ইংরেজ আমলে মুসলিম-মানসের পরিচয়-সূত্র
পাক-ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয় মুখ্যত সূফী সাধকের দ্বারা। ইরানে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার পর কোরআনের ইসলামের উপর ইরানী অধ্যাত্মতত্ত্বের প্রভাব পড়ে সুপ্রচুর। কোরআনের ইসলামের মূলকথা : স্রষ্টা ও সৃষ্টি আলাদা, পরস্পরের সম্বন্ধ হচ্ছে বান্দা ও মনিবের। আল্লাহর নির্দেশিত বিধি নিষেধ মেনে চলাই মানুষের একমাত্র কর্তব্য। নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি অনিবার্য। আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধও কোনো অধ্যাত্ম-জীবনের ইঙ্গিত বহন করে না, তা একান্তভাবেই মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার সম্পর্কিত। কাজেই কোরআনের শিক্ষায় কোথাও কোনো অস্পষ্টতা বা হেঁয়ালি নেই। সূফী মতবাদে কিন্তু বান্দা-মনিব সম্পর্কটি প্রায়ই অস্বীকৃত হয়েছে এবং ঘোষিত হয়েছে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে পরমাত্মা ও জীবাত্মার প্রণয় সম্পর্ক। এর পরিণাম দ্বৈতাদ্বৈতবোধে। অথচ ইসলামের মৌল কথা দ্বৈতবাদ। ফলত ইসলাম আর মুসলমানধর্ম এক থাকে নি। পাক-ভারতে এই মুসলমান ধর্মই প্রচলিত হয়েছিল, তার উপর শিয়ামতবাদও এখানে অপ্রচলিত ছিল না।
জনসাধারণ ছিল অশিক্ষিত, আর প্রচারক ছিলেন পীর-দরবেশ, কাজেই যুক্তি প্রয়োগে নয়– কেরামতি, সামাজিক-সাম্য ও ভাবালুতা সম্বল করেই প্রচারিত হয়েছিল ইসলাম। তাই অধ্যাত্ম মহিমামুগ্ধ তত্ত্বপ্রবণ মনে ইসলামের ব্যবহারিক শিক্ষা বিশেষ সক্রিয় হতে পারে নিঃ যেমন শিয়া, ইসমাইলী সম্প্রদায় কিংবা চিশতিয়া-আদি সূফী খান্দানীদের ধর্মবোধ আজো পীরকেন্দ্রী। মারফত-পন্থ নামে চিহ্নিত করে ইত্যাকার মতবাদকে শরীয়তী-ইসলামেরও উপরে স্থান দেয়া হয়েছে।
ফলে পাক-ভারতের দীক্ষিত মুসলমান কোনোদিন দৃঢ়-প্রত্যয়ী মুসলিম হতে পারে নি। তাই নানক-কবীর-চৈতন্যের মাহাত্ম্য-মুগ্ধ মুসলমান ইসলাম ছেড়ে তাদের শিষ্য হয়েছিল। যারা রইল, তারাও পূর্বপুরুষের বিশ্বাস-সংস্কার পুরো ত্যাগ করতে পারে নি।
তাই বাঙলা দেশে আমরা কিছুকাল আগে পর্যন্ত সত্যপীর, বনবিবি কালুগাজী, ওলাবিবি প্রভৃতি মুসলিম-পূজ্য উপদেবতা পাচ্ছি। এভাবে পাক-ভারতে একপ্রকার লৌকিক ইসলাম দাঁড়িয়ে যায়। মাদার-পন্থী ফকিরেরা ও শাহ বু-আলি কলন্দরের যোগমার্গ আরো বাড়িয়ে দিল এ-বিকৃতি। যোগপন্থী দেহাত্মবাদী বাউল-বিকৃতিও মুসলিম সমাজকে পেয়ে বসেছিল। একে তো মুসলমান শাসকজাতি-শাসিত সম্প্রদায়ের তুলনায় ঐশ্বর্যবান–সবক্ষেত্রে ধনে না হোক, মানে ও মনে তো বটেই! তাই আবার ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার একান্ত অভাব। কাজেই বিকৃতি ও উজ্জ্বলতা ছিল প্রকট ও প্রবল। আকবরের আমলে রাজশক্তির প্রশ্রয়ে তা আরো বেড়ে গেল। আকবরের রাষ্টচেতনা ছিল সে যুগের পক্ষে অভিনব। তিনি রাজ্যের স্থায়িত্বের খাতিরে এক-জাতিতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে স্বধর্ম ও সংস্কৃতি ত্যাগ করলেন। সম্রাটদের মধ্যে তিনিই প্রথম দাড়ি চাঁছলেন, রাজপুতদের মতো পোশাক পরলেন, দরবারে নানা হিন্দুয়ানী তথা রাজপুত আচার চালু করলেন আর সামাজিকভাবে হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতলেন।
ইলাহি মত আসলে একজাতি এক রাষ্ট্র-তত্ত্বের বাস্তবায়নের উপায়রূপেই পরিকল্পিত। না ব্রাহ্মণ্য, না-ইসলামী আবহাওয়ায় মানুষ হলেন জাহাগীর। ফলে মুসলিম প্রজা-সাধারণের মধ্যে ধর্মানুরাগের অভাব লক্ষ্য করে কিছু সংখ্যক আলেম বাদশাহর ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য ব্যাখ্যায় আত্মনিয়োগ করলেন মোজাদ্দেদ-ই আফিসানি শেখ আহমদ সিরহিন্দ। এ আন্দোলন পুরুষ পরম্পরায় চলেছিল এবং সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। তারই ভাবশিষ্য ছিলেন শাহ ওয়ালী উল্লাহ। এঁর সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানবুদ্ধি ইসলাম এবং মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রবোধের একটি আশ্চর্য সুন্দর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিল। কিন্তু পতন-যুগের শিথিল-চরিত্র মুসলমান সমাজে তা বিশেষ কার্যকর হয়নি। তারপর কিছুকালের মধ্যেই ঘুণে-ধরা। রাষ্ট্রশক্তির পতন অনিবার্য হয়ে উঠল। একদিন বাঙলা-বিহারে দণ্ডধর হল বিদেশী বেনে-শক্তি। ভারতের সর্বত্র ক্রমে খসে পড়তে লাগল দেশী শাসন-দণ্ড। তা পড়ল বটে; কিন্তু মুসলমান চরিত্র হারালেও মর্যাদা ও অভিমান হারায় নি তখনো। বৃটিশ মুসলমানের এই মনোভাব টের পেয়েছিল গোড়াতেই। তাই কার্যত দণ্ডধর হয়েও তারা নামত দেওয়ানই রইল বহুকাল। তারা জানত মুসলমান তাদের রাজশক্তি হিসেবে স্বীকার করতে চাইবে না। এরূপ ঘটনা আমরা ইতিহাসে আগেও দেখেছি; মুসলমানেরা তখত নিয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করেছে, কিন্তু কোনো হিন্দু প্রশ্রয় পায়নি। তাই মালিক কাফুর, গণেশ টিকতে পারেন নি আর জগৎশেঠ-রাজবল্লভ মসনদ দখল করতে সাহস করেন নি।
মুসলমান নিজেদের জীর্ণতার কথা বহুকাল টের পায় নি, যদিও মারাঠা, শিখ ও ইংরেজ কার্যত ভারতের মালিক হয়ে উঠেছিল। যখন টের পেল তখন সব শেষ হয়ে গেছে। তবু তারা নিঃশেষে ভেঙে পড়ে নি। হৃত রাজ্য ও গৌরব ফিরে পাবার সংগ্রামে তারা মেতে উঠল নতুন উদ্যমে। এবার নেতৃত্ব দিলেন সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী। ইনি ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভাবশিষ্য এবং আরবের সংস্কার-নেতা মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের মতবাদে মুগ্ধ। মুসলমান আমলে যা ছিল একান্ত ধর্ম-সংস্কারান্দোলন, তা-ই এখন ধর্মসংস্কারের আবরণে রূপ নিল আযাদী সংগ্রামের। তাঁরও যতটা ইসলামী জোস্ ছিল, রাষ্ট্রনীতিক দৃষ্টি ততটা ছিল না। তাই তিনি ঘরের পাশের বৃটিশকে শত্রু ভাবলেন না, যুদ্ধ করতে গেলেন বালাকোটে ক্ষয়িষ্ণু শিখ-শক্তির বিরুদ্ধে। ভাবী শত্রু শিখ এভাবে হতবল হচ্ছে দেখে সৈয়দ আহমদের প্রতি হয়তো বৃটিশ সহানুভূতিশীল ছিল। পরে নানা সঙ্গত কারণেই ওহাবীরা বৃটিশ বিরোধী হয়। আযাদী সংগ্রামে মুসলমানদের আত্যন্তিক উত্তেজনা দানের জন্যেই তিনি ভারতকে দারুলহরব বলে ঘোষণা করেছিলেন। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর সদিচ্ছা ছিল; কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টি ছিল না। তাই তলিয়ে দেখবার বা বুঝবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মোকাবেলা করবার এতটুকু যোগ্যতাও আর মুসলমানদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। যোগ্যতা বা কৌশল ছাড়া কেবল মনের বলে কিংবা গায়ের জোরে কিছু হবার নয়। এই সামগ্রিক দূরদৃষ্টির অভাবে তাঁর সাধনা ও সংগ্রাম ব্যর্থ হল। যদিও আযাদী-লুব্ধ গাঁয়ের তরুণও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই যেহাদে। স্বেচ্ছায় প্রাণ দিয়েছে হাজার হাজার আযাদীমত্ত তরুণ। একই কারণে ব্যর্থ হল বাঙলা দেশে তাঁর শিষ্য তীতুমীরেরও সগ্রাম।
সৈয়দ আহমদ ও তীতুমীরের শাহাদতের পরেও চেষ্টা চলেছিল সংগ্রাম চালিয়ে যাবার। কিন্তু বৃটিশের ভয়ে বিত্তবানেরা ওহাবীদের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাদের বিরত হতে হল। কিন্তু ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন তারা ত্যাগ করে নি; ফলে অন্তত বাঙলা, বিহার ও সেকালীন উত্তর ভারতে শরীয়তী ইসলাম দৃঢ়মূল হল। এও একটা বড় লাভ। বাঙলা দেশে এ আন্দোলন বিশ শতকের প্রথম দুদশক পর্যন্ত বেশ প্রবলভাবেই চলেছিল, তার রেশ কোনো কোনো অঞ্চলে যেমন চাটগাঁয়ে ও উত্তরবঙ্গে এখনো বর্তমান। এ ক্ষেত্রে কেরামত আলী, হাজী শরীয়ৎ উল্লাহ, দুদুমিয়া, ইমামুদ্দিন, মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রমুখের কৃতিত্ব এবং আহলে হাদীস, শর্ষিনা ও ফুরফুরার প্রভাব স্মরণীয়।
বাঙলা দেশে যাকে ফকির বিদ্রোহ বলে, উত্তরবঙ্গে মজনু শাহর নেতৃত্বে সেই অবাধ লুটতরাজও বৃটিশ-বিরোধী মনোভাব প্রকাশের বা বৃটিশশাসন অস্বীকারের প্রচেষ্টামাত্র। এক শ্রেণীর আলেমের মতে বিজাতি ও বিদেশী রাজের শাসন অমান্য করা ও দেশের বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রাখা মোমেনের কর্তব্যেরই অঙ্গ। মজনু শাহ ও তাঁর অনুচরদের মনে এ শিক্ষাই ক্রিয়া করেছিল। তাই তাদের আচরণ ও কাজের পশ্চাতে এই আদর্শই সক্রিয় ছিল। ঢাকার সরফরাজ খান, বীরভূমের আসাদুজ্জামান খান, মুর্শিদাবাদের উজীর আলী প্রমুখের বিদ্রোহও মুসলমানের আযাদী-উদ্যমের সাক্ষ্য বহন করছে। আজিমুদ্দিনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও অর্থপূর্ণ ভূমিকাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। অতএব দেখা যাচ্ছে, নদীর পাড়ভাঙার মতই অতর্কিতে যখন আযাদী গেল, তখন মুসলিম মনে জাগল এক অসহ্য গ্লানিবোধ এবং তা-ই লাভ-ক্ষতির পরওয়াহীন বিক্ষোভে, বিরোধিতায় ও সংগ্রামে রূপ পেল।
এদিকে বাঙলাদেশে ইংরেজ সুকৌশলে সরকারি দপ্তর থেকে মুসলিম তাড়ন শুরু করে দিল। এতে শাসন পরিচালনে কোনো অসুবিধেও হল না তাদের। গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলিম নিয়োগ ছিল নিষিদ্ধ। পুরোনো আমলা অবসর নিলে তার পদে হিন্দুই নিযুক্ত হত। নতুন প্রভুর অযাচিত অনুগ্রহে আপুত হিন্দুসমাজ সোৎসাহে ইংরেজিও শিখতে লাগল। ফলে ১৮২০ খ্রীস্টাব্দের দিকে মুসলিম-শূন্য হল সরকারি দপ্তর। কাজেই ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে ইংরেজিকে দরবাবি-ভাষা রূপে চালু করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। মুসলিম কাযীর পদও বাতিল হল ১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দে।
আমরা মুখে যাই বলি না কেন, আসলে লেখা-পড়ার মুখ্য উদ্দেশ্য চাকরি- এক কথায় লেখাপড়াও বৃত্তিমূলক। চাকরির আশা নেই দেখে অভিভাবকদের কাছে সন্তানদের লেখাপড়ার কোনো গুরুত্ব রইল না, এভাবে লক্ষ্যহীন-ভরসাহীন শিক্ষা চলতে পারে না।
তার উপর ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দে জনহিতকর দাঁতব্য লাখেরাজ আয়েমা বাজেয়াপ্ত হওয়ায় মুসলমানের শিক্ষার পথও হয়ে গেল রুদ্ধ। এরূপে মুসলমানদের শেষ আশা এবং আশ্রয়ও নষ্ট হল। কাজেই ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দের দিকে অশিক্ষিত কুলি-কাঙালে পরিণত হল মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা। এভাবে যে দুর্ভাগ্যের দুর্দিন নেমে এল তা সুদীর্ঘ ষাট-সত্তর বছরকাল স্থায়ী হয়েছিল, তারপর ক্রমে ক্রমে সুদিনের সূর্যরশ্মি দেখা দিতে থাকে।
পলাশীর প্রান্তরে জয়লাভ করে ইংরেজরা দেশের ভাগ্যবিধাতা হল বটে, কিন্তু তারা এদেশ শাসন করবে কি শোষণ করবে, তা তখনই স্থির করতে পারে নি। মনস্থির করতে পুরো পঁচিশটি বছর লেগেছিল তাদের। অবশেষে সাব্যস্ত হল তারা শাসন ও শোষণ দু-ই সমানে চালিয়ে নেবে। এসবের চমকপ্রদ দলিল ও বিবরণ পাওয়া যাবে ডক্টর ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের Early Administrative System of East India Company নামক মূল্যবান গ্রন্থে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেই শাসন-শোষণের সুবিধার জন্যে ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে সরকার যে নতুন ভূমিস্বত্ব ও রাজস্বব্যবস্থা চালু করে, তাতে কাঁচা মুদ্রার অভাবে অভিজাত মুসলমানেরাও জমিদাবি ক্রয় করে সম্পদশালী থাকতে পারল না।
১৮৫৭-৫৮ খ্রীস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবে ওহাবী আন্দোলনের মনোভাবও যে সহায়তা করেছিল, তা অবশ্যস্বীকার্য। সিপাহী বিপ্লবকালে স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজ-পক্ষে ছিলেন। এই দূরদর্শী মনীষীই প্রথম উপলব্ধি করলেন, হিন্দুরা যখন বৃটিশের সহযোগিতা করছে, তখন মুসলমানদের এই বৃটিশ-বিদ্বেষ, অসহযোগ ও সগ্রাম আত্মধ্বংসী বই কিছুই নয়। এই সর্বনাশ থেকে উদ্ধারের উপায়। হিসেবে বৃটিশ-প্রীতি ও সহযোগের মনোভাব সৃষ্টির জন্যে তিনি মুসলিম সমাজে প্রচারণা চালাতে লাগলেন। তাঁর মতবাদ মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজে অভিনন্দিত হল। তখন থেকেই মুসলমানেরা আচরণে বৃটিশ-বিদ্বেষ ত্যাগ করে এবং অভিমান ছেড়ে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু তখন কাঙাল মুঠে-মজুরের সমাজে ইংরেজি শেখার গুরুত্ব বুঝবার ও ব্যয়ভার বহন করবার মতো যোগ্যতা আর বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না, তাই অর্ধশতাব্দীকালের মধ্যেও বিশেষ কোনো ফল দেখা গেল না।
এ সময় থেকেই শিক্ষিত হিন্দুসমাজে স্বাজাত্য ও অধিকারবোধ জাগতে থাকে। ফলে বৃটিশ সরকার এখন থেকে মুসলমানের প্রতি প্রসন্ন ও হিন্দুর সম্পর্কে সতর্ক হতে থাকে।
আমরা মুসলিম মনের বিক্ষোভ, বৃটিশ-বিদ্বেষ ও ইংরেজি বর্জনকে মুসলমান-জাতির বোকামি বলব না; মর্যাদাবান মানুষের মতো তারা নির্ভীকচিত্তে ও সমুন্নত শিরেই দুর্ভাগ্যকে জয় করতে চেয়েছিল। বাইরের দাসত্ব তখনো তাদের মনের মহিমাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। কারণ আত্মসচেতন ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ মাত্রেরই কাছে জানের চেয়ে মান বড় এবং তার চাইতেও বড় স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা হারিয়ে যদি তারা লাভ-ক্ষতির বেনেসুলভ খতিয়ান তলিয়ে না দেখে, তবে তাদের ব্যবহারিক জীবনের লোকসান যত বেশিই হোক না কেন, অন্তৰ্জীবনের ঐশ্বর্যের প্রভাব আমাদের আনন্দিত করে। অবশ্য ক্ষতি যা হল, তা অপরিমেয় এবং এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ যুগেও আমাদের পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় লাগবে।
এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে ১৮৬০ থেকে ১৯৪৭ সন অবধি সাধারণভাবে ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাত ও নেতৃস্থানীয় মুসলমানেরা বৃটিশবিরোধী ছিল না। কিন্তু আরবি-ফারসি শিক্ষিত মুসলমানদের আযাদী স্পৃহা এতই তীব্র ছিল যে, আযাদী লাভের আশায় মৌলবী-মোল্লারাই সাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন কাফের বলে নিন্দিত হিন্দুদের সঙ্গে। এঁরা শেষ অবধি কংগ্রেস-পন্থী তথা হিন্দু মুসলিমের একজাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন। কংগ্রেস, খেলাফত সমিতি বা মুসলিম লীগের আহ্বানে অশিক্ষিত নিঃস্ব মুসলমান যেভাবে অকপট সাড়া দিয়েছিল, অশিক্ষিত অমুসলমান কোনোদিন স্বাধীনতা সগ্রামে সেভাবে সাড়া দেয়নি।
বিশ্বাসের অঙ্গীকারে জন্মায় ধর্মবোধ। আস্তিক মানুষের জীবন চালিত হয় ধর্মবিশ্বাসের আনুগত্যে। এবং ধর্মমাত্রই পুরোনো। কাজেই আস্তিক মানুষ জীবনযাত্রার নীতি-আদর্শ খোঁজে অতীতে। এমন মানুষ পরিবেষ্টনীকে অবহেলা করে এবং দেশ-কালের চাহিদা ও প্রভাব এড়িয়ে আদর্শ জীবনের অদ্ভুতস্বপ্ন রচনা করে স্বস্তি পায়। সম্মুখদৃষ্টিকে পশ্চাতে নিবদ্ধ করার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় নিহিত থাকে তাদের ব্যর্থতার বীজ। ইসলামের উদ্ভবযুগের ঋজু অবিকৃত ধর্মবিশ্বাসই আরবদের দিগ্বিজয়ী করেছিল–মুসলমানেরা এ-কথা ভুলতে চায় নি। এবং একেই আত্মোন্নয়নের একমাত্র ও ধ্রুব উপায় বলে মেনেছে। তাই ধর্মবোধের মাধ্যমে মুসলমানদের প্রেরণাদানের ও পতনরোধের চেষ্টা হয়েছে সর্বত্র। পাক-ভারতের ইতিহাসের ধারায় আমরা তাই বারবার একই আহ্বান শুনেছি, শেখ আহমদ সিরহিন্দী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, তিতুমীর, কেরামত আলী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদুমিয়া, হালী-ইকবাল-জলন্ধরী-ফররুখ প্রভৃতি ধর্মবেত্তা, সমাজনেতা ও কবি-দার্শনিকের মুখে। ওহাবী-ফরায়েজীর পিউরিটানিক গোঁড়ামির তথা গ্রহণবিমুখতা ও বর্জন-প্রবণতার কারণও ছিল এ-ই। কল্যাণচিন্তায় এঁদের আন্তরিকতা ছিল, কিন্তু কালিক জীবনচেতনা ছিল না, ছিল না স্থানিকবোধও। তাই তেরোশ বছর আগের মরুভূ আরব তারা কখনো অতিক্রম করতে পারেন নি।
আত্মপ্রত্যয়হীন মানুষ আত্মসংকোচনকেই আত্মরক্ষার উপায় বলে জানে। স্বশক্তিতে আস্থাবান মানুষ চারদিককার সবকিছু আত্মসাৎ করে হয় বড়ো। অতএব যদিও তাদের লক্ষ্য ছিল মহান কিন্তু সামর্থ্য ছিল সামান্য, মনন ছিল সীমিত এবং পথ ছিল ভ্রান্ত। গ্রহণ, বরণ, বর্জন ও সমন্বয় সাধনের মধ্যেই যে ব্যক্তিজীবনের বৃদ্ধি এবং জাতীয় জীবনের প্রগতি পন্থা নিহিত, তা বুঝিয়ে দেবার জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদের মতো আরো অনেক ব্যক্তিত্ব ও চিন্তানায়কের স্থানিক ও কালিক প্রয়োজন ছিল।
ওহাবী-ফরায়েজী আন্দোলন প্রবল হলেও সর্বশ্রেণীর লোকের যে এতে সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল না, তা না বললেও চলে। বিশেষ করে উচ্চবিত্তের অভিজাত মুসলমানের ভূমিকা এতে দুর্লক্ষ্য। ফলে ধর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমান সমাজের দারিদ্র-মুক্তি ও আযাদী স্বপ্ন সফল হয়নি। এমনকি তাঁদের প্রচেষ্টায় এদেশী মুসলমানের পতন পথ রুদ্ধ হয়েছিল বলেও প্রমাণ নেই। বরং ইংরেজ বিদ্বেষহেতু ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের বিরূপতা মুসলিম মধ্যবিত্ত ঘরে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। ফলে অর্থাগমের পথ রুদ্ধ রইল দীর্ঘদিন। এমনকি এই বিরূপতা বশে মাদ্রাসায়ও নাম-ঠিকানা লেখা ও পড়ার জন্যে ইংরেজি হরফও শেখানো হয় নি। অথচ প্রশাসনিক ভাষার সঙ্গে এই লৈপিক পরিচয় বৈষয়িক কারণেই জরুরী ছিল।
অবশ্য মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এতেই রোধ করা যেত না, যেমন জাত নষ্ট ও সমাজ বিচ্যুতিভয় হিন্দুদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ ও বিলেত গমন রোধ করতে পারে নি। কিন্তু এর বিস্তার মন্থর হল অন্য কারণে। হিন্দুসমাজে নিম্নবর্ণের মধ্যে যেমন, পুরুষানুক্রমে নিম্নবিত্তের দেশজ মুসলমানদের মধ্যেও তেমনি শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল না। তারা বাঙলা বা আরবি শিক্ষাও গ্রহণ করে নি কোনোদিন। অতএব মসজিদ-কেন্দ্রী আরবি ফারসি শিক্ষায়ও তাদের কোনো কালে আগ্রহ ছিল না। নিরক্ষরতা ছিল সর্বব্যাপী। কেবল গায়ে গায়ে দু-চারটি লোক লেখাপড়া জানত। এরাই হত নায়েব গোমস্তা পীর-মুনশী-মুয়াজ্জিন। বিহারে-উত্তরপ্রদেশে উচ্চবিত্তের অভিজাত বেশি ছিল, তাই ওহাবী আন্দোলনের কেন্দ্র হয়েও সেখানে ইংরেজি শিক্ষা প্রসার লাভ করেছিল এবং বাঙলার উচ্চবিত্তের অভিজাত মুসলমানরা ও রাজসরকারের পদস্থ কর্মচারীরা ছিল অবাঙালি। তাঁদের অধিকাংশই সিরাজদ্দৌলা-মীরকাশেমের পতনের পর উত্তর বিহারে ও উত্তর ভারতে চলে যায়। আর যারা নানা কারণে রয়ে গেল, তারা গোড়া থেকেই ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করছিল। তাদের এবং দেশী মধ্যবিত্ত মুসলমানের সংখ্যা ছিল নগণ্য। আবার পড়তে গেলেও পড়া হয় নি অধিকাংশের। তাই ব্রিটিশ আমলে বাঙলার মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়েনি। আবার মৌলানা কেরামত আলী, ইমামুদ্দিন প্রভৃতি ধর্ম-সংস্কারকদের প্রবর্তনায় চট্টগ্রাম বিভাগে আরবি শিক্ষা বিস্তার পায়।
আঠারো শতকের শেষার্ধ থেকেই য়ুরোপে দৈশিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। উনিশ-বিশ শতকে ঘটে তার উগ্রবিকাশ এবং পৃথিবীব্যাপী বিস্তার। এর আগে ধর্মীয় ঐক্যবোধ ভিত্তিক একপ্রকার জাতীয়তাবোধ মানুষের ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবমুক্ত এদেশী হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ ছিল প্রবল। এমনকি প্রতীচ্য শিক্ষার আলো প্রাপ্ত অনেক চিন্তাবিদ মনীষী-কবি-সাহিত্যিকও এ সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন না। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-স্যার সৈয়দ আহমদ-আমীর আলী প্রভৃতি অনেকের জাতি-চেতনা এ সূত্রে স্মর্তব্য। তাই সে-যুগে দৈশিক জীবন-চেতনা ছিল দুর্লভ। ভৌগোলিক পরিবেষ্টনীগত জীবনের ও প্রয়োজনের অস্বীকৃতিতে হিন্দু আত্মত্রাণের প্রেরণা খুঁজেছে স্বধর্মে ও উত্তরভারতের বৈদিক, রাজপুত ও মারাঠা ঐতিহ্যে এবং মুসলমানও ত্রাণ সন্ধান করেছে তার স্বধর্মে ও আরব-ইরানে। এটির নাম স্বাধর্ম– প্যান হিন্দুইজম ও প্যান ইসলামইজম। ফলে মধ্য ও উচ্চবিত্তের হিন্দু-মুসলমান নানা কাজে একত্রিত হয়েছে কিন্তু তাদের মিলন হয় নি। যদিও তারা একই হাটে বেচা-কেনা করেছে একই বাটে হেঁটেছে, একই মাঠে ফসল তুলেছে, একই বন্যায় পীড়িত হয়েছে এবং মরেছে একই মহামারীতে। তারা পাশাপাশি বসেছে, ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়েছে,– বাইরে সর্বত্র মিলেছে, সহযোগিতা করেছে, অন্য সব কিছুই দেয়া-নেয়া করেছে, মনটাই কেবল দেয়া-নেয়া করে নি, তারা মনটা ফিরিয়ে রেখেছিল দেশবহির্ভূত ধর্মের ও ঐতিহ্যের আনুগত্যবশে। ওটার নাম স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধর্ম যার অপর নাম দেশকালহীন আদর্শিক জাতীয়তা। কিন্তু এই আদর্শিক জাতীয়তা কোন্ শ্ৰেয়সের সন্ধান দিয়েছে!