মুক্তির অন্বেষায়

মুক্তির অন্বেষায়

প্রায় দশলাখ বছর আগে প্রাণিজগতে যখন মনুষ্য শ্রেণীর উদ্ভব, তখন থেকেই হয়তো শুরু হয় মানুষের মুক্তির অন্বেষা। জন্মমুহূর্ত থেকেই শিশু যেমন বুঝবার চেষ্টা করে তার পরিবেশকে, এও ছিল হয়তো তেমনি অবচেতন প্রয়াস। দিন যায়, বর্ষ যায়, এমনি করে বয়ে যায় লক্ষ লক্ষ অব্দ। এক সময়ে তার অবোধ মনে সৃষ্টি হয় বোধের, যেমন শিশু অর্জন করে তার বোধশক্তি।

তার বোধ-বুদ্ধির বিকাশ ছিল মন্থর, কিন্তু বিরামহীন ও প্রবহমান। তার আত্ম-শক্তি-চেতনাও ছিল তার বোধ-বুদ্ধির আনুপাতিক। এবং অজ্ঞতার দরুন সে-শক্তির প্রয়োগ-সামর্থ্য ছিল তার আরো কম। প্রয়োগ-বাঞ্ছাই যোগায় প্রয়াসের প্রেরণা। আবার প্রত্যয়হীন বাঞ্ছও বন্ধ্যা। কাজেই প্রয়োগ-বাঞ্ছার সঙ্গে প্রত্যয় ও প্রয়াসের মেল-বন্ধন না হলে সাফল্য থাকে অনায়ত্ত। আর তেমনি অবস্থায় আসে নিষ্ক্রিয়তা। তখন বুদ্ধি ও শক্তি দুটোই আচ্ছন্ন হয় জড়তায়। শীতকালীন ঔষধির মতো দুটোই আত্মগোপন করে সুপ্তির গহ্বরে।

এমন মানুষ হয় প্রয়াস-বিহীন প্রাপ্তিকামী। তারা পরোপজীবী ও পরনির্ভর। এ রকম মানুষের সংখ্যাই অধিক। তাই মানুষের সংখ্যার অনুপাতে মানুষের কৃতি ও সাফল্য নিতান্ত নগণ্য। চেতনার ও চিন্তার, বুদ্ধির ও কর্মের, প্রয়োগ-বাঞ্ছ ও প্রয়াসের যোগ হয়েছে তেমন মানুষের সংখ্যা যে গোত্রে বেশি, সে-গোত্রের অগ্রগতিও হয়েছে সে অনুপাতে। আর অন্য গোত্রগুলো প্রকৃতির কৃপা জীবী হয়েই রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে।

এ কারণেই মানুষের যা কিছু সাফল্য ও কৃতিত্ব তা গুটিকয় মানুষেরই দান। এই গুটিকয় মানুষের উদ্ভাবনের ও আবিষ্কারের, চিন্তার ও চেতনার ফসলই সাধারণ মানুষের সম্বল ও সম্পদ। এই স্বাচ্ছন্দ্য-সুখেই, এই গৌরব-গর্বেই মানুষ প্রাণিশ্রেষ্ঠ।

সেকালে মানুষের জগৎ ছিল অঞ্চলের দিগন্তে সীমিত। সেজন্যে মানুষের কোনো কৃতিই হতে পারে নি সর্বমানবিক সম্পদ। তাই আজো কেউ রয়েছে আদি অরণ্যচারী, আর কেউ হয়েছে নভোচর।

পরমুখাপেক্ষী মানুষের এই নিষ্ক্রিয়তা কেবল বেদনাদায়কই নয়, সমস্যাপ্রসূও। কেননা এদের চেতনার বিকাশ নেই, নেই সৃষ্টির প্রয়াস। এদের এগুবার আগ্রহ নেই, আছে সুস্থির থাকার বাসনা। তাই নিশ্চিত পুরোনো-প্রীতি আর অনিশ্চিত নতুন-ভীতিতে তাদের মন-মানসের পরিক্রমা অবসিত। আচার-সংস্কারের পরিসরে স্বস্তি খোঁজে তাদের জীবন। স্বাচ্ছন্দ্য-বৃদ্ধির কাক্ষা নিয়ে নতুন সৃষ্টির আগ্রহে অজানার ঝুঁকি নিতে তারা নারাজ। তাই জীবন-সচেতন কর্মী-মনীষীর নব চেতনালব্ধ চিন্তা কিংবা প্রয়াসার্জিত কৃতি গ্রহণেও তারা বিমুখ। তারা কেবলই রুখে দাঁড়ায়, কেবলই পিছু টানে। চেতনায়, চিন্তায় ও কর্মে অগ্রসর মানুষের জীবন তাই দ্বন্দ্ববহুল ও বিঘ্নসঙ্কুল। আজ অবধি মানুষের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের মর্মকথা এ-ই।

এভাবে আশীর্বাদকে অভিশাপ ভেবে তারা যে কেবল নিজেরা ঠকেছে তা নয়, ভাবী মানুষের অগ্রগতিও করেছে ব্যাহত। অতএব, আদিম স্তরে আবদ্ধ আরণ্য-মানুষের কথা তো উঠেই না, এমনকি দুনিয়ার অগ্রসর মানুষের সংস্কৃতি-সভ্যতাও সময় আর সংখ্যার পরিমাপে শোচনীয় ভাবে সামান্য।

যতই মন্থর ও বাধাগ্রস্ত হোক, তবু প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির দাস মানুষের মুক্তি অন্বেষার ও প্রয়াসের একটি প্রবহমান ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাস অবশ্যই গুটিকয় চিন্তাশীল ও কর্মীমানুষের চিন্তা ও কর্মের ইতিকথা। এ ভাবে একজনের চিন্তা অন্য সবার সংস্কারে এবং একজনের কর্ম অন্যদের আচারে হয় রূপায়িত ও পরিণত। অতএব, একের চিন্তা ও কর্মের ফসল সমাজবদ্ধ অঞ্চলবাসী গোত্রের মানস ও ব্যবহারিক সংস্কার এবং আচার তথা চেতনা ও জীবিকা-পদ্ধতিরূপে পরিচিত।

প্রমাণে ও অনুমানে জানা যায়, Animism, Magic belief, Totem, Taboo gyfo Pagan ও প্রতীকতার স্তর পার হয়েই ধর্ম-দর্শনের স্তরে উন্নীত হয়েছে মানুষ। এখনো অবশ্য সর্বস্তরের মানুষই মেলে অল্পবিস্তর। এ সব মতবাদ বিশ্বাস-ভিত্তিক। এ বিশ্বাসপ্রসূত ভয়-ভরসা নির্ভর জীবনধারা চলেছে আজো। প্রকৃতির পোষণ ও পীড়ন থেকে মুক্তি-কামনায় মানুষ স্বাধীন ও স্বস্থ জীবনোপায় সন্ধানে বেরিয়ে, ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন স্তর উত্তীর্ণ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আজকে অবস্থায়।

অঞ্চল ও গোত্রে সীমিত জীবনে আচার-সংস্কারের এরূপ ঐক্যমত ছিল সমাজ-বন্ধনের ও সমাজ-শৃঙ্খলা রক্ষার সহায়ক। অভিন্ন মত ও স্বার্থভিত্তিক ঐক্য অন্য অঞ্চলের ভিন্ন গোত্রীয় লোকের আক্রমণ প্রতিরোধের হয়েছিল সহায়ক আর সহজ করেছিল যৌথ প্রচেষ্টায় জীবিকার্জন।

কাজেই একস্তরে গোত্ৰ-চেতনা ও পরবর্তী স্তরে ধর্মীয়-ঐক্য চেতনা ছিল মানুষের আত্মরক্ষার ও আত্মোন্নয়নের সহায়ক। Pagan মত ও ধর্মমতের পার্থক্য এখানে, যে Pagan মতের ভিত্তি হচ্ছে ভয়-বিস্ময়-ভরসা ও কল্পনা। আর ধর্মমত হচ্ছে বিশ্বাসের অঙ্গীকারে যুক্তি ও তাৎপর্যের সমন্বিত রূপ। যে-যুক্তির ভিত্তি জ্ঞানও নয়, প্রজ্ঞাও নয়, কেবলই বিশ্বাস, তা ফুটো পাত্রে জল ধরে রাখার মতো অলীক। সে-যুক্তি প্রমাণ নয়,অনুমান। বিশ্বাস ও যুক্তি এমনিতেই পরস্পর বিপরীত ভাব। বিশ্বাস অন্ধ ও বন্ধ্যা, আর যুক্তি জ্ঞান ও জ্ঞানপ্রসূ। বিশ্বাসের উৎস মানসপ্রবণতাজাত ভাব, আর যুক্তির ভিত্তি বাস্তব প্রমাণ। তাই বিশ্বাসে যুক্তি আরোপ করা পুতুলে চক্ষু বসানোরই নামান্তর।

দুধ শিশুর খাদ্য। শৈশবোত্তর কালে মানুষ সে-খাদ্যে বাঁচে না। তখন অন্য খাদ্য প্রয়োজন। তেমনি Animism থেকে Religion অবধি বিশ্বাস ও ব্যবস্থা সমাজবদ্ধ মানুষের শৈশব-বাল্যের সংস্কৃতি, সভ্যতা কিংবা জীবন-জীবিকার প্রয়োজন মিটিয়েছে। এক বয়সের অবলম্বন অন্য বয়সের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। তাই পুরোনো সবকিছু জীর্ণপত্র ও ছিন্ন বস্ত্রের মতো পরিহার করে নতুনের প্রতিষ্ঠা করেছে মানুষ। কাজেই পুরোনো জীবনবোধ ও রীতিনীতি নতুন মানুষের জীবন যাত্রার অনুকূল নয়। কিন্তু বিশ্বাস-সংস্কারের ব্যাপারে সে পুরোনোকেই শ্রেয় ও সত্য মনে করে। এজন্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে পরিবর্তনকে স্বীকার করে,-পরিবর্তন যে পরিবর্ধনও তা সহজেই মেনে নেয়। কিন্তু তার বিশ্বাস ও আচার সংস্কারের ক্ষেত্রে সে সত্য ও শ্রেয়সের চিরন্তনত্বে আস্থাবান। ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্রে মানুষ চিরকালই বিনাদ্বিধায় নতুনকে গ্রহণ করেছে, পরম আগ্রহে বরণ করেছে শ্রেয়ঃ-কে। কিন্তু মনোজীবনে তার রয়েছে অচলায়তনের বাধা। সেখানে সে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কারের অনুবর্তনে আশ্বস্ত থাকে–আয়ত্তগত সংকীর্ণ চেতনার পরিসরে সে যেন খুঁজে পায় নিজেকে–এতেই তার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য। তাই নিষ্ক্রমণের সিংহদ্বার খুলে দিয়ে বাইরের উদার আকাশের আলো-হাওয়ায় কেউ আহ্বান জানালেও বের হতে সাহস পায় না সে। পাছে অনিশ্চিত অজানায় বেঘোরে মরতে হয়–এই তার ভয়। চিন্তনে ও সৃজনে সে নিষ্ক্রিয় বলেই সে বিবেচনা শক্তিহীন, সে গোঁড়া; সে রক্ষণশীল। তার নতুন-ভীতি ও পুরোনো-প্রীতির এই কারণ।

বলেছি গুটিকয় লোক ছাড়া আর সব পরচিন্তা ও পরসৃষ্টিজীবী। বিরূপ সংখ্যাগরিষ্ঠের বিমুখতার ফলে মনুষ্য-সমাজের অগ্রগতি ছিল নিতান্ত মন্থর এবং সময় সময় হয়েছে ব্যাহত।

যেহেতু পুরোনোর অপর নাম জরা ও জীর্ণতা, আর নতুন-মাত্রই জীবন ও শক্তির প্রতীক; সেহেতু নতুনকে শেষ অবধি ঠেকিয়ে রাখা যায় না যায়নি। কেননা বন্যা বাঁধ মানে না। তাই সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করেই এগিয়েছে সংস্কৃতি ও সভ্যতা,–ভাব-চিন্তার হয়েছে বিকাশ ও বিস্তার। কিন্তু তবু তার উত্তরণ ঘটেনি যুগের তোরণে। কেননা, কোনো বিকাশই হতে পায়নি সর্বাত্মক ও সর্বমানবিক। আজকের মানুষের বারো আনা দুঃখই এ পিছিয়ে-পড়া মানুষের মানস মুক্তির অভাব প্রসূত। সব মানুষের মনে যতদিন জ্ঞান-প্রজ্ঞাজ যুক্তির জন্ম না হবে, ততদিন সমাধান নেই মানবিক সমস্যার।

আদিম মানুষের জীবনবোধ ছিল অবিকশিত। তার জৈবিক চাহিদা ছিল সীমিত। জীবন ছিল আঞ্চলিক। জীবিকা ছিল পরিবেষ্টনীগত। তাই গোত্রীয় ঐক্যই ছিল নিদ্বন্দ্ব-নির্বিঘ্ন জীবন ও জীবিকার দৃষ্টিগ্রাহ্য উপায়। প্রকৃতি ও পরিবেষ্টনীর অনুগত জীবনে তাই বিবেচিত হয়েছিল শ্রেয়। বলে। কথায় বলে, Necessity is the mother of invention, এই প্রয়োজন-বুদ্ধিই উপযোগ সৃষ্টির যুগিয়েছে প্রেরণা। পূজ্যের অভিন্নতা পূজারীকে করেছে ঐক্যবদ্ধ। Fatherhood of deity, brotherhood of men-তত্ত্বে দিয়েছে প্রেরণা ও প্রবর্তনা। সেদিন সে-অবস্থায় এর থেকে কল্যাণকর আর কিছুই হতে পারত না হয়তো। উপযোগবুদ্ধিজাত এই ঐক্য জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে দিয়েছে যৌথ প্রয়াসের সুযোগ দিয়েছে নিরাপত্তার আশ্বাস ও আত্মপ্রসারের প্রেরণা।

তারপর ক্রমে জীবনবোধ হয়েছে প্রসারিত। প্রয়োজনবোধ হয়েছে বিচিত্র। জনসংখ্যা গেছে বেড়ে। জীবিকা হয়েছে দুর্লভ। তখন সীমিত অঞ্চল ও গোত্রগত জীবন আর অনুকূল থাকেনি জীবিকার। সে-সময় প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক গোত্রের সংহতি ও সহযোগিতা, কিন্তু সে কল্যাণবুদ্ধি জাগেনি জনমনে। তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হল গোত্রে গোত্রে ও অঞ্চলে অঞ্চলে। তখন আত্মসংকোচন ও স্বাতন্ত্র-বুদ্ধিই আত্মরক্ষার উপায় রূপে হল বিবেচিত। বাহুবলই হল টিকে থাকার সম্বল। তখন জোর যার মুলুক তার। তখন বসুন্ধরা বীরভোগ্যা। তখন শক্তিমানের উদ্বর্তনই প্রমাণিত তত্ত্ব ও তথ্য। তখন আত্মরতি আর পরপীড়নই মনুষ্যধর্ম। তখন অসূয়া ও বিদ্বেষেই নিহিত ছিল বাঁচার প্রেরণা। স্বমতের ও স্বগোত্রের না হলেই শত্রু। এবং শত্রুর বিনাশ সাধনই ছিল নিজের বাঁচার উপায়। সহ-অবস্থান তত্ত্ব ছিল অজ্ঞাত।

জ্ঞানী-মনীষীরা নব-উদ্ভূত সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন নানাভাবে। কিন্তু জনগণের অবোধ্য উপায় কাজে লাগেনি বিশেষ। তাই আজো জটিলতর হয়েই চলেছে সমস্যা। কেননা জীবনবোধ প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের চাহিদা বেড়েই চলেছে, অথচ প্রয়োজন মিটানোর সদুপায়-চিন্তা আজো ঠাই পাচ্ছে না জনমনে। আজকের সংহত পৃথিবীতে সংহতি, সহ-অবস্থান ও সহযোগিতা যে দরকার, তা তারা যেন কোনো রকমেই চিন্তাগ্রাহ্য করে উঠতে পারছে না। কেননা, তারা চিন্তা করে না। তাই তাদের পিতৃ-পুরুষদের মতোই প্রতাপকেই তারা সত্য বলে জানে। প্রভাবের গুরুত্ব আজো অস্বীকৃত। অথচ প্রতাপে নয়, মানুষ বেঁচে থাকে প্রভাবের মধ্যেই। প্রতাপ দূরে সরায়, আর প্রভাব টানে কাছে। নিজের প্রভাব যে যতটুকু অন্যমনে সঞ্চারিত ও বিস্তৃত করতে পারে–তার অস্তিত্ব ততটুকুই। প্রতাপ নেতিবাচক, প্রভাব ইতিসূচক। কেননা, প্রতাপের প্রকাশ পীড়নে, আর প্রভাবের ফল প্রীতি।

আজকের দিনেও মানুষ আঁকড়ে ধরে রয়েছে তার পূর্বপুরুষ-শিশুমানবের বিশ্বাস সংস্কার ভিত্তিক আচারিক ধর্ম ও ধর্মবোধকে। এবং গোত্রীয় চেতনারই আর এক রূপ–স্বাধার্মিক ও স্বাদেশিক জাতীয়তা মানুষের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। আদিকালের এই জীর্ণ ও জড় আচারিক ধর্মের নিগড় ও স্বাগোত্রিক মোহ থেকে অন্তত অধিকাংশ মানুষ মুক্ত না হলে, কল্যাণ নেই আজকের মানুষের। স্বাধর্ম ও স্বাজাত্য-চেতনা স্বাতন্ত্রের দেয়াল তুলে রোজই যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে বিরোধের ব্যবধান। দেশ-জাত-ধর্ম অস্বীকারের ভিত্তিতে, নিবর্ণ মনুষ্য–সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকারে সংহতি, সহযোগিতা ও সহ-অবস্থান নীতির প্রয়োগে একালের মানবিক সমস্যার সমাধান সম্ভব।

ব্যষ্টি ও সমষ্টি, পরিবার ও সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রসঙ্, জাতি ও জাতিসঙ্, স্বাতন্ত্র ও সদ্ভাব, সহিষ্ণুতা ও সহানুভূতি, প্রতাপ ও প্রভাব, বিদ্বেষ ও প্রীতি, অসূয়া ও অনুরাগ, স্বার্থ ও সৌজন্য প্রভৃতির সমন্বয় ঘটিয়ে চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে বিশ্বমানবের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকের কল্যাণকামী মানুষের প্রয়াস হবে To convert hostility into negotiation, bloody violence into politics and hate into reconciliation.S

আশ্চর্য এই যে মানুষ প্রকৃতি-বশ্যতা থেকে মুক্তি-বাঞ্ছায় সংগ্রাম শুরু করে মনের জোরে। মনই ছিল তার শক্তির উৎস,–তার ভরসার আশ্রয়,–প্রাণিজগতে তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। যে মনের সৈনাপত্যে তার এই মুক্তি-অন্বেষা, সেই মনই কোন্ সময়ে বিশ্বাস-সংস্কারের দাসত্ব স্বীকার করে তাকে করেছে প্রতারিত! এভাবে মন নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে বিশ্বাস-সংস্কারের কাছে, আর মানুষ নিজেকে বন্ধক রেখেছে মনের কাছে। এজন্যে মানুষের মুক্তি-অন্বেষা সফল হয়নি–সার্থক হয়নি তার প্রয়াস।

তাই মুক্তি আজো দৃষ্টিসীমার বাইরে। যদিও মানুষ তার প্রাথমিক ব্রতে সফল হয়েছে– কেননা প্রকৃতি আজ তার প্রভু নয়, দাস– কিন্তু অভাবিত রূপে সে যার দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ হয়েছে, তাকে সে শত্রু বলেও জানে না। এবং শত্রু না চিনলে সংগ্রাম চলে না,–সতর্কতাও হয় ব্যর্থ। তেমন অবস্থায় আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। আজ মানুষ তেমন এক মিত্ৰকল্প শত্রুর কবলে আত্মসমর্পণ করে আশ্বস্ত। জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তিকে সে এই মিত্রকল্প শত্রু–বিশ্বাস-সংস্কারের অনুগত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। খাঁচায় পোষা পাখির মতো সে মিথ্যা সুখে প্রবঞ্চিত। তার আত্মা যে অবরুদ্ধ, তার আত্মবিকাশের অসীম সম্ভাবনা যে বিনষ্ট, তা সে অনুভবও করে না। তার রক্ষক বিশ্বাস-সংস্কার যে তাকে গ্রাস করছে, তা সে মানে না। অজগরের দৃষ্টিমুগ্ধ শিকারের মতো তার অভিভূত চেতনা তাকে প্রতারিত করছে। তার বিমুগ্ধ আত্মা ফাঁদের চুম্বক আকর্ষণে ব্যাকুল। তাই তার মনে চেতনা-সঞ্চার করা কঠিন।

মানুষ মাত্রেই শান্তি ও কল্যাণকামী। কিন্তু শান্তি ও কল্যাণের পথ চেনা নেই বলেই তারা শান্তির নামে ঘটায় অশান্তি, কল্যাণ কামনায় ডেকে আনে অকল্যাণ; প্রীতির নামে জাগায় গোষ্ঠী চেতনা। তাই আচারিক ধর্মানুগত্য ও উগ্রজাতীয়তাবোধই মানবপ্রীতি ও মানবতাবোধ বিকাশের বড়ো বাধা,–আজকের মানব-সমস্যার মূল কারণ। প্রীতি বিনিময়ে কারো অনীহা নেই–এ বিশ্বাসে আমরা মানুষ অবিশেষকে আহ্বান জানাই,–সংস্কারমুক্ত চেতনা, চিন্তা ও বুদ্ধি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে। কামনা করি, বিবেক ও যুক্তি তাদের দিশারী হোক। কৃত্রিম আচারিক ধর্ম ও উগ্রজাতীয়তা পরিহার করে তারা বিবেকের ধর্মে ও মানুষের অভিন্ন জাতীয়তায় আস্থা রাখুক। তাদের চিত্তলোকে প্রীতি ও সহিষ্ণুতার চাষ হোক, সেই ফসলে তাদের চিত্তলোক ভরে উঠুক। মানবতাই মানব ধর্ম–এ বোধের অনুগত হোক তাদের চিন্তা ও কর্ম। মুক্তি অন্বেষ্টা মানুষের মুক্তির অন্বেষা সফল ও সার্থক হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *