ঘৃণা

ঘৃণা

ঘৃণা

এক শিশুদের আমি ঘৃণা করি।

ওদের কষ্ট দিতে ভাল লাগে আমার। ভাল লাগে গায়ে আগুনের ছ্যাকা দিতে।

আমাকে পারভার্ট বলতে পারেন আপনারা। পাগল বললেও কিছু এসে যাবে। কিন্তু খবরদার, বেঁটে বামুন বলে কখনও খেপাবেন না। তা হলে খবর করে দেব। শক্তিতে হয়তো আপনার সাথে পারব না। কিন্তু আমাকে অপমান করার শোধ ঠিকই নেব। আপনার ঘরে যদি কাচ্চা-বাচ্চা থাকে তাহলে ওরা হবে আমার। প্রতিশোধের শিকার। ধরে নিয়ে গিয়ে আগুনের ছ্যাকা দেব গায়ে। ওরা যন্ত্রণায়। চিৎকার করবে। আমি তখন আনন্দে হাততালি দেব।

শিশুরা আমাকে দেখতে পারে না। বামন বলে খেপায়। এক সময় চাকরের কাজ করতাম। এক বড়লোকের বাসায়, পাঁচ বছরের বিছুটার ভয়ে সব সময় সিটিয়ে থাকতে হত। আমাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে খুব আনন্দ পেত শয়তানটা। মুখ বুজে সব সহ্য করেছি। কারণ ওই সময় আমার যাবার কোন জায়গা ছিল না। রাস্তায় ফেরিওয়ালার কাজটা ছেড়ে দিতে হয়েছে এই বিচ্ছুগুলোর যন্ত্রণায়। ওরা আমাকে যেখানে দেখে সেখানেই পিছু নেয়। বাটকু বেঁটে বাটুল বেঁটে ভূত ইত্যাদি বলে খেপায়। আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু চেহারা এবং আকৃতি নিয়ে অপমান সইতে পারি না। জানি আমি দেখতে সুন্দর নই, তার ওপর ছোট বেলায় পোলিও রোগে একটা ঠ্যাং গেছে বাঁকা হয়ে। চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা ছিল না দিনমজুর বাপের। এক গাদা ভাইবোেন আমরা 1 খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসি আমি। পরে একটা চায়ের দোকানে কাজ জুটেছিল। কিন্তু খদ্দেরদের আমার চেহারা নিয়ে কটুক্তি সহ্য করতে না পেরে চাকরিটা ছেড়ে দিই। কিছুদিন আইসক্রীম বিক্রি করেছি। বিচ্ছুগুলো বাকি খেয়ে তাও লাটে উঠিয়ে দিয়েছে। ওদের তোয়াজ করতাম যাতে আমাকে আজে বাজে কথা না বলে। কিন্তু একেকটা লম্বায় আমার সমান হলে কি হবে, বুদ্ধিতে সব কটা ধাড়ি শয়তান। চেটেপুটে আইসক্রীম খাওয়া শেষ হলে বেঁটে বাটক বলে দৌড় দিত। ওদের সাথে দৌড়ে পারতাম না, নিষ্ফল আক্রোশে রাস্তায় দাড়িয়ে ফুঁসতাম।

গুলশানের বাড়িটাতে আমার চাকরি হয়েছে আইসক্রীম বিক্রি করতে গিয়ে। সোবহান সাহেবের বাচ্চাটাকে দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। বাচ্চাটার বাবা-মা দুজনেই চাকরি করেন একটা বিদেশী এমব্যাসীতে। অসুস্থ বিলটুর খেলার সাথী কেউ নেই। আমাকে ওই বাড়িতে চাকরি দেয়া হলো সার্কাসের ক্লাউন সেজে বিলটুর খে হাসি ফোটানোর জন্য। বিনিময়ে মাস গেলে মোটা বেতন। আগেই বলেছি, তখন আমার আইসক্রীমের ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাকরিটা নিলাম। আর প্রথম দিনই বিলটুর উদ্ভট নির্যাতনের শিকার হতে হলো। আমাকে ঘোড়া বানিয়ে, পিঠে উঠে আমার অর্ধেক চুল ছিঁড়ে ফেলল সে। আর হট ঘোড়া হাট বলে পেটে লাথি মেরে সে কালশিটে ফেলে দিল শরীরে। কোনমতে একটা হপ্তা টিকে থাকলাম। ততদিনে আমার সামনের পাটির দুটো দাঁত নড়ে গেছে বিলটুর লাথি খেয়ে, ডান কান সব সময় আঁ আঁ করে ও নলের মত কি একটা জিনিস ঢুকিয়ে জোরে ফু দেয়ার পর থেকে। আমার বাঁ পা মচকে গেল ওর হুকুমে দোতলার সিঁড়ি লাফাতে গিয়ে। বিলটুর বিটকেলে নির্যাতনে আমার দিশেহারা অবস্থা। শুকননা, পাটখড়ির মত, মায়াবী চেহারার খুদেটার মাথায় অত দুর্বুদ্ধি জানলে আমি রাস্তায় ভিক্ষে করে পেট চালাতাম, জনমেও এ বাড়িতে আসতাম না। আসলে শিশুদের মত নিষ্ঠুর পৃথিবীতে নেই। ওরা দেব শিশু না ছাই। একেকটা ইলিশের দোসর।

শিশুদের আমি এমনিতেই দেখতে পারি না। বিলটুর অত্যাচারে ওদের প্রতি ঘৃণা আমার আরও বেড়ে গেল। পালিয়ে যাব ঠিক করলাম। তার আগে বিলটুটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।

রোববার দিন বিলটুর বাবা-মা যথারীতি অফিসে যাবার পর বিলটু আমার ওপর তার বিদঘুটে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে দিল। ছোকরার নাকি হার্টের সমস্যা আছে। তাই ওকে এখনও স্কুলে ভর্তি করেননি সোবহান সাহেব। তবে বিলটুর মা ওকে বাড়িতে এ বি সি ডি শেখান। তারা অফিসে যাবার আগে পইপই করে পুত্রধনকে বলে যান সে যেন দুষ্টমি না করে বই-খাতা নিয়ে বসে। কারণ সামনের মাসে বাড়ির কাছে কিন্ডার গার্টেনটায় বিলটুকে ভর্তি করে দেবেন তাঁরা। বিলটুকে নিয়মিত স্কুলে যেতে হবে না, শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিলেই চলবে। তবে ভর্তি পরীক্ষায় তো আগে পাস করতে হবে। বিলটু সুবোধ ছেলের মত মাথা দোলালেও, যেই সোবহান সাহেবের গাড়ি গেট পেরিয়ে রাস্তায় পড়েছে, সাথে সাথে দুরন্ত গতিতে বাঁদরামি শুরু হয়ে গেল তার।

কিচেন থেকে একটা রঙিন মোমবাতি নিয়ে এল বিলটু। বলল, মজা দেখবে। এসো? আমার হাত টানতে টানতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল সে। দরজা বন্ধ করে পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করল। আমি তটস্থ হয়ে থাকলাম নতুন অঘটনের ভয়ে। বিলটু এবার বাথটাবের কল ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে টলটলে জলে ভরে গেল বাথটাব। তারপর জিন্সের ঢাউস প্যান্টের আরেক পকেট থেকে একটা ছোট বাক্স বের করল। বলল, এবার তুমি বাথটাবে নেমে পড়ো।

কেন? জানতে চাইলাম আমি।

আহ্, নামোই না। মজা দেখবে।

বিনাবাক্যব্যয়ে একান্ত অনুগত দাসের মত লুঙি পরেই বাথটাবে নেমে পড়লাম আমি।

বিলটু বলল, ডুব দাও। চোখ বন্ধ করে।

আমি এক হাতে নাকে আঙুল টিপে ধরে মাথা ডুবিয়ে দিলাম পানিতে। হঠাৎ ছ্যাত ছাত শব্দ শুনে চোখ মেললাম। দৃশ্যটা দেখে ভয়ে আত্ম উড়ে গেল। বিলটু জ্বলন্ত মোমবাতিটা উল্টো করে ধরে আছে, মোম গলে পড়ছে পানিতে আর ছ্যাত ছাত শব্দ হচ্ছে। আর বিরাট এক আরশোলা গরম মোমের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাণপণে সাঁতার কাটছে বাথটাবে। নিচ থেকে ওটাকে দেখতে বিকট এবং ভয়ানক লাগছে। বিলটুর দাত বের করা মুখখানাও কিম্ভুতকিমাকার লাগল।

আরশোলাকে আমি ভয় পাই যমের মত। মুখ হাঁ করে চিৎকার করতে যেতে নাকের মধ্যে গড়গড় করে পানি ঢুকে গেল, খাবি খেয়ে লাফিয়ে উঠলাম আমি। নামতে গিয়ে পিছলা বাথরুমে পা পিছলে আলুর দম হয়ে গেলাম। মোজাইক করা মেঝেতে ভীষণভাবে ঠুকে গেল মাথাটা। পরক্ষণে কপালের কাছটা জ্বলে উঠল ভীষণভাবে। চেয়ে দেখি বিলটু হাসি মুখে জ্বলন্ত মোমবাতিটা উল্টো করে ধরে আছে আমার মুখের ওপর, ফোটায় ফোটায় গরম মোম গলে পড়ছে।

আর সহ্য হলো না। শুয়ে শুয়ে ল্যাং মেরে দিলাম বিলটুর পায়ে। প্যাকাটি বিলটু লাথি খেয়ে দড়াম করে পড়ে গেল আমার পাশে। মোমটা ছিটকে পড়ল বাথটাবের এক কোণে। বিদ্যুৎগতিতে ওটা তুলে নিয়ে বিলটুর যন্ত্রণায় হাঁ করা মুখে ঠেসে ধরলাম। বিকট গলায় চিৎকার করে উঠল বিলটু আল জিভে জ্বলন্ত শিখার ছ্যাকা খেয়ে। আমি দুহাতে চেপে ধরলাম ওর মুখ যাতে আর চিকার করতে না পারে। বিলটু বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল, পা ছুঁড়ল কাটা মুরগীর মত, তারপর স্থির হয়ে গেল। বিলটুর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। গাজলা আর রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে হাত। রাগে আর ব্যথায় শরীর তখনও কাঁপছে আমার। শয়তানটা অজ্ঞান হয়ে আছে না মারা গেছে খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছেই হলো না। বিলটুর যে দশা আজ করেছি আমি, সোবহান সাহেব এসে দুটুকরো করে ফেলবেন আমাকে। কাজেই পালাতে হবে। ঢাকা শহর ছেড়ে দূরে, অনেক দূরে। কেউ যেখানে আমার খোঁজ পাবে না কখনও।

০২.

বিলটু সম্ভবত মারা যায়নি। কারণ সোবহান সাহেবের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসার পর কোন পত্রিকায় শ্বাসরোধ হয়ে শিশু মৃত্যুর কোন খবর আমার চোখে অন্তত গত পনেরো দিনে পড়েনি। বলতে ভুলে গেছি, গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। যাহোক, প্রথম কটা দিন খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এখনও যে নির্ভয়ে আছি তা বলব না। বলা যায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। বিলটুদের বাসা থেকে পালানোর সময়ে আমার আগের জমানো টাকা আর বিলটুর গলা থেকে দুভরি ওজনের সোনার চেনটা নিয়ে এসেছি। চেন বা হাটা মফস্বলের এক সোনার দোকানে অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি করে সেই টাকায় এখনও চলছি। ঠিক করেছি এ দেশে আর থাকব না, সীমান্ত পার হয়ে ভারত চলে যাব। ওখানে কোন কাজ জুটিয়ে নেব। বিচিত্র ধরনের কাজের অভিজ্ঞতার তো কমতি নেই আমার। এখানে থাকা আমার জন্য ঝুঁকি। কারণ বিলটুর যে দশা করে এসেছি, তাতে সাবহান সাহেব প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না। কে জানে গোপনে আমাকে পুলিশ খুঁজছে কিনা। তাই বড় শহর বাদ দিয়ে শুধু মফস্বল শহরগুলোতে ঘাপটি মেরে থাকার চেষ্টা করছি। আপাতত মঠবাড়িয়া শহরে আছি। এখান থেকে নদী পথে মংলা চলে যাব। ওখান থেকে জাহাজে চড়ে হুগলি পগার পার হব।

মঠবাড়িয়ায় আগে বাস চলত না, এখন চলে। আমি সেদিন বাসে চড়ে বড় মাউছ্যা নামে একটা জায়গায় যাচ্ছি, ভর ভরন্তি বাসে, আমার ঠিক সামনের সিটে এক কামলা শ্রেণীর মহিলা উঠল, কোলে নদশ মাসের বাচ্চা।

আমাকে সিগারেট খেতে দেখে সে ভয়ানক কুটি করল। পাত্তা দিলাম না। মহিলাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে উদাস দষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম বাইরের দিকে। মহিলা সিটে বসে বা কাধে শোয়াল তার বাচ্চাকে, আঁচল দিয়ে বাতাস করতে লাগল। বাচ্চাটার পা ঝুলে রইল তার মার বুকের ওপর, মাথাটা কাঁধ আর ঘাড়ের মাঝখানে। কালো, স্বাচ্ছ চোখ মেলে জুল জুল করে তাকিয়ে থাকল সে আমার দিকে। খোদা জানে এই খুদে মানুষটা কি ভাবছে মনে মনে। আর তখুনি আমার ভেতরে দুষ্ট বুদ্ধিটা জেগে উঠল।

আমি বসে আছি বাসের একেবারে পেছনের সিটে, সামনে যাত্রীদের কালো কালো মাথা। আড়চোখে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকালাম। না, কেউ আমার দিকে তাকিয়ে নেই। ঠিক এই সময় বাচ্চাটা তার মধুরঙা মুখখানা খুলল হামি দিতে। আর সাথে সাথে জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠেসে ধরলাম বাচ্চাটার ছোট্ট, গোলাপী জিভে।

বেশ বেশ!

যদি আপনি থাকতেন ওখানে! এমন ভয়ানক চিৎকার জীবনেও শুনিনি আমি; যন্ত্রণা আর ভয়ে বিকট গলায় কেঁদে উঠল বাচ্চা। আমার গায়ের রোম পর্যন্ত বাড়া হয়ে গেল। সাথে সাথে সিগারেটটা পায়ের নিচে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে ফেললাম।

বাচ্চার হঠাৎ গগনবিদারী চিৎকারে হতভম্ব হয়ে গেল মা। যাত্রীরা কি হয়েছে? কি হয়েছে? বলতে লাগল। বাচ্চা তখনও সমানে চিৎকার করেই চলেছে। আমিও সহানুভূতিশীল হয়ে জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? বাচ্চার মা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি সন্তানের কান্নার কারণ। সে বাচ্চার হাত দেখছে, পা দেখছে, জামা উন্টে পেট দেখছে। বাচ্চা ওদিকে তারস্বরে কেঁদেই চলেছে। এমন সময় ব্রেক কষে থেমে গেল বাস। কি ব্যাপার? না, গন্তব্যে পৌঁছে গেছি আমরা। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল যাত্রীদের মাঝে কে আগে নামবে তাই নিয়ে। এখান থেকে অনেকেই লঞ্চে দূরদূরান্তে যাত্রা করবে। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে আমিও আলগোছে নেমে পড়লাম। নামার ঠিক আগের মুহূর্তে শুনতে পেলাম বাচ্চার মা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে, খোদারে, মোর মনুর মুখে কেডায় জানি আগুন চাইপা ধরছে। আমার চলার গতি দ্রুত হলো। এখানে একটা নির্জন জায়গায় আমার আরেকটা গোপন ঘাঁটি আছে। ওখানে আমার কিছু মাল-পত্র আছে। ওগুলো নিয়ে আসতেই যাচ্ছি। তারপর আজ রাতে কেটে পড়ব এখান থেকে।

০৩.

আমি শিপলু। আমার বয়স আট। আর আমার প্রাণের বন্ধু টুবলুর বয়সও আট। দুজনেই বড় মাউছা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রীতে পড়ি। কিছুক্ষণ আগে আমরা দুজনে দারুণ একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি। আমাদের বাসা থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে একটা পুরানো ইটের ভাটা আছে। এখন আর ওখানে কেউ যায় না। কিন্তু আমি আর টুলু বাবা মার চোখ এড়িয়ে সুযোগ পেলেই ওখানে চলে যাই। চোর-পুলিশ খেলি। কখনও আমি হই চোর, টুলু পুলিশ। আবার টুলু চোর, আমি পুলিশ।

যা হোক, যা বলছিলাম। আজ দুপুরে, বাবা যখন অফিসে আর মা খাওয়াদাওয়া সেরে দিবান্দ্রিায় মগ্ন, এইসময় টুই টুই পাখির ডাকে বিছানা থেকে ভূতের মত নিঃশব্দে নেমে এলাম আমি। খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি টুলু। ওর হাতে একটা ঝোলা। ওতে কি কি আছে সব চোখ বুজে বলে দিতে পারি আমি। একটা জংধরা পুরানো হ্যান্ডকাফ, (শিপলুর বাবা দারোগা। কাজেই এই জিনিসটা জোগাড় করতে কষ্ট হয়নি ওর। ওদের ভাড়ার ঘর থেকে হ্যান্ডকাফটা চুরি করেছে টুলু। চাচী এ ব্যাপারে কিচ্ছুটি টের পায়নি, মাহতাব চাচা তো নয়ই।) একটা লম্বা রশি (চোরের হাতে শুধু হ্যান্ডকাফ পরালেই চলবে না, তার কোমরে রশি বাধতেও হবে।) আর কিছু স্কচ টেপ যে চোর সাজে তার মুখ অন্যজন টেপ দিয়ে বেঁধে দেয়। চুরির সাজা আর কি।

তো টুলু আসতেই আমাদের গায়ে যেন পাখা গজাল। প্রায় উড়ে চলে গেলাম। গোপন আস্তানায়। আর সেখানে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল লোকটাকে দেখে। আমাদের চেয়েও বেঁটে লোকটা মাথায় কাকের বাসা, ডান পা-টা বাকা, মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাডি। লোকট, ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে ভাটির পশ্চিম দিকে, গুহামত জায়গাটায়। গুহা থেকে হাত দশেক দূরে আমাদের চোরপুলিশ খেলার স্থান। ওখানে আমাদের কিছু গোপন জিনিসপত্র আছে। দ্রুত সব পরীক্ষা করে দেখলাম। না ঠিক আছে, হারায়নি কিছু। কিন্তু বেঁটে বামনটার আকস্মিক অনুপ্রবেশে সাংঘাতিক বিরক্ত হলাম দুজনে। এ লোকটাকে এর আগে কখনও দেখিনি এদিকে। উড়ে এসে জুড়ে বসল নাকি? বেজায় মেজাজ খারাপ হলো। আর। তক্ষুণি মাথায় দারুণ একটা বুদ্ধি এল। টুলুকে ডেকে কানে কানে বললাম প্র্যানটার কথা। উত্তেজনায় চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর। জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে আমার কথায়। আর সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে পড়লাম দুজনে।

লোকটার ঘুম কি গভীর রে, বাবা! আমাদের খিকখিক হাসি, পায়ের শব্দ কিছুই টের পাচ্ছে না। যখন একসাথে লাফিয়ে পড়লাম ওর বুকের ওপর এবং চট করে হ্যান্ডকাফ জোড়া পরিয়ে দিলাম হাতে, ধড়মড় করে জেগে গেল সে। উঠে বসতে গেল। কিন্তু আমি ওকে মাটির সাথে জোরে চেপে ধরে থাকলাম আর টুবলু দক্ষ হাতে লোকটার পা বেঁধে ফেলল দড়ি দিয়ে। দারোগার ছেলে হলে এ সব কাজ কারও কাছে শিখতে হয় না। লোকটা চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কিন্তু আমি আর টুলু জোরে মুখ চেপে ধরে থাকলাম। টুবলু ঝোলা থেকে স্কচ টেপ বের করে কষে লোকটার মুখে লাগিয়ে ফেলল। এখন যতই চিৎকার করো আর শব্দ শোনা যাবে না। অসহায়ভাবে ঘেত ঘোত করতে থাকল লোকটা। মজা পেয়ে হাততালি দিলাম আমরা। কিন্তু এটুকু মজায় আমাদের হবে না, আরও মজা পেতে হবে। বিশেষ করে চোরদের শাস্তি দেয়ার মধ্যে দারুণ মজা আছে। যদিও সে সুযোগ আমরা কেউই পাই না। আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না বড়দের চোখ রাঙানি আর থাপ্পড়ের ভয়ে। বড়রা যেটা করতে নিষেধ করে ঠিক সেই কাজটা করতে যে কি মজা তা যদি ওরা জানত! বাবা-মা আর বড় ভাইয়ার শাসনের ঠেলায় ওষ্ঠাগত প্রাণ আমার। টুবলুরও। ওর বড় বোনটা তো পান থেকে চুন খসলেই বেধড়ক পিট্টি লাগায় বেচারা টুলুকে। একটুও মায়া করে না। এজন্য বড়দের দেখতে পারি না আমরা। সবসময় ওদের অনিষ্ট করার চিন্তা গিজগিজ করে মাথায়। ইচ্ছে করে ওদের ধরে মারতে। কি শক্তিতে পারব না বলে সাহসে কুলোয় না। তবে একটা ধেড়ে ইদুরকে তো। পেয়েছি। এবার এটাকে নিয়ে একটু মজা করা যাক।

চড়ইভাতি খাওয়ার জন্য আমি আর টুলু আমাদের গোপন আস্তানায় ছোট হাঁড়ি-পাতিল, ম্যাচ ইত্যাদি সব রেখে দিয়েছি। করলাম কি, শুকনো ডাল পাতা কুড়িয়ে এনে তাতে আগুন জ্বালালাম। তার মধ্যে দুটো লোহার শিক খুঁজে দিলাম। মা তার লাকড়ির চুলোয় আগুন উস্কে দিতে এই শিকগুলো ব্যবহার করে। আমি একটা শিক রান্নাঘর থেকে চুরি করেছি আর টুবলু ওরটা রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে।

দেখতে দেখতে লোহার শিকের ডগাটা লাল হয়ে উঠল। কিন্তু টুলু বলল তার শিকের ডগা সাদাটে রঙের না হওয়া পর্যন্ত ওটা সে তুলবে না। টিভির ছবিতে এভাবে লোহার শিক গরম করতে দেখেছে ও।

আমার শিকটা যথেষ্ট গরম হয়েছে। আমি ওটা দিয়ে বামনার পায়ে, হাতে আর মুখে ছাকা দিতে শুরু করলাম। টুলুও একটু পর তাই করতে লাগল। সেই সাথে দেখা গেল মজা।

টেপ দিয়ে মুখ বন্ধ বেঁটে লোকটা অদ্ভুত সব ভোতা, ফুপা শব্দ করতে লাগল। শরীর মোচড় খাচ্ছে মাটিতে কাটা সাপের মত। পা বাধা বলে উঠেও দাঁড়াতে পারছে না। ওর চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে। চিবুক বৈয়ে বিশ্রী রঙের তরল পদার্থ টপটপ করে পড়তে শুরু করল। আমরা বাটকুলটার দশা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি আর কি!

আচ্ছা, ওর বিস্ফারিত চোখের মধ্যে যদি গরম শিকটা ঢুকিয়ে দেয়া যায়?

ঠিক এই ভাবে।

ওয়াক থুঃ, মাংস পোড়ার কি বিশ্রী গন্ধ!

একটু পরে নড়াচড়া থেমে গেল লোকটার। চিৎ হয়ে পড়ে থাকল সে মাটিতে। চোখের জায়গায় মণি নেই, লাল ঘা দগদগ করছে। আমার গা গুলিয়ে উঠল। তবে আনন্দও হচ্ছে বেশ। খেলাটা জমেছিল চমৎকার। সুযোগ পেলে এরকম খেলা অরও খেলব বড়দের নিয়ে, একমত হলাম আমি আর টুলু।

বড়দের আমরা ঘৃণা করি।

ওদের কষ্ট দিতে ভাল লাগে আমাদের।

ভাল লাগে গায়ে আগুনের ছ্যাকা দিতে।

[নিরম্যান কাউফম্যানের ‘ফ্লেইম’-এর ছায়া অবলম্বনে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *