বোতল যখন কোকিল হয়?
সকালে থলে হাতে বাজারে যাচ্ছেন বৈকুণ্ঠবাবু! রাস্তায় অনেক দিন বাদে দেখা হল ঘোঁতনবাবুর সঙ্গে। এই যে ঘোঁতন। কেমন আছো? অ্যাদ্দিন ছিলে কোথায় হে? আঁ? ব্যাপারটা কী? ইত্যাদি প্রশ্নসূচক বাক্যে অনর্গল জর্জরিত করতে থাকলেন ঘোঁতনবাবুকে! বৈকুণ্ঠবাবুর বরাবর এই অভ্যেস। অনর্গল কথা বলতে পারেন।
ঘোঁতনবাবু কিন্তু কোনও কথাই বলছেন না। চাউনিটা ভারি বিমর্ষ। টাক চুলকোচ্ছেন আর চুলকোচ্ছেন এবং মাঝে-মাঝে কান খাড়া করে কী শুনছেন। তখন মুখের ভাবটা বিকৃত দেখাচ্ছে।
তখন বৈকুণ্ঠবাবু তার পেটে আঙুলের গুঁতো মেরে বললেন,-মুখে কি বোবায় ধরল ঘোঁতন? কথা বলছ না কেন? সব জিনিসের দাম বেড়েছে বলে বুঝি কথারও দাম বাড়াতে চাইছ?
গুঁতো খেয়েই যেন মুখে কথা ফুটল ঘোঁতনবাবুর! একটু ম্লান হেসে বললেন, এমন সময় তুমি আমাকে জেরা করছিলে, যখন আমার জবাব দেওয়ার উপায়ই ছিল না–এখন যা জিগ্যেস করবে করো, বলছি।
অবাক হয়ে বৈকুণ্ঠবাবু বললেন, তার মানে, এতক্ষণ তো খালি টাক চুলকোচ্ছিলে ভায়া।
ঘোঁতনবাবু চাপাগলায় বললেন, না। তখনি আমি কোকিলের ডাক শুনছিলুম, বুঝলে? তোমার গুঁতো খেয়ে সে-ডাক থাকল।
বলো কী! –বৈকুণ্ঠবাবু হতভম্ব হয়ে বললেন,–এ হেঁয়ালির অর্থ কী ভায়া? নাকি রসিকতা করছ? তুমি তো কোনওদিনই রসিক লোক ছিলে না!
সত্যি বলছি বৈকুণ্ঠ। কোকিলের ডাক শুনছিলুম। –ঘোঁতনবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, সেই কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে ডাকতে শুরু করেছে। এই বৈঠকখানায় এসে থামল। তাও ভাগ্যিস তুমি গুতো মারলে, তাই। নইলে মৌলালির মোড় অবধি সমানে ডাক চালিয়ে যেত।
বৈকুণ্ঠ আকাশ থেকে পড়তে-পড়তে বললেন,–কোকিল! কার কোকিল? কীসের কোকিল? কোথায় কোকিল?
এবার ঘোঁতনবাবু বৈকুণ্ঠবাবুর একটা হাত ধরে টানলেন।সে এক ইতিহাস ভাই বৈকুণ্ঠ। একটু নিরিবিলিতে এসো। সংক্ষেপে মোটামুটি বলছি।
বাজার করে নিয়ে গেলে রান্না হবে এবং তাই খেয়ে বৈকুণ্ঠ আপিস যাবেন। অতএব তাড়া ছিল। কিন্তু ঘোঁতনের মতো রাশভারী মানুষ কোকিল-টোকিল নিয়ে রসিকতা করবেন, এ অসম্ভব। নিশ্চয় গুরুতর এবং রহস্যময় কিছু ঘটেছে। তাই বৈকুণ্ঠ আড়চোখে হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে একটু নিরিলিতে গেলেন ওঁর সঙ্গে।
তারপর ঘোঁতনবাবু যা বললেন, তো শুনে তো আঁতকে উঠলেন। ব্যাপারটা হয়েছে এই :
ইদানীং ঘোঁতন ধর্মেকর্মে মন দিয়েছিলেন। ওঁর সেকেন্ডহ্যান্ড শিশি-বোতলের ব্যবসাটা পৈতৃক। সেই ব্যবসাতে হঠাৎ একগুচ্ছের লোকসান খেয়ে সামলে উঠতে পারেননি। মনের দুঃখে কিছুদিন নানান তীর্থে দেবসন্দর্শনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একদিন দক্ষিণ ভারতে এক তীর্থে পুকুরের ঘাটে শুয়ে আছেন। সেই সময়ে স্বপ্নে দেখলেন, জটাজুটধারী প্রকাণ্ড চেহারার এক সাধু এসে তাঁকে একটা বোতল দিয়ে বললেন, এইটে নিয়ে বাড়ি চলে যা। ঘুম ভেঙে ঘোঁতন কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। একেবারে দুপুরবেলা। মন্দিরের ছায়া ঘাটে এসে পড়ছে। সে ঘাটের ধাপে ঠান্ডা ছায়ায় তিনি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন।
তারপর তার চোখে পড়ল পায়ের কাছে নিচের ধাপে একটা বোতল গড়াতে গড়াতে জলের দিকে যাচ্ছে। অমনি হাত বাড়িয়ে সেটাকে ধরে ফেললেন।
কালো কুচকুচে লম্বা বোতল, খালি। শুঁকে দেখলেন, ভেতরে কেমন একটা মিঠে গন্ধ। মনের জ্বালা জুড়িয়ে গেল। বারবার শুকলেন। ওঁকে আশ মেটে না, এমন অবস্থা।
কিন্তু হায়! তখন যদি জানতেন এই বোতলই তাঁর কাল হবে! সাধু দুষ্টুমি করে কী বিপদে না তাকে ফেলে দিয়েছেন।
বোতলটা পকেটস্থ করে মহানন্দে চলেছেন ঘোঁতন। মনে হচ্ছে এই পবিত্র বোতল তার চিৎপুরের শিশি-বোতলের দোকানে প্রতিষ্ঠা করলেই ব্যবসা আবার হু হু করে ফুলে উঠবে। হ্যাঁ, সোনার না হোক, আপাতত একটা চাদির পালঙ্ক তৈরি করে তার ওপর শ্রীশ্রীবোতল-দেবকে শুইয়ে রাখবেন এবং দুবেলা ধুপ চন্দন ফুল দিয়ে পুজো করবেন। জয় বাবা বোতলদেব। বোতলদেবায় নমঃ।
মন্দিরের গেট পেরিয়ে কয়েক পা গেছেন, হঠাৎ চমকে উঠলেন। বোতলটা নিচের ঝুল পকেটে ঢোকানো ছিল! সেটা খুব নড়াচড়া করছে। পকেটে হাত ভরতেই একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন ঘোঁতন।
একি! একি! বোতল কোথায়? হাতে যে নরম পালকের মতো কিছু ঠেকছে। ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে পকেটের ফাঁক দেখেন, বোতলটা রূপ বদলে একটা কোকিল হয়ে গেছে। ঠোঁট ফাঁক করলে তার মুখের ভেতরে লালচে জিভ এবং গলা অবধি দেখা গেল। মনে হল কোকিলটা ডাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু আঁটো জায়গায় সুবিধে করতে পারছে না। এবং সেই সময় কোকিলটা তার হাতে বেজায় ঠোক্কর দিতে শুরু করল।
হাত সঙ্গে সঙ্গে বের করে নিলেন। রক্তারক্তি হয়ে গেছে ডান হাতটা। তখন করলেন কী, পকেটের মুখ চেপে ধরে আটকে রাখলেন এবং দৌড়তে শুরু করলেন
যাই হোক, সেদিনই টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে কলকাতা রওনা হলেন ঘোঁতনবাবু। দুদিন দুরাত জানি। কিন্তু একবারও পকেটের মুখ ফাঁক হতে দেননি। কোকিল সারাক্ষণ ছটফট করেছে। মরিয়া হয়ে পকেট চেপে ধরে বসে থেকেছেন ঘোঁতনবাবু। এইভাবে হাওড়া পৌঁছেছেন।
তারপর প্রথমে চিৎপুরের দোকান গিয়ে বন্ধ দরজার তালা খোলেন বাঁ-হাতে। ভেতরে ঢুকে বাঁ-হাতেই দরজা ফের আটকে সুইচ টিপে বাতি জ্বালেন। তারপর পকেট থেকে হাত সরিয়ে নেন। কিন্তু আশ্চর্য, পরমাশ্চর্য! কোথায় কোকিল! সেই বোতলটাই পকেটে পোরা আছে।
তখন শ্রদ্ধা সহকারে বোতলটা দেয়ালের তাকে গণেশের পাশে বসিয়ে রাখেন। আপাতত ওখানেই সিদ্ধিদাতার পাশে থাকুন। শিগগির একটা চাদির পালঙ্ক এনে একটা ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠা করবেন। দেয়াল কেটে নতুন তাক করে নিতেই বা অসুবিধেটা কী?
সেদিনকার মতো এই। দরজা বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গেলেন নিশ্চিন্তে। বোতলদেব যদি আবার বেখেয়ালে কোকিলদেব হয়েও ওঠেন, পালাতে পারবেন না। দরজা তো বন্ধ রইল।
এবং পরে যদি দেখেন, সত্যি আবার কোকিল রূপ ধারণ করেছেন তাহলে বরং একটা খাঁচার ব্যবস্থাই করবেন।
করতেও হল ঠিক তাই। পরদিন সকালে গিয়ে দোকান খুলছেন তখনই কানে এল ভেতরে কোকিল ডাকছে। কু-উ-উ–কু-উ-উ–কু-উ-উ। তারপর কুহু কুহু কুহু কুহু-কহুকুহু–কুক্কু কু কু কু কুকু–
আর দরজা খোলা হল না। তক্ষুনি একটু দূরে একটা হার্ডওয়ার স্টোর্স থেকে মজবুত লোহার খাঁচা কিনে আনলেন। তারপর খুব সাবধানে দোকানে ঢুকেই দরজা আটকে দিলেন। সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দেখলেন–কোকিলদেব গণেশের পাশেই বসে আছেন এবং উদাস সুরে গান গাইছেন।
পা টিপে পাশ থেকে এগিয়ে ধপ করে ধরে ফেললেন তাকে এবং খাঁচায় ভরে নিশ্চিন্ত হলেন। খাঁচাটা টাঙিয়ে রাখলেন জায়গামতো।
হ্যাঁ, শিশি-বোতলের ব্যবসা কি আবার জমে উঠল। প্রায়ই নানান কোম্পানি থেকে সেকেন্ডহ্যান্ড শিশি-বোতলের অর্ডার আসে। এসব মাল ঘেতনবাবু সস্তায় কেনেন। ওই যে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে শিশি-বোতল কিনে বেড়ায় যারা, তাদের কাছ থেকে কিনে নেন। তারপর ঠিকে কাজের লোক দিয়ে সাফ করিয়ে রাখেন। তাকে, আলমারিতে, মেঝেয়, বস্তায় অজস্র শিশি-বোতল।
এ পর্যন্ত সব ভালোয়-ভালোয় চলছিল। এরপর শুরু হল গোলমেলে ব্যাপার। এক সন্ধ্যাবেলা প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে। দেখতে-দেখতে রাস্তায় জল জমে উঠল। সেই জল ঘোঁতনবাবুর জগদম্বা বোতল ভাণ্ডার-এর চৌকাঠে এসে উঁকি মারল। তখন তিনি তাপোশে ঠ্যাং তুলে বসলেন এবং মনেমনে বোতলায় নমঃ, কোকিলায় নমঃ জপ শুরু করলেন। তখন বৃষ্টির জল দোকানের ভেতর ঢুকে পড়েছিল। তারপর আর বেরুবার নামগন্ধ নেই। কত কষ্টে যে তাড়ালেন কহতব্য নয়। তাঁ, বোতলবাহিনীর সাহায্যেই তাড়িয়েছিলেন।
তো এদিনও সেই অবস্থা প্রায় তারপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো তক্ষুনি লোডশেডিং। ব্যস! দোকানপাট, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বিলকুল অন্ধকার। চিকুর হেনে বাজ ডাকছে এবং বৃষ্টি সমানে ঝমঝমিয়ে পড়ছে তো পড়ছেই। লোজনেরা কোথায় মাথা বাঁচাতে ঢুকে পড়ছে। এসব সময় দোকানে চোর-ডাকাতের হামলার ভয় আছে। তাই ঘোঁতনবাবু যথারীতি মোমবাতি জ্বেলে দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন।
আর সেই সময় অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।
খাঁচার কোকিলদেব গান গেয়ে উঠলেন, কুউ-কুউ-কুউ- কুহু কুহু…কুহু কুক্কু কু কুকু!
আর সঙ্গে সঙ্গে হল কী–তাকে, আলমারিতে, বস্তায়, মেঝেয় যেখানে যত কালো বোতল ছিল, সব কোকিলের গলায় কুহু গাইতে শুরু করল।
দেখাদেখি রংবেরঙের অন্য শিশি-বোতলগুলোও নানান পাখির ডাক ডেকে উঠল। কিচির মিচির-কিচির মিচির–চু চিক্ চিক্ চিক্ চিকি চিকি চিকি-কুছ কুছ—ক্রিরররর ক্রু ক্রু–কি কি কিচুক চুক চুক চাঁকুক্ চাঁকুক্ চাকু চ্যাঁক চ্যাঁক!
ঘোঁতনবাবু যেদিকে ঘোরেন, দেখতে পান ঘরভর্তি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখপাখালি। দোয়েল, শ্যামা, শালিক, ফিঙে, ছাতার, টিয়া, চন্দনা, মৌটুসি, কাদাখোঁচাকতরকম পাখি! আর তাদের মধ্যে গলা চড়িয়ে গান ধরেছে ওই কোকিলগুলো। গণ্ডয়-গণ্ডায় কোকিল। খাঁচার কোকিল অর্থাৎ শ্ৰীশ্ৰীবোতলদেব ওরফে শ্রীশ্রীকোকিলেশ্বর যেন টুকটুকে মুখে মুচকি হাসছেন এবং গাইছেন। বাকি কোকিলরা সুর ধরেছে।
ভয় পেয়ে এক লাফে এগিয়ে দরজা খুলে দিলেন ঘোঁতনবাবু। আর অমনি ঝাঁকে ঝাকে পাখপাখালি ফরফর করে দরজা দিয়ে বেরুতে শুরু করল। ঘেতনবাবু বেগতিক দেখে চোখ বুজে এক পাশে সরে এলেন এবং ভয়ে বসে পড়লেন। আধমিনিটের মধ্যে ঘর খালি হয়ে গেল। শুধু রইল খাঁচায় বন্দি সেই শ্রীশ্রীকোকিলেশ্বর ওরফে শ্ৰীশ্ৰীবোতলদেব কিংবা বোতলেশ্বর, যিনিই হোন। পালাতেন নিশচয়ই-কিন্তু খাঁচায় বন্দি বলেই পারলেন না।
যা হওয়ার হল। এবার বানের জল ঢুকে পুকুরের জল বেরিয়ে যাওয়া। ফতুর হয়ে গেলেন ঘোঁতনবাবু। তার ওপর জুটল এই ব্যারাম। মাথার মধ্যে যখন-তখন সেই কোকিল ডেকে ওঠে। সে কী বিচ্ছিরি ব্যাপার, অন্যে বুঝতে পারবে না। মাথার মধ্যিখানে কোকিলের ডাক নিয়ে কি মানুষ বাঁচতে পারে? খেতে-শুতে শান্তি নেই।
সব শোনার পর বৈকুণ্ঠবাবু দুঃখিত মুখে বললেন, তাহলে তো বড় বিপদে পড়েছ ভায়া। তা সেই খাঁচার কোকিলটা এখন কোথায়?
ঘোঁতনবাবু ফিক করে হেসে বললেন, সম্প্রতি এক মাড়োয়ারিকে বেচে দিয়েছি।
যাকগে, ভালো করেছ। আপদ গেছে। –বৈকুণ্ঠবাবু এই বলে পা বাড়ালেন।
ঘোঁতনবাবু বললেন,–আপদ গেল কোথায়? কোকিল গেল, কোকিলের ডাকটা যে গেল না। তাই যাচ্ছি মৌলালির দরগায় সিন্নি দিতে।
বৈকুণ্ঠবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাই যাও ভায়া। কোকিলের ব্যানো ওষুধটষুধ খেয়ে সারবে না। তুমি পিরবাবার দরগায় গিয়ে সিন্নিই চড়াও।
বলে ব্যস্তভাবে হনহন করে বাজারে ঢুকলেন বৈকুণ্ঠবাবু।
অন্যদিনে দরাদরি করে খুব জমিয়ে বাজার করেন। আজ সময়ও কম। ঘোঁতনবাবুর কথা শুনতে-শুনতে বেশ খানিকটা দেরিও হয়েছে। অল্পস্বল্প কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরলেন।
তাঁর মেয়ে ইতি গতকাল বাড়ির সামনে একটা কালো বোতল কুড়িয়ে পেয়েছে। বেশ লম্বা বোতল। কেরোসিন রাখার জন্যে ইতির মা সেটা রান্নাঘরে নিয়ে গেছেন। ইতি বোতলটা ধুয়ে সাফ করার সময় বলছিল,–কেমন মিষ্টি গন্ধ মা। মধুর মতো যেন।
ওর মা বলেছিলেন, তাহলে মধুটধুর বোতল!
বৈকণ্ঠবাবু বলেছিলেন,–তোমার মাথা খারাপ? এমন বোতলে আজকাল মধুর কারবার করে না কেউ। সে ছিল সায়েবদের যুগে। আজকাল বেঁটে চ্যাপ্টা শিশিতে মধু ভরে বেচে। ওটা ওষুধের বোতলই বটে। কই রে ইতি, নিয়ে আয় তত শুঁকে দেখি।
হ্যাঁ, শুঁকেছিলেন। একবার জলভরে ধোয়া হলেও গন্ধটা যায়নি। কিন্তু মজার কথা, গন্ধটা ওষুধের বলে মনে হয়নি বৈকুণ্ঠবাবুর। সত্যি বলতে কী, এমন মনমাতানো গন্ধ জীবনে কখনও শোকেননি।
আজ সকালবেলায় বাজার করতে গিয়ে ঘোঁতনবাবুর কাছে বোতল ওরফে কোকিলরহস্য শুনে তাই গোলমালে পড়ে গেছেন বৈকুণ্ঠবাবু।
সেই মাড়োয়ারি ভদ্রলোক তো খাঁচায় ভরা একটা কোকিল কিনেছিলেন ঘোঁতনের কাছে। কিন্তু যা শোনা গেল, কোকিলটার আবার হঠাৎ-হঠাৎ বোতল হয়ে যাওয়ার স্বভাব আছে। তাই কোকিলের বদলে খাঁচায় বোতল দেখে মাড়োয়ারি ভদ্রলোক নিশ্চয় ওটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে যান এবং সেইটেই ইতি কুড়িয়ে এনেছে।
বাড়ি ঢুকে প্রথমে কিচেনের দরজায় থলেটা ধপাস করে ফেললে বৈকুণ্ঠবাবু। তারপর হন্তদন্ত হয়ে বললেন,–বোতলটা কই? বোতলটা?
ইতির মা বললেন,–কোন বোতলটা?
–সেই যে গো, কাল ইতি যেটা কুড়িয়ে আনল।
বৈকুণ্ঠবাবুর কথা শুনে ইতির মা বাজার হয়ে বললেন,–তাই বলো। সে বোতল-বোতল করে পাঁচুর মাকে এইমাত্র তাড়ালুম না? ও ছাড়া আর কেউ নেয়নি। কাল সন্ধ্যাবেলা আঁচলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। ওই তো ওখানে জলজ্যান্ত রেখে দিলুম। আজ উনুন ধরাবার জন্য টিন থেকে কেরোসিন ঢালতে গিয়ে দেখি বোতলটা নিপাত্তা। তখনই বুঝলুম কার কীর্তি!
ইতি বললে, কাল সন্ধ্যাবেলা পাঁচুর মা যখন যাচ্ছে, ওর পেটে কী যেন লুকানো ছিল, বাবা!
তার মা ভেংচি কেটে বললেন, লুকানো ছিল বাবা, তা তখন বলতে কী হয়েছিল ধাড়ি মেয়ে?
বৈকুণ্ঠবাবু হাত তুলে বললেন, খুব হয়েছে, খুব হয়েছে। চেপে যাও!
চেপে যাব মানে? কী বলছ তুমি? –ইতির মা অবাক!
বৈকুণ্ঠবাবু চোখ নাচিয়ে একটু রহস্যময় হেসে বললেন,–পরে বলবখন। সে এক অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার। যাক, শত্রু পদে-পদে। আপদ বিদেয় হয়েছে।
ইতির মা হাঁ করে তাকিয়ে থাকার পর, ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বাজারের থলে নিয়ে পড়লেন। এক্ষুনি তো আপিসের ভাত বাড়তে হবে। বৈকুণ্ঠবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সংসারের শতেক জ্বালায় মাথার মধ্যিখানে এমনিতেই এক গুচ্ছের ঝিঁঝিপোকা সারাক্ষণ ডাকে। বাড়তি করে কোকিলের ডাক ঢুকিয়ে কাজ নেই।
তার চেয়ে একটা ভাবনার ব্যাপার ছিল। ঘোঁতনের জগদম্বা বোতল ভাণ্ডারে তো শুধু শিশি-বোতল ছাড়া আর কিছু ছিল না। বৈকুণ্ঠবাবুর ঘরে কোকিলের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে হাড়িকুঁড়ি বাসনপত্র খাট আলমারি কাপড়চোপড় যদি রকমারি জন্তুজানোয়ার হয়ে ডাক জুড়ে দেয়! শিশি যদি পাখপাখালি হয়ে ওঠে, আলমারির বাঘ হতে কতক্ষণ। হাঁড়িগুলো হয়তো ভালুক হয়ে যাবে। বাসনকোসন ঘটিবাটি ইয়াবড় কচ্ছপ আর শামুক হয়ে উঠবে। খাটটা হাতি হয়ে চারঠ্যাং সোজা করে দাঁড়াবে। আলনাটা জেব্রা হয়ে–বাপস!
এই সাংঘাতিক দুর্ভাবনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে আচমকা আঁতকে উঠলেন বৈকুণ্ঠবাবু। কোথায় যেন এইমাত্র শুনলেন কু-উ কু-উ কুউ…
যেন নয়, সত্যি। শোবার ঘরের মেঝেয় দাঁড়িয়ে স্নানের জন্যে কাপড় বদলাচ্ছেন, আর শুনছেন কুহু কুহু কুহু কুহু কু কু কু কু কুউ কু কু–
অমনি চেরা গলায় বৈকুণ্ঠবাবু উঠলেন,–বেরোও। বেরোও!
তারপর লাফালাফি হুলুস্থুল কাণ্ড ঘরের মধ্যে। ইতির মা, ইতি দৌড়ে এল।
ইতির মা বললেন, কী? অমন ষাঁড়ের মতো চাচাচ্ছ কেন? বেরোও বলছ কাকে? লাফালাফি করে তাড়াচ্ছই বা কী?
ইতি অনুমান করে বলল,-বেড়ালটাকে মা। তোমার বেড়ালটাকে।
কী? আমার বেড়াল তোমার শত্রুর? –ইতির মা রুখে দাঁড়ালেন।
বৈকুণ্ঠবাবু বললেন, আরে না, না। বেড়াল না।
–তবে কী? কুকুর?
–না। ওই শুনতে পাচ্ছ না?
বৈকুণ্ঠবাবু কান পেতে শান্তভাবে দাঁড়িয়েছেন এবার। ফের বললেন,–ওই শোনো কুউ কুউ করে ডাকছে না? কু কু কু কু কুহু কুহু কুহু কুহু কুউ-উ-উ।
ইতির মা হেসে ফেললেন।তাই বলল। কোকিল ডাকছে? তা অমন চাচাচ্ছ কেন?
ইতি বুদ্ধিমতীর মতো বলল,–ও বাবা, এটা যে বসন্তকাল। বইয়ে লেখা আছে বসন্তকালে কোকিল ডাকে, দেখবে, বইটা আনব?
বৈকণ্ঠবাবু উদ্বিগ্নমুখে বললেন, কিন্তু কোকিলটা ডাকছে কোথায় দেখো তো?
ইতির মা কান পেতে শুনে বললেন, কই, কোকিল ডাকছে না তো!
–তাহলে ওই যে কুউ কুউ কুহু কুঃ কুঃ–
মলো ছাই। রেললাইনে ইঞ্জিন হুইসিল দিচ্ছে। কানের মাথা খেয়েছ এ বয়সেই? বলে ইতির মা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলেন। সেখানে গিয়ে গজগজ করতে থাকলেন, কী শুনতে কী শুনছে দেখো তো! এরপর কবে কী দেখতে কী দেখে হুলুস্থুল বাধাবে। এরই মধ্যে বাহাতুরে ধরে গেল মানুষটাকে।
হ্যাঁ তাই বটে। জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন বৈকুণ্ঠবাবু। শেয়ালদা স্টেশনের শান্টিং ইয়ার্ডে একটা ইঞ্জিন হুইসিল দিচ্ছে। দেখে আশ্বস্ত হলেন। শুনেও তৃপ্তি পেলেন। বাথরুমে ঢুকে মনের আনন্দে ছেলেবেলার মতো বলে উঠলেন কু-ঝিক্ কু-ঝি, কু ঝিক ঝিক মি মি মিক্–।
একটু পরে স্নান করে খেতে বসে বললেন, তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে বলছিলুম। শোনো কী হয়েছে। সেই ঘোঁতন চক্কোত্তিকে মনে পড়ছে? সেই যে চিৎপুরে জগদম্বা বোতল ভাণ্ডার আমাদের ফটিকের জ্যাঠশ্বশুর।
ইতির মা পাতে গরম ডালের বাটি উপুড় করে দিয়ে বললেন,-হ্যাঁ বুঝেছি। ফটিক কাল দুপুরে এসেছিল। বলল, জ্যাঠশ্বশুরের মাথার দোষ হয়েছে। ব্যবসায় লোকসান খেয়ে মনে খুব আঘাত পেয়েছিলেন। এখন নাকি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে খালি পথে-পথে টোটো করে যোরেন। জোর করে ধরে আনতে হয়। শুনে খুব দুঃখ হল। অমন শান্ত আর ভদ্র স্বভাবের মানুষটা। হ্যাঁ গো, একবার গিয়ে দেখে এসো না! তোমার সঙ্গে তো খুব খাতির ছিল।
বৈকুণ্ঠবাবু এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। তাই বটে! সেইজন্যেই ঘেতনবাবুকে কেমন যেন দেখাচ্ছিল। পরম নিশ্চিন্ত হয়ে গরম ভাত গিলতে থাকলেন বৈকুণ্ঠবাবু। বাপস, ঘোঁতন তার মাথায় সেই বোতল ওরফে কোকিলটা প্রায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পাগল আর বলে কাকে। আসলে হচ্ছে কিনা-কুঝিক ঝিক-কু-ঝিক ঝিক্কু ঝিক ঝিক্ আর ভুল করে শুনেই ফেলতেন, কুহু কুহু কুউ কুউ। খুব বাঁচোয়া, বোতলের যদি বা কোকিল হয়ে যাওয়া সম্ভব, ইঞ্জিনের তা সম্ভব নয়।, বড়জোর ইঞ্জিনের পক্ষে হাতি হয়ে যাওয়া সম্ভব বটে। তবে একটু মুশকিল আছে। বৈকুণ্ঠবাবু আনমনে ভাতের গ্রাস মুখে দিয়ে ভাবছিলেন, কোকিল মাথায় ঢুকলে মোটামুটি একটা জায়গা পেয়ে যাবে। কিন্তু হাতি? ওরে বাবা, মাথায় হাতি ঢুকে পড়লে সে কঠিন ব্যাপার! অত জায়গা কোথায়?
বৈকুণ্ঠবাবু দুরুদুরু বুকে পাত থেকে উঠে পড়লেন। বললেন, ইতি, পুবের জানলাগুলো ভালো করে আটকে দে তো মা। খালি দিনরাত্তির কু ঝিক ঝিক আর কু ঝিক ঝিক্।