কৃতান্তবাবুর কাঁকুলে যাত্রা
বাস থেকে নেমে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল কৃতান্তবাবুর। ভুল জায়গায় নামিয়ে দেয়নি তো কন্ডাক্টর! পাকা রাস্তার দুধারেই ধু-ধু মাঠ। দিগন্তে ধোঁয়ার মতো যা দেখা যাচ্ছে, তা নিশ্চয় গ্রাম। কিন্তু এই প্রখর রোদূরে পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছতে শরীরের অর্ধেক রক্ত ঘাম হয়ে বেরিয়ে যাবে যে।
হ্যাঁ, ঘাম হয়ে। শরীরের রক্তই যে ঘাম হয়ে বেরোয়, তাতে কৃতান্তবাবুর এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। এই ধু ধু মাঠ, লোক নেই, জন নেই, গাছ নেই, পালা নেই, যাকে তেপান্তর বলা হয় রূপকথায়–সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক এমন কথাই মনে হবে মানুষের।
বৈকুণ্ঠবাবুকে না জানিয়ে এভাবে হুট করে এসে পড়াটা ভালো হয়নি। জানিয়ে এলে তিনি পাকারাস্তার মোড়ে গাড়ি-টাড়ি নিশ্চয় রাখতেন! বৈকুণ্ঠ পয়সাওলা মানুষ।
পরক্ষণে কৃতান্ত মোড়ের কাঁচারাস্তাটা দেখে ভাবলেন–হ্যাঁ, গাড়ি ঠিকই রাখত বৈকুণ্ঠ। তবে নির্ঘাৎ সেটা গরু বা মোষের গাড়ি। অবশ্য ওর জিপ থাকাও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু যে কিপটে মানুষ, রিটায়ার করার পর দেশের বাড়ি গিয়ে জিপ কিনবে? তাহলেই হয়েছে।
কমাস আগে কলকাতায় দেখা হয়েছিল দুই বন্ধুর। দুজনেরই বয়স হয়েছে। চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। কৃতান্ত থাকেন বড়ছেলের কাছে। বৈকণ্ঠ গ্রামে পৈতৃক ভিটেয় গিয়ে উঠেছেন। কিছু জমিজমাও আছে। ছেলেপুলে নেই, আছে এক ভাগ্নে। সেই এতদিন সব দেখাশোনা করছিল। এখন মামা-ভাগ্নে মিলে নাকি উন্নত প্ৰথায় চাষবাস করছেন। কথায় কথায় বৈকুণ্ঠ বলেছিলেন, মন খারাপ করলে সোজা চলে যেও ভাই কেতো। কীভাবে যেতে হবে, বলে দিচ্ছি।
পথ ঠিকই বাতলে দিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠ। ওই তো কাঁচারাস্তা মাঠের বুকে সোজা চলে গেছে। ওই রাস্তায় তিন মাইল গেলেই বৈকুণ্ঠের গ্রাম কাকুলিয়া। কিন্তু বৈকুণ্ঠ সবই বলেছিলেন,–শুধু বলেননি মাঠটা অবিকল রূপকথার সেই তেপান্তর–আর এই এলাকার আকাশে সূর্যদেবও বেজায় রাগী। বাপ! সবে তো দশটা বেজেছে, এরই মধ্যে মেজাজ কী তিরিক্ষি। কটমট করে তাকাচ্ছেন কৃতান্তের দিকে রোস্ট করে খেয়ে ফেলবেন একেবারে।
তাও তো রূপকথার তেপান্তরে একটা গাছ ছিল শুনেছেন ছেলেবেলায়– যে গাছের ডালে বাস করত ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী।
কিন্তু এ যেন মরুভূমি। ঢেউ খেলানো ধুধু মাঠ, রুক্ষ নীরস হয়ে পড়ে আছে। হুঁ! সব গুল বৈকুণ্ঠের। চাষবাস না হাতি। এই পাথুরে মাটিতে এক চিলতে ঘাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেনি, শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে আর কিনা ওঁরা মামা-ভাগ্নে নাকি ফসল ফলিয়ে মা-লক্ষ্মীর বরপুত্র হয়ে গেছেন? ধুর, ধুর! বয়স হলেও বৈকুণ্ঠ এমন মিথ্যুক, ভাবা যায় না।
কৃতান্তবাবুর রাগ হচ্ছিল। কিন্তু এসে যখন পড়েছেন, এবং বুড়োমানুষ হলেও এখনও শরীরে যুবকের মতো শক্তি আছে বইকী, তখন বৈকুণ্ঠের মুখোমুখি হয়ে ঝাল ঝেড়ে ছাড়বেন না।
অতএব কৃতান্ত মাথায় রুমাল জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। রুমাল না জড়ালে সূর্যদেবের দাঁতের কামড় খেয়ে প্রকাণ্ড টাকের অবস্থাটা ভারি কাহিল হয়ে যাবে। কাঁধে একটা ব্যাগ ছাড়া আর কোনও বোঝা নেই। সেই রক্ষে।
সত্যি বলতে কী, এই যে এমন করে বৈকুণ্ঠবাবুর বাড়ি যাচ্ছেন, তার কারণ গত রাত থেকে তার মন খারাপ। বৈকুণ্ঠ বলেছিলেন, মন খারাপ হলেই চলে যেও। আনন্দ পাবে।
মন খারাপের কারণ আর কিছুই না, চা। নেপাল নামে যে ছোকরাটিকে উমা সম্প্রতি বাসায় বহাল করেছে, সে চোরের ওস্তাদ। তিরিশ টাকা কিলোর চা কিনতে গিয়ে পনেরো টাকা কিলোর চা এনে দেবে এবং তিরিশ টাকা দরেই হিসেব দেখাবে। আর সেই চা কুকুরও ছোঁয় না। কৃতান্তবাবুর বরাবর এই এক অভ্যাস। ভালো এবং দামি চা খাওয়া তার শখ ছিল। এখন নিজে চা কিনতে যান না। তার মানে, ছেলে কিংবা বউমা তাঁকে চা কিনতে যেতে দেবে না। ওদের সম্মান যাবে নাকি!
আসলে নেপাল ওদের মাথাটি খেয়েছে। গত রাতে পার্ক থেকে বেড়িয়ে এসে অভ্যাস মতো চা চাইলেন। চা ঠিকই এল কিন্তু সে কি চা, না শুকনো কচুরিপানা সেদ্ধ জল?
নেপালকে বকাবকি করতে গেলে উল্টে বউমা তার হয়ে সাফাই গেয়ে বলল কিনা,–আজকাল চায়ে বেজায় ভেজাল দিচ্ছে যে। নেপু কী করবে?
নেপাল হল নেপু! ন্যাপলা নয়, আদর করে নে-পু! কোনও মানে হয়?
বেশ, নেপু নিয়ে তোমরা ভেঁপু বাজাও। আমি চললুম যে-দিকে দুচোখ যায়।
কৃতান্তবাবু অবশ্য টেবিলে একটা চিরকুট সবার চোখে পড়ার মতো জায়গায় রেখে এসেছেন। তাতে লিখে রেখেছেন : আমাকে খুঁজিও না। পাইবে না।
বাস থেকে কাকুলিয়া রাস্তার এই মোড়ে নেমে একটু পস্তানি অবশ্য হয়েছিল। এতটা করা কি ঠিক হয়েছে? বড়ছেলে প্রতুল কি চুপ করে থাকবে? হাজার হলেও বাবা। বাবা নিরুদ্দেশ হলে ছেলেদের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা অসম্ভব। থানা-পুলিশ করবে। কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। খামোকা হয়রান হবে।
কিন্তু যা করার করে ফেলেছেন, আর পস্তিয়ে লাভ নেই। তবে যদি প্রতুল তার খোঁজ পেয়ে যায় এবং মুখোমুখি এসে পড়ে কৃতান্ত বলবেন,-হা, ফিরে যাব একটা শর্তে। ওই ন্যাপলাকে তাড়াতে হবে।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে কৃতান্তবাবু চলেছেন।
একটা সুবিধে, কঁকা মাঠ বলে হুহু করে বাতাস বইছে। তাই রোদ্দুরটা খুব একটা কষ্ট দিচ্ছে না।
কিন্তু রাস্তা যেমন এবড়ো-খেবড়ো, তেমনি ধুলোয় ভরা। হাঁটু অবধি ধুলোয় সাদা হয়ে যাচ্ছে। একদমে এতখানি হাঁটা অভ্যেস নেই বলে ক্লান্তিও আসছে।
বৈকুণ্ঠের দেশের লোকেরা এমন গবেট যে রাস্তার ধারে একটা গাছও লাগায়নি। একেই বলে পাণ্ডববর্জিত দেশ। আর সরকারি সড়কদফতরই বা কী করছে? প্রতি বছর ওই যে বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়, কত ধুমধাম শুনতে পাওয়া যায়, সে সব কঁকুলিয়া এলাকায় হয় না? আসলে তদ্বিরের লোক নেই এখানে। সরকার তো অন্তর্যামী ভগবান নন। গিয়ে সব জানাতে হবে তবে না! ছ্যা, ছ্যা, বৈকুণ্ঠের দেশের লোকেরা এখনও সেই মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে।
কৃতান্ত তেতো মুখে এসব কথা ভাবছেন, এমন সময় আচমকা পেছনে আবছা শব্দ শুনতে পেলেন টংলং টংলংটংলং।
ঘোড়ার গাড়িটা দেখামাত্র রাস্তার ধারে সরে গেলেন কৃতান্ত। মনে ক্ষীণ আশা হল, গাড়িটা থামিয়ে বলবেন নাকি, একটা লিস্ট দিতে?
ঘোড়ার গাড়িটা যত কাছে আসছে, কৃতান্তবাবু কিন্তু তত অবাক। একালে এমন অজ পাড়াগাঁয়ে ঘোড়ার গাড়ি কেন, পালকি থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু এই গাড়িটা একেবারে রাজকীয়। সোনার মতো ঝকঝক করছে। কী অপূর্ব নকশা! ঘোড়াদুটোও প্রকাণ্ড এবং সাদা রঙের। তাদের সাজও দেখবার মতো। কোচোয়ানের দিকে তাকিয়ে কৃতান্ত আরও অবাক হলেন। জরি আর মখমলের পোশাক, মাথায় বিচিত্র উষ্ণীষ!
কৃতান্ত এত অবাক হয়েছিলেন যে গাড়িটাকে হাত তুলে থামাবার কথাই ভুলে গেছেন।
কিন্তু গাড়িটা আচমকা তার কাছে এসেই থেমে গেল। সাদা ঘোড়াদুটো সামনের দুই পা শূন্যে তুলে বিকট চিহিঁ করে উঠল।
যাকে কোচোয়ান ভেবেছিলেন, সে যে কোচোয়ান নয় বুঝতে দেরি হল না কৃতান্তের। কী সুন্দর বীরোচিত চেহারা! কী উজ্জ্বল গৌর গায়ের রং! আবার কোমরে খাপেভরা তরোয়ালও ঝুলছে।
কৃতান্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
এই মহাকাশযুগেও বৈকুণ্ঠবাবুর দেশের বড়লোকেরা এমন ঝলমলে সেকেলে পোশাক পরে কোমরে তরোয়াল ঝুলিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে বেড়ায়, ভাবলে অবাক লাগে না?
বোঝা যাচ্ছে, যে কারণেই হোক, কাঁকুলিয়া এলাকা এখনও সেই ঐতিহাসিক রাজরাজড়ার যুগেই পড়ে আছে। একে ঘোড়ার গাড়ি বলা উচিত নয়। এ তো অশ্বচালিত রথ!
কৃতান্তের শেষ অবধি ভালোই লাগল ব্যাপারটা। কথায় কথায় লোকে আপশোস করে বলে না–হ্যায় রে সেকাল? কৃতান্তবাবু কতবার বলেন কথাটা। অতএব, বৈকুণ্ঠবাবুর দেশে সত্যি সত্যি জলজ্যান্ত সেকাল যদি টিকেই থাকে, সে তো খাসা! আহা, সেকালে মানুষের নাকি কত আনন্দ, সুখসুবিধে ছিল! পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধান, গামলা-গামলা দুধ! এই সে পরান গয়লার নর্দমার জল মেশানো দুধ নয়, হরিণঘাটায় বোতলের সর তুলে সাদা তরল পদার্থও নয়–খাঁটি দুধ।
আর ঘি? নির্ভেজাল প্রকৃত ঘৃত। কৃতান্তের নোলায় জল এসে গেল। হায় রে! কতকাল প্রকৃত ঘৃতপ লুচি আর খেতে পাওয়া যায় না। কৃতান্ত দীর্ঘশ্বাস না ফেলেও পারলেন না।
এবং মনে-মনে আনন্দে নেচেও উঠলেন। বৈকুণ্ঠের বাড়িতে প্রকৃত ঘৃতপক লুচির কথা ভেবেই।
এদিকে অশ্বচালিত রথে বসে রাজপুরুষটিও তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি।
কৃতান্ত সৌজন্য দেখিয়ে করজোড়ে নমস্কার করলেন।
তখন রাজপুরুষ নমস্কার করে সংস্কৃত ভাষায় তাঁকে বললেন,–আর্য! ত্ব অভিনন্দতে কঃ ত্বাম্? কুত্র গচ্ছসি?
এই সেরেছে। কৃতান্তবাবু মুশকিলে পড়ে গেলেন। সেই পঞ্চাশ বছর আগে ম্যাট্রিকে সংস্কৃত পড়েছেন। তার কি মনে আছে কিছু? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণ কৌমুদীখানা হাতের কাছে থাকলে বরং চেষ্টা করা যেত।
রাজপুরুষটি মনে হচ্ছে খুবই ভদ্র। মুখের হাসিটি দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু শাস্ত্রে আছে না? শৃঙ্গী প্রাণী আর অস্ত্রধারী মনুষ্য থেকে শতহস্ত দূরে থাকা উচিত। বলা যায় না, কখন কীসে মেজাজ চড়ে যায়।
কৃতান্তবাবু ঘাবড়ে গিয়ে–না, সংস্কৃত নয়–একেবারে ইংরেজিতে বলে ফেললেন, স্যার, আই অ্যাম কামিং ফ্রম ক্যালকাটা অ্যান্ড গোয়িং টু বৈকুণ্ঠবাবু হাউস। বাট স্যার, ভেরি হট ডে। ভেরি টায়ার্ড স্যার। ওল্ড ম্যান স্যার–
রাজপুরুষ হোহো করে হেসে ফেললেন। এবার বিশুদ্ধ বাংলায় তার মানে সাধুভাষায় বলে উঠলেন, বুঝিয়াছি মহাশয়! বুঝিতে পারিয়াছি। থাউক। ইংরাজি ভাষায় কথোপকথনের আবশ্যকতা নাই। আপনি স্বচ্ছন্দে বাংলা ভাষায় কথা কহিতে পারেন। তবে তার আগে আপনি আমার রথে আরোহন করুন। পশ্চাৎ যাহা কহিবার কহিবেন।
কৃতান্তবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এবং সাবধানে ময়ূরপঙ্খী রথের পেছনদিকের পাদানি দিয়ে অনেক কষ্টে চড়ে বসলেন। রাজপুরুষ তাঁর হাত ধরে পাশে বসিয়ে মৃদু হেসে ফের বললেন,–মনে হইতেছে আপনি ক্ষুধার্ত এবং যৎপরোনাস্তি ক্লান্ত। চিন্তা করিবেন না। আমার প্রাসাদে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া যথা ইচ্ছা গমন করিবেন।
কৃতান্ত খুশি হয়ে বললেন, আপনার প্রাসাদে আতিথ্যের আমন্ত্রণ আমি কি প্রত্যাখ্যান করতে পারি কি? হে ভদ্র! সেখান হইতে কাংকুলিয়া পল্লী কতদূর বলিতে পারেন কি?
কাঁকুলিয়া সাধুভাষায় কাংকুলিয়া হওয়াই উচিত বলে মনে করলেন কৃতান্ত। রাজপুরুষ তার কথা শুনে বললেন, কাংকুলিয়া? ওহো! বুঝিয়াছিকাংকালিয়ার কথা বলিতেছেন।
কৃতান্ত বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। কাংকালিয়াই বটে।
–কাংকালিয়া আমার পিতার রাজধানী। আপনি কাহার নিকট যাইবেন?
–আজ্ঞে বৈকুণ্ঠ। তিনি আমার সুহৃদ বটেন।
–বৈকুণ্ঠ। আহা বুঝিয়াছি। শ্ৰেষ্ঠীপ্রবর বৈকুণ্ঠের নাম এরাজ্যে কে না জানে– বলে রথের অশ্বকে কশাঘাত করলেন রাজপুরুষ।
রথ চলতে থাকল। ক্রমশ গতি বাড়ছিল। কিন্তু এতটুকু কঁকুনি নেই। অদ্ভুত রথ বানাতে পারে এরা ইতিহাসের দেশের লোকেরা। কৃতান্ত মনে-মনে তারিফ করছিলেন। কিন্তু বৈকুণ্ঠকে শ্রেষ্ঠীপ্রবর বলছেন কেন যুবরাজ? শ্ৰেষ্ঠী মানে তো বণিক বা ব্যবসায়ী। বৈকুণ্ঠ কি তাহলে এখন চুটিয়ে ব্যবসা করতে নেমেছে?
দেখতে-দেখতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দিগন্তের সেই ধোঁয়াটে ব্যাপারটাতে অর্থাৎ গ্রামে এসে পড়ল। কিন্তু গ্রাম বলা কি ঠিক হচ্ছে? গাছপালার ফাঁকে সাদা-হলদে নীল, রংবেরঙের পাকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। এ যে রীতিমতো শহর!
কিন্তু না–ইলেকট্রিক লাইন নেই। আকাশ পরিষ্কার। ঘরবাড়িগুলোর গড়নও ছবিতে যেমনটি দেখা যায় তেমনি। আর ওই বুঝি রাজপ্রাসাদ! বিশাল তোরণ। সশস্ত্র প্রহরী। ওরে বাবা! কী পেন্নায় দানোর মতো ওদের চেহারা! মস্ত বল্লম কাঁধে। কোমরে চ্যাপ্টা খাঁড়ার মতো অদ্ভুত তরোয়াল ঝুলছে। মাথায় লোহার টুপি। ওদিকে উঁচুতে ফটকের মাথায় একদল প্রহরীর হাতে তীরধনুকও রয়েছে। ভুল করে শত্রু ভেবে তির ছুড়লেই হয়েছে! কৃতান্ত ভয়ে চোখ বুজলেন।
ফের যখন চোখ খুললেন, দেখলেন বিশাল এক প্রাঙ্গণে রথ ঢুকছে। প্রাঙ্গণে কত ফুলের গাছ, মর্মরমূর্তি, ফোয়ারা।
চওড়া মস্ত সিঁড়ি উঁচু, সোপান বলাই উচিত, তার ধারে রথ থামলে একদল পরিচারক আর সশস্ত্র প্রহরী এসে অভিবাদন জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
যুবরাজ কৃতান্তের একটা হাত ধরে বললেন, আর্য! গাত্রোত্থান করুন।
কৃতান্ত সাবধানে নামলেন।
সিঁড়ির ওপরদিকে চওড়া বারান্দার মতো জায়গায় বীণা বাজিয়ে কারা গান জুড়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। গানের ভাষা সংস্কৃত। মলোচ্ছাই! এত সংস্কৃতের মধ্যে বাংলা নিয়ে বিপদে পড়তে হবে যে! হিন্দি হলে ততটা অসুবিধে ছিল না। আজকালকার হিন্দি তো হ্যায়-ট্যায় এসব ক্রিয়াপদ বাদ দিলে খাঁটি সংস্কৃত। এদিকে বাংলার ক্রিয়াপদ বাদ দিলে তো স্রেফ ইংরিজি। এই যেমন আমি হাংগ্রি ফিল করছি!
কৃতান্ত সিঁড়িতে পা বাড়ালে বীণাবাদক আর বীণাবাদিকা মিলে জনা পনেরো পুরুষ ও স্ত্রীলোক দুধারে দাঁড়িয়ে গান করতে লাগল।
কৃতান্ত যুবরাজের পাশাপাশি সপ্রতিভ ভঙ্গিতে অর্থাৎ কিনা স্মার্ট হয়ে, রাষ্ট্রনেতারা যেভাবে গার্ড অফ অনার ভিজিট করেন, সেইভাবে উঠে গেলেন।
সামনে কারুকার্যময় সুদৃশ্য দরজার পরদা দুদিকে টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন পরিচারিকা। আর ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন পরিচারক তার হাতে বিশাল রুপোর রেকাব, তার ওপর সোনার গেলাসে সম্ভবত সুশীতল শরবত-টরবত হবে। দেখামাত্র তৃষ্ণা বেড়ে গেল কৃতান্তবাবুর।
কিন্তু তারপরই থমকে দাঁড়ালেন।
সুশীতল পানীয় নিয়ে যে পরিচারক দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ নয়– স্বয়ং নেপাল। সেই ন্যাপলা। বউমার আদরের নেপু। নেপু না বলে নেপো বলাই ভালো। যে নেপো দই মারে। কিন্তু অসম্ভব? একই চেহারার লোক তো থাকে। কৃতান্তবাবু হাত বাড়ালেন। প্রচণ্ড তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল।
কিন্তু শরবতের গেলাস নিতে গিয়ে দেখলেন, হা–এ ব্যাটা সেই ন্যাপলাই বটে, ফিক করে হাসল। তারপর ফিসফিস করে বলে উঠল, কর্তাবাবু, ভালো আছেন।
অমনি ঝনঝন করে হাতের গেলাস মেঝেয় পড়ে গেল। যুবরাজ অবাক! পরিচারক, পরিচারিকারা অবাক। কৃতান্ত গর্জন করে বললেন, ন্যাপলা! তুই এখানে!
–আজ্ঞে হ্যাঁ কাবাবু।
কৃতান্ত রেগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,–গেট আউট। গেট আউট।
কাল রাত্তিরে চায়ের নামে শুকনো কচুরিপানার শেকড়সেদ্ধ জল ফুটিয়ে খাইয়েছিল। এখন এই কাংকালিকা রাজপ্রাসাদে শরবতের নামে নির্ঘাত নর্দমার জল এনেছে। স্বভাব যাবে কোথায়? আসল শরবতটুকু খেয়ে ফেলেছে ব্যাটা। এ ভেজাল মাল।
কৃতান্তের তাড়া খেয়ে যথারীতি নেপাল গ্রাহ্যই করল না। সে মুচকি হাসতে থাকল। যুবরাজ বললেন,–কী হল আর্য? খুলিয়া বলিবেন কি?
কৃতান্ত হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন,–এই দুবৃত্ত, দুর্জন ছোকরাকে এখনই বিদায় করুন যুবরাজ। এ ব্যাটা ভেজালরাজের গুপ্তচর।
অমনি যুবরাজ ফুঁসে উঠলেন, কী! ভেজালরাজের গুপ্তচর? আমার প্রাসাদে? সর্বনাশ! ভেজালরাজ ঝুনঝুনওয়ালা গুলঞ্চ প্রসাদ যে আমাদের শত্রু। এই কে আছে! ইহাকে বন্দি করো।
দুজন কালান্তক চেহারার প্রহরী এসে নেপালকে ধরে ফেলল। নেপাল তাও মুচকি মুচকি হাসে যে। কৃতান্ত চেঁচিয়ে উঠলেন,–আবার হাসি হইতেছে? যুবরাজ! দেখিতে পাইতেছেন কি দুবৃর্ত্ত এখনও অম্লানবদনে হাসিতেছে?
যুবরাজ আরও রেগে হুকুম দিলেন, উহাকে এইখানেই বধ করো। এই মুহূর্তে দুবৃত্তের মস্তক ছেদন করো।
ওরে বাবা! সে বড় রক্তারক্তি কাণ্ড! এখানেই মুন্ডু কাটবে? কৃতান্ত ঘাবড়ে গেলেন। চোখ বুজে ফেললেন। নেপালটা কী গাড়োল! কেন এখনও ক্ষমা চাইছে।? দেখো দিকি, কী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এতখানি হবে, ভাবতে পারেননি কৃতান্ত।
হঠাৎ তাঁর কানে এলা বউমারই গলা, তাতে কোনও ভুল নেই। কী হইল? কী হইয়াছে? আমার নেপু কী অপরাধ করিয়াছে শুনি?
চোখ খুলেই কৃতান্ত দেখতে পেলেন। বড়বউমাই বটে। কিন্তু এ কী বেশ! এ যে একেবারে রাজ্ঞীর পোশাক পরনে! মাথায় সোনার মুকুট পর্যন্ত। এসে যুবরাজের সামনে হাত-মুখ নেড়ে ফের বলে উঠল, নেপু আমার পিতার দেশের ভৃত্য। উহার মস্তক ছেদন করিলে আমি পিত্রালয়ে যাত্রা করিব, বলিয়া দিতেছি –হ্যা!
যুবরাজ বললেন, কিন্তু ও যে ভেজালরাজের গুপ্তচর।
বউমা বলিল,-হাতি! ঘোড়া! তোমার শ্রেষ্ঠীরাই ভেজালরাজের গুপ্তচর!
যুবরাজ্ঞীবেশিনী বউমা আবার বলল, এই তো আমি পাকশালা হইতে আসিতেছি। শ্ৰেষ্ঠীর বিপণী হইতে যে ঘৃত পাঠানো হইয়াছে, উহা ঘৃত নহে, অন্য কোনও বস্তু।
বন্দি নেপাল বলল, ডালডাও নহে। জলহস্তীর চর্বি।
যুবরাজ গর্জন করে বললেন, কে আছো? শ্ৰেষ্ঠীকে বন্দি করিয়া লইয়া আইস।
এবার যুবরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃতান্তবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন।
–প্রতুল! তুই।
–হ্যাঁ পিতা।
–ওরে হতভাগা। এতক্ষণ কহিস নাই কেন? আমি যে তোকে চিনিতে পারি নাই!
বড়ছেলে আর বড়বউমা ঢিপ করে একসঙ্গে কৃতান্তের পায়ে প্রণাম করতেই সব রাগ জল হয়ে গেল কৃতান্তের। আশীর্বাদ করে বললেন–সুখমস্তু! চিরজীবি হও!
তারপর নেপালও প্রহরীদের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে তাঁর পায়ে একটি প্রণাম ঠুকে বলল,–অপরাধ লইবেন না কর্তামশায়! আসুন, আপনাকে উৎকৃষ্ট চা পান করাইতেছি।
এই সময় বাইরে ভেরি, তুরি, কাড়াকাড়া বেজে উঠল। একজন দৌবারিক ঘরে ঢুকে প্রণাম করে বলল, মহারাজ! আপনি ফিরিয়া আসিয়াছেন শুনিয়া কাংকালিকার প্রজাবৃন্দ আপনার দর্শনপ্রার্থী।
কৃতান্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ছ্যা-হ্যাঁ, এই ধুলোময়লা নোংরা পাঞ্জাবি-ধুতি পরে কি প্রজাদের দর্শন দেওয়া যায়? কাঁধের ঝোলাটা ফেলে দিয়ে বললেন,–কে আছো? আমাকে উৎকৃষ্ট রাজবেশ পরাইয়া দাও।
সঙ্গে সঙ্গে প্রকাণ্ড রেকাবে রাজবেশ নিয়ে পরিচারকবৃন্দ এসে দাঁড়াল। নেপাল একগাল হেসে বলল, আমি মহারাজের মস্তকে মুকুট পরাইব।
ইচ্ছে হয়েছে তো পরাক না। নেপাল ছেলেটা তো এমনিতে খারাপ নয়। বড় মধুর মিষ্টি স্বভাব। আসলে ভেজালরাজের চেলারা জিনিসিপত্রে ভেজাল দিলে ও বেচারা করবে কী?
বাইরে তুমুল বাদ্য বাজছে। প্রজারা জয়ধ্বনি দিচ্ছে। নেপাল কৃতান্তের মাথায় মুকুট পরিয়ে বলল,-এবার সুশীতল জল আনয়ন করি মহারাজ। আপনি তৃষ্ণার্ত।
দেরি হল না। নেপালচন্দ্র জলভরা সোনার গেলাস রূপোর রেকাবে রেখে সামনে তুলে ধরল। কৃতান্ত তৃষ্ণার্ত। হাত বাড়ালেন। হাতটা হঠাৎ বড় ভারী লাগছে। হা, লাগবেই তো। সোনা হীরে মানিক বসানো রাজপপাশাক। ওজন আছে।
বাইরে প্রজার মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি দিচ্ছে–জয় মহারাজ কৃতান্তদেব। তুরি, ভেরি কাড়ানাকাড়া বাজছে। তারপর কী একটা ঘটল। ঠিক বুঝতে পারলেন না কৃতান্ত। কিন্তু গুরুতর কিছু নিশ্চয় ঘটল।
কারণ কৃতান্তবাবুর মনে হল আচমকা বুঝি আছাড় খেয়েছেন। খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
কোথায় কী! কোথায় কাংকালিকা রাজপ্রাসাদ। কোথায় রাজপোশাক, ন্যাপলা, প্রতুল, বউমা, পরিচারক-পরিচারিকা, বীণা বাদক-বাদিকা, গায়ক-গায়িকা! কোথায় বা পেন্নায় চেহারা কালান্তক প্রহরীরা!
তবে ধুধু রোদ্দুরে নয়, ছায়াতেই শুয়ে আছেন। গাছটা বটগাছ। ডালে অজস্র পাখি লাল টুকটুকে বটফল ঠোকরাচ্ছে।
আর হ্যাঁ, আকাশের নিচু দিয়েই একটা এরোপ্লেন যাচ্ছে। তুরি ভেরি কাড়ানাকাড়া নয়। নিছক এরোপ্লেন।
আর কৃতান্তের পরনে ধূলিধূসর সেই পাঞ্জাবি-ধুতি, পায়ের পাম-শুজোড়া ব্যাগের তলায় রাখা আছে। ব্যাগটা দিব্যি বালিশ করে বটতলার শুকনো ঘাসে শুয়ে আছেন।
.
তাহলে নিছক স্বপ্নই দেখছিলেন।
দুঃখে ও রাগে মন খারাপ হয়ে গেল সঙ্গেসঙ্গে। কোনও মানে হয়? কৃতান্ত উঠে বসে হাই তুললেন। পাকারাস্তাটা দূরে দেখা যাচ্ছে। হু-হুঁ রোদ্দুরে কাঁচের মতো ঝকঝক করছে।
তাহলে কাঁচারাস্তায় আনমনে হাঁটতে-হাঁটতে কখন এই বটতলায় পৌঁছে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু তেষ্টায় গলা কাঠ। এখনই জল খাওয়া দরকার। কৃতান্ত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখলেন, বটগাছেরই ডালে কে যেন বসে আছেন। আঁতকে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে! কালো কুচকুচে একটা লোক এখানে বসে কী করছে?
ভূতপ্রেত নয় তো? কিছু বলা যায় না। বৈকুণ্ঠের এই দেশে সব সম্ভব। কাঁপা কাঁপা গলায় কৃতান্ত বললেন,–কে? কে ওখানে?
ভূত অথবা লোকটা ঘুরে বসল। কালো মুখে সাদা দাঁত ঝকমক করছে। হাসছে, না ভয় দেখাচ্ছে?
কৃতান্ত ভয় পেয়েছেন বলেই ধমক দিতে পারলেন, দাঁত বের করছ কেন বাবা? আঁ? হনুমানের মতো ডালেই বা বসে আছো কেন শুনি?
না, ভূত নয়। নাকিস্বরে কথা বলল না। লোকটা বলল, আজ্ঞে, পাকা বটফল পাড়ছি।
–বটফল? খায় বুঝি?
–আজ্ঞে, পাখপাখালিতে খায়; আমি একটা পাখি পুষেছি কিনা। তার জন্যে বটফল পাড়ছি।
–তা কেশ করছ। এখানে জল আছে কোথায় বলতে পারো?
জল? এই যে এখানে একটা দিঘি আছে।লোকটা কথা বলতে-বলতে নেমে এল গাছ থেকে। এসে করজোড়ে প্রণামও করল–
–আপনি শুয়ে ঘুমোচ্ছিলেন দেখলুম। তা কোত্থেকে আসছেন বাবুমশাই? কোথায় যাবেন?
–কলকাতা থেকে। যাব কাকুলিয়া।
–কাকুলে? সে তো এখনও দু-মাইলটাক পথ বাবুমশাই।
–বলো কী হে। তা এ জায়গাটার নাম কী?
–বাজে-কাঁকুলে আজ্ঞে।
–বাজে কাকুলে! সে আবার কী হে?
–আজ্ঞে বাবুমশাই, শুনেছি কোন আমলে নাকি এখানেই আসল গেরামটা ছিল। এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। লোকে বলে বাজে কাঁকুলে।
কৃতান্ত উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমার বাড়ি কোথায়।
লোকটা জবাব দিল, আমার বাড়ি আজ্ঞে কঁকুলের পাশে আঁদুলে।
কী অদ্ভুত নাম সব। কঁকুলে-আঁদুলে। পুঁদুলে নামেও হয়তো গ্রাম আছে, বলা যায় না। কৃতান্ত মনে-মনে হেসে বললেন,–ওহে! আমাকে দিঘিটা দেখিয়ে দিয়ে এসো তো!
অমনি লোকটা হাতজোড় করে বলল, ক্ষমা করবেন বাবুমশাই! আমি যেতে পারব না। ওই তো দেখা যাচ্ছে উঁচু পাড়আপনি চলে যান। খুব ভালো জল আছে। টলটলে কালো জল। ঘাটও পাবেন।
কৃতান্ত একটু অবাক হয়ে বললেন,–কেন যেতে পারবে না?
লোকটা জবাব না দিয়ে আবার বটগাছে গিয়ে উঠল। অদ্ভুত লোক তো! বৈকুণ্ঠের দেশের লোক কিনা। এমনিই তো হবে। মনেমনে গজগজ করতে করতে কৃতান্তবাবু দিঘির পাড় লক্ষ করে এগিয়ে চললেন।
ক্ষয়াখবুটে ঝোঁপঝাড় গাছপালার জঙ্গল পেরিয়ে পাড়ে উঠে দেখলেন, প্রচুর ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি আর তার আগাছা গজিয়ে রয়েছে। ঘাটটাও পাথরে বাঁধানো। ধাপগুলো ভাঙাচোরা। শ্যাওলা জমে আছে। বিশাল দিঘিটা দামে ভর্তি। তাহলে কি এখানে ঐতিহাসিক যুগে এক সময় সত্যি-সত্যি রাজপ্রাসাদ ছিল?
সে পরে হবে। আপাতত জলতেষ্টা মেটানো যাক। সত্যি, জলটা যাকে বলে কাজলবৰ্ণ। স্বচ্ছ। আঁজলায় জল তুলে প্রাণভরে পান করলেন কৃতান্ত। সূর্য এখন একটু ঢলেছে। হাত-ঘড়িতে বেলা দেড়টা বাজে।
জল খেয়ে মুখ কাঁধ-হাত-পা রগড়ে ধুলেন কৃতান্ত। আঃ কী আরাম। বরং আরও কিছুক্ষণ ওই বটতলায় বিশ্রাম করে রোদের তেজ কমলে বৈকুণ্ঠের গ্রামের দিকে রওনা হবেন।
আরামে নিশ্বাস ফেলে কৃতান্ত ঘুরে সিঁড়ির ধারে পা ফেলেছেন, সেই সময় ধুপধাপ শব্দ হল সিঁড়ির ওপর দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন কৃতান্ত।
রাত হলে কিছু বলার ছিল না। এ যে একেবারে দিনদুপুর! উজ্জ্বল রোদ্দুর।
তাছাড়া তখন না হয় ঘুমোচ্ছিলেন বটতলায়, তাই স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু এখন? এখন তো স্বপ্ন নয়। তাহলে?
ঘাটের মাথায় সার-সার দাঁড়িয়ে আছে তিন-তিনটে কঙ্কাল।
হ্যাঁ, পুরোদস্তুর কঙ্কাল।
তারপর তারা চেরা-গলায় অমানুষিক চেঁচিয়ে উঠল,–পেয়েছি! পেঁয়েছি! পেয়েছি!
তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কৃতান্তের ওপর।
কৃতান্ত টের পেলেন তাকে অসম্ভব ঠান্ডা হাড়ের হাতে চ্যাংদোলা করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনবরত খটখটখটাখট শব্দও শোনা যাচ্ছে।
না–অজ্ঞান হলেন না। অজ্ঞান হওয়ার অভ্যাস নেই কৃতান্তের। ভয় পেলে মানুষের অজ্ঞান হওয়া স্বাভাবিক। কৃতান্ত ভয় পেয়েছেন বললে ভুল বলা হবে। কারণ, এ ব্যাপারটাও চরম মুহূর্তে স্বপ্ন বলে মেনে নিয়েছেন। এবং স্বপ্নে মুভুই কাটা যাক, আর ভূতেই ঘাড় মটকাক, ক্ষতি কী?
বরং এই গরমে ঠান্ডা হাড়ের ছোঁয়ায় আরামই লাগল। কৃতান্ত চোখ বুজে থাকলেন। দেখা যাক্ না স্বপ্নটা শেষ অবধি কোথায় দাঁড়ায়।…
কিন্তু একি সত্যি-সত্যি স্বপ্ন?
কঙ্কালগুলো কৃতান্তবাবুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে একটা ভাঙা ঘরে ঢুকল। তারপর দুম করে ফেলে দিতেই আছাড় খেলেন কৃতান্ত এবং ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন। অতএব এটা স্বপ্ন নয়।
আছাড় খেলেই তো স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কথা। এতকাল কত ভীষণ সব স্বপ্ন দেখেছেন এবং আছাড়ও খেয়েছেন। তারপর দেখেছেন খাটের নিচে পড়ে গেছেন। ঘুমও ভেঙেছে।
এটা স্বপ্ন নয়। আসলে বৈকুণ্ঠবাবুর কাকুলিয়া গ্রামের ব্যাপারটাই এমনি বিদঘুঁটে। এ এক সৃষ্টিছাড়া দেশ।
কৃতান্ত আছাড় খেয়ে ব্যথায় কাতরে উঠলে কে নাকিস্বরে বলল, লাগল নাকি ভঁয়া?
ঘরের দেয়াল ভাঙা, ছাদও ফাটলধরা। তার ফাঁকে যেটুকু আলো আছে তাতেই কৃতান্ত অবাক হয়ে দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা কঙ্কাল।
কঙ্কালের মুখে ভঁয়া বলা সহ্য করা যায় না। কৃতান্ত দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন,–থাক, আর সিমপ্যাথি দেখাতে হবে না। কে হে তুমি? এমন করে এদের পাঠিয়ে আমাকে জবরদস্তি ধরে আনলে। একি মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি?
কঙ্কালটা হিহি করে হেসে উঠল। তারপর বলল,–সে কি ভয়া! আঁমায় চিনতে পারছ না? আঁমি বৈকুণ্ঠ।
অ্যাঁ! বলে কী ব্যাটাচ্ছেলে ভূত! বৈকুণ্ঠ এখনও দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন। ভাগ্নেকে গিয়ে এগ্রিকালচার ফার্ম খুলেছেন। কৃতান্ত হাত তুলে বললেন,-থাপ্পড় মারব বলে দিচ্ছি। ইয়ার্কির জায়গা পাওনি?
কঙ্কাল আবার হিহি করে হেসে উঠল। বলল,-মাইরি কেঁতো, তোমার দিব্যি। আঁমি তোমার বন্ধু সেঁই বোঁকা!
কৃতান্ত গোঁ ধরে বললেন,–মুখে বললে তো চলবে না। প্রমাণ চাই।
এদিকে যে তিনটে কঙ্কাল কৃতান্তবাবুকে ধরে এনেছে, তারা এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। এবার তাদের একজন চেঁচিয়ে উঠল,–ওঁরে বাবা, ঐ যে প্রমাণ চাইছে।
আরেকজন বলল,–তাঁহলে তোঁ মুশকিল বেঁধে গেঁল রে!
তৃতীয়জন বলল, কিঁচ্ছু নাঁ রেঁ! আঁয় আঁমরা এঁর মাঁথায় গাঁট্টা মারি। তাঁহলে প্ৰঁমাণ চাঁইবে না।
বৈকুণ্ঠবাবুর পরিচয় দিচ্ছিল যে কঙ্কালটা, সে বলল,–ওঁহে এবাঁর মাঁথা বাঁচাও! বলে সে হাড়ের হাতে তালি বাজিয়ে হিহি করে হাসতে লাগল।
তারপরই ভীষণ কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। কৃতান্তবাবু বুড়োমানুষ হলে কী হবে? এখনও গায়ে জোর আছে। যৌবনে দস্তুরমতো ডনবৈঠক ভাঁজতেন। ফুটবলও খেলতেন। বক্সিং, জুডো এসবেও অল্পস্বল্প হাত ছিল। ওরা হাড়ের হাতে গাঁট্টা মারতে আসার সঙ্গেসঙ্গে এক প্যাঁচে সবাইকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। একজন তো উঁ হু হু করে ককিয়ে উঠল।
তারপর কৃতান্ত ধুন্ধুমার যুদ্ধ বাধিয়ে ফেললেন। স্রেফ ঘুসির চোটে কঙ্কালগুলোকে কোণঠাসা করে দিলেন। এমন আজব বক্সিং ক্যাসিয়াস ক্লে ওরফে মহম্মদ আলির লড়ারও সাধ্য ছিল না।
হ্যাঁ, খটখটে হাড়ে ঘুষি মারলে হাত ব্যথা তো করবেই। তাই বলে কৃতান্তবাবু দমবার পাত্র নন।
দেখা গেল, ভূত বা কঙ্কালগুলো বক্সিংয়ে একেবারে আনাড়ি। ওদের রাজ্যে বক্সিং নেই সম্ভবত। কাতুকুতু আছে। ঘাড় মটকানো আছে। চোখে আঙুল দেওয়া আছে। বক্সিং নেই। অবশ্য একটু-আধটু জুডো থাকলেও থাকতে পারে।
ঘুসির চোটে শেষ অবধি জানালা-দরজা গলিয়ে চারটে কঙ্কালই পালিয়ে গেল। তারপর হাত ব্যথা করতে থাকল কৃতান্তের।
তা করুক। ভূতের সঙ্গে লড়াইতে জিতেছেন। এই গর্বে বুক ফুলিয়ে বেরুলেন।
বেরিয়ে দেখেন দিঘির ঘাটের কাছে সেই বটগাছের লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সে আগের মতো দাঁত বের করে হাসল।
কৃতান্ত তার কাছে গিয়ে বললেন,–হাসি কীসের? আঁ? তখন খুব তত দিঘি দেখিয়ে দিয়েই হনুমানের মতো গাছে চড়ে বসলে। ব্যাপার কী?
লোকটা চাপাগলায় এবং চোখ নাচিয়ে বলল, ওনাদের দেখা পেলেন নাকি বাবুমশাই!…ওনাদের ভয়েই তো আমি আসিনি।
–এখন এলে যে?
–আজ্ঞে, পরে ভেবে দেখলুম আপনি বিদেশি মানুষ। একা কোনও বিপদে পড়লেন নাকি। তাই এলুম। তা বাবুমশাই, ওনারা কেউ আসেনি?
কৃতান্ত ফের ঘাটে হাত ধুতে নামছিলেন। ছ্যাঃ, কঙ্কালের গায়ের ছোঁয়া লেগেছে, স্নান করতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু বিদেশ-বিভূঁয়ে পুকুরের জলে স্নানের অভ্যাস নেই। ঠান্ডা লেগে অসুখ-বিসুখ হতে পারে। তাই হাতদুটো রগড়ে বোবেন!
হাত ধুতে ধুতে কৃতান্ত লোকটার কথার জবাব দিলেন। ব্যাটারা এসেছিল হে। বুঝেছ? এলে কী হবে? হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছি।
লোকটা খুশি হয়ে বলল, ভালো করেছেন আজ্ঞে। খুব ভালো করেছেন।
কৃতান্ত এত কাণ্ডের মধ্যেও কাঁধের ব্যাগ কিন্তু ফেলেননি। তার ভেতর থেকে তোয়ালে বের করে হাত মুছে বললেন,–যাকগে। তোমার বাড়ি তো বৈকুণ্ঠবাবুদের পাশের গায়ে বলছিলে। চলো তো আমায় রাস্তা দেখিয়ে দেবে।
–কী বললেন বাবু?
–বৈকুণ্ঠবাবু। কাকুলিয়ার বৈকুণ্ঠ তলাপাত্রের নাম শোনোনি?
লোকটা চোখ কপালে তুলে বলল,–বৈকুণ্ঠবাবু? মানে কাঁকুলের বোকা বাবুর কাছে যাবেন? ও বাবুমশাই, উনি যে গতকাল মারা গেলেন!
–অ্যাঁ! মারা গেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ওনার ভাগ্নেবাবুরা কাল সন্ধেবেলা ওই শ্মশানে ওনাকে পুড়িয়ে গেলেন যে! বলে লোকটা দিঘির অন্যপাড়ে একটা ঝোঁপ ঝাড় ও শিমূলগাছের দিকে আঙুল তুলল।ওই যে দেখছেন, ওটাই শ্মশান।
কৃতান্তবাবু আস্তে-আস্তে ঘাটে বসে পড়লেন। তাহলে সত্যিসত্যি বৈকুণ্ঠের আত্মা বা ভূত কঙ্কালের রূপ ধরে দেখা দিয়েছিল তখন। তিনি প্রমাণ চেয়ে বসে খামোকা ঝামেলা বাধালেন।
আহা, বেচারা বৈকুণ্ঠকেও এন্তার ঘুসি মেরেছেন। না জানি কত ব্যথা সে পেয়েছে। বন্ধুর শোকে এবং তার ভূতের ব্যথা পাওয়ার দুঃখেও বটে, কৃতান্তবাবু কেঁদে ফেললেন, ওরে বোকা রে। তোকে খামোকা কেন অত ঘুসি মারলুম রে।…
লোকটা সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, আহা! কাঁদবেন না বাবুমশাই। আমারও কান্না পাচ্ছে যে। কাকেও কাঁদতে দেখলে আমারও কান্না পায়।
তারপর সে-ও বিকট ভ্যাঁ করে উঠল।
সঙ্গে-সঙ্গে কৃতান্তবাবু উঠে থাপ্পড় তুলে তার গালে মারলেন।–আমার বন্ধুর মরেছে এবং ভূত হয়েছে আমি কাঁদতে পারি। তাই বলে তুই ব্যাটা কঁদবার কে?
কিন্তু থাপ্পড় মেরেই দেখলেন–এতক্ষণে দেখলেন যে যাকে থাপ্পড় মেরেছেন, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং নেপাল। তার বউমার আদরের চাকর নেপু।
ব্যাপারটা কী—
.
ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়।
থাপ্পড় সত্যি তিনি নেপালচন্দ্রকেই মেরেছেন। তবে সেটা ওর গায়ে লাগেনি। লেগেছে চায়ের কাপে এবং কাপটা উল্টে গেছে। ঝনঝন শব্দ হয়েছে। বড়বউমা দৌড়ে এসেছে। নাতি-নাতনিরাও এসে পড়েছে।
নেপাল বলল,-দিলেন তো চা-টা ফেলে। অত ভালো চা সেই নিউমার্কেট থেকে খুঁজে আনলুম আপনার জন্যে। কাল সন্ধেবেলা বাজে চা খেয়ে বকাবকি করলেন বলে তক্ষুনি দৌড়েছিলুম নিউমার্কেটে। ভেবেছিলুম সকালবেলা কর্তাবাবুকে যদি ফাস্টকেলাস চা না খাওয়াতে পারি তো আমার নাম নেপালই নয়।
কৃতান্তবাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
হ্যাঁ, নিজের ঘরের খাটেই সব কিছু ঘটেছে। তবে আগে এখনই টেবিলে রাখা চিরকুটটা হাতসাফাই করা দরকার। সেই যে লেখা আছে? আমাকে বৃথা খুঁজিও না। পাইবে না। রাতে মনের দুঃখে লিখে রেখেছিলেন। ভোরবেলা কেউ ওঠার আগে কেটে পড়ার মতলব করে শুয়ে পড়েছিলেন। তারপর কত কী ঘটেছে। স্বপ্ন ভেবেছিলেন, কিংবা স্বপ্ন নয় তাও-ভেবেছিলেন এ সবই স্বপ্নের মধ্যে ভাবা।
চিরকুটটা মুঠোয় লুকিয়ে ফেলে কৃতান্ত ছেলেমানুষের মতো হাসলেন। বললেন, কী সব স্বপ্ন। স্বপ্নের মধ্যে হাত ছুঁড়ে চায়ের কাপ ফেলে দিয়েছি। বুঝলে বউমা?
বউমা হাসি চেপে চলে গেল। নাতি-নাতনিরা বলল, কী স্বপ্ন? কী স্বপ্ন দাদুভাই?
কৃতান্ত বললেন, শুধু কি স্বপ্ন? স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন। তার ভেতর স্বপ্ন। আয়নার ভেতর আয়না। তার ভেতর যেমন আয়না। বুঝলে তো?
এই সময় বাইরের ঘরে কে চড়া গলায় বলল,–কেতোভায়া, আছো নাকি?
কৃতান্ত আশ্বস্ত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, এসো, এসো বৈকুণ্ঠ এসো। আজ রাত্রে কী হয়েছে শোনো। অদ্ভুত সব স্বপ্ন
বৈকুণ্ঠ ঘরে ঢুকে বললেন,–পরে শুনব ওসব। কই, তুমি তো গেলে না। সন্ধেবেলা কলকাতা এসেছি। এসেই ঠিক করেছিলুম সকালে তোমার বাসায় আসব। তা এত বেলা অবধি শুয়ে থাকো আজকাল? বাতে ধরবে যে।
কৃতান্ত হাসতে-হাসতে বললেন, আরে আগে স্বপ্নটাই শোনো না। দেখলুম, তুমি মারা গেছ আর
বৈকুণ্ঠবাবু হোহো করে হেসে বললেন,–এ তো আমার পক্ষে সুস্বপ্ন। কারুর মারা যাওয়ার স্বপ্ন দেখা মানেই তার আয়ু বাড়ল।
কৃতান্ত যতের মুঠো দেখছিলেন। কিন্তু ব্যথা করছে যে? স্বপ্নে ঘুসি মারলে তো ব্যথা লাগা উচিত নয়।
অবশ্য নেপালের চায়ের কাপে হাত ছুঁড়েছিলেন। কিন্তু তাতে ব্যথা হওয়ার কথাই ওঠে না। তাহলে?
কৃতান্তবাবু উদ্বিগ্ন হলেন। এবার যা দেখছেন, এও আগের স্বপ্নের মধ্যে আরেকটা স্বপ্ন নয় তো? যেমন আয়নার ভেতর আয়না, তার ভেতর আবার আয়না।
বৈকুণ্ঠবাবু বললেন, কী হল ভায়া? হাতে কী হল? ব্যথা নাকি? চলো, আমার সঙ্গে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ো। আমাদের কাকুলিয়ায় ভালো কবরেজ আছেন। চিন্তা নেই।
কৃতান্ত নিস্তেজ ভঙ্গিতে বললেন,–ও কিছু না।
তারপর আবার দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন। এও যদি স্বপ্ন হয়?
হুঁ, এটা যে স্বপ্ন নয়, তার প্রমাণ কী? আগের স্বপ্নে এই বৈকুণ্ঠের ভূত ঠিক কথাই তো বলেছিল। প্রমাণ ব্যাপারটা সত্যি বড় কঠিন। বিশেষ করে নেপাল এইমাত্র যে ভালো চা এনে দিলে দুকাপ, তা সত্যি অপূর্ব বলেই ধাঁধা ঘুচছে না। নেপালের চা তো এত ভালো হয় না।
ও বেশি দামের চা এনেছে বলে আনে কম দামের। পয়সা মারে। তাই এমন ভালো চা যে খাওয়াবে, তা অবিশ্বাস্যই বলা যায়।
কৃতান্ত চা খেতে-খেতে বললেন, আচ্ছা বৈকুণ্ঠ, তোমাদের কাঁকুলিয়াকে কি লোকে কাকুলে বলে?
বৈকুণ্ঠ বললেন, হ্যাঁ। তুমি কেমন করে জানলে?
–আচ্ছা, একটা বাজেকাঁকুলেও আছে কি?
–আছে। জঙ্গলমতো একটা জায়গা
–সেখানে একটা দিঘি আছে। ভাঙা পাথুরে ঘাট আছে। দক্ষিণ পাড়ে শ্মশান আছে। পুবপাড়ে ভাঙা ঘরবাড়ি আছে। তাই না?
বৈকুণ্ঠ অবাক হয়ে বললেন, সব ঠিক। কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে?
কৃতান্ত আরও উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কাঁচারাস্তার মোড়ে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ আছে।
–আছে বইকী। খুব পুরোনো আমলের বটগাছ। পাঁচশো বছর–
–তোমাদের কঁকুলের পাশে আঁদুল নামে একটা গ্রাম আছে?
–হুঁ, আছে। কিন্তু তুমি–
কৃতান্ত সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন,–দেখো বৈকুণ্ঠ, আমার মনে হচ্ছে, কোনও গোলমেলে ধাঁধায় আটকে গেছি। স্বপ্নের গোলকধাঁধা বলতে পারো। কিংবা এমনও হতে পারে, আমি আর বেঁচে নেই। পরলোকে চলে এসেছি।
বৈকুণ্ঠ হোহো করে হেসে বললেন,–মাথা খারাপ! কী সব আবোল-তাবোল বলছ!
–তাহলে আমায় একটা চিমটি কাটো তো।
বৈকুণ্ঠ বললেন, নাঃ! আমার আঙুলে জোর নেই। তবে কাতুকুতু দিতে পারি। দেব নাকি!
–তাই দাও দিকি ভায়া।
বৈকুণ্ঠের কাতুকুতু খেয়ে কৃতান্ত হিহি করে হেসে আকুল হলেন। নাঃ আর স্বপ্ন নয়। নিশ্চয়ই নয়। তাহলে ঘুম ভেঙে যেত।
কিন্তু স্বপ্নে সত্যিকার একটা জায়গা দেখলেন–এর রহস্য কী? হঠাৎ চোখ গেল বালিশের পাশে রাখা বইটার দিকে। তক্ষুনি বুঝলেন কী ঘটেছে। সব মনে পড়ল। কৃতান্তবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে নড়েচড়ে বসলেন। বাপস! জোর বাঁচা গেল।
বুঝলেন বৈকুণ্ঠও। তিনিই বইটা তুলে নিয়ে দেখে বললেন,–তাই বলো। ওমালি সায়েবের পুরোনো জেলা গেজেটিয়ার পড়ছিলে রাত্রে?–এই যেআমাদের এলাকার ঐতিহাসিক বিবরণও আছে দেখছি। পাতা মুড়ে রেখেছ। বুঝলে ভাই কেতো? কঁকুলে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জায়গা। গুপ্তযুগে একসময় এক রাজার রাজত্ব ছিল। তার প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আছে। পাঁচশো বছরের অক্ষয় বটগাছ আছে। কত কী আছে। দিঘির ধারে শ্মশানটারই বয়স দুশো বছর হয়ে গেল।