আচরণে যুক্তিবাদ
যুক্তি অনুসারে চলা মানে অভ্যস্ত অযৌক্তিক আচরণ সজ্ঞানে বিসর্জন দিয়ে যুক্তিসিদ্ধ আচরণ করা; এতটা পরিশ্রম খুব কম লোকই করে। অধিকাংশ মানুষই চলে পারিপার্শ্বিক সমাজের অভ্যস্ত আচরণ নিজের জীবনে অনুসরণ করে। এতে নিজেকে আলাদা করে নিজের আচরণ নিয়ে ভাবতে হয় না। ফলে হাঙ্গামা নেই। তাই গতানুগতিককে মেনে চললে জীবন হয় নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু এ ধরনের জীবনে যুক্তির কোনও জায়গাই নেই, কারণ এদের পুরো জীবনচর্যাই অভ্যাসের দ্বারা নির্ধারিত।
সামান্য কিছু মানুষ অযৌক্তিক আচরণের বিরুদ্ধে নিজের অগোচরেই বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে ওই অভ্যাস-আশ্রিত জীবনধারা পরিত্যাগ করেন; এঁদের আচরণের কারণটা এঁদের নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়, সাধারণের আচরণের বিরুদ্ধতাটাই এঁদের প্রেরণা। যে সব আচরণ পারিপার্শ্বিক সমাজে কোনও যুক্তি ছাড়াই দীর্ঘকালের অভ্যাসকে আত্মসাৎ করার ফলে একটা গতানুগতিক জীবনচর্যা নির্মিত হয়েছে, শুধু তাকে আবার তেমনই নির্বিচারে বর্জন করাই এঁদের জীবনধারার পরোক্ষ প্রেরণা।
আবার এক শ্রেণির মানুষ অভ্যস্ত জীবনযাত্রাকে পরিহার করেন যুক্তি বিচারে। যে-কোনও সামাজিক আচরণই তাঁরা বর্জন করেন না, যেমন ধুতি শাড়ি পরা বা ভাত রুটি খাওয়া। বিশিষ্ট কিছু আচরণ নিয়েই তাঁরা চিন্তা করেন, কারণ এ সব আচরণ কোনও কোনও প্রত্যয়ের থেকে উদ্ভুত বা তার সঙ্গে যুক্ত।
কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে। বৃহৎ পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে পড়ে বিবাহ, অন্ত্যেষ্টি, শ্রাদ্ধ, উপনয়ন ও জাতকাশৌচ (আঁতুড়); শেষ দুটিতে অশৌচের দুই ভিন্ন রূপ বা প্রকৃতি। জাতকাশৌচের পিছনে একটা বহু সহস্রাব্দপ্রাচীন বিশ্বাস আছে; কোনও শিশু জন্মালে তার ক্ষতি করবার জন্য, মেরে ফেলবার ও তাকে খেয়ে ফেলবার জন্যে অনেক প্রেত, পিশাচ, মন্দ আত্মা উদ্যত হয়ে আছে। এরা ক্ষতি করবার জন্যে আঁতুড়ঘরের ভেতরেও চারদিকে ঘুরে বেড়ায় একুশ দিন পর্যন্ত। একুশের পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুচিকর্ম সম্পাদন করবার পর এরা শক্তিহীন হয়ে যায়। যারা এ সব মন্দ আত্মা ও প্রেতে বিশ্বাস করে আঁতুড় তারাই মানতে পারে। অন্যেরা মানলে সেটা নিছকই অভ্যাস বা কুসংস্কার মেনেই করা হবে, যুক্তিতে যার কোনও ভিত্তি নেই।
এর সঙ্গে তুলনীয় মৃতাশৌচ— অন্ত্যেষ্টি থেকে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত যে অশৌচ তার ভিত্তি হল প্রেতে বিশ্বাস। শ্মশান থেকে ফেরার সময়ে পিছন ফিরে দেখা নিষিদ্ধ কারণ, যে প্রেতাত্মা পিছন পিছন আসছে সে ক্ষতি করতে পারে। বাড়ির দরজায় লোহা ও আগুন ছুঁয়ে তেতো কিছু ও মটর দাঁতে কেটে বাড়ি না ঢুকলে প্রেতাত্মা ঘাড় মটকে দিতে পারে। বাড়ির মধ্যে অশৌচকালে পেরেক (অর্থাৎ লোহা) পুঁতলে নিরাপদ। বহু যুগের সংস্কার বলে, প্রেতাত্মা আগুন সহ্য করতে পারে না। কোনও অজ্ঞাত কারণে মটরডালও নয় (স্মরণীয়, প্রাচীন গ্রিস, রোমেও ওই সময়ে মটরডাল দাঁতে কাটার রীতি ছিল)। আর, যেহেতু এ সব সংস্কারের উদ্ভব ও প্রচলন ব্রোঞ্জ যুগেই ছিল, তাই লৌহযুগ প্রবর্তনের পরে অপরিচিত লোহা প্রেতের কাছে আতঙ্কের বস্তু হয়ে উঠল। কাছাকাছি লোহার পেরেক মাটিতে পোঁতার সংস্কার সৃষ্ট হল, কারণ কাছেপিঠে লোহা থাকলে ভূত সে দিক মাড়াবে না। মৃতাশৌচের ওই কদিন ঘরে পূর্ণকুম্ভ রাখতে হবে, নইলে খালি কলসিতে প্রেতাত্মা ঢুকে বসে থাকবে; ওই কদিন সারারাত্রি প্রদীপ জ্বেলে রাখতে হবে কারণ অন্ধকারেই প্রেতের আনাগোনা
ওই কদিন বাড়ির লোকেরা নিরামিশ খাবে। কারণ আমিষ সুস্বাদু ও লোভনীয়; অতএব প্রেতকে প্রলোভিত করতে পারে। স্মরণীয়, মাংস যে লোভনীয় খাদ্য এ কথা মহাভারত ও পুরাণে আছে। কোনও লোক এ জন্মে পাপ করলে পরজন্মে তার একটি বিশিষ্ট শাস্তি ‘ভোজনং মাংসরহিতম’– মাংসবিহীন আহার। তেমনই গায়ে মাথায় তেল-সাবান মাখা চলবে না। পায়ে জুতো পরা চলবে না, ছেলেরা বুকে লম্বালম্বি একগাছা কাপড় পরবে (কাছা)। স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি বসবে না, বা শোবে না। কারণ দাম্পত্য সান্নিধ্য প্রেতকে অসম্মানিত ও উদ্বিগ্ন করবে। অশৌচের বাড়িতে গানবাজনা, হাসি, আনন্দ, গন্ধমাল্য পুষ্পের প্রবেশ নিষেধ। স্বাভাবিক ভাবেই শোকাচ্ছন্ন মানুষ এগুলো পরিহার করে, তবে বাড়ির মধ্যে প্রেতের অবস্থানে বিশ্বাসই এর একটা হেতু।
শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস ব্যাপক ভাবে প্রচারিত; শ্রদ্ধা থেকেই শ্রাদ্ধ। অথচ শ্রাদ্ধের বিধিনিষেধ নিয়মকানুন লক্ষ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় শ্রদ্ধার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্কই নেই। ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষায় (যে ভাষা থেকে সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন এসেছে) বিশ্বাস-বোধক ধাতুটির সংস্কৃত রূপ শ্রদ্; মানে বিশ্বাস (এই ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ইংরেজি credible, credo, ইত্যাদি)। এই যে বিশ্বাস তার অবলম্বন কী? প্রেতাত্মা ও প্রচ্ছন্ন ভাবে পরলোক। প্রত্যক্ষ ভাবে প্রেতাত্মা, এবং শ্রাদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অনুষ্ঠানগুলো। যেমন অগ্রদানী ব্রাহ্মণকে পোড়া মাছভাত খাইয়ে বলানো ‘তেতো লাগছে’, অর্থাৎ প্রেতাত্মার লোভ নষ্ট করা। শ্রাদ্ধভোজে মৃতের প্রিয় খাদ্য পরিবেশন, যাতে প্রেতাত্মার খাদ্যলোভ তৃপ্ত হয়। সমস্ত অনুষ্ঠানের মূলে একটিই বিশ্বাস: মৃত মানুষটি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, প্রেত আকারে সে আছে এবং বহু অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে সেই সব বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য সে জীবিত দেহ আশ্রয় করে। শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণের মুখে তাকে স্বাদু অন্নব্যঞ্জন খাওয়ালে তার লোভ নিবৃত্ত হয়। মাসিক ও বার্ষিক শ্রাদ্ধে তার লোভ তৃপ্ত হয় এবং গয়ায় ব্রহ্মযোনি পাহাড়ের কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে পিণ্ড দিলে চিরকালের জন্য তার অতৃপ্ত বাসনার পরিতৃপ্তি হয়। আসলে এতে যা ঘটে তা হল জীবিত আত্মীয়রা এই অনুষ্ঠানটি সম্পাদন করলে পুরোহিত তাদের আশ্বস্ত করে যে, প্রেতাত্মার যাবতীয় অতৃপ্ত বাসনা এখন চিরতরে প্রশমিত হয়েছে, তার কাছ থেকে এখন আর কোনও অশুভের আশঙ্কা নেই। এই আশ্বাসটি জীবিত আত্মীয়ের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তাই এই অনুষ্ঠান। কিন্তু সবটাই একটা ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রকাশ।
যারা পরলোক, প্রেতাত্মার ক্ষতিকর ভূমিকায় বিশ্বাস করে তাদের পক্ষে অন্ত্যেষ্টি থেকে শ্রাদ্ধ, প্রেততর্পণ ও পিণ্ডদানের একটা যথার্থ মূল্য আছে; তারা স্বভাবতই এ সব অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী বলেই এগুলো সম্পাদন করবে। কিন্তু সমাজে অধিকাংশ মানুষই এ সব অনুষ্ঠান করে নিজেদের বিশ্বাসকে তলিয়ে না দেখেই। তারা এ সব করে কারণ তাদের আত্মীয় পরিজন ও পারিপার্শ্বিক সমাজর সকলেই চিরকাল এ সব মেনে এসেছে ও এমন ভাবে অনুষ্ঠান করে এসেছে, অর্থাৎ তাদের আচরণের ভিত্তিতে কোনও যুক্তি নেই, আছে শুধু পরম্পরাগত অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য।
উপনয়ন অনুষ্ঠান যারা করে তাদের মধ্যে এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের বেশি বৈদিক উপনয়নতত্ত্ব জানেও না, বোঝেও না। বামুনের ছেলের পৈতেটা হওয়াই চাই। নইলে সমাজে সে অচল, ব্রাত্য। যারা উপনয়ন অনুষ্ঠানে দর্শক বা পার্শ্বচরের ভূমিকায় থাকে তাদের অধিকাংশই এর একটা রহস্যাবৃত মায়াজালের দ্বারাই আকৃষ্ট হয়। দণ্ডী ঘরের তিনদিন, তারপর ‘ভবতি ভিক্ষা দেহি’– একটা ক্ষুদ্র অভিনয় এবং সর্বশেষে একটা ভাল রকম ভোজ। এরা জানেও না যে, শুধু ভারতীয়দের মধ্যেই উপনয়ন নেই, পারসিদের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই অনুরূপ অনুষ্ঠান ‘অব্যঙ্গ’ প্রচলিত ছিল। এখনও অন্য নামে আছে। ইয়োরোপেও উপনয়নের অনুরূপ ‘দ্বিতীয় জন্ম’-বোধক অনুষ্ঠান ছিল। যেটা পরবর্তিকালে খ্রিস্টান সমাজে ‘ব্যাপটিজম’ রূপে দেখা দিয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এমন দ্বিতীয় জন্মের অনুষ্ঠান আছে, যাতে সে সমাজে সদস্যরূপে গৃহীত হয়।
আজ যারা উপনয়ন অনুষ্ঠান করে বা তাতে যোগ দেয় তাদের এ সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই, তার দরকারও কেউ বোধ করে না। হইচই করে বহুকাল ধরে অর্থলুপ্ত একটা অনুষ্ঠানে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে তিনদিন ছোটখাটো অভিনয়ের মধ্যে বামুন হয়ে যায়, যদিও সে ব্রাহ্মণবংশেই জন্মেছিল। এই দ্বিজত্ব অর্জন করার দ্বারা সে সমাজের বাকি অংশকে যে শূদ্রত্বের অসম্মানে ঠেলে দিল এ চেতনাও তার নেই। যারা বৈদিক উপনয়নের খবর রাখে, তারা জানে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরও উপনয়ন হত। ওই ব্রাহ্মণবটুটিকে ব্রাহ্মণ করার উৎসাহে দেশের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মানুষকেই হীনতর শূদ্র আখ্যা দিতে কোনও দ্বিধা নেই এবং ব্রাহ্মণ সন্তানটিরও ব্রাহ্মণ হওয়ার আচরণগত ও চরিত্রগত সব দায় ওই তিনদিনেই সমাপ্ত, তারপর দিন থেকেই সে আর পাঁচজনের মতো সাধারণ মানুষ। শুধু ওই একটি তাৎপর্যহীন অনুষ্ঠানের দ্বারা সে সমাজের বৃহত্তম অংশকে নিজের চেয়ে হীন প্রতিপন্ন করল। যুক্তি দিয়ে জাতিভেদকে স্বীকার করা যায় না, উপনয়নে ব্রাহ্মণত্ব স্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে অপর সকলকে শূদ্র বলাটাও সেই কারণেই তাই অযৌক্তিক। উপনয়নে যোগ দিলে যুক্তিবাদীর বিশ্বাসের বিরুদ্ধ-আচরণ করতে হয়, প্রকারান্তরে জাতিভেদ স্বীকার করা হয়, যা হয়তো সে যুক্তি দিয়ে মানে না।
আরও কিছু অনুষ্ঠান আছে যার ভিত্তি কোনও শাস্ত্র নির্দেশে নয়, বিশুদ্ধ লোকাচারে, যেমন, বউভাত, জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা, ইত্যাদি। বউভাতের প্রবর্তন হয় বউ-টির শ্বশুরবাড়িতে কাজে নিযুক্ত হওয়ার প্রথম দিন হিসাবে। আজ অবস্থাপন্ন বাড়িতে নানা উৎসবের মতো এটিও সাড়ম্বরে পালিত হয়, কিন্তু আদিতে এই দিনে প্রথম আত্মীয় পরিজনকে ভাত পরিবেশন করত বধূটি, পরবর্তী জীবনে যে কাজ সে রোজ করবে, তারই সূচনা হিসেবে। এটি আজ সুসজ্জিত ভূমিকায় এর তাৎপর্য হারিয়েছে। কিন্তু আদিতে এর সঙ্গে কিছুমাত্র গৌরবের অনুষঙ্গ ছিল না, শ্বশুরবাড়িতে তার দাসীত্বের সূচনা দিন ছিল। ভুললে চলবে না, পাত্র বিয়ে করতে যাওয়ার আগে বলে যেত ‘মা, তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি’। নতুন দাসীর দাসীত্বের সূচনা বউভাত। যারা এ অনুষ্ঠানের ইতিহাস ও তাৎপর্য জানে তারা কেমন করে এতে অংশগ্রহণ করে নিজের বোধ ও যুক্তির বিরুদ্ধে? লিঙ্গ বৈষম্য এত উৎকট ভাবে প্রত্যক্ষ হয় না। যারা অন্য প্রসঙ্গে লিঙ্গসাম্যে বিশ্বাস করে তারা এখানে যুক্তিহীন আচরণ করে কেন?
আর একটি অনুষ্ঠান জামাইষষ্ঠী। এতে বধূটির পিতৃগৃহের অসম্মান নিহিত। জামাই যেন এক মূল্যবান প্রাপ্তি, এক সম্মানিত সম্পদ, তাই তাকে উপলক্ষ করে বিশেষ ভোজ, বস্ত্র ও সাধ্যমতো অন্য উপহার দেওয়া। বহু ক্ষেত্রে জামাই ফরমাস করে সুখাদ্যের তালিকা আগে পেশ করে রাখে, উপহার ও বস্ত্র সম্বন্ধে তার প্রত্যাশাও অস্পষ্ট রাখে না এবং সেগুলি আদায় করে ছাড়ে এবং আত্মীয় বন্ধুমহলে উপহার দেখিয়ে গর্ববোধ করে এবং খাতির আদায় করে। এ সব কিছুর মধ্যে যে কাঙালপনা প্রচ্ছন্ন আছে সে সম্বন্ধে সে কি অবহিত নয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার জুলুম মেটাতে তার শ্বশুরকে ধার করতে হয়। এই অসম্মান ও গ্লানির মধ্যে নিতান্তই অকারণে তাকে ঠেলে দেয় সমাজ। এ সব বুঝেও লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত ছেলে কর্মস্থলে ছুটি নিয়ে সাজগোজ করে শ্বশুরবাড়িতে উদিত হয় এবং সম্রাটের মহিমায় বিরাজ করে। যে দেশে বউ-ষষ্ঠী বলে কিছু নেই সেখানে নারী-পুরুষের এতখানি বৈষম্য মানুষ কেমন করে মেনে নেয়? যুক্তি দিয়ে চললে এটা তার বুদ্ধিবৃত্তির অপমান বলে প্রতিভাত হয়। যুক্তি যদি আচরণে না প্রকাশ পায় তা হলে সে যুক্তি থাকাও যা না থাকাও তা। অসংখ্য শিক্ষিত যুবক শ্বশুরের কন্যাকে বিয়ে করে তাঁকে যেন চিরঋণী করে রেখেছেন— এই মনোভাবেই এই দিনটা যাপন করে বাৎসরিক খাজনা আদায়ে প্রচুর সমারোহের জন্য নির্লজ্জ ভাবে।
এমনই এক অনুষ্ঠান ভাইফোঁটা। শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষও অনায়াসে ভাইফোঁটা নেয়, আনুষঙ্গিক প্রাপ্তি সহযোগে এমন সমাজে যেখানে ‘বোনফোঁটা’ বলে কিছু নেই। এ সব ছেলেদের মধ্যে অনেকে মুখে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকার করে থাকে। কিন্তু হলে কী হবে, বেদেও সব অনুষ্ঠানে পুরুষের দীর্ঘায়ু, স্বাস্থ্য, ইত্যাদির জন্যে প্রার্থনা আছে, নারীর জন্যে নেই। নারীর স্বাস্থ্যের জন্যে প্রথম প্রার্থনা পুংসবন অনুষ্ঠানে। সেখানেও প্রার্থনার উদ্দিষ্ট হল নবজাতক যেন পুরুষ হয় এবং সে উদ্দেশ্যেই তার জননীর স্বাস্থ্য কামনা করা হয়। এ মূল্যবোধ আড়াই হাজার বছর ধরে আকাশে বাতাসে প্রবাহিত। আজকের ভাইফোঁটা তারই এক প্রকাশ।
আমাদের সমাজে সন্তানের জন্মদিন বড় একটা পালিত হয় না। যখন হয় তখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা পুত্রের, কন্যার নয়। আধুনিক মননের প্রভাবে কিছু কিছু পরিবারে অবশ্য কন্যা সন্তানের জন্মদিনেও অনুষ্ঠান হয়, কতকটা খ্রিস্টান ও ব্রাহ্ম, অর্থাৎ পাশ্চাত্য প্রভাবে; এ অনুষ্ঠানের ইতিহাস প্রাচীন নয়। আধুনিক চিন্তায় নারীপুরুষের সাম্যের প্রভাবে এই মার্জিত রুচির প্রকাশ দেখা দিয়েছে।
যারা মুখে জাতিভেদ স্বীকার করে না, তাদের মতের অগ্নিপরীক্ষা বিবাহে। প্রেমের বিবাহে বহু ক্ষেত্রেই জাতিভেদ লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু সম্বন্ধ করে যে বিয়ে ঠিক হয় সেগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বজাতি, ভিন্নগোত্র, সবর্ণ, এ সব সযত্নে রক্ষিত হয়। অথচ শিক্ষিত পাত্রেরা মুখে জাতিভেদ স্বীকার করে না। কাজের বেলায় পরিবারের সিদ্ধান্ত নিষ্প্রতিবাদে মেনে নেয়। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে প্রায়ই চোখে পড়ে সবর্ণ অথবা উচ্চ অসবর্ণ! কোথায় থাকে জাতিভেদ সম্পর্কে নীতিগত আপত্তি, শিক্ষালব্ধ যুক্তি? যুক্তি কি শুধু তর্ক করবার সময়ে কাজে লাগে, জীবনযাত্রায় তা অনায়াসে পদদলিত করা যায়?
এমনই আর একটা বিষয় বিবাহে পণযৌতুক নেওয়া। শিক্ষিত ছেলেরা প্রায় সকলেই মুখে পণপ্রথার বিরোধী। তার একটা কারণ আইন এর বিপক্ষে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ছেলেরা সবাই দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের ব্রজেশ্বরের মতো পিতৃভক্ত হয়ে যায়, বুদ্ধিতে যুক্তিতে যাকে সমর্থন করা যায় না। এই সব বুদ্ধিমান শিক্ষিত পাত্ররা তখন গোপনে ওই দিকটা মা-বাবার হাতে সঁপে দেয়, মুখে বলে, “ওসব গুরুজনেরা ঠিক করবেন আমি এর কিছু জানি না।’ সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। সব শিক্ষা, যুক্তি নগদ প্রাপ্তি লোভের সামনে বিলীন হয়ে যায়। ইদানীং পণ নেওয়ার অপরাধে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সাজা হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরা যথার্থই পণ নেওয়ার হীনতা সম্বন্ধে অবহিত হচ্ছে, তাই খুব সামান্য সংখ্যায় হলেও পণ ছাড়া বিয়েও হচ্ছে। শুভ লক্ষণ, সন্দেহ নেই, কিন্তু এখন সমাজে পণ দিয়ে বিয়ের সংখ্যাই বেশি। স্নেহলতাদের জীবনদান অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষা বা শিক্ষালব্ধ যুক্তি জীবনে উপেক্ষিত।
তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেও জ্যোতিষের প্রভাব প্রবল। বিজ্ঞানীরা ও যুক্তিবাদীরা জানে জ্যোতিষ কোনও বিজ্ঞান নয়, নেহাতই একটা ভিত্তিহীন ধোঁকা। কিন্তু অন্নপ্রাশন, বিয়ে বা অন্য তথাকথিত শুভকর্মের লগ্ন নির্দিষ্ট হয় জ্যোতিষের গণনায়, অথবা পঞ্জিকায় নির্দিষ্ট লগ্ন থেকে। বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী মানুষ মাত্রই জানে, যে নক্ষত্রের আলো থেকে হিসাব করা হয়, সে নক্ষত্র থেকে আলো নির্গত হয়েছে লক্ষাধিক বছর আগে, সেই রশ্মি থেকে আজকের গণনা সম্পূর্ণ অর্থহীন, তার সিদ্ধান্তও সম্পূর্ণ অলীক। তবু জ্যোতিষীর নির্দেশে গৃহশান্তির জন্য আংটিতে রত্নধারণ, কবচ-মাদুলি-তাবিজ ধারণ চলছে; শিক্ষিত এবং তথাকথিত যুক্তিবাদী মানুষও তা করছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষিত সমাজে এ সব ধারণ করা বেড়েই চলেছে, এবং বলাই বাহুল্য এগুলো অলংকার ধারণ নয়। ‘বিপত্তারিণী’র সূত্র ও অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করে অনেকেই, নিঃসংকোচে, প্রকাশ্যে। অর্থাৎ তথাকথিত যুক্তিবাদীরা অসংকোচে অযৌক্তিক কুসংস্কারের বশে চলে, এবং এটা বোধহয় ইদানীং বেড়েই চলেছে। আচরণে যারা কুসংস্কারের বশে চলে কথায় তারা নিজেদের যুক্তিবাদী বললে সেটা অসত্যই হয়। কথায় ও কাজে এক হওয়া চাই।
এ ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে গত ক-বছর দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত উঁচু চাকুরে, অধ্যাপিকা, বিজ্ঞানচর্চায় কৃতী মেয়েরাও কোনও কোনও ঠাকুরের তিথি উপলক্ষে কপালের মাঝামাঝি পর্যন্ত নেমে আসা সিঁথিতে চওড়া সিঁদুরের রেখা, বড় টিপ, ব্রতধারিণীর মতো মাথা ঘিরে কাঁধ পর্যন্ত নামা আঁচল, হাতে ধরা নৈবেদ্যের থালা, স্বপ্নচারিণীর মতো চলেছে মন্দিরে বা দেবস্থানের উদ্দেশে। কর্মস্থলে বা বাড়ির মধ্যে, সভা-সমিতিতে এরা যুক্তিবাদী, কিন্তু সে যুক্তির পরিধি ওই পর্যন্তই। তার বাইরের জগৎ কুসংস্কার দিয়ে ঘেরা এবং বিস্ময় ও দুঃখের বিষয় যুক্তি ও জীবনচর্চার বিরোধে এঁদের কিছুমাত্র সংকোচ নেই। অর্থাৎ আসলে এঁরা বাইরের সমাজে যুক্তিবাদীরূপে পরিচিত হতে চাইলেও সধর্মীদের বা সহ-সংস্কারবাদীদের মধ্যে সহজেই চলাফেরা করেন। শাঁখা, কড়া, লোহা (নানা কিসিমের) সিঁদুর আলতা, কিছু কিছু মাদুলি ও আংটি ও হারে রত্ন, কবচ-মাদুলি ধারণ করতে এঁদের কিছুমাত্র সংকোচ নেই।
অস্যার্থ, যুক্তিবাদ একটা বাইরের পোশাকমাত্র হয়ে উঠলে শিক্ষিত মানুষের ভণ্ডামিটাই প্রকট হয়ে ওঠে। সুখের কথা, এখন বেশ কিছু মেয়েই শাঁখা-সিঁদুর বর্জন করেছে। পুরুষ বিবাহের কোনও চিহ্ন দেহে বা পোশাকে ধারণ করে না, মেয়েরা কেন করবে? ওই সব ধারণ করা সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ নারী বিধবা হয়েছে এবং পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ধারণ করার নীতিই নেই। সে সব দেশে কি সব নারী বিধবা হয়? একটু ভেবে নিজের আচরণ ঠিক করলে কাজে ও কথায় সংগতি থাকে, তাতেই যুক্তিবাদীর সংজ্ঞা যথার্থ হয়ে ওঠে, নইলে, কথায় এক, কাজে আর এক হলে মানুষ অসৎ বলে প্রমাণিত হয়।
বিবাহ, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, এগুলি ধর্ম ও সংস্কার-নিরপেক্ষ, কাজেই সকল যুক্তিবাদীই এগুলিতে যোগ দিতে পারে, কাজে ও কথায় কোনও বিরোধ থাকে না। শুভ অনুষ্ঠান মাত্রেই ধর্ম বা সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত নয়। মানবিক স্তরে যা শুভ, আনন্দের, তাতে সকলেই পরিপূর্ণ চিত্তে যোগ দিতে পারে, যুক্তি ও আচরণে কোনও বিরোধ থাকে না তাতে। এ দেশে সুদীর্ঘকালের চলিত একটা অভিবাদন গুরুজনকে প্রণাম করা। অবশ্য অনেক প্রদেশে এর চল নেই। নতিস্বীকার করার জন্য পা ছোঁওয়া নিতান্ত অনাবশ্যক। আমাদের দেশে চমৎকার অভিবাদন প্রথা নমস্কার তো আছেই। এ সত্ত্বেও ‘নম্’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘প্রণাম’। পা না ছুঁয়ে জোড়হাতে মাথা সামান্য নুইয়ে নমস্কার উচ্চারণ করাটাই অনেক বেশি রুচিসম্মত। নমস্কারে ভদ্রতা, নত হওয়া আছে, কিন্তু পা ছোঁওয়ার দৃষ্টিকটু দীনতা নেই। ইসলাম, পারসি অন্যান্য সমাজে প্রণামের মতো দৈন্যসূচক কোনও অভিবাদন নেই।
এ প্রসঙ্গ এখন কেন? প্রথম কারণ, এখন এ দেশে অযৌক্তিকতার, কুসংস্কারের নতুন এক প্রাবল্য দেখা দিচ্ছে, শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষও জীবনচর্যার, অর্থাৎ দৈনন্দিন আচরণে অযৌক্তিক হয়ে যাচ্ছে। এক দিকে অমুক-মা, তমুক-বাবার প্রাদুর্ভাব ঘটছে এবং দলে দলে শিক্ষিত মানুষ তাদের ভক্ত হয়ে উঠছে। যুক্তি নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে, নতুন পুজো তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কুসংস্কার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়ছে। এরই সঙ্গে আছে বার তিথি, কবচ-মাদুলি-আংটি, ‘সূত্র’ ইত্যাদি ধারণ— এর মধ্যে যুক্তির অবকাশ কোথায়? দেখা যাচ্ছে, তথাকথিত শিক্ষার সঙ্গে যুক্তির কোনও যোগ নেই। দেশে ‘শিক্ষিত’ লোকের চেয়ে অনেক বেশি দরকার যুক্তিবাদী মানুষ।
তার এত অভাব ঘটল কেন? একটা কারণ হল দেশের যা আর্থিক অবস্থা তাতে ধনীর নিরাপত্তার আশ্বাস টলে যাচ্ছে, তাই সে অলৌকিকের আশ্বাসের জন্য উৎকণ্ঠিত। মধ্যবিত্তের পায়ের তলার মাটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে, চাকরি ও ব্যবসার স্থায়িত্ব বা উন্নতি প্রায়ই মরীচিকার মতো ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, নিম্নবিত্তের তো অনেক আগে থেকেই অনিশ্চয়তা বাড়ছে— ছাঁটাই, লক আউট-এ; চাষির যাচ্ছে খরা, বন্যা ও শোধ না করা কৃষিঋণের চাপে। অনেকেই আত্মহত্যা করেছে, জীবনমৃত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এ অবস্থার প্রতিকার সরকার করবে না, কাজেই মানুষ প্রতিকারের আশ্বাসে যে-কোনও আশ্রয় অবলম্বন করতে চাইবেই। তা সে সত্যকার আশ্রয়ই হোক আর ভ্রান্ত আশ্বাসই হোক।
এই ভ্রান্ত আশ্বাসের সব চেয়ে বড় উৎসব হল ধর্ম। স্বয়ং ভগবান কোনও কিছুর পেছনে আছেন জানলে মানুষ চূড়ান্ত আশ্বাস পায়। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এই সব ‘মা’ ও ‘বাবারা’ তো সাক্ষাৎ ভগবানের অবতার বা প্রতীক রূপে অবতীর্ণ, এমন প্রচারই তারা করে থাকে। কাজেই প্রচ্ছন্ন, প্রায়-অদৃশ্য এক যোগসূত্রে মানুষের সত্যকার অভাব অভিযোগ ও ভগবানের প্রতীক ‘মা’ ‘বাবা’রা যুক্ত। এই সুতোটি সরকারের হাতে, ধনী যাতে আরও ধনী হয়, গরিব যাতে সর্বহারা হয়, তার চেষ্টা নিরন্তর চলছে দেশের আভ্যন্তরীণ শাসন ও আর্থনীতিক ব্যবস্থায়। বিস্তর অবৈধ উপায়ে বিশিষ্ট উচ্চপদস্থ দুর্জনদের প্রমত্ত লোভের ফলে পুকুরচুরি, অনাদায়ী ঋণ (ব্যাঙ্কে ও অন্যত্র)। বিচিত্র পন্থায় শোষণ ও ফাঁকির ব্যবসায়ে তেরো চোদ্দোশো কোটি কালো টাকার মুনাফায় গরিব দেশটা আরও গরিব হয়ে যাচ্ছে। এবং তার সঙ্গে জুটেছে বৈদেশিক আর্থিক আক্রমণ। ভোগ্য পণ্যসম্ভারের প্রলোভনের সঙ্গেই আছে অভাবের দরুন সে সব কেনার অক্ষমতা। এ সব যে ব্যর্থতাবোধ জাগায় তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য একটা কিছু অতিলৌকিক শক্তিকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক। এবং এইখানেই প্রশ্ন আসে যুক্তির ভূমিকা তা হলে কোথায়? অলৌকিক শক্তির কাছ থেকে সাহায্য বা প্রশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা কি কোনও যুক্তিবাদী মেনে নিতে পারে? চিরাচরিত ধর্মাচরণের মধ্যে যে যুক্তিবিরোধিতা আছে তা কি নিষ্প্রতিবাদে গ্রহণ করা যায়? মানুষের আচরণই তার ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে। সে আচরণ যুক্তিবাদীর এক রকম, গতানুগতিকে অনুগামীর আর এক রকম
আমাদের, যুক্তিবাদীদের আচরণ যেন যুক্তিবহির্ভূত না হয়। এ জন্যে সর্বদা সতর্ক না থাকলে শুধু আমাদেরই দ্বিচারিতা প্রকাশ পাবে না, সমাজের, দেশের অগ্রগতিও সেই মাত্রায় প্রতিহত হতে থাকবে।