মিত্তির বাড়ি – ৩

তিন

[বড়ভাই ঘরে ঢুকছেন, একজনকে আহ্বান করছেন, আসুন আসুন।

দুটো হাত দু’পাশে ছড়িয়ে সসম্ভ্রমে ভিতরে চলুন, ভিতরে চলুন।]

বড়।। আমাদের কী ভাগ্য। কতদিন পরে আপনি এলেন।

[সৌম্যসুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। পরনে ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, সোনার বোতাম। সব আঙুলে সোনার আংটি। পাঞ্জাবির বুকপকেটে দুটো সোনার কলম। পকেট ঘড়ির সোনার চেন বুকের কাছে দুলছে।]

[ভদ্রলোক রাজকীয় ভঙ্গিতে সোফায় বসা মাত্রই বড়র চিৎকার]

বড়।। ওরে কে কোথায় আছিস?

[ডাক শুনেই প্রথেমে এল গান্ধারী। হাতে এক গেলাস জল, গেলাসটা বড়র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে]

গান্ধারী।। ফিলটারের জল। গরম—ঠান্ডা মেশানো।

বড়।। তোর কাছে আমি জল চেয়েছি?

গান্ধারী।। বড়দা আপনি যে বলেন মেঘ না চাইতেই জল।

বড়।। মেঘ না চাইতেই জল আজ ওই সোফায় বসে আছেন। ডাক সবাইকে।

[এক—একজন ঢুকছে আর বিস্ময়ের উক্তি। ওমা আপনি।]

কুসি।। এতদিন কোথায় ছিলেন?

রাজজ্যোতিষী।। আর বলো কেন, রাজা—মহারাজারাই আমাকে শেষ করে দিল। গেছি পশুপতিনাথে, নেপালের রাজার কানে খবরটা ঠিক চলে গেছে। একবারে হাওদা চড়ানো হাতি এসে হাজির, যেতেই হবে। নেপালে একটু ক্রাইসিস যাচ্ছে তো।

কুসি।। হাতি কেন? রাজার তো মার্সিডিজ, রোলস রয়েস সবই আছে।

রাজজ্যোতিষী।। এই দেখ ভুলে গেছ। আমি ধাতব গাড়িতে চড়তে পারি না, কাঠ ছাড়া সমস্ত কিছু অসহ্য। লোহা হল কন্ডাকটার, আমার ভিতরের এনার্জি, আমার পাওয়ার লোহা টেনে নিতে পারে। সেই কারণে ননকন্ডাকটার হাতি, ঘোড়া, কাঠেররথ—এছাড়া আমার চলে না। বেসরকারি বাস চলতে পারে, কাঠের সিট। আগে ট্রেন চলতে পারত, কিন্তু এখন তো সব লোহার।

কুসি।। মহা মুশকিল। এখন কীভাবে এলেন?

রাজজ্যো।। ওই দ্যাখো, আবার তোমার মেমারি ফেল করছে। কলকাতায় চলাফেরা করার জন্য আমি পৈত্রিক ফিটন গাড়িটাই ব্যবহার করি। অস্ট্রেলিয়ার প্রাইম মিনিস্টার আমাকে একটা ঘোড়া প্রেজেন্ট করেছেন। আগে খুব তাগড়া ছিল। এখন বলে না দিলে কেউ বিশ্বাসই করবে না ওটা অস্ট্রেলিয়ার ঘোড়া। এদেশের জলবায়ুতে পটকে গেছে।

বড়।। আমি একটু চেঞ্জ করে আসি।

রাজজ্যো।। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধড়াচুড়ো খুলে এসো। [বউদের দিকে তাকিয়ে] বাঃ তোমরা দুটিতে বেশ ফুটফুটে হয়েছে। ভালো সময় যাচ্ছে।

[বাচ্চা দুটো একপাশে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়েছিল]

রাজজ্যো।।  [তাদের দিকে তাকিয়ে] এদেশে বেশি দিন নয়। ছেলেটা যাবে আমেরিকায়, মেয়েটা যাবে জার্মানিতে। আমি দেখতে পাচ্ছি। ওটার তুঙ্গী রবি, আর মেয়েটার তুঙ্গী চন্দ্র।

দুই মা।। [রেখা ও পরমা] [একসঙ্গে] ওরা বড়ো হবে তো?

রাজজ্যো।। প্রশ্নটা ঠিক হল না। কালের নিয়মে সবাই বড়ো হবে। মহাকাল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বড়ো হবে কি না জিজ্ঞাসা কোরো না। জিজ্ঞাসা করো মানুষ হবে কি না? মানুষের বড়ো অভাব।

বড়।। [ঘরে ঢুকতে ঢুকতে] আজ্ঞে হ্যাঁ, মানুষের বড়ো অভাব।

রাজজ্যো।। দুটো পা থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না। বকেরও তো দুটো ঠ্যাং।

কুসি।। মহাভারতে বককে যে ধর্ম বলা হয়েছে?

রাজজ্যো।। এই নাও, আর একবার গুলোলে। ধার্মিকের ধর্ম, আর বকের ধর্মে অনেক তফাত। বকধার্মিক হওয়াটা মোটেই ঠিক নয়। বকধার্মিকের প্রকাণ্ড প্রত্যাশা।

বড়।। [ তাড়াতাড়ি অনুনয়ের কণ্ঠে] ওটা আর ব্যাখ্যা করবেন না, ওটা আর ব্যাখ্যা করবেন না। মেয়েরা রয়েছে, বাচ্চারা রয়েছে।

রাজজ্যো।। তুমি আমাকে এতটা বেআক্কেলে ভাবলে কী করে অমল? সাধন—ভজনের সময় আমার পরিবেশ জ্ঞান থাকে না ঠিকই। কিন্তু এখন তো আমি সাধন—ভজন করছি না। এখন আমি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেই আছি। রাত বারোটার সময় আমি দেহের দরজা খুলে অন্যলোকে চলে যাই। কাল মাঝরাতে দেখলুম ভারতের অবস্থা খুব খারাপ। খুব খারাপ। মানুষ আর পশুতে আর প্রভেদ থাকবে না। ভাই ভাইকে মারবে, বাপ ছেলেকে মারবে, ছেলে বাপকে মারবে। স্ত্রীরা সব ব্যভিচারিণী হয়ে যাবে। ঘরে ঘরে কলসি থেকে মদ গড়িয়ে খাবে। বাচ্চারা ফুটপাতে পড়ে থাকবে, কুকুরে এসে শুঁকবে, কিন্তু খাবে না।

কুসি।। [ভয়ে ভয়ে] আমাদের কী হবে?

রাজজ্যো।। ধর্ম ধরে থাক, বেঁচে যাবি। এই সবকটাকে ক্ষীরিকার মূল পরিয়ে দে। আর রোজ দুটো করে মরিচ চিবিয়ে খাবি। আচ্ছা এখন যে আমার একটু ইচ্ছে করছে…

বড়।। [সসম্ভ্রমে] আজ্ঞে কী ইচ্ছে করছে?

রাজজ্যো।। একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার একটু চায়ের লিকার, এক চামচে মধু। মধুটা গোলানো হবে না। সিরসির করে মধুটা মিশে যাবে। আর এই লিকারটা করবে ন’বউ। ওর একটা মনের বাসনা প্রবল হয়েছে না। হবে, হবে, মাদুলি ধারণ না করেই হবে।

কুসি।। [রেখাকে] নতুন স্টেনলেস স্টিলের নতুন গেলাসে তুই লিকারটা নিয়ে আয়।

রাজজ্যো।। এই দ্যাখ মেয়েটার আমার কিছু মনে থাকছে না। কী বলেছি ধাতু আমি স্পর্শ করতে পারি না। কাঠের গেলাস, পাথরের গেলাস যখন নেই তখন নতুন কাচের গেলাস।

কুসি।। পাথরের গেলাস আছে তো।

রাজজ্যো।। নিশ্চয়ই কালো পাথর অথবা ছিটছিটে পাঁশুটে পাথর, হবে না, মার্বেল পাথর চাই।

[ন’বউ উঠে বেরিয়ে গেল]

রাজজ্যো।। ইচ্ছে তো হতেই পারে। মেয়ের পর একটা ছেলে। দেখি আজ মাঝরাতে টপোস্ফিয়ার থেকে একটা বীজ জোগাড় করে শক্তিচালান করে দেব।

বড়।। আহারাদি কী করবেন?

রাজজ্যো।। সব ভুলে গেছ। আমার আহার তোমরা জানো। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা চারখানা ফুলকো লুচি, একটু সিজিন্যাল তরকারি। কাশী হলে বলতুম একবাটি মালাই। এখানে অভাবে একবাটি ক্ষীর। সঙ্গে একটু সন্দেশ থাকলেও হয়, না থাকলেও হয়। আমার চাহিদা খুব অল্প।

বড়।। তাহলে সেইরকম বলে দিই?

রাজজ্যো।। না, ওই কাজের লোককে দিয়ে করালে হবে না। ওই ভোগ প্রস্তুত করতে হবে কুসিকে। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা পরে। সে মালাটি অবশ্য আমিই দেব। জানো তো সাধারণ মানুষ ভাবে আমিই আহার করছি। অজ্ঞ, তারা অজ্ঞ। আহার করি, মনে করো আহুতি দি শ্যামা মাকে। মেজভাইকে দেখছি না কেন? তিনি তো আবার ঘোর নাস্তিক।

বড়।। এই সময়টা ও একটু বেড়াতে যায়। এখন কলেজের ছুটি চলেছে তো। তিন—চার মাইল না হাঁটলে উইক ফিল করে।

রাজজ্যো।। নাস্তিক হোক আর আস্তিকই হোক, তিনি তাঁর কাজ ঠিক করে যান। ওই যে সুগার হতে পারে, সে যোগ আছে কোষ্ঠীতে। কবে দেখেছি আজও আমার মনে আছে। তাই তিনি টেনে নিয়ে গেছেন বেড়াতে। তাঁর খোলার কথা যখন ভাবি তখন স্তম্ভিত হয়ে যাই। ঠিকই বলেছেন। সাধকরা ঠিকই বলেছেন। আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী। যেমন চালাচ্ছ তেমনই চলছি। জীবনের টুনি লাইট পাওয়ার হাউসের সেই শক্তিতে জ্বলে আছে। যেই কানেকশন কেটে দেবেন, সঙ্গে সঙ্গে ফিউজ। [হঠাৎ খুব তীব্র গলায়] ওরে মূঢ়, মা কুরু ধনজন যৌবন গর্বং, হরোতি নিমেষাৎ কাল সর্বং।

গান্ধারী।। [ধড়ফড় করে ঘরে ঢুকে] কী হল, কী হল?

রাজজ্যো।। [সেইদিকে তাকিয়ে] সেই গান্ধারী না, বেশ ডাগর—ডুগুর হয়েছে, রূপ খুলেছে, আদরে আছে। পূর্বজন্মের সামান্য একটু ভুলে রাজরানি না হয়ে চাকরানি। সৎকর্ম করে যা, সৎ কর্ম। জেনে রাখিস কর্মই ধর্ম। ফলের আকাঙ্ক্ষা করিসনি। একটিমাত্র ফলই ফল, সেটি হল মোক্ষফল। আচ্ছা, একটু জল খেলে কেমন হয়?

বড়।। এই যে বললেন চা খাব।

রাজজ্যো।। চায়ের আগে তো একটু জল খেতে পারি। তিনি চাইছেন। এত কথা বললেন তো। গলাটা শুকিয়ে গেছে।

কুসি।। তাহলে জল নিয়ে আসি?

রাজজ্যো।। কীসে করে আনবে?

কুসি।। আপনার তো ধাতু চলবে না।

রাজজ্যো।। এই। এখন শ্রুতি স্মৃতিতে বসেছে।

[কমলের প্রবেশ। বাড়ির সেজ ছেলে। ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। পরনে অফিসের ধড়াচুড়া।]

রাজজ্যো।। কমল না? তুঙ্গী বৃহস্পতি। তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে তুমি নিজেই জানো না। টাকা বিছিয়ে তার ওপর শুয়ে থাকবে। আর যশ খ্যাতি। দেশে—বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। কীরকম হবে জানো? আজ ভারতে তো কাল আমেরিকায়, কাল আমেরিকায় তো পরশু থাইল্যান্ডে। তবে বাবা, শত্রু হতে সাবধান। [উত্তেজিত হয়ে] শত্রু কোথায়? শত্রু বাইরে, না গো, শত্রু আর মিত্র দুটোই তোমার ভিতরে বসে আছে। আত্মাই আত্মার শত্রু। আত্মাই আত্মার মিত্র। একথা আমার নয়। আমি মূর্খ। একথা ভগবানের গীতায় বলেছেন। [আবার গলা চড়িয়ে] প্রলোভনে পা দেবে না, দেবে না, দেবে না। নারী হতে সাবধান।

কমল।। [ভয়ে ভয়ে আমার জীবনে আমার স্ত্রীই একমাত্র নারী।]

রাজজ্যো।। মূর্খ, স্ত্রী নারী হলেও নারী নয়। সে হল তোমার শক্তি। জীবনের কতটুকু দেখেছ ছোকরা যে তর্ক করছ! তোমার জীবনে নারী প্রলোভন আসবে, ধরে থাকো।

কমলা।। [ভয়ে ভয়ে] কাকে?

রাজজ্যো।। শক্তিরূপিণী তোমার ওই স্ত্রীকে।

[ছিপির প্যাঁচ ঘুরে যাওয়া সকালের সেই লোকটি কখন ঢুকে পড়েছে। ফাঁক পেয়েই বলে উঠল]

লোক।। ডাক্তারবাবু, প্যাঁচ ঘুরে গেছে।

বড়।। [অন্যমনস্ক] যাকগে ঘুরে, আবার সোজা হয়ে যাবে।

লোক।। এ প্যাঁচ সে প্যাঁচ নয়, শিশির প্যাঁচ।

বড়।। [তাকিয়ে] কী বলতে চাইছ?

লোক।। আপনি যে ওষুধটা দিয়েছিলেন সেই ওষুধের সিল করা ছিপির প্যাঁচ ঘুরে গেছে। খুলছে না, শুধু ঘুরেই যাচ্ছে। নটার ওষুধ খাওয়া হয়নি।

বড়।। বাড়িতে দরজা আছে?

লোক।। হ্যাঁ আছে। পুবদিকে একটা, পশ্চিমদিকে একটা, দক্ষিণ দিকে একটা। উত্তরে তো কোনো দরজা নেই।

বড়।। [অবাক হয়ে] তোমাকে উত্তরের দরজার কথা বলেছি। বলেছি দরজার কথা। যে—কোনো একটা দরজা ও পাল্লার মাঝখানে ছিপিটাকে চেপে ধরে ঘোরাও।

লোক।। ঘুরিয়ে ছিলাম।

বড়।। তা কী হল?

লোক।। [হতভম্ব হয়ে বলল] ভেঙে গেল, সব ওষুধ মাটিতে।

বড়।। বাঁচা গেছে।

লোক।। অনেক টাকা দাম, আর যে কেনার পয়সা নেই, একটা ফ্রি স্যাম্পেল।

বড়।। ঠিক আছে, পরে এসো।

লোক।। [তবু না গিয়ে] আমার আর একটা প্রশ্ন আছে ডাক্তারবাবু। নাভিশ্বাস কাকে বলে?

বড়।। যে শ্বাস নাভি থেকে ওঠে।

রাজজ্যো।। এই প্রশ্নের ওই উত্তর হল। শোন বাবা, নাভিশ্বাস দু’রকমের আছে। সাধকের নাভি থেকে যে শ্বাস ওঠে তাকে বলে প্রাণায়াম, আর সাধারণ মানুষের যে শ্বাস নাভি থেকে ওঠে তাকে বলে মৃত্যু। কার উঠেছে?

লোক।। আমার মায়ের।

রাজজ্যো।। পূর্বদিকে মাথা, পশ্চিমদিকে পা। মাথার দিকের দেয়ালে মা কালীর ক্যালেন্ডার। ডানপাশে জানালার বাইরে একটা নারকেল গাছ। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা নর্দমা। মাথার বালিশের ওয়াড়টা ময়লা। বিছানায় যে তোশক পাতা তার জায়গায় জায়গায় তুলো ঢেলা পাকিয়ে আছে। যে খাটে শুয়ে আছেন তার তলায় পিচবোর্ডের বাক্সে একগাদা পুজোর বাসন। ঘরের আলোর শেডে ঝুল। ঘরে ঢোকার মুখের পাপোশ ছেঁড়া ছেঁড়া। বাথরুমের একটা কল ঠিকমতো বন্ধ হয় না। ফোঁটা ফোঁটা জল পড়েই যাচ্ছে কী মিলছে?

লোকটি।। [ভয়ে ভয়ে] হ্যাঁ, সবই মিলছে।

রাজজ্যো।। দ্বাদশীর শেষ রাতে তোমার মা পুষ্পক রথে চড়ে সপ্তম স্বর্গে প্রস্থান করবেন। বাবা দুঃখ কোরো না। শঙ্কর বলছেন, যাবৎ জনমং তাবৎ মরণং। জীবের ধর্মই হল আজ আছে কাল নেই।

লোক।। আপনি কিছু করতে পারেন না? মায়ের মৃত্যুটা আমার কাছে বড়ো কথা নয়। সব মা—ই মরবেন, আমার মা—ও মরবেন। কথাটা হল মা মারা গেলেই দাদা আর বউদি আমার পিছনে লাথি মারবে।

রাজজ্যো।। শোনো, শোনো, ভাগ্য বদলানো যায় না। কারুর বাবার ক্ষমতা নেই। জগদবিখ্যাত প্রাণবল্লভ তোমার কী করবেন, যদি রাধবল্লব তোমায় রক্ষা না করেন? ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করবার জন্য প্রস্তুত হও।

লোক।। কীভাবে মহারাজ?

রাজজ্যো।। উঁহুঃ আমি রাজাও নই, মহারাজাও নই। আমি কৃষ্ণদাস। তোমাকে একটা উপদেশ দিই। রোজ সকালে ডন—বৈঠক মারো। পঞ্চাশটা ডন, একশোটা বৈঠক। তারপর…..

লোক।। [উদগ্রীব হয়ে] তারপর?

রাজজ্যো।। দাদা ঘুষি মারার আগেই দাদাকে ঝেড়ে দাও এক ঘুষি। শোন বাবা, পৃথিবীর নিয়ম আর ভগবানের নিয়ম দুটো আলাদা। দুটো আলাদা শাস্ত্র। ভুল করো না ভাগ্যটাই সব নয়। পুরুষকার বলে একটা কথা আছে। মারের বদলা মার প্রেমের বদলা প্রেম। যাও, যাও, বাড়ি যাও, আমাদের এখন একটু অন্য আলোচনা হবে।

লোকটি।। আমি একটু বসে শুনতে পারি?

বড়।। শুনতে পারবে কিন্তু কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।

লোক।। আমার একটাই প্রশ্ন, পাথর চাপা বরাত কি খোলা যায়?

রাজজ্যো।। এই তো, নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়ে দিয়েছ। পাথরটা সরাতে হবে। কেউ সরিয়ে দেবে না। তুমি নিজে সরাবে। পাথর মানে কী? ভারী একটা জিনিস। সরাতে শক্তি চাই। তাহলে একটু আগে বলেছি ডন—বৈঠক মারো। আর ভিজে ছোলা খাও।

লোক।। কোনও ধারণ—টারণ?

রাজজ্যো।। [একটু রাগ রাগ গলায়] হিরে পরাতে পারবে? হিরে! ষাট হাজার টাকা দাম।

লোক।। আজ্ঞে না।

রাজজ্যো।। তাহলে হয়ে গেল।

লোক।। আপনি সকলকেই সব বিধান দিচ্ছেন, আমি গরিব বলে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।

রাজজ্যো।। শোনো, তোমার ওই ক্যাটক্যাটে কথা না ছাড়লে তোমার ভাগ্য ফিরবে না। আসলে তুমি একটা নির্বোধ।

বড়।। তুমি যাবে?

লোক।। না গেলে কী করবেন?

বড়।। ওরে কুসি, এ যে ক্রমশ বাঁকছে।

রাজজ্যো।। আমি এক মিনিটে সোজা করে দিতে পারি।

বৃদ্ধ।। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি। [লোকটিকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন]

বড়।। কতরকমের উৎপাত আছে?

রাজজ্যো।। উৎপাত তো থাকবেই। শোনো, উনুনে দুধ বসালেই ওতলাবে। জান তো ক্রোধ হচ্ছে ষড়রিপুর দ্বিতীয় রিপু। সারা পৃথিবীতে এই ক্রোধের খেলা। [হঠাৎ উঁচু গলায়] শক্তি, শক্তি। জাগো মা।

[ন’বউ চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল]

ন’বউ রেখা।। এই যে চা, তলায় এক চামচে মধু, এই দেখুন রস ছাড়ছে।

রাজজ্যো।। [কাচের গেলাসটাকে আলোর দিকে তুলে] মনটাকে করতে হবে এইরকম স্বচ্ছ। এইরকম উষ্ণ। তবেই না সেই অমৃতস্বরূপিণী মধুক্ষরণ করবেন।

বড়।। আমার কয়েকটা প্রশ্ন ছিল।

রাজজ্যো।। বলো।

বড়।। আমি এমন একটা শক্তি চাই, যাতে সমস্ত মানুষের ভিতরটা দেখা যায়। যেমন এন্ড্রোস্কোপি ছাড়াই আমি মানুষের স্টমাকটা দেখতে পাব। সিস্টোস্কোপি ছাড়াই ব্লাডারের মধ্যে ঢুকে যাব। অ্যাঞ্জিওগ্রাফি ছাড়াই হৃদয়ে প্রবেশ করব। স্ক্যানিং ছাড়াই ঢুকে যাব মানুষের খুলির তলায়।

রাজজ্যো।। এই চাহিদাটা তো জাগতিক চাহিদা। আধ্যাত্মিক কিছু চাও।

বড়।। [ভালোমানুষের মতো] মানুষের দেহটা আধ্যাত্মিক নয়?

রাজজ্যো।। দূর পাগলা পঞ্চভূতের এই দেহ পঞ্চভূতেই মিশে যাবে। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, [বোমা ফাটার মতো] ব্যোম।

[ভিতরে বাসন পড়ে যাবার ভীষণ শব্দ]

কুসি।। যাঃ, সব ভেঙে শেষ করে দিল।

গান্ধারী।। মনে হয় সেই হুলোটা। জানো বড়দা, তোমার মুজাহিদ আজ গোটা একটা মাছ মুখে নিয়ে পাঁচিলে উঠে সাবড়েছে। তুমি যদি শিক্ষা দিতে না পারো আমিই দেব।

রাজজ্যো।। আঃ, সাংসারিক কথাবার্তা কেন রে পাগলি? কার মাছ কে খায়। সবই ভাগ্য।

গান্ধারী।। আজ্ঞে মুখ্যু মানুষ, এই যে একটু আগে বললেন ভাগ্য বলে কিছু নেই।

রাজজ্যো।। সেটা ওই নির্বোধকে বলেছি। জানিস, সমস্ত মানুষই ভাগ্যের চাকায় বাঁধা। রবি, চন্দ্র, বৃহস্পতি, শুক্র, মঙ্গল, বুধ, শনি, কেতু, রাহু। সবসময় জানবে আমরা গ্রহের দাস। তাহলে উপায়? [আঙুল তুলে সেজভাইকে দেখিয়ে] বল টেক্সটাইল মাস্টার উপায়।

[জনে জনে সকলের দিকে আঙুল তুলে বারকতক উপায় উপায় করলেন। তারপর ঠক করে কাচের গেলাসটা টেবিলে রেখে হা হা করে হাসতে লাগলেন।]

রাজজ্যো।। উপায় আছে রে, উপায় আছে। সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ। [আবার সকলের দিকে একে একে তাকিয়ে] মানে? [অল্প হেসে] কেউ জানো না। কেউ জানো না। একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন আর্টিস্ট, একজন দার্শনিক। সেই দার্শনিকটি কোথায়?

[মেজভাই ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবেশ করলেন]

মেজ।। এই যে আমি। অনেকদিন পরে এলেন।

রাজজ্যো।। অধ্যাপক, গীতার শেষ শ্লোকটা বলো তো।

মেজ।। আজ্ঞে, সেই সর্বধর্মাণ পরিত্যজ্য?

রাজজ্যো।। হ্যাঁ, ওর মানে কী?

মেজ।। শ্রীভগবান বলছেন, তুমি সকল প্রকার ধর্ম ও অধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমাকেই আশ্রয় করো।

রাজজ্যো।। ব্যস, ব্যস, ব্যস, ওই জায়গাটাতেই ধরো। আমাকেই আশ্রয় করো। এই আমিটা কে?

মেজ।। এই আমিটা শ্রীভগবান।

রাজজ্যো।। হুঁ হুঁ, হল না। এটা সেই চিরাচরিত ব্যাখ্যা। এই আমি হল তুমি নিজে। নিজেকে ধরো। নিজেকে ধরলেই দেখতে পাবে পাপও নেই, পুণ্যও নেই। কর্মও নেই, অকর্মও নেই। প্রেমও নেই, ঘৃণাও নেই। আছে শুধু ইন্দ্রিয়। ছটি ফোকর দিয়ে জগৎ আর জীবনকে দেখছ বাবাজীবন। ছটা জানালায় ছ’রকমের কাচ। একটা লাল, সেটা কাম, একটা ক্রোধ, সেটা হল কমলালেবুর রং, একটা লোভ, সেটা হল পিত্তি রং, একটা মোহ, সেটা হল ধোঁয়াটে রঙ। আর একটা মদ, সেটা হল মদের রঙ। আর একটা মাৎসর্য, সেটা হচ্ছে কুচকুচে কালো। যে জানলায় চোখ রাখবে ঠিক সেই রঙের পৃথিবী দেখবে। তাহলে উপায়? এ দেহটাকে তো নাশ করা যায় না। যায়? যায় না। বড়ো প্রেমের জিনিস, বড়ো প্রিয় জিনিস। তাহলে উপায়?

মেজ।। নিরুপায়।

রাজজ্যো।। ধুৎস। পণ্ডিত মানুষ হয়ে এই কথা, উপায় থাকবে না? সবকিছুর উপায় আছে। তাহলে শোনো শ্রীভগবান কী বলছেন—ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ। মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যোবুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ। মানেটা কী?

মেজ।। সত্যি কথা বলব। গীতা আমি তেমন পড়িনি। সংস্কৃত আমার জিভে জড়িয়ে যায়।

রাজজ্যো।। শোনো, ইন্দ্রিয় হল শ্রেষ্ঠ। কোনও সন্দেহ নেই ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ। তুমিও জানো, আমিও জানি, রামও জানে, শ্যামও জানে। সব মানুষই জানে। কারা জানে না? বল, জানে না পশুরা। তা ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ হল তো কী হয়েছে। ইন্দ্রিয়ের ওপরে তো বসে আছে মন। আরে বেটা মনই তো ইন্দ্রিয়গুলোকে চালাচ্ছে। তুমি গাড়ি চালাচ্ছ, তোমার ফ্যাক্টরিতে তুমি মানুষ চালাচ্ছ। সেইরকম ইন্দ্রিয়কে চালাচ্ছে মন। চালাক। চালাতে দাও। মনের মাথার ওপর তো বুদ্ধি বসে আছে। মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। এইবার বুদ্ধি তুমি যাবে কোথায়। বুদ্ধির মাথার ওপরে বসে আছে আত্মা। শুধু আত্মা নয় বলো পরমাত্মা। যেমন তোমাদের মাথার ওপর বসে আছেন তোমাদের বড়দা। সেই পরমাত্মার সঙ্গে বন্ধুত্ব করো। তাকে সন্তুষ্ট করো। [হঠাৎ সুর ঘুরিয়ে] একটু যেন খিদে খিদে পাচ্ছে।

কুসি।। কী খাবেন বলুন?

রাজজ্যো।। এই দেখো বোকা মেয়ে। খিদে পেলেই খেতে হবে? এটা কি মামার বাড়ি? দেহগত আত্মা অর্থাৎ জীবাত্মা যেই হুকুম করবে এইটা আমার চাই, সঙ্গে সঙ্গে সেটা দিয়ে দিতে হবে? পাগল, পাগল কোথাকার। দেবো না। ।[চিৎকার করে] কিছুতেই দেবো না। তুমি যা চাইবে ঠিক তার উলটো পাবে। তোমাকে উপোস করিয়ে মারব। বুঝলে কিছু। এটা টেকনোলজির যুগ। এটাই টেকনিক। নিজের কাছে সরে আসা। এক থাপ্পড়ে, এক থাপ্পড়ে ।[আরও জোরে] সব ঠান্ডা।

গান্ধারী।। আপনি মাঝে মাঝে ওরকম আচমকা চেঁচিয়ে ওঠেন কেন?

রাজজ্যো।। এই মেয়েটা ধরেছে। চমকে দেব বলেই আচমকা চেঁচাই, তা না হলে ভিতরে যে সব ঘুমিয়ে পড়বে। ওঠো, জাগো। কাকে বললুম? নিজে কিন্তু উঠছি না। বসে আছি, বসে থাকব। তাহলে কাকে বললুম? ভেতরে যে আছে তাকে।

পরমা।। আমার একটা প্রশ্ন ছিল।

রাজজ্যো।। প্রশ্ন করতে হবে কেন মা? আমি তো সব জানি। এই ঘরে যারা বসে তাদের সকলের মনের কথা আমি জানি। তুমি বলতে চাইছ তোমার কর্তার শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না। রাতে ভালো ঘুম হয় না। ভোরের দিকে একটু ঘুমোয়। তাও পাতলা ঘুম, স্বপ্নে ভরা। কেন হবে না? এ যে যুগের ধর্ম। আকাঙ্ক্ষা। আমি একটা গান গাইব।

কুসি।। গান না, গান না, হারমোনিয়াম আনব?

রাজজ্যো।। কোনো দরকার নেই। সব বাদ্যযন্ত্র আমার গলায়, গানটা মন দিয়ে শোনো, উত্তর পেয়ে যাবে। অকারণ মন আশা/কোর না কোর না/যতই করিবি আশা/মিটিবে না সে পিপাসা/অপার সে আশা নদী/তাও কী মন জান না/ভিখারী বাসনা করে/হইতে চায় লক্ষপতি/লক্ষপতি হলেও সে হইতে চায় কোটিপতি/ইন্দ্রত্ব লভিলেও সে শিবত্ব করে কামনা।[গান শেষ, দমকা কাশি]।

সবাই সমস্বরে।। কী হল, কী হল?

রাজজ্যো।। [কাশির ফাঁকে কোনোরকমে বললেন] ম—ম—মশা ঢুকে গেছে।

বড়।। [দুঃখের গলায়] তোরা কিছু স্প্রে করিসনি? তোদের নিজে আমি আর পারব না। পারব না। শিগগির একটু জল নিয়ে আয়।

রাজজ্যো।। [কোনোরকমে] গিলব না, গিলব না, ম্যা, ম্যা।

বড়।। [সঙ্গে সঙ্গে] ম্যালেরিয়া হবে না, ম্যালেরিয়া হবে না। এখানে একটা মশাও ম্যালেরিয়ার নেই। সব মেল মসকুইটো। আপনি ক্যাপসুলের মতো ঢোঁক করে গিলে ফেলুন।

রাজজ্যো।। [মুখব্যাদান করে বারতিনেক হাঃ হাঃ হাঃ করলেন।]

মেজ।। এটা মনে হয় জীবাত্মার কাজ। পরমাত্মার গলায় মশা ঢুকতে পারে না।

রাজজ্যো।। এই ধরেছ ঠিক। ওই যে তিনবার হাঁ করলাম, ওইটাই পরমাত্মা।

এই যে একটু আগে বলছিল না নাভি শ্বাস। সেই নাভিরশ্বাস দিয়ে মশাটাকে অনন্তে উড়িয়ে দিলুম।

[কোথায় ঢ্যাং করে একটা শব্দ হল]

রাজজ্যো।। শব্দটা শুনলে? কোথায় হল?

বড়।। আজ্ঞে কাছাকাছি কোথায়।

রাজজ্যো।। আরে না, শব্দটা আমি করলুম। একেই বলে অনন্তের সমাপ্তি ঘণ্টা। [কুসির দিকে তাকিয়ে] ও মেয়ে, জীবাত্মা যে এবার ফুলকো লুচি খেতে চাইছে। গাওয়া ঘিয়ের সুগন্ধ, জীবাত্মাই ওটা পরমাত্মার দিকে ঠেলে দেবে।

গান্ধারী।। [বোকার মতো] আপনার ঘোড়াটা কী খাবে?

রাজজ্যো।। [মুচকি হেসে] ফচকে মেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *