মিত্তির বাড়ি – ৪

চার

দাবার ছক, এপাশে ঝুঁকে আছে বড়, ওপাশে ঝুঁকে আছে মেজ।

মেজ।। বড়দা, কিছু একটা কেরামতি করেছ মনে হচ্ছে? তোমার এই বোড়েটা তো এখানে ছিল না। এটা কোথা থেকে এল?

বড়।। কোথা থেকে আসবে? ওটা ওখানেই ছিল।

মেজ।। না, না, হতেই পারে না। আমি অনেকক্ষণ ধরে তাক করে আছি। ওই রুট দিয়ে ঢুকে তোমার রানীকে কব্জা করব। এটা তোমার জোচ্চুরি। তুমি কোন ফাঁকে ওটাকে তুলে এনে বসিয়েছ।

বড়।। মিথ্যে কথা বলবি না মেজ। জীবন আর খেলা—দুটোতেই সত্যকে ধরে থাকবি।

মেজ।। শোন বড়দা, এই দাবার ব্যাপারে তোমার একটা ব্যাড রেপুটেশন আছে। তোমার সঙ্গে যে খেলতে বসে সেই হারে। তুমি যদি দাবায় এতবড় চ্যাম্পিয়ান হবে তাহলে কারপভকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছ না কেন? তোমার যত কেরামতি বাড়িতে। আর সে কেরামতিটা হল জোচ্চুরি। কুসি আমায় আগেই সাবধান করেছিল—’মেজদা চোখ বুজিয়ে থেকো না, চোখ খোলা রেখো।’ আমি ওই উপদেশটাকেই একটু অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছিলাম। চোখ বুজিয়ে মিট মিট করে দেখছিলাম তুমি কী করো। তুমি এদিক—ওদিক তাকিয়ে টুক করে ওটা ঠেলে দিলে।

বড়।। তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে মানিক। ওই ঘুঁটিটা প্রথম থেকেই ওখানে আছে।

মেজ।। না, ওটা ছিল না।

বড়।। দাদাকে জোচ্চোর বলতে লজ্জা করছে না? তোর অন্তরে লাগছে না?

মেজ।। জোচ্চোরকে, জোচ্চোর বলব, অন্তরে লাগবে কেন?

বড়।। তার মানে আমি একটা চিট!

মেজ।। আমি ইংরেজি বলিনি জোচ্চোর আর চিট আলাদা ব্যাপার। আকাশ—পাতাল তফাত। চিট অনেক বড়ো ব্যাপার। সে তোমার দ্বারা হওয়া সম্ভব হবে না। তুমি ছিঁচকে চোর হতে পারবে, ডাকাত কোনোদিনই নয়।

বড়।। ছিঁচকে চোর কথাটা ভালো হল? ছিঁচকে চোর, সিঁধেল চোর, ঘৃণ্য জীব। বরং ডাকাত অনেক রেসপেকটেবল।

মেজ।। ঘুঁটিটা ওখান থেকে সরাও।

বড়।। কেন সরাব?

মেজ।। ওটা ওখানে ছিল না।

বড়।। ওটা ওখানেই ছিল।

মেজ।। না ছিল না।

বড়।। হ্যাঁ ছিল।

মেজ।। না, ছিল না।

বড়।। কুসি, কুসি,

[খুন্তি হাতে কুসির প্রবেশ]

কুসি।। তোমাদের জ্বালায় বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। তোমরা বিয়ে করো বাপু, বেঁচে যাই।

বড়।। সে পরে দেখা যাবে। আগে তুই বল আমাকে তুই চোর বলেছিস। ছিঁচকে চোর। আমি নাকি ফ্রিজ খুলে চুরি করে মিষ্টি খাই। ছেলেবেলায় আমার জন্য মা আচারের বয়াম সিন্দুকে চাবি দিয়ে রাখত? শেষ জীবনে আমি ডাকাতি করব? আমি ব্যাগ দেখলেই খুলে টাকা সরাই, সেজবউয়ের কানের দুল বিক্রি করে আমি বাদাম ভাজা খেয়েছি।

মেজ।। দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি এসব কী বলছ?

বড়।। আরে দাঁড়া, দাঁড়া। কুসির নাম করে তুই যা বলেছিস, তারপর এইগুলোই আসে। একটা রোগের পিছনে পিছনে দশটা রোগ জোটে।

কুসি।। কী হয়েছে বলবে তো?

মেজ।। আরে সেই ওল্ড কেস। খেলতে খেলতে অন্যমনস্ক হয়েছি অমনি ঘুঁটি সরিয়েছে।

কুসি।। বড়দা, এই রোগটা তোমার আছে। তুমি যখনই আমার সঙ্গে লুডো খেলতে বসেছ তখনই আমি গোহারান হেরেছি। তুমি পাঁচ ফেলে ছয়ের চাল দাও। আঙুলের কায়দায় ছক্কা ফেলো। এ তোমার অনেক দিনের ব্যামো। তোমার ভেতর স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নেই। তুমি হারতে ভয় পাও, খালি হারাতে চাও।

বড়।। তার মানে আমি ক্যারেকটারলেস। আমি একটা বদ লোক। তাহলে কাল থেকে তোরা আমাকে দাদা বলিস না।

মেজ।। তুমি আচ্ছা ক্রুকেড লোক তো!

বড়।। ক্রুকেড মানে?

মেজ।। বাঁকা লোক।

বড়।। আর তুমি ভারি সোজা লোক।

[কুসি খেপে গিয়ে দাবার ছকটক সব উলটে দিল]

কুসি।। তোমরা যদি আর কোনোদিন দাবা খেলতে বসেছ তাহলে এই খুন্তি গরম করে ছ্যাঁকা দেব।

বড়।। তা তুমি দিতে পারো। বড়ভাইকে যখন চোর বলতে পারো, তখন ছ্যাঁকাও দিতে পারো।

কুসি।। তোমার এখন এক কাপ চা খাওয়া দরকার।

বড়।। থাক, থাক, অত খাতিরে প্রয়োজন নেই। পয়সা ফেলব, মোড়ের দোকান থেকে খাব।

কুসি।। তোমার অনেক পয়সা আছে। সে আমরা জানি। তবে আমার হাতের চায়ের মতো চা কোথাও পাবে না।

বড়।। কোন হাত? যে হাত খুন্তি ছ্যাঁকা দেয়। আমি জানি যেদিন আমার মা মারা গেছেন সেদিন থেকে আমার আদরও চলে গেছে। আর এই মেজ জ্ঞানের অহংকারে একবারে ফেটে পড়ছে। অধ্যাপক, অধ্যাপক।

মেজ।। বড়দা, তুমি তিলকে তাল করছ।

বড়।। আজ্ঞে না। আমি তালকে তিল করছি। তোমরা যা বলেছ, অন্য কেউ হলে গৃহত্যাগ করত।

মেজ।। শোনো বড়দা, এই গৃহত্যাগের কথা যখন বললে তখন আমার স্ট্যাটিসটিক্সের কথা শোনো। আমি জনে জনে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি গৃহত্যাগ করে কে কতদূর যেতে পেরেছে। ওই গেট পর্যন্ত, কিংবা গেটের বাইরে রাস্তা পর্যন্ত। একজনই একটু বেশিদূর পর্যন্ত গিয়েছিল, ওই মোড়ের মাথার ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত। রাত এগারোটার সময় পান—বিড়ির দোকান বন্ধ করতে করতে দোকানদার বলল, আমি তো চললাম, আপনি কী করবেন? সে তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, ভাই বাড়িতে একটু বলে পাঠাও না আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, একবার ডাকলেই যেতে পারি। অতএব গৃহত্যাগ করার আগে ভেবে নাও কোথায় যাবে, কার কাছে।

বড়।। আমার যাবার অনেক জায়গা আছে।

কুসি।। ঠিক আছে জায়গাগুলো বলো।

বড়।। যেমন ধর, যেমন ধর, যেমন ধর, [হতাশ হয়ে] যাবার কোথাও জায়গা নেই রে। এক কাপ চা—ই খাওয়া।

মেজ।। পথে এসো। শোনো বড়দা, আমরা যে গোয়ালে আছি সেই গোয়ালেই মিলেমিশে থাকতে হবে। তুমি হলে বড়ো ষাঁড়, আমি হলুম মেজ ষাঁড়, ভাইগুলো সব ষণ্ড, আর…

কুসি।। আর এগিয়ো না মেজদা।

[দরজার কাছে গলা] আসতে পারি?

কুসি।। আরে প্রমোদ জ্যাঠা!

প্রমোদবাবু।। [ঢুকতে ঢুকতে] অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি তোমাদের কাছে এলাম। দ্যাখো এ পাড়ায় আমার নাম মি. অ্যাংজাইটি। কিন্তু তোমরাই বলো, দুশ্চিন্তা না করে থাকা যায়? এটা কী একটা দিনকাল! কোনো ভদ্রলোক এভাবে বাঁচতে পারে! [সুর করে] বসতে পারি?

বড়।। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসুন, বসুন। আপনার জন্ডিস হয়েছিল, কেমন আছেন?

প্রমোদ।। অ্যাই, ভালো কথা জিজ্ঞাসা করেছ। জন্ডিসে কী হয় তুমি জানো?

কুসি।। আপনি চা খাবেন?

প্রমোদ।। অবশ্যই।

বড়।। তার মানে লিভার ভালো যাচ্ছে।

প্রমোদ।। ডাক্তার হয়ে এ কথাটা কী করে বললে? চায়ের সঙ্গে লিভারের কী সম্পর্ক? [কুসি এই ফাঁকে বেরিয়ে গেছে] চায়ের সঙ্গে লিভারের কী সম্পর্ক? গলায় চা ঢালবে সড়াক করে স্টমাকে পৌঁছে যাবে? সেখান থেকে জলীয় পদার্থ তার পথ বেয়ে বেরিয়ে যাবে। আর চায়ের কষটা লেগে যাবে পাকস্থলীর ভিতরের দেওয়ালে। তাহলে কী হল? চায়ের সঙ্গে আলসারের সম্পর্ক। লিভারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ, জন্ডিসের সঙ্গে লিভারের সম্পর্ক আছে।

বড়।। জল ফুটিয়ে খাচ্ছেন?

প্রমোদ।। জল ফুটিয়ে! আমার জন্য এত তদারকি কে করবে? তোমাদের জীবনের দাম আছে। আমার জীবনের কী দাম?

মেজ।। আপনি একসময় কত ভালো বেহালা বাজাতেন?

প্রমোদ।। একালে বেহালা বাজালে লোকে মারতে আসবে। বেহালা নাকি শুধু কাঁদতে জানে। কথাটা খুব মিথ্যে নয়। যাত্রা, থিয়েটার, সিনেমায় কান্নার সিন হলেই বেহালা বেজে ওঠে।

মেজ।। বেহালায় আপনি ক্লাসিক্যাল সুর—টুর বাজাতে পারেন। সময়টা ভালো কাটবে। বিদেশি কনসার্টে একসঙ্গে পঞ্চাশটা বেহালা বাজে।

প্রমোদ।। বিদেশের সঙ্গে কেন তুলনা করছ? তোমরা শুনেছ?

বড়।। কী হল আবার?

প্রমোদ।। কিডন্যাপিং। এপাড়ায় ঢুকে পড়েছে। সকাল থেকে সুজনের মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বউমাদের ডাকো।

[ডাকাডাকি। পরমা ও রেখা দুজনেই ঘরে ঢুকল]

দুজনে একসঙ্গে।। জ্যাঠামশাই!

প্রমোদ।। তোমাদের সাবধান করতে এলুম। বাচ্চা দুটোকে সাবধানে রেখো, চোখে চোখে। সুজনের বাচ্চা মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। এইবার চিঠি আসবে দশ লাখ টাকা ছাড়ো।

রেখা।। থানায় ডায়েরি করেছে?

প্রমোদ।। আর ডায়েরি। পুলিশ কী করবে? সে কি আর এদেশে আছে?

পরমা।। কত পুলিশ, এক একটা থানায় গিজগিজ করছে পুলিশ, পুলিশ নেই?

প্রমোদ।। আমি পুলিশের কথা বলিনি। আমি মেয়েটার কথা বলছি। সে এতক্ষণে পাঞ্জাব কী হরিয়ানায় পাচার হয়ে গেছে। দুবাইতেও চলে যেতে পারে।

রেখা।। এইটুকু সময়ের মধ্যে দুবাই চলে যাবে?

প্রমোদ।। মডার্ন টেকনোলজির যুগে মানুষের স্পিড কী বেড়েছে। হু হু শব্দে সব ছুটছে। ও হ্যাঁ, স্পিডের কথায় মনে পড়ল। ডাক্তার, তুমি কি রোজ ওই স্পিডে গাড়ি চালাও?

বড়।। কোন স্পিডে?

প্রমোদ।। ওই যে আজ হুস করে চলে গেলে আমার পাশ দিয়ে। তুমি জানো কীরকম দুর্ঘটনা হচ্ছে। কালকে আমার চোখের সামনে একটা গাড়ি একটা অটোকে মারল। অটোটা ছিটকে রাস্তার ধারে গিয়ে পড়ল চায়ের দোকানে বসে তিনজন খবরের কাগজ পড়ছিল তাদের ঘাড়ে। ব্যস ছ’টা খতম।

বড়।। ছজন কোথা থেকে এল?

প্রমোদ।। আরে তিনজন তো অটোয় ছিল।

মেজ।। ছজনেই মারা গেল?

প্রমোদ।। সঙ্গে সঙ্গে কী গেল। যখন মেরেছে তখন ছটাই যাবে। জীবনের কোনো দাম নেই, কোনো দাম নেই। চারপাশে ফুটকড়াই—এর মতো লোক। পিলপিল করছে গাড়ি। যাবে কোথায়? এইভাবেই পপুলেশন কন্ট্রোল হচ্ছে।

[গান্ধারী চা নিয়ে ঢুকল]

গান্ধারী।। এই নিন, গরম গরম দার্জিলিং চা।

প্রমোদ।। এই শোনো, তুমি আজ সেফটিপিন দিয়ে দাঁত খুঁটছিলে?

গান্ধারী।। কখন?

প্রমোদ।। যদি না খুঁটে থাকো ভালো। আর যদি ওই অভ্যাস থাকে তাহলে ছাড়ো। আজ আমাদের পাশের বাড়ির কার্তিকের মা হাসপাতালে গেল। দাঁতের গোড়ায় সেফটিপিন দিয়ে খোঁচা মেরেছিল। সেপটিক।

গান্ধারী।। তাই বলুন, আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।

প্রমোদ।। [মেজকে] শোনো শোনো, চা সবসময় ঠান্ডা করে খাবে। অত গরম চা খেলে পেটের লাইনিং নষ্ট হয়ে যায়।

বড়।। তা আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

প্রমোদ।। আর শরীর! ক্যানসার কেমন হচ্ছে দেখেছ ডাক্তার। ঘরে ঘরে ক্যানসার। জানো, আমার খুব অম্বল হয়। আজকাল শুনছি ডাক্তাররা অম্বলের কারণ খুঁজে পায় না। খালি অ্যান্টাসিড খাওয়ায়। একবারও ভাবে না ওটা ক্যানসার হতে পারে। এই যে আমার থেকে থেকে কাশি হয়, এই কাশিটা কি সেই কাশি?

মেজ।। কোন কাশি? বারাণসী?

প্রমোদ।। খুব অফেনডেড হলুম। আমি একজন বয়স্ক লোক। তোমাদের কাছে আসি পাঁচটা কথা বলতে। তুমি ঠাট্টা করছ?

বড়।। না, না, আমিও তো বুঝতে পারলাম না, কাশি তো কাশিই হবে।

প্রমোদ।। শোনো, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সব কাশি কাশি নয়। কিছু কাশি হল লাঙ ক্যানসার। তোমরা কী বলতে পারো তোমাদের কারুর ক্যানসার হয়নি বা হবে না?

বড়।। তা কী করে বলব? হতেই পারে।

প্রমোদ।। তাহলে ক্যানসার নিয়ে ঠাট্টা করছ কেন?

বড়।। কই ঠাট্টা করিনি তো।

প্রমোদ।। ঠাট্টা না করলেই ভালো, ও হ্যাঁ, ভুলে যাবার আগে জিজ্ঞাসা করেইনি, আমার চোখের দৃষ্টি ক্রমশই কমছে। একটা ব্রেন স্ক্যান করানো দরকার।

বড়।। স্ক্যান, স্ক্যান করতে যাবেন কেন?

প্রমোদ।। আরে শোন, আমার জ্যাঠতুতো ভাইয়ের বউয়ের এইরকম পাওয়ার ঘন ঘন চেঞ্জ হচ্ছে। শেষে ধরা পড়ল ব্রেন টিউমার। টিউমারটি তখন বিশাল হয়ে গেছে। এখন ডাক্তাররা বলছেন কিস্যু করার নেই।

বড়।। আপনার দৃষ্টিশক্তি কমছে বয়সের জন্য। একে বলে চালসে।

প্রমোদ।। কী কথাই বললে, আমাদের ফ্যামিলিতে কারুর কখনোই চালসে হয়নি। আমার বাবা আশি বছর বয়সে খালি চোখে পাখি ছুঁচে সুতো পরাতেন।

বড়।। তাহলে স্ক্যান করান। খরচটা কত জানেন তো?

প্রমোদ।। সে করাতেই হবে। আমার বাবা একটা কথা বলতেন, এ স্টিচ ইন টাইম সেভস নাইন। বাঃ চা—টা বেশ ভালো হয়েছে তো। কত টাকার।

বড়।। কে জানে, কুসি আনায়।

প্রমোদ।। [একটু বাঁকা হেসে] তোমরা সংসারের কিছু দ্যাখো না, ওই মেয়েটার ঘাড়ে ফেলে রেখেছ। আছে অনেক তাই বুঝতে পারছ না। যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি। পরের লাইন?

মেজ।। ও কুসি জানে।

প্রমোদ।। সবই তোমাদের কুসি। মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছ না কেন?

মেজ।। ও বিয়ে করবে না।

প্রমোদ।। আমার মাসিমাও বিয়ে করেননি। শেষকালটায় মাথার গোলমাল হয়ে গেল। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলেই সপাটে ঝাপটা মারবে। মারবেই মারবে। [সুর করে]  এই যে এত ইউটেরাসে ক্যানসার হচ্ছে, কেন হচ্ছে? একটা রিপোর্টে পড়েছিলুম…

বড়।। অসুখের কথা থাক না জ্যাঠামশাই। ওতে মন দুর্বল হয়ে যায়।

প্রমোদ।। বাজে কথা, পুরানো কথা, জেনে রাখো প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিয়োর। আচ্ছা, তোমরা কী জুতো পর?

বড়।। জুতোয় চলে গেলেন?

প্রমোদ।। কেন গেলুম জানো। মুখ খোলা জুতো হলে ভয় নেই। শু হলেই বিপদ।

মেজ।। বিপদ কেন? কড়া পড়বে পায়ে?

প্রমোদ।। কড়াতে মানুষ মরে না। কাঁকড়াবিছের কামড়ে মানুষ মরে যেতেও পারে।

বড়।। জুতোর সঙ্গে কাঁকড়াবিছের কী সম্পর্ক?

প্রমোদ।। আছে, আছে। কিছুই জানো না, জন্মে বসে আছ। ওই মুখবন্ধ জুতোর মধ্যে কাঁকড়াবিছে ঘাপটি মেরে থাকে। সেদিন সন্তোষকে অ্যায়সা মেরেছে। তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি। বাচ্চাদের কেডস, তোমাদের শু সবসময় ঠুকে পরবে।

মেজ।। কাঁকড়াবিছে কোথা থেকে আসবে?

প্রমোদ।। যখন আসবে তখন বুঝবে কোথা থেকে আসে।

বড়।। কিছু আশার কথা বলুন না।

প্রমোদ।। আশার কথা থাকলে কী বলতাম না। এটা হচ্ছে নিরাশার যুগ। এই যে তোমাদের বাড়ির ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং কত বছর আগে চেক করিয়েছ?

বড়।। তা পাঁচ বছর হবে।

প্রমোদ।। অদ্ভুত। তোমরা এক একটি ভূত। নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছ। প্রত্যেক ছয় মাস অন্তর চেক করানো উচিত। আমাদের ওয়েদার তো ভালো নয়। ধরো তোমরা সবাই ঘুমোচ্ছ, মাঝরাতে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে গেল। ভোরবেলা সব ছাই।

মেজ।। তা কেন হবে?

প্রমোদ।। শিক্ষিত লোকের মুখে কী অশিক্ষিত কথা। সামান্য শর্ট সার্কিটে কতবড়ো থিয়েটারটা পুড়ে গেল। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

বড়।। কোন থিয়েটার?

প্রমোদ।। আরে স্টার। স্টার—এর কথা বলছি।

বড়।। জ্যাঠামশাই, রাত হল দিনকাল ভালো নয়, এইবার আপনি বাড়ি যান।

প্রমোদ।। বাড়ি! এত তাড়াতাড়ি আমি বাড়ি ফিরি না। যাক, তোমাদের এখানে এককাপ চা খেলুম। এইবার একবার পঞ্চাননের কাছে যাই। খবর পেলুম ওদের বাড়িতে আজ মালপো হয়েছে।

মেজ।। আপনি এখানে খেয়ে যান না।

প্রমোদ।। পাগল হয়েছ? আমি কী ভিখিরি যে চেয়ে চেয়ে খাব! তোমরা যদি আগে বলতে, তাহলে ভেবে দেখা যেত। আচ্ছা আসি বাবা। তোমরা ভালো থেকো, সাবধানে থেকো, আর ছোটোদের নাগালের মধ্যে দেশলাই রেখো না। ও যে কী মারাত্মক জিনিস! বাথরুমে গিজার আছে নাকি?

বড়।। [অপরাধীর গলায়] আজ্ঞে আছে।

প্রমোদ।। হয়ে গেল। ও একদিন মারবেই। একমাত্র উপায় বাথরুমে একটা কাঠের পিঁড়ি রেখো। ওই কাঠের পিঁড়ের ওপর দাঁড়িয়ে যা করার কোরো।

[প্রমোদবাবু বেরিয়ে গেলেন। বড় মেজকে জিজ্ঞাসা করলেন ]

বড়।। কী বুঝলি?

মেজ।। সব কথাই শোনার মতো। মানুষকে মারার মেশিন ফিট হয়েই আছে। বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের।

[গান্ধারী ঝাঁ ঝাঁ করে ঢুকল।]

গান্ধারী।। তোমার মুজাহিদ, আদরের মুজাহিদ।

বড়।। কী করেছে?

গান্ধারী।। তোমার পাখির খাঁচার মাথার ওপর উঠে বসে আছে।

বড়।। সেকী রে। নামা নামা।

গান্ধারী।। সে আমি নামিয়ে দিয়েছি। এই নিয়ে তিনবার হল। পাখিগুলো ভয়ে চিৎকার করছে। একই বাড়িতে বেড়াল, কুকুর, পাখি, খরগোশ এমন দেখিনি বাপু। প্রত্যেকটাই প্রত্যেকের শত্রু।

বড়।। কেন জঙ্গলে? একই জঙ্গলে বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, হরিণ থাকে না?

গান্ধারী।। মরেও তেমনি।

বড়।। তা মরুক।

গান্ধারী।। বেশ তাহলে মরুক। কিন্তু মরার পর মেজাজ খারাপ কোরো না। সেদিন একটা পাখি মরেছিল, আমরাও মরতে বাকি ছিলাম।

বড়।। সব ব্যাপারটাই নির্ভর করে ট্রেনিং—এর ওপর। তোর বড়ো মুখ হয়েছে গান্ধারী।

গান্ধারী।। সত্যি কথা বললেই মুখ হয়ে গেল!

[গান্ধারী বেরিয়ে গেল]

মেজ।। আর একদান বসবে নাকি?

বড়।। জোচ্চোর বলবি না?

মেজ।। জোচ্চুরি না করলে, বলব না।

বড়।। তাহলে লাগা।

[দাবার ছক পড়ল এমন সময় টেলিফোন। বড় উঠে গিয়ে ফোনে]

বড়।। হ্যালো।

বড়।। ড. মিত্র বলছি।

বড়।। হ্যাঁ, কী হয়েছে?

বড়।। কে?

বড়।। আপনার স্ত্রী?

বড়।। ভেরি স্যাড।

বড়।। এ তো ভাই আমি কিছু করতে পারব না। সোজা হাসপাতালে নিয়ে যান। এ তো পুলিশ কেস হবে।

বড়।। মানবিকতা।

বড়।। না মশাই, ও কথায় আর ভুলছি না। এখন দিনকাল বড়ো খারাপ, সোজা হাসপাতালে কিংবা নার্সিংহোমে নিয়ে যান।

[বড় ফোন নামালেন]

মেজ।। কী হল?

বড়।। আগুন।

মেজ।। কোথায়?

বড়।। ওই যে প্রোমোটার হয়েছে। বিষ্ণুবাবু। ওর বউ। বলছে রান্না করতে গিয়ে… কেউ কি তা বিশ্বাস করবে? একালে মেয়েদের কিছু হলে রক্ষে নেই। হাজতবাস। তার আগে গণধোলাই, বাড়ি ভাঙচুর। আমরা বিয়ে না করে বেশ আছি বল। শুধু তোর সঙ্গে আমার যদি একটু মনের মিল হত?

মেজ।। এটা সিরিয়াসলি বললে?

বড়।। ধ্যুর। আমাদের ভালোবাসা, অবিচ্ছিন্ন বন্ধন। একটা কথা তোকে বলি, তখন আমি ঘুঁটিটা সরিয়েছিলুম রে।

মেজ।। এই স্বীকারোক্তিতে তোমার পাপ কেটে গেল। না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণকে বলে চুরি। বলিয়া গ্রহণ করাকে বলে ছিনতাই।

বড়।। ছিনতাই বললি কেন?

মেজ।। [একগাল হেসে] দুষ্টুমি।

বড়।। [একটু চিন্তিতভাবে] একবার যাই কী বল?

মেজ।। কোথায়?

বড়।। বিষ্ণুবাবুদের বাড়িতে। ওর বউটা আমাকে খুব ভালোবাসত রে, দাদা দাদা করত, ভারি সুন্দর মেয়ে।

মেজ।। আমিও যাই চলো। তোমাকে একা ছাড়তে ভয় করছে। ওদের বাড়ির সামনে এতক্ষণে শ’দুই জমে গেছে।

বড়।। থানার ওসিকে একবার ফোন করব?

মেজ।। এতক্ষণে ওরাই ফোন করেছে।

বড়।। দাঁড়া, জুতোটা গলাই।

মেজ।। আমার তো চটি।

[বড় জুতো পরে উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়েই চিৎকার]

বড়।। ওরে ডান পাটির ভেতর কী একটা খড়খড় করছে। কাঁকড়াবিছে বাঁচাও বাঁচাও এ প্রমোদবাবু ছেড়ে দিয়ে গেছেন।

[বড় ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন]

মেজ।। আরে তুমি জুতোটা খুলে ফেল না।

বড়।। [দাঁতে দাঁত চেপে] দেখছিস না কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, নড়লেই কামড়ে দেবে।

মেজ।। কুসি, কুসি।

[মেজর চিৎকারে সবাই ঘরে। বাচ্চা দুটোও এসেছে]

কুসি।। এবারে কী?

মেজ।। দাদার জুতোয় কাঁকড়াবিছে।

কুসি।। তুমি সোফায় বোস, দেখি কেমন কাঁকড়াবিছে।

[সবাই হাঁ করে যেন সিনেমা দেখছে। কুসি টান মেরে জুতো দু’পাটি খুলে ফেলল।

জুতো ঠুকতেই ডান পাটি থেকে বেরিয়ে এল মেয়েদের চুলের একটা কাঁটা ]

কুসি।। [ওটাকে তুলে ধরে] এটা কোন বউয়ের মাথা থেকে খসেছে? সেজকি তোর, না নকার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *