অষুধ – শহীদ আখন্দ
কিছুদিন ধরে ঘটছিল কাণ্ডটা। রাতের খাবারটা কোনমতে গিলে কুলিটা মুখে নিয়েই সেই যে ঘর থেকে একলাফে নিচে নামে তারু মিয়া আর পাত্তা পাওয়া যায় না তারপর। ফেরে অনেক রাতে চোরের মতো। কপাটের উপরের ব্যাঙটা আর লাগায় না। সুরুয বানু, মানুষটা বাইরে আছে যখন কি জানি কত রাত হয় ফিরতে, নিচের ব্যাংটা বরং বাইরে থেকে খোলা যায়। চোরের মত কখন ফেরে রাতে, সুরুয বানু টের পায় মাঝে-মাঝে, টের পায়না কোনদিন। প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি সুরুয বানু, সারাদিন খাটে বন্ধে বাইরে, সন্ধ্যেবেলায় কোথাও একটু গিয়ে তামাক টানল, গপ্পো-টপ্লো মারল তাতে গা চুলকানোর কি আছে! কিন্তু আস্তে আস্তে ঘটনাটা কেমন চোখে ঠেকছে। মনে ঠেকছে। সন্ধ্যা থেকে এত রাত পর্যন্ত কোথায় কোন রসের এমন ভাণ্ডার আছে যে, খালি বিছানায় তাকে এমন খালি গড়াগড়ি খেতে হবে আর বার বার দরজার দিকে কোন পরিচিত শব্দের জন্য কান পেতে পেতে কাহিল হয়ে পড়ে ঘুমাতে হবে? সে জায়গাটা কোথায়? সুরুয বানু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, খায়া কুলিটা ফালানির তর সয়না কই যাওয়ার জন্য এমুন পাগল হন, রুজ রুজ রাইতের বেলা?
উঠানে নেমে ডালিমতলায় চলে গেছে ততক্ষণে তারু মিয়া। ওখান থেকে কি রকম একটা মিনমিন করে চিবানো জবাব দিল টের পাওয়া গেল না। পরদিন সারাদিন সুরুয বানু তক্কে তকে থেকেছে ভাল করে কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যে ভাল করে। একটা জবাব পাওয়া পর্যন্ত বুকের ভিতরে একটা অচেনা দুপদাপকে কিছুতেই দূরে সরাতে পারছে না। কিন্তু সারাদিন তাকে একান্তে পাওয়া খুব কঠিন কাজ। শাশুড়ি আছে, দেবর ননদ আছে, আছে সারাদিন গুচ্ছের কাজ। হাঁড়ি ঠেলাঠেলি, ধান শুকানো, রকারি সাজানো। অথচ সারাটা দিন তার কিছু ভাল লাগেনি। মনে হয়েছে ডালিম গাছের পাতাগুলো হঠাৎ কবে-হলদেটে হয়ে গেছে। ধরতে ধরতে সেই রাতে খাবার সময়। ভাত দিয়েই প্রশ্নটা করল সুরুয বানু, কই যান কইলেন না?
কইলাম যে কালকে! অবাক হয় তারু মিয়া।
কি কইলেন, বুঝলাম না। ভাল কইরা কন।
আমার কথা তুমি বুঝ না?
তারুমিয়া তার বড় বড় চোখ মেলে এমন করে তাকাল, মুহূর্তে বিভ্রম হলো সুরুয বানুর। এবং তার ফলে একটু হেসে বিষয়টাকে হালকা করতে চায় সে, বলে, কথা পরিষ্কার কইরা না কইলে কেমনে বুঝব কন।
তারু মিয়া বলে, সব কথা পরিষ্কার কইরা কওয়া যায়?
ঘরে এসে আবার ঢোকে তারু মিয়া। ফিসফিস করে বলে, বাজারে নতুন এক বুড়া আইছে কবিরাজ। অনেক রকমের অষুধ জানে।
ব্যস এক কথায় সুরুয বানুর সমস্ত দ্বন্দ্ব কেটে ফর্সা হয়ে গেল। পেটের ভিতর কোন গুমর রাখতে নেই। রাখলে নিজেরও কষ্ট পবেরও কষ্ট।
কিন্তু প্রতিদিন যেতে হবে কেন? কিছু কিছু কথা কানে আসছে তার যার ফলে সমস্ত ব্যাপারটাকে আর হালকা করে দেখা যাচ্ছে না। সত্য, তাদের সাড়ে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে কোন আনন্দ আসেনি কোলে-পিঠে। যখনই গরীব মানুষের কোন বউয়ের দিকে তাকায় সুরুয, মনটা খাঁ-খাঁ করে ওঠে। অভাগিদের এতো এতো তার একটাও নেই। পাড়ার কোন মেয়েকে বাচ্চা-কোলে দেখলে তার তলপেটে মোচড় দিয়ে ওঠে, হাত প্রসারিত হয় আপনা-আপনি। স্বামী আর শাশুড়ি বিশেষ করে এই দুজন মানুষ তাকে যত ভালবেসেছে এমন আর কেউ বাসেনি। এই দুজন মানুষ এখন যেন সমস্ত মায়া মহব্বত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শিকেয় যত্ন করে সাজিয়েছিল যেন এক বিচিত্র সুন্দর বৈয়ম এখন কে যেন শিকে খালি করে ফেলেছে, বৈয়ম নেই। বয়সের ভারে, বাতাসের ভারে ঝুলছে ন্যাংটা শিকে।
তারু মিয়া চেষ্টা করছে করুক। কিন্তু রোজ রাতের বেলা এত রাত পর্যন্ত। কবিরাজ বাড়িতে কি করতে হয় তার?
সুরুয বানুর এখানে বিশ্বাসী মানুষ নেই। বাপের বাড়ি থেকে খবর দিয়ে একটা মানুষ আনতে হলো। মদন। বিশ একুশ বয়েস। বড় চটপটে। কাজের। বিশ্বাসী।
বাজার বেশি দূরে নয়। বাড়ি থেকে বাইরের উঠান পার হয়ে উত্তরদিকে মোড় নিলেই তো আব্বার কবর। যেখানে এলে দিন হোক রাত হোক গা ছমছম করে। তারপর বুড়ি আম গাছ। কতোকাল ওর আম খেয়েছে তারু, ওর গায়ে চড়ে, ঘাড়ে চড়ে বুকে বসে। অন্ধকারে গাছটাকে ভূত-ভূত লাগে। তারপরই জেলা বোর্ডের রাস্তা, পুবে-পশ্চিমে। না এই রাস্তায় রাত হোক বিরাত তোক কোন ভয় নেই এলাচিপুরের মানুষের। এখানে না আছে কোন গোপনীয়তা, না কোন ফাটাফাটি। দদিকের ধান ক্ষেত রোদের মতো ফর্সা। রাতে শীতল বাতাস। পশ্চিম দিকে ফার্লং খানেক হাঁটলেই হাট বাজার। শনি-মঙ্গল হাট বসে। রোজ সকালে বসে দধের হাট। আর সকাল সন্ধ্যা কয়েকটা চায়ের দোকান, একটা অষুধের দোকান হা করে থাকে। ইস্কুল কলেজের কিছু নতুন ছেলেছোঁকরা ওখানে গুলতানি মারে। অদূর যেতে হয় না তারু মিয়ার। বাজারে ঢুকতেই আগে যে একটা ঘর ছিল ছোট, হরদম মজত থাকতো নানান জাতের জিনিসপত্র। আর পঞ্চাননের হাসি মুখ, সেইটে। ঘরটা একটু বড় হয়েছে। এখন। ঘরটার সামনে দিয়ে গেলেই বিভিন্ন অদ্ভুত জিনিসের আনচান করা গন্ধ নাকে লাগে। সেই গন্ধের টানে ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে। না, তারু মিয়া ওখানে নিজের ইচ্ছায় ঢোকেনি।
বাজার হইল বড় মানুষের পুত?
কথা শুরু করার কায়দা বটে।
হ-হ, চাচা।
তামুক খায়া যাবা একখান?
মন্দ কি? ঢুকল তারু মিয়া, ঘরটা ঠাণ্ডা। মেঝেয় খালি পা পড়তেই সমস্ত শরীর যে জুড়িয়ে গেল তা নয়, মেঝের ঠাণ্ডা পা দিয়ে ঢুকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। এবং বিভিন্ন অষুধের মিশ্রিত গন্ধ নাকের ভিতর দিয়ে একেবারে বুকে এসে বসে গেল, মনে হলো, কোন মাতোয়ালীর নাঙ্গা বুকে তার বুক মিশল বুজি।
তারু মিয়া টুকেই বলে সরল মনে, ঘরটা ত আপনার খুব ঠাণ্ডা চাচা, মনে হয় শরীর জুড়াইল।
খিল-খিল করা বুকের পোকা-সাফ করা একটা হাসি ভিতর থেকে বের হয়ে এল তখন। কান গরম হয়ে উঠল তারু মিয়ার। একে শীতল মেঝে, তারপর কোবরেজি গন্ধের বাহার, তারপর সেই হাসি।
কন্ধেয় টিকে লাগিয়ে ফুঁ দেয় আরজান কবিরাজ। লম্বাটে মুখ, পাতলা দাড়ি, টানা-টানা তরল চোখ আর কেমন স্যাঁত-সেঁতে গলা। টানে খুব। কাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আরজান কবিরাজ প্রশ্ন করেছিল, সুখ ও শান্তি কও, টাকা কও পয়সা কও; তদবির ছাড়া কিছু হয় না। ঘরে বইসা থাকলে কাম হয় না, তদবির করন লাগে। এই যে অত বড় সংসার, এত ধান চাউল, তুমি না থাকলে খাইবো কেডায়?
কি করুম চাচা, আল্লায় দেয় নাই।
তদবির না করলে আল্লায় কেমনে দিব? ভালা কইরা চাও তার কাছে।
অষুধ-টষুধ খাইছো কুনদিন?
অষুধ আছে? আপনার কাছে?
হাসলেন আরজান কবিরাজ। অষুধ নেই আবার! সব রোগের অষুধ আছে। সাপের বিষ আছে না? সাপের বিষ দিয়া অষুধ হয়। সেই অষুধে অমৃত পয়দা হয়। সেই অষুধে হয় না হেনো কাজ নেই। কতো মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে তার অষুধ।
অষুধ, বিচিত্র গন্ধ এবং নেপথ্যের খিলখিল করা বুকে-তালা মারা হাসি তারু মিয়াকে বিদিশা করে ফেলেছিল। এবং আরেকদিন যখন হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় নদিনাকে দেখল আর হুঁশ রইল না তার। তার দীর্ঘ শক্ত সমর্থ ধ্বটা দেহ যেন সাপের বিষের ভারে অবশ হয়ে গিয়েছিল।
বাতাসে টিম টিম করে ঝিমানো হ্যারিকেনে কাঁপন লাগে, মাঝে-মধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে, কিন্তু তাতে কোন সাহায্য হয় না। পর্দার আড়াল থেকে করে জ্বলে ওঠে, কিন্তু তাতে কোন সাহায্য হয় না। পর্দার আড়াল থেকে মধ্যে মধ্যে নদিনা কথা বলে, মাঝে মধ্যে বলে ওর মা। কি একটা পান বানিয়ে দেয় নদিনা, নাকি তার মা, মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। আর রাজ্যের গন্ধ; মুখের ভিতরে যেন একেবারে বেচায়েন অবস্থা। হুঁকোর গুড়ুক গুড়ুক শব্দ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসতে আসতে একদিন এসে দেখল কবিরাজ চাচা গেছে সদরে অষুধ আনতে। সেই কথা বলল নদিনা। দরমার দরজা ভেদ করে একেবারে দোকান ঘরে এসে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় নদিনাকে দেখামাত্র বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে পারলে যেন শান্তি পেত তারু মিয়া, সন্তানহীন সুখি কৃষক; গরব্বিী সুরুয বানুর প্রাণের মানুষ তারু মিয়া।
কিয়ের অষুদ লাগবো কন।
কান লাল হয়ে গেল তারু মিয়ার। তাহলে জানে, কিসের অষুধের জন্য রোজ এখানে তামাক খায় এসে সে। কিন্তু চাষা-ভূষা মানুষ কি কথা কইবে সে! কথা তো কতো কিছুই বলতে চাইল, জমা রইল পেটে, কিন্তু মুখের আব্রু ভেদ করে কথাকে বাইরে আনা কী যে কষ্ট সে নদিন বুঝবে না।
–হর হর কইরা কথা কয় বাবার সাথে, আমার সাথে একটা কথাও কইতে পারে না-কি মানুষ।
ভিতর থেকে ওর মা সাহায্য করে, তুমি বইসো বাবা, নদি তামুক দে বাবারে।
তামাক নিয়ে আসে নদিনা। পান নিয়ে আসে। ওর বাবার গদিতে গিয়ে বসে। তারু মিয়া চোখ মুখ বন্ধ করে পান চিবোয় আর হুঁকোয় টান দেয়। যা একখানা শরীর কাঁপানো আরাম লাগছে না তার! তার মধ্যে কি কথা?
নদিনা আস্তে আস্তে সরল গলায় বলে, একটু বা ফিসফিসানির টান আছে গলায়, ফিসফিসানির বাতাস বুঝিবা মুখের পানের গন্ধের সঙ্গে কানে এসে লেগে যায়, বলে, অষুদে কোন কাজ হইলো?
লজ্জা নেই শরম নেই কিছুই আটকায় না তার মুখে। ওকি জানে কিসের অষুদের জন্য তারু মিয়া এখান আসে যায়?
জান? জিজ্ঞেস করবে তাকে? দূর, তাও কি সম্ভব?
নদিনাই, বলে, আবার দোষ কার, ঘরের না বাইরের সেইটা আগে বাইর করেন, বুঝছেন? তারপর জায়গা মতো অষুদ দেন। আতারে পাতারে খালি গুতাগুতি করলে লাভ হইবো না।
বলে কি! ছি ছি ছি। হুঁকো থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো যখন তারু মিয়া, দেখল অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে এক জোড়া চোখ, দেখল ঘাড় পেঁচানো শাড়ির আঁচল দুই হাতের আঙুলে কুটছে বটে, কিন্তু চোখ তার তারই দিকে ধরে কেমন রহস্যময় এলোমেলো বাউরি বাতাসের মতো উদাসকরা।
নদিনা বলে, ধরেন আরেকটা পান খান।
অনেক রাতে ও যখন ওদের ঘর থেকে বের হয়ে পথে নামল, জেলা বোর্ডের রাস্তার দুধারে ধান ক্ষেতে তখন মিঠে বাতাস। ওর লুঙ্গি উড়িয়ে নিচ্চে। পাঞ্জারি বুকে ওম দিচ্ছে কইর পাখি। একটা গান ধরল, তারু মিয়া ও জ্বালায়ে চান্দের বাতি, জেগে রব সারারাতি গো, কর কথা শিশিরের সনে ওর ভমরা; নিশিতে যাইয়া ফুলবনে। না, গলা ছেড়ে নয়, চাপা গলায়, এমন করে, যেন সে গান সে কেবল নদিনাকেই শোনাচ্ছে।
হঠাৎ ওর মনে হলো, কে যেন পেছন পেছন আসছে। পায়ের শব্দ। কে! নদিনা! অসম্ভব! মনের ভুল।
একটু পর আবার পষ্ট শব্দ। মনের ভুল নয়। দাঁড়িয়ে পড়ে, তাকায় পেছন দিকে। সাবধানে পরিষ্কার গলায় বলে, কেডায়?
একটা দলাদলা অন্ধকার কাছে এল। এসে একটা মানুষের আকৃতি নিল। চিনতে পারল না তারু মিয়া, প্রশ্ন করল একটু জোরে, কেডা?
আমি।
আমি-র নাম নাই?
আমি-র নাম মদন, আপনের শালা।
মদন!
বিস্ময়ের পার নেই। মদন, শ্বশুরবাড়ির লোক। কিছুদিন হলো তাদের বাড়িতে এসেছে। বাইরের ঘরে থাকে খায়। ড্যাবড্যাবে চোখ, উনিশ বিশ বছর বয়স কিন্তু গায়ে গতরে আছে বেশ।
তুমি মদন! কই গেছিলা?
বাজারে। বুজির লই অযুদ আনতে গেছিলাম।
এত রাত্রে? কিয়ের অষুদ?
মাথা ধরার।
এত রাত্রে?
মদন সে কথার জবাব দেয় না। পাল্টা প্রশ্ন করে সন্দেহবিহীন গলায়, আপনে কই গেছিলেন এত রাত্রে দুলা ভাই?
প্রশ্নটাকে বিশ্বাস করে না তারু মিয়া। প্রশ্নটা মিথ্যা। মাথা ধরা, অষুদ এবং এই প্রশ্ন সবগুলো ভুয়া। ফাঁকি। আসলে সুরুয বানু তার পেছনে চর লাগিয়েছে। ছোঁকরা চালাক চতুর বেশ। নিশ্চয়ই আড়ি পেতে সব শুনেছে। সুরুয বানুর কাছে গিয়ে বলবে, রিপোর্ট করবে সব। মনে মনে বিপদ গুনল তারু মিয়া। সুরুয বানুর কোন সন্তান হয়নি, এটিই তার একমাত্র দোষ, ওর আর সব গুণ। বড়লোক বাপ, অঢেল সম্পত্তি। একমাত্র মেয়ে। বাপ মরলে সব সম্পত্তি এই সুরুয বানুর। এটা খুব হাল্কা চিন্তার কথা নয়। অবশ্য সম্পত্তি তারু মিয়ারও আছে অনেক, তা থাকলেই বা। আছে বলে আরও হবে না কেন? আরও হবে, সঙ্গতভাবে যা পাবার সব পবে। তবে, কোন ওয়ারিশ যদি না থাকল তাহলে কার জন্যে করবে এত সম্পত্তি? আর এটা কি রকম কাজ হলো? সুরুয বানু তার পেছনে নোক লাগিয়েছে।
প্রশ্ন করে তারু মিয়া, আসল কথাটি কি মদন?
মদন চুপচাপ পেছ পেছ হাঁটতে লাগল। মদনকে তার পেছনে লাগানো হয়েছে, এটা সে টের পেয়েছে, এটা সে পছন্দ করছে না, এসব কথা এই মুহূর্তে মদনকে বলা হবে কিনা ভাবল খানিক তারু মিয়া। মদনকে সে সাবধান করে দিতে পারে, ভবিষ্যতে যদি তার পেছনে পেছনে আসতে দেখে তাহলে দুটো পার একটাও আস্ত থাকবে না, কিন্তু, এতো তাড়াহুড়ো করে কিছু করা ঠিক হবে না। বিষয়টা ঘোলাটে হোক তা সে চায় না। বরং ভালয় ভালয় এর শেষ দেখতে চায় সে।
মদন?
জি দুলাভাই?
আমাকে পাহারা দেওয়ার লাগি পাঠায় তোমার বুজি?
জে, রাইতে আন্ধাইরে কত কি হইতে পারে ত, তয় বুজি কয় থাকিস মদনা তানির লগে লগে।
২.
কোন ওজর-আপত্তি অশ্রুর মিনতি, চিৎকারের শাসানি টিকল না। নদিনা ভর বয়সী, মাছের মত শক্ত আর পিচ্ছিল শরীর, বেহায়া যৌবন আর আদরের রসে ভেজাগলা নিয়ে তারু মিয়ার সংসারে প্রবেশ করল, তারু মিয়ার কোন উপায় ছিল না। পৃথিবী একদিকে থাকলেও অন্যদিকে থাকতো নদিনা আর তারু মিয়া। আরে জীবনে সুখই না পেলাম তো কি দরকার সে জীবন দিয়ে। তাছাড়া, একটা অজুহাত যখন আছেই। অজুহাত, আবার ভয়। বাইরে সে যতই বলুক সে কাউকে পরোয়া করে না, সে নিজের বংশরক্ষার জন্য যা ভালো মনে করেছে তাই করেছে, ভিতরে ভিতরে ভয়টা ছিলই। সুরুয বানুর সঙ্গে তার অন্যরকম সম্পর্ক। অভ্যাসের সম্পর্ক, সংসারের সম্পর্ক, সুরুয বানু, এ সংসারে নেই একথা তার পক্ষে চিন্তা করা কঠিন।
ভাবনা ছিল, নদিনাকে সুরুয বানু গ্রহণ করবে না, কিংবা দু’জনে খুব লাগবে। বলে না দুষ্টলোকে কারো সঙ্গে দুশমনি থাকলে তাকে দুই বিয়ে করিয়ে দাও? সেরকম অশান্তি হবে ভেবেছিল। দু’জনের ঝগড়ার ঠেলায় বাড়িতে কোন কাক আসবে না, কুকুরগুলো ভেগে যাবে। এ গাছ লাগাবে তো সে গাছ কাটবে। এ শুকাবে তো সে ভিজাবে। এমনি।
কিন্তু না, সুরুয বানু সেদিন দিয়েও গেল না।
বরং ছোটবোনকে যেমন, তেমনি নদিনাকে বরণ করে নিল। ওক বলল, তুমার কি দোষ? তুমি তো তুমার সংসারে আসছে। দোষ আমার, আমার কপালের। লক্ষ্মী হইয়া আসছে, লক্ষ্মী হইয়া থাকবা।
কিন্তু তারু মিয়ার সঙ্গে কোন কথা নেই তার। তার দিকে ভুলেও তাকানো নেই। সংসারের কোন কথা নেই।
শাশুড়ি বানেছ। বিবি কেবল মাথা চাপড়ান, আমার সুখের সংসার আছিল, কি শাস্তি আছিল, সংসারে এখন শয়তান আসছে আমি টের পাইতাছি। কপালে শাস্তি না থাকলে জ্বর কইরা মানুষে শান্তি পায়?
তিনি কি যে দেখেছিলেন সংসারে, কিসের ছায়া তা তিনিই জানেন।
এমন করে আদর দিল নদিনাকে সুরুবানু সে গলে গেল। সবাই অবাক হলো, অবাক হওয়ার কথা। জিনিসটা অস্বাভাবিক, বড় সতীনের জান হয়ে গেল ছোট সতীন এটা কে কবে কোথায় শুনেছে। কিন্তু এই কথাটি কারো মনে ঢুকল না। বাইরের চেহারা দেখে মানুষ বিচার-আচার করে বটে।
৩.
আরজান কবিরাজ মদনকে পাত্তাই দিল না। তার মতো পোলাপানের আবার সাংসারিক সমস্যা কি? মদন বলল যে বিষয়টা তার নয়, তার বোনের। বোন তো পর্দানসীন, তায় অনেকদূরে বাড়ি। তার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে অসুখ তার নয়, অসুখ তার বোনের। আরজান কবিরাজ বলল, যার অসুখ তাকে আসতে হবে, রোগী। না দেখে অযুদ কিসের?
মদন নাছোড়বান্দা, বলল, সকলেই বলে, আপনে বড় ভালো কব্রিজ। এখন বুঝতেছি কেন আপনের এত নামডাক।
হাসল আরজান কবিরাজ, বলল, বুঝতাছে?
হ।
তাহলে যাও, বইনরে লইয়া আস গিয়া।
মদন একটু ইতিউতি করে। বলে, আমার নিজের একটা অসুখ আছে।
কি অসুখ?
মদন লজ্জা পাওয়ার ভান করে। তারপর সঙ্কোচ করে। যেন কিছুতেই কথাটা মুখ দিয়ে রে হচ্ছে না। কব্রিজ উৎসাহ দেয়, বলে, কও কইয়া ফালাও।
শরম লাগে।
অসুখ নিয়া শরম কি? কও।
পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে দেয় মদন। সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্ন হয়ে ওঠে কব্রিজের চেহারা। দ্বিগুণ উৎসাহে হুঁকোয় টান দেয় আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখ ছোঁকরাকে। নিশ্চয়ই ভালবাসার অসুখ। কাউকে সমস্তটা মন দিয়ে আছে কিন্তু তার মন পাচ্ছে না। এই বয়সে কবিরাজ প্রশ্ন করে, কাউকে ভালবাস?
মাথা দোলায় মদন।
সে তুমারে বাসে না?
বাসে।
তবে?
আরেকজন আছে। সে থাকতে আমার কোন আশা নাই।
তারে কি করতে চাও?
মদন বলে, সে জন্যই ত আপনার কাছে আসছি।
কবিরাজ অনেকক্ষণ চিন্তা করল। নতুন তামাক ভরল। টিকা লাগিয়ে ফু দিল। তামাকের ধোঁয়ার ভুরভুর গন্ধে ঘর ভরে গেল। আবার নতুন উদ্যমে বেশ কয়েকবার ঘন ঘন টান দিলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন অনেক দূরের কি দেখলে।
বললে, তারে সুরাইয়া দিবা একেবারে?
জে?
কিন্তু–
গলার স্বর নামিয়ে আনল কবিরাজ আরজান, কিন্তু তাতে অনেক খরচ হবে, অনেক বিপদ।
মদন পকেট থেকে আরো একশ টাকার একটা নোট বের করে হাতে দেয়। কবিরাজের চোখ চকচক করে ওঠে।
বলে, ওর সাথে খারি দিবা। দাওয়াত কইরা খাওয়াইবা। প্যাঁচা আছে না? পাচার কলজা খাওয়াইবা।
খাওয়াইলে?
ব্যস। সাবধান, কেউরে কইবা না। কইলে তুমিই বিপদে পড়বা। আমি তুমারে চিনি-টিনি না। যাও।
৪.
কোনদিক দিয়ে যে সময় বয়ে যায়। আজকে কালকে করতে করতে কেমন করে একটি বছর পার হয়ে যায়, কেমন করে সহ্যের সীমা আর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়ে নিজেই দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়বে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে বসে সুরুয বানু, নিজেই টের পায় না। নদিনার পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকে অধৈর্য হয়ে যায় তারু মিয়া, বানেছা বিবি। প্যাচা ধরা সে যে কী ভীষণ কঠিন কাজ তা হাড়ে হাড়ে জানে মদন। এর মধ্যে ওকে আর ছেলেমানুষ লাগে না, পুরু গোঁফ প্রায় মুখ ঢেকে ফেলেছে। প্যাচার কলিজা খাইয়ে এমন একটা সোনার টুকরো মানুষকে মারবে, যতই সে ভাবে আর। নদিনাকে দেখে, নদিনার জন্যে একটা কাঁচা কচি মায়ার ভাব তার বুকে ভিতর কান্নাকাটি শুরু করে। একটা মানুষকে কেমন করে মারবে সে যেখানে নিজেই সে মরে আছে। নদিনার কথারও কোন ট্যাকসো নেই। সেদিন তাকিয়ে ছিল তার মুখের দিকে অনেকক্ষণ, ও যে কেমন করে ওর অমন বাণ-মারা চোখে বিদ্ধ করে, হু হু করে তখন বুক কেঁপে উঠল, ওকে প্যাচার কলজে সে খাওয়াতে পারবে না, তখনই নদিনা ওকে এক অসম্ভব লোমকাঁপানো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসল, অমন আর কতদিন খালি তাকাইয়া থাকবা? এবং তখন মদন একটু সাহস করে প্রশ্ন করল, আর কি করব? নদিনা মাথা সোহাগভরে মৃদু নাড়িয়ে চোখে ঢেউ তুলল এবং একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল ক্যান আর কিছু করার নেই? সব রোগের দাওয়াই আছে, খালি আমার রোগের নেই।
সুরুযবানু ওকে আবার পাঠাল কবিরাজের কাছে। প্যাচা যোগাঢ় করা খুব কঠিন কাজ। উনি পোকার (ছোট্ট অণুর মতো কালো পোকা বর্ষাকালে মশার মতো। কামড়ায়) নয় মণ দুধও হবে না রাধাও নাচবে না। মদন আবার যাক, সহজ কোন অযুদ আছে কিনা জিজ্ঞেস করে আসুক। টাকা যতো লাগে, সে দেবে—আর না হয় যদি এমন কোন দাওয়াই হারে কাছে থাকে খেলেই ঘুম আসে, আর ভাঙে না সে ঘুম সেই দাওআই যেন দিয়ে দেয়, সে নিজেই খেয়ে নেবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে সুরুয বানুর। বুজি তারা সারা রাত ঘুমায় না। কান্দে। সোনার শরীর কি হয়ে গেছে। না, আত্মীয় নয় পাড়ার ছেলে মদন কিন্তু সুরুয বানুদের সঙ্গে এমন একটা বংশানুক্রম সম্পর্ক সুরুবানুদের জন্য চিরকাল প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকেছে। মদনরা। সেই কথা বুজিয়ে দেখে মনে এল মদনের, নবীন যুবক মদন। সেদিন ভোরে যখন ওরা সবাই আবিষ্কার করল বাড়িতে তারু মিয়ার এক বছরের পুরনো নতুন বিছানায় নদিনা নেই, মদন নেই, তখন অনেকদিন পর স্বামীর সামনে এসে দাঁড়াল সুরুয বানু। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো সহজ সুরে বলল, একটা মানুষ পালাইয়া কই যাইবো। আপনে লোক পাঠান, যেখানে পায় ধইরা আনবো।
তারুমিয়া কথা শুনে চমকে উঠল। এই একটি বছর একবারও সুরুয বানুর কথা, সুরুব্বানুর মনের কথা ভাব্বার কথা মনেও আসে নি। সে যে ভিতরে অনেক নিদারুণ কষ্ট পেতে পারে সেকথা একবারও মনে আসেনি। সতীনকে ছোট বোনের মতো আদর করেছে তাতেও অসঙ্গতি দেখেনি। কিন্তু নদিনার চলে যাওয়ায় তার খুশি হওয়ার কথা নয়? কিন্তু ও কোন্ কথা বলছে সে?
তারু মিয়া বলল, যে চইলা গেছে তারে ধইয়া আনলে তুমি খুশি হইবা?
সুরুয বানু বলল, আমি অই বা না হই আপনে তো খুশি হইবেন। ব্যাস তাইলে হইলো। আপনের সুখ ছাড়া আমার আলাদা কুন সুখ নাই।
এর জবাব তারুমিয়া দিনের বেলা এত মানুষের ভিড়ে দিতে পারেনি কান্নার মতো যে মহব্বতের দলাটা সমস্ত শরীরে জমেছিল, তাকে নামিয়ে দিল রাত্রে দুজনে একসঙ্গে। নামাজের পরে অবসন্ন কন্ঠে তারু মিয়া বলল, আমরা দুজনেই শহরে যাব, ডাক্তার দেখাব, কতো জাতের অষুদ বাইর হইছে আজকাল। ডাক্তার পরীক্ষা কইরা কইতে পারবো, কার দোষ।
তখন সুরুয বানু ভাল একটা প্রশ্ন করল, যদি আপনের দোষ থাকে, তাহলে? তাহলে আমি অষুধ খাব।
অষুধ যদি না থাকে?
তারু মিয়া ওকে আবার জড়িয়ে ধরে। সত্যিই কিইবা আর করতে পারে সে।