ভন কেমপেলেন অ্যান্ড হিস ডিসকভারি
আরাগো কর্তৃক লিখিত প্রতিটা বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখা প্রবন্ধের পর ‘সিলিম্যানংস জার্নাল’-এ প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত বিবরণীর কথা না-ই উল্লেখ করলাম, আর লেফটেন্যান্ট মাউরি-র সবেমাত্র প্রকাশিত বিবরণীর যদি ভন্ কেমপেলেনের আবিষ্কারের ব্যাপারে সামান্য কিছু মন্তব্য পেশ করলে অবশ্যই কেউ ভাববেন না যে, ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার কোনো আগ্রহ বা পূর্ব-পরিকল্পিত ইচ্ছা আদৌ আমার নেই। সত্যি কথা বলতে কি, তার আবিষ্কারের ব্যাপারটা উত্থাপনের ব্যাপারে আমি আগেভাগে কোনো চিন্তাভাবনাই করে রাখিনি।
প্রথমত আমার উদ্দেশ্য কিন্তু খুবই সহজ-সরল। বছর কয়েক আগে ভ কেমপেলেনের পরিচয়ের সৌভাগ্য আমার হয়। আমি তার সম্বন্ধে কিছু বলতে উৎসাহি। কারণ, বর্তমানে তার সম্পর্কিত সবই অবশ্যই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। আর দ্বিতীয়ত, সে আবিষ্কার ফলাফলগুলোকে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি আর দার্শনিকের চোখ দিয়ে দেখে বিচার বিশ্লেষণ করা।
কট অ্যান্ড মুনরো, লন্ডন-এর একশো পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় ছাপা ডায়েরি অব স্যার হামফ্রে ডেভি’র সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই তেপান্ন আর বিরাশি পৃষ্ঠায় লক্ষ্য করা যাবে; এ বিখ্যাত রসায়নবিদের যে ব্যাখ্যাটাকে কেন্দ্র করে চারদিকে ভন্ কেমপেলেনের জয়ধ্বনি ঘোষিত হচ্ছে, সে ব্যাপারটা প্রথম তার মাথায় জেগেছিল ওই ডায়েরি থেকে, তাই নয়, এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে তিনি অনেকখানি এগিয়ে গেছেন।
এ-ব্যাপারে তিনি একটা কথা না বললেও আমি নির্দিধায় বলছি, প্রয়োজনে এর প্রমাণও দিয়ে দিতে পারি, অন্তত নিজের প্রচেষ্টায় তিনি যে প্রথম ইঙ্গিতটা দিয়েছেন তার জন্য ‘ডায়রি’র কাছে তিনি কৃতজ্ঞ।
স্বীকার করছি কাজটা কিছুটা পারিভাষিক! তবুও আমি নিতান্ত বাধ্য হয়েছি স্যার হামফ্রি ডেভির একটা সমীকরণসহ ‘ডায়রি’-র দুটো অংশ সংযোজন করতে।
খবরের কাগজের পাতায় ‘কুরিয়ার অ্যান্ড এন্কয়ারার’-এর অনুচ্ছেদটা ছাপা হয়েছে এবং পাঠকদের হাতে হাতে ঘুরছে, আর এ আবিষ্কারটাকে যাতে মেইন পাথরের ব্রান্সউইক-এর অধিবাসী কোনো এক মি. কিসাস আবিষ্কার করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে সে অনুচ্ছেদটাকে আমি বহু কারণের জন্য নকল ভাবছি এবং ব্যক্ত করছি। তবে এ-কথাও বলছি যে, সে বিবরণটা মোটেই অসঙ্গত বা অযৌক্তিকতা দোষে দুষ্ট নয়।
আর এ-কথাও বলছি যে, এ ব্যাপারটার বিস্তারিত বিচার বিশ্লেষণ করার ইচ্ছা আমার আদৌ নেই।
সে অনুচ্ছেদটা সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চাইলে বলব, প্রধানত তার ব্যক্ত করার কায়দা-কৌশলের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। সেটাকে কিন্তু সত্য বলে মেনে নিতে উৎসাহ পাওয়া যায় না। স্বীকার না করে উপায় নেই, যারা ঘটনার বিবরণমাত্র ব্যক্ত করে তা কিন্তু দিন, তারিখ, সময় আর ঘটনাস্থলের কথা মি. কিসাসের মতো হুবহু ঠিকঠাকভাবে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয় না।
এ ছাড়াও বলছি, মি. কিসাসের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, যদি তিনি সত্যি প্রায় আট বছর পূর্বের কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে আবিষ্কারটার সন্ধান পান তবে এটা কি করে ঘটা সম্ভব যে, এত বড় একটা আবিষ্কারের ফলস্বরূপ সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে ফায়দা, অর্থপোর্জনের জন্য তিনি তৎপর হলেন না? এমন কোনো ঘটনার কথা যে ভুলেও ভাবা সম্ভব নয়?
কিন্তু কোনো বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির কথা না হয় ছাড়ানই দিলাম, যে কোনো সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মাথায় তো ব্যাপারটা খেলবে যে, ঠিক সে মুহূর্তেই তৎপরতার সঙ্গে সে পথে পা-বাড়ালে তিনি একদম একাই এ আবিষ্কারটার কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারতেন, ঠিক কি না? অর্থাৎ এ আবিষ্কারটার ফায়দা তিনি একাই লুটতেন।
অন্য কেউ কি বলত জানি না। আমি কিন্তু বলব, আমার কাছে ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। বিশ্বাস করতে তিলমাত্র উৎসাহও পাচ্ছি না যে, সে আবিষ্কারটা মি. কিসারে দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সেটা যে কোনো বুদ্ধিমান লোকের দ্বারাই সম্ভব। অথচ পরবর্তীকালে তিনিই একটা কচি শিশুর মতো–একটা পঁাচার মতোই আচরণ করেছেন, অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার।
প্রসঙ্গক্রমে বলছি, কে এই মি. কিসাস? তার পরিচয় কি? কোথায়ই বা তার বাড়ি। আরও একটা কথা আছে, ‘কুরিয়ার অ্যান্ড এনকয়ারারের ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে যে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আলোড়ন সৃষ্টি করাই যার উদ্দেশ্য সেটা মনগড়া ধাপ্পার ব্যাপার-স্যাপার হওয়া সম্ভব নয় তো? এমনও তো হতে পারে পুরো ব্যাপারটাই নিছক একটা ধাপ্পাবাজি–সম্ভব কি?
তবে আর যা-ই হোক না কেন, এ-কথা তো মেনে না নিয়ে উপায় নেই যে, পুরো ব্যাপারটাকে কেমন যেন উদ্ভট, পাগলের প্রলাপ বলেই মনে করা যেতে পারে। আর যে, যা বলে বলুক গে, আমি কিন্তু বলব, এর ওপর সামান্যতমও আস্থা রাখা সম্ভব নয়।
যাক গে, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, আমরা বরং স্যার হামফ্রে ডেভির প্রসঙ্গে আবার আলোচনা শুরু করি। ডেভি বলতে তার ডায়রির কথা বলতে চাচ্ছি।
বইটা কিন্তু জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মোটেই লেখা হয়নি। এমনকি লেখকের মৃত্যুর পরও সাধারণ মানুষের নজরে আসুক, এ উদ্দেশ্যও ছিল না।
আর একটা কথা, লেখার কায়দা কৌশল লক্ষ্য করলেই যে কেউ বুঝে নিতে পারবেন, কে এর লেখক। কেন এমন কথা বলছি; তাই না? কারণ, লেখাটার কয়েকটা ছত্র পড়লেই অবশ্যই বোঝা যাবে, তার প্রতিটা বাক্যই গঠনগত ভুল ভ্রান্তিতে ভরা।
প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে সহজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। বলাবাহুল্য, স্যার হ্যামফ্রে ডেভি কোনোদিনই বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ নিয়ে লেখাঝেকা করতে অভ্যস্ত ছিলেন না। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লিখতে তিনি কখনই পটু ছিলেন না।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জীবদ্দশায় তিনি যদি ঘৃণাক্ষরেও বুঝতে পারতেন যে, তাঁর পরলোকগমনের পর এ-ডায়রিটা আগুনে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেওয়ার অতি ইচ্ছা তিনি অন্তরে পোষণ করেন, তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য কেউই উৎসাহি হবেন না। তবে তিনি জীবনের শেষের দিনগুলো যারপরনাই মর্মপীড়ার মধ্য দিয়ে কাটাতেন, অর্ন্তজ্বালায় তিলে তিলে দগ্ধ হতেন। এটা নিছকই কথার কথা নয়। আমি এটা হলফ করে বলতে পারি।
তবে এও সত্য যে, ডায়রিটা আগুনের শিখার শিকার না হয়ে কেন যে আজও নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে চলতে পারছে, কি নিছক সৌভাগ্যের জন্য সম্ভব হয়েছে, নাকি দুর্ভাগ্যের ব্যাপার তা আজও জানা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু এ বিষয়ে তিলমাত্রও সন্দেহ নেই যে, ডায়রিটা ব্যবহার করে ভন্ কেপেনে আর তার ঘনিষ্ঠ সুহৃদরা মোটা মালকড়ি কামিয়ে নেবেন। কেউ যদি এর বিপরীত কথা বলেন তবে তার বিচার-বুদ্ধিকে আমি অবশ্যই ঘষে মেজে পরিষ্কার করে নিতে বলব। তবে অবাক না হয়ে পারব না যে, এত বড় আহাম্মক সে হলো কি করে!
আমি এ প্রসঙ্গে এও নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এ ডায়রিটা ভাঙিয়েন্ি কেমপেলেন আর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বৃহদায়তন বহু বাড়ি, জমি, গাড়ি অন্যান্য সম্পত্তি কিনে যে তারা আমির-ওমরাহ বনে যাবে না এমন দুর্বল চিত্তের অধিকারী তারা অবশ্যই নয়। এককথায় তারা আখের গুছিয়ে নিয়ে ভবিষ্যতের ভোগ-বিলাসের পথ উন্মুক্ত করে নিতে অবশ্যই ভুলবে না।
তবে প্রেসবুর্গের অধিবাসী বলে ‘দ্য লিটারেরি ওয়ার্ডনামক পত্রিকা ব্যক্ত করেছে। যেহেতু কথাটা আমি তার মুখেই শুনেছি, তাই রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারি, প্রেসবুর্গে অবশ্যই নয়,নিউ ইয়র্কের উটিকা অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে আমি কিন্তু বিশ্বাস করি, তার মা-বাবা প্ৰেসবুর্গ পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানেই তাঁর বাল্য-কৈশোর-বার্ধক্য কাটে। মৃত্যুও হয় সে জায়গাতেই।
ওই প্রেসবুর্গ পরিবারের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন শ্রুতিধর দাবাড় যন্ত্রের আবিষ্কারক মায়েল জেল।
লোকটা ছিলেন খুবই বেঁটে। দেহসৌষ্ঠব ছিল লক্ষ্য করার মতো। আমিও শক্তিধরও বটে। মুখটায় সর্বদা হাসির প্রলেপ মাখানো থাকে। চোখ দুটো নীল আর ফোলা ফোলা। আর দাঁতগুলো রীতিমত ঝঙ্ক করে। তবে একটা পায়ে খুঁত আছে। তার চেহারা-ছবি, কথাবার্তা, আদব কায়দা এবং কাজকর্ম দেখে ভুলেও ভাবা যায় না লোকটাকে-মানবদ্বেষী। কারো মনে যদি এরকম কোনো ধারণা জন্মায় তবে তাকে বিশ্বনিন্দুক ছাড়া আর কোনো আখ্যা দিতে উৎসাহই পাওয়া যাবে না।
প্রায় সপ্তাহ দুয়েরই কথা বলছি, আমরা দুজন এক সপ্তাহ কালরোড দ্বীপভূমির প্রভিডেমের আলগ হোটেলে এক সঙ্গে থেকেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে, বিভিন্ন ।’ সময়ে আমরা তিন-চার ঘণ্টাবাক্যালাপ করে কাটিয়েছি।
উপরোক্ত হোটেলে অবস্থানকালে আমি তার সঙ্গে দীর্ঘসময় ধরে বাক্যালাপের মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে যে ধারণা নিতে পেরেছি তার ওপর নির্ভর করে বলছি, তিনি প্রধানত সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়েই কথাবার্তা বলতেন। আরও একটা কথা, তার বক্তব্যের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও ধ্যানধারণার নাম-গন্ধ কোনোদিন পাইনি।
আমি হোটেল ছাড়ার আগেই তিনি হোটেল ছাড়েন।
হোটেল ছেড়ে যাবার সময়ই তার ইচ্ছা ছিল, প্রথমে নিউ ইয়র্কে যাবেন। তারপর সেখান থেকে যাত্রা করে যাবেন ব্রেসেল ন্যাসেন।
তাঁর উদ্দেশ্য ব্রেসেল নগরেই তিনি নিজের আবিষ্কারের কথা প্রচার করবেন। শেষপর্যন্ত করলেনও তা-ই। এ নগরের অধিবাসীরাই সবার আগে তাঁর মহান কীর্তি, আবিষ্কারের কথা জানতে পারল।
অথবা উপরোক্ত বক্তব্যকে একটু ঘুরিয়ে বললে, সেখানকার মানুষই প্রথম সন্দেহ করে যে, তিনিই মহান আবিষ্কারটা করেছেন। ব্যস, আমি বর্তমানে মহাপ্রাণ ভন্ কেমপেলেনের ব্যাপারে এটুকুমাত্রই আমার জানা আছে। এর বেশি একটা শব্দও আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।
একটা কথা আমি না বলে পারছি না, আবিষ্কারের ব্যাপারটা নিয়ে চারদিকে লোকের মুখে মুখে গালগল্পগুজব অর্থাৎ নিতান্তই কাল্পনিক এতে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
তবুও একটা কথা খুবই সত্য বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে যে, এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে যা-কিছু কৃতিত্ব, খ্যাতি পাওয়া সম্ভব সম্পূর্ণরূপে তাঁরই প্রাপ্য, তথাপি আর একটা খুবই সহজ সরল যে, এসব ব্যাপারের পিছনে যে প্রকৃত সত্য লুকিয়ে থাকে তা কিন্তু উপন্যাসের কাহিনীর চেয়ে অনেক, অনেক বেশি বিস্ময় উৎপাদনের ক্ষমতা রাখতে পারে। আর কিছু না-ই বা মেনে নেওয়া হোক, অন্তত নিচে যে কাহিনীটা তুলে ধরা হচ্ছে, এটা এতেই প্রমাণিত যে, আমরা অনায়াসেই অন্তর থেকে স্বীকৃতি দিতে পারি।
একটা কথা গোড়াতেই বলে রাখছি ব্রেমেন নগরে অবস্থানকালে ভন কেমপেলেমের আর্থিক অবস্থা ভালো তো ছিলই না এবং আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে তিনি দিনাতিপাত করতেন। পরিচিত মহল এ কথা জানত, চোখের সামনে দেখেছেও যে, প্রায়ই সামান্য কিছু অর্থের সংস্থান করার জন্য তাঁকে যারপরনাই ফন্দি ফিকির করতে হত।
তখন গুটসমুখ অ্যান্ড কোম্পানির জালিয়াতির ব্যাপারকে কেন্দ্র নগরের সর্বত্র, এমনকি আনাচে কানাচে পর্যন্ত তুমুল হৈ হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। সংক্ষেপে বললে; জালিয়াতির ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে নগর জুড়ে তুমুল আলোড়ন হতে থাকে। ব্যাপারটার জন্য ভন্ কেমপেলেনকেই দায়ী করা হয় যাবতীয় সন্দেহ তার ওপরই বর্তাল।
জালিয়াতির ব্যাপারে ভন কেম্পেলেনকে সন্দেহ করার যুক্তি ছিল যথেষ্টই। কারণ, ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর পরই তিনি নগরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত গ্যাসপেরি লেনে তিনি বেশ বড়সড় একটা বাড়ি খরিদ করেছিলেন। ব্যস, এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল।
সন্দেহ যখন চরমে উঠল তখন তাকে টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হয়ে গেল। তাকে সরাসরিই জিজ্ঞাসা করা হল–এত বড় বাড়িটা খরিদ করতে যে দাম আপনাকে শোধ করতে হয়, তা আপনি কোন্ সূত্র থেকে পেয়েছেন, বলুন?
প্রশ্নটা শুনে বেচারা ভন্ কেমপেলেন কেবল আমতা আমতা করতে লাগলেন।
বার বার ধমক খেয়েও তিনি প্রশ্নটার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারলেন না। শেষপর্যন্ত হাতকড়া পরিয়ে তাকে জেলে ভরে দেওয়া হল।
ভন্ কেমপেলেনের বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায় শেষমেশ তাকে মুক্তি দেওয়া হল।
জেলখাটার দায় থেকে অব্যাহতি পেলেও টিকটিকির দল কিন্তু তার পিছন ছাড়ল না। আর পুলিশ তো ধরতে গেলে আঠালির মতো তার গায়ের সঙ্গে সেঁটে রইল। তারা তার গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রেখে দেখল, তিনি বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে ভাণ্ডার ঘাট নামক সঙ্কীর্ণ গলিপথ ধরেন। গলিটার গোলকধাঁধা অতিক্রম করার সময় অনুসরণকারী পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে হঠাৎ কোথায় যে উধাও হয়ে যায়, তার হদিসই তারা পায় না।
ব্যস এবার জোর তল্লাসি শুরু হয়ে গেল। গৃহকর্তা ভন্ কেমপেলেনকে হাতকড়া পরিয়ে কেবলমাত্র তার থাকার ঘরটাই নয়, বরং কথাচ্ছলে সব কয়টা ঘরই তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। এর যথেষ্ট যুক্তিও ছিল। কারণ, বাড়িটার সবগুলো ঘরই তার দখলেই ছিল। নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাঁর তো কিছু করারও ছিল না।
ভন্ কেমপেলেনকে যে চিলেকোঠা থেকে খুঁজে বের করে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তারই লাগোয়া দশ ফুট দৈর্ঘ্য ও আট ফুট প্রস্থবিশিষ্ট ছোট্ট একটা কামরা ছিল। সেটাতে কিছু রাসায়নিক সরঞ্জাম রক্ষিত ছিল। কামরাটার ভেতরে ঢুকে অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে তাকালে চোখে পড়ল এক কোণে একটা উনুন জ্বলছে। তার ওপর বসানো ছিল একটা নল দিয়ে সংযোগ সাধন করা দুটো পাইপ।
পাইপ দুটোর একটাতে সিসর ছিদ্র ছিল, আর অন্যটাতে কোনো একটা তরল পদার্থ অনবরত ফুটছিল। আর তা থেকে গলগল করে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
লোকটি গ্রেপ্তার হবার ভয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে দুটো পাইপ দুহাতে ধরে ভেতরের পদার্থগুলোকে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে দেয়।
পুলিশ তার অপরাধ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার পর মুহূর্তমাত্র দেরি না করেই তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। এবার তার প্যান্ট ও জ্যাকেটের পকেটে হাত চালিয়ে খোঁজাখুঁজি করা হল। শেষমেশ জ্যাকেটের পকেটে একটা কাগজের পার্সেল বের করে আনা হল। এ ছাড়া আর কিছু পেল না।
পরবর্তীকালে আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেল; জ্যাকেটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল রসাঞ্জনে এবং একটা অজ্ঞাত পদার্থের মিশ্রণ।
পুলিশ অফিসাররা এবার হাতকড়া পরিহিত বন্দিকে নিয়ে তাঁর রসায়নাগার থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরে গেলেন। ঘরের সবগুলো বাক্স পেটারা ঘাঁটাঘাঁটি করে, তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি করে কিছু সোনা ও কিছু রূপার মুদ্রা ছাড়া বিশেষ কিছু বের করতে পারল না।
এবার বিছানাপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে বিছানার তলা থেকে বিশাল একটা বাক্স দেখতে পেলেন। কিন্তু গায়ের জোরে টানাটানি করেও সেটাকে বাইরে আনতে পারলেন না।
ব্যাপারটা পুলিশ অফিসারদের মনে বিস্ময়ের সঞ্চার করল। উপায়ান্তর না দেখে তাদের একজন প্রায় বুকে হেঁটে খাটের নিচে ঢুকে বাক্সটার ভেতরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে উঠল–‘দেখুন, বাক্সটাকে টানাটানি করেও আমরা যে এক তিলও নড়াতে পারিনি তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। কি করেই বা নড়াব? পুরনো পিতলের টুকরো দিয়ে বাক্সটা একেবারে বোঝাই।’
কথাটা বলেই সে এবার তার বলিষ্ঠ পা দুটোকে দেওয়ালে ঠেকিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে বাক্সটাকে ঠেলতে লাগল। আর তার সহকর্মীরা সবাই মিলে সেটার আংটা ধরে দাঁতে দাঁত চেপে টানতে লাগল।
এভাবে উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় দুদিক থেকে টানাটানির ফলে বহুকষ্টে বাক্সটাকে বিছানার তলা থেকে বের করে আনা সম্ভব হল। এবার তার ভেতরে হাত চালিয়ে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হল।
বাক্সটার ভেতর থেকে বের করা হলো বেশ কয়েকটি মসৃণ ও চকচকে ধাতব টুকরো–এক-একটার আকার মটরদানা থেকে পর্যন্ত বিভিন্ন মাপের।
তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের মধ্যে কারোই মাথায় এলো না যে, ধাতব টুকরোগুলো পিতল ছাড়া অন্য কোনো ধাতু হতে পারে। আর এগুলো যে সোনা হওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়, কেউ অনুমানও করতে পারল না।
পরদিন সকাল হতে না হতেই ব্রোমন নগরের মানুষ জানতে পারল যে, পুলিশ অফিসাররা যে সব পিতলের টুকরো গাড়ি ভর্তি করে থানায় নিয়ে গেল, অথচ সেগুলোর মধ্য থেকে কেউ একটা কণাও পকেটে ভরেনি সেগুলো সবই খাঁটি সোনা ছিল। খাঁটি সোনা বলতে বুঝাতে চাচ্ছি, যে সোনা মুদ্রা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়, তার চেয়ে অনেক উস্কৃষ্ট ধরনের সোনা। খাঁটি, পুরোপুরি খাঁটি সোনা বলতে যা বোঝায়।
আমি এখানে ভন কেমপেলেনের স্বীকারোক্তি আর তার মুক্তি সংক্রান্ত বিশদ বিবরণ উল্লেখ করব না। কারণ? কারণ, একটাই। সে সব কথা তো আর কারোই অজানা নয়। তিনি যে একজন দার্শনিকদের পরশমণির হদিস পেয়েছিলেন, কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষই তাকে সন্দেহ করবে না, ভুলেও না।
তবে সহজ কথাটা এই যে, আজ পর্যন্ত যত কিছু বিশ্লেষণ করা হয়েছে সবই দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কিভাবে তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হবে? ভন কেমপেলেন নিজে থেকে এ-রহস্যটা আমাদের কাছে যতদিন সমাধান না করবেন ততদিন এ-ব্যাপারটা পর্দার আড়ালেই রয়ে যাবে।
তাঁর গবেষণার ব্যাপার স্যাপার দেখে ভালোভাবেই বুঝা গেল, কিছু সংখ্যক অজ্ঞাত পদার্থ অজানা অনুপাতে মিশিয়ে ইচ্ছানুযায়ী এবং তৎক্ষণাৎ খাঁটি সোনা তৈরি করা সম্ভব। ভন কেমপেলেন দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে এ-তথ্যটাই আবিষ্কার করেছেন।
ভন্ কেমপেলেনের এ আবিষ্কার আর মুহূর্তের মধ্যেই তার ফলাফল লাভের ব্যাপারটা নিয়ে এরই মধ্যে নানা জল্পনা কল্পনা–চিন্তা ভাবনা আরম্ভ হয়ে গেছে।
আজ পর্যন্ত সোনা তৈরির ব্যাপারে ইউরোপে যে ফলাফল লক্ষিত হয়েছে তা হচ্ছে–বাজারে সিসার দর শতকরা দশ টাকা হারে বেড়ে গেছে। কেবল সোনার দরই নয়, রূপার দরও কম বাড়েনি। শতকরা পঁচিশ হারে বেড়েছে। আর হবে না-ই বা কেন? চারদিকে যে সোনা তৈরির জন্য প্রচেষ্টার দারুণ তোড়জোড় চলছে।