ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক

ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক

কুরচি নামে একটা জায়গা আছে, কস্মিনকালেও শুনিনি। কিন্তু ওই যে আমাদের টপ্পাদা, তার আবার অদ্ভুত সব বাতিক। ম্যাপ খুঁজে খুঁজে উদ্ভুট্টে সব জায়গা বের করবেন। তারপর একটা শুভক্ষণ দেখে একদিন দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়বেন। ফিরে এসে এইসা একখানা গপ্পো শোনাবেন যে আমাদের গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাবে।

আমাদের অজানায় অভিযান ক্লাবের মূলে ওই টপ্পাদারই প্রেরণা ছিল। আমরা পঁচজন কিশোর মিলে রাতারাতি ক্লাবটা গড়ে ফেলেছিলুম। টপ্পাদা তার সভাপতি হলেন। ক্লাবের উদ্দেশ্য হল, আজগুবি অচেনা সব জায়গায় বেড়াতে যাওয়া। অর্থাৎ স্রেফ অ্যাডভেঞ্চার। প্রথমবার কোথায় যাওয়া হবে তা ঠিক করে দিলেন টপ্পাদাই এবং কুরচির কথা তার কাছে এই প্রথম শুনলুম। টপ্পাদা গম্ভীর মুখে বললেন, হা, কুরচিই ভালো হবে। প্রথমে ছোটখাট থেকে শুরু করা ভালো। ক্রমে-ক্রমে আরও কঠিন কঠিন জায়গার নাম বলব।

নিরু আমাদের নেতা। বয়সে বড়। ঢ্যাঙা, একটু কুঁজো, রোগাটে গড়ন। কিন্তু দারুণ সাহসী। সে খুঁতখুঁতে করে বলল, কুরচি। নাম শুনেই মনে হচ্ছে তেমন কিছু নয়। টপ্পাদা, বরং আরও দু-একটা জায়গার নাম বলুন।

টপ্পাদা রেগে গিয়ে বললেন,–তেমন কিছু নয়? ওরে হতভাগা! শেক্সপিয়ার পড়িসনি, তাই বলছিস! হোয়াটস ইন এ নেম? নামে কী আসে যায়? কুরচিকে অত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিস নে। মাত্র একরাত্তির ছিলুম সেখানে, তাতেই আমার যা অবস্থা হয়েছিল, বাপস!

টপ্পাদা চোখ বুজে কাঁধে ঝাঁকুনি দিলেন। যেন শিউরে উঠলেন। তবু বললুম, কী হয়েছিল টপ্পাদা?

টপ্পাদা চোখ খুলে মিটিমিটি হেসে মাথা দোলালেন। বললেন, উঁহু। আগে থেকে ফঁস করব না। তাহলে তো হয়েই গেল।

অমু বলল,–জাস্ট একটু হিন্ট দিন না! মানে…ঠিক…ব্যাপারটা…

টপ্পাদা মুখ ভেংচে বললেন,–মানে…ঠিক…ব্যাপারটা কী, গেলেই টের পাবে। সাহস থাকে তো যাও, নয়তো ভ্যানর-ভ্যানর কোরও না। আমি এখন নিজের কাজে বসব।

বলে টপ্পাদা বিহারের ম্যাপটা খুলে টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। একটা ডটপেনের ডগা দিয়ে কী সব জায়গায় খোঁচাখুঁচি শুরু করলেন।

নিরু গম্ভীরমুখে বলল,–এক মিনিট ডিসটার্ব করছি টপ্পাদা!

টপ্পাদা ম্যাপে চোখে রেখে বললেন, উঁ?

–আরেকবার ম্যাপে কুরচিটা দেখিয়ে দিন না প্লিজ!

টপ্পাদা সহাস্যে ডটপেনের ডগা একটা জায়গায় রেখে বললেন,–এই যে এখানে। ভালো করে দেখেনে আবার।

নিরুর দেখাদেখি আমরা চারজনও ঝুঁকে পড়লুম ম্যাপের ওপর। কিন্তু কুরচি বলে কোনও নামই ডটপেনের ডগায় দেখতে পেলুম না। নিরু বলল, হুঁ বুঝেছি।

নিরু কী বুঝল কে জানে। সতু বলল,–কোথায় কুরচি? ওটা তো একটা শুঁয়োপোকা।

টপ্পাদা হো-হো হেসে উঠলেন,–ভূগোল এগজামিনে কত পেয়েছিস এবার?

সতু ভড়কে গিয়ে বলল, সাঁইতিরিশ টপ্পাদা!

–চোপ! চালাকি হচ্ছে? ম্যাপে পাহাড়পর্বত চিনিসনে, আবার বলছিস সাঁইতিরিশ পেয়েছিস? একেবারে তিরিশ চুরি? আচ্ছা বল তো, সাঁইতিরিশের তিরিশ চুরি করলে কত থাকে?

সতু আরও ভড়কে গিয়ে বলল,–সাত।

টপ্পাদা চোখ ছানাবড়া করে বললেন,–সাত! আঁ! হাসালি রে! সাঁইতিরিশের তিরিশ গেলে সাঁই থাকে না? আমরা টপ্পাদার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হেসে উঠলুম। সত্যি, সতুটা একেবারে গবেট। হাসির তোড়ে সতু একেবারে কোণঠাসা হয়ে গেল। আর কথাই বলল না। সাঁইতিরিশের তিরিশ গেলে সত্যি তো সাঁই পড়ে থাকে। কার সাধ্য এটা অস্বীকার করে?

নিরু বলল, ঠিক আছে? আশীর্বাদ করুন টপ্পাদা, যেন আপনার মুখ উজ্জ্বল করতে পারি।

টপ্পাদা ধমক দিয়ে বললেন, আমার মুখ উজ্জ্বল করে কাজ নেই। ক্লাবের মুখ উজ্জ্বল করলেই চলবে। যাও, এখন আর ডিসটার্ব কোরো না। কাজ করতে দাও…

আমাদের কুরচি অভিযানের ব্যাপারটা এভাবেই শুরু হয়েছিল। নিরু বলেছিল, আরে বোকা! ম্যাপে লেখা নেই বলেই তো আমরা সেখানে যাচ্ছি। ম্যাপে তো শুধু বড়-বড় জানাশোনা জায়গার নাম লেখা থাকে। সেসব জায়গায় তো রামশ্যাম-যদু–মধু সবাই যায়। এতে ক্রেডিট কীসের? অজানার অভিযানে বেরুব বলেই না আমরা ক্লাব করেছি।

সবাই সায় দিয়েছিলুম। নিরু আমাদের লিডার। ব্যস এইটুকুই যথেষ্ট। ট্রেনে বার্থ রিজার্ভ থেকে শুরু করে সঙ্গে কী কী জিনিসপত্র নিতে হবে, সব ঠিক করল নিরু। আমরা চারজনে হুকুম তামিল করে গেলুম। তারপর এক শনিবার রাত নটার মেলট্রেনে আমরা সদলবলে উঠলুম। নিরু বলল, আপাতত আর কোনও কথা নয়। চুপচাপ নিজের বার্থে শুয়ে পড়। ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেব।

ট্রেনে ঘুম ভালো হল না। অজানা জায়গায় আনন্দ যেমন, তেমনি অস্বস্তিও কম হচ্ছে না। না জানি কী বিপদ সেখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে!

ভোরের দিকে বোধ করি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, নিরুর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। নিরু বলল, সামনের স্টেশনে নামতে হবে। উঠে পড় সব।

সবে শীত পড়েছে কলকাতায়। শেষরাতে ঠান্ডাটা পড়ে বেশি। কিন্তু এখানে দেখছি ঠান্ডা ভোরের দিকে অনেক বেশি। জানালা খুললে কনকনে হাওয়ায় হাড় কেঁপে উঠল। কুয়াশায় সব ঢাকা। তার মধ্যে মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে। আমরা বিছানাপত্তর ঝটপট গুছিয়ে নিয়ে দরজার কাছে গেলুম।

বেশ বড় স্টেশন। কিন্তু তেমন ভিড় নেই। সতু বলল,–স্টেশনের নাম লেখা নেই রে!

নিরু বলল, তোকে স্টেশনের নাম নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

ধমক খেয়ে সে চুপ করে গেল। আমরা কিন্তু ঘুরে-ঘুরে স্টেশনের নাম খুঁজছিলুম। কোন স্টেশনের টিকিট কেটেছে নিরু, তাও তো জানি না। সব টিকিট ওর কাছে। চায়ের স্টলে চা খেতে-খেতে অমু সাহস করে বলল,–ঠিক স্টেশনে নেমেছি তো আমরা?

নিরুর শুধু জবাব,–হুঁ। তারপর বলল,–তোরা দাঁড়া। আবার টিকিট কাটতে হবে?

একটুপরে চা খেয়ে আমরা যে যার বোঁচকাকুঁচকি পিঠে আটকে নিয়ে স্কাউটদের মতো নিরুর পেছনে-পেছনে চললুম। ওভারব্রিজ দিয়ে অন্য একটা প্ল্যাটফর্মে গেলুম আমরা। তারপর নিরু বলল,–ট্রেন বদলাতে হবে। মিনিট পনেরোর মধ্যে ট্রেন পাওয়ার কথা। নাঃ। ওই যে আসছে। ওটাই হবে।

তবু বলল,-পোঁছব কখন?

নিরু বলল–প্রায় নটা বেজে যাবে। টপ্পাদার কথামতো।

যাকগে, বাঁচা গেল। তাহলে টপ্পাদার কাছে সব হালহদিস নিয়েই বেরিয়েছে নিরু! সে লিডার। আমরা চুপচাপ হুকুম তামিল করে যাব, ব্যাস!

এমন বিচ্ছিরি ট্রেনে কখনও চাপিনি, কামরাগুলো যেন কোন মান্ধাতার আমলে তৈরি। যেমন নোংরা, তেমনি বিদঘুঁটে শব্দ আর ঝাঁকুনি। ইঞ্জিনের হুইশিলও বড় মারাত্মক! কানের ভেতর গরম সিসে ঢুকে যাচ্ছে যেন। স্পিডও তেমনি ছাড়া গাড়ির মতো। ঘট ঘট ঘট্টাং…ঘট ঘট ঘট্টাং…একটানা বিরক্তিকর শব্দ। দুপাশে তখনও কুয়াশা। তাই কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কামরায় আমরা বাদে আর কেউ নেই। কঁকুনির চোটে প্রচণ্ড ঘুম আসছে। সতু তো হাঁ করে ঘুমুতে শুরু করল। দেখাদেখি আমিও আর চোখ খুলে থাকতে পারলুম না।

কতক্ষণ পরে নিরুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি ফাঁকা ধুধু মাঠের মধ্যে দিয়ে ট্রেন চলেছে। আর কুয়াশা নেই। রোদ্দুর ঝকমক করছে। কাছে ও দূরে টিলা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গাছপালা খুব কম। পাথুরে মাটি। কোনও ফসলের চিহ্ন নেই কোথাও। কোনও বসতির চিহ্নও চোখে পড়ছে না।

নিরু তাড়া লাগাল, রেডি, স্টেশন এসে গেল।

একটু পরে ট্রেনের গতি কমল। তারপর থামল। আমরা নেমে গেলুম জিনিসপত্তর নিয়ে, ট্রেনটা কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ছেড়ে দিল। মনে হল, আমরা ছাড়া এ ট্রেনে যেন কোনও যাত্রী নেই!

তারপর দেখি, এ কী উদ্ভুট্টে স্টেশন। আমরা ছাড়া আর কেউ ট্রেন থেকে নামেনি। আর স্টেশন বলতে একটা মালগাড়ির কামরা নিচু প্ল্যাটফর্মের একধারে দাঁড় করানো আছে। তারও দরজা বন্ধ। কোথাও কোনও লোক নেই। একেবারে খাঁ-খাঁ নিঃঝুম। তারপর আমরা হইহই করে উঠলুম। প্ল্যাটফর্মের শেষে ইংরিজি ও হিন্দীতে বোর্ডে লেখা আছে কুরচি।

সতু বলল, কিন্তু আমরা থাকব কোথায়? কিছু দেখতে পাচ্ছিনে যে!

নিরু ধমকাল,–তোর আসাই উচিত হয়নি সতু! অ্যাডভেঞ্চারে বেরোতে হলে ওসব ভাবা চলে না।

সতু প্রায় কেঁদে ফেলার সুরে বলল, কিন্তু আমরা খাব কী? আমার যে বারবার খিদে পায়।

একথায় আমরা চারজনে হেসে উঠলুম। নিরু বলল–ওরে বোকা। খাওয়ার ব্যবস্থা না করে বেরোইনি। সে তুই ভাবিস নে। চল, মার্চ করে এগোন যাক্।

মালগাড়ির কামরাটা–থুড়ি, স্টেশনঘরের পাশ দিয়ে আমরা মাঠে নামলুম। কিছুটা হাঁটার পর একটা কাঁচা রাস্তা পাওয়া গেল। নিরু বলল–ওই যে পাহাড়টা দেখছিস, টপ্পাদা বলেছেন,–ওর ওপর একটা বাংলো পাওয়া যাবে।

সন্দিগ্ধ অমু বলল, কী করে বুঝলি ওটাই সেই পাহাড়?

নিরু তার বগলের ফাঁকে ঝোলানো কিটব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বাইনোকুলার বের করল। বলল, খালিচোখে দেখেই চিনেছি। তবে সার্টেন হওয়া যাক। বলে সে দূরবীন যন্ত্রটা চোখে রেখে কিছুক্ষণ দেখল। দেখে একটু হেসে বলল, আমার আইসাইটের জোর আছে। ভাবিস কী তোরা? ওটাই বটে। টপ্পাদা বলেছিলেন, শুধু ওই পাহাড়টাতেই কিছু গাছপালা-ঝোঁপঝাড় আছে–বাদবাকি সব ন্যাড়া। দ্বিতীয়ত, ওটার চূড়োয় একটা পুরোনো ভাঙাচোরা মন্দির আছে। মন্দিরের দেয়ালে বটগাছ গজিয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলোটা পাহাড়ের অন্য পিঠে, তাই দেখা না গেলেও বাংলোর পিছনে একটা উঁচু দেবদারু গাছ আছে–তার ডগায় একটা সাদা পতাকা উড়ছে। পতাকাটাই প্রথমে চোখে পড়েছিল। তোদেরও এবার চোখে পড়বে তাকিয়ে দ্যাখ।

ঠিক তাই বটে। আমরা খুব উৎসাহের সঙ্গে হাঁটতে থাকলুম। শীতের রোদ্দুরে হাঁটতে বেশ আরামই হচ্ছিল। অবশ্য বাতাস সামনে থেকে জোরে বইছে। পিঠে মস্ত বোঁচকা নিয়ে একটু ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছিল, এই যা।

নিরু গান গেয়ে উঠল একটু পরে। আমরাও ওর সঙ্গে গলা মেলালুম। সতুও বেসুরো গলা নিয়ে যোগ দিল। মহানন্দে আমরা পাহাড়টা লক্ষ্য করে চলতে থাকলুম।

আমরা কখনও পাহাড়ে উঠিনি। প্রায় হাজার ফুট উঁচুতে বাংলোউঠতে আমরা সবাই হাঁপিয়ে পড়েছিলুম। পাহাড়ের গায়ে চারদিক ঘুরে গাড়ি ওঠার রাস্তা রয়েছে। রাস্তায় কোন কালে খোয়া এবং যৎসামান্য পিচের প্রলেপ ছিল। এখন আর নেই। ওই ঘুরপথে উঠলে ততটা কষ্ট হত না। কিন্তু তাহলে আর অভিযান কিসের? সোজা নাক বরাবর উঠে গেলুম। কিন্তু ভাগ্যিস, মাঝে-মাঝে গাছ ছিল। তাই জিরিয়ে নিচ্ছিলুম। এখন আর শীতের নামগন্ধ নেই। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে।

অবশেষে বাংলোর উঠোনে পৌঁছনো গেল। পুরোনো বাংলো তা বোঝাই যায়। পাথরের দেওয়াল। ছাদও পাথরের টালি দিয়ে তৈরি। অমু বলল, মনে হচ্ছে এখানে অনেককাল মানুষ আসেনি রে নিরু!

নিরু বলল,–সেজন্যেই তো এখানে এলুম।

সতু বলল, আমার যে খিদে পেয়েছে নিরু!

নিরু ধমক দিতে গিয়ে হেসে ফেলল, হুঁ! দাঁড়া–-দরজা খোলা যায় নাকি দেখি। কোন ব্যাটা তালা দিয়ে রেখেছে দেখছি।

বলে সে একলাফে উঁচু বারান্দায় উঠল। তারপর যেমনি তালা ধরে টেনেছে, উঠোনে আমরা যে গাছটার তলায় দাঁড়িয়েছিলুম, সেই গাছের ওপর থেকে খনখনে গলায় কে বলে উঠল,–এ বাবু! এ খোকাবাবু! তালা মাং টুটিয়ে। মাৎ টুটিয়ে!

আমরা আঁতকে উঠেছিলুম। তারপর দেখি ঝাকড়া গাছটার পাতার আড়ালে একটা লোক বসে আছে। অদ্ভুত লোক তো! এতক্ষণ বুঝি চুপচাপ সব দেখে যাচ্ছিল।

আমাদের অবাক করে সে হনুমানের মতো দিব্যি নেমে এল। পরনে ময়লা নোংরা একটা নেভি-রু হাফপ্যান্ট, গায়েও তেমনি একটা ঘেঁড়াখোঁড়া শার্ট, কাঁচা-পাকা চুলগুলো মাথায় যেন পেরেকের মতো খোঁচা-খোঁচা বসানো রয়েছে। লোকটার দুটো কানই লক্ষ করার মতো। বিরাট লম্বা কান। গোঁফও দেখার মতো। কিন্তু এত রোগা আর লম্বা মানুষ কখন দেখিনি।

আমরা ভড়কে গিয়েছি। কিন্তু সে কপালে হাত তুলে মিলিটারি কায়দায় সেলাম ঠুকে হিন্দিতে বলল, আমাকে ডাকলেই তো দরজা খুলে দিতুম! আমার নাম রামনারাণ। এ বাংলোর চৌকিদার আমি। বলুন, কী করতে হবে।

নিরু গম্ভীর হয়ে বলল, । তোমাকে অনেক কিছুই করতে হবে। আপাতত ঘর খুলে দাও। তারপর বলছি।

সে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে তালা খুলল। বিশ্রী আওয়াজ করে দরজা খুলে গেল। আমরা ঘরে ঢুকে দেখি, যাচ্ছেতাই অবস্থা। কতকাল পরিষ্কার করা হয়নি কে জানে। ধুলোময়লায় নোংরা হয়ে আছে। আসবাব বলতে কোণার দিকে একটা লোহার খাট। তার ছোবড়ার গদিটার শোচনীয় দশা। রামনারাণ জানালাগুলো খুলে দিল। ঘরে ঢুকে বোটকা গন্ধ পাচ্ছিলুম। বাতাস ঢোকায় গন্ধটা কমে গেল। নিরু তাড়া দিয়ে বলল, কী করো? মাসে-মাসে দিব্যি তো বেতন নাও! ঘরে একবার ঝাড়ুও দাওনি দেখছি! যাও, বঁটা আনো! জলও এনো এক বালতি।

রামানারাণ কাঁচুমাচু হয়ে বলল,-খবর দিয়ে এলে সব ঠিক করা থাকত খোকাবাবু। আচ্ছা ঘাবড়াবেন না। আমি এখনই সাফ করে দিচ্চি সব।

সে বাংলোর টানা বারান্দা দিয়ে পিছন দিকে চলে গেল। আমি আর অমু বাইরে এসে চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখতে থাকলুম। অমু বলল, হ্যাঁ রে বিজু রামনারাণ গাছে চড়ে কী করছিল, বল তো?

বললুম,–জ্বালানির জন্যে শুকনো কাঠ ভাঙছিল নিশ্চয়।

অমু সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, ভ্যাট! ওই তো কত শুকনো কাঠ পড়ে রয়েছে। গাছে উঠতে যাবে কেন? আয় তো দেখি।

আমরা গাছটার তলায় গেলুম। গাছটা অচেনা। চ্যাপ্টা পাতা, সাদা ডাল। খুব উঁচুও বটে। তেমনি ডালপালা ছড়িয়ে রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। বললুম ফলটল পারছিল তাহলে।

কিন্তু ফল কোথায়? দেখছিস না শুধু পাতায় ভর্তি। অমু দেখতে-দেখতে বলল–।

হঠাৎ আমার চোখ গেল ওপরে একটা ছড়ানো মোটা ডালের দিকে। আঁতকে উঠে বললুম, অমু! অমু! ওটা কী রে? ওই যে–দেখতে পাচ্ছিস, ঝুলছে?

অমু দেখে অবাক হয়ে বলল, সর্বনাশ। ডাল থেকে একটা ফঁস লাগানো দড়ি ঝুলছে যে! ডালে দড়ি বেঁধে ও কী করছিল রে? সুইসাইড করতে যাচ্ছিল নাকি?

শিউরে উঠে বললুম,–ওরে বাবা! তাহলে তো আমরা এসে না পড়লে রামনারাণ নির্ঘাত গলায় দড়ির ফাঁস আটকাত! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!

আমরা দুজনে এইসব বলাবলি করছি, এমন সময় নিরুর চেঁচামেচি কানে এল, তুমি আবার কে? রামনারাণ গেল কোথায়? তোমাকে দিয়ে চলবে না। রামনারাণকে ডাকো।

তাহলে রামনারাণ ছাড়া এখানে আরও একজন লোক আছে, বোঝা গেল। তার গলাও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না, কী বলছে সে। একটু পরে দেখি তপু হাসতেহাসতে বেরিয়ে এল। আমরা তার কাছে এগিয়ে গেলুম। অমু বলল, কী হল রে?

তপু বলল, দ্যাখ গে না! খুব গোলমেলে ব্যাপার। বলে সে বাংলোর অন্য পাশে চলে গেল।

রামনারাণের কাণ্ডটা ওকে বলার সুযোগ পেলুম না। এদিকে দেখি, রামনারাণ ওপাশ থেকে এক বালতি জল আর ঝাড়ু নিয়ে আসছে। যে মানুষ মনের দুঃখে একটু আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যাচ্ছিল, তার মুখে হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলুম। সে ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর চ্যাঁচামেচি বেশ বেড়ে গেল। তখন অমু বলল, আয় তো দেখি কী ব্যাপার?

আমরা দৌড়ে গেলুম। বারান্দায় উঠে মনে হল, যেন ঘরের ভেতর মারামারি শুরু হয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকে দেখি, নিরু মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে রামনারাণ আর অন্য একটা অচেনা লোককে সামলাচ্ছে। দুজনেই মারমুখী। অমু বলল, কী হয়েছে রে নিরু?

নিরু হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, কী ঝামেলা দ্যাখ তো! রামনারাণ যাওয়ার পর কোত্থেকে এই লোকটা এসে বলছে, কার হুকুমে বাংলোয় ঢুকেছেন আপনারা? আমি বাংলোর চৌকিদার। রামনারাণ বলে এক চৌকিদার ছিল বটে, তবে সে নাকি তার ঠাকুর্দার আমলে। এখন ও নামে কেউ নেই।…

অচেনা লোকটা বাধা দিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে বলল,–নেইই তো।

অমনি রামনারাণ হুংকার দিয়ে বলল, খবরদার! নেই মানে? আমি কে তাহলে?

অচেনা লোকটাও রামনারাণের মতো রোগা। অমনি প্রকাণ্ড গোঁফ আছে। এমনকি এর পোশাকও হুবহু এক। তফাতের মধ্যে এর একটা কানই নেই, অন্য কানটাও রামনারাণের মতো অত বড় নয়। সে রামানারাণের কথা শুনে বলল, তুমি কে? তা বললে তো খোকাবাবুরা ভয় পাবেন। তাই বলছি, আর কথা বাড়িও না। ভালো চাও তো মানে-মানে কেটে পড়ো!

নিরু বলল, ভয় পাব মানে? ভয় পাব কী হে?

লোকটা বাঁকা হেসে বলল, আমার ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, ডেভিড সাহেব এই বাংলোর মালিক ছিলেন। তাঁর আমলে রামনারাণ বলে একজন চৌকিদার ছিল। গলায় দড়ি দিয়ে মারা গিয়েছিল সে। আর কোনও রামনারাণের কথা জানি না।

একথা শুনে অমু আর আমি পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম। আর রামনারাণ লাফিয়ে উঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, দ্যা রঘুপতি! এবার আমার মাথায় সত্যি খুন চড়ে যাচ্ছে। আমাকে তুই মরা মানুষ বলতে চাইছিস?

রঘুপতি মুখ ভেংচে বললে,–আলবৎ বলছি! তুই তো মড়া। গাছে ঝোলা মড়া। কমবয়সি এসব ছেলেপুলে দেখে তাদের ভয় দেখাতে এসেছিস! লজ্জা করে না তোর?

রামনারাণ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ওরে রঘুপতি! আমি মড়া আর তুই বুঝি জ্যান্ত মানুষ? দেব এবার ফাস করে তোর কীর্তি? দেব? দিই তাহলে?

রঘুপতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, দে না ফাঁস করে, দি দিবি?

রামনারাণ নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল,–খোকাবাবু, বাঁচতে চান তো এ ব্যাটাকে তাড়ান। এ ব্যাটা গত বছর কঠিন ব্যামোয় পটল তুলেছে। এই বাংলোর পেছনের একটা ঘরে থাকত ব্যাটা। এবার বুঝেছেন তো ও কে?

আমি ও অমু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। নিরু কিন্তু ঘাবড়ে যায়নি। সে হাসতে হাসতে বলল, তোমরা দুজনেই তাহলে মরা মানুষ–তার মানে ভূত, এই বলছ তো?

রঘুপতি বলল,-মোটেও না, মোটেও না। ও ব্যাটা ভূত, আমি ভূত হব কোন দুঃখে খোকাবাবু? আসলে কী জানেন? ওর বড় খারাপ অভ্যাস। এখনও দখল ছাড়তে পারে না। কিছুদিন আগে এক বাবু এলেন, আপনাদের মতো বাঙালি, মাথায় বড় বড় চুল বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ হবে…

নিরু বলল, হুঁ। আমাদের টপ্পাদা।

রঘুপতি বলল,–তো সেই বাবুও এসে ওর পাল্লায় পড়লেন। গতি দেখে আমাকে আসতে হল। তারপর তো বুঝতেই পারছেন, আমাদের ঝগড়া থামাতে বাবুর হিমশিম অবস্থা। শেষে বললেন, ঠিক আছে। মীমাংসা করে দিচ্ছি।

নিরু বলল,–হুঁ, জানি। টপ্পাদা তোমাদের রেস লড়িয়ে দিলেন। যে আগে ওই ওপরকার মন্দিরের বটগাছ থেকে একটা পাতা আনতে পারবে–সে জ্যান্ত মানুষ, আর যে হেরে যাবে সে মরা মানুষ।

রামনারাণ একগাল হেসে বলল, আমি জিতেছিলুম না? রঘুপতিটাই তো হেরে গিয়েছিল। বলেননি আপনাকে?

নিরু কী বলতে যাচ্ছে, রঘুপতি চেঁচিয়ে বলল,-বাঙালিবাবু বোকা! বোকার হদ্দ! আরে, ভূতের সঙ্গে জ্যান্ত মানুষ কখনও পারে? তাই আমি হেরে গিয়েছিলুম।

নিরু এবার রেগে গেল, টপ্পাদা মোটেও বোকা নন। যা-তা বোলো না।

রঘুপতি বেজার হয়ে বলল, ঠিক আছে। কে জ্যান্ত, কে মড়া বুঝুন। আমি চলে যাচ্ছি। ওই গাছে-ঝোলা রামানারাণটা যখন নিজের মূর্তি ধরবে, তখন বুঝবেন ঠ্যালা। তখন আর মাথা ভাঙলেও আমি আসব না।

বলে রঘুপতি জোরে বেরিয়ে গেল। নিরু বলল,–যতে সব! রামনারাণ, ঘর সাফ করো! ততক্ষণ আমরা বাইরে গিয়ে কিছু খেয়ে নিই। হ্যাঁজল কোথায় পাব, বলে দাও তো রামনারাণ!

রামনারণ ঝাড়ু হাতে মেঝের দিকে ঝুঁকে বলল, বাংলো-ঘরের দক্ষিণদিকে গেলে একটা পাতালঝরনা পাবেন।

নিরু বলল, আয় তোরা!

বেরিয়ে গিয়ে অমু বলল,-পাতালঝরনা কী রে? প্রস্রবণ নাকি?

নিরু বলল, । কিন্তু সতুটা কোথায় গেল? তপুই বা কোথায়?

বললুম,–তপু ওই উত্তরদিকে গেল দেখলুম একটু আগে।

নিরু বলল,–ডাক তো ওকে। আর অমু, তুই দ্যাখ তো সতু কোথায় গেল। এরা এখন থেকেই ডিসিপ্লিন ভাঙতে শুরু করেছে।

আমি ততক্ষণে মনে-মনে বেশ অস্বস্তিতে ভুগছি। গাছের দড়িটা, আর এই দিনদুপুরে ভূত-মানুষ তর্কাতর্কি, কোনও মাথামুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছিনে। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে ডাকলুম,–তপু! তপু!

তপুর সাড়া এল,–এই যে এখানে!

ঝোঁপের শেষে উঁচু হয়ে ওঠা পাহাড়ের গা থেকে একটা প্রকাণ্ড পাথর বেরিয়ে রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখি, একটা গুহা। এবং গুহার দরজায় বসে তপু কী চিবুচ্ছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে ডাকল হাত তুলে। কাছে গিয়ে বললুম, কী চিবুচ্ছিস রে?

তপু পাশে বসতে ইশারা করল। বসলুম। তপু বলল,-খাবি নাকি? দারুণ টেস্টফুল জিনিস! দ্যাখ না খেয়ে।

কী বলতো? বলে হাত বাড়ালুম।

তপুর মুঠোয় কিছু রয়েছে। সে মুঠো থেকে আমার হাতে যা দিল, আমি তক্ষুনি ছি-ছি করে ফেলে দিলুম। খিদেয় পেট ফোঁ-টো করছে। এখন এই ঠাট্টা-তামাশার মানে হয়?

তপু যেন অবাক হয়ে বলল,–ফেলে দিলি? এত কষ্ট করে খুঁজে আনলুম।

–ভ্যাট! কী বলছিস তুই? মরা পিঁপড়ে মানুষ খায়?

তপু আমাকে দারুণ অবাক করে সেই ইয়া বড় মড়া পিঁপড়েটা কুড়িয়ে নিয়ে মুখে পুরল। তারপর তৃপ্তির সঙ্গে মুড়মুড় করে চিবুতে লাগল।

আমি হতভম্ব হয়ে বললুম, ছি-ছি! তোর কি মাথা খারাপ হল তপু? এ কী খাচ্ছিস তুই?

তপু মুঠো থেকে আঙুলের ডগায় করে আরও একটা প্রকাণ্ড মরা পিঁপড়ে মুখে চালান করে দিল। এবার আমি খুব রেগে গেলুম যা খুশি কর! নিরু ডাকছে। আমি চললুম। বলে হনহন করে ওর কাছ থেকে চলে এলুম।

বাংলোর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, রামনারাণ যত্ন করে ঘর ধুচ্ছে। দক্ষিণপাশে গিয়ে ডাকলুম, নিরু! তোরা কোথায়?

পাহাড়ের একটু নিচের দিকে সাড়া এল,–চলে আয়, বিজু! শিগগির চলে আয়!

এদিকে ঘন জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে অনেক পাথর রয়েছে। কিছুটা নেমে গিয়ে দেখলুম একটা প্রস্রবণ রয়েছে। একটা চৌবাচ্চার মতো পাথরের খাদ থেকে ঝিরঝির করে জল নিচে গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রস্রবনের ধারে বসে নিরু বনরুটি ছিঁড়ে খাচ্ছে। একটু অভিমান হল। সবাই আসার তর সইল না ওর? ও না দলের লিডার? আমি চৌবাচ্চাটার অন্য ধরে দাঁড়িয়ে বললুম,–ওরা এখনও আসেনি?

নিরু হেসে বলল, আসছেখন। নে, খেয়ে ফেল।

চৌবাচ্চার ওধারে যেখানে সে বসে আছে, সেখান থেকে আমি যেখান দাঁড়িয়ে আছি, কমপক্ষে শতমিটার দূরত্ব তো বটেই। আমার চোখ বড়ো হয়ে গেল। নিরুর হাতটা শতমিটার লম্বা হয়ে আমার নাকের ডগায় একটা মোড়কে ভরা বনরুটি ধরেছে।

এই রুটিগুলো গতকাল আমাদের পাড়ার বেকারি থেকে কেনা। কিন্তু কথা হচ্ছে, নিরু যত লম্বাই হোক, এত দুরে ওর হাত এল কীভাবে? টের পেলুম, আমার পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে।

নিরু বলল,–নে না বাবা! কতক্ষণ ধরে থাকব?

অমনি চোখ বুঝে দৌড়তে শুরু করলুম। দৌড়নো বলা ভুল। পাহাড়ে চড়াই ভাঙা কী ব্যাপার, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে বোঝানো কঠিন। দুহাত-দুপায়ে কাঠবিড়ালির মতো হাঁচড়-পাঁচড় করে এগোচ্ছিলুম আর কী!

একটু পরে বাংলোর দেখা মিলল। সমতল একটা জমিতে বাংলোটা রয়েছে এতক্ষণে বোঝা গেল। উঠোনের পাশে একটা গাছের তলায় অমুর দেখা পেলুম। সে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে হাঁপাতে-হাঁপাতে উঠতে দেখে সে তাকাল। বলল, কী রে তোরা। খুঁজেই পাচ্ছিনে তোদের! নিরু কোথায় গেল? তুই বা কোথায় গিয়েছিলি?

ভাবলুম, ব্যাপারটা বললে অমু নিশ্চয় হো-হো করে হেসে উঠবে। বলবে, গুল দিচ্ছি। তাই চেপে গেলুম। বললুম, সতু কোথায়? পেলি দেখা?

অমু বলল,–অদ্ভুত ব্যাপার রে! সতু…

ওকে থামতে দেখে বললুম, কী হল সতুর?

অমু ফিসফিস করে বলল,–অবাক কান্ড বিজু। সতুটা ওখানে একটা ঝোঁপের ধারে বসে কী খাচ্ছিল জানিস? ঘাস। বিশ্বাস কর বিজু। খিদেটা ওর বরাবর বেশি। তাই বলে ঘাস খাবে? আমাকে দেখে খুব লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, কাকেও বলিস নে। তারপর করল কী জানিস? হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে ঝোঁপ থেকে পাতা ছিঁড়ে খেতে লাগল। বকাবকি করে চলে এলুম। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি বল?

কথাগুলো করুণ মুখে বলার পর অমু ধুপ করে বসে পড়ল। বললুম, বসে কী হবে? উঠে আয়। ব্যাপার বড্ড গোলমেলে মনে হচ্ছে। বাংলোয় গিয়ে আলোচনা করা যাক।

অমু বলল,-আলোচনা করার কী আছে?

–আছে রে! তুই সতুকে ঘাস আর পাতা খেতে দেখলি। আমি তপুকে কী খেতে দেখলুম জানিস? ইয়া বড় বড় মরা পিঁপড়ে। পাহাড়ি পিঁপড়ে।

অমু মুখ ভেংচে বলল, রামো! পিঁপড়ে! ছ্যা ছ্যা! বড় বোকা তো তপুটা, বরং মাটি খেলেও পারত।

বলে সে পায়ের কাছ থেকে একমুঠো কঁকড়ঘুটি-ভরা মাটি তুলে নিয়ে মুখে পুরল এবং কড়কড় করে খেতে শুরু করল।

আর সহ্য করতে পারলুম না। রেগে চেঁচিয়ে উঠলুম,–তোরা কি রাক্ষস, না ভূত? হয়েছে কী তোদের? এই নাক কান মলা–কেটে পড়ছি।

তারপর হনহন করে বাংলোয় গিয়ে ঢুকলুম। জিনিসপত্তর নিয়ে এক্ষুনি কেটে পড়া যাক দল থেকে। আগে যদি জানতাম, এরা এখানে কেউ ভূতের মতো হাত শতমিটার লম্বা করে ফেলবে, কেউ পিঁপড়ে খাবে, কেউ ঘাস, কেউ মাটি–তাহলে কে আসত এদের সঙ্গে? ফিরে গিয়ে টপ্পাদাকে সব রিপোর্ট করবখন।

ঘরে ঢুকে দেখি, কেউ নেই। রামনারাণ হোক, কিংবা গাছেঝোলা ভূতই হোক, ঘরটা চমৎকার সাফ করে রেখেছে। লোহার খাটের ভেঁড়া গদির ওপর সুন্দর একটা চাদরও বিছিয়ে দিয়েছে। বালিশও এনে রেখেছে গুনে-গুনে পাঁচটা।

পেটের খিদে ভুলে গেছি অনেক আগেই। কিন্তু এখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছি। এমন সুন্দর বিছানা দেখেই ঘুমের টান এসেছে চোখে। ধুপ করে গড়িয়ে পড়লুম।

সবে চোখ এঁটেছে, হল্লার শব্দে ঘুম ছুটে গেল। চোখ খুলে দেখি, নিরু, তপু, অমু আর সতু তর্কাতর্কি করতে করতে ঘরে ঢুকছে। নিরু বলছে, আলবাত দেখেছি, তুই মাটি খাচ্ছিলি।

অমু বলছে, কিন্তু সতু যে ঘাস আর পাতা খাচ্ছিল, তার বেলা?

সতু বলছে–হুঁ। আমি না হয় তাই খাচ্ছিলুম। বিজু কী খাচ্ছিল জিগ্যেস কর

লাফিয়ে উঠলুম, খবর্দার সতু। যা-তা বলবিনে। আমি কিছু খাইনি।

সতু বলল, মিথ্যে বলবিনে বিজু। তুই গাছে চড়ে পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করে খাচ্ছিলি। আমাকেও ডাকলি না, বল?

–কী বললি? আমি রুখে দাঁড়ালুম। মিথ্যুক তুই! মহা মিথ্যুক!

সতু দাঁত বের করে বলল,–ওর মুখ শুঁকে দেখ! তাছাড়া ও করল কী জানিস নিরু? ডিম খেয়েও খিদে মিটলো না। তখন পাখির বাসাটা চিবুতে শুরু করল।

নিরু গম্ভীর গলায় বলল, খুব অন্যায় করেছিস্ বিজু!

আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললুম,–আর তপু যে মরা পিঁপড়ে খাচ্ছিল। আর তুই যে শত মিটার মস্তো ভুতুড়ে হাতে আমাকে…

নিরু বাধা দিয়ে বলল, শা আপ! ডিসিপ্লিন ভাঙছিস বিজু!

তপু এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। এবার একটু হেসে বলল, বিজু কী বলল রে? আমি পিঁপড়ে খাচ্ছিলুম?

বললুম, হ্যাঁ। খাচ্ছিলি তো! আমাকেও খেতে বলছিলি!

নিরু আবার লিডারের ব্যবহার দেখাতে যাচ্ছিল, তপু তাকে থামিয়ে দিয় বলল,–কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে মনে হচ্ছে।

নিরু বলল,–কীসের গোলমাল হবে। বিজুটা মিথ্যে করে আমার লম্বা হাতের কথা বলছে। এই তো আমার হাত। মেপে দ্যাখ ক মিটার।

তপু বলল,–ওয়েট, ওয়েট। শোন, গোলমাল একটা হয়েছে কোথাও। প্রথম কথা, জ্ঞানত ধৰ্মত বলছি–আমি মোটেও পিঁপড়ে-টিপড়ে খাইনি। আপন-গড। মা কালীর দিব্যি। মা সরস্বতীর দিব্যি।

সতু বললে,–আমিও দিব্যি করতে পারি। স্বীকার করছি, আমার বেশি খিদে পায়, তাই বলে ঘাস-পাতা খাব কোন দুঃখে।

অমু বলল,-আমিই বা মাটি খাব কেন? বই দে, ছুঁয়ে বলছি।

আমি বললুম, আমিও তো বলছি, পাখির ডিম বা বাসা খাওয়ার কী মানে হয়? আমি ভূত না রাক্ষস? যা ছুঁয়ে বলতে বলবি বলব।

তপু বলল, আমি শুনেই বুঝতে পেরেছি, কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে।

নিরু বলল,–কিন্তু গোলমালটা কীসের?

তপু গম্ভীর হয়ে বলল,-ভৌতিক গোলমাল।

–ভৌতিক গোলমাল মানে?

এ পাহাড়টা মনে হচ্ছে ভুতুড়ে। বাংলোটাও তাই। তপু বলতে থাকল।

–আমরা পরস্পর যাদের আজেবাজে জিনিস খেতে দেখেছি। তারা সবাই ভূত। আমাদের চেহারা ধরে গোলমাল পাকাতে চেয়েছিল। কিন্তু জ্যান্ত মানুষ আমরা– আমাদের সঙ্গে এঁটে ওঠা কি সহজ? নিরু, অবস্থা তো বুঝলি। তুই লিডার, এবার ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে বল, কী করবি?

ঘরে একেবারে চুপচাপ অবস্থা। শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দিনদুপুরে এমন গোলমেলে কাণ্ড দেখা যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল?

একটু পরে নিরু বলল, উল্লাদা কতকটা ইশারা দিয়েছিলেন বটে তবে উনি যখন ভয় পাননি, আমরাই বা ভয় পাব কেন? তোরা শোন! আমরা এখানে থাকছি। কিন্তু একটা কথা বলে দিচ্ছি, কেউ যদি কাউকে কোন বিদঘুঁটে কান্ড করতে দেখিস, জানবি সে ভূত। অমনি তাকে রামধোলাই দিতে শুরু করবি। এই আমার নির্দেশ। এবার চল, সবাই মিলে প্রবণটা খুঁজে বের করি। স্নানটান করে খেয়ে নেওয়া যাবে।

বিকেল অব্দি তেমন কিছু ঘটল না। রামনারাণ আর রঘুপতি, তাদের আর পাত্তা পাওয়া গেল না। আমরা ক্লান্ত ছিলুম বলে বিকেল অব্দি জিরিয়ে নিয়েছি। খাটটা বেশ চওড়া। পাঁচজনে ঠাসাঠাসি করে শুতে অসুবিধে নেই। শীতের সময়। এভাবে শুলে আরামই লাগে। বিকেলে উঠে শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে একটা এনামেলের মগে জল ফুটিয়ে চা করা হল। চা-চিনি-দুধের কৌটো সবই ছিল।

চা খাওয়ার পর বাংলোর সামনে উঠোনে বসে আছি, হঠাৎ দেখি অমু সতুকে দুমদাম মারতে শুরু করল। সতু হাউমাউ করে উঠল। নিরু বলল, কী হল রে? হলটা কী?

অমু আবার একটা কিল চালিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল,–ভূত! এ ব্যাটা ভূত! সতু না!

সতু ভ্যাঁ করে কেঁদে বলল, আমি ভূত না, সতু! মাইরি সতু! চিমটি কেটে দ্যাখ!

নিরু ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, ব্যাপার কী বলবি তো অমু!

অমু বলল,–ও আবার ঘাস খাচ্ছিল।

সতু কাঁদতে কাঁদতে প্রতিবাদ করল, না রে নিরু, না। আমার অভ্যেস। আমি ঘাস ছিঁড়ে এমনি দাঁতে চিবুচ্ছিলুম,–অনেকেই তো এমন করে। অভ্যেস!

আমার আবার আঙুল কামড়ানো অভ্যেস। টের পেলাম আঙুলটা তখনও মুখে রয়েছে এবং তপু আড়চোখে তাকাচ্ছে, আর মুঠো রেডি করছে। ঝটপট আঙুল বের করে নিলুম। তপু সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তবু। কাঁচুমাচু হেসে ফিসফিস করে বললাম, কিছু না! অভ্যেস!

শীতের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে এল। এমন জায়গায় রাত কাটানোর অস্বস্তি পেয়ে বসেছিল সবাইকে। তার ওপর, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। প্রত্যেকে খুব সতর্ক হয়ে গেছে। যেন বিদঘুঁটে কোনও কাণ্ড না করে ফেলি নিজের অজান্তেও।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশায় ঢেকে ফেলল পাহাড় আর এই বাংলোকে। তারপর হঠাৎ নিরু বলল, সর্বনাশ! মস্ত ভুল হয়ে গেছে। আমাদের একটা আলো আনা উচিত ছিল।

তপু বলল,–কেন? টর্চও তো আছে প্রত্যেকের।

একটা ল্যাম্পের দরকার ছিল না? –নিরু উদ্বিগ্ন হয়ে বলল। অন্তত কিছু মোমবাতি আনাও উচিত ছিল। ধুস! এমন ভুল মানুষ করে? টর্চের আলোয় রান্না করতে হলে ব্যাটারি পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।

আমরা তখন পরস্পর কাছাকাছি থাকছিলুম। ঘরে গিয়ে আরও কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলুম। এমন সময় দেখা গেল, পাহাড়ের নিচের দিক থেকে একটা আলো উঠে আসছে। আমরা নেচে উঠলুম।

নিরু বলল, নিশ্চয় সেই দুই ব্যাটা ভূতের একজন আসছে। হয় রামনারাণ, নয়তো রঘুপতি। একটা কথা শোন। আলোটা আমাদের সত্যি বড় দরকার। ওদেরকে নিয়ে কী করব? ভূতটুত নিয়ে সমস্যায় পড়ব। ওদের ঝগড়া থামাতে হবে। তার চেয়ে একটা প্ল্যান করা যাক।

অমু বলল, বল। শুনি।

নিরু চাপা গলায় বলল, আলোটা আগে হাতিয়ে নেব। তারপর ব্যাটাকে রামধোলাই শুরু করব সবাই মিলে। মারের চোটে ভূত ভাগানোর কথা শুনিসনি? পাগল আর ভূত, দুটোকেই মার দিলে কাজ হয়। রেডি হ তোরা। টপ্পাদা ঠিক এমনি করেই সেবারে ওদের ভাগিয়ে দিয়েছিলেন।

লণ্ঠনটা উঠোনের ও প্রান্তে দেখা গেল। ঘন পাহাড়ি কুয়াশা। আলোর ছটা দুহাত অব্দি পৌঁছচ্ছে। দেখা গেল, একজন নয় দুজন আসছে। তার মানে রামনারাণ আর রঘুপতি দুজনেই। হয়তো নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নিয়েছে। নাকি আবার ঝগড়াঝাঁটি করতেই আসছে?

নিরু ফিসফিস করে বলল, রেডি। তপু, তুই ওরা বারান্দায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আলোটা কেড়ে নিয়ে ঘরে চলে আসবি। সত্যু, বিজু, অমু! তোরা আমার সঙ্গে হাত লাগাবি। কাম অন!

বারান্দায় দুজনে উঠেছে, অমু, তপু বাঘের মতো দরজা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে। তারপর হাচটা টানে হ্যারিকেনটা কেড়ে নিয়েছে। আর আমরাও একসঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছি ওদের ওপর। তারপর দুমদাম কিল-থাপ্পড়চড়-ঘুষি।

দুই মূর্তি আলো কাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে গিয়েছিল। মার খাওয়ার কয়েক সেকেণ্ড পরে যেন তারা টের পেল যে তাদের বেজায় রামধোলাই দেওয়া হচ্ছে। গলা ফাটিয়ে একসঙ্গে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাবা রে! মেরে ফেললে রে! ওরে বাবা রে! এরা কারা রে!

আমার কানে একটা গলা খুব চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু ভূত তো চেনা মানুষ হয়েই দেখা দেয়, দেখা দিয়েছে আমাদের।

তারপর একজন পড়ে গিয়ে চেঁচাতে থাকল,–ওরে নিরু রে! তপু-রে! বিজু রে! অমুসতু-রে! তোরা কোথা গেলি রে! আমায় বাঁচা রে।

তপু দৌড়ে এল আলো নিয়ে। আলোয় দেখি সর্বনাশ! স্বয়ং টপ্পাদা সেজে এসেছে! চালাকি বুঝছিস নে?

সে আবার ঘুষি পাকিয়ে যেতেই টপ্পাদা আর্তস্বরে বললে,–ওরে, আমি ভূত নই! মারিসনি, আর মারিসনি। তোদের বিপদ-আপদ হবে ভেবে লোক নিয়ে এসেছি রে!

.

তারপর কী হল, কহতব্য নয়। টপ্পাদার পা ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করেও ওঁর রাগ পড়ে না, তোদের জন্যে আমি পরের ট্রেনে কষ্ট করে এলুম। ভেবেছিলুম ডেভিড সাহেবের বাংলোয় আবার ভূতের হাতে না পড়ে। অনভিজ্ঞ ছেলেপুলে সব। তাই তিন মাইল দূরের গ্রাম থেকে চৌকিদারকে ডেকে নিয়ে আসছি, আর তোরা…উঃ!

এই লোকটাই তাহলে আসল চৌকিদার। বেচারা একটু হেসে বলল, ছোড় দিজিয়ে বাবুজী। খোকাবাবুলোগ ডরসে মারা হ্যায়। ডর পেয়ে মাথা বিগড়িয়ে গিয়েছে। উনহিদের হাতমে মারউর বহুৎ মিঠা হ্যায়। ছোটা-ছোটা হাত, মার ভি বহুং ছোটা।

টপ্পাদার মুখে হাসি ফুটল। বললেন, ঠিক আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *