1 of 2

ডিডলিং

ডিডলিং

সেই আদিকালে অর্থাৎ সৃষ্টির গোড়াতেই দুটো ব্যাপার পণ্ডিতদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। তারা সচকিত হয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে উৎসাহি হয়েছেন। উৎসাহি বলা ঠিক হবে না, বরং বা উচিত ভাবনা চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন।

কি সে বিষয় দুটো–তাই না? একটা অবৈধ সুদ আদায়, আর দ্বিতীয়টা তঞ্চকতা।

তঞ্চকতা বলতে বোঝায়, কায়দা কৌশলের মাধ্যমে লোকের সঙ্গে প্রবঞ্চণা করা বা লোক ঠকানো।

আপনারা যে, যা-ই বলুন না কেন, তঞ্চকতা যে বিজ্ঞানেরই একটা শাখা, অর্থাৎ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত আর এ-বিজ্ঞানবিদ্যা নিয়ে শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করে পৃথিবীতে বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই।

প্রাচ্যদেশে হয়তো বা এ-তঞ্চকতা-বিদ্যাকেই চৌষট্টি কলার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিদ্যা আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

অভিধানের পাতা ঘাটাঘাটি করলে চোখে পড়বে, তঞ্চ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রবঞ্চণা, চাতুর্য, কৌশল প্রভৃতি। আর তঞ্চক কথার অর্থ প্রবঞ্চক, ফাঁকি, ধোঁকা আর সত্যগোপন।

আবার যদি কয়েকপাতা পিছিয়ে যাওয়া যায় তবে দেখা যাবে তঞ্চন শব্দটার অর্থ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির। এর অর্থ জমে যাওয়া বা জমাটবাঁধা।

এবার আপনিই বিচার করুন ধাপ্পাবাজি কতটা গাঢ় হলে, জমাট বাঁধলে একটা মানুষ প্রবঞ্চক বা তঞ্চকে পরিণত হয়ে প্রবঞ্চণার বা তঞ্চকতায় পারদর্শিতা দেখাতে পারে! অতএব এ-কথা তো বা যেতেই পারে। প্রবঞ্চণা বা তঞ্চকতায় সাধনায় সিদ্ধিলাভের মাধ্যমে প্রবঞ্চক বা তঞ্চক বৈজ্ঞানিক আখ্যা করা যে-সেকথা নয়! মোদ্দা কথা, নামকরা প্রবঞ্চক বা শ্রেষ্ঠ-প্রবঞ্চক হতে হলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তবেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা সম্ভব।

কিন্তু তঞ্চকতা অর্থ সম্বন্ধে ধারণা করা গেলেও যথাযথভাবে তার সংজ্ঞা লিখতে বসলে নাস্তানাবুদ হতে হয়, বসে বসে অসহায়ভাবে মাথা চুলকানো ছাড়া উপায় থাকে না।

তবে একটা কথা কিন্তু খুবই সত্য যে, প্রবঞ্চণা বা তঞ্চতা-র সংখ্যা লেখা মহাসমস্যা হলেও তঞ্চকের সংজ্ঞা লেখা কিন্তু সহজ ব্যাপার। আমি এটাই বুঝতে চাইছি–বিজ্ঞানের বিশেষ কোনো শাখার সংজ্ঞা লেখা অনেক কষ্টসাধ্য হলেও কিছু বলে বৈজ্ঞানিকটিকে বুঝানো অনেক, অনেক সহজ ব্যাপার।

বৈজ্ঞানিক প্লেটোর কথাই ধরা যাক না কেন। তিনি যদি এ-ধারণাটাকে মাথায় আনতে পারতেন তবে দ্বি-পথ প্রাণী হিসেবে মুরগিকে কেন মানুষের পর্যায়ে ফেলা যাবে না, মানুষ গণ্য করা যাবে না, এ-কথা বলতে দুঃসাহসী হতেন না।

আমার কিন্তু এসব বিতর্কে ঝুট-ঝামেলায় আদৌ ইচ্ছা নেই। আমি কেবলমাত্র এটুকুই বলতে চাচ্ছি, একমাত্র মানুষই তঞ্চক হতে পারে, অন্য কোন জন্তু জানোয়ারের পক্ষে সম্ভব নয়।

কেবলমাত্র পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত প্রাণীরাই তঞ্চকতার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছে। শেয়াল ধূর্ত–সে অন্যকে ঠকায়, কাক চুরি বিদ্যায় অভ্যস্ত, বেজি অন্যের মাথায় দিব্যি হাত বুলায় আর মানুষ করে তঞ্চকতা।

সত্যিকথা বলতে কি, তঞ্চকতাই মানুষের ভাগ্য। কবি তো বলেছেনই হা পিত্যেশ করবার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

আমি কিন্তু বলব, তঞ্চকতা করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। জীবনের লক্ষ্যই তো তঞ্চকতা–জীবনে শেষ।

তাই তো কেউ তঞ্চকতা করেছে শুনলেই আমারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠি ব্যস, সব খতম হয়ে গেল! অর্থাৎ সব শেষ!

এবার বলা যেতে পারে তঞ্চকতা আসলে একটা যৌগিক পদার্থ। বহু উপাদানের সমন্বয়ে এটি গঠিত। সামান্য ব্যাপারে অসামান্যতা, স্বার্থপরতা, মৌলিকতা, ধৃষ্টতা প্রদর্শন, আঠার মতো লেগে থাকা, বেপরোয়া হওয়া, উদ্ধত প্রকৃতি হওয়া, দাঁতাল হাসি মুখে অক্ষুণ্ণ রাখা, উদ্ভাবনী শক্তি ধারণা করা প্রভৃতিই হচ্ছে তঞ্চকতার উপাদান।

এবার তঞ্চকতার উপাদানগুলো সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা যাক।

গোড়াতেই সামান্য ব্যাপারে অসামান্যতা সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক-তঞ্চক সামান্য ব্যাপার থেকে অসামান্য কিছুর সন্ধান পেতে পারে। তার চোখের দৃষ্টি খুবই তীক্ষ্ণ। সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়কেও সে দেখতে পায়, উপলব্ধি করতে সক্ষম। তার কারবার ছোটখাট ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে। সে খুচরা ব্যাপারী। নগদ অর্থ বা মূল্যবান কোনো কাগজ চোখে পড়ামাত্র তার ছোঁকছোঁকানি শুরু হয়ে যায়। যে কোনো উপায়ে সেটাকে হাফিস করে না দেওয়া অবধি সে স্বস্তি পায় না। এই একই লোক যখন কোনো আড়ম্বর ও জৌলুসপূর্ণ ব্যাপারের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন সে নিজের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে, মহাজনে পরিণত হয়। এতেও কিন্তু তঞ্চকতা পুরোদস্তুর কাজ করে। আর ছোটখাটো আকারে নয় কিন্তু ব্যাপক ও বিশালরূপেই।

মহাজন আর তঞ্চকের মধ্যে পার্থক্য কিছু-না-কিছু তো আছেই। কিন্তু কতটুকু সে পার্থক্য? ম্যামথ হাতির সঙ্গে ইঁদুরের পার্থক্যের মতোই। আবার ধূমকেতুর ল্যাজের সঙ্গে শুয়োরের পার্থক্যের সমানও বলা চলতে পারে।

এবার স্বার্থতার কথা বলছি, শুনুন–তঞ্চক প্রধানত স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়। কোন ও কেমন স্বার্থ? অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে নিজের স্বার্থ। আর পকেট পূর্ণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। আর সে পকেট একান্তই নিজের। আর আপনারও বটে। প্রথম পকেটটা তার নিজের আর দ্বিতীয় পকেটটা অবশ্যই আপনার। তার সর্বদা লক্ষ্য থাকে প্রথম পকেটের দিকে।

এবার মৌলিকতার প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক-প্রত্যেক তঞ্চকই ভয়ানক রকমের মৌলিক চিন্তাধারার অধিকারী হয়। সে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জালের ফাঁদ বিছিয়ে দেয়। ষড়যন্ত্র কী বস্তু–কীভাবে চক্রান্তর জাল বুনতে হয় তা সে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা শক্তি দিয়ে পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে তৈরি করে নেয়। এ-বুদ্ধির জন্য অন্যের প্রত্যাশী তাকে হতে হয় না। আর তা যদি হয় তবে তা সব কাজ ভেস্তে যাবে। সে সর্বদা নিত্য-নতুন মতলব আঁটে। প্রয়োজনে নিষ্ফল মতলব বাতিল করে দিয়ে আবার নতুন মতলব ভাজার জন্য তৎপর হয়। নতুন মতলবকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে। গ্রীক দিঘীজয়ী বীর আলেকজান্ডার হওয়ার হিম্মৎ তার যদি নাও থাকে তবে সে গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিস তো হতে পারত। সে যদি তঞ্চকে পরিণত না হতো তবে ইঁদুর ধরা ফাঁদ নইলে বঁড়শি আর ছিপ হতে পারত। কিন্তু তঞ্চকতার মৌলিক চিন্তাধারা যে তার মধ্যে গিজ গিজ করছে। তঞ্চকতার প্রতি প্রবণতা তার মধ্যে জাগতে বাধ্য।

আঠার মতো লেগে থাকার ব্যাপারটা এবার বলছি শুনুন ইচ্ছাশক্তি আর আগ্রহ প্রবল না থাকলে তঞ্চকতায় সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। যার সঙ্গে সে তঞ্চকতা করতে আগ্রহি তার পিছনে প্রবল ইচ্ছাশক্তি সম্বল করে দিনের পর দিন লেগে থাকার মানসিকতা ও ধৈর্য তাকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা যোগাবে। আর তারই ফলে সেনিজেকে কর্তব্য সম্পাদনে লিপ্ত রাখবে।

এবার ধৃষ্টতা প্রদর্শন সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ আভাস দিচ্ছি, শুনুন–অসীম ধৃষ্টতা ছাড়া তঞ্চকতায় পরিপূর্ণ সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। সে ভয়ঙ্কর রকমের দুঃসাহসী না হলে সাফল্য লাভ তো দূরের ব্যাপার তঞ্চকতা করার ব্যাপারে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারবে না। তাকে এমনই বুকের পাটা রাখতে হবে যাতে আফ্রিকার গভীর বনেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। যুদ্ধ জয়লাভ করতে হলে তাকে একটা বীজমন্ত্রই জপ করতে হবে–আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহস যাতে তার মধ্যে সর্বদা বিরাজ করে।

তরবারি দেবার আঁচড় লাগার ভয়-ডরের লেশমাত্রও তার মধ্যে থাকবে না। আর তা যদি থাকে তবে গোড়াতেই তাকে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। আর এ-কাজে দুঃসাহসের তুলনায় বিচক্ষণতার প্রয়োজনও কম নয়। সাহস আর বিচক্ষণতাই তঞ্চককে সাফল্য দান করে গলায় জয়মাল্য পরিয়ে দিতে সক্ষম।

ইংরেজ ঘোড়সওয়ার ডাকাত ডিক টারপিনের কথা আশা করি অবশ্যই জানা আছে? সে যদি আর একটু বেশিমাত্রায় বিচক্ষণ হতো তবে পয়লা নম্বরের তঞ্চক সে হতে পারত এতে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই।

আর আইরিশ জাতীয় নেতা দা নিয়েল ওকোনেল? তোষামুদে বলে তার যথেষ্ট অখ্যাতি রয়েছে। চাটুকার-শক্তিতে তার মতো পারদর্শী সচরাচর দ্বিতীয় আর একজন চোখে পড়ে না। কিন্তু তিনি যদি তোষামোদ করার সময় জায়গামতো লাগাম টেনেনিজেকে সংযত রাখতে পারতেন, অর্থাৎ একটু কম তোষামুদে হতেন তবে তঞ্চকতায় অভাবনীয় সাফল্য লাভ করতে পারত।

এবার সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লসের কথা বলছি–তার মগজটায় আয়তন আর ওজন যদি আর একটু বেশি হতো তবে তঞ্চকদের তালিকার শীর্ষে নিজের নামটাকে রাখতে পারতেন। অতএব এ-কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, পয়লা নম্বরের তঞ্চক হতে হলে তার মধ্যে ধৃষ্টতামূলক গুণ যথেষ্টই থাকা চাই।

ধৃষ্টতার মতোই তঞ্চকের আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বেপরোয়া মনোভাব। রীতিমত বেপরোয়া অর্থাৎ কাউকে তোয়াক্কা না করা কৃতী তঞ্চকের একটা বড় গুণ। সে কারো ধার ধারবে না। কোনো পরিস্থিতিতেই তাকে স্নায়ুবিক বল হারালে চলবে না। তাকে মনে করতে হবে স্নায়ু নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব তার মধ্যে কোনোদিন ছিল না, আজও নেই। তঞ্চকতা করতে নেমে পিছপাও হওয়ার পাত্র সে নয়। উত্তম মধ্যম না দিয়ে তাকে ঘায়েল না করা অবধি সে তার কর্তব্যকর্ম থেকে এক তিলও সরতে নারাজ। কার্যসিদ্ধি করতে হলে তাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে একের পর এক ধাপ অগ্রসর হতে হবে। তাকে মাথা এমন ঠাণ্ডা রাখতে হবে যেন শশারও হার মেনে যায়। যত বড় সমস্যার সম্মুখীনই হতে হোক না কেন তঞ্চককে কোনোকিছু গায়ে না মেখে ঠাণ্ডা মাথায় সাফল্যের দিকে ধীর-স্থিরভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

তঞ্চকতায় সাফল্যের আর এক চাবিকাঠি হচ্ছে, তাকে উদ্ধত প্রকৃতির হতে হবে। ঔদ্ধত্য ছাড়া সে এক পা-ও অগ্রসর হতে পারবে না। কথায় কথায় তাকে বুক ফুলিয়ে বড়াই করতে জানতে হবে। এতে সামান্য শৈথিল্য দেখা দিলেই তার দুর্বলতা প্রকাশ পাবে এবং সাফল্যের পরিবর্তে ব্যর্থতার গ্লানি গায়ে মেখে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো গতিই থাকবে না। হাতের পেশীর ওপরেই তাকে নির্ভর করতে হবে খুব বেশি করে। যার সঙ্গে তঞ্চকতায় প্রবৃত্ত হবে তার সামনে বার বার হাতের পেশী ফুলিয়ে তার মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে হবে। প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখে মস্তানির ভাব সর্বদা প্রকট করে রাখতে হয়। সে নিজের খাদ্যবস্তু মুহূর্তের মধ্যে গোগ্রাসে গিলে ফেলবে, ঢকঢক করে মদের বোতল খালি করে দেবে, লম্বা লম্বা টানে মুহূর্তে সিগারেট খতম করে দিয়ে ঔদ্ধত্যকে প্রকট করে তুলতে তার জুড়ি নেই। এমন ভাব দেখাত তঞ্চককে ওস্তাদ হতে হবে। আর গুণের বল সম্বল করেই তঞ্চক শিরোমণি আপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা টাকা ধারের নামে ছি নিয়ে নেয়। আপনার নাক-কান নির্ভয় ও নিঃসঙ্কোচে মলে দেয়। আপনার পোষা ছোট্ট কুকুরটাকে জুতোর ডগা দিয়ে টুক করে লাথি হাঁকায় আর মওকা বুঝে আপনার বউকে সবেগে চুম্বন করে সোহাগ দেখায়। উদ্ধত আচরণ ছাড়া কে কোন কালে পয়লা নম্বরের তঞ্চক হতে পেরেছে, বলতে পারেন? সবশেষে বলছি তঞ্চকতায় সাফল্য লাভ করাকে হলে মুখে সর্বদা সেঁতো হাসি বজায় রাখতে হয়। যেমন বুকে সুতীক্ষ ছুরির ফলা পুষে রাখতে হয় ঠিক তেমনি মুখে প্রতিনিয়ত সেঁতো হাসি ফুটিয়ে রেখে বাঞ্ছিত ব্যক্তির মন জয়ের চেষ্টায় লেগে থাকতে হয়। তবে হাসির প্রয়োজন কখন সবচেয়ে বেশি হয়? কাজ হাসিল করার পর। কর্ম যাতে করে দিয়ে ফিক ফিক করে সেঁতো হাসি হেসে আত্মতুষ্টি লাভ করতে হয়। তবে একটা কথা, এটা এমনই এক বিশেষ ধরনের হাসি যার বেশি ঘটে না, অন্যের চোখে ধরা পড়ে না বললেই চলে।

কাজ সাঙ্গ করে তঞ্চক পরমানন্দে নিজের আশ্রয়স্থল খোপটায় ঢুকে আপন মনে দাঁত বের করে হেসে আত্মতুষ্টি লাভ করে। কেউ দেখবে না, কেউ মানবে না, বুঝবেও না কেউ, অথচ সে নিঃশব্দে হা-হা করে হাসতে আরম্ভ করে।

আর? কাজ হাসিল করে বাড়ি ফিরে পোশাক পাল্টে সে টুক করে মোমবাতিটা জ্বেলে দেয়। বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে মাথার তলায় বালিসটাকে দিয়ে নেয়। তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এবার হ্যাঁ, এবারই অঞ্চলের দেতো হাসি শুরু হয়ে যায়। সে এমন করে দাঁত বের করে হাসে না। তাকে কিছুতেই পয়লা নম্বরের তঞ্চক বলা যাবে না। নিঃশব্দে অট্টহাসিতে তাকে মাততেই হয়।

আরও আছে, তঞ্চককে পুরনো বস্তাপচা তঞ্চকতা-পদ্ধতি আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে না। তার উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হতেই হয়। অন্যের কায়দা-কৌশল নকল করে কাজ করতে গেলে তার প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। সে যে পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করবে তা একেবারেই নতুন হওয়া চাই-ই চাই।

কৃতী তঞ্চকের চিন্তা-ভাবনা হয়ে পুরোপুরি নতুন, নিতান্তই নিজস্ব–কারো অনুকরণ করা অবশ্যই নয়। অনুকরণপ্রিয়তা দোষ যার মধ্যে থাকে তার পক্ষে নতুনতর কোনোকিছু করার ঝোঁক থাকতে পারে না। সেনিজেই কাজের পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনাকে কিভাবে বাস্তবায়িত করবে তা তাকেই মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হয়। পয়লা নম্বরের তঞ্চক সে হবে সে তঞ্চকতার পরিকল্পনা চুরি করা, নকল করে কাজ হাসিলের চেষ্টা করাকে সে মনে-প্রাণে ঘৃণা করবে। অন্যের পদ্ধতি প্রয়োগ করে সে যদি কোনোক্রমে কারো টাকার থলি গায়েব করে ফেলে, পরমুহূর্তেই তার মাথায় যদি আসে যে, পদ্ধতিটা মৌলিক নয়, অজান্তে হলেও অন্যের মস্তিষ্ক প্রসূত পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফেলেছে তবে সে তৎক্ষণাৎ টুটে গিয়ে যেন-তেন প্রকারে মালিককে চুরি-করা টাকার থলেটা ফিরিয়ে দিতে আসতেও সে কুণ্ঠিত হয় না। অতএব উদ্ভাবনীয় শক্তি প্রথম শ্রেণির তঞ্চকের একটা বড় হাতিয়ার স্বীকার না করে উপায় নেই।

তঞ্চকতা করার প্রচলন মানুষ জাতটার মধ্যে আদিম কাল থেকেই রয়েছে। তারপর থেকে একনাগাড়ে চলেই আসছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, পৃথিবীর প্রথম তঞ্চক কে ছিল? এর উত্তর দিতে গিয়ে বলা যায় হয়তো বা পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদম নিজেই প্রথম তঞ্চক ছিল। প্রাচীনকালে এ-বিজ্ঞানেরনিদর্শন বস্তাবস্তা পাওয়া যায়। তবে বর্তমানকালে এ বিজ্ঞানকে ঘষে মেজে রীতিমত উন্নতমানের করা হয়েছে। আদিকালের বিজ্ঞানের সঙ্গে সাম্প্রতিককালের বিজ্ঞানের যে আকাশ-পাতাল ফারাক, এ-কথা না বললেও চলে। কয়েকটা অতি সাম্প্রতিককালের উদাহরণ তুলে ধরছি–

ঠিক সে মুহূর্তেই সাধু ব্যক্তি মুশকিল আসান করে দিলেন। সমস্যার সমাধান করে দিতে গিয়ে বললেন–ধরুন, আমার কাছে পঞ্চাশ টাকার নোট আছে।

নোট বইটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে, পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিজের পকেটে চালান করতে করতে লম্বা-লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে যাত্রী এক লাফে মোটর বোটে উঠে গেল।

ব্যস, সে বোটে পা দেওয়া মাত্র ভটভট আওয়াজ করতে করতে জলযানটা বন্দর ছেড়ে তরতর করে এগিয়ে চলতে লাগল।

বোটটা বন্দর ছাড়তে সাধু ব্যক্তি নোটবইয়ে নোটের তোড়া দেখলেন। হ্যাঁ, সবই একশো টাকার নোট, সত্য। কিন্তু সব কটাই জাল নোট!

দুঃসাহসের তঞ্চতা নমুনা তো এরকমই হয়ে থাকে–এমন এক স্থানে জাতীয় সমাবেশ বা সভা হতে চলেছে যেখানে যেতে গেলে একটা সাঁকো না পেরিয়ে উপায় নেই। ফলে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা দলে দলে কাতারে কাতারে সাঁকোটার ওপর দিয়ে সভাস্থলে যেতে লাগলাম।

এক তঞ্চক সমাবেশের খবর পেয়েই আগেভাগে সাঁকোটার গায়ে আস্তানা গড়ল না। এমন একটা মওকা তো আর হাতছাড়া করা যায় না।

তঞ্চক পরিকল্পনামাফিক প্রত্যেকের কাছ থেকে সাঁকো ভাড়া বাবদ একটা করে টাকা আদায় করতে লাগল। মানুষই হোক আর গরু-ছাগল-ঘোড়া গাধাই হোক সঁকো পেরোতে গেলেই একটা করে টাকা দক্ষিণা দিলে তবেই ওপারে যেতে পারবে।

অনেকে ব্যাপারটা নিয়ে একটু-আধটু ওজর আপত্তি যে করেনি তা নয়। কিন্তু একে ভিড় ঠেলে যাওয়া, তার ওপর সমাবেশে যোগদানে বিলম্ব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পকেট থেকে একটা করে টাকা বের করে তঞ্চকের হাতে গুঁজে দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে সাঁকোটা পেরিয়ে যেতে লাগল।

ব্যাপারটা মিটে গেলে তঞ্চক পকেট ঝেড়ে ঝুড়ে হিসেব করে দেখল, অল্পক্ষণের মধ্যেই সে পঞ্চাশ-ষাট টাকা কমিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ ধনী বনে যাওয়া তঞ্চক বাবাজী সেঁতো হাসি হেসে আত্মতৃপ্তি লাভ করার জন্য বাড়ির পথ ধরল। দুঃসাহস না থাকলে এত অল্পসময়ে ও অল্পায়াসে এতগুলো টাকা কামানো কি তার সম্ভব হত?

এবার শুনুন একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক তঞ্চকতার কথা–এক তঞ্চক ছাপা হুণ্ডির কাগজে স্বাক্ষর করে তার বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করল। সেহেতু হুণ্ডির কাগজটায় সরকারি ছাপ রয়েছে অতএব টাকা ধার দিতে দ্বিধা থাকার কথাও নয়।

তঞ্চক মহাপ্রভু একই ছাপা হুণ্ডির কাগজ কয়েকটা খরিদ করে বাড়ি ফিরে এলো। প্রতিদিন একটা করে কাগজে মাংসের ঝোল মেখে নেয়। তার পর সেটাকে নিজেরই পোষা কুকুরের দিকে বাড়িয়ে ধরে। মাংসের গন্ধ পেয়ে কুকুরটা অত্যুৎসাহী হয়ে সেটর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জিভ দিয়ে চেটে চেটে পরম তৃপ্তিতে মাংসের ঝোলটুকুর সদগতি করে। তারপর মনিব তাকে ভেজা কাগজটা উপহার দিয়ে দেয়। সেটাকে নিয়ে দৌড়ে দূরে চলে যায়। তারপর সেটাকে নিয়ে খেলায় মেতে যায়।

রোজই কুকুরটা একটা করে কাগজের গা থেকে মাংসের ঝোল জিভ দিয়ে চেটে পুটে খেয়ে তৃপ্তি লাভ করে এবং শেষে পুরো কাগজটাই উপহার পায়। এমন ব্যবস্থা চচা রোজই চলতে লাগল।

কিছুদিন এভাবে চলার পর একদিন তঞ্চক মহাপ্রভু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুরটাকে সঙ্গে করে সে বন্ধুর বাড়িতে টাকা শোধ করার জন্য উপস্থিত হলো।

শেঁকল-খোলা পোষা কুকুরটাকে পাশে বসিয়ে তঞ্চক বন্ধুকে বলল তোমার প্রাপ্য। মিটিয়ে দিতে এসেছি। সই-করা হুণ্ডিটা নিয়ে এসো।

তার বন্ধু ঘরে গিয়ে হুণ্ডির কাগজটা হাতে করে বাইরে বেরিয়ে এলো।

হুণ্ডির কাগজটা তঞ্চক-বন্ধুর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া মাত্র কুকুরটা সেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যস, তার হাত থেকে সেটাকে ছোঁ মেরে নিয়েই দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করল। চোখের পলকে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কোন হদিসই পাওয়া গেল না।

বিষণ্ণ মুখে কুকুরটার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে প্রাপক বন্ধু বলল–আমার টাকাগুলো দাও।

টাকা? টাকা অবশ্যই দেব। কিন্তু আমার স্বাক্ষর করা হুণ্ডিটা ফেরৎ দিলেই তোমার প্রাপ্য মিটিয়ে দেব।

হুম! প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করে প্রাপক বন্ধু চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে তঞ্চক বলল–আমার স্বাক্ষর করা হুণ্ডিটা ফিরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রাপ্য মিটিয়ে দেব।

আশা করি আর না বললেও চলবে–বেচারার অসহায়ভাবে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না। হুণ্ডিটাও ফিরে এলো না, বন্ধুকে তার পাওনাগণ্ডা মেটাতেও হলো না।

এবার মাজা-ঘষা এক তঞ্চকতার উদাহরণ তুলে ধরছি–একবার প্রকাশ্য দিবালোকে ভরা-রাস্তায় তঞ্চকেরই এক অংশীদার এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলাকে অপমান করে বসল। যা মুখে এলো তা-ই বলে গালমন্দ করল। তারপর মন থেকে ভয় দূর করার জন্য সে মহিলাটিকে সঙ্গে করে তার বাড়ি পৌঁছে দিতে গেল।

তাকে সদর দরজায় পৌঁছে দিয়ে সে বিদায় নিতে গেল।

মহিলাটি ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললেন–আপনি যে কষ্ট করে আমাকে পৌঁছে দেবার জন্য এতটা পথ এলেন, তার জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়।

তঞ্চক লোকটা ফিরে যাবার জন্য পিছন ফিরতেই মহিলাটি বি বিনয়ে বললেন–ভাই, আপনি যখন কষ্ট করে আমার জন্য এতই করলেন, দয়া করে ভেতরে আসুন।

তঞ্চক দরজায় দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগল।

মহিলাটি আগের মতোই কাকতি-মিনতি জানাতে গিয়ে বললেন–দয়া করে একবারটি ভেতরে আসুন। বাড়িতে আমার বাবা আর ভাইরা রয়েছেন, আলাপ করে যাবেন না?

তঞ্চক এবার কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–কিন্তু মহাশয়া, আমার পক্ষে যে দেরি করা সম্ভব নয়–দুঃখিত।

মহিলাটি অধিকতর মোলায়েম স্বরে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন–কিন্তু–কিন্তু আপনি এতটা করলেন

দেখুন, আপনি যদি আমার কাছে সত্যি কৃতজ্ঞ–

এ কী বলছেন ভাই! কৃতজ্ঞতার কথা মুখে না বললেও–

ভালো কথা, তঞ্চকতার নিদর্শনস্বরূপ আপনি আমার একটা উপকার করতে পারেন।

উপকার?

হ্যা! দশটা টাকা ধারস্বরূপ দিতে পারেন?

এ তো সামান্য ব্যাপার মশায়! দশটা তো মাত্র টাকা; এর জন্য এমন অনুনয় বিনয়–কথা বলতে বলতে মহিলাটি তার বান্ডিলটা খুলে একটা নোট বের করে তার হাতে গুঁজে দিলেন।

তঞ্চক হাত বাড়িয়ে প্রায় ছোঁ মেরে নোটটা নিয়ে নিল। এ-তঞ্চতার ক্ষেত্রে একটা মাত্র ফাঁক থেকে গেছে, খুঁতও বলা চলে। নোটটার অর্ধেক, অর্থাৎ পাঁচ টাকা বিনা প্রতিবাদে তার অংশীদারের হাতে তুলে দিতে হয়। অংশীদার বলতে যে লোকটাকে মুখ বুজে বেধড়ক পিটুনি খেতে হয়েছে।

এবার খুবই ছোট্ট হলেও অভাবনীয় বৈজ্ঞানিক তঞ্চকতার একটা নমুনা পেশ করছি–দশাসই চেহারাধারী এক ব্যক্তি এক রেস্তোরাঁয় হাজির হলেন পানাহার করতে। গায়ে বহুমূল্য জমাকালো পোশাক।

টেবিলে বসেই ভদ্রলোক দামি চুরুট অর্ডার দিলেন। এক পরিবেশক সঙ্গে সঙ্গে তার বাঞ্ছিত চুরুট টেবিলে পৌঁছে দিল। ভদ্রলোক চুরুটটাকে হাতে তুলে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর চোখে-মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ এঁকে সেটাকে পরিবেশককে ফেরৎ দিলেন।

পরিবেশক পরবর্তী অর্ডারের জন্য টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।

খদ্দের ভদ্রলোক এবার বললেন–ঠাণ্ডা পানি আর ব্র্যান্ডি নিয়ে এসো।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশক তাঁর বাঞ্ছিত বস্তু দুটো নিয়ে আবার টেবিলে ফিরে এলো। খদ্দের ভদ্রলোক পরম তৃপ্তিতে বস্তু দুটোই নিঃশেষে উদরস্থ করলেন।

হাত থেকে ব্র্যান্ডির খালি গ্লাসটা নামিয়ে রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

চেয়ারটাকে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে তিনি রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ালে পরিবেশক বলল–স্যার, আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি?

হ্যাঁ। আর মিছে এখানে বসে সময় নষ্ট করতে যাব কেন?

ঠাণ্ডা পানি আর ব্যান্ডির দামটা মেটাতে হয়তো আপনি ভুলে গেছেন।

ভ্রু কুঁচকে খদ্দের ভদ্রলোক বলে উঠলেন–ভুলে গেছি? ভুলে গেছি মানে?

আমতা আমতা করে পরিবেশক এবার বলল–স্যার, ওই যে ঠাণ্ডা পানি আর ব্রান্ডি পান করলেন।

ব্যস, আর যাবে কোথায়! খদ্দের ভদ্রলোক বাজখাই গলায় বলে উঠলেন–সে কী হে! ঠাণ্ডা পানি আর ব্রান্ডির দাম-স্বরূপ তোমাকে তো আগেই চুরুট দিয়ে রেখেছি–দিইনি বলতে চাও?

পরিশেক তো একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। সে এর কী জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে অথর্বের মতো নীরবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

খদ্দের ভদ্রলোক ধরতে গেলে তার ওপর মারমুখি হয়ে আগের মতো তড়পাতে লাগল–চালাকি করার জায়গা পাওনি! টেবিলের ওপর পড়ে থাকা চুরুটটার দিকে আঙুলনির্দেশ করে তিনি এবার বললেন–তোমার সামনেই তো চুরুটটা পড়ে রয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না?

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু চুরুটের দাম তো আপনি শোধ করেননি।

যা আমি মুখেও তুলিনি তার জন্য দাম দিতে যাব? এমন আহাম্মক আমাকে পেয়েছ! বাজে ধান্ধা ছাড়, আমাকে যেতে দাও।

কিন্তু, কিন্তু–

এর মধ্যে কোনো কিন্তু টিন্তু নেই।

খদ্দের ভদ্রলোক রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে দুম করে দরজাটা বন্ধ করে দেবার পূর্ব মুহূর্তে উপস্থিত অন্যসব খদ্দেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন–শোন হে, মদের নেশা ধরিয়ে দিয়ে খদ্দেরের সঙ্গে ঠকবাজি করার ধান্দা ছাড় বাছাধন! কথাটা বলেই সে লম্বা-লম্বা পায়ে রেস্তোরাঁ ছেড়ে পথে নেমে গেল। আর এদিকে পরিবেশক বেচারা নিতান্ত অপরাধীর মতো তাঁর ফেলে যাওয়া পথের দিকে নীরবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

খুবই সাধারণ প্রকৃতির তঞ্চকতার একটা উদাহরণ এবার বলছি শুনুন–এক ভদ্রলোকের টাকার ব্যাগ খোয়া গেছে। খোয়া গেছে ঠিক বলা যাচ্ছে না, হারিয়ে ফেলতেও পারেন।

তিনি টাকার ব্যাগটা ফিরে পাবার আশায় খবরের কাগজে জিজ্ঞাপন দিলেন যে টাকার ব্যাগটা ফিরিয়ে দেবেন তাকে নগদ এত হাজার টাকা পুরস্কারস্বরূপ দেওয়া হবে।

খবরের কাগজের পাতার বিজ্ঞাপনটা এক তঞ্চকের চোখে পড়ল। তৎক্ষণাৎ সেটাকে নিজের পকেট বইয়ে টুকে নিল।

আসল বিজ্ঞাপনে কথার ফুলঝুরি ছিল, কিন্তু নকল কপিতে তা টোকা হলো না, বাদ দিয়ে জরুরি কথাগুলোই সে কেবলমাত্র টুকে নিল। এমনকি ঠিকানাটাও একটু আধটু রদবদল হয়ে গেল। প্রকৃত মালিকের পল্লিরই প্রতিবেশী অমুকের ঠিকানায় হারানো টাকার থলেটা ফেরৎ দিলেই প্রাপ্য পুরস্কার মিলে যাবে।

বড় বড় শহরে সারাদিনে বহুবার খবরের কাগজ বের হয়, অর্থাৎ ঘণ্টাখানেক পরপর। তঞ্চক মহাপ্রভু তার নকল বিজ্ঞাপনটা বের করেছিল আসল বিজ্ঞাপনটা সে খবরের কাগজে, যে সময়ে বেরিয়েছে তার কিছু সময় পর যে খবরের কাগজে বেরোবে তার পাতায়।

যথাসময়ে নকল বিজ্ঞাপনটা বুকে নিয়ে নির্দিষ্ট খবরের কাগজটা বেরল। এদিকে তঞ্চক বাবাজী নকল ঠিকানার সদর দরজার কাছাকাছি একটা গোপন জায়গায় শিকারি বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল, শিকার ধরার প্রত্যাশা নিয়ে।

একটু পরেই একজনকে ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে নির্দিষ্ট বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেই তঞ্চক ব্যস্ত-পায়ে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল।

প্রাপকের হাত থেকে টাকার ব্যাগটা নিয়ে তঞ্চক প্রথম বিজ্ঞাপনে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মিলিয়ে নিল। সে সন্তুষ্ট হয়ে টাকার ব্যাগটা নিয়ে তার হাতে পুরস্কার গুঁজে দিল।

ব্যস, টাকার ব্যাগটা পাওয়ামাত্র তঞ্চক আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে চোখের পলকে সেখান থেকে চম্পট দিল।

এদিকে বহু বিজ্ঞাপন যখন একই দিনে বহু কাগজে ছাপা হয়ে বের হয়, তখন প্রাপক বড় বিজ্ঞাপনের কথার ফুলঝুরি কথা ভুলে যায়। ঘুলিয়ে ফেলে। ছোট বিজ্ঞাপনের ঠিকানা অনুযায়ী চলে যায় বলেই তঞ্চককের ভাগ্য খুলে যায়। ফলে সহজেই তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়।

ঠিক একই রকম আর একটা তঞ্চকতার নমুনা তুলে ধরছি–এক ভদ্রমহিলা বহুমুল্য হীরার আংটি হারিয়েছেন। আংটিটা যেমন দেখতে চমৎকার দামও তেমনি আকাশ ছোঁয়া।

বহু খোঁজাখুঁজি করে হতাশ হয়ে ভদ্রমহিলা শেষপর্যন্ত খবরের কাগজের শরণাপন্ন হলেন। কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনে আংটিটার যথাযথ বিবরণ দেওয়া হলো।

যথাসময়ে আংটিটার বিবরণ এবং পুরস্কারের কথাসহ খবরের কাগজ বেরল। ভদ্রমহিলা বিজ্ঞাপনে এও উল্লেখ করলেন, হিরার আংটির প্রাপককে কোনোরকম জেরা না করেই পুরস্কারস্বরূপ মোটা টাকা দেওয়া হবে। আর সে সঙ্গে আংটির মালিক ভদ্রমহিলার পুরো ঠিকানা তো দিলেনই।

বিজ্ঞাপনটা প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরে বিজ্ঞাপনের বর্ণনা অনুযায়ী ভদ্রমহিলার বাড়িতে একজন হাজির হলো। লোকটা এমনই সময়ে আংটিটা নিয়ে এলো যখন আংটির মালিক ভদ্রমহিলা বাড়িতে নেই। জরুরি দরকারে কোথায় যেন গেছেন। বাড়ির পরিচারক দরজা খুলে আগন্তুকের প্রয়োজনের কথা জানতে চাইল।

আগন্তুক খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের কথা পাড়ল। পরািরক আংটিটা দেখতে চাইল।

আগন্তুক কোটের পকেট থেকে আংটিটা বের করে পরিচারকের সামনে ধরল।

সেটাকে দেখামাত্রই পরিচারক চিনতে বলল। খবরটা প্রকাশ হতেই ভদ্রমহিলার ভাই এবং অন্য কয়েকজন ছুটে এলেন। সবাই আংটিটা চিনতে পেরে একবাক্যে বলল–হ্যাঁ, এটাই হারিয়ে যাওয়া আংটি।

কিন্তু আংটির মালিক ভদ্রমহিলা বাড়িতে নেই শুনেই আগন্তুকের মুখ শুকিয়ে গেল। মনে মনে বিরক্তও হলো খুবই। পরিশ্রম ও সময় নষ্ট করে এতটা পথ আসার পর বাঞ্ছিত ব্যক্তি বাড়ি নেই শুনলে যে কোনো লোকই বিরক্ত হবার কথা। সে বিষণ্ণ মনে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিল।

এমন সময় বাড়ির সবাই তাকে অনুরোধ করে বসতে বলল। তারপর পুরস্কারের টাকা মিটিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে আংটিটা নিল।

প্রাপ্য পুরস্কার বুঝে পেয়ে আগন্তুক খুশি মনে সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। একটু পরেই আংটির মালিক ভদ্রমহিলা বাড়ি ফিরলেন।

ব্যস, আর যাবে কোথায়, আংটিটা দেখেই ভদ্রমহিলার তো মাথায় রক্ত ওঠার যোগাড়। কেবল তারই নয় বাড়িসুদ্ধ লোকের বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। আরে ব্যস, এ যে রীতিমত দিনে ডাকাতি! লোকটা এতগুলো লোককে মুহূর্তের মধ্যে ঘোল খাইয়ে দিয়ে চলে গেল!

অনুশোচনা হবার মতো কথাই তো বটে। কারণ, আংটিটা যে নকল। একটা নকল আংটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে লোকটা এতগুলো টাকা নিয়ে চলে গেল। এ কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার।

এবার খবরের কাগজটা এনে বিজ্ঞাপনটা বের করা হলো। হ্যাঁ, আংটিটা অবিকল বিজ্ঞাপনের বিবরণ অনুযায়ী তৈরি বটে। কোথাও এতটুকু অমিল নেই। অতএব খুঁত ধরার সাধ্য কার? একমাত্র মালিক, যার হাতে সর্বক্ষণ সেটা থাকে, চোখে দেখে সে ছাড়া কারো পক্ষে তফাতটুকু ধরতে পারা তো সম্ভবও নয়। তাই তো তক্কে তক্কে থেকে, মালিকের অনুপস্থিতিতেই তঞ্চক মহাপ্রভু বাড়িতে হাজির হয়েছিল।

তঞ্চকতার শেষ? না, শেষ নেই। তঞ্চকতার কথা বলতে বসলেও শেষ করা যাবে না। একের পর এক ঘটনা স্মৃতির পটে ভেসে উঠবে। পাতার পর পাতা ভরবে। রাত কেটে যাবে, তবুও মনে হবে কাহিনী কতই না বাকি রয়ে গেছে। রাত ভর বললেও বুঝি তঞ্চকতার অর্ধেকও বলা হয়ে ওঠেনি।

যাক গে, শেষ যখন করাই যাবে না তবে এ-মুহূর্তে একটা পথই বেছে নেওয়া যেতে পারে সভ্যতার মোড়কে মোড়া একটা খুবই সুসভ্য সুপরিকল্পিত তঞ্চতার কাহিনী দিয়ে এ-নিবন্ধের যবনিকাপাত টানছি।

আর কেবলমাত্র সম্প্রতিকালেই না। এর পরবর্তীকালেও একের পর এক তঞ্চতার ঘটনা পৃথিবীর বুকে, পৃথিবীর প্রতিটা আনাচে কানাচে প্রতিদিন ঘটে চলেছে। আর পৃথিবীর বড় বড় শহরের বুকে তো তঞ্চকদের কারবার খুবই রমরমা। তবু আজ অবধি আমরা কেউ এ-ব্যাপারটা নিয়ে তেমন করে মাথা ঘামাইনি।

এবার আমেরিকার এক বড় শহরের ছোট্ট একটা তঞ্চকতার কাহিনী পাঠক পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরছি।

একবার সে শহরে এলেন এক ভদ্রলোক। মানে সবাই তাকে বিশিষ্ট ভদ্রলোক বলেই জানে। তার চেহারা ছবি যেমন দেখাক, আবার পোশাক আশাকও খুবই রুচিসম্মত ব্যবহার করেন। যাকে বলে সর্বদা একজন ভদ্ৰশিষ্ট ব্যক্তির মতো সেজেগুজে থাকেন। কথাবার্তাও রীতিমত রুচিশীল ব্যক্তির মতো। আচার আচরণ আর কথা বলার ধরন-ধারণ মহাশয় ব্যক্তির মতোই লক্ষণীয়। এক কথায় এমন মার্জিত স্বভাবের মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। প্রথম আলাপের মুহূর্তেই তিনি সবার মন ও নজর কেড়ে নেবার ক্ষমতা রাখেন।

ভদ্রলোক শহরে এসেই সোজা সম্ভ্রান্ত পল্লিতে চলে গেলেন। সেখানে খুঁজেপেতে সুদৃশ্য একটা বাড়ি ভাড়া করে ফেললেন।

আগন্তুক ভদ্রলোক বাড়িউলির সঙ্গে কথা বলে ভাড়া ঠিক করে ফেললেন। আর তাকে এ কথাও পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন, প্রতি মাসের প্রথম দিনই সকাল দশটার মধ্যেই যেন এসে ভাড়া বুঝে নিয়ে রসিদ দিয়ে যায়। এমন একজন উদারচেতা নিষ্ঠাবান ভাড়াটে পেলে এমন কোন বাড়িউলি আছে যে খুশিতে ডগমগ হবে না?

ব্যস, আর কোনো সমস্যাই রইল না। বাড়িউলি এক মাসের অগ্রিম ভাড়া বুঝে পেয়ে, ভাড়াটের হাতে খুশিমনে বাড়ির চাবি তুলে দিলেন।

বাড়িউলি প্রথম মাস শেষ হতেই ভাড়াটে ভদ্রলোকের কথার দাম যে যথেষ্টই আছে তার প্রমাণ পেয়ে গেলেন। কারণ মাসের পয়লা তারিখে বেলা দশটার মধ্যেই ভাড়ার টাকা হাতে পেয়ে গেল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভাড়াটের প্রতি তার আস্থা আরও অনেকাংশে বেড়ে গেল।

এবার ভদ্রলোক শহরের এক নামি খবরের কাগজে অগ্রিম টাকা মিটিয়ে দিয়ে জবরদস্ত একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনটার মূল বক্তব্য এরকম–তিন-চারজন কেরানি নিয়োগ করা হবে। কর্মপ্রার্থীদের অবশ্যই শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভুত এবং মার্জিত স্বভাবের হতে হবে। কারণ অগাধ অর্থ তাদের জিম্মায় থাকবে, হাতাতে হবে। তাই চাকরিতে নিযুক্ত হবার আগে নির্বাচিত প্রার্থীদের কেরাণিদের মাত্র দেড় হাজার টাকা জমা রাখতে হবে।

সব শেষে কোম্পানির নাম ছাপা হয়েছে–বগ, হগস, লগস্, ফ্রগ অ্যান্ড কোম্পানি। ১১০, ডগ স্ট্রিট।

বিজ্ঞপনের পাতায় প্রতিষ্ঠানটার এমন একটা বাহারি নাম দেখে সবাই তো রীতিমত ভিরমি খাওয়ার যোগাড় হলো। কারো মনে এতটুকু সন্দেহ জাগল না জাগার কথাও নয়। খালি পাত্রের আওয়াজ বেশি এ-কথা কারো অজানা না থাকলেও কেউ তিলমাত্র বিপরীত ধারণাও করতে পারল না।

এক মাসের মধ্যেই প্রায় পঞ্চাশজন কর্মপ্রার্থী ভদ্রলোকের বাড়ির দরজায় এসে হাজির হলো। প্রত্যেকেই চাকরিটা পাওয়ার জন্য তার কাছে বহুভাবে কাকুতি মিনতি জানাতে লাগল।

ভদ্রলোক কিন্তু প্রথম দিন কাউকেই চাকরিতে বহাল করার আগ্রহ দেখালেন না।

পরবর্তীকালে অর্থাৎ মাসের শেষ দিন বারে বারে পঞ্চাশ জনকেই চাকরিতে বহাল করলেন। আর প্রত্যেকের কাছ থেকে দেড় হাজার করে নগদ টাকা বুঝে নিয়ে রসিদও দিয়ে দিলেন প্রত্যেককে।

মাসের এক তারিখ সকাল দশটায় এক এক করে পঞ্চাশজনই কোম্পানির দরজায় হাজির হলো চাকরিতে যোগদান করার বাসনা নিয়ে। কিন্তু হায়! কোথায় অফিস! কোথায়ই বা কোম্পানি মালিকই বা কোথায় গেলেন? পাখি খাঁচা ভেঙে পালিয়েছে।

এদিকে বাড়িউলি সকাল দশটায় রসিদ নিয়ে হাজির হতে পারল না। ফলে তার পক্ষে ভাড়া বুঝে পেয়ে রসিদটা তার হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হলো না। কিন্তু যদি এক মিনিট আগে, ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটায় রসিদ নিয়ে হাজির হতো তবে কি সত্যনিষ্ঠ মার্জিত স্বভাবের নৈপুণ্যের সঙ্গে কোম্পানি পরিচালনাক্ষম ভদ্ৰবেশি তঞ্চকের দেখা পেত, নাকি ভাড়ার টাকা হাতে পেত?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *