মাছের কাঁটা – ৬

কৌশিক আদালতে যায়নি। বাড়িতেই ছিল। বেলা বারোটা নাগাদ একটা টেলিফোন এল বাসু-সাহেবের অফিসে। ব্যারিস্টার সাহেব অনুপস্থিত শুনে লোকটা সুকৌশলীর কৌশিক মিত্রের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। কৌশিকের সঙ্গে তার নিম্নোক্ত কথোপকথন হল—

—আপনি কি সুকৌশলীর মিস্টার কৌশিক মিত্ৰ আছেন?

কৌশিক ওর খাজা বাংলা শুনে বললে, আছি। আপনি কে?

—আমার নাম আছে যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া। নামটা পহচানতে পারেন?

—পারি। আপনি গত এগারো তারিখে কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির একটা বাড়ি সাড়ে ছয় লাখ টাকায় কিনেছেন।

—দু-দুটো টেকনিক্যাল গতি হইয়ে গেল, সুকৌশলী দাদা। সাড়ে ছয় না আছে, সাড়ে চার লাখ; ঔর বাড়ির মালিক কাপাডিয়া কোম্পানি না আছে। মালিকের খাস সম্পত্তি ছিল। আর শুনেন—যো মামলাটা বাসু-সাহেব হাতে নিয়েছেন, আই মিন সুরিও দাশগুপ্তের মামলা—ঐটার বিষয়ে কুছ জরুরি টিপ্‌স্‌ আমি বাসু-সাহেবকে দিতে চাই। তা বাসু-সাহেব তো দফতরে না-আছেন না? তাই আপনাকে বাতলিয়ে দিচ্ছি। অগর জরুরত হোয় তো ফিন লিখিয়ে নিন-

—কিন্তু আপনিই যে মিস্টার যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া তা আমি বুঝব কী করে? আপনি বাড়ি থেকে বলছেন তো? লাইন কেটে দিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি এখনই আপনাকে বাড়িতে ফোন করছি—

টেলিফোনে খুকখুক করে হাসির শব্দ ভেসে এল। লোকটা বললে, সুকৌশলী দাদা। আমি ভি কুছকুছ সুকৌশলী আছি। আমি একটা পাবলিক বুথ থিকে টেলিফোন করছি, ঘর থেকে নয়। লেকিন আমি আপনার বাত মানিয়ে নিলাম—আমি যে, জেনুইন যদুপতি আছি, সিটা প্রমাণ করার ‘ওনাস’ আমার আছে। একটা কোড-নাম্বার বাতলাচ্ছি, লিখে নিন— 795630।…লিখেছেন? আমার সঙ্গে বাতচিতের পিছে আপনি হামার বাড়িতে হামার ‘ফাদার’কে ফোন করবেন। তিনি ঐ কোড-নম্বরটা বাতলিয়ে দেবেন। ব্যস! আমার আইডেন্টিটি ইস্ট্যাবলিশ হইয়ে যাবে। সমঝলেন?

কৌশিক অবাক হয়ে বলে, এমন কাণ্ড করার অর্থ?

লোকটা হেসে বললে, আগর বাসু-সাহেব হলে এ বাত পুছতেন না। সমঝিয়ে নিতেন। মালুম হল না?…এ মামলার ফয়সালা যবতক না হচ্ছে ততক্ আমি শালা ছিপিয়ে থাকব। আমার পাত্তা মিলে গেলেই বাসু-সাহেব আমাকে ‘নেওতা’ করে বসবেন-

—নেওতা! মানে নিমন্ত্রণ! কিসের?

—কোর্টের ‘সমন’, সুকৌশলী দাদা! ব্যস! খতম! শালার আদালতে উঠলেই আমাকে কবুল খেতে হবে কি আমি দো-লাখ রূপেয়া ব্ল্যাক-মানি সুপারিও বাবুকে দিয়েছি! কবুল খেলে ইনকাম ট্যাক্সে ফাঁসব।…হর্নস অব এ ডাইনামো সম্‌ঝেন?

—হর্নস্ অব এ ডায়নামো!

—জী হাঁ! ডাইনামো ভি চার্জ নিচ্ছে না, ব্যাটারি ভি ডিসচার্জড! আমার ঐ হালত! তাই ছিপিয়ে বসে আছি!

ইংরাজি জ্ঞান যেমনই হ’ক লোকটা যে খলিফা এটা বোঝা গেল। কৌশিক বললে, তাহলে নিজে থেকে টেলিফোন করছেন কেন?

—সিটা কেমন করে আপনাকে সমঝাই সুকৌশলীদাদা? আমার গলায় যে মছলির কাঁটা বিঁধিয়ে গেল। হর্নস্ অব এ ডাইনামো—শালার কাঁটা না নামছে না উগড়াচ্ছে।

— মছলির কাঁটা! সেটা আবার কী?

—আপনি বাংগালি আছেন, ফির ‘মাছের কাঁটা’ বুঝেন না?…আপনার ক্লায়েন্ট শালা সাচ্চা মাল আছে। এমন ইমানদার বুড়বক আমি জিন্দগিভর দুটি দেখি নাই। শালা যদি খালাস পায় ঔর কাপাডিয়া কোম্পানি যদি ওকে বরখাস্ত করে তবে ঐ শালা ইমানদার বুড়বককে আমি দেড়া মাইনা দিয়ে আমার ম্যানেজার বানিয়ে লিব!

কৌশিক হেসে বলে, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না কি মিস্টার…?

লোকটা গম্ভীরস্বরে বললে, জি নেহি! তাহলে সেই কোথাই শুনাই : মোহনস্বরূপ কাপাডিয়া তাঁর ম্যানেজারকে সিরফ স্পেশাল পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দেননি -দরটা ফাইনাল করবার এক্তিয়ারও দিয়েছিলেন। মোহনস্বরূপজি লেনদেনটা খুব গোপন রাখতে চেয়েছিলেন—আমি জানি, চার লাখ টাকাতে তিনি ক্লোজ ডাউন করতেন। লেকিন তা হতে পারেনি ঐ শালা ইমানদার বুড়বটার জন্য। সে কলকাতা বাজারে যাচাই করে সমঝে নিয়েছিল কি হোয়াইট মানিতে সাত লাখ দর উঠবে। আমি তখন ঐ ম্যানেজারকে সিধা অফার দিয়েছিলাম কি সে যদি ভাও কমিয়ে দেয় তবে টুইন্টি ফাইভ পার্সেন্ট কমিশন দিব। লোকটা এত বড় বুড়বক্ যে, রাজি হল না! আমি দাদা নাত্বক কালোটাকায় ডুবে আছি, লেকিন ঐসব বুড়বকের জন্য আজও আমি মাথার টুপি খুলি। সমঝলেন?

—বলে যান। আমি শুনছি—

—আদালতে দাঁড়িয়ে আমি এজাহার দিতে সেক্‌ব না; লেকিন ঐ জান-কবুল বুড়বকটাকে বাঁচাবার জন্য আমি তৈয়ার! কাপাডিয়া কোম্পানি যদি মামলা খরচ না দেয় তবে আমি ও মামলা চালাতে প্রস্তুত—

—কালো টাকায়?

—সে বাত পুছিয়ে কেন লজ্জা দিচ্ছেন দাদা! বাসু-সাহেবকে আমার নাম বাতাবেন।

—কিন্তু বাসু-সাহেব আপনার পাত্তা পাবেন কেমন করে?

ঐ তো মুশকিল আছে দাদা। তো ঠিক হ্যায়, আমি ফিন রাত আট বাজে ফোন করব।

—তার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন তো? প্রথম কথা, গত বৃহস্পতিবার, আই মিন এগারোই এপ্রিল রাত্রে আপনারা তিনজনে মোকাম্বোতে খেয়েছিলেন?

—তিনজন না আছে দাদা, দু’জন। আমি আর ঐ সুপারিও দাশগুপ্তা। রাত সাড়ে সাত বাজে মোকাম্বোতে ঘুষেছিলাম, সাড়ে নও বাজে নিকলে আসি। জৈনসাব যখন বড়বাজারে ফৌত হল তখন ঐ সুপারিও শালা আমার সামনে বসে মুরগির টেংরি চুষছে। আপন গড।

—সেখানে ঐ ক্যাশিয়ার জীবন বিশ্বাস ছিল না?

—সুকৌশলীদাদা-

—আমার নাম সুকৌশলী নয়, কৌশিক-

—একই বাত আছে দাদা। লেকিন এটা তো মানবেন কি ঐ গন্দাকামিজ পিনহেবালা বিয়াসবাবুকে নিয়ে আমি মোকাম্বোতে ঘুষবো না? সে পান খেতে চেয়েছিল, তাকে পান-শ’ রূপেয়ার পান খাইয়েছি। ‘পান খাওয়া’ সমঝেন?

কৌশিক বলে, আর একটা কথা বলুন তো? ওরা ঐ বাড়তি দু’লাখ টাকা কী ভাবে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিল?

—কালোটাকার লেন-দেন কী ভাবে হয় আপনি জানেন না সুকৌশলীদাদা? হুন্ডি। হুন্ডির চোরা গলিতে। আমি খোদ ইন্তাজাম করে দিয়েছিলাম। জৈনসাব ঐ হুন্ডি দিত। লেকিন তার আগেই লোকটা ফৌত হইয়ে গেল। ইমানদার বেওকুফটা রোডে সিট-ডাউন হইয়ে গেল।

—কৌশিক ধমক দিয়ে ওঠে, বার বার লোকটাকে ইমানদার বেওকুফ বলছেন, সেই ইমানদার লোকটাকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচানোর জন্যে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবার সাহস আপনার নেই?

—দাদা! দো-লাখ রূপিয়ার ঝামেলা আছে। আমি বিলকুল গড্ডায় গিরে যাব—

—তবে ফোন করছেন কেন?

—ওহি তো বাতাচ্ছি! হর্নস অব এ ডাইনামো! ইদিকে আই.টি.ও. উদিকে মছলির কাঁটা—

—কৌশিক উত্তেজিত হয়ে বলে, আপনি কী মশাই? আপনি…আপনি একটা— কথাটা তার শেষ হয় না। যদুপতি বলে ওঠে, সুকৌশলীদাদা! এখন আপনি আমাকে শালা-বাহানচোৎ শুরু করবেন। আমি লাইন কাটিয়ে দিলাম…

সত্যই সে টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিল।

স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল কৌশিক। যদুপতি সিঙ্ঘানিয়ার চরিত্রটাকে বুঝবার চেষ্টা করল। লোকটা নিজেই স্বীকার করছে তার নাক পর্যন্ত ডুবে আছে কালো টাকায়। তাহলে ‘মাছের কাঁটা’ বলতে সে কী বোঝাতে চায়? কোথায় বাধছে তার ঐ কাঁটাটা? বিবেক? বিবেক বলে ঐ জাতীয় লোকের সত্যই কিছু থাকে না কি?

একটু পরে সে টেলিফোন ডাইরেক্টারি হাতড়ে ফোন করল যদুপতির বাবা রঘুপতি সিঙ্ঘানিয়াকে। বাপ ছেলের মতো বাংলা বলতে পারেন না। কৌশিক যেইমাত্র বলল যে, সে ব্যারিস্টার বাসুর বাড়ি থেকে ফোন করছে, ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ বললেন, তব ঠাহরিয়ে!

মিনিটখানেক টেলিফোনে আর মনুষ্যকণ্ঠ শোনা গেল না। ক্ষীণ সুরে বিবিধ-ভারতীর হিন্দি প্রোগ্রামের গানের সঙ্গে একটা অ্যালসেশিয়ানের গর্জন ভেসে এল শুধু। তারপর শুনল : অব শুনিয়ে! ম্যায় রঘুপতি সিঙ্ঘানিয়া বোলতা হুঁ। মুঝকো কহনেকা মতলব ইয়ে হ্যায় কি : সেবুন-নাইন-ফাইভ-সিকস্-থিরি ওর ইয়ে ক্যা হ্যায়? জিরো হোগা সায়েদ। রাম রাম…

লাইন কেটে দিলেন রঘুপতি।

কিন্ত কৌশিক ছাড়বার পাত্র নয়। পুনরায় ফোন করল সে। এবার বৃদ্ধ সিঙ্ঘানিয়া সিংহমূর্তি ধরলেন। অনর্গল মাতৃভাষায় যে ঝড় বইয়ে দিলেন তার নির্গলিতার্থ : তিনি এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানেন না—তাঁর পুত্রের নির্দেশ আছে, ব্যারিস্টার বাসুর ফোন এলে ঐ অদ্ভুত নাম্বারটা তাঁকে শুধু শুনিয়ে দিতে হবে। কেন, কী বৃত্তান্ত তিনি কিছুই জানেন না। ঐ সঙ্গে আরও বললেন—এসব হচ্ছে ঐ ‘জিরো-জিরো-সেবুন’ মার্কা পিকচারের কুফল। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বর্তমান জেমস্ বন্ডের ভূমিকায় না-পাত্তা হয়ে গেছেন। ফলে তাঁর মন-মেজাজ খারাপ। নিজেকেই গদিতে বসতে হচ্ছে। তাঁকে যেন এ নিয়ে আর বিরক্ত করা না হয়। পুনরায় রাম-নামের দ্বিত্বপ্রয়োগান্তে তিনি দূরভাষণে ক্ষান্ত হলেন।

কৌশিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল। বেলা বারোটা। এখনই বার হলে মধ্যাহ্ন-অবকাশের মধ্যে বাসু-সাহেবকে খবরগুলো জানানো যায়। সে তৎক্ষণাৎ একটা ট্যাক্সি নিয়ে আদালতের দিকে রওনা দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *