টিপ্পনী – চর্যাগীতি
(প্রথম সংখ্যা চর্যার দ্বিতীয় সংখ্যা ছত্রের)
১
লুইয়ের এই চর্যাটি দুইটি চর্যার যুগ্মক । প্রথমটি হইল কায় চর্যা (১-৪)। দ্বিতীয়টি যোগপীঠ চর্যা। প্রথম চর্যায় বৃক্ষের সঙ্গে মানব দেহের তুলনা করা হইয়াছে। এমন তুলনা পরবর্তীকালে বৈষ্ণব সাধকদের গানেও মিলে। যেমন লোচনের পদে
শ্রীকৃষ্ণভজনে ভাই সংসারে আইনু
মায়াজালে বন্দী হৈয়া বৃক্ষরূপ হৈনু।
স্নেহলতা বেড়ি বেড়ি তরু কৈল শেষ
নারীরূপ কীড়া তাহে করিল প্রবেশ।
ফলরূপ ডাল ভাঙ্গি পুত্রকন্যা পড়ে
মাতা-পিতা বেঙ্গম উপরে বাসা করে।
বাড়িতে না পাইল বৃক্ষ গেল শুখাইয়া।
সংসার দাবানলে তাহাতে পড়িয়া।
দুরাশা দুবার্সা মনে উঠি ধোঙাইয়া
লোচন পুড়িয়া মরে কহে ফুকারিয়া ॥
দ্বিজ হরিদাসের অষ্টোত্তরশতনামে
ফলরূপে পুত্রকন্যা ডাল ভাঙ্গি পড়ে
কালরূপ সংসারেতে পক্ষ বাস করে।
চর্যাটিতে ‘সহজ’-সাধনার স্পষ্ট ইঙ্গিত যাছে। ‘সহজ’-সাধনা সহজ (symbiotic) সাধনা অর্থাৎ দেহের সহজাত ইন্দ্রিয় ও প্রবৃত্তির স্বাভাবিক বৃত্তি ও উপভোগ অস্বীকার করিয়া সাধারণ জীবনচর্যার মধ্য দিয়া অনির্বচনীয় নির্বিকল্প মহাসুখতন্ময়তার অন্বেষণ। এ সাধনাকে টীকাকার বলিয়াছেন ‘মহারাগনয়চর্যা’ অর্থাৎ মহাঅনুরাগের পদ্ধতি। এই প্রাচীন সহজ-সাধনার পরিণতি যে ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব-সাধনায় তাহা শুধু বিষয়ে নয়, ‘সহজ’ এই কথায়ও নয়, ‘মহারাগনয়’ এই নামেও। বৈষ্ণব-সাধনার ‘রাগানুগা পদ্ধতি’ মহারাগনয়েরই প্রতিশব্দ।
১-২. ‘কায় তরুবর। ডাল পাঁচটি। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবিষ্ট (হইয়াছে) ।’
“বি” এখানে নির্দেশক প্রত্যয়ের মতো। “কাল” বলিতে এখানে কালপেঁচার ইঙ্গিত আছে। টীকাকারের মতে কাল কৃষ্ণপক্ষে ক্ষীয়মাণ চন্দ্রের রাহু।
৩. ‘দৃঢ় করিয়া মহাসুখ পরিমাণ কর’ (টীকা)। অথবা ‘মহাসুখের পরিমাণ দৃঢ় করা হইল।’
৪. ‘লুই ভনে, গুরুকে পুছিয়া জানো’ (টীকা)। অথবা ‘লুই ভনে, জ্ঞান গুরু-পৃচ্ছা (-লভ্য)!’
৫-৬, ‘সকল সমাধা (হইল)। কী করা যায় (এখন) ? সুখ-দুঃখে নিশ্চিত মরিতে হইবে।’
“সহিঅ” পাঠ ধরিলে অর্থ হইবে ‘সকল সহা (হইল)।’ অথবা হে সকল সখী!’
৭. ‘একদম ছাড়ো ছন্দের বন্ধ, ইন্দ্রিয়ের পটুত্বের আশা।’
“এড়ি এড়”-সঙ্গে তুলনীয় “মেলি মেল” (৩৮-৬), “ছাড়ু ছাড়” (৫০.৩)। এই ইডিয়মে প্রথম শব্দটি সমধাতুজ কর্ম। তুলনীয় আধুনিক প্রয়োগ,—“কী মারই মেরেছে”।
৮, ‘শূন্যপক্ষ পাশে চাপিয়া লও।’
৯-১০, ‘ভনে লুই—আমরা সানে (অথাৎ ইশারায়) দেখিয়াছি। প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস দুই পিঁড়িতে বসিয়াছি।’ টীকা অনুসারে ‘ধ্যানে দেখিয়াছি।’
২
নিষ্প্রপঞ্চ চর্যা। অসম্ভব-ঘটনামূলক প্রহেলিকা-পরম্পরা দ্বারা রচয়িতা মহাসুখনয়ে যোগচর্যার ইঙ্গিত দিতেছেন।
১-২. ‘মাদী কাছিম দোহা হইল । পাটায় (দুধ) ধরে না। গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়।’
৩-৪. ‘অঙ্গনে গৃহব্যবহার (অথবা টীকা অনুসারে, ‘ঘরে অঙ্গন বায়ু’), শুন ওগো বধূ। কানেট চোরে নিলে আধ রাতে।’
তুলনীয় বাউলের গানে
উঠন ঠনঠন করে রে ভাই ঘরে জলের ঢেউ।
কর্তাভজার গানে
অন্দরতে সদর হল।
৫-৬. ‘শ্বশুর নিদ্রা গেল, বউড়ী জাগে। কানেট চোরে নিলে কোথা গিয়ে মাগে।’
৭-৮. দিনে বউড়ী কাকের ভয়ে কাপ করে। রাত্রি হইলে কামরূপে যায়।’
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের প্রবোধচন্দ্রিকায় এ বিষয়ে একটি প্রচলিত গল্প সংকলিত আছে।
৯-১০. ‘এমনি চর্যা কুক্কুরীপাএর দ্বারা গীত হইল। কোটির মধ্যে একটি হৃদয়ে [তা] জানান দিলে।’
মানসোল্লাস (১৬.৪.৫৭) অনুসারে চর্যা-গানের লক্ষণ।
অর্থশ্চাধ্যাত্মিকঃ প্রাসঃ পাদদ্বিতয়শোভনঃ।
উত্তরার্ধে ভবেদেবং চর্যা সা তু নিগদ্যতে ॥
‘অর্থ অধ্যাত্মবিষয়ক, মিল আছে, দুই তিন জোড়া ছত্র। দ্বিতীয় অংশেও এমনি। তাহাকে বলে চর্যা।’
শুঁড়ি-বাড়ি চর্যা। মদচোলাই ও মদবিক্রয় উপলক্ষ্যে দেহতত্ত্বের কথা।
১-২. ‘এক যে শুঁড়ি-বৌ দুই ঘরে সাঁধায়। চিয়ান-বাকড় মদ বাঁধে।’
“শুণ্ডিনী” দ্ব্যর্থ । দ্বিতীয় অর্থে চোলাইগের বক-যন্ত্র ।
তুলনীয় রূপরামের ধর্মমঙ্গলে
পশ্চিম-উদয় দিতে গেছে পাত্রের ভাগিনা
সেই হইতে ময়না-নগরে মদ মানা।
বৎসর অবধি হৈল নাই সান্ধা বান্ধা।
যত কিছু রূপা সোনা সব গেল বান্ধা।…
লুকাইয়া মদ বেচে শহর ভিতর
সান্ধা বান্ধা নাই বলে মোর বরাবর।
৩-৪. ‘সহজাবস্থায় স্থির করিলে মদ সাঁধায়। যাহাতে অজরামর দৃঢ়স্কন্ধ হইতে পারা যায়।’
৫-৬. ‘দশমী দুয়ারে চিহ্ন দেখানো আছে। বাহিরের (অথবা আপন গরজে) আপনি গ্রাহক আসিল।’
সেকালে শুঁড়ি-বাড়ির সাইনবোর্ড ছিল ঘরের দ্বারে অথবা চালে শাদা কলসী অথবা শাদা পতাকা।
৭-৮. চৌষট্টি ঘড়ায় করিয়া পসার দেওয়া (আছে)। ঢুকিল যে গ্রাহক তাহার আর নির্গমন নাই।’
টীকাকার এই দুই ছত্রের ব্যাখ্যা লেখেন নাই। এ দুই ছত্র পরবর্তী ছত্রের সঙ্গে সঙ্গতও নয়। সম্ভবত টীকারচনার পরে মূল চর্যায় এ ছত্র দুটি প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। বহু প্রাচীন কাল হইতেই শুঁড়ির ঘরে ঘটিতে মদ রাখিয়া গোল করিয়া সাজানো থাকিত। মহাভাষ্যে উদ্ধৃত এই উদ্ভট (“ভ্রাজ”) শ্লোকটি তুলনীয়
যদুদুম্বরবর্ণানাং ঘটনাং মণ্ডলং মহৎ।
পীতং ন গময়েৎ স্বর্গং তৎ কিং ক্রতুগতং নয়েৎ ॥
‘ডুমুর-রঙা ঘড়ার বড় মণ্ডলং পান করিলেও যদি স্বর্গপ্রাপ্তি না ঘটায় তবে তাহা কি যজ্ঞকুণ্ডে ঢালিলে সাধন করিবে ?’
৯-১০. ‘একটি ছোট ঘড়া। নল সরুই। বলেন বিরুআ— স্থিরভাবে চালাও।’ “সরুই”-র-‘ই’ = “পঞ্চবি”-র (১-১) ‘বি’ ।
৪
যুগনদ্ধ-হেরুক চর্যা। নৈরাত্মা যোগিনী ও হেরুকের প্রেমক্রীড়ার ইঙ্গিত আছে। তুলনীয় সরহের দোহাকোষে।
জোইনি গাঢ়লিঙ্গনহি বজ্জিল লহু উবসণ্ণ।
‘যোগিনীর গাঢ় আলিঙ্গনে বজ্রসত্ত্ব অনায়াসে লভ্য ।’
কমল কুলিস বেবি মজ্ঝঠিউ জো সো সুরঅবিলাস।
কো ন রমই তহ তিহুণেহি কস্ন পূরই আস ॥
‘পদ্ম ও বজ্র— দুইটির মধ্যস্থিত সেই যে সুরত্-বিলাস তাহাতে ত্রিভুবনে কে না মজে। কাহার আশা না পূর্ণ হয়।’
১-২. ‘তিউড়ি চাপা হইল। যোগিনী আলিঙ্গন দে। পদ্মবজ্রের ঘাঁটে বেলা পড়ন্ত করো।’
৩-৪. ‘যোগিনী তো-বিনা মুহূর্তও বাঁচি না। তোর মুখ চুমিয়া কমলরস পান করি।’
৫-৬, ‘আমি খেপিতেছি, যোগিনী। লেপা যাইতেছে না (টীকা অনুসারে, ক্ষেপন হইতে লেপন যায়।’) মণিকুলে (অথবা মণিমূলে) বহিয়া ওড়িয়ানে প্রবেশ করে।’
৭-৮, ‘শাশুড়ীর (অথবা শ্বাসের) ঘরে চাবি-তালা পড়িল। চাঁদ-সূর্য দুই পাখা উৎপাটিত হইল।’
৯-১০. ‘ভনে গুড়রী— আমরা সুরতে ধীর (টীকা অনুসারে বীর)। সকল নারী মাঝে কাপড় ওড়ানোহইল।’
উদ্দাম হাওয়ায় পরিধেয় বস্ত্র অথবা অঞ্চল উড়াইয়া মনের আনন্দ প্রকাশ শিশুরা ও মেয়েরা করিত। প্রাকৃতপৈঙ্গলে উদ্ধৃত একটি কবিতায়ও আছে— “চেলু দুলাবে”।
৫
নদী-সাঁকো চর্যা। নদী-পারাবারের জন্য পুল বাঁধার উৎপ্রেক্ষার দ্বারা গুরু-উপাসনার মাহাত্ম নির্দেশ।
১-২. ‘গহনগভীর ভবনদী বেগে প্রবাহিত। দুই ধারে কাদা। মাঝে থই নাই।’
৩-৪. ‘ধর্মের তবে চাটিল সাঁকো গড়ে । পারগামীরা নিশ্চিন্তে পার হয়।’
৫-৬. ‘ফাড়া হইল মোহতরু। পাটি হইল জোড়া। অদ্বয় দৃঢ় টাঙ্গি নির্বাণে হইল গাড়া।’ ‘অদ্বয় রূপ দৃঢ় ঝোলানো তরু (bridge span) নির্বাণে আটকানো হইল’— ষষ্ঠছত্রের এমন অর্থও হইতে পারে।
৭-৮. ‘সাঁকোয় চড়িলে ডাহিন-বাম হইও না । নিকটে বোধি । দূরে যাইও না।’
৮-১০. ‘যদি ওরে তোমরা সবাই পারগামী হইতে চাও, তবে জিজ্ঞাসা কর শ্রেষ্ঠ সাঁই চাটিলকে।’
“স্বামী”-র সঙ্গে তুলনীয় আধুনিক বাউল-দরবেশ গোষ্ঠীর “সাঁই”, বৈষ্ণবদের “গুরু গোঁসাই”।
৬
আখটি চর্যা। বন বেড়িয়া হরিণ-শিকারের উৎপ্রেক্ষা। হরিণীকে শিকারী চায় না, সে যেন “ঘাইহরিণী” বা টোপ। চর্যাকর্তা সাধক নিজেকে শিকারী কল্পনা করিয়াছেন।
প্রথম ছত্রের পাঠে গোলমাল আছে। অর্থ সন্দিগ্ধ ।
১-২. (হরিণীর উক্তি।) ‘কাহার তরে ওলামেলা করিয়াছ— আছ কিসের জন্য। বেড়া ডাক পড়িতেছে চারিদিকে।’
টীকাকারের মতে এ দুই ছত্র হরিণের উক্তি। তাহা হইলে ক্রিয়াপদের পাঠ হইবে “অচ্ছহুঁ” (‘আমি রহিয়াছি’)।
৩-৪. ‘আপনার মাংসে হরিণ (আপনার) বৈরী । ক্ষণকালের তরে ভুসুকু শিকার ছাড়ে না।’
“হরিণা” ষষ্ঠীর পদ হইতে পারে। তখন অর্থ হইবে, ‘আপনার মাংসে হরিণের বৈরিতা।’
তৃতীয় ছত্রটি প্রবচন রূপে বাঙ্গালা সাহিত্যে বরাবর চলিত আছে।
৫. ‘ঘাস ছোঁয় না হরিণ জল খায় না।’ (টীকার পাঠ অনুসারে, ‘ঘাস (দাঁতে) কাটে হরিণ।’)
৬. হরিণ হরিণীর নিলয় জানে না।’
৭-৮. ‘হরিণী বলে হরিণকে—“ফেরারী তুই, শোন, এ বন ছাড়িয়া পলাতক হ”।’
৯. ‘ত্রস্তগমনে হরিণের খুর দেখা যায় না।’ (টীকার পাঠ অনুসারে ‘তরঙ্গে তরঙ্গে হরিণের খুর দেখা যায় না।’)।
১০. ‘ভুসুকু ভনে— মূঢ়ের হৃদয়ে (এই চর্যার মর্ম) কিছুতেই পশে না।’
৭
বাটপাড় চর্যা। দস্যু-অবরুদ্ধ পথে গমন ভয় এবং আশ্রয় লাভের ইঙ্গিত ।
১-২. ‘আলিতে কালিতে বাট রুদ্ধ করিল। তা দেখিয়া কাহ্ন মনমরা হইল।’
মৌলিক অর্থে “আলি” হইল গুণ বৃদ্ধি সমেত স্বর বর্ণ এবং অ-কার ও অ-কার যুক্ত য র ব ল হ, আর “কালি” হইল অ-কার ও আ-কার যুক্ত আর সব ব্যঞ্জন বর্ণ।
‘আলি কালি উচ্যতে তদ্ যথা— অ আ ই ঈ ঋ ৯ অ আ এ ঐ অর্ আর্ ও ঔ অ আ হ হা য় য়া র রা ব বা ল লা ইতি সৃষ্টিক্রমেণালিজাপঃ শ্বাসপ্রবেশেন। শ্বাসনির্গমে কালিঃ — ক কা খ খা গ গা ঘ ঘা ঙ ঙা চ চা ছ ছা জ জা ঝ ঝা ঞ ঞা ট টা ঠ ঠা ড ডা ঢ ঢা ণ ণা প পা ফ ফা ব বা ভ ভা ম মা ত তা থ থা দ দা ধ ধা ন না স সা হ্য হ্যা ষ ষা শ শা ক্ষ ক্ষা ইতি।” ১
৩-৪. ‘কাহ্নু কোথায় গিয়া নিবাস করিবে। যে মন-গোচর সে উদাস।
৫-৬. ‘সে তিন সে তিন—তিন অভিন্ন (অথবা ‘তিনই ভিন্ন’)। কাহ্নু ভনে, ভব বিনষ্ট।’
টীকাকারের মতে তিন হইল (১) স্বর্গ মর্ত্য রসাতল, (২) কায় বাক্ চিত্ত, (৩) দিবা রাত্রি সন্ধ্যা, (৪) যোগ যোগিণী তন্ত্র।
৭-৮, যেমন যেমন আসিল তেমন তেমন গেল। আনাগোনায় কাহ্নু মনমরা হইল।’
৯-১০. ‘এই সে কাহ্নি নিকটে জিনপুরে বসে। ভনে কাহ্ন—আমার হৃদয়ে পশে না।
“মোহিঅহি” পাঠ কল্পনা করিলে অর্থ হইতে পারে ‘মোহিত (ব্যক্তির চিত্তে)’।
নৌবাণিজ্য চর্যা। বিদেশী বন্দর হইতে মূল্যবান্ পণ্য আমদানির বিস্তারিত উৎপ্রেক্ষা।
১. ‘সোনায় (অথবা শূন্যে) ভরা করুণা নৌকা।’
‘শূন্য’, ‘করুণা’ যেন সাংখ্যের “পুরুষ”, “প্রকৃতি”। চর্যাগীতির সহজতত্ত্বে (১) শূন্য=নিরঞ্জন, হেরুক আর করুণা = নৈরাত্মা, যোগিনী ; অথবা (২) শূন্যতা =ভগবতী নৈরাত্মা আর করুণা =ভগবান, বোধিচিত্ত ।
২. ‘রূপা থুইতে নাহিক ঠাঁই।’
শেষ অংশের পাঠ নিঃসন্দিগ্ধ নয়। ছত্রদ্বয়ের মর্মার্থ— শুন্যদ্বারা করুণা ভরতি হওয়ায় সহজাবস্থাপ্রাপ্তি ঘটিয়াছে। সেখানে রূপাদি্ বিকল্পজ্ঞানের অবকাশ নাই।
৩-৪. ‘বাহ, তুই কামলি, (নৌকা) গগন উপদেশে (=উদ্দেশে)। জন্ম (-ভর) গেল । ফিরিয়া ‘আসে কিসে।’
৫-৬. ‘খুটি উপড়ানো হইল, কাছি খোলা হইল । বাহ, তুই কামলি, (নৌকা) সদ্গুরুকে পুছিয়া।’
৭-৮. ‘মাঙ্গে চড়িলে চারদিকে চায়। কেরোয়াল নাই। কেউ কি বাহিতে পারে।’
৯-১০. ‘বাম ডাহিন চাপা হইল। মিলন মেলা হইল মাঙ্গে। বাটে মিলিল মহাসুখ-সঙ্গ।’
৯, তুলনীয় ৫.৭ ।
৯
মত্তমাতঙ্গ চর্যা। মত্ত হস্তীর বাঁধন ছিঁড়িয়া যথেচ্ছ বিচরণের এবং পরিশেষে তাহার দমনের উৎপ্রেক্ষায় মুক্ত যোগীন্দ্রের আচরণ বর্ণিত।
১-২. ‘এবংকার-রূপ দৃঢ় স্তম্ভ ভাঙ্গা হইল। বিবিধ বন্ধন ছেঁড়া হইল।’
‘এবংকার’ পারিভাষিক শব্দ। অর্থ, দিবা-রাত্রি সদসৎ ইত্যাদি দ্বৈতবোধ।
৩-৪. ‘কাহ্নু মদমত্ত (হইয়া) বিলাস করে । সহজরূপ নলিনীবনে পশিয়া (তবে সে)। শান্ত (হয়)।’
‘কাহ্নুঁ দ্ব্যর্থ। এক অর্থে চযকতা, অন্য অর্থে কৃষ্ণবর্ণ গজেন্দ্র।
৫-৬. যেমন করী করিণীকে আক্রমণ করে, তেমন তেমন তথতারূপ মদগল বর্ষিত হয়।’
‘তথতা’ পারিভাষিক শব্দ।, অর্থ, মৌলিক স্বভাব বা বিশুদ্ধ প্রকৃতি।
৭-৮, ‘সকল ষট্গতি স্বভাবে শুদ্ধ। ভাব-অভাব কেশাগ্রও ক্ষুব্ধ (করিতে পারে) না।’
‘ছড়গই’ বুঝাইতেছে ছয়প্রকারে উৎপন্ন তাবৎ জীব বা সত্ত্ব—অণ্ডজ জরায়ুজ স্বেদজ স্বতউৎপন্ন দেবপ্রকৃতি ও অসুরপ্রকৃতি।
৯-১০. ‘দশবল-রূপ (অথবা ‘দশ শ্রেষ্ঠ’) রত্ন দশ দিক হইতে আহৃত হইল। বিদ্যাকরী অক্লেশে দমন যায়। (টীকাকারের মতে ‘দমন করো’ ।
‘দশবলরঅণ’ টীকাকারের মতে বল বৈশারদ্য প্রভৃতি দশ গুণযুক্ত তথতারত্ন বুঝাইতেছে। এই রত্নের প্রভাবে মত্ত বিদ্যাহস্তী বশ মানে।
ডোমনারী চর্যা। নীচজাতীয় নারীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমের উৎপ্রেক্ষার দ্বারা সহজাবস্থাসিদ্ধির নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর মনসামঙ্গলে ও অষ্টাদশ শতাব্দীর শিবসঙ্কীর্তনে শিবের সহিত নৌকাবাহিকা কোঁচ-তরুণী রূপে দেবীর প্রেম-লীলার পূর্বাভাস পাইতেছি এই চর্যাগীতিতে । সাধক এখানে নিজেকে নাঙ্গা কাপালিক কল্পনা করিয়াছেন।
১-২. ‘নগর-বাহিরে, ওরে ডোমনী, তোর কুঁড়ে। (তোকে) ছুঁইয়া ছুঁইয়া যায় সেই বিজ্ঞ বামুন (টীকাকারের মতে ‘নেড়া ব্রাহ্মণ বালক’)।’
অষ্টাদশ শতাব্দীর ধর্মপূজাপদ্ধতিতে এই দুই ছত্রের রূপান্তর রক্ষিত আছে।
পখুর-পাড়েতে সদা-ডডামের কুড়িয়া
ঘন ঘন আইসে যায় ব্রাহ্মণ বড়ুয়া।
৩-৪. ‘ওলো ডোমনী তোর সঙ্গে আমার সাঙ্গা করিতে হইবে। (আমি) কাহ্ন-নাঙ্গা কাবাড়ি যোগী।’
৫-৬. ‘এক সে পদ্ম, (তাহার) চৌষট্টি পাপড়ি। তাহাতে চড়িয়া নাচে ডোমনী (ও) বেচারি (কাহ্ন)।’
৭-৮. ‘ওলো ডোমনী আমি তোকে সদ্ভাবে জিজ্ঞাসা করি,— আসিস যাস তুই কাহার নায়ে ?’
৯-১০. ‘তাঁত বেচা হয়, ডোমনী। আর তো চাঙ্গারি । তোর বিরহে আমি ছাড়িলাম নটসজ্জা।’
১১-১২. ‘তুই লো ডোমনী, আমি কাবাড়ি। তোর তরে আমি লইলাম হাড়ের মালা।’
তুলনীয় কাহ্নের দোহা
এক্কু ণ কিজ্জই মন্ত ণ তন্ত
ণিঅ ঘরিণী লই কেলি করন্ত।
‘এটাও করে না সে— না মন্ত্র না তন্ত্র, (শুধু) গৃহিণীকে লইয়া ক্রীড়ারসে মত্ত থাকে।’
১৩-১৪. ‘সরোবর ভাঁজিয়া ডোমনীর মৃণাল খাও (অথবা ‘খায়’)। মারি আমি ডোমিনীকে (অথবা ‘ডোমিনী তোকে’)। লই (তোর) প্রাণ।’
১১
ডোম্বীহেরুক চর্যা। কাপালিক (কাবাড়ি নটবেশে সাধকের নগরভ্রমণের চিত্র।
১-২. ‘নাড়ীশক্তি দৃঢ় ধরা হইল খাদে (অথবা ‘খাটে’)। অনাহত ডমরু বাজে বীরনাদে (অথবা ‘বীরনাটে’)।
প্রথম ছত্র তুলনীয় শিবসংহিতা (৩৬)
পদ্মাসনস্থিতো যোগী জনসঙ্গবিবর্জিতঃ।
বিজ্ঞাননাড়ীদ্বিতয়ম্ অঙ্গুলিভ্যাং নিরোধয়েৎ ॥
৩-৪. ‘কাপালিক যোগী চরিতে লাগিয়াছে। এক নাগাড়ে দেহনগরীতে (সে)। বিহার করে।’
৫-৬. ‘আলি-কালি চরণে ঘণ্টানূপুর। রবিশশী আভরণ করা হইল— কুণ্ডল।’
৭-৮. ‘রাগ-দ্বেষ-মোহ ছাই পরা হইল। পরমমোক্ষ মুক্তাহার ঝোলানো হইল।’
৯-১০. ঘরে শাশুড়ীকে (অথবা ‘শ্বশুরঘরে’) ননদ ও শালীকে মারা হইল। মায়া (ভার্যাকে) মারিয়া কাহ্নকাবাড়ি (কাপালিক) হইল।’
সন্ধ্যাঅর্থে শাসু-শ্বাস, মনপবন। ননদ-শালী=ইন্দ্রিয়-আয়তন। মঅ=মায়া, অবিদ্যা।
১২
চর্যাগীতিটিতে দাবাখেলার রূপকের সাহায্যে সংসারমুক্তি-রূপ পরমার্থসাধনের ইঙ্গিত।
১-২. ‘করুণা-পিঁড়িতে নয়বল (=দাবা) খেলিতেছি। সদ্গুরুর বোধে সংসার-খুঁটি (অথবা ‘সংসার-শক্তি’) জেতা হইল।
টীকাকার যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা হইতে অনুমান করা যায় যে প্রথম ছত্রের এই পাঠ তিনি পাইয়াছিলেন— “করুণা পিড়ি ফাড়ি খেলহুঁ নঅ-বল।”
৩. ‘দুয়া সরাইয়া দেওয়া হোক। ওরে ঠাকুরকে (=রাজাকে) দিস না।’ টীকার ব্যাখ্যায় “দুআ” “আভাসদ্বয়ং” এবং “ঠকুরমবিদ্যাচিত্তং”।
৪. ‘কাছারি উপদেশে। কাহ্ন নিকটে জিনপুর (=বাজিমাত)।’
৫, ‘প্রথমে তুড়িয়া বড়ে মারা হইল।’
টীকা অনুসারে ‘বড়িআ’ সন্ধ্যাসংকেতে বুঝাইতেছে একশ ষাট প্রকৃতি (“ষষ্ট্যুত্তরশতপ্রকৃতয়ঃ”)। তোড়িঅ=তোড়ে (“বজ্রজাপক্ৰমেণ”)। ‘মরাড়িইউ’ ভ্রান্ত পাঠ মনে হয়। টীকাকার ব্যাখ্যা করিয়াছেন “নিঃস্বভাবীকৃত্য” । তাহা হইলে সম্ভবত ‘মারিউ’ অথবা ‘মাড়িউ ছিল আসল পাঠ।
৬. ‘গজবর কর্তৃক তুড়িয়া পাঁচজন খোলানো হইল।’
টীকার মতে “গঅবরে”=“যোগীন্দ্রস্য তথতাচিত্তগজেন্দ্রেণ”। “পাঞ্চজনা’=“পঞ্চস্কন্ধাত্মক…পঞ্চবিষয়স্য”। “তোলিআ’=“নির্মদঃ কৃত্বা।”
৭. ‘মন্ত্রীর দ্বারা ঠাকুরের (রাজার) নিষ্কৃতি।’
“মতিএ” এক অর্থে মন্ত্রীর দ্বারা, অন্য অর্থে বুদ্ধির দ্বারা (“মত্যা প্রজ্ঞাপারমিতানুবুদ্ধ্যা”)। “পরিনেবিত্তা”-“পরিনির্বাণারোপিতং কৃতং”।
৮, ‘অবশ্য করিয়া (=সুনিশ্চিতভাবে) ভাববল জেতা হইল।’
৯-১০. ‘ভনে কাহ্নু—আমি ভাল দাঁও দিই। চৌষট্টি ঘর গুনিয়া নিই ।
১৩
নৌযাত্রা চর্যা। নৌকা করিয়া অভিসারযাত্রার রূপকে মহাসুখসাধনার বর্ণনা। চর্যা ৮ দ্রষ্টব্য।
১-২. ‘ত্রিশরণ করা হইল আটকামরা নৌকা । নিজদেহ (হইল)করুণা, শূন্য মেয়েমহল।’
ত্রিশরণের আদি অর্থ বুদ্ধ ধর্ম ও সংঘ— অধ্যাত্মসাধনায় এই তিন আশ্রয়। “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি ধর্মং শরণং গচ্ছামি সংঘং শরণং গচ্ছামি”—ইহাই ত্রিশরণ মন্ত্র । এখানে, সহজসাধনায়, অর্থ—কায় বাক্ চিত্ত। টীকাকার ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে সন্ধ্যাসংকেতে ত্রিশরণ-নৌকা বুঝাইতেছে সেই চতুর্থ শরণ মহাসুখকায়, যাহাতে কায়-বাক্-চিত্ত লীন হইয়া যায়।
অঠকমারীর অর্থ লইয়া সংশয় আছে।
৩-৪. ‘তরণ করা গেল সংসারসাগর, যেমন মায়ায় স্বপ্নে । মাঝ-চৌকার তরঙ্গ টের পাইলাম আমি।’
৫-৬, ‘পঞ্চ তথাগত করা হইল কেরোয়াল। বেচারা কাহ্ন কায় (নৌকা) বাহিতেছে (টীকার মতে, ‘কাহ্নিল, কায় নৌকা বাহো মায়াজাল (মধ্যে)।
“পঞ্চ তথাগত”=পাঁচ ধ্যানী বুদ্ধ— বৈরোচন অমিতায়ু বজ্রসত্ব রত্নসম্ভব এবং অমোঘসিদ্ধি। এখানে টীকা অনুসারে “বিশুদ্ধপঞ্চতথাগতাত্মকং স্বদেহং”। তুলনীয় বোধিচর্যার্বতারে।
মানুষীং নাবমাসাদ্য তর দুঃখমহানদীম্ ।
মূঢ় কালো ন নিত্ৰায়া ইয়ং নৌর্দুলভা পুনঃ ॥
‘মানুষ-দেহ নৌকা পাইয়া দুঃখমহানদী উত্তীর্ণ হও। মূঢ়, ঘুমাইবার সময় নয়। এ নৌকা পুনরায় লাভ না হইতে পারে : ॥
৭-৭. গন্ধ স্পর্শ রস যেমন তেমনই। নিদ্রা বিনে স্বপ্ন যেমন।’
৯-১০. ‘চিত্ত কাণ্ডারী (বসিয়া) শূন্যতা-মাঙ্গে। চলিল কাহ্ন মহাসুখের সাঙ্গায়।
১৪
খেয়া চর্যা। ডোমনীর খেয়া-নৌকায় নদী-পারাপারের রূপকের দ্বারা যোগসাধনার ইঙ্গিত।
১. ‘গঙ্গা যমুনার মাঝে, ওরে, বহে (এক) নদী।’
“গঙ্গা, যমুনা” যোগসাধনার সঙ্কেতে যথাক্রমে ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী। ইড়া বামনাসাপুটে চন্দ্রের অমৃতধারাবাহী, পিঙ্গলা দক্ষিণনাসাপুটে সূর্যের বিষধারাবাহী। তুলনীয় শিবসংহিতা ১৩২, ১৩৩।
গঙ্গাযমুনয়োর্মধ্যে বহত্যেষা সরস্বতী।
তাসাং তু সঙ্গমে স্নাত্বা ধন্যো যাতি পরাং গতিম্ ॥
ইড়া গঙ্গা পুরা প্ৰোক্তা পিঙ্গলা চার্কপুত্রিকা।
মধ্যা সরস্বতী প্ৰোক্তা তাসাং সঙ্গোহতিদুর্লভঃ ॥
‘গঙ্গা-যমুনার মধ্যে এই সরস্বতী বহিতেছে। তাহাদের সঙ্গমস্থলে যিনি স্নান করেন তিনি ধন্য এবং তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন। ইড়াকে বলে গঙ্গা পিঙ্গলাকে বলে যমুনা। মাঝখানে যাহা তাহাকে বলে সরস্বতী। এই তিনের একত্র সংযোগ অতিদুর্লভ।’
টীকাকার “নাঈ” পাঠ পাইয়াছিলেন। তিব্বতী অনুবাদ অনুসারে পাই “মার্গ”। সুতরাং তিব্বতী অনুবাদক “নাঈ” পাঠ পান নাই, “নঈ” পাইয়াছিলেন।
২. ‘সেখানে চঞ্চল (অথবা ‘ডুবন্ত’) ডোমিনী শ্রাবকদের (অর্থাৎ বাল যোগীদের) লীলায় পার করে।’
মাতঙ্গী-হস্তিনী হইলে ‘শাবকদের। “চুড়িলী” বা “বুড়িলী” যে পাঠই ধরি না কেন তা টীকাকারের মতে “সহজযানপ্রমত্তাঙ্গী” ।
৩-৪. ‘বাহো তুই ডোমনী, বাহে ওলো ডোমানী, পথে বেলা হইয়া গেল। সদ্গুরু-পাদপ্রসাদে জিনপুর যাইতে হইবে।’
৫-৬. ‘পাঁচ কেরোয়াল পড়ার কালে মাঙ্গে পিঠায় কাছি বাঁধা। গগন-সেঁউতিতে সেঁচো। পানি যেন ফাঁকে না ঢোকে।’
৭-৮, ‘চাঁদ সূর্য দুই চাকা ছাড়িবার ও গুটাইবার লাটাই । বাম ডাহিনে দুই মার্গ দেখা যায় না। বাহ তুই ইচ্ছামত।’
“চান্দ” “প্রজ্ঞাজ্ঞানং”। “সুজ্জ”=“উৎপাদাদ্বয়জ্ঞানং”। “পুলিন্দা”=“নপুংসক। টীকাকারের মতে এই ছত্রের অর্থ— ‘চাঁদ, সূর্য এবং পুলিন্দ এই তিন সৃষ্টিসংহারকারক।’ নৌকার রূপকে এ অর্থ গ্রাহ্য নয়। তখন বাহ্য অর্থ হইবে ‘চাঁদ ও সূর্য দুই চাকা মাস্তুলের পাল মেলিবার (“সৃষ্টি”) ও গুটাইবার (“সংহার”) সিলিণ্ডার।’
৯-১০, ‘না লয় কড়ি না লয় বুড়ি। স্বচ্ছন্দে পার করিয়া দেয়। যে রথে-চড়া, বাহিতে জানে না, (সে) কূলে কূলে ছুটাছুটি করে (টীকার মতে ‘ঘুরিয়া ফিরে’)।
১৫
ঋজুবর্ত্ম চর্যা। সহজসাধনমার্গ সোজা রাজপথ। অন্য সাধনায় লোকে বিপথে যায়। আর সংসার তো সমুদ্র, সেখানে ভেলা বা নৌকা কিছুই নাই। স্থলমার্গের রূপকে সাধনসঙ্কেতের দ্যেতনা আছে এই চর্যাগীতিতে। তুলনীয় চর্যা ২৬।
১. ‘স্বসংবেদন-স্বরূপ বিচারে অলক্ষ্য লক্ষ্য করা যায় না।’
স্বসংবেদন হইল স্বয়ম্ভুয়মান নির্বিকল্প মহাসুখ। তীলপা দোহায় বলিয়াছেন।
চিত্ত মরই জহি পবণ তহি লীণো হোই ণিরাস।
সঅ-সংবেঅণ তত্তফলু কস্স কহিজ্জই কীস ॥
‘যেখানে চিত্ত মরে সেখানে পবন বিলীন ও নিরস্ত হয়। (সেই) স্বয়ংবেদনতত্ত্বের ফল কাহাকে কহা যায় কি করিয়া ॥
২. ‘যে যে সোজা পথে গেল অপ্রত্যাবৃত্ত হইল সে-ই।’
‘অনাবাটা’ অপুনরাবর্তনকারী, তথাগত । সরহ দোহায় বলিয়াছেন স্বসংবিত্তির ফলে
অধ-উধ-মজ্ঝেঁ সঅল ভূঅ ণাসী
হোসই ভহিগত ওর পইসী ॥
‘মধ্যদেশে অধোদেশে ঊর্দ্ধদেশে সকল উৎপাদ নষ্ট হয় । ওপারে পৌঁছিয়া হইবে সে তথাগত।’
৩-৪. ‘কূল হইতে কূলে (গতায়াতকারী) হইও না, মূঢ়। সংসার সোজা রাস্তা। একতিল কেশাগ্র বাঁকে ভুলিয়ো না। রাজপথ কানাত-ঘেরা।’
৫-৬. ‘মায়ামমাহসমুদ্রের, ওরে (তুই) না বুঝিস অন্ত (না বুঝিস) থই। আগে না ভেলা না নৌকা দেখা যায়। ভুলে তুই নাথকে পৃছিস না।’
“নাহা”=“সদ্গুরুনাথ”। তুলনীয় সরহের দোহা
বিণ্ণ-বিবজ্জিঅ জোউ বজ্জই।.
অচ্ছহ সিরিগুরুণাহ কহিজ্জই ।
‘দ্বয়বিবর্জিত যে (অদ্বয়) যোগ তাহাও বর্জন করা হয়। শ্রীগুরুনাথ বলেন—আচ্ছা।’
৭-৮, ‘শূন্য পাথার, আন্দাজেও কিছু দেখা যায় না। ভ্রান্তিবশে যাইতে চাহিস না। এখানে অষ্ট মহাসিদ্ধি সিদ্ধ হয় সোজা পথে গেলে।’
৯-১০. ‘বান ডাহিন দুই.পথ ছাড়িয়া শান্তি চলিতেছেন (?) আনন্দে। ঘাট ঘাঁটি খদ তড়—নাই। চোখ বুজিয়া পথ চলা যায়।’
“আটি বুজিঅ” টীকাকার ব্যাখ্যা করিয়াছেন “শুদ্ধোন্মীলিতলোচনে”। তিব্বতী অনুবাদেও এই মানে স্বীকৃত। সুতরাং ইহাদের প্রাপ্ত পাঠ ছিল “আখি বুঝি’—অর্থাৎ চোখে বুঝিয়া ।
১৬
মগজেন্দ্র চর্যা। চিত্তগজেন্দ্রের মত্তাবস্থার রূপকের সাহায্যে সহজাবস্থাপ্রাপ্তির ইঙ্গিত বর্ণিত।
১-২. তিন পাটে লাগিলাম (আমি)। ওরে অনাহত কৃষ্ণ (মেঘ) ঘন গর্জন করে। তা শুনি ভয়ঙ্কর মার, ওরে, সকল মণ্ডল সহ বিচলিত হয়।’
তিন পাট হইতেছে কায় বাক্ চিত্ত।
“কসন ঘণ গাজই’ এক অর্থে ‘কৃষ্ণ মেঘ গর্জন করিতেছে’, অপর অর্থে ‘কৃষ্ণ বর্ণ (গজেন্দ্র) ঘোর গর্জন করিতেছে’। টীকাকারের মতে “কসণ ভয়ানকং”।
তিব্বতী অনুবাদ অনুসারে ‘বিস মণ্ডল’।
৩-৪. ‘মাতাল চিত্তগজেন্দ্র ধায়। নিরস্তর গগনপ্রান্ত তৃষ্ণায় (?) ঘোলায়।’
‘গহন্দা’ এক অর্থে গজেন্দ্র, অন্য অর্থে গুণ্ডা (তুলনীয় ‘হিন্দু গন্দা’ বিদ্যাপতির কীর্তিলতা)।
৫-৬, ‘পাপ পুণ্য দুই শিকল ছেঁড়া হইল। আলানস্তম্ভ মটকানো হইল। গগন-টাকলি লাগিয়া, ওরে, চিত্ত (-গজেন্দ্র) নির্বাণে প্রবিষ্ট হইল।’
টীকা ও তিব্বতী অনুবাদ অনুসারে আসল পাঠ হইবে ‘গণ টকা লাগেলি রে’ । “টাকলি” (বা “টকা”) হাতি চালাইবার বিশেষ শব্দ।
৭-৮ ‘মহারস পানে মাতাল, ওরে, ত্রিভুবন সকল উপক্ষিত। পঞ্চ বিষয়ের নায়ক, ওরে, বিপক্ষ কেউ দেখা যায় না।’
৯-১০. ‘খর রবিকিরণ সপ্তাপে, ওরে, গগনাঙ্গনে (অথবা ‘গগনগঙ্গায়’) গিয়া প্রবিষ্ট (হইল)। ভনেন মহিণ্ডা,—এখানে ডুবিতে ডুবিতে (অথবা ‘ঘুরিতে ঘুরিতে’) আমি কিছুই দেখি নাই।’
তুলনীয় সরহের দোহা
মুক্কই চিত্তগএন্দ করু এথ বিঅল্প ণ পুচ্ছ।
গঅণ-গিরিণঈজল পিঅউ তহি তড় বসই সইচ্ছ ॥
‘চিত্তগজেন্দ্রকে মুক্ত করা হোক। ইহাতে সংশয় তুলিও না। গগন-গিরিনদীর জল পান করুক। সেখানে তটে স্বইচ্ছায় বাস করুক ॥
১৭
বুদ্ধনাটক চর্যা। বীণাযন্ত্রের ও নাচগানের রূপকে অধ্যাত্ম-অনুভবের ইঙ্গিত।
১-২. ‘সূর্য লাউ। তাঁত হইল শশী । অনাহত দণ্ড। চাকি করা হইল অবধূতী ।’
৩-৪. ‘বাজে, ওলো সই, হেরুক-বীণা। শোন, তাঁতের ধ্বনি মীড় খেলাইতেছে ।’ টীকাকারের মতে তৃতীয় ছত্রের অর্থ,—বীণাপাদ বীণাদ্বারা শ্ৰীহেরুক এই চারিটি অক্ষর অনাহতভাবে বাজাইতেছেন।
টীকাকারের মতে, চতুর্থ ছত্রের অর্থ,—‘শূন্যতাধ্বনি করুণায় ব্যাপ্ত হইতেছে ।’
৫-৬, ‘আলি-কালি দুই সারি বোঝা (অথবা ‘শোনা’) গেল। গজবর সমরস সন্ধি গোনা হইল।’
৭-৮. ‘যখন করপার্শ্ব করহকলে চাপা হয়, (তখন) বত্রিশ ধ্বনি সকল ব্যাপ্ত করে।’
৯-১০, ‘নাচ করেন বজ্রধর, গান করেন দেবী। বুদ্ধ-নাটক হয় বিষম (অর্থাৎ বিপরীত) ।’
১৮
কামচণ্ডালী চর্যা। ডোমনীর সহিত কাপালিক যোগী সাধকের বিলাসের ইঙ্গিত।
১-২. ‘তিন ভুবন আমার দ্বারা বাহিত হইল হেলায় । আমি শুইলাম মহাসুখ-নীড়ে।’
৩-৪. ‘কি রকম, ওলো ডোমনী, তোর ভাবকালি ? এক পাশে কুলীন জন, মাঝে কাবাড়ি!’
৫-৬. ‘তোর দ্বারা লো ডোমনী, সকল নষ্ট হইল। শুধু শুধু শশধর টলানো হইল ।’
৭-৮. ‘কেহ কেহ তোরে মন্দ (অথবা ‘কুরূপ’) বলে । বিদ্বদ্জ্জনেরা তোকে কণ্ঠ হইতে ছাড়ে না।’
৯-১০. ‘কাহ্নের দ্বারা গীত হইল (এই) কর্মচণ্ডালী (গান)। ডোমনীর বাড়া ছিনাল নাই।’
১৯
ডোমনীবিবাহচর্যা। কাহ্নের বিবাহযাত্রার ও ডোমনীর সহিত বিবাহের বর্ণনা।
১-২. ‘সংসার ও নির্বাণ (যেন) পড়া (ও) মাদল। মন (ও) পবন (যেন) দুটি করতাল (ও) কাঁসি।’
বরযাত্রায় বাদ্যভাণ্ডের তালিকা।
৩-৪. ‘জয় জয় দুন্দুভি-শব্দ উচ্ছলিত হইল। কাহ্ন ডোমনীকে বিবাহ করিতে চলিয়াছে। দ
৫-৬, ‘ডোমনী বিবাহিত হইল। জন্ম হইল উচ্ছিন্ন। যৌতুক করা হইল পরম ধর্ম।’
৭-৮. ‘দিন রাত্রি যায় সুরতপ্রসঙ্গে। যোগিনীজালে রজনী কাটায় ( টীকার মতে ‘শোভা পায়’)।’
৯-১০. ডোমনীর সঙ্গে যে যোগী অনুরক্ত (হয়), সহজ-উন্মত্ত সে তাহাকে) একমুহূর্তও ছাড়ে না।’
২০
মৃতবৎসা চর্যা। পতিপরিত্যক্ত তরুণীর প্রথম প্রসব গর্ভপাতে পর্যবসিত। এই ইঙ্গিত।
১-২. ‘আমি নিরাশী, ভর্তা ক্ষপণক। আমার পতিসঙ্গসুখ অবর্ণনীয়।’
৩-৪. ‘প্রসব করিলাম গো মা। আঁতুড় খুঁজি । যতক্ষণ এখানে খুঁজি আমি (“চাহাম” ?) সে এখানে নাই।’
৫-৬. ‘পয়লা বিয়ান মোর,—বাসনার পূড়া। নাড়ী কাটিতে কাটিতে সেও (হইল) হাওয়া।’
“বাসনয়ুড়া” মানে হইবে ‘অনেক আশায় ধন’
৭-৮. ‘আমার যেন নব যৌবন (অথবা ‘জীবন-যৌবন’) সে হইল পূর্ণ। মূল কুরনিতে বপন-বীজ সংগৃহীত হইল।’
৯-১০. ‘ভনেন কুক্কুরীপা, (যিনি) এ সংসারে স্থির— যে এথা বোঝে সে এথা বীর।’
২১
মূষিক চর্যা। অন্ধকার রাত্রিতে ইঁদুর চরে এবং যেখানে সেখানে গিয়া শস্য নষ্ট করে। তাহাকে মারিয়া ফেলিতে হয়। এই রূপকের মধ্য দিয়া যোগসাধনার ইঙ্গিত।
১-২. ‘অন্ধকার রাত্রিতে মূষিকের আহার-অন্বেষণ। মূষিক অমৃত (অর্থাৎ দুর্লভ খাদ্য খায় এবং (তাহা) জড়ো করে।’
৩-৪. ‘ওরে যোগী, পবনরূপ মূষিককে মারো। তাহাতে তাহার আনাগোনা বন্ধ হইবে।’
৫-৬. ‘সংসার-শক্তিমান্ (=ভবৃন্দারক) মূষিক দেওয়াল (অথবা ‘ভিত’) খোঁড়ে।’
“বলয়া গাতী” পাঠান্তর স্বীকার করিলে অর্থ হইবে ‘বলবান শরীর’।
৬. ‘চঞ্চলমূষিক কল্যাণ (?) নাশের জন্য সর্বদা স্থিতি (করে, অর্থাৎ প্রস্তুত থাকে)।’
“কলিআঁ” শব্দের অর্থ ঠিক বোঝা গেল না। এইসব অর্থে অনুমান করা যায়— (১) কল্যাণ, (২) কলিকা, (৩) কলহকার, (৪) কালো।
৭. ‘কালো মূষিক । রঙ বোঝা যায় না।’
৮, “গনে উঠিয়া করে অমৃত পান।’
এই অর্থ টীকাকারের পাঠ (“অমিত পান”) ও ব্যাখ্যা অনুযায়ী । অন্যথা অর্থ হইবে, ‘গগনে উঠিয়া চরে (অর্থাৎ ধরে) অমনস্ক ধ্যান।’
৯-১০. ‘ততক্ষণ সে মূষিক হুটোপাটি (করে), (যতক্ষণ) তাকে সদ্গুরুর বোধে (অর্থাৎ সদ্গুরুর কাছে লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা) নিশ্চল করা না হয়।’
১১-১২. ‘যখন মূষিকের চরা ঘুচিয়া যায়, ভুসুকু বলে, তখনই (সংসার-) বাঁধন খুলিয়া যায়।’
২২
অচিন্ত্য জন্মমৃত্যুভেদ চর্যা। জন্ম-মৃত্যু-সংসার কর্মজনিত এবং মানুষেরই আপনার সৃষ্টি। পরমার্থতত্ত্ববিদ্ জন্মমরণের অতীত। এই তত্ত্ব চর্যাগীতিটির প্রতিপাদ্য। তুলনীয় টীকাকার-উদ্ধৃত চর্যাপদ, “ভব ভুঞ্জই ন বাজ্ঝইরে” ইত্যাদি।
১-২. ‘আপনা থেকে সংসারবন্ধন ও মুক্তি রচনা (অর্থাৎ কল্পনাসৃষ্টি) করিয়া করিয়া লোকে শুধুশুধুই নিজেকে বন্ধনে ফেলে।’
৩-৪. ‘অচিন্ত্য যোগী আমরা জানি না উৎপাদ বিনাশ ও স্থিতি কেমন করিয়া হয়।’
৫-৬. ‘যেমন উৎপাদ বিনাশও তেমনি। বাঁচায় মরায় তফাৎ নাই।’
৭-৮, ‘যাহার এখানে জন্ম-মরণের শঙ্কা (আছে), সে করুক রসরসায়নের প্রত্যাশা।’
৯-১০, ‘যে সচরাচর (সৃষ্টিচক্র) তিন দশায় (অর্থাৎ উৎপাদ বিনাশ স্থিতি— এই তিন অবস্থায়) ঘুরিতে থাকে তাহা কোনমতেই অজর-অমর হয় না।’
১১-১২. ‘জন্ম হইতে কর্ম, কি কর্ম হইতে জন্ম। —সরহ বলেন, সে ধর্ম চিন্তার বাহিরে।’
২৩
আখেটিক চর্যা। মাংসাৰ্থী ব্যাধ কর্তৃক-হরিণ-শিকারের উৎপ্রেক্ষা। ছয়টি ছত্র পাওয়া গিয়াছে। পাঠ খুব সংশয়িত। চর্যাকারের স্বগত উক্তি ।
১-২. ‘যদি ভুসুকু তুই শিকারে যাইবি । তো মারিস সে পাঁচ জনকে। নলিনীবনে প্রবেশ করিবার কালে একাগ্ৰমন হইবি।’
পঞ্চজনা=পঞ্চেন্দ্রিয়বৃত্তি।
৩-৪. ‘জীবন্ত থাকা বিনে মরা লইলাম (?)। হানা (অর্থাৎ হত্যা) বিনা মাংসের জন্য (আমি) ভুসুকু পদ্মবনে প্রবেশ করিলাম।’
৫-৬, ‘মায়াজাল প্রসারিত, ওরে, মায়াহরিণী বাঁধা পড়িল। সদ্গুরুর দেওয়া জ্ঞানে বোঝা যায়, ওরে, কাহার (এ) কাহিনী ।’
২৬
তুলাধোনা চর্যা। তুলা ধুনিয়া পাঁজ করার উৎপ্রেক্ষা।
১-২. ‘তুলা ধুনিয়া ধুনিয়া (পাওয়া যায়) আঁশ, ওরে আঁশ। আঁশ ধুনিয়া ধুনিয়া শেষ (থাকে) নিরাবরণ।’
৩-৪. ‘তবু সেই বোয়া (অথবা ‘সে হেরুক’) পাওয়া যায় না। শান্তি বলে—(যতই) কেন তা ভাবা যায়।’
৫-৬, ‘তুলা ধুনিয়া ধুনিয়া শূন্য জড়ো হইল। শূন্য লইয়া স্বয়ং নিঃশেষিত (?)।’
যষ্ঠ ছত্রের পাঠ ও অনুবাদ সংশয়িত।
৭-৮. ‘প্রশস্ত পথ। দুই প্রান্ত চোখে পড়ে না। শান্তি বলে— (অথচ এত সঙ্কীর্ণ যে) কেশাগ্রও প্রবেশ করে না।’
৯-১০. ‘না কাজ না কারণ—এই যে যুক্তি, (তা হইল) স্বসংবেদন (অর্থাৎ আপেলব্ধি) —শান্তি বলিতেছেন।’
শেষের পদটি পরে যুক্ত হইয়াছে। আগে দুইটি ভনিতা আছে “ভণই” দিয়া। এ পদে সম্ভ্রমাত্মক “বোলথি”। এই এক সন্দেহের কারণ। আর এক সন্দেহের কারণ হইল পদটির অস্পষ্ট ভাব ও পূর্বের সহিত অসংলগ্নতা।
২৭
বিকচকমল চর্যা। সহজানন্দ-লীলার উৎপ্রেক্ষা।
১-২. ‘ভরা অর্ধরাত্রি। কমল ফুটিল। বত্রিশ যোগিনী, তাহার অঙ্গ উল্লসিত হইল।’
প্রথম ছত্রে ‘অর্ধরাত্রি ধরিয়া কমল ফুটিল।’—এ অর্থও হইতে পারে ।
১১ পৃষ্ঠায় বজ্রগীতিটি তুলনীয়
৩উ৪. ‘চালিত হইল শশধর অবধূতী মার্গে। রত্নপ্রভাবে সহজ কথিত হয়।’
অবধূতী-মার্গ শৈব যোগশাস্ত্রে সুষুম্না নাড়ী।
৫-৬. ‘চালিত (হইয়া) শশধর নিবাণে গেল। নলিনী পদ্মকে মৃণালে ধরিয়া রাখে।’
৭-৮. ‘বিরমানন্দ বিলক্ষণ(ও) শুদ্ধ। যে এখানে বোঝে সে এখানে বুদ্ধ।’
চার ক্ষণ অনুসারে আনন্দের চার অবস্থা—বিচিত্রানন্দ, বিপাকানন্দ, বিরমানন্দ ও সহজানন্দ। হেবজ্রতন্ত্র অনুসারে
বিচিত্রে প্রথমানন্দঃ পরমানন্দো বিপাককে।
বিমানন্দো বিমর্দে চ সহজানন্দো বিলক্ষণে ॥
সরহ বলিয়াছেন।
সমরস সহজানন্দ জাণিজ্জই ॥
‘সমরস হইলে সহজানন্দ জানা যায়।
৯-১০. ‘ভুসুকু বলে, আমি বুঝিলাম মেলায়, সহজানন্দ মহাসুখে লোল (হইয়া) (অথবা ‘মহাসুখলীলায়’)।
২৮
শবরশবরী চর্যা। পর্বতবাসী শবরশবরীর প্রেমলীলার বর্ণনা। এই সঙ্গে চর্যা ৫০ পঠনীয়।
১-২. ‘উঁচু উঁচু পাহাড়। সেখানে শবরী বালিকা বাস করে। পরণে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা।’
পৃষ্ঠা ২২ দ্রষ্টব্য।
৩-৪. ‘উন্মত্ত শবর। পাগল শবর । গোল করিও না, দোহাই তোমার। নিজ গৃহিণী (ও তোমার), নাম সহজসুন্দরী।’
তুলনীয় কাহ্নের দোহা, “ণিঅ ঘরিণী লই কেলি করন্ত”।
৫-৬, ‘নানা তরুবর মুকুলিত হইল। ওরে, গগনে লাগিল ভাল। একাকিনী শবরী এ বন ঢোঁড়ে—কানে কুণ্ডল কণ্ঠে (বজ্র) ধারণ করিয়া।’
৭-৮, ‘তিন ধাতুর খাট পড়িল, শবর, মহাসুখের শয্যা ছাওয়া (অর্থাৎ পাতা) হইল। শবর নাগর নৈরামণি নাগরী। প্রেম (-লীলায়) রাত্রি পোহাইল।’
৯-১০. ‘গুরু বাক্য-পুচ্ছ (বাণের)। নিজ মনকে বাণে বিদ্ধ কর। এক শরসন্ধানে বিদ্ধ কর, পরম নির্বাণের হেতু।’
১১-১২. ‘উন্মত্ত শবর, অত্যন্ত রোষযুক্ত। গিরিবরের শিখর সন্ধিতে প্রবেশ করিলে শবরকে খুঁজিয়া মিলিবে কিসে।’
২৯
দুর্লক্ষ্য বিজ্ঞান চর্যা। পরমতত্ত্ব যুক্তিতর্কের, অনুমান-প্রমাণের, বাহিরে, না সত্য না মিথ্যা।
১-২. ‘না হয় ভাব না যায় অভাব। এমন বোঝানোয় কে প্রত্যয় করে।’
তুলনীয় তীলোপার দোহ, “সহজে ভাবাভাব ন পুচ্ছই”, অর্থাৎ সহজাবস্থায় ভাব-অভাবের (অর্থাৎ অস্তিত্বনাস্তিত্বের) প্রশ্ন নাই। সরহের দোহা, “সহজ সহাব ণ ভাবাভাব।”
৩-৪. ‘লুই বলে— মূর্খ, বিজ্ঞান দুর্লক্ষ্য। ত্রিধাতুতে বিলাস করে, কিন্তু তাহার সন্ধান নাই পরিচয় নাই।’
৫-৬. ‘যাহার বর্ণ চিহ্ন রূপ নাই জানা, সে কিসে আগমে বেদে ব্যাখ্যাত হয় ?’
তুলনীয় সরহের দোহা, “যো অবাচ তহি কাহি বখাণে’, অর্থাৎ যাহা (বা যে) অবাচ্য সেখানে ব্যাখ্যানে কি (হইবে)।’
৭-৮. ‘কাহারে কী বলিয়া আমি জবাব দিব ? জলে যেমন চাঁদ (অর্থাৎ চন্দ্র-প্রতিবিম্ব) তেমনি সত্য নয় মিথ্যাও (নয়)।’
৯-১০. ‘লুই বলে—ভাবিবার কী (আছে)। যা লইয়া আছি তাহার সন্ধান নাই উদ্দেশও (নাই) ’
৩০
চন্দ্রোদয় চর্যা। মেঘশ্যাম দিবেসের অন্তে আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে। সেই উৎপ্রেক্ষায় সহজস্বরূপের উপলব্ধির ইঙ্গিত।
১-২. ‘করুণা-মেঘ নিরন্তর স্ফুরিত। ভাব-অভাবের (অর্থাৎ আলো-ছায়ায়) দ্বন্দ্ব দলিত।’
৩-৪. ‘উদিত হইল গগন-মাঝে অদ্ভুত। দেখ, ওরে সহজস্বরূপ ভুসুকুকে (অথবা ‘ওরে ভুসুকু, সহজ স্বরূপকে দেখ’)।’
তুলনীয় চর্যাপদ
উইঅউ রে ভুসুকু তারা
শান্তি ভণই পোহান্ত পহারা ॥
৫-৬. ‘যা ভাবিতে ভাবিতে ইন্দ্রিয়জাল টুটিয়া যায়, নিভৃতে (?) নিজমন উল্লাস দেয়।’ ৭-৮. ‘বিষয় বিশুদ্ধি আমি বুঝিলাম আনন্দে, যেমন গগনের উজ্জ্বল (শোভা) চাঁদে।’
৯-১০, “এ ত্রৈলোক্যে এই তো সার। যোগী ভুসুকু দূর করে অন্ধকার।’
এই চটি ভুসুকুর কোন শিষ্যের (শান্তির ?) রচনা হওয়া অসম্ভব নয়। চর্যাকার সহজস্বরূপ ভুসুকুকে দেখিতে বলিতেছেন (ছত্র ৪)। শেষ ছত্রে ভুসুকু স্পষ্টই চাঁদের সঙ্গে তুলিত হইয়াছেন। উপরে উদ্ধৃত শান্তি ভনিতার পদটি এখানে স্মরণীয়।
৩১
অদ্ভুত ভেলকি চর্যা। ডমরু বাজাইয়া ভেলকি বাজি দেখানো হইতেছে। আর্যদেব শূন্যে ভর করিয়া রহিয়াছেন। এই উৎপ্রেক্ষা।
১-২. ‘যেখানে মন ইন্দ্রিয় পবন হয় নষ্ট, (সেখানে) কোথায় জানি না আমার আত্মা (চিত্ত) প্রবেশ করিল।’
৩-৪. ‘অদ্ভুত করুশা ডমরুটি বাজিতেছে। আর্যদেব নিরালা (অথবা নিরালম্বে) অবস্থান করিতেছেন।’
সেকোদ্দেশটীকায় পদটি উদ্ধৃত আছে। পাঠ এই
অকঢ় করুণা ডমরুলি বাজঅ
আজ্জদেব নিরালে রাজঅ ॥
শূন্যে স্থিতি বাজি।
৫. ‘জ্যোৎস্না যেমন চন্দ্রকাস্তি (মণিতে) প্রতিফলিত হয়।’ (অথবা মূলের পাঠ ধরিলে, ‘চন্দ্ৰকান্তি যেমন চাঁদের প্রতি রশ্মিক্ষেপ করে।’)
৬, ‘(তেমনি) চিত্ত বিকরণ (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়চাঞ্চল্যবিহীন) হইলে সেখানে টলিয়া পড়ে।’
জীবন্মৃত্যু বাজি।
৭-৮. ‘ছাড়া হইল ভয় ঘৃণা লোকাচার। খুঁজিতে খুঁজিতে শূন্য বিচার।’
প্রথম ছত্র অখাদ্যভক্ষণ বাজি। দ্বিতীয় ছত্র অন্তর্ধান বাজি।
৯-১০. ‘আর্যদেব সকলকে বিহ্বল করিল। ভয় ঘৃণা দূরে নিবারিত হইল।’
৩২
মনঃশিক্ষা চর্যা। অধ্যাত্মসাধনায় বাহ্য উপকরণ অনাবশ্যক, কৃচ্ছ্র তপস্যাও তাই। সাধনার সামগ্রী ও শক্তি সাধকের মধ্যেই আছে। আত্মজ্ঞানের উদয়েই সিদ্ধি। এইরূপ সরল সহজসাধনার ইঙ্গিত রহিয়াছে এই চর্যায়।
১. ‘না নাদ না বিন্দু না রবি (-মণ্ডল) না শশিমণ্ডল (আবশ্যক)।’
নাদ-বিন্দু যোগীদের সাধনার সামগ্রী এবং উপায় । রবি ও শশী যোগীদের কর্ণ-আভরণ এবং দেহের প্রধান দুই নাড়ী।
২. ‘চিত্তরাজ স্বভাবতই মুক্ত।’
রাজ=গজেন্দ্র। তুলনীয় কৃষ্ণদাস কবিরাজের উক্তি, “নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম সাধ্য কভু নয়”।
৩-৪, ‘হড়কা পড়িলে সোজা (পথ) ছাড়িয়া বাঁক লইও না । নিকটে বোধি, ওরে লঙ্কায় যায় না।’
৫. ‘ওরে (তোর) হাতে কাঁকন, দর্পণ খুঁজিস না।’
বাংলায় এই প্রবাদবাক্যটি চলিয়া আসিয়াছে। মিথিলায়ও অজানা ছিল না । তুলনীয় বিদ্যাপতি, “হাথক কঙ্কন অরসী কাজ”।
৬, ‘আপনা আপনি বোঝ তুই নিজ মন (অথবা ‘হে নিজ মন’)।’
৭-৮. ‘অপর পারে (উত্তীর্ণ হইয়া) সেই অনুসৃত হয়। সঙ্গে দুর্জন (থাকিলে) অপসৃত হইয়া যায়।’
৯-১০. ‘বামে ডাইনে বা (তা হইল) খাল ডোবা। সরহ বলে—বাবা, (সামনে) সোজা পথ প্রতিভাত।’
টীকাকারের মত “খাল”, “বিখলা” “উজুবাট” যথাক্রমে ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না (অবধূতী) নাড়ী ।
৩৩
বিশুদ্ধ প্রহেলিকা চর্যা। অসম্ভবসংঘটনার প্রহেলিকা-রূপকের দ্বারা অধ্যাত্ম সাধনার ও,অনুভূতির বর্ণনা।
আনুমানিক দেড়শত-দুইশত বছরের একটি পুরানো পুথিতে চর্যাটির এই কালোপযোগী হিন্দী-বাংলা রূপান্তর কবীরের ভনিতায় পাওয়া গিয়াছে,
রাগ বিভাষ
অব কেয়া করে গান গাঁব-কতুআলা
শ্ব মাংস-পসারি গীধ রাক্ষউআলা।
মূষকী নাও বিলাই কাঁড়ারী
শোয় মেড়ুক নাগ পহারী।
বলদ বিয়াওএ গাভী ভই বাঞ্ঝা।
বাছুরি দুহাওএ দিন তিন সাঞ্ঝা।
নিতি নিতি শৃগাল সিংহ সনে জুঝে
কহে কবীর বিরল জনে বুঝে ॥
‘এখন কে গান করে ?—গ্রামের কোতোয়াল। কুকুর দিয়াছে মাংসের পসরা, রাখোয়াল শকুনি। ইন্দুরের নৌকো, বিড়ালকাণ্ডারী । বেঙ শুইয়া আছে, সাপ পাহারা দিতেছে। বলদ বৎস প্রসব করিয়াছে, গাই রহিয়াছে বন্ধ্যা। বাছুর দোহা হয় দিনে তিন সন্ধ্যা। নিত্য নিত্য শৃগাল সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করে। কবীর কয়—অতি অল্প লোকে (ইহা) বুঝে।’
১-২. ‘টোলায় আমার ঘর, পড়শী নাই। হাঁড়িতে ভাত নাই, নিত্যই রাতের অতিথি ।’
দ্বিতীয় ছত্রটি বাংলার একটি বিশিষ্ট প্রবাদবাক্য। তুলনীয় বীরভূমে প্রচলিত প্রবাদবাক্য—হাঁড়িতে ভাত নাই নাঙ্গে ঢেলাচ্ছে।’
৩. ‘বেগে সংসার বর্ধিত হইয়া প্রবাহিত হইতেছে।’
এই ছত্রের পাঠ ও অর্থ লইয়া সংশয় আছে। টীকাকার “বেঙ্গ” লইয়াছেন “ব্যঙ্গ” অর্থাৎ “বিগতাঙ্গ” অর্থে এবং টানা মানে করিয়াছেন “ব্যঙ্গেন প্রভাস্বরেণ বিজ্ঞানপরশ্চোদিতঃ”। শাদা কথায় “বেঙে তাড়া করে সাপকে”। তিব্বতী অনুবাদকারী এই অর্থই লইয়াছেন। কবীরের ভনিতায় প্রাপ্ত রূপান্তরের সঙ্গে মিলাইয়া লইলে এই পাঠ কল্পনা করিতে পারি— ‘বেঙ্গ শোএ সাপ বেঢ়িল জাঅ।’ টীকাকার যে পাঠ পাইয়াছিলেন তাহাতে ছিল “বেঙ্গ সয়” (“অঙ্গস্য ষড়ঙ্গতৌ সয়তি গচ্ছতীতি সয়ঃ তদেব বায়ুরূপং তেন ব্যঙ্গেন প্রভাস্বরেণ বিজ্ঞানপরশ্চোদিতঃ”)। সুতরাং “বেঙ্গ শোএ” এই পাঠের সমর্থন টীকাতেও রহিয়াছে।
“বেঙ্গ সয় সাপ বেঢ়িল ছাঅ (অর্থাৎ বেঙ শুইয়া আছে সাপ তাকে বেড়িয়া যাইতেছে), অথবা “বেঙ্গ স সাপ বহিল জাঅ” (অর্থাৎ বেঙ সে সাপ বাহিত যাইতেছে)—এমন পাঠও কল্পনা করা যাইতে পারে।
৪. ‘দোহা দুধ কি বাঁটে সামায় (অর্থাৎ ঢোকে)।’
৫-৬. ‘বলদ প্রসব করিল, গাই (রহিল) বাঁঝা। পাত্র দোহা হয় তিন বেলা।’
৭. ‘যে সেই বুদ্ধি সেই (তো) ধন্য বুদ্ধি।’
মনে হয় টীকাকার পাঠ পাইয়াছিলেন “সোই নিবুধী” (“বালযোগিনাং যা বুদ্ধি সবিকল্পকজ্ঞানং সা পরমার্থবিদাং প্রতি গুরুপ্রসঙ্গনিরুপলম্ভরূপা”)। তিব্বতী অনুবাদকও এইরকম বুঝিয়াছিলেন ।
‘যে সে চোর সেই চোরধরা।”
৯. নিতি নিতি শিয়াল সিংহের সঙ্গে যোঝে।’
তুলনীয় ঋগ্বেদ “লোপাশঃ সিংহম্ প্রত্যঞ্চমৎসাঃ”।
১০. ‘ঢেণ্টনপাএর গীত খুব কম লোকে বোঝে।’
৩৪
মহাসুখ চর্যা। শূন্য-করুণার মিলনে, সমরসে, মহাসুখপ্রাপ্তি। গগনসমুদ্রের ওপারে আছে মহাসুখনীড়। এই উৎপ্রেক্ষা।
১-২. শূন্য-করুণার অভিন্ন-চারে কায় বাক্ চিত্ত (লইয়া) বিলাস করে, দারিক—গগনে ওপার কূলে। অলক্ষ্যের লক্ষ্যে চিত্ত (নিবেশ করিয়া) বিলাস করে দারিক—গগনে ওপার কূলে।’
৩-৪. ‘কি তোর মন্ত্রে কি তোর তন্ত্রে, কি তোর ধ্যানে ব্যাখ্যানে, (যেখানে)। অপ্রতিষ্ঠান মহাসুখে লীন পরম নিবাণ দুর্লক্ষ্য।’
৫-৬, ‘দুঃখে সুখে একই করিয়া ইন্দ্রিয় ভোগ করে জ্ঞানী। নিজ পর অপর হুঁশ করে না দারিক, (সে) সকলই অনুওর মানে।’
৭-৮, ‘রাজা রাজা রাজা, ওরে অপর (সবাই) রাগমোহে বদ্ধ। লুইপাদের অনুগ্রহে দারিক দ্বাদশ ভুবনে লব্ধ (অর্থাৎ সিদ্ধ)।
৩৫
চিত্তবিনাশ চর্যা। গুরুর উপদিষ্ট সাধনার দ্বারা চিত্তস্থির হইলেই মোহমুক্তি। সে অবস্থায় অনুভবের ইঙ্গিত এখানে।
১-২. ‘এতকাল আমি ছিলাম মোহে। এখন আমার বোঝা হল সদ্গুরুর জ্ঞানসঞ্চারে।’
৩-৪. ‘এখন চিত্তরাজ আমার কাছে নষ্ট, গগন-সমুদ্রে টলিয়া প্রবিষ্ট।’
৫-৬. ‘দেখিতেছি দশদিক সবই শূন্য। চিত্ত বিহনে পাপ না পুণ্য (না)।’
৭-৮, ‘রাউল (রাজপুরুষ গুরু) আমাকে (অথবা ‘আমাকে লক্ষ্য করিয়া’) ভনিয়া দিল । আমার দ্বারা সংগৃহীত হইল গগনে পানি।’
৯-১০, ‘ভাবে (বা ‘ভাদে’) বলে অভাগ্য সম্বন্ধে। চিত্তরাজ আমার দ্বারা সংগৃহীত। (অর্থাৎ শৃঙ্খলিত, অথবা ভক্ষিত) হইল।’
৩৬
সহজনিদ্রা চর্যা। নির্বিকল্প সহজাবস্থায় সকল দ্বন্দ্ববিরোধ, উৎপাদ-অপায়, বিনষ্ট হয়। নির্ভরনিদ্রার উৎপ্রেক্ষায় সেই সহজ অনুভূতির প্রকাশ এই চর্যাগীতিতে।
১. ‘শূন্য বাসঘর তথতা প্রহরী।’
“বাহ সম্ভবত টীকাকারের দৃষ্ট পাঠে “বাহর” ছিল, তাই তিনি ব্যাখ্যা করিয়:ছেন “বাসনাগার” বলিয়া। শূন্য ভাণ্ডাগার ভাঙ্গিয়া ধনরত্ন সব লুট করা হইল, ইহাই বাহ্য অর্থ। “বাহর” পাঠ ধরিলে ছন্দেরও সুবিধা হয়। তিব্বতী অনুবাদ “বাহ” বা “বাহু” পাঠ সমর্থন করে।
২. ‘মোর ভাণ্ডার হইতে (অথবা ‘লইতে’) সকল সংগৃহীত হইল।’
৩-৪. ‘ঘুমায় সে, হুঁশ নাই তাহার আত্মপর বিবেচনায়। সহজনিদ্রাকুল নাঙ্গা কাহ্ন বেচারা।’
৫-৬. ‘চেতনা নাই, বেদনা (অর্থাৎ সাড়ও) নাই। ভর-নিদ্রায় মগ্ন। সকল সকল করিয়া সুখে সুপ্ত।’
৭-৮, ‘স্বপ্নে আমার দেখা হল ত্রিভুবন শূন্য। (কেবলই) ঘোরা (অথবা ‘ঘানির পাক’), আনা গোনা নাই।’
৯-১০. ‘জালন্ধরিপাকে সাক্ষী করা হইবে। পণ্ডিত-আচার্য আমার পক্ষে রয় (অথবা ‘চায়’) না।’
জালন্ধরিপা সম্ভবত চর্যাকারের গুরু ছিলেন। “নাথ”-সাধনার ঐতিহ্যে কাহ্নের গুরু জালন্ধরিপা, নামান্তর হাড়িপা।
লক্ষণীয়, টীকায় এবং অন্যত্র কাহ্ন “পণ্ডিতাচার্য” রূপে উল্লিখিত।
সহজানুভব চর্যা। সর্বসংস্কাররিমুক্ত সহজ-অবস্থায় যোগী সংসারে থাকিয়াও নাই । এই অনির্বচনীয়তার উৎপ্রেক্ষা।
১-২. ‘আপনি(ই) নাই, আমার কিসের শঙ্কা (তবে)। তাই মহামুদ্রার আকাঙ্ক্ষা টুটিয়া গেল।’
৩-৪. ‘সহজ অনুভব। ওরে যোগী, ভুলিও না। চতুষ্কোটিবিমুক্ত যেমন তেমন করিয়া হইতে হয়।’
৫-৬. ‘যেমনভাবে ছিলে তেমনিভাবে আচ্ছা। সহজ যে (জীবন হইতে) পৃথক—এ ভুল ধারণা, যোগী, করিও না।’
৭-৮. ‘পুরুষাঙ্গ অণ্ডকোষ সন্তরণে জানা যায়। বাক্যপথের অতীত কি করিয়া ব্যাখ্যা করা যায় ?’
৯-১০. ‘তাড়ক বলে—এখানে (তর্কের) ফাঁক নাই। যে বোঝে তাহার গলায় ফাঁসি।’
৩৮
নৌবাহিক চর্যা। সহজে নৌকা বাহিয়া গন্তব্যস্থানে পৌঁছিবার উৎপ্রেক্ষা।
ত্রয়োদশ চর্যা তুলনীয়। দেহ-নৌকা ভারতীয় সাহিত্য ও অধ্যাত্মচিন্তায় একটি বিশিষ্ট প্রতীক।
১-২. ‘কায় (হইল) ছোট নৌকাখানি, মন (হইল) কেরোয়াল। সদ্গুরু-বচনে পতবাল (অর্থাৎ পাল) ধর।’
তুলনীয় বৈষ্ণব পদ, “হরিনামের নৌকাখানি নিতাই কাণ্ডারী ।”
৩-৪. ‘চিত্ত স্থির করিয়া নৌকার নাভি (অর্থাৎ মধ্যস্থান) ধর। অন্য উপায়ে পারে যাওয়া যায় না।’
৫-৬. ‘নৌবাহিক (তড়ে) নৌকা টানে দড়িতে। সহজের সঙ্গে মিলনে মেল । অন্যথা যাওয়া যায় না।’
৭-৮. ‘পথে ভয়। দস্যুও বলবান্ । ভব-উল্লোলে সবই বিধ্বস্ত।’
৯-১০. ‘কূল ধরিয়া খর স্রোতে উজান যায় । সরহ বলে—গগনে প্রবেশ করে।’
৩৯
অবিনীত চিত্ত চর্যা। গুরু-অনুগতি ভিন্ন পথ নাই। গুরুর কথা না শোনায় বিহার হইতে বহিষ্কৃত শিষ্যের দুর্গতির উৎপ্রেক্ষা।
১-২. ‘স্বপ্নেও অবিদ্যারত, ওরে মন, (তুই) নিজের দোষে। বিবাগী তোর গুরুবচনবিহারে থাকা হইবে কি করিয়া ?’
৩-৪, ‘আশ্চর্য হুভব গগন। বঙ্গে জায়া লইলি। পরে তোর বিজ্ঞান ভাঙ্গিল।’
৫-৬, ‘ওরে ভবমোহ অদ্ভুত, পর দেখায় আপন। জলবিম্বকার এ জগতে সহজবস্থায় আত্মা শূন্য।’
৭-৮. ‘অমিয়া থাকিতে বিষ গিলিস, ওরে চিত্ত, (তোর) আত্মা পরবশ(?)। ঘরে পরে কি মোর বুঝিলে, ওরে আমার খাওয়া হইবে দুষ্ট কুটুম্বকে।’
শেষ ছত্রের অর্থ সংশয়িত।
তুলনীয় সরহের দোহা, “খরবই খজ্জই” (=গৃহপতিঃ খাদ্যতে)।
৯-১০, ‘সরহ বলে—বরং শূন্য গোয়াল, কি (হইবে) মোর দুষ্ট বলদে। একেলা (হইলে) জগৎ বিনাশিত। ওরে, (আমি) সচ্ছন্দে বিহার করি।’
নবম ছত্রের প্রবাদটি অদ্যাবধি চলিত আছে।
৪০
মূকবধির গুরুশিষ্য চর্যা। সহজাবস্থা অনির্বচনীয়, সাধারণ বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়। পণ্ডিতন্মন্য যদি কেউ তাহা ব্যাখ্যা করিতে যায় তবে সে কালা শিষ্যকে বোবা গুরুর উপদেশ দেওয়ার মতোই অলীক। সহজসাধনার ইঙ্গিত দতেছেন বজ্রগুরু আভাসে, যেমন করিয়া কালা বোবাকে পথের হদিশ দেয়। চর্যাগীতিটির ইহাই তাৎপর্য।
তুলনীয় সরহের দোহা
ণউ তম্বাঅহি গুরু কহেই বউ তম্বুজ্ঝই সীস।
সহজামিঅরসু সকল জগু কাসু কহিজ্জই কীস।
‘বাক্যের দ্বারা গুরু কখনই তাহা বলিতে পারে না শিষ্য তাহা কখনই বুঝিতে পারে না। সকল জগৎ সহজামৃতরসময়, কাহাকে কি করিয়া বলা যায় ?’
কৃষ্ণদাস কবিরাজের উক্তিও স্মরণীয় “সহজবস্তু না যায় লিখন”।
১-২. ‘যে মনগোচর (তাহার জন্যই) বাজে আড়ম্বর—আগমপুথি, টাট, মালা। তুলনীয় সরহের দোহা
জো মণগোঅর পাঠিঅই সো পরমত্থ ণ হোন্তি ।
‘মনোগোচর যাহা পড়ানো হয় তাহা পরমার্থ নয়।’
৩-৪, ‘বল কিসে সহজ বলা যায়, যাহাতে কায়বাক্চিত্ত প্রবেশ করে না।’
৫-৬, ‘বৃথাই গুরু শিষ্যকে উপদেশ দেয়। বাক্যপথের অতীত (ভাব) কিসে বলা যায় ? ’
৭-৮, ‘যতই বলে ততই ভুল করে। গুরু বোদা (পাঠান্তরে ‘বোবা’), শিষ্য কালা।’
৯-১০, ‘কাহ্ন বলে—জিনরত্ন কেমন ? যেমন কালার দ্বারা বোবাকে বোঝানো।’
৪১
রজ্জুসপাদি প্রতিভাস চর্যা। পরমার্থে জগতের উৎপাদও নাই ভঙ্গও নাই। ইন্দ্রিয়বেদ্য জ্ঞান সবই মিথ্যা। ইহাই কয়েকটি উৎপ্রেক্ষার দ্বারা প্রতিপাদিত।
১-২. ‘আদিতে অনুৎপন্ন এ জগৎ, ওরে, ভ্রান্তিতে সে প্রতিভাত হইতেছে। রজ্জুসর্প দেখিয়া যে চমকিত হয় যথার্থই কি (তাহাকে) বড়ে (অথবা ‘বোড়ায়’) খায় ?’
৩-৪. ‘আশ্চর্য, ওরে যোগী। হাত নোনা করিও না। এই রকম স্বভাবে যদি জগৎকে বুঝিস (তবে) তোর বাসনা টুটিবে।’
৫-৬. ‘মরুমরীচিকা গন্ধর্বনগরী দর্পণে প্রতিবিম্ব যেমন, বাতাবর্তে দৃঢ় হইয়া জল যেমন পাথর।’
৭-৮. ‘বন্ধার পুত্র যেমন খেলা করে বহুবিধ খেলা—বালুকার তেলে, খরগোসের শিঙে, পুষ্পিত আকাশে (অর্থাৎ আকাশফুলে।’
৯-১০, ‘রাউত বলে সনির্বন্ধে ভুসুকু বলে সনির্বন্ধে—সয়ালের (অর্থাৎ জগতের স্বভাবই এই রকম। যদি মূঢ় তোর (অথবা ‘তুই’) ভ্রান্তি (অথবা ‘ভ্রান্তিতে’) থাকে (অথবা ‘থাকিস’) তবে তুই সদ্গুরুর চরণে প্রশ্ন কর।’
৪২
স্বন্ধবিয়োগ চর্যা। সিদ্ধ যোগীর জন্মমৃত্যু নাই। তাঁহার আসন্ন বিয়োগে শিষ্যের কাতরতা দেখিয়া কাহ্ন যেন তাহাকে প্রবোধ দিতেছেন।
তুলনীয় সরহের দোহা, “জোই কালু করই কিরে তব্বে?”। (‘যোগী কিরে তবে দেহত্যাগ করে ?’)
১-২. ‘সহজাবস্থায় চিত্ত সম্পূর্ণ শূন্য। স্বন্ধের বিনাশে কাতর হইও না।’
৩-৪, ‘বল, কিসে কাহ্নু নাই। ব্যক্ত রহিয়াছে (সে) সর্বদা ত্রিভুবন ব্যাপিয়া।’
৫-৬, ‘দৃষ্ট (বস্তু) নষ্ট দেখিলে কাতর হয় (যে সে) মৃঢ়। তরঙ্গভঙ্গ কি সাগর শুষিয়া লয় ?’
তুলনীয় সরহের দোহা, “অণ্ণ তরঙ্গ কি অণ্ণ জলু” (‘তরঙ্গ আর জল কি ভিন্ন?’)।
৭-৮. ‘মূঢ় হইলে লোকে (সত্য) দেখে না। দুধের মাঝে ননী থাকিলে(ও) দেখা যায় না।’
৯-১০. ‘এ সংসারে যায় না আসে (না) কেউই। এমনিভাবে বিলাস করে যোগী কাহ্ন-বেচারা।’
৪৩
সমরস চর্যা। সহজাবস্থায় অস্তি নাই নাস্তিও নাই। উৎপাদ এবং ভঙ্গ দুইই সমান মিথ্যা।
১-২. ‘সহজ-মহাতরু এ ত্রিভুবনে বিস্তারিত । শূন্য-স্বভাবে ওরে কে বা না মুক্ত (অথবা ‘বর্ণত্যক্ত’)?
তুলনীয় তীলোর দোহা, “অদ্দর চিত্ত তরুবরহ গউ তিহুবণেঁ বিত্থার” (‘অদ্বয় চিত্ত তরুবরের ত্রিভুবনে বিস্তার পাইয়াছে’)।
৩-৪. ‘যেমন জলে পানি (অর্থাৎ জল) পড়িলে পৃথক্ করা যায় না, তেমনি, ওরে মনরত্ন সমরস (হইলে) গগনে মিশিয়া যায়।’
৫-৬. ‘যাহার আপন নাই তাহার পর কোথায়। ওরে, মূলেই যে অনুৎপন্ন তাহার জন্ম মৃত্যু স্থিতি নাই।’
৭-৮, ‘ভুসুকু বলে সনির্বন্ধে, রাউত বলে সনির্বন্ধে,—সয়ালের (অর্থাৎ সংসারের) এই স্বভাব। কেউ যায় না আসেও (না)। তাহাতে ভাব নাই অভাবও নাই।’
সপ্তম ছত্রটি ৪১ চর্যার নবম ছত্রের সঙ্গে প্রায় এক।
তথতানাদ চর্যা। চতুর্থক্ষণে বিবমানন্দপ্রাপ্তির অবস্থা উৎপ্রেক্ষিত ।
১-২. ‘শূন্যে শূন্য মিলিল যখন, সকল ধর্ম উদিল তখন।’
৩-৪. ‘আছি (আমি) চতুঃক্ষণ সংবধিতে। মধ্য নিরোধে অনুত্তর বোধি (লাভ হয়)
৫-৬, ‘বিন্দু নাদ হৃদয়ে প্রবিষ্ট নয়। এক চাহিতে অন্য বিনষ্ট ।’
তুলনীয় ৩২ চর্যা, “নাদ ন বিন্দু ন রবি ন শশিমণ্ডল”।
৭-৮, ‘যে ভাবে আসিলে সে ভাবে জানো। মাঝে থাকিয়া সয়াল (অর্থাৎ জগৎসংসার)-ই হানো।’
৯-১০. বলে কঙ্কণ কলকলশব্দে—সব বিচূর্ণ হইল ৩থতানাদে।’
৪৫
বৃক্ষচ্ছেদ চর্যা। বাসনাজালসৃষ্টিকারী মন আগাছারূপে উৎপ্রেক্ষিত। অধ্যাত্মসাধনা যেন সেইরকম গাছ কাটা।
তুলনীয় প্রথম চর্যার প্রথম ছত্র, “কায়া তরুবর”।
১-২. ‘মন তরু, পাঁচ ইন্দ্রিয় তার শাখা, আশারূপ প্রচুর পত্রের উপশাখা (অথবা ‘বাহক’)।
৩-৪. ‘গুরুবচন-কঠারে কাটিতে হয়। কাহ্ন বলে—তরু পুনরায় উৎপন্ন হয় না।’
৫-৬, ‘সে তরু বাড়ে শুভ-অশুভ (অর্থাৎ পূণ্য-পাপ) রূপ জলে (অর্থাৎ সেচে) বিদ্বান্ ব্যক্তিরা (সে তরুকে) কাটে গুরুর দোহাই দিয়া।’
৭-৮, ‘যে তরুচ্ছেদনরহস্য জানে না, ওরে, সে মূঢ় পদস্খলিত হইয়া তখন সংসার মানিয়া লয়।’
৯-১০. ‘শূন্য তরুবর, গগন কুঠার। কাটো সে তরু, (যেন না) মূল না ডাল (থাকে)।’
৪৬
ছায়ামায়া চর্যা। সংসার তেমনই সত্য যেমন ছায়া-প্রতিবিম্ব। মোহমুক্তি হইলে সত্যবোধ হয়। তখন জন্ম মৃত্যু স্থিতি একই।
১-২. ‘দেখা যায় যেমন স্বপ্নে, আরশিতে, তেমনি (লোকে দেখে) মোহের আড়ালে ।’
৩-৪. ‘মন (যখন) মোহবিমুক্তি পায় (অর্থাৎ মোহবিমুক্ত হয়) তখন আনাগোনা টুটিয়া যায়।’
৫. ‘না (সে) পোড়ে, না (সে) ভিজে, না (সে) ছেঁড়ে।’
তুলনীয় সরহের দোহা
পবণ বহন্তে ণউ সো হল্লই
জলণ জ্বলন্তে ণউ সো ডজ্ঝই।
ঘণ বরিসন্তে ণউ সো তিন্মই
ণ উবজ্জই ণউ খঅহি পইস্সই ॥
‘বায়ু বহিলে (সে) হেলে না, আগুন জ্বলিলে (সে) পোড়ে না। মেঘ বর্ষণে (সে) ভিজে না। (সে) উৎপন্ন হয় না, (সে) ক্ষয়েও পড়ে না।’
৫-৬, এই দুই ছত্রের ভাষা অবহট্ট।
৬. ‘দেখ, লোক মোহে পুনঃ পুনঃ বদ্ধ হয়।’
৭-৮. ‘ছায়া মায়া ও কায়া—সমান। বিনা পক্ষাপক্ষে সেই বিজ্ঞান।’
৯-১০. ‘চিত্ত তথতা-স্বভাবে শোভিত হয়। স্পষ্ট বলে জয়নন্দী—অন্য কিছু নয়।’
৪৭
গৃহদাহ চর্যা। ঘরে আগুন লাগিয়াছে। জল ঢালিয়া আগুন নেবানো হইল। কিন্তু তখন সবই পুড়িয়া গিয়াছে, গৃহে প্রতিষ্ঠিত দেবতা-বিগ্রহ এমন কি শাসনপট্টও। এই উৎপ্রেক্ষা।
১-২. ‘কমলকুলিশ মাঝে হয় আমার অন্তঃপুর (?)। সমতা-যোগে চণ্ডালী জ্বলিত ’
৩-৪. ‘ডোম্বী ঘরে দাহ, আগুন লাগিয়াছে। শশধর লইয়া জল সিচিঁতেছি।’
৫-৬, ‘খরজ্বাল (অথবা ‘খড়ের জ্বাল’), ধূম—(কিছুই) দেখা যায় না। মেরুশিখর ধরিয়া গগনে প্রবেশ করে।’
অর্থাৎ আগে ধোঁয়া অথবা আঁচ কিছুই বোঝা যায় নাই। চালের উপর ফুড়িয়া আগুন দাউ দাউ করিয়া আকাশে উঠিল।
৭-৮. ‘পুড়িতেছে হরি হর ব্রহ্মা ভট্টারক (অর্থাৎ ঠাকুর), পুড়িয়া গেল নয়খণ্ড (অথবা ‘পইতা’ এবং) শাসনপট্ট।’
“নবগুণ শাসন-পড়া” দুই অর্থে নেওয়া যাইতে পারে। এক অর্থে-নবগুণ (অর্থাৎ পইতা) এবং শাসনপট্ট, অপর অর্থে নয়-ফলক বিশিষ্ট শাসন-পট্ট। রাজপ্রদত্ত ভূমির পরিমাণ অথবা গ্রহীতার সংখ্যা বহু হইলে একাধিক ফলকে তাম্রশাসনপট্ট উতকীর্ণ হইত । এগুলি ধাতুনির্মিত বলিয়া একত্র গাঁথা থাকিত। এইরকম গাঁথা শাসনপট্ট পুড়িয়া নষ্ট হওয়ার উল্লেখ পাই ভাস্করকর্মার নিধনপুর তাম্রশাসনে। ভাস্করবর্মার বৃদ্ধ প্রপিতামহ ভূতিবর্মা অনেকগুলি সদ্ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। গৃহদাহে অথবা গ্রামদাহে শাসনপট্টগুলি পুড়িয়া যাওয়ায় জমিগুলি কর-নির্ধারণযোগ্য হয়। ভাস্করবর্মার সেই সব শাসনপট্ট নূতন করিয়া লিখাইয়া জমিগুলিকে পুনরায় নিষ্কর করিয়া দেন। এই কথা নিধনপুর অনুশাসনের শেষে লেখা আছে,
শাসনদাহাদ্ অর্বাগভিনবলিখিতানি ভিন্নরূপাণি।
তেভ্যোহক্ষরাণি যস্মাৎ তস্মান্ নৈতানি কুটানি॥
‘শাসন-দাহের জন্য পরে নূতন করিয়া লিখিত হওয়ায়, পূর্ববর্তী (আসন) হইতে অক্ষরগুলি যেহেতু ভিন্নরূপ হইল, কিন্তু সেই-হেতু এগুলি জাল নহে।’
৯-১০. ‘ধাম স্পষ্ট বলে—ওরে, জানিয়া লও। পাঁচনলায় জল উঠিয়া গেল।’
৪৯
জলদস্যুতা চর্যা। জলদস্যুর লুণ্ঠনে সম্পন্ন গৃহস্থের ধনজন সর্বস্ব গেল। নিঃস্ব হওয়ায় তাহার জীবনমরণ সমান হইল। এই রূপকের সাহায্যে সহজসাধনার ও সিদ্ধির নির্দেশ দিয়েছেন ভুসুকু। তুলনীয় চর্যা ৪৭।
১-২. ‘বজ্র-নৌকা পাড়ি দিয়া পদ্ম-খালে বাহিত হইল। দয়াহীন ডাঙ্গালিয়া দেশ লুট করিল।’
ছত্র ২: দঙ্গালিয়া যোগীর উল্লেখ আছে অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থে। নেপালে কাঠমাণ্ডুর পশ্চিম দিকে ‘দঁগালী’ বা ‘দাঁগ’ নামে একশ্রেণীর ব্রাহ্মণ আছে। যোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর রচনায় নিঃস্ব ভবঘুরে অর্থে ‘ডাঙ্গালিয়া’ শব্দ পাই। যেমন, “মোরে বিভা দিল বাপ ডাঙ্গালিয়া বরে।”
৩-৪. ‘আজ, (আমি) ভুসুকু, বাঙ্গালী হইলাম। চণ্ডালীকে নিজ গৃহিণী করিয়াছি ’ তুলনীয় চর্যা ৩৯।
“বঙ্গে জায়া নিলেসি পরে ভাঙ্গেল তোহার বিণাণা॥”
৫-৬. ‘দগ্ধ (হইল) পাঁচ পাটন (অর্থাৎ বাণিজ্যনগর), নষ্ট (হইল) ইন্দ্রের সমান রাজ্য না জানি চিত্ত মোর কোথায় গিয়া ঢুকিল।’
৭-৮. ‘সোনা রূপা মোর কিছুই থাকিল না। নিজ পরিবারে (পূর্বে আমি) মহাসুখে ছিলাম।’
৯-১০. ‘চার কোটি (মূল্যের) ভাণ্ডার মোর নিঃশেষে হইল। বাঁচায় মরায় কোন তফাৎ নাই।’
৫০
মত্তশবর মৃত্যু চর্যা। শবর-শবরীর ঘরবাড়ী, মদমত্ততা, মদ্যপানে শবরের মৃত্যু এবং তাহার সৎকার—এই রূপকপরম্পরার মধ্য দিয়া পরমার্থসত্য-অনুভবের ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে এই কাব্যগুণসমৃদ্ধ চর্যাগীতিতে।
শবর-শবরীর পূর্বরাগ ও প্রথম বিরহ ২৮ সংখ্যক চর্যার বর্ণিত আছে।
১-২. “গগনে গগনে তৃতীয় বাড়ী, হৃদয়ে কুঠার, কণ্ঠে নৈরামণি বালিকা । জাগিয়া থাকিলে মঙ্গল।’
বধদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির গলায় বধ-অস্ত্ৰ কুঠার বাঁধিয়া দেওয়া হইত ।
৩-৪.‘একেবারে ছাড় মায়ানমোহ, বিষম ঝঞ্ঝাট। মহাসুখে বিলাস করিতেছেন শবর শূন্য মেয়েমহল লইয়া।’
৫-৬. ‘এই তো আমার তৃতীয় বাড়ী খসমের সমতুল্য । ওরে, এখন উত্তম কাপাস ফুটিয়াছে।’
৭-৮. ‘তৃতীয় বাড়ীর পাশের বাড়ী তখন জোৎস্না (=সমুজ্জ্বল)। দূর হইল অন্ধকার, ওরে, আকাশে ফুল ধরিয়াছে।’
৯-১০. ‘কঙ্গুচিনা পাকিল। ওরে, শবর-শবরী মাতিল। দিনের পর দিন শবর কিছুই খেয়াল রাখে না, মহাসুখে মগ্ন।’
১১-১২. ‘চার বাঁশে (খাট) গড়িল, ওরে, চাঁচাড়ি দিয়া। তাহাতে তুলিয়া শবরকে (অথবা শবর’) দাহ করা হইল (অথবা ‘করিল’) । কাঁদে শকুনি শিয়াল।’
দ্বাদশ ছত্রের শেষাংশের প্রবাদটি এখনো চলিত আছে।
১৩-১৪, ‘মরিল (অথবা ‘মারা হইল’) ভবমত্ত (অথবা ‘ভবমত্তকে’)। দশদিশে দেওয়া হইল বলি (অর্থাৎ পিণ্ড)। এই সে শবর (অথবা ‘শবরী’) নির্মূল হইয়া গেল। সব দুঃখ দূর হইল।’