পালাবার পথ নেই
পালাবার পথ নেই
কলিংবেলের শব্দে জেগে উঠল শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড। চট করে চোখ চলে গেল বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা সুদৃশ্য ঘড়িটার দিকে। রাত একটা। কপালে ভাঁজ পড়ল ওর। এমন বৃষ্টির রাতে কে এল? ঘন ঘন, টুং টাং শব্দে আবার বেজে উঠল বেল। বাজতেই থাকল। অধৈর্য হয়ে কেউ টিপে ধরে রেখেছে ঘণ্টিটা। তাই অনবরত বেজেই চলেছে।
বিছানা থেকে নেমে পড়ল শ্যারন, পায়ে হরিণের চামড়ার চটি গলিয়ে ছুটল লিভিংরুমের দরজার দিকে। বিরক্তি নয়, অজানা আশঙ্কায় এবার ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেছে বুকের ভেতর। গভীর রাতে দুটো জিনিস মানুষের ঘুম হারাম করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। একটা হলো টেলিফোন। (অবশ্য শ্যারনের ফোনটা দিন দুই হলো নষ্ট। এক্সচেঞ্জে খবর দেয়া হয়েছে। ওরা বলেছে শিগগিরি রিপেয়ারম্যান। পাঠিয়ে দেবে।) অন্যটা কলিংবেল। দুটোই রাত গভীরে বেজে উঠলে গৃহস্থের মনে অশুভ চিন্তাটাই আগে আসে।
অবশ্য শ্যারনের আশঙ্কিত হয়ে ওঠার মত যথেষ্ট কারণ আছে। তার গুণধর ছোট ভাইটা মাঝে মাঝেই আকাম-কুকাম ঘটিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় বড় বোনটাকে। শ্যারনের লেখালেখির বড় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে সে ইদানীং। মারামারি, ড্রাগস বহন ইত্যাদি কারণে ইতিমধ্যে পুলিশ কেসও খেয়েছে দুএকটা। এবারও তেমন কিছু ঘটেনি তো? অথবা তারচেয়েও সিরিয়াস কিছু? যার কারণে এত রাতে পুলিশ এসেছে ওর বাড়িতে।
ভীরু, এস্ত পায়ে লিভিংরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল শ্যারন। কলিংবেলের শব্দ থেমে গেছে। সে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কে?
ওধার থেকে কোন জবাব নেই।
এবার গলা একটু চড়াল শ্যারন, কাকে চাই?
দরজার ওপাশে ফুঁপিয়ে ওঠার মত শব্দ করল কেউ। অস্পষ্ট, মেয়েলি গলায় বলল কিছু ঠিক বুঝতে পারল না শ্যারন। তবে নারী কণ্ঠটা অবাক করে দিল ওকে। তাহলে কি পুলিশ নয়? কী-হোলে চোখ লাগাল। যাকে দেখল, তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল সে। এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল শ্যারন, বাইরে দাঁড়িয়ে। থাকা ভেজা বর্ষাতি গায়ে, আলুথালু বেশের, ওর সমবয়েসী সুন্দরী তরুণীটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আরে, তুই!
নবাগতা তরুণীর চোখে স্পষ্ট ভয়, শ্যারনকে দেখে সেখানে নির্জলা বিস্ময় ফুটে উঠল, তারপর ফুপিয়ে উঠল সে, তুই এখানে! ঘরে চল। সব বলছি। কেউ যেন ওকে তাড়া করেছে, একবার পেছন ফিরে চেয়ে শিউরে উঠল সে, শ্যারনকে প্রায় ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। তার ইঙ্গিতে দরজার বল্ট লাগিয়ে দিল শ্যারন। তরুণী ততক্ষণে একটা সোফায় এলিয়ে পড়েছে, রীতিমত হাঁপাচ্ছে। উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল শ্যারন। কি হয়েছে, লিনড়া? এমন করছিস কেন? এত রাতে কোত্থেকে এলি? বাসা চিনলি কি করে? পরপর অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসল সে।
বলছি। সব বলছি। হাত তুলে ওকে বাধা দিল লিন্ডা নামের মেয়েটি। আমাকে তুই বাচা, শ্যারন। ওরা আমাকে ধরে ফেলবে।
কারা ধরবে?
ওরা ড, জেসন স্লোনের লোক। আমার পিছু নিয়েছে। এ বাড়িতে ঢুকেছি জানতে পারলে নির্ঘাত আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
কি বলছিস মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। অসহায় ভঙ্গিতে কাধ কঁকাল শ্যারন। তবে ভয় পাসনে। আমি যখন আছি, তোর কিছু হবে না।
না, না। তুই বুঝতে পারছিস না ওরা খুব ভয়ঙ্কর। ধরতে পারলে সর্বনাশ করে ছাড়বে। বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল লিন্ডা।
পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে লাগলেও ওকে আর চাপাচাপি করল না শ্যারন। তবে বুঝতে পারছিল সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে তার প্রিয় বান্ধবীর জীবনে। নইলে সহজে ভয় পাবার পাত্রী সে নয়। সে লিন্ডার পাশে বসে রইল ওকে জড়িয়ে ধরে। লিন্ডার ফোপানি থামলে যত্নের সাথে ভেজা রেইন কোটটা খুলে নিল গা থেকে, লিভিংরুমের ফায়ারপ্লেসের আগুনটা উস্কে দিয়ে গরম কফি বানিয়ে আনল। লিন্ডা দুই হাতে মগটাকে চেপে ধরল। অনেকক্ষণ চুপচাপ পান করল কফি। তারপর কথা বলতে শুরু করল। নিজের জীবনের রোমহর্ষক সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কখনও কখনও চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল, কখনও অশ্রুসজল হলো, বেশিরভাগ সময় ভয়ের ছাপ ফুটল তারায়, শিউরে উঠল বারবার।
ঘটনার শুরু প্রায় বছর খানেক আগে। অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মানুষ প্রফেসর গর্ডন ম্যাক্সওয়েলের ছোট এক রিসার্চ টীমের একজন সহযোগী ছিল লিন্ডা, রেনল্ডস। দলের মোট সদস্য ছিল চারজন, বাকি দুজন হলো জন বার্ন এবং মার্টিন সন্ডারস। ওদের গবেষণার বিষয় ছিল সর্দিজ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই। উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা ওষুধ আবিষ্কার করা যা খেলে অন্তত পাঁচ বছর মানুষ ঠাণ্ডাজনিত কোন অসুখে আক্রান্ত হবে না।
তবে, দুর্ভাগ্যবশত, অন্যান্য অনেক প্রজেক্টের মত লিন্ডাদের এই রিসার্চ কাজও বিঘ্নিত হচ্ছিল উপযুক্ত ফান্ডের অভাবে। সাফল্যের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছিল, টাকা-পয়সার সমস্যা ততই প্রকট হয়ে উঠছিল। অবশেষে একটা আশার আলো দেখতে পায় সবাই, ভাবে এবার হয়তো সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। স্যার আর্থার ওয়েন ওদের সামনে জ্বেলে দেন সেই আলো।
স্যার আর্থার ওয়েন অত্যন্ত ধনী এবং ভাল মানুষ, সারা জীবন জনহিতকর নানা কাজে অর্থ বিলিয়ে গেছেন। মিডিয়ায় তার পরিচিতি প্রচুর। তো এই ভদ্রলোক যখন ঘোষণা দিলেন, গবেষণাধর্মী কাজের জন্য হাফ মিলিয়ন পাউন্ড দান করবেন, তখন স্বভাবতঃই লিন্ডারা নেচে উঠেছিল আনন্দে। মেডিকেল রিসার্চের সাথে জড়িত যে কোন ব্যক্তি বা দল পুরস্কার পাবার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এক্ষেত্রে বোর্ড অভ এক্সপার্টরা প্রতিটি প্রজেক্ট বিশ্লেষণ করে দেখবেন কার বা কাদের রিসার্চ সম্প্রতি সময়ে সবচে বেশি এগিয়ে গেছে বা সমৃদ্ধি অর্জন করেছে।
নিজেদের ব্যাপারে প্রফেসর ম্যাক্সওয়েলের ছোট্ট দলটি যথেষ্ট আশাবাদী ছিল, তাছাড়া তাদের হারাবার তো কিছু ছিল না। তাই প্রতিযোগিতায় নাম লেখায় ওরা। প্রফেসর ম্যাক্সওয়েল অত্যন্ত চমৎকারভাবে তাদের গবেষণার বিষয়টি উপস্থাপন করলেন। অবশেষে জানা গেল ওরাই জয়ী হয়েছেন।
ফলাফল ঘোষণার পরে অন্যান্য প্রতিযোগী দলগুলোর প্রায় সবাই প্রফেসরকে বিজয়ে অভিনন্দন জানাল শুধু একজন ছাড়া। এই লোকটির নাম জেসন স্নোন, বোর্ডের বিচারে সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। তবে স্যার আর্থারের বোর্ডে হাজির হবার আগ পর্যন্ত তার সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছু জানত না বললেই চলে। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল মানুষকে হিমায়িত করে দীর্ঘ জীবনের সন্ধান দেয়া। স্নোন দাবি করছিল সে এ ব্যাপারে প্রচুর সাফল্য অর্জন করেছে। বোর্ড যখন তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, সেইসময় গুজব রটে যায় নেই প্রথম পুরস্কারটি পাচ্ছে।
স্যার আর্থারের বাড়িতে গর্ডন ম্যাক্সওয়েলের দলের সাফল্য ঘোষণার আয়োজন করা হয়। বক্তৃতায় বোর্ডের চেয়ারম্যান তার কাছে আসা সকল প্রজেক্টের প্রশংসা করেন, স্নোনের নাম তিনি একাধিকবার উচ্চারণ করেন। তাকে দ্বিতীয় পুরস্কার দেয়া হয়। কিন্তু জেসন স্নোন বোর্ডের সিদ্ধান্তে মোটেও খুশি হতে পারেনি। প্রফেসর ম্যাক্সওয়েল তাকে অভিনন্দিত করলেও সে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, প্রফেসরের বাড়ানো হাত দেখেও না দেখার ভান করেছে। মাছের মত ঠাণ্ডা চোখে দেখছিল সে ওদেরকে, যেন চারজনের মূল্য যাচাই করছিল। সে বলছিল, বোর্ড আমার কাজের মূল্যায়ন না করে ভুলই করল। বলে চলে গেল। জন বার্ন মন্তব্য করল, হেরে গিয়ে লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
প্রফেসর ম্যাক্সওয়েল বললেন, শড় হওয়াই স্বাভাবিক। স্নোন ভেবেছিল প্রথম পুরস্কারটি সে-ই পাবে। হেরে গেলে ওর মত আমরাও ভেঙে পড়তাম।
স্লোনকে নিয়ে ভাবনার অবকাশ ছিল না লিন্ডাদের। কারণ পরের হপ্তাতেই প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা কাজে। নতুন প্রজেক্ট, দাতার নাম অনুসারে যেটার নাম দেয়া হয় এ.ডব্লিউ, ওটার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে বেশ কিছু নতুন ইকুইপমেন্ট কেনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। প্রফেসর বললেন তাকে হামবুর্গে যেতে হবে জিনিসগুলো কিনতে। বিশেষ প্লেন চার্টার করে জার্মানীতে যাবেন তিনি, ইকুইপমেন্ট পছন্দ হলে সাথে করে নিয়ে আসবেন।
তোমাকে যেতে হবে না, লিন্ডা, বললেন ম্যাক্সওয়েল। আর কদিন পরে তোমার বিয়ে। তুমি বরং বিয়ের কেনাকাটা শুরু করে দাও।
জন বার্নের সাথে লিন্ডার এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছিল আগেই, কিন্তু আর্থিক কারণে প্রজেক্টটা স্থগিত হয়ে পড়ায় বিয়ে করতে সাহস পাচ্ছিল না ওরা। এখন নতুনভাবে অর্থসংস্থান হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল বিয়ের কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলবে। আর সেটা হবে জন প্রফেসরের সাথে হামবুর্গ থেকে ফেরার পরপরই।
যাত্রার দিন ওদের বিদায় জানাতে লুটন এয়ারপোর্টে গেল লিন্ডা। তারপর খুশি মনে ফিরে এল বাবার বাড়িতে, বাকিংহামশায়ারে। এখানেই বিয়ের অনুষ্ঠানটা হবে। জন বলেছিল হামবুর্গ পৌঁছার পরপরই ফোন করবে। কিন্তু ফোনের জন্য বৃথাই অপেক্ষা করল লিভা। ভাবল হয়তো কাজের চাপে ভুলে গেছে জন ফোন করতে।
পরদিন সকালে লিন্ডার মা ওকে ঘুম থেকে জাগাল খবরটা দিতে। ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি তখনও, তাই প্রথমে বুঝতে পারল না মা কি বলছে। কিন্তু মার। কণ্ঠের জরুরী সুর ওকে জাগিয়ে তুলল পুরোপুরি। মা বলছিল, খবরে শুনলাম গত রাতে উত্তর সাগরে একটা হালকা প্লেন নিখোঁজ হয়ে গেছে। তোকে বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু ভয় লাগছে জনের কিছু হলো কিনা ভেবে।
খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেল লিন্ডার মার আশঙ্কাই সত্যি। জনদের প্লেনের সাথে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ যোগাযোগ ছিল ইংলিশ কোস্ট পার হবার আগ পর্যন্ত, তারপর হঠাৎ করেই নেই হয়ে গেছে ওরা। সাগরে অভিযান চালানো হলো। প্লেন বা তার যাত্রীদের কোন হদিশ মিলল না। তিনদিন পরে লিন্ডারা প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, এমন সময় খবর এল একটা এয়ারক্রাফটের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পাওয়া গেছে। ধ্বংস হওয়া প্লেনটার টুকরো-টাকরা তোলা হলো সাগর থেকে, বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হলেন এটা সেই নিখোঁজ নেই। পরীক্ষায় জানা গেল, আকাশে কোন কারণে বিস্ফোরিত হয়েছে প্লেন। কিন্তু প্লেনের যাত্রীদের কোনই সন্ধান মিলল না।
একেবারেই ভেঙে পড়ল লিন্ডা তার ভবিষ্যৎ স্বামী এবং দুজন প্রিয় বন্ধুকে, হারিয়ে। কলেজের পড়া চুকিয়ে প্রফেসরের প্রজেক্টে ঢুকেছিল বিজ্ঞানী হিসেবে। ক্যারিয়ার গড়বে বলে। সে স্বপ্ন এভাবে ভেঙে যাওয়াতে আরও মুষড়ে পড়ল। তবে বিশ্বাস হতে চাইছিল না তিন তিনটে মানুষ কোন চিহ্ন না রেখে এভাবে অদৃশ্য হয়ে। যেতে পারে। পত্রিকাগুলোও এ নিয়ে বেশ লেখালেখি করছিল। লিন্ডার বার বার। কেন যেন মনে হচ্ছিল মরেনি ওরা, বেঁচে আছে এখনও।
গভীর শোক আর ক্ষীণ প্রত্যাশা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল একঘেয়ে দিনগুলো। চাকরি-বাকরি করতেও আর ইচ্ছে করছিল না। লিন্ডার বাবা বলল, তোকে কিছু করতে হবে না। তুই আমাদের সাথেই থেকে যা। তার একটা ছোট বাগান ছিল। ফলের ব্যবসা করতেন। মাঝে মাঝে সাহায্য করত লিভা তাকে কাজে। মাস ছয়েক পরে একটা ঘটনা ঘটল।
সেদিন আপেল তুলছে লিন্ডা গাছ থেকে, মা বলল এক ভদ্রলোক এসেছে, দেখা করতে চায়। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখে জেসন স্নোন অপেক্ষা করছে ওর জন্য। খুবই অবাক হয়ে গেল সে ওকে দেখে। আমাকে নিশ্চয়ই আশা করেননি, মিস রেনল্ডস, লিন্ডার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসল সে। মনে হলো ওকে দেখে খুব খুশি হয়েছে।
জী, নিজের অজান্তেই যেন হাতটা ধরে বলল লিভা।
স্যার আর্থার ওয়েনের বাড়িতে পরিচয় হয়েছিল। মনে আছে?
মনে আছে। লোকটার সেদিনের ব্যবহারের কথা মনে পড়তে ইচ্ছে করেই রূঢ় স্বরে কথাটা বলল সে।
লিন্ডার মনোভাব টের পেয়ে দ্রুত বলে উঠল স্লোন, সেদিনের কথা ভাবলে আমি এখনও লজ্জায় মরে যাই, মিস রেনল্ডস। সত্যি ক্ষমার অযোগ্য একটা কাজ করেছি সেদিন। এখন ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে আমার? আসলে ওয়েন অ্যাওয়ার্ড না পেয়ে এত হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।
লোকটাকে তার আচরণের জন্য সত্যি খুব মর্মাহত মনে হচ্ছিল। লিন্ডা ভাবল। লোকটার ব্যাপারে হয়তো ভুল ধারণাই পোষণ করেছে তারা।
অনেক কাজ আমরা আবেগের বশে করে ফেলি যার জন্যে পরে আফসোস করতে হয়, বলল সে। ভেবে কষ্ট লাগছে প্রফেসর ম্যাক্সওয়েল এবং তার সঙ্গীদের কাছে ক্ষমা চাইবার সুযোগ কোনদিন হবে না। খুবই করুণ অ্যাক্সিডেন্ট ছিল ওটা।
হ্যাঁ, তাই ছিল, তীক্ষ্ণ গলায় বলল লিন্ডা।
আপনাকে আর অ্যাক্সিডেন্টের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই না। ব্যক্তিগতভাবেও আপনার বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। কাগজে খবরটা পড়ে খুব কষ্ট পেয়েছি আমি। প্রফেসর ম্যাক্সওয়েলের মত প্রতিভাবান মানুষের এমন মৃত্যু কল্পনাও করা যায় না! যাকগে, আমি এসেছিলাম আপনার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে।
প্রস্তাব? অবাক হয় লিন্ডা।
জী। আমি চাই আপনি আমার সাথে কাজ করবেন।
কিন্তু…
আগে ব্যাপারটা আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন, বাধা দিল স্লোন। আসলে ওই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটার পর থেকে আপনাকে খুঁজছিলাম। আপনার ঠিকানা খুঁজে বের করতে অনেক সময় লেগেছে। প্রফেসর ম্যাক্সওয়েলের ল্যাবরেটরির লোকজন আপনার ফ্ল্যাটের ঠিকানা শুধু জানত, বাড়ির কথা জানত না কেউ। অনেক কষ্টে আপনাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি আপনি যদি আমার সাথে কাজ করতে রাজি হন তাহলে সেটা একদিক থেকে প্রফেসর ম্যাক্সওয়েলের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাই হবে। এটা তার প্রজেক্ট না হলেও আমিও বিশ্ব মানবতার কল্যাণে কাজ করছি। তিনিও তাই করছিলেন। কাজেই আমার সাথে কাজ করলে আপনি মানবতার সেবাই করবেন। সামান্য বিরতি দিল সে, তারপর বলল, তাছাড়া আমার একজন ভাল অ্যাসিস্ট্যান্টও দরকার।
কিন্তু আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন, বলল লিন্ডা। আমি আপনার প্রয়োজনে না-ও আসতে পারি।
খুব ভাল এবং দক্ষ লোক ছাড়া যে প্রফেসর ম্যাক্সওয়েলের দলে সুযোগ পাওয়া যায় না তা আমার চেয়ে ভাল কে জানে? না, আপনাকে আমার সাথে কাজ করতে বলে কোন ভুল করিনি। আপনি রাজি কিনা তাই বলুন?
লিভাকে ইতস্তত করতে দেখে স্লোন বলল, বুঝতে পারছি এখনও শোক সামলে উঠতে পারেননি…।
না, ঠিক তা নয়, বলল সে।
তাহলে এখানে বসে বসে আপনার প্রতিভার অপচয় করছেন কেন?
জেসন স্রোনের মানুষকে পটানোর ক্ষমতা সাংঘাতিক। কিন্তু মনস্থির করতে পারছি না সিন্ডা।
ঠিক আছে, বলল সে অবশেষে। এখনই কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। আগে চলুন আমার কাজের জায়গায়। আমার ল্যাবরেটরি ঘুরিয়ে দেখাই আপনাকে। তারপর ঠিক করবেন কাজ করবেন কিনা।
স্নোনের কথায় যুক্তি ছিল। তারপরও ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল লিন্ডা রেনল্ডসের। স্নোন আরও খানিকক্ষণ ঝোলাঝুলি করার পরে রাজি হয়ে গেল ওর ল্যাবরেটরি দেখতে। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল সে।
দিন দুই পরে সন্ধ্যার ট্রেনে চড়ে লন্ডনে গেল লিন্ডা, সেখান থেকে গ্লাসগোতে। স্নোন নিজে ওকে রিসিভ করল কুইন স্ট্রীটে, তারপর গাড়ি নিয়ে ছুটল শহরের বাইরে, উত্তর দিকে। খটকা লাগল লিভার, জানতে চাইল কোথায় যাচ্ছে। স্নোন বলল, তার ল্যাবরেটরি পাহাড়ের ওপরে। ব্যাখ্যা করল, টাকার অভাবে শহরে গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
গ্লাসগো শহর পেছনে ফেলে ওরা ডানবার্টনশায়ার-এর পেঁচানো রাস্তা ধরে আরগিলের দিকে ছুটল। এদিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম নেই তেমন। টানা দুই ঘণ্টা পরে সরু একটা রাস্তায় ঢুকল, দুপাশে বাঁধ, পাথর দিয়ে বাঁধানো। আরও মাইলখানেক এগোবার পরে একটা পাহাড় চোখে পড়ল, তার
পরে ঘন জঙ্গলে ঢাকা উপত্যকা। দূর থেকে কালো রঙের, চৌকোনা চিমনি দেখল। লিভা, হালকা ধোয়ার রেখা ভেসে যাচ্ছে গাছের মাথার ওপর দিয়ে। জীবনের চিহ্নও নেই কোথাও। এমনকি পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে না। কেমন অস্বাভাবিক, থমথমে একটা পরিবেশ।
টাকা বাঁচাতে এবং কাজের সুবিধের জন্য জেসন স্নোন এমন একটা জায়গা বেছে নিলেও পরিবেশটা পছন্দ হলো না লিন্ডার। বড় বেশি নির্জন। গা ছমছম করে।
গাছের ভেতর থেকে পথ করে ওরা এগোল বাড়িটার দিকে, ক্রমে দৃশ্যমান হয়ে উঠল লম্বা, চৌকোনা, ধূসর রঙের চিমনিগুলো, পাথুরে দেয়াল, সেই সাথে ছোট ছোট জানালা। বাড়িটা এমন আদলে তৈরি, বাইরে থেকে মধ্য যুগের দুর্গ মনে হয়, একই সাথে ভিক্টোরিয়ান আমলের কারাগারের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
এটা একটা পুরানো হান্টিং লজ, প্রকাণ্ড সদর দরজার দিকে যেতে যেতে ব্যাখ্যা করল স্নোন। তবে ভেতরটা বেশ আরামদায়ক।
পাথুরে দেয়ালে পায়ের আওয়াজ তুলে বিশাল একটা ঘরে ঢুকল ওরা। ঘরটিতে সেগুন কাঠের আসবাব, বিমগুলো কালো রঙের, দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিংগুলো বিবর্ণ, মান। খোলা ফায়ারপ্লেসে দাউ দাউ জ্বলছে আগুন, বাড়িটাকে আলখেল্লার মত জড়িয়ে থাকা হিম ঠাণ্ডা ভাব অনেকটা দূর হয়েছে উষ্ণ তাপে। কল্পনার চোখে দেখার চেষ্টা করল লিন্ডা পাহাড় থেকে শিকার করে এ বাড়িতে ফিরে এসেছে তার বাসিন্দারা, তাদের কলহাস্যে মুখরিত প্রতিটি ঘর। কিন্তু কল্পনার চোখে কিছুই ফুল না।
এক গ্লাস শেরি ঢেলে দিল শ্রেন ওকে, নিজে নিল হুইস্কি। আগুনের সামনে সে কথা বলল দুজনে।
ভাগ্যগুণে এ বাড়িটি পেয়ে গেছি আমি, উৎফুল্ল দেখাচ্ছে নেকে। গ্লাসগোর ডিস্টিলারী ব্যবসায়ী মি, ওভারেট লডারেট মালিক ছিলেন এটার। বিশ এবং ত্রিশের দশকে, ছুটির দিনগুলোতে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আসতেন তিনি এখানে। মাছ ধরতেন। শিকার করতেন। কিন্তু যুদ্ধ তার সমস্ত আনন্দ শেষ করে দেয়। সেনাবাহিনী বাড়িটিকে তাদের কমান্ডাে ট্রেনিং হেডকোয়ার্টার বানায়। কমান্ডাে ট্রেনিং-এর জন্য দুর্গম এই অঞ্চল যথার্থ ছিল বটে। যুদ্ধ শেষে লডারেট তার ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে দেশের বাইরে চলে যান। বাড়িটি বহুদিন খালি ছিল। তারপর ইয়ুথ হোস্টেলস অ্যাসোসিয়েশন এখানে অফিস করেছিল। কিন্তু তারাও বেশিদিন থাকেনি। তারপর জলের দামে বাড়িটি আমি কিনে নিই।
আরেক গ্লাস ড্রিঙ্ক অফার করল স্লোন লিন্ডাকে, মানা করতে নিজেই খানিকটা হুইস্কি গিলে নিল ঢক ঢক করে। তারপর আবার শুরু করল বকবক।
বাড়িটি আমার প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট বড়, যদিও কিছু চাকর-বাকরও আছে। ওরা রান্না করে, ঘর-দোর পরিষ্কার রাখে। দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে, তেমন দক্ষ নয়। তাই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একজন পার্সোনাল অ্যাডভাইজারের খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। এ কারণেই আপনার কাছে যাওয়া। আপনার সাহায্য আমার ভীষণ দরকার। আপনার সাহায্য পেলে গবেষণার কাজ আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
এমন সময়, দাড়িঅলা, সাদা কোট পরা, বিশালদেহী এক লোক ঝড়ের বেগে ঢুকল ঘরে। লিন্ডাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর স্নোনের দিকে ঘুরে, হাপাতে হাঁপাতে বল্ল, ড, স্লোন, দয়া করে একবার আসবেন? এক রোগিণীকে নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। নিঃশ্বাস ফেলছে না সে।
বিরক্তিতে কপাল কোঁচকাল স্নোন, শঙ্কা ফুটল চোখে পরমুহূর্তে চেহারা স্বাভাবিক করে বলল, তুমি যাও, ব্রানস্টোন। আমি আসছি এখুনি।
ব্রানস্টোন যাবার পরে ঘুরে দাঁড়াল স্নোন লিডার দিকে। অল্পক্ষণের জন্য আমাকে ক্ষমা করতে হবে, মিস রেনল্ডস। শুনলেনই তো ইমার্জেন্সী কেস। একবার নিচে যাওয়া দরকার। আপনি গেস্টরুমে গিয়ে ততক্ষণে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি হাউসকীপারকে বলে দিচ্ছি। প্লীজ, নিজের বাড়ির মত ভাবুন এ বাড়িটিকে। আমি শীঘ্রি ফিরব। তারপর একসাথে লাঞ্চ করে সব ঘুরিয়ে দেখাব।
স্নোনের ডাকে কালো পোশাক পরা এক বুড়ি এল, লিভাকে দোতলায় নিয়ে গেল, করিডরের শেষ মাথায়, একটা ঘরে ঢুকল। বুড়ির সাথে ভাব জমাতে চাইল। ও। কিন্তু ওর একটা প্রশ্নেরও জবাব দিল না সে, শুধু হুঁ হাঁ করে গেল।
বেডরুমটা বাড়ির পেছনের অংশে, বড় বড়, উঁচু জানালা দিয়ে পাহাড়ী উপত্যকা চোখে পড়ে। মনে হলো বাড়িটার সমস্ত দিক ঘিরে আছে রুক্ষ পাহাড়ের সারি।
ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে লিন্ডা। যতই সুন্দর নিসর্গ থাকুক, এমন ভৌতিক নির্জনতার মাঝে থাকতে পারবে না ও, দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। একা হলেই প্লেন ক্রাশের কথা মনে পড়বে, আর খালি মন খারাপ হবে। ঠিক করল প্রথম সুযোগেই স্লোনকে তার বদান্যতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলবে ফিরতি ট্রেনে লন্ডনে ফিরে যেতে চায় সে।
লাঞ্চের সময় অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য পরিবেশন করা হলেও খাওয়াতে মন বসল না লিন্ডার। টেবিলে স্নোন ছাড়াও তার দুই সহকারী ছিল। একজনকে আগেই দেখেছে-ব্রানস্টোন। অপরজন বয়সে তরুণ, রোগা চেহারা, তীক্ষ্ণ চোখ, নাম ডেভিস। ওরা যে বারবার লিন্ডার দিকে চোরা চোখে তাকাচ্ছে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল সে। স্নোন খোশ গল্প চালিয়ে যাবার ভান করলেও তার মন ছিল অন্যদিকে। কারণ মাঝে মাঝে কথার খেই হারিয়ে ফেলছিল সে, কি যেন চিন্তা করছিল।
লাঞ্চ শেষে স্নোন বলল, মিস রেনল্ডস, এবার তাহলে যাওয়া যাক। চলুন, আমার ল্যাবরেটরি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি।
হলঘর থেকে বের হয়ে ছোট একটা দরজার সামনে চলে এল স্নোন। এটা আসলে একটা চোর-কুঠুরি। দরজা খুলে, আলোকিত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল। প্রবেশ করল ভিন্ন এক জগতে।
এদিকের দেয়ালগুলো চমৎকার চুনকাম করা, এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমের কারণে স্যাতসেতে, ঠাণ্ডা ভাবটা নেই। সিঁড়ি গোড়ায় আরেকটা দরজা, তারপর সরু প্যাসেজ। তারপর আরও একটা দরজা পার হয়ে ঢুকে পড়ল স্নোনের সুসজ্জিত, বিশাল গবেষণাগারে।
এ ধরনের গবেষণাগার আপনার জন্য নতুন কিছু নিশ্চয়ই নয়, বলল স্নোন। বাড়িটার আন্ডারগ্রাউন্ডের এই ঘরগুলো আমার খুব কাজে লেগেছে। এসব ঘর ব্যবহার করা হত কিনা জানি না, তবে ধারণা করতে পারি এদিকের একটা অংশ ছিল ওয়াইন সেলার। হয়তো জ্বালানী গুদামজাত করে রাখা হত এখানে, শিকারীদের শিকার করা হরিণের চামড়া ছেলা হত। বুঝতেই পারছেন ঘরগুলোকে নিজের মত করে সাজাতে প্রচুর খরচ হয়েছে আমার। এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমের ব্যবস্থা করেছি বেশিদিন হয়নি। এর আগে হিটার জ্বালিয়ে রাখতাম। এখন আমাদের নিজস্ব ইলেকট্রিক জেনারেটিং প্ল্যান্টও রয়েছে। কারণ পাওয়ার ফেল করার ঝুঁকি তো আর নিতে পারি না।
ল্যাবরেটরিটা ঘুরে দেখল লিন্ডা। কিছু অ্যাপারেটাস চিনতে পারল, বেশিরভাগই অচেনা ঠেকল।
আপনার সাথে আলোচনায় বসার আগে আমার কাজের ধরন নিয়ে একটু কথা বলি, বলল স্নোন। মোট তিন ধরনের লোক আছে এখানে, যাদের নিয়ে আমি কাজ করছি। প্রথম ক্যাটাগরির লোকেরা, চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় মৃত। মৃত্যু তাদের শারীরিক বৃদ্ধি রুখে দিয়েছে, তাদেরকে রাখা হয়েছে কোল্ড স্টোরেজে। এদের নিয়ে আমার কিছু করার নেই। তবে থিওরী মতে, যদি তাদের শক্টরের টিস্যগুলো ঠিকঠাকভাবে সংরক্ষণ করে রাখা যায়, যে রোগের কারণে তাদের মৃত্যু। সেটার প্রতিষেধক যদি আগামীতে তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহলে তাদের আবার বেচে ওঠার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। জানি, আমেরিকায় একদল বিজ্ঞানী একই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি তাদের থেকে একশো কদম এগিয়ে আছি। শুরুতে, আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিফল হয়। পরবর্তীতে লাশগুলোকে নিয়ে আমরা আরও কাটাছেড়া করেছি, স্টোর করেছি, দেখেছি দুএকটা অঙ্গের পচন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। গত কয়েক বছরে অন্তত এটুকু সাফল্য আমার এসেছে যে লাশের স্বাভাবিক পচন রোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। আশা করছি। নিকট ভবিষ্যতে থিওরীর দ্বিতীয় অংশেও সাফল্য অর্জন করতে পারব।
আমার এক ক্লায়েন্ট মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। লোকটার হার্ট দুর্বল। ছিল। আপনার জানার কথা, ওইসময় হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট অপারেশন সম্পর্কে ডাক্তাররা। জানতেন না কিছুই। আর এখন তো এটা অহরহ প্রাকটিসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার ক্লায়েন্টকে যদি হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট অপারেশন করে বাঁচিয়ে তুলতে পারি সেটা কতবড় বিজয় হবে ভাবুন একবার। তবে এ জন্য আগে দরকার একজন উপযুক্ত ডোনার এবং একজন দক্ষ সার্জন, যিনি নিখুঁতভাবে ট্রান্সপ্ল্যান্টের কাজটা করতে পারবেন।
কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে উঠল স্নোনের চোখ। আসলে নিজেকে জাহির করছে সে। ওর কাজ কর্মের বর্ণনা শুনে ওকে পাগল মনে হতে লাগল লিভার।
আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরি? অস্বস্তি নিয়ে জানতে চাইল সে।
দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে আছে সেইসব লোক যারা প্রচণ্ড অসুস্থতার কারণে মারা যেতে বসেছে, কিন্তু মরেনি এখনও। এখানেও সেই একই দাওয়াই দিতে হবে, তবে এদের ক্ষেত্রে সফল হবার সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল আজ সকালের ইমার্জেন্সী কেসটা অমনই একটা ছিল। অল্প বয়সী একটা মেয়ে, মারা যেতে বসেছিল, ওকে এখানে নিয়ে আসা হয়। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, ফ্রিজিং প্রসেসটা সময় মত শুরু করতে পারিনি বলে দুপুরের ঠিক আগে মারা গেছে সে। ওকে আমরা হিমায়িত করে রাখব, তবে ভবিষ্যতে ওর বেঁচে ওঠার চান্স শেষ হয়ে গেছে।
লোকটার বকবকানি যথেষ্ট শোনা হয়ে গেছে লিভার। সে যা অর্জন করতে চাইছে তা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, ভয়ঙ্করও। এ ধরনের উন্মাদের সাথে ও কাজ করবে না।
শুনুন, ড. স্নোন, বলল লিন্ডা। আপনার আমন্ত্রণে এখানে এসেছি আমি। কিন্তু মনে হচ্ছে না আপনার সাথে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে। আপনি বরং সময় নষ্ট না করে আরেকজনের সন্ধানে লেগে যান। আর কাউকে দিয়ে আমাকে গ্লাসগো পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল স্নোন, তারপর যখন কথা বলল, যেন এক ভিন্ন মানুষ। ওর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে শিউরে উঠল লিন্ডা।
ব্যাপারটা দুঃখজনক, মিস রেনল্ডস, সত্যি দুঃখজনক, এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছে সে। যখন এসেই পড়েছেন তৃতীয় ক্যাটাগরির লোকদেরকে না দেখিয়ে আপনাকে ছাড়ছি না।
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যে…
আপনাকে ছাড়ছি না কিন্তু, অদ্ভুত এক টুকরো হাসি ফুটল তার মুখে। এবারের জিনিসটা দেখে খুব আনন্দ পাবেন আপনি। প্লীজ, আসুন তো।
ল্যাবরেটরির শেষ মাথার দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা, ঢুকল অন্ধকার, ঠাণ্ডা একটা প্যাসেজে। মনে হলো সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠছে। হালকা কমলা আলোয় প্যাসেজের দুপাশে অসংখ্য ছোট ছোট দরজা চোখে পড়ল।
আমার পেশেন্টরা থাকে এসব ঘরে, ব্যাখ্যা করল স্নোন। এদের অর্ধেক মৃত, বাকিরা মরো মরো, অবস্থায় এখানে এসেছে। তবে প্রসেসটা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। অবশ্য সবাইকে ভাল মত পরীক্ষা রে মাইনাস দুশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় হিমায়িত করে রাখা হয়েছে। তাদের শারীরিক যে কোন পরিবর্তন আমরা রেকর্ড করে রাখছি।
মনে হলো একটা কবরস্থানে হাজির হয়েছে লিন্ডা, বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ। খুব ভয় ভয় লাগছিল, একই সাথে কৌতূহলও জাগছিল।
কতদিন ধরে ওরা এখানে আছে? শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করল ও।
সবচে পুরানো পেশেন্টের এখানে অবস্থানের সময় দশ বছর তো হবেই, জবাব দিল স্লোন। যারা এখনও মারা যায়নি, এমন পেশেন্ট এসেছে পাঁচ বছর আগে।
পাসেজের দূরপ্রান্তের একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো, স্নোন দরজা খুলল। আবার সিডি নেমে গেছে নিচে।
সমস্যা হলো, ফ্যাকাসে, ক্ষীণ আলোয় সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল স্লোন, গত ২/৩ বছর ধরে পেশেন্টদের রাখার জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। তাই একটা লোয়ার চেম্বার খুলতে হয়েছে।
নিচে আসার পরে, স্লোন সুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিল বাতি, যদিও পুরোপুরি অন্ধকার দূর করতে পারল না আলো। লিন্ডা দেখল একটা লম্বা, সরু, ভল্টের মত ঘরে ঢুকেছে, ছাদটা ঢেউ খেলে দেয়ালের সাথে মিশেছে, এত নিচু যে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। দেয়ালের এক ধারে অসংখ্য ডায়াল আর সুইচ, তবে ওর নজর কেড়ে নিল লম্বা দেয়ালের বিপরীত দিকটা। চারকোনা, গভীর করে খোদাই করা অনেকগুলো পাথুরে গর্ত ওদিকটাতে। তিনটা গর্ত দেখে বোঝা গেল অল্প কদিন আগে ইট আর সিমেন্ট দিয়ে গর্তগুলো বুজিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকি গর্তগুলো খালি। শেষ মাথার গর্তটার সামনে বড় একটা ধাতব ক্যানিস্টার শোয়ানো। সিলিন্ডার আকারের ক্যানিস্টারটি লম্বায় ফুট সাতেক হবে, ডায়ামিটারে তিন/চার ফুট। হয়তো পেছনের গর্তে ওটার জায়গা হবে। ক্যানিস্টারটা পুরো লেংথ থেকে এমন ভাবে ভাগ করা, ইচ্ছে করলেই ওপরের অংশটা তলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।
চারপাশে চোখ বোলালেও লিন্ডা টের পাচ্ছিল স্লোন তাকিয়ে আছে ওর দিকেই! তার চোখে চোখ পড়তে দেখল বন্ধুসুলভ ভাবটা চেহারা থেকে মুছে গেছে স্নোনের, ঠাণ্ডা, বুক হিম করা একটা হাসি মুখে। লিন্ডার বুকটা কেঁপে উঠল।
ধাতব ক্যানিস্টারে টোকা দিল স্লোন, বলল, এটার মধ্যে এবং এটার মত আরও তিনটে কন্টেইনারে, যেগুলো দেয়ালের পেছনে ইট দিয়ে পুঁতে রাখা হয়েছে, ওখানে যারা শুয়ে আছে তারা না জীবিত না মৃত।
আপনার কথা বুঝতে পারলাম না, বলল লিভা। আমি বলতে চাইছি, ওখানে যাদের রাখা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই সুস্বাস্থ্যবান ছিল।
কিন্তু কেন? অবাক হলো লিভা। এতে তাদের সুবিধেটা কি?
সুবিধেটা তাদের নয়, আমার ইচ্ছে সুবিধেটা গোটা বিশ্বের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।
ওঁরা কি এ ধরনের অভিযানে স্বেচ্ছায় এসেছেন?
ঠিক তা নয়, শয়তানী হাসি হাসল স্নোন। তাদেরকে কাজটা করাতে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয়েছে। বিজ্ঞান যদি বিনিময়ে অনেক লাভবান হতে পারে তাতে সামান্য শক্তি প্রয়োগের ঘটনায় কিইবা এসে যায়?
তার মানে আপনি ইচ্ছের বিরুদ্ধে মানুষগুলোর অমন অবস্থা করেছেন? ঘৃণা আর রাগে গলা চড়ল লিন্ডার। এমন অমানবিক আচরণের কথা জীবনেও শুনিনি আমি।
থামুন! ধমকে উঠল স্লোন। লেকচার দেয়ার সময় পরে পাবেন। আসুন এদিকে। আরও কিছু জিনিস দেখানো বাকি রয়ে গেছে।
ক্যানিস্টারের ডালা খুলল স্লোন, হিমায়িত বাষ্পের একটা মেঘ উঠে এল ওপরে। ঘন মেঘটা স্বচ্ছ হয়ে ওঠার পরে লিন্ডা দেখল একটা লোক শুয়ে আছে ক্যাপসুলের ভেতরে। লোকটা সম্পূর্ণ নগ্ন, গায়ের চামড়া অস্বাভাবিক ফ্যাকাসে, খিচ ধরে আছে। মাংসপেশী, পরিষ্কার বোঝা গেল। মরা মানুষের মত শুয়ে আছে সে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথাটা ঘুরে উঠল ওর। তার চোখ বোজা, মাথায় এক গাছি চুলও নেই, নিখুঁতভাবে কামানো, তারপরও ওকে চিনে ফেলল।
জন, নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল লিন্ডা। তারপরই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
সম্ভবত কয়েক মিনিট চেতনা ছিল না ওর জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখে চিৎ হয়ে পড়ে আছে স্নোনের চেম্বারে, ধাতব কবরটা খোলা, ভেতরে শুয়ে আছে প্রেমিক জন বার্ন।
হাত ধরে টেনে তুলল স্নোন লিন্ডাকে, ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল সে।
আপনি-আপনি একটা দানব! হিস্টিরিয়া আক্রান্ত রোগীর মত চেঁচাতে লাগল। লিন্ডা। আমার জনের কি দশা করেছেন! ও এখানে এল কি করে?
ধীরে, বন্ধু, ধীরে, মুচকি হাসল স্নোন। এক এক করে আপনার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। আপনার প্রেমিক এবং তার দুই বন্ধু, তাদের পাইলটসহ, সবাই আছে এখানেই। অন্যদেরকে দেয়ালের ইট দেয়া অংশে একই কন্টেইনারে পুরে সীল করে দেয়া হয়েছে। আপনার প্রেমিককেও একই পদ্ধতিতে সীল করা হবে। আমি তাকে এখানে এনে রেখেছি আপনার কথা ভেবে। আপনি ওকে দেখে হয়তো খুশি হবেন।
লিন্ডা মারমুখী হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে থামিয়ে দিল স্নোন।
আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। কেন কাজটা করতে গেলাম সে ব্যাখ্যায়। এবার আসছি। যে ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করে সাফল্যের পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম, সে প্রজেক্ট হঠাৎ স্থবির হয়ে পড়ে ফান্ডের অভাবে। কাজটা আবার শুরু করার স্বপ্ন দেখছি, এমন সময় প্রফেসর ম্যাক্সওয়েল ওয়েন অ্যাওয়ার্ড আপনারা জিতে আমার শেষ ভরসাটাও নষ্ট করে দিলেন। তারপর ভাবলাম আপনাদের টাকায় ভাগ বসাচ্ছি না কেন? হাফ মিলিয়ন পাউন্ড অনেক টাকা। এ টাকা দিয়ে দুদলের প্রজেক্টের কাজই ভাল ভাবে চলতে পারে। কাজেই প্লেনটা হাইজ্যাকের ব্যবস্থা করতে হলে আমাকে, ওদেরকে নিয়ে এলাম এখানে। প্রফেসরের কাছে প্রস্তাব দিলাম এক সাথে কাজ করার। তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন সেই প্রস্তাব। তন ওদের তিনজনকে চিরতরে অদৃশ্য করে দেয়া ছাড়া বিকল্প রাস্তা ছিল না আমার। প্রফেসরের প্রজেক্ট বাতিল মানে দ্বিতীয় সেরা হিসেবে টাকাটা আমি পেয়ে যাব।
ওদের নিয়ে কি করব সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। বেপরোয়া স্বভাবের মানুষ হলেও আমি বিজ্ঞানী। কাজেই ওদের খুন করার প্রশ্নই আসে না। হঠাৎ বুদ্ধিটা মাথায় এল। মৃত বা মৃতপ্রায় লোকদের ওপর আমার টেকনিক ব্যবহার না করে এই সুস্থ, সবল মানুষগুলোকে দিয়ে পরীক্ষা চালালেই তো হয়। আমি তরুণদের হিমায়িত করে দেখতে চাই বয়সের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে থামিয়ে দেয়া যায় কিনা। ধরুন, আজ থেকে একশো বা দুশো বছর পরে আপনার প্রেমিকের আবার
পুনর্জন্ম হলো ঠিক এই চেহারা এবং বয়স নিয়ে। ব্যাপারটা দারুণ হবে, না?
আপনি একটা পাগল, বলল লিন্ডা।
তাচ্ছিল্যভরে কাঁধ ঝাকাল স্নোন।
হয়তো। খামখেয়ালীপনা আমাদের সবার মধ্যেই আছে। তবে মতিভ্রমতা এবং মতিস্থিরতার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা যাবে কিভাবে? আমি শুধু বুঝি সারাজীবনের পরিশ্রমের সাফল্য আমাকে পেতে হবে। মানব কল্যাণই হলো আসল কথা। এটা এমন বিশাল একটা ব্যাপার যে এর কাছে তিনটি মানুষের জীবন আর হাফ মিলিয়ন পাউন্ডের মূল্য কিছুই না।
মানে… লিন্ডা তেতেমেতে মুখ খুলতে যেতেই স্নোন বাধা দিল আবার।
এমন কিছু বলবেন না যাতে আপনার ফিয়াসে শকুড় হয়। উনি কিন্তু সব কথা শুনছেন।
কি! হতভম্ব হয়ে গেল লিন্ডা কথাটা শুনে। এটা স্নোনের কোন নির্মম রসিকতা নয়তো? কিন্তু স্নোনকে সিরিয়াস দেখাল।
জী। জনকে হিমায়িত করে শরীর থেকে সমস্ত রক্ত টেনে নেয়া হলেও মস্তিষ্ক কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছে। আমাদের সব কথাই শুনতে পাচ্ছেন উনি। এ সমস্যাটার এখনও সমাধান করে উঠতে পারিনি আমি। শরীরটাকে অসার করে সমস্ত ফাংশন বন্ধ করে দিতে পারলেও ব্রেনসহ কিছু অনুভূতিকে ডি-অ্যাক্টিভেট করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেমন, সাবজেক্ট এখনও শুনতে পাচ্ছে, কিছু বিশেষ অনুভূতি অনুভব করার ক্ষমতাও তার রয়ে গেছে।
একবার যদি ব্রেন তার কাজ বন্ধ করে দেয়, ওটাকে চালু করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে রোগীকে আবার আগের সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এ কারণেই আমার এক নম্বর ক্যাটাগরির পেশেন্টদের দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের ব্যাপারে আমি সন্দিহান। বিশেষ করে যারা এখনও মারা যায়নি। তবে, যারা ডিপ ফ্রিজের মধ্যে থাকছে, তাদের ব্রেনের কিন্তু মৃত্যু হচ্ছে না।
আপনার এসব পরীক্ষা স্রেফ পাগলামি, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল লিন্ডা। পুলিশে খবর দিলে ওরা আপনাকে পাগলা গারদে পাঠাবে।
আপনি আমাকে সত্যি হতাশ করলেন, মিস রেনল্ডস, এদিক-ওদিক মাথা নাড়তে নাড়তে বলল স্লেন কি করে ভাবলেন আমার সমস্ত গোপন কথা জানার পরেও আপনাকে পুলিশের কাছে যেতে দেব?
লোকটার প্রচ্ছন্ন হুমকি শুনে থ হয়ে গেল লিন্ডা। এভাবে নিজের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে কল্পনাও করেনি। আতঙ্কে অবশ হয়ে এল শরীর।
স্নোন বলে চলল, আপনাকে এখানে ডেকে এনেছিলাম আমার কাজে সাহায্য করার জন্য। এখন দেখছি সে আশায় গুড়ে বালি। ওই ক্যাপসুলের ভেতরে কে বা কারা আছে জানার দরকার ছিল না আপনার। কিন্তু যে মুহূর্তে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, সিদ্ধান্ত নিলাম আপনাকে ভিন্ন কাজে লাগাব। এতে আপনার প্রেমিককেও খানিকটা শাস্তি দেয়া যাবে।
জন নিশ্চয়ই আপনাকে খুব ভালবাসে। আপনার দশা কি করব তা যখন জানবে সে, আফসোস করবে আমাকে কেন গালাগালি দিয়েছিল ভেবে। জানেন, ওকে ধরে নিয়ে আসার পরে ও পালাবার চেষ্টা করেছে? আমার মূল্যবান কতগুলো অ্যাপারেটাসও ভেঙেছে। বলতে বলতে ধকধক করে জ্বলে উঠল স্রোনের চোখ। এই প্রথম ওকে রাগতে দেখল লিন্ডা। বোকাটার জন্য আমার কাজ পিছিয়ে গেছে কয়েক বছর। তাই ঠিক করি ওকে এবং ওর বন্ধুদের গিনিপিগ বানাব।
একটু বিরতি দিল স্লোন। চেহারা শান্ত দেখালেও এমন ভাবে লিন্ডার দিকে তাকাল যে আত্মা উড়ে গেল। এবার তোমাকেও বাগে পেয়েছি, মাই ডিয়ার, হঠাৎ সম্বােধন পরিবর্তন করে বসল স্লোন। এখন আমার ধারাবাহিক এক্সপেরিমেন্টগুলো শেষ করব। খুব শীঘ্রি তোমার তিন বন্ধুর সাথে যোগ দিতে হবে তোমাকে। তার আগে তোমাকে গর্ভবতী করা প্রয়োজন। তাহলে এ পরীক্ষাটাও হয়ে যাবে অনন্ত কালের জন্যে গর্ভধারণকে প্রতিহত করে রাখা যায় কিনা এবং মুক্ত হবার পরে প্রক্রিয়াটা আবার চালু করা সম্ভব কিনা।
জনের দিকে তাকাল সে। শুনতে পাচ্ছেন, মি. বার্ন? চেঁচিয়ে উঠল স্লোন। বিজ্ঞানী হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই আমার মতামতকে শ্রদ্ধার সাথে বিচার করবেন। একটু পরেই আপনাকে সীল করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। হয়তো অনন্তকালের জন্য। তবে এটুকু ভেবে অন্তত সান্ত্বনা পাবেন, আপনার বাগদত্তা আপনার ধারে কাছেই থাকবে।
তুমি একটা উন্মাদ, হিসিয়ে উঠল লিন্ডা। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না আমি।
সিঁড়িঘরের দিকে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল ও, ভয়ঙ্কর এই চেম্বার, যেটা গোরস্থানের চেয়েও ভয়াবহ মনে হচ্ছিল, এখান থেকে পালাতে পারলেই এখন বাঁচে। অবাক হয়ে লক্ষ করল স্লোন ওকে বাধা দেয়ার কোন চেষ্টাই করল না। একটু পরেই অবশ্য কারণটা বোঝা গেল। সিঁড়ি গোড়ায় দাড়িয়ে আছে যমদূত, তার দুই সহকারী।
ব্রানস্টোন, বলল স্লোন। মিস রেনল্ডসকে ওপরে, তার ঘরে নিয়ে যাও। দেখো যেন পালাতে না পারে। আর ডেভিস, ওকে সাহায্য করো। একটু পরেই তোমাদের ডাকব আমি। ক্যাপসুলটা বন্ধ করে এখান থেকে সরাতে হবে।
ব্রানস্টোন আর ডেডিস লিন্ডার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল প্রায় অন্ধকার প্যাসেজ দিয়ে। ধস্তাধস্তি করল মেয়েটি, গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিল। কোন লাভ হলো না। কেউ এল না সাহায্য করতে। ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হলো। ওকে, তারপর আরেকটা দরজা দিয়ে, যেটা আগে লক্ষ করেনি, সেখান থেকে একটা ঘরে ঢুকল, সিঁড়ির নিচে। ঘরে আসবাব বলতে শুধু একটা বিছানা। লিন্ডাকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে ওরা চলে গেল। পায়ের শব্দ শুনতে পেল ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে।
পরবর্তী কয়েকটা হপ্তা আতঙ্ক, ভয়, নির্যাতন আর অনিশ্চয়তার এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নের মধ্যে কেটে গেল। স্নোনের ল্যাবরেটরিতে লিন্ডার নানা শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা চলল। বাকি সময়টা ওই ঘরে বন্দী হয়ে রইল। দুই সাগরেদ পালাক্রমে ওর খাবার দিয়ে যায়, মাঝে মাঝে স্লোন নিজেও নিয়ে আসে। ওদের দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যায় লিন্ডা কপালে আরও কত দুর্ভোগ আছে ভেবে। মাঝে মাঝে জন, মার্টিন এবং প্রফেসর ম্যাক্সওয়েলের কথা চিন্তা করে। ভেবে পায় না ওরা এই শয়তানের পাল্লায় পড়ল কি করে।
একদিন জেসন স্নোন নিজেই ঘটনাটা খুলে বলল ; কোন কারণে মৃড় ভাল ছিল তার, কথা বলার নেশায় পেয়ে গেল। আর বক বক শুরু করলে সে তো থামতেই চায় না।
স্নোন বলল, তার সাগরেদ ব্রানস্টোন একজন ট্রেইনড় পাইলট, প্রফেসরদের যাত্রার দিন সে আসল পাইলটকে হাত-মুখ বেঁধে প্লেনের পেছনে লুকিয়ে রেখে নিজেই পাইলট সেজে বসে। জার্মানীর দিকে কোর্স সেট করলেও কোস্ট পার হবার পরে কোর্স বদলে সে স্কটল্যান্ডের দিকে যাত্রা শুরু করে। মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে চলছিল ওরা, ওদিকে নিচেটাও ছিল অন্ধকার, ফলে যাত্রীরা কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারেনি। তাদের টনক নড়ে প্লেন স্রোনের বাড়ির ধারে, পুরানো এক এয়ারফিল্ডের ল্যান্ড করার পরে। ওরা প্রথমে ভেবেছিল বোধহয় কোন ঝামেলা হয়েছে যার কারণে প্লেন ওখানে নেমেছে। কিন্তু স্নোন এবং ডেভিস মাথায় পিস্তল ঠেকাতে তাদের ভুল ধারণা ভেঙে যায়। তারপর স্নোন প্রফেসরকে তার প্রস্তাব দেয় এবং প্রফেসর ঘৃণা ভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তারপরে কি হয়েছে সে কথা লিন্ডার জানা।
স্নোন বলল প্রফেসরদের এয়ার ক্রাফট সে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। তারপর প্লেনের খানিক ধ্বংসাবশেষ নিয়ে আকাশ পথে ফিরে যায় অরিজিনাল রুটে, যে কোর্স ধরে প্রফেসরদের যাবার কথা ছিল। ওখানে, সাগরের পানিতে প্লেনের ধ্বংসাবশেষ ফেলে দেয় স্নোন। অনুসন্ধানকারীরা ওই জিনিসগুলোই পরে খুঁজে পেয়েছে।
একদিন শয়তান স্নোন সত্যি সত্যি ব্রানস্টোন আর ডেভিসকে লিন্ডার ওপর লেলিয়ে দিল। ওরা পালা করে ওকে ধর্ষণ করল। জঘন্য কাজটাতে ওরা মজা পেয়েছে ঠিকই, তবে পুরো ব্যাপারটাই ঘটল স্নোনের উপস্থিতিতে। সে যেভাবে যেভাবে বলে দিল ওরা ঠিক সেভাবে ওর ওপর চড়াও হলো।
লিন্ডার ধারণা, স্নোন ওর শরীরে ফার্টিলিটি ড্রাগ পুশ করেছে। মাস দুয়েক পরেই সে গর্ভবতী হয়ে পড়ল। স্নোন বেশ খুশি। মা হতে পারা প্রতিটি মেয়ের পরম সৌভাগ্যের বিষয়, কিন্তু লিন্ডা মোটেও সুখী হতে পারল না। কারণ জানে, কিছুদিনের মধ্যেই জনের মত ওকেও বরফের মধ্যে কবর দেয়া হবে, জীবত অবস্থা হবে ওর, গর্ভের সন্তানও হিমায়িত হয়ে রইবে।
ঘরের মধ্যে বন্দী অবস্থায় দিন কাটছিল লিন্ডার। সারাক্ষণই পালাবার চিন্তা করত। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিল না। মরিয়া হয়ে একটা বুদ্ধি আঁটল। তবে বুদ্ধিটা কাজে লাগানোর জন্যে দুটো কাঠের টুকরো দরকার। জিনিস দুটো ল্যাবরেটরি থেকে একদিন লুকিয়ে নিয়েও এল। ওরা লিন্ডার কি একটা টেস্ট করতে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়েছিল, সেই সময়। একটা টুকরোর সাইজ কিউবিক ইঞ্চি, অন্যটা চেটাল, চওড়ায় ইঞ্চি তিনেক। কাঠের টুকরো দুটোর ওপর লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু কাজ চালাল। আসলে দেয়াল আর মেঝেতে ঘষে ও দুটোকে আরও মসৃণ করে তুলল।
সেদিন সন্ধ্যার অনেক পরে ব্রানস্টোন এল ওকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যেতে, আর ও কিসব টেস্ট করাবে।
চলো, আমার সাথে, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলল সে, তারপর লিন্ডা পিছু পিছু। আসছে কিনা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ল্যাবরেটরির দিকে হাঁটা দিল।
দরজায় বাইরে থেকে ইয়েল লক লাগানোর ব্যবস্থা আছে, কী-হোলসহ। ভেতরের মেকানিজম নষ্ট। ঘর থেকে বেরুবার সময় কাঠের ছোট টুকরোটা গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল লিভা, এর ফলে দরজা বন্ধ করার সময় লকটা স্বাভাবিকভাবে উচু হয়ে থাকবে। ব্রানস্টোন এদিকে তাকাল না দেখে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে : কাঠের টুকরোটা শক্তভাবে লাগানো হয়েছে, সহসা পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই।
শ্রেন তার ল্যাবরেটরিতে মিনিট কয়েক পরীক্ষা করল লিন্ডাকে, কাজ শেষ করে ব্রানস্টোনের দিকে ঘুরল। ঠিক আছে, আমি লিস্ট তৈরি করছি। তুমি ডোভসকে বলো গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে। মেয়েটাকে ওর ঘরে নিয়ে যাও, তারপর তোমার কাজে যেয়ো! তোমরা ফিরে এলে, মাঝ রাত্তিরে কাজ শুরু করব।
স্নোন চলে গেল বরাবরের মত লিভার দিকে একবারও না তাকিয়ে। লিন্ডা কার্ডিগানটা গায়ে জড়িয়ে নিল, চেয়ে চেয়ে দেখল ব্রানস্টোন। তারপর নিয়ে চলল ওর ঘরে।
লিন্ডাকে ঘরে ঢুকিয়ে ব্রানস্টোন দরজা বন্ধ করছে, বিদ্যুৎগতিতে কাঠের গোঁজটা তালার নিচে, ফাঁকা জায়গাটাতে ঢুকিয়ে দিল, চেপে রাখল সর্বশক্তি দিয়ে। একটু পরেই শুনল ব্রানস্টোন চলে যাচ্ছে, জুতোর আওয়াজ উঠল মেঝেতে। আগে ভালভাবে দেখে যেত সে ঠিকঠাক তালা মারা হয়েছে কিনা। ইদানীং তেমন দেখে না। হতে পারে সে ভেবেছে লিন্ডা পালাবে না। আর পালালেও কোন লাভ হবে না। দুর্গম এই অঞ্চলের পথ-ঘাট তো আর সে চেনে না।
ব্রানস্টোন চলে যাবার পরে, দুরু দুরু বুকে কাঠের গোঁজটা টেনে খুলল লিভা, মনে মনে প্রার্থনা করল গর্তের মধ্যে আগে ঢুকিয়ে রাখা ছোট্ট কাঠের টুকরোটা যেন তালটিাকে বন্ধ হতে না দেয়। আনন্দে ফুপিয়ে উঠল দরজাটা খুলে যেতে। কাজ হয়েছে। সাবধানে পা রাখল সে এবার প্যাসেজে, কাঠের টুকরোটা হাতে নিয়েছে আগেই, তারপর বন্ধ করল দরজা। পা টিপে টিপে এগোল সিঁড়ির দিকে, সিঁড়ির মাথায় দরজা খুলে উঁকি দিল। মিটমিটে আলো জ্বলছে হলঘরে। বাতাসটা ঠাণ্ডা আর স্যাঁতসেঁতে। মনে পড়ল এ বাড়িতে আসার প্রথম দিনটির কথা। সেদিনও গা হিম করা ঠাণ্ডা ছিল। সে যেন অনেক আগের কথা।
সদর দরজায় একটা গাড়ি আসার আওয়াজ পেল, কে যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। চট করে সরে গেল লিন্ডা দরজার আড়াল থেকে, ডেভিস। হলঘর পার হয়ে দূরপ্রান্তের একটা দরজার দিকে এগোল সে!
পালাবার এটাই সুযোগ। না হলে এমন সুযোগ আর কোনদিন পাবে না ও। ভূতের মত নিঃশব্দ পায়ে হলঘরের দিকে এগোল লিন্ডা, দাঁড়িয়ে পড়ল দরজার সামনে। ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভাগ্য ভালই বলতে হবে, দরজার পাশে, একটা র্যাকে একটা রেইনকোট ঝুলছে। চট করে বর্ষাতিটা গায়ে। চাপাল। তারপর দরজা খুলে পা রাখল বাইরে।
চারদিকে নজর বুলিয়ে লিন্ডা বুঝতে পারল এমন বর্ষার রাতে, চেনে না জানে এমন দুর্গম একটা এলাকায়, ছুটে পালানোর চিন্তা বাতুলতা মাত্র। ওর জানা নেই আশ-পাশে আর কোন ঘর বাড়ি আছে কিনা। রাস্তায় বেরুলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে দিশা হারিয়ে ফেলবে। কে জানে ওরা কুকুর পোষে কিনা। তা হলে নিরাপদ কোন আশ্রয়ে যাবার আগেই ওরা ওকে ধরে ফেলবে। কপালে যা থাকে ভেবে এক দৌড়ে স্নোনের গাড়ির বুট খুলে ভেতরে বসে রইল লিন্ড।
খানিক পরে লোকজনের সাড়া পেল, গাড়ির দিকেই আসছে। এখন ওরা কোন কারণে গাড়ির বুট খুলে ফেললেই সে শেষ। গাড়ির পেছন দিয়ে কেউ একজন যাচ্ছে টের পেয়ে বন্ধ করে রাখল দম। দুপদাপ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, ভয় হলো হার্টবিটের আওয়াজ শুনে ফেলবে লোকটা। লোকটা গাড়িতে উঠে বসল, দড়াম করে বন্ধ করল দরজা। গর্জন ছেড়ে চালু হয়ে গেল এঞ্জিন, চলতে শুরু করল, লিন্ডাকে যেন উদ্ধার করে নিয়ে চলল নরক থেকে। চোখে জল এসে গেল ওর। নীরবে কাঁদতে লাগল।
বুটের মধ্যে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিল লিভা, গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবে কষ্টটাকে আমল দিল না। ভাবছিল স্নোন সাপার নিয়ে এসে যখন দেখবে সে পালিয়েছে, কিরকম প্রতিক্রিয়া হবে তার। রাগে উন্মাদ হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। সে কি সন্দেহ করতে পারে গাড়িতে চড়ে কেটে পড়েছে লিন্ডা? ব্রানস্টোন এবং ডেভিসের সাথে সে নির্ঘাত যোগাযোগ করবে, ফোন করবে গ্লাসগোর ল্যাবরেটরিতে। ওরা লিন্ডা পালিয়েছে শোনা মাত্র ফিরে আসবে হান্টিং লজে। কাজেই থামা মাত্র নেমে পড়তে হবে লিন্ডাকে।
কতক্ষণ ধরে গাড়ি চলছিল জানে না, তবে প্রায়ই অন্যান্য বাহনের হুস করে পাশ কেটে যাবার শব্দে বুঝতে পারছিল শহরে ঢুকে পড়েছে ওরা। ওরা গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত কোথাও গাড়ি থামাবে বলে মনে হলো না। আরও অনেকক্ষণ গাড়ি চলার পারে থেমে গেল এক জায়গায়। লিন্ডা শুনল ব্রানস্টোন নামছে দরজা খুলে।
তুমি এগোও, ডেভিসের গলা শোনা গেল। আমি গাড়িটা পার্ক করে আসছি এখুনি।
শঙ্কিত হয়ে উঠল লিন্ডা, ব্রামস্টোন ল্যাবরেটরিতে ঢোকামাত্র ওর খবর পেয়ে যেতে পারে। এদিকে গা; ঘুরিয়ে পার্ক করল ডেভিস, থেমে গেল এঞ্জিনের শব্দ, টের পেল নামছে সে। গুনে গুনে দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করল সে, তারপর ধাক্কা মেরে বুট খুলল, নেমেই দিল দৌড়। কে যেন ওর নাম ধরে ডাক দিল। কিন্তু পেছন ফেরার সাহস পেল
ও। কারও সাহায্য পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে ও, হঠাৎ একতলা বাড়িটা চোখে পড়ল। ছোট গেট টপকে ভেতরে ঢুকতে অসুবিধে হলো না। কলিংবেলে পাগলের মত চাপ দিতে লাগল ও। দরজা খুলে গেল। অবাক হয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরই বান্ধবী শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড।
লিন্ডার রোমাঞ্চকর, অবিশ্বাস্য গল্প শেষ হলো। লিভিংরুমের ফায়ারপ্লেসের আগুন প্রায় নিবু নিবু হয়ে এসেছে। পুরো গল্পটা মনোযোগের সাথে শুনেছে শ্যারন, কোন প্রশ্ন বা মন্তব্য করেনি। দেখল গল্প শেষ করার পরে বান্ধবীর চেহারায় ভয় এবং শঙ্কা ফুটে উঠেছে, নরক থেকে পালিয়ে আসার ভয়াবহ স্মৃতি নতুন করে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে গেছে ওকে।
গল্প শেষ করে মৃদু গলায় লিভা বলল, আমি কল্পনাও করিনি তোকে এখানে দেখব।
শ্যারন বলল, মাস দুয়েক আগে কটেজটা ভাড়া করেছি। নতুন একটা লেখায় হাত দিয়েছি। কিন্তু যাকগে ওসব। তুই এখন কি করবি?
জানি না কি করব, গুঙিয়ে উঠল লিন্ডা। ওরা হয়তো দেখেছে আমাকে এখানে আসতে, বাইরে অপেক্ষা করছে।
মনে হয় না। তবু আমরা কোন ঝুঁকি নেব না। আমি এখুনি পুলিশকে ফোন করছি। ওরা এসে পড়লে আর ভয় নেই।
শ্যারনকে গায়ে কোট চাপাতে দেখে সভয়ে জিজ্ঞেস করল লিন্ডা, কোথায় যাচ্ছিস?
ফোন করতে। আমার ফোনটা নষ্ট। রাস্তার ধারে একটা ফোন বক্স আছে। পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না।
আমাকে একা রেখে যাবি? আর্তনাদ করে উঠল লিন্ডা।
তাহলে তুইও চল সাথে।
ওরে বাবা! রাস্তায় আমি কিছুতেই যাব না। আঁতকে উঠল লিন্ডা।
বেরুনো ঠিকও হবে না, ওর সাথে একমত হলো শ্যারন। ভয় নেই। এখানে কোন সমস্যা হবে না। আমি যাবার পরে দরজাটা বন্ধ করে দিবি। বলে দরজা খুলল শ্যারন এবং আক্রান্ত হলো।
কে জানে কখন থেকে ওরা ওঁৎ পেতে ছিল দরজার পাশে। দরজায় কান লাগিয়ে হয়তো সব শুনেছে। অপেক্ষায় ছিল কখন শ্যারন দরজা খুলবে। লিভার কথাই ঠিক ওরা দেখে ফেলেছিল ওকে। অনুসরণ করে চলে এসেছে ওখানে।
কানের ঠিক নিচে রবারের শক্ত ডাণ্ডার বাড়িটা লাগল শ্যারনের, গলা দিয়ে বিদঘুটে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল, হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেতে। বিদ্যুৎগতিতে ভেতরে ঢুকে পড়ল ব্রানস্টোন এবং ডেভিস। ওদেরকে দেখে ভীষণ আঁতকে উঠল লিন্ডা, ঝট করে উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে। এক লাফে ওর পাশে পৌঁছে গেল হালকা-পাতলা ডেভিস, চকচকে একটা ক্ষুর গলায় চেপে ধরে হিসিয়ে উঠল, আওয়াজ দিয়েছ কি এক পোচে কল্লা নামিয়ে দেব।
অবশ্য চিৎকার করলেও লিন্ডার আর্তনাদ কেউ শুনতে পেত কিনা সন্দেহ। কারণ আশপাশে দুএক মাইলের মধ্যে আর বাড়ি-ঘর নেই, শুধু স্লোনের ল্যাবরেটরি ছাড়া। নির্জনতা পছন্দ করে লেখিকা শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড। তাই লোকালয় থেকে এত দূরের একটা বাড়ি বেছে নিয়েছে লেখালেখির জন্য। লোকজনের হৈ-হট্টগোল পছন্দ করে না বলে স্লোনও শহরতলির শেষ মাথায় ওর ল্যাবরেটরি বানিয়েছে।
ড. স্নোন রেগে বোম হয়ে আছেন, দুষ্ট মেয়েকে বোঝাবার ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল ব্রানস্টোন। এখন চলো। হাত ধরে টান দিল সে।
শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় খুঁজে ওরা যখন বাড়ির বাইরে এসেছে, তখন পুবাকাশ একটু একটু ফর্সা হতে শুরু করেছে। দূরে অপেক্ষমাণ গাড়িতে ওরা ঠেলতে ঠেলতে তুলল লিডাকে। যন্ত্রচালিত পুতুলের মত গাড়িতে উঠে বসল লিন্ডা, মাথাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে আছে, কিছুই ভাবতে পারছে না সে, মেনে নিয়েছে অমোঘ নিয়তিকে। তাই সারা রাস্তা সম্মোহিতের মত বসে থাকল সে, ফিরতি পথে একটা কথাও বলল না। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পুরানো হান্টিং লজের সেই ল্যাবরেটরিতে।
স্নোন লিন্ডাকে দেখে আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, আমাদের অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছ তুমি। পুলিশ-টুলিশ এলে ওদের উৎকট প্রশ্নের জবাবে এখন আমাদের আগেই সাবধান হয়ে যেতে হবে। যদিও তোমার নিয়তি কেউ খাতে পারবে না।
লিন্ডা স্লোনের কথা শুনছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তার চেহারা শান্ত, ভয় বা আশঙ্কার কোন ভাব ফুটে নেই। যেন সমস্ত আবেগ, অনুভূতি শুষে নেয়া হয়েছে। ভয়, আতঙ্ক, আশা-আকাঙ্ক্ষা সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখন লিন্ডা রেনল্ডস।
স্নোনের নির্দেশে তার সঙ্গীরা কাজ শুরু করে দিল। ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশ যাতে ঘটতে না পারে সে জন্য আগেভাগে ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখা হয়েছে। এখন চুড়ান্ত প্রসেসিং-এর আগে বাকি কাজগুলো সেরে নিতে হবে।
ওরা জামা-কাপড় খুলে নগ্ন করল লিভাকে, মেয়েটা পাথর হয়ে দাড়িয়ে রইল, সামান্য ধস্তাধস্তি পর্যন্ত করল না। ওর লম্বা সুন্দর চুলগুলো ঘেঁটে দেয়া হলো, কামানো হলো মাথা। তারপর অত্যন্ত সাবধানে শরীরের অন্যান্য সমস্ত অবাঞ্ছিত লোমও চেঁছে ফেলা হলো ক্ষুর দিয়ে। তারপর স্টিম বাথ দেয়া হলো লিন্ডাকে। প্রতিটি লোমকূপের গোড়া থেকে দূর করা হলো ধূলিকণা। সবশেষে শরীর শুকিয়ে ফেলা হলো পরম বাষ্প চালিয়ে।
গোটা ব্যাপারটা তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করল স্লোন। সন্তুষ্ট হয়ে মেয়েটাকে ঠাণ্ডা স্টেরিলাইজড় টেবিলে শুইয়ে দিল, হাইপডারমিক সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে দাঁড়াল পাশে। নিষ্প্রাণ চোখে ওকে দেখল লিন্ডা।
অবশেষে সময় হয়েছে, উল্লাসের সাথে ঘোষণা করল স্নোন। সুঁইর সামান্য একটা গুঁতো ছাড়া আর কোন ব্যথা পাবে না তুমি! ইনজেকশনটা দেয়ার পরে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসবে তোমার কাছে, যদিও খানিক পরে বুঝতে পারবে তোমাকে হিমায়িত করতে চলেছি আমরা। এরপর সীমাহীন নীরবতা ছাড়া আর কিছুই টের পাবে না।
ফাঁকা চোখে তাকিয়ে রইল লিন্ডা ছাদের দিকে, পুট করে ওর কোমল বাহুতে সুই ফোটাল স্লোন।
পরের কয়েক ঘণ্টা লিন্ডাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকল ওরা। গা থেকে সমস্ত রক্ত শুষে নেয়া হলো, পরিবর্তে গ্ল্যাকো-স্যালাইন সল্যুশন ঢোকানো হলো। এ জিনিসটা প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতেও জমাট বাঁধবে না বা শরীরের কোন অঙ্গের ক্ষতি করবে না। লিন্ডাকে উজ্জ্বল সবুজ রঙের একটা ধাতব ক্যানিস্টারে শোয়ানো হলো। সারা শরীরে পেচানো হলো তার। তারগুলো ল্যাবরেটরির নানা যন্ত্রপাতির সাথে আটকানো। এটা আসলে একটা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রস্তুত কফিন। কয়েকটা সুইচ টিপতেই ক্যানিস্টারের ভেতরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে আসতে লাগল।
বন্ধ করে দাও, নির্দেশ দিল স্লোন। ঢাকনি নামিয়ে সীল করে দেয়া হলো। তারপর ক্যানিস্টারটা ব্রানস্টোন এবং ডেভিস টেনে নিয়ে গেল দেয়ালের কাছে। দেয়ালটা আগেই খুঁড়ে গর্ত করে রাখা হয়েছে, ভেতরে ক্যানিস্টারটা বসিয়ে দিল ওর। তারপর দ্রুত হাতে ফাঁকা দেয়াল ভরাট করে ফেলল ইট আর বালু দিয়ে।
স্নোন শেষবারের মত তাকাল দেয়ালের f, ঘুরল সিঁড়ি ঘরের দিকে। ওদিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বিড়বিড় করে যে জেকেই শোনাল, এখন তুমি আমাকে ঘৃণা করছ, মাইডিয়ার, কিন্তু একশো বছর পরে তোমার অনুভূতিটা অন্যরকমও হতে পারে।
[মূল: উইলিয়াম সিনক্লেয়ার-এর দ্য হরিফাইং এক্সপেরিমেন্টস অভ ড. জেসন স্লোন।]