মিসির আলির চশমা – ২

মিসির আলি কুরিয়ারে একটা দীর্ঘ চিঠি পেয়েছেন। চিঠির প্রেরকের নাম শায়লা রশীদ। পুনশ্চতে লেখা—ড. হারুন রশীদ নামে যে চোখের ডাক্তার আপনার চিকিৎসা করছেন আমি তাঁর স্ত্রী।

দশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি, এক বৈঠকে লেখা এটা বোঝা যাচ্ছে। চিঠি লিখতে লিখতে উঠে গিয়ে আবার লিখতে বসলে শুরুর লেখায় টানা ভাব কমে যায়। লেখার গতি কমে যায় বলেই এটা হয়।

চিঠি না পড়েই মিসির আলি পত্র লেখিকার বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন—

(ক) মহিলা ধৈর্যশীলা। যিনি এক বৈঠকে এত বড় চিঠি লিখবেন, তাঁর ধৈর্য থাকতেই হবে।

(খ) মহিলা শান্ত। তাঁর মধ্যে অস্থিরতা নেই। মানসিক অস্থিরতার ছাপ লেখায় চলে আসে। এই মহিলার হাতের লেখায় অস্থিরতা নেই।

(গ) মহিলা অত্যন্ত গোছানো। কারণ তিনি চিঠি লেখার সময় বাংলা ডিকশনারি পাশে নিয়ে বসেছেন। ভুল বানান ডিকশনারি দেখে শুদ্ধ করেছেন। প্রতিটি ভুল বানান কেটে শুদ্ধ বানান লিখেছেন।

(ঘ) মহিলা বুদ্ধিমতী। কারণ তিনি ব্যবস্থা করেছেন যেন মিসির আলি পুরো চিঠি পড়েন। সম্বোধনেই সেই ব্যবস্থা করা। মহিলা মিসির আলিকে ‘বাবা” সম্বোধন করেছেন। ‘বাবা’ সম্বোধনে লেখা চিঠি অগ্রাহ্য করা কোনো পুরুষের পক্ষেই সম্ভব না। মেয়েদের পক্ষে ‘মা’ সম্বোধনের চিঠি অগ্রাহ্য করা খুবই সম্ভব। তারা নানানভাবে ‘মা’ ডাক শুনে অভ্যস্ত। পুরুষরা ‘বাবা’ শুনে অভ্যস্ত না। কেউ বাবা ডাকলেই সেই ডাক পুরুষদের মাথার ভেতর ঢুকে যায়।

মিসির আলি চিঠি পড়তে শুরু করলেন। তাঁর হাতে একটা লাল কালির বল পয়েন্ট। চিঠির কোনো কোনো জায়গা লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করতে হবে বলে তাঁর ধারণা। এই কাজটা প্রথম পড়াতেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো।

প্রিয় বাবা,

আমার বিনীত সালাম নিন।

মিসির আলি লাল কালি দিয়ে ‘প্রিয় বাবা’ আন্ডারলাইন করলেন।

সম্বোধন পড়ে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। একজন চিরকুমার মানুষের কন্যা থাকার কথা না। কন্যাস্থানীয়া অনেকেই থাকবে, তারা বাবা ডাকবে না। চাচা ডাকবে কিংবা আধুনিক কেতায় আংকেল ডাকবে। আপনাকে আমি কেন বাবা ডাকছি তা অন্য কোনো দিন ব্যাখ্যা করব।

মিসির আলি আবারো লাল কালি দিয়ে দাগ দিলেন। ‘অন্য কোনো দিন ব্যাখ্যা করব’ এই বাক্যের নিচে দাগ পড়ল।

আপনি অনেকের অনেক জটিল সমস্যার সহজ ব্যাখ্যা দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। আমি আপনাকে অতি জটিল একটা সমস্যা দিচ্ছি। সমস্যার ব্যাখ্যা আমি নিজে নিজে বের করেছি। ব্যাখ্যা ঠিক আছে কি না তা শুধু আপনি বলে দেবেন। এই দীর্ঘ চিঠিতে আমি শুধু সমস্যাটি বলব। ব্যাখ্যায় যাব না। আপনি রহস্য সমাধানের পর আমি আমার সমাধান বলব।

আপনার সঙ্গে ‘রহস্য সমাধান’ খেলা আমি খেলতে পারি না। আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন। যাই হোক, এখন সমস্যাটি বলি।

অল্পবয়সে আমার বাবা-মা দু’জনই মারা যান। আমি বড় হই আমার ছোট চাচার আশ্রয়ে। চাচা-চাচি দু’জনই মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-মা নেই, এটা তাঁরা কোনোদিনই বুঝতে দেন নি। ছোট চাচিকে আমি চাচি না ডেকে সব সময়ই মা ডেকেছি। চাচাকে বাবা ডাকতে শুরু করেছিলাম। চাচা ডাকতে দেন নি।

মিসির আলি লাল কলমে পুরো প্যারাটা দাগ দিলেন। তাঁর ভুরু সামান্য কুঞ্চিত হল। মেয়েটি তাঁকে কেন বাবা সম্বোধন করেছে তা মনে হয় পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। সে নিজের বাবাকে বাবা ডাকতে পারে নি। চাচাকে ডাকতে গিয়েছিল, অনুমতি পায় নি। কাউকে বাবা ডাকার তীব্র ইচ্ছা থেকেই কি বাবা সম্বোধন? মেয়েটি কি একজন ফাদার ফিগার খুঁজছে?

আমার চাচা-চাচি অনেক যাচাই-বাছাই করে আদর্শ এক পাত্রের সঙ্গে আমার বিয়ে দিলেন। পাত্র আদর্শ, কারণ তাঁর চেহারা রাজপুত্রের মতো। আফ্রিকান কালো রাজপুত্র না, গ্রিক রাজপুত্র। আর্য সন্তান। আপনি তো আমার স্বামীকে দেখেছেন। বলুন সে রাজপুত্র না? এখন অবিশ্যি চিন্তায় ভাবনায় চোখের নিচে কালি জমেছে। মাথায় টাক পড়েছে। মন্ত্রীপুত্র টেকো হলেও মানিয়ে যায়। টাক মাথার রাজপুত্র মানায় না।

যাই হোক, আমার রাজপুত্র ডাক্তার। পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায়। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। চোখের কর্নিয়া রিপ্লেসমেন্টের একটি বিশেষ অপারেশন তাঁর আবিষ্কার। মেডিকেল জার্নালে Haroon’s cornia grafting হিসেবে এর উল্লেখ আছে।

এই রাজপুত্রের ঢাকা শহরের ওয়ারীতে একটা দোতলা বাড়ি আছে। বাড়ির নাম ‘ছায়াকুটির’। ছায়া আমার শাশুড়ির ডাকনাম আমার শ্বশুর সাহেব স্ত্রীকে যে নামে ডাকতেন বাড়ির কপালেও সেই নাম জুটল। তাঁদের দু’টা গাড়ি আছে। একটা কালো রঙের মরিস মাইনর, একটা লাল রঙের ভক্সওয়াগন।

আমার শ্বশুর সাহেব ব্যাংকার ছিলেন। হাসিখুশি ফুর্তিবাজ মানুষ। বিয়ের পানচিনিতে তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আমাকে পাশে বসিয়ে তিনি বললেন, আমার ছেলে আমাকে ডাকে বাবুই। তাকে শেখানো হয়েছিল ‘বাবাই’ ডাক। সে ডাকা শুরু করল বাবুই। আমি তার কাছে হয়ে গেলাম—’পক্ষী’। তুমিও আমাকে বাবুই ডাকবে। পুত্র এবং পুত্রবধূ দু’জনের কাছেই আমি পক্ষী হিসেবে থাকব। হা হা হা।

আমার শ্বশুর সাহেবকে আমার বাবুই ডাকা হয় নি। আমাদের বিয়ে হল রাত আটটায়। উনি সেই রাতেই এগারটার দিকে মারা গেলেন। বিয়ের আনন্দবাড়ি শোকে ডুবে গেল। আমার শাশুড়ি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি সাক্ষাৎ ডাইনি। আমার কারণেই আমার শ্বশুর মারা গেছেন। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।

বাসররাত নিয়ে কত সুন্দর সুন্দর গল্প শুনেছি। আমাদের বাসর ছিল বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর টাইপ বাসর। যেন আমাদের দু’জনের মাঝখানে কিলবিল করছে ভয়ঙ্কর কাল সাপ।

আমার শাশুড়ি শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কথাবার্তা খুব কম বলতেন। শুধু নিজের ছেলের সঙ্গে গলা নিচু করে নানান কথা বলতেন। তিনি এক অর্থে ভাগ্যবতী ছিলেন। ছেলে পেয়েছেন মাতৃভক্ত। বিদ্যাসাগর মায়ের জন্য সাঁতরে দামোদর নদী পার হয়েছিলেন। আমার শাশুড়ির ছেলে মায়ের জন্য সাঁতারে যমুনা পার হত, যদি সে সাঁতার জানত। হারুন সাঁতার জানে না।

হারুনের মাতৃভক্তির নমুনা না দিলে আপনি বুঝবেন না। আমি নমুনা দিচ্ছি। আমার শাশুড়ি তাঁর শোবার ঘরের দরজা কখনো বন্ধ করতেন না। সারা রাত দরজা খোলা থাকত। কারণ তাঁর ছেলের ভয় পাওয়া রোগ আছে। ভয় পেলে সে যেন যে কোনো সময় মা’র ঘরে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা। এমন অনেকবার হয়েছে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছি, আমার বিছানার পাশে সে নেই। আমি আমার শাশুড়ির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছি, মাতা-পুত্র খাটের উপর বসে গল্প করছে। দু’জনই আনন্দিত। আমি সব সময় চেষ্টা করতাম ওরা যেন আমার উপস্থিতি টের না পায়। কিন্তু প্রতিবারই আমার উপস্থিতি আমার শাশুড়ি টের পেতেন এবং বিরক্ত কিন্তু শান্ত গলায় বলতেন, বৌমা, তুমি শুয়ে পড়, আমি ওকে পাঠাচ্ছি।

আমার এবং হারুনের আলাদা কোনো জীবন ছিল না। মনে করুন রেস্টুরেন্টে খেতে যাব, সেখানেও আমার শাশুড়ি। হারুন মা’কে ছাড়া কোথাও যাবে না। আমার শাশুড়ি আপত্তি করতেন। তিনি বলতেন, তোরা দু’জন খেতে যাচ্ছিস যা। আমি কেন? হারুন রেগে গিয়ে বলত—তোমাকে ছাড়া আমি যদি রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, তা হলে আমার নাম হারুন রশীদ না। আমার নাম কুত্তা রশীদ। এরপর আর কারোই বলার কিছু থাকে না।

তবে একবার শুধু আমরা দু’জন কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি হারুন ড্রাইভ করেছে। আমি বসেছি তাঁর পাশে। কী আনন্দের ভ্রমণ যে সেটা ছিল! থামতে থামতে যাওয়া। পথের পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানে গাড়ি থামিয়ে চা খাওয়া। যাওয়ার পথে এক জায়গায় হাট পড়ল। আমরা গ্রাম্য হাটে ঘুরে বেড়ালাম। কাঁচামরিচ, পটলের দাম করলাম। হারুন বলল, ঐ দেখ গরু-ছাগলের হাট। দরদাম করে একটা ছাগল কিনে ফেলব নাকি? আমি বললাম, কিনবেই যখন ছাগল কেন, এস একটা গরু কিনে ফেলি। গাড়ির ছাদে করে নিয়ে যাই।

আনন্দ করতে করতে আমরা কক্সবাজারে পৌঁছলাম রাত আটটার দিকে। পর্যটনের একটা মোটেল আছে, শৈবাল নাম। সেখানে আমাদের একটা ডিলাক্স রুম বুকিং দেয়া ছিল। শৈবালের লাউঞ্জে এসে আমি হতভম্ব হয়ে দেখি, আমার শাশুড়ি বিশাল এক সুটকেস নিয়ে লাউঞ্জে বসে আছেন। প্রথম ভাবলাম চোখে ভুল দেখছি। আমি হারুনের দিকে তাকালাম। সে আনন্দিত গলায় বলল, শায়লা, মা’কে দেখে তুমি সারপ্রাইজ হয়েছ কি না বল?

আমি শীতল গলায় বললাম, সারপ্রাইজ হয়েছি।

সে বলল, বেশি সারপ্রাইজ না মিডিয়াম সারপ্রাইজ?

আমি বললাম, বেশি সারপ্রাইজ।

হারুন বলল, তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আমি এই কাজ করেছি। মা’কে প্লেনের টিকিট কেটে দিয়ে এসেছিলাম। আমরা রওনা হবার পর মা প্লেনে উঠেছেন। আমাদের আগে পৌঁছেছেন। ভালো করেছি না?

আমি বললাম, ভালো করেছ।

হারুন বলল, আমি সাঁতার জানি না তো। মা পাশে থাকলে ভয় নেই। মা আবার সাঁতারে এক্সপার্ট।

আমি শাশুড়ির কাছে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন।

কক্সবাজার ট্রিপটা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার ধারণা সেখানেই আমি ‘কনসিভ’ করি। এইসব জিনিস মেয়েরা বুঝতে পারে। আমি আমার বাবুর নামও ঠিক করে ফেলি। ছেলে হোক বা মেয়েই হোক, আমার বাবুর নাম হবে সাগর

কক্সবাজার থেকে ফেরার আট মাসের মাথায় সাগরের জন্ম হল। কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে! বড় বড় চোখ। আমি তার চোখের দিকে তাকালেই সাগর দেখতে পাই। বাবুকে যখনই কোলে নিতাম আমার কাছে মনে হত, আমার যা পাওয়ার আমি পেয়ে গেছি। এই পৃথিবীতে আমার আর কিছু চাইবার নেই। এক সেকেন্ডের জন্যও বাবুকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করত না। বাধ্য হয়ে আমি বাবুকে না দেখে থাকতাম, কারণ আমি তখন কেমিস্ট্রির লেকচারারশিপের চাকরি পেয়েছি। সরকারি কলেজের চাকরি। ক্লাস বেশি না, কিন্তু ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনই যেতে হত। প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন খুবই কড়া।

চিল আকাশে ওড়ে, তার দৃষ্টি থাকে স্থলে। আমি কলেজে ছাত্র পড়াই, আমার মন পড়ে থাকে বাবুর কাছে। আমার শাশুড়ি কি ঠিকমতো দেখাশোনা করছেন? কাজের মেয়েটা কি পানি সেদ্ধ করে ফর্মুলা বানাচ্ছে? নাকি ট্যাপের পানি দিয়ে কাজ সারছে? সাগর কি ভেজা কাঁথায় শুয়ে আছে? তার কাঁথা কি সময়মতো বদলানো হচ্ছে? তাকে গোসল দেয়ার সময় কানে পানি ঢোকে নি তো? বিছানার ঠিক মাঝখানে তাকে শোয়ানো হচ্ছে তো? সিলিং ফ্যানের নিচে শোয়ানো হচ্ছে না তো? কত রকম দুর্ঘটনা হয়। দেখা গেল, ফ্যান সিলিং থেকে খুলে নিচে পড়ে গেছে।

একটা শিশুকে একা বড় করা যায় না। সবার সাহায্য লাগে। হারুনের কোনো সাহায্য আমি পেলাম না। সব বাবাই প্রথম সন্তান নিয়ে অনেক আহ্লাদ করে। বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে থাকা, ছবি তোলা…হারুন তার কিছুই করল না। একসময় সে আলাদা বিছানা করে ঘুমুতে শুরু করল। রাতে বাচ্চা জেগে থাকে, কান্নাকাটি করে, তাঁর নাকি ঘুমের সমস্যা হয়।

একদিন অবাক হয়ে দেখি হারুনের গলায় দু’টা তাবিজ। নাটকে গ্রামের চরিত্রে অভিনয় করলে মোটা মোটা রুপার তাবিজ পরে। সেরকম তাবিজ। আমি বললাম, তাবিজ কীসের?

সে জবাব দেয় না। আমতা-আমতা করে। খুব চেপে ধরায় বলল, মা দিয়েছেন। সামনে আমার মহাবিপদ, এই জন্যই তাবিজ। এই তাবিজে বিপদ কাটা যাবে।

আমি বললাম, উনি কী করে বুঝলেন, সামনে তোমার মহাবিপদ?

হারুন বলল, মা স্বপ্নে দেখেছেন। উনি স্বপ্নে যা দেখেন তাই হয়।

স্বপ্নে কী দেখেছেন?

হারুন অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, মা’র স্বপ্ন তোমাকে বলব না।

কেন বলবে না?

মা নিষেধ করেছেন।

আমি অতি দ্রুত দুই-এ দুই-এ চার মেলালাম। আমাকে স্বপ্ন বলতে নিষেধ করা হয়েছে, এর অর্থ একটাই—স্বপ্নে আমার ভূমিকা আছে। খুব সম্ভব হারুনের মহাবিপদের সঙ্গে আমি যুক্ত।

আমি বললাম, তোমার মহাবিপদে কি আমার কোনো ভূমিকা আছে? মহাবিপদটা কি আমি ঘটাচ্ছি?

হারুন মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, হুঁ।

আমি বললাম, তোমাকে আমি খুন করছি এরকম কিছু?

হারুন আবার বলল, হুঁ।

খুনটা করছি কীভাবে? গলা টিপে?

হারুন বলল, ছুরি দিয়ে গলা কেটে।

এই জন্যই কি তুমি আলাদা ঘুমাও?

হুঁ।

তুমি বুদ্ধিমান আধুনিক একজন মানুষ। বিদেশে পড়াশোনা করেছ। স্বপ্নের মতো হাস্যকর জিনিস তুমি বিশ্বাস কর?

না।

তা হলে গলায় তাবিজ ঝুলিয়ে ঘুরছ কেন? তাবিজ খোল।

না।

না কেন?

মা রাগ করবে।

মা-ই কি তোমার সব? আমি কিছু না? তোমার ছেলে কিছু না?

হারুন জবাব দিল না। আমি বললাম, তোমাকে একটা অনুরোধ করব। তোমাকে সেই অনুরোধ রাখতে হবে। বল রাখবে?

হারুন বলল, রাখব।

আমার হাত ধরে বল রাখবে?

হারুন আমার হাত ধরে বলল, সে অনুরোধ রাখবে।

এবং আমার এই অনুরোধের কথা মা’কে জানাতে পারবে না।

জানাব না।

আমার অনুরোধ হচ্ছে, তুমি একটা ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া করবে। সেই ফ্ল্যাটে আমি, তুমি এবং বাবু থাকব। তোমার মা থাকবেন না।

হারুনের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। দিনেদুপুরে ভূত দেখলে মানুষের যে অবস্থা হয় সেই অবস্থা। সে বিড়বিড় করে বলল, এই স্বপ্নটাই মা দেখেছেন।

আমি বললাম, বিড়বিড় করবে না। পরিষ্কার করে বল। এই স্বপ্নটাই মা দেখেছেন মানে কী?

হারুন বলল, মা স্বপ্ন দেখেছেন মা’কে এ বাড়িতে রেখে আমরা তিনজন আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছি। তারপর তুমি আমাকে খুন করেছ। আমি কঠিন গলায় বললাম, তোমার মা স্বপ্নে যাই দেখুন, তুমি আমাকে কথা দিয়েছ আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করবে। তুমি যদি ফ্ল্যাট ভাড়া না নাও তা হলে আমি কিন্তু বাবুকে নিয়ে চাচার বাসায় চলে যাব। বাকি জীবন তুমি আমার বা তোমার ছেলের দেখা পাবে না। I mean it.

হারুন বলল, ফ্ল্যাট ভাড়া করব।

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

হারুন সত্যি সত্যি ফ্ল্যাট ভাড়া করল। তিনতলায় চার কামরার সুন্দর ফ্ল্যাট। দক্ষিণে খোলা। বারান্দা আছে। ফ্ল্যাট দেখে আমি মুগ্ধ। হারুনদের পুরোনো বাড়ির উঁচু সিলিং আমার খুব অপছন্দ ছিল। সেই বাড়ির চারদিকে বড় বড় গাছপালা। গাছের জন্য বাড়িতে আলো ঢুকতে পারত না এমন অবস্থা। ফ্ল্যাটবাড়িটায় অনেক আলো হাওয়া।

এপ্রিল মাস থেকে বাড়ি ভাড়া নেয়া হল। আমরা ঠিক করলাম এপ্রিল মাসের এক তারিখ April fool’s day. সেদিন নতুন ফ্ল্যাটে না গিয়ে দু’ তারিখে উঠব। আমি ভেবেছিলাম আমার শাশুড়ি ব্যাপারটা নিয়ে খুব হইচই করবেন, বেঁকে দাঁড়াবেন। সেরকম কিছুই করলেন না। বরং শান্তগলায় বললেন, ঠিক আছে যাও। সপ্তাহে একদিন বাবুকে এনে আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, অবশ্যই।

শাশুড়ি বললেন, তোমার চাচার বাড়ি থেকে কাউকে স্থায়ীভাবে এনে তোমাদের ফ্ল্যাটে রাখতে পার কি না দেখ। তুমি কলেজে চলে যাবে, কাজের মেয়েদের হাতে এত ছোট বাচ্চা রেখে যাওয়া ঠিক না।

আমি বললাম, সেই ব্যবস্থা করব।

মহা আনন্দে আমি গোছগাছ শুরু করলাম। নতুন সংসার শুরু করতে যাচ্ছি সেই আনন্দেও আমি আত্মহারা। মা’র কঠিন বলয় থেকে হারুনের মুক্তিও অনেক বড় ব্যাপার।

এপ্রিল মাসের দু’তারিখ বাড়ি ছাড়ব, এক তারিখে দুর্ঘটনা ঘটল। আমার বাবু মারা গেল। আমি তখন কলেজে। প্রাকটিক্যাল ক্লাস নিচ্ছি। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে বললেন, শায়লা আপনি এক্ষুনি বাড়ি যান। আপনার বাচ্চা অসুস্থ। আমার গাড়ি আছে, গাড়ি নিয়ে যান।

বাড়িতে পৌঁছে দেখি আমার শাশুড়ি মৃত বাচ্চা কোলে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। তিনি ক্ষীণগলায় বললেন, বৌমা সব শেষ।

আমার বাচ্চাটি কীভাবে মারা গেল, তার কী হয়েছিল, আমি কিছুই জানতে পারি নি। আমার শাশুড়ি আমাকে বলেন নি। যে কাজের মেয়েটি বাচ্চার দেখাশোনা করত তাকেও পাওয়া যায় নি। দুর্ঘটনার দিন কাচের জগ ভাঙার মতো অতি গুরুতর অপরাধে (?) তার চাকরি চলে যায়। আমার শাশুড়ি তাকে বেতন দিয়ে বিদায় করে দেন। বাসায় একজন কেয়ারটেকার থাকত, সবুর মিয়া। সবুর মিঁয়াও ঘটনার সময় বাসায় ছিল না। শাশুড়ি তাকে কী এক কাজে নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়েছিলেন। আমি শাশুড়ির কাছ থেকে ঘটনা জানতে চেয়েছি, তিনি কিছুই বলেন নি। শুধু বলেছেন, আমি কিছু বলব না, তোমরা ফ্ল্যাটবাড়িতে চলে যাও। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না।

আমি বাচ্চাটার সুরতহাল করাতে পারতাম, তার জন্য পুলিশ কেইস করতে হত। সেটা করা সম্ভব ছিল না। আমার নিজের মাথা ও তখন পুরোপুরি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম আমার ছোট্ট বাবু হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে আসছে। তার সব ঠিক আছে—হাসি হাসি মুখ, বড় বড় মায়াভর্তি চোখ; শুধু মুখ দিয়ে টপটপ করে রক্তের ফোঁটা পড়ছে। দীর্ঘদিন গুলশানের এক মনোরোগ ক্লিনিকে আমাকে কাটাতে হয়েছে। সেখানেই আমি একবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইডের চেষ্টা করি।

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। আমার শাশুড়ি মারা গেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু। ডায়রিয়া হয়ে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পরও তিনি আমার স্বামীকে ছাড়েন নি। এখনো হারুনের ঘাড়ে ভর করে আছেন। তিনি হারুনকে কন্ট্রোল করে যাচ্ছেন। হারুন তাঁর জীবিত মায়ের দ্বারা যেভাবে চালিত হত, মৃত মা-ও তাঁকে সেভাবেই চালিত করছে।

আমাদের আর কোনো ছেলেমেয়ে হয় নি। কারণ আমার শাশুড়ি তাঁর অতি আদরের ছেলেকে বলেছেন যেন আমার সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক না হয়।

আমি আপনাকে লেখা আমার এই দীর্ঘ চিঠি এখানে শেষ করছি। আপনাকে ‘বাবা’ সম্বোধন করেছি যেন আপনি চিঠির এক কন্যার প্রতি দয়া করেন এবং চিঠিকন্যার পুত্রের মৃত্যুরহস্য বের করেন। আমার ধারণা এই রহস্য ভেদ হওয়া মাত্র হারুনের মোহমুক্তি ঘটবে। সে তাঁর মৃত মা’কে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলবে। আমি হারুনকে নিয়ে

সত্যিকার সংসার শুরু করতে পারব।

বিনীতা

চিঠিকন্যা শায়লা

পুনশ্চ ১.

বাবা! আপনি আমার এই চিঠির বিষয়টি যদি হারুনের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেন তা হলে খুব খুশি হব। সে এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। চিঠির বিষয় জানলে সে আরো আউলায়ে যাবে। আমি এই অবস্থাটা চাচ্ছি না। সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে আপনি তাঁর চিকিৎসা করুন তাও চাচ্ছি না। তাঁর অসুস্থতা আপনি সারাতে পারবেন না। জগতের কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের এই ক্ষমতা নেই।

পুনশ্চ ২.

দীর্ঘ চিঠিতে অনেক কঠিন কঠিন বিষয় লিখেছি, এখন হালকা কিছু লিখি। একটা ধাঁধা ধরি। দেখি আপনি পারেন কিনা। ধাঁধাটার দু’টা অংশ আছে।

ক) এমন একটি প্রাণী যে বাস করে পানিতে কিন্তু সে স্থলের প্রাণী। স্থলের প্রাণী হয়েও একবারও সে স্থলে যায় না। জীবন পার দেয় পানিতে। প্রাণীটির নাম কী?

খ) এটিও একটি প্রাণী। এই প্রাণীটি জলের প্রাণী। তার জন্ম-মৃত্যু সবই কিন্তু স্থলে। জলজ প্রাণী হয়েও সে একবারও জলের ধারেকাছে যায় না।

বাবা! আপনি কি বিরক্ত হলেন? চিঠির জন্য বিরক্ত না হলেও পুনশ্চতে যে ধাঁধার কথা লিখেছি তার জন্য নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছেন। এই ধাঁধা দু’টির একটা সমস্যা আছে। উত্তর না জানলে কষ্ট হয়। নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। আমি অনেক দিন এই কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *