মসি-সংগ্রামীর সমস্যা

মসি-সংগ্রামীর সমস্যা

এ যুগে লেখকেরা বঞ্চিত শোষিত মানুষের ত্রাণের জন্যে লেখনী ধারণ করেছেন। মসি যুদ্ধে মানুষের মতি ফেরানোর এই অভিনব ও সুপরিকল্পিত প্রয়াসে চরিত্রবান সাহিত্যিকদের আন্তরিকতার অভাব নেই। এঁদের লক্ষ্য দ্বিবিধ : প্রত্যক্ষভাবে শোষিতদের ও সহানুভূতিশীলদের সচেতন ও সগ্রামী করে তোলা আর পরোক্ষে শোষকদের অন্যায়বিমুখ ও সুবিবেচক করা।

কিন্তু মুখ্য কিংবা গৌণ লক্ষ্য–কোনোটাই আশু ফলপ্রসূ নয়। কেননা যারা লেখেন তারা এমনকি বিত্তহীন হলেও-মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত। যাদের জন্য তাঁদের সংগ্রাম তারা অশিক্ষিত, অজ্ঞ, মূক এবং মধ্যবিত্তদের সঙ্গে তাদের মানস-সূত্র অসংযুক্ত। আর যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তারাও এ সাহিত্যে অবহেলাপরায়ণ। কাজেই এ সাহিত্যের দ্বারা অশিক্ষিত শোষিতজন বিক্ষুব্ধ ও সংগ্রামী হয় না। আর শোষক বুর্জোয়ারাও ন্যায়নিষ্ঠ ও দায়িত্বসচেতন হওয়ার গরজ বোধ করে না।

সুতরাং আপাতত, দেখা যাচ্ছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ লক্ষ্য যারা, তাদের কাছে এ সাহিত্য পৌঁছেই না।

তাহলে, এ সাহিত্য কাদের জন্যে, কাদের কাছে এ সব লেখার আবেদন? ..

না বললেও চলে যারা বঞ্চিত কিংবা শোষিত, তাদের চেতনা সূক্ষ্ম নয়; তারা কেবলই মার খায়, আর তাকে নিয়তি কিংবা বিধিলিপি বলে মেনে নেয়। আন্দোলন করবার, বিদ্রোহী হবার, কিংবা নেতৃত্ব দেবার স্বপ্ন অথবা সামর্থ্য তাদের কোনো কালেই ছিল না। তাদের জাগাবার, সংগ্রামী প্রেরণা দেবার কিংবা নেতৃত্ব দানের গরজ বোধ করেছেন চিরকালই মধ্য অথবা উচ্চবিত্তের সংবেদনশীল মানবতাবাদী শিক্ষিত মানুষ। মার্কস-এঙ্গেলস্ থেকে মাও-সে-তু অবধি সব নেতাই মধ্য ও উচ্চবিত্তের লোক। অতএব মানবতাবাদী সমাজতন্ত্রী লেখকের উদ্দিষ্ট পাঠক মধ্য ও উচ্চ বিত্তের শিক্ষিত জনগণই। তাদের কিছু সংখ্যক লোককে লেখার মাধ্যমে সংবেদনশীল ও সংগ্রামী করে গড়ে তুলতে পারলেই তাদের মাধ্যমেই গণসংযোগ ও গণ-আন্দোলন সম্ভবপর হয়। দুনিয়া জুড়ে সৈন্যরা ছড়িয়ে রয়েছে, কেবল সেনাপতিরই অভাব। দুর্যোগ-দুর্দিনে শিক্ষিত সংবেদনশীল দৃঢ়চিত্ত সাহসী ও ত্যাগপ্রবণ কর্মীর নেতৃত্বই সংগ্রামে সাফল্য দান করে।

সংবেদনশীলতা ও মনুষ্যত্ব সব হৃদয়ে সুলভ নয়। পরিশীলন ও পরিচর্যায় এর বিকাশও হয়তো সামান্যই হয়। সহানুভূতি ও মনুষ্যত্ব মন-মেজাজের বিশেষ গড়ন-প্রসূত। নীতিকথায় এক্ষেত্রে মন ফেরানো অসম্ভব। এ অবস্থাকে স্বাভাবিক ও অপ্রতিরোধ্য বলেই মেনে নিতে হবে। তাছাড়া উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বিত্তশালী হবার নানা সুযোগ ঘটে। শিক্ষিত, কুশলী ও নীতিভ্রষ্ট নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে প্রলোভন সংবরণ করা সহজ নয়। কাজেই যে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর উপর জনকল্যাণ ও গণমুক্তি নির্ভরশীল, তাদেরও রয়েছে চোরাবালির মতো প্রতারক মন।

একেবারে নিঃস্ব না হলে সাধারণত মানুষ নিশ্চিত বর্তমান ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা বাড়ায় না। ব্যতিক্রম কেবল অসামান্যতারই পরিচায়ক। তাই দেখা যায় Boss ও বিবেকের দ্বন্দে প্রায়ই Boss-এর জয় হয়। কেননা চাকুরে-কুকুরে সমান–হুকুম করিলেই দৌড়িতে হয়।

এজন্যে মধ্যবিত্তে দীর্ঘস্থায়ী চারিত্রিক দার্ট সুদুর্লভ। আবার টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকটে গিয়া যে-আজ্ঞাও করছে। এমনো দেখা যায় মধ্য বয়সে মানুষ ন্যায় নীতি-আদর্শের বন্ধন মুখোশের মতোই হঠাৎ পরিহার করে। বাইরের লোক তার খোলস পালটানো দেখে নিন্দে করে। কিন্তু কোন্ বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে মানস ও বৈষয়িক সংগ্রামে সে পর্যদস্ত ও পরাজিত, তা তারা ভাবতে-বুঝতে চায় না। তেমন অবস্থায় একজন সংগ্রামপ্রবণ, আদর্শবাদী মানুষও একান্তভাবে বিষয়ী স্বার্থপর হয়ে উঠে। তখন আল্লাহর দয়া, মনিবের দক্ষিণ্য ও বিবির দিদার ছাড়া কিছুই তার কাম্য থাকে না। তখন আদর্শের রূপায়ণ-ব্ৰতী কোনো বুদ্ধিজীবী একাকী দায়িত্ব পালনে কিংবা কর্তব্য সাধনে ভয় পায়। তার রাত্রি-নিশীথের সংকল্প দিন-দুপুরে আত্মপ্রকাশের সাহস হারায়। তেমন লোক বক্তব্য প্রকাশের জন্যে কেবলি আকুলিবিকুলি করে সহায়-সমর্থনের জন্যে নিজের চারদিকে তাকায়, কাকেও না পেয়ে গুমরে মরে, ব্যথায় জর্জরিত হয়, ক্ষোভের যন্ত্রণায় ছটফট করে,–কিন্তু একা মৃত্যুর কিংবা পীড়ন বরণের ঝুঁকি নিতে জৈব কারণেই অসমর্থ।

শিক্ষিত লোকের সংখ্যাল্পতার জন্যে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট ও তীব্র। কেননা, সেখানে সহানুভূতিশীল পাঠকও কম। এজন্যেই প্রাচ্যদেশে যদিও ধনবৈষম্য তীব্র, জীবিকা অর্জনের সুযোগ সীমিত, পীড়ন ভয়াবহ ও প্রবলের স্বৈরাচার নির্বিঘ্ন, তবু এখানে গণদরদী লেখক স্বল্প, পাঠক নগণ্য, সরকারও অসহিষ্ণু। তাই তারুণ্যের অবসানে অধিকাংশকেই দেখি ব্রতভ্রষ্ট ও খন্ত্রত।

তাছাড়া মধ্যবিত্ত সংজ্ঞাটিও আপেক্ষিক। প্রাচ্যদেশে যারা মধ্যবিত্ত, যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা য়ুরোপের কোনো কোন দেশের নিম্নবিত্তের লোকের চেয়েও তারা হীনাবস্থ। জীবনযাত্রার মান নিম্ন এবং রুচি অবিকশিত বলে এ দেশে যারা প্রাচুর্যের মধ্যে আছে বলে মনে করি, তারাও জীবনের নানা ভোগ্য-সামগ্রী থেকে বঞ্চিত। ফলে তারাও অভাব মুক্ত নয়–তারাও মনে কাঙাল। কাজেই প্রলুব্ধ হওয়া তাদের পক্ষেও সম্ভব ও সহজ। এবং কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাদের নানা প্ররোচনায় ও প্রলোভনে বিভ্রান্ত ও আদর্শচ্যুত করবার প্রয়াসী। সাহিত্য পুরস্কারের শিকার হয়ে প্রাণের কথা বিকৃত করে প্রকাশ করা বা বক্তব্য চেপে যাওয়া গরিব লেখকের পক্ষে সম্ভব। আবার প্রত্যয় দৃঢ়মূল নয়, অথচ বয়োধর্মের বশে ফ্যাশানের আনুগত্যে কেউ কেউ আদর্শবাদের বুলি কপচায়, একটু বয়স হলেই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে–দালালও হয়ে উঠে। যেমন গতশতকে ইয়াংবেঙ্গলদের প্রায় সবাই চল্লিশোত্তর জীবনে নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। এসব নানা কারণে তারুণ্যের অবসানে আদর্শবাদী গণদরদী ন্যায়নিষ্ঠ সগ্রামপ্রবণ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকরা বদলে যায়, ভোল পাল্টায়।

নির্যাতিত মানবতার কথা ছেড়ে দিলেও দুনিয়াব্যাপী গণমানবের দুঃখের অন্ত নেই। যেখানে একনায়কত্ব, সেখানে পেটের ক্ষুধা যদি বা মেটে, মনের কথা প্রকাশের পথ নেই। তাতে মনের ঝাল মিটিয়ে প্রাণের জ্বালা জুড়োবার উপায় খুঁজে পায় না মানুষ। জীবনে সে আর এক যন্ত্রণা। যেখানে ডেমোক্রেসির মার্কা আঁটা সরকার পরমত অসহিষ্ণু সেখানেও সেই জ্বালা। ক্ষোভে-দুঃখে, জ্বালায়-যন্ত্রণায় বাকস্বাধীনতা মানুষের বেদনা উপশমের অন্যতম উপায়। কেননা, মানুষ প্রাণ নিয়ে বাঁচে না, বাঁচে মন নিয়ে। সে মনের উপর পীড়ন একসময় সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। তাই দৈহিক পীড়ন ঘটায় মৃত্যু, আর মানস নির্যাতন দেয় বিকৃতি। তখন গুপ্ত পথে বিষাক্তক্ষতের মতো তা পরিণামে প্রাণঘাতী বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও জিঘাংসা জাগায়। সমাজে-রাষ্ট্রে নেমে আসে বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা ও ব্যভিচার। ক্ষমতাপ্রিয় স্বার্থলোলুপ শাসকের দৌরাত্মও বেড়ে যায়। তখন রাষ্ট্র যেন লুটের মাল, শেষ মুহূর্ত অবধি যা পাওয়া যায় তাই লাভ–এই মনোভাবের বশে শাসক গোষ্ঠীও হয়ে ওঠে বেপরওয়া। ধন-জন সব ছারখার হয়ে যায় রক্তে আর আগুনে।

এসব পরিণাম যে শাসক গোষ্ঠীর অজানা, তা নয়, কিন্তু আপাত সুখের মোহে তাদের শ্রেয়োবোধ হয় অবলুপ্ত। অন্যদিকে সগ্রাম ও জীবনধ্বংসী দুর্ভোগ ছাড়া যে মুক্তি আসতে পারে না, তা যদিও সংগ্রামীদের বোধ বহির্ভূত নয়, কিন্তু যন্ত্রণা-বঞ্চনা সইবার ধৈর্যের অভাবে তারা সংকল্পচ্যুত ও পলাতক।

কাজেই আজকের দুনিয়ায় নিপীড়িত মানুষের জন্যে সংগ্রামের প্রস্তুতি পর্বে চাই বাক স্বাধীনতার আন্দোলন, আর এজন্যে চাই শিক্ষিত বয়স্ক মধ্যবিত্তের সহানুভূতি এবং তরুণ মধ্যবিত্তের সমর্থন, বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্তের সহায়তা এবং লিখিয়েদের উচ্চ ও নির্ভীক কণ্ঠ এবং অবিচলিত কলম। এ ব্যাপারে সমর্থন ও সহযোগিতাই শক্তির উৎস। এককভাবে মানুষ কেবল দুর্বল নয়-ভীরুও। জনবলই বল। আর মনোবলই সামর্থ্য। সঙ্শক্তির মতো শক্তি নেই, যৌথ কর্মে নেই অসাফল্য।

এদেশের প্রাচীন কবির এক আপ্তবাক্য বদংশত মা লিখ–আজ মিথ্যে বলে প্রমাণিত। কেননা সরকারের চোখে বক্তৃতা মারাত্মক, গদ্য লেখা দূষণীয় ও কবিতা নিষ্ফল। তাই দেখছি কবিতায় যে-কিছু বলা যায়, কিন্তু গদ্যে লিখলে হয় আপত্তিকর, আর বক্তৃতায় বললে হয় অপরাধ।

কবিতার আবেদন যদিও গভীর ও স্থায়ী, তবু তা স্বল্পসংখ্যক পাঠকে সীমিত। প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প এবং নাটকের আবেদনও সর্বজনীন নয়। বক্তৃতা গণমুখী,–তাই সরকার বক্তৃতাভীরু। দুনিয়ার প্রায় সব সরকারেরই এক চেহারা এক রূপ। তাই বলে কি কাফেলা স্থির হয়ে থাকবে, চিন্তার স্রোত কি শুকিয়ে যাবে! বাধা প্রবল ও বেপরওয়া হলে কালমাত্রা বেড়ে যায় এবং ক্ষয়-ক্ষতিও বেশি হয় বটে কিন্তু পরিণামে গণসগ্রামে সাফল্য সুনিশ্চিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *