1 of 2

মাইলেন্সে ফেবল

মাইলেন্সে ফেবল

দৈত্য!

বিশালদেহী আর ভয়ালদর্শন এক দৈত্য।

দৈত্যটা আচমকা আমার মাথায় তার হাতটা রাখল। তারপর বজ্রগম্ভীর স্বরে বলল–শোন, উৎকর্ণ হয়ে শোন।

আমি এক্ষেত্রে যে স্থানটার কথা উল্লেখ করছি, সেটা লিবিয়ার অন্তর্গত একটা মরুভূমি–বালির একাধিপত্য সেখানে। সে অঞ্চলটার অবস্থান জাইরে নদীর তীরে। আর সেখানে নিস্তব্ধতা তো বিরাজ করছেই, এমনকি সামান্যতম হৈ-হল্লাও কারো কানে আসে না।

জাইরে নদী দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হয় বাদামি রংয়ের ঘোলা জলরাশি। আর তার গতি সাগরের দিকে তো নয়ই, বরং মাথার ওপর অবস্থানরত জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড সূর্যের নিচে অবস্থান করে প্রতিনিয়ত উত্তাল-উদ্দাম রূপ ধারণ করে থাকে আর তার জলরাশি বিপুল বিক্রমে তোলপাড় করে।

নদীর উভয় তীর থেকে দুইমাইল দূরবর্তী অঞ্চল থেকে শুরু করে পরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কেবল সোনালির ছড়াছড়ি। কেবল বালি আর বালি। রাশি রাশি বস্তাবস্তা বালি যেন কোনো অমিত বিক্রমশালী কোনো দৈত্য প্রচণ্ড ক্রোধের বশবর্তী হয়ে দুই তীরে সুবিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। আর তারই মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট আকার বিশিষ্ট বিবর্ণ মরু-ফুল নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।

মরুভূমির নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা লক্ষ্য করে সুবিশাল-বিবর্ণ মরু-ফুলগুলো যেন বিষাদ ক্লিষ্ট মনে, হতাশ দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

শুধু কি তাই? তারা যেন লম্বাটে গলা তুলে আকাশের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় আর থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর এদিক-ওদিক মাথা দোলাতে থাকে।

নীরস মাটির বুক নিঙড়ে বেরিয়ে আসা ফোয়ারার মতো মরু-ফুলগুলোর ভেতর থেকেই প্রায় অস্ফুট একটা মৃদু স্বর বেরিয়ে এসে বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে বিলীন হয়ে যায়।

মরুভূমির আয়তন বিশাল, সুবিশাল। কিন্তু বিশালেরও কোথাও-না-কোথাও শেষ আছে, সীমানা বলে কিছু একটার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু কি তাদের সীমানা নির্দেশ করছে? কালো, ভয়াল দর্শন বনভূমি আকাশচুম্বী গাছগাছালির ঘন বনভূমি। সেখানেও ব্রোইডিসের ঢেউয়ের মতোই লতাপাতা গাছগাছালির ঝোঁপঝাড় বাতাসে অনবরত আন্দোলিত হচ্ছে। তবে এও সত্য যে, কোথাও তেমন বাতাস নেই। তা সত্ত্বেও সেই আগেকার আমলে জন্মানো সুবিশাল গাছগুলো চিরটাকাল ধরে, প্রতিদিন। আর প্রতিনিয়ত একই রকমভাবে আন্দোলিত হয়ে আসছে। আর তাদের মাথা, প্রতিটা শাখা-প্রশাখা আর পাতাগুলোতে শিশিরবিন্দু পড়ে স্নান করিয়ে দেয়।

কেবলমাত্র শাখা-প্রশাখা আর পাতার কথাই নয়, তাদের শেকড়ের তলায় বিচিত্র সব বিষফুল গা-জড়াজড়ি করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। আর মাথার ওপরে? মাথার ওপরে জমাটবাধা টুকরো টুকরো মেঘ নিশ্চিন্ত অলসভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ধেয়ে চলে। এমনিভাবে ধীর মন্থরগতিতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গিয়ে দিগন্তের প্রাচীরের ওপর মুষলধারে অনবরত ঝরতে থাকে। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে। তিলমাত্র বাতাসের অস্তিত্বও নেই।

আর জাইরে নদীর উভয় তীরে নিস্তব্ধতা তো নেই-ই বরং অভাবনীয় আনন্দ ফুর্তি হৈ-হল্লা বিরাজ করছে। সেখানকার প্রতিটা অঞ্চল, প্রতিটা বস্তির মানুষ যেন সর্বদা আনন্দে মশগুল। প্রকৃতির বুকে তখন রাতের অন্ধকার বিরাজ করছে। অনবরত বৃষ্টি পড়েই চলেছে। যখন পড়ছিল তখন তাকে বৃষ্টিই বলা চলে, তবে তারপর যা শুরু হলো তাকে রক্ত না বলে উপায় নেই।

আমি তখন লতানো গাছগাছালির লম্বা বিশভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একা আমি, একেবারে একাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার মাথায় টপ টপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। আর নির্জনতা ও নিস্তব্ধতার বিমর্ষতা হেতু লতানো গাছের ফুলগুলো একে অন্যের দিকে ফিরে চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে বাতাসকেও যেন বিষময় করে তুলছে।

হঠাৎ একেবারে হঠাই হালকা ও ভৌতিক কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে আকাশের গায়ে চাঁদ উঠল। রূপালি চাঁদটা দেখতে দেখতে রক্তবর্ণ ধারণ করল।

নদীর তীর ঘেঁষে যে সুউঁচু একটা ধূসর পাহাড় সদম্ভে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটার দিকে আমার নজর গেল।

আমি কিছু সময় পাহাড়টার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার গায়ে চাঁদের আলো পড়ায় সেটাকে ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে।

পাহাড়টা যে কেবলমাত্র উঁচু ও ধূসর রং বিশিষ্ট তা-ই নয় রীতিমত বিবর্ণও বটে।

চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে, পাহাড়টার সামনে, পাথরের গায়ে বড় বড় করে বহু অক্ষর খোদাই করে রাখা হয়েছে।

পার্বত্য উপত্যকার জলাজমির ওপর দিয়ে, লতানো ফুলগাছগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি এক সময় তীরের কাছাকাছি একটা জায়গায় হাজির হলাম। আমার উদ্দেশ্য পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা অক্ষগুলোর পাঠোদ্ধার করা। অতএব হাঁটতে হাঁটতে এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম যাতে সে অক্ষরগুলোকে পড়া সম্ভব হয়। কিন্তু হায়! সে অক্ষরগুলো যে কোনো ভাষার তা-ই আমার পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব হলো না। অতএব পড়তে পারার প্রশ্নই ওঠে না।

আমি হতাশ হয়ে শেষপর্যন্ত জলাজমির দিকে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। সামান্য এগোতেই কুয়াশার হালকা আস্তরণ ভেদ করে চাঁদ উঠল। একেবারে রক্তিম তার বর্ণ।

চাঁদ উঠতেই আমি ঘাড় ঘুরিয়ে–আবার পিছন দিকে তাকালাম। পাহাড়টার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। সামান্য পিছিয়ে গিয়ে আবার অক্ষরগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলো পড়ায় অক্ষরগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।

একটু আগে যে অক্ষরগুলো আমার পক্ষে পাঠোদ্ধার করা তো দূরের কথা কোনো ভাষায় তাও বুঝতে পারছিলাম না, এবার চাঁদের আলোয় আমার সে সমস্যা আর রইল না। নিঃসঙ্গতা শব্দটাকে আমি অনায়াসেই পড়তে পারলাম।

মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকালাম, পাহাড়টার দিকে। মনে হল, পাহাড়ের শীর্ষে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পেলাম।

অনুসন্ধিৎসু নজরে পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকা মনুষ্য মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থেকে শেষপর্যন্ত নিঃসন্দেহই হলাম, একটা মানুষই দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সে লোকটার গতিবিধির ওপর গোপনে নজর রাখার জন্য আমি দ্রুত জলাজমির লতানো গাছের ঝোঁপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে দিলাম। ভালোভাবে দেখার পর আমি বুঝলাম, লোকটা দীর্ঘদেহী আর বিশাল বপুধারী। আর প্রাচীন রোমের টোগা দিয়ে তার আপাদমস্তক আবৃত।

আমি অনুসন্ধিৎসু নজরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলাম, লোকটার দেহরেখা তেমন স্পষ্ট নয়। তবে দেবতার মতোই তার দৈহিক গঠন।

রাতের স্বচ্ছ আবরণ, হালকা কুয়াশার আবরণ আর কুয়াশার আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া চাঁদ ও শিশিরের স্বচ্ছ আবরণ আর লোকটার মুখাবয়বটাকে ঢেকে দিতে পারেনি। তাই স্পষ্টই দেবতার মতোই দেহসৌষ্ঠবটাকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। এমনকি তার চিন্তায় উন্নত জঁ দুটো পর্যন্ত আমার নজরে পড়ল। তার চোখ দুটোর ওপর আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই আমি লক্ষ্য করলাম, সে দুটো গভীর চিন্তায় উভ্রান্ত। আর তার চিবুক? চিবুকে কয়েকটা মাত্ৰ ভাঁজ পড়েছে। তাতেই দুঃখের কাহিনী পড়া আমার পক্ষে সম্ভব হল।–ক্লান্তি-অবসাদ, মনুষ্য সমাজের প্রতি বিরক্তি, নির্জনতা আর নিঃসঙ্গতার বাসনা।

আমি লোকটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়েই রইলাম। সে পাহাড়টার শীর্ষে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। একটা হাত ভাঁজ করা। আর সেটার ওপর মাথাটাকে রেখে হেলান দিয়ে সে বসে।

লোকটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে জনমানবশূন্য প্রান্তরের দিকে উদাস-ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।

কয়েকমুহূর্ত প্রান্তরটার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে এক সময় সেখান থেকে চোখ দুটোকে তুলে এনে অশান্ত, দোদুল্যমান ঝোঁপঝাড়ের ওপর নিবদ্ধ করল। পর মুহূর্তেই ওপরে অবস্থানরত সুদীর্ঘ প্রাচীন বনভূমির ওপর দৃষ্টি স্থির করল। তারপর সে আরও, আরও ওপরে, আকাশের গায়ে ঝুলন্ত রক্তিম চাঁদটাকে দেখতে লাগল বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে।

এদিকে আমি জলাভূমির লতানো গাছের ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে স্থির দৃষ্টিতে সে লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম।

আর সে নির্জন নিরালায় থর থর করে কাঁপতে আরম্ভ করল।

এদিকে রাত শেষ হতে চলেছে। প্রকৃতির বুকে ভোরের আলো ফুটে না উঠলেও এটুকু অন্তত বুঝা যাচ্ছে ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। লোকটা কিন্তু উঠল তো

-ই বরং একই ভঙ্গিতে পাহাড়ের শীর্ষে আগের মতোই ঠায় বসেই রইল। ওঠা তো দূরের কথা, সামান্য নড়াচড়াও করল না।

আমি সেখানে আর থাকার দরকার বোধ করলাম না। তাই লতানো গাছের ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে জলাভূমির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলাম এমন একটা জায়গায়, যেখানে জলহস্তীর মেলা বসেছে।

জলহস্তির পালকে সামনে দেখে আমার মধ্যে কৌতূহলের সঞ্চারও হল। আনন্দও কম হলো না।

আমি মুখে বিচিত্র এক শব্দ করে তাদের কাছে ডাকলাম। তারা মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে পাহাড়টার পাদদেশে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে বুক কাঁপানো ভয়ঙ্কর তর্জন গর্জন শুরু করে দিল।

আমি সেখান থেকে দৃষ্টি তুলে নিয়ে পাহাড়ের শীর্ষদেশে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকালাম। দেখলাম, সে এখনও নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতায় বসে আগের মতোই অনবরত কেঁপেই চলেছে।

এদিকে রাত বাড়তে বাড়তে ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। আর সে-ও পাহাড়ের শীর্ষে আগের মতো একই ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। আমি এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না। নিতান্ত কোনো উপায় না দেখে প্রকৃতিকে উদ্দামতার অভিশাপ দিলাম।

ব্যাস, আর এক মুহূর্তও দেরি হলো না–ভয়ঙ্কর ঝড় উঠল, ঝড়ের প্রকোপে সবকিছু তোলপাড় হতে লাগল। অথচ কয়েকমুহূর্ত আগেও সেখানে ঝড় বা প্রবল বাতাস তো দূরের কথা একটা গাছও নড়তে দেখা যায়নি।

সে যে কী ভয়ঙ্কর ঝড়, প্রলয়কাণ্ড ঘটে চলেছে তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ঝড়ের প্রকোপে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশের রং পাল্টাতে পাল্টাতে ক্রমে সিসার রং ধারণ করল।

পাহাড়ের ওপরে অবস্থানরত লোকটার মাথায় টপ টপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল।

কিছুক্ষণ মুষলধারে বৃষ্টি পড়ার পর নদী ভরে গেল, ফুলে ফেঁপে উঠল। দুকূল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দিল আর রাশি রাশি ফেণা জমে উত্তাল-উদ্দাম রূপ ধারণ করল।

ঝড়ের তাণ্ডব আর পানির প্রচণ্ড ধাক্কায় বিশাল গাছগাছালি হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়তে লাগল। চিরিক্-চিরিক করে বিদ্যুৎ ঝলকাতে লাগল, বিকট আওয়াজ করে বাজ পড়তে লাগল আর পাহাড়ের ভিত পর্যন্ত বার বার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। সব মিলে এমন প্রলয়কাণ্ড ঘটাতে লাগল তা আর কহতব্য নয়।

আমি সেখানে অবস্থান করেই সে লোকটার কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম। সে আগের মতোই নির্জনতা আর নিস্তব্ধতায় সমানভাবে কেঁপেই চলেছে। কিন্তু এদিকে রাত বাড়তে বাড়তে ফুরিয়ে আসতে চলেছে তবুও সে ঠায় বসেই রয়েছে।

আমার পক্ষে আর ক্রোধ সম্বরণ করা সম্ভব হলো না। ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে তাকে অভিশাপ দিলাম। কেবলমাত্র তাকেই নয়, আমি অভিশাপ দিলাম নির্জনতা আর নৈঃশব্দকে, উত্তাল-উদ্দাম নদীকে, লতানো ফুলগাছকে, প্রবল বাতাসকে, অরণ্যের আকাশছোঁয়া গাছগুলোকে, কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা আকাশকে, গুরুগম্ভীর স্বরের বজ্রকে, অতি উজ্জ্বল বিদ্যুচ্ছটাকে।

ক্রোধান্মত্ত আমার অভিশাপে জর্জরিত হয়ে তারা গতি হারিয়ে স্থিও নিশ্চল-নিথর হয়ে পড়ল।

চাঁদ আর আগের মতো কাঁপতে কাঁপতে আকাশপথে হেঁটে বেড়াচ্ছে না, বজ্রের অপমৃত্যু ঘটল, বিদ্যুৎ থমকে গিয়ে আর চমকাতে পারল না, মেঘের দল গতি হারিয়ে নিশ্চল হয়ে আকাশের গায়ে অলসভাবে ঝুলতে লাগল। একটু আগে ফুলে ফেঁপে থাকা জলরাশি আবার নেমে গিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল, সুউচ্চ গাছগুলো আর দাপাদাপি করছে না, লতানো গাছের ফুলগুলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বন্ধ করে দিয়েছে আর অন্তহীন মরুপ্রান্তরে সামান্যতম শব্দও হচ্ছে না।

আমি আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাহাড়ের গায়ে খোদিত অক্ষরগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। নিঃসঙ্গতা শব্দটাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য বার বার চেষ্টা করতে লাগলাম। হতাশই হতে হলো আমাকে। আগেকার সে অক্ষরগুলো যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। আর সে জায়গাটা দখল করেছে কয়েকটা নতুন অক্ষর। নতুন একটা শব্দ আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল–‘নৈঃশব্দ। অবাক না হয়ে পারলাম না।

আমি আবার মুখ তুলে পাহাড়ের ওপরে অবস্থানরত লোকটার দিকে তাকালাম। তার মুখের ওপর আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। লক্ষ্য করলাম, আকস্মিক আতঙ্কে তার মুখটা যেন চকের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

তার দিকে আমার চোখ পড়তেই সে অতর্কিতে সচকিত হয়ে পড়ল। যন্ত্রচালিতের মতো হাতের ওপর থেকে মাথাটাকে তুলে নিল। তেমনি ব্যস্ততার সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সুবিস্তীর্ণ মরু অঞ্চলগুলোয় কোনো শব্দই নেই।নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে মরুভূমির বুকে। আর? আর পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা শব্দ-নৈঃশব্দ’।

লোকটা সচকিত হয়ে পড়ল। তার সর্বাঙ্গে অবর্ণনীয় শিহরণ জেগে উঠল। অনবরত থর থরিয়ে কাঁপতে লাগল। ঘাড় ঘুরিয়ে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলল। হাঁটতে লাগল। ঘাড় ঘুরিয়ে বার কয়েক এদিক ওদিক তাকাল। তারপর ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলল। হাঁটতে হাঁটতে দূরে, বহু দূরে চলে গেল। এক সময় সে একেবারে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। তাকে আর এক মুহূর্তের জন্যও দেখতে পেলাম না।

ম্যাগির বইটা আসলেই খুব ভালো। তার বইতে অনেক ভালো ভালো গল্প আছে। তার লোহা-বাঁধানো বিষণ্ণ বইটার গল্পগুলোর কথা বলছি। সত্যি গল্পগুলো ভালো। আমি সে-সব গল্প মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। আমি বলছি, তাতে লেখা আছে আকাশের গল্প, পৃথিবীর গল্প আর মহাসাগরের গৌরবময় ইতিকথা–আর আছে সেসব জিনদের গল্প যারা সমুদ্র, পৃথিবী আর আকাশকে শোষণ করত।

সাইবিলসও বহু কাহিনী–গল্প বলে গেছেন। প্রাচীন পুঁথিপত্রের পাতায় পাতায় বহু ভালো ভালো কথা লেখা আছে। কিন্তু আল্লাহর কৃপায়, সমাধির গায়ে বসে দৈত্য। আমাকে যে গল্পটা বলেছিল সেটাকেই আমি সবচেয়ে অদ্ভুত ও আশ্চর্য মনে করছি।

গল্পটা শেষ করে দৈত্য উঠে আবার কবরের মুখের কাছে গেল। সরবে হেসে উঠল।

আমি কিন্তু তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসতে পারলাম না। আর এরই জন্য দৈত্য ক্রোধে ফুঁসতে লাগল। আমাকে অভিশাপ দিল। আর ভামটা এতদিন কবরে গর্ত খুঁড়ে বাস করত সে হুড়মুড় করে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর ছুটতে ছুটতে এগিয়ে গিয়ে দৈত্যের পায়ের কাছে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর নিষ্পলক চোখে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। নিশ্চল নিথর তার দৃষ্টি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *