গীতগোবিন্দ কাব্য

গীতগোবিন্দ কাব্য

ভারতবর্ষে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য গীতগোবিন্দ। উড়িষ্যার বিভিন্ন মন্দিরে ওডিশি নৃত্যে ও সুরে গীতগোবিন্দ-গান উপাসনারই একটি অঙ্গ। এতে দর্শকশ্রোতার মনে যে সাড়া জাগে তাতে নানা আবেগের মিশ্রণ; এতে প্রবাহিত একটি অন্তঃসলিলা ভক্তিরস। তা ছাড়া অধিকাংশ গানে পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ, ইত্যাদি শৃঙ্গাররসের নানা বিভঙ্গ সন্নিহিত থাকে। শ্রোতা বা দর্শক জানে কৃষ্ণভক্তিই মুখ্য উপপাদ্য, কিন্তু শৃঙ্গাররসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে বিজড়িত সে ভক্তি।

জয়দেব ছিলেন বীরভূমের অজয় নদীর তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামে ভোজদেব ও বামাদেবীর পুত্র, সময়টা গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণসেনের কিছু পূর্বে। বাল্যে জয়দেবের মধ্যে বৈরাগ্যলক্ষণ প্রবল ছিল; তার পরে ধীরে ধীরে লক্ষ্মণসেনের সভায় তাঁর প্রতিষ্ঠা লাভ। তার কিছু দিন পরে সুন্দরী তরুণী পদ্মাবতীকে বিবাহ ও গৃহে দুজনে মিলে রাধামাধবের প্রতিষ্ঠা। জয়দেবের যশ তাঁর গীতগোবিন্দ-তেই প্রতিষ্ঠিত।

আকারে ছোট এ গ্রন্থটি দ্বাদশ সর্গে বিভক্ত, প্রত্যেক সর্গের প্রথমে একটি কবিতা (শ্লোক), এটি কখনও স্বরে পাঠ করা হত, কখনও বা সুরে গাওয়া হত। তার পরে পরপর গানের শ্রেণি। প্রত্যেক সর্গে কৃষ্ণের এক একটি রূপ বা অভিব্যক্তি :

১. সামোদদামোদর ২. অক্লেশকেশব ৩. মুগ্ধমধুসূদন ৪. স্নিগ্ধমধুসূদন ৫. সাকাঙ্ক্ষপুণ্ডরীকাক্ষ ৬. ধৃষ্টবৈকুণ্ঠ ৭. নাগরনারায়ণ ৮. বিলক্ষলক্ষ্মীপতি ৯. মুগ্ধমুকুন্দ ১০. মুগ্ধমাধব ১১. সানন্দগোবিন্দ ১২. সুপ্রীতপীতাম্বর

সর্গের নামগুলি থেকে বোঝা যায় এ বইয়ে নায়ক কৃষ্ণেরই প্রাধান্য, বিভিন্ন সর্গে তাঁরই বিভিন্ন মেজাজ ঘিরে নাম, শ্লোকগুলি ওই ভাবেই গ্রথিত। তবে রাধার ভূমিকা কী? পড়তে গেলে দেখা যায় রাধা খুবই প্রধান চরিত্র, এ কাব্যের খুব বড় একটা অংশ জুড়ে রাধারই কথা, তাঁর প্রেমের নানা অবস্থা— পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ এ গ্রন্থের মুখ্য উপপাদ্য। গানে ধ্রুবপদ প্রায়ই ঘুরে ঘুরে আসে। নাচে ওড়িশি ভঙ্গিরই প্রাধান্য। এই যে সব আঙ্গিকে শৃঙ্গাররস ও ভক্তির আবেশ মিশে রয়েছে তার পশ্চাতে আছে আনুমানিক কয়েকশো বছরের যাত্রা, গান ও নাচের পৃথক ও সম্মিলিত ভাবে মন্দিরে অনুষ্ঠিত শিল্পরূপের সুদীর্ঘ ইতিহাস। এতে যেহেতু নৃত্যগীতেরই প্রাধান্য ছিল তাই শব্দ ও অর্থ কিছুটা গৌণ।

কিন্তু যেহেতু গীতগোবিন্দ কাব্যও বটে তাই শব্দার্থকে উপেক্ষা করা যায় না; এবং এখানেই একটি সমস্যা দেখা দেয়। বিশুদ্ধ কবিতা হিসাবে বিচার করলে এটি নৃত্যগীতের অনুষঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়; তবুও এটি জনপ্রিয়, কারণ যারা এটা শুধু পড়ে তারাও এর মাধুর্যে মুগ্ধ। কী সেই মাধুর্য? এ মাধুর্য মুখ্যতই শ্রুতিগ্রাহ্য। এতে সুপ্রচুর অনুপ্রাস, কিছু যমক, প্রচুর অন্ত্যমিল এবং তালের স্পষ্ট প্রাধান্য। মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতকাব্যের মুখ্য ধারায় অন্ত্যমিল নেই, অনুপ্রাস পরিমিত এবং কিছু স্তোত্রসাহিত্য ছাড়া অন্যত্র তাল অনুপস্থিত। এই যে নতুন লক্ষণ, এর কারণ তখন অপভ্রংশ সাহিত্য সৃষ্ট হচ্ছে, ভারতীয় ভাষার মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় যুগের শেষে ভারতবর্ষের প্রাদেশিক ভাষার নব্যযুগে কথ্য ও লিখিত ভাষাও সাহিত্যে সৃষ্ট হচ্ছে, যেমন বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া, গুজরাতি, ইত্যাদি। এদের কয়েকটিতেই অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা দেখা দিচ্ছে। সমগ্র গীতগোবিন্দে সমাসবদ্ধ পদের প্রাচুর্য; সংস্কৃত কবিতার মূলধারায় এগুলো অনুপস্থিত এবং গদ্যেও সপ্তম শতাব্দীর আগে নেই; কবিতার পক্ষে এগুলো স্পষ্টতই ক্ষতিকর। কিন্তু এখানে গানই তো বেশি এবং সুরের তানের বিস্তারে সমাসবদ্ধ পদগুলি বিস্তার পায় এবং বিলম্বিত লয়ে তাদের ঘনসন্নিবদ্ধ রূপটি গৌণ হয়ে অন্তর্হিত হয়; তাই কবিতায় যা অসংগত, শ্রুতিকটু, গান তার অনেকটা ভারই বহন করতে পারে। যখন শুধু কবিতা হিসাবে পড়া হয়, তখন এই সব ত্রুটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শুরু হল এক অসাধারণ শ্লোক দিয়ে:

মেঘৈমেদুরমম্বরংবনভুবঃশ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ। নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।। ইত্থং নন্দনির্দেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জভ্রমং। রাধামাধবয়োজয়ন্তি যমুনাকুলে রহঃ কেলয়ঃ।।

অর্থ, আকাশ মেঘে মেদুর হয়ে উঠেছে, বনভূমি তমালতরুতে শ্যামবর্ণ ধারণ করেছে। ‘(এখন) রাত্রি, এ (কৃষ্ণ) ভীরু, তাই রাধিকা তুমিই একে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এস,’- নন্দের এই নির্দেশে রাধামাধব যমুনাতীরে পথে চলতে চলতে পথের প্রত্যেকটি কুঞ্জে যে কেলি করলেন তা-ই তোমাদের রক্ষা করুক।

ওই আশ্চর্য প্রথম চরণটি তার ধ্বনিমাধুর্যে নশো বছর ধরে শ্রোতা পাঠককে মুগ্ধ রেখেছে। দ্বিতীয় শ্লোকে জয়দেব নিজের পরিচয় দিয়েছেন, এর তিনটি চরণই সমাসবদ্ধ এক-একটি পদ, খুব একটা বৈশিষ্ট্য নেই, শুধু বিষয়বস্তুটি নির্দেশিত হল: বাসুদেবের রতিকেলির কথাই এর উপজীব্য। এরপর পাঠক-দর্শককে বলা হচ্ছে:

যদি হরিস্মরণে সরসং মনো যদি বিলাসকলাসু কুতুহলম্।
মধুর কোমলকান্ত-পদাবলীং শৃণু তদা জয়দেবসরস্বতীম্।।

যদি হরির স্মরণে মন সরস হয়, যদি শৃঙ্গার কলায় কৌতুহল থাকে তা হলে এই মধুর, কোমল, কমনীয় জয়দেবের কাব্য শোনো।

পড়তে পড়তে বোঝা যায় কবিতার বক্তব্য ও কোমলতা। চতুর্থ শ্লোকে লক্ষ্মণসেনের সভার পঞ্চরত্নের পরিচয়: উমাপতিধর, জয়দেব, শরণ, গোবর্ধন এবং ধোয়ী। এঁদের রচনার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও বলা হল, নিজের বিষয়ে জয়দেব শুধু বললেন সন্দর্ভশুদ্ধ বাক্যরচনা— যা কেবল জয়দেবই জানেন।

ভূমিকাশেষে মূল কাব্য শুরু হল: কৃষ্ণের দশাবতার নিয়ে রচিত একটি গম্ভীর সুন্দর, শ্লোকে:

বেদদ্ধরতে জগন্তি জয়তে ভূগোলমুদ্বিভ্রতে দৈত্যান্ দারয়তে বলিং ছলয়তে ক্ষত্ৰক্ষয়ং কুৰ্বতে। পৌলস্ত্যং জয়তে হলং কলয়তে কারুণ্যমাতন্বতে ম্লেচ্ছান্ মূর্ছয়তে দশাকৃতিকৃতে কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ।।

মৎস্য কূর্ম বরাহ ইত্যাদি অবতারগুলির তালিকা, কিন্তু শব্দবিন্যাসে যেমন মন্দ্ৰ গাম্ভীর্য, তেমনই সরস কোমলতা। ক্রিয়াপদগুলির (আত্মনেপদ, বর্তমানকাল প্রথম একবচনে) একই রকম রূপ কার্যত অনুপ্রাসে পরিণত হয়ে এক ধরনের স্বরের গাম্ভীর্য সৃষ্টি করেছে। পরেও দেখি এই ধরনের ব্যাকরণগত রূপ দিয়ে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয়েছে।

পততি পতত্রে/বিচলতি পত্রে/শঙ্কতি ভবদুপযানম্। রচয়তি শয়নং/সচকিতনয়নম্/ পশ্যতি তব পন্থানম্।

এখানেও শতৃ-প্রত্যয়ান্ত শব্দ ও ক্রিয়াপদের ল্ট + তি যোগে একই ধরনের অনুপ্রাস তৈরি হয়েছে। উদ্দেশ্যটা অনুপ্রাস, তবুও প্রসঙ্গত উভয়ক্ষেত্রে অন্ত্যমিলও দেখা দিয়েছে।

আগেই বলেছি, এটা তখনকার উদীয়মান অপভ্রংশ সাহিত্যের লক্ষণ। এর মধ্যে তালের প্রভাব খুব স্পষ্টই লক্ষ করা যায় এবং এ তাল কবির অভিপ্রেতও বটে, সচিত্র ও নৃত্যসংযোগে যার রূপায়ণ, তাতে এর উপযোগিতা তো স্পষ্ট।

আর একটি বৈশিষ্ট্য, গীতগোবিন্দে সমাসবদ্ধ পদের প্রাচুর্য, এটিও নতুন। কবিতায় সচরাচর সমাসবদ্ধ পদ বাদ দেওয়া হয়, কারণ কবিতা অত ওজন সইতে পারে না। কিন্তু কবিতাটি রচিত গৌড়ে। অলংকারশাস্ত্রে কবিতায় যে কটি ‘রীতি’র উল্লেখ আছে তার মধ্যে একটি হল গৌড়ী, এই গৌড়ী রীতির সংজ্ঞা হল: গৌড়ে সমাসভূয়স্ত্বম্, অর্থাৎ গৌড়ী রীতিতে প্রচুর সমাস থাকবে। কথা হচ্ছে, গৌড়ী কবিতার পক্ষে এতে ওজনটা বেশি হয়ে যায়। সম্ভবত গানের তানে বিলম্বিত উচ্চারণে এর ভার অনেকটাই ঝরে পড়ে, তাই জয়দেব একে কবিতায় স্থান দিয়েছেন। এবং সমাসের ফাঁকে ফাঁকে তালের অস্তিত্বও একে শ্রোতার কাছে সহনীয় করে তোলে।

মাঝে মাঝে গোপন অর্থ কিছু সাধারণ শব্দার্থকে জটিল করে তোলে। যেমন, ‘হে ভ্রাতঃ, এই ভাণ্ডীরতরুমূলে বিশ্রাম করছ কেন? এ যে বিষধর কৃষ্ণসর্পের আকর (অন্য অর্থে কৃষ্ণের সম্ভোগস্থল) ঐ তো দূরে নন্দ-ভবন দেখা যাচ্ছে, ঐখানে যাও’— রাধা এই কথা বলে কৃষ্ণের সম্ভোগ কুঞ্জটিকে নির্জন ও নিরাপদ করে তোলেন। এমন আরও আছে, এবং মনে হয় নাচ গানের অনুষঙ্গযুক্ত শৃঙ্গাররসের গীতিকাব্য এ ধরনের কৌতুক ও দ্ব্যর্থবাচক শ্লোক না থাকলেই ভাল হত। যেমন রাধাকৃষ্ণের প্রেম যার উপজীব্য সে কাব্যে কৃষ্ণের বীরকৃতির উল্লেখ মাঝে মাঝেই আছে, তাতে যেন মূল রস ব্যাহত হয় বলে মনে হয়। তেমনই কৃষ্ণ রাধাকে বলেছেন, তোমার অনুমতি পেলে আমার কণ্ঠের শোভাবর্ধক যে স্থলকমল তাকেও তিরস্কৃত করে তোমার ওই চরণদুটিকে অলক্তরসে রঞ্জিত করি। সোজা কথাটা হল, তুমি বললেই তোমাকে আলতা পরাই। (১০:৭) এখানে জটিল বাক্যবিন্যাস কবিতার মর্যাদা বাড়ায়নি বরং কতকটা হাস্যকর করে তুলেছে। এই ধরনের কষ্টকল্পনা, কৃত্রিমতা অন্যত্রও আছে। (৮:৮, ১০:৭, ১০:৮, ১০:১১, ১১:২৮, ২৯) এ ছাড়াও শৃঙ্গার-রসের কাব্যের মধ্যে আঙ্গিকের কৌশল দেখাবার জন্যে কিছু কিছু ছন্দের নাম (ওই ছন্দে রচিত শ্লোকে আছে, যেমন শার্দূলবিক্রীড়িত (৪:১০), উপেন্দ্রবজ্র (৪০); এগুলো অত্যন্ত রুচিপীড়াকর। তেমনই প্রেমিক কৃষ্ণ যেখানে কাব্যের নায়ক, সেখানে হঠাৎ তাঁকে বীররূপে উপস্থিত করা (৮:১০) কবিতার রসভঙ্গ করে। বহু শ্লোকই নেহাত বৈচিত্র্যহীন, সাধারণ, হয়তো গানের সুরে সুরে উতরে যেত, কিন্তু কবিতা হিসাবে এগুলি একেবারেই নগণ্য। ফলে কাব্যের নিরিখে গীতগোবিন্দের বিচার করলে এর মান সত্যিই নিচু। শৃঙ্গাররসের কাব্য, অতএব দেহ ও সম্ভোগের বর্ণনা স্বাভাবিক ভাবেই এখানে প্রত্যাশিত, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলি শালীনতাকে লঙ্ঘন করেছে। সুর, তাল, লয়, হয়তো এ কাব্যের উপস্থাপনায় একে মঞ্চে বাঁচাত, কিন্তু যেটুকু নিছক কাব্যাংশের বিচার, সেখানে জুগুপ্সা জন্মাবার মতো উপাদান প্রচুর। এর মধ্যে প্রথম দিকে যেটুকু ধর্মীয় উপাদান, সেটুকু বরং রুচিদোষ থেকে রক্ষা পেয়েছে; কখনও বা বিষয়গাম্ভীর্য এবং বর্ণনা সংযমে সত্যিই উৎকর্ষও লাভ করেছে।

এতে প্রকৃতিবর্ণনা বিস্তর আছে, যার মধ্যে শ্রেষ্ঠই বোধহয় প্রথম শ্লোকটি, অন্যত্রও গাছ, ফুল, কুঞ্জ, ইত্যাদির বর্ণনা বর্ণাঢ্য হয়েছে, বিশেষত রঙের এবং ফুলের কাব্যিক অনুষঙ্গ বর্ণনাকে খানিকটা সমৃদ্ধ করেছে, যদিও এর দ্বারা সেগুলি যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠেনি। তেমনই শৃঙ্গাররসের পরিচিতি ভাবগুলির বর্ণনাও অধিকাংশই গতানুগতিক, বৈশিষ্টহীন। মঞ্চে বা মন্দিরে এগুলো চলে যেত হয়তো সুর আর নাচের তালে, কিন্তু কাব্যিক উৎকর্ষে নয়। নানা রকম যেসব কাব্যিক ত্রুটি এ পর্যন্ত দেখলাম, সে সবই হয়তো খানিকটা চাপা পড়ত সুন্দরী, সুসজ্জিতা সুশিক্ষিতা নর্তকীর নাচে, তৌর্যত্রিক বাজনায় (অর্থাৎ বাঁশি জাতের বাদ্যযন্ত্র, তারের যন্ত্র ও মৃদঙ্গ জাতের বাজনা) এবং তার সঙ্গে কোকিলকণ্ঠী গায়িকার গানে। আসলে এতে গানবাজনার সংযুক্ত আবেদনের মধ্যে গানের শব্দার্থের দিকে কেই বা মন দিতে পারত? কাজেই কাব্যগত ত্রুটি গৌণই থাকত।

কিন্তু গীতগোবিন্দ তো কাব্য হিসেবেও পড়া হয়, অতএব কাব্য হিসেবেও তার মূল্যায়ন প্রয়োজন। বিশেষ করে যখন কাব্য হিসেবে এটি খুব জনপ্রিয়। স্যার আর্থার বেরিডেল কি মশায় তাঁর ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে আর সব কাব্যেরই কিছু না কিছু খুঁত ধরেছেন, কিন্তু গীতগোবিন্দ প্রসঙ্গে তাঁর অবিমিশ্র প্রশংসা বেশ অবাক করে। সাহেবের কাব্যবিচারের নিরিখ এখানে একেবারে নিজস্ব। কীসে তিনি এত মুগ্ধ, অভিভূত? শব্দমাধুর্যে। মনে রাখতে হবে ইয়োরোপীয় সাহিত্যে শব্দঝংকার নির্ভর সাহিত্যের লক্ষণ বেশি নেই। অর্থ ও ব্যঞ্জনাই কাব্যকে কাব্য করে। কিন্তু গীতগোবিন্দ শব্দের অভূতপূর্ব ঝঞ্জনা এমনই যে কিথ্ সাহেব একেবারে নির্বিচারে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

একটু দেখা যাক কেন সাহেবের এই শব্দঝংকার এত ভাল লেগেছিল। একটি বিখ্যাত শ্লোকে দেখি :

চন্দনচর্চিতনীলকলেবরপীতবসনবনমালী।
কেলিচলন্মণিকুণ্ডলমণ্ডিতগণ্ডযুগস্মিতশালী।। (১:৪০)

অর্থ, কৃষ্ণের নীল শরীরে চন্দনচর্চা, গণ্ড দুটিতে স্মিত হাসি, প্রণয়কালে আন্দোলিত কানের মণিকুণ্ডল আন্দোলিত।

অর্থ সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্যহীন; কিন্তু শব্দ? ঝমঝম করেছে বেজেছে চারটি চরণেই। তেমনই শুধু ছন্দের দোলায় আন্দোলিত শ্লোকও আছে, যেমন,

ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয় সমীরেঃ
মধুকরনিকরকরম্বিকোকিলকূজিতকুঞ্জকুটীরে।।

এখানে প্রথম চরণে ‘ল’-বর্ণের ছটি অনুপ্রাস, দ্বিতীয় চরণে ‘কর’ বর্ণদ্বয়ের তিনবার, আর ‘ক’ বর্ণের চারটি অনুপ্রাস। অর্থ হল, মলয় সমীরে কোমল লবঙ্গলতিকার সৌন্দর্য বেড়েছে, মৌমাছিদের মধুর গুঞ্জনে ও কোকিলের কুহুরবে কুঞ্জকুটীর মুখরিত হয়েছে। অর্থে কিছুমাত্র বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু শব্দ? একে তো ঘনসন্নিবদ্ধ গৌড়ী সমাসের সমারোহ, তার ওপরে এত অনুপ্রাস আর কোমল ব্যঞ্জনের ও বর্ণবিন্যাসের ছড়াছড়ি। এ কাব্যে রস কই? বর্ণনা আছে বসন্ত সৌন্দর্যের, আর নায়ক-নায়িকার। কিন্তু সে বর্ণনা পাঠকমনকে কোনও রসে বা গূঢ় ব্যঞ্জনায় পৌঁছে দেয় না।

মাঝে মাঝে যৎসামান্য খাঁটি কাব্যের ইঙ্গিত মেলে:

ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবন
ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্।। (১০:৪)

তুমিই আমার ভূষণ, তুমি আমার জীবন, এই জীবন-সমুদ্রে তুমিও আমার রত্ন। এখানে ভূষণ, বা রত্ন প্রেমকে ব্যঞ্জিত করে না, করে কেবল ‘জীবন’ শব্দটি কিন্তু আড়ম্বর সর্বস্ব অলংকারনির্ভর এ কাব্যে ভূষণ বা রত্ন প্রাধান্য পাবেই, তবু শ্লোকটি খানিকটা গভীরতায় পৌঁছোয়।

কাব্য হিসেবে গীতগোবিন্দের দীনতার কারণ হল, প্রকৃত কাব্য সম্বন্ধে মানুষ যা বলবে তা কৃষ্ণের বাঁশি শুনে বাংলা কাব্যে রাধা যা বলেছিলেন তাই: কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো/আকুল করিল মোর প্রাণ। একটু লক্ষ করলে দেখি কানে শোনা হল প্রথম পর্ব, অর্থাৎ কাব্য মানুষ প্রথমে শোনে, কিন্তু এটা সূত্রপাত। পরের ধাপ হল, অর্থবোধের মধ্য দিয়ে মরমে প্রবেশ করা, অর্থাৎ আবেগ অভিভূত হওয়া, সেটা এমনই যে প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। পরিণতি তা হলে প্রাণকে আকুল করা। মুশকিল হল, গীতগোবিন্দ-তে এমনই শব্দঝংকার যে সর্বপ্রথম আকুল হয় কান। অনুপ্রাসের ঘটা, নৃত্যপর ছন্দের দোলাতে একটা তাৎক্ষণিক শিহরণ জাগে, রক্তস্রোতকে নাচিয়ে তোলে এবং প্রাণ যে আকুল হয় তা শব্দঝংকার ও ছন্দহিল্লোলে, অর্থের গভীরতায় নয়। অভিধা, লক্ষণ ও ব্যঞ্জনা এই সব স্তর পেরিয়ে কাব্যার্থ যে গভীরতায় পৌঁছে মনকে আকুল করে আবেগে উপলব্ধিতে— সে সব এখানে বাইরে রয়ে গেল। অথচ কান মুগ্ধ, রক্তে সে দোলার স্পন্দন লাগল, অন্ধ শরীরী এক ধরনের তালে সত্তা যেন নেচে ওঠে, সেখানে মনের ভূমিকা গৌণ। কাব্য মনকেই আকুল করবে আবেগে, আবার কখনও-বা মননের জটিল গ্রন্থিতে, কিন্তু শুধুমাত্র রক্তের হিন্দোল কখনওই নয়। এইখানেই কবিতা হিসেবে গীতগোবিন্দ-র ব্যর্থতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *