২
মাসখানেক পরের কথা।
এই একমাসে নিউ আলিপুরের ও-ব্লকের বাড়িটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এতদিন অধিকাংশ ঘরই তালাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। মিস্সে বাসুর গতিবিধি শুধুমাত্র একতলাতেই সীমিত। দোতলাটা ভাড়া দেবার কথা হয়েছে মাঝে মাঝে—কিন্তু অজানা উটকো লোক এসে ঝামেলা না বাধায় মাথার উপর বসে—এ জন্যই এতদিন দোতলাটা ভাড়া দেওয়া হয়নি। অর্থের প্রয়োজন তো আর ওঁদের নেই। প্রথম জীবনে মাসে দশ-বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করেছেন বাসু-সাহেব।
বাড়ির পুবদিকের অংশের দুখানি ঘর। পিছনের ঘরটা হচ্ছে লাইব্রেরি, সামনেটা দুটি অংশে বিভক্ত। সামনের দিকটা ল অফিস–ভিতরে বাসু-সাহেবের চেম্বার। একজন সদ্য-পাশ উকিল, প্রদ্যোত নাথ, জুনিয়ার হিসাবে কাজ শিখতে এসেছে। এছাড়া আর দ্বিতীয় কর্মী নেই। বাসু-সাহেব বলেন, অনেকদিন পর শুরু করেছি তো—প্রথমেই কতগুলো লোককে চাকরি দেব না। প্র্যাকটিস্ যেমন যেমন জমবে, অফিসে লোকও বাড়াব।
পশ্চিমদিকের অংশটাতেও দুখানি ঘর। ‘সুকৌশলী ও কোনো বাড়তি লোক নেয়নি। সুজাতা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটা পোর্টেব্ল টাইপরাইটারে ধীরে ধীরে টাইপ করে। কৌশিক প্রথম মাসে একটাও বিজনেস্ পায়নি। কীভাবে বিজ্ঞাপন দেবে তাই শুধু ভাবছে। বাসু-সাহেব একটা কেস্ পাঠিয়েছিলেন—ডিভোর্স কেস! মেয়েটির অভিযোগ তার স্বামী অসৎচরিত্র। তাই কৌশিককে কদিন তার পিছনে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। খারাপ পাড়ায়।
তারপর একদিন। শুক্রবার বারোই এপ্রিল। বাসু-সাহেব নিজের ঘরে বসে, একটা আইনের বই পড়ছিলেন। হঠাৎ ইন্টারকমটা বেজে উঠল। সুইচটা টিপে বাসু-সাহেব বলেন, কী ব্যাপার, ব্রেকফাস্ট রেডি?
—না। তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছেন। মিস্টার জীবন কুমার বিশ্বাস। প্রয়োজন বলছেন, আইনঘটিত পরামর্শ। পাঠিয়ে দেব?
বইটা সরিয়ে রেখে বাসু-সাহেব বললেন, দাও।
সকাল সাড়ে আটটা। অফিস আজ ছুটি, গুড ফ্রাইডে। প্রদ্যোত আসবে না আজ। কাছারি বন্ধ। একটু পরে বিশু পথ দেখিয়ে একজন ভদ্রলোককে নিয়ে এল। ভদ্রলোক কাশলেন। বাসু-সাহেব এবার ওঁর দিকে ফিরে বললেন, আসুন। বসুন ঐ সোফাটায়।
আগন্তুক ভদ্রলোক জানতেন না বাসু-সাহেবের টেকনিক। মানব-চরিত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল পি.কে. বাসু জানেন উকিলের সাক্ষাত্মাত্র লোকে একটা আবরণ টেনে দেয় তার মনের উপর। ঠিক যে মুহূর্তে সে উকিলের দিকে চোখে-চোখ তুলে তাকায় তখনই সেই পর্দাটা সে টেনে দেয়—ঠিক তার আগের মুহূর্তটাতেই সে সব চেয়ে দুর্বল—যখন সে ছদ্মবেশ ধারণ করতে চাইছে। তাই বাসু-সাহেবের চেম্বারে ওঁর সামনেই অন্ধকারে টাঙানো আছে, একটা আয়না, আর প্রবেশ পথের উপর ফেলা আছে একটা জোরালো আলো। আগন্তুক ধ্যানস্থ ব্যারিস্টার সাহেবকে দেখে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না—তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে আয়নার ভিতর দিয়ে ওকেই লক্ষ্য করছিলেন। ঘরে ঢুকে পরে হয়তো সে এটা লক্ষ্য করে—কিন্তু ততক্ষণে প্রথম প্রবেশ-মুহূর্তটি অতিক্রান্ত।
—বলুন, কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
আগন্তুক ধুতি-পাঞ্জাবি পরা—বেশবাসে আভিজাত্য নেই কিছু। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। চোখে চশমা, ঝোলা গোঁফ, হাতে একটি ফোলিও ব্যাগ
—ব্যাগটা পাশে রেখে জীবনবাবু বসলেন সোফাটায়। হাত দুটো জোড় করে নমস্কার করলেন। বললেন, তার আগে স্যার, একটা কথা জানতে চাই। আপনাকে কত ফি দিতে হবে? আমি মধ্যবিত্তর ছাপোষা মানুষ, বিপদে পড়ে এসেছি। আপনার নাম আমি অনেক শুনেছি; কিন্তু আপনাকে উপযুক্ত মর্যাদা দেবার আর্থিক ক্ষমতা আমার নেই।
—কী করেন আপনি?
— আমি স্যার বোম্বাই-এর কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির ক্যাশিয়ার। কুল্লে চারশ পঁচাত্তর টাকা মাইনে পাই, আর ফ্রি কোয়ার্টার্স। ব্যবসায়ের কাজেই কলকাতায় এসেছি—মানে মালিকের নির্দেশে। আমি আজ দশ বছর কলকাতা ছাড়া—পথ-ঘাটও ভাল চিনি না। এখানে এসেই বিপদে পড়ে গেছি। আত্মীয়-বন্ধু কেউ নেই যে পরামর্শ করি। আপনার নাম জানা ছিল। টেলিফোন গাইড খুঁজে ঠিকানা দেখে চলে এসেছি।
—তাহলে আগে একটা টেলিফোন করলেই পারতেন?
—টেলিফোনে ও সব কথা বলতে চাই না স্যার।
—কী আশ্চর্য! টেলিফোনে তো শুধু অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতেন। যাক সে কথা, আপনার বিপদটা কী জাতীয়?
—স্যার, আপনার ফি-এর কথাটা—
—ফি-এর অঙ্কটা নির্ভর করবে আপনার কেস-এর উপর। তবে কেসটা শোনার জন্য আমি কিছু চার্জ করব না। আপনি বিস্তারিত বলে যান। ফি-এর কথা অত ভাববেন না, প্রয়োজন হলে আপনাকে পরামর্শও দেব, ফি চার্জ করব না।—বলুন—
—আপনি আমাকে বাঁচালেন স্যার। তাহলে খুলেই বলি সব কথা
জীবন বিশ্বাস মাড়োয়ারি সওদাগরি অফিসের ক্যাশিয়ার। কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া একটি কোটিপতি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। মালিকের নির্দেশে জীবনবাবু কলকাতায় এসেছেন দিন-সাতেক আগে। একা নয়, সঙ্গে আছেন ম্যানেজার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত। ম্যানেজারের নতুন চাকরি, এম.এ. পাশ। চাকরি নতুন হলেও বড়কর্তার প্রিয় পাত্র। ওঁরা এসে উঠেছেন পার্ক স্ট্রিটের পার্ক হোটেলে—
বাসু-সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ঐ সুপ্রিয় কত টাকা মাইনে পায়?
—কাটাকুটি করে পে-প্যাকেট পায় এগারো শো টাকার, লোন নেওয়া আছে বলে বেশ কিছু কাটা যায়।
—বুঝলাম। পার্ক হোটেলে দৈনিক কত খরচ পড়ছে আপনাদের?
জীবনবাবু রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন স্যার। খুলেই বলি। আমরা ঠিক কোম্পানির কাজে আসিনি-এসেছি আমাদের বড়কর্তা মোহনস্বরূপ কাপাডিয়ার ব্যক্তিগত কাজে—যাবতীয় খরচ তাঁরই। বড়কর্তার সাদা অ্যাভিন্যুতে একটা বাড়ি আছে। সেটা বিক্রির ব্যাপারে। বিক্রি হল সাড়ে ছয় লাখ টাকায়। রেজেস্ট্রি ডিডে কিন্তু লেখা হল সাড়ে চার। দুই লাখ হচ্ছে কালো টাকা। এটা আমরা নগদ নিয়েছি। টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখা চলবে না, ব্যাঙ্ক ড্রাফট্ করানো চলবে না। বড়কর্তার নির্দেশ আছে ওটা নগদে বড়বাজারে একজনের কাছে জমা দিয়ে হুন্ডি করিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নগদ দু’লাখ টাকা হয়তো দু-একদিন হোটেলে লুকিয়ে রাখতে হতে পারে। তাই বড়কর্তা আমাদের দুজনকে কোনো খানদানি বড়-হোটেলেই উঠতে বলেছিলেন। দিন চার-পাঁচের তো ব্যাপার-
—বুঝলাম। তারপর? লেনদেন হয়ে গেছে?
—হ্যাঁ স্যার, কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি, সুপ্রিয়বাবুর মতি-গতি সন্দেহজনক লাগছে আমার কাছে। উনি টাকাটা নগদেই বোম্বাই নিয়ে যেতে চাইছেন। কারণ, বলছেন, যাঁর কাছ থেকে হুন্ডি করানোর কথা তিনি এখন কলকাতায় নেই—
—এ কথাটা সত্যি? আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন?
—হ্যাঁ স্যার। সত্যি।
—তাহলে আপনার বড়কর্তার সঙ্গে ট্রাংক লাইনে কথাবার্তা বলে নিৰ্দেশ নিন না।
—ঐখানেই তো হয়েছে মুশকিল স্যার। বড়কর্তা বোম্বাইয়ে নেই—এমনকি ভারতবর্ষে নেই। উনি এখন আছেন ব্যাঙ্ককে। আর সবচেয়ে ঝামেলা হয়েছে এই যে, বড়কর্তা এই সম্পত্তিটা বেচে দিচ্ছেন গোপনে-মানে তাঁর পরিবারের লোকেরাও জানে না। ওঁর স্ত্রী পর্যন্ত না।
—স্ত্রী পর্যন্ত না? আপনি সেটা কেমন করে জানলেন?
—হাসলেন জীবনবাবু। বললেন, ও আপনি শুনতে চাইবেন না স্যার—মেয়েছেলে- ঘটিত ব্যাপার। টাকাটা উনি ওঁর রক্ষিতাকে দিচ্ছেন। মানে ওড়াচ্ছেন!
—বেশ তো, তাঁর টাকা তিনি ওড়াচ্ছেন—তাতে আপনার আমার কী?
–না, তো তো বটেই। আমার আশঙ্কা হচ্ছে ঐ দু’লাখ টাকা নগদে নিয়ে যাবার সময় যদি ভালমন্দ কিছু হয়ে যায়, তবে আমি ফেঁসে যাব না তো?
বাসু-সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, দায়িত্বটা আপনার বড়কর্তা কার উপর দিয়েছেন?
—ম্যানেজারের উপর স্যার। আমি তো ক্যাশিয়ার মাত্র। পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেওয়া আছে ম্যানেজারকে। দলিলে, রসিদে সইও করেছেন তিনি—আমি শুধু সঙ্গে আছি। উনিই আমার উপরওয়ালা—
—তবে আর কী? আপনার ভয়টা কী?
জীবনবাবু ইতস্তত করে বললেন, এর মধ্যে স্যার আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। ম্যানেজার-সাহেব আমাকে ট্রেনের টিকিট কাটতে পাঠিয়েছিলেন। বোম্বে মেলে একটা ফার্স্ট ক্লাস ক্যুপেতে দুখানা টিকিট আমি কেটে এনেছি—কিন্তু টিকিটটা কাটা হয়েছে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস দাশগুপ্তের নামে।
—তাতে কী? মিসেস দাশগুপ্তাও ঐ ট্রেনে যাচ্ছেন বুঝি? আর আপনার টিকিট হয়েছে কি পাশের কামরায়?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু মজা হচ্ছে এই যে, মিসেস দাশগুপ্তা বর্তমানে বোম্বাইতে আছেন।
–তার মানে? আপনি আপনার ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করেননি এমন করার অর্থটা কী?
—করেছিলাম। উনি বললেন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ না বললে ক্যুপে পাওয়া যাবে না। তাই উনি তিনখানা টিকিট কাটতে বলেছেন, ট্রেন ছাড়ার সময় আমি বসব পাশের কামরায়। ক্যুপের একটা সিট ফাঁকা থাকবে। তারপর আমি চলে আসব ক্যুপেতে।
বাসু-সাহেব জবাব দিলেন না। কী যেন ভাবছেন তিনি। জীবনবাবু বলেন, ইতিমধ্যে আরও এক ব্যাপার হয়েছে স্যার। আমাদের হোটেলে পাশের ঘরেই একজন মহিলা এসে উঠেছেন। তিনি ম্যানেজারের সঙ্গে মাঝে মাঝে গুজগুজ ফুসফুস করছেন। তিনি যে কে, তা আমি জানি না। প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি বুঝি বাঙালি। কিন্তু ম্যানেজার-সাহেব বললেন, ওঁর নাম মিস্ ডিক্রুজা এবং জানালেন তিনিও নাকি ঐ একই ট্রেনে বোম্বাই যাচ্ছেন।
—ইন্টারেস্টিং কেস! ঐ একই ক্যুপেতে?
—হঠাৎ লজ্জা পেলেন জীবনবাবু। মুখটা নীচু করে বললেন, সেটা আমি জিজ্ঞাসা করিনি স্যার। হাজার হোক উনি আমার ওপরওয়ালা। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে। এক নম্বর—কেন উনি এভাবে অতগুলো নগদ টাকা ট্রেনে করে নিয়ে যাচ্ছেন? দু নম্বর—কেন আমাকে পাশের ঘরে পাচার করলেন, তিন নম্বর—ঐ অচেনা মেয়েটা যদি সত্যিই ওঁর সঙ্গে এক ক্যুপেতে-সঙ্কোচে মাঝখানেই থেমে গেলেন জীবনবাবু।
—বুঝলাম। তা আপনি কী করতে চান?
—সেই পরামর্শই তো করতে এসেছি আপনার সঙ্গে।
—কবে আপনাদের রওনা হওয়ার কথা?
—আজ রাত্রে সাড়ে সাতটার বম্বে মেল-এ।
—টাকাটা বর্তমানে কোথায় আছে? হোটেলে আপনাদের ঘরে?
—হোটেলেই; তবে আমাদের ঘরে নয়। হোটেলের সেফ-ডিপজিট ভল্টে।
—টাকাটা কি একশ’ টাকার নোটে?’
—আজ্ঞে না দশ টাকার নোটে। স্যুটকেস বোঝাই!
—ঠিক আছে। আপনি এক কাজ করুন—আমাকে যা যা বললেন তা একটা বিবৃতির আকারে লিখে ফেলুন। সেটা আমাকে দিয়ে যান। যাতে প্রমাণ হবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটার পর আপনি বানিয়ে কিছু বলছেন না।
জীবনবাবু গোঁজ হয়ে বসে কী ভাবতে থাকেন।
—কী ভাবছেন বলুন তো?
—ভাবছিলাম কি স্যার, আপনি যা বলছেন তা খুবই ভাল–কিন্তু একটা মুশকিল আছে। ধরুন যদি ভালমন্দ কিছু হয়েই যায় তখন আপনি হবেন আমার পক্ষের উকিল। সে ক্ষেত্রে তো আপনি নিজেই সাক্ষী দিতে পারবেন না। তার চেয়ে এক কাজ করি না কেন? আমি এখন হোটেলে ফিরে যাই। সব কথা একটা বিবৃতির আকারে লিখে ফেলি। তারপর পোস্ট-অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে আপনাকে পাঠাই। সিল মোহর করে। আমি ভাল করে দেখে দেব যাবে পোস্ট-অফিসে তারিখের ছাপটা খামের উপর পড়ে। সে ক্ষেত্রে আপনি সিলটা ভাঙবেন না। চিঠিটাও পড়বেন না। ভালমন্দ কিছু ঘটলে সিল-মোহর করা খামটাই আপনি প্রমাণ হিসাবে দাখিল করবেন!
বাসু-সাহেব বুঝতে পারেন এই ক্যাশিয়ার একটি ধুরন্ধর ব্যক্তি। বললেন, কিন্তু পোস্ট-অফিস তো আজ বন্ধ। গুড-ফ্রাইডের ছুটি।
—জি.পি.ও. তে রেজিস্ট্রেশন খোলা। সে আপনাকে ভাবতে হবে না।
—ঠিক আছে। তাই করুন।
—আপনি আমাকে বাঁচালেন স্যার।
বাসু-সাহেব তাঁর ডায়েরিতে ওঁদের নাম, ধাম, পার্ক হোটেলের রুম নম্বর, রেলওয়ে টিকিট তিনটের নম্বর এবং বোম্বাইয়ের ঠিকানা লিখে নিলেন। জীবনবাবু প্রশ্ন করেন, আপনাকে কী দেব স্যার?
—কিছু দিতে হবে না আপনাকে। এবার আসুন আপনি
জীবনবাবু যেন এই জবাবই আশা করছিলেন। নমস্কার করে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলেন তিনি। জীবনবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র বাসু-সাহেব ইন্টারকমে সকলকে ডেকে পাঠালেন তাঁর ঘরে। পূর্বাংশ, পশ্চিমাংশ এবং মধ্যমাংশের রিসেপশান কাউন্টারের মধ্যে ইন্টারকম ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পাঁচ মিনিটের ভিতরেই বাসু-সাহেবের ঘরে এসে বসলেন মিসেস বাসু, কৌশিক আর সুজাতা। বাসু-সাহেব বললেন, তোমাদের পরমার্শ চাইছি, বল আমার কী করা উচিত? ওয়ান ইজটু টোয়েন্টি রেশিওতে একটা বাজি ধরার সুযোগ এসেছে আমার সামনে। পাঁচশ’ টাকা ঢালতে হবে—পেলে পাব দশহাজার, না পেলে পাঁচশ’ টাকাই বরবাদ হবে! এখন তোমরা বল, আমার কী করা উচিত?
কৌশিক বললে, ওয়ান ইজ-টু টোয়েন্টি! নিশ্চয় বাজি ধরবেন!
সুজাতা বলে, আগে বলুন জেতার চান্স কত পার্সেন্ট?
রানি বললেন, করছ ওকালতি, এর মধ্যে বাজি ধরাধরির কী আছে?
বাসু-সাহেব নিরুপায়ভাবে শ্রাগ্ করলেন শুধু
ওদের পীড়াপীড়িতে খুলে বলতে হল সব কথা। শেষে বললেন, আমার অভিজ্ঞতা বলছে—ব্যাপারটা ঘোরালো! ঈশান কোণে যে ছোট্ট কালো স্পটটা দেখা যাচ্ছে ওটা কালবৈশাখী হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। খুন, তহবিল তছরুপ, রাহাজানি, ডাকাতি যা হোক কিছু একটা হবে। কেসটা তাহলে অনিবার্যভাবে আসবে আমার কাছে। দু-লাখ টাকা ইনভল্ভড্ হলে পাঁচ পার্সেন্ট হিসাবে আমার কমিশন হবে দশ হাজার টাকা। কিন্তু এখনই আমাকে সেই আশায় শ’ পাঁচেক টাকা ইনভেস্ট করতে হয়। আমার প্রশ্ন : করব?
কৌশিক আবার বললে, আলবাত!
সুজাতা বলে, এটা গাছে-কাঁঠাল-গোঁফে-তেল হচ্ছে না কি?
বাসু-সাহেব বলেন, আর রানু? তোমার মত?
রানি বলেন, আমার মতে সুজাতা একটু বেশি আশাবাদী। গাছে কাঁঠাল নজরে পড়ছে না আমার! বরং বলতে পার ট্যাকে-বিচি, গোঁফে তেল!’
—সেটা আবার কী?
—তুমি কাঁঠালের বিচি পকেটে নিয়ে ঘুরছ। পুঁতলেই গাছ হবে, গাছ হলেই কাঁঠাল, পাকলেই পেড়ে খেতে হবে—তাই গোঁফে তেল দিতে শুরু করেছ!
হো-হো করে হেসে ওঠে সবাই। মায় বাসু-সাহেব পর্যন্ত
শেষ পর্যন্ত কিন্তু বাসু-সাহেবকে রোখা গেল না। ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস, হয় জীবনবাবু, না হয় ঐ সুপ্রিয়-ডিক্রুজা টাকাটা হাতাবার তালে আছে। এখন থেকে ব্যবস্থা করলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো চলতে পারে। কৌশিককে উনি বললেন, তুমি এখনই একটা স্যুটকেস্ নিয়ে পার্ক হোটেলে চলে যাও। ওরা আছে রুম নম্বর 39-এ। তার কাছাকাছি একটা ঘর একদিনের জন্য ভাড়া নিও। ঘরটা নেওয়ার আগে দেখে নিও ওখান থেকে রুম 39 নজরে আসে কি না। তারপর সারাদিন ঐ ক্যাশিয়ার ম্যানেজারের উপর নজর রাখ। কে কখন বেরিয়ে যাচ্ছে, ঢুকছে, কোনও বাইরের ভিজিটার্স আসছে কি না, কোথায় লাঞ্চ করছে ইত্যাদি।
কৌশিক বলে, আর কিছু?
—হ্যাঁ। এছাড়া তুমি বম্বে মেলে-এ একখানা ফার্স্ট ক্লাস টিকিট কাট। রিজার্ভেশান যদি না পাও তাহলেও টিকিট কাটবে। সুপ্রিয় যে কথা জীবন বিশ্বাসকে বলেছে তা যদি সত্য হয় তাহলে একটা ব্যার্থ শেষ মুহূর্তে খালি পাবেই। যদি নাও পাও তবে কন্ডাকটার গার্ড-এর সঙ্গে ম্যানেজ করে নিও। শেষ পর্যন্ত দরকার হলে প্যাসেজে বসেই যেতে হবে। মোটকথা ঐ বগিতে তোমাকে বোম্বাই যেতে হবে।
—বুঝলাম। বোম্বাই গেলাম। তারপর?
—ঐ ম্যানেজার আর ক্যাশিয়ার নিরাপদে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলেই তোমার ছুটি। ফিরে আসবে। কিন্তু তার আগে সহযাত্রী হিসাবে ওদের দু-জনের সঙ্গেই যতটা পার আলাপ জমাবে।
—আর কিছু নির্দেশ?
—আছে। প্রথম কথা, পার্ক হোটেলে যখন উঠবে তখন তোমার ছদ্মবেশ থাকবে। ট্রেনে স্বাভাবিক চেহারায়। যাতে ওরা দুজন বুঝতে না পারে যে, ওদের ট্রেনের সহযাত্রী ভদ্রলোকে ঐ পার্ক-হোটেলেরই বোর্ডার ছিল। দ্বিতীয় কথা, ট্রেন ছাড়ার আগে তুমি সুজাতার সঙ্গে কথা বলবে না।
—সুজাতা! সুজাতাকে কোথায় পাব?
বাসু-সাহেব এবার সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, তুমি সুজাতা, সন্ধ্যা সাড়ে ছটার সময় একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাওড়া স্টেশানে চলে যাবে। সঙ্গে নেবে শুধু একটা লেডিজ হাত-ব্যাগ। স্টেশানে পৌঁছে একটা প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটবে। বম্বে মেল নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে রাত সাড়ে সাতটার সময় ছাড়ে। কিন্তু সেটাকে বেদবাক্য বলে ধরে নিও না। কানখাড়া করে শুনে নিও ঘোষক বলছে কি না : কৃপা কর্ শুনিয়ে থ্রি-আপ বোম্বাই মেল নও নম্বরকে বদলে—
সুজাতা বাধা দিয়ে বলে, আপনি কি আমাকে বাচ্চা খুকিটি পেয়েছেন?
—না। সব সম্ভাবনাই ভেবে দেখছি আমি। মোটকথা ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভেশান চার্টে দেখবে 3542 এবং 3543 টিকিটধারি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ দাসগুপ্তের ক্যুপ কোন্ বগিতে আছে। ঐ ক্যুপেতে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে-থাকবে। কী হচ্ছে না হচ্ছে দেখবে।
—আর-কন্ডাকটার গার্ড যখন আমার রিজার্ভেশান টিকিট দেখতে চাইবে?
—তখন বলবে, তুমি মিসেস দাশগুপ্তা। তোমার কর্তা টিকিট আর মালপত্র নিয়ে পিছনের ট্যাক্সিতে আসছেন। ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত ঐ অজুহাতে কামরায় বসে থাকবে। তারপর বাধ্য হয়ে নেবে কর্তাকে খুঁজবার অভিনয় করবে। এনি কোশ্চেন?
—ধরুন যদি ঐ সুপ্রিয় দাশগুপ্ত একটি মহিলাকে নিয়ে এসে কন্ডাকটার গার্ডকে তাদের রিজার্ভেশান দেখায়?
—তা তো দেখাবেই। তবু তুমি সিট ছাড়বে না। ঝগড়া-চেঁচামেচি করবে—যাতে ভিড় জমে যায়।…অমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন সুজাতা এ জাতীয় কাজ তো তোমরা হামেশাই অহেতুক করে থাক, আজ প্রয়োজনে পারবে না?
—কী করে থাকি?
—অবুঝের মতে অহেতুক চেঁচামেচি! আবদেরে ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলা— আগে আমার মিস্টার আসুন, না হলে আমি সিট ছাড়ব না।’
সুজাতা হেসে ফেলে। বলে, আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো?
ভিড় জমানো। যাতে আশপাশের কামরার প্যাসেঞ্জার কৌতূহল হয়ে ব্যাপারটা দেখতে আসে। অন্তত কন্ডাকটার গার্ড যাতে ঐ তথাকথিত মিসেস্ দাশগুপ্তকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে ঐ কন্ডাকটার গার্ড বা অন্য কোনো সহযাত্রী সহজেই মেয়েটিকে শনাক্ত করতে পারবে।
রানি বলেন, আর আমার কাজ? কড়ায় তেল বসিয়ে দেব?
—তেল?
—ভ্যারেণ্ডা ভাজতে?
—না! তুমি হচ্ছ আমাদের কন্ট্রোলরুম। কৌশিক প্রতি দু’তিন ঘণ্টা অন্তর রিপোর্ট দেবে। তুমি সেই রিপোর্ট সময়-চিহ্ন দিয়ে নোট করে যাবে। আমাদের তিনজনকে গাইড করবে ওর রিপোর্ট অনুযায়ী।