মিসির আলির চশমা – ১

অদ্ভুত এক যন্ত্র।

যন্ত্রে বাটির মতো জায়গা, বাটিতে থুতনি রেখে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে হয়। যন্ত্রের ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণে তীব্র আলো এসে চোখের ভেতর ঢুকে যায়। তখন বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। মনে হয় কেউ একজন তীক্ষ্ণ এবং লম্বা একটা সুচ চোখের ভেতর দিয়ে মগজে ঢুকানোর চেষ্টা করছে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার কথা। শেষ হচ্ছে না, কারণ ডাক্তার সাহেবের কাছে টেলিফোন এসেছে। তিনি উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছেন। মিসির আলি বুঝতে পারছেন না, তিনি কি বাটি থেকে থুতনি উঠিয়ে নেবেন? নাকি যেভাবে বসে আছেন সেভাবেই বসে থাকবেন? নড়ে গেলে যন্ত্রের রিডিংয়ে গণ্ডগোল হতে পারে। তখন হয়তো আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। হিন্দিতে যাকে বলে ফির পেহলে সে।

মিসির আলি নড়লেন না। ডাক্তার সাহেবের টেলিফোন আলাপ বন্ধ হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ডাক্তার সাহেবের নাম হারুন অর রশীদ। নামের শেষে অনেকগুলো অক্ষর আছে। মনে হয় বিদেশের সব ডিগ্রিই তিনি জোগাড় করে ফেলেছেন।

ডাক্তার সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবার কথা। চুলে পাক ধরে নি, তবে দুই চোখের ভুরুর বেশ কিছু চুল পাকা। চিমটা দিয়ে ভুরুর পাকা চুলগুলো তুলে ফেললে তাঁর বয়স আরো কম লাগত।

ভদ্রলোক বেঁটে। ভারী শরীর। গোলাকার মুখ। চোখের দৃষ্টিতে সারল্য আছে, তবে ভুরু ঝোপের মতো বলে দৃষ্টির সারল্য চোখে পড়ে না। তিনি ঝকঝকে সাদা অ্যাপ্রন পরে আছেন। অ্যাপ্রনটা তাঁকে মানিয়েছে। বেশিরভাগ ডাক্তারের গায়ে অ্যাপ্রন মানায় না।

ডাক্তার হারুন এখন চরম রাগারাগি শুরু করেছেন। তাঁর কথা শোনা যাচ্ছে, ওপাশের কথা শোনা যাচ্ছে না। মিসির আলির ধারণা ওপাশে টেলিফোন ধরেছেন হারুন সাহেবের স্ত্রী। রাগারাগির ধরনটা সেরকম। ডাক্তার সাহেবের গলার স্বর ভারী এবং খসখসে। তাঁর চিৎকার এবং হইচই শুনতে ভালো লাগছে।

ডাক্তার : আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না। এই জিনিসটা আমার পছন্দ না। একেবারেই পছন্দ না।

(ওপাশ থেকে কেউ কিছু বলল।)

ডাক্তার : খবরদার পুরোনো প্রসঙ্গ তুলবে না।

(ওপাশের কথা।)

ডাক্তার : কী! আমাকে বিয়ে করে ভুল করেছ? আরেকবার এই কথাটা বল তো? একবার শুধু বলে দেখ।

মনে হচ্ছে ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী আরেকবার এই কথাটি বললেন।

ডাক্তার : চিৎকার করছি? আমি চিৎকার করছি? আমি এক পেশেন্টের চোখ পরীক্ষা করছি। তুমি খুব ভালো করে জানো পেশেন্টের সামনে আমি চিৎকার চেঁচামেচি করি না। শাট আপ, শাট আপ বললাম। Yes, I say shut up and go to hell.

হারুন মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি এখনো এইভাবে বসে আছেন কী জন্য? আপনার চোখ দেখা তো শেষ।

মিসির আলি বললেন, পরীক্ষা শেষ হয়েছে বুঝতে পারি নি। মাঝখানে আপনার টেলিফোন এল।

আপনার চোখ ঠিক আছে, শুধু প্রেশার হাই। গ্লুকোমা। একটা ড্রাপ দিচ্ছি। ঘুমুবার আগে চোখে এক ফোঁটা করে দেবেন। ভুল করবেন না।

মিসির আলি বললেন, যদি ভুল করি তা হলে কী হবে?

ডাক্তার নির্বিকার গলায় বললেন, অন্ধ হয়ে যাবেন—আর কী।

অন্ধ হয়ে যাব?

হ্যাঁ। পনের দিন পর আবার আসবেন। ভালো কথা, আপনাকে ফি দিতে হবে না।

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললন, কেন?

হারুন বললেন, আপনাকে আমি চিনি। আপনি বিখ্যাত মানুষ। আমি বিখ্যাত মানুষদের কাছ থেকে ফি নেই না। বিখ্যাত মানুষরা দশ জায়গায় আমার কথা বলেন। তাঁদের কথার অনেক গুরুত্ব। এতে পসার দ্রুত বাড়ে।

মিসির আলি বললেন, আপনি মনে হয় ভুল করছেন। আমাকে অন্য কারোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। আমি বিখ্যাত কেউ না। আমি অতি সাধারণ একজন।

হারুন ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনার নাম কী?

মিসির আলি।

হারুন বললেন, তা হলে তো ভুলই করেছি। মেজর মিসটেক। আমি আপনাকে নাটক করে এমন কেউ ভেবেছি। চেহারা খুব পরিচিত লেগেছে। ভালো কথা, আপনি কি অভিনয় করেন? গত সপ্তাহে টিভিতে কী যেন একটা নাটক দেখলাম, আপনি সেখানে ছিলেন?

জি না।

অতি বোগাস এক নাটক। তারপরেও শেষ পর্যন্ত দেখেছি। নাটকের নামটা মনে পড়ছে না। ন দিয়ে নামের শুরু, এইটুকু মনে পড়ছে। আচ্ছা শুনুন, আপনি হাফ ফি দেবেন। আমার চারশ টাকা ফি, আপনি দু’শ দেবেন।

হাফ কেন?

প্রথমবার বাই মিসটেক ফ্রি বলেছিলাম এইজন্য। আপনি আশা করে বসেছিলেন ফ্রি হয়ে গেছে। যখন দেখলেন হয় নি, তখন আশাভঙ্গ হয়েছে। হয়েছে কি না বলুন?

মিসির আলি কী বলবেন ভেবে পেলেন না। বোঝা যাচ্ছে এই ডাক্তার বিচিত্র স্বভাবের। তাঁর সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা ছাড়া কথা বলা ঠিক না। ফি দিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচা যেত। চোখের ড্রপের নামটা এখনো তিনি লিখে দেন নি।

হারুন ভুরু কুঁচকে বললেন, কী হল, জবাব দিচ্ছেন না কেন? আপনার আশাভঙ্গ হয়েছে না? মনটা খারাপ হয়েছে না?

সামান্য হয়েছে।

এই জন্যই ফি হাফ করে দিলাম।

প্রেসক্রিপশনটা লিখে দিলে চলে যেতাম

হারুন কাগজ টেনে নিলেন। কলমদানি থেকে কলম বের করতেই আবার টেলিফোন। মনে হচ্ছে তাঁর স্ত্রী। কারণ ডাক্তার টেলিফোন ধরেই খ্যাকখ্যাক করে উঠলেন।

তোমার প্রবলেমটা কী? রোগী দেখছি, এর মধ্যে একের পর এক টেলিফোন। আমাকে শান্তিমতো কিছু করতে দেবে না?

(ওপাশের কিছু কথা।)

সব সময় টাইম মেনটেন করা যায় না। রোগীর চাপ থাকে। ক্রিটিক্যাল কেইস থাকে। তর্ক করবে না। স্টপ তর্ক। স্টপ। যাও আজ আমি বাসাতেই যাব না। ক্লিনিকে থাকব। সোফায় ঘুমাব। যা ভাবছ তা-না। চেম্বারে কেউ শখ করে থাকে না।

হারুন টেলিফোন নামিয়ে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি বসে আছেন কেন?

প্রেসক্রিপশনটার জন্য অপেক্ষা করছি। আই ড্রপ।

হারুন ড্রয়ার খুলে একটা প্যাকেট মিসির আলির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, মেজাজ খুবই খারাপ। প্রেসক্রিপশন লিখতে পারব না। এটা নিয়ে যান। রাতে ঘুমাবার সময় এক ড্রপ করে দেবেন।

দাম কত?

দাম দিতে হবে না। ওষুধ কোম্পানি থেকে স্যাম্পল হিসেবে পাই। স্যাম্পলের ওষুধ বিক্রি করার অভ্যাস আমার নেই। দরিদ্র রোগীদের ফ্রি দিয়ে দেই।

ধন্যবাদ।

এক মাস পর আবার আসবেন।

আগে বলেছিলেন পনের দিন পর আসতে।

এখন বলছি এক মাস পর।

জি আসব।

মিসির আলি উঠে দাঁড়াতেই ডাক্তার বললেন, একটু বসুন।

মিসির আলি বসে পড়লেন।

আপনি আমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন। এই জন্যই বসতে বলছি। আমার সঙ্গে চা খেয়ে তারপর যাবেন। এবং একটা বিষয় মনে রাখবেন, আমি ডাক্তার যেমন ভালো, মানুষ হিসেবেও ভালো। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া সব জায়গায় হয়। এটা কিছু না। ভালো মানুষরা ঝগড়া করে। মন্দ মানুষের চেয়ে বেশিই করে।

মিসির আলি বললেন, আমি আপনার সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণা নিয়ে যাচ্ছি না। আপনি খুব ভালো ডাক্তার—এটা জেনেই আপনার কাছে এসেছি। আপনি দামি একটা আই ড্রপ বিনা টাকায় আমাকে দিয়েছেন। এটা প্রমাণ করে যে, আপনি মানুষ হিসেবেও ভালো।

দামি আই ড্রপ বুঝলেন কীভাবে?

প্যাকেটের গায়ে লেখা, বার শ টাকা রিটেল প্রাইস।

আরে তাই তো! এত সহজ ব্যাপার মাথায় আসে নি।

মিসির আলি বললেন, এরকম হয়। মাঝে মাঝে পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং লজিক একসঙ্গে কাজ করে না।

হারুন আনন্দিত গলায় বললেন, নামটা মনে পড়েছে—নদীর মোহনা।

মিসির আলি বললেন, নাটকের নামটার কথা বলছেন?

জি। জি। নামকরণটা ভুল হল না? মোহনা তো নদীরই হবে? সমুদ্রের মোহনা হবে না। নাটকের নাম শুধু ‘মোহনা’ রাখলেই হত। তাই না? কিংবা ‘নদী’ নাম হলেও চলত। নায়িকার নাম নদী। লম্বা একটা মেয়ে, তবে তার চোখে মনে হয় সমস্যা আছে। সারাক্ষণ চোখ মিটমিট করছে। আমার কাছে এলে বিনা ভিজিটে চোখ দেখে দিতাম।

দরজা ফাঁক করে কে একজন উঁকি দিচ্ছে। তার চেহারায় ভয়। ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন, কী চাও?

স্যার, বাসায় যাবেন না?

না। তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যাও। সামছুকে বল, দু’কাপ চা দিতে। চিনি আলাদা দিতে বলবে। লিকার যেন ঘন হয়।

সত্যি চলে যাব স্যার?

মিথ্যা চলে যাওয়া বলে কিছু আছে? গাধার মতো কথা। Get Lost : ম্যাডামকে গিয়ে বলবে, স্যার আজ আসবে না।

ভীত মানুষটা সাবধানে দরজা বন্ধ করল। বন্ধ করার আগে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।

হারুন মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, সব গাধা।

মিসির আলি বললেন, আমি কি আপনাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করব? আপনি বাসায় চলে যান। আপনার স্ত্রী একা। উনার নিশ্চয় মনটা খারাপ। আজ আপনাদের একটা বিশেষ দিন। ম্যারেজ ডে।

কে বলেছে আপনাকে?

অনুমান করছি।

হারুন রাগী গলায় বললেন, আমি মিথ্যা পছন্দ করি না। আপনাকে কেউ নিশ্চয় বলেছে। অনুমান বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।

মিসির আলি বললেন, আপনার অফিসে আপনার এবং আপনার স্ত্রীর ছবি আছে। বাচ্চাকাচ্চার ছবি নেই। যিনি অফিসে স্ত্রীর ছবি রাখেন তিনি বাচ্চাকাচ্চার ছবিও অবশ্যই রাখেন। সেই থেকে অনুমান করছি, আপনাদের ছেলেমেয়ে নেই। আপনার স্ত্রী বাসায় একা।

আজ আমাদের ম্যারেজ ডে এটা বুঝলেন কীভাবে?

আজ ছয় তারিখ। দেয়ালে যে ক্যালেন্ডার ঝুলছে সেখানে ছয় তারিখটা লাল কালি দিয়ে গোল করা।

আমার স্ত্রী বা আমার জন্মদিনও তো হতে পারে।

মিসির আলি বললেন, আপনার জন্মদিন হবে না, কারণ নিজের জন্মদিন মনে থাকে। আপনার স্ত্রীর জন্মদিনও হবে না। স্ত্রীরা জন্মদিনে স্বামী দেরি করে বাড়ি ফিরলে তেমন রাগ করে না। ম্যারেজ ডে ভুলে গেলে বা সেই দিনে দেরি করে স্বামী ঘরে ফিরলে রাগ করে। তা ছাড়া গোল চিহ্নের ভেতর লেখা M. এটা ম্যারেজ ডে’র আদ্যক্ষর হওয়ার কথা।

হারুন বললেন, আপনি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক।

মিসির আলি বললেন, খুব বুদ্ধিমান না। তবে কার্যকারণ নিয়ে চিন্তা করতে আমার ভালো লাগে।

আপনি করেন কী?

আমি কিছুই করি না। অবসরে আছি।

আগে কী করতেন?

সাইকোলজি পড়াতাম।

আপনার কি কোনো কার্ড আছে?

জি না।

হারুন বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আমি আপনাকে চিনেছি। আপনাকে নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। আমার স্ত্রী আপনার বিশেষ ভক্ত। M দিয়ে আপনার নাম, মেহের আলি বা এই জাতীয় কিছু। আপনার নামটা কী বলুন তো। আগে একবার বলেছিলেন। ভুলে গেছি। সরি ফর দ্যাট।

আমার নাম মিসির আলি।

আপনার কি টেলিফোন আছে? সেল ফোন একটা আছে।

হারুন আগ্রহ নিয়ে বললেন, নাম্বারটা লিখুন তো। শায়লাকে দিব। সে খুবই খুশি হবে। আচ্ছা আপনি নাকি যে কোনো সমস্যার সমাধান চোখের নিমিষে করে ফেলেন, এটা কি সত্যি?

সত্যি না।

যে কোনো মানুষকে দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব বলে দিতে পারেন, এটা কি সত্যি?

সত্যি না।

শায়লা আপনার বিষয়ে যা জানে সবই তো দেখি ভুল।

মগভর্তি চা চলে এসেছে। আগের লোকই চা এনেছে। ডাক্তার ধমক দিয়ে বললেন, ফজলু, তোমাকে না চলে যেতে বললাম? তুমি ঘুরঘুর করছ কেন? Stupid. যাও সামনে থেকে। গাড়িতে বসে থাক।

স্যার কি বাসায় যাবেন?

যেতে পারি। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি। চা খেয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিব।

এখন Get lost.

ফজলু চলে গেল। মিসির আলি লক্ষ করলেন ফজলুর মুখ থেকে ভয়ের ছাপ কমেছে। তাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে।

হারুন মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, চা ভালো হয়েছে। খান। বিস্কিট আছে। বিস্কিট দেব? ভালো বিস্কিট।

বিস্কিট লাগবে না।

হারুন সামান্য ঝুঁকে এসে খানিকটা গলা নামিয়ে বললেন, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন?

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, না।

হারুন আনন্দিত গলায় বললেন, আমিও না।

মিসির আলি বললেন, ভূতের প্রসঙ্গ এল কেন?

হারুন জবাব দিলেন না। তাঁকে এখন বিব্রত মনে হচ্ছে। মিথ্যা কথা ধরা পড়ে গেলে মানুষ যেমন বিব্রত হয় সেরকম। মিসির আলি বললেন, আপনি কি কখনো ভূত দেখেছেন?

হারুন ক্ষীণস্বরে বললেন, হুঁ।

মিসির আলি বললেন, একটু আগেই বলেছেন, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন না।

হারুন বললেন, ভূত দেখি নি। আত্মা দেখেছি। আত্মা। আমার মায়ের আত্মা। সেটাও তো এক ধরনের ভূত। তাই না?

ও আচ্ছা।

আমার সামনে যখন কোনো বড় বিপদ আসে, তখন আমার মায়ের আত্মা এসে আমাকে সাবধান করে।

তাই নাকি?

জি! আত্মার গায়ে যে গন্ধ থাকে এটা জানেন?

মিসির আলি বললেন, জানি না।

হারুন চাপা গলায় বললেন, গন্ধ থাকে। কেম্ফরের গন্ধ। বেশ কড়া গন্ধ।

সব আত্মার গন্ধই কি কেফরের? নাকি একেক আত্মার গন্ধ একেক রকম?

হারুন বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি তো আত্মা শুঁকে শুঁকে বেড়াই না যে বলব কোন আত্মার গন্ধ কী? আমি শুধু আমার মা’র আত্মাকেই দেখি। তাও সব সময় না। যখন আমি বিপদে পড়ি তখন দেখি। তিনি আমাকে সাবধান করে দেন।

মিসির আলি বললেন, উনি শেষ কবে আপনাকে সাবধান করেছেন?

হারুন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চট কবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে, যাই। বলেই অপেক্ষা করলেন না। অ্যাপ্রন পরা অবস্থাতেই দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন।

মিসির আলির কাপের চা এখনো শেষ হয় নি। চা-টা খেতে অসাধারণ হয়েছে। তাঁর কি উচিত চা শেষ না করেই উঠে যাওয়া? একা একা ডাক্তারের চেম্বারে বসে চুকচুক করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়াও তো অস্বস্তিকর। হঠাৎ করে বাইরে থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলেও তো বিরাট সমস্যা। যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও সম্ভাবনা থেকে যায়। প্রবাবিলিটির একটা বইয়ে পড়েছিলেন যে কোনো মানুষের হঠাৎ করে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

মিসির আলি চা শেষ করলেন। তাড়াহুড়া করলেন না, ধীরেসুস্থেই শেষ করে চেম্বার থেকে বের হলেন। গেটের কাছে ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল। তিনি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। গা থেকে অ্যাপ্রন খুলে ফেলেছেন বলে তাঁকে অন্যরকম লাগছে। ডাক্তারের হাতে সিগারেট। তিনি মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, গাড়িতে উঠুন। আপনাকে পৌঁছে দেই। আপনি থাকেন কোথায়?

মিসির আলি বললেন, আমি ঝিকাতলায় থাকি। আপনাকে পৌঁছাতে হবে না। আমি রিকশা নিয়ে চলে যাব।

আপনাকে গাড়িতে উঠতে বলছি উঠুন। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসবেন।

মিসির আলি উঠলেন। এই মানুষটাকে ‘না’ বলে লাভ হবে না। হারুন সেই শ্রেণীর মানুষ যারা যুক্তি পছন্দ করে না।

হারুন বললেন, ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে কি আপনার অস্বস্তি লাগছে?

না।

অস্বস্তি লাগা তো উচিত। আমি আরাম করে পেছনের সিটে বসব। আর আপনি ড্রাইভারের পাশে হেল্পারের মতো বসবেন, এটা তো এক ধরনের অপমান। আপনি অপমান বোধ করছেন না?

মিসির আলি বললেন, অপমান বোধ করছি না। তা ছাড়া গাড়ি ড্রাইভার চালাবে না, আপনি চালাবেন। এই ক্ষেত্রে আপনার পাশে বসাই শোভন

গাড়ি আমি চালাব আপনি বুঝলেন কীভাবে?

মিসির আলি বললেন, আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যান নি। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কারণ আপনি আমাকে আরো কিছু বলতে চান। সেই ক্ষেত্রে আপনি আমাকে আপনার পাশে বসাবেন এটাই স্বাভাবিক। আমাকে ড্রাইভারের পাশে বসিয়েছেন, সেখান থেকে ধারণা করেছি, গাড়ি আপনি চালাবেন।

হারুন হাই তুলতে তুলতে বললেন, ঠিকই ধরেছেন। আপনার বুদ্ধি ভালো। আমার বুদ্ধি নেই। স্কুলে আমার নাম ছিল হাবা হারুন। হারুন নামে কেউ আমাকে ডাকত না। সবাই ডাকত হাবা হারুন। কলেজে আমার নাম হল ‘হাহা’। হাবা থেকে হা এবং হারুন থেকে হা নিয়ে হাহা।

গাড়ি মিরপুর সড়কে উঠে এসেছে। রাত এগারটার কাছাকাছি। এখনো রাস্তায় ভিড়। গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। প্রায়ই থামতে হচ্ছে।

হারুন বিরক্ত হচ্ছেন না। ক্যাসেটে গান ছেড়ে দিয়েছেন। হিন্দি গান হচ্ছে। বয়স্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ টাইপ মানুষরা সাধারণত গাড়িতে হিন্দি গান শোনেন না। ইনি যে শুধু শুনছেন তা না, যথেষ্ট আনন্দও পাচ্ছেন। গানের সঙ্গে স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে তালও দিচ্ছেন। মিসির আলি বললেন, আপনি আমাকে কিছু বলবেন?

হারুন বললেন, ভেবেছিলাম বলব। এখন ঠিক করেছি বলব না।

মিসির আলি বললেন, তা হলে আমাকে যে কোনো জায়গায় নামিয়ে চলে যান। আপনার দেরি হচ্ছে।

হারুন বললেন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেবার কথা বলে গাড়িতে তুলেছি। এখন পথের মাঝখানে নামিয়ে দেব না।

মিসির আলি বললেন, পথে নামালেই আমার জন্য সুবিধা। কারণ আমি হোটেলে ভাত খেয়ে তারপর বাসায় যাব। বাসায় আমার রান্নার ব্যবস্থা নেই।

আমি আপনাকে বাসায় নামিয়ে দেব। সেখান থেকে আপনি যেখানে ইচ্ছা যাবেন। I keep my words.

মিসির আলি চুপ করে গেলেন। অসময়ে চা খাওয়ার জন্য ক্ষুধা মরে গিয়েছিল। এখন আবার তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। কলিজা ভুনা খেতে ইচ্ছা করছে। ঝাল কলিজা ভুনা, সঙ্গে পেঁয়াজ কাঁচামরিচ।

মিসির আলি সাহেব!

জি।

কোনো গন্ধ কি পাচ্ছেন?

এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ পাচ্ছি।

হারুন গান বন্ধ করে দিয়ে বললেন, এয়ার ফ্রেশনারটার গন্ধ আপনার কাছে কেমন লাগছে?

মোটামুটি লাগছে। এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ আমার কখনোই ভালো লাগে না। হারুন বললেন, আপনি কেম্ফরের গন্ধ পাচ্ছেন। গাড়িতে কোনো এয়ার ফ্রেশনার নেই। আমার মায়ের আত্মা আমাদের সঙ্গে আছে বলেই এই গন্ধ।

ও আচ্ছা।

আপনি খুব হেলাফেলা করে ‘ও আচ্ছা’ বলেছেন। এটা ঠিক করেন নি। আমি সিজিওফ্রেনিক পেশেন্ট না। স্কুলজীবনে আমাকে হাবা হারুন বলা হলেও আমি হাবা না।

আপনার মা কি প্রায়ই আপনার সঙ্গে থাকেন?

যখন কোনো বড় বিপদ আমার সামনে থাকে তখন তিনি আমার সঙ্গে থাকেন।

মিসির আলি বললেন, আপনি কি কোনো বড় বিপদের আশঙ্কা করছেন?

করছি।

জানতে পারি বিপদটা কী?

আমি খুন হয়ে যাব। কেউ একজন আমাকে খুন করবে। কে খুন করবে সেটাও আমি জানি। My mother told me.

মিসির আলি বললেন, তিনি কি সরাসরি আপনার সঙ্গে কথা বলেন? নাকি স্বপ্নে বলেন?

হারুন বললেন, তিনি নানানভাবে আমার সঙ্গে কম্যুনিকেট করেন। মাঝে মাঝে স্বপ্নেও করেন।

আপনার মা কী বলেছেন? কে আপনাকে খুন করবে?

আপনি জেনে কী করবেন?

কৌতূহল থেকে প্রশ্ন করেছি। বলতে না চাইলে বলবেন না।

ডাক্তার গলা নামিয়ে বললেন, আমাকে খুন করবে আমার স্ত্রী। ওর নাম শায়লা।

মিসির আলি বললেন, খুন কবে হবেন সেটা কি আপনার মা আপনাকে বলেছেন?

বলেছেন। তবে খুব নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন নি। জন্ম-মৃত্যুর বিষয় নির্দিষ্ট করে আত্মারা কিছু বলতে পারে না। ওদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। আমার খুন হবার কথা আজ রাতে।

মিসির আলি ধাক্কার মতো খেলেন। একটা মানুষ ভাবছে সে রাতে খুন হবে। তারপরও স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চালাচ্ছে।

নানান কায়দাকানুন করে এই কারণেই বাসায় যাওয়া পেছাচ্ছি। আপনাকে নামিয়ে দিয়ে কোনো একটা হোটেলে চলে যাব।

মিসির আলি কী বলবেন ভেবে পেলেন না। মানুষটা মানসিকভাবে অসুস্থ। এতটা অসুস্থ তা শুরুতে বোঝা যায় নি।

হারুন বললেন, আমাকে কীভাবে মারবে জানতে চান?

কীভাবে?

বিষ খাইয়ে মারবে। বিষের নাম জানতে চান? পটাশিয়াম সায়ানাইড। পটাশিয়াম সায়ানাইডের নাম জানেন তো? KCN.

নাম জানি। আপনার স্ত্রী পটাশিয়াম সায়ানাইড পাবেন কোথায়?

তার কাছে আছে। সে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রির চেয়ারম্যান। সে কী করবে জানেন? কোনো একটা খাবারে এই জিনিস মিশিয়ে দেবে।

আপনি কি আপনার আশঙ্কার কথা আপনার স্ত্রীকে জানিয়েছেন?

জানিয়েছি। তার ধারণা আমার প্যারানয়া হয়েছে। ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে আমার চিকিৎসা করা উচিত। এই কারণেই আপনাকে সে খুঁজছে।

মিসির আলি বললেন, আমাকে এইখানে নামিয়ে দিন। সামনের গলিতেই আমার বাসা।

হারুন বললেন, আপনাকে আপনার বাসার সামনে নামাব। আপনার বাসাটা চিনে আসব। আপনার আপত্তি নেই তো?

কোনো আপত্তি নেই।

আমার মা’কেও আপনার বাসাটা চেনানো দরকার। প্রয়োজনে তিনি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমার মায়ের নাম সালমা রহমান।

মিসির আলির জানতে ইচ্ছা করছে সালমা রহমান কি দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন। হারুনুর রশীদ ডাক্তারের নাম। তাঁর বাবার নাম যদি রশীদ হয় তা হলে সালমা রহমান না হয়ে সালমা রশীদ নাম হবার কথা।

মিসির আলি বললেন, আপনার বাবার নাম জানতে পারি?

কেন?

কৌতূহল।

আমার বাবার নাম আবদার রশীদ।

আপনার বাবা কি জীবিত?

বাবা মারা গেছেন।

আপনার মা কি দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন?

হারুন বিরক্ত গলায় বললেন, ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন না। ব্যক্তিগত প্ৰশ্ন আমি পছন্দ করি না। আমার মাও পছন্দ করেন না। Like mother like son.

মিসির আলি বললেন, আমি আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট, সেই কারণেই ব্যক্তিগত প্ৰশ্ন করছি।

হারুন বললেন, আপনি আমার সাইকিয়াট্রিস্ট না। আপনি আমার একজন রোগী ভদ্রতা করে আমি যাকে বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।

মিসির আলি বললেন, এই সামনে গাড়ি রাখুন। ডানদিকের ফ্ল্যাটবাড়ির একতলায় আমি থাকি। আপনি কি নামবেন?

না।

আপনি বলেছিলেন আপনার মা’কে আমার বাসা চিনিয়ে দেবেন।

হারুন রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে দরজা খুলে নামলেন। তাঁর চোখে ভরসা হারানো মানুষের দৃষ্টি। যে মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না তার কী করা উচিত।

.

মিসির আলির বসার ঘরের বেতের চেয়ারে ডাক্তার হারুন বসে আছেন। তাঁকে অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়বেন। তাঁর মাথা ঝুলে আছে। থুতনি বুকের সঙ্গে প্রায় লাগানো। তাঁর চোখ খোলা, তবে ঘুমন্ত মানুষের নাক দিয়ে যেমন ঘড়ঘড় আওয়াজ হয় সেরকম আওয়াজ হচ্ছে।

হঠাৎ আওয়াজ বন্ধ হল। হারুন মাথা তুলে বললেন, আপনি একা থাকেন?

মিসির আলি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

হারুন বললেন, আপনার বাসায় কি এক্সট্রা বেড আছে?

মিসির আলি বললেন, নেই।

এক্সট্রা বেড থাকলে আপনার এখানেই থেকে যেতাম। হোটেলে যেতাম না। আমার মায়ের আপনার বাসা পছন্দ হয়েছে। তিনি পুরো বাড়ি ঘুরে দেখেছেন।

মিসির আলি বললেন, এখন কি তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন?

হুঁ।

এই মুহূর্তে তিনি কোথায়?

আপনার শোবার ঘরে।

মিসির আলি বললেন, আমার শোবার ঘরের দেয়ালে একটা ঘড়ি আছে। ঘড়িতে ক’টা বাজে তিনি বলতে পারবেন?

হারুন বললেন, আপনি পরীক্ষা করে দেখছেন মায়ের ব্যাপারটা আমার মনের কল্পনা কি না, ঠিক বলেছি?

ঠিক বলেছেন। এই পরীক্ষা আপনার মনের শান্তির জন্যও প্রয়োজন।

হারুন বললেন, আত্মা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। দেহধারী মানুষ এবং আত্মা এক না। আত্মা জাগতিক পৃথিবী ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। জাগতিক পৃথিবী তাদের কাছে অস্পষ্ট। গাঢ় কুয়াশার জগৎ। আত্মা প্রবল আকর্ষণের কারণে তার অতি প্রিয়জনদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগাযোগ করে। কিন্তু জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না।

মিসির আলি বললেন, তার মানে কি এই যে আপনার মা আমার শোবার ঘরের ঘড়িতে কয়টা বাজে বলতে পারবেন না?

বলতে না পারার কথা। তারপরেও তাঁকে জিজ্ঞেস করব।

মিসির আলি বললেন, আপনি কি চা খাবেন? কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দেই?

না, আমি উঠব।

হারুন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, মা আমাকে জানিয়েছেন—আপনার শোবার ঘরের দেয়ালে কোনো দেয়ালঘড়ি নেই।

মিসির আলি ধাক্কার মতো খেলেন। তাঁর শোবার ঘরের দেয়ালে কোনো ঘড়ি নেই। কখনো ছিল না। অনেকদিন থেকেই তিনি ভাবছিলেন একটা দেয়ালঘড়ি কিনবেন। ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই যেন সময় দেখতে পারেন।

মিসির আলি ডাক্তারকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যাচ্ছেন। হারুন সাহেবের একটা বিষয়ে তিনি অবাক হচ্ছেন, এই মানুষটা একবারও জিজ্ঞেস করেন নি- দেয়ালঘড়ি আসলেই কি নেই? খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন। অস্বাভাবিক মানুষ স্বাভাবিক প্রশ্ন করে না।

.

ডাক্তার হারুন বাড়ি পৌঁছলেন রাত একটা দশে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় তিনি গেটের সঙ্গে গাড়ির ধাক্কা লাগালেন। বাম্পারের একটা অংশ ঝুলে পড়ল। গাড়ি গ্যারেজে ঢোকানোর সময়ও গ্যারেজের দরজার সঙ্গে ধাক্কা লাগল। পরপর দু’টি অ্যাকসিডেন্টই হারুন সাহেবের স্ত্রীর চোখের সামনে ঘটল। তিনি বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে ছিলেন। তাঁর চোখে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। বারান্দার বাতি নেভানো। বাইরে থেকে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি আজ সুন্দর করে সেজেছেন। কলাপাতা রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছেন। কপালে টিপ দিয়েছেন। তাঁর নাকের হীরের নাকফুল এই অন্ধকারেও ঝকমক করছে।

হারুন বারান্দায় ঢুকতেই শায়লা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, হ্যালো।

হারুন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, হুঁ।

বলেই তিনি দরজার দিকে এগুলেন। শায়লা বললেন, দুটা মিনিট বারান্দায় বস। ঠাণ্ডা হও, তারপর ঘরে যাবে।

হারুন কথা বাড়ালেন না। স্ত্রীর সামনের চেয়ারে এসে বসলেন। শায়লা বললেন, লাচ্ছি বানিয়ে রেখেছি। লাচ্ছি খাও।

হারুন টেবিলের দিকে তাকালেন। দু’টা গ্লাসে লাচ্ছি। গ্লাস পিরিচ দিয়ে ঢাকা। শায়লা একটা গ্লাস এগিয়ে দিলেন। হারুনের ভ্রূ কুঁচকে গেল। পটাশিয়াম সায়ানাইড নামক ভয়ংকর বিষ কি এই গ্লাসেই মেশানো? তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বারান্দার অল্প আলোয় শায়লার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।

লাচ্ছি খাব না।

শায়লা বললেন, বিয়ের দিন লাচ্ছি খাওয়া আমাদের অনেক দিনের রিচুয়াল। প্লিজ গ্লাসে চুমুক দাও।

হারুনের ঘাড় শক্ত হয়ে গেছে। শিরশির করছে। এত সাধাসাধি করছে কেন? আজই কি তা হলে সেই বিশেষ দিন?

শায়লা বললেন, আজ সারা রাত আমরা ঘুমাব না। গল্প করব। বিয়ের রাতটা যেভাবে গল্প করে কাটিয়েছি। তোমার মনে আছে না?

হুঁ।

রাত তিনটার সময় কে দু’গ্লাস লাচ্ছি নিয়ে দরজা ধাক্কা দিল তোমার মনে আছে?

হুঁ।

হুঁ হুঁ না করে তাঁর নামটা বল। দেখি তোমার স্মৃতিশক্তি কেমন।

তোমার ভাবি লাচ্ছি এনেছিলেন।

গুড। তোমার স্মৃতিশক্তি ভালো। এখন লক্ষ্মীছেলের মতো লাচ্ছিটা খাও। আমি অনেক যত্ন করে বানিয়েছি।

হারুন একবার ভাবলেন হাত বাড়িয়ে বলবেন, তোমার হাতের লাচ্ছিটা আমাকে দাও। আমারটা তুমি খাও। যুক্তি দিয়ে বললে সে সন্দেহ করবে না। বললেই হবে তোমার হাতের গ্লাসটা বেশি পরিষ্কার। ঐ গ্লাসটা দাও।

শায়লা বললেন, কী হল! চুমুক দাও।

হারুন হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। মৃত্যুর সঠিক সময়টা জানা থাকা দরকার। অবিশ্যি জেনেও কোনো লাভ নেই। তিনি কাউকে বলে যেতে পারবেন না, একটা তের মিনিট একুশ সেকেন্ড সময়ে তিনি মারা গেছেন।

ঘড়ির দিকে তাকিয়েই হারুন গ্লাসে চুমুক দিলেন। সেকেন্ডের কাঁটা নড়ছে। একুশ সেকেন্ড থেকে হল তেইশ সেকেন্ড। এখন হল পঁচিশ সেকেন্ড।

কী দেখছ?

কিছু দেখছি না।

লাচ্ছিটা খেতে ভালো হয়েছে না?

হুঁ।

বিয়ের রাতের মতো হয়েছে?

হুঁ।

এই লাচ্ছিটার দৈ ঘরে পাতা।

হুঁ।

তুমি দেখি হুঁ হুঁ করেই যাচ্ছ। ভালো কথা, তুমি চায়ের মতো চুকচুক করে খাচ্ছ কেন? একটানে শেষ কর।

হারুন একটানে গ্লাস শেষ করলেন। ঘড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মৃত্যু হলে এতক্ষণে হয়ে যেত। শায়লা বললেন, আমি বাথটাব পানি দিয়ে ভর্তি করে রেখেছি। তুমি আরাম করে সময় নিয়ে গোসল করবে। তারপর আমরা একসঙ্গে খাব।

আমি খেয়ে এসেছি।

কোথায় খেয়ে এসেছ?

এক পেশেন্টের বাসায় গিয়েছিলাম। পেশেন্ট জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।

মেনু কী ছিল?

কৈ মাছের ঝোল আর আর…

আর কী?

ইলিশ মাছ ভাজা।

আরাম করে খেয়েছ?

হুঁ।

শায়লা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কৈ মাছের কাঁটার জন্য রাতে তুমি কৈ মাছ খাও না। ইলিশ মাছ খাও না গন্ধ লাগে এই কারণে। আজ এই দুই নিষিদ্ধ বস্তুই খেয়ে এসেছ? তাও তোমার এক পেশেন্টের বাড়িতে। যেখানে তুমি জানো আজ আমাদের ম্যারেজ ডে। বাসায় বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জানো না?

জানি।

তুমি কি সত্যি খেয়ে এসেছ?

না।

শায়লা বললেন, মিথ্যা কথাটা কেন বলেছ আমি জানি না। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। কারণ জানতে চাচ্ছি না। আমি আজ কোনো কিছু নিয়ে হইচই করব না। ঝগড়া করব না।

হারুন বললেন, তুমি তো কখনোই হইচই কর না। ঝগড়া কর না।

তা ঠিক। মাঝে মাঝে করতে ইচ্ছা করে। আজ রাতে টেলিফোন করে সিরিয়াস

ঝগড়া করেছি না? এরকম আর হবে না। উঠ তো, গোসল করবে।

হারুন উঠে দাঁড়ালেন। শায়লা বললেন, বল দেখি আজ রান্না কী?

আমার পছন্দের কোনো আইটেম।

হয়েছে। কলিজা ভুনা, খিচুড়ি।

থ্যাংক য়্যু। পেঁয়াজ কুচি করে ভিনেগারে দিও। কলিজা ভুনার সঙ্গে ভিনেগার মেশানো পেঁয়াজ ভালো লাগে।

শায়লা বললেন, দেয়া আছে। তোমার আরেকটা অতিপ্রিয় খাবারও আছে। ঘিয়ে ভাজা শুকনা মরিচ।

থ্যাংক য়্যু এগেইন।

.

বাথটাবের পানিতে গা ডুবিয়ে হারুন শুয়ে আছেন। পানি শীতল। পানির শীতলতা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আরামদায়ক অভিজ্ঞতা। হারুনের হাতে বিয়ারের ক্যান। বিয়ারের ক্যানের উত্তাপ হিমাঙ্কের কাছাকাছি। ঠাণ্ডা বিয়ারে চুমুক দিতে ভালো লাগছে। স্নায়ু ঝিমিয়ে পড়ছে। স্নায়ুকে অলস করে দেয়াটাও আনন্দময় প্রক্রিয়া।

স্নানের সময় বরফশীতল বিয়ারের ক্যানে চুমুক দেয়ার অভ্যাস তিনি বিলেতে আয়ত্ত করেছেন। মাঝে মাঝেই তাঁর মনে হয়, বিদেশে যে অল্পকিছু ভালো অভ্যাস তিনি করেছেন এটা তার একটা।

হারুন!

হারুন চমকে উঠলেন। তাঁর মা’র গলা। এই গলা বিয়ারের ক্যানের মতোই শীতল। এমনভাবে চমকালেন যে বিয়ারের ক্যান তাঁর হাত ফসকে বাথটাবের পানিতে পড়ে গেল। ক্যানটা তিনি অতি দ্রুত তুলে ফেললেন। তার আগেই অনেকখানি পানি ক্যানে ঢুকে গেল।

হারুন।

জি মা।

তুই পীরবংশের ছেলে, এটা জানিস? তোর বাবার দাদা হুজুরে কেবলা ইরফানুদ্দীন কুতুবি কত বড় পীর ছিলেন সেটা জানিস?

কিছু কিছু জানি। তুমি বলেছ।

তুই এত বড় পীরের পুতি! আর তুই কিনা নেংটো হয়ে মদ খাচ্ছিস?

হারুন হাত বাড়িয়ে টাওয়েল নিয়ে কোমরে জড়াতে জড়াতে বললেন, বিয়ার মদ না মা। ইউরোপ আমেরিকায় পানির বদলে এই জিনিস খাওয়া হয়। অ্যালকোহলের পরিমাণ পাঁচ পার্সেন্টেরও নিচে।

চুপ।

হারুন চুপ করে গেলেন। তাঁর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মুখ শুকিয়ে আসছে।

হারুন! বাতি নিভিয়ে দে।

বাতি নেভালে আমার ভয় লাগবে মা

লাগুক ভয়। বাতি নেভা। আলোর মধ্যে থাকতে পারছি না। বিয়ারের ক্যান এখনো হাতে ধরে আছিস কেন? ফেলে দে।

হারুন ক্যান রেখে উঠে দাঁড়ালেন। বাতি নেভালেন। বাথরুম হঠাৎ অন্ধকারে ডুবে গেল। হারুন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, মা ভয় লাগছে।

ভয়ের কী আছে? আমি আছি না!

তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না তো।

আমাকে দেখবি কী করে গাধা? কথা যে শুনতে পাচ্ছিস এই যথেষ্ট।

মা, তুমি তো কথাও ভুলভাল বল।

কখন ভুলভাল কথা বললাম?

তুমি বলেছিলে আজ রাতে বিষ খাওয়াবে। খাওয়ায় নি তো।

রাত কি শেষ হয়েছে?

না।

তুই কত বড় গাধা বুঝতে পারছিস?

ডিনারের সময় বিষ দেবে মা?

তোকে কিছুই বলব না!

মা। মা।

তোর কথা শুনতে পাচ্ছি। মা মা করতে হবে না। কী বলতে চাস বল।

আমার একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে তুমি আসলে আমার মনের কল্পনা।

আমি কল্পনা?

হুঁ। এক ধরনের অসুখ আছে যে অসুখে রোগীর হেলুসিনেশন হয়। সে কথা শুনতে পায়। নানান কিছু দেখে।

তোর ধারণা তোর সেই অসুখ হয়েছে?

হুঁ।

রোগ বাঁধিয়ে ঘরে বসে আছিস কেন? চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।

করব।

আজ যে গাধাটার কাছে গিয়েছিলি সে-ই কি তোর চিকিৎসা করবে?

এখনো ঠিক করি নি।

দেরি করছিস কেন, ঠিক করে ফেল। সেও গাধা তুইও গাধা। গাধার চিকিৎসা তো গাধাই করবে।

আমাকে গাধা বলছ বল। উনাকে কেন গাধা বলছ?

যে বলে যুক্তির বাইরে কিছু নেই তাকে গাধা বলব না তো কী বলব? ছাগল বলব? এটাই ভালো—সে ছাগল তুই গাধা। গাধা শোন, রাতে খেতে গিয়ে দেখবি কলিজা ভুনা দু’টা প্লেটে রাখা। একটা তোর জন্য একটা তার জন্য। তোরটায় বিষ দেয়া। যা বলার আমি বলে দিলাম। এখন বাতি জ্বালা। তোর বউ এক্ষুনি তোকে খেতে ডাকবে। যদি দেখে বাতি নেভানো তা হলে নানান প্রশ্ন করবে।

হারুন বাতি জ্বালালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাথরুমের দরজায় টোকা পড়ল। শায়লা বললেন, এই এতক্ষণ লাগাচ্ছ কেন? টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। সব তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

.

হারুন খেতে বসেই বললেন, কলিজা ভুনা দু’টা বাটিতে কেন?

শায়লা বললেন, তোমারটায় ঝাল দিয়েছি। আমি ঝাল খেতে পারি না বলে আমারটা আলাদা।

ঝাল খাওয়া তো আমিও ছেড়ে দিয়েছি।

কবে ছাড়লে?

হারুন আমতা-আমতা করছেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শায়লা বললেন, তুমি ঝাল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ এই তথ্য জানতাম না। এইমাত্র জানলাম। এখন থেকে সবকিছুই কম ঝালে রান্না হবে। আজ খেয়ে ফেল। প্লিজ।

শায়লা স্বামীর প্লেটে কলিজা ভুনা তুলে দিলেন।

হারুন খাচ্ছেন। খেতে অসাধারণ হয়েছে। ভিনেগার দেয়া পেঁয়াজের কারণে কলিজা ভুনার স্বাদ দশগুণ বেড়ে গেছে। হারুন ঘড়ি দেখলেন। ছয় মিনিট ধরে খাচ্ছেন। পটাশিয়াম সায়ানাইড দেয়া থাকলে অনেক আগেই ‘কর্ম কাবার’ হয়ে যেত। মা আবারো ভুল করলেন।

খাবারে পটাশিয়াম সায়ানাইড দেয়া থাকলে মন্দ হত না। এক ধাক্কায় সব ঝামেলা থেকে মুক্তি। মৃত্যুর পর মায়ের মতো আত্মা হয়ে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়ানো। হারুন ঠিক করলেন আত্মা হতে পারলে তিনি মাঝে মাঝে শায়লাকে ভয় দেখাবেন। ধরা যাক সে ক্লাস নিচ্ছে, সেকেন্ডে ল অব থার্মোডিনামিক্স পড়াচ্ছে। তিনি হঠাৎ ঘাড়ের কাছে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলবেন। কিংবা রাতে শায়লা যখন ঘুমুবে তিনি তার পায়ের বুড়ো আঙুল কামড়ে ধরবেন। আত্মারা কি কামড়াতে পারে? মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।

কী ভাবছ?

কিছু ভাবছি না।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করছ।

হারুন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আত্মা নিয়ে চিন্তা করছি। Soul.

ও আচ্ছা।

আত্মার প্রপার্টি নিয়ে ভাবছি। তবে সমস্যা হচ্ছে আত্মা কোনো বস্তু না, পরা বস্তু। পরা বস্তুর ধর্ম পৃথিবীর বিজ্ঞান ধরতে পারবে না।

শায়লা বললেন, তুমি কি ভালো একজন ডাক্তার দেখাবে? একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।

দেখাব। মিসির আলি সাহেবকে দেখাব। উনার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছে।

সত্যি?

শায়লা, তুমি জানো আমি মিথ্যা কথা বলি না। জানো না?

জানি।

হারুনের খাওয়া শেষ হয়েছে। পানি খাওয়া দরকার। পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েও শেষ পর্যন্ত গুটিয়ে নিলেন। তাঁর মন বলছে পানির গ্লাসেই মেশানো আছে ভয়ঙ্কর KCN. অবশ্যই পানির গ্লাসে মেশানো। পানি হবে বর্ণহীন। এই গ্লাসের পানি নীলচে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *