মুখোশের আড়ালে

মুখোশের আড়ালে

মুখোশের আড়ালে

একাকীতু যেন দাঁত মুখ খিচিয়ে গিলতে আসে রবিনকে। ক্লাসমেটদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় ও। কিন্তু গ্রীন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছেলেগুলো যেন কেমন! মিশতেই চায় না রবিনের সঙ্গে। ওকে বহিরাগতদের মত দেখে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। করে। ওকে খেলতে ডাকে না, কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে না। একরকম একঘরেই করে রেখেছে ওরা রবিনকে।

কিন্তু রবিনের দোষ কী? রবিন তো নিজের কোন ক্রটি খুঁজে পায় না। ও সবার। সাথে মিশতে চায়, বন্ধু হতে চায়। ক্লাসমেটরা দূরে দূরে সরে থাকলে ওর কী করার আছে? রবিন ভেবেছিল অন্তত আজকের দিনটা ওরা ওকে কাছে ডেকে নেবে। আজ বিশেষ একটি দিন। হ্যালোউইন ডে। আজ নানা ভূতুড়ে মুখোশ পরে মজা করবে। রবিনের ক্লাসমেটরা-জনি, রিন্টু, লিটন, আবিদ, জেসি সবাই। ওদের আনন্দের ভাগীদার হতে চেয়েছিল রবিন। আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিল দলটার সঙ্গে যোগ দিতে পারবে কিনা। দেখি বলে ওকে পাশ কাটিয়ে গেছে জনি। জেসি শুধু মুচকি হেসেছে। আবিদ তো মুখের ওপর না-ই বলে দিল! আর লিটন খ্যাক খ্যাক করে। উঠেছে, আমাকে বিরক্ত কোরো না তো!

ভীষণ অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে রবিনকে। মন খারাপ করে বাড়ির রাস্তা ধরেছে। স্কুল থেকে খুব বেশি দূরে নয় বাসা। হেঁটেই যাওয়া যায়। ঢাকায়। নতুন এসেছে রবিনরা। এর আগে খুলনা ছিল। ওর বাবা-মা সরকারী চাকুরে। দুজনেই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তবে বাবা বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন না। ফলে প্রায় প্রতি বছরই স্কুল বদলাতে হয় রবিনকে। ওর প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। এখন লাগে না। বরং নতুন জায়গা, নতুন মানুষ দেখতে ভালই লাগে। বাবা-মা তেল, জল, উদ্ভিদ, প্রাণীদের স্যাম্পল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। বর্তমানে এ সবেরই কিছু একটা নিয়ে গবেষণা করছেন ওঁরা। তবে রবিন ঠিক জানে না। বাবা-মার কাজে ওর নাক গলানো কঠোরভাবে নিষেধ।

নতুন স্কুলের ছেলেমেয়েগুলো এত বাজে হবে জানত না রবিন। জানলে এ স্কুলে ভর্তি হত না। বাবা-মা ঢাকা থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলেই ভাল। এরকম পচা সহপাঠীদের সঙ্গে বেশিদিন সহাবস্থান করতে পারবে না রবিন। রবিনের মুখ শুকনো দেখে মা জানতে চাইলেন, কী হয়েছে রে? মা পেছনের ঘরে কাজ করছিলেন। হাতে মাটি লেগে আছে। তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললেন, তোর চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন?

আজ হ্যালোউইন ডে, মা, গুঙিয়ে উঠল রবিন, ধপ করে বসে পড়ল একটা সোফায়। স্কুলের সবাই হ্যালোউইন ডে পালন করবে ঠিক করেছে। আমি ওদের সাথে যোগ দিতে চাইলাম। কেউ আমাকে নিল না। তাছাড়া হ্যালোউইন ডে-তে পরার মত কোন ড্রেসও আমার নেই।

হ্যালোউইন ডে-র মজা হয় রাতে, সান্ত্বনার সুরে বললেন মা। হাতে ঢের সময় আছে। তোকে একটা ড্রেস বানিয়ে দেবখন।

রবিনের বাবা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, রাবারের গ্লাভ পরা হাতে একটা গাছ। হ্যালোউইন ডে তো পালন করে আমেরিকা-ইউরোপের ছেলেমেয়েরা। তোদের স্কুলেও এসব পালন করা হয় নাকি?

আমাদের স্কুলে হয় শুনেছি, মুখ গোমড়া হয়ে আছে রবিনের। টিভিতে দেখেছি হ্যালোউইন নাইটে অনেক মজা হয়। নানা রকম ভূতুড়ে মুখোশ পরে সবাই…

তোর স্কুলের ছেলেমেয়েরা কে কী পরবে? জিজ্ঞেস করলেন মা!

ওরা বলল সবাই নাকি চুলে রঙ করাবে, তারপর মুখোশ পরবে, মুখে থাকবে বড় বড় দাত। তবে সবাই একই রকম সাজবে। আমি অন্যরকম সাজতে চাই।

হঠাৎ হেসে উঠলেন বাবা। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, বললেন তিনি। তুই প্রতিদিন যেভাবে স্কুলে যাস, আজ রাতে সেভাবে যাস না কেন? স্বাভাবিক পোশাকে?

দারুণ বুদ্ধি, বাবাকে তারিফ করলেন মা। সবাই ডাইনী বা ভূত সেজে আসবে। আর তুই যাবি স্বাভাবিক চেহারা নিয়ে। বেশ মজা হবে।

মোটেই মজা হবে না, গোমড়া মুখে আরও আঁধার ঘনাল রবিনের। ওরা ভাববে হ্যালোউইন ডে-তে পরার মত কোন ড্রেসই আমার নেই। আমি ফকির।

আরে, ওরা তো সবাই সেই পুরানো সাজেই সাজবে, ওকে উৎসাহ দিতে চাইলেন বাবা। একমাত্র তুইই কোন ড্রেস পরবি না। তোর সাজটা হবে সবার থেকে আলাদা। দেখবি সবাই কেমন বেকুব বনে গেছে।

মনে মনে কী যেন ভাবল রবিন। তারপর হাসি ফুটল ওর মুখে। কথাটা মন্দ বলোনি, বাবা। আমাকে সাধারণ পোশাকে দেখে ওরা বেকুব বনেও যেতে পারে। আর আমাকে দেখে বোকা না বলে বুঝব ব্যাপারটা ওদের মাথাতেই ঢোকেনি।

এই তো ব্যাটা ছেলের মত কথা! সাবাস দিলেন বাপ তার সন্তানকে। রবিন তক্ষুণি স্কুল ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়ল নিজের ঘরে। মা এলেন পিছু পিছু। বললেন, শুনেছি, তোর সহপাঠীগুলো তেমন ভাল না। তাই একটু সাবধানে থাকিস। ওরা যদি তোকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করে কিছু বলিস না যেন।

কিছু বলব না, মা, মাকে আশ্বস্ত করে রবিন। দাঁড়ায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। চুল আঁচড়াতে থাকে।

সন্ধ্যার পরপর বেরিয়ে পড়ল রবিন। এদিকটা এমনিতেই নির্জন, সন্ধ্যার পরে লোক চলাচল আরও কমে যায়। রাস্তার সোডিয়াম বাতির মরাটে আলোয় কেমন ভূতুড়ে লাগে চারপাশ। নির্জনতা যেন ছেকে ধরে রবিনকে। ভয় ভয় লাগে। ও দ্রুত পা চালায় স্কুলের দিকে। ওখানেই পালন করা হবে হ্যালোউইন নাইট।

বড় রাস্তার মোড়ের ধারে চলে এসেছে রবিন, এমন সময় দেখতে পেল দলটাকে। রাস্তার পাশের একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। পিশাচদের একটা দল। ভূত, প্রেত, ভ্যাম্পায়ার সবাই আছে সেই দলে। ওদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আশায় দ্রুত পা চালাল রবিন।

রবিনকে দেখে ফেলল ওরা। ওটা কেরে? ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখোশ পরা একজনের ফাসফেসে গলা শোনা গেল।

কঙ্কাল সাজা একজন রবিনের পাঁজরে গুঁতো দিল আঙুল দিয়ে। তোমাকে তো কেউ আসতে বলেনি।

জিন্দালাশের মুখোশ পরা আরেকজন লম্বা নখ বাগিয়ে প্রায় ঝাপিয়ে পড়ল রবিনের ওপর। বু! বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল সে।

ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল রবিন, হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা ঝোপের ওপর। হা হা করে হেসে উঠল সবাই। তারপর হাটা দিল।

কে রে ছেলেটা? বড় রাস্তায় উঠে পড়েছে ওরা, একজনের গলা শুনতে পেল রবিন।

স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে, জবাব দিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। রবিন না কি যেন নাম।

হাঁচড়েপাঁচড়ে বোপ থেকে উঠে পড়ল রবিন। গা চুলকোচ্ছে। দুএক জায়গায় ছড়েও গেছে। দুঃখে-অপমানে জল এসে গেছে চোখে। একবার চিন্তা করল বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু বাবা-মা ওর এই দশা দেখলে কষ্ট পাবেন ভেবে নাকচ করে দিল। চিন্তাটা। না, সিদ্ধান্ত নিল রবিন। সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র আমি নই। সে

আবার হাঁটতে শুরু করল স্কুলের উদ্দেশে।

যাবার পথে একটা বাড়ির বাগানে একটা নেকড়ে মানব, দুজন ফুটবল খেলোয়াড় আর এক এক-চোখা দানবকে লাফালাফি করতে দেখল রবিন। খুব মজা করছে ওরা। ওদের হাতের ব্যাগগুলো ফুলো ফুলো। বোঝা যায়, উপহারে ভর্তি। ওদেরকে ডাক দেবে রবিন, এমন সময় একজন চিনে ফেলল ওকে। হেঁকে বলল, ওই দ্যাখ রবিন!…কী ব্যাপার রবিন? তোমার হ্যালোউইন ড্রেস কোথায়?

ওর বোধহয় হ্যালোউইন ড্রেস কেনার পয়সা নেই, মন্তব্য করল আরেকজন। শুনে অন্যরা হেসে উঠল হো হো করে। রবিনের লাগল খুব। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। মুখ নিচু করে চলে এল ওখান থেকে।

আবার হাঁটতে শুরু করেছে রবিন। ভাবছে লোকের বাড়িতে কড়া নেড়ে ঘাউ করে চিৎকার করে তাদেরকে চমকে দিলে কেমন হয়? কিন্তু সবাই কি জানে আজ হ্যালোউইন ডে? দেখি না একবার চেষ্টা করে। ভাবল রবিন। সে একটা বাড়ির কলিংবেল টিপল। দরজা খুলে দিলেন এক বয়সী ভদ্রলোক। তিনি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন রবিনের দিকে। রবিন কিছু বলতে যাবার আগেই ভদ্রলোকের পেছন থেকে বেরিয়ে এল ছোট একটা ছেলে। রাক্ষস সেজেছে সে। রবিনকে দেখে নখ বাঁকিয়ে হাউ মাউ খাউ বলে উঠল। রবিন ওকে দেখে হাসল। ছেলেটা ভদ্রলোকের দিকে টলটলে দুই চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, বাবা, ওকি জানে না আজ হ্যালোউইন ডে?

জানি তো, হাসিমুখে বলল রবিন। আমি—

না। তুমি জানো না? প্রতিবাদ করল বাচ্চা। তোমার হ্যালোউইন ড্রেস কই? তোমার মুখে মুখোশও নেই।

আহ, এভাবে বলে না, রন্টি, বললেন ভদ্রলোক। রবিনকে একটা ক্যান্ডি বার ধরিয়ে দিলেন, রন্টির কথায় কিছু মনে কোরো না, কেমন? আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

এক মুহূর্ত ওখানে দাঁড়িয়ে রইল রবিন। শুনল বাচ্চাটা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, ওর মুখোশ নেই কেন, আব্বু?

মুখোশ কেনার পয়সা নেই বোধহয় ছেলেটার, জবাব দিলেন রন্টির বাবা। আর সবাই তো তোমার মত হ্যালোউইন ডে বলে অস্থির হয়ে ওঠে না।

আবার মন খারাপ হয়ে গেল রবিনের। ওর আসলে আজ বেরুনোই উচিত হয়নি। গুলশানের বড়লোকের ছেলেদের এসব মানায়। তারা সাড়ম্বরে হ্যালোউইন ডে পালন করে। তার মত মধ্যবিত্ত ছেলে হ্যালোউইন ডে পালন করার জন্য একেবারেই বেমানান। এ জন্যই জনিরা ওকে দলে নিতে চায়নি, এতক্ষণে বুঝতে পারছে রবিন। নাহ, একদম বোকা বনে গেছে রবিন। আর কখনও সে এসব হ্যালোউইন ডে-ফে-তে অংশ নেবে না। স্কুল ব্যাগটার দিকে তাকাল রবিন। ওটা প্রায় খালি। শুনেছে হ্যালোউইন ডে-তে নানা জনে নানা উপহার দেয়। কিন্তু রবিন কোন উপহার পায়নি। বাবা-মাকে বড় মুখ করে বলে এসেছিল ব্যাগ ভর্তি উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ওর খালি ব্যাগ দেখে বাবা-মা হয়তো কষ্টই পাবেন। ভাববেন, ছেলেটার সত্যি কোন বন্ধু নেই।

পকেট হাতড়ে পঞ্চাশটা টাকা পেল রবিন। এ দিয়ে কিছু চকলেট কিনবে সে। অন্তত বাবা-মাকে দেখানো যাবে চকলেট উপহার পেয়েছে।

গুলশান গোল চক্করের দিকে পা বাড়িয়েছে রবিন, এমন সময় কে যেন উঁচ গলায় ওর নাম ধরে ডাকল। এই যে, রবিন। হ্যালোউইন ডে-তে এমন দশা কেন তোমার?

ঘুরল রবিন। অন্ধকার মোড় থেকে বেরিয়ে এল ওরা, খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে।

আমি ওর রক্ত খাবোওওও! বলল ড্রাকুলার মুখোশ পরা একজন।

একটা মেয়ে পাউডার মেখে মুখটাকে ফ্যাকাসে করে রেখেছে, চোখের নিচে কালো, মোটা দাগ। ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। সে খিকখিক হাসল। আমি ডাকলার বউ। তুমি কে হে? বখাটে? * বখাটেই বটে, বলল এক জলদস্যু। তার এক চোখে কালো তাঞ্জি, হাতে নকল বড়শি, কোমরের বেল্টে কার্ডবোর্ডের তরবারি গুজে রাখা। দেখি তো ওর ব্যাগে কী ধন সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে। ঘোত ঘোত করে উঠল সে। খপ করে চেপে ধরল রবিনের ব্যাগ।

আমাকে ছেড়ে দাও! হিসিয়ে উঠল রবিন, টান মেরে ছাড়িয়ে নিল ব্যাগ।

লংজন সিলভার যা চাইছে ভালয় ভালয় ওকে তা দিয়ে দাও, বলল একটা ছেলে। তার মাথায় রাবারের ছোরা গাথা, সারামুখে নকল রক্ত দিয়ে দাও বলছি। নইলে আমার মত দশা হবে তোমারও।

দলটা বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে রবিনকে হাসছে, তামাশা করছে ওকে নিয়ে। জলদস্যু সংজন সিলভার কার্ডবোর্ডের তরবারি দিয়ে খোচাতে শুরু করল রবিনকে। ড্রাকুলা নকল দাঁত নিয়ে মুখ খিচাচ্ছে। রবিনের শরীর ঘামতে লাগল, অপমানে জ্বালা ধরে গেছে গায়ে। ছেলেগুলোকে চিনতে পেরেছে ও। জনি সেজেছে ড্রাকুলা, জেসি হয়েছে ড্রাকুলার বউ। আবিদ জলদস্যু আর লিটন মাথায় নকল ছুরি গেঁথে রেখেছে। এদেরকেই সকালে রবিন অনুরোধ করেছিল ওদের দলে নেয়ার জন্যে।

তুমি এমন সাধারণ বেশে রাস্তায় বেরুলে কেন, বোকা? হাসতে হাসতে বলল জনি।

জলদস্যু আবিদ রবিনের কাধে ধাক্কা দিল। ঘটনা কী, রবিন খোকা? তোমার কি কোন বন্ধু নেই?

বুকের ভেতর ব্যথা হচ্ছে রবিনের। সত্যি তো ওর কোন বন্ধু নেই। ওদের দিকে একবার তাকাল সে। তারপর মুখ নিচু করল।

কী ব্যাপার, জবাব দিচ্ছ না কেন? বলল আবিদ।

অ্যাই, চলে এসো তোমরা, বলল জেসি, ওর চক সাদা মুখখানায় সহানুভূতির ছাপ। এভাবে ওকে আর অপমান কোরো না।

একটা মুখোশ কিনতে পারো না! বিস্ময় প্রকাশ করল আবিদ। এতই ফকির তুমি।

ওর মা তার বখাটে ছেলের জন্য কোন ড্রেস বানিয়ে দিতে পারেনি, কপালের ছুরিটা খুলে পড়ে যাচ্ছিল, ওটা সামলাতে সামলাতে বলল লিটন।

আমার মা ঠিকই ড্রেস বানিয়ে দিয়েছে, গর্জে উঠল রবিন। তোমরা অন্ধ। তাই চোখে দেখতে পাও না।

আহ-ওহ, বিদ্রুপ করল জনি। বেচারী রবিন পাগল হয়ে যাচ্ছে।

তুমি কী সাজতে চেয়েছ? আবিদ তরবারি দিয়ে আরেকটা খোঁচা দিল রবিনকে।

এমন কিছু যা কেউ কখনও কল্পনাও করেনি, বলল রবিন। আমার বাবার আইডিয়া ওটা।

আইডিয়াটা কী, শুনি? জানতে চাইল আবিদ। তোমাকে তো সেই আগের মতই বোকা বোকা টাইপের লাগছে।

আইডিয়াটা হলো, গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল রবিন। সাধারণ বেশে বেরিয়ে পড়া।

ফু! হেসে উঠল জনি। সাধারণ বেশে বেরিয়ে পড়া। এটা একটা আইডিয়া হলো?

হেই, বলল জেসি, তোমার মা না একটা ড্রেস বানিয়ে দিয়েছে বললে। ওটা পরে আসোনি কেন?

আমার মা- বলতে গেল রবিন।

কথা শেষ করার আগেই ওর হাত থেকে জলদস্যু আবিদ ছিনিয়ে নিল ব্যাগটা।

আমার ব্যাগ ফিরিয়ে দাও, রেগে গেল রবিন। ফিরিয়ে দাও বলছি। নইলে কিন্তু-

নইলে কী? মুখ ভেংচাল আবিদ। বাবা-মার কাছে গিয়ে নালিশ করবে?

হ্যাঁ, তাই করব, ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইল রবিন। আমার বাবা-মার অনেক ক্ষমতা। তারা তোমার বারোটা বাজিয়ে দেবেন।

তাই নাকি? হা হা করে হেসে উঠল আবিদ। কী রকম বারোটা বাজাবেন, শুনি?

সাবধান! সাবধান! মুখ টুখ ভেংচে বিচিত্র একটা ভঙ্গি করল জনি। আমি খুউউব ভয় পাচ্ছি। রবিনের বাবা-মা কিন্তু খুব শক্তিশালী। তা কোথায় কাজ করেন তারা?

শাক্কুরা গ্রহে। চিৎকার করে উঠল রবিন।

শাক্কুরা গ্রহ? সেটা আবার কোথায়। হেসে উঠল জেসি।

গ্রহটার নাম শাক্কুরা নাকি শুক্র? মুখ বাঁকাল জনি।

গ্রহের নামও ঠিক মত বলতে পারো না। অথচ গপ্পো মারতে এসেছ।

আগুন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল রবিন। এত রেগে গেছে যে কথা ফুটছে না মুখে।

জনি বলল, তা তোমার গ্রহের গল্প একটু বলো না শুনি। শুনে ধন্য হই আমরা। জ্ঞান বাড়ক আমাদের।

তোমরা খুবই বোকা, গনগনে গলায় বলল রবিন। তোমরা আসলে-

আমরা আসলে কী, অ্যাঁ? বোকা বলায় রেগে গেছে জনি। ঘুসি মারল সে রবিনের বুকে। ঘুসি খেয়ে আবিদের গায়ে পড়ে গেল রবিন। আবিদ ওকে ধাক্কা মারল। হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল রবিন। তীব্র ঘৃণা নিয়ে। তাকিয়ে থাকল ওদের দিকে।

তোমার শাক্কুরা না ফাকুরা গ্রহের গল্প শোনালে না? হাসি মুখে বলল জনি। তোমার বাবা-মার গল্প? কী করেন তাঁরা?

তারা বিজ্ঞানী, চিৎকার করে বলল রবিন। তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে দেখতে, পৃথিবী দখল করে নেয়া যায় কিনা। আমার বাবা-মার মত ভাল বাবা-মা গোটা ব্রহ্মাণ্ডে আর একটিও নেই। ওরা আমার জন্য সব কিছু করেন। আমার মা আমার জন্যে একটা মুখোশ বানিয়ে দিয়েছেন। সেই মুখোশ পরে আমি প্রতিদিন স্কুলে যাই। সেই মুখোশই আমি এখনও পরে আছি। এটা সাধারণ একটা ছেলের মুখোেশ। তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না করো তাহলে দেখিয়ে দিচ্ছি।

হাসল জনি, তোমার মাথা আসলেই ঠিক নেই, খোকা। তুমি–

গলা থেকে আর স্বর বেরুল না ওর। মুখ থেকে হাসি মুছে গেল বেমালুম, সেখানে ফুটে উঠল নির্জলা ভয় আর আতঙ্ক। রবিনকে দেখছে ও। রবিন মুখোশ খুলে ফেলছে-সাধারণ ছেলের মুখোশ।

চিৎকার করে উঠল জেসি।

আঁতকে উঠল লিটন।

মুখ হাঁ হয়ে গেল আবিদের।

সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে রবিনের দিকে। রবিনের হাতে মানুষের মুখের মুখোশ…ওর আসল মুখটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল সকলে। মুখটা মাছের আঁশের মত আঁশ দিয়ে ঢাকা, শ্বাপদের মত হলুদ চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। রাগে ফেটে পড়ছে।

রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল ওদের চারজনের সম্মিলিত ভয়ার্ত চিৎকারে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে ওরা ছুটল যে যার বাড়ির উদ্দেশে। আর ভয়ঙ্কর মুখটা কুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের গমন পথের দিকে।

বাড়ি ফেরার পথে মানুষের মুখোশটা আবার পরে নিল রবিন। ঘরে ঢোকামাত্র বাবা-মা বুঝে ফেললেন কিছু একটা ঘটিয়ে এসেছে তাদের ছেলে।

কোন সমস্যা? জানতে চাইলেন বাবা।

বিরাট সমস্যা, বাবা। বলল রবিন।

মা ছেলের কাধে একটা হাত রাখলেন। কী হয়েছে বল তো, বাপ।

চেয়ারে বসল রবিন। ছেলেগুলো এত খারাপ! হাঁপাচ্ছে ও। আমার সাথে শুধু শুধু ইয়ার্কি মারছিল, ধাক্কা দিচ্ছিল। শেষে আমি আর সইতে না পেরে

ওহ, রবিন। না! আঁতকে উঠলেন মা। তুই নিশ্চয়ই

দুঃখিত, মা, কেঁদে ফেলল রবিন। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। ওরা তাহলে তোর পরিচয় জেনে গেছে? গম্ভীর গলায় বললেন বাবা। আমাদের কথাও বলে দিয়েছিস?

কাঁদতে কাঁদতে মাথা দোলাল রবিন।

তাহলে আর কি, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মা। এখানকার পাততাড়ি আবার গোটাতে হবে।

সবকিছু গুবলেট করে ফেলেছি আমি, অপরাধীর গলায় বলল রবিন। সব আমারই দোষ। আমি

হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ হলো বাসার সামনে। কথা শেষ করতে পারল না রবিন। দ্রুত জানালার সামনে গিয়ে পর্দা উঁচিয়ে দেখল।

পুলিশ! আর্তনাদ করে উঠল রবিন। ছেলেগুলো নিশ্চয়ই আমার কথা বলে দিয়েছে পুলিশকে।

শান্ত হও। বললেন ওর বাবা। জানালার সামনে গিয়ে উঁকি দিলেন।

ওরা এদিকেই আসছে! কাঁপা গলায় বলল রবিন। দুজন!

রবিনের কাধের ওপর থেকে স্ত্রীর দিকে তাকালেন বাবা। প্রাণীদের স্যাম্পল কেমন জোগাড় হয়েছে।

মন্দ না, জবাব দিলেন রবিনের মা। তবে মানুষ স্যাম্পল জোগাড় করতে পারলে আরও ভাল হয়। দরজায় সজোরে কড়া নড়ে উঠল।

বেশ। বললেন রবিনের বাবা। শহর ছাড়ার আগে এক জোড়া মানুষ নিয়ে বি শ্রামরা কুরায় স্যাম্পল হিসেবে।

বুদ্ধি খারাপ না, হাসলেন রবিনের মা।

রবিনের বাবা খুলে দিলেন দরজা। গুড ইভনিং, অফিসার। বললেন তিনি। কোন সমস্যা?

একটা অদ্ভুত ফোন পেয়ে এসেছি আমরা, বলতে লাগল মোটা পুলিশ অফিসার। এখানে একটা ছেলে থাকে। সে নাকি ভিনগ্রহের দানব।

আমার ধারণা, এটা হ্যালোউইন নাইটের কোন ঠাট্টা, বলল অপরজন। তবু আমাদের একবার চেক করে দেখতে হবে।

অবশ্যই, খুশি খুশি গলায় বললেন রবিনের বাবা। ভেতরে আসুন আপনারা, অনুগ্রহ করে চলে আসুন।

পুলিশ দুজন ভেতরে পা বাড়াল। তারা জানে না তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে!

[ডন উলফসনের দ্য ফ্রাইট মাস্ক অবলম্বনে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *