বাঙলা-সাহিত্যের আঁধার-যুগের ইতিকথা

বাঙলা-সাহিত্যের আঁধার-যুগের ইতিকথা

চর্যাগীতিকে দশ থেকে বারো শতকের বাঙলা রচনা বলে ধরা হয়। এর পরে তেরো শতক থেকে চৌদ্দশ পঞ্চাশের মধ্যেকার কোনো বাঙলা রচনার নিশ্চিত নিদর্শন মেলে না। তাই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ মনে করেন, এ সময় বাঙলায় কিছুই রচিত হয়নি এবং তারা তুর্কী বিজয়কেই এ-জন্যে দায়ী করেন। তাঁরা বলেন, তুর্কী বিজয়ের ফলে বাঙলা দেশে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চলে। দেড়শ, দুশ কিংবা আড়াইশ বছর ধরে হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালানো হয়। কাফেরদের উপর। তাদের জীবন-জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির উপর চলে বেপরোয়া ও নির্মম হামলা। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা এর পরেও মাটি কামড়ে টিকে রইল, তারা ত্রাসের মধ্যেই দিন-রজনী গুনে গুনে রইল। কাজেই ধন, জন ও প্রাণের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে প্রাণ নিয়ে সর্বক্ষণ টানাটানি, সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার বিলাস অসম্ভব। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্মেষ-বিকাশের কথাই উঠে না। এই হল তাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত।

ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন থেকে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় অবধি সব ইতিহাসকারেরই একই সিদ্ধান্ত। বাংলা দেশে তুর্কী বিজয় সম্বন্ধে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাদের মনে একটা বিজাতীয় বিরূপতা সব সময় সক্রিয় থাকে, ফলে তাঁদের সহজ বিচারবুদ্ধি এখানটায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। নইলে তাঁদের রচনায় উক্তির অসঙ্গতি, তথ্যের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার ফিরিস্তি এমন উল্কট হয়ে ফুটে উঠত না।

যে তুর্কী বর্বরতার বরাত দিয়ে বাঙলা সাহিত্যের বন্ধ্যাযুগের ইতিকথা তৈরী হয়েছে, সে তুকী-বিজয় ও তুর্কী শাসনের খসড়াচিত্র এখানে তুলে ধরছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রকাশিত History of Bengal-কে সাধারণত নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বলে স্বীকার করা হয়। তারই দ্বিতীয় খণ্ডের আলোকে এ সময়কার রাজনৈতিক ইতিহাসের আভাস ও ফলশ্রুতি দেবার চেষ্টা করব।

মধ্যযুগের ইতিহাস সে-যুগের আবহেই যাচাই করতে হবে। সে-যুগে পরমতসহিষ্ণুতার কিংবা বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সৌজন্যমূলক শ্রদ্ধার একান্ত অভাব ছিল। পরাক্রান্ত শক্তি মাত্রেই পরপীড়ক ছিল। তার উপর ছিল ফৌজী বর্বরতা–যা এ-যুগেও বিরল নয়। এটিলা, চেঙ্গিজ, হালাকু থেকে তৈমুর-নাদির অবধি এশিয়ার যে-কোন দিগ্বিজয়ীর কথা স্মরণ করলেই এ তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শাসক কিংবা বিজেতার কোনো জাতধর্ম নেই। তাদের লোভের কিংবা ক্ষোভের কবলে যে পড়ে সেই উৎপীড়িত হয়। তাই দুনিয়ার রাজবংশাবলীর ইতিহাসে আত্মীয় হত্যার নজিরই বেশি। দুনিয়াতে চিরকাল রাজা-প্রজা, শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত–এই দুই শ্ৰেণীই আছে। সেই রাজা শাসক বা শোষক স্বদেশী-স্বজাতি হোক কিংবা বিদেশী-বিজাতি হোক তাতে কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মীয় ও জ্ঞাতি হত্যার নজির হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান প্রভৃতি পৃথিবীর রাজবংশের ইতিহাস মাত্রেই বিদ্যমান।

ঐতিহাসিক মধ্যযুগে মুসলমানরাই প্রধানত পরাক্রান্ত ও দিগ্বিজয়ী। কাজেই তাদের অন্যায়, উৎপীড়ন ও বর্বরতার দৃষ্টান্ত সহজেই চোখে পড়ে। আসলে সে-যুগের সভ্যজগতের ইতিহাস সর্বত্রই একরূপ। পনেরো শতকের ইটালিতে পোপ পঞ্চম নিকোলো (১৪৪৭-৫৫) পেগান, মন্দির, মূর্তি, ইমারত ও শিল্পকৃতি ভেঙে প্রাসাদ ও গির্জা তৈরি করিয়েছিলেন। ফরাসী বিপ্লবকালে লুই ও রাজবংশীয়দের হত্যা, গ্রীক-তুর্কী যুদ্ধে গ্রীকদের আনাতোলীয়া অঞ্চলে তুর্কী নিধন, হিরোসিমা নাগাসাকির হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি পুরোনো প্রবৃত্তিরই নতুন প্রকাশ। উত্তেজনাবশে ভাল মানুষও যে হিংস্র শ্বাপদ হয়ে উঠতে পারে তার চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের পাক-ভারতে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬-৫০এর বেপরওয়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজে। সেকালের যুদ্ধনীতি ও শাসনরীতি ছিল ভিন্ন। রাজা-প্রজা তথা শাসক-শাসিতের কর্তব্য, দায়িত্ব এবং অধিকারবুদ্ধিও ছিল অন্যরকম। জাতি ও বর্ণ-দ্বেষণা আজো সুসভ্য আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ও ভারতে তীব্র সমস্যা হয়েই রয়েছে। সে যুগে যে ছিল–তা এমন আর ক্ষোভের কি! তবু যারা ক্রীতদাসকেও নিজের সমান মর্যাদা দিয়েছে, উচ্চপদে বসিয়েছে, জামাতা করেছে, সিংহাসন দিয়েছে, তারা কি একেবারে অমানুষ হতে পারে? উদারতা ও মানুষের প্রতি নিঃসঙ্কোচ শ্রদ্ধার এমনি দৃষ্টান্ত আর কোনো জাতির মধ্যে পাওয়া যায় না। সত্য বটে, মুসলমানেরা অমুসলিম দেশ জয় করতে গিয়ে ধনের লোভে ও ফেরারী শত্রুর খোঁজে গির্জা-মন্দির-বিহার আক্রমণ করেছে, মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছে, ধন-রত্ন লুট করেছে। যেখানে স্থায়ী আস্তানা গেড়েছে সেখানে মন্দিরকে মসজিদ করেও নিয়েছে। আত্যন্তিক স্বধর্মপ্রীতি ও বিধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা এমনি অপকর্মে সেনাদলকে চিরকালই অনুপ্রাণিত করে। পৌত্তলিক সমাজ থেকে গড়ে ওঠা নিরাকার একেশ্বরবাদী মুসলিম মানসে পৌত্তলিকতার প্রতি অবজ্ঞাটাও ছিল তীব্রতর। কাজেই যুদ্ধকালে বর্বর ফৌজী-উত্তেজনার সময় মন্দির-মূর্তি ভাঙা ও ধনরত্ন লুট করা সে-যুগের কোনো বিজেতা-বাহিনীর পক্ষে কলঙ্কের কথা নয়। বিজাতি বিধর্মী বিজেতারা চিরকালই তা করেছে, দুনিয়ার ইতিহাসে সর্বত্র এর নজির রয়েছে। মুসলমানেরা এর ব্যতিক্রম নয়। যুদ্ধ ছাড়া শান্তির সময়ে খেয়ালের বশে কিংবা বিজাতি-বিদ্বেষের প্রাবল্যে কোনো মুসলমান শাসক মন্দির মূর্তি ভাঙেননি। বরং কেউ কেউ পাপের ভয় উপেক্ষা করেও মন্দির তৈরিতে অর্থসাহায্য করেছেন, দেবোত্তর জমি দিয়েছেন। এদেশে আসিয়া মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপাইয়াছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ ও মন্দিরের জন্য বহু দানপত্র দিয়াছেন। সে-সব ঐতিহাসিক নজির দিন-দিন নূতন করিয়া বাহির হইতেছে। (ক্ষিতিমোহন সেন)। তারপর যখন হিন্দু মুসলমান অধ্যুষিত দেশে রাজায়-বাদশায় যুদ্ধ হয়েছে, তখন ধর্মস্থানের উপর হামলা (বিশেষ কারণ না ঘটলে–যেমন মন্দিরে শত্রুর আশ্রয় নেয়া, আত্মগোপন করা ইত্যাদি) হয়নি। ভারতের কোনো মুসলমান বিজেতাই স্বধর্মপ্রচারের মহৎ উদ্দেশ্যে দেশ জয় করেননি— রাজত্বলোভেই অস্ত্রধারণ ও প্রয়োগ করেছেন। মুসলমান বিজেতারা এদেশে রাজ্য স্থাপন করেই হিন্দু পাইক (পদাতিক সৈন্য) ও কর্মচারী নিয়োগ করতে থাকেন। রাজ্য শাসনে ও রাজস্বব্যবস্থায় এমনকি সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এবং গৌড়ের সুলতানেরা মুসলমান হইলেও রাজকার্য প্রধানত হিন্দুর হাতেই ছিল। (সুকুমার সেন)। অধিকাংশ আফগানই তাঁহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুদের হাতে ছাড়িয়া দিতেন।–এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্ত ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং ইহারা ব্যবসায় বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন। (স্টুয়ার্টের বাঙলার ইতিহাস)। পাঠান রাজত্বকালে জায়গীরদারেরা দেশের ভিতরে রাজস্ব আদায়ের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। দেশে শাসন ও শান্তিরক্ষার জন্য হিন্দুদের উপরেই তাদের নির্ভর করতে হত। সেইজন্য পাঠান আমলে হিন্দু ভূস্বামী ও অধিকারীদের যথেষ্ট উল্লেখ দেখা যায়। (বাঙলার নব জাগৃতি, বিনয় ঘোষ পৃ. ২৮।)

কাজেই তখনকার নতুন অভিযানে মন্দির ভাঙায় বাস্তব বাধা ছিল। আর ফৌজী বর্বরতার কথা বাদ দিলেও শাসকদের কেউ হয় নরদেবতা আবার কেউ বা নরদানব–এ একান্তভাবে ব্যক্তিক চরিত্রের কথা। সুশাসন-কুশাসন ব্যক্তিক যোগ্যতা ও স্বভাবের উপরই নির্ভরশীল। এজন্যে জাত তুলে খোঁটা দিলে বুদ্ধির তারল্যই প্রকাশ পায়। এবার আমরা বাঙলার শাসকদের পরিচয় নেব।

(ক) খালজী আমীরদের শাসনে (১২০২-২৭ খ্রী.)

১। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী (১২০২-৭) ১২০২ কিংবা ১২০৬ সনে নুদিয়া জয় করেন। তিনি রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই এদেশ জয় করেন। তাই শাসনক্ষমতা হাতে পেয়েই ইনি সামন্ততান্ত্রিক শাসন-সংস্থা গড়ে তুলেন। আর একদিকে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে গঠনমূলক কাজে যেমন যত্নবান হন, তেমনি শক্তি সঞ্চয় করে রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন। Malik Ikhtyar-uddin Muhammad devoted the next two years (1203–05) to the peaceful administration of his newly founded kingdom. He followed the usual practice of Muslim conquerors by pulling down idol temples and building mosques on their ruins, endowing Madrasa or Colleges of Muslim learning and evincing his zeal for religion by converting the infidels. But he was not blood-thirsty and took no delight in massacre or inflinching misery on his subjects (PP 8–9)… (He) was indeed the maker of the medieval history of Bengal-He was a born leader of men, brave to recklessness and Generous to a fabulous extent. (P. 12)

২। মালিক ইজুদ্দিন মুহম্মদ শিরান খালজী (১২০৭-৮) এক বছরের মতো রাজত্ব। Shiran was a man of extra-ordinary courage, sagacity and benevolence (P. 15)

৩। মালিক হুসামুদ্দীন গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ (১২০৮-১০ খ্রী.)–ইনি বিদ্রোহী আমীর আলি মর্দানের সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থেকেও দক্ষ শাসক বলে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। (He) was the most level headed politician, steadfast in ambition, unfettered by any scruple or sentiment, possessed of the rare gift of making himself acceptable even to his prospective rivals and too clever to place all his cards on the table a minute too soon. (P. 18)

৪। মালিক আলি মর্দান (১২১০-১৩ খ্র.)-এঁর ঘটনাবহুল জীবন। বিদ্রোহ, নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, দুঃসাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা, উন্মত্ততা, উচ্চাভিলাষ প্রভৃতির সমবায়ে ইনি বিচিত্র ও ভয়ঙ্কর মানুষ।

হিন্দু-মুসলমান সবাই তার হাতে সমভাবে উৎপীড়িত হয়েছে। (He) was a man of undoubted ability as a soldier, but impolitical, blood-thirsty and of a murderous disposition …. Partly out of policy but mainly actuated by a feeling of Vengeance against his Khilji Kinsmen who had cast him out, he made the Khilji nobles suffer terribly at his hands. (P. 19)

৫। মালিক হুসামুদ্দিন গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ (পুন. ১২১৩-২৭)– অত্যন্ত জনপ্রিয় সুশাসক। ইনি নৌবহর সৃষ্টি করেন। সম্ভবত তাঁর নৌসৈন্যেরা হিন্দু ছিল।

(Iwaz) Proved one of the most popular Sultans that ever sat on the throne of Gour (P. 21) … Iwaz built more than one Juma Mosque, other Mosques and Madrasas also arose on all sides (P. 25) …. the kingdom of Lakhnawati and Bihar enjoyed uninterrupted peace for about twelve years under the vigorous and beneficient rule of Sultan Ghyasuddin Khilji till the first expedition of Sultan Shamsuddin Iltutmish against Bengal 1225 A. D. (P. 25)-Sultan Ghyasuddins reign of about fourteen years was a prosperity for his kingdom (P.17). Sultan Ghyasuddin in his exterior and interior graces was every inch a Padishah, just, benevolent and wise (P. 28), বৃহৎত্বঙ্গেও (পৃ. ৬১২) এর উচ্ছ্বসিত তারিফ আছে। এখানেই খালজী আমীরদের শাসনের অবসান ঘটে। তারপরে শুরু হয় দিল্লী সুলতানের মামলুক (ক্রীতদাস) শাসন।

 (খ) মামলুক (গোলাম) শাসনে (১২২৭-৮২)।

৬। শাহ্জাদা নাসিরুদ্দীন মাহমুদ (১২২৭-২৯) সম্রাট ইলতুতমিসের পুত্র নাসিরুদ্দীন গিয়াসুদ্দীন ইওয়াজকে পরাজিত ও হত্যা করে গৌড়ের শাসক নিযুক্ত হন। তিনি দেড় বছর মাত্র অতি দক্ষতার সহিত রাজদণ্ড চালনা করিয়াছেন। (বৃহবঙ্গ পৃ. ৬১৩)।

৭। মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন বখ খালজী (১২২৯-৩০) ওরফে দৌলতশাহ্ বিন মওদুদ নাসিরুদ্দীনের মৃত্যুর পর ইনি স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। কিন্তু সম্রাট ইলতুতমিসের সেনানীর হাতে পরাজিত ও নিহত হন।

৮। মালিক আলাউদ্দীন জানি (১২৩১-৩২)–সম্রাট ইলতুতমিস এঁকেই গৌড়ের শাসক নিযুক্ত করেন। কিন্তু অল্পকাল পরে সম্রাট স্বয়ং গৌড়ে আসেন এবং অজ্ঞাত কারণে তাঁকে পদচ্যুত করে মালিক সাইফুদ্দীন আইবককে সুবাদারী দেন।

৯। মালিক সাইফুদ্দীন আইবক (১২৩২-৩৫)He possessed all the noble qualities of his race and rose to the front rank of the maliks of his age. (P. 45)

১০। মালিক ইজুদিন তুঘরল তুঘান খান (১২৩৬-৪০)- ইনি রাঢ় অঞ্চলও দখলে এনেছিলেন। ফলে বিহার, বরেন্দ্র ও রাঢ়ের অধীশ্বর হয়ে ইনি যোগ্যতার সঙ্গে শাসনদণ্ড চালনা P659 1 He was adorned with all sorts of humanity and sagacity and graced with virtues and noble qualities and in liberality, generosity and power of winning mens heart he had no equal. (P. 46)

১১। মালিক তৈমুর খান-ই-কিরান (১২৪৫-৪৭) ইনি তুঘরল তুঘান খান থেকে গৌড় জবরদখল করেন। এঁর আমলে উড়িষ্যার গঙ্গাবংশীয় রাজা নরসিংহদেব রাঢ় ও বরেন্দ্রের অনেকখানি দখল করে নেন। কিন্তু তিনি তা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।

১২। মালিক জালালউদ্দীন মাসুদ জানি (১২৪৭-৫১)–ইনি আলাউদ্দীন জানির পুত্র। এর উপাধি ছিল মালিক-উ-শর। উল্লেখ্য কৃতিহীন রাজত্ব।

১৩। মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন মুঘিসুদ্দীন উজবেক (১২৫২-৫৭)–ইনি তিনবার দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করেন। এই দিগ্বিজয়ী, সাহসী ও নিপুণযোদ্ধা গৌড়, বিহার ও অযোধ্যা জয় করেন এবং কামরূপ অভিযানে পরাজয় ও মৃত্যুবরণ করেন।

Rushness and imperiousness were implanted in his nature and constitution; but he was a man of undoubted ability as soldier and proved a successful ruler too (P.51)

১৪। মালিক ইজুদিন বলবন-উজবেকী (১২৫৭-৫৯)–জবরদখলকার। তাঁর উল্লেখ্য কোনো কৃতি নেই।

১৫। মালিক তাজুদ্দিন আরসালান খান (১২৫৯-৬৫)–যুদ্ধবাজ ও রক্তপিপাসু। ইজুদিন যখন বঙ্গ অভিযানে ব্যস্ত তখন লখনৌতে প্রবেশ করে হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

He was an impetuous and warlike men and had attained the acsue of capacity and intrepidity (P. 55)

১৬। তাতার খান (১২৬৫-৬৮)–আরসালানের পুত্র।

Tatarkhan was a very capable ruler, renowned for his bravery, liberality, heroism and honesty. (P. 57)

১৭। শেরখান (১২৬৮-৭২) উল্লেখ্য কৃতিহীন।

১৮। আমীন খান–উল্লেখ্য কৃতিহীন। সহকারী সুবাদার তুঘরল খান (১২৭২-৮১)।

১৯। মুঘিসুদ্দিন তুঘরল তুঘান খান (১২৭২-৮১)– অল্পদিন সুবাদার আমীন খানের সহকারী রূপে থেকে গৌড়ের শাসন-ক্ষমতা লাভ করেন। তুঘরলের হিন্দু পাইক (পদাতিক) সৈন্যবাহিনী ছিল, (P. 61)। সম্রাট গিয়াসুদ্দীন বলবন অসংখ্য পরিকর সহ তুঘরলকে হত্যা করেন। গৌড়ে সে এক বীভৎস হত্যাকাণ্ড।

Tughral possessed all the characteristic virtues of Turk, indomitable will, reckless bravery, resourcefulness and boundless ambition. (P. 58)-His court at Lakhnawati rivalled that of Delhi in power and magnificence and he was more popular with his people and much better served by them than Sultan Balban who was more feared than loved by his subjects–He was profuse in liberality so the people of the city (of Delhi) who had been there, and also the inhabitants of that place (Lakhnawati) became very friendly to him. The troops and citizens having shaken off all of the Balbani chastisement, joined Tughral heart and soul. (P. 60–61)

এবার ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে মামলুক শাসনকালের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা যাক: The History of this period is sickening record of internal dissensions usurpations and murders- Here in Bengal the political maxim gained ground that who-soever could kill or oust the reigning ruler should be acknowledged without demur as its legitimate master and Bengalees, whether Turks or Hindus remained generally indifferent to the fate of their rulers and enunciated a constitutional principle of their own that the loyality of a subject was due to the masnad (throne) and not to the person who happened to occupy it (P. 42) Another notable feature of the history of this period was the beginning of a sort of rapprochment between the conquerors and their Hindu subjects. The exodus of upper class Hindus on a wide scale from the Muslim Territory gradually stopped and now for the first time we come across references to Hindus as a class of inhabitants in the Muslim Capital. The Muslim rulers had no internal trouble with regard to their Hindu subjects or Varendra even when the Hindus of Orissa threatened the capital with a siege. (P. 43).

(গ) বলবন বংশের শাসনে (১২৮২-১৩০১)

২০। নাসিরুদ্দীন বঘরা খান (১২৮২-৯১)- কর্মকুণ্ঠ, বিলাসপ্রিয়, কিন্তু হৃদয়বান সজ্জন। He was wise in counsel, weak in action and unaggressive by temperament. Though there was nothing to admire in him, he was a lovable and genial personality strong in human virtues. He reigned rather than ruled the kingdom of Bengal, but he enjoyed throughout the esteem of his nobles and popularity with his subjects in the land of his adoption (P. 47)

২১। রুকুনউদ্দীন কায়কোয়াস (১২৯১-১৩০১)–নারুিদ্দীনের পুত্র। উল্লেখ্য কৃতিহীন রাজত্ব।

এবার বলবনী শাসনের ফলশ্রুতি যাচাই করা যাক : The Balbani regime in Bengal was not only a period of expansion but one of consolidation as well. It was during this time that the saints of Islam who excelled the Hindu priesthood and monks in active peity, energy and foresight began prosetlylising on a wide scale not so much by force as by the fervour of their faith and their exemplary character. They lived and preached among the low class of Hindus then as ever in the grip of superistition and social repression.: –About of a century after the military and political conquest of Bengal, there began the process of the moral and spiritual conquest of the land through the efforts of the muslim religious fraternities that now arose in every corner. By destroying temples and monasteries the muslim warriors of earlier times had only appropriated their gold and silver-the saints of Islam completed the process of conqueset-moral and spiritual by establishing Dargahs and Khankhas deliberately on the sites of these ruined places of Hindu and Buddhist worship (P.69)

(ঘ) অজ্ঞাত মামলুক শাসনে (১৩০১-২৮)

২২। শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৩০১-২২)Shamsuddin Firoz was a ruler of exceptional ability. (P. 81) He died full of years of glory and a fame (P. 82)

২৩। (ক) গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ Rebellious son of Firoz Shah.

(খ) নাসিরুদ্দীন ইব্রাহিম শাহ্

(গ) বহরম খান ও তাতার খান (১৩২২-২৮)।

এখন থেকে কয়েক বছরের জন্য গৌড় রাজ্যকে তিন-অঞ্চলে ভাগ করে তিনজন শাসকের অধীনে দেয়া হয় এবং শাসকদের নিজেদের মধ্যে দখল-বেদখলের কোন্দলও চলতে থাকে।

২৪। (ক) কদর খান-লখনৌতি–১৩২৮

(গ) মালিক ইজুদ্দিন এহিয়া–সাতগাঁও-১৩২৮

(গ) বহরম খান–সোনারগাঁও-১৩২৮–(মৃত্যু : ১৩৩৮)

২৫। (ক) ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৫০)–সোনারগাও। The lot of Hindu population in Fakhruddins time was not very enviable for They are muleted says Ibn Batuta of half of their crops and have to pay taxes over and above that (P. 102)

(খ) আলী শাহ (১৩২৮-৪২) লখনৌতি

(গ) শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ-লখনৌতি-সাতগাঁও (১৩৪২-৫৭)–সোনারগাঁও (১৩৫৩-৫৭)

 (ঘ) ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহ (১৩৫০-৫৩)–সোনারগাঁও। ইনি ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর পুত্র।

(ঙ) ইলিয়াস শাহী আমলে (১৩৪২-১৪১৩)

২৬। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ-ই শেষ অবধি গোটা গৌড়রাজ্যের অধিপতি হয়ে উঠেন এবং তিনি ১৩৫৩ সন থেকেই গৌড়রাজ্যের স্বাধীন সুলতান।

২৭। সিকান্দর শাহ (১৩৫৭-৮৯)-ইলিয়াস শাহর পুত্র। During the long period of peace that followed Sultan Sikandar adorned his capital with many noble monuments of architecture (P. 112)

২৮। গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ (১৩৮৯-১৪০৯)–এর ন্যায়পরায়ণতা, বিদ্যানুরাগ ও সাহিত্যপ্রীতি প্রাবাদিক ও প্রাবনিক হয়ে আছে। ইনি সিকান্দর শাহর পুত্র। বিদ্যাপতি এঁরই গুণকীর্তন করেছেন।

২৯। সাইফুদ্দীন হামজা শাহ (১৪০৯-১০)। উল্লেখ্য কৃতিহীন।

৩০। শামসুদ্দীন (১৪১০-১৩) ইনি হামজা শাহের পুত্র। এর আমল রাজা গণেশের প্রভাবের যুগ। এ সময় সম্ভবত রাজপরিবারে গৃহযুদ্ধ ঘটে।

(চ) গণেশ ও তার বংশধরদের আমল (১৪১৪-৪২)

৩১। রাজা গণেশ (১৪১৪-১৮)–জবরদখলকার। এঁর নিন্দা-প্রশংসা দু-ই আছে। তবে সুদক্ষ শাসক।

৩২। মহেন্দ্র দেব (১৪১৮) রাজত্বকাল কয়েক মাস মাত্র। ইনি হিন্দু দলের দ্বারা মসনদে প্রতিষ্ঠিত হন।

৩৩। যদু বা জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৮-৩১)–যেসব ব্রাহ্মণ তাঁর প্রায়শ্চিত্তে অংশগ্রহণ করেও তাকে সমাজে গ্রহণ করতে নারাজ ছিল, তাদের তিনি লাঞ্ছিত করেন। মোটামুটিভাবে সুশাসক। We can well believe that the province grew in wealth and population during his peaceful reign. (P. 129)

৩৪। শামসুদ্দীন আহমদ শাহ (১৪৩২-৩৩)- ইনি জালালউদ্দীনের পুত্র। His reign was darkened by his crimes and follies, till the nobles finding it intolerable1 got him murdered through his slaves Shadi khan and Nasir khan in 1333 A. D. (P. 129)

 (ছ) পরবর্তী ইলিয়াস শাহ আমলে (১৪৩৩-৮৬)

৩৫। নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৩-৫৯)।

Chosen by the people the new sovereign, who styled himself Nasiruddin Abul Muzaffar Mahmud, was able to enjoy an undisturbed and prosperous reign. He is described as a just and liberal king by whose good administration the people, both young and old, were contended and the wounds of oppressions inflicted by Ahmad Shah were healed …. his main interests probably lay in the arts of palace. A large number of inscriptions found all over his kingdom recording the erection of Mosques, khankas, gates, bridges and tombs, testify not only to the prevailing prosperity but also to the enthusiasm for pulic works and interest in the building art, which he inspired. (P. 130) -২১

৩৬। রুকনউদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-৭৬)–Histories praise him as a sagacious and law-abiding sovereign in whose kingdom the soldiers and citizens alike had contentment and security. (P. 132) prosto প্রতিপোষকতা পেয়েছিলেন।

৩৭। শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-৮১)– মালাধর বসু এরই প্রতিপোষকতায় শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন। Both Firishta and Nizamuddin described him as vastly learned, virtuous and an able administrator. He evidenced a special interest in the administration of justice and interested on the strict and impartial application of the law-like Alauddin, he totally prohibited the drinking of wine and frequently assisted the judges in difficult cases. (P. 136)

৩৮। জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ (১৩৮১-৮৭)–Fath is stated to have been an intelligent and liberal ruler who maintained the usages of the past and in whose time the people enjoyed happiness and comfort. (P. 137)

এবার এখানে ইলিয়াস শাহী রাজত্বের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন উদ্ধৃত করছি :

The dynesty deserved well of Bengal, for with remarkable consistency it produced a succession of able rulers. They were tolerant, enlightened administrator and great builders. In shaping the economic and intellectual life of the Bengali people for nearly a century and a half; the Ilyas Shahi kings played the leading part. Tolerance was their greatest asset. To have ruled over a people of an alien faith for eight generations was in itself a great achievement; to be instated on the throne after twenty five years exclusion by a local dynesty was an even greater one. It was a singular proof of their popularity-a popularity which rested on their past services. (P. 137)

(জ) হাবসী গোলাম আমলে (১৪৮৭-৯৩)

৩৯। সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-৯২)–প্রভু হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে প্রভুপত্নীর অনুরোধে বিশ্বস্ত হাবসী-গোলাম–আমীর আন্দিল সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ নামে গৌড়ের সিংহাসনে বসলেন।

He is credited with having ruled justly and efficiently. His reputation as a soldier inspired respect and awe and his attachment to the Ilyas Shahi house made the people forget his race. His kindness and benevolence evoked warm praise from the historians. (P. 139)

৪০। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (২য়)–(১৪৯০-৯১)– এক বছর কাল রাজত্ব করার পর সিবিদরের হাতে নিহত হন।

৪১। শামসুদ্দীন মুজাফফর ওর্ফে সিদিবদর ওফেঁ দিওয়ানা (১৪৯১-৯৩)-রক্তপিপাসু নরদানব।

He was perfect reign of Terror …. Commenced a ruthless destruction of the noble and learned men of the capital. His sword fell equally heavily on the Hindu nobility and princes suspected on opposition to his sovereignty. (P. 140)

 (ঝ) হোসেন শাহী আমল (১৪৯৩-১৫৩৮)

হোসেন শাহী শাসন সম্বন্ধে কোনো অভিযোগ নেই, বরং তারিফ আছে প্রচুর। কাজেই আমরা ইতিহাস আর ঘটতে চাইনে।

৪২। সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)। আমরা বাঙলার ৩১৫ বছরের ইতিহাসের খসড়া চিত্র দিলাম। এ ধরনের শাসনেই ডক্টর সুকুমার সেন অত্যাচার ও হত্যার তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেছেন, গোপাল হালদার দেখেছেন কেবল রক্ত আর আগুন, আর ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মনীন্দ্রমোহন বসু, ডা. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাঙলা সাহিত্যের প্রায় সব ইতিহাসরচয়িতাই পড়েছেন দুঃশাসন, নিপীড়ন, বিধর্মী হত্যা কিংবা বলপ্রয়োগে ইসলামে দীক্ষার ত্ৰাসকর কাহিনী।

.

ইখতিয়ার উদ্দীন খালজী (১২০৪) থেকে সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৫১৯) অবধি মোট বিয়াল্লিশ জন শাসক গড়ে সাত বছর করে গৌড়রাজ্য শাসন করেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ স্বাধীন, কেউ বা দিল্লীর সম্রাটের সুবাদার। সুবাদারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ও বিধিবদ্ধ শাসনতান্ত্রিক কানুনের অনুপস্থিতি, সিংহাসনের উত্তরাধিকারে দাবী ও যোগ্যতা বিষয়ে ধর্মীয় কিংবা শাসনতান্ত্রিক বিধানের অভাব এবং অঞ্চল হিসাবে গৌড়ের প্রান্তিকতা গৌড় শাসকদের উচ্চাভিলাষী ও উচ্ছখল হতে সহায়তা করেছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিপুলতার কারণও এ-ই। তাই সুবাদার বদল হয়েছে ঘন ঘন। এতেই শাসকসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা-যুগে সুলতানেরা সাধারণত আমৃত্যু রাজত্ব করেছেন।

এঁদের মধ্যে হিন্দু-পীড়ক ও অত্যাচারী শাসক হচ্ছেন : ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খালজী (১২০৪-৭), আলী মর্দান (১২১০-১৩), মালিক তাজুদ্দিন আরসালান খান (১২৫৯-৬৫), সোনার গাঁয়ের ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৫৩-৫৭), শামসুদ্দীন মুজাফফর ওর্ফে সিদিবদর (১৪৯১-৯৩)। এদের মোট রাজত্বকাল বিশ বছর। ৩১৫ বছর কালের পরিসরে কুশাসন বা হিন্দু নিপীড়নের বিভিন্ন কালের যোগে পাচ্ছি মাত্র বিশ বছর। এই বিশ বছরই দুধে চনা কিংবা দুধে গরলের মতো গোটা মুসলিম আমলকে রক্ত ঝরানো ও আগুন জ্বালানো শাসনরূপে পরিচিত করেছে। সে-যুগে বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি না হওয়ার কারণ নাকি এ-ই।

আমরা জানি, মুসলমান শাসকেরা কেবল নিজেদের মধ্যে মারামারিই জিইয়ে রাখেননি, রাজ্যবিস্তারেও উদ্যোগী ছিলেন। রাজ্যের সংখ্যাগুরু হিন্দুকে শক্ত করে রেখে, অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু সৈন্য-ও নিয়ে (যেমন তুঘান খান, ১২৭২-৮১) যুদ্ধাভিযান করা কিছুতেই সম্ভব হত না। কাজেই রাজ্যের স্থায়িত্বের গরজেই হিন্দু-নির্যাতন সম্ভব ছিল না। আর সুবাদারেরা ঘন ঘন মসনদ নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছেন বটে, তাতে রাজধানীতে ও যুদ্ধক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা ও প্রজার দুর্ভোগ হওয়া সম্ভব, অন্যত্র নয়। বিশেষ করে দুইজনের কাড়াকাড়ির অবসরে প্রজারা প্রশ্রয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আর প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন মুসলমান, তখন এরূপ ক্ষেত্রে কেবল হিন্দুর উপরই পীড়ন হওয়ার কারণ নেই। সে যুগে রাজধানীর যুদ্ধ ও রাজা বদলের সংবাদ রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয় মাসে নয় মাসেই পৌঁছত। প্রজাসাধারণের তাতে ক্ষতি-বৃদ্ধির তেমন কিছু ছিল না। এ সম্পর্কে মামলুক শাসন সম্বন্ধে ঐতিহাসিকের পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্য স্মরণীয়। যুগান্তকর পলাশী যুদ্ধের খবরই বা কাকে বিচলিত করেছিল? শহুরে রাজনীতি, আন্দোলন কিংবা হাঙ্গামা এ দেশে আজো গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। এ প্রসঙ্গে ১৯৪২, ৪৬ ও ৫০-এর রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার কথা স্মর্তব্য। আরো আগের ইতিহাসের দৃষ্টান্তও নেয়া যায়। আকবরের সময়ে (১৫৭৫ খ্রী:) বাঙলা বিজিত হল বটে; কিন্তু আকবর-জাহাগীরের আমলে নিরঙ্কুশ মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা মুঘলে-পাঠানে তথা রাজশক্তি ও সামন্ত শক্তিতে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই ছিল। শাহজাহানের আমলে বাঙলায় মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল সত্য; কিন্তু হার্মাদদের উপদ্রবে মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ছিল না; আবার আওরঙ্গজীবের আমলে বাণিজ্য-ক্ষেত্রে য়ুরোপীয় বণিকদের দৌরাত্ম্য নতুন উপসর্গরূপে দেখা দিল। তা সত্ত্বেও বাঙলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ ছিল না। আর ভারতে ইসলাম প্রচারে কোনো কোনো রাজশক্তির সহানুভূতি ছিল হয়তো, কিন্তু সহযোগিতা যে ছিল না তা ঐতিহাসিকেরাও স্বীকার করেন। জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করার কাহিনীও অমূলক। এ ব্যাপারে বলবনী শাসন সম্বন্ধে ঐতিহাসিকের পূর্বোদ্ধৃত মন্তব্য স্মরণীয়।

এবার বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসাগুলো পেশ করছিঃ

ক. তুর্কী আক্রমণ ও বিজয় কি কেবল বাঙলা দেশেই ঘটেছিল, ভারতের অন্যত্র ঘটেনি? সেখানকার অবস্থা কিরূপ দাঁড়িয়েছিল?

খ. যুদ্ধকালে জীবন ও সম্পদ নষ্ট অনিবার্য। কিন্তু তাই বলে যারা রাজত্ব করতে আসে, তারা বিজিতদের ওপর নির্বোধের মতো চিরকাল বেপরওয়া অত্যাচার চালায় না এবং চালালে সে-রাজ্য ও রাজত্ব টেকে না। রাজনীতি ও শাসননীতিতে এমন নির্বোধ policy থাকতে পারে না। যারা কথায় কথায় বাঙলা দেশে দেড়শ, দুশ বা আড়াই শ বছরব্যাপী হিন্দু-পীড়নের কথা বলেন, তাঁরা ভেবে দেখেছেন কি, যে এটা ছয় থেকে দশ পুরুষের (generations) ব্যাপার? ইতিমধ্যে শাসক বদল হয়েছে কয়বার; generation ঘুরেছে কয়বার? দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে পুরুষানুক্রমে একই মতাদর্শে আস্থা রাখা, একই পীড়ননীতি চালু রাখা কিংবা একই কর্মে সক্রিয় থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব কি?

গ, জনাব গোপাল হালদার (বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা, ১ম খণ্ড) বলেছেন, বৌদ্ধদেরও উপর অত্যাচার হয়েছিল। দুর্গভ্রমে মগধের বৌদ্ধবিহার আক্রমণ ও সৈন্যভ্রমে ভিক্ষু হত্যার ব্যাপারটি যে একান্তই অজ্ঞানকৃত তা ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেছেন। বৌদ্ধদের সংখ্যা তখন বাঙলায় নেহাত নগণ্য এবং দণ্ডশক্তি তাদের কারো হাতে ছিল না। তারা তখন ব্রাহ্মণ্য সমাজের নিগ্রহপিষ্ট ও অনুকম্পাজীবী। কাজেই তাদেরকে নিপীড়িত করবার কারণ ও সুযোগে দু-ই ছিল অনুপস্থিত। মুসলমান বিজয়ে ব্রাহ্মণ্য পীড়ন-মুক্তির উল্লাসই কি নিরঞ্জনের রুমায় ব্যক্ত হয়নি?

ঘ. ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন, উচ্চ বর্ণ ও বিত্তের লোকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। তারপরেও বাঙলা দেশে–বিশেষ করে গৌড়ে-নদীয়ায় উচ্চবর্ণের এত হিন্দু রইল কী করে? বাঙলা দেশে উচ্চবর্ণের লোকের আনুপাতিক সংখ্যা যত, ভারতের অন্য কোনো প্রদেশে তত আছে কি? বাঙলার যে অংশ সুলতানদের পদতলে ও পদপ্রান্তে ছিল সেখানে হিন্দুর সংখ্যা বেশি কেন? রক্তে ও আগুনে এতকিছু ধ্বংস করার পরেও সব রইল কী করে? মন্দির ধ্বংস কিংবা হিন্দু নাগরিক হত্যা না করেই পূর্ববঙ্গ একশত বছর পরে (১৩০১ খ্রী.) জয় করা হয়। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করতে আসলে ১৫০ বছরের বেশি সময় লেগেছিল।] রাঢ় অঞ্চলও তেরো শতকের তৃতীয়পাদ অবধি গঙ্গারাজদের দখলে ছিল। সেখানকার বাঙলা ও সংস্কৃত অবদানের নিদর্শন কী এবং কোথায়?

ঙ. সে যুগে কি নির্দিষ্ট প্রান্তরে নির্দিষ্ট সময়ে যুদ্ধ হত না? এবং সেনাপতির নিধনে, দুর্গ দখলে কিংবা তখৃত অধিকারে গোটা দেশ জিত হত না? গরিলা যুদ্ধ তথা গণসগ্রাম ছিল কি? রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখড়ের প্রাণ যায়–কথাটা কি আক্ষরিক অর্থে সত্য ছিল না? আমাদের মধ্যযুগীয় শেষ লড়াই পলাশীর যুদ্ধও এরূপ যুদ্ধ নয় কি? জয়ের পরে দুই একদিন নিশ্চয়ই যুদ্ধক্ষেত্রের চারপাশে, রাজধানী প্রবেশের পথে ও রাজধানীতে লুটতরাজ চলত (এ-ই নিয়ম)। তাই বলে তা বছরের পর বছর ধরে চলেছে বলে ভাববার কারণ কি? বর্গীর হামলার মতো রাজশক্তির ও রাজার সুপরিকল্পিত cold-blooded বর্বরতা, লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ডের নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর আছে কি? তবু বর্গী উপদ্রুত অঞ্চলে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, পালা-পার্বণ ও বিবাহ-উৎসবাদি কি বন্ধ ছিল? দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে নিপীড়ন চললে তা কি গা-সহা বা অভ্যস্ত হয়ে উঠে না? সে অবস্থায় জীবনযাত্রা কি বিকৃতভাবেও স্বাভাবিকতা লাভ করে না? তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় খুব বাধা থাকে কি? ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষকালে যখন বাঙলা দেশের প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ হারাল তখনো কি কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখিত এবং বাঙলার দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রে কি ছাপা হয় নি? পলাশীর যুদ্ধের পরে, সিপাহী বিপ্লবকালে, ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের সময়ে কিংবা ১৮৪৬-৫০-এর পাক-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বেপরওয়া হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সময়ে (সংবাদপত্রাদির মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও এবং অনেকের আত্মীয়-স্বজনের প্রাণ ও সম্পদহানি হওয়ার পরেও) বাঙলা দেশের অধিকাংশ লোকের প্রাত্যহিক জীবনে ও মননে বিপর্যয় ঘটার প্রমাণ আছে কি? তখন কি স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত, পার্বণ ও বিবাহাদি উৎসব বন্ধ ছিল?

চ. মুসলমান আক্রমণকারীরা নাহয় গৌড়-লখনোতিতে চলার পথে, যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা রাজধানী দখলের সময়ে মন্দির ভেঙেছে, প্রধান ব্যক্তিদের হত্যা করেছে, গ্রাম লুট করেছে; কিন্তু তাদের সংখ্যা কয়টি ও কয়জন? দেশব্যাপী হিন্দু যারা বেঁচে রইল তাদের বাড়ির এবং দেশের অন্যান্য মন্দিরের পুথিপত্র নষ্ট হবার কারণ কি? এ তো গৌড়ের কথা। রাঢ়ে-বঙ্গে তো মুসলমানের পা বহুকাল পড়েনি, যখন পড়েছে তখন যুদ্ধক্ষেত্রেই জয়-পরাজয় নিশ্চিতভাবে নির্ণিত হয়েছে, মন্দির ভাঙার কিংবা নির্বিচারে লোকহত্যার প্রয়োজন হয়নি। সেখানকার হিন্দুর বাঙলা-সংস্কৃতে কী অবদান আছে? গৌড়-লখনেতিতে কাফেররা কি কেবল নিগৃহীতই হচ্ছিল; রাজনীতি ও কূটনীতির নিয়মানুসারে কেউ কেউ কি অনুগৃহীত হয়নি? তাদের দান কী?

ছ. ভারতে সর্বত্র ইংরেজের শাসনকাল সমান নয়। বাঙলাতেই তো ১৮২ বছর মাত্র। তবু আমরা কী দেখলাম? এর মধ্যেই আমাদের সর্বাত্মক বিবর্তন ও রূপান্তর জন্মান্তরেরই নামান্তর নয় কি? তা হলে মুসলমান রাজত্বের প্রথম আড়াইশ বছরেও (বিজ্ঞানযুগ নয় বলে হয়তো খুব মন্থরগতিতে) দেশের সমাজ সংস্কৃতি ক্ষেত্রে রূপান্তর ও বিবর্তন নিশ্চয়ই ঘটেছে, যার ক্রমিক ও পূর্ণ বিকশিত রূপ পাচ্ছি ভাস্কর রামানুজ-নিম্বার্ক-বল্লভ-কলন্দর-রামানন্দ-কবীর-নানক-একলব্য রামদাস-দাদু-রজ্জব-চৈতন্যের মতবাদে। ক্ষিতি মোহনসেনের ভারতের মধ্যযুগে সাধনার ধারা, হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা, তারাঠাদের, Influence of Islam on Indian culture সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের The Hindu view of life, বিনয় ঘোষের বাঙলার নবজাগৃতি, উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের ভারত দর্শন সার প্রভৃতি গ্রন্থে আমাদের উক্তির সমর্থন রয়েছে।

এ ব্যাপারে সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, নবদেবী-বনবিবি, কালুরায়-কালুগাজী, ওলাদেবী-ওলাবিবি প্রভৃতি উপ ও অপদেবতার উদ্ভব ও পূজা-শিনীর কথাও স্মরণীয়।

বৃহৎ বঙ্গে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, বাঙলা দেশে পাঠান প্রাবল্যের যুগ এক বিষয়ে বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশের সভ্যতার যে শ্রী ফুটিয়াছিল, এই পরাধীনতার যুগে সেই শ্ৰী শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল। এই পাঠান প্রাধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল। অরবিন্দ পোদ্দারের মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য ও মানবধর্ম গ্রন্থেও তুর্কী বিজয়ের সুফলের কথা আছে এবং বৈষ্ণব মত যে সুফী মতের প্রভাবপ্রসূত তা সুকুমার সেনও কিছুটা স্বীকার করেন। (বাঙ্গাল সাহিত্যের ইতিহাস-পূর্বার্ধ পৃ. ২৪৫)।

জ, বাঙলা দেশ উজাড় হল বলে বাঙলা সাহিত্য, দেড়শ-আড়াইশ বছর ধরে সৃষ্টি হয় নি, এ-ই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু সিদ্ধাদের চর্যাপদ ছাড়া বাঙলায় আর কিছুই সৃষ্টি হয়েছিল কি? উচ্চবর্ণের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মুসলিম বিজয়ের পূর্বেকার কোনো বাঙলা রচনার সন্ধান বা উল্লেখ পাওয়া যায় কি? লক্ষণ সেনের সভায় বাঙলায় লিখিয়ে কবি ছিলেন কি? শৌরসেনী ছাড়া অন্য কোনো অবহট্টেই কি লিখিত বিশেষ কোনো রচনা আছে [ODBL-P. 113]? গৌড়ী অবহট্টে রচনার রেওয়াজ না থাকলে প্রাচীন বাঙলাতেই বা থাকবে কেন? ধ্বংসের মধ্যেও মূর্ধাহত বাঙালি প্রাকৃত পৈঙ্গল ও সদুক্তিকর্ণামৃত সংকলন করবার প্রেরণা ও সংকলনের জন্য কবিতা পেলেন কোথায়? আর প্রাকৃত-অবহট্টের মতো বাঙলা কবিতা থাকলেও কি এরূপ সংকলন হত না? এ সময়ে রচনার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে এ সময়কার কিছু কিছু সংস্কৃত রচনার (পুরাণাদির) সন্ধান মিলল কিরূপে? বাঙলা কি তখন শিক্ষিত লোকের সাহিত্য রচনার বাহন হবার যোগ্য হয়েছিল? সে-যুগের ধর্মসম্পৃক্ত সাহিত্য ভাষায় সৃষ্টির বা অনুবাদের পক্ষে বাধা ছিল না কি? চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস ছাড়া কোনো বামুন আদিস্তরে বাঙলায় কিছু লিখতে সাহস বা আগ্রহ দেখিয়েছেন কি?

অষ্টাদশ পুরাণানি চ রামস্য চরিতানি চ।
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।

কিংবা কৃত্তিবেসে, কাশীদেসে আর বামুনঘেঁষে এ তিন সর্বনেশে বুলিটা আঠারো শতক অবধি কথায় ও কাজে অন্তত কিছুটা কি চালু ছিল না?

ঝ. হিন্দুর বেদ-পুরাণাদি রইল, লক্ষ্মণ সেনের সভাকবিদের গ্রন্থও রইল, মুসলমানেরা কি শুধু বেছে বেছে বাঙলা বই নষ্ট করেছিল যে চর্যাপদ নেপাল দরবারের আশ্রয়ে টিকে রইল আর শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন) বাঁকুড়ার গোয়ালঘরে আশ্রয় পেল? শ্রীকৃষ্ণ-সন্দর্ভের আর কোনো কপি পাওয়া গেল না কেন? শেখ শুভোদয়া কী বলে? বাঙলা দেশে কি আগুন-পানি-উই-কীট সে যুগে ছিল না? জনপ্রিয় না হলে এ-যুগের ছাপা বইও কি দুর্লভ ও ক্রমে লুপ্ত হয় না? ভাষার পরিবর্তনে ও জনপ্রিয়তার অভাবে (যদি বাঙলায় কিছু রচিত হয়েও থাকে) আলোচ্য যুগের বাঙলা বই কি লুপ্ত হতে পারে না? শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ কী লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় গ্রন্থ নয়?

নেপালেই বা চর্যাপদের একাধিক পুথি পাওয়া গেল না কেন? ষোলো-সতেরো শতকে রচিত বহু পুথি কি লুপ্ত হয়নি? শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের তারিখটি এবং কৃত্তিবাসের আত্মকথা প্রচুর পাওয়া যায় না কেন?

আমাদের ধারণায় তুর্কীবিজয় ও তার পরেরকার গৌড়রাজ্যের চিত্র এরূপঃ

তুর্কীরা যুদ্ধ করে যখন দেশ জয় করেছে (আসলে বখতিয়ার খলজী অনায়াসেই দেশ দখল করেন, হত্যাকাণ্ডের বিশেষ প্রয়োজন হয়নি, কারণ রাজা পালিয়ে গিয়েছিলেন]; তখন সাময়িকভাবে হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজ চলেছিল (যেমনটি চলে থাকে)। তারপর দেশ শাসনে তারা মনোযোগী হয়। গোড়ার দিকে উদ্ধত অসহযোগীদের শায়েস্তা করতে হয়, ফলে বিশেষ বিশেষ লোকের উপর অত্যাচার চলে। কিছু কিছু লোকের ধন-জন-প্রাণ হরণ করা হয় (যেমনটি নিয়ম ও প্রয়োজন)। তারপর রাজত্ব স্থায়ী করার গরজেই শাসিতদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা দানে শাসকবর্গ বাধ্য হয় এবং যেহেতু দেড়শ বছর ধরে গৌড় সিংহাসনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা ছিল না, মসনদ নিয়ে নিত্য কাড়াকাড়ির আশঙ্কা থাকত, সেহেতু সিংহাসনাভিলাষীরা সামন্ত, সর্দার ও ভূঁইয়াদের স্বপক্ষে টানবার জন্যে সুশাসন চালাবার চেষ্টা করতেন এবং সে সূত্রে সুশাসনের নামে বেশকিছুটা অতিরিক্ত উদারতা ও সদাশয়তা দেখাতেন এবং জনপ্রিয়তার জন্যে জনগণকে প্রশ্রয় দিতেন। এও অনুমান করা যায় যে, তাঁরা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হবার গরজে প্রজাদের গোড়ার দিকে করভারে পীড়া দিয়েছেন। ইংরেজদের যেমন দেখেছি, তেমনি মুসলমানেরাও উত্তম্মন্যতা (Superiority complex) নিয়ে চলত, আর শাসিতদের অবজ্ঞা ও অনুকম্পা দেখাত; নির্বোধ ও সাধারণ মুসলমানেরা সে-অবজ্ঞা কথায় ও আচরণে প্রকাশ করত। কীর্তিলতা ও চৈতন্যমঙ্গলে যেমন দেখা যায় এজন্যে হিন্দু। মনেও ক্ষোভ ছিল (যেমন মধ্যযুগের হিন্দুরচিত নানা গ্রন্থে মুসলমানদের প্রতি বিরূপতা দেখা যায়; বৃটিশ আমলের দেশীয় সাহিত্যে যেমন ইংরেজ-বিদ্বেষ প্রকট)। এজন্যে সময় ও সুযোগমতো তারা তিলকে তাল করে রটিয়ে দিত। (কিছুকাল আগে যেমন পাকিস্তানে হিন্দু-নারী হরণের ও হিন্দুর উপর নানা লঘুগুরু অত্যাচারের অলীক সংবাদ কলকাতায় শোনা যেত)। শাসক-শাসিতের সম্পর্ক বিজাতির ও বিদেশীর হলে এমনটিই হয়, না হয়ে পারে না। শাসকের দোষ খোঁজার ও দেখার জন্যে এবং ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগের জন্যে এমনি অবস্থায় মনটি তৈরি হয়েই থাকে। (গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধীদলের ভূমিকা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।) ঐতিহাসিকের কর্তব্য সব কথা আক্ষরিকভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস না করে সত্য ও সারটুকু হেঁকে নেয়া। আর অদ্ভুত ও অসম্ভব কথা এ যুগেও রটে– সুতরাং সে-যুগে নানা কারণে এর বাহুল্য যে ছিল এবং অজ্ঞতার সুযোগ এবং যাচাই করবার উপায়ের অভাবে সেগুলো যে সহজে বিশ্বাস হত তা না বললেও চলে। আজকের মতোই ভালয় মন্দয় শাসনকার্য চলত, মাঝে মাঝে অমানুষ শাসকের হাতে পড়লে তার ব্যতিক্রম ঘটত–আজও যেমন ঘটে। এজন্যে মানুষের ভাব-চিন্তা কিংবা আনন্দ-উৎসব বন্ধ থাকেনি–থাকে না। তবে অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশে তার উৎকর্ষ-অপকর্ষ ঘটে। তাও এসব বাধার যা-কিছু গুরুত্ব সাধারণের কাছেই–প্রতিভাধরের কাছে কখনোই নয়। তার প্রমাণ বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য।

এবার বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের কথায় আসা যাক। চর্যাগীতি যে বাঙলা এ বিশ্বাস থেকেই বাঙলা সাহিত্যের তামস-যুগ তত্ত্বের উদ্ভব। অথচ চর্যাগীতি যে প্রাচীন বাঙলা তা আজো সর্বজন স্বীকৃত সত্য নয়। হিন্দি, মৈথিল, উড়িয়া, অসমীয়াও এর দাবীদার। ডক্টর সুকুমার সেন, অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন প্রমুখ বাঙালি বিদ্বানেরাও ওদের দাবীর আংশিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। সব সিদ্ধার বাড়ি বাঙলায় নয়, বাঙলা তখনো শালীন ও লেখ্য সাহিত্যের ভাষা নয়, আঞ্চলিক বুলি মাত্র। কাজেই উড়িষ্যা, মিথিলা কিংবা আসামের লোকের বাঙলা পদ রচনা করার তখনো সাধ-সাধ্য থাকার কথা নয়। অতএব সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, চর্যাপদ অর্বাচীন প্রাচ্য (গৌড়ী?) অবহট্টে রচিত। সে সময় আঞ্চলিক বিকৃতিজাত সামান্য প্রভেদ থাকলেও উড়িয়া-বিহারী-বাঙলা ও আসামী অবহট্ট মোটামুটি অভিন্ন ছিল। নাথ সহজিয়া পন্থের অন্যতম প্রসারক্ষেত্র চন্দ্ররাজদের রাজ্য পূর্ববঙ্গ। কাজেই মানিকচাঁদ-ময়নামতী-গোপীচাঁদের দেশে (আধুনিক কুমিল্লাদি জেলায়) বহুল চর্চার ফলে নেপালেও চর্যাগীতি সম্ভবত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশাদি পূর্ববাঙলার লোকেরাই নিয়ে যান চর্যাগীতিতে বঙ্গ-গৌড়ীয় বিকৃতি এসেছে। এতেই বাঙলার দাবী জোরালো হয়েছে। মুনিদত্তের টীকাযুক্ত চর্যাগীতি নেপালে নেওয়ারী হরফে লিখিত পুথিতেই পাওয়া গেছে। বিদেশে বিভাষীর পক্ষে ভিন্ন ভাষার অলিখিত শাস্ত্রচর্চা সম্ভব নয়। কাজেই চর্যাগীতি নেপালে স্বাভাবিকভাবেই লিখিত ও টীকা সম্বলিত হয়েছে। কিন্তু আসাম-বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যাতেও তার লেখ্যরূপ ছিল বলে মনে করবার সঙ্গত কারণ নেই। নাথ সহজিয়া-শন্থ যোগ-তান্ত্রিক বজ্রযান বৌদ্ধদের বিকৃত উপশাখা। কাজেই উপসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেশি ছিল না এবং তারা স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপন। করেনি। অতএব সেকালের বাঙালি-বিহারী-আসামী-উড়িয়া সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বের দাবী বা যোগ্যতা এদের ছিল না। সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পাল আমলের। মধ্যকাল থেকেই সংস্কৃত চর্চা করত। কারণ শাস্ত্রচর্চার ও শাসন পরিচালনের বাহন ছিল সংস্কৃত। তাই প্রাচ্য অবহট্টেরও লেখ্যরূপ মিলে না। গৌড়ী-মাগধী অবহট্টেই যদি লেখার রেওয়াজ না থাকে, তা হলে তখনো নিতান্ত অবজ্ঞেয় আঞ্চলিক মুখের বুলি আসামী-বাঙলা-উড়িয়া-বিহারীতেই বা লেখ্য রচনার সম্ভাব্যতা কোথায়? কাজেই এদেশে চর্যাগীতির কোনো লেখ্যরূপ ছিল না এবং এগুলো মুখে মুখে রচিত ও গীত লোকসাহিত্য বা লোকায়ত শাস্ত্ররূপেই চালু ছিল বলে আমাদের ধারণা। অতএব, আমাদের অনুমান এই যে চর্যাগীতি লিখিত রচনাও নয়, বাঙলাও নয়– অর্বাচীন গৌড়ী-মাগধী অবহট্ট এবং মৌখিক রচনা। ডক্টর সুকুমার সেনও বলেছেন–অসমীয়া ভাষীদের দাবী অযৌক্তিক নয়, কেননা যোড়শ শতাব্দী অবধি (বাঙলা ও অসমীয়া) দুই ভাষায় বিশেষ তফাৎ ছিল না  এবং উড়িয়া-আসামীদের সঙ্গে বাঙলার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আদিতে এই তিনটি একই ভাষা ছিল। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর হইতে মূল ধারা হইতে উড়িয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে।4- ৫ কাজেই ভাষার এক সাধারণ স্তর থেকে বাঙলা, উড়িয়া, মৈথিল অসমীয়ার উদ্ভব। ডক্টর সুকুমার সেন এর নাম দিয়েছেন, প্রত্ন-বাঙ্গালা-অসমীয়া-উড়িয়া।৬ এই সাধারণ স্তর আমাদের ধারণায় অর্বাচীন অবহট্ট বা আধুনিক ভাষাগুলোর লক্ষণ স্ফুটনকালীন অবহট্ট। অতএব চর্যাগীতি কেবল বাঙলার নয়, উক্ত অপর ভাষাগুলোও সাধারণ ঐতিহ্য এবং এর ভাষা আলোচ্য সবকয়টি ভাষার জননী।

ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্য সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদিযুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলের লোকের ভাব-বিনিময়ের বাহন। তাই কোনো আর্য ভারতিক আঞ্চলিক বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা কিংবা শালীন সাহিত্যের বাহন হবার সুযোগ পায়নি। বৌদ্ধ ও জৈন মত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেক কাল রাষ্ট্র শাসনের কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে পরে কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠি ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ট সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।

এরপরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরকারী ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাববিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্য ভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, নানক, কবীর, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজ্জব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।

এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভাল। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ট বৌদ্ধ ব্ৰজযান সম্প্রদায়ের যোগ-তন্ত্র ও শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়– যার ফলে আধুনিক আর্য ভাষার (অবহট্ট থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুইস্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শনস্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।

তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল বৈষ্ণবমত ও দেব পাঁচালী। পরবর্তীকালে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের, হিন্দুসমাজে সংস্কারের এবং কোম্পানীর শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগসুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেনি; কারণ পরপর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনো দিন জাতীয় ভাষা বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।

শিক্ষার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা শিক্ষিত লোকের ভাষা। সেকালে শিক্ষিতের সংখ্যা। ছিল নগণ্য। কাজেই প্রাকৃতজন তাদের ভাব-ভাবনা ও অনুভূতি-উপলব্ধি প্রকাশ করত নিজেদের মুখের বুলিতেই। এভাবে তারা গান, গাথা, ছড়া, বচন ও রূপকথা-রসবার্তা তৈরি করে মুখে মুখে প্রচার করতে থাকে। বহু মুখের স্পর্শে ওগুলো রূপ ও রস বদলায়, ফলে ও-গুলোকে ব্যক্তিক রচনা বলে চিহ্নিত করা যায় না। তাই আজকাল এ সাহিত্যকে গণরচনা বলে নির্দেশ করা হয়। আমাদের আধুনিক সংজ্ঞায় এগুলোই লোক-সাহিত্য বা পল্লী-সাহিত্য। আঞ্চলিক বুলিতে রচিত বলে লোক সাহিত্য সাধারণত অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে দেশময় ব্যাপ্ত হতে পারত না। পল্লী-সাহিত্য সাহিত্য-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস-প্রসূত নয়। তবু মানবমনের কোমল অনুভূতির আন্তরিক প্রকাশ বলেই এগুলো সুন্দর এবং স্থানে স্থানে শিল্পগুণে মণ্ডিত। মুখের বুলির পুষ্টি ও বিকাশ হয়েছে প্রাকৃত . রচনা লোক-সাহিত্যের মাধ্যমেই। বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে–ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবাদ, রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, যোগীপাল-ভোগীপাল, মহীপাল গীত (অপ্রাপ্য), ময়নামতী-গোপীচাঁদ-মানিকচাঁদ গীত, মীননাথ-গোখনাথ-হাড়িপা কাহিনী; শিবের-ছড়া, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালী, ভারত কথা প্রভৃতি। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে ব্রাহ্মণ্য সমাজের কাহিনীগুলো রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ও মঙ্গল কাব্যাদিতে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ কাহিনী ময়নামতী-গোপীচাঁদকথা গাথা রূপেই রয়ে গেছে এবং পাল গীতি লোপ পেয়েছে।

অন্যান্য দেশের বুলি যেমন ধর্মমত প্রচারের বাহন বা রাজ্য শাসনের মাধ্যম কিংবা প্রাকৃতজনের রচনার অবলম্বন হয়ে ক্রমে সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে বাঙলার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে বলে রাখা ভাল, মুসলমান সুলতান-সুবেদারেরাও শাসিতদের জানবার ও শাসন পরিচালনার গরজেই বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির পোষকতা করেন। লেখ্য ভাষা বইপত্র ছাড়া লেখা যায় না, কাজেই গ্রন্থ লিখিয়ে নিতে হল–ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যেমনটি হয়ে ছিল। আর ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে উঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে। বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি।

অতএব আলোচ্য দুশ বছরের মধ্যেকার বাঙলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না মেলার আমাদের অনুমিত কারণ এই :

ক. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্য শাসনের বাহন হয়নি বলে বাঙলা তুর্কী বিজয়ের পূর্বে লেখ্য ভাষার মর্যাদা পায়নি।

খ. ফলে, তেরো-চৌদ্দ শতক অবধি বাঙলা ভাষা উচ্চবিত্তের লোকের সাহিত্য রচনার যোগ্য হয়ে উঠেনি। এ সময় প্রাকৃতজনের মুখে মুখে গান, গাথা ও ছড়া-পঁচালীই চলত।৭

গ. সংস্কৃতের কোনো ভাষাতেই রস-সাহিত্য চৌদ্দ শতকের পূর্বে রচিত হয়নি। ভাষাকে লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহন রূপেই প্রাকৃতজনেরা গ্রহণ করে। সাহিত্যের ভাষা। তখনো সংস্কৃত প্রাকৃত বা শৌরসনী অবহট্টই ছিল। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ভাষায় রচন, পঠন ও শ্রবণ নিষিদ্ধ ছিল। সংস্কৃতের মাধ্যমে বৌদ্ধ শাস্ত্রেরও চর্চা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর অপরিণত বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির কল্পনা ও সম্ভাব্যতা কোনো উচ্চশিক্ষিত লোকের মনে জাগে নি। পাল ও সেন আমলে সংস্কৃত চর্চা হয়েছে এবং মুসলমান বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাঙলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেককাল গড়ে উঠেনি। কিন্তু এতে ভাষা বিকশিত হয়েছে; তার প্রমাণ মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে (তথা শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে)। এ গ্রন্থেই দেখা যায়, ইতিমধ্যে এক ডজন ফারসি-তুর্কী শব্দ বাঙলা সাহিত্যের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে।

ঘ, তেরো-চৌদ্দ শতকে সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দু শাসিত মিথিলায়। তাই এ সময় বাঙলা দেশে সংস্কৃতচর্চা বিশেষ হয়নি, কেবল কিছু কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের অনুশীলন হয়েছিল। মিথিলার পণ্ডিত চক্ৰায়ুধের মৃত্যুর পর নবদ্বীপ সংস্কৃতচর্চার তথা শাস্ত্রচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠে।

ঙ. তর্কের খাতিরে যদি স্বীকারও করা যায় যে আলোচ্য যুগে বাঙলায় কিছু কিছু পুথিপত্র রচিত হয়েছিল, তা হলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপি করণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। যত্ন করে রক্ষা না করলে অপ্রিয় বা বাজে ছাপা বইও লোপ পায়। আগুন পানি-উই-কীট তো রয়েইছে। কিন্তু এ যুগে যে ভাষায় কিছু লিখবার রীতি ছিল না, তার বড় প্রমাণ পনেরো শতকের শেষাবধি নানা মঙ্গল গীতি, রামায়ণ গান, ভারত পাচালী এবং বিশ শতকেও পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়নামতী গানের লিখিতরূপ পাওয়া যায়নি। অথচ এগুলো সুপ্রাচীন।

চ. আবার লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ, (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন), শেখ শুভোদয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।

ছ. চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বারো শতক হয়, তা হলে তেরো-চৌদ্দ শতক বাঙলা ভাষার গঠন যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়কার কোনো লিখিত রচনা না-থাকারই কথা। চর্যাগীতি ছাড়াও বারো শতকের বাঙলা-ঘেঁষা রচনার নমুনা মেলে শেখ শুভোদয়ার আর্যায় ও প্রাকৃত পৈঙ্গলের কোনো কোনো পদে। বাঙলা তখন সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, লক্ষ্মণ সেনের সভায় আমরা বাঙলা-কবিও দেখতে পেতাম এবং পূর্ববঙ্গ ও রাঢ়ের মতো হিন্দুশাসিত অঞ্চলে তেরো শতকে লিখিত বাঙলা রচনার নিদর্শন পাওয়া যেত।

জ. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাঙলা। বাঙলায় লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কী-বিজয়ের পূর্বের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না এবং মুসলিম বিজয়ে তাদের রচনার ধারাবাহিকতা ছিন্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি। কেবল তাই নয়, বাঙলা লেখ্য ভাষা হলে গৌড়-সুলতানের দরবারে রাজ্যশাসনের প্রয়োজনে গোড়া থেকেই অন্তত বাঙলা ফরমান লিখিয়ে মুসলমান পাওয়া যেত। হিন্দুরা যে অশ্রদ্ধাবশত বাঙলায় কখনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে চায়নি, লৌকিক দেবতার পূজাপ্রচার প্রয়াসীই ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে আঠারো শতক অবধি লিখিত হিন্দুর রচনায়।

পরাধীনতার গ্লানি হিন্দু-মনে অবশ্যই ছিল। তেমন অবস্থায়ও যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হতে পারে তার সাক্ষ্য রয়েছে উনিশ-বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্যে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যে চারশ বছরেও আশানুরূপ উন্নতি ও বিকাশ হয়নি বাঙলা দরবারী কিংবা জাতীয় ভাষার মর্যাদা পায়নি বলেই।

অতএব, আমাদের অনুমান এই যে বাঙলা বারো, তেরো ও চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ অবধি লেখ্যভাষার স্তরে উন্নীত হয়নি। এটি হচ্ছে বাঙলার প্রাপ্তির কাল ও মৌখিক রচনার যুগ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *