত সিদুরি সেই নাবিকের সঙ্গে গিল্‌গামেশ্রে পরিচয় করিয়ে দিলেন যে, সেই পথের সবই জানে। এই নাবিকের নাম উসানাবি। আলাপের পর উসানাবি গিলগামেশকে বলে যে, আগে পথে পড়বে একটি বৃহৎ অরণ্য— যেমন জটিল তেমনই দুর্ভেদ্য— সেটি পার হলে পর সেই প্রায় দুষ্পার নদীটি আসবে। গিল্‌গামেশ্ তাতেই রাজি হলেন।

এ অরণ্য যথার্থই দুষ্প্রবেশ্য, গাছগুলি গায়ে গায়ে লাগা, চারিদিকে সূচিভেদ্য অন্ধকার, চালার পথ পাওয়া দুঃসাধ্য। গাছগুলি খুবই মোটামোটা এবং লম্বা, নানা লতায় জড়ানো। গিগামেশ্ তলোয়ার দিয়ে লতা কেটে কেটে পথ তৈরি করে অতি কষ্টে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন। দীর্ঘকাল এ ভাবে অতি কষ্টে চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত এক সময়ে তিনি এসে পৌঁছোলেন সেই দিগন্তবিস্তৃত নদীর ধারে। নৌকাতে বসে উসানাবি। কিছু না বুঝেই গিগামেশ্ নৌকার ভেতর থেকে বড় বড় পাথরের খণ্ডগুলিকে জলে ফেলে দিলেন; অথচ এই পাথরগুলিই নৌকাটিকে স্থির ধরে রেখেছিল, অতএব গিল্‌গামেশের হঠকারিতায় বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। কাজেই আবার অনেক পরিশ্রমে অনেক কষ্টে বড় বড় গাছের গুঁড়ি কেটে আনলেন তিনি, এবং সেগুলি দিয়েই নৌকাটিকে অনেক কষ্টে আটকানো হল। এই বার দুজনে সমস্ত শক্তি একত্র করে বহু কষ্টে নৌকাটিকে নদীর জলে নামালেন।

এ নদী দেখলে মনে হয়, নদী নয়, এ যেন সমুদ্র। কোনও দিকে কূল দেখা যায় না। তাই দুজনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ওই বিপুল অকূল নদীর ওপরে নৌকো বেয়ে চলেছেন তাঁরা। দিনের পর দিন কেটে গেল, রাতের পর রাত, সপ্তাহের পর সপ্তাহ; অবশেষে, একসময়ে তাঁরা সেই তীরে এসে পৌঁছোলেন যেখানে সেই বিখ্যাত ‘উতনাপিতিম’-এর বাস। সেই বন্দরে পৌঁছে তাঁরা নৌকো আটকে মাটিতে নামলেন।

এই বন্দর, যার নাম দিলমুন, গিল্‌গামেশের কাছে প্রগাঢ় তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তাঁর যে বাসনা, অমরত্ব লাভ, তা সম্ভব হবে এইখানে, উতনাপিতিম তাঁকে সেই অমোঘ নির্দেশ দেবেন, যে পথে তিনি অমৃতত্ব লাভ করবেন। উতনাপিতিম এক অতি বৃদ্ধ পিতামহের মতো এক জায়গায় বসে ছিলেন। উসানাবি গিল্‌গামেশকে উপনাপিতিম-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। উতনাপিতিম গিলগামেশকে জিজ্ঞাসা করলেন সে অত বিমর্ষ কেন। তখন গিগামেশ্ তাঁকে বন্ধু এনকিছুর জীবন ও মৃত্যুর কথা বলেন এবং বলেন মৃত্যুর ওই রূপ তাঁকে এত বিমর্ষ করেছে যে তিনি মৃত্যুকে জয় করে অমর হতে চান। এর জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলটি একমাত্র উতনাপিতিম-এরই জানা আছে, তাই বহু পথ অতিক্রম করে অরণ্য, বহু কষ্টে সমুদ্র পার হয়ে তাঁরই শরণাগত হয়েছেন, যাতে তিনি তাঁকে মৃত্যু জয় করে অমর হওয়ার কৌশলটি শিখিয়ে দেন। এ কথা শুনে উতনাপিতিম তাঁকে বলেন অমরত্বে একমাত্র দেবতাদেরই অধিকার, কোনও মর্ত মানুষ তা পেতে পারে না। তাই গিল্‌গামেশের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং সে জন্যে এখন তাঁর উচিত ভোগবিলাস ঐশ্বর্য স্ফূর্তির মধ্যে জীবনকে যতটা সম্ভব উপভোগ করা, অমরত্বের ব্যর্থ সাধনায় লিপ্ত না হওয়া, কারণ তাতে কোনও সিদ্ধি নেই।

কিন্তু গিল্‌গামেশ্ নাছোড়বান্দা, অমরত্বের সন্ধান তাঁর চাই-ই। অবশেষে উতনাপিতম্ তাঁকে একটা নদীর নির্দেশ দিলেন, উসানাবি তাঁকে সেখানে নিয়ে যাবেন। সেখানে স্নান করে নদীর তটে জলের মধ্যে একটা ছোট গাছের পল্লব আছে। সেইটি তুলে খেয়ে ফেললে তিনি অমর হতে পারবেন। গভীর উল্লাসে গিল্‌গামেশ্ উসানাবির সাহায্যে সেই নদীতটে এলেন। পুরোনো কাপড় ছেড়ে স্নান করে জলের মধ্যে গাছটি দেখতে পেলেন এবং তার পল্লবটি ভেঙে নিয়ে তটে রাখলেন, স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে সেটি খাবেন বলে। স্নান করে উঠতেই দেখতে পেলেন একটি সাপ জল থেকে উঠে এসে পল্লবটি খেয়ে ফেলল এবং সঙ্গে সঙ্গে নির্মোক ছেড়ে নবীন উজ্জ্বল দেহ পরিগ্রহ করল। অর্থাৎ ওই পল্লবটি সত্যিই নবজীবন দিতে পারে, উতনাপিতিম তাঁকে ঠকাননি। আবার ওই সাপের উপস্থিতি ও পল্লবটি আত্মসাৎ করে নবজীবন লাভ করার মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা প্রতারণাও তো ছিল। শোকে উন্মাদ গিল্‌গামেশ্ একেবারে হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে নৌকায় ফিরে এলেন। একটু স্তব্ধতার পরে, তাঁর সারাজীবনের সাধনার ব্যর্থতা অনুভব করে মর্মন্তুদ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উসানাবিকে বললেন, উরুক নগরে নিয়ে চলো’।

আবার সেই সুদীর্ঘ নদীপথে যাত্রা। সামনে আর কোনও আশা নেই, লক্ষ্য নেই, পেছনে রয়ে গেল সারাজীবনের সাধনা, দুঃসহ যন্ত্রণা, আশা ও গভীর আশাভঙ্গ। এ যাত্রা পরাজিতের লক্ষ্যহীনের। আর কোনও কিছুই তার চাইবার নেই, আর কিছু পাওয়ার নেই। সুদীর্ঘ পথ যান্ত্রিক ভাবে অতিক্রম করতে হবে, সম্পূর্ণ নিরুদ্দিষ্ট যাত্রায় এমনকী এক বিপুল যাত্রাভঙ্গের বেদনা নিয়ে।

উর্সানাবির সঙ্গে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করলেন গিল্‌গামেশ্। এনকিডুর মৃত্যুর পর থেকে, মৃত্যুর শেষ কুৎসিত চেহারা দেখবার পর থেকে গিলগামেশকে পেয়ে বসেছিল এক অন্ধ সাধনা। সে সাধনায় ব্যয় করেছেন দীর্ঘ সময়, প্রায় অভুক্ত এবং পুরোপুরি বিনিদ্র থেকে। শরীরে নানা ধরনের কষ্ট সহ্য করে, এই শরীরটাকেই মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অমর করবার উদ্দেশ্যে। এখন সেই শীর্ণ বিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত শরীরটা এবং পরাহত মনটাকে নিয়ে ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু করলেন উরুকের দিকে।

উরুক তাঁর নিজের দেশ। এই শহর তাঁর নিজের রাজধানী। সেখানে ফিরে তিনি উর্সানাবিকে বললেন প্রাচীরের ওপর উঠে শহরটার সমৃদ্ধি ভাল করে দেখতে। দেখে মুগ্ধ, অভিভূত হল উসানাবি। এই উরুক, এখানকার রাজা হয়েও এত দুঃসহ কষ্ট সহ্য করে উতনাপিতিম-এর কাছে যাওয়া, সেখান থেকে নদীতীরে গিয়ে অমরত্ব পদ্মপল্লব তুলে নদীতটে রেখে স্নান, স্নানান্তে দেবতাদের নীরব অট্টহাস্যের মতো সেই মর্মান্তিক প্রতারণা। মানুষের অমৃত চুরি করল সাপ, নির্মোক ত্যাগ করে বারে বারে নবজীবন লাভ করবে সে, আর এত সাধনা, এত কৃচ্ছ্রসাধনের পর অমরত্ব নাগালের মধ্যে এসেও হারিয়ে গেল, মানুষ তাকে হাতে পেল না।

উরুকে এসে গিল্‌গামেশ্ রাজত্ব করতে লাগলেন, প্রবল বিক্রমে। ধীরে ধীরে যৌবন অস্তমিত হল, প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধক্যে পৌঁছোলেন। ইতিমধ্যে তাঁর প্রজাদের জন্য তিনি অনেক উপকার করেছেন, পার্শ্ববর্তী রাজ্য জয় করেছেন, সমৃদ্ধি বাড়িয়েছেন নিজের রাজ্যের। চারিদিকের লোকের মুখেই তাঁর প্রশংসা।

অবশেষে এনকিছুর মতো তিনিও শীর্ণ হলেন, মৃত্যুশয্যায় আরোহণ করলেন এবং যে চক্ষু দুটি অমরত্বের স্বপ্ন দেখেছিল সারাজীবন, সেই দুটি চোখই নীরবে মৃত্যুতে মুদিত হয়ে এল। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রজারা বেশ কয়েকদিন মরণোৎসব পালন করল এবং এনকিছুর মতোই যখন মৃতদেহে কীট জন্মাল তখন তারা তাঁকে স্নান করিয়ে বহুমূল্য বসনভূষণে সাজিয়ে সমাধিস্থ করল সসম্মানে ও সগৌরবে।

গিগামেশের কাহিনি অমরত্ব অনুসন্ধানের, তাঁর কাহিনিই এ বিষয়ে প্রথম। এবং তাঁর যাত্রাপথে বারবার তাঁকে শুনতে হয়েছে, মানুষের নির্দিষ্ট ভাগ্য মৃত্যু, অমরত্বে দেবতার অধিকার, তাঁরা তা কখনওই মানুষকে দেবেন না, মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন না। মানুষ এটা মানতে চায় না, তাই যুগে যুগে নানা প্রক্রিয়ায় যোগ সাধনা, তন্ত্রমন্ত্র, যাগযজ্ঞ দিয়ে অমরত্বের সাধনা করেই চলেছে। পাবে না জেনেও এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও তীব্ৰ সাধনা। যেমন করুণ, তেমনই নিষ্ফল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *