ভুতুড়ে চশমা
নাতিকে কোলে নিয়ে আদর করতে গিয়ে মুরারিবাবুর চশমাটা গচ্চা গেল। নাতিটির সবে একটি-দুটি দাঁত গজিয়েছে। মুখের কাছে আঙুল দেখলেই খপ করে ধরে কুট্টুস করে কামড়ে দেয়, খিকখিক করে হাসে।
কিন্তু দাদুর চোখ থেকে একটানে চশমা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলবে, ভাবা যায়? এখনই এমন বিচ্ছু, তো ভবিষ্যতে কেমন হবে আন্দাজ করে উদ্বিগ্ন হলেন মুরারিবাবু।
চশমা না থাকলে একেবারে কানা বললেই চলে। তাছাড়া চশমাটা সবে কিছুদিন আগে করিয়েছিলেন। স্টিলফ্রেমের দামি চশমা।
চশমা ভেঙেছে যে দুষ্টুটা, তার দাদা নুকুর বয়স বছর আষ্টেক। দাদুর অবস্থা দেখে দুঃখিত হয়ে বলল, চলো দাদু, তোমাকে চশমার দোকানে নিয়ে যাই।
মুরারিবাবু বললে,–সে তো বউবাজারে। হরিকে বল, একটা ট্যাক্সি ডেকে আনুক।
হরির ভরসা করা কঠিন। ট্যাক্সি ডাকার ছলে সে মোড়ের চায়ের দোকানে ঘণ্টাদুয়েক আড্ডা দিয়ে এসে হয়তো বলবে,–কেউ আসতে চাইছে না বড়বাবু।
নুকু তা জানে বলে নিজেই বেরিয়ে গেল এবং তক্ষুনি একটা ট্যাক্সিও ডেকে আনল। মাঝে-মাঝে নুকু তার ক্ষমতা দেখিয়ে এমনি করে তাক লাগিয়ে দেয়। তবে দাদুর সঙ্গে তার যাওয়া হল না। স্কুলের সময় হয়ে আসছে।
ট্যাক্সিওয়ালার চেহারা খেঁকুটে, রোগা। মাথাটি প্রকাণ্ড। তার মধ্যিখানে কাঠির মতো একগোছা চুল বসানো। কুতকুতে চোখ। ইয়া বড় নাক। খুব আলাপি মানুষ। পথে যেতে-যেতে বলল,-ছেলেমানুষ। বড় মুখ করে এসে বলল, দাদুর চশমা ভেঙেছে। বউবাজারে যাবেন চশমা করাতে। তা চশমা না থাকার কষ্ট আমি আমি বুঝি, সার!
মুরারিবাবু হাসলেন, আপনার তো চশমা নেই দেখছি। কী করে বুঝলেন তাহলে?
ছিল। ট্যাক্সিওলা বলল। আর দরকার হয় না। গত মাসে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। ওতেই চোখ সেরে গেছে।
মুরারিবাবু অবাক হয়ে বললেন,–তার মানে?
লরির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। বুঝলেন না? এক ধাক্কাতেই চশমা গুঁড়ো এবং চোখ পরিষ্কার। ট্যাক্সিওলা খিকখিক করে হাসতে লাগল। তারপর থেকে আর চশমার দরকার হয় না। এই যে আপনি চশমা ছাড়া দেখতে পাচ্ছেন না–একটা অ্যাকসিডেন্ট হলে বুঝলেন না?
আঁতকে উঠে মুরারিবাবু বলেন, সর্বনাশ! ওসব অলক্ষুণে কথা বলবেন না মশাই! আমার চশমাই ভালো।
ট্যাক্সিওলা বলল, নানা। কথার কথা বলছি। তা বউবাজারে কোন দোকানে চশমা করালেন স্যার?
–ফ্রেন্ডস অপটিক্যালস। খুব নামকরা দোকান।
–আপনি ইং চুংয়ের দোকানে করান না কেন? গলির ভেতরে ছোট্ট দোকান। হলে কী হবে? সস্তায় ঝটপট অত ভালো চশমা আর কেউ করতে পারে না। আধঘণ্টার মধ্যে পেয়ে যাবেন।
মুরারিবাবু একটু ভেবে বললেন, হ্যাঁ, ফ্রেন্ডস অপটিক্যালসে বড্ড বেশি দাম নেয়। তা ইং চুংয়ের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে নাকি?
–খুব আছে। চলুন না, দেখবেন কত অমায়িক লোক ইং চু সায়েব।
ট্যাক্সিওলা বউবাজারে একটা গলির মুখে ট্যাক্সি রেখে বলল, আসুন, কাছেই।
ইং চুং অপটিক্যালস লেখা আছে ছোট্ট সাইনবোর্ডে। ঘুপচি একফলি ঘরের ভেতর বসে আছে একজন চীনা। কফিনের সাইজ শোকেসের ভেতরে গোটাকতক চশমা রয়েছে। মিটমিটে একটা বাল্ব জ্বলছে পেছনে। সরু গলিটা এমনিতেই দিনদুপুরে আঁধার হয়ে আছে।
ট্যাক্সিওলা বলে দিল, আমাদের পড়ার লোক চুং সায়েব, বুঝলে তো? বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখলে চলবে না–ট্যাক্সি দাঁড় করানো আছে।
মুরারিবাবু খুব অবাক হয়েছিলেন। বসিয়ে রেখে আধঘণ্টার মধ্যে চশমা দেবে? অবশ্য চীনারা সব বিষয়ে দক্ষ। ওদের দেশে প্রাচীন যুগে আশ্চর্য সব বৈজ্ঞানিক কাণ্ডকারখানাও ঘটেছে। সেই প্রাচীন বিদ্যার জোরেই হয়তো চুং সায়েব আধঘণ্টার মধ্যে চশমা বানিয়ে দিলেও দিতে পারে। তবে ট্যাক্সির মিটার কিন্তু ঘুরবে এবং ভাড়ার অংক বেড়ে চলবে।
তা বাড়ুক। চটজলদি চশমা পেলে কত সুবিধে। এই ভেবে মুরারিবাবু প্রেসক্রিপশন বের করে দিলেন চুং সায়েবকে। স্টিলফ্রেমের চশমা পছন্দ, তাও বললেন। চুং সায়েব দেখে ফেরত দিয়ে বলল,-ওকে বাবু! ওনলি টেন মিনিটস!
বলে কী! দশ মিনিটে দেবে? –মুরারিবাবু তাকিয়ে রইলেন মুগ্ধদৃষ্টিতে। চুং সায়েব ঘরের ভেতর দিকে একটা সুড়ঙ্গ ঢুকে গেল। ট্যাক্সিওলা চোখ নামিয়ে বলল,–ম্যাজিক সার, ম্যাজিক! আমার বেলায় আধঘণ্টা লেগেছিল। আপনার মাত্র দশ মিনিট। আসলে আপনাকে খদ্দের হিসেবে মনে ধরে গেছে চুং সায়েবের।
মুরারিবাবু বললেন, হয়তো সবরকম পাওয়ারের চশমা আগে থেকে করা থাকে। তাই–
বলা কঠিন, স্যার! ট্যাক্সিওলা বলল।–ওই যে দেখছেন আমার মুণ্ডুর মাপ। চোখের কোনা থেকে কান অবধি মেপে দেখুন–পাক্কা দশ ইঞ্চির কম নয়। এই বেখাপ্পা মাপের ফ্রেমও কি আগে থেকে করা থাকে? আসলে সার, চীনারা বহুরকম বিদ্যা জানে! বুঝলেন না?
বুঝলেন মুরারিবাবু। তাই ঠিক। প্রাচীন কোনও গুপ্তবিদ্যার জোরে চুং সায়েব ঠিক মাপের চশমা ঝটপট বানিয়ে ফেলতে পারে। তেমনি মুগ্ধচোখে ঘরের ভেতরকার সেই সুড়ঙ্গের দিতে তাকিয়ে রইলেন মুরারিবাবু।
কিছুক্ষণ পরে সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এল চুং সায়েব। একটা ডিসের ওপর রাখা, সুন্দর স্টিলফ্রেমের চশমা। মুরারিবাবুর চোখে পরিয়ে দিয়ে ছোট্ট লাল গোল একটা আয়না ধরল ওঁর মুখের সামনে। মুরারিবাবু মুখে হাসি ফুটে উঠল। অপূর্ব! চেহারা খুলে গেছে একেবারে। মাপেও ঠিক। আর পাওয়ারও ঠিক। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। বাইফোকাল চশমা। ওপরের কাঁচ তফাতে দেখার জন্য এবং নিচের অংশ পড়াশুনোর জন্য। চমৎকার! মানিব্যাগ বের করতেই চুং সায়েব বলল,-টোয়েন্টি রুপিজ ওনলি!
মাত্র কুড়ি টাকা! তাহলে দেখা যাচ্ছে ফ্রেন্ডস অপটিক্যালস মহা জোচ্চোর। দুশো টাকা দাম নিয়েছিল আগের চশমাটার!
টাকা মিটিয়ে অনেকবার থ্যাংকস জানিয়ে নতুন চশমা পরে ট্যাক্সিতে এসে চাপলেন মুরারিবাবু। ট্যাক্সিওলা স্টার্ট দিয়ে খি-খি করে হেসে বলল, কী বুঝলেন সার? যা বলেছিলুম, তাই হল কি না বলুন?
মুরারিবাবুও একগাল হেসে বললেন,–ভালো। খুব ভালো।
ট্যাক্সিওলা বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে বলল, ভাড়াও দেখুন খুব বেশি ওঠেনি। মাত্র টাকা পনেরো। অন্য কেউ হলে–
ট্যাক্সিওলাকে আর কথাই বলতে দিলেন না মুরারিবাবু। একটা কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিলেন ওর হাতে। নমস্কার করে চলে গেল ট্যাক্সিওলা।
ট্যাক্সির নাম্বারটা দেখে রাখলেন। ডব্লিউ বি টি ৯৯৯৯। ভবিষ্যতে কখনও দেখা হলে সুবিধে হবে। বলা যায় না, বর্ষাবাদলার দিনে কোথাও গিয়ে আটকে গেছেন, কোনও ট্যাক্সি রাজি হচ্ছে না, দৈবাৎ যদি ওকে পেয়ে যান–তাকে না করতে পারবে না। বড় উপকারী ভালোমানুষ লোকটা। বাড়ির সবাই খুব তারিফ করল নতুন চশমাটার। এমনকী যে বিচ্ছু চশমা ভেঙেছিল সেও দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসতে লাগল। তাই বলে আর ওর ধারেকাছে যাচ্ছেন না দাদু।
নিজের ঘরে ঢুকে এদিনকার কাগজটা নিয়ে বসলেন মুরারিবাবু। কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে-মাঝে জানালা দিয়ে তাকাচ্ছিলেন। এক সময় হঠাৎ দেখলেন, শরতের নীল ঝকঝকে আকাশে একটা ট্যাক্সি ছুটে আসছে–ছুটে আসবে কীভাবে, উড়েই আসছে এবং প্রচণ্ড বেগে তার দিকে আসছে। আসতে-আসতে একেবারে জানালার কাছে। আর ট্যাক্সিওলা জানালা দিয়ে মুন্ডু বের করে আছে সেই ট্যাক্সিওলালম্বা নাক, প্রকাণ্ড মুন্ডু, মাথার ওপর বসানো একগোছা কাঠি-কাঠি চুল, কুতকুতে চোখ আর ঠোঁটে বিদঘুঁটে হাসি…।
আঁতকে উঠে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। কিন্তু এ কী! ট্যাক্সিটা যে তার ঘরের ভেতর এবং সেই ট্যাক্সিওলা মুখ বাড়িয়ে হাসছে।
খবরের কাগজে চোখ রাখলেন সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তুওরে বাবা। কাগজের ওপরও যে তাই। সেই ট্যাক্সি ও ট্যাক্সিওলা। এবার এতটুকুনটি হয়ে গেছে। পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে ট্যাক্সির নম্বর। সেই নম্বর!
ভয় পেয়ে চশমা খুলে ফেলে হাঁক দিলেন মুরারিবাবু-হরি! ও হরি! শিগগির একবার আয় তো!
হরি এসে একগাল হেসে বলল, লতুন চশমাখানা শুনলুম ভালোই হয়েছে। বড়বাবু! পরুন একবার দেখি।
মুরারিবাবু বললেন, হরি! একবার চশমাটা পর তো বাবা।
হরি অবাক হয়ে বলল,-কেন বড়বাবু? আমি চশমা পরব? আপনার চশমা?
–ধুর হতভাগা! যা বলছি কর। নে–পর।
জোর করে পরিয়ে দিলেন হরির চোখে। হরি বলল,-বাঃ! খুব পোস্কের চশমা! সব বড়-বড় পষ্টাপষ্টি দেখিতেছি।
–কিছু দেখতে পাচ্ছিস? জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকা।
হরি জানালার কাছে এসে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল, উড়ে বাব্বা! একখানা ট্যাক্সি আসিতেছে যে বড়বাবু! এই! এই! চাপা দেবে যে!
বলে চশমাটা খুলে ফেলল। মুরারিবাবু উত্তেজনা ও আতঙ্ক চেপে বললেন, এবার ঘরের ভেতরটা দ্যাখ তো হরি!
হরি ভয় পেয়েছিল। বড়বাবুর কথায় ভয়ে-ভয়ে আবার চশমা পরে ঘরের ভেতর তাকিয়ে, সব্বোনাশ! ট্যাক্সিখানা ঘুরে ঢুকে পড়তিছে–বলে খুলে ফেলল চোখ থেকে।
মুরারিবাবু গুম হয়ে চশমা নিয়ে বললেন,–হরি! কথাটা কাউকে বলিসনে। এটা একটা ম্যাজিক চশমা বুঝলি তো?
হরিও গুম হয়ে মাথা নেড়ে নিজের কাজে চলে গেল…।
.
দুই
হরিকে মুরারিবাবু বললেন বটে ম্যাজিক চশমা, কিন্তু ভালোই বুঝে গেছেন এ একটা ভুতুড়ে চশমা এবং এর পেছনে কোনও চক্রান্ত আছে। তা না হলে চুং সায়েব এর ভেতরে ও ট্যাক্সিওলাকেই তার ট্যাক্সিসমেত ঢুকিয়ে দিয়েছে কেন? সেদিনই আবার যেতে হল বউবাজারে। ফ্রেন্ডস অপটিক্যালসেরই শরণাপন্ন হতে হল মুরারিবাবুকে। কিছু বেশি টাকা দিয়ে পরদিন বিকেলের মধ্যেই ডেলিভারি পাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তারপর গেলেন ইং চুং সায়েবের দোকানে।
গিয়েই কিন্তু হতবাক মুরারিবাবু। সেই গলি, সেই ঘুপচি আলো-আঁধারি ঘর, তোবড়ানো রংচটা সেই ছোট্ট সাইনবোর্ড সবই ঠিক আছে। কিন্তু এ যে একটা চানাচুর-তেলেভাজার দোকান! এক বুড়ো কাঠখোট্টা চেহরার লোক কয়লার উনুনে প্রকাণ্ড কড়াই চাপিয়ে নাকমুখ সিঁটকে বসে আছে। কড়াইয়ের কালো তরল পদার্থটা থেকে প্রচণ্ড ঝুঁজ ছড়াচ্ছে। মুরারিবাবু অবাক হয়ে বললেন, ওহে, এখানে চুং সায়েবের চশমার দোকান ছিল, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে দোকান কোথায় উঠে গেল? লোকটা ভুরু কুঁচকে তাকাল, কী বলছেন বাবুজি?
মুরারিবাবু সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে বললেন,–ইং চুং সায়েবের দোকান ছিল না এটা?
লোকটা গরম তেলে বেগুনি ছেড়ে দিয়ে বলল,–তা তো জানি না বাবুজি। আমি এই দোকান করেছি পাঁচ-ছ বছর আগে।
চটে গেলেন মুরারিবাবু, কী বাজে কথা বলছ? আজ সক্কালে এখান থেকে চশমা করিয়ে নিয়ে গেলুম। আর তুমি বলছ পাঁচ-ছ বছর এই দোকান করেছ? তাহলে এই সাইনবোর্ডটা কেন?
লোকটা বলল, সাইনবোর্ড তো পাঁচ-ছ বছর ধরেই আছে। তাতে কী হয়েছে? খামোকা ঝামেলা করবেন না বাবুজি! গলির ভেতর আরও চশমার দোকান আছে। আপনি ভুল করছেন।
মুরারিবাবু জোরগলায় বললেন, অসম্ভব। ওই তো ঘরের ভেতর সেই সুড়ঙ্গ টাও দেখতে পাচ্ছি। চালাকি কোরো না আমার সঙ্গে। নিশ্চয় ওই সুড়ঙ্গের ভেতর চুং সায়েব লুকিয়ে আছে। ওকে ডাকো।
লোকটা খাপ্পা হয়ে বলল, আঃ! কী ঝুটঝামেলা করছেন বাবুজি! সবাইকে জিগ্যেস করুন না, এখানে কোনও চশমার দোকান ছিল কি না।
মুরারিবাবু ছড়ি তুলে সাইনবোর্ড ঠুকে বললেন, আলবাত ছিল।
গণ্ডগোল দেখে লোক জড়ো হচ্ছিল। পাশের দোকানের এক ভদ্রলোক ব্যাপারটা শুনে বললেন, আপনার ভুল হচ্ছে স্যার! ইং চুং সায়েবের চশমার দোকানই ছিল এটা। তবে তা সাত বছর আগের কথা। চীনা সায়েব ভালোই চশমা বানাত। একা থাকত। তারপর একরাত্রে ওকে ডাকাতরা খুন করে যায়। তারপর থেকে কিছুদিন ঘরটা খালি পড়ে ছিল। শেষে মটরবুড়ো এসে ভাজার দোকান করে।
মুরারিবাবু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। আস্তে-আস্তে চলে এলেন গলি থেকে সদর রাস্তায়। পকেটে চুং সায়েবের চশমাটা ঠিকই আছে। অথচ চুং সায়েব বেঁচে নেই! ছ-সাত বছর আগে ডাকাতরা তাকে খুন করে গেছে। আজ সকালে তাহলে কি কোনও অলৌকিক পদ্ধতিতে মুরারিবাবু ছ-সাত বছর পিছিয়ে গিয়েছিলেন?
খুব রহস্যময় ব্যাপার বলতে হয়। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আর ওই ট্যাক্সি এবং ট্যাক্সিওলাই চশমার ভেতর ঢুকে গেল কীভাবে?
এ হেঁয়ালি উদ্ধার করা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। উদ্ধার করা যেত হয়তো, যদি ট্যাক্সিওলার সঙ্গে ফের দেখা হতো।
কিন্তু ট্যাক্সিওলা যে চুং সায়েবের মতো ছ-সাত বছর আগের এক মরে যাওয়া মানুষ নয়, তাই বা কে বলল? সম্ভবত সেও তাই। অপঘাতে মরে যাওয়া মানুষ। তা না হলে লরির সঙ্গে তার ট্যাক্সির মুখোমুখি ধাক্কা, চশমা ভাঙা এবং চোখ সেরে যাওয়ার কথা বলছিল কেন?
শিউরে উঠলেন মুরারিবাবু। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সাহস করে আবার একবার চশমাটা বের করলেন। চোখে পরে আকাশের দিকে তাকালেন। আধমিনিট পরেই সেই দৃশ্য আবার। তেড়ে আসছে হলুদ কালো ট্যাক্সি। জানালা দিয়ে মুন্ডু বের করা ট্যাক্সিওলা–সেই লম্বা নাক, মাথার ওপর কাঠি কাঠি একগোছা চুল।
ঝটপট চশমাটা খুলে পকেটে ভরে রাখলেন। তারপর সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাসে উঠে পড়লেন। বাসে প্রচণ্ড ভিড়। কিন্তু উপায় কী? চারটে বাজতে না বাজতে এই অবস্থা হয়ে যায়। বয়স হয়েছে মুরারিবাবুর। চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই টের পেলেন তার পাঞ্জাবির পাশ পকেটে কেউ হাত ঢোকাচ্ছে। দু-হাতে ওপরকার রড ধরে আছেন। হাত দুটো নামাবার উপায় নেই। এতটুকু নড়ারও সাধ্য নেই। সামনে-পেছনে দুপাশে লোকেরা তাকে ঠেসে রেখেছে। এ অবস্থায় মুখে পকেটমার! পকেটমার! বলে চেঁচানো ছাড়া আর কিছু করা যায় না। কিন্তু চাচাতে গিয়ে থামলেন মুরারিবাবু। বরং মুচকি হাসলেন।
যে পকেটমার হাত ঢোকাচ্ছে, সেই পকেটে সেই ভুতুড়ে চশমাটা ছাড়া আর কিছু নেই। নিয়ে যাক না ব্যাটা আপদ বিদায় হোক বরং। ওই বিদঘুঁটে জিনিসটা আবার কী ঝামেলা বাধায় বলা যায় না। কে বলতে পারে, আচমকা ট্যাক্সিটা চশমা থেকে বেরিয়ে তাকে চাপা দেবে কি না। সেটা হয়তো অসম্ভব নয়। যে জোরে ছুটে আসে, মনে হয় তার ওপর এসে পড়ল বলে। কিংবা ছোট্টটি হয়ে চোখের ভেতর ঢুকে যেতে পারে।
পকেটমার পকেটে হাত ঢোকাচ্ছে আর মুরারিবাবু এই সব কথা ভেবে খিক খিক করে হাসছেন। পাশের লোকটা তার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। নিশ্চয় পাগলা ভাবছে তাঁকে। ভাবুক।
কিন্তু তারপরেই কেউ চেঁচিয়ে উঠল,–তবে রে ব্যাটা! তখন থেকে দেখছি এই ভদ্রলোকের পকেটে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করছ–
সঙ্গে সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল চলন্ত বাসের ভেতর। একসঙ্গে অসংখ্য যাত্রী কানফাটানো গলায় চ্যাঁচিতে থাকল,-মার! শেষ করে দে।
বাসে পকেটমার ধরা পড়লে যা হয়। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। ভিড়ের ধাক্কায় মেয়েদের আর্তনাদ, বাচ্চাদের ভা–বেগতিক বুঝে ড্রাইভার বাস দাঁড় করাল।
মুরারিবাবু দেখলেন, একটা লোককে যাত্রীরা টানতে টানতে বাস থেকে নামাচ্ছে এবং সেই লোকটাই নিশ্চয়ই তাঁর পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল।
কিন্তু রাস্তায় তাকে টেনে নামাতেই মুরারিবাবু হতচকিয়ে গেলেন। পকেটমার আর কেউ নয়, সেই ট্যাক্সিওলা-লম্বা নাক, মাথার ওপর বসানো কাঠি কাঠি চুল! মুরারিবাবু ভিড় ঠেলে নামবার চেষ্টা করে চেঁচিয়ে উঠলেন,–ওকে মারবেন না! ওকে মারবেন না!
কিন্তু এখন এসব কথা কে শোনে! রাস্তার লোকেরাও এসে জুটে গেছে। সবাই তাকে মারবার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে মুরারিবাবু কিছুতেই কাছে যেতে পারলেন না।
এই সময় বাসের কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে বলল, বাস ছেড়ে যাচ্ছে! ওঠবার হলে উঠে পড়ুন।
নিমেষে ভিড় শূন্য হয়ে গেল। এ বাস ছেড়ে দিলে আবার কখন পাবে, তার ভরসা নেই। মুরারিবাবু তাকিয়ে রইলেন। কই? কোথায় গেল সেই ট্যাক্সিওলা– যাকে পকেটমার বলে লোকেরা বেদম পিটুনি দিচ্ছিল?
তন্নতন্ন করে খুঁজে আর তাকে দেখতেই পেলেন না মুরারিবাবু। কোন ফাঁকে কেটে পড়েছে সে। তবে শুধু ওইটুকু পরিষ্কার বোঝা গেল, লোকটা চশমাটা হাতানোর তালে আছে। নিশ্চয়ই কোনও কারণে সে চশমাটা মুরারিবাবুর কাছে থাকা আর ঠিক মনে করছে না।
হুঁ–রহস্য আরও জট পাকিয়ে গেল তাহলে। মুরারিবাবু ভাবনায় গুম হয়ে গেলেন। তারপর বাসটা স্টার্ট সম্বিৎ ফিরল। রোখ। রোখ–বলে চেঁচিয়ে উঠলেন বটে, কিন্তু তক্ষুনি থমকে দাঁড়ালেন। কোন সাহসে আবার বাসে চাপতে যাচ্ছেন ভিড়ের মধ্যে?…
.
তিন
সেদিনই অনেক রাতে আরও একটা ঘটনা ঘটল। মুরারিবাবুর রাত জেগে বই পড়ার অভ্যাস। কিন্তু চশমার অভাবে বই পড়া হল না। অথচ ঘুমও আসতে চাইল না। তাই বলে চুং সায়েবের চশমা পরে বই পড়ার সাহস ছিল না। বইয়ের পাতায় দেখবেন শুধু একটা রহস্যময় ট্যাক্সি। বই পড়া তো যায় না এভাবে।
শুয়ে ছিলেন চুপচাপ। চশমা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছিলেন। অগত্যা। সেই সময় ফোন বাজল। রাত বারোটায় কে ফোন করছে? হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে বললেন, হ্যালো! কাকে চাই?
–আপনি কি মুরারিমোহন সাঁতরা?
–হ্যাঁ। কে বলছেন আপনি?
–আমি তারাপদ বকসী। নমস্কার স্যার!
–আপনাকে তো চিনতে পারলুম না ঠিক।
–সে কী সার! আজ সকালেই তো আপনাকে ট্যাক্সি করে চুং সায়েবের দোকানে–
মুরারিবাবু নড়ে উঠলেন, আরে শুনুন, শুনুন!
–শোনার আগে আমার কথাটা বলে নিই স্যার!
উত্তেজনা চেপে মুরারিবাবু বললেন, হুঁ–বলুন।
–চুং সায়েব কেলেঙ্কারি করেছে। আজ সকালে আপনাকে চশমা তৈরি করে দেওয়ার পর দুপুরবেলা আমার সঙ্গে এক জায়গায় হঠাৎ দেখা। হাসতে-হাসতে বলল কী–সেই বুড়োবাবুর চশমার ভেতর আমাকে ট্যাক্সি সমেত ঢুকিয়ে দিয়েছে। শুনে তো আমি ভাবনায় পড়ে গেলুম। বুড়োবাবু মানে আপনি যদি ব্যাপারটা পুলিশের কানে তোলেন বুঝলেন তো সার?
–কিছু বুঝলাম না।
–তাহলে গোড়ার কথাটা খুলে বলি, স্যার!
–বলুন। সেটাই শুনতে চাই।
–বছর ছয়েক আগে এক রাত্তিরে ভবানীপুরে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে খালি ট্যাক্সি নিয়ে শ্যামবাজারে ফিরে আসছি, চৌরঙ্গীতে চারজন লোক দাঁড় করিয়ে বলল, শ্যামবাজার যাবে। খুশি হয়ে ওঠালুম তাদের। কিন্তু তখন কী জানতুম ওদের কী মতলব? বলল, বউবাজার হয়ে একটা কাজ সেরে ওদের যেতে হবে। তাই বউবাজারের দিকে চললুম। চুং সায়েবের দোকানের গলির মুখে আমাকে ট্যাক্সি দাঁড় করাতে বলল। তিনজন নেমে গেল। একজন আমার পেছন থেকে ছুরি দেখিয়ে বলল, চুপ। যা, বলব, করবে। টু করলে মারা পড়বে। বুঝলেন তো স্যার?
–হুঁ। ওরা চুং সায়েবের দোকানে ডাকাতি করেছিল। তারপর চুং সায়েবকে খুন করে—
ট্যাক্সিতে ফিরে এল। প্রাণের ভয়ে একটা কথা বলতে পারলুম না। বুঝলেন না?
–আহা বুঝতে পেরেছি। তারপর?
–তারপর স্যার লোকগুলো হুকুম দিলে স্পিড বাড়াও। বাধ্য হয়ে স্পিড বাড়ালুম। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যেই পৌঁছেছি, আচমকা একটা লরি এসে পড়ল মুখোমুখি। আর ব্যস! বুঝলেন তো স্যার?
–বুঝলুম। আপনি অক্কা গেলেন?
–একেবারেই!
–তার মানে আপনি ভূত হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?
–হেঁ হেঁ লজ্জা পাই স্যার, ভূত বললে।
–ভূত বললে লজ্জা পান, কিন্তু বাসে উঠে আমার পকেটে হাত ঢোকাতে লজ্জা পান না!
–ধরা পড়ার ভয়ে স্যার! পুলিশ–বুঝলেন না? পুলিশ এখনও খুঁজছে আমাকে।
–সেই পুলিশও নিশ্চয় ভূত?
–ঠিক ধরেছেন স্যার! তাই বলছিলুম, দয়া করে যদি চশমাটা আমাকে দেন, খুব ভালো হয়। চুং সায়েব আমাকে আর জড়াতে পারবে না ডাকাতি কেসে। পুলিশও প্রমাণ পাবে না।
মুরারিবাবু গর্জে বললেন,–চালাকি?
–কেন স্যার? –আপনি ভূত?
–হেঁ-হেঁ–আর লজ্জা দেবেন না স্যার।
–শাট আপ! আপনি ভূত হয়ে আমাকে টেলিফোন করছেন রাতদুপুরে? আমি কচি খোকা?
–সে কী স্যার? বিশ্বাস করলেন না?
–না। চুং সায়েবেকে ডাকাতরা খুন করেছিল শুনে এসেছি। কিন্তু আপনি দিব্যি ট্যাক্সি করে এখনও ঘুরছেন তার মানে, আপনি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। চুং সায়েব ভূত। তাতে আর সন্দেহ নেই। ভূত হয়ে চুং সায়েব এতদিন আপনাকে ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন। আপনাকে আমি ধরিয়ে দেব। মশাই! আমাকে কি বুদ্ধ পেয়েছেন যে বিশ্বাস করব, ভূত হয়েও আপনি আমার পকেটে হাত ঢোকাচ্ছিলেন এবং লোকেদের হাতে যথেচ্ছ পিটুনি খাচ্ছিলেন?
–চুং সায়েবের ভূত যদি চশমা করে দিতে পারে, তাহলে আমিই বা আপনার পকেটে হাত ঢোকাতে পারি না কেন? লোকের হাতে মার খেতেই বা অসুবিধেটা কীসের স্যার?
তর্কে হেরে মুরারিবাবু বললেন, কিন্তু আমি তো ভূত নই। আমি আপনাদের পুলিশ-ভূতকে পাচ্ছি কোথায় যে চশমাটা দেব তাদের?
–ওরা আপনার আনাচে-কানাচেই ঘুরছে স্যার! আজ সকালে আমার ট্যাক্সি করে আপনাকে যেতে দেখছে না?
মুরারিবাবু শিউরে উঠে জানালাগুলোর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আপনি কোত্থেকে ফোন করছেন?
–যে হাসপাতালের মর্গে ছিলুম, সেই হাসপাতালের পাবলিক বুথ থেকে।
–বেশ! চলে আসুন। চশমা পেয়ে যাবেন।
আমি গোপনে যাব, স্যার! –তারাপদ বকসী চাপা গলায় বলল। গিয়ে আপনার জানালায় টোকা দেব। আপনি যেন দয়া করে জেগে থাকবেন।
–জানালা খোলা থাকে আমার ঘরে।
–এটা উচিত নয়, স্যার। বিস্তর খারাপ লোক আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায় আজকাল!
–ঠিক আছে। বলছেন যখন বন্ধ করে দেব। আপনি আসুন।
ফোন রেখে মুরারিবাবুর গুম হয়ে বসে রইলেন মিনিট দুই। মুহুর্মুহু গা শিউরে উঠল। এতক্ষণ একজন ভূতের সঙ্গে কথা বলছিলেন ভেবেই।
তারপর ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেন। একটু পরে ঝমঝম করে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। বর্ষার রাত। তাছাড়া এবার বর্ষাটা বড্ড বেশি রকমের। কিন্তু তারাপদ বকসীর আসবার নাম নেই। ভুতুড়ে চশমা ভূতের হাতেই চলে যাক, তাতে ক্ষতি মাত্র গোটা পঁয়তাল্লিশ টাকা। মাঝখান থেকে চর্মচক্ষে ভূতদর্শন হয়ে গেল। মন্দ কী! এখন সবকথা জানার পর দরকার খানিকটা সাহস। ভয় পেলে চলবে না।
আবার ফোন বাজল ক্রি-ক্রিং করে। তারাপদ বকসী এ রাতে আসতে পারবে না বলবে নাকি? কে জানে, আনাচে কানাচে পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে বলছিল।
কাঁপা-কঁপা হাতে ফোন তুলেই বললেন,–তারাপদবাবু নাকি?
ফোনের ভেতর ভারিক্কি গলায় ভেসে এল, আপনি কি তারাপদ বকসীর কথা বলছেন।
–হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
–বউবাজার থানা থেকে বলছি। আপনার তাহলে তারাপদর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
–না–মানে–
–মানে-টানে আবার কী। শুনুন মুরারিবাবু! আমাদের কাছে খবর আছে, ১৯৭৮ সালের ২১শে জুলাই তারিখে বউবাজার এলাকায় ইং চুং সায়েবের দোকানে যে ডাকাতি হয়েছিল, সে ব্যাপারে আপনার কাছে একটা মূল্যবান এভিডেন্স আছে।
–বুঝেছি। চশমাটার কথা বলছেন তো?
–হ্যাঁ। শুনুন, এখনই আমরা যাচ্ছি আপনার কাছে। সাবধান, চশমাটা যেন কাউকে দেবেন না। আমরা খবর পেয়েছি, তারাপদ ওটা চুরির মতলবে ঘুরছে? আপনার কাছে চাইতেও যেতে পারে। আপনি যা ভালোমানুষ, বলা যায় না কিছু।
মুরারিবাবু বিব্রতভাবে বললেন,–আচ্ছা, আচ্ছা।
–আচ্ছা-টাচ্ছা নয়। আমরা যাচ্ছি।…
ফোন রেখে মুরারিবাবু আবার গুম হয়ে গেলেন। বেচারা তারাপদ বকসীর তো কোনও দোষ নেই। ছুরি দেখিয়ে ডাকাতরা ওকে বাধ্য করেছিল ট্যাক্সি নিয়ে যেতে! খামোকা পুলিশ হয়রান করবে ওকে।
কিন্তু তারাপদকে চশমা দিলে পুলিশ এসে তাঁকেই হয়রান করবে। কে জানে এ পুলিশ কোন পুলিশ? ভূত-পুলিশ, নাকি শুধু পুলিশ। পুলিশ বলেই মনে হচ্ছে।
বাইরে বৃষ্টি ঝরছে সমানে। একটা জানালা খুলেই বন্ধ করে দিলেন মুরারিবাবু। বৃষ্টির ছাট আসছে। ঘরের ভেতর টেবিল ল্যাম্প জুলছিল।
হঠাৎ সেটা নিভে গেল। ফ্যানও বন্ধ হয়ে গেল। লোডশেডিং।
অন্ধকারে টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে একটা মোমবাতি পাওয়া গেল। এত রাতে হরির ঘুম ভাঙানো কঠিন। একটা হ্যারিকেন হলেই ভালো হতো! মোমবাতিটা বড় ছোট আর লিকলিকে।
মোমবাতিটা সবে জ্বেলেছেন, বাইরে খটখটঝুপঝাঁপ জুতোর শব্দ শোন গেল। তারপর দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন মুরারিবাবু। চেয়ারের ডগায় মাথা লাগল। বেশ জোর লাগল। ককিয়ে উঠলেন।
তারপরই কানের কাছে নুকুরের চিৎকার শুনতে পেলেন, দাদু! দাদু!
চোখ খুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন মুরারিবাবু। তার মুখের সামনে মুকু, নুকুর বাবা, নুকুর মা এবং কোলে সেই চশমা-কাড়া বিচ্ছু খোকাটা, এবং হরিও দাঁত বের করে আছে।
ব্যাপারটা কী? মুরারিবাবু মুখটা একটু তুলেই অবাক হলেন। এ কোথায় শুয়ে আছেন তিনি? এ তো হাসপাতাল বলে মনে হচ্ছে।
আর তার মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যান্ডেজ।
সঙ্গে-সঙ্গে মাথার ভেতরটা কেমন করে উঠল। নুকু বলল, দাদু, চোখ খোলো। আমরা তোমাকে দেখতে এসেছি। ট্যাক্সিতে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে তুমি মরে গিয়েছিলে যে?
তবে তাই। লম্বা নাক, কুতকুতে চোখ, মাথার ওপর কাঠিকাঠি চুল–একটা লোকের ট্যাক্সিতে চেপে চশমা করাতে যাচ্ছিলেন মনে পড়ছে। কিন্তু কখন অ্যাক্সিডেন্টটা হল। কিছুতেই মনে পড়ছে না। যাইহোক, ট্যাক্সিতে ওঠার পর বাকিটা তাহলে ধাক্কা খেয়ে চোখের মতোই মগজ পরিষ্কার হওয়ার ফল। সময়ের উজানে চলে গিয়েছিলেন। খিকখিক করে হেসে উঠলেন মুরারিবাবু। তাকে হাসতে দেখে সবাই অবাক। উদ্বিগ্নও। পাগল হয়ে যাবেন না তো?
.
চার
না। আঘাত তত গুরুতর হয়নি। মাস তিনেকের মধ্যে মুরারিবাবু আগের মতো চলাফেরা করতে পারছেন। তবে ভারি আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটে গেছে, বিনা চশমায় দিব্যি বইপত্র পড়তে পারছেন এবং দূরের সবকিছুই দেখতে পারছেন।
তারাপদ বকসী বলেছিল বটে, এক ধাক্কাতেই চোখ পরিষ্কার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি চেয়ে মোড় অবধি গেছেন, আচমকা লরির ধাক্কা। ট্যাক্সিওলা বেচারা নাকি মারা গেছে।
যে আগেই মরে গিয়েছিল, দ্বিতীয়বার তার মরা না মরা সমান।
এরপর একদিন মুরারিবাবু রাস্তার মোড়ে গেছেন ট্যাক্সি ধরতে। ভবানীপুরে ভাগ্নে শ্রীমান মুকুলের বাড়ি যাবেন। কিন্তু বাসে বেজায় ভিড়। ট্যাক্সিও পাচ্ছেন না। হঠাৎ দেখতে পেলেন একটা খালি ট্যাক্সি আসছে। হাত দেখাতেই ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে গেল।
অমনি মুরারিবাবু দেখলেন সেই লম্বা নাক, কুতকুতে চোখ, মাথায় কাঠি-কাঠি চুল–তারাপদ বকসী আঁতকে এসে বললেন,–না, না। যাব না।
এক ভদ্রলোক ট্যাক্সির জন্য তাক করছিলেন। তিনি তক্ষুনি উঠে পড়লেন। মুরারিবাবু বারণ করার আগেই ট্যাক্সিটা বেরিয়ে গেল। সেই নম্বর। ডব্লিউ বি টি ৯৯৯৯। যাকগে। আরেকজনের মগজ সাপ হয়ে যাবে ধাক্কা খেয়ে। এই কলকাতায় এমন কত ট্যাক্সি আর কত তারাপদ বকসী কত ঘুরে বেড়াচ্ছে সঙ্গে পুলিশ। মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তবে মুরারিবাবু কৃতজ্ঞ বইকী। এক ধাক্কায় তাঁর চোখ পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর চশমাও লাগে না।…