দ্য ডোম্যাইন অব আর্নহিস
এলিসন।
আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু এলিসন।
জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে একেবারে সমাধিক্ষেত্র পর্যন্ত পুরো পথটাই আমার বন্ধুবর এলিসন সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের মধ্য দিয়েই পাড়ি দিয়েছে।
সমৃদ্ধি আর প্রাচুর্য্য কথা দুটোকে কিন্তু আমি মোটেই কেবলমাত্র জাগতিক অর্থেই ব্যবহার করছি না। বরং মনে করা যেতে পাওে, মুখের সমার্থক শব্দ হিসেবেই ব্যবহার করছি। অর্থাৎ আমার বন্ধুবর যেমন রূপার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিল ঠিক তেমনই সুখ স্বাচ্ছন্দের মধ্য দিয়ে আমৃত্যু জীবন যাপন করে গেছে। দুঃখ-দুর্দশা বা অভাব অনটন কাকে বলে বিন্দুমাত্রও তার জানা ছিল না।
এবার বলছি, যার কথা আমি বলছি, তার জন্মও বিশেষত্বে ভরপুর। সত্যি কথা বলতে কি, তার জন্মই যেন প্রিস্টলি, কন্ডসেট, তুগগা ও প্রাসইস কর্তৃক প্রচারিত মতবাদের পূর্বভাষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায় না। একটু আধটু ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, তার জন্ম পূর্ণতাবাদীদের অলীক কল্পনার ব্যক্তিগত একটা উদাহরণস্বরূপ।
তবে এ-কথাও কিন্তু খুবই সত্য যে, সুখ সম্বন্ধে কোনো কাহিনী বা প্রবন্ধের অবতারণা করা আদৌ আমার অভিলাষ নয়, সে চেষ্টাও আমি করব না।
তবে খুই সংক্ষেপে আমার বন্ধুটি সম্বন্ধে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা সম্ভব।
আমার সে বন্ধুবর মুখের চারটি মৌলিক নীতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত, অর্থাৎ আরও খোলসা করে, যথাযথভাবে বললে, চারটি শর্তকে সে সতর্কতার সঙ্গে পালন করত।
শুনলে অবাক না হয়ে পারা যায় না, শর্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সরল দৈহিক একটা কাজ। ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো না, তাই না? আসলে কোনোরকম যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম ছাড়াই মুক্ত বাতাসে কয়েকটি ব্যায়ামের অনুশীলন করা।
শরীরগঠন অর্থাৎ ব্যায়ামের প্রসঙ্গ নিয়ে কারো সঙ্গে কথা উঠলেই আমার বন্ধু সরাসরি জবাব দিত–অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে যে স্বাস্থ্য লাভ সম্ভব হয় তাকে স্বাস্থ্য আখ্যাই দেওয়া চলে না!
আর একটা কথা, শ্রেণিগতভাবে অন্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে যাদের সুখি বলা যেতে পারে তাদের দৃষ্টান্ত খাড়া করাতে গিয়ে আমার বন্ধুটি শেয়াল শিকারিদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর যারা কৃষিকাজে লিপ্ত থাকে তাদের দৃষ্টান্তই তুলে ধরত।
আমার বন্ধুটির প্রথম ও সেরা শর্তের কথা তো বললাম। এবার বলছি, তার দ্বিতীয় শর্তের কথা। সেটা হলো নারীর প্রেম–নারী হৃদয়ের ভালোবাসা।
আর তৃতীয় শর্তটা? সেটা অর্জন করা বাস্তবিকই কঠিন সমস্যা। সেটা কি? সংক্ষেপে বলতে গেলে, উচ্চাকাঙ্খার প্রতি বিতৃষ্ণা, জলন্ত বিতৃষ্ণাই বলা চলে। এবার শেষ, অর্থাৎ চতুর্থ শর্তের কথা উল্লেখ করছি। সেটা হচ্ছে, নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুসরণ করার মতো কোনো বিষয়। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিল, অন্য যাবতীয় কিছু যদি সমতুল্য হয় তবে লব্ধ সুখের পরিমাণ হবে বিষয়টার আধ্যাত্মিকতার সমানুপাতিক। এটা একটু লটঘটে সন্দেহ নেই।
আমার বন্ধুবর এলিসনের ওপর ভাগ্যদেবতা যেন উদার হস্তে সৌভাগ্য চাপিয়ে । দিয়েছেন। কোনো মানুষের প্রতি ভাগ্যদেবতা যে এমন উদার হতে পারেন তা যেন কল্পনাও করা যায় না। তিনি দুহাতে আমার বন্ধুটির মাথায় সৌভাগ্য উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন।
কেবলমাত্র যে ধন দৌলতের ব্যাপার তাই নয়, ভাগ্যদেবতা তাকে দৈহিক সৌন্দৰ্য্যও কম দেননি। সুঠাম ও রূপ-লাবণ্যের বিচারেও তার জুড়ি মেলা ভার। তার তুল্য সৌন্দর্য পরিচিত মহলে অন্য কারো দেহেই লক্ষিত হয় না। আর বুদ্ধিমত্তা?
জ্ঞান-বুদ্ধির বিচারেও আমার বন্ধু এলিসনের তুলনা হয় না। যাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করতে হয় না আমার বন্ধুটি তাদেরই একজন। অর্থাৎ তার জ্ঞান যেন তার মধ্যে জন্মাবধি বিরাজ করত।
আর তাদের বংশ মর্যাদা? পারিবারিক খ্যাতির বিচারেও তাদের সাম্রাজ্যে সবার শীর্ষে অবস্থান করত। বংশমর্যাদার ব্যাপারেও তাদের পরিবারের ওপর যেন দেবতার আশীর্বাদ বর্ষিত হত।
আমার বন্ধুর পারিবারিক সুখ-শান্তিও ছিল যথার্থই অতুলনীয়। তার সহধর্মিনী ছিল যথার্থই একজন রূপে গুণে অনন্যা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তার সহধর্মিনী ছিল একজন রমনীয়া রমনী। আর তার বিশ্বস্ততা? এদিক থেকে তার তুল্য সতী নারী দ্বিতীয় আর একজন খুঁজে পাওয়া ভার।
আর তার বিষয় সম্পত্তির কথা মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের পরিবারে সর্বদাই প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি ছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে সে যেমন রূপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিল, আজীবন তা আর মুখ থেকে নামেনি।
আমার বন্ধুবরের জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর জানতে পারল যে, নিয়তি আরও একবার তাকে নিয়ে অসাধারণ খামখেয়ালি খেলায় মেতেছে।
আমার বন্ধু এলিসন নাবালকত্ব কাটিয়ে সাবালক হবার প্রায় একশো বছর আগে দেশের একেবারে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মি. ব্রিাইট এলিসন নামক এক ভদ্রলোক ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমান। তিনি ছিলেন এক রাজার তুল্য ধন দৌলতের অধিকারী। এমন অপরিমিত বিত্তসম্পদ কিন্তু তার প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী ছিল না, বলতে কেউই ছিল না। মোদ্দা কথা, ধন সম্পত্তি অঢেল কিন্তু তার কোনো মালিক নেই।
শুধু কি এই? মি. ব্রিাইট এলিসন তার ধন-সম্পত্তির যে ব্যবস্থাদি করে যান তা হচ্ছে, তার পরলোক গমনের পর সে বিষয় আশায় দীর্ঘ একশো বছর ধরে বিভিন্ন প্রকার লগ্নির মাধ্যমে কেবল বেড়েই যাবে। তারপর সে ধন-সম্পদের কি গতি হবে, তাই না? সবকিছুর মালিকানা যাবে রক্তের সম্পর্ক আছে এমন এক আত্মীয়ের ওপর। সে ব্যক্তি একশো বছর পরও পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে। এতেই আমার বন্ধুবর যুবক এলিসনের ভাগ্য গেল খুলে। সে তার একুশতম জন্মদিনে সে সব অপরিমিত সম্পত্তি রেখে-যাওয়া ব্রিাইটের উত্তরাধিকারী হিসেবে পঁয়তাল্লিশ কোটি ডলারের মালিক বনে গেল। পঁয়তাল্লিশ কোটি ডলার, কম কথা! এক দাও মারার কথা ভাবা যায়! হ্যাঁ, ব্যাপারটাকে একেবারেই অভাবনীয়, রীতিমত অবিশ্বাস্য ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে?
ব্যাপারটা চাপা তো থাকলই না, বরং বাতাসের কাঁধে ভর করে দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এ-কান সে-কান করে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে অঞ্চলের মানুষরা এখানে-ওখানে ছোট-বড় দলে বিভক্ত হয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনায় মেতে উঠল। সবার একই বক্তব্য, মি. এলিসন হঠাৎ এমন বিপুল অর্থের মালিক তো বনে গেল। এবার? সে অর্থগুলো কিভাবে খরচ করবে? এ ব্যাপারটা নিয়ে এক-একজন খরচের ভিন্ন ভিন্ন ফিরিস্তি দিতে লাগল। শেষমেষ দেখা গেল, সব মিলে পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, কম সে কম হাজার রকম মতামত লোকের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কেউ, কারো চেয়ে কমতি যায় না।
আরে ব্যস, একে রাজার সমান ধন-সম্পত্তি! তার ওপর একশো বছর ধরে তা লগ্নি খেটে তা শেষমেশ পঁয়তাল্লিশ কোটি ডলারে পরিণত হয়েছে। পঁয়তাল্লিশ কোটি ডলারের কথা শুনলেই তো মাথা ঘুরে, মূচ্ছা যাবার জোগাড়।
এবার কেউ কেউ কাগজ-কলম নিয়ে হিসাব কষতে বসে গেল। পঁয়তাল্লিশ কোটি ডলার শতকরা তিনভাগ হার সুদ হলেও প্রাপ্ত মোট অর্থের সুদ পাওয়া যাবে এক কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ ডলার; অর্থাৎ প্রতি মাসে পাওয়া যাবে এগারো লক্ষ পঁচিশ হাজার ডলার।
এ তো গেল প্রতিমাসে অর্থাগমের হিসাব। আর প্রতিদিনে? প্রতিদিনে তার আয় হবে ছত্রিশ হাজার নয়শ ছিয়াশি ডলার।
আর যদি প্রতিঘণ্টার অর্থাগমের হিসাব করা যায়, তবে প্রতি ঘণ্টায় আয় হবে এক হাজার পাঁচশো একচল্লিশ ডলার।
এবার দেখা যাক, সে কি পরিমাণ অর্থ পেতে পারে। হিসাব কষে দেখা গেল, তা হবে দুশ বিশ ডলার–ভাবা যায়!
তাই বলতেই হয়, মানুষের কল্পনা বার বার ধাক্কা খেতে খেতে একেবারে ভোতা হয়ে গেল। সত্যিই তো এমন একটা ব্যাপার নিয়ে বাবনা-চিন্তা করতে বসলে এমন কোন মানুষ আছে যে বেশিক্ষণ মাথা ঠিক রাখতে পারে?
আমার বন্ধুবর মি. এলিসনের অর্থকড়ির ব্যাপারটা নিয়ে যারা বেশি করে ভাবনা চিন্তায় মাতল তাদের মধ্যে কেউ-কেউ জল্পনা-কল্পনার মাধ্যমে এমন সিদ্ধান্তেও এলো যে, মি. এলিসন তার প্রাপ্ত সম্পূর্ণ সম্পত্তির কম হলেও অর্ধেকটা দূর সম্পর্কের ও নিকট আত্মীয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেবে। আর অবশিষ্ট অর্ধাংশ? নিজের ভোগ বিলাসের জন্য অর্ধেক সম্পত্তি জমা রাখবে।
কিন্তু আমি জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন জানতে পারলাম, আমার বন্ধুবর এলিসন অনেক আগেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছে, সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে তখন কিন্তু আমি এতটুকুও বিস্মিত তো হই-ইনি বরং স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছি।
আবার তার অর্থকড়ির ভাগাভাগির ব্যাপারটা নিয়েও আমি অবাক হবার মতো কিছু দেখলাম না।
শেষমেশ আমি লক্ষ্য করলাম, আমার বন্ধুটি সুখে বা দুঃখে যে করেই হোক সে প্রায় তার আগেকার সে-অবস্থাতেই ফিরে গেল। অর্থাৎ সে যা ছিল বর্তমানে অবস্থা সে-রকমই হল।
বন্ধুবর মি. এলিসন ছিল একজন মনে-প্রাণে কবি। কবিতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিতেই তার সবচেয়ে বেশি আনন্দ।
তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল কাব্যিক মনস্কতা। আর সে ভালোই জানত, তার মহান মান-মর্যাদা তার উদার আদর্শ বলতে আসলে কি বোঝায়?
আমার বন্ধুটি ভালোই বুঝত, বিশ্বাস করত, তার কাব্যিক মনোভাবের পরিপূর্ণ প্রকাশ ও বিকাশ কেবলমাত্র নুতন নতুন সৌন্দর্য সৃষ্টির মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। আর এরই জন্য বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন হয়ে উঠল যে, সে একজন সত্যিকারের কবি বা সুরশিল্পী কোনোটাই হতে পারল না, আর যা-ই হোক, অন্তত সাধারণ অর্থে তো অবশ্যই নয়। আবার এও বলা যেতে পারে যে, এ দুটোর কোনোটা হবার আগ্রহ তার মধ্যে ছিল না।
আমি তার মনোভাব সম্বন্ধে যে ধারণা করেছিলাম, সে হয়তো বা মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল, পৃথিবীতে প্রকৃত সুখি হবার একমাত্র পথই হচ্ছে উচ্চাভিলাষের প্রতি মনে বৈরাগ্যভাব পোষণ করা। অর্থাৎ বৈরাগ্য ছাড়া যথার্থ সুখ আসতে পারে না, কিছুতেই না।
একজন বড়মাপের প্রতিভাবানকে উচ্চাভিলাষী হতেই হবে এটা কি সত্যি সত্যি সম্ভব নয়? তবে এও খুবই সত্য যে, একজন সর্বোচ্চ প্রতিভার অধিকারী কিন্তু উচ্চাভিলাষের অতীত। অর্থাৎ সত্যিকারের প্রতিভাবান উচ্চাভিলাষের বশীভূত হয়ে কোনো কাজে প্রবৃত্ত হয় না। এসব ব্যাপার স্যাপার নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা করার মানসিকতার বড়ই অভাব।
আচ্ছা, এটা কি সম্ভব নয় যে, কবি মিলটনের চেয়ে অনেক বড় মাপের কবি প্রতিভা নীরব আর অখ্যাতই বয়ে গেছেন।
আমার বন্ধুবর এলিসন কবি হলো না, আর সুরশিল্পী কোনোটাই হলো না। যদিও তার মতো কবিতা আর সংগীতের প্রতি এমন অনুরাগের গভীরতা ওর আগে কারো মধ্যেই কেউ দেখেনি।
সত্যি কথা বলতে কি, সে অন্য রকম পরিবেশে পড়লে হয়তো বা একজন চিত্রশিল্পীরূপে খ্যাতি অর্জন করতে পারত।
চিত্রশিল্পী সম্বন্ধে কথা উঠলে প্রসঙ্গক্রমে সে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলত, শিল্পকর্মের সবচেয়ে আসল, সর্বাধিক মূল্যবান আর সবচেয়ে স্বাভাবিক বিভাগটাকেই একেবারেই অহেতুক অবস্থার চোখে দেখা হয়েছে। এমন একটা ব্যাপারের কথা ভাবলেও খারাপ লাগে।
কবি কাকে বলা হয়, একজন কবির সংজ্ঞা কি, কার না জানা আছে? কিন্তু একজন যদি প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাধ্যমে চমৎকার একটি উদ্যানকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে তবে তাকে কি বলে সম্বোধন করা হবে, তাকে কোন আখ্যা দেওয়া হবে? অথচ আমার বন্ধুবর এলিসন নিজের মতো ব্যক্ত করতে গিয়ে বলে প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাধ্যমে উদ্যান তৈরির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে একজন চিত্রকরের শিল্প-বিকাশের যথার্থ ক্ষেত্র।
আমার বন্ধুবর চিত্রশিল্প সম্বন্ধে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে এও বলেছে যে, চিত্রশিল্পীর শিল্প-বিকাশের ক্ষেত্রেই রয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যকে কল্পনার সাহায্যে হরেক রকম উপায়ে সাজিয়ে নতুন নতুন দৃশ্য সৃষ্টির এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র। মনোলোভা প্রাকৃতিক দৃশ্য সৃষ্টির এমন সুযোগ সচরাচর মেলে না, তাকে কাজে লাগাতেই উৎসাহি হবে। আশ্চর্য কি?
উপরোক্ত দিকটার কথা বিবেচনা করে তাই তো সে প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাধ্যমে সৃষ্টির কাজেই সে নিজেকে লিপ্ত করল। আর এটাই তো স্বাভাবিক।
আমার বন্ধুবর মি. এলিসন শিল্প-সৃষ্টির এ বিশেষ দিকে যে দক্ষতার পরিচয় দিল, সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট একটা ধারণা পাঠক-পাঠিকাদের কাছে যথাযথভাবে ব্যক্ত করার সাধ্য আমার নেই, আসলে সত্যি ব্যাপারটা সাধ্যাতীত। এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেই আমার অক্ষমতার জন্য আমি যারপরনাই হতাশায় ভেঙে পড়ি। তাই অনন্যোপায় হয়েই সে চেষ্টা থেকে আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। তার চেয়ে বরং তার কাজের একটা দৃষ্টান্ত দিয়েই আমার বক্তব্য পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরছি
আমার বন্ধু মি. এলিসন কাজে হাত দিয়েই গোড়াতেই যে কাজে মনোনিবেশ। করল তা হচ্ছে, প্রস্তাবিত উদ্যানের জন্য উপযুক্ত স্থাননির্বাচন করা।
উদ্যানের জন্য উপযুক্ত স্থান বাছাবাছি করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করতেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক পরিবেশের দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। মতি দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক দৃশ্য তাঁর মন-প্রাণকে পুরোপুরি জয় করেনিল।
ব্যস, তার মন-প্রাণ দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে ছুটে গেল। সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, যত শীঘ্রই সম্ভব দক্ষিণ সমুদ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। কিন্তু আবার এক রাতের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল, অর্থাৎ দক্ষিণ-সমুদ্রের অভিমুখে যাত্রা করার পরিকল্পনাকে বাতিল করে দিল।
আমি বন্ধুর এরকম সিদ্ধান্ত বাতিলের কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জবাব দিল ‘হ্যাঁ, কারণ তো অবশ্যই আছে।’
আমি আগ্রহান্বিত হয়ে বললাম–আরে বন্ধু, সে কারণটাই তো জানতে চাইছি। কেন হঠাৎ দক্ষিণ-সমুদ্রে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা বাতিল করলে, বল তো?’
‘যদি আমি একদল মানববিদ্বেষী হতাম তবে সে জায়গাটা আমার কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য হত সন্দেহ নেই।
‘হুম!’
‘সত্যি কথা বলতে কি, সে স্থানটার সম্পূর্ণ নির্জনতা বিচ্ছিন্নতা আর প্রবেশ ওনির্গমনের সমস্যাই আমার মনকে দারুণভাবে আকর্ষণ করত।
‘তাই বুঝি?
‘অবশ্যই। আরে ভায়া, আমি তো আর ‘টাইমন’ নই।’
‘তোমার কথার তাৎপর্য–’
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বন্ধু মি. এলিসন এবার বলল–‘আমি বলতে চাইছি, নির্জনতা আমার প্রিয়। কিন্তু আমি নির্জনতার শান্তির প্রত্যাশী, তার বিষণ্ণতাকে অবশ্যই চাই না। তাই তো আমাকে এমন একটা জায়গার খোঁজ করতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে যার অবস্থান জনাকীর্ণ শহর থেকে তেমন কিছু দূরে নয়। আমি নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী যেখানে কাজে আত্ম নিয়োগ করতে সক্ষম হব।’
ব্যস, যে কথা সেই কাজ। আমার বন্ধু এবার কয়েক বছর ধরে নিজের মনের মতো একটা উপযুক্ত জায়গার খোঁজে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়ালো। আজ এখানে কাল সেখানে করে কত জায়গায়ই যে সে ঘুরে বেড়ালো তার ইয়ত্তা নেই।
জায়গা বাছাবাছির কাজে সে আমাকে সঙ্গেনিল। আমরা দুজন মিলে হাজার হাজার জায়গা দেখে বেড়াতে লাগলাম। আমি যতসব জায়গা দেখে মুগ্ধ হই, তার কাজে জায়গাটা সম্বন্ধে যতই আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি না কেন সে কিন্তু এক কথাতেই তা বাতিল করে দিল। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়াল যে, আমার রুচি-পছন্দ যেন মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আর বন্ধু মি. এলিসন নিজের কাজের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমার কাছে যেসব যুক্তির অবতারণা করত সেগুলোকে আমিও শেষ অবধি মেনে না নিয়ে পারতাম না। এ তো খুবই সত্য যে, কোনো কথা যদি যুক্তিসঙ্গত হয় তবে তাকে মেনে না নিয়ে। উপায়ও তো থাকে না।
একের পর এক জায়গায় ঘুরে আমরা শেষমেষ এমন একটা জায়গায় হাজির হলাম যেখানে কেবলমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের বিচারে আকর্ষণীয় নয়, আছে অবিশ্বাস্য রকমের উর্বর আর মনোরম এক উচ্চ মালভূমি। বিচার করতে বসলে বলতেই হয়, জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পরিবেশ রূপসি এটনার পরিবেশ থেকে কোনো অংশে কম বলা যাবে না। বরং বন্ধুবর এলিসনের মতে, এমনকি আমার মতেও, সে জায়গায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টিপাত করলে যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের মুখোমুখি হওয়া যায়, তা এটনার পর্বতের শীর্ষদেশ থেকে দেখা যায় এমন বহুজনের দ্বারা প্রশংসিত মনোলোভা দৃশ্যগুলোকেও ম্লান করে দেয়। তাই আমার পক্ষে বন্ধুর সঙ্গে সহমত ব্যক্ত না করে উপায়ই বা কি? যা প্রকৃত সৌন্দর্য্যের দাবিদার, যা বাস্তবিকই দেহ-মনকে এক অনাস্বাদিত পুলকে ভরপুর করে তোলে তাকে অস্বীকার করা যে কেবলমাত্র আমার পক্ষেই নয়, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
আমার পর্যটকবন্ধু মি. এলিসন অপলক চোখে, ভাবাপুত মন নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সে মনোলোভা দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে এক সময় পুলকানন্দে ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল–একটা কথা কিন্তু আমার অবশ্যই জানা আছে, মানে ভালোই বুঝি
আমি তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকালাম।
সে প্রসঙ্গটার জের টেনে বলে চলল–‘হ্যাঁ, আমি বুঝি যে, যে কেউ আমার পরিস্থিতিতে পড়লে খুবই নাক সিঁটকানো খুঁত খুঁতে চরিত্রের দশজন মানুষের মধ্যে নয়জনই এ জায়গাটা দেখে মুগ্ধ হবে। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী বাস্তবিকই মনোরম ও অতুলনীয়।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে দৃশ্যটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলাম–হুম’!
সে বলে চলল–এ দৃশ্যাবলী, মানে জায়গাটা সম্বন্ধে আমার পুলকিত হওয়া উচিত। তবে একটা কথা–‘।
আমি তার কথার মাঝখানে বলে উঠলাম–কী? কী বলতে চাইছ?
‘বলতে চাইছি, এ স্থানটা কিন্তু খুব বেশি মহিমামণ্ডিত।
‘হ্যাঁ, তা অবশ্য খুবই সত্য কথা।
‘এমন অতিমাত্রায় মহিমান্বিত দৃশ্য গোড়ার দিকে মনকে চমকে দেয় বটে। আর উত্তেজনাও কম সৃষ্টি করে না। ব্যস, তারপরই মনপ্রাণকে ক্লান্তিতে ভরপুর করে তোলে, আর বিষণ্ণও কম করে না।
‘হুম!’
‘তাই বলছি কি–’
সে কথাটাকে শেষ করার দরকার মনে না করায় এ পর্যন্ত বলেই সে থেমে গেল।
আমরা এভাবে এক নাগাড়ে চার বছর ধরে ঘুরে বেরালাম। ঘুরতে ঘুরতে আমরা শেষমেশ এমন একটা জায়গার খোঁজ পাই সেটা দেখে আমার বন্ধু এলিসনও উল্লসিত হল। কোন জায়গা সেটা বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করছি না।
বর্তমানে আমার বন্ধুবর এলিসন আর ইহলোকে নেই। সে পরলোকে গমন করায় তার সে জমিদারি কয়েকটা বিশেষ শ্রেণির পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এরই জন্য, আর্লহিমকে কেন্দ্র করে একটা গোপন ও চাপা যশ-খ্যাতির ঢেউ গড়ে উঠল। অনেকেই এর-ওর সঙ্গে ফিসফিসিয়ে আহিসের সুখ্যাতি সম্বন্ধে আলোচনায় মগ্ন হল।
এবার বিখ্যাত স্থান আর্নহামে প্রবেশের উপায় সম্বন্ধে ধারণা দিচ্ছি। একমাত্র নদীপথেই সেখানে যেতে হয়। আমার পর্যটক বন্ধু কাক ডাকা ভোরে শহর থেকে আর্নহামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
জলপথ ধরে সে ধীর-মন্থর গতিতে এগোতে লাগলাম। নদী ও নদীর দুপাড়ের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে দুপুর পর্যন্ত পথ পাড়ি দিল।
নদীর পাড়ের তৃণক্ষেত্রে অগণিত ভেড়ার পালকে চড়ে বেড়াতে দেখতে পেলাম যাকে ভেড়ার মেলা আখ্যা দিলেই হয়তো সঠিক বর্ণনা দেওয়া হবে। সেখানে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে, তা বাস্তবিকই অকল্পনীয়। সাদা লোমযুক্ত ভেড়াগুলো এমন দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছে হঠাৎ করে দেখলে যাদের সবুজ ঘাসের প্রান্তরের গায়ে অগণিত সাদা বিন্দু বলে মনে হতে লাগল।
গোড়ার দিকে তার মাথায় ছিল চাষ আবাদ করা। কিন্তু সবুজ প্রান্তরের বুকে এমন মনোরম দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার পর তার মন থেকে সে বাসনা মুছে গিয়ে পশুপালনের বাসনা তার মনে চেপে বসল।
তার গতি অব্যাহতই রইল। ধীরগতিতে ক্রমেই সামনের দিকে এগিয়ে চলল। এবার তার মন থেকে পশুপালনের বাসনা একটু একটু করে মুছে যেতে লাগল। ক্রমেই নির্জনতার চেতনা তার মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে লাগল, আর তা অচিরেই তা তার মনকে ছেয়ে ফেলল।
ক্রমে প্রকৃতির বুকে শুরু হয়ে গেল আলো-আঁধারীর খেলা। তারপরই একটু একটু করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে লাগল। অন্ধকার যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল নদীটাও যেন অন্ধকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমেই সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়তে আরম্ভ করল। তার উভয় তীরই খাড়া হতে লাগল।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে নদীর তীরবর্তী মাঠ-প্রান্তর যেন ক্রমেই ঘন সবুজ আর লতাপাতায় বেশি করে ঢাকা পড়তে পড়তে মিলিয়ে যেতে আরম্ভ করল।
এদিকে নদীর পানি ক্রমেই স্বচ্ছ হতে লাগল। আর একের পর এক বাঁক ঘুরে নদী তার গতি, স্রোতধারাকে নজরে পড়ছে না, অর্থাৎ হাত কয়েক দূরে গিয়েই দৃষ্টি থমকে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
ছোট, এক চিলতে নদীটা ক্ৰমে এগোতে এগোতে এক সময় গিরি-নালার রূপনিল।
পাহাড়ের বুক চিড়ে নদীটা কুল কুল ধ্বনি ধ্বনিত করে এগিয়ে চললনিম্নভূমির উদ্দেশ্যে।
গিরি নালাটার দুপাশের পাথরের প্রাচীর খাড়াভাবে একশো থেকে দেড়শো ফুট ওপর পর্যন্ত উঠে গেছে। আর একটা ব্যাপার নজরে পড়ছে, প্রাচীর দুটো যতই ওপরে উঠছে ততই যেন একে অন্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আর এ-ঝুঁকে পড়াটা ক্রমে এত বেশি হতে লাগল যে, দিনের আলো ঢোকা রাস্তাটাও যেন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
শুধু কি এ-ই? খাড়া পাথরের প্রাচীর দুটোর শীর্ষদেশ গায়ে গায়ে অবস্থান করার সঙ্গে গাছগাছালি আর লতাপাতার সমাবেশ ঘটেছে। আর শ্যাওলা আর পাহাড়ের ঝোঁপঝাড় লতাপাতা মিলে সম্পূর্ণ সুড়ঙ্গটাকেই যেন এক বিশেষ প্রকৃতির বিষণ্ণতায় ভার সে রেখেছে। সব মিলে যেন এক অত্যাশ্চর্য পরিবেশ সেখানে গড়ে উঠেছে।
গিরি-পালাটা এঁকে বেঁকে হেলে দুলে বার বার বাঁক ঘুরে রীতিমত এমন এক চক্করের সৃষ্টি করেছে, যাকে একমাত্র গোলকধাঁধার সঙ্গেই তুলনা করে চলতে পারে। এমন এক সঙ্কীর্ণ নালাপথে, গোলকধাঁধার কয়েক ঘণ্টা চক্কর খেয়ে হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত বাঁক ঘুরে এগোতেই আমাদের জাহাজটার সামনে যেন আকাশ থেকে। বড়সড় একটা বৃত্তাকার অববাহিকা সামনে পড়ল।
বৃত্তাকার অববাহিকাটার ব্যাস দুশ মিটারের কাছাকাছি। ওপরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় একটিমাত্র বিন্দু ছাড়া আর অন্য সব দিকেই সুড়ঙ্গের মতো খাড়া পাহাড় সদম্ভে অবস্থান করছে।
পাহাড়টার দিকে চোখ ফেরাতেই চোখ দুটো যেন জুড়িয়ে যায়। সে মনোলোভা দৃশ্য নজরে পড়ে তা হচ্ছে, পাহাড়টার পাদদেশ থেকে শুরু করে চূড়া অবধি যেন অত্যুজ্জ্বল হরেক রং আর হরেক ঢঙের ফুল দিয়ে দৃষ্টিনন্দন অলঙ্কারের মতো সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুধুই ফুল আর ফুল। মাঝে মধ্যে, একেবারেই হঠাৎই এক আধটা সবুজ পাতা চোখে পড়ে, কি পড়ে না।
ভালোভাবে লক্ষ্য করে বোঝা গেল, অববাহিকাটা খুবই গভীর। তবে গিরি নালাটার পানি এতই গভীর, এতই স্বচ্ছ যে, তার তলার সবকিছু পরিষ্কার, স্পষ্ট নজরে পড়ে।
আর তার পানির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আকাশটাকে দেখে মনে হয় বুঝি সেটাকে উলটে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে আর ফুলে ফুলে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া দ্বিতীয় একটা পর্বতমালা বুঝি তার গায়ে অবস্থান করছে।
আমাদের জাহাজটা গিরি-নালাটা ধরে অগ্রসর হতে হতে সুড়ঙ্গটার বিষণ্ণতা থেকে হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে এসে দিগন্তের গায়ে অস্তগামী সূর্যের পূর্ণ বৃত্তটাকে চোখের সামনে দেখে আমার পর্যটক বন্ধু মি. এলিসন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে যতখানি খুশিতে ডগমগ হলো তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি বিস্ময়াপন্ন হল।
তার অবাক হবার কারণও কম ছিল না। সে মোটামুটি নিঃসন্দেহই হয়ে পড়েছিল বিদায়ী সূর্য ইতিমধ্যে দিগন্তরেখা অতিক্রম করে নিচে নেমে গেছে। কিন্তু সেই সূর্যই এমন অন্তহীন দৃশ্যকে তার দুচোখের সামনে মেলে ধরেছে। এমন একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য হঠাৎ চাক্ষুষ করলে বিস্মিত হবার মতো কথাই বটে।
আমার বন্ধুবর এখানে পৌঁছেই জাহাজ থেকে নেমে পড়ল। এবার জাহাজটা ছেড়ে সে ছোট্ট একটা নৌকায় উঠে পড়ল। সেটা হাতির দাঁতের তৈরি ধবধবে সাদা একটা নৌকা। আর তার সারা গায়ে দক্ষ শিল্পীর দ্বারা কারুকার্যমণ্ডিত।
বাস্তবিকই নৌকা ছোট হলেও সুদৃশ্য তার গঠনপ্রকৃতি। তার সামনের আর পিছনের গলুই দুটো পানি থেকে এতই ওপরে ওঠানো যে, সেটাকে হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় উপসাগরের বুকে বুঝি একটা সফেন দুধের মতো ধবধবে সাদা রাজহাঁস সগর্বে ভেসে বেড়াচ্ছে।
হাতির দাঁতের নৌকাটার পলকে মোড়া মেঝের একধারে একটামাত্র হালকা দাঁড় আলতোভাবে পড়ে রয়েছে। সেটার ওপরে কোনো মাঝি বা অনুচরকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অতিথিকে আনন্দ ফুর্তিতে থাকতে বলে দেওয়া হয়েছে। নিয়তিই তার দেখভাল করবে।
বড় জাহাজটা ক্রমে দূরে সরে যেতে যেতে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়ালে। চলে গেল।
পাহাড়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে নতুন একটা নদী এগিয়ে গেছে। সেটা উপসাগরের বাঁ দিক থেকে বেরিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এভাবে একই ভাবে, একই দিকে অনবরত অগ্রসর হতে হতে বহু ছোট ছোট বাঁক, অতিক্রম করে হঠাৎ নৌকারোহীর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা ফটক, সুবিশাল একটা ফটক। সেটা যেন তার পথ আগলে অবস্থান করছে।
সেটাকে ফটক না বলে বার্নিশ করা একটা দরজাও বলা যেতে পারে। তবে সাধারণ দরজা অবশ্যই নয়, তার গায়ের অদ্ভুত সব নক্সার ওপর বিদায়ী সূর্যের শেষ রক্তিম আভা প্রতিফলিত হচ্ছে। আর তাতে করে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ বনভূমিটাই বুঝি আগুনের শিখায় অনবরত জ্বলছে তো জ্বলছেই।
আর তার চোখের সামনে যে দরজাটা অবস্থান করছে সেটা একটা উঁচু দেওয়ালের গায়ে বসানো।
উঁচু দেওয়ালটার গায়ে দরজাটাকে এমন অত্যাশ্চর্য কায়দায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, হঠাৎ করে দেখলে বলতেই হয়, দরজাটাকে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যেন সেটা নদীটাকে বুঝি সমকোণে সমদ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে।
তবে অবশ্য হাতির দাঁতের ছোট্ট নৌকাটা তরতর করে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই আরোহীর মনে হলো দেওয়ালটার বুঝি শেষ নেই–সীমাহীন। সেটা যেন আগের মতোই তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।
আর ঠিক আগের মতোই মূল জলধারাটা নদী থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
সামান্য এগিয়েই খুব প্রশস্ত একটা জলধারা আসল নদীটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ সৃষ্টি করে দরজাটার তলা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
হাতির দাঁতের ছোট্ট নৌকাটা এবার নদী থেকে পড়ল, তারপর খাল-বেয়ে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ সৃষ্টি করে দরজাটার তলা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নৌকাটা এগিয়ে দরজার কাছে গেলে দরজার ভারী পাল্লা দুটো আস্তে আস্তে সরে গিয়ে নৌকাটার যাবার মতো রাস্তা তৈরি করে দিল।
খোলা-দরজাটা দিয়ে এগিয়ে সবেগে দরজাটা দিয়ে গলে গেল। তারপর তীরবেগে এগিয়ে যেতে যেতে সেটা সুবিশাল একটা খোলা রঙ্গমঞ্চের ভেতরে হাজির হল।
রঙ্গমঞ্চটার চারদিক টকটকে লাল পাহাড় বেষ্টন করে রেখেছে। শুধু কি এই? পাহাড় আর লালপাহাড়ের চারদিক ঘিরে রয়েছে একটা নদী। তার জলরাশি ঝকঝক করছে। ছোট্ট নৌকাটা নদীতে পড়তে না পড়তেই আৰ্ণহিসের স্বর্গরাজ্য নৌকারোহীর চোখের সামনে ভেসে উঠল।
কোথা থেকে শ্রুতিমধুর সংগীতলহরীর তাল ভেসে আসতে লাগল, নৌকারোহী তা উকর্ণ হয়ে শুনেও তার উৎস সম্বন্ধে তিলমাত্র ধারণাও করতে পারল না। এবার অবর্ণনীয় মিষ্টি-মধুর সুগন্ধ বাতাস প্রবাহিত তার নাকে আসতে লাগল।
আর? আর প্রাচ্যদেশীয় বনাঞ্চলের এমন এক অদ্ভুত এক সমাবেশ নৌকারোহীর চোখের সামনে ফুটে উঠল যার সৌন্দর্যের বর্ণনা ভাষার মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব নয়। আর তার মাথার ওপর দিয়ে রক্তবর্ণ আর সোনালি পাখির দল পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে যাব, যার শোভা তার চোখ-মনকে তৃপ্ত করল। আর পদ্ম-ছাওয়া বিচিত্র হ্রদের শোভা তো আছেই।
নদী আর পাহাড়ের ধারে রয়েছে বিস্তীর্ণ এক প্রান্তর যা টিউলিপ, হায়াসিন্থ, ভায়োলেট, টিউবরোজ আর আফিমফুলে ছাওয়া। তারই ফাঁক দিয়ে এঁকে বেঁকে হেলে দুলে বয়ে চলেছে বেশ কয়েকটা রূপালি নদীর জলধারা। সবকিছুর মাঝখানে সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে অবস্থান করছে আধাগনিক আর আধা সারাসেনীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশৈলীর মনোলোভানিদর্শন। শত শত কারুকার্যমণ্ডিত বাতায়ান, সুউচ্চ গম্বুজ
আর আকাশচুম্বী মিনার সূর্যের রক্তিম আভায় ঝকমক করছে।
নৌকারোহী কৌতূহল-মিশ্রিত বিস্ময়ের ছাপ চোখে এঁকে সবকিছু দেখে ভাবতে লাগল, এ সবকিছুই রূপসি তম্বী নারী, স্বর্গের অপ্সরা, পরী, জিন আর পাতালে বসবাসকারী ভূত-প্রেতদের মিলিত প্রচেষ্টায় সৃষ্ট এক অলৌকিক কাণ্ড!