১
আর্যেরা যখন আসিলেন তখন ভারতবর্ষ দ্রবিড় ও প্রাচীনতর নানাবিধ সভ্যতার সমৃদ্ধিতে সুসম্পন্ন। সে সব সভ্যতার মধ্যে ধর্মকর্ম, সামাজিক বিধিব্যবস্থা সবই ছিল। আর্যেরাও আবার নিজেদের ধর্মকর্ম, সমাজব্যবস্থা লইয়া আসিলেন। বহু শতাব্দীর ঘাত- প্রতিঘাত-সংঘাতে ভারতে আর্য ও আর্য-পূর্ব নানাবিধ সভ্যতা মিলিয়া একটি বিরাট্ ভারতীয় সভ্যতা গড়িয়া উঠিতে লাগিল। তখন সকলের মধ্যে প্রাণশক্তি ছিল বলিয়া এই নূতন সৃষ্টিটি গড়িয়া ওঠা সম্ভবপর হইয়াছিল।
এই গঠনকার্য যখন চলিতেছে তখনও বাহির হইতে ভারতে নানা জাতির আগমন চলিয়াছে; মহাভারতে ও পুরাণে এমন কত জাতির নামই পাওয়া যায়। যখন শক, হূণ প্রভৃতি জাতি এদেশে আসিল তখন এদেশের সমাজে জীবন ছিল, তাই দেখিতে পাই তাহারা ক্রমে বিরাট্ ভারতসমাজেরই অন্তর্ভুক্ত হইয়া গেল। শক হূণ প্রভৃতি জাতিরা বিভিন্ন সভ্যতা আনিলেও বিরুদ্ধ সভ্যতা আনে নাই, আর ভারতসমাজেরও গ্রহণ করার মত শক্তি আছে বলিয়া দু-একপুরুষ যাইতে-না-যাইতেই সেই সব জাতিরা ভারতীয় ধর্মে, ভাবে ও চিন্তায় ভরপূর হইয়া উঠিল।
বৈদিক কর্মকাণ্ড যে ক্রমে উপনিষদের অধ্যাত্মবাদের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল এবং চিন্তাশীল ভাবুকেরা যে নিগূঢ়-মর্মবাদী (mystic) হইয়া উঠিতে লাগিলেন তাঁহার মূলে হয়তো তখনও এইরূপ বাহিরের নানাবিধ বিচিত্র সভ্যতা ও চিন্তার আঘাত। উপনিষদে যাহা চিন্তায় আবদ্ধ ছিল ক্রমে তাহা জীবনে ও সাধনায় পরিণত হইতে আরম্ভ করিল। মহাবীর বুদ্ধ প্রভৃতি অনেক চিন্তাশীল সাধক এই ধারাকে অগ্রসর করিয়া দিয়া গেলেন।
তখনও ভারতে শক্তির ও জীবনের লীলা নানা ক্ষেত্রে বিচিত্রভাবে আপনাকে প্রকাশ করিতেছে। ধর্মমতে ধর্মসাধনায় ধর্মসমাজে সমাজ-ব্যবস্থায় রাজ্য ও সাম্রাজ্য-ব্যবস্থায় শিল্পে সাহিত্যে সর্বত্র ভারত তখন জীবন্ত। ক্রমে ভারত এই প্রচণ্ড শক্তি হারাইতে লাগিল; তার ধর্ম তার সমাজ-ব্যবস্থা তার চিন্তা দৃষ্টি চেষ্টা রাজ্যনীতি সবই ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ হইয়া আসিল। ইহাই হইল মধ্যযুগ।
মুসলমান-সাধনা ও মুসলমান-শক্তির আবির্ভাবে এই যুগ আবার ভক্তি ও প্রেমে ভরপূর হইয়া উঠিল। নানা অন্ধতায়, ধর্মে আচারের জটিলতায়, ভক্তিভাবের অতি সরসতায় যে সহজ প্রেম ও ভক্তি চাপা পড়িয়া গিয়াছিল তাহা এই আঘাত পাইয়া ও মুসলমান-সাধনার একেশ্বরবাদ ও দৃঢ় নিষ্ঠায় নূতন করিয়া জাগ্রত হইয়া উঠিল; নহিলে ভক্তিবাদ এদেশে নূতন নহে। বেদে বশিষ্ঠাদির মন্ত্রে, বরুণ প্রভৃতি দেবতার স্তবে ভক্তির ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। তবে, আর্যেরা একদিকে ভক্তি অপেক্ষা যাগযজ্ঞ-ক্রিয়াতেই বা অন্যদিকে বিশুদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞানে বেশি অনুরক্ত ছিলেন। আর্যদের পূর্ববর্তী দ্ৰবিড় প্রভৃতি জাতির মধ্যে ভক্তির ভাব ছিল বেশি। আর্যদের জ্ঞানের সহিত এই ভক্তিবাদ মিশিয়া ভারতে ধর্মভাব গভীর ও উদার হইয়া উঠিতে লাগিল।
উপনিষদের যুগের প্রাক্কালে যাগযজ্ঞ ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধতার আঘাতে আর্যদের হৃদয়ে গভীর অধ্যাত্মভাব (mysticism) জাগ্রত হইতেছিল। সেই ভাবের সহিত ভক্তি ও প্রেমভাব মিলিয়া লোকচিত্তকে প্রভাবান্বিত করিতে লাগিল। তারপর যখন বৌদ্ধদের বিশুদ্ধ জ্ঞান ভারতে প্রচারিত হইল তাহারও প্রতিঘাতে এই ভাব ক্রমে লোকচিত্তে গভীর হইতে লাগিল। ক্রমে বৌদ্ধদের মধ্যেও প্রেমভক্তির বিস্তর প্রভাব ঘটিল।
দক্ষিণ দেশে গ্রাম্য দেবদেবী, লিঙ্গপ্রতিমা-পূজা প্রভৃতির প্রতিঘাতেও সরল চিত্তে এই প্রেম ও ভক্তি ক্রমে প্রবল হইতে লাগিল। শৈব ও বৈষ্ণব ভক্তদের ভক্তিই তার প্রমাণ। তাঁরা মুখে শিব ও বিষ্ণুর নাম করিলেও চিন্তায় বাক্যে ক্রমাগতই ভক্তির সর্ববিধ বাধা অতিক্রম করিতেছিলেন।
মুসলমানেরা যখন আসিলেন তখন দেশের নানাবিধ দুর্বলতার সঙ্গে সঙ্গে এই ভক্তি প্রেম ও অধ্যাত্মদৃষ্টি দুর্বল হইয়া আসিতেছিল; মুসলমান-আক্রমণ ও সাধনার প্রতিঘাতে আবার সেই ভাব জাগিয়া উঠিতে লাগিল—এই কথা পূর্বে বলিয়াছি। সংখ্যার বাহুল্যে বা পরিমাণের বিশালতায় যে যথার্থ শক্তি নাই তাহা ইতিহাস বার বার প্রমাণ করিয়াছে। তাই তখনকার ভারতের ইতিহাসে দেখা গেল ঐক্যের আদর্শের অভাবে অসামান্য বীরত্বসম্পন্ন হইয়াও অসংহত হিন্দুসমাজ সংহত জীবন্ত অল্পসংখ্যক মানুষের প্রচণ্ড শক্তির কাছে দীর্ঘকাল দাঁড়াইতে পারিল না। তবু এ কথা সত্য য়ুরোপের মত অত শীঘ্র ভারত মুসলমানের কবলে পড়ে নাই—বেশ কয়েক শতাব্দী যে তাহারা মুসলমানদিগকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিয়াছিল সে কেবল রাজপুতদের অতুলনীয় বীরত্বের গুণে। তখন হিন্দুসমাজের আর এমন জীবন নাই যে ইহাদের আত্মসাৎ করিয়া লয়, আর ইহারাও শক-হূণদের মত কেবল বিভিন্ন ভাব ও চিন্তা মাত্র আনে নাই—একেবারে বিরুদ্ধ ভাব ও চিন্তা লইয়া আসিয়াছে। কাজেই ইহাদের আত্মসাৎ করা সহজ হইল না। মুসলমান- আক্রমণে তীর্থমন্দির নানাবিধ ধর্মক্ষেত্র বার বার বিপন্ন হইল সত্য, কিন্তু ধর্মের প্রধান স্থান হৃদয়মন্দির ক্রমে জাগ্রত হইয়া উঠিতে লাগিল।
নব-আগত আদর্শ ও সাধকদের মাহাত্ম্যের কাছে পাছে হার মানিতে হয় এই ভাবনায় ভারতের সাধকেরা তাঁহাদের বিস্তৃত ও পরিত্যক্ত পুরাতন মহৎ আদর্শগুলি আবার আনিয়া সকলের সম্মুখে ধরিতে লাগিলেন ও সাধনায় প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। ইহাই মধ্যযুগের নব ভক্তিসাধনা ও অধ্যাত্মদৃষ্টির মূলে।
দক্ষিণে দ্রবিড়দের ভক্তি তীর্থপ্রতিমার প্রতিঘাতে যেমন হৃদয়ে হৃদয়ে জাগিয়া উঠিতেছিল, মুসলমানের সাধনা ও বিরুদ্ধভাবের প্রতিঘাতে উত্তরেও তেমনি ভক্তি জাগিয়া উঠিতে লাগিল। গুরু রামানন্দ এই উভয়কে একত্র করিলেন। তিনি দক্ষিণের দীক্ষা লইয়া উত্তরে আসিলেন। সংস্কৃত ছাড়িলেন— জাতিনির্বিশেষে সকলকে জনসাধারণের ভাষায় জ্ঞান-ভক্তি উপদেশ দান করিলেন। নবযুগের আরম্ভ হইল। মুসলমানেরাও এই ভাবের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইতে লাগিলেন। তাঁরা দৃঢ় নিষ্ঠা, শুদ্ধ একেশ্বরবাদ, কঠোর সাধনা সঙ্গে আনিয়াছিলেন। ক্রমে তাহাতে ভারতের রং ধরিতে লাগিল—ক্রমে এই উভয় ভাবের মিলন মধ্যযুগের ভাবের ঐশ্বর্য আবার আশ্চর্যরূপে সম্পন্ন হইয়া উঠিতে লাগিল।
বাহিরের নানা কারণে ভারত তাহার শক্তি বাহিরে হারাইয়াছিল বটে—কিন্তু সে শক্তি তাহার অন্তরে সুপ্ত হইয়া ছিল। সেই শক্তি পূর্ণ জাগরণের জন্য বাহিরের কোনো আঘাতের উপলক্ষ্য খুঁজিতে ছিল। এই উপলক্ষ্যটি ঘটিল মুসলমানদের আগমনে মধ্যযুগের এই জাগরণে সহায়তা করিয়াছিল বলিয়া মধ্যযুগের জাগরণের ইতিহাসে মুসলমানদের সাধনার উল্লেখই প্রথমে করা উচিত।
তখনও যে ভারতে সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তির অভাব ছিল তাহা নহে। তখনও উচ্চশ্রেণীর চিন্তাশীলেরা ন্যায় দর্শন শিল্প সাহিত্য প্রভৃতি নানাবিধ চিন্তায় তাঁহাদের অসাধারণ চুলচেরা বিশ্লেষণ-ক্ষমতায় জগৎকে চমৎকৃত করিতে পারিতেন— কিন্তু অভাব ছিল যথার্থ জীবনের যোগদৃষ্টির ও মহান্ আদর্শের। তখন আদর্শ, দৃষ্টিশক্তি ও সৃষ্টিশক্তি ক্ষুদ্র ক্ষীণ ও সংকীর্ণ হইয়া আসিয়াছে।
ইতিহাসে মুসলমানদের আগমন কেবল রাজরাজড়াদের কথা লইয়াই পরিপূর্ণ। রাজরাজড়ার সৈন্যসামন্তদের অভিযান বার বার ঘটিয়াছে। নগরের পর নগর, রাজ্যের পর রাজ্য অধিকৃত হইয়াছে, কিন্তু সে ভাবে তো বহু বহু লোকের হৃদয় জয় করা সম্ভব হয় নাই। রাজাদের আগমনে, লোকলস্করের তাড়নায় প্রাণভয়ে ভীত হইয়া বহু লোক ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছে সত্য, তবু ভারতের যথার্থ হৃদয় জয় রাজরাজড়ারা বা সৈন্যসামন্তরা করে নাই; তাহা ঘটিয়াছিল কেবল মুসলমান সাধু ও সাধকদের আগমনে ভয়ে ভীত, লোভে লুব্ধ, অথবা নিজের সমাজ ও ধর্মের সঙ্গে যাহাদের স্বার্থের আঘাত লাগিয়াছে এমন বহু বহু লোক প্রয়োজনের তাগিদে ধর্মান্তর গ্রহণ করিল। কিন্তু যাহারা হৃদয়ের ও ভাবের তাগিদে নূতন আদর্শ খুঁজিল তাহারা নব সত্য পাইল কোথায়?
ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থা যখন বৃহৎ সত্য হইতে ভ্রষ্ট, তখন সমাজের উপেক্ষিত এমন বহু লোক ছিল যাহাদের সমস্যার সমাধান তখনকার প্রাণশক্তিহীন সমাজ করিয়া উঠিতে পারে নাই। উপায়ান্তর না থাকিলে হয়তো সেই সব উপেক্ষিত ও লাঞ্ছিত লোক সমাজের অবিচার অগত্যা মাথায় পাতিয়া লইয়া দীর্ঘকাল সবার পদতলে পড়িয়া থাকিত। কিন্তু এখন একটি নূতন শক্তির আবির্ভাব ঘটিল—বিদেশ হইতে সব সাধকেরা তাঁহাদের বিভিন্ন আদর্শ লইয়া সাধনার জন্য ভারতের নানাস্থানে বসিয়া গেলেন। এমন অবস্থায় যাহাদের সমস্যার সমাধান হয় নাই তাহারা স্বাভাবিক নিয়মে ঐ সব সাধকের চারিদিকে আসিয়া সমবেত হইতে লাগিল। তাঁহাদের সাধনার পীঠগুলিই এক একটি তীর্থ হইয়া উঠিতে লাগিল।
এ বিষয়েও যে সব নিষ্ঠাবান্ স্বধর্মনিরত পরমতা সহিষ্ণু মুসলমান শাস্ত্রপন্থীরা আসিলেন তাঁহারা তেমন করিয়া সকলের হৃদয় জয় করিতে পারেন নাই—যেমন করিয়া জয় করিলেন ভাবুক ও সূফী শ্রেণীর আধ্যাত্মিকভাবে ভরপূর মুসলমান সাধকেরা। অন্য সব প্রকারে সংখ্যাবৃদ্ধি বেশি পরিমাণে হইলেও যথার্থ অধ্যাত্মশক্তির মূলে এই সব ভাবুক সাধকরাই।
স্বাভাবিক কারণে এই সাধকেরা প্রথমেই পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশে আসিলেন—কারণ, এই সব স্থান দিয়াই তাঁহাদের ভারতের দিকে আসিবার পথ। এই সব সাধকদের নাম করিতে গেলে প্রথমেই মনে আসে বিখ্যাত সাধক মখদুম সৈয়দ অলি অল্-হুজরীরীর নাম। তাঁহার প্রচলিত নাম দাতা গঞ্জ বখ্ষ। তাঁহাকে অল্-জুল্লাবীও বলে। গজনীর কাছে জুল্লাব ও হুজরের নামক স্থানে তিনি পূর্বে বাস করিতেন। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি নানা দেশ পর্যটন করিয়া অবশেষে লাহোরে আসিয়া তাঁহার সাধনার ক্ষেত্র করেন। সেখানেই তিনি দেহত্যাগ করেন। লাহোরে ভাটী দরওয়াজার কাছে তাঁহার সমাধিস্থল আজও হিন্দু-মুসলমান বহু যাত্রী শ্রদ্ধাভরে দর্শন করিতে আসনে। সেইখানেই তাঁহার সমাধিস্থান বা মজার বিদ্যমান। সেই মজারের দরজার উপর একটি শিলালেখের দ্বারা জানা যায় তাঁহার মৃত্যুকাল ৪৬৫ হিজরাব্দ বা ১০৭২ খ্রীষ্টাব্দ।
প্রতি বৃহস্পতিবার সেখানে বহু যাত্রী আসে; শ্রাবণ মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবারে বার্ষিক বিরাট্ মেলা বসে। তাঁহার রচিত ‘কফ অল্-মহজুব’ (‘আবরণ উন্মোচন’) বা ‘গূঢ়ার্থপ্রকাশ’ সূফীভাবে সাধনার্থীর পক্ষে অমূল্য গ্রন্থ। সেখানকার লোকদের মতে ভারতের সুফীদের তিনি আদিগুরু। তাঁহারই সাধনাস্থানে নাকি স্খাজা মোইনুদ্দীন ও খাজা কুতবুদ্দীন কাকী ও খাজা বা বাবা ফরীদুদ্দীন প্রভৃতি সাধকেরা সাধনা করিয়া সত্য লাভ করেন।
তখনো দেখিলাম সেখানে পাঞ্জাবের নানা সুফী সাধকের সাধনার স্থান হইতে তীর্থযাত্রীরা আসিয়াছেন। কেহ আসিয়াছেন মীয়া মীর সাহেবের স্থান হইতে, কেহ আসিয়াছেন শাহদর মালী হইতে, শাহ মহম্মদ গোনী সাহেবের স্থান হইতে, পাক দোনা সাহেবের স্থান হইতে, মাধো লাল হুসেনের স্থান হইতে। লাহোরের নিকটবর্তী মীর জঞ্জানীর মজার হইতে ও রাওলপিণ্ডির নিকটবর্তী তোঁসের খাজা সুলেমানের স্থান হইতেও কেহ কেহ আসিয়াছেন।
‘কফ অল্-মহজুব’ গ্রন্থে হুজরীরী উপদেশ করিয়াছেন সাধনার্থী সদ্গুরুর নিকট অন্ততঃ তিন বৎসর শিষ্যত্ব করিবেন। প্রথম বৎসর নিরভিমান হইয়া সকল মানবের সেবা করিতে হইবে। দ্বিতীয় বৎসর সকল কর্মকে ভগবদ্ভাবে অনুগত করিয়া ভগবানের সেবা করিতে হইবে। তৃতীয় বৎসরে আপনার যথার্থ স্বরূপ বুঝিতে হইবে, নিজের হৃদয় নিজের অন্তর দেখিতে হইবে।
সূফীদের মধ্যে ‘ফনা’ হইল সাধনার অতি গভীর কথা। ‘ফনা’ হইলে জীবন্তে মরণ বা অহম্কে লোপ করিয়া দেওয়া। হুজরীরী বলেন, সাধনার জগতে ‘গরীবী’ হইল জগতের সর্ববস্তু হইতে বিমুখ হইয়া সম্পূর্ণ অহম্ বিলোপ করিয়া সেই পূর্ণ এককে দেখা। এই সাধনার দ্বারা সাধক নিত্যজীবনের পূর্ণতা লাভ করে। তখন তাহার অহমিকা-আচ্ছাদিত জীবধর্ম বিলীন হইয়া যায় এবং ভগবানের কৃপায় ভগবদ্ভাবে সে পূর্ণ হইয়া উঠে। তখন তাহার সকল স্বত্ব ও সম্বন্ধের অবসান হইয়া যায়। ইহাই হইল ‘ফনা’। তিনি আরও বলেন, ‘ফনা’ বলিতে ব্যক্তিত্বের নাশ বুঝায় না। সাধনার বাধাস্বরূপ মর্ত্য ভাবগুলি ঘুচিয়া গিয়া যথার্থ সত্যে ও সত্ত্বগুণে পূর্ণ হইয়া ওঠার নামই হইল ‘ফনা’। প্রেমের ফনার পথের অবস্থাই হইল ‘হাল’ বা বাউল বৈষ্ণবদের ‘দশা’। ইহার জন্য অন্তর্দৃষ্টি, শ্বাসজপ প্রভৃতি উপায়—সকলের উপরে ভগবানের দয়া।
ইহার পরেই চিতিয়া সূফী সম্প্রদায়ের প্রভাব ভারতে পৌঁছিল। এই সম্প্রদায়ের গুর স্খাজা আবু আহমদ আবদাল চিশতী (মৃত্যু ৯৬৬ অব্দ) দশম শতাব্দীতে তাঁর মত প্রচার করিলেও ভারতে ইহা আনিলেন স্খাজা মুইন অলদীন চিশতী। ১১৪২ খ্রীষ্টাব্দে সীস্তানে তাঁর জন্ম। তিনি তৎকালের প্রধান প্রধান সব সূফী গুরুর সঙ্গে যোগ স্থাপন করিবার জন্য খুরাশান হইয়া বাগ্দাদে আসিলেন। করমানী, কুব্রা, সুবরদী প্রভৃতি গুরুর সঙ্গে তাঁর যোগ ঘটিল। ১১৯৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দিল্লীতে আসিলেন বটে কিন্তু সেখানে বাস করিয়া সাধনা করা তাঁহার পছন্দ হইল না, তিনি আজমীর হিন্দুর পবিত্র স্থান পুষ্করের কাছে আসিয়া বাস করিলেন। ১২৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এখানে তিনি দেহত্যাগ করেন। ভারতীয় সূফীরা বলেন তিনি ভারতের পীরদের শাহানশাহ বা সম্রাট্। তিনি ভারতের সূর্য, ‘আফতাব-ই-মুল্ক-ই-হিন্দ’। তাঁর দরগায় হিন্দু-মুসলমান যাত্রীর ভিড় লাগিয়াই থাকে। মহামতি আকবর পায়ে হাঁটিয়া সেখানে তীর্থ করিতে গিয়াছিলেন। বৎসরে ছয় দিন এখানে বিশেষ মেলা হয়। এখানে হিন্দুমন্দিরের মতই দরগার নহবতখানায় প্রহরে প্রহরে নহবত বাজে, প্রত্যেক পবিত্র স্থানে পাশে বিখ্যাত গায়িকারা ধনী যাত্রীদের অনুরোধে গান করিয়া বিস্তর উপার্জন করে। সাধক মুইন অলদীনের সাধনা ভারতে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল—হিন্দুদের মধ্যেও তাহা অনুভূত হয়। সেখানে তীর্থযাত্রীদের মধ্যে একদল ব্রাহ্মণ দেখিয়াছি যাহাদিগকে হুসেনী ব্রাহ্মণ বলে।
এই হুসেনী ব্রাহ্মণেরা ঠিক হিন্দুও নহেন ঠিক মুসলমানও নহেন। হিন্দুদের বিশ্বাস আচার ক্রিয়াকর্মপদ্ধতির সঙ্গে মুসলমান ভাব ও ক্রিয়াকর্ম মিশাইয়া ইঁহারা তাহা আচরণ করেন। তাঁহারা বলেন, “আমরা ব্রাহ্মণ, আমাদের বেদ হইল অথর্ববেদ। অথর্ববেদে হিন্দু ও মুসলমান উভয় মতের সমন্বয় আছে।”
ইঁহাদের ব্রাহ্মণাচার মুসলমানাচার উভয়ই আছে। হিন্দুধর্মের অবিরোধী মুসলমান আচার ইঁহারা পালন করেন। রোজার দিনে উপবাস করেন আবার হিন্দু উপবাস – ব্রতাদিও পালন করেন। ইঁহাদের নারীরা হিন্দু নারীদের মত বেশ-ভূষা করেন। সধবারা হিন্দু সধবার চিহ্ন ধারণ করেন। পুরুষেরা ভিক্ষার সময় হুসেনের নাম ব্যবহার করেন।
ও-সব দেশে আরও অনেক আধা-হিন্দু ও আধা-মুসলমান শ্রেণী আছে, তাহাদের মধ্যে ইঁহারা সম্মানিত। আগ্রা ও রাজপুতানা প্রদেশে মালকানা রাজপুতেরা হিন্দুভাবেই থাকেন, রাম নাম ব্যবহার করেন, হিন্দু আচার ক্রিয়াকর্মই করেন, আবার কখনও কখনও দরগা প্রভৃতিতেও যান। সাধারণ শ্রেণীর হিন্দু হইতে তাঁহাদের কোনো প্রকার ভিন্নতা নাই।
ইমামশাহী সম্প্রদায়ের পুরোহিত বা ‘কাকা’ শ্রেণী কতকটা হুসেনী ব্রাহ্মণের মত। শাহদুল্লা সম্প্রদায়ের লোকেরাও অথর্ববেদের ও হিন্দু-মুসলমান-সমন্বয়াবতার ‘নিষ্কলঙ্কে’র দোহাই দেন। তাঁহার প্রধান এক শিষ্য খাজা কুতব অলদীন কাকী ফারগানা হইতে বহু সাধকের কাছে গিয়া অবশেষে মুইন অলদীনের কাছে আসেন এবং তাঁহাকে গুরু বলিয়া স্বীকার করেন। দিল্লী কুতব মিনারের কাছে তাঁর সমাধি স্থানে এখনো বহু যাত্ৰী সমবেত হন। গুরুর মৃত্যুর বৎসরেই তাঁরও মৃত্যু ঘটে।
তাঁহার আর একজন প্রধান শিষ্য শেখ ফরীদ অলদীন শকরগঞ্জ। ইনি উপাসনা করিয়া এমন মাধুর্য অনুভব করিতেন (অনেকে বলেন উপাধানের নীচে মিছরি পাইতেন) যে তাঁর নাম হইল শকর বা শর্করগঞ্জ। মুসলমানেরা বলেন পাঞ্জাবে মন্টগুমারী জেলায় শতদ্রু নদীতীরে আজুধান নগর ছিল। এখান হইতে ডেরা গাজী খাঁ ও ডেরা ইসমাইল খাঁর দুই পথ গিয়াছে। শকরগঞ্জ এখানে সাধনা করায় ইহার নাম হইয়া গেল ‘পাক পত্তন’ বা পবিত্র তীর্থ। কীলহন একবার পাক পত্তনে মুসলমানদের সম্পূর্ণ পরাজিত করেন। মহরমের সময় এখানে সুদূর আফগানিস্থান ও মধ্য-এশিয়া হইতেও যাত্রী আসে। ইঁহারই প্রভাবে দক্ষিণ পাঞ্জাবে মুসলমানধর্ম প্রসার লাভ করে। ইনি উপদেশ করিতেন যে স্বর্গের পথ অতি সংকীর্ণ, তাই এখানে দেয়ালে একটি সংকীর্ণ ছিদ্র করা আছে। স্বর্গকামী যাত্রীরা মহরম পঞ্চমী রাত্রে শুভ নির্দিষ্ট মুহূর্তে তাহা দিয়া কষ্টে যায়। ঐ ছিদ্রের নাম স্বর্গদ্বার। ১২৬৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দেহত্যাগ করেন। ইঁহারই বংশে বিখ্যাত কবি শেখ শরফুদ্দীনের জন্ম। সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি মজমূল নামে প্রসিদ্ধ।
তাঁহার এক শিষ্য ‘সাবির চিন্তী’ সম্প্রদায় প্রবর্তক অহমদ সাবীর। ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দে রুড়কীর কাছে তিনি দেহত্যাগ করেন।
শকরগঞ্জের প্রধান শিষ্য হইলেন নিজাম অলদীন ঔলিয়া। ১২৩৮ খ্রীষ্টাবে বদাউনে তাঁহার জন্ম কুড়ি বৎসর যখন তাঁহার বয়স তখনই গুরু তাঁহাকে স্বীয় ভবিষ্যৎ-প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। বিখ্যাত কবি আমীর খসরু ও কবি আমীর হসন দিলরী তাঁর শিষ্য। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জিয়া অলদীন বরণীও তাঁর শিষ্য। ঔলিয়ার দরগায় বহু হিন্দু- মুসলমান যাত্রী যায়। ইঁহার শিষ্যসাধক চিরাগদিল্লীর দরগাও প্রসিদ্ধ।
শেখ সলীম চিতীর দরগা ফতেপুর সিকরীতে। ইঁহার আশীর্বাদে জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়। ইনি একটি গুহায় বাস করিতেন। আকবর তাঁহার দরগা রচনা করিয়া দেন। ১৫৭২ খ্রীষ্টাব্দে ইঁহার মৃত্যু ঘটে।
সিন্ধুদেশে ও পাঞ্জাবে চিতী-মত প্রবর্তন করেন খাজা নূর মহম্মদ। ১৭৯১ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়। সুরর্দী শাখার ভারতে প্রবর্তক হইলেন বহা অলদীন জকরিয়া। মুলতানে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু; বগ্দাদ তাঁর দীক্ষাস্থান। তাঁর মৃত্যুকাল ১২৬৬ খ্রীষ্টাব্দ। সৈয়দ জলাল অলদীন সুখ-পোষ বোখারা হইতে আসিয়া ইঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, অবশেষে উছ নগরে বাস করেন, ১২৯১ খ্রীষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। তাঁর পৌত্র মখদূম-ই জহানিয়া (মৃত্যু ১৩৮৪ খ্রী) বিখ্যাত সাধক ছিলেন। তাঁহার পৌত্র বরহান অলদীন কুবত-ই-আলম গুজ়াতে গিয়া বাস করেন। বট্রাতে তাঁর সমাধি একটি পবিত্র তীর্থস্থান, ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র শাহ আলমের দরগা আহমদাবাদের কাছে রসূলাবাদে; সৌন্দর্য হিসাবেও তাহা বিখ্যাত।
কাদিরী আদিগুরু অব্দ্ অল কাদির অল জীলী মহাপণ্ডিত ও বড় লেখক ও বক্তা ছিলেন। তাঁহার বংশীয় সৈয়দ মুহম্মদ এই মতবাদ ভারতে আনেন। উছে ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। বিখ্যাত সাধক মিয়া মীর এই শাখারই অন্তর্গত। দারা শিকোহ মীয়া মীরের একান্ত অনুরাগী ছিলেন এবং ‘সফিনাত-ই-ঔলিয়া’ নামক গ্রন্থে সাধারণতঃ ইঁহার জীবনী রচনা করিয়াছিলেন। ১৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দে লাহোরে মীয়া মীরের মৃত্যু হয়। ইঁহারই এক শিষ্য মুল্লা শাহ কাশ্মীরে প্রচার করেন।
বাংলাদেশে শাহ জালাল, বিহারে মখদূম শাহ প্রভৃতি সাধকেরা এই মতবাদ বহুল প্রচার করিয়া যান।
সূফী মতবাদী সাধকেরা যথাসম্ভব কোরানের সহিত যোগ রক্ষা করিয়াই চলিতেন। তবু অনেকে আপত্তি করেন যে, এই সব মতবাদের দ্বারা কোরান-প্রবর্তিত বিশুদ্ধ পন্থা রক্ষিত হয় নাই। এই অভিযোগের উত্তরে বুরহানপুরের মুহম্মদ ফজল আল্লাহ একখানা গ্রন্থ রচনা করিয়া প্রমাণ করিতে বাধ্য হন যে, সূফী মতবাদের সহিত কোরানের বিরোধ নাই। গ্রন্থখানির নাম ‘অল তুহ্ ফল অল মুরসল ইল’ল নবী’। ১৬২০ খ্রীষ্টাব্দে ফজল আল্লাহ পরলোক গমন করেন। তিনি প্রমাণ করেন এই সব সূফী মতবাদীরা ‘বা-শরা’ বা শাস্ত্রানুমোদিত। তবু এমন বহু শাস্ত্র-অননুমোদিত ‘বেশরা’ মতবাদের উদ্ভব হইল যাহা কিছুতেই ঠেকান গেল না।
অনেকে মনে করেন ভারতে সূফীদের যেমন প্রয়োজন ছিল সকলের হৃদয় জয় করিতে, তেমনি তাঁহাদের স্বাধীনতা যখন সাধারণের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হইল তখন নিষ্ঠাবান, শাস্ত্রসম্মত-আচরণশীল ধার্মিকদেরও প্রয়োজন ঘটিল। আদি বিজেতাদের শাস্ত্রবন্ধ ধর্ম ক্রমে যখন সংকীর্ণ হইয়া আসিল তখন নিজামুদ্দীন প্রভৃতি সূফী সাধকেরা সকলের হৃদয়-স্পর্শ-করা প্রেমধর্ম প্রচার করিলেন। আকবরের সময় তাহা সকলের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইল; আওরংজেবের সময় শর্মাদ প্রভৃতি নগ্ন সাধকের মধ্যে স্বাধীনতার কিছু বাড়াবাড়ি হইল। তখন আওরংজেব ও অলবিহারী প্রভৃতি পণ্ডিতেরা আবার সবকিছু সংযত করিয়া আনিলেন। এই শর্মাদের রুবাইয়াৎও সাধকদের কাছে খ্যাত। আওরংজেবের আদেশে শৰ্মাদ নিহত হন।
সিন্ধুদেশে সূফীদের স্বাধীনতা কিছু বেশি দূরে অগ্রসর হইয়াছিল। আকবরের বন্ধু ও মন্ত্রী আবুল ফজল ও ফৈজীর পূর্বপুরুষ আরব দেশ হইতে আসিয়া সিন্ধুদেশে অবতরণ করেন, পরে ইঁহাদের পূর্বপুরুষ জোধপুর নাগোরে চলিয়া যান। তাই ইঁহাদের পিতার নাম মুবারক নাগোরী। তিনি গ্রীক দর্শন ও সাহিত্যে প্রগাঢ় পণ্ডিত ছিলেন। এই পরিবার শাস্ত্র-অনুশাসনের বিশেষ ধার ধারিতেন না, যদিও এই পরিবারে পিতা ও পুত্রেরা কোরানাদিতে পণ্ডিত ছিলেন, এমনকি সে সম্বন্ধে টীকা প্রভৃতিও রচনা করিয়াছেন।
মুবারকের প্রথম পুত্র ফৈজী ১৫৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আকবর তাঁহাকে কবীশ্বর উপাধি দেন। তিনি মহাভারতের অনুবাদ করেন ও কোরানের টীকা রচনা করেন। রাজকুমারদের তিনি শিক্ষাদাতা ছিলেন। আকবরের তৌহিদ ইলাহী দলের তিনি একজন সভ্য ছিলেন।
ফৈজীর কনিষ্ঠ আবুল ফজল ১৫৫১ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পনেরো বৎসর বয়সে তিনি সর্বশাস্ত্রে ও বিজ্ঞানে পণ্ডিত হন। ইহার পর দশ বৎসর তিনি অধ্যাপনা করেন। কিন্তু মনে তাঁর শান্তি ছিল না। আকবরনামায় তিনি লিখিয়াছেন—”দিনের বেলা তো বিজ্ঞানাদি আলোচনায় কোনোমতে কাটিত কিন্তু রাত্রে আমার নিদ্রা ছিল না। আমি নগরের বাহিরে ময়দান পার হইয়া আধ্যাত্মিক সম্পদে সম্পন্ন দীনদরিদ্র সাধুদের কুটিরে যাইতাম—কিন্তু তবু হৃদয়ের ব্যথার ঔষধ মিলিল না। এক-একবার ভাবিতাম চীনদেশের জ্ঞানীদের কাছে যাই, আবার ভাবিতাম দরাজ দেশের সন্ন্যাসীদের কাছে যাই, কখনো ভাবিতাম তিব্বতের লামাদের সঙ্গে গিয়া আলাপ করি, কখনো বা হিস্পানের পর্তুগালের যাজকদের দিকে মন টানিত, কখনো বা ভাবিতাম পারস্যদেশের অগ্নিপূজকদের কাছে গিয়া জেন্দাবেস্তার গূঢ় রহস্য জানিয়া লই। আমার নিজধর্মের অনুরাগী বা যুক্তিবাদীদের প্রতি আর আমার আস্থা ছিল না।”
স্বাধীন মতবাদের জন্য এই পরিবার উলেমাগণের কোপে পতিত হয়। সকলে তাই আগরায় পলাইয়া আসেন। আকবরের সঙ্গে দেখা হওয়ায় এঁরা একটা মহৎ আশ্ৰয় পাইলেন। ঐতিহাসিক বদায়ুনী কিন্তু এঁদের উপর অত্যন্ত বিরূপ। তিনি বলেন, “এঁরাই আকবরকে নষ্ট করেন আর আবুল ফজল এই সব মতবাদের আগুনে দুনিয়া দগ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হন।” আবুল ফজলও মহাভারতের পারস্য-অনুবাদে সহায়তা করেন। আকবরের স্বাধীন একেশ্বরবাদে ইনি একজন বড় সহায় ছিলেন।
আকবরের একেশ্বরবাদীর দলে একজন ছিলেন আজিজ কুকা। তিনি মক্কায় তীর্থ করিতে গিয়া সেখানকার গোঁড়ামি দেখিয়া প্রচলিত আচার-ব্যবহারের ধর্মে বীতশ্রদ্ধ হন।
ফৈজী আকবরের জন্য বেদান্ত গ্রন্থ সংস্কৃত হইতে অনুবাদ করেন, রামায়ণ- মহাভারতাদি গ্রন্থও অনুবাদ করেন। আকবরের মন্ত্রী আবদুল রহীম খানখানাঁ (১৫৫৩- ১৬২৩) আরবী পারসী সংস্কৃত ও হিন্দীতে প্রবীণ ও হিন্দীভাষায় চমৎকার কবি ছিলেন। তাঁর ‘রহীম সতসঈ’ চমৎকার হিন্দী কাব্য। তিনি ভক্ত তুলসীদাসের বন্ধু ছিলেন এবং তুলসী-রামায়ণের একজন বড় অনুরাগী ছিলেন। সূরদাসের কৃষ্ণভক্তির কাব্যগুলি তাঁর কৃপায় অনেকটা রক্ষিত হইয়াছে, এই কথা অনেকে বলেন।
আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর ও পৌত্র শাহজাহান ধর্মসম্বন্ধে অনেকটা উদাসীনভাবাপন্ন ছিলেন। শাহজাহান নাকি একবার তাঁর উদাসীনতার জন্য বাবা-ই-কোহ অর্থাৎ পর্বতবাসী মুসলমান সাধকের হাতে লাঞ্ছিত হন। শাহজাহানের পুত্র দারা শিকোহ ধর্মসম্বন্ধে গভীর চিন্তা করিতেন। তাঁর হৃদয় ও দৃষ্টি অত্যন্ত উদার ছিল, সকল ধর্মের সকল মতবাদের ভেদাভেদকে তিনি গভীর যোগদৃষ্টির দ্বারা দেখিতে পারিতেন। মীয়া মীরের প্রতি অনুরাগবশতঃ সাধকদের জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ করিতে দারা শিকোহ ‘সফিনাত-ই-ঔলিয়া’ গ্রন্থ লেখেন। তাঁর সভায় হিন্দী কবির দল, সংস্কৃত কবি জগন্নাথ মিশ্র প্রভৃতি, কবীরপন্থী দাদূপন্থী প্রভৃতি সাধুগণ, পাঞ্জাবের সাধক বাবালাল প্রভৃতি সর্বদাই আসা-যাওয়া করিতেন। হিন্দুর অধ্যাত্মবাদ ও সূফীদের মতামতের সমন্বয় করিয়া তিনি এক গ্রন্থ রচনা করেন—তাহার নাম ‘মজমা অল বহরইন’। উপনিষদ ও আত্ম-পরমাত্ম-বিষয়ক অনেক গ্রন্থ তিনি নিজে অনুবাদ করেন ও অনুবাদ করান। এই অনুবাদগুলির নাম ‘সির্-ই-অকবর’। নানা ধর্মের মৈত্রী ও হিন্দু-মুসলমান সাধনার সমন্বয় বিষয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল, সেগুলি তিনি সিদ্ধ করিয়া যাইতে পারেন নাই। তবু আওরংজেবের পুত্রদের উপর তাঁর সাহিত্যিক ভাবের প্রভাব হইয়াছিল। আওরংজেবের পুত্র আজম শাহ বৈষ্ণব কবি বিহারীর যে সপ্তশত পদাবলী সংগ্রহ করেন, সে সংগ্রহ আজও সর্বোৎকৃষ্ট বলিয়া সর্বজনসম্মানিত। এইজন্য নিষ্ঠাবান্ অনেকে এই দুঃখ করিয়াছেন যে, আওংজেবের পুত্র হইয়াও আজম শাহ এমন সব সাহিত্যের কাছে হৃদয় বিকাইয়াছেন। ‘রসবিলাস’, ‘প্রেম-চন্দ্রিকা’ প্রভৃতি প্রণেতা দেব কবিও আজম শাহের আশ্রয় লাভ করিয়াছিলেন। দারার ভগ্নী জাহানারাও দারার ভাবেই অনুপ্রাণিত ছিলেন।
সিন্ধের সূফী ধর্মের কথা আরম্ভ করিয়া নাগোরী ও ফৈজী ফজলের কথায় আমরা আকবর ও দারা শিকোহ পর্যন্ত আসিয়া পড়িয়াছি। সিন্ধে সূফী সাধনা চিরদিনই খুব উদার। ত্রয়োদশ শতাব্দীর কাছাকছি গজনীতে চারিজন সাধক বন্ধু ছিলেন। তাঁহাদের নাম শাহ কলংদর, ফরীদগঞ্জ, জমালউদ্দীন ও শাহ শকর। তাঁহারা প্রচলিত ধর্মসাধনার সংকীর্ণতায় ব্যথিত হইয়া মনে করিলেন, সমুদ্র পার হইয়া কোনো দূর দেশে যাওয়া যাউক। তাঁহারা ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া সব পার্থিব সম্পদ ফেলিয়া দিয়া যাত্ৰা করিলেন। পরিশেষে তাঁহারা সিন্ধুদেশে সেয়ানে আসিয়া উপস্থিত হন। সেখানে পীরেরা তাঁহাদের দূর করিতে চান তবু তাঁহারা সেখানে রহিলেন। পরে একজন গেলেন ফরীদগঞ্জে ও আর একজন গেলেন মূলতান উছে।
১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সূফী সাধক শাহ করীম জীবিত ছিলেন। তাঁর জীবনীর একস্থানে আছে তিনি আহমেদাবাদের নিকট এক বৈষ্ণব সাধুর কাছে ধর্মজীবনে প্রবেশে সহায়তা পান। তিনি করীমকে ওঁকার মন্ত্র জপ করিতে শিক্ষা দেন। জীবনীতে লেখা আছে ঐ মন্ত্রটি যেন তাঁর পক্ষে অন্ধকারগৃহে ঘূর্ণমান দীপের মত হইল। শাহ করীমের জীবনী পারস্য ও সিন্ধী ভাষা মিলাইয়া লেখা।
তারপরই নাম করা উচিত শাহ ইনায়তের। তিনি সর্বলোকের পূজিত ছিলেন। তখন সিন্ধের কহোরা রাজগণ তরবারির সহায়তায় বহু লোক মুসলমান করিতেছিলেন। বহু লোক কচ্ছ কাঠিয়াওয়াড়ে পলাইতেছিল। ইনায়ত তাঁর আশ্রমে বহু হিন্দুপরিবারকে আশ্রয় দিয়া রক্ষা করিলেন। তাঁহার বিশ্বাস ছিল ভগবান্ কোনো সম্প্রদায়বিশেষের সম্পত্তি নহেন। পরিশেষে সিন্ধের রাজারা তাঁহার মস্তক ছেদন করিয়া দিল্লীশ্বরকে উপহার পাঠান। তাই আজও তিনি ‘বেসির’ (বিনসির) বা মুণ্ডহীন নামে সকলের শ্রদ্ধা পাইতেছেন। বহরাইচের ‘শালারগাজী’, পানীপথের ‘বিনসির’, বটালার বাবাচূড়া, লখে প্রভৃতি তুলনীয়।
এই সব সাধকের শিরোমণি হইলেন শাহ লতীফ (১৬৯৮ খ্রী) – সিন্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও গায়ক। আজও তাঁর গান নর-নারীর কণ্ঠে কণ্ঠে গীত হইতেছে। তাঁর সাধনার স্থান ভীটে প্রতি বৃহস্পতিবার রাত্রে হিন্দু-মুসলমান নরনারীর সম্মিলিত সাধনা চলে। কখনও তাঁরা গান করেন, কখনও সকলে মৌনধ্যানে মগ্ন থাকেন। সেখানে কবীর, দাদূ, নানক, মীরাবাঈ প্রভৃতি ভক্তদের গানও হয়। এইসব গানের সংগ্রহ প্রাচীন পুঁথি সেখানে আছে।
সিন্ধে প্রায়ই দেখা যায় হিন্দুর গুরু মুসলমান ও মুসলমানের গুরু হিন্দু। ইঁহারা সবাই এক ভাষায় ও এক প্রেমের ভাবে সাধনা করিয়াছেন। সূফী প্রেমিক কবি বেদলি ও বেকসের (১৮৫৯) গান এখোনো নরনারীর কণ্ঠে শোনা যায়। তাঁদের সমাধিস্থানে বহু দুঃখ-শোক-পীড়িত নরনারী সান্ত্বনা পায়। বেকসের নাম ছিল মহম্মদ হুসেন। কবি রোহল ও কুতুবও এই পথের পথিক। তাঁদের গান যেমন গভীর তেমিন সুন্দর। এখনও তাঁদের দরগাহে মেলায় হিন্দু-মুসলমান নরনারী রাত্রি জাগিয়া তাঁদের দরগাহে মেলায় হিন্দু-মুসলমান সাধকের গান করেন। বেকস মোটে বাইশ বৎসর জীবিত ছিলেন, তবু তাঁর প্রভাব অত্যন্ত গভীর।
প্রেমের ধর্মে সাধকদের কাছে এই দুই ধর্মের যেরূপ উচ্চ ভাবের মিলন আছে, আবার সাধারণ লোকের কাছে এই দুই ধর্মের প্রচলিত আচার ও সংস্কারগুলি তেমনি মিলিয়া মিশিয়া গিয়াছে।
পাঞ্জাব শাহপুর জেলায় গিরোট তীর্থ হিন্দু-মুসলমান দুই দলেরই পবিত্র স্থান। মুসলমানেরা জমালী সুলতানের ও হিন্দুরা দয়াল ভাবনের নামে সেখানে একত্র হন।
মুসাসুহাগের ভক্তরা (১৫শ শতাব্দী) আহমদাবাদের নিকটবর্তী বেচরা দেবীর ভক্তদের মত নারীর বেশ ধারণ করেন। উভয়ের স্থলই কাছাকাছি।
কাংরা রাণীতালে বাবা ফুত্তুর দরগাহ। ইনি হিন্দুসাধক সোধী গুরু গুলাব সিংহের আশীর্বাদে সিদ্ধ হন। পাঞ্জাব ঝাঙ্ জেলায় হিন্দু সাধক বাবা সহানার স্থান। তাঁর পূর্ব নাম ছিল মিত্র। তিনি এক মুসলমানের চেলা হইয়া সিদ্ধ হন। তাঁর নাম হইয়া যায় মিশাহ। এখন সেখানে হিন্দু-মুসলমান শ্রদ্ধায় একত্র হন।
কাশ্মীরে প্রায় প্রত্যেকটি জিয়ারত পুরাতন হিন্দুতীর্থে স্থাপিত।
মুলতানের শামস্-ই-তবরেজ মন্ত্রবলে সূর্যতেজ ও অগ্নিকে নাকি আয়ত্ত করেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় দলের তীর্থযাত্রীই সেখানে যায়। মধ্যপ্রদেশে বহাদূরপুরে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মহম্মদ শাহদুল্লা একটি সম্প্রদায় স্থাপন করেন, তাহাতে তিনি হিন্দু- মুসলমান উভয় সাধনাকে মিলাইতে চাহিয়াছিলেন। তাঁর দরগায় এখনো বহু ভক্ত যান। তাঁর মতবাদীদের নাম পীরজাদা। তিনি হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্র হইতে বাছিয়া বচন লইয়া একটি সমন্বয়-শাস্ত্র রচনা করেন। পীরজাদা বলেন বিষ্ণুর দশম অবতার হইলেন ‘নিষ্কলঙ্ক’ –তিনিই আমাদের উপাস্য। এ বিষয়ে গুজরাতের পীরানাপন্থ ও ইঁহাদের মধ্যে বিশেষ প্রভেদ নাই।
গুজরাতে পঞ্চদশ শতাব্দীর ইমাম শাহের সম্প্রদায় আছে, তার নাম পীরানাপন্থ বা কাকাপন্থ। এই মতে অধিকাংশই পাটীদার। ইঁহারা হিন্দুভাবে থাকেন, ইঁহাদের হিন্দু নাম ও আচার, তবু ইঁহারা মুসলমান গুরুর শিষ্য। সেই গুরুর পাটীদার সহায়ক আছেন, তাঁদের কাকা বলে। ইঁহারা ব্রাহ্মণের ও কাকাদের দ্বারা ধর্মানুষ্ঠান করান ও মরিলে এঁদের কবর দেওয়া হয়। এখন নরসারী প্রভৃতি স্থানে ইঁহারা ধীরে ধীরে হিন্দুমতে ফিরিয়া যাইতেছেন। ইঁহাদের অবতারও নাকি নকলঙ্কী বা নিষ্কলঙ্কী। ইঁহাদের আটটি শাখা আছে। মূল স্থান কচ্ছে।
তাজ নামে এক মুসলমান মহিলা কবি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কৃষ্ণভক্তিবিষয়ক অনেক চমৎকার গান লিখিয়াছেন। তিনি ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন। ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের এক গুরু আসিয়া ভারতে বল্লভ-সম্প্রদায়ী বৈষ্ণব গুরুর মত হইয়া হিন্দুদের দীক্ষা দেন। তাঁহারা তাঁহাকে কৃষ্ণের অবতার মনে করেন। এখন এই সম্প্রদায়ের নাম খোজা। ইঁহারা অতিশয় ধনী ব্যবসায়ী। তবে বল্লভাচার্য সম্প্রদায়ের মত ইহাতেও অন্ধতা ও গুরুপূজা একান্তভাবে বিরাজিত। এই সম্প্রদায়ে পূর্বে হিন্দু আচার ও নাম ছিল, এখন ইঁহারা ক্রমে বিশুদ্ধ মুসলমান হইতে আরম্ভ করিয়াছেন। কাঠিয়াওয়াড় গঢ়ড়ায় প্রায় আড়াইশটি খোজা-পরিবার স্বামী নারায়ণ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছে।
মুসলমানদের মধ্যে উদারদৃষ্টিসম্পন্ন অনেকে ধর্মের মৈত্রী ও সমন্বয়সম্বন্ধে বহু চিন্তা করিয়াছেন ও গ্রন্থাদি রচনা করিয়াছেন। চিতিয়া সম্প্রদায়ের সাধক মহীউদ্দীনের শিষ্য মালিক মহম্মদ জায়সী (১৫৪০) কবীরের উপদেশে অনুপ্রাণিত হইয়া আত্মা ও পরমাত্মার বিষয়ে অসাধারণ চমৎকার রূপক কাব্য ‘পদুইমাবতী’ রচনা করেন। তাঁর কাব্য বাঙ্গা ভাষায় মুসলমান কবি আলাওল অনুবাদ করেন; হুসেন গজনবী এই কাব্য পারস্য ভাষায় অনুবাদ করেন। জায়সী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
আমেঠির হিন্দু রাজা তাঁর ভক্ত ছিলেন। তাঁর দরগাহ রাজাই তৈয়ার করাইয়া দেন। রাজা জগৎদেবের সভাপণ্ডিত ও রায়পুরা হলদিয়ার ব্রাহ্মণ কথকদের পূর্বপুরুষ গন্ধর্বরাজ তাঁর বন্ধু ছিলেন। জায়সী অপুত্রক ছিলেন বলিয়া তাঁর বংশনাম ‘মালিক’ তিনি ব্রাহ্মণবন্ধুর পুত্রদের দিয়া যান ও আশীর্বাদ করেন—তোমাদের বংশে সুকণ্ঠ চিরস্থায়ী হইবে, তোমরা ভগবানের গুণগান করিবে। তাই হলদিয়ার কথক ঠাকুরদের উপাধি মালিক।
মালিক মহম্মদের ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া নূর মহম্মদ (১৭৫০ খ্রী) তাঁহার ‘ইন্দ্রাবতী’ কাব্য রচনা করেন। ইহা অনেকটা পদ্মাবতীর মতই রূপক আখ্যান।
বেশিদিনের কথা নয়, নিজামউদ্দীন ঔলিয়ার বংশধর ও তাঁর দরগাহের হাফিজ হসন নিজামী তাঁর রচিত ‘হিন্দুস্থান কে দো পয়গম্বর রাম ও কৃষ্ণ, সলাম অল্লাহী অলই হিমা’তে লেখেন যে, “কোরানে আছে সকল দেশেই ভগবান্ তাঁর গয়গম্বর পাঠান। ভারতের মত বিশাল দেশে কি সে কথা মিথ্যা হইবে? অতএব রাম, কৃষ্ণ ও বুদ্ধ সত্যই এদেশের সত্যদ্রষ্টা পয়গম্বর এবং ইঁহাদের উপদেশ প্রামাণিক।
ভারতে আসিয়া মুসলমান সাধকেরাও হিন্দুসাধনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইতে লাগিলেন। গুরুর প্রতি যে আনুগত্য হুজরেরীর কশফউল মহজুবে আছে ও সূফী শাস্ত্রে আছে তাহা আরও হিন্দুভাবাপন্ন হইল। অনেক পরবর্তী কালে হাজী সবজরারী যে বলিয়াছিলেন সৃষ্টি ভগবানের আলোকরশ্মি, সেই মতবাদের সঙ্গে উপনিষদের সৃষ্টবাদ মিলিয়া সাধকদের মধ্যে পরে অনেক নূতন সৃষ্টিরহস্য রচিত হইয়াছিল।
বাতিনীয়াদের গূঢ়ার্থবাদের সঙ্গে ভারতের অধ্যাত্মবাদ মিলিতে লাগিল। ক্রমে এমন সব মত দাঁড়াইল যাহাকে মৌলানারা বলিতে বাধ্য হইলেন এসব ‘বে-শরা’, অর্থাৎ শাস্ত্রের অননুমোদিত। যোগশাস্ত্রের অনুসরণ করিয়া পাঞ্জাবে ও নানা স্থানে মুসলমান যোগীরা যোগের, আসনের, দেহতত্ত্বের, ষট্চক্র প্রভৃতি চিত্রসংবলিত গ্রন্থাদি লিখিলেন। ষট্চক্র, কমল-বেধ সব গৃহীত হইল। পাঞ্জাবে এমন পুস্তক একাধিক আমি দেখিয়াছি।
আজাদ সম্প্রদায় তো গোঁফদাড়ি কামাইয়া সব শাস্ত্রশাসন অস্বীকার করিল। জালাওনে এদের অনেক সময় দেখা যায়।
আলওয়ার রাজ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে রসূল সাহ তান্ত্রিক মত প্রচার করিতে লাগিলেন। পাঞ্জাবে তাঁদের মধ্যে রসায়নশাস্ত্র ও কাব্য-সাহিত্য সুপ্রতিষ্ঠিত। ইঁহারা মদ্যপানে কুণ্ঠিত নহেন। লোকেরা মনে করে ইঁহারা অলৌকিক ক্রিয়া করিতে পারেন। ইঁহারা তান্ত্রিকদের মত ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্নাযোগে ষট্চক্র ভেদ করিয়া সহস্রার-সুধা পান করেন। তান্ত্রিকদের মত ইঁহারা চক্রে বসেন ও বীরাচারে সাধনা করেন।
সিন্ধে হিন্দুর জিন্দা-পীরই মুসলমানের খাজা খিজির। হিন্দুর লাল-মধেরো মুসলমানের সেখ তাহির। লাল-জসরাজই পীর সংঘো। মুলতানের জালালী সম্প্রদায়ের প্রধান কলংদর উসমানী মের বন্দী বা লাল সাহবাজ ও পীর সংঘো। সেহওয়ানে ১২৭৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। হিন্দু-মুসলমান উভয়ের অন্ধ কুসংস্কারও মিলিতে লাগিল। ক্রমে গাজী মিয়াঁ, পাঁচ পীর, পীর বদর, খাজা খিজিরের পূজা চলিল। ডেরা গাজী খাঁর সখী সররর তীর্থ হিন্দু-মুসলমান-শিখের তীর্থস্থান। মূলতানে শের সাহের দরগা হতাশ প্রেমিকদের তীর্থস্থান। বাংলাদেশে সত্যপীর সত্যনারায়ণ হিন্দু-মুসলমানের উপাস্য।
বাংলায় বাউল ও জিকির বলিয়া যে সব মণ্ডলী আছে তাহাদিগকে না বলিতে পারা যায় কোনো জাতি, না বলা যায় কোনো সম্প্রদায়। তাহারা না মুসলমান, না হিন্দু। এই বাউলরা গৃহস্থ বাউল, তাঁহারা কতক পরিমাণে মুসলমানও বটেন। তাই নিষ্ঠাবান্ মুসলমানেরা ফতোয়া দ্বারাও ইঁহাদের সংখ্যা লোপ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। এরূপ বাউল বিধ্বংস ফতোয়া আমি দেখিয়াছি। রংপুর জেলায় পার্বতীপুরের কাছে বাঙ্গালপাড়ায় ও অন্যান্য কোনো কোনো স্থানে, বিশেষতঃ উত্তরবঙ্গের কতকগুলি স্থানে বাউল জাতি আছে। ধর্মের বাউল ইহা হইতে স্বতন্ত্র। ময়নমনসিংহের পূর্বভাগে মেঘনাতীরে জিকির জাতি আছে। এই উভয় শ্রেণীরই হিন্দু মুসলমান উভয়বিধ গোঁড়ামির কোনটাই নাই। ইঁহারা গান সাধনা করেন ও ইঁহাদের মতামত খুব উদার। খানিক বৈষ্ণব খানিক সূফী ভাবে ইঁহারা অনুপ্রাণিত।
এই পর্যন্ত যাঁহাদের নাম করা গেল তাঁহারা প্রায় অনেকেই নিজেদের মুসলমান নামে পরিচয় দিয়াছেন—যদিও নিষ্ঠাবান্ মুসলমানেরা বলিয়াছেন এসব আচার বা-শরা বা শাস্ত্রসম্মত নহে। বহু স্থানে ইঁহার প্রতিবাদও চলিল, তার মধ্যে পূর্ব বাংলার ফরাইজী সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। ফরিদপুরে হাজী শরিয়ত অল্লার জন্ম জোলার বংশে। তিনি মক্কা যাইয়া সেখ তাহির অল মক্কীর শিষ্য হন। কুড়ি বৎসর তথায় থাকিয়া ১৮০২ খ্ৰীষ্টাব্দে দেশে ফিরিয়া ১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মত প্রচার করেন। তাঁর মতে, শিষ্যের গুরুর একান্ত আনুগত্য ভালো নয়। তিনি বলেন, ভারত অমুসলমান রাজার অধীন অতএব ‘দরঅলহব’ অর্থাৎ যুদ্ধস্থান। অতএব এখানে ঈদ ও জুম্মা নামাজ চলে না। প্রত্যেকে খুব নিষ্ঠাবান্ আচারী মুসলমান হইবে। পীর, দরগাহ প্রভৃতি পূজা করিবে না—এই মতবাদই ওয়াহাবী। তাঁর পুত্র মুহম্মদ মুহসিন বা দুধু মিয়াঁ তাঁদের সম্প্রদায়কে নানা মণ্ডলে ভাগ করিয়া সুব্যবস্থা করিলেন। তাঁহারা প্রচার করিলেন সম্প্রদায়ে ধনী-দরিদ্রে ভেদ নাই। একের বিপদে সকলকে দাঁড়াইতে হইবে। ইঁহাদের কাহারও সঙ্গে বাহিরের কাহারও বিবাদ হইলে ইঁহারা একত্র হইয়া বিরুদ্ধে দাঁড়াইতেন। তাঁদের মতে পৃথিবী ভগবানের, তাই কেহ পুরুষানুক্রমে তাহা অধিকার করিতে বা কর চাহিতে পারে না। তাই পুরাতন মুসলমান, নীলকর ও জমিদাররা ইঁহাদের সঙ্গে সমবেতভাবে লড়িয়াও সহজে কিছু করিতে পারেন নাই।
সৈয়দ অহমদও পশ্চিমভারতে এইরূপ মতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন। এই আন্দোলনকে ওয়াহাবী আন্দোলন বলে।
মুসলমানদের মত হিন্দুদের দিক হইতেও নানারকম চেষ্টা চলিতে লাগিল, যাহাতে নিজেদের সাধনা ও আদর্শ বাঁচাইয়া রাখা যায়। তার মধ্যে কোন কোন দলের চেষ্টা চলিল নিজেদের শাস্ত্র ও আচার যথাসম্ভব বাঁচাইয়া রাখিয়া তার মধ্যে যতটা স্বাধীনতা চলে ততটা দিয়া। আর কোন কোন দল নিজেদের পুরাতন সব শাস্ত্র ও বন্ধন অতিক্রম করিয়া একেবারে নূতন করিয়া বৃহৎ যোগ ও সমন্বয়ের জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। মুসলমানেরা প্রথমোক্ত দলকে বলেন ‘বা-শরা’ বা শাস্ত্রসম্মত ও অপর দলকে বলেন ‘বে- শরা’ বা শাস্ত্রবহির্ভূত। বাউলদের দেওয়া নাম আরও চমৎকার। তাঁহারা প্রথমে দলকে বলেন ‘দীঘল-ডুরী’ বা দীর্ঘ দড়ি-বাঁধা দল অর্থাৎ যাঁহাদের খোঁটাটা ঠিকই আছে তবে দড়িটা যতটা সম্ভব দীর্ঘ করিয়া যথাসম্ভব স্বাধীনতা যাঁহারা পাইতে চান। আর ‘বে-ডুরী’ বা বন্ধনমুক্ত দল। মধ্যযুগে প্রথমোক্ত দলকে বলে ‘লোকবেদ পংথী’ অর্থাৎ যাঁহারা লোকাচার ও বেদাচারকে প্রামাণিক মনে করেন। অপর দলকে বলেন ‘অনভৌ-সাচ পংথী’ অর্থাৎ যাঁহারা অনুভবের দ্বারা প্রত্যক্ষীকৃত সত্যকেই মানেন। এখনকার আলোচনা প্রধানতঃ হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই এক ‘দীঘল-ডুরী’ দলদের লইয়া। পরে ‘বে- ডুরী’দের কথাই প্রধানতঃ বলা হইবে। মুসলমান ‘বা-শরা’ দলের কিছ পরিচয় এতক্ষণ দেওয়া গিয়াছে। এখন শাস্ত্রসম্মত হিন্দুর দিকের চেষ্টার কিছু পরিচয় দেয়া যাউক।
হিন্দু তরফের এই সব চেষ্টার অনেক কথাই আপনাদের সকলের জানা আছে। কাজেই যথাসম্ভব সংক্ষেপ করিয়া খুব অল্প কথায় একটু পরিচয় দিব। মুসলমানদের সাধনার দান সকলের জানা না-ও থাকিতে পারে মনে করিয়া তাহা একটু খোলাসা করিয়া বলিবার চেষ্টা করা হইয়াছে।
মুসলমানদের আসিবার পূর্বেই ভারতের বৈদিক আচার ও ধর্ম বৌদ্ধ জৈন প্ৰভৃতি নানা মতবাদের আঘাতে মৃতপ্রায় হইয়া আসিয়াছিল। আনন্দতীর্থ দুর্গ ভট্টভাস্কর সায়ণ মাধব উবট প্রভৃতি পণ্ডিত ও শ্রুতির টীকাকারেরা তাহা পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করিলেন রাজা বুক্ক হরিহরের আশ্রয় পাইয়াছিলেন বলিয়া চতুর্দশ শতাব্দীতেও সায়ণাচার্য বেদের এমন একখানা টীকা রচনা করিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রয়াস সুবিদিত, এখানে বলার প্রয়োজন নাই।
মুসলমানদের আসার পর যখন সমাজের নিজেরই জীর্ণতা হইতে সমাজ খান্ খান্ হইয়া ভাঙিয়া যাইতেছিল, তখন নূতন একটা জীবন দিয়া সকল ভাঙাচোরাকে নবজীবনে জীবন্ত করিয়া যুক্ত করিয়া তোলা সহজ নয়। সমাজব্যবস্থা যখন ভাঙিয়াছে, তখন মনু-টীকাকার মেধাতিথি, কুল্লুকভট্ট, মিতাক্ষরা-টীকাকার বিজ্ঞানেশ্বর (১১শ খ্রী), চতুর্বর্গচিন্তামণিকার হেমাদ্রি (১২৬০-১৩০০), বাংলার রঘুনন্দন প্রভৃতির চেষ্টা চলিল যাহাতে পুরাতন বন্ধনগুলি দিয়া অন্ততঃ ভাঙা অংশগুলি একত্র কোনোমতে বাঁধিয়া রাখা চলে। পুরাণ-রচয়িতা ও নিবন্ধকারগণের পাণ্ডিত্য ও বিপুল প্রয়াস দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়।
গৌড়পাদ, শংকরাচার্য (অষ্টম শতাব্দী) প্রভৃতি জ্ঞানিগণ জ্ঞানের দ্বারা সকলকে জাগ্রত করিতে চাহিলেন। বৌদ্ধমঠগুলি হীনবল হইতেছিল, শঙ্করাচার্য তাঁর চারি মঠের প্রতিষ্ঠা করেন, ছয় দর্শন ও তার টীকাকারদের চেষ্টাও চলিল। তবে সে সব প্রয়াস জ্ঞানী ও বিদ্ধাদের লইয়া, সাধারণের তাহাতে বড় আসে-যায় না।
তাহার পরেই নাম করিতে হয় তন্ত্রকারগণের। তন্ত্র বলিতে অনেকে কেবল কুৎসিত আচারাদিই বুঝেন। কিন্তু মহানির্বাণ, কুলার্ণব, বিশ্বসার প্রভৃতি তন্ত্র গভীর জ্ঞানের কথায় পূর্ণ। যে জ্ঞান কেবল বেদান্তাদি শাস্ত্রে ও পণ্ডিতগণের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, তাহা সরল সহজ ভাষায় আপামর সকলের মধ্যে বিলাইয়া দেওয়ার জন্য এই সব তন্ত্রের যে আশ্চর্য প্রয়াস, তাহা ভাবিয়া দেখিলে অবাক্ হইতে হয়।
ক্ষুদ্র জ্ঞান ও পূজাদি পরিত্যাগ করিয়া ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্ম-সাধনার জন্য মহানির্বাণের যে উপদেশ, তাহা যে কোন দেশের পক্ষে গৌরবের। ইহাতে সামাজিক আচারের অর্থহীন বন্ধনগুলি ঘুচাইয়া দিয়া আচণ্ডাল নরনারী সকলকেই সাধনার সমান অধিকার দেওয়া হইয়াছে। দায়ভাগ, সমাজব্যবস্থা, ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক ধর্মসাধনার পূর্ণ ব্যবস্থা করিয়া সাধনার একটি পরিপূর্ণ নূতন আদর্শ সকলের কাছে ধরিতে তন্ত্রকারগণ চেষ্টা করিয়াছিলেন।
যাঁহারা ক্রিয়াকর্ম পূজা-অৰ্চনা মাত্র লইয়া জীবন কাটাইতে চান, বড় বড় সামাজিক আদর্শে মাথা ঘামাইতে চান না, তাঁহাদের জন্য আগমবাগীশ কৃষ্ণানন্দ প্রভৃতি তান্ত্রিক সাধকগণ নানা তন্ত্র হইতে তন্ত্রসারের মত তান্ত্রিক কর্মের গ্রন্থ রচনা করিলেন
ব্যক্তিগত সাধনার্থীর জন্য পূর্ণানন্দ আদি সাধকেরা ষট্চক্র নিরূপণ, যোগ প্রভৃতির প্রচার করিলেন। তারপর তন্ত্রের টীকাকারও কত হইয়া গিয়াছেন।
অনেকে বলেন যদু, তুর্বসু, বৃষ্ণি প্রভৃতি পরবর্তী কালের ভারতে আগত জাতি হইতে ভাগবতধর্ম এদেশে প্রচারিত হয়। এদেশের ধর্মচিন্তার সঙ্গে মিলিয়া এই ভগবতধর্ম এক অপূর্ব ভক্তিবাদে পরিণত হয়। এখানকার যোগমতের সঙ্গেও তার মিলন ঘটিল। মহাভারতের নারায়ণী অংশ রচয়িতা পঞ্চরাত্রকার শাণ্ডিল্য-সূত্রকার হইতে আরম্ভ করিয়া নারায়ণ পরিব্রাজক এমনকি তার পরেও অনেক মতিমান্ এই ভাগবতধর্মকে সকলের গ্রহণীয় করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ভাণ্ডারকর প্রভৃতি পণ্ডিতেরা এ বিষয়ে অনেক লিখিয়াছেন, কাজেই এখানে তাহা উল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই।
বুদ্ধের ভক্তগণ যেমন ভগবান্ তথাগতের মধ্যেই সব আদর্শকে পূর্ণভাবে পাইবার চেষ্টা করিয়াছেন ভারতে তেমনি ভক্তেরা শিব বা বিষ্ণুকে বিশেষতঃ বিষ্ণুকে রাম ও কৃষ্ণ ভাবে লইয়া তাঁহাদের সকল আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের পূর্ণ আধার ও আশ্রয় রচনা করিবার চেষ্টা করিলেন।
দক্ষিণ ভারতের দ্বাদশ আলরারের নয় জন অন্ততঃ মানুষ এবং তার মধ্যে অনেকে বেশ নীচকুলজাত এবং ‘আণ্ডাল’ একজন নারী। পঞ্চম আলরার ডোমজাতীয় শঠকোপের ‘তিরু বায়মোলি’ বা মুখের বাণী বেদের অপেক্ষা বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে অধিক সমাদৃত। আণ্ডাল ও তাঁর পিতা বিষ্ণুচিত্ত আলরার জাতিতে অস্পৃশ্য পারিয়া।
মানবহৃদয়ের প্রেমভক্তি লইয়া আলরারেরা নব ভক্তিবাদ রচনা করিলেন। ক্রমে নাথমুনি, আলরন্দার যামুনাচার্য, অর্থ-পঞ্চককার পিল্লে লোকাচার্য (১২১৩ খ্রী) প্রভৃতির সময় হইতে রামানুজের সময় পর্যন্ত এই নব ভক্তির ধারা সমান উদ্যমে চলিল। ভক্ত আলরারদের বাণী ভক্তিরস দিয়াছিল। নাথমুনি, যামুনাচার্য প্রভৃতি আচার্যেরা জ্ঞানের দিক্ দিয়া সেই ভক্তির বাণীর ধারাকে পূর্ণ করিবার চেষ্টা করিলেন। জাতিবিচার-শাসিত দক্ষিণ দেশে দ্বাদশ শতাব্দীতে রামানুজ বিষ্ণুভক্তি বিলাইয়া নীচ জাতিকেও উচ্চ করিয়া তুলিলেন এবং দেশীয় ভাষায় শঠকোপ রচিত ‘তিরু বায়মোলি’ প্রভৃতি ভক্তিশাস্ত্রকে বৈষ্ণবের বেদ বলিয়া আশ্রয় করিলেন। ধর্মের দৃষ্টিতে বিষ্ণুভক্ত সবাই সমান, অথচ সমাজে জাতিভেদ আছে, কাজেই উভয় কূল রক্ষা করিয়া ব্যবস্থা হইল প্রত্যেকে পৃথক্ খাইবে। পংক্তিভোজন করিতে গেলেই তো উচ্চনীচ বিচার আসে। ইহাই হইল তেন্ কলই বা দক্ষিণবাদ। ইহা কিছু বেশি স্বাধীনতা মনে করিয়া পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীতে বেদান্ত-দেশিক অনেক পরিমাণে বেদবাদ ও প্রাচীন রীতি পুনঃপ্রবর্তিত করেন তাহাই হইল বেদ্ কলই বা বেদবাদ। তেন্ কলই মতবাদীরা বিবাহে বৈদিক হোম বাদ দিয়াছিলেন, বিধবার মস্তকমুণ্ডন বাদ দিয়াছিলেন, বেদান্ত-দেশিক সেগুলি পুনঃপ্রবর্তিত করিলেন।
লক্ষ্মীর উপদিষ্ট বলিয়া রামানুজ-মতকে শ্রী-সম্প্রদায় বলা হয়। ইহাতে বেদান্তের অদ্বৈতভাবের প্রভাব আছে বলিয়া ইঁহাদের মতকে বিশিষ্টাদ্বৈতমতও বলে। রামানুজ ও তাঁর মতবাদীদের সম্বন্ধে বহু গ্রন্থ রচিত হইয়াছে, কাজেই বেশি কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। রামানন্দ পূর্বে এই রামানুজ-সম্প্রদায়ী ছিলেন, পরে সম্প্রদায়ের বন্ধন হইতে মুক্ত হন। তিনি মধ্যযুগের একজন যুগগুরু। তাঁর কথা পরে বলা হইবে।
আনন্দতীর্থ (১৩৩১ খ্রী) পূর্বে শৈব শংকর-মতবাদী ছিলেন। পরে বৈষ্ণব হইয়া দ্বৈতমতের মাধ্ব সম্প্রদায় স্থাপন করেন। তাঁর সম্প্রদায়কে ব্রহ্ম-সম্প্রদায়ও বলে। তিনি চতুর্দশ শতাব্দীর লোক। বেদান্তবাদকে পরিহার করিয়া ইনি সাংখ্যযোগের পথে সাধনায় অগ্রসর হইতে চাহেন।
বিষ্ণুস্বামীর সম্প্রদায়কে রুদ্র-সম্প্রদায় বলে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইনি বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন। শিব বা রুদ্র ভাষিত বৈষ্ণবমতই তিনি প্রচার করেন। গুজরাতে তাঁর মতবাদী লোক বেশি। তাঁর বংশের লক্ষ্মণ ভট্ট উত্তর-ভারতে চলিয়া যান। সেখানে তাঁর পুত্র বল্লভ বিখ্যাত পুষ্টিমার্গ বা বল্লভাচার্য-মত স্থাপন করেন। ইঁহারা ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দস্বরূপ বলেন। ইঁহাদের মতকে শুদ্ধাদ্বৈতবাদ বলে। নামদেবের শিষ্যেরা বলেন, বিষ্ণুস্বামী নাকি ভক্তি নামদেবের কাছে ভক্তির উপদেশ পাইয়াছিলেন। কাল হিসাবে তাহা অসম্ভব নয়। শ্রী-সম্প্রদায় প্রভৃতি বিশিষ্ট সম্প্রদায়েও দেখা যায়, বড় বড় আচার্যরা তাঁহাদের আদি অনুপ্রেরণা পাইয়াছেন আলার প্রভৃতি নিরক্ষর জাতি-কুলহীন সাধকদের কাছে।
নিম্বাদিত্যের সম্প্রদায়ের নাম সনকাদি-সম্প্রদায় বা দ্বৈতা-দ্বৈত-সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়-গুরু সূর্যের অবতার। ইঁহারা সকলের অপেক্ষা পুরাতন মতবাদী।
চৈতন্য মতকে গৌড়ীয় মাধ্বমতও বলে। মাধ্বমতের একটি স্রোত বাংলাদেশে পৌঁছিয়া মহাপ্রভুকে নূতন জীবন দিল। যদিও চৈতন্যের পূর্বে বাংলায় ঈশ্বরপুরী, কেশব ভারতী প্রভৃতি ছিলেন, তবু মহাপ্রভু চৈতন্যই বাংলাদেশে নূতন ভক্তিধর্ম প্রবর্তিত করিলেন। তিনি ধর্মে মুসলমান ও হিন্দুর সকল জাতিকে গ্রহণ করিলেন বটে কিন্তু সামাজিকভাবে সকলকে সমান অধিকার দিতে পারিলেন না, সে হিসাবে জাতিভেদ রহিল। নারীদের অধিকারও তিনি সাবধানে কতকটা দিয়াছিলেন। তাঁহার জন্ম ১৪৮৪, মৃত্যু ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দে। চৈতন্যের পূর্বে বাংলায় জয়দেব বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস প্রভৃতি সহজ বৈষ্ণবমতের লেখকদের প্রভাব ছিল। সহজমতের নিত্যানন্দ প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হওয়ায় মহাপ্রভুর ধর্ম সহজে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। শ্রীরূপ শ্রীসনাতন রায় রামানন্দ শ্রীনিবাস জীব গোস্বামী কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি লেখকেরা তাঁর মতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের শাখা পরে বাউলদের সঙ্গে মিলিত হয়। মহাপ্রভুর মতবাদ তাঁর সঙ্গে উড়িষ্যায় যায়, বৃন্দাবনেও তাঁর অনুবর্তীদের সঙ্গে যায়। আসাম মাজুলির চারিধামের গোঁসাইরাও বাংলার ভাবই প্রচার করিয়াছেন।
আসামের শংকরদেবের মহাপুরুষিয়া মত আরও একটু উদার। তার কারণ শংকরদেব নিজে কায়স্থ ছিলেন। সামাজিক দৃষ্টি তাঁর অনেকটা উদার ছিল। তাঁর নাগা মিকির ও মুসলমান শিষ্য ছিল। দেবদেবী পূজা, মন্দিরে গমন, প্রসাদ ভোজন তাঁর মতে মিথ্যাচার। ইঁহাদের মধ্যে শূদ্রেরও ব্রাহ্মণ শিষ্য আছে।
বৃন্দাবন হইতে মহাপ্রভুর ধর্ম ভারতে অনেক দূরে ছড়ায়, বৃন্দাবনের তাৎকালিক সকল বৈষ্ণব-আন্দোলনে গৌড়ীয় ভাবের প্রভাব দেখা যায়। তাহা ছাড়া রাজপুতানার বৈষ্ণবদের উপরও চৈতন্য-মতের বেশ প্রভাব লক্ষিত হয়। সূরত জেলায় বলসার প্রভৃতি স্থানের বানিয়াদের মধ্যে সুদূর পাঞ্জাবে ডেরা-ইস্মাইল খাঁ বাসীদের মধ্যেও গৌড়ীয় ভাবের বৈষ্ণব দেখিয়াছি। তাঁহারা বৃন্দাবন ও নবদ্বীপকে মহাতীর্থ মনে করেন। তাঁহারা ভক্তিভাবে দু একটি গৌড়ীয় পদকীর্তনও করেন।
বল্লভাচার্যের মতকে পুষ্টিমার্গও বলে। গুজরাত ও কচ্ছেই ইহার বেশি প্রচার। দক্ষিণ-ভারত হইতে বিষ্ণুস্বামিবংশীয় লক্ষণ ভট্ট উত্তরে আসেন। বল্লভ তাঁরই পুত্র। কাশীতে ১৪৭৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। ইঁহারা রাজসিক ভাবে রাধাকৃষ্ণ ভগবানের পূজা ও সেবা করেন।
ইঁহার পুত্র বিল গদ্যরচনার সুলেখক ছিলেন। বল্লভের চারি শিষ্য ও বিলের চারি শিষ্য, এই আটজন কৃষ্ণভক্তির প্রচারক কবি ছিলেন। ইঁহাদিগকে অষ্টছাপ বলে। বিখ্যাত অন্ধ কবি সূরদাস এই বল্লভের চারি শিষ্যের একজন ছিলেন। তাঁর ছয় ভাই মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা যান। ইনি অন্ধ বলিয়া যুদ্ধ করিতে অক্ষম ছিলেন, পরে ভক্ত কবি হন। কেহ কেহ বলেন ইঁহার পিতা বাবা রামদাস আকবরের সভায় গায়ক ছিলেন।
সৈয়দ ইব্রাহিম (১৬১৪ খ্রীষ্টাব্দে জীবিত) বৈষ্ণবভাবে ও পদাবলীতে মুগ্ধ হইয়া বৈষ্ণব হন এবং ভক্তিতে ভরপূর পদাবলী রচনা করেন। তাঁর তখন নাম হয় রসখান। তাঁর শিষ্য কাদির বক্ষ্ ও ভক্তির কবিতায় হৃদয়ের প্রেমভাব প্রকাশ করিয়াছেন। বল্লভ-সম্প্রদায়ের বৃন্দাবনবাসী ব্রজবাসী দাসের ‘ব্রজবিলাস’ (১৭৭০) কৃষ্ণভক্তির একটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
বল্লভ-সম্প্রদায়ে নানাবিধ বিকার ও ব্যভিচার প্রবেশ করিল। তাহারই প্রতিবাদ- স্বরূপে ১৭৩০ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীতে চরণদাস তাঁর সম্প্রদায় প্রবর্তন করেন। তাঁহার মতামত অনেকটা কবীরের মতানুযায়ী। দারা শিকোহের ভাবেও তিনি কতকটা অনুপ্রাণিত ছিলেন।
১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে অযোধ্যা গোণ্ডা জেলায় ছপৈয়া বা ছিপয়া গ্রামে সহজানন্দের জন্ম হয়। এক চামারের কাছে কিছু উপদেশ পাইয়া সহজানন্দ ধর্মের সরল সহজ রূপ উপলব্ধি করেন এবং বিশুদ্ধ ধর্ম প্রচারে প্রবৃত্ত হন। তিনি বল্লভের সম্প্রদায়ের সব ব্যভিচার দূর করিয়া স্বামী নারায়ণী-সম্প্রদায় স্থাপন করেন। ইহার প্রধান স্থান গুজরাত বড়তালে কাঠিয়াওয়াড় গঢ়ড়ায় ও মূলীতে। ইহাতে নিম্নবর্ণেরও সাধনার অধিকার আছে। ইহাতে মুসলমানও গৃহীত হইয়াছে। গঢ়ড়ায় এখনো আড়াইশ ঘর খোজা মুসলমান এই ধর্মে আছে। গুজরাত বড়তালের মঠ ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত।
সনকাদি সম্প্রদায় হইতে রাধাবল্লভী সম্প্রদায়ের উদ্ভব। তান্ত্রিকদের মত তাঁহারা শক্তিকে পুরুষ অপেক্ষা বড় মনে করেন। তাই তাঁহাদের রাধা আগে, কৃষ্ণ পরে। ভক্ত হিত-হরিবংশ বৃন্দাবনে ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই সম্প্রদায় প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশেও তান্ত্রিকতার সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম মিশিয়া গিয়া নানাবিধ মতবাদের উদ্ভব হয়। তান্ত্রিক বৈষ্ণবেরা চণ্ডীদাস নিত্যানন্দ ও বীরভদ্রাদির নাম যতটা করেন, মহাপ্রভু চৈতন্যের নাম ততটা করেন না। সেইসব তান্ত্রিকতার প্রভাব রাধাবল্লভী মতবাদের উপর থাকিতে পারে। মহাপ্রভুকে বরং অনেকটা এই সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিয়া কাজ করিতে হইয়াছে। এই সম্প্রদায়ের কবি নাগরীদাসকে অনেকে গৌড়ীয় চৈতন্য-সম্প্রদায়ী মনে করেন।
বাংলাদেশের প্রভাবে বৃন্দাবনে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে হরিদাসী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। ইহাতে গৌড়ীয় ভাবের প্রাধান্যই লক্ষিত হয়। এই সম্প্রদায়ে বিল বিপুল, বিহারিণী দাস, সহচরীশরণ (১৭৬৩) প্রভৃতি নেতা জন্মগ্রহণ করেন। হরিদাসী মঠের টট্টী সম্প্রদায়ের বিখ্যাত কবি শীতল স্বামীর জন্ম হয় ১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দে।
মীরাবাঈ যদিও রবিদাসের শিষ্য বলিয়াই খ্যাত তবু বৃন্দাবনের জীব গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার কথা আছে। অনেকে মনে করেন তাঁর উপর গৌড়ীয় মতের প্রভাব কতক পরিমাণে ছিল। এ কথা বিচারসাপেক্ষ। এখানে স্থানাভাব, কাজেই উল্লেখ মাত্র করিয়া কথাটা রাখিয়া দিলাম।
মহারাষ্ট্রের তুকারামের নাম এখানে করা উচিত। তিনি শাস্ত্র ও সংস্কৃতি ছাড়িয়া ভাষায় সহজভাবে প্রেম ও সুনীতি সকলের হৃদয়ে প্রচার করিয়াছেন। কেহ বলেন, তিনি ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে জন্মগ্রহণ করেন, কাহারও মতে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। তিনি শূদ্র। তাঁর পিতা শস্য বিক্রয় করিতেন। পাণঢরপুরের বিঠোবার তিনি ভক্ত। কেহ কেহ বলেন বাংলার চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের সহিত তাঁহার যোগ ছিল। কারণ তাঁর গুরু কেশবচৈতন্য বা বাবাজিচৈতন্য। নামদেবের প্রভাবে তাঁহাতে প্রভূত পরিমাণে লক্ষিত হয়। তাঁহার রচিত ‘অভঙ্গ’ সে দেশের ভক্তদের মুখে মুখে।
মহারাষ্ট্রে নামদেবেরও খুব প্রভাব। তিনি জাতিতে ছিলেন দরজী। পাঢরপুরে তাঁর স্থান। সাধারণ মতে ১৪০০-১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর সময়। এই ধর্মের প্রভাব মহারাষ্ট্র হইতে পাঞ্জাবে যায়, পাঞ্জাব বাঁটালার নিকট ঘোমান গ্রামে তাঁহাদের মঠ দেখিয়াছি।
পাঞ্জাবের ঘোমান মঠের মত অনুসারে নামদেবের জন্ম ১৩৬৩ খ্রীষ্টাব্দে। বোম্বাই সাতারার নরসি-বামনি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর গুরু মহারাষ্ট্রের লোকবিশ্রুত গুরু জ্ঞানেশ্বর। নামদেব বিবাহিত গৃহস্থ ছিলেন। পঞ্চাশ বৎসর বয়সে সংসার ত্যাগ করিয়া ভারতের নানাস্থানে ভ্রমণ করেন ও সাধকদের সঙ্গে পরিচিত হন। হরিদ্বারে তাঁহার মন বসিল না। শেষে ঘোমানে গিয়া বাস করিলেন। ফিরোজ শাহ তোগলকের (১৩৫৫- ১৩৮৮ খ্রী) সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। সৈয়দ বংশের শেষ রাজা আলম ১৪৪৬ খ্রীষ্টাব্দে নামদেবকে মঠের জন্য ভূমি বৃত্তি দেন; জলাশয় খনন করাইয়া দেন, এবং মঠটি তৈয়ার করাইয়া দেন। ১৪৬৪ খ্রীষ্টাব্দে নামদেব ঐখানেই দেহত্যাগ করেন। নামবেদীয়দের মতে বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্য বিষ্ণুস্বামী তাঁর শিষ্য। বিষ্ণুস্বামী, কেশবদাস, বোহরদাস জল্লো, লড্ডা প্রভৃতি ভক্ত তাঁর সমাধিমন্দির তৈয়ার করাইয়া দেন। বোহরদাসের বংশীয়রাই এখন ঘোমানে মঠের সেবক ও আচার্য। গুরুদাসপুর জেলায় বাবা নামদেবী সম্প্রদায়ে অনেকেই বোহরদাসের বংশীয়। মন্দিরের আয়ে দরিদ্রদের সেবা করা হয়। মঠে নামদেবের বাণী বলিয়া একখানি দুইশত বৎসরের হস্তলিখিত পুঁথি আছে। পুঁথিখানির ঊনত্রিশটি পৃষ্ঠা। ভাষা মহারাষ্ট্রী গন্ধযুক্ত হিন্দী। এই মঠে গ্রন্থ-সাহেবের ও আদর আছে। শিখদের মত ইহারা কৃপাণকে পবিত্র মনে করেন না ও মন্দিরে কৃপাণ স্পর্শ করেন না। নামদেবের জন্মতিথি শ্রীপঞ্চমীতে; মাঘের পয়লা-দোসরা তারিখে ও জন্মাষ্টমীতে ঘোমানে নামদেবের স্থানে মেলা হয়। মাঘমাসের মেলায় সেখানে বহুলোক সমবেত হয়।
‘গ্রন্থ-সাহেবে’ নামদেবের পদ গৃহীত হইয়াছে। এই দরজী নামদেব ছাড়া এক ছিপি বা বস্ত্রছাপ-দেওয়া ব্যবসায়ী নামদেব ভক্ত আছেন, তাঁর স্থান বুলন্দ শহরে। মারবারে আর এক নামদেব হইয়া গিয়াছেন। তিনি ছিলেন জাতিতে তূলাধুনকর। এঁরা সবাই ভক্ত ও অনেক ভক্ত সাধক ইঁহাদের অনুরাগী।
মহারাষ্ট্র ভক্তদের নাম আরও অনেক আছে। সব এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। তবু শিরজির গুরু সমর্থ রামদাস স্বামীর নাম না করিলে অন্যায় হইবে। শিরজিকে সহায় রূপে পাইয়া হিন্দু আদর্শ পুনঃ স্থাপনের একটি বড় সুযোগ রামদাস পাইলেন। হিন্দুধর্মের জন্য গৃহীতব্রত হইলেও মুসলমান ধর্মের প্রতি শিরজির যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল, মুসলমান সাধকদের প্রতি ও মুসলমান সাধনা-স্থানের প্রতি তাঁর কর্তব্য কখনো তিনি অসম্পূর্ণ রাখেন নাই।
গুজরাতের নর্সী মেহেতার কথা এতক্ষণ বলা হয় নাই। জুনাগড়ে ১৪১৩ খ্রীষ্টাব্দে ইঁহার জন্ম ও ১৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু। ইঁহার চমৎকার প্রেমভক্তি পদে গুজরার সৌরাষ্ট্র কচ্ছের ভক্তদের হৃদয় সরস হইয়া আছে। নাগর ব্রাহ্মণ-বংশে ইঁহার জন্ম।
ইহা ছাড়া গুজরাতের কয়েকজন ভক্তের কথা এখানে বলা উচিত। আখো ভগত (১৬১৩-১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দ) জাতিতে ছিলেন স্বর্ণকার। আমেদাবাদের তাঁর স্থান। পূর্বে বৈষ্ণব ছিলেন পরে বেদান্তী হন। ইঁহার রচিত বহু পদ আছে।
নিঙ্কুলানন্দ ছিলেন কাঠিয়াওয়াড় গঢ়ড়াবাসী। ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। জাতিতে তিনি ছুতার। স্বামী নারায়ণ-সম্প্রদায়ে সাধনা লাভ করিয়া উত্তম পদ রচনা করেন।
মুক্তানন্দ স্বামী নারায়ণী। ইনি সহজানন্দের শিষ্য। ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর গঢ়ড়ায় মৃত্যু। ভক্ত দয়ারাম বড়োদার অন্তর্গত দাভোই নগরে ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন; ১৮৫ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান।
ভক্ত প্রীতম দাস গুজরাত চরোতর সংদেশর গ্রামে ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান ছিলেন।
ভোজো ভগত কাঠিয়াওয়াড় জেতপুরের নিকট দেবকীগালোড় গ্রামে ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে জন্মিয়া ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন।
ব্রহ্মানন্দ জাতিতে বারোট। ডুংগরপুর পরগনায় সাণ গ্রামের অধিবাসী; ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। স্বামী নারায়ণ-সম্প্রদায়ে সাধনা করেন।
ধীরো ভগত বড়োদার কাছে সাবলী গ্রামবাসী। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
বাপু ভকত মীয়া গ্রামবাসী ধীরো ভগতের শিষ্য। ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দে ইঁহার মৃত্যু। ইঁহাদের রচিত পদ গুজরাত কাঠিওয়াড়ের ভক্তদের হৃদয়ে প্রেমভক্তি জাগ্রত রাখিতেছে।
ব্রহ্মানন্দ, দেবানন্দ প্রভৃতি স্বামী নারায়ণী-সম্প্রদায়ের সাধুরা মুসলমান, চামার প্রভৃতি অন্ত্যজ জাতিকে সাধনা দিয়াছেন। ইঁহাদের কৃপায় দীনহীনদের ঘরে ভগবদ্ভক্তি ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
ইহা ছাড়া গুজরাতের আরও যে কয়জন সমর্থ উপদেষ্টা সাধকের নাম করা উচিত তাঁহাদের উল্লেখ করা যাউক :
সন্তরাম সাধক, ইঁহার স্থান নদীয়াদে। শাখা উমরেঠ ও পাদরায় আছে। ইঁহারা অপৌত্তলিক। মুসলমানও ইঁহাদের মধ্যে সাধনা গ্রহণ করিতে পারেন।
মাধবগর ভক্ত ৮২৪ সালের কাছাকাছি নদীয়াদে ছিলেন। ইনি সম্প্রদায় মানিতেন না। নামরূপহীন ব্রহ্মস্বরূপ উপদেশ করিয়াছেন। ইতি আচার সংস্কার মুক্ত। সুনীতি ও সদাচার বিনা সাধনা চলে না এই তাঁর মত ছিল।
লক্ষ্মণগরের উপদিষ্ট ভক্তিমার্গের সাধকও গুজরাতে আছেন। কুবের নামে কোলি জাতীয় একজন ভক্ত অল্পদিন পূর্বে ছিলেন। সারসা গ্রামে তাঁর বাড়ি। কুবেরের ভক্তিগুণে বহু উচ্চশ্রেণীর লোক তাঁর উপদেশ শিরোধার্য করিয়া সাধনা করিয়াছেন।
সণছোড় দাস ভগত নামে এক বাণিয়া এক ভক্তিপন্থের উপদেশ করেন। ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি জীবিত ছিলেন।
রাম ও কৃষ্ণকে পূর্ণ আদর্শরূপে ধরিয়া যাঁহারা ভারতীয় ধর্মকে শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ করিতে চাহিলেন, তাঁহাদের মধ্যে সকলের আগে নাম করিতে হয় ভক্ত তুলসীদাসের। তাঁর রামায়ণ উত্তর-ভারতের কত ভক্তের হৃদয়কে আজও পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে তাহা বলিয়া বুঝান যায় না। বান্দা জেলার রাজপুরে কনৌজী ব্রাহ্মণ বংশে ১৫৩২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। রামানন্দের সম্প্রদায়ে তিনি ভক্তি-দীক্ষা গ্রহণ করেন। রামানন্দ হইতে তিনি ষষ্ঠপীঢ়ীতে। তাঁহার ‘রামচরিতমানসকে’ অনেকে বাল্মীকি-রামায়ণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ মনে করেন। ভক্তিরসে পবিত্রতায় এই গ্রন্থ ভরপূর। তাঁহার বিনয়পত্রিকার প্রার্থনামালা ভক্তদের অমূল্য ধন।
বাংলাদেশের কৃত্তিবাস ও মহাভারতকার কাশীদাসের কথা এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন। বাংলার ঘরে ঘরে ইঁহারাই প্রাণ দিয়াছেন। তবে এ কথা হয়তো অনেকে জানিতে না পারেন যে, মধ্য-ভারতের রায়পুর ও বিলাসপুর জেলা পর্যন্ত হিন্দুস্থানী কৃষকের ঘরে বাংলা অক্ষরে কাশীদাসী মহাভারত দেখিয়াছি। ভাষা ভাল করিয়া বুঝেন না তবু তুলসী রামায়ণের মত কাশীদাসের মহাভারতখানিও রোজ সযত্নে একটু একটু পড়েন।
ভারতের সকল ভাষায়ই রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতি পুরাণকারেরা প্রভূত উপকার করিয়া গিয়াছেন। কাশীরামদাসের কৃপায় মহাভারত বাংলার যেরূপ প্রতিজনের সুবিদিত এমন আর ভারতের কোথাও নহে। যাত্রা কথকতা রামলীলা প্রভৃতি উৎসব, মেলা তীর্থযাত্রা ভজন কীর্তন সংগীত সৎসঙ্গাদি এ ক্ষেত্রে প্রভূত সহায়তা করিয়াছে।
শৈব ভক্তদের বিষয় এ পর্যন্ত কিছুই বলা হয় নাই। কাশ্মীরে ও হিমালয় প্রদেশে যদিও নকুলীশ পাশুপত বা শৈব শাস্ত্র পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, কিন্তু প্রকৃত শৈব ভক্ত দেখা যায় দক্ষিণে। কাশ্মীরে একাদশ শতাব্দী অভিনবগুপ্তের উপদিষ্ট শৈবদর্শন ও প্রত্যাভিজ্ঞা শাস্ত্রাদির কথা বলার অবসর এখানে নাই। ইঁহার পূর্বেও সিদ্ধ সোমানন্দ প্রভৃতি গুরু ছিলেন। উৎপলাচার্য লিখিত গ্রন্থ প্রভৃতি শুধু পণ্ডিতেরাই পড়িবেন। ভক্তদের জন্য শৈবদের বাণী আছে।
দক্ষিণেও সুপ্রভেদ আগম, স্বায়ম্ভূব আগম, বীর শৈবদের বীরাগম প্রভৃতি প্রচলিত ছিল। চন্নবসব পুরাণে নূতন পুরাতন অনেক শিবভক্তের নাম পাওয়া যায়। কি সংগমেশ্বর শিষ্য মায়িদেবের গ্রন্থ, কি সিদ্ধান্তশিখামণি, কি অষ্টাবিংশতি শৈবাগম, কি উৎপলাচার্য বা মারিতোণ্টদার্যের গ্রন্থ সবই পণ্ডিতদের পঠনীয়, মূর্খ ভক্তরা তার কি জানে? ময়কোণ্ডদেব-লিখিত ‘শৈবজ্ঞানবোধ’ গ্রন্থে দেখা যায় (ত্রয়োদশ শতাব্দী, ১২২৩ খ্রী) প্রায় সব ভক্তই অব্রাহ্মণ। ময়াকাণ্ডদেব সাধারণের মধ্যে শিবভক্তি প্রচার করেন। পরে ‘মরাই জ্ঞানসম্বন্ধ’ কর্তৃক ‘শৈব সময় নেরী’ রচিত হয়। উমাপতি শিবাচার্য চতুৰ্দশ শতাব্দী প্রথমেই ‘শিবপ্রকাশ’ রচনা করেন। পত্তিরাগিরিয়ার, শিববাক্য, পত্তিনাত্তু পিলে, পরণযোধি মুনিয়র, অঘোর শিবাচার্য, শিবযাগিন্ প্রভৃতি সবাই অব্রাহ্মণ, ইঁহারা সবাই ব্রাহ্ম-বিরোধী ও শাস্ত্রনির্দিষ্ট আচার-বিরোধী, প্রতিমার বিরোধী। ইঁহারা বলেন, কোনো আচার বা নিয়মকে ধর্ম বলা চলে না। ধর্ম হইল অন্তরের অনুভবের বস্তু। প্রতিমায় দেববুদ্ধি অতি সংকীর্ণ মতি। শিববাক্য (সপ্তদশ শতাব্দী) বলেন, এই সব কৃত্রিম দেবতা, যাহাদের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব, পূজা-অপূজাও মানুষের আয়ত্ত, তাহারা কি করিতে পারে? তাহারা কেমন করিয়া মুক্তি দিবে? পাষাণে ফুল সাজাইয়া কি ফল? ঘণ্টাবাদনে, বিধিবদ্ধ নিয়মে, প্রদক্ষিণে, ধূপো পূজোপচারে কি ফল? যোগীর ছিয়ানব্বই নিয়মে কি ফল? কায়াকর্ষণে, মন্ত্রে, তীর্থে, গঙ্গাস্নানে কি ফল? মায়া ত্যাগ কর, চিত্ত শান্ত কর, তোমার হৃদয়ে কাশী তরঙ্গিত হইবে। মৃন্ময় প্রতিমা নহে চিন্ময় ঈশ্বরই আরাধ্য।
পত্তিরাগিরিয়ার (দশম শতাব্দী) অতি কাতরভাবে ভগবানকে নিবেদন করিতেছেন, “কবে ইন্দ্রিয় দান্ত হইবে, গর্ব নত হইবে, ক্লান্তি সুষুপ্তিতে শান্ত হইবে?” “লিখিত শাস্ত্রে কি ঈশ্বরানুভব হয়? বহু পাঠেও ভক্তিজ্ঞান হয় কি? কবে শাস্ত্র দগ্ধ করিয়া, দেব অগ্রাহ্য করিয়া, মর্ম উদ্ঘাটন করিয়া পরমানন্দ লাভ করিব? কবে বদ্ধ মীন মুক্ত হইবে? নতনেত্রে ভগবানের চরণতলে গিয়া তাঁর ভাবে কবে নিজ ভাব বিলীন করিব?”
পত্তিনাত্তু পিল্লে বলেন, ‘হাতে গড়া পাষাণে বা তেঁতুলেমাজা তাম্রমূর্তিতে ঈশ্বর নাই। তাঁহাকে অন্বেষণ কর হৃদয়গুহায়, সাধকের হৃদয়-স্বর্গে, মানবপ্রেমে।’
ভারতের নানাভাগের নানামতের ভক্তদের পরিচয় কোনো একখানা গ্রন্থে পাওয়া কঠিন।
বিট্ঠলের পুত্র গোকুলনাথ (১৫৬৮ খ্রী) ‘চৌরাশী বার্তা’ নামে এক গ্ৰন্থ লেখেন। তাহাতে ভক্তজীবনী অপেক্ষা গল্পই বেশি। তারপরেই নাভার ‘ভক্তমাল’। ইনি ১৬০০- তে ছিলেন বলিয়া অনুমিত হয়। ইনি জাতিতে ডোম। বল্লভাচার্য-সম্প্রদায়ের অগ্রদাস ইঁহাকে পাইয়া অনাথ শিশু দেখিয়া পালন করেন। ভক্ত অগ্রদাস ও কীহের কথা বৈষ্ণবমাত্রেই বিদিত। কোনো কোনো মতে নাভা রামানন্দ-সম্প্রদায়ী ছিলেন। তাই হয়তো রামভক্তদের কথা তিনি বেশি লিখিয়াছেন। পরে প্রিয়াদাস যে টীকা করেন তাহাতে তিনি কৃষ্ণভক্তের বিষয় লিখিয়াছেন, কারণ তিনি কৃষ্ণপন্থী মাধ্ব-প্রবর্তিত ব্ৰহ্ম- সম্প্রদায়ের লোক।
‘ভক্তমালে’ ১৬০ জনের উপর ভক্তের চরিত আছে। তার মধ্যে কতক পৌরাণিক। তবু ১৪০ জনের উপর ঐতিহাসিক যুগের ভক্তদের চরিত আছে। যাঁহারা শাস্ত্র মানিয়া চলেন নাই বা সম্প্রদায়ী নহেন এমন অনেক ভক্তের নাম তিনি বড় একটা দেন নাই। রবিদাস ও কবীর নীচজাতি এবং স্বাধীন মতবাদী হইলেও রামানন্দের নিজ শিষ্য বলিয়া তাঁহাদের বাদ দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু ‘ভক্তমালে’ দাদু নানক রজ্জব প্রভৃতি বড় বড় ভক্তের নাম নাই। কারণ তাঁহাদিগকে কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মসাৎ করিয়া লওয়া সহজ নহে। দক্ষিণের শৈব ভক্তদের নাম বোধ হয় ইঁহারা তেমন জানিতেন না। তবু সৌভাগ্যের কথা এই যে, নাভা-রচিত ‘ভক্তমাল’ ছাড়া আরও ‘ভক্তমাল’ আছে, এবং নানা মঠে ও সম্প্রদায়সংগ্রহ-গ্রন্থে যে সব ভক্তদের চরিত রক্ষিত আছে তাহা সযত্নে সংগ্রহ করিলে ভারতের মধ্যযুগের সাধকদের চমৎকার ইতিহাস রচিত হইতে পারে।
‘ভক্তমালে’ যে সব শাস্ত্র বা আচারবাদী ভক্তের কথা লেখা হইয়াছে, তাঁহাদের নাম আর এখানে করিলাম না। ‘ভক্তমাল’ খুবই চলিত গ্রন্থ। যে কেহ তাহা দেখিয়া লইতে পারেন। পারসী ভাষায় রচিত কিছু কিছু উপাদানও আছে। ‘দবীস্তান’ পুস্তক হইতেই উইল্সন সাহেব তাঁহার ভারতীয় ধর্ম সম্বন্ধে বিখ্যাত পুস্তকখানি লিখিয়াছেন। তামিল ভক্তদের সম্বন্ধেও অনেক গ্রন্থ আছে। পূর্বে দুই একখানি পুস্তকের নাম করা হইয়াছে। সেরূপ পুস্তক আরও আছে। ভবিষ্যৎ যুবক সত্যান্বেষীরা এই সব উপকরণ সংগ্রহ করিয়া ভারতীয় সাধনার পরিচয় দিবার কাজ পূর্ণ করিবেন এই আশা মনে রাখি।
এই কয়জন মুসলমান ও হিন্দু ভক্তের কথা বলিয়া বর্তমান অধ্যায় সমাপ্ত করিব। ইহার শেষদিকে দুই-এক জন হিন্দু-শাস্ত্র না-মানা ভক্তের নামও আসিয়া পড়িয়াছে। তবু প্রধানতঃ তাঁদের কথাই বলা গেল যাঁহারা শাস্ত্র ও নিয়ম মানিয়া চলিয়াছেন, যাঁহারা প্রচলিত সামাজিক চিহ্ন ও আচার মানেন। তাই তাঁদের পণ্ডিতেরা বলেন ব্যক্তলিঙ্গাচার। বে-শরা, বে-ডুরী বা অব্যক্তলিঙ্গাচারদের কথা পরবর্তী অধ্যায়ে বলা যাইবে।