৭
ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হয়েছি। উদ্দেশ্য জনৈক জালাল আহমেদের খোঁজ বের করা। বৃষ্টিতে ভিজে ঠক ঠক করে কাঁপছি। আবহাওয়ার বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। গরমকালের বৃষ্টির পানি এত ঠাণ্ডা হবে না। পানি বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা হতে পারে না। কিন্তু পায়ে যে পানি পড়ছে মনে হচ্ছে তার তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির অনেক নিচে। জালাল আহমেদের মা মারা গেছেন। বাবা একা বেইলি রোডের এক ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকেন। বাড়ির দারোয়ান আমাকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। তার একটাই কথা, কারোর দেখা করার অনুমতি নাই। পুলিশের আইজি আসলেও নাই। মন্ত্রী মিনিস্টার আসলেও নাই। অনেক ঝামেলা করে জালাল সাহেবের বাবার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়া গেল। বৃদ্ধ অত্যন্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। তিনি আমাকে শীতল গলায় বললেন, আমি আপনাকে চিনি না, জানি না। কোনোদিন আপনার সঙ্গে আমার দেখাও হয় নি। আপনাকে আমি আমার ছেলের ছবি কেন দেব? আপনি তো দূরের কথা, আমি তো আমার আত্মীয়স্বজনকেও কোনো ছবি দেব না। আমার ছেলে মারা গেছে, ধরে নেন তার ছবিও মারা গেছে।
আপনার ছেলে মারা গেছে তা তো জানতাম না। কবে মারা গেছে?
কবে মারা গেছে জেনে কী করবেন? মিলাদ পড়াবেন? কুলখানি করবেন? অনেক কথা বলে ফেলেছি, যান বিদায় হোন। ভেজা শরীরে সোফায় বসেছেন। সোফাটা তো নষ্ট করেছেন।
সরি।
এখন সরি বলে কী হবে? ক্ষতি যা করার তো করে ফেলেছেন।
আমি হতাশ হয়ে দেয়ালের দিকে তাকালাম। দেয়ালভর্তি এক যুবকের নানান ভঙ্গিমার সুন্দর সুন্দর ছবি। রাজপুত্রের মতো রূপবান সেই যুবক বসার ঘরের দেয়াল আলো করে রেখেছে। এই যুবক যে জালাল আহমেদ তাতে সন্দেহ নেই। একটি ছবি এত সুন্দর যে সেই ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার করা যায়। যুবক জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর পেছনে নীল সমুদ্র। যুবকের চোখে বিষণ্ণতা। তাঁর হাতে একটা মগ। মনে হচ্ছে সে মগে করে কফি খাচ্ছে।
আমি বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার ছেলের ছবি?
বৃদ্ধ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, আমার ছেলের ছবি না। পাড়ার ছেলের ছবি। পাড়ার ছেলের ছবি দিয়ে আমি দেয়াল ভর্তি করে রেখেছি।
আমি মুগ্ধ কণ্ঠে বললাম, পুরুষমানুষ যে এত রূপবান হতে পারে এই প্রথম দেখলাম। মাইকেল এঞ্জেলোর ডেভিডের চেয়েও আপনার ছেলে সুন্দর।
এই কথাতেই কাজ হল। বৃদ্ধের চোখ থেকে কাঠিন্য মুছে গেল। সেখানে চলে এল এক ধরনের বিষণ্ণতা। বৃদ্ধ বললেন, চা খাবেন?
আমি বললাম, চা না, কফি খেতে ইচ্ছা করছে। জাহাজের ডেকে আপনার ছেলের কফি খাওয়া দেখে আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে। আপনার বাসায় কফির ব্যবস্থা কি আছে?
বৃদ্ধ বললেন, অবশ্যই আছে। আমার ছেলে যে মগে করে কফি খাচ্ছে সেই মগটাও আছে। ঐ মগে করে খেতে চান?
আমি বললাম, এত সৌভাগ্য আমি আশা করছি না। কফি হলেই আমার চলবে।
বৃদ্ধ আমাকে মাথা মোছার টাওয়েল এনে দিলেন। ছেলের কফি মগেই কফি দিলেন। চোখ মুছতে মুছতে ছেলের মৃত্যুর ঘটনা বললেন। নিউইয়র্কের সাবওয়েতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যু।
মৃত্যুর দশ মিনিট আগেও টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। মোবাইলে টেলিফোন করেছে। আমি বাথরুমে ছিলাম। দৌড়ে এসে টেলিফোন ধরেছি। ছেলে বলল, বাবা কেমন আছ?
আমি বললাম, ভালো। তুই কেমন আছিস?
ছেলে বলল, আমি বেশি ভালো না।
আমি বললাম, ভালো না কেন? শরীর খারাপ?
ছেলে বলল, শরীর ঠিকই আছে। মনটা অস্থির। বাংলাদেশে চলে আসতে ইচ্ছা করছে। কতদিন বাংলাদেশের বৃষ্টির শব্দ শুনি না। ব্যাঙের ডাক শুনি না
আমি বললাম, দেশে চলে আয়।
ছেলে বলল, বর্ষা শুরু হোক। তারপর আসব। বাবা রাখি?
এই বলে সে টেলিফোন বন্ধ করল। ও আল্লা, এক মিনিটের মাথায় আবার টেলিফোন। আমি বললাম, বাবা কী?
সে বলল, বাবা খুব অস্থির লাগছে। বুঝতে পারছি না কেন? তুমি আমার জন্য দোয়া করবে।
আমি বললাম, অবশ্যই করব বাবা।
এক্ষুনি দোয়া করতে বস। এক্ষুনি।
আমি বললাম, বাবা, তোর শরীর ঠিক আছে তো?
সে বলল, আমার শরীর খুব ভালো। শুধু মন অস্থির।
ছেলে টেলিফোন রাখামাত্র আমি অজু করে নামাজ পড়তে বসলাম। আমার বাবু যখন মারা যাচ্ছে তখন আমি বাবুর জন্য নামাজ পড়ছি। এটাই আমার একমাত্র সান্ত্বনা।
.
জালাল আহমেদের ছবি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। জাহাজে কফি খাওয়ার ছবিটাই আমাকে দিলেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমার ছেলের এই ছবিটা আপনার পছন্দ হয়েছে, আপনি নিয়ে যান। ফেরত দিতে হবে না। ছবি আপনার কেন দরকার, ছবি দিয়ে কী করবেন, কিছুই জানতে চাচ্ছি না। আজকাল কিছুই জানতে ইচ্ছা করে না। কফি খেতে চাইলে আমার কাছে এসে কফি খেয়ে যাবেন। আমার ছেলের কফি খুব পছন্দ ছিল। মৃত্যুর সময়ও তার হাতে কফির কাপ ছিল।