এক
মিত্তির বাড়ির ন’বউয়ের আজ জন্মদিন। একটা গ্রুপ ফোটো তো হচ্ছে। মহা গুলতানি। বড় আর মেজ ভাইয়ের মহা সমস্যা। কী উপহার দেওয়া যায় যা ন’বউয়ের নেই। শেষে ঠিক হল একটা নতুন বাথরুম দেওয়া হবে, মডার্ন স্টাইলের। আপাতত সিদ্ধান্তটাই উপহার। রাতের উৎসব জমে গেল বাচ্চাদের নাটিকা পরিবেশনে। সেই জমাট মুহূর্তে এসে হাজির হলেন পূর্বপরিচিত নিরাশ্রয় এক বৃদ্ধ। ব্যস্ত ফোটোগ্রাফারের কেরামতিতে কেউ তিষ্ঠতে পারছে না। আপাতত ছবি, তারপর ধীরে ধীরে একে একে।
ফোটোগ্রাফার।। একটু সরে, বড়দা একটু ডানদিকে। উঁহু বাঁদিকে যাচ্ছেন কেন?
বড়দা।। কার ডানদিক? আমার, না তোমার? শোনো নির্দেশ যখন দেবে পরিষ্কার নির্দেশ। তোমার মাথায় এক বলছ আর এক। তোমার বলা উচিত ছিল, আপনার ডানদিক।
মেজদা।। শুরু হয়ে গেল। ওরে! মুখের কাছে একটা মাইক্রোফোন ধরে দে। আরও আধঘণ্টা উচিত, অনুচিতের লেকচার হোক।
বোন কুসি।। আধঘণ্টা হয়ে গেল, ঝড়ের এঁটো পাতার মতো, একবার ডান থেকে বাঁ, বাঁ থেকে ডান।
বড়দা।। আমার মনে হচ্ছে পাশাপাশি স্ট্রেট লাইনে দাঁড়ালে ভালো হত।
মেজদা।। তোমার মুণ্ডু হত। এতবড় একটা গ্রুপ। অর্ধচন্দ্রাকারে, ঘোড়ার ক্ষুরের নালের আকারে কাস্তের আকারে…
বড়দা।। তোর মতো একটা ইডিয়েটের আকারে…
মেজদা।। তোমার মতো একটা পণ্ডিত মূর্খের নির্দেশে…
[Flash]
কুসি।। যাঃ, মেরে দিলে।
ফোটোগ্রাফার (কুন্তল)।। ঠিক এই জিনিসটাই চাইছিলুম। মিত্তির বাড়ির সব ব্যাপারটাই চনমনে। মাল্টিভিটামিন কমপ্লেক্স।
[(group photo)-বড় থেকে ন’ সব ভাই। সেজবউ, বড়বউ তাদের একটি ছেলে একটি মেয়ে। বোন কুসি।]
[গ্রুপ ভেঙে ছড়িয়ে গেল।]
মেজ।। বড়দা তুমি এখনও মিচকি হাসি হাসছ কেন?
বড়।। অফ করতে ভুলে গেছি। ছবি তোলার সময় অন করেছিলুম। দেখবি, আলো আর হাসি, যে অন করে খুব হিসেবি না হলে অফ করতে ভুলে যায়। কুন্তল, হঠাৎ তুমি ছবি তুললে কেন?
কুন্তল।। লাস্ট ফিলম। একসপোজ করে দিলুম। এইবার রিলটা খুলে ওয়াশ করব।
মেজ।। একেই বলে, উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ।
বড়।। এই কথাটা অপমানসূচক।
মেজ।। কুন্তল আমার ছাত্র ছিল। ওকে একসময় আমি বাঁদর, উল্লুক, গাঁধা থ্রি ইন ওয়ান বলেছি। আমার সে অধিকার আছে।
বড়।। কুন্তল আমার পেশেন্ট। আত্মিক আঘাত থেকে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। নার্ভাস টেনশানে ভুগছে। ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না।
মেজ।। কেন আসে না?
কুন্তল।। ভয়ে।
মেজ।। ভয়ের ওষুধ ঘুমের বড়ি নয়, একটি রবীন্দ্রসংগীত—
আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।
বড়।। রবীন্দ্রসংগীতের অডেশানে তোর পাশ সার্টিফিকেট আছে?
মেজ।। নো।
বড়।। তাহলে আর কেরামতি নাইবা করলে। ওটা বড় পবিত্র মন্দির।
কুন্তল।। স্যার! ও ভয় আর এ ভয়ে অনেক তফাত। অন্যের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আমি ঘুমোতে পারি না।
মেজ।। সে আবার কী।
কুন্তল।। আজ্ঞে, আগে আমি ঘুমোতুম। আমার স্ত্রী সারারাত জেগে থাকত। চোখ গর্তে ঢুকে গেল। রোগা হয়ে গেল। হজমের গোলমাল। সবাই বললে, ফিমেল ডিজিজ। অনেক চিকিৎসা করালুম। শেষে জানা গেল, ওটা মেল ডিজিজ।
মেজ।। ফিমেলে মেল ডিজিজ কী ব্যাপার। ফিমেল বলেই না ফিমেল ডিজিজ।
কুন্তল।। স্যার! লজ্জার কথা বলব কী!
মেজ।। আরে, লজ্জার কী আছে, ডিজিজ বলছ কেন? ফিমেলে ফিমেল আসতে পারে মেলও আসতে পারে। মানুষের হাতে কিছু নেই। আর ছেলেপুলেদের ডিজিজ বলাটা ঠিক নয় কুন্তল। সব মানুষেই মহামানবের সম্ভাবনা।
ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
কুন্তল।। স্যার মহামানব নয় মহা নাক। শোয়া মাত্রই আমার নাকের পাঞ্চজন্য শঙ্খ বেজে ওঠে। হরেক জানোয়ারের মিলিত ডাক। শোবার ঘরে আফ্রিকার অরণ্য। প্রতিবেশীদের কমপ্লেন। আপনার বউমা ভয়ে জানালা খোলে না।
মেজ।। গাধা কোথাকার। ঘুমের ওষুধ বউকে খাওয়া, নিজে সুখে নিদ্রা যা।
কুন্তল।। সেইটাই তো করেছি। প্রেসক্রিপশান আমার নামে, ওষুধ খাচ্ছে মিসেস।
বড়দা।। বাঃ, এই না হলে রুগি। এদের জন্যই ডাক্তাররা পেটাই খায়।
মেজ।। এক কাজ করো না দাদা, নাকটা খুলে ক্লিন করে আবার সেট করে দাও।
বড়।। নাক নাকের জন্য ডাকে না, প্রবলেমটা গলায়।
মেজ।। তাহলে গলাটা কেটে দাও।
বড়।। তারপর জেলে যাও, তারপর ফাঁসিতে লটকাও। আধহাত জিভ বের করে লাট খাও। আহারে! আমার ভ্রাতা লক্ষ্মণ রে।
মেজ।। এরা সব দাঁড়িয়ে?
বড়।। আমাদের শ্রুতিনাটক শোনার জন্যে।
মেজ।। কর্তব্য কর্মে অবহেলা। আামাদের তো এখন টি—টাইম (হাঁক) গান্ধারী!
গান্ধারী।। ইয়েস মেজদা।
মেজ।। কী করছিস?
গান্ধারী।। চাটুতে ঝাঁটা দিয়ে তেল মাখাচ্ছি।
মেজ।। এই ধরনের বদমাইশি তোকে কে করতে বলেছে।
গান্ধারী।। ন’বউদি।
মেজ।। বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও।
কুসি।। কারণ?
মেজ।। চাটুতে আর ঝাঁটাতে কেউ এক করে?
কুসি।। করে। ধোসা তৈরির সময়।
বড়।। কেয়া বাত! মশলা ধোসা। আমি উদবোধন করব।
মেজ।। আমরা দুজনে করব। দুয়ে মিলে করি কাজ/ভুগে মরি নাহি লাজ।
কুসি।। আজ রেখার জন্মদিন। খেয়াল আছে?
মেজ।। বড়দা, তোমার আছে?
বড়।। তোর আছে?
[কুসি চলে গেল, বড় আর মেজ মুখোমুখি]
মেজ।। আমাদের মাথার অবস্থা দেখেছ? সব ভুলে যাই।
বড়।। আমি মনে রাখতে রাখতেও লাস্ট মোমেন্টে ভুলে গেলুম।
মেজ।। একটা কিছু দিতে হয়!
বড়।। অবশ্যই।
মেজ।। একসঙ্গে, না আলাদা আলাদা।
বড়।। আলাদা আলাদা এ তোমার বন্ধুবান্ধবের জন্মদিন নয়, যে চাঁদা তুলে একটা গামলা কিনে নিয়ে আসবে!
মেজ।। কী দেওয়া যায়? শাড়ি?
বড়।। হাজারখানেক আছে।
মেজ।। ভালো বই?
বড়।। কেউ পড়ে না। আজকাল চিঠির নীচে অলিখিত থাকে—বই না দিলে বাধিত হব। [বড় পায়চারি করতে করতে] এমন একটা কিছু, এমন একটা কিছু।
মেজ।। [উঠে দাঁড়িয়ে] এমন একটা কিছু এমন একটা কিছু
দুজনে।। [সমস্বরে] যা কাজে লাগে।
দুজনে।। [সমস্বরে] গান্ধারী!
গান্ধারী।। যাতা হুঁ ম্যায়।
মেজ।। তোর ন বউদির কী নেই! চিৎকার করবি না, ফিসফিস করে বল।
গান্ধারী।। [ফিসফিস] ছেলে নেই। ছেলের খুব শখ।
বড়।। ছেলে? এত রাতে ছেলে কোথায় পাব?
মেজ।। আরে, কী যে বল? এ ছেলে সে ছেলে নয়। ভেতরের ছেলে।
বড়।। [বুঝতে পেরে] ও হোঃ সেই ছেলে। সন্তান! সন্তান। এইটুকু থেকে তোর মতো এতবড় একটা দামড়া। সে তো মানুষের হাতে নেই।
গান্ধারী।। আছে। আছে। মাদুলি। সেই মাদুলি দেশ থেকে আসার সময় তিনটে এনেছি। সেই গুণীন শ্মশানে থাকে। ভূত চতুর্দশীর রাতে তিন পহরে শেয়ালের ডাক শুনে কাজ আরম্ভ করে।
মেজ।। কী কাজ?
গান্ধারী।। সে আমরা কী জানি। এক একটা মাদুলির খরচ পড়ে যায় পাঁচশো। এর পর বাইরের সাজ। তামার মাদুলি, রুপোর মাদুলি, সোনার মাদুলি। যে যাতে ভরবে। মেয়ের মাদুলির খরচ কম, মাত্র একশো টাকা। প্রত্যেকটা মাদুলির সঙ্গে সঙ্গে আধ হাত লাল সুতো ফিরি।
মেজ।। কী বড়দা দেবে নাকী! তুমি একটা, আমি একটা।
বড়।। তাহলে তো যমজ হয়ে যাবে! সে কী সামলাতে পারবে? বরং আমি ভেতরটা দি, তুই বাইরেটা দে। একটা সোনার মাদুলি আর কত নেবে হাজার বারোশো!
মেজ।। না, আমি ভেতর তুমি বাইরে।
বড়।। না, তুই বাইরে আমি ভেতরে।
মেজ।। মেজ আমি ভেতরে তুমি বাইরে।
বড়।। বাইরে।
মেজ।। ভেতরে।
(বাইরে। ভেতরে। ভেতরে। বাইরে।)
গান্ধারী।। উঁরে ব্বাসরে। এ কী করতে লেগেছে। যাই, কুসি দিদিমণিকে ডেকে আনি।
মেজ।। আমি ভেতরে থাকায় অবিচল।
বড়।। আমি বাইরে যাব না, যাব না, যাব না।
কুসি।। তোমরা দুটোতেই বাইরে যাও। বেরোও। গেট আউট। দুটো দামড়া হুলো। মুখোমুখি হল তো ফ্যাঁসফোঁস। যাও, যাও। রাত দশটার আগে দুজনের মুখ যেন না দেখি।
বড়।। কুসি, তুই এসেছিস। এ বাইরে সে বাইরে নয় রে। এ হল মাদুলির বাইরে।
কুসি।। কীসের মাদুলি?
বড়।। সোনার মাদুলি।
মেজ।। না, আমি ভেতরে পাঁচশো। ও বাইরে বারোশো।
বড়।। না, আমি ভেতরে পাঁচশো ও বাইরে বারোশো।
মেজ।। কান্ট বি।
বড়।। উইল বি।
কুসি।। কীসের মাদুলি। কই দেখি মাদুলিটা।
মেজ।। সে তো স্যাকরার দোকানে। আমাকে কিনতে বলছে।
কুসি।। কিনতে বলছে কেন?
মেজ।। ওর মধ্যে মন্ত্রপূত গান্ধারী ঢুকবে।
কুসি।। সে আবার কে?
বড়।। ব্যাপারটা আমি ক্লিয়ার করি। ও উত্তেজিত। মাদুলির মধ্যে থাকবে গান্ধারীর শ্মশান।
কুসি।। গান্ধারীর শ্মশান! শ্মশান থাকবে মাদুলিতে! গান্ধারীটা কে?
মেজ।। আমাদের গান্ধারী। মহাভারতের গান্ধারী নয়।
কুসি।। [গলা জড়িয়ে] গান্ধারী।
গান্ধারী।। হাঁ দিদি।
কুসি।। কী ব্যাপার!
গান্ধারী।। যতদূর বুঝেছি, এরা ন’বউদিকে মাদুলি পরাবে।
কুসি।। কেন? এত লোককে টুপি পরিয়ে শান্তি হচ্ছে না। মাদুলি পরাবে কেন?
[গান্ধারী কানে কানে]
কুসি।। [ভাইদের দিকে তাকিয়ে] আরে ছিছি। তোমারে লজ্জাশরম সব গেছে। সময়ে বিয়ে না করলে মানুষের এই অবস্থাই হয়। ছোঁকছোঁক স্বভাব হয়। অসভ্য, ইতর।
দু’ভাই।। [একসঙ্গে] লে হালুয়া। আমরা কী জানি। গান্ধারী তো বললে।
গান্ধারী।। বাঃ, আমি বললুম না আপনারাই আমাকে বললেন, বল তো গান্ধারী ন’বউয়ের কী নেই? আমি বললুম, ছেলে নেই। যা নেই, তা নেই, সত্যিই তো নেই। আমি কি মিথ্যে বলব! সে মেয়ে আমি নই। আমার গুরু পঞ্চানন।
ন’বউ।। [চায়ের ট্রে হাতে] দিদি পুরটা হয়ে গেছে।
কুসি।। কাপ ধরে দিয়ে তুই এখুনি এখান থেকে কেটে পড়া। এ দুটো অ্যান্টি—সোস্যাল হয়ে গেছে।
[ন’বউ ভয়ে চলে গেল]
বড়।। দেখলি তো মেজ, কী যুগ পড়েছে। ভালো করতে চাইলে মন্দ হয়। কলির শেষ। এই ব্যাটা গান্ধারীই বললে, আমার কাছে শ্মশানের বীজ আছে, সোনার মাদুলিতে ভরে ডান হাতে বেঁধে দেন। বীজের দাম পাঁচশো, মাদুলি বারোশো। বছর না ঘুরতেই দোল দোল দুলনি/ রাঙা মাথায় চিরুনি।
গান্ধারী।। ও বাবা, কী মিথ্যে কথা বলে গা!
বড়।। মেজ! তুই সাক্ষী।
মেজ।। গোছগাছ করে একটা বলেনি।
বড়।। এখন দলত্যাগ করিসনি পাঁঠা ফ্রন্টের ঐক্য বজায় রাখ।
মেজ।। যুক্তফ্রন্ট জিন্দাবাদ।
কুসি।। [গান্ধারীকে] যা, তুই সাম্বারটা বসা। এ দুটো পাগল। তোমাদের আমি বিয়ে দেবো। তবে যদি টিট হও।
বড়।। আমার একজন প্রেমিকা ছিল রে কুসি।
মেজ।। জানি। মণি পাগলি। তোমাকে দেখলেই গান ধরত, ও দয়াল বিচার করো। আমায় গুণ করেছে, আমায় খুন করেছে।
বড়।। না রে না, আমার প্রেমিকার নাম কবিতা। দুজনেই প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, বিয়ে করে প্রেমের মতো একটা সুন্দর জিনিসকে নষ্ট করব না। প্রেমকে মুরগি করে, জবাই করে পালক ছাড়িয়ে চিলি চিকেন বানাব না। বিরহী যক্ষ, বিবাগী কোকিল আমাদের আদর্শ। আমাদের আদর্শ রবি কবি। আমাদের প্রাণের মানুষ প্রাণে থাকে।
মেজ।। আমার আদর্শ তুলসীদাস। বেহা বেহা সবকোই কহে, মেরা মনমে এহি ভায়/চড় খাটোলি ধোঁ ধোঁ লগড়া জেহেল পর লে যায়। ওই দেখ বর যাচ্ছে চৌদালায় চড়ে। বাদ্য—বাজনা। ভোঁপ্পোড়ো পোঁ। যাচ্ছে কোথা, না জেলখানায়।
বড়।। তোর মধ্যে কোনো প্রেম নেই।
মেজ।। আমার ফ্রেমে প্রেম নেই। আছে কর্ম। কর্মযোগী আমি। স্বামীজি আমার আদর্শ। জীবে প্রেম করে যেই জন…
বড়।। কারেকসান, জীবন নয় জিভ, জিভে প্রেম….
মেজ।। ফ্রন্টের ঐক্য বজায় রাখ। বলো বলো বলো সবে, আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।
বড়।। কুসি তুই বিয়ে করলি না কেন?
কুসি।। তোমাদের ছেড়ে থাকা যায় না বলে। এই দুটো কচি পাঁঠাকে কোথায় রেখে যাব। কার কাছে রেখে যাব, গা মাখা ঝোল করে খেয়ে ফেলবে।
বড়।। এই দেখ মেজ, একই রকমের ত্যাগ। মনে আছে অনেক কাল আগে, বাবা যখন হঠাৎ মারা গেলেন, শ্মশানে চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ভাই দুটো নাবালক, বোনটার বিয়ে দিতে হবে, আমরা বিয়ে করব না। কী জানি বাবা, কেমন বউ আসবে, কৈকেয়ী আর মন্থরা আমাদের সুখের সংসার ফ্র্যাকচার করে দেবে।
মেজ।। কুসির শাসনে আমরা কেমন সুখে আছি বলো?
বড়।। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বর্গে আছি। উঃ পাগল করা গন্ধ আসছে রান্নাঘর থেকে একটু টেস্ট করা না। টক, ঝাল, নুন।
মেজ।। কুসি। ন’বউকে জন্মদিন কী দেওয়া যায় বল তো। মাদুলি তো ক্যানসেল।
কুসি।। একটা বাথরুম দাও।
বড়।। এই রাতে বাথরুম কোথা থেকে কিনব। বাথরুম কী জিনিস।
কুসি।। আরে বাথরুম জানো না! যেখানে মানুষ চান করে।
বড়।। সে তো আমাদের আছে।
কুসি।। ওর নিউ স্টাইলের একটা বাথরুমের খুব শখ। সিরামিক টাইলস, টেলিফোন শাওয়ার, বাথটাব, টাওয়ার ট্যাপ।
মেজ।। ওই ইংরেজি সিনেমার মতো।
বড়।। বাথটাব? আমি শুয়ে থাকবো সাবানের ফেনায়। সেলুলার ফোনে কথা বলব ভগবানের সঙ্গে।
[এক যুবকের হন্তদন্ত প্রবেশ]
যুবক।। ডাক্তারবাবু, আবার হেঁচকি উঠছে। ননস্টপ। হিক, হিক। কোনো কাজ হল না ওষুধে।
বড়।। কার হেঁচকি? কীসের হেঁচকি?
যুবক।। আমার স্ত্রীর।
বড়।। কী খাইয়েছিল?
যুবক।। এক খিলি জর্দা পান?
বড়।। জর্দার অভ্যাস ছিল?
যুবক।। না। জীবনের এই ফার্স্ট জর্দা।
বড়।। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়। ঠিক হয়ে যাবে।
যুবক।। মরে যাবে না তো! জাস্ট পনেরো দিন বিয়ে হয়েছে।
বড়।। মানুষ হেঁচকি তুলেই মরে। সেই হেঁচকি তোলার বয়েস এখনও হয়নি। এটা ছেঁচকি।
যুবক।। বিশ্বাস করুন ডাক্তারবাবু, আমি জোর করে জর্দা খাওয়াইনি। নিজের ইচ্ছেয় চেয়ে চেয়ে খেয়েছে। এ যা দিনকাল যদি মরে যায় সঙ্গে সঙ্গে আমার গণধোলাই, আমার মায়ের, আমার বোনের হাজতবাস। সতীর চিতায় পতির সহমরণ।
বড়।। সেরকম কোনো সম্ভাবনা আছে?
যুবক।। নেই কেমন করে বলি। হলেই হল। একালে সবই সম্ভব। আমার আর একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম ছিল।
বড়।। দয়া করে তাকে বিয়ে করলেই হত।
যুবক।। একটু সমস্যা ছিল। সেই মেয়েটা আর একটা ছেলেকে ভালোবাসত, সেই ছেলেটা আবার আর একটা মেয়েকে ভালোবাসত, সেই মেয়েটা আবার আর একটা….
বড়।। হয়েছে, সবশেষে একটা ফাঁকা মাঠ, মাঠে একটা গোরু। ইলু, ইলু, ইলু, ইলু।
যুবক।। আপনার কাছে এসেছিলুম, প্রয়োজন হলে বলবেন তো।
বড়।। কাকে বলব?
যুবক।। পুলিশকে, আদালতকে। ডেথ সার্টিফিকেটে লিখে দেবেন, হেভি ডোজে জর্দা খেয়ে মৃত্যু।
বড়।। (মেজকে) কীসব আবোলতাবোল বকছে বল তো!
মেজ।। দাঁড়াও কুসিকে কল করি। (গলা চড়িয়ে) কুসি কুসি।
কুসি।। আজ বাড়িতে একটা উৎসব। বারে বারে ডাকলে হয়?
বড়।। কী করব বল। এ কোথা থেকে এসে কীসব বকছে।
কুসি।। কোথা থেকে আসবে কেন, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে তাই এসেছে। পল্লবকে চিনতে পারলে না। যাত্রার পালা লিখে বিখ্যাত।
বড়, মেজ।। [সমস্বরে] আমাদের দেশের গৌরব পল্লব গাঙ্গুলি। মাই গড।
বড়।। যাত্রা আমার ভালোই লাগে। ছেলেবেলায় খুব দেখেছি। এখন আর সময় পাই না।
মেজ।। যাত্রার চেয়ে যাত্রার নাম আমার ভীষণ ভালো লাগে, সতীর কোলে পতির মাথা।
পল্লব।। ওটা আমার হিট পালা।
মেজ।। জুতোর তলায় কাঁটা পেরেক।
পল্লব।। এটা আমার নয়। আমার আর একটা হিট পালা হল পানাপুকুরে কচিসুন্দরী। আমি এখন যে পালাটা লিখছি, সেটার নাম জর্দাপান কেন খেলে কুলবধূ। ক্রাইম পালা। সেখানে এইরকম একটা প্লট আছে। একের পর এক বধূর করুণ মৃত্যু। শেষে সাহসী এক বধূ আসামিকে ধরবে। তাকে ল্যাম্প পোস্টে ঝোলাবে। তারপর সে ইলেকশানে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী হবে। আইন করবে, ক্যারেকটার সার্টিফিকেট না দেখালে কোনো মেয়ে কোনো ছেলেকে বিয়ে করবে না। আমার পরের পালা ঘরে ঘরে সিঁদুরের আগুন।
[এক বৃদ্ধের প্রবেশ]
বৃদ্ধ।। চিনতে পারছ মিত্তির?
বড়।। আমাকে বলছেন?
বৃদ্ধ।। তোমাদের দুজনকেই।
মেজ।। চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
বৃদ্ধ।। কালীপুজোর রাতে আমার খড়ের গোলা তোমাদের বাজির আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।
বড়।। হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো অনেক বছর আগে। আমরা তখন ছাত্র।
বৃদ্ধ।। সেই আগুন আজও আমার বুকে ধিকি ধিকি জ্বলছে।
বড়।। এখনও জ্বলছে! নেভাতে পারছেন না।
বৃদ্ধ।। তোমাদের জন্যে আমি ধনে প্রাণে মারা গেছি। ত্রিভুবনে আমার আর কেউ নেই। একজনের আশ্রয়ে ছিলুম। সে এইমাত্র আমাকে তাড়িয়ে দিলে।
মেজ।। তাড়ালে কেন?
বৃদ্ধ।। আগুনে আমার খুব ভয়। সেই থেকে। লোকটা সংসারে আগুন ধরাচ্ছে। প্রতিবাদ করেছিলুম, বললে নিকাল যাও। বেরিয়ে এলুম। এইবার কোথায় যাই। জানো মিত্তির, মানুষের কোনো যাবার জায়গা নেই। যার ঘর আছে তার আছে। যার নেই? হ্যাঁগো, তোমরা কি আমাকে তাড়িয়ে দেবে? তা দেবে নাই বা কেন। এই বাজারে কে কাকে দেখে!
[কথা শেষ হতে না হতেই সবাই ঘরে ঢুকল। ভায়ের বউরা, কাজের লোকেরা, বাচ্চা দুটো।
কুসির হাতে ‘বার্থ ডে কেক’]
বৃদ্ধ।। আজ কিছু আছে বুঝি! তাহলে আসি ভাই। রাতটা শ্মশানেই কাটাই।
[বৃদ্ধ উঠছেন]
বড়।। দাঁড়ান। দাঁড়ান যাচ্ছেন কোথায়? আমরা কি যেতে বলেছি কুসি, চিনতে পারছিস এঁকে। না পারারই কথা, তুই তখন অনেক ছোটো। ইনি আমাদের সরকার মশাই। একসময় খুব ভালো টপ্পা গাইতেন।
কুসি।। হাত জোড়া, নমস্কার করতে পারছি না।
বড়।। আজ থেকে আমাদের বাড়িতে থাকলে কোনো আপত্তি আছে তোমাদের?
বাচ্চা দুটো।। [আনন্দে] আমাদের দাদু, আমাদের দাদু।
[জিন্স—শার্ট পরা এক যুবক। আধুনিক বাউল।
ন’ভাইয়ের বন্ধু। গান গাইতে গাইতে ঢুকছে]
চেতন বাউল।। আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/তাই হেরি তায় সকল খানে। ঠিক সময়ে এসে পড়েছি।
গান্ধারী।। আজ কিন্তু সব নিরামিষ।
চেতন।। আমি কেবল খেতে আসি? আমি গান শোনাতে আসি।
গান্ধারী।। তুমি বাপু বড্ড খাও।
চেতন।। খিদে পায় তাই খাই। দোষটা তো কুসিদিদির। অত ভালো রাঁধে কেন?
[ইতিমধ্যে কেক সাজানো হয়েছে। আলো জ্বলছে। বাতি জ্বলছে।]
কুসি।। সবাই রেডি।
মেজ।। [গালে হাত বুলিয়ে] যাঃ আজ দাড়ি কামানো হয়নি।
বড়।। আজ রেখার জন্মদিন, তোর নয়। আজ রবিবার, মানুষ যেমন কাজে বেরোয় না, দাড়িও সেইরকম বেরোয় না।
মেজ।। ঠিক বলেছ। গালটা সত্যিই তেমন খড় খড় করছে না!
কুসি।। আমাদের দীপু আর পূজা ছোট্ট একটা নাটক পরিবেশন করবে। তোমরা সবাই বোসো। মেজদা কেক কাটার জন্যে ছুরিটা এনেছি। হাত কাটার জন্যে নয়।
মেজ।। সরি।
কুসি।। স্টার্ট।
পূজা।। হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল/সাদাকে বলছিলি লাল? আর সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে/ নাক ডেকেছিস বিশ্রী সুরে? আর তোদের পোষা বেড়ালগুলো/শুনছি নাকি বেজায় হুলো। আর এই যে শুনি তোদের বাড়ি/কেউ নাকি রাখে না দাড়ি?
দীপু।। ক্যানে রে ব্যাটা ইসটুপিড।/ঠেঙিয়ে তোরে করব টিট।
পূজা।। চোপরাও তুম স্পিকটি নট,/মারব রাগে পটাপট—ফের যদি ট্যারাবি চোখ/কিংবা আবার করবি রোখ, কিংবা যদি অমন করে/মিথ্যেমিথ্যে চ্যাঁচাস জোরে। আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি/ জানিস আমি স্যান্ডো করি? ফের লাফাচ্ছিস? অলরাইট কামেন ফাইট! কামেন ফাইট।
দীপু।। ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি/টেরটা পাবে আজ এখনি। আজকে যদি থাকত মামা/পিটিয়ে তোমায় করত ঝামা। আরে! আরে! মারবি নাকি?/দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি। হাঁ হাঁ হাঁ হাঁ। রাগ করো না/করতে চাও কি তাই বল না?
পূজা।। হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো সত্যি বটেই/আমি তো চটিনি মোটেই। মিথ্যে কেন লড়তে যাবি?/ভেরি ভেরি সরি, মশলা খাবি?
দীপু।। শেক হ্যান্ড আর দাদা বল/সব শোধ বোধ ঘরে চল। ডোন্ট পরোয়া অলরাইট হাউ ডুয়ুডু
।। গুড নাইট।।
বড়।। বাঃ বাঃ, আর ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না। এইবারে কেকে মারো ছুরি।
সমস্বরে : হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।