মানব-মানবী – শিহাব সরকার
পুরো এক সপ্তাহ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করার পর শায়লার চোখে স্বামীর চলাফেরা ও আচার ব্যবহারে কিছু পরিবর্তন ধরা পড়লো। নটা-পাঁচটা অফিস আরিফের। মাঝারি গোরে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় অ্যাকাউনট্যান্টের চাকরি—নেহাত অসুস্থ না হয়ে পড়লে বা বাড়ি থেকে হঠাৎ কোনো দুঃসংবাদ না এলে পাঁচটা বাজার এক মিনিট আগেও অফিস ছাড়ার উপায় নেই। সারাদিনের হিসেব-নিকেশ মিলিয়ে বেরুতে বেরুতে ওর প্রায়ই ছ’টা-সাতটা হয়ে যায়। তারপরও যে সোজা বাড়ি ফেরে তা-ও নয়। শায়লা জানে আরিফ বারে যায়। অবশ্য এতে ওর কোনো আপত্তি নেই। অভ্যাস। তাছাড়া ওর বাবাকেও দেখে আসছে ছোটবেলা থেকে—একটা হালকা বুজ রং-এর গ্লাস থেকে চুক চুক করে খাচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন ড্রইংরুমে, ঠাট্টা-মস্করা করছে টিভির কোনো প্রোগ্রাম নিয়ে। সুতরাং এ ব্যাপারে শায়লার সংস্কার ভেঙেছে। বিয়ের অনেক আগেই।
বারে যাওয়া সম্ভব না হলে অফিসেরই কপিরাইটার আমজাদের খালি বাসায় আসর শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আরিফের রাত এগারোটা হয়ে যায়। প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার। বিয়ের নি বছরের মধ্যে একবার জন্ডিসে ভুগে এক নাগাড়ে দশদিন বিছানায় পড়ে থাকা ছাড়া বছরে একটা দিনও এর আগেও বাড়ি ফেরে না। বিয়ের পর একদিন ব্যাপারটা নিয়ে ওর সঙ্গে শায়লার কিছু মন কষাকষি হয়েছিলো। রাগ করে একবার পর পর দু’রাত আরিফ বাড়িই ফিরলো না। এরপর থেকে শায়লা চুপ। আরিফ চরিত্রহীন নয়। বউ এবং ছেলে রিকুকে আর দশজন পুরুষের চেয়ে বেশিই ভালোবাসে।
১২ জুন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর শায়লা শুয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস পড়ছিলো। স্কুলে গরমের ছুটি। পাশে এক বছরের রিঙ্কু খুব আগ্রহ নিয়ে একটা বই ছিড়ছে। এমন সময় কলিং বেলের শব্দ। উঠে দরোজা খুলতেই শায়লা অবাক। আরিফ। কী হলো তোমার? চলে এলে যে? কোনো কথা না বলে আরিফ ঘরে ঢোকে। তারপর ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বলল, মাথা ঘুরছিলো। অফিসে বসতে পারছিলাম না। শায়লা ভয় পেয়ে যায়। আবার জন্ডিস নয় তো? দেখি, তোমার চোখ দেখি বলতে বলতে শায়লা স্বামীর বুকের সঙ্গে লেগে গিয়ে ওর এক চোখের নিচের অংশটুকু টেনে ধরে। নাহ! চোখ তো ঠিকই আছে। জ্বর জ্বর লাগছে? শায়লা একই সোফায় আরিফের পাশে বসে পড়ে।
না, তেমন কিছুই হয় নি। বারোটার দিকে মাথাটা কেমন জানি হঠাৎ ঘুরে উঠলো। রিঙ্কু কই? আরিফ দু’হাতে কপালের দু’পাশ চেপে ধরে বললো।
রিঙ্কু খেলছে। তুমি শুয়ে পড়ো। বলতে বলতে শায়লা গেলো রান্নাঘরের দিকে। সেদিন আরিফ আর বেরুলো না।
দ্বিতীয় দিনও একই ব্যাপার। আরিফ ফিরলো চারটের দিকে। বললো, মাথা ঘুরছে। কিন্তু দুদিন তারিফের চেহারায় শরীর খারাপ বা অসুখের কোনো লক্ষণ চোখে পড়লো না শায়লার। সাতটা পর্যন্ত সটান, নিশ্ৰুপ শুয়ে থেকে ও ড্রইংরুমে গিয়ে বসে টিভির সামনে। রোববারে সকালের দিকে ছাড়া টিভি দেখে না ও। এ দুদিন আরিফকে খুব মনোযোগ দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা ও শিশুদের প্রোগ্রাম দেখে শুরু করে বাংলা-ইংরেজি খবর, বিদেশি ছবি, রাজ্যের বিজ্ঞাপন, সাক্ষাৎকার ইতাদি প্রায় সবকিছু দেখতে দেখে দারুণ অবাক হয় শায়লা। ভালোও লাগে। এতো দীর্ঘ সময় ধরে স্বামীকে কাছে পায় নি ও অনেকদিন।
১৪ জুন রাতে বিছানায় আরিফকে জড়িয়ে ধরে শুতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলো শায়লা। সেই পুরনো মিঠেকড়া গন্ধটা নেই। নিটে বছর প্রায় প্রতিদিন এই বিশেষ গন্ধটা অতিক্রম করে ও আরিফের আগুন স্পর্শ করেছে। এই গন্ধ তাকে ঘুম পাড়িয়েছে রোজ। মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিলো আরিফ। ওর মুখের ওপর কুঁকতে গিয়ে সিগারেটের গন্ধ পায় শায়লা। আরিফ চোখ বুজে পড়ে ছিলো। মুখের ওপর শায়লার খোলা চুলের এক গোছা ঝপ করে পড়তেই ও চোখ খুললো।
কী খাও না আজকাল? শায়লা ডিম লাইটে মদু হেসে জিগ্যেস করে।
ভাল্লাগে না। আরিফও হাসলো বলে শায়লার মনে হয়।
চারদিন পর একটা বোতল নিয়ে আমজাদ এসে হাজির। তখন সবে সন্ধে হয়েছে। বাইরে বৃষ্টি। অফিসের কলিগকে দেখে কোনোরকম উচ্ছ্বাস দেখালো না আরিফ। বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলো আমজাদ। উদাস এক জোড়া চোখ মেলে আরিফ শুধু ওকে একবার মাথা মুছে নিতে বললো। পাশে বসা শায়লার সঙ্গে চোখাচোখি হয় আমজাদের। আরিফ মন দিয়ে টিভি দেখছে। পায়ের কাছে হামাগুঁড়ি দিচ্ছে রিঙ্কু। সেদিনই: আমজাদের মুখে শায়লা শুনলো, অফিসে ওর স্বামীর ওপর কারণ দর্শাও নোটিস জারি হয়েছে। অফিসের মতে, আরিফুল হকের যুক্তিহীন অনিয়মের জন্য কোম্পানিকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দু’দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব না দিলে কর্তৃপক্ষ ওকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হবে। শায়লার মুখ এক মুহূর্তে ফ্যাকাশে। চোখে পানি এসে যাচ্ছিলো। মরিয়া হয়ে শেষে ও কাঁদো কাঁদো গলায় আমজাদকে জিজ্ঞেস করে, কী হলো বলুন তো? একটা কিছু বলার জন্য আমজাদ অনেক পীড়াপীড়ি করার পর আরিফ একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। শুকনো ও দুঃখী-দুঃখী হাসি। এক পলকের জন্য আরিফকে আমজাদের ভীষণ একা ও অসহায় মনে হলো। কিন্তু ও একবার টিভি, একবার শায়লার মুখ—এরকম বার কয়েক তাকিয়ে কোনো কারণ বের করতে পারে না। কাল একবার ফিসে যাস আরিফ। আর এটা রেখে গেলাম। সাদা জিনের বোতলটা টিপয়ে ঠক করে রেখে আমজাদ দরোজার দিকে এগুলো। শায়লা কিছু বলার আগেই লম্বা লম্বা পা ফেলে ও রাস্তায়। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে।
আহ্, হাবিব ছাড়োয় পরিষ্কার শায়লার কণ্ঠ। নিজের কানে শুনেছে আরিফ। রাত তিনটেয় শায়লা, আমি তোমার গলায় পরিষ্কার শুনেছি—পরিষ্কার শুনেছি, বিড় বিড় করতে করতে সায়েন্স ল্যাবরেটরির পাশ ঘেঁষা ফুটপাত ধরে আরিফ হেঁটে যাচ্ছিলো। ধু ধু করছে বেলা দুটোর দুপুর। একটা খালি রিকশাও চোখে পড়ে না। রায়ের বাজার। থেকে এতোটা পথ ও হেঁটে এসেছে। ঘামে জবজব করছে গা। হাবিব, হাবিব। আরিফ আবার বিড়বিড় করে অজান্তেই ওর হাঁটার গতি বেড়ে যায়।
তিনদিন ধরে খাওয়া একটু বেশি হয়ে যাচ্ছিলো। জার্মানি থেকে সুহাস এসেছে পাঁচ বছর পর। উঠি উঠি করেও আরিফ আমজাদ ওখান থেকে ছুটতে পারছিলো না। সুহাস পুরনো বন্ধু। একসঙ্গে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। ওর সঙ্গে খেতে খেতে মন খুলে পুরনো দিনের গল্প করার লোভ ছাড়াও সহজ নয়। এমনিতে আরিফ চাপা স্বভাবের। কিন্তু দুতিনটে পেটে পড়ার পর ওকে আর চেনাই যায় না আমজাদও সঙ্গী হিসেবে চমৎকার। চুটিয়ে আড্ডার পর তিনটে রাত আরিফের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় একটা হয়ে যাচ্ছিলো।
আজকাল ওদের একবারের বেশি হয় না। কিন্তু সেদিন প্রথমবারের পর আরিফ বিছানা ছেড়ে উঠে এলো ড্রইংরমে। খুব হালকা এবং ফুরফুরে লাগছিলো। টু-ইন ওয়ানে ডোনা সামার চড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বইপত্র ঘাঁটঘাঁটি করে। ঘন্টা দুয়েক কিছু পাঁচমিশেলি গান শোনার পর আরিফ আবার শুতে যায়। ঘুম আসছিলো না। রিঙ্কু দলামলা পাকিয়ে খাটের একেবারে কিনারে শুয়ে আছে। ওকে কিছুটা ভেতরের দিকে টেনে আনলো আরিফ। শায়লা ওর পুরনো ভঙ্গিতে ডানদিকে ফিরে শোয়া। মাথার কাছে ধবধবে সাদা ব্রা ডিমলাইটেও স্পষ্ট দেখা যায়। হাঁটুর অনেকদূর পর্যন্ত শাড়ি উঠে আসায় ওর ফরসা পা দুটো ঠাণ্ডা সাদা বাতির মতো আভা দেয়। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর পারলো না আরিফ। প্রথমে শায়লার পায়ের পাতা থেকে আলতো হাত বুলিয়ে উরু পর্যন্ত টেনে আনলো। আহ্, কী গরম। তারপর ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো আচমকা। আর ঠিক তক্ষুণি, রাত তখন তিনটে (দুরে ঘন্টা বাজছিলো)—আহ্ হাবিব ছাড়ো। প্লিজ ছাড়ো! শায়লার কণ্ঠ। ছিটকে উঠে আসে আরিফ। কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত স্ত্রী দিকে। ধ্রুপদী ভঙ্গিতে একটা অদ্ভুত তরঙ্গ শায়লার শরীরে দোল খায়, ঠোঁট ফুরিত হয়, দেখা যায় ওর ঝকঝকে দারে মুক্তো। দৃশ্যটা আরিফ উপভোগ করছে না, ওর শরীরে কোষে কোষে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিষ—আরিফ সে মুহূর্তে বুঝতে পারলো না।
হাঁটতে হাঁটতে আরিফ যখন পুরনো রেসকোর্সের কাছে এলো, হঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টি। অনেকক্ষণ ধরে আকাশ কালো হয়ে আসছিলো, ও খেয়াল করে নি। আর্ট কলেজের একপাল ছেলেমেয়ে হৈচৈ করতে করতে ঢুকে গেলো গেটের ভেতরে। বৃষ্টিতে ভেজা সহ্য হয় না আরিফের। এছাড়া চুলের ব্যাপারে ও এতো সচেতন যে, রাস্তায় চলার সময় আকাশে কালো মেঘের ছিটেফোঁটা দেখলে ও রুমালে মাথা ঢেকে নেয়। আজ ও কিছুই করলো না। কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রায়-ডজন দুয়েক মানুষের চোখের সামনে দিয়ে ও নেমে গেলো মাঠের ভেতরে। আষাঢ়ে ঢল। পাঁচ মিনিটে ও ভিজে ন্যাতা হয়ে যায়। সিমেন্টের পেল্লাই সাইজের ছাতার নিচে কয়েকটা পাতাকুড়ুনি ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আরিফের এমন নিশ্চিন্তে, বৃষ্টির ভেতরে হেঁটে যেতে দেখে খি খি করে হেসে উঠলো একটা পিচকে ধরনের কিশোরী। সঙ্গে সঙ্গে হাসির ছররা। অই সার, কই যান এই ম্যাগের মাইজে। পাগল অইলেন নি?’ বয়সে কিছু বড়ো একটা ছেলে ওকে চিৎকার করে বলল। উত্তরে ওদের দিকে তাকিয়ে আরিফ সামান্য হাসার চেষ্টা করে। ওরা কী বুঝলো কে জানে। আর কোনো ডাকাডাকি হয় না। ভেজা সবুজ ঘাসে ছপ ছপ শব্দ তুলে আরিফ মাঠের ভেতরে ঢুকে গেলো।
ইউনিভার্সিটিতে একট ডিবেট কম্পিটিশনে শায়লার সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছিলো। দেখতে আহামরি কিছু নয়, কিন্তু সারা মুখ জুড়ে এমন একটা মায়ামাখানো যে, প্রথম দেখাতেই আরিফ আটকে গেলো। শায়লা দলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বলে। কথা অল্প, যুক্তি বেশি। তবুও ডিবেটে জিতলো আরিফরা। রেজাল্টের পর শায়লাকে একটা সান্ত্বনাসূচক ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে আরিফের ভীষণ খারাপ লাগে কী দরকার ছিলো জেতার! ও আমার চেয়ে ভালো বলেছে। অন্য মেয়ে। নিটেও মন্দ নয়। আপনি চমৎকার বলেছেন, প্রায় ফাঁকা অডিটোরিয়ামের এক পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলার সময় আরিফ দু’চোখ স্থির রেখেছিলো শায়লার চোখের ওপরে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। এক চুল নড়তে পারে না।
একটা উদোম পাগল মাঠময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঠের মাঝখানে গভীর ডোবাটা পানিতে টইটুম্বুর। বিশাল কালীমন্দিরটা ডোবার ডানে না বাঁয়ে ছিলো, আরিফ ভাবতে চেষ্টা করে। একাত্তরে সাতাশে মার্চ সকালে মন্দিরের উঠোনের দৃশ্যটার কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। একসঙ্গে এতোগুলো লাশ এর আগে ও কখনো দেখে নি। বীভৎস। বৃষ্টির ছাট কমে আসে। ঝাকড়া চুল জট পাকিয়ে আরিফের। কপালে এসে পড়ে। গা কুট কুট করছে। হাঁটা যাচ্ছে না। ঘাস এবং পানিতে স্যান্ডেল কেবল আটকে যায়। পাগলটা হঠাৎ দেখে ফেলে আরিফকে। তারপর তেড়ে ছুটে আসে। কী যেন চিৎকার করে বলে, আরিফ বুঝতে পারে না, দৌড় দেয় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের সামনে এসে ও থামলো। পাগলটা এতোদুর আসে নি। আবার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে ওকে দু’হাত আড়াআড়িভাবে দু’পাশে তুলে দিয়ে রকির মতো ঘুরতে দেখলো আরিফ। শালার পাগল। মনে মনে বললো ও।
ঐদিন রাতের ঘটনার পর সকাল পর্যন্ত আরিফ ঠায় জেগে থাকলো। ভোরের সামান্য আগে ও চোখ বোজে। সাতটার দিকে শায়লা যখন রোজকার মতো খাটের পাশে টিপয়ে শব্দ করে চায়ের কাপ রাখে ও চোখ খুলে তাকায়। গোসল সেরে এসেছে শায়লা। সাবানের গন্ধে ভুরভুর করে সমস্ত ঘর। ফিকে গোলাপি শাড়ির মধ্যে ওর সদ্য ঘুম ভাঙা মুখখানা বড় কচি এবং পবিত্র মনে হয়। ঐ মুহূর্ক্সে জন্য রাত্রে ব্যাপারটা ভুলে যেতে চেষ্টা করে আরিফ। নাস্তা খেয়ে অফিসে যাওয়ার সময় অনেকদিন পর ও শায়লাকে চুমু খেলো।
কেউ রাস্তার ওপাশে অন্য এক রিকশা থেকে আরিফের নাম ধরে ডাকলো। বোঝা গেলো না। এবার সামান্য বিব্রত বোধ করে ও। অফিসের কেউ এ অবস্থায় দেখে ফেললে একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে যাবে। শাহবাগের কাছে এসে রিকশাকে রায়ের বাজার যেতে বলে যতটা সম্ভব রাস্তার বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো আরিফ।
ইউনিভার্সিটিতে ও ছাড়াও দুটো ছেলের সঙ্গে শায়লার আলাপ ছিলো। এদের কোনটা হাবিব? একজনকে জানতো ক্রিকেট খেলে। অপরজন একটু উদাসীন ধরনের। ইচ্ছে করলে ও নাম জেনে নিতে পারতো। পরিচয়ও হয়তো হতো? কিন্তু একটা অস্তলীন ঈর্ষা ওকে শায়লার সামনে ছেলে দুটোর ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাতে দেয় নি। পরে অবশ্য শায়লা সবার থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে আনে। ও তখন পুরোপুরি আরিফের।
হুবহু শায়লার মতো দেখতে একটা মেয়ের মুখ দেখা গেলো দ্রুত ছুটে যাওয়া একটা গাড়ির ভেতর। পাশে বসা লোকটা ঐ দুই স্কাউড্রেলের একজনের মতো দেখতে। ঘাড় ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আরিফ। মনে মনে ও এক ঝলক শায়লার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখে নেয়। গত ক’দিন ওর অদ্ভুত ব্যবহারে ভয় খেয়ে যাওয়া একটা মুখ। চোখদুটো পানিতে টলটল করছে। বাহ্ বাহ্ চমৎকার। লে লাপাকে, জোরে বলে উঠলো আরিফ। রিকশাঅলা চমকে পিছনে ফিরে তাকালো, ‘কী কইলেন সাব, লেকের পার?’ ‘ওনা কিছু না। তুমি যাও’, বোকার মতো হাসলো আরিফ।
ক্ষিদেয় মরে যাচ্ছিলো শায়লা। টেবিলে রাখা খাবার আর কিছুক্ষণ পর মুখে দেয়া যাবে না। এমন বৃষ্টি। ভাতে ছাতা পড়ে যাচ্ছে হয়তো।
দেড়টার দিকে হঠাৎ কাপড় চোপড় পরে ঘরে পায়চারি করছিলো আরিফ। সে কী, এখন বেরুবে না-কি? লাগোয়া রান্নাঘর থেকে গলা বাড়িয়ে শায়লা জিজ্ঞেস করে। একটু আমজাদের ওখানে যাচ্ছি। এক্ষুণি চলে আসবো।
রান্না হয়ে গেছে। খেয়ে যাও। স্বামীর এই আচরণের কোনো কারণ খুঁজে পায় শায়লা। না, এসে খাবো। আর আমার দেরি হলে তুমি খেয়ে নিও। বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না আরিফ। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সাধারণত দুটোর মধ্যে খাওয়া সেরে নেয় শায়লা। স্কুল থেকে কোনোদিন ফিরতে দেরি হলে বড় জোর তিনটা। আরিফ তখন অফিসে থাকে। খায় পাশের কোনো রেস্তোরাঁয়। ওর লাঞ্চ আওয়ার এক ঘন্টা। রায়ের বাজার থেকে মতিঝিলে আপ-ডাউন এবং খাওয়া ব মিলিয়ে সময় লাগে দেড় ঘন্টার বেশি। সুরাং দুপুরে বাসায় যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। শুধু রোবার দিন একসঙ্গে খাবার জন্য সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নেয় শায়লা। এখন বিকেল পাঁচটা। মাথা ধুরছিলো শায়লার। রিঙ্কু ঘুমুচ্ছে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে। ছটফট করতে করতে ও বারান্দায় চলে এলো। কোথায় গেল মানুষটা? এমন সময় দূর থেকে একটা রিকশায় আরিফকে দেখা যায়। আজ একটা এসপার ওসপার হয়ে যাবে। প্রেম করে বিয়ে করেছে বলে মাথা কিনে নেয় নি। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে শায়লা। আরিফের রিকশা বাসা থেকে বেশ কয়েক গজ দূরে এসে থামলো। আর এগুবে না। বৃষ্টির পানি জমে ঢাল রাস্তা, পাশের মাঠ, ডোবা একাকার।
রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে আরিফ শায়লার দিকে মুখ ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। স্বামীর ভেজা উদভ্রান্ত অবস্থা দেখে চমকে যায় শায়লা। বৃষ্টিতে ভেজার লোক নয় আরিফ, পানি লাগার ফলে ওর চুল চুপসে গিয়ে মাথার সঙ্গে লেপ্টে আছে। রোকেয়া হলের সামনে এক শ্রাবণের বিকেলে একটা কাক-ভেজা পাগল গাড়ি চাপা পড়েছিলো। মেয়েরা বলছিলো আত্মহত্যা।
প্যান্ট না গুটিয়েই আরিফ আধ হাঁটু পানি ভেঙে বাসার দিকে আসতে থাকে, শায়লার চোখে চোখ পড়তে ও হাসলো। হাসিটা শায়লার কাছে অচেনা লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ও টের পায়, ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা সরু হিমেল স্রোত বয়ে যাচ্ছে।