ভূমিকা (চর্যাগীতি-পদাবলী)

ভূমিকা

১ মূলের সন্ধানে

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ হইতে একখানি বই বাহির করিয়াছিলেন ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নাম দিয়া। বইটিতে নেপাল-দরবার গ্রন্থাগারে রক্ষিত এই চারখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থ সঙ্কলিত হইয়াছিল, ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, ‘সরোজবজ্রের দোহাকোষ’, ‘কৃষ্ণাচার্যের দোহাকোষ’ ও ‘ডাকার্ণব’। প্রথম গ্রন্থখানিই সটীক চর্যাগীতিসংগ্রহ। মূল চর্যাগীতিসংগ্রহ গ্রন্থখানির নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ’। ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নামটি হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়া। প্রাপ্ত পুথিখানি আসলে টীকার। তবে সেই সঙ্গে মূল চর্যাও আছে। টীকাকারের নাম যে মুনিদত্ত তাহা পরে প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতী অনুবাদ হইতে জানা গিয়াছে। নেপাল-দরবারে রক্ষিত মূল পুথি খণ্ডিত। লুপ্ত শেষ পত্রে অবশ্যই টীকাকারের নাম ছিল। পুথির মাঝেও কয়েকখানি পাতা নাই। তাহাতে সাড়ে তিনটি পদের (২৩, ২৪, ২৫, ৪৮) মূল ও তদনুযায়ী টীকার অংশ বিলুপ্ত। তিব্বতী অনুবাদ হইতে লুপ্ত অংশের ভাবার্থ জানা যায়। চর্যাগীতির তিব্বতী অনুবাদের প্রথম সন্ধান পাইয়াছিলেন শ্ৰীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পরে প্রবোধচন্দ্র বাগচী সমগ্র অনুবাদ আবিষ্কার করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।

নেপাল -দরবারের পুথি যিনি লিখিয়াছিলেন তিনি মূল ও টীকা স্বতন্ত্র পুথি হইতে নকল করিয়াছিলেন। একই আদর্শ পুথি হইতে মূল ও চর্যা ও টীকা অনুলিপি করিলে লিপিকর একাদশ চর্যার পরে “সূনেত্যাদি চর্যায় ব্যাখ্যা নাস্তি” লিখিতেন না। (টীকার পুথিতে টীকা পান নাই বলিয়াই লিপিকর মূলও উদ্ধৃত করেন নাই।) পুথির শেষ পাতা নাই। এই পাতায় আর কোন চর্যাগীতি ছিল না। থাকিলে তিব্বতী অনুবাদে মিলিত । তিব্বতী অনুবাদ অনুসারে মুনিদত্ত পঞ্চাশটি চর্যার ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন । টীকাকারের কাছে মূল চর্যার পুথিতে আরো অন্তত একটি বেশি চর্যা ছিল (একাদশ ও দ্বাদশ চর্যার মাঝখানে)। এই চর্যাটির ব্যাখ্যা না থাকায় লিপিকর উদ্ধৃত করেন নাই, শুধু “টীকা নাই” এই মন্তব্যটুকু করিয়াছেন।

চর্যাগীতিগুলি রচিত হইার বেশ কিছু পরে টীকাটি লেখা হইয়াছিল। কিন্তু কত পরে তা জানা নাই। তবে অনুমান করা যায়। পাঠান্তরগুলি পর্যালোচনা করিয়া মূল ও টীকার মধ্যে কালান্তর দুই হইতে চার শত বৎসর ধরিলে খুব ভুল হয় না। টীকায় উদ্ধৃত মূলের পাঠ অনেক সময় পাঠান্তর নয়, একেবারে ভিন্ন পাঠ। মূল ও টীকার এইরকম পাঠভেদের ভালো উদাহরণ দিতেছি।

চর্যা-ছত্রমূলে পাঠটীকায় উদ্ধৃত পাঠ
২·৯অইসনঅইসনি
৬·৫চ্ছুপইখণ্ডই
৮·১ভরিতীভরিলী
১০·১১হাউহউ
১২·১পিহাড়িপিড়ি
১২·৯দাহদায়
১৬·৯গঅণাঙ্গণগগনগঙ্গা
২০·৩ফেটলিউফিটলেসু
২০·৫পহিলপহিলে
২০·৭জান জৌবননব যৌবন
২১·১নিসিঅ অন্ধারীনিশি আন্ধারী
৩০·৩উইত্তাউইএ
৩০·৬নিহুরেনিহএ
৩১·৫চান্দরেচান্দেরি
৩১·৭ছাড়িঅছাড়িল
৩২·৭পার উআরেঁপারোআরে
৩৩·২হাড়ীতহন্ডী[ত]
৩৩·৩বেগবেঙ্গ
৩৩·৫বলদবলদা
৩৩·৫গবিআগাবী
৩৬·৮ঘোরিঅঘাণিকা
৩৮·৫নৌবাহিনোবাআ
৩৮·৭বাট অভয় ; খান্টাবাটত [ভয়];
  খন্ট
৩৮·৯খরে সোন্তেঁখর-সোন্তেঁ
৩৯·৯সুইণাসুইণেঁ
৩৯·৯ভণন্তিভণ[ই]
৪০·৫আলেঅলেঁ
৪০·৭জে তইতেইজ
৪০·৮বোধবোব
৪৫·৯সুতরুসুন তরুবর
৪৬·১পেখুপেখই
৪৭·৩ডাহদাহ
৪৯·২অদঅদঙ্গালেঅদ্বয়বঙ্গালেঁ
৪৯·৫ডহি জোদহিঅ
৪৯·৭সোণ তরুঅসোন রুঅ
৫০·৩ছাড়ুছাড়
৫০·১১ভাইলাগড়িল

তিব্বতী অনুবাদ প্রায় সর্বত্র টীকার অনুসারী। তবুও কিছু পার্থক্য নজরে পড়ে। মনে হয় টীকার কিছু কিছু পাঠান্তর তিব্বতী অনুবাদকের জানা ছিল । অনেক সময় অনুবাদক খাঁটি অর্থ অনুধাবন করিতে পারেন নাই।

মুনিদত্তের টীকার পাঠ কোন কোন স্থানে মূলের তুলনায় ভালো। যেমন, ‘অইসনি’ (২.৯), ‘ভরিলী’ (৮·১), ‘দায়’ (১২·৯), ‘ফিটলেসু’ (২০·৩), ‘চান্দেরি’ (৩১·৫), ‘ঘাণিকা’ (৩৬·৮), ‘সুইণেঁ’ (৩৯·১), ‘ভণই’ (৩৯·৯), ‘বোব’ (৪০·৮), ‘পেখই’ (৪৬·১), ‘গড়িল’ (৫০·১১)। কোন কোন স্থানে মূল ও টীকা দুইয়ের পাঠ তুল্যমূল্য। যেমন, ‘চ্ছুপই : খণ্ডই’ (৬·৫), ‘উইত্তা : উইএ’ (৩০·৩), ‘ছাড়িঅ : ছাড়িল’ (৩১·৭), ‘বলদ : বলদা’ (৩৩·৫), ‘জে তই : তেজই’ (৪০·৭), ‘ডাহ : দাহ’ (৪৭·৩) ইত্যাদি। আবার কখনো কখনো মূলের পাঠ উন্নততর। যেমন, ‘হাড়ীত’ (৩৩·২), ‘নৌবাহী’ (৩৮·৫), ‘আলে’ (৪০·৫) ইত্যাদি।

একটি বিষয়ে মূলের সঙ্গে টীকার গুরু বিরোধ আছে। মূলে চর্যার সব পদই ধ্রুবপদ (“ধ্রু”)। অথাৎ প্রত্যেক পূর্বপদ পরবর্তী পদ গাহিবার পর ধুয়ার মত পুনরাবৃত্ত হইত। এই বিশেষত্ব টীকাকার শুধু দুইটি চর্যাতেই নির্দেশ করিয়াছেন এই বলিয়া, “পদস্যোত্তরপদে ধ্রুবপদং বোদ্ধব্যম্‌।” এই দুইটি চর্যাতেই ছত্রসংখ্যা চর্যার সাধারণ ছত্ৰসংখ্যার সমান নয়। একটিতে (২৮) বেশি—চৌদ্দ ছত্র, অপরটিতে (৪৩) কম—আট ছত্র। বাকি সব চর্যাতেই টীকাকার দ্বিতীয় পদকে ধ্রুবপদ নির্দেশ করিয়াছেন এবং/অথবা দ্বিতীয় পদকে ধ্রুবপদ ধরিয়া চর্যার পদসংখ্যা উল্লেখ করিয়াছেন। ধ্রুবপদের এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করিলে টীকাকারের অবলম্বিত মূলকে বেশি খাঁটি বলিতে হয়।

এই চর্যাগীতিকোষে সঙ্কলিত ছিল না এমন একটি চর্যা পুরাপুরি এবং কয়েকটি চর্যার টুকরা অন্যত্র পাওয়া গিয়াছে। মুনিদত্ত তাঁহার টীকাতেও কিছু চর্যাপদ ও পদাংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন। প্রাপ্ত সম্পূর্ণ চর্যাটি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংগ্রহ করিয়াছিলেন। এই গানটি (*১) এবং চর্যাপদ ও পদাংশগুলি (এবং পরে আবিষ্কৃত অর্বাচীন গানগুলি) পরিশিষ্টে দেওয়া গেল।

অধ্যাত্মগতি ও ছড়া অর্থে “চর্যা” শব্দটি দ্বাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ভারতে প্রচলিত ছিল। চালুক্যবংশীয় রাজা সোমেশ্বর ভূলোকমল্লের উৎসাহে সঙ্কলিত ‘মানসোল্লাস’ নামক বিশ্বকোষজাতীয় গ্রন্থে ‘চর্যা’ নামক রচনার এই লক্ষণ বর্ণিত আছে,

অর্থশ্চাধ্যাত্মিকঃ প্রাসঃ পাদদ্বিতয়শোভনং।

উত্তরার্ধে ভবেদেবং চর্যা সা তু নিগদ্যতে ॥

অর্থাৎ, অর্থ অধ্যাত্মঘটিত, পদান্তে মিল, দুই চরণ। দ্বিতীয় অর্ধেও সেইরূপ, তাহাকে বলে চর্যা।

এই লক্ষণ অনুসারে চর্যা গানে চার চরণ, আর দুই দুই চরণে মিল। এই লক্ষণে ভনিতার উল্লেখ নাই । চর্যা চার চরণের এই লক্ষণ ধরিলে লুইপাদের প্রথম চর্যাটি (১) এবং চাটিলের চর্যাটি (৫) দুই চর্যার যুগ্মক বলা চলে। চার ও ছয় চরণের (এবং ছয় ও চার চরণের) যুগ্মক আরও আছে,—ভুসুক (৬,৩০), কাহ্ণ (৭), কামলি (৮) এবং আজদেব (৩১)।

চর্যাগানগুলির অধিকাংশেই রচয়িতার নাম (অর্থাৎ ভনিতা) আছে। সবগুলিতে নাই। কিন্তু টীকাকার (অথবা পুথির লিপিকর) প্রত্যেক চর্যার রচয়িতার নাম করিয়াছেন। এ কাজে টীকাকার (অথবা লিপিকর) মাঝে মাঝে ভুলও করিয়াছেন। কয়েকটি নাম আবার মূলে একরকম টীকায় অন্যরকম। আবার কোন কোন চর্যায় স্পষ্টতই গুরুর নাম ভনিতারূপে প্রদত্ত হইয়াছে। চর্যাকর্তাদের ও চর্যাকর্তা বলিয়া টীকাকারের উল্লিখিত নামগুলি যেভাবে মূলে ও টাকায় আছে তাহার তালিক দিতেছি।

২. চর্যার কবি ও কাল

লুই (লুইপাদ, লূয়ীপাদ, লূয়ীচরণ)১,২৯
কুক্কুরীপা (কুক্কুরীপাদ, কুক্কুরিপাদ)২,২০,৪৮
বিরুআ (বিরুপাদ)
গুডরী (গুণ্ডরীপাদ, গুড্‌ডরী)
চাটিল (চাটিল্লপাদ, চাটিল)
ভুসুকু (ভুসুকুপাদ, ভুসুকু)৬ ২১ ২৩ ২৭ ৩০ ৪১ ৪৩ ৪৯

কাহ্নু, কাহ্নূ, কাহ্ন, কাহ্ণ, কাহ্নি, কাহ্নিলা, কাহ্নিল, (কৃষ্ণাচার্যপদ, কৃষ্ণবজ্রপাদ, কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণাচার্যচরণ, কৃষ্ণপাদ, কৃষ্ণাচার্যসুন্দর) ৭,৯-১২,১৮,১৯,২৪ ,৩৬,৪০,৪২,৪৫.

“ভণই কাহ্ণ (কাহ্ণ)” আছে চারটি গানে (৭, ১২, ৪০, ৪৫); “কাহ্ণে গাই” আছে একটি গানে (১৮); বাকি সর্বত্র “কাহ্ণ, কাহ্ণু, কাহ্ণিল, কাহ্ণিলা” প্রথম পুরুষ রূপে ব্যক্ত ।

কামলি (কম্বলাম্বরপাদ)
(ডোম্বীপাদ)১৪
শান্তি (শান্তিপাদ)১৫,২৬
মহিণ্ডা (মহীধরপাদ)১৬
(বীণাপাদ)১৭
সরহ (সরহপাদ)২২,৩২,৩৮,৩৯
(শবরপাদ)২৮,৫০
আজদেব (আর্যদেবপাদ)৩১
ঢেণ্ঢণপা (ঢেণ্ঢণ, ঢেণ্ঢণপাদ)৩৩
দারিক (দারিকপাদ) ৩৪
ভাবে (ভাবেপাদ, ভদ্রপাদ)৩৫
তাড়ক (তাড়কপাদ)৩৭
কঙ্কণ (কঙ্কণ, কৌঙ্কণপাদ)৪৪
জঅনন্দি (জয়নন্দিপাদ)৪৬
ধাম (ধামপাদ)৪৭
(তন্ত্রী পাদ)২৫ (মূল বিলুপ্ত)
নাড়ীডোম্বীপাদপুথিতে অনুদ্ধৃত (অপ্রাপ্ত)

এই নামমালা হইতে মধ্যে দুইটি নাম সরাসরি বাদ দিতে হয়। “বীণা” ও “শবর” পদ দুইটি যেভাবে চর্যায় আছে তাহাতে ভনিতা বলিয়া মনে করা অনুচিত। শবরীপাদ বলিয়া এক বা একাধিক সিদ্ধাচার্য ছিলেন। শবরপাদের লেখা বলিয়া উল্লিখিত চর্যা দুইটিতে ( ২৮, ৫০) শবর-শবরীর উল্লেখ আছে। চর্যা দুইটি কোন এক শবরীপাদের রচনা হওয়া অসম্ভব না হইতে পারে, কিন্তু চর্যায় ব্যবহৃত পদটি ভনিতা নয়। টীকাকারের উক্তির বাহিরে কোন “বীণাপাদ”-এর অস্তিত্ব মিলে না।

কুক্কুরীপা ও ঢেণ্ঢণপা ভনিতা দুইটিতে গুরুগৌরববাচক “পা” থাকায় এই নামাঙ্কিত চর্যাগুলিকে সিদ্ধাচর্যাদ্বরের কোন শিষ্যের বা অনুশিষ্যের রচনা বলিতে হয়। চাটিল ভনিতার চর্যাটিও তাঁহার কোন শিষ্যের—সম্ভবত ধামের —রচনা। চাটিল নিজেকে “অনুত্তরস্বামী” নিশ্চই বলেন নাই।

তাড়ক ও কঙ্কণ—এই দুইটি চর্যাকর্তার নাম ঠিক নাম নয়, ছদ্মনাম (তখল্লুস, penname)। তাড়, কাঁকণ, হার, মুকট প্রভৃতি ভূষণ-উপহারযোগে সেকালে কবি-গুণীকে পুরস্কৃত করার রীতি ছিল। উপহার-লব্ধ ভূষণের নামে কবিরা নিজেদের পরিচিত করাইতেন।

ডোম্বী ও তন্ত্রী জাতিবাচক নাম হইতে পারে। যেমন সম্ভবত দোহা-রচয়িতা তীল বা তিল্লো ।

নেপাল-দরবারের পুথি বাঙ্গালা লিপিতে লেখা, বাঙ্গালীর লেখা, পুরানো পুথি, তবে সমসাময়িক নয়। তিব্বতী অনুবাদের রচনাকাল জানা নাই। তবে যোড়শ শতাব্দীর পরবর্তী না হওয়াই সম্ভব। মুনিদত্তের টীকার রচনাকাল পুথি লেখার বেশ কিছুকাল আগে। আমি পুথি দেখি নাই, তবে পুথির ফটো আনাইয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। পুথির অক্ষর আলোচনা করিয়া আমার ধারণা হইয়াছে যে পুথির লিপিকাল পঞ্চদশ শতাব্দী ধরিলে মারাত্মক ভুল হইবে না । চর্যাগীতিগুলির রচনাকাল অনেক আগে। কিন্তু কত আগে? ভাষা ধরিয়া আন্দাজ করা হইয়াছে যে চর্যাগীতি রচনাকাল মোটামুটি দশম হইতে দ্বাদশ শতাব্দী। কিন্তু এ নিছক অনুমান । এবং এ অনুমান নিম্নতম সীমা সম্বন্ধেই, খাটে। চর্যাকর্তাদের মধ্যে দুই-চারি জনের জীবৎকালের যে আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাহাতে এই নিম্নতম কালসীমাই সমর্থিত হয় । মৎস্যেন্দ্রনাথ-গোরক্ষনাথের কল্পনা-নির্ভর ঐতিহাসিকতা-সূত্র ধরিয়া কোন কোন পণ্ডিত সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী অবধি পৌঁছিয়াছেন। এমন অনুমানের পক্ষে আপাতত কোনো তথ্য নাই। তবে অন্য দিক দিয়া হয়ত কিছু যুক্তি আছে। কিন্তু সে পথ এখন ধরিব না, ধরিলে হয়ত অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত ঢালিয়া সাজিতে হইবে।

চর্যাগীতিগুলিই সবই যে এক সময়ের লেখা তাহা বলিবার যো নাই। গুরু-শিষ্য দুই পুরুষের রচনা তো আছেই। তিন-চার পুরুষের রচনা থাকাও বিচিত্র নয় । যেহেতু চর্যাগীতিগুলির ভাষায় ও রচনারীতিতে কালগত বৈষম দুর্লক্ষ্য সেই হেতু প্রথম ও শেষ চর্যাকর্তার মধ্যে দুইশত বৎসরের বেশি ব্যবধান অনুমান করা সঙ্গত নয়। এবং এই ব্যবধানও দরাজ কল্পনায়। তখন বাঙ্গালা ভাষার শৈশব অবস্থা, ভাষার পরিবর্তন তখন স্বভাবতই দ্রুতগতি। কিন্তু সেরকম পরিবর্তনের সাক্ষ্য চর্যাগুলিতে নাই। তবে অবহট্‌ঠের প্রভাব সর্বদা উদ্যত ছিল। তাহাতে কতক পরিমাণে পরিবর্তনের বেগ মন্দীভূত হইয়া থাকিবে।

এই যুক্তির বিরুদ্ধে বলা যায় যে চর্যাগীতির ভাষা কথ্য-ভাষাশ্রিত হইলেও তাহা সাহিত্যের ভাষা এবং সে ভাষায় একাধিক উপভাষার (পরে যা স্বতন্ত্র ভাষায় পরিণত হইয়াছে) মিশ্রণ আছে। সুতরাং এই সাহিত্য-ভাষা যে প্রথম চর্যাকর্তার হুবহু মুখের ভাষা তাহা সিদ্ধান্ত করা যায় না। কালিদাসের বিক্রমোর্বশী নাটকের অপভ্রংশ গানগুলি যদি কবির নিজের রচনা হয় তবে চর্যার ভাষার মূল অনায়াসে সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত পৌঁছিতে পারে। যাই হোক এ তর্ক এখানে অপ্রাসঙ্গিক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মুনিদত্তকে অনুসরণ করিয়া লুইকে আদি সিদ্ধাচার্য বলিয়াছেন। লুইয়ের একটি চর্যা লইয়া চর্যাগীতিকোষের আরম্ভ। সুতরাং এ অনুমানের সমর্থন আছে। লুই অভিসময়ের বই লিখিয়াছিলেন। আর কোন চর্যাকর্তা অথবা বৌদ্ধ তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য বিশুদ্ধ বৌদ্ধ-দর্শনের বই লিখিয়াছেন বলিয়া জানা নাই। এখানেও লুইয়ের প্রাচীনত্বের প্রমাণ। লুইয়ের চর্যা দুইটিতে যোগ-সাধনার কথা আছে কিন্তু যৌন-তান্ত্রিকতার কোনরকম ইঙ্গিত নাই। তাঁহার গানে লুই বলিয়াছেন যে গুরু-উপদিষ্ট যোগধ্যানের দ্বারাই, অধ্যাত্মদৃষ্টি লভ্য, তপজপের দ্বারা তাহা অলভ্য, শাস্ত্র অধ্যয়নের দ্বারাও পথ-নির্দেশ হয় না। লুইয়ের চর্যায় সাংকেতিক “সন্ধা”-ভাষের আভাস নাই। রূপক তিনি সর্বদা ভাঙ্গিয়াই দিয়াছেন। (যেমন, কায়া তরুবর ।) কোনো পারিভাষিক শব্দও লুই ব্যবহার করেন নাই। অপর চর্যাকর্তারা যেখানে পারিভাষিক “আলি কালি” প্রয়োগ করিয়াছেন সেখানে লুই লিখিয়াছেন অপারিভাষিক “ধমন চমণ”। লুইয়ের চর্যায় ভনিতার ব্যবহারেও বিশেষত্ব আছে। ভনিতা পাই দুইবার করিয়া—একবার ধ্রুবপদে আর একবার শেষ পদে। এই বিশেষত্ব লুইয়ের শিষ্য দারিকের (৩৪) এবং আরও দুই-একজনের চর্যাতেও (২, ২৬, ৩০, ৩১) দেখা যায় । মনে হয় এখানে গানগুলি দুইটি করিয়া চর্যার সংযোগে গঠিত। (চারছত্রের চর্যাগানের নিদর্শন মানসোল্লাসে উদ্ধৃত আছে।)

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলিয়াছেন, “লুইয়ের সময় ঠিক করিতে হইলে এই কথা বলিলেই যথেষ্ট যে, তাঁহার একখানি গ্রন্থে দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান সাহায্য করিয়াছেন। সে গ্রন্থখানির নাম অভিসময়বিভঙ্গ। দীপঙ্করশ্ৰী জ্ঞান ১০৩৮ সালে বিক্রমশীল বিহার হইতে ৫৮ বৎসর বয়সে তিব্বত যাত্রা করিয়াছিলেন।” একথা ঠিক হইলে লুই দীপঙ্করশ্ৰী জ্ঞানের বর্ষীয়ান্‌ সমকালীন হন। অতএব লুইয়ের জীবৎকাল একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ধরিতে পারি। কিন্তু তাহাতে একটু অসুবিধা আছে। সরহের আলোচনায় দেখা যাইবে যে সরহকেও একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের এদিকে আনা যায় না, ওদিকে লইয়া যাওয়াই উচিত। অথচ আভ্যন্তরীণ বিচারে লুইকে সরহেব চেয়ে প্রাচীনতর বলিতে আমরা বাধ্য। বোধ করি তিব্বতী ঐতিহ্যে যাহা লুই ও দীপঙ্করশ্রীর সাক্ষাৎ সহযোগিতা বলা হইয়াছে আসলে তাহা তেমন ছিল না। হয় দীপঙ্করশ্রী পরবর্তী কালে লুইয়ের অসমাপ্ত অভিসময়বিভঙ্গ সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন, নয় লুই লিখিয়াছিলেন ‘অভিসময়’, আর এই অভিসময়ের পরিশিষ্ট (“বিভঙ্গ”) রচনা করিয়াছিলেন দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান। এমন অনুমান করিলে লুইকে দীপঙ্করশ্রীর সমসাময়িক হইতে হয় না। তাহা হইলে লুইয়ের জীবৎকাল দশম শতাব্দী বলিলে ভুল হইবার সম্ভবনা কম হয়।

তিব্বতী অনুবাদের মধ্য দিয়া লুইয়ের তিনখানি গ্রন্থের নাম পাইতেছি,—‘শ্রীভগবদভিসময়’, ‘অভিসময়বিভঙ্গ’ এবং ‘তত্ত্বস্বভাবদোহা-কোষগীতিকাদৃষ্টি নাম’। মনে হয় শেষ রচনাটি লুইয়ের দোহা ও চর্যাগীতির সংগ্রহ এবং এটির আসলে নাম ছিল ‘তত্ত্বস্বভাবদৃষ্টি নাম দোহাকোষগীতিকা’। লুইয়ের যে চর্যা দুইটি পাওয়া যাইতেছে তাহা ভাবের দিক দিয়া ‘তত্ত্বস্বভাবদৃষ্টি’-র মধ্যে স্বচ্ছন্দে ধরা যায়। তারনাথের মতে লুই ছিলেন শবরীপা-এর শিষ্য।

লুই নামটি সম্ভবত ‘রোহিত’ হইতে আসিয়াছে । ধর্মমঙ্গলের “লুইয়া”, “লুইধর, “লুইচন্দ্র” এবং পরবর্তীকালের “রুইদাস” এই নামের সঙ্গে অভিন্ন।

কুক্কুরীপা-এর চর্যা তিনটি যে তাঁহার কোন ভক্তের বা শিষ্যের রচনা তাহা বোঝা যায় নামের সম্ভ্রমসূচক অংশ “পা” (পদ) হইতে। এই গ্রন্থকর্তার নামে সংস্কৃত রচনা ‘মহামায়াসাধন’ পাওয়া গিয়াছে। তাহার মধ্যে একটি বজ্রগীতি নিবদ্ধ আছে। বজ্রগীতিটির সঙ্গে কুক্কুরীপাদের দুইটি চর্যার (২, ২০) এই মিলটুকু পাই যে তিনটিই নারী-ভাবিত এবং তিনটিতেই মেয়েলি সঙ্কোচহীনতা প্রকটিত। চর্যা দুইটি সন্ধা-ভাষায় এবং লোকগীতি-পদ্ধতিতে লেখা। বজ্রগীতিটি এই

হলে সহি বিকসিঅ কমলু প্রবোহিউ বজ্জেঁ

অললললহো মহাসুহেণ আরোহিউ ণচ্চেঁ।

রবিকিরণে পফুল্লিঅ কমলু মহাসুহেণ

অললললহো মহাসুহেণ আরোহিউ ণচ্চৈঁ ॥

তারানাথের মতে কুক্কুরীপা-এর সঙ্গে সর্বদা একটি কুক্কুরী থাকিত, তাই তাঁহার এই নাম।

বিরুআ ভনিতায় একটিমাত্র চর্যা মিলিয়াছে । ভনিতার ক্রিয়াপদটি (“ভণন্তি”) গৌরবসূচক, সুতরাং রচনা যে বিরুআর নয়, তাঁহার কোন শিষ্যের অথবা প্রশিষ্যের, এমন অনুমান অপরিহার্য। তিব্বতী অনুবাদের মধ্য দিয়া আমরা “মহাযোগী” “যোগীশ্বর” “আচার্য” বিরূপের এই রচনাগুলির সন্ধান পাই,—‘কর্মচণ্ডালিকা নাম গীতি’ (তিব্বতীতে ‘কর্মচণ্ডালিকা দোহাকোষগীতি নাম’), ‘দোহাকোষ’ এবং ‘বিরূপ-পদচতুরশীতি’! তারানাথ বলিয়াছেন বিরুআ ছিল মহাযোগী আচার্য কাহ্নের অর্থাৎ কৃষ্ণপাদের নামান্তর। একথা যে সত্য, অর্থাৎ কাহ্ন নামধারী বহু সিদ্ধাচার্যের মধ্যে একজনের নামান্তর যে বিরূপ ছিল, তাহার প্রমাণ কাহ্ন ভনিতার একটি চর্যাতেই (১৮) রহিয়াছে।

কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই

বিদুজণলোঅ তোরেঁ কণ্ঠ ন মেলঈ।

একথা যে কাহ্ন নিজের সম্বন্ধেই বলিয়াছেন তাহা বুঝিতে পারি চর্যান্তরের (৩৬) ভনিতা হইতে

শাখি করিব জালন্ধরি-পাএ

পাখি ণ রাহঅ মোরি পাণ্ডিআচাএ ॥

তিব্বতী অনুবাদে যে কর্মচণ্ডালিকাগীতির উল্লেখ আছে তাহা কাহ্নের রচনা অনুমান করিতে বাধা নাই। যে চর্যায় কাহ্ন নিজেকে “বিরুআ” বলিয়াছেন, তাহাই মনে করি এই কর্মচণ্ডালিকাগীতি। ভনিতায় তাহার প্রমাণ,

কাহ্নে গাই তু কামচণ্ডালী

ডোম্বিত আগলি ণাহি চ্ছিণালী ॥

কাহ্নের দোহাকোষ আছে বিরূপের নাই। ইহা কাহ্ন-বিরুআর অভিন্নত্বের অবিরোধী। প্রাপ্ত চর্যাগীতিটি যাঁহার রচনা ‘বিরূপপদচতুরশীতি’ও বিরুআর সেই শিষ্যের অথবা প্রশিষ্যের রচনা হওয়া সম্ভব। বিরুআ ভনিতায় কাহ্ন কিছু যে লিখিয়াছিলেন এমন অনুমানের সমর্থনে কিছু পাই নাই। বিরূপের নামে সংস্কৃতে লেখা তান্ত্রিক সাধনার দুই একটি নিবন্ধ পাওয়া গিয়াছে।

এক কাহ্নের নাম যে বিরূপ (বিরুআ) ছিল তাহা তিব্বতী ঐতিহ্যেও স্বীকৃত। কাহ্ন ও বিরুআ নাম দুইটি মিলাইতে গিয়া তারানাথ গোলমাল করিয়া ফেলিয়াছেন। তিনি বলেন গুরু-শিষ্য দুই বিরুআ, গুরু বিরুআর শিষ্য কালো (অর্থাৎ কৃষ্ণ) বিরুআ।১০ তিনি আরও বলিয়াছেন ছোট বা কালো বিরুআর গুরু জালন্ধরি-পা। এইখানে চর্যাগীতির সঙ্গে মিল পাইতেছি। গুরু বিরুআর যে বর্ণনা তারনাথ দিয়াছেন তাহা স্পষ্টতই বিরুআর চর্যাগীতিটির ও কাহ্নের একটি চর্যাগীতির (১০) আধারে গড়া। তারনাথ বলিয়াছেন জালন্ধরি-পা হাড়ের ভূষণ পরিতেন ও ডমরু ধরিতেন। ১১ কালো বিরুআ ছিলেন ব্রাহ্মণ, রামপালের সমসাময়িক এবং তিনি প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ্যপন্থী তান্ত্রিক ছিলেন। —এই ইঙ্গিতও পাই তারনাথের বর্ণনায়। ইহাতে খানিকটা সত্য থাকা অসম্ভব নহে।

“বিরুআ” নামটির মূলে আছে—‘বিরূপক’। সেই সঙ্গে ‘বীর’ শব্দের অর্থপ্রতিভাসও থাকিতে পারে। যোগী কাহ্ন বীরনাটে ডমরু বাজাইতে বাজাইতে নগর পর্যটন করিতেছেন। —এ চিত্র কাহ্নের একটি চর্যায় (১১) আছে।

গুণ্ডরীর নাম তিব্বতী ঐতিহ্যে নাই। এই ভনিতায় একটিমাত্র চর্যা মিলিয়াছে (৪)। ধাম ভনিতার একটি চর্যায় (৪৭) রাগনির্দেশের ভুল পাঠ গ্রহণ করিয়া ১২ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলিয়াছেন, “ধামপাদের আর এক নাম গুণ্ডরীপাদ ।” এ অনুমান পরিত্যাজ্য। চর্যাটিতে সন্ধাসঙ্কেতে “দ্বীন্দ্রিয়সমাপত্তি” অর্থাৎ যৌন-তান্ত্রিক ক্রিয়ার ইঙ্গিত আছে। পারিভাষিক শব্দও অনেক আছে—কমলকুলিশ, মণিমূল, ওড়িআণ, চান্দসুজ, কুন্দুর। মনে হয় চর্যাকর্তা প্রাচীনদের মধ্যে পড়েন না। নামটিও ছদ্ম বলিয়া বোধ হয়, হয়ত “গুণ্ডকরিক” (মশলা ইত্যাদি গুঁড়া করা যাহার পেশা) অথবা “গুড়করিক” (আখের রস হইতে গুড় করা অথবা গুড়ের পাক করা যাহার পেশা) হইতে উদ্ভুত। (তুলনীয় “গুড়িয়া”—ময়রা ।) তাহা হইলে “অম্‌হে কুন্দুরে বীরা” এই উক্তির সঙ্গেও কিছু সামঞ্জস্য থাকে।

চাটিল নামটিও তিব্বতী ঐতিহ্যে একেবারে অজ্ঞাত। এই নামে যে চর্যাটি পাইয়াছি তাহা চাটিলের রচনা হওয়া সম্ভব নয়, কেন না যত উচ্চস্তরের সাধক হোন না কেন কোন চর্যাকর্তাই নিজেকে অনুত্তরস্বামী গুরু বলিয়া জাহির করিবেন না। সুতরাং গানটি চাটিলের কোন ভক্তশিষ্যের রচনা, যিনি পারগামী লোককে গুরু চাটিলের উপদেশ অনুসরণ করিতে আহ্বান করিয়াছেন। ধ্রুবপদে আছে, “ধামাৰ্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই।” “ধামার্থে” কথাটির ব্যাখ্যা মুনিদত্ত করিয়াছেন, “ধর্মার্থং স্বলক্ষণধারণাৎ ধর্মঃ ঘটপটস্তকুম্ভাদিভূতবিকারঃ।” এ অর্থের কোনই সঙ্গতি নাই। মনে হয় এখানে “ধাম” ব্যক্তিবিশেষের নাম, যিনি চাটিলের শিষ্য, মুখ্যত যাঁহার উত্তরণের জন্য চাটিল সাঁকো গড়িয়াছেন, তবে সে সাঁকোয় আরও অনেকে স্বচ্ছন্দে ভবসাগর পার হইয়া যাইতে পারে। এই ব্যাখ্যা স্বীকার করিলে চর্যাটি ধর্মপাদের রচনা বলিতে হয়।

“চাটিল” নামটি কি চাটিগাঁয়ের লোক এই অর্থে ব্যবহৃত ? (পরে ধামের প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য ।) অথবা ‘চট্ট’ (=ভট্টের চেলা) হইতে ?

স্পষ্ট “ধাম” ভনিতা পাই একটি চর্যায় (৪৭)। চাটিল-নামাঙ্কিত চর্যায় পারিভাষিক শব্দ দুইটি মাত্র—নিবাণ ও বোহি। ধাম-ভনিতার চর্যায় পারিভাষিক শব্দ অনেকগুলি,—কমলকুলিশ, সমতাযোগ, চণ্ডালী, ডোম্বী, সসহর, মেরুশিখর, গঅণ। দ্বিতীয় চর্যায় সন্ধাসঙ্কেত গাঢ়তর।

তিব্বতী ঐতিহ্যে “আচার্য” ধর্মপাদকে কৃষ্ণপাদের বংশধর বলা হইয়াছে। ইহার দুইটি রচনায় তিব্বতী অনুবাদ আছে,—‘সুগতদৃষ্টি-গীতিকা’ এবং ‘হুঙ্কারচিত্তবিন্দুভাবনাক্রম’। প্রথমটি চর্যাগীতি হইতে পারে।

ভুসুকুর আটটি চর্যা পাইতেছি। দুইটিতে ভুসুকুর সঙ্গে “রাউতু” পদবী অথবা নামান্তর আছে (৪১, ৪৩)। তিব্বতী ঐতিহ্যে এবং অন্যত্র ১৩ “ভুসুকু” ‘বোধিচর্যাবতার’ ও ‘শিক্ষাসমুচ্চয়’ রচয়িতা শান্তিদেবের নামান্তর। কিন্তু শান্তিদেব অনেক আগেকার লোক। তিনি মঞ্জুশ্রীর উপাসক। আর ভুসুকু ছিলেন সহজানন্দের সাধক। ভুসুকু বোধ করি “রাজপুত্র” (অর্থাৎ অশ্বারোহী যুদ্ধ-ব্যবসায়ী বংশের সন্তান) ছিলেন, তাই তিনি “রাউত”। ১৪ “ভুসুকু” নামটি বোধ হয় ‘ভুসূক্ষ্ম’ (অর্থাৎ তন্মাত্র) শব্দের সংক্ষিপ্তরূপ। দুইটি চর্যায় (৬, ২৩) হরিণ-শিকারের এবং একটি চর্যায় (৪৯) জলদস্যু কর্তৃক দেশলুণ্ঠনের সন্ধাসঙ্কেত আছে। ইহা তাঁহার রাউত-বৃত্তির সমর্থক। ভুসুকু নিজেকে ও শিষ্যদের “যোগী” বলিয়াছেন (২১, ৩০, ৪১)।

ভুসুকুর চর্যাগুলি সন্ধাসঙ্কেতময় এবং পারিভাষিক-শব্দকণ্টকিত,—সসহর, অবধূই, সহজ, কমল, বিরমানন্দ, সহজানন্দ, মহাসুখ, করুণা, গঅণ, বিসঅবিশুদ্ধি, খসমসহাব, মণরঅণা, সমরস। ইহা হইতে মনে হয় ভুসুকু চর্যাকর্তাদের মধ্যে বেশ অর্বাচীন। পারিভাষিক শব্দের বাহুল্য এবং সন্ধাসঙ্কেতের আড়ম্বর চর্যাগীতির অনুশীলনে দীর্ঘ গতানুগতিরই দ্যোতক।

ভুসুকুর জীবৎকালের নিম্নতম সম্ভাব্য সীমা ১২৯৫ খ্রীষ্টাব্দ। এই বৎসরে নকল করা ভুসুকুর ‘চতুরাভরণ’ গ্রন্থের পুথি পাওয়া গিয়াছে।১৫ এটি বৌদ্ধ সহজ-সাধকদের সাধনা ও দিনচর্যাবিষয়ক নিবন্ধ। ইহাতে বাঙ্গালা-অবহট্‌ঠ মিশাল ভাষায় কিছু দোহা আছে । পাঠ খানিকটা বিকৃত। একটি দোহায় “রাউতু” ভনিতা মিলিয়াছে।

অম্বু পসরতু চন্দন বারহ অক্ব

হেট্‌ঠ কমল করি শয়ন থক্ক।

সূজ চাপ্পি শশি সমরস জাই

রাউতু বোলে জর-মরণ ভাই ॥

শান্তিদেবের সঙ্গে ভুসুকুর যোগ টানা চলে না, তবে চর্যাকর্তা শান্তির সঙ্গে হয়ত চলিতে পারে। তবে শান্তির চর্যা দুইটিতে (১৫, ২৬) সহজ-সাধনার উল্লেখ নাই এবং পারিভাষিক শব্দও খুব কম,—সঅসম্বেঅন, সূন, হেরুঅ। এদিক হইতে শান্তিকে প্রাচীনতর পদকর্তা বলিতে হয়। নাড়পাদের উদ্ধৃত একটি চর্যাপদে শান্তির ভনিতা ও ভুসুকুর উল্লেখ রহিয়াছে (*৫)। এ শান্তি নিশ্চয়ই ভুসুকুর শিষ্য অথবা ভক্ত। নাড়পাদের গ্রন্থের লিপিকাল ১৩৯৪ খ্রীষ্টাব্দ । ইহাই শান্তির জীবৎকালের নিম্নতম সীমা। তবে চর্যাগীতি দুইটির (১৫, ২৬) শান্তি আর চর্যাপদটির (*৫) শান্তি যে একই ব্যক্তি তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা চলে না। চর্যা দুইটির ক্রিয়াপদে ভনিতায় যে ‘-থেউ’, ‘-থি’ বিভক্তি পাই তাহা বহুবচনের ‘-অন্তি’ হইতে উৎপন্ন সুতরাং গৌরবসূচক। তাহা হইলে চর্যা দুইটি শান্তির কোন ভক্ত-শিষ্যের রচনা বলিতে হয়।

তিব্বতী অনুবাদে শান্তিদেবের ‘সহজগীতি’ ও শান্তির ‘সুখদুখ-পরিত্যাগ অদ্বয়দৃষ্টি’ পাওয়া গিয়াছে।

কাহ্ন ভনিতায় সব চেয়ে বেশি চর্যাগীতি পাওয়া গিয়াছে—তেরোটি। ভনিতায় নাম পাওয়া যায়—কাহ্ন, কাহ্ণু কাহ্ন, কাহ্নি, কাহ্নিল, কাহ্নিলা। একটিতে নামান্তর পাই বিরুআ।১৬ কয়েকটি চর্যায় রচয়িতা নিজেকে কাপালিক যোগী (১০, ১১, ১৮), অথবা শুধু যোগী (৪২) অথবা “লাঙ্গা” (৩৬) বলিয়াছেন । ১৭ যে পদটিতে “কাহ্নিলা লাঙ্গা” আছে তাহাতে চর্যাকর্তার গুরু অথবা ইষ্ট “জালন্ধরিপা”-এর উল্লেখ আছে। নাথ-সাধনার ঐতিহ্যে কানুপা (বা কানফা) জালন্ধরির (অর্থাৎ হাড়িপার) শিষ্য।

তিব্বতী ঐতিহ্যে কৃষ্ণপাদ “যোগীশ্বর”, “আচার্য’ ও “মণ্ডলাচার্য।” তবে কৃষ্ণপাদের নামে যেসব রচনা আছে তাহা সবই যে একজনের রচনা নয় তাহারও ইঙ্গিত আছে। চর্যাগীতিকোষে যে গানগুলি আছে তাহা হইতে অন্তত দুইজন কাহ্নের অস্তিত্ব অনুমান করিতে পারি। একজন জালন্ধরিপাদের শিষ্য কাহ্ন, যাঁহার নামান্তর ছিল বিরুআ। তিনিই নিজেকে কাপালিক, নাগা, যোগী বলিয়াছেন এবং গানে ডোমনীর সহিত প্রেমসম্পর্কের পুনঃপুন সন্ধাসঙ্কেত করিয়াছেন। ছয়টি চর্যা (১০, ১২, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪২) ইঁহার রচনা বলিয়া ধরিতে পারি। বাকি সাতটি চর্যা (৭, ৯, ১২, ১৩, ২৪, ৪০, ৪৫) অপর এক কাহ্নের রচনা যিনি ডোম্বী-বিবাহের বদলে মহাসুখ-সাঙ্গা করিতে চাহেন এবং যাঁহার রচনায় তান্ত্রিক-সাধনার ইঙ্গিত ছাপাইয়া জ্ঞান-উপদেশেরই প্রবলতা। ভনিতার দিক দিয়া কিন্তু কোন পার্থক্য নির্দেশ করা যায় না। কাহ্ণ ও কাহ্নিল নাম দুই দফার চর্যাতেই আছে। দোহাকোষে পাই শুধু কাহ্নু।

পারিভাষিক শব্দ দুই দফাতে সব এক রকম নয়। প্রথমে কাহ্নের রচনা বলিয়া যেগুলি অনুমান করি তাহাতে পাই—ডোম্বী, পদ্ম, খাট, আলিকালি, রবিশশী, সসহর, নির্বাণ, সহজ, শূন, তথতা, কান্ধ। দ্বিতীয় কাহ্নের রচনা বলিয়া যাহা মনে করি তাহাতে পাই—আলিকালি, জিনউর, এবংকার, সহজ, তথতা, দশবলরঅণ, তিশরণ, করুণা, শূন, তথাগত, মহাসুহ, জিণরঅণ, গঅণ।

কাহ্নের দোহাকোষের একটি পদ ও একটি পদার্ধের সঙ্গে দ্বিতীয় কাহ্নের একটি চর্যাগীতির (৪০) ভাবের মিল আছে।

আগম-বেঅ-পুরাণেঁ পণ্ডিআ মাণ বহন্তি।

পক্ক সিরিফলেঁ অলিঅ জিম বাহেরিঅ ভমন্তি॥

‘আগম বেদ পুরাণ লইয়া পণ্ডিতেরা অহঙ্কার করেন, যেমন ভ্রমর পাকা শ্রীফলের বাহিরে বাহিরে ঘুরিয়া বেড়ায়।’

সত্থাগম বহু পঢ়ই সুণই বড় কিম্পি ণ জাণই ॥

‘বহু শাস্ত্র আগম পড়ে শোনে, তবু মূর্খ কিছুই জানে না।’

এবংকার, দশবলরত্ন, ত্রিশরণ, তথাগত এবং জিনরত্ন—এই পাঁচটি পারিভাষিক শব্দ দ্বিতীয় কাহ্নের চর্যা ছাড়া আর কোন চর্যাগীতিতে পাওয়া যায় নাই। কাহ্নের দোহাকোষে “এবংকার” “তথাগত” ও “জিনরত্ন” আছে ।

এক কাহ্ন (কৃষ্ণাচার্য) হেবজ্রতন্ত্রের টীকা লিখিয়াছিলেন ‘যোগরত্নমালা’ নামে। গোবিন্দপালের ৩৯ রাজ্যাঙ্কে নকল করা ইহার একটি পুথি পাওয়া গিয়াছে। টীকাটি নিশ্চয়ই ঐ সালের অর্থাৎ ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে রচিত হইয়াছিল। এই কৃষ্ণাচার্য যদি চর্যাকর্তা হন তবে তাঁহার জীবৎকালের নিম্নতম সীমা দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ।

দ্বিতীয় (?) কাহ্নের একটি পদে ‘-ক’ বিভক্তি আছে, “ঠাকুরক” (১২)। এ বিভক্তির ব্যবহার চর্যায় বেশি পাওয়া যায় নাই।

তারনাথ এক কৃষ্ণাচার্যকে ডোম্বী হেরুকের, ১৮ আর এক কৃষ্ণাচার্যকে অর্বাচীন ইন্দ্রভূতির ১৯ শিষ্য বলিয়াছেন। জালন্ধরির শিষ্য ছিলেন বিরূপ কৃষ্ণাচার্য। ২০

কামলির একটিমাত্র চর্যাগীতি পাইয়াছি (৮)। তাহাতে পারিভাষিক শব্দ আছে এইগুলি,—সোন, করুণা, গণঅ, মহাসুহ। “কম্বলপাদ”-এর সংস্কৃত রচনা আছে। সেখানে নামান্তর “কলাচার্য” । সরহের দোহাকোষের টীকাকার অদ্বয়বজ্র ইঁহার রচিত পাঁচটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন। কম্বলাচার্যের নাম সম্বন্ধে একটি অলৌকিক আখ্যান দিয়াছেন তারনাথ। ২১

কামলি নামটি আসিয়াছে ‘কম্বলিক’ হইতে। বহু প্রাচীনকালে এক বিশিষ্ট আচার্য ছিলেন অজিত কেশকম্বলী নামে। আধুনিক কালে কালী কমলিওয়ালা বিখ্যাত নাম।

যে চর্যাটি মুনিদত্তের নির্দেশমত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ডোম্বী হেরুকের রচনা বলিয়াছেন তাহাতে (১৪) বলিতে গেলে কোন ভনিতাই নাই। শুধু ধ্রুবপদে আছে

বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা

সদ্‌গুরু-পাঅ পএ জাইব পুণু জিনউরা ।

মুনিদত্তের উক্তি অনুসারে (লাড়ী-) ডোম্বী নামে একজন সিদ্ধাচার্য চর্যাকর্তা ছিলেন।২২ তারানাথের মতে ডোম্বী হেরুক ছিলেন ত্রিপুরার রাজা। পরে ইনি কাহ্ন বিরূআর শিষ্য হন।২৩ ইনি রাঢ় দেশে অনেক কাল ছিলেন। ইনি মুনিদত্তের উল্লিখিত লাড়ী (বা লাঢ়ী) ডোম্বী হইতে পারেন। এক কৃষ্ণাচার্য আবার ডোম্বী হেরুকের শিষ্য ছিলেন। তিব্বতী ঐতিহ্যে দুইজন ডোম্বী। একজন আচার্য ডোম্বী, আর একজন ডোম্বী হেরুক। দুইজনেরই বহু রচনা আছে তিব্বতী অনুবাদে।

১৪ সংখ্যক চর্যাগীতি যাঁহার রচনা তিনি যোগী ছিলেন। তাঁহার চর্যায় পারিভাষিক শব্দ আছে এইগুলি–গঙ্গাযমুনা, মাতঙ্গী, ডোম্বী, জিণউর, গঅণ, চান্দসুজ্জ।

একটি চর্যাগীতির (১৬) রচয়িতা মহিণ্ডার নাম পাঠান্তরে পাই মহিত্তা, টীকায় পাই মহীধর, তারনাথের গ্রন্থে পাই মহিল। মনে হয় আসল নাম “মহিণ্ডা” কালক্রমে হইয়াছিল “মহিড়া” (তারানাথের “মহিল”)। টীকাকারের মহীধর সম্ভবত লোকব্যুৎপত্তি-জনিত। তিব্বতী ঐতিহ্যে ইনি মহীপাদ, আচার্য, কৃষ্ণের বংশধর। ইহার ‘বায়ুতত্ত্বদোহাগীতিকা’র তিব্বতী অনুবাদ আছে। ভনিতার ক্রিয়াপদ (“ভণন্তি”) সম্ভ্রমসূচক বলিয়া, মনে হয় চর্যাটি মহিণ্ডার কোন ভক্তের বা শিষ্যের রচনা। রচয়িতা কাহ্নের শিষ্যানুশিষ্য হইতে পারেন। ইহার চর্যার সঙ্গে কাহ্নের একটি চর্যার (৯) গভীর ভাবসাম্য আছে। মহিণ্ডা-ভনিতায় চর্যার এই পারিভাষিক শব্দগুলি পাই—অণহ, মার, গঅণ, গঅণগঙ্গা।

টীকাকারের অনুসরণে একটি চর্যা (১৭) অকারণে বীণাপাদের রচনা বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু ভনিতা বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি এমন কোন নাম চর্যাটিতে নাই। ধ্রুবপদে যে “বীণা” শব্দ আছে তাহাও সমাসবদ্ধ (“হেরুঅ-বীণা”)। চর্যাটিতে অনেকগুলি পারিভাষিক শব্দ আছে—সুজসসি, অণহা, অবধূতী, হেরুঅ, আলিকালি, সূন, সমরসসান্ধি, বুদ্ধ।

তিব্বতী ঐতিহ্যে আচার্য বীণাপাদ ছিলেন বিরুয়া বংশধর। ইনি লিখিয়াছিলেন ‘বজ্রডাকিনী নিষ্পন্নক্রম’। প্রাপ্ত চর্যাটিকে এই নিবন্ধের অন্তর্গত মনে করিতে পারি। তারনাথের বর্ণনা হইতে মনে হয় বীণাপাদ আর ডোম্বী হেরুক একই ব্যক্তি ।২৪

সরহের ভনিতায় চারটি চর্যা পাই (২২, ৩২, ৩৮, ৩৯)।২৫ চর্যাগুলিতে ধ্যানধারণার ও যোগের উদ্দেশ আছে যৌন- তান্ত্রিসাধনার ইঙ্গিত নাই। পারিভাষিক শব্দও বেশি নাই,—নাদবিন্দু, রবিশশী, বোহি, বিহার, হুঁভব-গণঅ, সহজ, সূন।

সরহ অনেকগুলি দোহা লিখিয়াছিলেন অবহট্‌ঠে। এগুলিতে প্রকাশ্য সাধনমার্গের উপদেশ বিবৃত। চর্যাগীতির মর্মার্থ গ্রহণে এই দোহগুলি বিশেষভাবে সহায়ক। সরহের দোহাগুলি একদা তিনটি “কোষ”-এ সঙ্কলিত ছিল। দোহাকোষের প্রাচীনতম পুথি ২৬ হইতে জানা যায় যে খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বেই সরহের অনেক দোহা লোপোন্মুখ হইয়াছিল এবং পণ্ডিত দিবাকর চন্দ সরহের দোহাগুলি যথাসাধ্য সঙ্কলন করিয়াছিলেন।২৭ এই পুথির শেষের কয়েকটি দোহা সংগ্রহকর্তা দিবাকর চন্দেরই রচনা। শেষে ইনি লিখিয়াছেন

জোহি বিণট্‌ট পণট্‌ঠপউ সোহিঅ অত্থ বুত্ত ।

সরহপাঅ-কিঅ দোহ-তিউ সো সংগহিও এত্থ॥

‘যাহা বিনষ্ট অথবা প্রনষ্টপদ তাহা শুদ্ধ করিয়া অর্থ উক্ত হইল। সরহপাদের কৃত দোহাত্রয়ী এইভাবে সংগৃহীত হইল।’

দিবাকর চন্দ ১১০১ খ্রীষ্টাব্দের পূর্ববর্তী অবশ্যই। সরহের দোহা নষ্ট হইতে যদি পঞ্চাশ বছর লাগিয়া থাকে তবে সিদ্ধাচার্য একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিদ্যমান ছিলেন। ইহাই সরহের জীবৎকালের নিম্নতম সীমা।

তিব্বতী ঐতিহ্যে সরহ “মহাযোগী”, “যোগীশ্বর”, “মহাশবর”, “মহাব্রাহ্মণ” ও “মহাচার্য”। তিব্বতী অনুবাদ হইতে ইহার অনেক রচনার নাম পাওয়া যায়। তাহার মধ্যে আছে ‘দোহাকোষ’ (মহাসমুদ্রোপদেশ, উপদেশগীতি, দ্বাদশোপদেশ, মর্মোপদেশ, তত্ত্বোপদেশশিখর), ‘চর্যাগীতি’ (ভাবনাদৃষ্টিগীতিকা), ‘কায়বাক্‌চিত্তমনসিকার’ । সরহের সংস্কৃত রচনাও আছে। তাহাতে প্রবীণতার পরিচয় প্রকট।

তারনাথ দুইজন সরহের উল্লেখ করিয়াছেন। এক সরহ ছিলেন শবরীপাদের সঙ্গে অভিন্ন। দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন আচার্য সরোরুহ। সরোরুহ বড় পণ্ডিত ছিলেন, কোন এক রাজার পুরোহিত। হাড়িনীর সঙ্গ করায় রাজা ইহাকে পরিত্যাগ করেন। ইঁহার গুরু ছিলেন অনঙ্গধজ্র।২৮

সরহ নামটি অত্যন্ত বিরল। প্রাকৃতে লেখা একটি জৈন গল্পে সরহ এক ব্যাধের নাম। নামটির মূল ‘শরভ’২৯ অথবা ‘সরঘ’৩০ হইতে পারে।

কাহ্ন ও সরহ ছাড়া আর শুধু তীলোপা-এর দোহাকোষ পাওয়া গিয়াছে। তীলোর নামে কোন চর্যাগীতি নাই। দোহাকোষে ভনিতা “তীলপা”। দুই-একটি দোহা সরহের কোষেও পাওয়া যায়। তীলো ও সরহ অভিন্ন হইতে পারেন। তাহা হইলে কি সরহ তৈলিক ছিলেন ?

দুইটি চর্যা (২৮, ৫০) মুনিদত্ত সিদ্ধাচার্য শবরপাদের নামে আরোপ করিয়াছেন। চর্যা দুইটিতেই “শবর” শব্দটি অনেকবার করিয়া আছে, “শবরী”ও আছে। কিন্তু কোনটিকেই ভনিতা অনুমান করিবার পক্ষে কিছুমাত্র যুক্তি নাই। নিঃসন্দেহ শবর ছদ্মনামে এক বা একাধিক প্রাচীন সিদ্ধাচার্য ছিলেন। সে নামে ‘সিতকুরুকুল্লাসাধন’৩১ পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু সেটি যে কোন এক শবরপাদের রচনা সে কথা বলা চলে না। ইহাতে সাপের বিষ ঝাড়ার একটি মন্ত্র উদ্ধৃত আছে বাঙ্গালা-অবহট্‌ঠ-সংস্কৃত মিশ্রিত ভাষায়। তাহাতে ভনিতা আছে “সবরপা” । সুতরাং এটি নিশ্চয়ই তাঁহার লেখা নয়, কোন ভক্ত অথবা সাম্প্রদায়িক শিষ্যের রচনা। মন্ত্রটি এই

তং কুরুকুল্লারূপ করি এহ্যগ্র ।৩২

অহণিসি বীঅ হন্তে দেহ্যগ্র ॥

গুরুবঅণে দিঢ় করি মাণহু।

ভণঅ সবরূপা বিসঢ়া করে হাণহু ॥

‘তুমি কুরুকুল্লারূপ ধরিয়া আগাইয়া আইস, অহর্নিশি বীজ হইতে (?) অগ্র (? উগ্র) দাও। গুরুবাক্য দৃঢ় করিয়া মানো। সবরপা বলেন, বিষ চাপড়ে হানো।’

যে পুথিতে মন্ত্রটি পাওয়া গিয়াছে তাহার লিপিকাল ১১৬৫ খ্রীষ্টাব্দ। ইহাই শবরপাদের জীবৎকালের সম্ভাব্য নিম্নতম সীমা।

শবরীপাদ বা শবরীশ্বরের নামে অনেক রচনার অনুবাদ তিব্বতীতে আছে। দুইটি নিবন্ধের মূল পাওয়া গিয়াছে সাধনামালায়,–একটি পূর্বে উল্লিখিত ‘সিতকুরুকুল্লাসাধন’, আর একটি ‘বজ্রযোগিনী-আরাধনবিধি’।

তারনাথের মতে মহাসিদ্ধ শবরীর নামান্তর সরহ। ইনি লুইপাদের গুরু ছিলেন।৩৩

ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রে “শবরী” ও “পর্ণশবরী” চণ্ডী-দুর্গার রূপান্তর।

চর্যা দুইটিতে শবর-শবরীর বিরহমিলনের কথা যে ভাবে ব্যক্ত তাহাতে কাব্যরসের সঞ্চার হইয়াছে। (আসলে চর্যা দুইটিতে লোকসাহিত্যের গাঢ় প্রতিফলন লক্ষিত হয়। পানোন্মত্ত শবর-শবরীর নৃত্যের চিত্র পাহাড়পুর মন্দিরের ভগ্ন ভিত্তিগাত্র হইতে পাওয়া গিয়াছে।) এই চর্যায় শবর-শবরী কোন সিদ্ধাচার্য অথবা ডাক-ডাকিনীর প্রতিচ্ছবি নয়, বজ্রধর-ডোম্বীর অর্থাৎ হেরুক-নৈরাত্মযোগিনীর চর্যারূপ বা নটভূমিকা। চর্যা দুইটিতে সেকথা স্পষ্ট করিয়াই বলা আছে। চর্যা দুইটির পদসংখ্যা বেশি এবং গঠনেও অসাধারণত্ব।

বজ্রধর শবরের উচ্চ উচ্চ পর্বতবাসের ইঙ্গিত আছে কাহ্নের দোহায়

বরগিরিসিহর উত্তুঙ্গ মুণি সবরেঁ জহিঁ কিঅ বাস

ইহার সঙ্গে তুলনীয় চর্যা-ছত্র

– গিরিবরসিহর-সন্ধি পইসস্তে সবরো লোড়িব কইসে। (২৮)

সরহের দোহায়

জোইণি-গাঢ়ালিঙ্গণহি বজ্জিল লহু উবসন্ন ।

চর্যাগীতিতে

মহাসুহে বিলসস্তি শবরো লইয়া সুণ-মেহেলী । (৫০)

সুন-নৈরামণি কণ্ঠে লইআ মহাসুহে রাতি পোহাই। (২৮)

সবরো ভুজঙ্গ ণইরামণি দারী পেহ্ম রাতি পোহাইলী। (২৮)

চর্যা দুইটিতে পারিভাষিক শব্দ পাই এইগুলি—সহজ, তিঅ-ধাউ, নৈরামণি, গিরিবরসিহ্‌রসান্ধি, গণঅ, সুণ, খসম, মহাসুহ ।

আজদেবের একটিমাত্র চর্যা মিলিয়াছে (৩১)। তিব্বতী ঐতিহ্যে ইনি “মহাচার্য” এবং ‘কাণেরিগীতিকা’ ও ‘চর্যামেলায়নপ্রদীপ’ রচয়িতা। শেষের নিবন্ধটি চর্যাগীতির ব্যাখ্যা হইতে পারে। আজদেবের চর্যাটিতে পারিভাষিক শব্দ চারটি মাত্র—করুণা, ণিরালে, চিঅ, সুণ। সিদ্ধাচার্যের নাম ছিল আর্যদেব, কিংবা তাঁর নাম ছিল আর্য (>আজ), “দেব” কৌলিক পদবী অথবা সম্ভ্রমাত্মক (পাদের বদলে),—এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত করা যায় না।

“ঢেণ্ঢণ-পা” নামিত চর্যাটি (৩৩) কোন শিষ্য-ভক্তের রচনা নিশ্চয়ই। এটি বিশুদ্ধ প্রহেলিকা। ইহাতে কোন পারিভাষিক শব্দ নাই। চর্যাটির একটি আধুনিক রূপান্তর কবীরের ভনিতায় মিলিয়াছে।৩৪

তিব্বতী ঐতিহ্যে ধেতন (ঢেণ্ঢণের তিব্বতী রূপ) একজন সিদ্ধাচার্য এবং কাহ্নের বংশধর ধীটিক বা ধোকড়ির সহিত অভিন্ন। এ মত সমর্থনযোগ্য নয়। ধোকড়ি স্বতন্ত্র ব্যক্তি। ইহার সংস্কৃত রচনা হইতে ইহার গুরুসম্প্রদায়ের কোন নির্দেশই মিলে না।

চর্যাগীতির পুথিতে দারিকের একটি চর্যা (৩৪) পাওয়া গিয়াছে। আর একটি চর্যা (পরিশিষ্টে উদ্ধৃত*) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে এক লামার কাছে শুনিয়াছিলেন।৩৫ দুইটিরই ভনিতায় লুইয়ের উল্লেখ আছে গুরুর মতো। লুইয়ের চর্যায় যেমন এখানেও তেমনি ভনিতা দুইবার করিয়া । চর্যা দুইটিতেই যোগের কথা আছে, এবং তান্ত্রিকতার ইঙ্গিত স্পষ্ট নয়। সুণ-করুণা, গঅণ ও রবিশশী ছাড়া পারিভাষিক শব্দ নাই। দারিকের অনেক রচনা তিব্বতী অনুবাদে রক্ষিত আছে।

ভাদের (—চর্যায় নামটি “ভাবে”—) একটিমাত্র চর্যা (৩৫) মিলিয়াছে। তিব্বতী ঐতিহ্যে ইনি “আচার্য”, নামান্তর “ভাণ্ডারিন”। তিব্বতীতে ভদ্রচন্দ্র ভদ্রদত্ত ও ভদ্রবোধির নাম আছে। ইহাদের কেহ ভাদে হওয়া সম্ভব। ভাদের ‘সহজানন্দদৃষ্টিগীতিকা’র তিব্বতী অনুবাদ আছে। সম্ভবত ইহা চর্যাগীতি কিংবা চর্যাগীতিকোষ। প্রাপ্ত চর্যাটিকে সহজানন্দদৃষ্টি-বিষয়ক বলা চলে। তারনাথ ভদ্রপাদকে জালন্ধরি এবং কৃষ্ণাচার্য দুইজনেই শিষ্য বলিয়াছেন।৩৬

ভাদে নামটি ‘ভদ্র’ অথবা ‘ভদ্রপাদ’ হইতে উদ্ভব হওয়া সম্ভব নয়। এখানে “-এ” বিভক্তি নয়, কেননা বাক্যে কর্তৃবাচ্যে (“ভাদে ভণই) ‘ভদ্রিক’ হইতেও আসিতে পারে না, কেননা ‘ইঅ’ (ভদ্রিক>ভদ্দিঅ>ভাদিঅ) ‘-এ’ হইতে পারে না। সুতরাং মনে করি যে নামটি ‘ভাব-দেব’ অথবা ‘ভাগদেব’ হইতে আসা বেশি সম্ভব। নতুবা “ভাবে” “ভাদো”-র অপপাঠ। (“ভদ্রোক” নাম তখনকার দিনে অচলিত ছিল না।)

ভাদের চর্যাটিতে তান্ত্রিকতার ছাপ নাই। পারিভাষিক শব্দ তিনটি মাত্র—চিঅরাঅ, গঅণ, বাজুলে।

তাড়কেরও একটিমাত্র চর্যা পাইয়াছি (৩)। তাড়কের সম্বন্ধে তিব্বতী ঐতিহ্যে আর কোন উল্লেখ নাই। “তাড়ক” ছদ্মনাম কিংবা উপাধি হওয়াই সম্ভব। নামটি আসিতে পারে সংস্কৃত ‘তাটঙ্ক’ ‘তাড়ঙ্ক’ হইতে (অর্থ—কর্ণাভরণ অথবা বাহুভূষণ)। তৎসম ‘তাড়ক’ শব্দও ছিল, অর্থ—খুনী, ফাঁসুড়ে। ভনিতা-পদের অর্থের সঙ্গে সংস্কৃত তাড়ক শব্দের এই অর্থ খাপ খায় ।

তাড়ক যে যোগী ছিলেন তাহা চর্যাটি হইতে জানা যায়। তিনি উদ্দিষ্ট শ্রোতাকে যোগী বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন। পারিভাষিক শব্দ আছে দুইটি মাত্র—মহামুদ্রা ও সহজ।

একটি চর্যা (৪৪) ছাড়া কঙ্কণের আর কোন রচনার সন্ধান পাওয়া যায় নাই। তিব্বতী অনুবাদে চর্যাগীতিরচয়িতা রূপে কঙ্কণের উল্লেখ আছে। সম্ভবত কঙ্কণ আরও চর্যা লিখিয়াছিলেন। তিব্বতী ঐতিহ্যে সিদ্ধা কঙ্কণ কম্বলাচার্যের বংশধর। কঙ্কণ নামটি ছদ্মনাম অথবা উপাধিসূচক (“কঙ্কণ” দ্বারা পুরস্কৃত কবি)। সদুক্তিকর্ণামৃতে (১২০৬) কঙ্কণ নামে এক কবির শ্লোক সঙ্কলিত আছে। মধ্যকালীন বাঙ্গালা সাহিত্যে “কবিকঙ্কণ” উপাধি একাধিক কবি-পণ্ডিতের ছিল।

কঙ্কণ যে বৌদ্ধ যোগী ছিলেন তাহা বোঝা যায় পারিভাষিক শব্দ হইতে,—সুন, সংবোহী, বোহী, বিন্দুনাদ, তথতা।

একটিমাত্র চর্যাগীতি (৪৬) ছাড়া জয়নন্দীর আর কোন রচনার সন্ধান মিলে না। তিব্বতী ঐতিহ্যে ইঁহার উল্লেখও নাই। চর্যাটি তান্ত্রিকতার ছায়াবর্জিত। যোগেরও স্পষ্ট ইঙ্গিত নাই। জয়নন্দী যে বৌদ্ধ ছিলেন সে অনুমান “তথতা” এই একমাত্র পারিভাষিক শব্দের উপর নির্ভর করিতেছে।

ধামের ভনিতায় চর্যা পাই একটিমাত্র (৪৭)। “চাটিল” নামযুক্ত চর্যাটিও (৫) ধামের রচনা বলিয়া মনে হয় ।৩৭ ধামের নামাঙ্কিত চর্যায় যোগের প্রক্রিয়া বর্ণিত । পারিভাষিক শব্দ বহু,—কমল, কুলিশ, সমযোগ, চণ্ডালী, ডোম্বী, সসহর, মেরুশিখর, গঅণ, পঞ্চনাল।

তারানাথ জালন্ধরির শিষ্যদের মধ্যে এক ধর্মের নাম করিয়াছেন। জালন্ধরি কিছুকাল চাটিগাঁয়ে ছিলেন।৩৮ তীলপা-এর দেশও তারানাথের মতে চাটিগাঁ।৩৯ সুতরাং “চাটিল” শব্দটির অর্থ যদি চাটিগাঁ-বাসী হয় তবে তা ইঁহাদের দুই জনের একজনকে নির্দেশ করিতে পারে।

পৃথির পাতা নষ্ট হওয়ায় তন্ত্রী বা তান্তির চটির (২৫) মূল পাওয়া যায় নাই। তবে ভনিতা ও শেষাংশের কয়েকটি শব্দ টীকায় উদ্ধৃত হইয়া রক্ষিত আছে। তীলপা-এর (তৈলিকপাদ) মত তান্তিও জাতিবৃত্তিবাচক নাম বলিয়া মনে হয়। ডোম্বীর মত ছদ্মনাম হওয়াও অসম্ভব নয়। তিব্বতী অনুবাদে “আচার্য তান্তিপাদের ‘চতুর্যোগভাবনা’ পাই। তারনাথের মতে “মহাসিদ্ধ” তান্তি জালন্ধরির শিষ্য ছিলেন।৪০

৩. টীকা ও তিব্বতী অনুবাদ

‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি’ যাহা নেপাল-দরবার গ্রন্থাগারে “চর্যাচর্যটীকা” নামে নথিভুক্ত এবং যাহা “চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়” নাম দিয়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছাপাইয়া ছিলেন তাহা মুনিদত্তের রচনা। এই সংবাদ তিব্বতী অনুবাদ হইতে পাওয়া যায়। তিব্বতী অনুবাদ হইতে আরো জানা যায় যে চর্যাগীতির ইহাই একমাত্র টীকা নয়। পণ্ডিত দীপঙ্কর ‘চর্যাগীতিবৃত্তি’ লিখিয়াছিলেন। আর্যদেবের ‘চর্যামেলায়নপ্রদীপ’ও চর্যাগীতির বৃত্তি বলিয়া মনে হয়। ‘চর্যামেলায়নপ্রদীপ’ বৃত্তির পঞ্জী লিখিয়াছিলেন আচার্য শাক্যমিত্র । মহাযোগী অজ (=আজ ?) মহাসুখচর্যাগীতির ও দোহাকোষের ব্যাখ্যা লিখিয়াছিলেন ‘অর্থপ্রদীপ’ নামে। তিনি নিজেই আবার অর্থপ্রদীপ তিব্বতীতে অনুবাদ করিয়াছিলেন।

তিব্বতীতে চর্যাগীতিকোষের অনুবাদ করিয়াছিলেন শীলচারী। মুনিদত্তের চর্যাগীতিকোষবৃত্তি অনুবাদ করিয়াছিলেন কীর্তিচন্দ্র (বা চন্দ্রকীর্তি)। শ্রদ্ধাকরবর্মা অনুবাদ করিয়াছিলেন আর্যদেবের চর্যামেলায়নপ্রদীপের।

এইসব অনুবাদ খ্ৰীষ্টীয় চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে করা হইয়াছিল বলিয়া পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। নিম্নতম সীমা ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ ধরিলে অন্যায্য হয় না।

৪. রূপ ও স্বরূপ

চর্যাগীতিগুলির নাম যে “চর্যা” এবং এগুলি যে গূঢ়ার্থবহ তাহা একাধিক চর্যাগীতিতে বেশ স্পষ্টভাবেই বলা আছে।

অইসন চর্যা কুক্কুরীপাএঁ গাইউ

কোড়ি-মঝেঁ একু হিঅহিঁ সমাইউ ॥

‘এমনভাবে চর্যা কুক্কুরীপা-এর দ্বারা গীত হইল, কোটিকে গোটিকের হৃদয়ে বোঝা গেল ।’

জো এথু বুঝই সো এথু বুধ।

‘এমন যে বোঝে সেই তো সুধী ।’

ঢেণ্ঢণ-পাএর গীত বিরলে বুঝই।

‘ঢেণ্টণ-পাএর গীত খুব কম লোকেই বোঝে।’

চর্যা শব্দটির মূল অর্থ ছিল (১) আচরণ, ব্যবহার, (২) ভ্রাম্যমানের গৃহীত বেশ, ভেক, নটবেশ। সজ্জিত নট অর্থে “চর্যাধর” কথাটি টীকাকার মুনিদত্ত অনেকবার ব্যবহার করিয়াছেন। নটের অভিনয়কেও যে চর্যা বলিত তাহা মাধব-আচার্যের কৃষ্ণমঙ্গল হইতে জানিতে পারি (“চরিয়া করেন নৃত্যকলা”)। সন্ন্যাসীর বা ভিক্ষুর আচরণবিধি অর্থে চর্যা শব্দের ব্যবহার বৌদ্ধ সাহিত্যে প্রচুর আছে। শান্তিদেবের শিক্ষাসমুচ্চয়ের ষোড়শ পরিচ্ছেদে ‘ভদ্রচর্যাগাথা’ হইতে কয়েকটি শ্লোক উদ্ধত হইয়াছে। আমাদের আলোচ্য চর্যাগীতিতে যোগিচর্যা এবং নটচার্য দুইই অন্তর্ভাবিত। সেই সঙ্গে বৌদ্ধতান্ত্রিক বজ্রধরচর্যাও আছে। কাহ্নের একটি চর্যায় (১০) আছে “তু লো ডোম্বী হাউ কপালী।” টীকাকার এখানে বলিতেছেন “হউ কাপালিকঃ চর্যাধুরশ্চ ।…অতএব তবান্তরেণ ময়া কৃষ্ণাচার্যেন ষট্‌তথাগতচক্রীকুণ্ডলকণ্ঠিকাদি নিরংশুচাং বিধৃত্য বাহ্যমন্ত্রনিরপেক্ষ্যতয়া পঞ্চবর্ণবিহরণং কৃতম্‌।”

চর্যাটির দশম ছত্রে যে “নটএড়া”-র উল্লেখ আছে তাহা নটচর্যাই নির্দেশ করে। কাহ্নের আর একটি চর্যার (১৯) ব্যাখ্যায় টীকাকার বলিয়াছেন “চতুর্থপদেন যোগিনীপ্রসাদাদ্‌ যোগীন্দ্রস্য চর্যামাহুঃ।”

চর্যাগীতি গান করা হইত। কি রাগে গাওয়া হইত টীকায় তাহার নির্দেশ আছে। রচয়িতার নামও প্রায় আছে। গানগুলির ছত্রসংখ্যা সাধারণত দশ। তিনটি চর্যার (১০, ২৮, ৫০) ছত্রসংখ্যা চৌদ্দ, একটির (২১) বারো এবং একটির (৪৩) আট । দ্বিতীয় পদটি সাধারণত ধ্রুবপদ। এইসব বিষয়ে জয়দেবের গানের এবং পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে চর্যাগীতির বেশ মিল আছে। তবে সাধারণত জয়দেবের গানে ছত্রসংখ্যা আট, বৈষ্ণব পদাবলীতে বারো কিংবা চৌদ্দ। চার ছত্রের (ভনিতাহীন) চর্যা গানের উল্লেখ এবং উদাহরণ মানসোল্লাসে (তৃতীয় খণ্ড পৃ ৪৭, ৬৪) আছে। এই রীতিই প্রাচীনতর মনে হয়। লুইয়ের চর্যাগীতি দুইটির প্রথম অংশ এই রকম চার ছত্রের চর্যাগান, তবে ভনিতাযুক্ত।

ভনিতার ব্যবহার চর্যাগীতিতে সব একরকম নয়। স্পষ্ট ভনিতায় ক্রিয়াপদ আছে। যেমন “ভনই” (১, ৪, ৬, ৭, ১২, ২৭, ২৯, ৩২, ৩৫, ৩৭-৪১, ৪৩-৪৭), “ভণন্তি” (৩, ১৬), “ভণথি” (২২), “ভনঅ” (২১), “ভণই” এবং “বোলথি” (২৬), “গাইউ” (২, ১৮), “বুলথেউ” (?) (১৫)। অস্পষ্ট ভনিতায় অনেক রকম প্রয়োগ। যেমন (১) নিজেকে প্রত্যক্ষ সম্বোধন (৮, ১৪, ৩০, ৪১); (২) নিজেকে প্রথম পুরুষে উল্লেখ এবং/অথবা সম্বোধন (৩, ৭, ৯-১১, ১৩, ১৯, ৩০, ৩১, ৩৪, ৩৬, ৪২), (৩) গুরুকে অথবা গুরুস্থানীয়কে নির্দেশ (৫, ৩৩)। চব্বিশটি চর্যায় শেষ পদে ভনিতা।৪১ চৌদ্দটি চর্যায় শেষ পদে এবং ধ্রুবপদে ভনিতা ।৪২ নয়টি চর্যায় ভনিতা শুধু ধ্রুবপদে।৪৩ একটি করিয়া চর্যায় শেষ পদে ও তৃতীয় পদে ভনিতা (১৩) এবং ধ্রুবপদে ও তৃতীয় পদে ভনিতা (৮)। দুইটি চর্যায় কোন ভনিতা নাই। এখানে “সবর” নামটি যদি ভনিতা বলিতেই হয় তবে উভয় চর্যায় তিনবার করিয়া আছে, ধ্রুবপদে এবং চতুর্থ ও শেষ পদে (৩৮), অথবা ধ্রুবপদে এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ পদে (৫০)। শেষ পদে ভনিতা দিয়াছেন কুক্কুরীপা, সরহ, বিরুআ, গুডরী, মহিণ্ডা, ঢেণ্ঢণ, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জয়নন্দী, ধাম, ভুসুকু (আটটির মধ্যে চারটিতে), কাহ্ন, (তেরোটির মধ্যে তিনটিতে), এবং শাস্তি (দুইটির মধ্যে একটিতে)। শেষ পদে এবং ধ্রুব (দ্বিতীয়) পদে ভনিতা দিয়াছেন লুই, দারিক, চাটিল, আজদেব, তন্ত্রী, ভুসুকু (আটটির মধ্যে দুইটিতে), এবং কাহ্ন (তেরোটির মধ্যে চারটিতে)। শুধু ধ্রুব (অর্থাৎ দ্বিতীয়) পদে ভনিতা দিয়াছেন ডোম্বী, বীণা (?), ভুসুকু (আটটির মধ্যে দুইটিতে) এবং কাহ্ন (তেরোটির মধ্যে পাঁচটিতে)।

৫. বজ্রগীতি

চর্যাগীতির অনুরূপ ছিল বজ্রগীতি। চর্যাগীতি উৎসবে ও অবসরবিনোদনে গাওয়া হইত, যেমন আধুনিক বাউল-কর্তাভজারা করে। বজ্রগীতি গাওয়া হইত গুহ্য যোগকর্মে ও তান্ত্রিক অনুষ্ঠানে, “মণ্ডলচক্র”-এ, আনুষ্ঠানিক স্তব-গান রূপে। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক ভৈরবীচক্রের পূর্বরূপ এই যোগিনীচক্র-অনুষ্ঠানে বজ্রগীতি গাহিয়া বজ্রসত্ত্ব হেরুককে জাগানো হইত। বজ্রগীতিও গান, তবে তাহাতে চর্যাগীতির মতো ভনিতা নাই। অর্থাৎ এ রচনা যেন কোন ব্যক্তি বিশেষের নয়, মন্ত্রের মতো অপৌরুষেয়। ভাষা বাঙ্গালা নয় তবে কাছাকাছি, অবহট্‌ঠ, অর্থাৎ চর্যাকর্তারা দোহাকোষে যে ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন তাহাই। একটি বজ্রগীতির নমুনা দিতেছি।৪৪

চার যোগিনী অনুনয় করিতেছে উদাসীন প্রণয়ী প্রভুকে প্রসন্ন করিবার জন্য। (যেন রাসে অন্তর্হিত কৃষ্ণকে গোপীরা ব্যাকুলভাবে ডাকিতেছে ।৪৫

কিচ্চে ণিচ্চঅ বিসাঅ-গউ

লোঅ ণিমন্তিঅ কাইঁ

তহ বত্তা ণ জই সম্ভরসি

উট্‌ঠহিঁ সঅল বিসাইঁ।

কজ্জ অপ্পাণ বি কবিঅ পিঅ

মা কর সুণ্ণ বিছিত্ত

ভব-ভঅ পড়িআ সঅল জণু

উট্‌ঠহি জোইণি-মিত্ত।

পুব্ব-পইজ্জহ সম্ভরসি

মা কর কাজ্জ-বিসাঊ

তই-অথ মিল্ল সঅল জণু

পতিঅঊ জগ অবসাউ ।

মিচ্ছেঁ মাণ বি মা করেহি পিঅ

উট্‌টহি সুণ্ণ-সহাব

কামহি জোইণি-বিন্দ তুই

ফিট্টউ অহবা ভাব ॥

কাজ যখন নিশ্চিত তখন কেন বিষাদগত হইলে, লোক নিমন্ত্রণ করিয়া ?

সে বার্তা না যদি স্মরণ কর সকলে বিষাদে উঠিবে।

নিজের কাজও করিতে হইবে, প্রিয়, শূন্যতা বিক্ষিপ্ত করিও না।

ভবভয়ে পড়িয়াছে সকল জন। উঠ, হে যোগিনী মিত্র।

পূর্ব প্রতিজ্ঞা স্মরণ কর, কার্য-বিষাদ করিও না।

তোমার তরে মিলিয়াছ সকল জন। জগতের অরসাদ দূর হইয়াছে।

মিছেই মান করিও না, প্রিয়। শূন্যস্বভাব তুমি, উঠ।

যোগিনীবৃন্দকে কামনা কর তুমি । ভাবাভাব দূর হোক॥’

৬. চর্যাগীতির বস্তু

চর্যাগীতির মধ্যে কতকগুলির বিষয় সোজাসুজি আধ্যাত্মিক। তাহাতে জন্মমৃত্যুর, উত্থানপতনের, সুখদুঃখের দোলা হইতে মুক্তি পাইবার ও সহজঅবস্থারূপ মহাসুখ-নিবাসে পৌঁছিবার ঠিকানা আছে, পরমার্থ সত্য উপলব্ধির জন্য গুরু-অনুগতির নির্দেশ আছে। কতকগুলি চর্যাগীতিতে তত্ত্ব-উপদেশ ও সাধনার ইঙ্গিত সম্পূর্ণভাবে ঢাকা দেওয়া হইয়াছে বাহ্য অর্থের অবগুণ্ঠনে। এই ধরণের চর্যায় এমন বহু শব্দ ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার আছে যাহার দুইটি করিয়া অর্থ—একটি অর্থ সাধারণের জানা অপর অর্থটি চর্যাকর্তাদের সাধনার পারিভাষিক, যেন তাঁহাদেরই প্রাইভেট কোড্‌। এইরূপ প্রহেলিকাবৎ দ্ব্যর্থ শব্দ ও প্রকাশরীতিতে সরহের দোহাকোষের “পঞ্জিকা”-রচয়িতা অদ্বয়বজ্র৪৬ এবং চর্যাগীতিকোষের টীকাকার মুনিদত্ত বলিয়াছেন “সন্ধ্যাভাষ (সন্ধাভাষ),”৪৭ “সন্ধ্যাভাষা,”৪৮ “সন্ধ্যাবচন,”৪৯ “সন্ধ্যাসংকে্‌ত,”৫০ অথবা “সন্ধ্যা ”৫১

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলিয়াছেন, “সহজিয়া ধর্মের সকল বইই সন্ধ্যা লেখা। সন্ধ্যা ভাষায় মানে আলো আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না”।৫২ একথা ঠিক নয়। “সন্ধ্যা” (বা “সন্ধা’) ভাষায় কোন সম্পর্ক নাই দিবারাত্রির মোহানার সঙ্গে। শব্দটিতে ‘ধ্যৈ’ (বা ‘ধা’) ধাতুর অর্থ প্রকট আছে। যে ভাষায় বা যে শব্দে অভীষ্ট অর্থ অনুধ্যান করিয়া অর্থাৎ মর্মংজ্ঞ হইয়া বুঝিতে হয় (সম্ + ধ্যৈ), অথবা যে ভাষায় বা শব্দে অর্থ বিশেষভাবে নিহিত (সম্‌ + ধা) তাহাই “সন্ধ্যা” (অথবা “সন্ধা”) ভাষা। একটি চর্যার (১২) ব্যাখ্যার প্রারম্ভে মুনিদত্তের উক্তিতে এই কথারই সমর্থন আছে । —“পুনরপি তমেবার্থং দ্যুতক্রীড়াধ্যানেন প্রকথয়ন্তি কৃষ্ণাচর্যাপাদাঃ।”

সন্ধ্যাভাষা যে বৌদ্ধ যোগীদের রচনারই বৈশিষ্ট্য ছিল এ দাবি তাঁহারা করেন নাই। অদ্বয়বজ্র এমনও বলিয়াছেন যে যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণেরা বৈদিক মন্ত্রের সন্ধ্যা-ভাষার্থ না জানিয়া পশু আলম্ভন করায় তাহাদের পাপ সঞ্চিত হয়। “তয়া শ্বেতচ্ছাগনিপাতনয়া নরকাদি দুঃখমনুভবন্তি। সন্ধাভাষমজানানত্বাৎ চ।”

সন্ধ্যাভাষার অর্থাৎ সন্ধ্যা-অর্থের কিছু উদাহরণ দিই।

লৌকিক অর্থমূল শব্দসন্ধ্যা অর্থ
স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণআলি-কালিপ্রশ্বাস-নিশ্বাস
চাঁদ (১)চন্দ্রপ্রজ্ঞা আদর্শ জ্ঞান (গ্রাহ্য)
সূর্যসূর্যঅদ্বয় বা সমতাজ্ঞান (গ্রাহক)
হরিণহরিণচিত্ত
হরিণীহরিণীজ্ঞানমুদ্রা
ডোমনীডোম্বীশুক্রনাড়িকা
ব’ড়ে (দাবা খেলার)বড়িআএক শত ষাট প্রকৃতি
দাবা খেলার ছকচউষট্‌ঠী কোঠানিমার্ণচক্র
নৌকানৌকামহাসুখকায়
গঙ্গা নদীগঙ্গাগ্রাহ্য
যমুনা নদীযমুনাগ্রাহক
কলপুলিন্দনপুংসক
শবর-জাতীয় পুরুষশবরব্রজধর, হেরুক
শবর-জাতীয় নারীশবরীদেবী নৈরাত্মা
চাঁদ (২)শশধরশুক্র
মূষিকমূষাচিত্তপবন
ব্রহ্মাবাহ্মবিষ্ঠানাড়ী
বিষ্ণুহরিমূত্রনাড়ী
শিবহরশুক্রনাড়ী
ইত্যাদি।

চর্যাগীতিতে, বিশেষ করিয়া সন্ধ্যাভাষিত চর্যাগীতিগুলিতে, সমসাময়িক তুচ্ছ নীচ সাধারণ জীবনের যে সত্য ছবি উঠিয়াছে তাহার তুলনা কোথাও নাই। এই চর্যাগীতিগুলিতে যে জীবনচিত্র ক্ষণোদ্‌ভাসিত তাহা দেবী-দেবার নয়, রাজা-উজীরের নয়, ব্রাহ্মণ-শূদ্রের নয়, ব্যাধ-বণিকেরও নয়। ইহাতে সাহিত্যের রীতিসিদ্ধ গতানুগতিক কারবার নাই। কোনরকম অতিশয়োক্তি নাই। সেকালে অখ্যাত অজ্ঞাত অতি সাধারণ লোকের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ও আচরণের বিন্বপ্রায় খণ্ড খণ্ড প্রতিরূপ থাকায় গানগুলি জীবনরসিক ঐতিহাসিকের কাছে মূল্যবান্ হইয়াছে।

সেকালে মদ তৈয়ারি হইত কেমন করিয়া, শুঁড়ির বাড়ী চেনা যাইত কিসে, সে দোকানে কেমনভাবে মদের পসরা দেওয়া থাকিত বেং খরিদদারই বা কেমন করিয়া দোকানে ঢুকিত তাহার ক্ষণিক অথচ পরিপূর্ণ ছবি পাই বিরূআর নামাঙ্কিত চর্যায়। গাছ ফাড়িয়া পাটা জুড়িয়া টানা দিয়া সাঁকো নির্মাণের উলেখ রহিয়াছে চাটিলের নামাঙ্কিত চর্যায়। ভুসুকুর দুইটি চর্যায় (৬, ২৩) সেকালের কালকেতুরা কিভাবে বন বেড়িয়া ডাক পাড়িতে পাড়িতে ঘাই-হরিণী ছাড়িয়া হরিণ শিকার করিত সে বর্ণনা রহিয়াছে । নিম্নবঙ্গে জলদস্যুরা হানা দিয়া সর্বস্ব লুট করিয়া ধনী গৃহস্থকে নিমেষে নিঃস্ব করিত, তাহার বর্ণনা দিয়াছেন ভুসুকু একটি চর্যায় (৪৯)। ইহা হইতে জানিতে পারি যে “মগ” অর্থাৎ জলদস্যুদের লুটেরা-পদ্ধতি বহুপুরাতন, পোর্তুগীস “হারমাদ” হইতে শুরু হয় নাই।

কাহ্নের একটি চর্যায় (১০) ডোমের জাতিবৃত্তি—তাঁতের কাজ, চাঙ্গারি বোনা ও নৌকা বাওয়ার এবং কাপালিকের নট-বৃত্তির উল্লেখ আছে। ডোমের পাড়া হইত লোকবসতির বাহিরে। কাপালিক যোগীর বেশভূষা আচরণেরও প্রায় নিখুঁত বর্ণনা পাই (১১)। আর একটি চর্যায় (১২) নয়বল অর্থাৎ দাবা খেলার প্রসঙ্গ আছে। এ খেলায় রাজাকে বলা হইয়াছে “ঠাকুর”। শব্দটি বিদেশী, তুর্কী। হয়ত চর্যায় বর্ণিত খেলার পদ্ধতিটি বিদেশ হইতে আসিয়াছিল।

একটি চর্যায় (১৯) কাহ্ন বিবাহ-যাত্রার যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহা প্রায় এখনকার দিনেরই মতো। কাড়া-নাকাড়া ঢাক-ঢোল বাজাইয়া বর বিবাহ করিতে চলিয়াছে । বিবাহে সে দামি যৌতুক প্রত্যাশা করে। বাসর ঘরে মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে সে রাত কাটায়। তারপর বর আর বধূকে ছাড়ে না। ডোমের মধ্যে প্রচলিত সাঙ্গার (বিধবা বিবাহের) ইঙ্গিত করিয়াছেন কাহ্ন দুইটি চর্যায় (১০, ১৩)।

চর্যাগীতিগুলিতে নদীমাতৃক বাঙ্গালা দেশের বহু ছবি পড়িয়াছে। নৌকার প্রসঙ্গ অনেক আছে। বিভিন্নপ্রকার নৌকার, ৫৩ নৌকার অবয়বের, ৫৪ দাঁড় ক্ষেপিয়া পাল তুলিয়া অথবা গুণ টানিয়া নৌকা বাওয়ার উল্লেখ বার বার পাওয়া যায় ।৫৫ নৌকায় পারাপারে তরপণ্য লাগিত কড়ি-বুডি,—তাহারও উল্লেখ আছে (১৪), এবং কড়ি নাই বলিলেও যে পারার্থীর নিস্তার ছিল না, তাহার গুহ্য অঙ্গ তল্লাসি করা হইত, তাহারও ইঙ্গিত আছে (৩৭)। রথ অর্থাৎ স্থলযানের তুলনায় নৌযানের শ্রেষ্ঠতা ঘোষিত হইয়াছে ডোম্বীর চর্যাটিতে (১৪)।

শান্তি একটি চর্যায় (২৬) তুলা ধোনার কথা আছে। তান্তির চর্যায় (২৫) ছিল মাদুর ও মোটা কাপড় বোনার বিবরণ। গতি পোষা, মাহুতের হাতি চালাইবার বিশেষ ধ্বনি বা শব্দ, পাগলা হাতির উদ্দামতা—ইত্যাদির উল্লেখ আছে কাহ্ণের (৯) ও মহিণ্ডার (১৬) চর্যায়। একতারার বর্ণনা আছে বীণাপাদের বলিয়া অনুমিত চর্যায় (১)। এখনো প্রায় এমনি গোপীযন্ত্র লইয়াই বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরা গান করিয়া বেড়ায়। শবর-শবরী চর্যা দুইটিতে (২৮, ৫০) সেকালের আদিবাসীদের জীবনচিত্র স্বল্পরেখায় কিন্তু নিখুঁতভাবে অঙ্কিত। টিলার উপর তাহাদের বাড়ী। বাড়ীর পাশেই কাপাস-ভুঁই। কাংনি-দানা ফসল উঠিলে হাঁড়িয়া তৈয়ারি করে এবং তাহা খাইয়া প্রমত্ত হয়। এই প্রমত্ততার চিত্ত পাহাড়পুরের ভগ্ন মন্দিরভিত্তিতে পাওয়া গিয়েছে।) শবরের মৃত্যু ঘটিলে পর তাহার সৎকারের যে বর্ণনা আছে তাহাও বাস্তব। ধনীর ঘরে আগুন লাগার বর্ণনা পাই ধামের চর্যায় (৪৭)। সৈন্য লইয়া অভিযান করিয়া পররাজ্য অধিকারের সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার বিবরণ রহিয়াছে। কুক্কুরীপা-এর নামাঙ্কিত একটি চর্যায় (৪৮)।

সেকালের সাধারণ ধনীর ঘরে যে পূজার জন্য দেব-প্রতিমা থাকিত তাহা বুঝিতে পারি ধানের চর্যাটি হইতে । রাজার তাম্রশাসন-দলিলের বলে ধনী গৃহস্থ ভূ-সম্পত্তি ভোগ করিত। ঘরে থাকিত সোনা-রূপার ভাঁড়ার (৪৯)। গৃহস্থের ঘরে চাষের জন্য বলদ ও দুধের জন্য গাই থাকিত। গাই দোহা হইত দিনে তিন বেলা (৩৩)। দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো—এই প্রবাদের প্রচলন তখনো ছিল (৩৯)।

শ্বশুর (“সসুরা”), শাশুড়ী (“শাসু”), ননদ (“ননন্দ”) ইত্যাদির সঙ্গে বউ (“বহুড়ী”) ঘর করিত। বাপ-মায়ের সঙ্গে শালীরও উল্লেখ আছে। সন্তান প্রসবের স্থান আঁতুড় (“আন্তউড়ি”)। আবশ্যক হইলে ঘরে চাবি-তালা (“কোঞ্চা তাল”) দেওয়া হইত। এখনকার মতোই ছিল পড়শী (“পড়বেষী”) লইয়া চালে চাল বসতি। তবে ডোম প্রভৃতি অনাচারী জাতি তফাতে থাকিত। নিদারুণ দারিদ্র্যের দুঃখ—“হাঁড়ীতে ভাত নাহি।”

বঙ্গদেশের (অর্থাৎ নিম্নবঙ্গের) সামাজিক ও আর্থিক জীবনের মান বেশ নীচু ছিল ।—“বাঙ্গালী” মানেই ছিল গরীব বেচারা (৩৯, ৪৯)।

এই কয়টি পরিধেয় অলঙ্কারের উল্লেখ পাই—বাজন-নূপুর (“ঘণ্টা-নেউর”), কাঁকণ (“কাঁঙ্কাণ”), মুক্তাহার (“মুত্তিহার”) এবং কুণ্ডল। আরশির (“দাপণ”) উল্লেখ আছে। বিছানা-পাতা খাটে শুইয়া বিলাসী পান (“তাঁবোলা”) খাইত কর্পূর (“কাপুর”) দিয়া।

বাসনপত্রের মধ্যে উল্লেখ পাই শুধু চারটির—হাঁড়ী, “পিটা” (দুধ দুহিবার পাত্র), “ঘড়ি” (ঘড়া) ও “ঘুড়ুলি” (গাড়ু)। হাতিয়ারের মধ্যে পাই—কুঠার, টাঙ্গি (?) এবং খন্‌তা (“নখলি”)। বাদ্যভাণ্ডের মধ্যে পাই—পটহ (“পড়হ”), মাদল (“মাদলা”), “করন্ড ”, “কসাল”। অন্য বাদ্য-যন্ত্র—ডমরু, (“ডমরুলি”, ছোট ডমরু), “বীণা” (একতারা), বাঁশি (“বংশা”)।

ধার্মিক লোকে আগম-পুথি পড়িত, কোশাকুশি লইয়া পূজা করিত এবং মালা জপ করিত (৪০)। বিদ্বান্‌ ব্যক্তির বিশেষ সম্মান ছিল (১৮, ৪৫)।

পথে-প্রান্তরে এবং জলযাত্রায় দস্যুভয় ছিল (৭, ৩৮)। নদীঘাটে এবং রাজপথে স্থানে স্থানে শুদ্ধ-সংগ্ৰকারী থাকিত। তাহারা ভয়ের পাত্র ছিল (১৫)। চোর ধরিবার জন্য দারোগা (“দুষাধী”) ছিল। থানা বা কাছারি ঘর ছিল, “উআরি” (১২)।

গ্রাম কথাটির নাম একেবারেই নাই, তবে নগর-নগরীর উল্লেখ আছে। সেকালের বাঙ্গালা দেশে নগর খুব কম ছিল, তাই উল্লেখযোগ্য বিবেচিত।

একটি চর্যায় শূন্যে-স্থিতি বাজি খেলার ইঙ্গিত আছে (৩১)।

চর্যাগীতিগুলি যে যে রাগে গান করা হইত তাহার নির্দেশ আছে টীকায়। তিব্বতী অনুবাদ হইতে দুইটি চর্যার (২৮, ৪৮) রাগ জানা গিয়াছে। রাগ অনুসারে চর্যার তালিকা এই,

পটমঞ্জরী ১২, গউড়া ৩, মালসী গউড়া ১, মালসী ১, মল্লারী ৫, গুঞ্জরী ৩, কুহু গুঞ্জরী ১, রামক্রী ২, দেশাখ ২, ভৈরবী ৪, কামোদ ৩, বরাড়ী ৪, শবরী ২, অরু ১, দেবক্রী ১, ধনসী ১, বঙ্গাল ১।

একটি লুপ্ত চর্যার তিব্বতী অনুবাদে ‘ইন্দ্রতাল’ নামটি মিলিয়াছে। ইহা রাগের নাম নয়, তালের নাম বলিয়া মনে করি

৭. ধর্ম ও সাধনা

ধর্মগীতিগুলি সবই “বৌদ্ধ” বলিয়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চিহ্নিত করিয়া গিয়াছেন। বাহির হইতে একথা মানিয়া লইতে বিশেষ বাধা নাই, কিন্তু আভ্যন্তর বিচারে চর্যাগীতির সবগুলিই যে বৌদ্ধ—তান্ত্রিক, সহজপন্থী, মন্ত্রপন্থী, বজ্রপন্থী যাহাই বলি না কেন—কোন যে একটিমাত্র সাধক-গোষ্ঠীর রচনা তাহা বলা যায় না। একটি চর্যায় “বুদ্ধ” আছে (“বীণা), তিনটিতে “তথতা” (কাহ্ন ৯, কঙ্কণ, জয়নন্দী), একটিতে “তথাগত” (কাহ্ন ১৩), একটিতে “স্কন্ধ” (কাহ্ন ৪২), তিনটিতে “বোধি” (চাটিল, সরহ ৩২, কঙ্কণ), একটিতে “সম্বোধি” (কঙ্কণ) ৫৬, সাতটিতে “নির্বাণ” (চাটিল, মহিণ্ডা, কাহ্ন ১৯, ৫৭ সরহ ২২, ভুসুকু ২৭, “শবর” ২৮, দারিক) ৫৮ বিশিষ্ট পারিভাষিক শব্দ “শূন্য”, “গগন”, “করুণা” ইত্যাদি অনেকেই ব্যবহার করিয়াছেন। দুইটি চর্যায় (১৭, ২৬) বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রধর হেরুকের নাম আছে। নৈরাত্মযোগিনীর নাম আছে দুইটি চর্যায় (২৮, ৫০) “নইরামণি” রূপে। তান্ত্রিক মহাযানের বহু পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ করিয়াছেন ভুসুক।

কতকগুলি চর্যাকে তান্ত্রিক অ-তান্ত্রিক কোন রকম বৌদ্ধ মতের সঙ্গে সংযুক্ত বলা চলে না (লুই ২৯, “কুক্কুরী-পা” ২, ৪০, বিরুআ, কাহ্ন ৪০, সরহ ৩৮, “শবর” ৫০, “ঢেণ্ঢণ-পা”, ইত্যাদি)। অনেকগুলি চর্যায় সম্বোধন করিয়াছেন (ডোম্বী, তাড়ক, ভুসুকু ২১, ৩০, ৪১, কাহ্ন ১০, ১১, ১৯, ৪২)। যোগিনী কথাটির অন্য অর্থ থাকিলেও কোন কোন চর্যাকর্তা ইহার দ্বারা সাধকের যোগমার্গ-সঙ্গিনীকে বুঝাইয়াছেন, তাহা ধরিয়া লইতে পারি (ডোম্বী, গুডরী, কাহ্ন ১৯)। সুতরাং চর্যাকর্তারা যে-মতাবলম্বী থাকুন না কেন তাঁহাদের অনেকেই যে তান্ত্রিক যোগপন্থী ছিলেন সে সিদ্ধান্ত অপরিহার্য। এই যোগপন্থায় কিছু বিশিষ্টতা ছিল। প্রথতে ইহাতে তান্ত্রিকতার ছোপ তেমন ছিল না, যোগচর্যার মধ্য দিয়া জন্মমৃত্যুর অতীত হওয়াই সাধকের উদ্দেশ্য। এ যোগসাধনায় দুষ্কর তপশ্চর্যার স্থান নাই, ইহাতে ইন্দ্রিয়ের সহজ বৃত্তির নিরোধ অনাবশ্যক। সাধকের কাম্য জন্মমৃত্যুর অতীত যে অবস্থা সে “সহজ” অর্থাৎ দ্বন্দ্বনির্মুক্ত বা নির্বিকল্প অবস্থা, তাহার প্রাপ্তি। সুতরাং সব দিক দিয়াই এই “সহজ” যোগপন্থার ‘সহজযান’ নামটি সার্থক। ভিন্নমতের দুষ্কর যোগমার্গের প্রতি কটাক্ষ আছে একটি চর্যায় (১৪)। সেখানে চর্যাকর্তা বলিয়াছেন,—তাঁহার উল্লিখিত সহজযান যেন নিকড়িয়া খেয়াপার, আর বহিরঙ্গ যোগীরা যেন রথারোহী তাই নদী পার হইবার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় তাহারা কেবলি ঘাটে ঘাটে ঘুরিয়া ফিরিয়া মরে।

চর্যাকর্তাদের শিষ্যানুশিষ্যদের মধ্যে তান্ত্রিকতার প্রসার বাডিয়াছিল। তবে চর্যাকর্তারা সকলেই যে তান্ত্রিকতার স্পর্শবর্জিত ছিলেন এমন কথা বলি না। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ সংস্কৃতে তান্ত্রিক-সাধনার বই লিখিয়াছিলেন। তবে একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে বৌদ্ধতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ—যেমন সৌভাগ্য প্রাপ্তি, বিদ্যা ও কবিত্ব লাভ, আরোগ্য, বিষাপনয়ন, দিব্যস্ত্রীসঙ্গ, দেবমনুষ্য-বশীকরণ, উচ্চাটন, মারণ, অষ্টসিদ্ধিলাভ ইত্যাদি যে সব ঐহিক কামনাপূরণ—তাহার কোন ইঙ্গিত তো নাইই উপরন্তু সে সবের নিন্দা আছে। রসরসায়নকে উড়াইয়া দিয়াছেন সরহ এই বলিয়া,—যাহার এখানে জন্মমৃত্যুর ভয় আছে সেই রসরসায়নের জন্য আকাঙক্ষা করুক (২২)।

চর্যাকর্তাদের মতে অধ্যাত্মসাধকদের এই মন্ত্রতন্ত্রের ক্রিয়া ছিল বাহিরের আচরণের সামিল, যেমন দেবপূজায় ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের পৌরোহিত্য করা। বৌদ্ধ-তান্ত্রিক আচার্যদের কোন কোন সাধননিবন্ধের শেষ শ্লোকে তাঁহাদের মনের কথাটির আভাষ পাওয়া যায়। লীলাবজ্রের শিষ্য করুণাবজ্র (বা করুণাচল) রচিত কুরুল্লাসাধনের শেষ শ্লোকটি প্রমাণরূপে উদ্ধৃত করিলাম।

এতৎ সাধনমুত্তমং ভগবতো লীলাশনেরাজ্ঞয়া

যৎ কৃত্বা করুণাভিধানকবিনা পূণ্যং সমাসাদিতম্‌।

তেনাস্তামতিনিষ্কলঙ্কবিমলপ্ৰজ্ঞোদয়স্ফারিতং

স্বচ্ছন্দপ্রসরপ্রভাস্বরমহাসৌখাপ্রতিষ্ঠং জগৎ ॥

‘ভগবান্ লীলাশনিব আজ্ঞায় এই যে উত্তম সাধন রচনা করিয়া করুণা নামক কবি যে পূণ্য প্রাপ্ত হইল তাহার দ্বারা জগৎ অতিনিষ্কলঙ্ক বিমল প্রজ্ঞার উদয়ে বিস্ফারিত হইয়া স্বচ্ছন্দ ও সর্বব্যাপী প্রভাস্বর মহাসুখে প্রতিষ্ঠিত হোক।’

মন্ত্রতন্ত্রের এই যে সাধন—সাধনা নহে, —ইহারই নাম ‘মন্ত্রনয়’, ‘মন্ত্রমার্গ’ বা ‘মন্ত্রযান’ । যিনি এমন সাধনের সাধক তিনি হইলেন “মন্ত্রী”। মন্ত্রযানে সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে মন্ত্রী যোগবেত্তা হন এবং বজ্রযান-পথে অগ্রসর হইতে পারেন।

ইত্থমহর্নিশং মন্ত্রী ভাবয়েদ্‌ যস্তু যোগবিৎ।

স প্রাপ্নোত্যচিরাদ্‌ বোধিং বজ্রযানপ্রবর্তিনীম্‌ ॥৫৯

বজ্র হইল অমোঘ অস্ত্র। এই অর্থেই ‘বজ্রযান’ সম্যক্‌সম্বোধিপ্রাপ্তির অমোঘ উপায়।৬০ বজ্রযান লইয়া যায় বজ্রসত্ত্বতায়, অর্থা অটল অচঞ্চল সহজ অবস্থায় (“বজ্রগর্ভাভিসম্বোধিপদ”)। বজ্রযানিক সাধক-যোগীর মূল মন্ত্রই তাই

“ওঁ শূন্যতাজ্ঞানবজ্রস্বভাবাত্মকোহহম্।”৬১

বজ্রযানের পরিণতি সহজযান। বজ্রযানের সাধনার ইঙ্গিত অল্পস্বল্প মিলে। ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ভৈরবীচক্রের পূর্বরূপ যোগিনীচক্রের মতো গোপন অনুষ্ঠান এ সাধনায় ছিল। কিন্তু সহজযানের সাধনার কথা চর্যাকর্তারা খুলিয়া বলেন নাই, স্পষ্ট ইঙ্গিতও দেন নাই। তাঁহারা পুনঃপুনঃ বলিয়াছেন যে এ মার্গের খবর গুরু-নির্দেশলভ্য, এবং সে নির্দেশ যে বচনশ্রবণগম্য তাহা নয়। সহজ অবস্থায় পৌঁছিলে ভাবও নাই অভাবও নাই, সেখানে হাঁ-না এক হইয়া যায়। সুতরাং ‘আইস সংবোহেঁ কো পতিআই” ? এখানে রবীন্দ্রনাথের গানের ছত্র মনে পড়ে।

সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি,

কাছের জিনিস দূরে রাখে, তার থেকে তুই দূরে রবি ।

চর্যাকর্তাদের যোগপন্থায় কিছু কিছু মতভেদ ও মার্গভেদ ছিল বলিয়া মনে হয়। কাহ্নের ভনিতাযুক্ত কোন কোন চর্যায় কাপালিক (বা কাবাড়ি) যোগীর কথা আছে। এক (“বিরূপ”) কাহ্ন নিজেকে কাপালিক (বা কাবাড়ি) যোগীর দলে ভিড়াইয়া ডোম্বীকে সাধনসঙ্গিনী রূপে কামনা করিয়াছেন। সম্ভবত এ সবটাই রূপক। তবে সাধারণ অর্থ একেবারে উপেক্ষা করিতে পারি না। কাপালিক (বা কাবাড়ি) যোগীর বেশ-ভূষা-আচরণের বর্ণনা নিখুঁতভাবে দেওয়া হইয়াছে যে চর্যায় (১১) তাহার ঠিক আগের চর্যার “কাপালি জোই” ও ডোম্বী যেন পরবর্তী কালের বাঙ্গালা সাহিত্যে শিব-শক্তির লৌকিক রূপ পূর্বাভাসিত করিয়াছে। শিব নিঃস্ব (“কাপালী”) যোগী। তিনি হাড়ের মালা (সতীর অস্থি) পরেন। আর শক্তি ডোমনী বা কোচ-নারী হইয়া নদীতে খেয়া দেন এবং শিবকে ভুলাইয়া যোগভ্রষ্ট করেন। যে সরোবর ঘাঁটিয়া তিনি মৃণাল খান, যে চৌষট্টি-দল পদ্মে চড়িয়া বেচারা ডোমনী নৃত্য করে তাহাতেই মনসার উৎপত্তি। এখানে শৈব যোগীদের সঙ্গে বৌদ্ধ যোগীদের এবং চর্যাগীতির সঙ্গে পরবর্তীকালের শিবসঙ্গীতের যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায় ।

কাহ্নের একটি চর্যায় জালন্ধরিপা-এর নাম আছে। মীনচেতনগোরক্ষবিজয়-গোপীচন্দ্রের গানে কানুপা জালন্ধরির শিষ্য। জালন্ধরির নামান্তর হাড়িপা। কাহ্নের হাড়ের মালা গ্রহণে কি এই হাড়িপার শিষ্যত্বের ইঙ্গিত ?

শুধু কাহ্ন-কাপালিকের চর্যায় নয়, অন্যত্রও নাথ-পস্থার সঙ্গে চর্যাকর্তাদের যোগ-পন্থার সংযোগের চিহ্ন লক্ষিত হয়। সদ্‌গুরু অথবা পরমগুরু বুঝাইতে “নাথ” কথাটি চর্যাগানে এবং দোহাকোষে পাওয়া যায়।৬২ নাথপন্থ নিরীশ্বর এবং গুরু-উপদেশগম্য, চর্যা-পস্থাও তাই। নাথ-পন্থের সাধনা ভাণ্ডে-ব্রহ্মাণ্ডে মিলাইয়া লইয়া ভাণ্ডকে অজরামর নিত্যরূপ দেওয়া। এ সাধনার ইঙ্গিত চর্যা-পন্থীদের গানে ও দোহায় অসুলভ নয়।

অম্ভে ন জাণসু অচিন্ত জোই

জাম মরণ ভব কইসন হোই ।

ভব জাই ণ আবই এথু কোই

আইস ভাবে বিলসই কাহ্নিল জোই ।

মোহবিমুক্কা জই মণা

তবেঁ তুটই অবণাগমণ ।

পবণ বহন্তে ণউ সো হল্লই

জলণ জলন্তে ণউ সো ডজ্‌ঝই।

ঘণ বরিসন্তে ণউ সো তিম্মই।

ণ উবজ্জই ণউ খঅহি পইস্‌সই. ॥

‘(সিদ্ধদেহে সহজাবস্থায়) বায়ু বহিলেও সে হেলে না, আগুন জ্বলিলেও সে জ্বলে না, মেঘ বর্ষণ করিলেও সে ভিজে না। সে না হয় উৎপন্ন না প্রবেশ করে ক্ষয়ে।‘

অবিনশ্বর দেহের নিত্যত্ব নাথ-পন্থে যেমন চর্যাপন্থায়ও তেমনি স্পষ্টভাবে স্বীকৃত। সরহ বলিয়াছেন, দেহের সদৃশ শুভ তীর্থ আর নাই ।

দেহ সরিসঅ তিত্থ মইঁ সুহ অণ্‌ন ণ দিট্‌ঠও।

নাথ-পন্থীদের সাধনায় বিশিষ্ট প্রতীক নাদ-বিন্দুর উল্লেখ দুইবার আছে চর্যাগীতিতে (৩২, ৪৪)। বিন্দু-রক্ষা নাথ ও চর্যা উভয় পন্থার সাধনায় সব চেয়ে কঠিন কাজ। কোন কোন চর্যাগীতির কবি যে ভাবে যোগিনীর বা ডোম্বীর সহিত সহবাসের ইঙ্গিত করিয়াছেন তাহা যদি পুরাপুরি রূপক কল্পনা না হয়—না হওয়াই বেশি সম্ভব, ৬৩ —তবে এখানে নাথ-মতের সঙ্গে চর্যা-মতের অত্যন্ত অনৈক্য মানিতে হয়। সিদ্ধগুরুর পক্ষেও নারীচর্যা নাথ-পন্থে একেবারে নিষিদ্ধ। মীননাথের যোগভ্রংশ-কাহিনী তাহার বড় প্রমাণ। নরকের দ্বার নারী—ইহা নাথ-ধর্মের আদি ও অন্ত্য উপদেশ । চর্যা-পন্থে এ সম্বন্ধে কোন নিষেধ নাই, বরং উচ্চতম সাধনায় নারীর সাহচর্য উপেক্ষিত নয়। সরহ বলিয়াছেন, যোগিনীর গাঢ় আলিঙ্গনে বজ্রসত্ত্ব ঝটিতি উপসন্ন হয়।

জোই-গাঢ়ালিঙ্গণহি বজ্জিল লহু উবসণ্ণ ।

কাহ্ন বলিয়াছেন, হে তরুণী, তোমার নিরন্তর প্রেম ব্যতিরেকে কি বোধি এই দেহে লাভ করা যায় ?

তো বিণু তরুণি ণিরস্তর নেহেঁ

বোহি কি লব্‌ভইঁ এণ-বি দেহেঁ ॥

চর্যা-মতের এই ধারাটি বাউলদের সাধনায় অব্যাহত রহিয়া গিয়াছে। চর্যা-সাধক বলিয়াছেন

কমল কুলিশ বেবি মজ্‌ঝ-ঠিউ জো সো সুরঅ-বিলাস ।

কো ত রমই ণহ তিহুঅণেহি কস্‌স ণ পূরই আস।

এই প্রসঙ্গে বলিয়া রাখি যে বাউল-সাধনার সঙ্গে চর্যাকর্তাদের সাধনার যোগাযোগের আরও সূত্র আছে। এই দুইটি বাউল ছড়ায় চর্যার পারিভাষিক শব্দ রহিয়াছে

টলে জীব অটলে ঈশ্বর, ৬৪

তার মধ্যে খেলা করে রসিকশেখর ॥

উঠন ঠনঠন করে রে ভাই ঘরে জলের ঢেউ

নৈরামণির নিরঞ্জনে পায় না খুঁজে কেউ ॥ ৬৫

এখন চর্যাকর্তাদের “বৌদ্ধ”ত্বের বিচার করি। আগেই বলিয়াছি যে, চর্যাকর্তাদের মধ্যে কেহ বুদ্ধ, তথাগত, তথতা, বোধি, নির্বাণ, শূন্য, করুণা, জিন ইত্যাদি বৌদ্ধমতের পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। ইঁহাদের দোহাতে পরমার্থ ও পরতত্ত্ব বুঝাইতে বুদ্ধ নামটিরও ব্যবহার আছে। তীলপা-এর দোহায় আছে,—বুদ্ধকে একমনে আরাধনা কর ।

বুদ্ধ আরাহহু অবিকল চিত্তেঁ ।

সরহ বলিয়াছেন, পণ্ডিতেরা সকল শাস্ত্র ব্যাখ্যান করে অথচ দেহে বুদ্ধ বাস করেন তাহা জানে না। জন্মমৃত্যু সে খাইতে পারে নাই, তবুও নির্লজ্জ হইয়া বলে, আমি পণ্ডিত।

পণ্ডিত সঅল সত্থ বক্‌ত্থাণই

দেহহিঁ বুদ্ধ বসন্ত-ন জাণই।

অবণাগমণ ণ তেন বিখণ্ডিঅ

তোবি ণিলজ্জ ভণই হউঁ পণ্ডিঅ ॥

তথাপি ইহাদের “বৌদ্ধ” বলিয়া মার্কা দেওয়া চলে না। কেন তাহা বলিতেছি।

সরহ তাঁহার দোহাকোষে সহজ-পন্থার উপদেশ দিবার আগে প্রথমে প্রচলিত ধর্ম ও সাধনার মতগুলির বিচার করিয়াছেন। তিনি এইগুলিকে ধরিয়াছেন, (১) ব্রাহ্মণ্যমত অর্থাৎ বেদবাদ ও বেদান্তবাদ, (২) “অইরিঅ” (অর্থাৎ আর্য) মত—মন্ত্রপূজাদি শৈব ও ভাগবত মত, (৩) ক্ষপণক অর্থাৎ জৈনমত এবং (৪) প্রধান দুই বৌদ্ধমত—সৌত্রান্তিক ও মহাযান। বৌদ্ধমত দুইটি নিরাস করিয়াছেন সরহ এই বলিয়া, ‘চেলা ও ভিক্ষু স্থবির-উপদেশে বন্দিত প্রব্রজ্যাবেশ ধারণ করে। কেহ সূত্রান্ত ব্যাখ্যানে নিবিষ্ট হয়। কেহ বা মাথায় হাত দিয়া চিন্তামগ্ন দৃষ্ট হয়, অপরে মহাযানে ধাবিত হয় । …ইহাদের একজনের দ্বারাও পরমার্থ সাধিত হয় না।’ সুতরাং চর্যাকর্তাদের বিধিমত বৌদ্ধ বলিতে পারি না।

সরহ-প্রমুখ সাধনতত্ত্বের মোটামুটি ব্যাখ্যা মিলে চর্যাকারদের দোহাকোষে। চর্যাগীতির তত্ত্বগত মর্মকথা দোহাকোষে যেমনটি পাই তাহার সারোদ্ধার করিয়া দিলাম।

ধ্যানে ধারণায়, গৃহবাসে বনবাসে, দেবপূজায় তীর্থস্থানে, তন্ত্রে মন্ত্রে নির্বাণ অথবা মোক্ষ লাভ করা যায় না। সেজন্য চাই সত্যদৃষ্টি। কাম্য যে সহজাবস্থা, তাহা সদ্‌গুরু-উপদেশলভ্য। সহজাবস্থা-প্রাপ্তির জন্য ইন্দ্রিয় নিরোধের দরকার নাই, সংসারের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার তাহা বিরুদ্ধ নয়। পাপপুণ্য, দুঃখসুখ, সত্যমিথ্যা, ভালোমন্দ, এমন কি জন্মমৃত্যু—সবই চঞ্চল চিত্তের, কালের, সৃষ্টি। গুরু-নির্দেশ সাধনার দ্বারা চিত্ত অচঞ্চল হইলে কালজয় ঘটে এবং “সহজ” অবস্থা প্রাপ্তি হয়। এ অবস্থায় দ্বৈত বা বিকল্পজ্ঞান নাই—“সহজ সহাব ণ ভাবাভাব” । এই সত্য সাধনার প্রথম সোপান আয়াস-বিশুদ্ধি, দ্বিতীয় সোপান অভিমাননাশ এবং চিত্তশুদ্ধি। তাহার পরের সোপনা চিত্তস্থৈর্য। চিত্ত স্থির হইলে দেহের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের বন্ধন টুটিয়া যায়। এইভাবে সমরস হইলে সহজাবস্থা-প্রাপ্তি। তখন সব ভেদাভেদ বিলুপ্তি।

জব্বেঁ মণ অত্থমণ জাই তণু তুট্‌টই বন্ধণ ।

তব্বেঁ সমরস সহজে বজ্‌জই ণউ সুদ্দ ণ বম্‌হণ ॥

‘যখন মন যায় মরিয়া, দেহ-(অভিমান) বন্ধন নাশ হয় তখন সমরস সহজে পৌঁছানো যায়। সে সাধনায় শূদ্র ব্রাহ্মণ অভেদ।’

সরহ বলিতেছেন, যদি কেউ সহজরসের রসিক হইতে চায় তবে সে চিত্ত (অর্থাৎ জ্ঞান-জ্ঞেয়) ও অচিত্ত (স্বভাবচ্যুতি) পরিহার করুক, শিশুর মতো থাকুক, আর গুরুবচনে দৃঢ় ভক্তি রাখুক।

চিত্তাচিত্ত বি পরিহরহু তিম অচ্ছহু জিম বালু।

গুরুবঅণেঁ দিঢ় ভত্তি করু হোই জই সহজ-উলালু ॥

সদ্‌গুরু-বোধে চিত্ত নিষ্ক্রিয় হইলে লোচন হয় অনিমিষ, তখন পবন হয় নিরুদ্ধ। পবন নিশ্চল হইলেই যোগী কালজয়ী ।

অনিমিস লোঅণ চিত্ত-ণিরোহেঁ

পবণহো বাজ্‌ঝই সিরিগুরু-বোহেঁ।

পবণ বহই সে নিচ্চলু জব্বেঁ

জোই কালু করই কিরে তব্বেঁ ॥

সহজে অবস্থিত যোগীর পক্ষে ঘরে থাকা আর বনে যাওয়া দুইই সমান। মনকে সে যেখানে সেখানে ছাড়িয়া দিতে পারে। সব কিছু সর্বদাই বোধিস্থিত, সুতরাং সংসার কোথায় নির্বাণই বা কোথায়।

‘ঘরহি ম থক্কু ম জাহি মণে জহি’তহি মণ পরিআণ

সঅলু নিরন্তর বোহি-ঠিঁউ কহিঁ ভব কহিঁ ণিব্বাণ ॥

তখন আর আত্মপর ভ্রান্তি নাই, কেননা—“সঅল নিরন্তর বুদ্ধ”।

৮. অনুবৃত্তি

চর্যাপদের সাধনার ধারা বাহিরের দিকে অবলুপ্ত হইলেও ভিতরে ভিতরে প্রবহমাণ ছিল।৬৬ সে সাধনার উত্তরাধিকারী ষোড়শ ও পরবর্তী শতাব্দীর রাগানুগ বৈষ্ণব ও মরমিয়া “সহজ” সাধকেরা। ইঁহাদের মধ্যে যে প্রাণী চর্যাগীতির স্মৃতি নিঃশেষে মুছিয়া যায় নাই তাহার প্রমাণ, একটি প্রায় অখণ্ড চর্যাগীতি৬৭ অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখা বাঙ্গালা পুথিতে কবীরের ভনিতায় পাওয়া গিয়াছে। ধর্মঠাকুরের গাজনের ছড়াতে চর্যাগানের ভগ্নাংশ রক্ষিত আছে। কায়-বৃক্ষ, গুরু-কাণ্ডারী ইত্যাদি রূপক বৈষ্ণব পদাবলীতে পুনরাবৃত্ত । কতকটা চর্যার ভাষায় এবং রীতিতে লেখা একটি গান পাওয়া গিয়াছে সেকশুভোদয়ায়। বইটি যোড়শ শতাব্দীর পরে লেখা, কিন্তু ইহার উপাদান অনেকটাই পূর্বতন রচনা হইতে আহৃত। গানটি দুই ডাকিনীর গীতিকা । ইহার মধ্যে চর্যাগীতির না হোক বজ্রগীতির গুঞ্জন শুনি ।৬৮

কীর্তন-গানের (বৈষ্ণব-পদাবলীর) গঠনে চর্যাগীতির সঙ্গে খুব ভিন্নতা নাই। কীর্তন-গীতপদ্ধতিতে চর্যাগীতপদ্ধতির অনুসরণ খুবই সম্ভাবিত। কীর্তনগান শুরু করেন শ্রীচৈতন্য, প্রথমে নবদ্বীপে শ্রীবাসের বাড়ীতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া । ইহা তিনি পাইলেন কোথা হইতে জানি না। কিন্তু এই ভাবেইতো তান্ত্রিক বা যোগপন্থী চর্যাসাধকেরা চর্যা ও বজ্রগীতি গাহিয়া মণ্ডল-উপাসনা বা হেরুক-সাধনা করিতেন। সুতরাং শ্রীচৈতন্য এখানে যে চর্যাসাধকদের প্রাচীন রীতিরই অজ্ঞাতসারে অনুসরণ করিয়াছিলেন তাহা মনে করিতে পারি । রাগানুগ সাধনায় যে তান্ত্রিক মহাযান সাধনার কিছু রেশ আছে সে কথা আগে বলিয়াছি। রাগানুগ সাধনার রাগাত্মিক পদাবলীতে চর্যাগীতির ধরণে সন্ধাভাষ ও প্রহেলিকাবিলাস লক্ষিত হয়। যেমন,

রূপ দু-আখর কাহারে বলে

রূপের বসতি কেমন স্থলে ।

নেত্র পক্ষ বলি যাহার নাম

তাহার মাঝারে রূপের ধাম।

তাহাতে আছয়ে পদ্মের কলি

শত অষ্টোত্তর দলেতে মেলি।

দুই দিগে তার সমান বয়

তাহার মাঝারে রূপ সে রয়।

মদনে মাদনে ছটায় তার

দেখিতে লালসা উঠয়ে যার।

এই তত্ত্ব জানে রসিক যে

রূপের মাঝারে পশিল সে।

সে সেই পাইবে রূপের দেখা।

কহে রামানন্দ মধুরে মাখা।৬৯

গানের সুরের পথে অধ্যাত্মসাধনা বৈষ্ণব ও সহজিয়া সাধকদের মধ্য দিয়া আসিয়া অষ্টাদশ শতাব্দীর কর্তাভজা-বাউলদের সাধনায় ও রচনায় একটি বিশেষ পরিণতি লাভ করিয়াছে। ভারতীয় সাধনার এই অপূর্ব রস কি জানি কেমনভাবে রবীন্দ্রনাথের মানসে ও বাচনে অনির্বচনীয় ও অভাবনীয় রূপ অভিব্যক্তি পাইয়াছে। সে কথা বর্তমান আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক মনে হইতে পারে, কিন্তু না বলিলে এই প্রাচীন সাধনার ও সাহিত্যধারার পক্ষে অবিচার হইবে । আর কিছু বলিব না, শুধু রবীন্দ্রনাথের একটি গান উদ্ধৃত করিব। চর্যাগীতির মর্ম যিনি বুঝিবেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানটির মহৎ তাৎপর্যও অনুভব করিবেন। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের গানটিকে অধ্যাত্মগীতি মার্কা দিবার আবশ্যকতা নাই।

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে,

দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি পেয়েছি আঁধার রাতে।

না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো ;

তাবি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগে;

তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে।

তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল,

বীণাবাদিনীর শতদলদলে করিছে তা টলমল ।

মোর গানে গানে পলকে পলকে

ঝলসি উঠিছে ঝলকে ঝলকে,

শান্ত হাসির করুণ আলোকে ভাতিছে নয়নপাতে ॥

নাথ-পন্থী ও গোরখ-পন্থী সাধকেরাও চর্যা-সাধনার ঐতিহ্য অনুসারী। ইঁহারাও গান করিতেন, তবে ইঁহাদের সাধনা গানের সুরের পথ বাহিয়া চলে. নাই। চর্যাগীতির চন্দ্র-সূর্য, গঙ্গা-যমুনা, দেহনগরী ইত্যাদি রূপক ও উৎপ্রেক্ষা ইঁহাদের রচনার সহিত চর্যাগীতির সংযোগসূত্রের মতো। নাথপন্থীরা গান লিখেন নাই, রচনা করিয়াছিলেন একটি মহাকাব্যোচিত আখ্যায়িকা—মীননাথ-গোরক্ষনাথ-জালন্ধরি ময়নামতী-গোপীচন্দ্র কাহিনী। আর লিখিয়াছিলেন শিষ্যসাধকদের শিক্ষার জন্য ছড়া ও প্রশ্নোত্তরময় ছোট ছোট কড়চা। বাঙ্গালী বৈষ্ণব সহজিয়ারাও এই ধরণের কড়চা রচনা করিয়াছিলেন। গোরখ-পন্থীদের ছড়ায় বিশেষ সাহিত্য বা সঙ্গীত রস নাই এবং তত্ত্বকথাও যাহা আছে তাহা সাধারণ পাঠকের অনধিগম্য ।

৯. ভাষা

সহজ বুদ্ধিতে বুঝিয়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাগীতির ভাষা বাঙ্গালা বলিয়াছিলেন। বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে বিচার করিয়া শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বাঙ্গালা বলিয়াই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন এবং ভাষাবিজ্ঞানীসব সে সিদ্ধান্ত মানিয়া লইয়াছেন। চর্যাগীতির ভাষায় কিছু কিছু শব্দ ও পদ আছে যাহা পরবর্তী কালের ভাষায় চলিয়া আসে নাই । এ গুলিতে সুনীতিবাবু শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাব দেখিয়াছেন এবং দুইটি ক্রিয়াপদ (“ভণথি,” “বোলথি”) মৈথিলী হইতে আগত বলিয়াছেন। এইখানেই গোলমালের সূত্রপাত। সুনীতিবাবুর ইঙ্গিত বুঝিতে না পারিয়া এবং নিজ নিজ প্রাদেশিক ভাষার গৌরব বাড়াইতে গিয়া বাঙ্গালার প্রতিবেশীরা এখন চর্যাগীতি লইয়া রীতিমত মামলা বাধাইয়াছেন। হিন্দীভাষী, মৈথিলীভাষী, উড়িয়াভাষী—ইঁহারা সবাই দাবি করিতেছেন যে চর্যাগীতির ভাষা হিন্দী, মৈথিলী এবং উড়িয়া, মোটকথা বাঙ্গালা নয়। (অসমিয়াভাষীদের দাবি অযৌক্তিক নয়, কেননা ষোড়শ শতাব্দী অবধি দুই ভাষায় বিশেষ তফাৎ ছিল না।) এই দাবিদারেরা জানেন না, কিংবা জানিয়াও জানেন না যে নবীন ভারতীয় আর্যভাষার প্রথম স্তরে সর্বত্র মোটামুটি একটা মিল ছিল, এবং এক আধটি শব্দ বা পদ লইয়া বিচার করিলে প্রথম স্তরের যে কোন ভাষাকে অপর ভাষা বলিয়া দেখানো খুব সহজ। “তেহনউ পিতা নগরী চালিউ আহীরহঁ সরিসউ ঘী বিক্রয় করিবা কারণি”—প্রাচীন গুজরাটী রচনা হইতে উদ্ধৃত এই বাক্যে “ঘী বিক্রয় করিবা” পদগুলি বিশুদ্ধ বাঙ্গালা, তাই বলিয়া কি সমস্ত বাক্যটিকে বা সমগ্র রচনাটিকে বাঙ্গলা বলিয়া দাবি করিব ? “বরি অহ্‌মে প্রাণ ছাড়ুঁ”—এ তো চর্যাগীতিরই ভাষা, কিন্তু পরের বাক্যাংশটি ধরিলে (“পণি এ নন্দিষেণইঁ নহীঁ পরিণউঁ”) প্রাচীন গুজরাটী বলিতেই হয়।

চর্যাগীতির বিষয়-পরিবেশ যে বাঙ্গালা দেশের তাহা আগে বিস্তারিতভাবে বলিয়াছি। চর্যাগীতির ভাষাও যে বাঙ্গলাই তাহা বোঝা যায় পদ, ইডিয়ম ও প্রবচন হইতে। শব্দরূপে ও ধাতুরূপে বাঙ্গলা ভাষার বিশিষ্ট বিভক্তি মিলিতেছে। যেমন ‘-তেঁ (তে)’ তৃতীয়ায় ; ‘-ত, তে (-তেঁ), -এ’ সপ্তমীতে; ‘-এর (-র)’ ষষ্ঠীতে ; ‘-রে (রেঁ)’ চতুর্থীতে ; ‘দিআ, সাঙ্গ’ যোগে করণ কারক ; ‘মাঝেঁ’ যোগে অধিকরণ কারক ; ‘-ইল’ অতীতকালে ; ‘-ইব’ ভবিষ্যৎকালে ; ‘-ইআ (-ইঅ), -ইলে’ অসমাপিকায় ; “গুণিআঁ লেহুঁ,” “দিল ভণিআ,” “লেহুঁরে জাণী,” “সড়ি পড়িআঁ”, “উঠি গেল,” “আখি বুঝিঅ,” “ধরণ ন জাঅ”,“কহন ন জাই”, “পার করেই”, “অহার কএল”, “নিদ গেল” ইত্যাদি ইডিয়মে ; “অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী”, “হাথেরে কাঙ্কাণ মা লোড় দাপণ”, “বর সুণ গোহালী কিমো দুট্‌ঠ বলন্দেঁ”, “হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী”, “বাণ্ড কুরুন্ড সন্তারে জাণী” ইত্যাদি প্রবচনে।

সুনীতিবাবু যে সব শব্দ ও পদ শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাবজাত বলিয়াছেন সেগুলি সূক্ষ্মবিচারে অবহট্‌ঠের ।৭০ যখন চর্যাগীতি রচিত হইতেছিল তখন অবহট্‌ঠ সমগ্র আর্যভাষী ভারতবর্ষের অন্যতম সাধুভাষা, সংস্কৃতের পরেই তাহার মর্যাদা। চর্যাগীতি-কবিদের মধ্যে অন্তত দুইজন সরহ ও কাহ্ন, এই সাধুভাষাতেই দোহা রচনা করিয়াছিলেন। চর্যাগীতির সঙ্গে মিলাইয়া পড়িলে দেখা যাইবে অবহট্‌ঠের সঙ্গে চর্যাগীতি ভাষার সম্বন্ধ কত নিকট। ছন্দ তো প্রায় একই। সুতরাং বাঙ্গালা ভাষার সেই শিশুকালে অবহট্‌ঠের শব্দ ও পদ না থাকাই বিস্ময়ের বিষয় হইত এবং চর্যাগীতির অকৃত্রিমত্বে সন্দেহ জাগাইত।

উদাহরণ দিয়া চর্যাগীতির ও দোহার ভাষার নিকট সম্পর্ক দেখাইতেছি।

চর্যাদোহা
জাহের বাণ-চিহ্ন রূব ণ জাণীঝাণ-বাহিঅ কি কী অই বাণে
সো কইসে আগম-বেএঁ রখাণী।জো অবাঅ তহি কাহি বখাণে।
জেবঁ বি লোঅর বান্ধনবজ্‌ঝন্তি জেণ বি জড়া
তেবঁ জি জোইর মেলণা ।লহু পরিমুচ্‌চস্তি তেণ বি বুহা।
নাদ ন বিন্দু ন রবি ন শশিমণ্ডলমস্ত ণ তন্ত ণ ধেঅ ণ ধারণ
চিঅরাজ সহাবে মুকল।সব্ববি রে বঢ় বিব্‌ভমকারণ।
কালেঁ বোব সংবোহিঅ জইসা।অন্ধো অন্ধ কঢ়াব জিম বেণ্ণবি কূব পড়েই।

চর্যাগীতির ব্যাকরণ বিচার করিবার সময় এ কথা মনে রাখা আবশ্যক যে বাঙ্গালা পুথিতে তৎসম বানানের সঙ্গতি প্রত্যাশিত নয়। (তদ্‌ভব ও অর্ধতৎসম শব্দের বানানে কখনই সঙ্গতি ছিল না। এখানে গোলমাল আছে হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরের আর তিন স-কারের ও দুই ন-কারের ব্যবহারে। অ-কার ই-কার ও এ-কারের মধ্যে বিপর্যয়ও কম নাই। বিশেষ লক্ষণীয় পদান্ত ই-কার স্থলে য়-কার বা অ-কার লেখা। যেমন—জাই, জায়, জাঅ।.পদাদিতে সাধারণত জ কারই দেখা যায়, কদাচিৎ য-কার। ‘ম্‌হ’ এই যুক্ত ধ্বনিটি ‘ম্‌ভ’ এবং ‘হ্‌ম’ এই দুইরূপেও মিলে। চন্দ্রবিন্দুর স্থানচ্যুতি অথবা লোপ বিরল নয়।

চর্যাগীতির পুথি বাঙ্গালা অক্ষরে লেখা, লিপিকাজ বাঙ্গালা দেশে হইয়াছিল বলিয়া অনুমান করিতে পারি। লিপিকরের (অথবা লিপির) কিছু ত্রুটি আছে। তাহার মধ্যে প্রধান হইল, ‘উ’ ও ‘ড’ একই রকম দেখিতে। এই ত্রুটির জন্য শাস্ত্রী মহাশয়ের পাঠ স্থানে স্থানে বেঠিক হইয়াছে। ‘উ’ এবং ‘তু’ও অনেক সময় একরকম দেখা যায়। এখানে মনে হয় পুথির অক্ষর অংশত উঠিয়া গিয়াছে অথবা ক্ষীণ বলিয়া ফোটো চিত্রে উঠে নাই। দ্বিতীয় ত্রুটি,—লিপিকর প্রায় সর্বদা ‘ঢ’ লিখিতে ‘ট লিখিয়াছেন। কেবল একবার ‘ঢ’ পাইয়াছি, “দাঢা” (পত্রাঙ্ক ৬৪ক)। তৃতীয় ত্রুটি,-‘ড্ড’, ‘ড্‌হ’, ‘ন্থ’, ‘ড’ ও ‘ড়’—এই অক্ষরগুলির ব্যবহার কোন নিয়মের মধ্যে ফেলা যাইতেছে না। মূল পুথি ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিলে তবে হয়ত এ বিষয়ে কিছু কিনারা হইতে পারে।

চর্যাগীতির ভাষায় লিঙ্গরীতি মোটামুটি অবহট্‌ঠের মতই। তবে নামপদে ক্লীবলিঙ্গ (অবহট্‌ঠে ‘-উ’-অন্ত কর্তা-কর্ম পদ) একেবারেই নাই। নিষ্ঠান্ত অতীতকালে স্ত্রীলিঙ্গ কত হইলে স্ত্রীপ্রত্যয়ের ব্যবহার আছে, কিন্তু সেখানেও বৈশিষ্ট্য দেখি। দোকাকোষের ভাষায় ‘-ত’ প্রত্যয়ান্ত অতীতে স্ত্রীপ্রত্যয় হয়। যেমন, “নিঅপাস বইট্‌ঠী জোইণি”। অথচ ‘ইল’ প্রত্যয়ান্ত বিশেষণে হয় না। যেমন, “পড়িল ভিত্তি”। চর্যাগীতিতে কিন্তু ইহার ঠিক বিপরীত। যেমন, “সোনে ভরিলী করুণা নাবী,” “সসি লাগেলি তান্তী” । ‘-এর’ বিভক্তিযুক্ত সম্বন্ধপদও স্ত্রীলিঙ্গের বিশেষণ হইলে স্ত্রী প্রত্যয় গ্রহণ করে। যেমন, “হাড়েরি মালী,” “তোহোরি ভাভরিআলী”। দোহাকাষে ইহার কোন উদাহরণ নাই। চর্যার ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গের সাধারণ বিশেষণেও স্ত্রীপ্রত্যয় দেখা যায়। যেমন, “অইসনি (?) চর্যা”,“নিশি অন্ধারী”।

বিশিষ্ট স্ত্রীপ্রত্যয় ছিল ‘-ই (ঈ)’ । এই সময়ে একটি বিশিষ্ট পুংলিঙ্গ (বা অ-স্ত্রীলিঙ্গ) প্রত্যয় ‘-আ’ উদ্‌ভূত হইয়াছিল। এটি সাধারণ শব্দে কর্তা ও কর্মকারকে দেখা যায় । যেখানে প্রাচীন পুংলিঙ্গ শব্দ জাতিবাচক হইয়া গিয়াছে সেখানে বিশেষ করিয়া পুরুষজাতীয় বুঝাইতে হইলে এই প্রত্যয় ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন, হরিণা, করিণা, শবরা।

চর্যাগীতির ভাষায় শব্দরূপে একবচন-বহুবচনের পার্থক্য নাই, ষষ্ঠী বিভক্তি ছাড়া স্ত্রীলিঙ্গ-পুংলিঙ্গেও তফাৎ নাই। সমষ্টিবাচক বহুবচন আছে। যেমন, পারগামিলোঅ, বিদুজণলোঅ, তুমে লোঅ।

উক্ত কর্তায় কোন বিভক্তি গোচর নয়। যেমন, কাল, লুই, রূব, সসুরা, বহুড়ী, ভব-ণই, বীরা, লোঅ, জোঅ, জোইআ । অনুক্ত কর্তায় (ভাব ও কর্মবাচ্যে) বিভক্তি ‘-এ, ঐঁ । যেমন, কুম্ভীরে (খাঅ) ; চোরে (নিল) ; কুক্কুরীপাএঁ (গাইউ)।

মুখ্যকর্মে বিভক্তি গোচর নয়। যেমন, অপনা, পতবাল, রূপা, গুরু, ডোম্বী, কমলরস।

একই বিভক্তি (-এ, এঁ, -তেঁ, -তে, এঁতে) করণ ও অধিকরণে পাওয়া যায় । অধিকরণে অতিরিক্ত ‘-ত’ ও ‘-ই’ বিভক্তি দেখা যায়। বিভক্তি গোচর নয় এমন করণ ও অধিকরণ পদও আছে।

করণ : সুখদুখেতেঁ ; অপণে, সাণে, বেগেঁ, আলিএঁ কালিএঁ, ষিহেঁ যম ; সমাহিঅ (?), বাকলঅ। অনুসর্গ যোগে—দুজ্জণ-সাঙ্গে ; দিআঁ চঞ্চালী ; কূল লই, ষষহর লই ; লইয়া সুন-মেহেলী।

অধিকরণ : পাণ্ডি, অধরাতী, নিঅড়ি, দেহ-নঅরী ; ঘরে, তৈলোএ, তিঅ-ধাএ ; ঘরেঁ, হিঁএঁ ; সাঙ্কমত, গঅণত, দুআরত, হাড়ীত, বাটত ; হিঅহি ; দিবসই, আকাশই ; ইত্যাদি।

গৌণকর্ণের ব্যবহার কম। গৌণকর্মের বিশিষ্ট বিভক্তি হইল ‘-রে, -রেঁ, -ক’ এবং সম্ভবত ‘-কে’ । যেমন, রসরসানেরে, করিণিরেঁ, ঠাকুরক, নাশক ; মহিকে (?), বাহবকে।৭১

অপাদান : করণ ও অধিকরণের পদ অপাদানে ব্যবহৃত হয়। যেমন, “জামে (কাম কি) কামে (জাম)” ; “দশ দিসেঁ”; “কুলেঁ (কুল)”; “ডোম্বিত (আগলী”)। দুইটি পদে অবহট্‌ঠের ‘-হু’ বিভক্তি আছে,—খেঁপহু, রঅণহু। “খম্ভা ঠানা” মূলে ষষ্ঠী পদ হইতে পারে।

সম্বন্ধ পদের বিভক্তি হইতেছে—‘এর’ (অকারান্ত পদে সর্বদা, আকারান্ত ও ই(ঈ)কারান্ত পদে কখনো কখনো) ও ‘-র’ ; স্ত্রীলিঙ্গ হইলে ‘-(এ)রি’। যেমন, পাটের, হরিণার, হরিণির, হাডেরি (মালী), মহামুদেরী (কংখা), ডোম্বীএর, জোইর। অবহট্‌ঠের ‘-হ’ পাই দুইটি পদে, —খণহ, গঅণহ। ‘-আ’ পাওয়া যায় দুইটি পদে, —অপণা (মাংসেঁ), মাআমোহাসমুদা। সংশয়িত –‘ক’ বিভক্তি, দুইটি পদে পাই—ছান্দক, করণক। অন্যত্র-‘কর’ বিভক্তির স্ত্রীলিঙ্গ পদ একটি পাই, —আপণকরি (সখী)।৭২

সর্বনাম-রূপের উদাহরণ দিতেছি।

কর্তা : উত্তমপুরুষ-আম্‌হে, অম্‌ভে, অহ্‌মে, মো, হাঁউ।৭৩ মধ্যমপুরুষ—তুম্‌হে, তু, তো, তুমে লোঅ (বহু°)। প্রথমপুরুষ—জ, স, জো, সো ; জে ৭৪ তে ৭৪; সেব ; কেহো, কোবী, কিম্পি, কিষ, কীস, কাহি, কিমো ; এহু, এ। বিশেষণ—আইস ৭৫, জইসোঁ ৭৫, তইসোঁ ৭৫, অইসসি ৭৬, কইসণ, কইসণি ৭৬, কইসা, জইসা ; জেতই ৭৬, তেত ৭৬

অনুক্ত কর্তা : আম্‌হে, মইঁ, মো, ম, মোএ। তঁই।

কর্ম : মধ্যমপুরুষ—তো ; জা, তা, কা, কীস, কিম্পি, কি, জাসু।

করণ ; আম্‌হে, মই। তঁই, তোএ। ক্রিয়াবিশেষণ—জেঁ, জেঁণ ; কইসেঁ ; জবেঁ, তবেঁ।

গৌণকর্ম ; মকুঁ (?)। তোরেঁ, তোহোরে। কাহেরে : তোহোর অন্তরে।

অপাদান ; জথা, তথা। ৭৫

সম্বন্ধ : মোহোর, মোর, মোরি ৭৬, মেরি ৭৬, মো। তো, তোরা, তোহোর, তোহৌরি ৭৬। জা, জাহের, তাহের, কাহরি ৭৬ ; জাসু, জসু, তাসু, তসু।

অধিকরণ : এথু ; কহিঁ, তহিঁ ; কা।

সর্বনামজাত অপর ক্রিয়াবিশেষণ, —জিম, তিম, জবেঁ, তবেঁ।

বিভিন্ন কারকের অর্থে অনুসর্গের ও উপসর্গের প্রয়োগ আছে। যেমন, -অর্থে : ধামাৰ্থে। আন্তরে (গৌণকর্ম) : তোহোর আন্তরে (= তোমার জন্য)। মঝ, মঝেঁ, মাঝেঁ (অধিকরণ) : দুধ মাঝেঁ ; কোড়ি মঝেঁ ; মঝ বেণি। সম (করণ) : তোএ সম (তোর সঙ্গে)। সঙ্গে (করণ); ডোম্বীএর সঙ্গে ; দুজ্জণ সাঙ্গে। বিণা, বিহুনে, বিহুণেঁ, বিহুন্নে (= বিনা) : বিণা পাখেঁ ; নিন্দ বিহুনে। লই (করণ, গৌণ কর্ম) : কুল লই ; জা লই আছম। গই (অধিকরণ, অপাদান) ; কা গই।

ক্রিয়াপদে বর্তমান ও ক্কচিৎ ভবিষ্যৎ ছাড়া অন্যত্র কর্তৃবাচ্যের প্রয়োগ নাই। ক্রিয়ার কর্তা স্ত্রীলিঙ্গ হইলে ‘-ইল’ প্রত্যয়ান্ত অতীত এবং ‘-ইব প্রত্যয়ান্ত ভবিষ্যৎ কালের পদ স্ত্রীপ্রত্যয় গ্রহণ করে। ক্রিয়ার বিভক্তিতে একবচন-বহুবচনের ভেদ ছিল, কিন্তু প্রয়োগে প্রায়ই লুপ্ত।

বর্তমান কালের রূপ,

উত্তমপুরুষ : একবচন—আছম (= আছমি ?), পেখমি, জাণমি, চাহমি, পুছমি, জীবমি, লেমি। বহুবচন—আছহুঁ, করহুঁ, জাণহুঁ, দেহুঁ, খেলহুঁ, লেহুঁ, বিহরহূঁ, ষিঞ্চহূঁ।

মধ্যমপুরুষ : একবচন—আছসি (?), বুঝষি, গিলেসি, যাইসি, যাসি, অইসসি (= আইসসি), পুছসি, বাসসি। বহুবচন—জানহ, পরিমাণহ, ছেবহ, বিন্ধহ, ভুলহ।

প্রথমপুরুষ : একবচন—অচ্ছই, পেখই, ভণই, বাহঅ (= বাহই), জাগঅ (= জাগই), গটই, পইসই, বহুড়ই, বিহরএ (= বিহরই), আবয়ি (আঅই), হোই, বন্ধাএ, (= বন্ধাঅই), বসই, পতিআই, মরিঁআই, মরিঅই, বুঝই, জুঝই, দেখই, জাই, উইজঅ (= উইজই), উইএ (= উইঅই), ষামাঅ (= সামাই), হোই ; তুট (<তুটই), উহ (<উেহই), দে (<দেই), বান্ধ (<বান্ধই)। বহুবচন (গৌরবে)—ভণন্তি, বিলসন্তি, চাহন্তি কহন্তি, ভমন্তি, নাচন্তি, গান্তি, হোন্তি, ভণথি, বোলথি। কর্ম ও ভাববাচ্য—পাবিঅই, ভাবিঅই, মরিআই, করিঅই, খাই, খাঅ (= খাই), ছিজই, ছিজঅ (= ছিজই), জাই, বাজএ (= বাজই), সিঝএ (= সিঝই), লবএ ( = লঅই), বন্ধাবএ (= বন্ধাঅই), বিহরএ (= বিহরই), দীসই, দীসঅ (= দীসই), মাগঅ (= মাগই), তিমই, বাঝই।

পুরানো ভবিষ্যৎ কালের রূপ,

মধ্যমপুরুষ : হোহিসি, মারিহসি, দেসি (?)।

প্রথমপুরুষ : কহিহ (<কেহিহই), করিহ (<কেরিহই)।

অনুজ্ঞার রূপ,

মধ্যমপুরুষ : একবচন—অচ্ছ, পেখ, কর, বুঝ, বাহ, দেহ, চাল, পুচ্ছ, ভোল, ছাড়, জাণ, পরিমাণ ; হোহি, জাহী। বহুবচন—অচ্ছহু, হোহু, জাহু, লেহু, লাহু, সিঞ্চহু।

প্রথমপুরুষ : ভাব ও কর্মবাচ্য—জাইউ, করউ ।

নিষ্ঠা-প্রত্যয়ান্ত অতীত কালের পদে পুরুষ ও বচন বিভেদ নাই। এগুলি প্রায় সর্বদাই কর্মভাববাচ্যে ব্যবহৃত।

(১) পইঠঅ, পইঠো, পঁইঠা ; দিঠা, বিনঠা। (২) গাইউ, সমাইউ, কিউ, গই, অহারিউ, চটারিউ, চাপিউ, বিআপিউ, বিহলিউ, ণিবারিউ, থাকিই, বুড়িউ। (৩) ভইঅ, বুঝিঅ, মোড়িঅ, তোড়িঅ, কিঅ, করিঅ, সংবোহিঅ, লাইঅ, ছাড়িঅ। (৪) জানী, জাণী ; বাহী, বখাণী, বখানী, করী, পোহাই, ভই। (৫) মুণিআ, মারিআ, শুনিআ, গুণিআ। (৬) উইত্তা, তরিত্তা, পরিনিবিত্তা, ফরিত্তা, মিলিত্তা।

‘-ইল’ প্রত্যয়ান্ত অতীতকালের রূপ,

উত্তমপুরুষ : ভাব ও কর্ম বাচ্য—দেখিল, উভিল। কর্তৃবাচ্য—অচ্ছিলেসু, ফিটলেসু (?), । ভইলি, সুতেলি।

মধ্যমপুরুষ : অছিলেস।

প্রথমপুরুষ : নিলেসি, আইলেঁসি। আইল, আইলা; গেল, গেলা ; ভইলা, রুন্ধেলা, নিল, জিতেল, চলিল, মিলিল, পইঠে, মৌলিল, কএলা, সুতেলা, পড়িলা, ভাইলা । স্ত্রীলিঙ্গ—ভরিলী, মেলিলি, লেলী, লাগেলী, ছাইলী, পোহাইলী, ঘলিলি । অন্যত্র—কএলেক ; জালিলিক ।

-‘ইব’ প্রত্যয়ান্ত ভবিষ্যৎ কালের রূপ কর্মভাববাচ্যে, সুতরাং সব পুরুষেই এক। হোইব, কাহিব, লোড়িব, খাইব, করিব, করিবে (= করিব ?), ভাইব, জাইব, থাকিব, খাইব ; জাইবেঁ । দিবি (স্ত্রীলিঙ্গ)।

নিষ্ঠান্ত অতীত কালের পদ অতীত কালের অসমাপিকা রূপে ব্যবহৃত হয়। দুহি, গই, করী, পুচ্ছি, চড়ি, পইসি, চাপী, রুচি, ধুণি ; করিঅ, পুচ্ছিঅ, ফাড়িঅ, ধরিঅ, মারিঅ ; করিআ, লইআ, মারিআ, বহিআ, দেখইআ, বুঝিআ (= বুজিআ), বিবাহিআ। অন্যত্র—পিবিবি।

তুমর্থ অসমাপিকা : থোই ; বাহ্‌বকে (?) ; বোলবা।

শত্ৰৰ্থ অসমাপিকা ; অচ্ছন্তে, অচ্ছন্তেঁ পড়ন্তে, জান্তে, শুণন্তে, পইসন্তে, বুড়ন্তে, চাহন্তে, জাগন্তে।

ভাবার্থ অসমাপিকা : ভইলে, চঢ়িলে, পড়িলে, বুঝিলে, জীবন্তে, মঅলেঁ (= মইলেঁ)। শত্ৰৰ্থ অসমাপিকা ভারার্থেও ব্যবহৃত আছে।

সংখ্যা শব্দ : এক, একু ; দুই, দো, বেণি ; তিনি ; চউ (দিশ) ; পঞ্চ, পাঞ্চ ; দশ ; বতীশ ; তেতীসেঁ ; চউশঠী, চৌষঠ্‌ঠী ; কোড়ি।

১০. ছন্দ

চর্যাগীতিগুলি মোটামুটি তিন রকম ছন্দে রচিত। তিনটি ছন্দই অবহট্‌ঠ হইতে আগত। তবে অবহট্‌ঠ ছন্দের হ্রস্বদীর্ঘ-মাত্রা-সুদৃঢ়তা চর্যাগীতিতে নাই। অক্ষর এখানে মাত্রাসমতার দিকে খানিকটা আগাইয়া আসিয়াছে। অর্থাৎ চর্যাগীতির ছন্দ একদিকে অবহট্‌ঠ ছন্দ আর একদিকে বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ছন্দ, দুইয়ের মাঝামাঝি।

অধিকাংশ চর্যাগীতি যোল-মাত্রার পাদাকুলক-পজ্‌ঝটিকা-পদ্ধড়ী-চউপই ছন্দে লেখা। প্রায় প্রত্যেক গীতিতেই এমন ছত্র দুই একটি করিয়া আছে যেখানে চৌদ্দ-অক্ষর পয়ারের ধ্বনি অভ্রান্তভাবে শোনা যায়, বিশেষ করিয়া অন্ত্য ছত্রার্ধে। যেমন,

দৃঢ় করিঅ মহা-। সুহ পরিমাণ

লুই ভণই গুরু। পুচ্‌ছিঅ জাণ ।

লুই ভণই বট। দুলখ বিণাণা

তিঅ ধাএ বিলসই। ঊহ ন ঠাণা।

সসুরা নিদ গেল। বহুড়ী জাগই

কানেট চোরে নিল | কা গাই মাগই ।

দশমি দুআরত | চিহ্ন দেখইআ

আইল গরাহক | অপণে বহিআ ।

নগর বাহিরেঁ ডোম্বি | তোহোরি কুড়িআ

ছোই ছোই যাইসি | ব্রাহ্মণ নাড়িআ।

ইহার সহিত অবহট্‌ঠের ছন্দঃপাতন তুলনা করা যাইতে পারে।

অন্ত্য ছত্রার্ধের ষড়ক্ষরতা চর্যাকর্তাদের রচিত দোহার মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়।

ঘরে ঘরে কহিঅই | সোজ্‌ঝু কহাণা

ণউ পরি সুণিঅই | মহাসুহ ঠাণা ॥

সরহ ভণই জগ | চিত্তেঁ বাহিঅ

সো অচিত্ত ণউ | কেণবি গাহিঅ।

যোল-মাত্রার ছন্দের পরেই ছাব্বিশ-মাত্রার ত্রিপদী বেশি ব্যবহৃত। এ ছন্দের উৎপত্তি দোহা হইতে ।

সুনা পাস্তর। উহ ন দিসই ॥ ভাস্তি ন বাসসি জান্তে

এহ অট মহা। সিদ্ধি সিজ্‌ঝএ ॥ উজুবাট জাঅন্তে।

সরহের দোহাতেও দৈবাৎ এই ছন্দ আরও সুস্পষ্টরূপে মিলিয়ছে। যেমন,

ঘরবই খজ্জই। সহজেঁ রজ্জই ॥ কিজ্জই রাআ বিরাঅ

নিঅপাস বইট্‌ঠী । চিত্তে ভট্‌ঠী ॥ জোইণি মঝু পড়িহাঅ।

ছাব্বিশ-মাত্রার (১৪+১২) দোহা ছন্দে লেখা চর্যাগীতি পাই তিনটি।৭৭

মহারসপানে মাতেল রে। তিহুঅন সএল উএখী

পঞ্চ বিষয়ের নায়ক রে। বিপখ কোবী ন দেখী।

অবহট্‌ঠে দোহার উদাহরণ,

অক্‌খর বাঢ়া সকল জগু। ণাহি ণিরক্‌খর কোই

তব সে অক্‌খর ঘোলিআ । জাব ণিরক্‌খর হোই।

পাদটীকা

গায়কোয়াড় ওরিয়েন্টাল সিরিজে প্রকাশিত। তৃতীয় খণ্ড পৃ৪৭, ৬৪।

টীকাকারের (অথবা লিপিকরের) উল্লিখিত নাম বন্ধনীমধ্যে দেওয়া হইল। সংখ্যাগুলি চর্যার।

পুথির পাতা না থাকায় মুল পাওয়া যায় নাই। তিব্বতী অনুবাদ আছে।

মুল চর্যাগীতিকোষের বহির্ভূত *১ সংখ্যক চর্যাটিতে “দারক” ভনিতা আছে।

“ধামার্ধে চাটিল সাঙ্কম গটই” (=ধামের জন্য চাটিল সাঁকো গড়িতেছে)।

গ্র্যুনবেডেলের Edelsteinmine গ্রন্থের ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত কৃত সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, Mystic Tales of Taranatha পৃ ১১।

সাধনমালা (বিনয়তোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত) সাধন সংখ্যা ২৪০।

কুক্কুরীপা নামের প্রসঙ্গে সংস্কৃত উদ্ভট শ্লোকের “কুক্কুটপাদমিশ্রঃ” স্মরণে আসে। এই সঙ্গে যদি সত্যই নামটির কোন যোগ থাকে তবে বলিব কুক্কুরীপা আসিয়াছে সম্ভাব্য “কুক্কুটিপাদ” হইতে।

‘ছিন্নমস্তাসাধন’, ‘রক্তযমারিসাধন’ (সাধনমালা দ্রষ্টব্য)।

১০ তারানাথ প ১৪-১৬।

১১ ঐ পৃ ৩১।

১২ “গুঞ্জরীপাদানাং”। আসলে হইবে “রাগ গুঞ্জরী ধামপাদানাং।”

১৩ বৌদ্ধগান ও দোহার মুখবন্ধ দ্রষ্টব্য।

১৪ তুলনীয় “মাহুত” (<মহমাত্র)—হস্তী-চালক, হস্তী-আরোহী যোদ্ধা।

১৫ এসিয়াটিক সোসাইটির পুথি জি ৪৮০১।

১৬ পূর্বে দ্রষ্টব্য।

১৭ যোগী—যিনি হঠযোগ দ্বারা চিত্তবশ করেন। কাপালিক—যিনি বিচিত্র বেশ ও কপর্দধারী (‘কপর্দিক’) অথবা কপাল-ভিক্ষাপাত্রধারী নিঃসঙ্গ সাধক, কিংবা দুর্গত নীচ ব্যক্তি (আধুনিক “হাড়ি কাঁবাড়ি”)। লাঙ্গা (আধুনিক নাগা সন্ন্যাসী)—যিনি উলঙ্গ (“নিরশুচর্যা”) অথচ কর্ণকুশুল ইত্যাদি অলঙ্কারপরিহিত, মল্লবৎ বেশধারী, সাধক।

১৮ তারানাথ পৃ ১৭।

১৯ ঐ ৯।

২০ ঐ ৩১

২১ তারানাথ পৃ ২২-২৩।

২২ দশম চর্যার টীকার শেষ দ্রষ্টব্য।

২৩ তারানাথ পৃ ১৭।

২৪ তারানাথ পৃ ২১।

২৫ এই চর্যার মূলে “ভণন্তি”.টীকায় “ভণই”।

২৬ নেপাল-দরবারের পুথি, ২২১ নেপাল সংবতে (১১০১ খ্রীস্টাব্দে) নকল করা। প্রবোধচন্দ্র বাগচী কর্তৃক প্রকাশিত (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Journal of the Deartment of Letters, vol. xxviii, ১৯৩৫)।

২৭ একথা জানি পুষ্পিকা হইতে,

“সমস্তো জহালদ্ধো দোহাকোসো এসো সংগহিও পরত্বকামেন পণ্ডিত-সিরি-দিবাকর-চন্দেনেত্তি। সম্বৎ ২২১ শ্রবণ শুক্লপূর্ণমাস্যাং। শ্রীনোন্থলকে পরমোপাসক-শ্রীরামবর্ম্মকণঃ পুস্তকোয়ং। যথা দৃষ্টং তথা শাক্যভিক্ষুস্থবির-পথমগুত্তেণ লিখিতব্যম্‌।”

২৮ তারানাথ পৃ ১৯।

২৯ =অষ্টপদ প্রাণী অথবা কীট।

৩০ =মৌমাছি।

৩১ সাধনমালা ১৮৫।

৩২ প্রাপ্ত পাঠ “করিয়ে হ্যগ্র”।

৩৩ তারনাথ পৃ ১১।

৩৪ টিপ্পনী দ্রষ্টব্য।

৩৫ সাহিত্যপরিষৎ পত্রিকায় (১৩২৯) প্রকাশিত।

৩৬ তারানাথ প ৩২-৩৩।

৩৭ পূর্বে দ্রষ্টব্য।

৩৮ তারানাথ পৃ ২৮-২৯।

৩৯ ঐ পৃ ৩৩।

৪০ ঐ পৃ ৩১।

৪১ চর্যা সংখ্যা ২, ৩, ৪, ১৫, ১৬, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭, ৩২, ৩৩, ৩৫, ৩৭, ৩৯, ৪১, ৪৩, ৪৪, ৪৬, ৪৭, ৪৮।

৪২ চর্যা সংখ্যা ১, ৫, ৬, ৭, ১১, ১২, ২৫, ২৬, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৪, ৫১, ৫২।

৪৩ চর্যা সংখ্যা ৯, ১০, ১৪, ১৭, ১৯, ২৩, ৩৬, ৪৫, ৪৯।

৪৪ সাধনমালা ২৫৪।

৪৫ বৈষ্ণব তান্ত্রিকতায় বৌদ্ধ তান্ত্রিকতারই যেন এক রকমফের। রাসচক্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক ভৈরবীচক্রের মিল নাই, কেননা সেখানে একটিমাত্র ভৈরবী। মিল আছে বৌদ্ধ তান্ত্রিক যোগিনীচক্রের, সেখানে একটিমাত্র পুরুষ (হেরুক)।

৪৬ অদ্বয়বজ্রের শিষ্য ললিতগুপ্তের ‘শুক্লৈকজটাসাধন’ যে পুথিতে মিলিয়াছে তাহা ১১৬৫ খ্রীষ্টাব্দে নকল করা। অতএব অদ্বয়বজ্রের জীবৎকাল দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের পরে নয়।

৪৭ “যথা বালৈঃ সন্ধাভাষমজানদ্‌ভির্মনপবনাদিনিরোধমাশ্রয়ঃ কল্পিতঃ”; “সন্ধ্যাভাষাস্তরেহপি গৃহং শরীরং বনং ঘটপটাদিষু তত্র ন বোধিঃ” (অদ্বয়বজ্র)।

৪৮ “তমেব মহাসুখরাজানং স্বানন্দসবপানপ্ৰমোদমনসা কুক্কুরীপাদাঃ সন্ধ্যাভাষয়া প্রকটয়িতুমাহ” (মুনিদত্ত)।

৪৯ “বারুণীতি সন্ধ্যাবচনেন তদেব সংবৃতিবোধিচিত্তং বোদ্ধব্যং” (মুনিদত্ত)।

৫০ “দুলি সন্ধ্যাসঙ্কেতে বোদ্ধব্যম্‌” (মুনিদত্ত)।

৫১ “জ্ঞানপাপপ্রমত্তোহি সিদ্ধাচার্যমহীধরঃ চিত্তগজেন্দ্রসন্ধ্যয়া তমেবার্থং প্রতিপাদয়তি” (মুনিদত্ত)।

৫২ বৌদ্ধগান ও দোহার মুখবন্ধ পৃষ্ঠা [৮]।

৫৩ নাব, নাবী, নাবড়ি, ভেলা, বেণি।

৫৪ কেড়ুআল, খুন্টি, কাচ্ছি, মাঙ্গ, পিট, দুখোল, চকা, পতবাল, নাহী, গুণ।

৫৫ ৮(কামলি); ১০, ১৩ (কাহ্ন); ১৪ (ডোম্বী); ১৫ (শাস্তি); ৩৮ (সরহ); ৪৯ (ভুসুকু)।

৫৬ লুইয়ের একটি চর্যায় (২৯) “সংবোহে”.সম্ভবত ‘সম্বোধি’-জাত।

৫৭ একবার (৯) কাহ্ন “নিবিতা” ব্যবহার করিয়াছেন নির্বাণপ্রাপ্ত বুঝাইতে।

৫৮ কাহ্ন ও সরহ মৃত্যু বুঝাইতে “নির্বাণ” ব্যবহার করিয়াছেন (“ভব-নির্বাণে পড়হ মাদলা” ১৯; “অপণে রচি রচি ভব-নির্বাণ” ২২)।

৫৯ সাধনমালা ২২২।

৬০ “এষোহহমনুত্তরসম্যক্‌সম্বোধিমার্গমাশ্রয়ামি যদু বজ্রযানম্‌” (ঐ ১১০)।

৬১ ঐ ২৩৯।

৬২ “নাব ণ ভেলা দীসঅ ভস্তি পুচ্ছসি নাহা” (শাস্তি ১৫); “বিণ্ণবি বজ্জিঅ জো উবজ্জই, অচ্ছহ গিরিশুক্ল-ণাহ কহিজ্জই” (সরহ, দোহ); “সোহ বাজির-ণাহু রে ময়িঁ বুত্তো পরমত্থ” (কাহ্ন দোহ)।

৬৩ তুলনীয় সরহের দোহা

রুঅণেঁ সঅল বি জোহি ণউ গাহই

কুন্দুরু-খণহি মহাসুহ সাহই ।

৬৪ তুলনীয় কাহ্ন (২৮)

তই লো ডোম্বী সঅল বিটলিউ

কাজ ন কারণ সসহর টালিউ।

৬৫ বিজয়চন্দ্র মজুমদার মহাশয় সংগৃহীত।

৬৬ আমাদের আলোচ্য চর্যাগীতিগুলির পরেও চর্যাগীতি লেখা হইয়াছিল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন এমন কয়েকটি অর্বাচিন দোহা একটি পুথিতে তিব্বতে পাইয়া পাঠাইয়াছেন। স্পষ্টতই এগুলি অন্ধ অনুকরণ। দ্বিতীয় পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ড দ্রষ্টব্য ।

৬৭ তেত্রিশ সংখ্যক চর্যার টিপ্পনী দ্রষ্টব্য।

৬৮ “হঙ যুবতী পতিয়ে হীন” ইত্যাদি (সেকশুভোদয়া, এসিয়াটিক সোসাইটি, কলিকাতা ১৯৬৩) পৃ ১০১-২ দ্রষ্টব্য।

৬৯ বর্ধমান সাহিত্য সভার পুথি সংখ্যা ১৪৩ (চ)।

৭০ যেমন, ‘কিউ’, ‘চালিউ’, ‘কিমো’, ‘কিম্পি, ‘তিম’, ‘জিম’, ‘দো’, ‘জো’, ‘সো’, ‘জইস’, ‘তইস’, ‘ভইঅ’, ‘মা’ (নিষেধে), ‘তঁহি’, ‘করিঅই’ ইত্যাদি। ‘জইসন, তইসন, অইসন’ এই তালিকা হইতে বাদ দিতে হইবে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ‘জৈসাণে, তৈসাণে’ আছে।

৭১ ‘বাহবকে’ পদটির পাঠ সংশয়াতীত নয়। ‘বাহবকে’ = ‘বাহব কে’ হইতে পারে।

৭২ দোহায় ‘পহুকের’ আছে।

৭৩ শুধু একবচনে।

৭৪ শুধু বহুবচনে।

৭৫ ক্রিয়াবিশেষণ।

৭৬ স্ত্রীলিঙ্গ।

৭৭ চর্যা সংখ্যা ১৬, ১৮, ৩৪।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *