মাছের কাঁটা – ৪

শনিবার তেরো তারিখ সন্ধ্যায় জীবন বিশ্বাস এসে হাজির হল বাসু-সাহেবের চেম্বারে। একদিনেই লোকটা যেন অর্ধেক হয়ে গেছে। ভেঙে পড়ল সে একেবারে, হুজুর এবার বাঁচান আমাদের!

—কী হল আবার? আপনার না গতকাল বোম্বাই চলে যাবার কথা?

—তাই তো কথা ছিল স্যার। ট্রেন ছাড়ার আগে নেমে পড়তে হল আমাকে। এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। বলি শুনুন :

জীবন বিশ্বাস বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন ঘটনাটার। হোটেল থেকে যথাসময়ে ওঁরা স্টেশানে এসেছিলেন। কথা ছিল, মিস্টার দাশগুপ্ত ক্যুপেতে একা থাকবেন ট্রেন ছাড়ার সময় এবং ট্রেন চলতে শুরু করলে পাশের কামরা থেকে জীবনবাবু এসে ওটাতে রাত্রে শোবেন। কিন্তু ঝামেলা বাধালেন এক ভদ্রমহিলা। জীবন তাঁকে চেনেন না, তিনি নাকি আগেভাগেই ঐ ক্যুপের একটা সিট দখল করে বসেছিলেন। বললেন, তাঁর নাম মিসেস্ অঞ্জলি দাশগুপ্তা। সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার সেই ভদ্রমহিলা ওদের টিকিটের নম্বর দুটোও কী করে জানি সংগ্রহ করেছিলেন।

বাসু-সাহেব বাধা দিয়ে বলেন, সে আর শক্ত কী? ফার্স্ট-ক্লাস রিজার্ভেশান চার্টেই তো নামের পাশে টিকিট নম্বর লেখা থাকে।

—তবে তাই হবে স্যার; কিন্তু ভদ্রমহিলা ব্যাগে করে একটা লোডেড রিভলভার নিয়ে এসেছিলেন-

আনুপূর্বিক ঘটনার একটা বর্ণনা দাখিল করলেন জীবনবাবু। শোনা গেল, সুপ্রিয় দাশগুপ্ত জামিন পায়নি। তার বিরুদ্ধে পুলিশ নাকি হত্যার অভিযোগ আনছে

—মার্ডার কেস? খুন হল কে আবার? কখন?

জীবনবাবু তখন বিস্তারিত জানালেন সেই পূর্ব ইতিহাস। তিনি থানা থেকে মোটামুটি জেনে এসেছেন।

এগারই তারিখ, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে আটটার সময় বড় বাজারে নিজের গদিতে খুন হয়েছেন একজন ধনী ব্যবসায়ী—এম. পি. জৈন। আটটায় দোকান বন্ধ হয়। ওঁরা ঝাঁপ ফেলার উদ্যোগ করছেন এমন সময় তিন-চারজন মুখোশধারী লোক হঠাৎ ঢুকে পড়ে দোকানে। তাদের একজনের হাতে ছিল রিভলভার আর সকলের ছোরা। গেটে ছিল দারোয়ান। সে বাধা দেবার চেষ্টা করায় প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হয়ে উল্টে পড়ে। ডাকাতেরা দোকানে ঢুকে পড়ে। ক্যাশিয়ারের কাছে চাবি চায়। ক্যাশিয়ার ইতস্তত করে। তখন একজন ডাকাত তার কপালে রিভলভার উদ্যত করে ধরে। বাধ্য হয়ে ক্যাশিয়ার চাবির থোকাটা বার করে দেয়।

মালিক এম. পি. জৈনের একটা নিজস্ব রিভলভার ছিল তাঁর ড্রয়ারে। ডাকাতগুলো আয়রন সেফ খুলে নোট বার করতে ব্যস্ত আছে দেখে তিনি চট করে টানা ড্রয়ারটা খুলে রিভালভার বার করে ফায়ার করেন। কেউই তাতে গুলিবিদ্ধ হয় না। অপর পক্ষে ডাকাতদের একজন তখন মিস্টার জৈনকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারে। জৈন উল্টে পড়ে যান। তাঁর হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ে। তখন আর একজন ডাকাত সেই রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে তাই দিয়েই জৈনকে গুলি করে। তিন-চার মিনিটের ব্যাপার। ওরা বোমা ছুড়তে ছুড়তে একটা কালো অ্যাম্বাসাডার চেপে উধাও হয়ে যায়। তখন লোকজন ছুটে আসে। দেখা যায় এম. পি. জৈন মৃত। দারোয়নটার আঘাত মারাত্মক নয়। ডাকাতেরা নগদে প্রায় ষাট হাজার টাকা নিয়ে যায়, এবং মৃত এম. পি. জৈনের রিভলভারটাও নিয়ে যায়!

এখন নম্বর মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে গতকাল বোম্বাই মেলের ফার্স্ট-ক্লাস কামরায় ঐ BOAC মার্কা ব্যাগের ভিতর যে রিভালভারটা পাওয়া গেছে সেটা জৈনসাহেবের রিভলভার।

সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে তাই চার্জ হচ্ছে, ডাকাতি আর খুনের।

বাসু-সাহেব সমস্ত শুনে বললেন, কেসটা খারাপ। কাল রাত্রে ঐ পুলিশ ইন্সপেক্টর যখন জিজ্ঞাসা করেছিল—ব্যাগটা আপনার’? তখন সুপ্রিয় কেন বলেছিল, ‘হুঁ’?

—ও অন্যমনস্ক হয়ে বলেছিল স্যার। বুঝতে পারেনি কোন্ ব্যাগটার কথা হচ্ছে।

—আপনাকে ও তাই বলল?

—তার দেখা পেলাম কোথায় স্যার? হাজতে আমাকে যেতেই দিল না। বললে, একমাত্র ওর উকিল ছাড়া আর কারও সঙ্গে ওকে দেখা করতে দেবে না। এখন আপনি যদি ওর কেসটা হাতে নেন স্যার! একটু ভেবে নিয়ে বাসু-সাহেব বললেন, নেব, কিন্তু এবার আর মৌফসে নয়।

—নিশ্চয় নয় স্যার, নিশ্চয় নয়—বলুন এবার কত দিতে হবে?

—আমার মোট ফি হবে দশহাজার টাকা, তার অগ্রিম পাঁচ হাজার এখনই দিতে হবে।

—দ-শ-হা-জা-র টাকা! কী বলছেন স্যার?

গম্ভীর হয়ে বাসু বললেন, জীবনবাবু, ফি নিয়ে দরাদরি আমি করি না। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ক্রিমিনাল লইয়ার অনেকে আছেন এ-শহরে। অনেক কমেও হয়তো অনেকে রাজি হয়ে যাবেন। চেষ্টা করে দেখুন

—না স্যার। আমিও বাজার যাচাই করতে যাব না। বেশ, ঐ দশ হাজারই দেব। টাকা তো আমার নয়, কোম্পানির! তবে স্যার আপনাকে আর একটা কাজও করে দিতে হবে। মামলায় যেন ঐ ব্ল্যাক-মানির প্রসঙ্গটা না ওঠে।

—সেটা অসম্ভব। এক লাখটাকার দশ টাকার নোটে ওর ব্যাগে কেন এল একথা উঠবেই। ভাল কথা, বাকি এক লাখ কি আপনার কাছে ছিল?

—হ্যাঁ স্যার। সেটা আবার ঐ হোটেলের ভল্টেই রেখেছি।

—পার্ক-হোটেলই উঠেছেন ফের?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, অত টাকা নিয়ে আর কোথায় উঠব? এবার রুম নম্বর 78।

—আর একটা কথা। ঠিক খুনের সময়, অর্থাৎ এগারো তারিখ রাত পৌনে আটটায় আপনি আর মিস্টার দাশগুপ্ত কে কোথায় ছিলেন?

—দুজনেই মোকাম্বো রেস্তোঁরাতে খাচ্ছিলাম স্যার!

—মোকাম্বো! কেন পার্ক-হোটেলের খানা কি পছন্দ হচ্ছিল না?

—কী যে বলেন স্যার? আমি ছাপোষা গরিব মানুষ—ওসব খাবার কি চোখে দেখেছি কখনও? এগারো তারিখ রাতে আমাদের নিমন্ত্রণ করে মোকাম্বোতে খাইয়েছিলেন ঐ রঘুপতি সিঙ্ঘানিয়া সাহেবের বড় ছেলে যদুপতিজি।

—ওঁরা কে?

—আজ্ঞে বড়কর্তার বাড়িটা রঘুপতিজি তাঁর বড় ছেলের নামে কিনলেন। ঐ এগারো তারিখের দুপুরেই রেজিস্ট্রি হল কিনা, তা আমি বললাম যদুপতিজি, অতবড় সম্পত্তি কিনলেন, আমাদের মিষ্টিমুখ করাবেন না? উনি তৎক্ষণাৎ আমাদের মোকাম্বোতে নিমন্ত্ৰণ করলেন। আমরা সন্ধ্যা সাতটায় ঐ রেস্তোঁরাতে যাই এবং রাত সাড়ে নয়টায় বার হয়ে আসি। আমরা তিনজনেই খেয়েছিলাম।

—তিনজন বলতে আপনি, সুপ্রিয় এবং ঐ যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া?

—আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার!

—তাহলে কেসটা অনেক সরল। যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া একজন নামকরা ধনী নিশ্চয়-

—নিশ্চয়, নিশ্চয়—বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা ইনকাম-ট্যাক্স দেন!

—তাঁর সাক্ষীটা জোরালো হবে। ঠিক আছে, আমি এ-কেস নেব। রিটোনারটা দিয়ে যান।

—রিটেনার কী স্যার?

—অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা।

ক্যাশিয়ার জীবনবাবু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। মাজার কষি আলগা করে একটা কোমরবন্ধ বার করে আনেন। পাঁচ থাক নোটের বান্ডিল নামিয়ে রাখেন টেবিলে। বাসু-সাহেব টেলিকমে রানি দেবীকে ডাকলেন। অল্প পরেই হুইল-চেয়ারে মিসেস্ বাসু এসে উপস্থিত হলেন ওঁর ঘরে। বাসু বললেন, এঁকে একটা পাঁচ হাজার টাকার রসিদ লিখে দাও। রসিদটা হবে মিস্টার সুপ্রিয় দাশগুপ্ত, ম্যানেজার কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানির নামে।

জীবন বিশ্বাস চমকে উঠে বললে, কেন স্যার? টাকা দিচ্ছি আমি, রসিদ কেন ম্যানজারের নামে হবে?

—কারণ সুপ্রিয় দাশগুপ্তই আমার ক্লায়েন্ট। আপনি নন।

জীবন বিশ্বাস ভ্রুকুঞ্চিত করে চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, তার মানে কি এটাই ধরে নেব স্যার, যে আপনি ইঙ্গিত করতে চাইছেন আপনার ক্লায়েন্টের স্বার্থে আপনি আমারও বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেন?

—না! ইঙ্গিত করছি না। স্পষ্টাক্ষরে সে-কথা জানাচ্ছি! টাকা আপনি টেবিলে রেখেছেন। আমি তা নিইনি এখনও। ঐ শর্তেই আমি কাজটা হাতে নেব।

জীবন বিশ্বাস গোঁজ হয়ে বসে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর বললেন। ঠিক আছে, রাখলেও আপনি, মারলেও আপনি

রানি দেবী বললেন, আসুন আপনি। রসিদটা নিয়ে যাবেন।

.

পরদিন রবিবার। সকালবেলা প্রাতরাশের টেবিলে বসেছিলেন বাসু-সাহেব, সুজাতা আর রানি দেবী। কৌশিক অনুপস্থিত। সুজাতাই এখন রান্নাঘরের হেপাজতে। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন রানি দেবী। তার চেয়েও বড় কথা নিঃসঙ্গতাটার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। অনেক—অনেকদিন পরে বাড়িটা কলমুখর হয়ে উঠেছে।

সুজাতা প্রশ্ন করে, আপনার ক্লায়েন্ট কী বলল শেষ পর্যন্ত?

বাসু-সাহেব শনিবার বিকালেই হাজতে গিয়ে দেখা করেছিলেন সুপ্রিয়র সঙ্গে। জামিন দেওয়া হয়নি তাকে। কথাবার্তা বলে বাসু-সাহেবের মনে হয়েছে খুনের মামলায় সে বেচারি বেমক্কা জড়িয়ে পড়েছে। সুপ্রিয় দাশগুপ্ত বোম্বাইয়ের একটা নামকরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। বিবাহিত। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া সে কলকাতার সমাজের খবর বড় একটা রাখে না। প্রবাসী বাঙালি। তার পক্ষে সাতদিনের জন্য কলকতায় এসে ডাকাতির দলে ভিড়ে পড়া একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। যে ব্যাগটার মধ্যে রিভলভারটা পাওয়া গেছে ওটা সুপ্রিয় সঙ্গে করে আনেনি। সুজাতা নিজেই তার সাক্ষী। সুজাতা ডিফেন্স-এর তরফে সাক্ষী দিলে সুপ্রিয়র ঐ অন্যমনস্কভাবে হুঁ বলার অপরাধটা গুরুত্ব পাবে না। তাছাড়া সুপ্রিয়র অকাট্য অ্যালিবাই আছে। দু-জন সাক্ষীর একজন অবশ্য ওরই অধীনস্থ কর্মচারী—কিন্তু দ্বিতীয়জন বিশিষ্ট নাগরিক।

রানি দেবী বলেন, তাহলে কাল থেকে এত কী ভাবছ তুমি?

—ভাবছি? হ্যাঁ ভাবছি অন্যদিক থেকে। দুটো কথা আমি ভাবছি। প্রথম, ঐ মিস ডিক্রুজার ব্যাপারটা। মিস ডিক্রুজা নামটা তোমার মনে আছে সুজাতা?

—আছে। দার্জিলিং-এর খুনের কেসটার প্রসঙ্গে এক মিস্ ডিক্রুজাকে আমরা খুঁজছিলাম; কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

—কারেক্ট। কিন্তু এটুক বোঝা গিয়েছিল মেয়েটা নষ্ট-স্বভাবের।

রানি দেবী বলেন, কিন্তু মিস্ ডিক্রুজা নামে কলকাতায় কি একটিই মেয়ে আছে?

—না নেই। কিন্তু ঐ নামটা আমাকে কেমন যেন হন্ট করছে।

—আর আপনার দ্বিতীয় চিন্তার কারণ?

—মাইতি হঠাৎ এত উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন কেন?

মিসেস বাসু বলেন, মাইতিটা কে?

বাসু-সাহেব বুঝিয়ে বলেন, নিরঞ্জন মাইতি হচ্ছেন পাবলিক প্রসিকিউটার। অর্থাৎ কোর্টে যখন কেস উঠবে তখন নিরঞ্জন মাইতি ওঁর বিরুদ্ধে সওয়াল করবেন, সরকার পক্ষে মাইতি নাকি গতকাল বার অ্যাসোসিয়েশানের আড্ডায় বলেছেন, বাসু-সাহেব কেন যে এই বুড়ো বয়সে তাঁর নিজের রেকর্ডটা ভাঙতে এলেন! বেচারি!

সুজাতা বলে, নিজের রেকর্ডটা ভাঙতে মানে?

বাসু জবাব দিলেন না। জোড়া পোচের প্লেটটা টেনে নিলেন।

রানি বললেন, উনি আজ পর্যন্ত কোনও কেসে হারেননি। মানে, মার্ডার কেসে।

সুজাতা প্রশ্ন করে, সত্যি কথা বাসু-মামা?

শ্রাগ করে ব্যারিস্টার বাসু বলেন, এ ফ্যাক্‌ট কান্ট বি ডিনায়েড! হ্যাঁ, ঘটনাচক্রে কোনও মার্ডার কেসেই আমি কখনও হারিনি সুজাতা। তাই আমি শুধু ভাবছি, মাইতি ও কথা বলল কেন? সে নিশ্চয়ই এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছে, এমন সাক্ষীর খোঁজ পেয়েছে যাতে কোর্টে আমাকে হঠাৎ চমকে দেবে। সেটা যে কী, তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না! বাট হি মাস্ট বি হ্যাভিং সামথিং আপ হিজ স্লিভ!

মিসেস বাসু প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য বললেন, কৌশিককে কোথায় পাঠালে?

—রাঁচি।

—রাঁচিতে কেন?

বাসু-সাহেব দাখিল করেন তাঁর যুক্তি! পার্ক-হোটেলের আটত্রিশ নম্বর ঘরের ঐ ভদ্রমহিলা আসলে কে. সেটা তাঁকে জানতে হবে। ঐ মেয়েটার সম্বন্ধে দুজনে দু-রকম কথা কেন বলছে?

—দুজনে দু-রকম কথা’ মানে?

—জীবন বিশ্বাস বলছে পাশের কামরায় ডি-সিল্ভাকে সে দেখেছে এবং ঐ মেয়েটির সঙ্গে সে সুপ্রিয়কে কথা বলতেও দেখেছে। অথচ সুপ্রিয় সরাসরি অস্বীকার করছে। পাশের ঘরের ঐ মেয়েটির অস্তিত্বই না কি সে জানে না।

—কেসটা কবে কোর্টে উঠবে?

—চার্জ ফ্রেম করা হয়ে গেছে। প্রাথমিক শুনানিও। কেস উঠবে বৃহস্পতিবার।

—এত তাড়াতাড়ি আপনি তৈরি হতে পারবেন?

—তৈরি আমাকে হতেই হবে সুজাতা। আমার মক্কেল জামিন পায়নি।

.

সোমবার সকালে বাসু-সাহেবের জুনিয়ার প্রদ্যোৎ নাথ এসে জানাল—জীবন বিশ্বাসকে সমন করা হয়েছে স্যার; কিন্তু তার আগেই ওকে থানা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে সে একটা এজাহার দিয়ে এসেছে—

—তাই নাকি? তা এজাহারে কী বলছে সে?

—আমাদের কাছে যা বলেছে সেই সব কথাই। তবে ব্ল্যাক-মানির কথা স্বীকার করেনি!

—অ্যালিবাই-এর কথা?

—তা বলেছে। জীবনবাবু বললেন, থানা অফিসার ঐ মোকাম্বোর ব্যাপারে খুব বিস্তারিত প্রশ্ন করেছে। কখন ওঁরা আসেন, কখন যান—মায় কে কোন্ আইটেম খেয়েছেন তাও।

—সব কথাই সে সত্যি বলেছে তো?

—তাই তো বললেন আমাকে।

—আর যদুপতি সিঙ্ঘানিয়া? তাকে সমন ধরানো হয়েছে তো?

—না স্যার। তিনি বাড়ি ছেড়ে একেবারে নিরুদ্দেশ।

—নিরুদ্দেশ! মানে? কেউ জানে না তিনি কোথায়?

—আজ্ঞে না। আমার মনে হয় পাছে আদালতে ঐ দু-লাখ ব্ল্যাক-মানির প্রসঙ্গটা উঠে পড়ে, তাই তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন।

বাসু-সাহেব বলেন, তবে তো কেসটা আবার কাঁচিয়ে গেল।

রাত্রের ট্রেনে কৌশিক ফিরে এল। রাঁচি থেকে সে জেনে এসেছে—মিস্টার ডি. সিল্ভাকে সত্যই আট তারিখে ওখানকার মানসিক হাসপাতাল থেকে মুক্ত করা হয়। তাকে নিয়ে যায় তারই দিদি মিস্ ডি. সিল্ভা। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ মেয়েটির যা বর্ণনা দিয়েছেন পার্ক-হোটেলের বেয়ারা হরিমোহনও তাই দিয়েছে। সুতরাং ওখানে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

—কিন্তু তাহলে সুপ্রিয় কেন তার অস্তিত্বটাই অস্বীকার করছে?

সন্ধ্যাবেলা গাড়িটা বার করে বাসু-সাহেব কৌশিককে নিয়ে চলে গেলেন চৌরঙ্গি অঞ্চলে। প্রথমে মোকাম্বো। সেখানে কিছুই সুবিধা হল না। না ওদের ম্যানেজার, না কোনও বেয়ারা—কেউ ধনকুবের যদুপতি সিঙ্ঘানিয়াকে চেনে না। সেটাই স্বাভাবিক। এমন কত লক্ষপতি আছে কলকাতা শহরে যারা নিত্য মোকাম্বোতে এসে সান্ধ্য আসর জমায়—খাদ্যে আর পানীয়ে।

দ্বিতীয়ত পার্ক-হোটেলে। এখানে হরিমোহন বরং কিছু খবর দিতে পারল। হ্যাঁ, আটত্রিশ নম্বরের সেই মেম-সাহেবকে তার মনে আছে; তার পাগল ভাইকেও। না, সে চেঁচামেচি কিছু করত না। কেমন যেন জড়বুদ্ধি, ধন্ধধরা মানুষ। সবসময় গোঁজ হয়ে বসে থাকত একটা চেয়ারে। মেমসাহেব তাকে নিয়ে দিবারাত্র একটা গাড়িতে করে ঘুরত। তার চিকিৎসা-ব্যবস্থার জন্যই হবে হয়তো। কবে তারা চলে যায়?—বারো তারিখ সকালে। ঠিক কখন তা সে জানে না। তখন সে ওখানে ছিল না। দারোয়ান বলতে পারে।

দারোয়ানকেও প্রশ্ন করা হল। তারও মনে আছে ওদের প্রস্থান পর্বটা। সে ঐ মেমসাহেব বা সাহেবকে আগে দেখেনি। তবে মনে আছে এজন্য যে, সাহেবটাকে প্রায় ধরাধরি করে এনে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। তখন দারোয়ান ভেবেছিল সাহেবটা মাতোয়ালা। পরে শুনেছে—না, সে পাগল।

—আর কিছু মনে পড়ছে না তোমার?

—নগদ পাঁচ টাকা বকশিশ পেয়েছে দারোয়ান। অনেক চিন্তা করে বলল, আরও একটা কথা মনে পড়ছে স্যার। ঠিক রওনা হবার আগে ড্রাইভার মেমসাহেবকে বলেছিল, জি.টি. রোড খারাপ আছে। আমরা দিল্লি রোড হয়ে যাই বরং

—ট্যাক্সি না প্রাইভেট গাড়ি?

না, সাব, প্রাইভেট গাড়ি।

বাসু-সাহেব মানি ব্যাগ খুলে আরও পাঁচটা টাকা ওর হাতে দিয়ে বললেন, থ্যাঙ্কু। গাড়িতে স্টার্ট দিলেন উনি। কৌশিক বললে, ব্যাপার কী? আপনি যে আজ দাতাকর্ণ! বাসু রোষ-কষায়িত নেত্রে একবার তাকালেন কৌশিকের দিকে। কোনো কথা বললেন না। বাড়িতে ফিরে এসেও নয়। সোজা ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে। ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে বাইরে গেলেন। তারপর বেরিয়ে এসে বললেন, সুজাতা, দুটো ট্রাঙ্ককল বুক করো। একটা বোম্বাই। লাইটনিং কল। নম্বর এই নাও। পি. পি. মিস্টার সি. বরুয়া। দ্বিতীয়টা বর্ধমানের সদর থানার ও. সি। ওটাও পি. পি. এবং লাইটনিং। নাম নৃপেন ঘোষাল। নম্বরটা 183 ডায়াল করে জেনে নাও।

সুজাতা ওঁর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না। এগিয়ে গেল টেলিফোনটার দিকে।

দুটি লাইনই পাওয়া গেল অল্পকালের মধ্যে। প্রথমে এল বর্ধমান।

রিসিভারটা তুলে বাসু-সাহেব বললেন, কে নৃপেন? আমি পি. কে. বাসু; চিনতে পারছ?…হ্যাঁ, একটা উপকার করতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানাও তো, যে, শুক্রবার বারো তারিখে বর্ধমানে সাম মিস্টার ডি. সিলভা এবং মিসেস্ ডি. সিল্ভা কোথায় উঠেছেন।…না, না একটু শোন ডিটেলস্টা। মিস্টার সিল্ভার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ, লম্বা একহারা। বিকৃতমস্তিষ্ক…ইয়েস, ম্যাড! তার দিদি তাকে একটা কালো অ্যাম্বাসাডরে নিয়ে যায় বারো তারিখ, বেলা আটটায়। তার মানে এগারোটা নাগাদ ওরা বর্ধমানে পৌঁছেছে। চেক অল্ দা হোটেলস্, রেস্ট হাউসেস্, অ্যান্ড য়ু নো বেটার হোয়্যার। ভাড়া বাড়িতেও উঠতে পারে। কালো রঙের অ্যাম্বাসাডারটাকে স্পট করার চেষ্টা কর বরং।…কী? না! বর্ধমান ছেড়ে যায়নি। গেলেও কাছে-পিঠে কোনোখানে আছে।…ইয়েস! খবর পেলেই আমাকে জানাবে। থ্যাঙ্কু!

নৃপেন ঘোষাল একটি বদলি সংক্রান্ত ব্যাপারে বাসু-সাহেবের কাছে প্রভূতভাবে উপকৃত। বেচারিকে দু’ নৌকায় পা দিয়ে চলতে হয়—সরকারি চাকরি আর ডিফেন্স কাউন্সিলার প্রতাপশালী ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু।

দ্বিতীয় ফোনটা ধরলেন বাসু-সাহেবের বোম্বাই-প্রবাসী এক বন্ধু—চন্দ্রকান্ত বরুয়া। তাঁকে বললেন, একটু কষ্ট দিচ্ছি। বোম্বাইয়ের কাপাডিয়া অ্যান্ড কাপাডিয়া কোম্পানিতে খোঁজ নিয়ে তাদের ম্যানেজার সুপ্রিয় দাশগুপ্তর স্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে দেখা কর। বেচারি বোধহয় এখনও জানে না, তার স্বামী কলকাতায় এসে একটা বিশ্রী মামলায় জড়িয়ে পড়েছে।…কী? না, মার্ডার চার্জ! তোমাকেই বললাম ব্যপারটার গুরুত্ব বোঝাতে। তুমি মেয়েটিকে মার্ডার-চার্জের কথা বল না। আমার নাম করে বল, তার সাক্ষী খুব জরুরি দরকার। সে যেন নেক্সট অ্যাভেইলেবল প্লেনে কলকাতা চলে আসে। প্যাসেজ-মানি তার কাছে যদি না থাকে, তুমি আমার হয়ে দিয়ে দেবে। মেয়েটি যদি পারে তবে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যেন সোজা আমার বাড়িতে চলে আসে। যদি পার, তবে ওকে প্লেনে তুলে দিয়ে আমাকে একটা ফোন করো। …ইয়েস্ ইয়েস্…অল এক্সপেনসেস আর মাইন্! চিয়ারিং।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *