মাজোরকা দ্বীপে ফ্রান্সিস – ৪

খাওয়া সেরে চলল দু’জনে। একটা বাড়ির সামনে সালভা ফ্রান্সিসকে নিয়ে এলো। বাড়িটার পাশেই বেশ লম্বা একটা ঘর। সালভা বলল–এটা গুদোম ঘর, মালিক চাষি পাঁচ-ছ’টা খচ্চরকে দানাপানি খাওয়াচ্ছিল। ওদের দিকে এগিয়ে এলো। সালভা ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল–আমার বন্ধু। একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাইছে। চাষিটি ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল–আপনার মালভর্তি গাড়ি নিয়ে যাবো আমরা। (কোস্তার আড়তে সব পৌঁছে দেব। চাষিটি দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে হেসে বলল–এতো ভালো কথা। মূর সৈন্যদের জ্বালায় কোনো মালই পাঠাতে পারছি না গুদোমে সব ভঁই হয়ে জমে আছে।

–ঠিক আছে। আমরা খেয়েদেয়ে আসছি। আপনি চারটে বস্তায় মাল ভরিয়ে রাখুন। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ তো। আমার লোকই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে। চাষিটি খুশি হয়ে বলল। ফ্রান্সিস বলল–কে চালিয়ে নিয়ে যাবে সেটা পরে ঠিক করছি।

ফেরার সময় ফ্রান্সিস বলল–সালভা তোমার বাবাকে নিয়ে এসো। একটু কাজ আছে।

— খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিসরা তৈরি হয়ে গুদোম ঘরের দিকে চলল। ফ্রান্সিস দেখল মারিয়া সেই চাষি মেয়েদের ঢোলা পোশাকটাই পরে আছে। বললকী ব্যাপার? তোমার গাউনটা কী হল?

–ওটা সালভার বোনকে দিয়ে দিয়েছি। মারিয়া হেসে বলল। ফ্রান্সিস অর কিছু বলল না।

ফ্রান্সিস গুদোম ঘরে ঢুকে দেখল–চারটে ডুমুর বাদাম খুবানি ভর্তি বড়ো বস্তা রাখা হয়েছে। সালভার বাবাই এসব বস্তায় নোক এনে ভরিয়েছে। ফ্রান্সিস ঐ লোকগুলোকে চলে যেতে বলল। লোকগুলো চলে গেল। এবার ফ্রান্সস সালভার বাবাকে বলল দেখুন–আমরা চারজন চারটে বস্তার মধ্যে লুকোব। আমরা বস্তায় ঢোকার পর আপনি ডুমুর বাদাম এসব ঢেলে বস্তার মুখটা বেঁধে দেবেন। সালভার বাবা তো অবাক। ফ্রান্সিস বুঝিয়ে বলল–মুর সৈন্যদের শেষ ঘাঁটিটা আমাদের এভাবেই পার হতে হবে। ওরা বুঝতেই পারবে না। সালভার বাবা মাথা ঝাঁকাল। তারপর কাজে হাত লাগাল। প্রথমে একটা বস্তা থেকে ডুমুর বাদাম বের করল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে মারিয়া বস্তাটায় বসে পড়ল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। বলল–চোখ বন্ধ করো। মারিয়া মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করল। ফ্রান্সিস এবার ডুমুর বাদাম এসব ঢালল। বস্তা ভরে গেল।

একইভাবে শাঙ্কো আর সালভাও বস্তাবন্দি হল। এবার ফ্রান্সিস সালভার বাবাকে বলল–একটি অল্প বয়েসের ছেলেকে ডেকে আনুন যে খচ্চরের গাড়ি ভালো চালাতে পারে। কিন্তু সাবধান ছেলেটিকে আমাদের কথা বলবেন না। বলবেন এইসব মাল তোকে কোস্তের আড়তে পৌঁছে দিতে হবে। ছেলেটা এলে কাজের লোকগুলো ডেকে গাড়িটার একপাশে প্রথমে আমাকে তার ওপরে মারিয়াকে রাখবেন। সালভার পিঠের ঘা এখনও সম্পূর্ণ সারেনি। আর একপাশেশাঙ্কোর ওপর সালভাকে রাখবেন। বুঝেছেন সমস্ত ব্যাপারটা? সালভার বাবা মাথা নেড়ে হাসল। এবার ফ্রান্সিস বস্তায় ঢুকল। সালভার বাবা ওকে বস্তাবন্দি করল।

ফ্রান্সিসের নির্দেশমতো সালভার বাবা কাজের লোকদের ডেকে ওদের গাড়িতে তুলে সাজিয়ে রাখল। একটা অল্পবয়সী ছেলেকেও জোগাড় করা হল। ছেলেটির হাতে কাঠের ছোটো লাঠির মাথায় চামড়া বাঁধা চাবুক দেওয়া হল। ছেলেটি খুব খুশি। গাড়িতে উঠেই চাবুক হাঁকাল খচ্চর দুটোর পিঠে। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ি চলল। কাঁচ ক্যাচ শব্দ তুলে ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি চলল। এবড়ো-খেড়ো রাস্তা দিয়ে গাড়ি এসে উঠল সদর রাস্তায়। এবার গাড়ির ঝাঁকুনি অনেকটা কমল। শাঙ্কোর নাকে ডুমুরের বোঁটার খোঁচা লাগল। হেঁচে ফেলতে গিয়ে শাঙ্কো ডুমুরগুলোর মধ্যেই নাক চেপে ধরল। হাঁচি আটকে গেল। শাঙ্কো নিশ্চিন্ত হল। গাড়ি চলল ঢিকির ঢিকির। ছেলেটির ছলাৎ ছপাৎ চাবুক চালাবার শব্দ শোনা যেতে লাগল। হঠাৎ ছেলেটি সরু গলায় জোরে গান গাইতে লাগল। গাড়িও চলেছে গানও চলেছে। মাঝে মাঝে পাথরের টুকরোয় চাকা লেগে গাড়িটা লাফিয়ে উঠছে। জোর ঝাঁকুনি ফ্রান্সিসরা মুখ বুজে সহ্য করছে।

হঠাৎ ছেলেটির গান বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। বোঝা গেল সাঁকোর কাছে গাড়ি এসেছে। একজন পাহারাদার মূর সৈন্যের চড়া গলা শোনা গেল। কী যেন বলল। ছেলেটিও ভাঙা ভাঙা আরবী ভাষায় কী বলল। কোস্তা’ কথাটা ফ্রান্সিস বুঝল। ছেলেটি কোস্তার আড়তে যাবার কথা বলছে। আরো কিছু কথা হল। ফ্রান্সিসের পরিকল্পনার হিসেব মিলে গেল। একে বিকেলবেলা তার ওপরে মালগাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা অল্পবয়সী চাষি ছেলে। সৈন্যদের মনে সন্দেহ হল না। গাড়ি চলতে শুরু করল। তখনই হঠাৎ একটি সৈন্য বস্তার তলোয়ারের খোঁচা দিল। মারিয়ার হাতের ফাঁক দিয়ে তলোয়ারের ডগাটা লাগল ফ্রান্সিসের পিঠে। ফ্রান্সিস একচুল নড়ল না। বস্তার গায়ে রক্ত ফুটে ওঠার আগেই গাড়ি কিছুটা চলে গেল। গাড়ি চলল।

ছেলেটার মুখের হাঃ হাঃ শব্দ আর হাতের চাবুকের শব্দ শুনতে শুনতে ফ্রান্সিসরা এগিয়ে চলল।

বেশ কিছুটা সময় গেল। ফ্রান্সিস বস্তার মধ্যে থেকে চাপা গলায় ডাকল–মারিয়া। মারিয়া মৃদু শব্দ করল–উ? ফ্রান্সিস তেমনি চাপা গলায় বলল–মনে হচ্ছে না যেন বাড়ির নরম পালকের বিছানায় শুয়ে আছি। মারিয়া একটু জোরেই বলে ফেলল– তোমার মুণ্ডু। ছেলেটির কানে আস্তে হলেও কথাটা পৌঁছল। ছেলেটি চম্‌কে পেছনের বস্তাগুলোর দিকে তাকাল। ঠিক বুঝল না। তবু ও ভুল শুনল কিনা বুঝতে চেঁচিয়ে বলল–কে কথা বলল? এ্যা? শাঙ্কো আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বলে উঠল– ভূত। আর কোথায় যাবে। ছেলেটি চাবুক ছুঁড়ে ফেলে একলাফে গাড়ি থেকে নেমেই রাস্তার পাশের ডুমুর ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ছুট লাগাল। শাঙ্কো ছোরা দিয়ে বস্তা কিছুটা কেটে ফেলে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকল–এই ছোঁড়া–ভয় নেই। চলে আয়। কে কার কথা শোনে। ছেলেটি ততক্ষণে ডুমুর ক্ষেত পার হয়ে ছুটে চলেছে।

শাঙ্কো ছোরা দিয়ে বস্তার অনেকটা কেটে বেরিয়ে এলো। মারিয়া ফ্রান্সিস আর সালভার বস্তার মুখ বাঁধা দাড়ি কেটে দিল। সবাই বস্তা থেকে বেরিয়ে হাঁফাতে লাগল। বস্তার মধ্যে এতক্ষণ আধশোয়া হয়ে থাকা। দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। ততক্ষণে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সালভা রাস্তা থেকে চাবুকটা তুলে নিয়ে চালকের জায়গায় বসল। গাড়ি চালাতে লাগল সালভা।

ফ্রান্সিস ঘুরে বসতেই মারিয়া দেখল ফ্রান্সিসের পিঠের দিকে জামাটায় রক্তের দাগ। মারিয়া বলল–তোমার পিঠটা তলোয়ারে কেটে গেছে। ফ্রান্সিস হাসলও কিছু না। এখন অনেক ভাবনা–এসব ভাবার সময় নেই।

সন্ধের পরে কোস্তার কাছাকাছি এসে সালভা বলল–ফ্রান্সিস কোস্তা এসে গেছি। কী করবে এখন? ফ্রান্সিস বলল–ঐ চাষির মালগুলো যা আছে তোমার কোনো পরিচিত আড়তদারের কাছে রাখো। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে এই গাড়িতে চড়েই পালমার দিকে যাত্রা শুরু করবো।

রাতটা বিশ্রাম নেবে না? সালভা বলল।

উঁহু-হাতে সময় কৈ। ফ্রান্সিস বলল।

সালভা গাড়ি থেকে নেমে গেল। কোস্তা বন্দর এলাকাটা বেশ জমজমাট। তিন চারটে জাহাজ জাহাজঘাটায় রয়েছে। একপাশে বেশ কয়েকটা গুদোমঘরের মতো। খচ্চরে টানা গাড়ি আসছে যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে। মালপত্র গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। লোকজনের ব্যস্ততা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সালভা ফিরে এলো। বলল–ঠিক আড়তদারকেই পেয়েছি। লোক পাঠাচ্ছে। মাল তুলে নেবে। আড়তদারের লোকজন এলো। সব মাল নিয়ে গেল আড়তে।

রাত বাড়ছে। ফ্রান্সিস বলল–খেতে চলো সব। গাড়ি থেকে নামল সবাই। এদিক ওদিক খুঁজে ফ্রান্সিস একটা ছোটো সরাইখানা বের করল। একটা বড়ো সরাইখানা ছিল। বেশ ভিড়। ফ্রান্সিস ঐ ভিড়ের সরাইখানায় গেল না।

গরম গরম গোল রুটি মুরগির মাংস পাওয়া গেল। বেশ সুস্বাদু রান্না। ফ্রান্সিসরা সবাই পেট ভরে খেল।

গাড়িতে ফিরে এলো সবাই। সালভা বলল–ফ্রান্সিস সারারাত তো গাড়ি চালাতে হবে।

–হ্যাঁ। শাঙ্কো আর আমিও চালাবো। ফ্রান্সিস বলল।

-তাহলে তো খচ্চর দুটোকে দানাপানি খাওয়াতে হয়। সালভা বলল। তারপর গাড়ি থেকে খচ্চর দুটোকে নিয়ে চলল যেখানে লোকেরা ঘোড়া খচ্চরগুলোকে দানাপানি খাওয়াচ্ছে।

ফ্রান্সিস মারিয়া আর শাঙ্কো গাড়িতে উঠল। ওরা সালভার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

সালভা কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো খচ্চর দুটোকে নিয়ে। গাড়িতে জুড়ে দিল। তারপর চালকের জায়গায় বসল। রাত বেড়েছে। সারা কোস্তা বন্দরে এখন আর লোকজনের সাড়াশব্দ নেই।

সালভা গাড়ি চালাতে শুরু করল। গাড়ি চলল পালমার উদ্দেশ্যে। টানা রাস্তা চলেছে। জ্যোত্সা অনেকটা উজ্জ্বল। দু’পাশে কোথাও ক্ষেতখামার কোথাও ছোটো ছোটো পাথুরে টিলা। মারিয়া কিছুক্ষণ জেগে রইল। তারপর আর পারল না। গাড়ির দুলুনিতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো। ও গাড়ির মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চোখ ঝুঁজে বসেছিল। একবার চোখ খুলে ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। একটু এগিয়ে এসে মারিয়ার মাথাটা নিজের ডানপায়ের উরুর ওপর তুলে নিল। মারিয়া নিশ্চিন্তে ঘুমুতে লাগল। শাঙ্কো জেগেই ছিল। এবার উঠে দাঁড়াল। বলল–সালভা–তুমি একটু বিশ্রাম করে নাও। আমি চালাচ্ছি। সালভা সরে এলো। শাঙ্কো গাড়ি চালাতে লাগল। রাত শেষ হয়ে আসছে। তখন ফ্রান্সিস গাড়ি চালাচ্ছে।

পুব আকাশ লাল হয়ে উঠল। সেই লাল দিগন্তের আকাশের নীচে কিছু কালো কালো বাড়িঘরের মাথা দেখা গেল। ফ্রান্সিস বুঝল ওটাই রাজধানী পালমার বাড়িঘর। ও ঘুমন্ত সালভাকে আর ডাকল না।

পালমা নগরে ওদের গাড়ি যখন ঢুকল তখন চারদিকে উজ্জ্বল রোদের ছড়াছড়ি। মারিয়ার ঘুম ভাঙল তখন। ও দু’পাশের বাড়িঘর দেখতে লাগল। সালভা আর শাঙ্কোও ঘুম ভেঙে উঠল। ফ্রান্সিসকে সালভা বলল–আপনি সরে আসুন আমি চালাচ্ছি।

সালভা গাড়ি চালাতে চালাতে বলল–এখন কী করবেন? কোনো সরাইখানায় খেয়েটেয়ে একটু বিশ্রাম করে রাজপ্রাসাদে যাবেন? ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। বলল–তোমার কি একটু বিশ্রাম চাই? মারিয়া মাথা নেড়ে বলল-না। ঘুমিয়ে আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

–তাহলে আলমুদাইনা রাজপ্রাসাদেই চলো। ফ্রান্সিস বলল। তখনই ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল মারিয়া সেই চাষি মেয়েদের ঢোলা পোশাকটাই পরে আছে। এখন তো রাজপ্রাসাদে যেতে হবে। রাজার সঙ্গে দেখা করতে হবে। মারিয়া ওদের দেশের রাজকুমারী। তার এই পোশাকে যাওয়া ভালো দেখাবে না। ফ্রান্সিস বলল–সালভা তুমি তো এখানে ছিলে। মহিলাদের ভালো পোশাক কোথায় পাওয়া যায় নিশ্চয়ই জানো।

-হা হা। যাবেন? সালভা গাড়ি থামিয়ে বলল। মারিয়া বুঝল ফ্রান্সিস কী চাইছে। মারিয়া বলল–আমার অন্য পোশাকের কোনো প্রয়োজন নেই।

–কিন্তু এ দেশের রাজার সামনে এই পোশাকে–ফ্রান্সিস মৃদু আপত্তি করল। মারিয়া বলল–এটা তা এই দেশের চাষি মেয়েদেরই পোশাক। ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। সালভা গাড়ি চালাল।

পালমা নগরীতে তখন লোকজনের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। একটু পরে ফ্রান্সিসদের গাড়ি বিরাট রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারে এসে দাঁড়াল।

সালভা গাড়ি থেকে নামল। চারজন দ্বাররক্ষী লোহার দরজার দু’পাশে ঝকঝকে পেতলের কারুকাজ করা বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।,

সালভা দ্বাররক্ষীদের সঙ্গে কী কথাবার্তা বলে ফিরে এলো। বলল–মুস্কিল হয়েছে। বছর কয়েক আগে এখান থেকে চলে গেছি। এরা সব নতুন দ্বাররক্ষী। আমাকে চেনে না। ফ্রান্সিস বলল–রাজার দেখা পাওয়া সহজে হবে না। বলল–তাহলে চলো– কোনো সরাইখানায় যাই। অপেক্ষা করি। তুমিও সাক্ষাতের ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাও।

ওরা কথা বলছে তখনই দ্বারক্ষীরা হঠাৎ বেশ তৎপর হ’ল। লোহার দরজার টানা টানা গারদের মাথাখোলা কালো রঙের গাড়ি ভেতর থেকে আসছে। একটু পরেই গাড়িটা দরজার কাছাকাছি আসতেই দ্বাররক্ষীরা দু’জন দু’দিক থেকে দরজা খুলে ধরল। গাড়ির কালো গায়ে রুপোর কাপড়ের জোব্বামতো পরা এক বৃদ্ধ। সালভা বলে উঠল–আরে মন্ত্রীমশাই। সালভা ছুটে গাড়িটার কাছে গেল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলে উঠল– মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়–আমার কিছু খুব প্রয়োজনীয় কথা বলার আছে। মন্ত্রীমশাই বোধহয় সালভাকে চিনলেন। আস্তে কী বললেন। গাড়ি থামল। সালভা মন্ত্রীমশাইর খুব কাছে গেল। মন্ত্রীমশাই পাকা দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হাসলেন। বললেন–কী ব্যাপার সালভা? পড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলে কেন? সালভা হেসে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল– সব বলবো আপনাকে। তার আগে দু’টো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংবাদ আপনাকে জানাচ্ছি। মহান পুরুষ রামন লাল আমাদের কুটীরে কয়েকদিন আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মন্ত্রীমশাই চমকে আসনে উঠে বসলেন। বলে উঠলেন–এ কী বলছো সালভা। এতো– সাংঘাতিক খবর।

—-আর একটা খবর –। মন্ত্রীমশাই সালভাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–সব শুনবো। তুমি গাড়িতে ওঠো। এক্ষুণি মাননীয় রাজাকে খবরটা দিতে হবে। সালভা ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল–কিন্তু আমার এই বন্ধুদের সঙ্গে আমি যেতে চাই। মন্ত্রীমশাই ফ্রান্সিসদের একবার দেখলেন। বললেন–ঠিক আছে তুমি ওদের নিয়েই এসো। এই বলে উনি গাড়িচালকের দিকে তাকিয়ে বললেন–প্রাসাদে ফিরে চলো। মন্ত্রীমশাইর গাড়ি ঘুরল। সালভা হাতছানি দিয়ে ফ্রান্সিসদের ডাকল। ফ্রান্সিসরা গাড়ি থেকে নেমে এলো। তারপর মন্ত্রীমশাইর গাড়ির পেছনে পেছনে ওরা সদর দেউড়ি পার হয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে হেঁটে চলল। দ্বাররক্ষীরা আর বাধা দিল না।

চারদিকে পাথরের দেয়ালঘেরা বিরাট জায়গা নিয়ে রাজপ্রাসাদ। এখানে ওখানে চৌকোণো তিনকোণা ফুলের বাগান। রোদে ঝলমল করছে ফোঁটা ফুল। বাগানের মাঝখানে ফোয়ারার পর ফোয়ারা। পাথরে বাঁধানো ঝকঝকে রাস্তা চলে গেছে প্রধান দ্বারের দিকে। চারপাশের বাগান সবুজ মখমলের মতো ঘাসে ঢাকা। ছোটো ছোটো মাঠ দেখতে দেখতে ওরা এগিয়ে চলল সেইদিকে। প্রধান দ্বারের সামনেই মন্ত্রীমশাই গাড়ি থেকে নামলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন ফ্রান্সিস সালভাদের জন্য।

ওরা এলো। মন্ত্রীমশাই ওদের নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকলেন। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেন। দ্রাররক্ষীরা সবাই পেতলের বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে। ওরা মন্ত্রীমশাইকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাতে লাগল। ডানহাতি একটা ঘরে মন্ত্রীমশাই ঢুকলেন। পেছনে ফ্রান্সিসরা।

ঘরের মাঝখানে বেশ বড়ো চকে কালো পাথরের একটা গোল টেবিল। টেবিলের চারপাশে গদীঅলা ওককাঠের বাঁকা পায়ার কারুকাজ করা চেয়ার পাতা। বোঝা গেল– এটা রাজার মন্ত্রণাকক্ষ। মন্ত্রীমশাই হাত বাড়িয়ে সবাইকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। আস্তে বললেন–সংবাদ পাঠানো হয়েছে। মাননীয় রাজা এক্ষুণি আসবেন। ফ্রান্সিসরা চেয়ারে বসল। মন্ত্রীমশাইও একটা চেয়ারে বসলেন। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি খুবই চিন্তান্বিত। সবাই চুপ করে বসে রইল।

একটু দ্রুতপায়েই রাজা তৃতীয় জেমস্ মন্ত্রণাকক্ষে ঢুকলেন। রাজা মধ্যবয়স্ক। মুখে ছাটা দাড়ি গোঁফ। পরনে সাধারণ পোশাক। হলুদ রঙের জোম্বামতো গায়ে। বুকের কাছে সোনার সুতোয় কাজ করা জলপাই পাতার মতো নকশা। সবাই দাঁড়িয়ে উঠে মাথা নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানাল। রাজা সবাইকে হাতের ইঙ্গিতে বসতে বলে নিজে বড়ো চেয়ারটায় বসলেন। সবাই বসল। মন্ত্রীমশাই সালভার দিকে তাকিয়ে বললেন– তোমার সংবাদ জানাও। সালভা তখন রমন লালের নৌকোয় চড়ে আসা অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংবাদ জানল। রাজা বলে উঠলেন–সেই শ্রদ্ধেয় পুরুষের পবিত্র দেহ এখন কোথায়? সালভা তখন আল আমিরি কর্তৃক দুর্গ দখল–সেই সংবাদ গোপন রাখার ব্যবস্থা–রমান লালের মৃতদেহ আনার সময় ধরা পড়া–এ সব কথা বলল। সবশেষে বলল–গুরুদেবের পবিত্র দেহ আল আমিরি কী করেছে আমি জানি না। সবাইচুপ করে রইল। এবার ফ্রান্সিস একটু মাথা নুইয়ে নিয়ে বলল–মাননীয় রাজা–আপনি অনুমতি দিলে আমি দু’একটা কথা বলবো। রাজা একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন সালভার দিকে। সালভা বলল–মাননীয় রাজা–এর নাম ফ্রান্সিস। সঙ্গে তার স্ত্রী মারিয়া। বন্ধু শাঙ্কো। এঁরা জাতিতে ভাইকিং। রাজা একটু চুপ করে থেকে বললেন–ভাইকিংদের সাহস আর জাহাজ চালনায় দক্ষতার কথা আমরা শুনেছি। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন–বলো। ফ্রান্সিস বলল–মহান রামন লালের পোশাকের পকেটে ছিল তার দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি। সেটা এখন আল আমিরির কাছে আছে। এই পাণ্ডুলিপি সালভা পড়েছে। এটার শেষ পাতায় রামন লাল লিখেছেন প্রথম পাণ্ডুলিপিতে তিনি অ্যালকেমির যে সূত্রগুলো লিখেছেন সেগুলো নির্ভুল। তাঁর বাসনা ছিল ফিরে এসে তিনি এই সূত্রগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। ফ্রান্সিস থামল। রাজা বললেন হা–প্রথম পাণ্ডুলিপিটা কোথায় আছে। তা আমরা খুঁজে বের করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

মৃত্যুর পূর্বে মহান রামন লালের বাক্‌রোধ হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা কাগজে তিনি একটা নকশা এঁকে সালভাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল। তারপরে ওর পোশাকের ভিতর থেকে নক্শাটা বের করে রাজার দিকে এগিয়ে ধরল। রাজা বেশ আগ্রহের সঙ্গেনশাটা নিলেন। মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বললেন কিন্তু নকশার নির্দেশটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস বলল–আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন। তাহলে আমি চেষ্টা করতে পারি এই নকশার নির্দেশ বের করতে। ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন–তুমি পারবে?

–যথাসাধ্য চেষ্টা করবো এই পর্যন্ত বলতে পারি। ফ্রান্সিস বলল। রাজা নকশাটা ফিরিয়ে দিলেন। বললেন–

–বেশ। আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম।

–তাহলে সালভাকে নিয়ে আমি চেষ্টা করবো। সালভাকে এই ক্ষমতা দিন যাতে সে এই রাজপ্রাসাদের সর্বত্র স্বাধীনভাবে আমাদের নিয়ে চলাফেরা করতে পারে– ফ্রান্সিস বলল। রাজা মন্ত্রীমশাইয়ের দিকে তাকালেন। বললেন–আপনি কী বলেন?

–এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর করবার জন্যে এই স্বাধীনতাটুকু তো ওদের দিতেই হবে। মন্ত্রীমশাই বললেন।

–ঠিক আছে। সেই অনুমতি দেওয়া হবে। রাজা বললেন। তারপর দ্বাররক্ষীর এ দিকে তাকিয়ে বললেন–সেনাপতিকে এক্ষুণি আসতে বলো। দ্বাররক্ষী মাথা নুইয়ে কার সম্মান জানিয়ে দ্রুত চলে গেল।

একটু পরেই সেনাপতি বেশ দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলেন। সেনাপতি দীর্ঘকায়। বলিষ্ঠ গড়ন। সাধারণ জোব্বামতো পোশাক গায়ে। কোমরের চামড়ার চওড়া কোমরবন্ধ। তা’তে কোষবদ্ধ তলোয়ার ঝুলছে। সেনাপতি মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। রাজা বললেন–আপনি বোধহয় খবর রাখেন না যে মূরনেতা আল আমিরি পালমা নোভার দুর্গ দখল করে আছে। সেনাপতি বেশ চমকে উঠল। অবাক চোখে একবার রাজা আর একবার মন্ত্রীমশাই-এর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। রাজা বললেন–বসুন। সেনাপতি তাড়াতাড়ি বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। রাজা বললেন

–একটি বড়োই শোক সংবাদ পেলাম–মহান পণ্ডিত রামন লাল দেহরক্ষা করেছেন। সেনাপতি উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রাজা আঙ্গুলের ইঙ্গিতে তাকে বসতে বললেন। সেনাপতি আস্তে আস্তে চেয়ারে বসলেন। রাজা বললেন– শুনুন–সৈন্যবাহিনী নিয়ে আপনি এক্ষুণি পালমা নোভা যাত্রা করুন। দুটি কাজ আপনাকে করতে হবে। আল আমিরিকে বন্দি করে মহামতি রামন লালের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা উদ্ধার করবেন। পাণ্ডুলিপিটা ওর কাছেই আছে। যাবার সময় একটি মূল্যবান কফিন নিয়ে যাবেন। রামন লালের পবিত্র দেহ আল আমিরি কোথায় কবরস্থ করেছে সেটা জানবেন। সেই পবিত্র দেহ কফিনে করে যথাযোগ্য মর্যাদায় এখানে নিয়ে আসবেন। এই প্রাসাদ সংলগ্ন সমাধিভূমিতে মহান রামন লালের পবিত্র দেহ রাজকীয় প্রথায় সমাধিস্থ করা হবে।

মাননীয় রাজা–আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। সেনাপতি বললেন।

–এইসব কাজ আপনাকে করতে হবে কাল সূর্যোদয়ের পূর্বেই। রাজা বললেন। সেনাপতি মাথা নুইয়ে বললেন

–যথা আজ্ঞা মাননীয় রাজা। চেয়ার ছেড়ে উঠলেন সেনাপতি। তারপর মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে দ্রুতপায়ে চলে গেলেন। রাজাও উঠলেন। মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে ফ্রান্সিসরা প্রাসাদের বাইরে এলো। মন্ত্রীমশাই গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

রাজপ্রাসাদ পাথরের দেয়ালে ঘেরা। দেয়ালের ওপাশেই বিস্তৃত প্রান্তর। সেনাপতি বেলোর পাথরের বাড়ি প্রান্তরের একপাশে। অন্যদিকে যোদ্ধাদের ছাউনি। ছাউনি বেশ লম্বা টানা ঘর। ছোটো ছোটো ঘর পরপর চলে গেছে। যোদ্ধাদের আবাসস্থল।

সেনাপতি বেলা রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। প্রান্তরে এলেন। চললেন যোদ্ধাদের আবাসস্থলের দিকে। সেনাপতি বেলোকে যোদ্ধাদের ছাউনির দিকে যেতে দেখে পাহারাদার কিছু যোদ্ধা এগিয়ে এলো। মাথা নিচু করে সেনাপতিকে অভিবাদন জানাল। সেনাপতি তাদের বললেন–যাও–সব যোদ্ধাদের বলো এক্ষুণি জড়ো হতে। আমি সব যোদ্ধাদের কিছু বলবো।

যোদ্ধা ক’জন ছুটে গেল যোদ্ধাদের আবাসস্থলের দিকে। কিছুক্ষণ যোদ্ধাদের মধ্যে সেনাপতির আদেশ জানানো হল। সব যোদ্ধা প্রান্তরে এসে আস্তে আস্তে সার দিয়ে দাঁড়াল। যোদ্ধাদের সামনেই একটি পাথরের বেদী। বেদীর রং কালো। রাজা বা সেনাপতি যোদ্ধাদের কোনো আদেশ দেবার সময় এই বেদীতে উঠে আদেশ দেন।

সেনাপতি বেদীতে উঠে দাঁড়ালেন। চারদিক নিস্তব্ধ। যোদ্ধাদের সমাবেশের দিকে তাকিয়ে সেনাপতি বলতে লাগলেন–আমার বীর যোদ্ধারা–দুটো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংবাদ জানাচ্ছি। প্রথম সংবাদ হল–মহামতি রামন লাল কয়েকদিন আগে দেহত্যাগ করেছেন! সেনাপতি কথাটা বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সৈন্যদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। অনেকেই মুখে হায় হায়’ করে উঠল। গভীর শোকে অনেক সৈন্য কেঁদে ফেলল। সেনাপতি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইলেন। তারপর মাথা তুললেন। সেনাপতি হাত তুলে পোশাকের হাতাটা চোখে ঘষে চোখের জল মুছলেন। তারপর বললেন–দ্বিতীয় সংবাদ হল–কিছুদিন আগে এক আরবীয় দলনেতা আমাদের পালমা নোভার দুর্গ দখল করেছে। এই সংবাদটা যাতে রটে না যায় যাতে কেউ রাজধানী পালমায় এসে খবরটা বলতে না পারে তার জন্যে বড়ো রাস্তাটায় পাহারা বসিয়েছে। সে। তাই এই দুটো সংবাদ এতদিন আমরা জানতে পারিনি। সেনাপতি থামলেন। তারপর বললেন-”রাজার হুকুম-কালকের মধ্যে পালমা মুর্গ অধিকার করতে হবে। তারপর আরবীয় দলনেতাকে বন্দি করে নিয়ে আসতে হবে। আর একটি কাজ–মহান চিন্তানায়ক রামন লালের নশ্বর দেহ এনে রাজপরিবারের কবরখানায় যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করা হবে। সেনাপতি থামলেন। তারপর বললেন–জানি, রামন লালের মৃত্যুতে আমরা শোকস্তব্ধ। কিন্তু কর্তব্য তো করতেই হবে। কাজেই সবাই তৈরি হও। আমরা সন্ধেবেলা পালমা নোভার দিকে যাত্রা করবো। যেভাবেই হোক পালমা নোভা দুর্গ অধিকার করতে হবে। সেনাপতি থামলেন। তারপর পাথরের বেদী থেকে নেমে এলেন। রাজার আদেশ জানা হল। যোদ্ধাদের সমাবেশ ভেঙে গেল। যোদ্ধারা কথা বলতে বলতে তাদের আবাসস্থলের দিকে চলল। সেনাপতি বেলোও তার বাড়ির দিকে চললেন।

তখন সন্ধে হয় হয়। বিস্তৃত প্রান্তরে পদাতিক বাহিনী সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে ঘোড়সওয়ার বাহিনী। তারপর একটা তিরন্দাজ বাহিনী। ধন্ধবে সাদা ঘোড়ায় চড়ে সেনাপতি এলেন। তিরন্দাজ বাহিনী সকলের সামনে সেনাপতি এলেন। তলোয়ার কোষমুক্ত করলেন। সামনের দিকে তলোয়ারটা তুলে চিৎকার করে বললেন যাত্রা শুরু। যোদ্ধাবাহিনী যাত্রা শুরু করল।

যোদ্ধাবাহিনী নগরের রাজপথে এলো। চলা শুরু করল দক্ষিণমুখো পালমা নোভার দিকে। ততক্ষণে পালমা নগরের রামন লালের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। যোদ্ধারা পালমা নোভা দুর্গ দখল করতে যাচ্ছে। আর রামন লালের নশ্বর দেহ আনতে যাচ্ছে। এই সংবাদও ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার নগরবাসী পথের দু’ধারে এসে দাঁড়াল। নগরবাসী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। তারা সবাই শোকস্তব্ধ। যোদ্ধাদের উৎসাহ দেবার জন্যেও কেউ ধ্বনি তুলল না। যোদ্ধারা চলল। চারদিক নিঃশব্দ। শুধু যোদ্ধাদের পায়ে চলার শব্দ। আর অনেকেহ ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।

যোদ্ধাবাহিনী যখন পালমা নোভার দুর্গের কাছে এলো তখন বেশ রাত হয়েছে। ওদিকে বড়ো রাস্তার ধারে যে নজরদারদের পহারা রাখা হয়েছিল তারা দূর থেকে রাজা দ্বিতীয় জেমসের ঐ যোদ্ধাবাহিনী দেখে ছুটে এলো দুর্গে। আল আমিরিকে সংবাদ দিল রাজা দ্বিতীয় জেমসের যোদ্ধাবাহিনী পালমা নোভা দুর্গ অধিকার করতে আসছে। আল আমিরি হুকুম দিলে সব যোদ্ধারা যেন দুর্গের চত্বরে এসে জড়ো হয়।

সব সৈন্যরা বর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে তলোয়ার বর্শা হাতে দুর্গের চত্বরে এসে সার বেঁধে দাঁড়াল। তিরন্দাজরাও এল।

একটু পরেই আল আমিরি এলো। যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বলল। আমরা যে এই দুর্গৰ্তা অধিকার করেছি সেটা যেমন করেই হোক রাজা জেমসের কানে উঠেছে। আমাদের এত কড়া নজরদারি সত্ত্বেও এটা কীভাবে হল জানি না। যাহোক, আর কিছুক্ষণের মধ্যে রাজার যোদ্ধাবাহিনী এসে পড়বে। আমরা দুর্গের বাইরের প্রান্তরে যুদ্ধ করবো। ঐ যোদ্ধাদের দুর্গ পর্যন্ত আসতে দেব না। কাজেই শরীরে সমস্ত শক্তি নিয়ে লড়াই চালাতে হবে। আল আমিরি থামল। মূর যোদ্ধারা মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করল। এটা ওদের যুদ্ধে নামার আগের ধ্বনি। আল আমিরি যোদ্ধাদের দুটো দলে ভালো করল। একদল বাইরের প্রান্তরে গিয়ে জড়ো হল। অন্যদল দুর্গের মধ্যেই রইল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাপতি বেলো আর ঘোড়সওয়ার বাহিনী দুর্গের বাইরের রাস্তায় এসে থামলেন। সেনাপতি বেলো একজন ঘোড়সওয়ার সৈন্যকে বললেন–যাও–ঐ মূরবাহিনীর দলনেতা কে তা জানো আর তাকে আমার কাছে আসতে বলে। যুদ্ধের চেয়ে যদি কথা বলে সমস্যাটা মেটানো যায় সেই শেষ চেষ্টাটা করবো আমি।

ঘোড়সওয়ার সৈন্যটি দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আল আমিরি যোদ্ধাবাহিনীর কাছে এলো। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাদের দলনেতা কে? একজন যোদ্ধা বলল– আল আমিরিআমাদের দলনেতা। সেনাপতির পাঠানো যোদ্ধাটি বলল–আল আমিরিকে এখানে আসতে বলো। আমাদের সেনাপতি বেলো তার সঙ্গে কথা বলবেন। আল আমিরির এক সৈন্য বলল–যদি একা পেয়ে আমাদের দলনেতাকে মেরে ফেলে। সেনাপতির যোদ্ধা বলল–আমাদের সেনাপতিও একাই থাকবেন। আল আমিরির সৈন্যরা আর কিছু বলল না। দু’জন দুর্গের দিকে চলল আল আমিরিকে প্রস্তাবটা জানাতে।

সেনাপতি বেলোর একটু সন্দেহ ছিল আল আমিরি আসবে কিনা। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল আল আমিরি ঘোড়ায় চড়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো। ঘোড়া ছুটিয়ে তার যোদ্ধাবাহিনীর সামনে এসে দাঁড়াল। সেনাপতি বেলো আস্তে আস্তে ঘোড়া চালিয়ে আল আমিরির কাছে এসে বললেন–শুনলাম–আপনার নাম আল আমিরি। আপনি আরবীয় দলনেতা।

–ঠিকই শুনেছেন। আল আমিরি বলল।

–আপনি রাজা দ্বিতীয় জেমসের এই দুর্গ অন্যায়ভাবে দখল করে আছেন সেনাপতি বললেন।

হ্যাঁ। লড়াইয়ে রাজার যোদ্ধাদের হারিয়ে তবে দখল করেছি। আল আমিরি বলল।

–ঠিক আছে–এবার আমি রাজা জেমসের সেনাপতি বেলো আপনাকে বলছি। আপনি ভালোয় ভালোয় দুর্গ ছেড়ে দিয়ে চলে যান। সেনাপতি বললেন।

–যদি না যাই। আল আমিরি বলল।

–তাহলে যুদ্ধ হবে। আমাদের যোদ্ধাবাহিনীর যোদ্ধাদের সংখ্যা আপনার যোদ্ধাদের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু শুধু রক্তপাত মৃত্যুকে ডেকে আনবেন না। আপনার দুর্গ ছেড়ে চলে যান। সেনাপতি বললেন।

–না। আমরা লড়াই করবো। আল আমিরি বলল।

–আমি শেষ পর্যন্ত শান্তি সব মিটিয়ে নিতে চেয়েছি। আপনারা তা হতে দিলেন না। তবে যুদ্ধই হোক। সেনাপতি বললেন।

সেনাপতি নিজের যোদ্ধাবাহিনীর কাছে ফিরে এলেন। আল আমিরিও ঘোড়া ছুটিয়ে দুর্গে ঢুকল।

চাঁদের আলো অনুজ্জ্বল। দুর্গে প্রান্তরে সেই আলো ছড়িয়ে আছে। সেনাপতি বেলো নিজেদের বাহিনীর কাছে ফিরে এলেন।

দু’পক্ষের যোদ্ধাবাহিনীর অনড় অপেক্ষা চলছে। সমুদ্রের দিক থেকে জোরালো বাতাস আসছে। শাঁ শাঁ শব্দ উঠছে। একটু দূরের বন-জঙ্গলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *