বংশের পরিচয়

বংশের পরিচয়

বংশ মানে বাঁশ, প্রকৃতির বাঁশে একটু দূরে গাঁট বা কস্তিকা থাকে, এতে বাঁশটির বয়স বোঝা যায়। মানুষের চেতনায় এ গ্রন্থিগুলি সম্ভবত প্রজন্মের চিহ্ন বহন করে। পুরো বংশ একটা অবিচ্ছিন্ন দীর্ঘ ধারার প্রতীক। বংশের কল্পনাই এই কোনও এক প্রখ্যাত (কখনও বা অখ্যাত) আদিপুরুষের (আদিনারীর কথা খুব কমই শ্রুত হয়) থেকে শুরু করে অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত একটা পরম্পরা; এবং সারা পৃথিবীতেই এটা একটা বিশিষ্ট পরিচয়। এই ধরনের পরিচয়ের জন্যে মানবচিত্তে যে আকাঙ্ক্ষা তার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে, ব্যক্তিমানুষ সদাই মৃত্যুভয়ে ত্রস্ত শঙ্কিত। সন্তানের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের সূচনা এবং প্রজন্ম পরম্পরার মধ্য দিয়ে গৌণ ভাবে হলেও ওই আদিপুরুষ বা তার উত্তরাধিকারী যেন ওই ধারার মধ্য দিয়ে জীবিত থাকে। এ এক ধরনের অমরতা — মননে, কল্পনায় মৃত্যুকে জয় করা। মৃত্যুর পূর্বে মানুষটি জেনে যায় যে, ব্যক্তিপুরুষের সঙ্গে সঙ্গে তার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে না। এইখানেই বংশ, বংশরক্ষা বংশের ধারা, ইত্যাদির যেন একটা তত্ত্বগত সমর্থন মেলে। বংশপরম্পরা এক প্রজন্মপুরুষের মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকবে। এটি একটি পরম আশ্বাস। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মৃত বংশকর্তা এক ভাবে নিজেকে প্রসারিত করে এবং সেই কারণেই এক বিদেহ সত্তায় বর্তমান থাকে বলে অনুভব করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঊর্ধ্বতন দু-তিনপুরুষের বেশি স্মৃতিচিন্তাতেও বিধৃত নয়, অথচ আর্যদের মধ্যে এই বোধ প্রবল ভাবে বিদ্যমান। সম্ভবত আগন্তুক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আর্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাগার্যদের মধ্যে বসবাস করেও তারা, আর্যরা, যে স্বতন্ত্র একটি জনগোষ্ঠী এবং তারা যে নানা কারণে বিশিষ্ট ও উন্নততর এ কথা স্মরণে রাখবার জন্যে এবং প্রতিবেশীদের কাছে এর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যেই সৃষ্টি হয় বংশপরিচয়। এতে আর্যদের একটা আত্মপরিচয় যেন নিহিত ছিল। বংশকর আদিপুরুষের পরে খ্যাতিমান বংশধর থেকে গোত্র এবং তারও পরে পরপ্রজন্মের উজ্জ্বল ব্যক্তি প্রবর নামে খ্যাত হতেন। এঁরা সকলেই বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতেন বলেই পরপ্রজন্মের কাছে সম্মানিত হতেন। এ সব বিভাগের দ্বারা আর্যদের বংশ আরও সুপরিচিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হত।

এখনও কথায় কথায় লোকে বংশের সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে ‘চোদ্দপুরুষ’ বলে থাকে— অর্থাৎ বংশ পরিচয়কে সুদীর্ঘ অতীতে বিস্তারিত করবার চেষ্টা। ক্রিয়াকর্মে ঊর্ধ্বতন তিনপুরুষের নাম উল্লেখ করে অনুষ্ঠান করা হয়, আর তারও পূর্বের পুরুষদের নাম উল্লেখ না করে তর্পণ করা হয়। লোকে নিজেদের বংশ কত প্রাচীন তা নিয়ে গর্ব করে থাকে। প্রাগার্য পরিবেষ্টিত আর্যদের বংশ পরিচয় ছিল গর্বের উপাদান। যার যত দীর্ঘ বংশতালিকা তার তত বেশি প্রতিষ্ঠা, তত গর্ব। ভিনদেশে এসে বসবাস করলে এটাই হয়তো নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও গর্ব করবার বিশেষ উপায় ছিল। একটা সময়ে যখন এ দেশে আর্য বসবাসের ইতিহাস হ্রস্ব ছিল তখন সমাজে বংশপরিচয়কে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হত। এখনও কোনও কোনও পরিবার তাদের গোত্র-প্রবরের পরিচয় দিয়ে বংশের দীর্ঘ তালিকা দিয়ে প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে। আর্যদের চেতনায় গোপন একটি বাসনা ছিল, এই উপায়ে তারা তাদের আগন্তুক সত্তাকে আড়াল করবে, এ দেশে বসবাসের দীর্ঘতা দিয়ে অভিবাসনের ইতিহাস গৌণ করে রাখবে। বংশ ও বংশপরিচয় তাই তখন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার ছিল: ঋগ্‌বেদে দেখি প্রাগার্যদের প্রতি আর্যদের প্রবল একটা অবজ্ঞা; ওরা কৃষ্ণবর্ণ, হ্রস্বজঙ্ঘ। এই অবজ্ঞাত, প্রাগার্যদের সঙ্গে পাছে আর্যরা মিলে যায় এবং তার ফলে আর্যমহিমা ক্ষুণ্ণ হয় তাই বংশতালিকার দৈর্ঘ্য দিয়ে, গোত্র-প্রবরের পরিচয় দিয়ে আর্যদের স্বতন্ত্র মহিমাকে অমলিন রাখার একটা চেষ্টা বংশপরিচয় সম্বন্ধে সতর্ক প্রহরার মধ্যে দেখা যায়; অর্থাৎ আর্য-প্রগার্য মিশ্রবিবাহের ফলে বর্ণসংকর ঘটলে আর্যমহিমা ক্ষুণ্ণ হবে এই আশঙ্কাতেই নিজেদের বংশগৌরব সম্বন্ধে আর্যরা তীব্র ভাবে সচেতন ছিল; তাদের শ্রাদ্ধ, বিবাহ ইত্যাদি বহু শুভকর্মের সূচনাই হত ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের নামোল্লেখ করে। অর্থাৎ তারা যে বহুকাল ধরে এ দেশে বাস করছে— উটকো আগন্তুক নয়— এ সম্বন্ধে নিজেদের ও প্রাগার্যদের বিশেষ ভাবে সচেতন থাকতে হত। এতে আর্যদের আত্মপ্রত্যয় ও শ্লাঘা প্রশ্রয় পেত। প্রাগার্যদের মধ্যে বংশপরিচয় সংরক্ষণের কোনও রীতি ছিল না। আজও তাই বর্ণহিন্দুর বাইরে যারা, তারা বংশপরিচয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন বলেই তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাপের নাম এবং গ্রামের নামেই তাদের পরিচয়, এতেই তাদের চলে এসেছে এতাবৎকাল এবং আজও চলছে। অথচ এখনও মধ্যবিত্ত পরিবার যখন বংশগৌরব নিয়ে পরস্পরের মধ্যে কথা বলেন, তখন তাঁরা ভুলে যান যে বাড়ির পরিচারিকাটি ওই পরিচয়ে বঞ্চিত এবং সে জন্য সে কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ নয়।

আমরা সবাই জানি যে, এত সব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও আজকের হিন্দু সমাজে আর্যরক্ত বহু ভিন্ন গোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে চলেছিল দীর্ঘকাল ধরে; এই মিশ্রণ শুধু প্রাগার্যদের রক্তের সঙ্গে নয়, একে একে যত আগন্তুক জাতি আক্রমণকারী বা অন্য ভূমিকাতেও ভারতবর্ষে এসেছে এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভাবে নিঃশেষে তাদের মধ্যে মিশে গেছে এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সকলের রক্ত মিশে আছে। ‘হিন্দুর’ রক্তে মিশে আছে পাঠান, মোগল, খ্রিস্টান, পারসি, পহ্লব, কুষাণ, শক, হূন, পারদ সকলেরই রক্ত। কাজেই বংশগৌরবের পূর্বে প্রাচীন আর্যসমাজে যে ভিত্তি ছিল, আজ তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এতে কিন্তু সমাজে যাঁরা বংশগৌরবে গর্বিত তাঁদের গর্বের মাত্রা কিছুই কমেনি। কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত প্রাগার্য, প্রত্যন্তবাসী জনগোষ্ঠীর থেকে নিজেদের পার্থক্য ঘোষণা। বংশপরিচয়ে মর্যাদার তারতম্য জ্ঞাপন আবার বংশগর্বে গর্বিত ওপরতলার মানুষের নীচুতলার লোকদের থেকে নিজেদের পার্থক্য ও গৌরব ঘোষণা করার এক উপায়।

ঋগ্বেদের কাল থেকে ধীরে ধীরে বেদাঙ্গসূত্রের কাল পর্যন্ত বংশ, গোত্র, প্রবর ইত্যাদি এক ভাবে বেড়েই উঠেছিল ও ক্রমেই পল্লবিত হচ্ছিল। কিন্তু এর পরের যুগে খ্রিস্টীয় পঞ্চম ষষ্ঠ শতকে কি তার অল্প আগে থেকেই যে সব শাস্ত্র রচিত হচ্ছিল যার মধ্য দিয়ে ধর্মসূত্রের চিন্তাধারার প্রসার ঘটছিল— যেমন নিবন্ধ শাস্ত্রগুলি, স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণ— এ সবের মধ্যে বংশ গোত্র-প্রবর ইত্যাদি ক্রমেই বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে। শুধু তাই নয়, এগুলির শাখা-প্রশাখার বিস্তার হয়ে চলে এবং নানা সামাজিক প্রভাবে ক্রমেই পল্লবিত হয় এবং ক্রমশ কঠিন দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ হয়; পরস্পরের মধ্যে সঞ্চরণ ক্রমেই বন্ধ হতে থাকে। ফলে সমাজে মানুষের পরিচয় তার পূর্বপুরুষের পরিচয়ের দ্বারাই নিরূপিত হয়। যার বংশমর্যাদা যত প্রাচীন ও যার গোত্র-প্রবর পরিচয় যত খ্যাতিমান, সমাজে তার আভিজাত্য তত বেশি। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে সংযুক্ত হল যার বংশ-গোত্র-প্রবর, ইত্যাদি পরিচয় নেই সেই প্রাগার্য বা সমাজের প্রত্যন্তবাসী আদিবাসী সম্প্রদায়— বংশপরিচয়হীন বলে সমাজে তার অবনমন। শুধু তাই নয়, যাদের বংশ পরিচয় আছে, তারাও সেই পরিচয়ে সকলে সমান নয় বলে সমাজে এই হিসাবে উঁচুনীচু ভেদ বাড়ল। যে বংশপরিচয়ে যত দীন সে অভিজাত সম্প্রদায় থেকে তত নীচে সরে যেতে থাকল। এই প্রক্রিয়া কয়েকশো বছর ধরে বেড়েই চলেছে এবং হিন্দুসমাজেই একটি বংশের ছোঁওয়া জল অন্য বংশ পান করবে না— ক্রমে এমন অমানবিক পরিণতিও দেখা দিল এবং কায়েম হয়ে রইল। এটা হল, সমাজের শতকরা নম্বই ভাগের কথা; বাকি দশ ভাগ বিগত দুই শতকের নানা মানবিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওই সব সংস্কারের জগদ্দল চাপ থেকে কতকটা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এখনও সমাজের মূলস্রোতে বংশপরিচয়ের প্রবল প্রতাপ বর্তমান।

আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত সমাজের লোকেদেরও প্রায়ই বলতে শোনা যায় ‘কত বড় বংশ তা দেখতে হবে তো?’ কিংবা, ‘অমন ছোটবংশের লোকের কাছে আর কী-ই বা আশা করা যায়?’ ‘সরাসরি প্রশ্ন করলে এঁরা স্বীকার করবেন যে, বংশ ইত্যাদির কোনও যথার্থ সামাজিক বা মানবিক ভিত্তি নেই। অর্থাৎ বংশপরিচয় ধীরে ধীরে আমাদের চেতনার অভ্যন্তরে স্থান করে নিয়েছে। জাতিভেদে যে শ্রেণিবিভাজন ঘটে তারই আনুষঙ্গিক এবং অনুরূপ একটি মারাত্মক বিভাজন ঘটে বংশপরিচয়ে। এটি আরও মারাত্মক এই কারণে যে, বহু শতক বা সহস্রাব্দ পূর্বের কোনও পূর্বপুরুষের পরিচয়ের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত, তা এত দূর অতীতের যে, একে কোনও ভাবে প্রভাবিত করার সাধ্য বর্তমান প্রজন্মের নেই; অতএব অমোঘ নিয়তির মতো এর দ্বারা নিরূপিত হয় বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় এবং সে পরিচয়ের দ্বারা সমাজে তার স্থান নির্ণীত হয়। তথাকথিত উচ্চবংশের মানুষ যেমন বিনা আয়াসে সুদূর অতীতের বংশের কোনও পুরুষের পরিচয় আত্মসাৎ করে সমাজে মাথা তুলে থাকে এবং নীচের দিকের মানুষের উপরে প্রতিপত্তি ফলায়, তেমনই আজ তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের কোনও সাধ্য নেই দু-আড়াই হাজার বছর আগেকার পূর্বপুরুষের নীচ অবস্থানকে কোনও ভাবেই অতিক্রম করা। এতে এক দিকে যেমন মানুষের আপন যোগ্যতা ও কৃতিত্ব যথার্থ মর্যাদা পায় না, তেমনই সম্পূর্ণ অযোগ্য অপদার্থ মানুষও বহু পূর্বের কোনও বংশকর মানুষের কৃতিত্ব অনায়াসে আত্মসাৎ করে দাপিয়ে বেড়ায়। মানুষের যথাযথ ব্যক্তিপরিচয় এতে গৌণ হয়ে যায়; বহু পূর্বের ধার করা এক তাৎপর্যহীন পরিচয়ই হয়ে উঠেছে আজকের সমাজে তার পরিচয়ের গৌরব বা দৈন্যের হেতু। এর মধ্যে একটা কৃত্রিমতা আছে।

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, শুধু বংশকৌলিন্যের চেয়ে অনেক বেশি গৌরবের বংশ ও বিত্তের সহাবস্থান। সমাজ বিত্তকে চিরদিনই বাড়তি খাতির করে এসেছে, এখনও করে। তবে বিত্ত না থাকলেও শুধু বংশমর্যাদার ওজন এখনও আছে। যদিও গত পঞ্চাশ বছর ধরে উল্টোটাও সত্যি, অর্থাৎ বংশগৌরবহীন নিছক বিত্তকৌলিন্যও এখন সমাজে অস্বাভাবিক এবং কুরুচিকর প্রাধান্য পায়।

বংশপরিচয় প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক; বংশকর পুরুষ, গোত্র ও প্রবরের প্রতিষ্ঠাতা সকলেই পুরুষ— শুধু এ দেশে নয়, অধিকাংশ দেশেই। কিছু কিছু আদিবাসী অঞ্চলে এবং দেশের কোনও কোনও মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলে মাতৃবংশের পরিচয়েও সন্তানের পরিচয় হয়। প্রাচীনকালেও বেদে কোথাও কোথাও এবং রামায়ণ মহাভারতেও দেখি রাধেয় (কর্ণ), কৌন্তেয় (প্রথম তিন পাণ্ডব), গাঙ্গেয় (ভীষ্ম), মাদ্রেয় (নকুল, সহদেব), বৈনতেয় (গরুড়), কাদ্রবেয় (কদ্রুর সপসন্তানরা), প্রভৃতি মাতৃ-পরিচয় ভিত্তিক নাম পাওয়া যায়। এগুলি ঠিক বংশপরিচয় না হলেও সমাজে এতটাই স্বীকৃত পরিচয় ছিল যে, ভীষ্মকে ‘শান্তনব’ বলে পিতৃপরিচয়ে খুব কমই অভিহিত করা হয়েছে। যেমন গরুড়কে কাশ্যপের সন্তান বা কর্ণকে অধিরথের পুত্র বলে তেমন উল্লেখ করা হয়নি। গঙ্গার ব্যক্তিত্ব রাজা শান্তনুর চেয়ে উন্নত ছিল। সে জন্য এ ধরনের মাতৃ-পরিচয়ের উল্লেখ স্বাভাবিক ও সঙ্গত বোধ করা হত বলে মনে হয়।

এগুলি কিন্তু ব্যক্তি-পরিচয়— বংশপরিচয় নয়। বংশের বেলায় সমাজ অনমনীয় ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। তার একটা কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতৃকুলের পরিচয়ে পরিচিত সন্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পিতৃপিতামহের সঞ্চিত বিত্ত লাভ করত। যে সব মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলে পুত্ৰ মায়ের সম্পত্তি পায়— যেমন দক্ষিণ ভারতের কোথাও কোথাও— সেখানে মাতৃপরিচয়েরই প্রাধান্য। বংশ সম্পত্তির ধারা বহন করে, তা ছাড়া মানুষ বিশ্বাস করে বংশগত গুণ (এবং দোষ)গুলিও উত্তরপুরুষে বর্তায়। আজ আমরা জানি, এ ধারণা যতটা সত্যি ততটাই মিথ্যে। বংশগত দোষগুণ একেবারেই বর্তায়নি এমন বহু দৃষ্টান্ত চারিদিকে পাওয়া যায়, সৎ মানুষের দুর্বৃত্ত পুত্র, মূর্খের বুদ্ধিমান বিদ্বান পুত্র, দাতার কৃপণ পুত্র এ সবের ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যায় এবং আজ ‘জিন’ চর্চায় বৈজ্ঞানিকরা তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও উদ্ধার করেছেন। কাজেই দোষ-গুণের ধারা সর্বত্রই বংশ ধরে দেখা দেয় এ ধারণা আজ আর বিদ্বজ্জনের কাছে গ্রাহ্য নয়।

তবে একটা জিনিস যা আইনের জোরে বংশে বর্তায়, তা হল বিত্ত। এই বিত্ত আপন ঔরসজাত পুত্রের হাতে রেখে যাওয়ার জন্যেই স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সংসর্গ থেকে সযত্নে দূরে রাখার কঠোর প্রয়াস সেই সুদূর অতীত থেকেই, যাতে পিতার সারা জীবনের সঞ্চয় নিজের ঔরসজাত পুত্র এবং পরে পৌত্রের হাতেই পড়ে। এখানে বংশের ধারাবাহিকতার একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি পাওয়া যায়। তবে গুণ, বিদ্যাবুদ্ধি, যোগ্যতা যদি পুত্র-পৌত্র ধারায় সঞ্চারিত হয় তবে সমাজে বংশ অন্য এক ধরনের প্রতিপত্তির সূচনা করে, এবং কখনও কখনও তা হয়ও।

বেদের ব্রাহ্মণ অংশ থেকেই বংশ সম্বন্ধে একটা সম্ভ্রমবোধ দেখা যায়, উপনিষদেও বেশ কিছু বংশাবলি পাওয়া যায়। রামায়ণ, মহাভারতেও বংশতালিকা আছে; অর্থাৎ খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীতে ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও এর উদ্ভব আরও সাত-আটশো বছর আগে। পৃথিবীর অন্য দেশের প্রাচীন সাহিত্যেও বংশতালিকা দেওয়া থাকে, প্রধানত আগন্তুক জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ও অভিবাসনের ইতিহাস রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং সেই সঙ্গে সেই গোষ্ঠীর প্রাচীনতা ও আপেক্ষিক মাহাত্ম্য ঘোষণা করার জন্য। বংশাবলিগুলি লক্ষ করলে দেখি দু-চারজন প্রতিষ্ঠিত বা স্বনামধন্য পণ্ডিত বা ঋষি থাকলেও সুদীর্ঘ বংশতালিকায় অধিকাংশেরই পরিচয় দীন, নিষ্প্রভ। বাস্তবে তো এমনটাই হয়, যে-কোনও বংশতালিকায় দু-তিনটির বেশি উজ্জ্বল ব্যক্তির নাম থাকে না, তবু বংশটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ওই দু-তিনটি প্রসিদ্ধ মানুষের জোরেই। সমাজ এইটেই মেনে নিয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্য পরিবেশে কয়েকটি আর্যবংশ কিছু বিদ্বান ও গুণবান ব্যক্তির জোরেই নিজ বংশকে সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতেন। যেহেতু আর্যরা প্রাগার্যদের বরাবরই হেয় জ্ঞান করেছে, সে জন্যে প্রাগার্য সংস্কৃতিতে উন্নত কিছু আছে আর্যরা তা বিশ্বাসই করত না, তাই কখনও তার সন্ধানও করেনি। নইলে হয়তো তারা প্রাগার্য বংশের কিছু উন্নত গুণ, যোগ্যতা, বিদ্যা ও জ্ঞান সেখান থেকে আত্মসাৎ করে সমৃদ্ধতর করে তুলতে পারত। আবার আর্য সমাজের মধ্যে সকল বংশ প্রখ্যাত ছিল না; আমরা যে কটির নাম পরিচয় জানতে পারি, গোটা আর্যসমাজ তার মধ্যে নিবদ্ধ ছিল না, তাদের বাইরেও বহু বংশ ছিল, যাদের পরিচয়ের উল্লেখ শাস্ত্রে নেই। তারাও সমাজে হীন ও নত হয়েই ছিল। গুণী বা বিদ্বান জ্যোতিষ্কস্বরূপ বংশধর সে সব বংশে জন্মায়নি বলেই তাদের পরিচয় গৌণ থেকে পরে লুপ্ত হয়ে গেছে। সে সব বংশের ধারাও হয়তো বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, কিন্তু কোনও উজ্জ্বল বংশধরের পরিচয় সে বংশতালিকায় ছিল না বলে সেগুলির স্বতন্ত্র পরিচয় শাস্ত্রে ছিল না, ছিল হয়তো বংশধরদের মনে, তাদের স্মৃতিতে। ব্রাহ্মণের বংশে যেমন ঋষি, বেদজ্ঞ, অধ্যাপক ও যজ্ঞকারী বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের দ্বারা বংশ উজ্জ্বল হত, ক্ষত্রিয় বংশে তেমনই যুদ্ধে বিজয়ী বীর বা শৌর্যবান বা দাতা ক্ষত্রিয়ের দ্বারাই বংশ খ্যাতিলাভ করত। কিন্তু ক্ষত্রিয় বংশতালিকা খুব কমই পাওয়া যায়, বৈশ্যের তো একেবারেই পাওয়া যায় না, আর শূদ্রের বংশধারা শূদ্রের কাছেও স্মরণীয় বোধ হত না, কারণ সে ছিল উচ্চ ত্রিবর্ণের সেবক— দাসের আবার বংশপরিচয় কী করে হবে! অতএব দেখা যাচ্ছে, বংশপরিচয় শুধু ব্রাহ্মণের। উপযুক্ত ব্রাহ্মণ রাজার কাছে প্রচুর দক্ষিণা ধনরত্ন পেতেন। ফলে যোগ্যতার সঙ্গেই থাকত ঐশ্বর্য, সমাজে বংশটির প্রতিপত্তি বাড়ত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ওই জাতীয় বংশতালিকার সন্ধান পাই না, এক প্রজন্মে কৃতী বীর বা ব্যবসায়ী নিজের পরিচয়েই প্রতিষ্ঠা পেত। তার বংশ পরিচয়ের সে ভাবে প্রয়োজন ছিল না। তাই শাস্ত্রেও তার নজির নেই।

গত দুই সহস্রাব্দে সমাজে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে; তার মধ্যে একটা প্রধান পরিবর্তন হল আজ গোষ্ঠীপরিচয় থেকে সমাজ ব্যক্তিপরিচয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর নানা কারণও আছে। বংশে নানা জাতির সংমিশ্রণ ঘটে গেছে, বহু বংশে আগের গৌরবের ভিত্তি নষ্ট হয়েছে। আগেকার পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত বংশগুলির অধিকাংশই ছিল আর্য এবং ব্রাহ্মণ, পরবর্তিকালে বহু অব্রাহ্মণ বংশের বংশধর নিজের কীর্তি ও যোগ্যতা দিয়ে, জ্ঞানবুদ্ধি, সৎকর্ম ও সমাজ হিতৈষিতার দ্বারা সমাজে সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছে। এখনও অধিকাংশ প্রখ্যাত বংশই ব্রাহ্মণ কায়স্থ বা বৈদ্যকুলের, কদাচিৎ অন্য বর্গের মধ্যে কীর্তিমান পুরুষের খ্যাতিতে কোনও কোনও বংশ গৌরব লাভ করেছে। এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বংশ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, যাদের অনেকেরই গোত্র-প্রবর পরিচয় জানা নেই। এ কথা দেশের বৃহৎ আদিবাসী সম্প্রদায় সম্বন্ধেও সত্যি: ওই ধরনের বংশপরিচয়ে তারা বিশ্বাসী নয়, কাজেই ওই হিসেব তারা রাখেও না। বৈদিক যুগে যে যোগ্যতার, কৃতিত্বের নিরিখে গোত্র-প্রবরের প্রতিষ্ঠাতারা স্বীকৃতি পেত, সেই যোগ্যতা, উৎকর্ষের নিরিখেই পরবর্তিকালে অব্রাহ্মণ বংশে প্রখ্যাত পুরুষের নামে বংশের ধারা প্রবর্তিত হয়।

একটা ব্যাপার কিন্তু বংশপরিচয়ে সার্বত্রিক, তা হল বংশপরিচয় নির্ধারিত হয় কোনও একটি পুরুষেরই নামে, কারণ সমাজটা আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক। আজকের সমাজ পুরুষতন্ত্রকে প্রতিস্পর্ধা জানাচ্ছে, উপেক্ষা করছে এবং বলছে, এ ব্যবস্থা ন্যায়সম্মত নয়। আজকে পৃথিবীর সর্বত্রই নারী স্বাধীনতার জন্যে নারীপুরুষের সমানাধিকারের জন্যে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বংশপরিচয় মূলত পুরুষের, নারীর নিজস্ব কোনও বংশপরিচয়ই নেই। কুমারীর পদবি পিতার, বিবাহিত বা বিধবার পদবি স্বামীর পদবির মধ্যে বংশপরিচয় নিহিত আছে। এই পদবির মধ্যে এক দিকে যেমন প্রকৃষ্ট ভাবে পুরুষতন্ত্রের ছাপ পড়ে এবং তেমনই ওরই মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে জাতি পরিচয় বা অনেকাংশে বংশপরিচয়। পদবিটির চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে নারীর স্বতন্ত্র স্বীকৃতি নেই, হয় সেটা তার বাবার পদবি নয় স্বামীর। তেমনই চট্টোপাধ্যায়কে সমাজ যে চোখে দেখে, মণ্ডল, নাই, দাস, বাউরি— এগুলিকে সে চোখে দেখে না কারণ, এরা সমাজে তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ। এ দিক থেকে পদবি বর্জন করার দ্বারা এক আঘাতে জাতি বা বংশপরিচয় এবং নারী পুরুষের পৃথক পরিচয় অস্বীকার করা হয়। নানা কারণে দু-চারজন ব্যতিক্রমী মানুষ ছাড়া জনসাধারণ পদবি বর্জন করতে পারেননি। দাক্ষিণাত্যে নামের সঙ্গে গ্রামের নাম উল্লেখে একদা এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছিল, যেমন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। কিন্তু এটা তখনই সম্ভব, যখন বাসস্থানের পরিচয় দীর্ঘকাল ধরে একই থাকে। দেশভাগের পরে বহু পরিবারেরই বাসস্থানের পরিচয় তছনছ হয়ে গেছে, উদ্বাস্তুরা কোন পরিচয় দেবে? বর্তমানের বা আদিবাসস্থানের? তারপর বহু পরিবারের কর্মস্থলই ধীরে ধীরে বাসস্থান হয়ে ওঠে, তখন কোনটা তার যথার্থ বাসস্থানের পরিচয়? কাজেই বাসস্থানের পরিচয়টা পদবির বিকল্প হতে পারে না। অতএব পদবির যথার্থ কোনও বিকল্প নেই। পদবিতে বংশপরিচয় এবং পিতৃপরিচয় অথবা স্বামীর পরিচয় নিহিত থাকে এবং সেটা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চিহ্ন বহন করে।

সমস্যাটা হল একুশ শতকের সমাজ লিঙ্গভেদের সঙ্গে কোনও অধিকারভেদ জড়াতে রাজি নয়। একজন মানুষ পুরুষ বলেই একটু উঁচু আর একজন নারী বলেই নীচু— এ কথা এ সমাজ মানতে চায় না। কারণ বর্তমান সমাজ নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। এ কথা মেনে নিলে এখনকার সমাজের সমদর্শিতাকে একটু প্রসারিত করলেই অনুসিদ্ধান্ত হবে— বংশ একা পুরুষের নয়, নারীরও। যেখানে স্কুলে অভিভাবক হতে পারে মা, রেশনকার্ডে ‘গৃহস্থ’ হতে পারে নারী, হাসপাতালে মা ভর্তি করতে পারে অসুস্থ শিশুকে, আইনে সাক্ষ্য দিতে পারে অর্থাৎ তাবৎ সামাজিক এবং সাংবিধানিক ক্ষেত্রে নারী সমান অধিকার ভোগ করে। সেখানে বংশপরিচয় শুধু পুরুষকে দিয়েই কেন হবে? একটি শিশু শুধু পিতামহ বা পিতামহীরই নাতি বা নাতনি, মাতামহ বা মাতামহীর নয়?

বহু প্রাচীনকালে ‘দম্পতি’ শব্দের অর্থ ‘জায়া ও পতি’ ছিল না। ইন্দো-ইয়োরোপীয় নির্বাচনে ‘দমঃপতী’ এই ছিল অর্থ। দম মানে গৃহ (যার থেকে domestic), এই গৃহের পতি ছিল দুজন; স্বামী ও স্ত্রী; যে কারণে দম্পতি শব্দ নিত্যদ্বিবচন, এখানে জায়া ও পতির কর্তৃত্বের মধ্যে তত্ত্বগত ভাবে কোনও পার্থক্য ছিল না, কার্যত ছিল। কিন্তু এই প্রাচীন বোধটি তো এক ধরনের সমানাধিকারের নিরিখ। তার অনতিকাল পরেই অবশ্য নারীর অধিকার খর্ব হতে থাকে। এখন প্রশ্ন হল, আজ যখন সারা পৃথিবীতে নারীপুরুষের সমানাধিকারের জন্যে ব্যাপক আন্দোলন চলছে তখন বৈষম্যমূলক বংশপরিচয়ের বোধকে বর্জন করে নারীকেও বংশকর্ত্রী বলে স্বীকার করা সঙ্গত। সন্তান শুধু পিতৃপরিচয়ে নয়, মাতৃপরিচয়েও অভিহিত হোক, বংশও নিরূপিত হোক ঊর্ধ্বতন প্রজন্মের পুরুষ এবং/অথবা নারীর পরিচয়েও। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র পরিচয়ের চেয়ে কি গান্ধারীর পুত্রপরিচয় কোনও অংশে ন্যূন? দশরথের পুত্র যদি কৌশল্যার পুত্র বলে পরিচিত হয় তো সেটা বেশি সম্মানের। এখনও পৃথিবীর কৃতী নারী ও কৃতী পুরুষের মধ্যে তারতম্য রক্ষা করে, নইলে পিতামহ-মাতামহ এবং পিতামহী-মাতামহী উভয়েরই পৌত্র পৌত্রী যে-কোনও পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার থাকা উচিত ছিল। এবং আজ যে-কোনও বংশের পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তা ঠিক করুক সেই উত্তরপুরুষই, বংশপরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন ঘটলে। তবে সেটা সাম্যদৃষ্টিতেই নিরূপিত হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *