পরিশিষ্ট – মহাপ্রভুর অভিনয়লীলা

পরিশিষ্ট – মহাপ্রভুর অভিনয়লীলা

যাহার লীলা দেখাইতে হইবে তাহার দ্বারা আবিষ্ট হওয়াই হইল অভিনয়ের মর্মকথা। এই আবিষ্ট হইবার অসাধারণ শক্তি মহাপ্রভুর ছিল। কবিরাজ গোস্বামীর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে আছে, পুরীধামে মহাপ্রভুকে দেখিবার জন্য গৌড়ীয় ভক্তগণ সমাগত। সেই উপলক্ষে কৃষ্ণজন্মযাত্রাদিনে মহাপ্রভু নন্দমহোৎসবের আয়োজন করিলেন এবং সেই উৎসবে গোপবেশে ধারণ করিয়া ভাবের আবেশ সেই লীলার অপরূপ অভিনয় করিলেন।

কৃষ্ণজন্মযাত্রা দিনে নন্দ মহোৎসব।
গোপবেশ হৈলা প্ৰভু লৈয়া ভক্তসব ॥
দধিদুগ্ধভার সবে নিজ স্কন্ধে করি।
মহোৎসব-স্থানে আইলা বলি হরি হরি।।
কানাই খুঁটিয়া আছে নন্দবেশ ধরি।
জগন্নাথ মাহিতী হৈয়াছেন ব্রজেশ্বরী ॥

অদ্বৈত কহে সত্য করি না করিহ কোপ
লগুড় ফিরাইতে পার তবে জানি গোপ ॥
তবে লগুড় লঞা প্রভু ফিরাইতে লাগিলা।
বারবার আকাশে ফেলি লুফিয়া ধরিলা ॥
পরম আবেশে প্রভু আইলা নিজ ঘর।
এইমত লীলা করে গৌরাঙ্গ সুন্দর ॥
বিজয়াদশমী লঙ্কাবিজয়ের দিনে।
বানরসৈন্য হৈল প্রভু লঞা ভক্তগণে ॥
হনুমানবেশে প্রভু বৃক্ষশাখা লঞা।
লঙ্কার গড়ে চড়ি ফেলে গড় ভাঙ্গিয়া ॥১

[১. চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্য, ১৫শ।]

এইসব বিবরণে দেখা যায়, মহাপ্রভু যখন কোনো পৌরাণিক ভাবের দ্বারা আবিষ্ট হইতেন তখন নিজের সত্তা পর্যন্ত ভুলিয়া যাইতেন। অভিনয়ের পক্ষে এরূপ ভাবাবিষ্ট হইতে পারা একটা খুব বড় কথা। কাজেই বুঝাই যায় মহাপ্রভু চমৎকার অভিনয় করিতে পারিতেন।

এই বিষয়ে অনুমান বা কল্পনার কোনো প্রয়োজন নাই। সেই যুগের বিশ্বাসযোগ্য ভক্তগণের লেখা হইতেই এই বিষয়ে নিঃসন্দেহে প্রমাণ মিলিতে পারে।

মহাপ্রভুর অভিনয়বিষয়ে কবিকর্ণপূর বিশেষ তথ্য দিয়াছেন তাঁহার চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকে। চৈতন্যচরিত সম্বন্ধে কবিকর্ণপূরের বলিবার অধিকার ছিল অসামান্য। তিনি মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ শিবানন্দের পুত্র; মহাপ্রভুকে স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, বাল্যকালে তাঁহার স্নেহ ও কৃপা লাভ করিয়াছেন। মহাপ্রভুর তিরোধানের পরেও মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গগণের সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, তাই চৈতন্যচন্দ্রোদয়ের উপসংহারে কবিকর্ণপূর বলেন, বাল্যকালে যাঁহার কৃপালাভ করিয়াছি সেই শ্রীচৈতন্যের কথা যেমনটি দেখিয়াছি বা শুনিয়াছি তাহাই তাঁহার কৃপায় যথামতি এই গ্রন্থে একটুখানি প্রকটিত করিলাম—

শ্রীচৈতন্যকথা যথামতি যথাদৃষ্টং যথাবৰ্ণিত
জগ্রন্থে কিয়তী তদীয়কৃপায় বালেন যেয়ং ময়া।

‘মহাপ্রভুর তিরোধানের পরে তাঁহার অনুরাগী ভক্তগণের মধ্যে বাস করিয়া তাঁহাদের দর্শন ও কৃপা লাভ করিয়াছি।

দৃষ্টা ভাগবতাঃ কৃপাপ্যুপগতা তেষাং স্থিতং তেষু চ।

কবিকর্ণপূর তাঁহার নাটকে বাংলাদেশের সাধনার মর্মকথাটি হঠাৎ বলিয়া ফেলিয়াছেন। প্রেম বলিতেছেন, ‘সহজভাবই আপনা হইতে বলবান। যতই চেষ্টা কর না কন কৃত্রিম ভাবকে সে হটাইয়া দিবেই।’

স্বতো বলীয়ঃ সহজো হি ভাবঃ
স কৃত্রিমং ভাবমধঃ করোতি ॥১

[১. ৩য় অঙ্ক।]

কাজেই জ্ঞান ও বিদ্যা হইতে তিনি প্রেম ভক্তিকেই বড় মনে করেন। কবিকর্ণপূর বলেন, ‘হরিভক্তিই বিদ্যা, বেদাদি শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য বিদ্যা নহে।’

ক বিদ্যা হরিভক্তিরেব ন পুনর্বেদাদিনিষ্ণাততা। ২

[২. ৭ম অঙ্ক।]

মহাপ্রভুর সময়ে ভক্ত সাধকদেরও মত ছিল বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি নয়। তাঁহারাও চাহিয়াছিলেন—

অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। …
ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার।
যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে।
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।
মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বালিয়া,
প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।

রামানন্দ মুখে কবিকর্ণপুর শুনাইতেছেন—

আস্থা তস্য প্রণয়রভসস্যোপদেহে ন দেহে
যেষাং তে হি প্রকৃতিসরসা হন্ত মুক্তা ন মুক্তা ॥১

অর্থাৎ বাহ্য বস্তুতে নয়, তাঁহার প্রেমানন্দ রসাস্বাদনেই যাহাদের অনুরাগ সেই সব প্রকৃতিসরস অর্থাৎ স্বভাব প্রেমিকেরাই মুক্ত। যাঁহাদের লোকে মুক্ত মনে করে সেইসব বৈরাগ্যপরায়ণ শুল্ক যোগী তপস্যাচারীরা তো মুক্ত নহেন।”

এইসব মত যে তখন শুধু কবিকর্ণপূরেরই ছিল তাহা নহে; তখন সকল ভক্তগণেরই এইরূপ মতামত ছিল। তাই নাটকের সমাপ্তিবাক্য কবিকর্ণপূর বলেন—

দৃষ্টা ভাগবতাঃ কৃপাপ্যুপগতা তেষা স্থিতং তেষু চ,
জ্ঞাতং বস্তু বিনিশ্চিতঞ্চ কিয়তা প্রেম্লাপি তত্রাসিতম্।

ইহার অনুবাদও বৈষ্ণব ভক্তগণের অনুবাদগ্রন্থ হইতেই দেওয়া যাউক–

চৈতন্যের সঙ্গে যত        মহা মহা ভাগবত,
তাঁ সভারে সাক্ষাতে দেখিনু।
আমা অভাগার প্রতি      কৃপা তাঁরা কৈল অতি
তাঁর সঙ্গে নিবাস করিনু ॥
সঙ্গে থাকি তাঁ সাভার      বস্তু বিনিশ্চয় তাঁর
তত্ত্বজ্ঞান হইল আমার। ২

এই অনুবাদটি প্রেমদাসের। ইঁহার পূর্ব নাম ছিল শ্রীপুরুষোত্তম মিশ্ৰ। ইনি ১৭১২ খ্রীঃ চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকের বাংলা অনুবাদ করেন।

ষোলশত চৌত্রিশ শকে     লৌকিক ভাষাতে সুখে
প্রেমদাস করিল লিখন। ৩

১২৯২ সালে আহিরীটোলা হইতে মহেশচন্দ্র শীল এই গ্রন্থখানি মুদ্রিত করেন। কবিকর্ণপূরের মতামত বৈষ্ণবসমাজে অতিশয় মান্য। চৈতন্যচরিতামৃত রচয়িতা কবিরাজ গোস্বামীও প্রমাণরূপে কবিকর্ণপূরের নাম ব্যবহার করিয়াছেন।

শিবানন্দ সেনের পুত্র কবিকর্ণপূর। রূপের মিলন গ্রন্থে লিখিয়াছেন প্রচুর ॥ এইমত কর্ণপূর লিখে স্থানে স্থানে।

প্রভু কৃপা কৈল যৈছে রূপসনাতনে ॥৪

[১. ৭ম অঙ্ক।

২. পৃ. ২৫০।

৩. পৃ. ২৫১।

৪. চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্য, ১৯শ।]

কাজেই কবিকর্ণপূরের মতামত তখনকার দিনের সর্ববৈষ্ণবাচার্যগণের মান্য। সেইসব মহাভক্ত সাধক বৈষ্ণবাচর্যগণ গৌরচন্দ্রের নৃত্যে গীতে অভিনয়ে আসক্তি দেখিয়া তাঁহাকে জাহান্নমে পাঠান নাই। কবিকর্ণপূর দেখাইয়াছেন, “বক্রেশ্বর পণ্ডিত যখন নৃত্য করেন তখন করতালি-সহকারে শ্রীগৌরাঙ্গ গলা ছাড়িয়া গান করেন, আর গৌরচন্দ্র যখন নৃত্য করেন তখন সমান আনন্দে গান করেন বক্রেশ্বর।“

বক্রেশ্বরে নৃত্যতি গৌরচন্দ্রো
গায়ত্যমন্দং করতালিকাভিঃ
বক্রেশ্বরো গায়তি গৌরচন্দ্রে।
নৃত্যত্যসৌ তুল্যসুখানুভূতিঃ ॥১

মহাপ্রভু যখন পুরীধামবাসী তখন একদিন তাঁহার কাছে প্রদ্যুম্ন মিশ্র নামে এক ব্রাহ্মণ আসিয়া কৃষ্ণকথা শুনিতে চাহিলেন। মহাপ্রভু তাঁহাকে রায় রামানন্দের কাছে পাঠাইলেন। একে রায় শূদ্র, তাহার উপর মিশ্র গিয়া শুনিলেন, রায় রামানন্দ ‘বয়সে কিশোরী’ ‘পরমাসুন্দরী’ নৃত্যগীতে সুনিপুণ দুইটি কন্যাকে নিভৃত উদ্যানে লইয়া নিজ নাটকের গীত তাহাদের নৃত্যে মূর্তিমান করিয়া তুলিতেছেন। তাহাদের সাজসজ্জা প্রসাধনও রামানন্দই করেন।

তাঁহা দোঁহে লৈয়া রায় নিভৃতে উদ্যানে।
নিজ নাটকের গীত শিখায় নর্তনে ॥
স্বহস্তে করান স্নান গাত্র সম্মার্জন।
স্বহস্তে পরান বস্ত্র সর্বাঙ্গ মণ্ডন ॥২

কিন্তু ভক্তিপূত রায়ের মন নির্বিকার।

তবু নির্বিকার রায় রামানন্দের মন।৩

রামানন্দ কল্যাবিদ্যায় নিষ্ণাত। তাই রায় –

তবে সেই দুইজনে নৃত্য শিখাইল।
গীতের গূঢ় অর্থ অভিনয় করাইল ॥
সঞ্চারী সাত্ত্বিক স্থায়ী ভাবের লক্ষণ।
মুখে নেত্রে অভিনয় করে প্রকটন ॥৪

রায় শূদ্র বলিয়াও বোধহয় মিশ্র বিরূপ ছিলেন। তারপর এই সব ব্যাপার। দেখিয়া শুনিয়া প্রদ্যুম্ন মিশ্র রায়ের কাছে কৃষ্ণ কথা না শুনিয়াই ফিরিয়া আসিয়া মহাপ্রভুকে সব কথা জানাইলেন।

শুনি মহাপ্রভু তবে কহিতে লাগিলা।
রামানন্দের রায়ের কথা শুনে সর্বজন।
কহিবার কথা নহে আশ্চর্য কথন ॥
একে দেবদাসী আর সুন্দরী তরুণী।
তার সব অঙ্গ সেবা করায় আপনি ॥
রাগানুগা মার্গে জানি রায়ের ভজন।
সিদ্ধ দেহ তুল্য তাতে প্ৰাকৃত নহে মন ॥
আমিও রায়ের স্থানে শুনি কৃষ্ণকথা।
শুনিতে ইচ্ছা হয় যদি পুনঃ যাও তথা ॥৫

]১. চৈতন্যচরিতামৃত, ৪র্থ অঙ্ক।

২-৪. চৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্য, ৫।

৫. চৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্য ৫।]

তখন প্রদ্যুম্ন মিশ্রকে আবার রামানন্দের কাছে যাইতে হইল। সেদিন ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণকথা শুনিয়া মিশ্র মুগ্ধ হইলেন। মহাপ্রভুকে বারবার এইজন্য ধন্যবাদ জানাইলেন।

মিশ্র কহে প্রভু মোরে কৃতার্থ করিলা।
কৃষ্ণকথামৃতার্ণবে মোরে ডুবাইলা ॥
রামানন্দ রায় কথা কহিলে না হয়।
মনুষ্য নহে রায় কৃষ্ণভক্তি রসময় ॥২

কাজেই নৃত্যগীত অভিনয়ে যেমন কলাবান ও রসজ্ঞ ছিলেন মহাপ্রভু তেমনি ছিলেন রায় রামানন্দ প্রভৃতি প্রভুর অন্তরঙ্গের দল। প্রবীণ অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দ প্রভৃতিও এই সব বিষয়ে কম রসিক ছিলেন না।

বৃদ্ধ ভক্ত অদ্বৈতাদি সুহৃদ্‌গণেরও মণ্ডলে বেষ্টিত হইয়া প্রেমের সিন্ধু যতীন্দ্র শ্রীগৌরাঙ্গ পুনঃপুনঃ নৃত্যানন্দে প্রেমরসে নিমজ্জিত থাকিতেন।

অদ্বৈতাদ্যৈরখিলসুহৃদাং মন্ডলৈমন্ড্যমানো।
সিন্ধুঃ প্রেন্নায়মিহ নরীনর্তি গৌরো যতীন্দ্রঃ ॥১

নৃত্যগীত অভিনয় করা সত্ত্বেও শ্রীগৌরাঙ্গকে এইসব বৈষ্ণবাচৰ্যগণ যতীন্দ্ৰ বা সাধকশ্রেষ্ঠ বলিতে সংকুচিত হন নাই। মহাপ্রভু তাঁহার প্রেমরসরসিক মিত্রমণ্ডলীকে লইয়া (প্রিয় সম্প্রদায়ৈঃ) নাচিয়া গাহিয়া অভিনয় করিয়া অন্তরের বেদনা উদ্‌ঘোষিত করিয়া ত্রৈলোক্যকে আনন্দসাগরে ডুবাইয়াছেন।

গায়ন্‌ নটন্‌ অভিনয়ন্ বিরুদন্ অমন্দম্।
আনন্দসিন্ধুষু নিমজ্জয়তি ত্ৰিলোককীম্‌ ॥২

শ্রীগৌরহরির প্রেমভক্তি প্রভৃতি অলৌকিক ঐশ্বর্যলীলা চমৎকার। তাহা অপেক্ষাও লোভনীয় হইল তাঁহার এইসব নৃত্যগীত অভিনয়াদির লৌকিকী লীলা। গঙ্গা যখন মহেশশিরে, তখন তিনি পরম পবিত্রা, নির্মলা। কিন্তু সেখান হইতে যখন গঙ্গা ভূতলে অবতীর্ণা তখনই তিনি আনন্দরসের বন্যা যান বহাইয়া। তখনই তাঁহার নাগাল আমরা পাই।

অলৌকিকীতোহপি চ লৌকিকীয়ং
লীলা হরেঃ কান লোভনীয়া।
মহেশশীৰ্ষাদপি ভূমিমধ্য
গতৈব গঙ্গা মুদমাতনোতি ॥৩

[১. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৮ম অঙ্ক।

২. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ১ম অঙ্ক।

৩. ঐ, ২য় অঙ্ক।]

মহাপ্রভুর সেই নৃত্য গীত অভিনয়লীলা দেখিয়া মনে হয়, “ইনিই কি আনন্দে প্রত্যক্ষ মূর্তি, ইনিই কি পরম প্রেমের সাক্ষাৎ বিগ্রহ, ইনিই কি মূর্তিমতী শ্ৰদ্ধা অথবা ইনিই কি স্বরূপিনী দয়া, ইনিই কি মাধুর্যের প্রত্যক্ষরূপ, নববিধাভক্তি ইঁহারই তনুখানিকে আশ্রয় করিয়া প্রত্যক্ষ হইল?”

আনন্দঃ কিমু মূর্তে এষ পরমঃ প্রেমৈব কিং দেহবান্
শ্রদ্ধা মূর্তিমতী দয়ৈব কিমু বা ভূমৌ স্বরূপিণ্যাসৌ।
মাধুর্যং নু শরীরি কিং নববিধাভক্তির্গতৈকাং তনুম্‌ … ১

এই লীলাস্থলে যে ভক্তি আবির্ভূতা, “তিনি অন্তরকে করেন প্রসন্ন, ইন্দ্রিয়গণকে করেন পরিশুদ্ধ। অর্থ বা কামের তো কথাই নাই, মোক্ষকেও দেন তুচ্ছ করিয়া, শুধু সন্নিহিত হইয়াই জীবমাত্রকে আনন্দসিন্ধুর অতল তলে ডুবাইয়া দিয়া সদ্যই করেন কৃতাৰ্থ।”

অন্তঃ প্রসাদয়তি শোধয়তীন্দ্রিয়াণি
মোক্ষঞ্চ তুচ্ছয়তি কিং পুনরর্থকামৌ।
সদ্যঃ কৃতার্থয়তি সন্নিহিতৈব জীবন্
আনন্দসিন্ধুবিবরেষু নিমজ্জয়ন্তী ॥২

এই গৌরাঙ্গ যখন চলিয়া গেলেন তখন জগন্নাথধাম যেন শূন্য হইয়া গেল। সেই নীলগিরি, সেই বৈভব, সেই গুণ্ডিচা বা রথযাত্রা, সেই সব নানা দিগ্‌বদিকের ব্যাকুল তীর্থযাত্রী, সেই সব নন্দনবন হইতেও উৎকৃষ্ট উদ্যান, সবই আছে, কিন্তু মহাপ্ৰভু বিনা সবই যেন শূন্য।

সোহদং নীলগিরীশ্বরঃ স বিভবো যাচা চ সা গুন্ডিচা
তে তে দিগ্বিদিগাগতাঃ সুকৃতিনস্তাস্তা দিদৃক্ষায়ঃ।
আরামাশ্চ ত এব নন্দনবনশ্রীণাং তিরস্কারিণঃ
সর্বাণ্যের মহাপ্রভুং বত বিনা শূন্যানি মন্যামহে ॥৩

[১. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৪র্থ অঙ্ক।

২. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ২য় অঙ্ক।

৩. ঐ, ১ম অঙ্ক।]

কবিকর্ণপূরের চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকের প্রস্তাবনায় দেখি, “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যস্য প্রিয় পার্ষদস্য শিবানন্দসেনস্য তনুজেন নির্মিতং পরমানন্দদাস কবিনা… শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়ং নাম নাটকম্।“

কবিকর্ণপূরের আসল নাম পরমানন্দ। তিনি মহাপ্রভুর পরমপ্রিয় সেন শিবানন্দের তৃতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্র। কাঁচড়াপাড়ায় তাঁহার জন্ম। তাঁহার বয়স যখন সাত বৎসর, তখন মহাপ্রভু তাঁহাকে আদর করিয়া পুরীদাস নাম দেন। মহাপ্রভুরই নির্দেশে বালকের নাম রাখা হইয়াছিল পরমানন্দ। পরমানন্দপুরী মহাপ্রভুর অশেষশ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাই এই বালকের নাম হইল পরমানন্দ দাস।

বাল্যকাল হইতে এই পরমানন্দ দাসের ছিল অপূর্ব প্রতিভা। সংস্কৃতে ও কাব্যরচনায় তাঁহার অসামান্য অধিকার। অলঙ্কারকৌস্তুভ তাঁহার রচনা। চৈতন্যচরিতামৃত নামে এক সংস্কৃত মহাকাব্য তিনি রচনা করেন। গদ্যপদ্যময় আনন্দবৃন্দাবনচম্পূকও তাঁহারই রচিত। এইসব কাব্যই ভারতের সর্বত্র সম্মানিত, কিন্তু তাঁহার সর্বপ্রধান কৃতিত্ব হইল চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক। ১৫৭২ খ্রী. অর্থাৎ ১৪৯৪ শকে তাহা রচিত হয়। গ্রন্থসমাপ্তিতে তিনি বলেন ১৪০৭ শকে গৌরহরি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, এবং ১৪৯৪ শকে অর্থাৎ মহাপ্রভুর তিরোধানের ৩৯ বৎসর পরেই চৈতন্যচন্দ্রোদয় রচনা সমাপ্ত হয়।

শাকে চতুর্দশশতে রবিবাজিযুক্তে
গৌরোহরি ধরণীমন্ডল আবিরাসীৎ।
তস্মিংশ্চতুর্নবতিভাজি তদীয়লীলা।
গ্রন্থোহয়মাবিরবভৎ কতমস্য বক্ত্রাৎ ॥

১০৬৫ খ্রী. কাছাকাছি মধ্যভারতের চন্দেল বংশীয় কীর্তিবর্মার রাজত্বকালে কৃষ্ণমিশ্র প্রবোধচন্দ্রোদয় নামে একখানি রূপক নাটক লেখেন। রূপক নাটক অর্থে এই নাটকে জ্ঞান ভক্তি প্রেম প্রভৃতি মানবীয় চিদ্‌বৃত্তিগুলি মানবরূপ ধারণ করিয়া মানুষের মতো কথাবার্তা অভিনয় প্রভৃতি করিতেছে। এই নাটকখানির সমাদর হইয়াছিল সারা ভারতে। দাসসুকোহ ইহার পারসী অনুবাদ করান।

মৌলবী এ.বি. হবিবুল্লা Indian Historical Quarterly তে ১৯৩৮ সালে মার্চ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ লেখেন Indo Persian Literature। তাতে দেখা যায় ১৬৬২- ১৬৬৩ সালে বনওয়ারীদাস ইহার পারসী অনুবাদ করেন। ইহার ছয় অঙ্ক পারসীতে হইয়াছে ছয় ঘমন। ইহার পারসী নাম গুলজার-ই-হাল। ইংলন্ডের জন বেনিয়ান তাঁহার ‘পিগ্রিম্‌স্‌ প্ৰগেস্‌’এ এই পদ্ধতিই অনুসরণ করিয়াছেন। সারা য়ুরোপে ও আমেরিকায় তাহা সমাদৃত। প্রবোধচন্দ্রোদয় যদিও লেখা হয় মধ্যভারতস্থিত খজ্জুরাহোর রাজদরবারে, তবু কৃষ্ণমিশ্রের বাড়ি ছিল রাঢ়ের ভূরিশ্রেষ্ঠ গ্রামে। বর্ধমানের অন্তর্গত ভূরসুঠ গ্রাম বহু মহাপুরুষের দ্বারা পবিত্রীকৃত। কাজেই রূপক নাটক প্রবর্তনের বিশেষ প্রতিভা দেখা গেল এই বাংলাদেশেই। চৈতন্যচন্দ্রোদয় নামেই মনে হয় ইহাও কতকটা সেই কৃষ্ণমিশ্ররচিত প্রবোধচন্দ্রোদয়েরই আদর্শে লেখা।

চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটকেও ভক্তি মৈত্রী প্রেম প্রভৃতির লীলা দেখিতে পাই। মহাপ্রভুর চরিতলীলা দেখানই নাটকটির উদ্দেশ্য। নাটকের মধ্যে আর একটি নাটক ভরিয়া দিয়া মহাপ্রভুর অভিনয়লীলা দেখান হইয়াছে, মহাপ্রভু অপূর্ব অভিনেতা তেমনই অসাধারণ অভিনয়কলাগুরু। মহাপ্রভুরই পরিচালনায় আচার্যরত্নের পুরাঙ্গনে যে কৃষ্ণলীলার অভিনয় হইয়াছিল, তাহাতে আগাগোড়া সব ব্যবস্থাই পরিচালিত হইয়াছিল মহাপ্রভুর দ্বারা।

দেখিতে পাই প্রশ্ন হইয়াছিল, এই অভিনয় হইবে কোথায় (সোজ্জেব কো পদেসো অর্থাৎ স এব কঃপ্রদেশঃ)? উত্তর হইল, আচার্যরত্নের পুরাঙ্গুণে (আচার্যরত্নন্স পুরাঙ্গণম্)১।

এই নাটকে মহাপ্রভুর নির্দেশে শ্রীমৎ অদ্বৈতাচার্যকে কৃষ্ণের ভূমিকা লইতে হয়।

অদ্বৈতমাপাদয়দ্ ঈশবেশম্। ২

স্বয়ং মহাপ্রভু লইয়াছিলেন শ্রীরাধার ভূমিকা।

স্বয়ঞ্চ রাধাকৃতিমগ্রহীৎ সঃ ॥৩

ইহাতে সেই যুগে একটু আপত্তির মতও উঠিয়াছিল, “ঈশ্বরের অবতার হইয়া কেন তিনি তবে স্ত্রীভাবে নাচিবেন?”

কধং দাব ঈসরো হুবিয় ইত্থীভাবেন ণচ্চিস্সদি।

[১-৪. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৩য় অঙ্ক।]

তাহাতে উত্তর দেওয়া হইয়াছিল, “বাছা, জান না? ভগবান যে সর্বরসের রসিক।”

বালে! ন জানাসি! ঈশ্বরঃ খলু সর্বরসঃ।১

ভক্তদের আশযানুরোধে তাঁহাকে নানা বিচিত্রলীলাই করিতে হয়।

সর্বেষাং ভক্তানামাশয়ানুরোধাদ্ বিচিত্রামেব লীলাং করোতি।২

শুধু অভিনয় নহে, আগাগোড়া নাটকটির প্রয়োগ-পরিচালনও করেন মহাপ্রভু স্বয়ং। তাহাতেই বুঝা যায় এই কলাতে তিনি কত বড় নিপুণ আচার্য ছিলেন। তাঁহারই নির্দেশে হরিদাস হইলেন সূত্রধার, মুকুন্দ হইলেন পারিপার্শ্বিক। বাসুদেব আচার্যকে লইতে হইল নেপথ্যরচনার ভার।

হরিদাসঃ সূত্রধারা মুকুন্দঃ পারিপার্শ্বিকঃ।
বাসুদেবাচার্যনামা নেপথ্যরচনাকরঃ ॥৩

শ্রীরাধাকৃষ্ণসংযোগকারিণী বৃদ্ধা ভগবতী যোগমায়ার অভিনয়ের ভার পড়িল শ্রীনিত্যানন্দের উপরে।

শ্রীরাধাকৃষ্ণসংযোগকারিণী জরতীব সা।
যোগমায়া ভগবতী নিত্যানন্দতনুং শ্ৰিতা ॥৪

শ্রীবাসের কাছে মহাপ্রভুর আদেশ পৌঁছিল, “হে শ্রীবাস, খুব সাবধানে তুমি সবদিক সামলাইবে। ইহাতে যোগ্য রসিকজন ছাড়া কোনো বাজে লোক যেন না প্রবেশ করিতে পারে তাহা সাবধানে দেখিবে।”

হে শ্রীবাস! স্বয়মবহিতেনাদ্য ভাব্যং ত্বয়াস্মিন্
যোগ্যো যঃ স্যাৎ স বিশতি যথা নাপরস্তদ্বিধেয়ম্।

শ্রীবাস বোধহয় এই নাটকের কথা জানিতেন না। তাই আধা বলিতে না বলিতেই শ্রীবাস জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন কর্মে এইরূপ যোগ্যাযোগ্য ব্যবস্থা করিতে হইবে? কোথায় বা প্রবেশ করাইতে হইবে?”

দেব, কস্মিন্ কর্মণি যোগ্যাযোগ্যব্যবস্থা করণীয়া।
কুত্র বা প্রবেশঃ কারয়িতব্যঃ।৫

তখন মহাপ্রভুর কথাই শ্রীবাসের কর্ণে আসিল, স্বয়ং তিনিই রাধার অভিনয় করিবেন। আচার্যরত্নের অঙ্গনভূমিতে দেবীর রসলীলার আবির্ভাব হইবে।

শ্রীরাধাহত্র স্বয়মিহমহো নূনমাচার্যরত্ন—
স্যাবাসসস্যাঙ্গণভুবি রসাব্যক্তমাবির্ভবিত্রী ॥৬

[১–৬. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৩য় অঙ্ক।]

মহাপ্রভু স্বয়ং রাধিকার অভিনয় করিবেন, মনে মনে কিছুতেই ইহা শ্রীবাস বুঝিতে পারিতেছিলেন না। তাঁহার মনের সন্দেহ কিছুতেই ঘুচিতেছিল না। তবু মহাপ্রভুর বাক্যে কৃতনিশ্চয় হইয়া গঙ্গাদাস নামে মহাপ্রভুর পরম বিশ্বাসী ব্রাহ্মণোত্তমকে তিনি দ্বারপালকর্মে নিয়োজিত করিলেন।

ততঃ শ্রীবাসেন মনসি সন্দিহানেন ভগবদ্বচ ইতি
বিহিতনিশ্চয়েনাপি গঙ্গাদাসনামা ভগবতঃ
পরমাপ্তো ভূসুরবরো দ্বারপালত্বেন ন্যয়োজি। ১

শ্রীবাসের প্রতি মহাপ্রভুর আরও হুকুম হইল, “তোমাকে সাজিতে হইবে নারদ।”

শ্রীবাস, ভবতা নারদেন ভবিতব্যম্।২

আর শুক্লাম্বরকে সাজিতে হইবে তোমার স্নাতক।

শুক্লাম্বরেণ তব স্নাতকেন ভাব্যম্ ॥৩

শ্রীরামাদি তোমার তিন সহোদর হইবেন গায়ক।

গাথকা : শ্রীরামাদয়স্তব সহোদরাস্ত্রয়ঃ ॥৪

আচার্যরত্ন এবং বিদ্যানিধি তাঁহার দ্বারই নিয়োজিত হইয়াছিলেন।

আচার্যরত্নবিদ্যানিধী চেতি দেবেনৈব নিয়োজিতাঃ।৫

ইঁহাদের ছাড়া আর কাহারও সেখানে প্রবেশের অধিকার রহিল না। কিন্তু শ্রীবাস ও তাঁহার সহোদরদের বধূগণকে ও আচার্যরত্ন মুরারি প্রভৃতির বধূগণকে আগেই অভিনয়স্থলে প্রবেশ করাইয়া বসান হইয়াছিল। তাঁহারা এই রসের রসিক, তাই তাঁহাদের এই অভিনয়লীলা-রসাস্বাদনের অধিকার বিষয়ে সন্দেহ করিবে কে?

অতঃপরং ন কেষামপি তত্র প্রবেশঃ। কিন্তু শ্রীবাসাদি
সহোদরবধূভিঃ সহাচার্য রত্নমুরারিবধূ প্রভৃতয়ঃ প্রাগেব
তত্র প্রবিশ্য স্থিতা অধিকারভাজশ্চ তাঃ ॥

কাজেই দেখা যায়, মেয়েদেরও কেহ কেহ রসজ্ঞ সামাজিকরূপে সেই মণ্ডলীতে স্থান পাইয়াছিলেন।

মহাপ্রভুর এই অভিনয়ের সজ্জা ও নৈপুণ্য কেমন ছিল তাহা চৈতন্যচন্দ্রোদয়ের তৃতীয় অঙ্কেই সুন্দর বর্ণিত আছে।

ভক্তপ্রেমদাস বাংলাভাষায় যে অনুবাদ করেন তাহা হইতেও কিছু কিছু উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করিতেছি—

মৈত্রী কহে সে নৃত্য হৈব কার ঘরে।
ভক্তি কহে শ্রীআচার্যরত্নের মন্দিরে ॥
মৈত্রী কহে যদি তেহঁ হেন সর্বেশ্বর।
স্ত্রীভাবে তাঁহার নৃত্য বুঝিতে দুষ্কর ॥
প্রেম বলে বালা তুমি জ্ঞান নাহি হয়।
যে হন ঈশ্বর তিহঁ সর্বরসাশ্রয় ॥
সর্বোত্তম সেই লীলা অনুকৃতি করি।
আজি নৃত্য করিবেন গৌরাঙ্গ শ্রীহরি ॥৬

[১-৫. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৩য় অঙ্ক।
৬. প্রেমদাসের চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৩য় অঙ্ক, পৃ. ৩৭-৩৮।]

পরম রহস্য তাহা অন্য নাহি পারে ॥
এই ভাবি রাধারূপ ধরিল আপনে।
অদ্বৈতের করিলেন শ্রীকৃষ্ণের বেশ।
আর শুন হরিদাস হৈল সূত্রধার।
শ্রীমুকুন্দ পারিপার্শ্বিক হইলা তাঁহার ॥
বাসুদেবাচাৰ্য হৈল বেশ-সম্পাদক।
নিত্যানন্দ শুন হৈলা যে লীলাকারক ॥
যোগমায়া ভগবতী বৃদ্ধারূপ ধরে।১

মহাপ্রভু শ্রীবাসকে বলিলেন,

শ্রীবাসের প্রতি কহিলেন কৃপাবান ॥
শুন শুন শ্রীনিবাস আমার বচন।
নৃত্যকালে হবে আজি সাবধান মন ॥
এ কর্মের যোগ্য যে তাহারে যাইতে দিবে।
অন্য জন যাইবারে নিষেধ করিবে ॥
প্রভুর আজ্ঞায় শ্রীনিবাস মতিমান।
দ্বারপাল রাখিলা হইয়া সাবধান ॥
প্রভুর পরম পাত্র গঙ্গাদাস বিপ্ৰ।
শ্রীনিবাস তারে দ্বারী করিলেন ক্ষিপ্র ॥২
ভগবান শ্রীবাসেরে কহিলেন পুনঃ।
নারদ হইবে তুমি মোর বোল শুন ॥
শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী তোমার স্নাতক।
এবে শুন যে-যে জন হইব গায়ক ॥
শ্রীরামাদি তোমার যে তিন সহোদর।
আচার্যরত্ন বিদ্যানিধি পঞ্চ সাধুবর ॥
ইহা বহি অন্য প্রবেশিতে নাহি দিবে।
পরম রহস্যলীলা আজি সে হইবে ॥
ইহা শুনি শ্রীআচার্যরত্নের দুহিতা।
মুরারির বধূ আদি যত পতিব্ৰতা ॥
শ্রীবাসের সহোদর-পত্নীর সহিতে।
আগে গিয়া নৃত্যস্থলে রহিল একভিতে ॥
সে লীলা দেখিতে তাঁর হন অধিকারী।
তেঞি আগে শ্রদ্ধা করি গেল অনুসরী ॥৩
রাধাবেশে গৌরচন্দ্র আসি প্রবেশিলা ॥
বিশ্বম্ভর বলি কেহ চিনিতে না পারে।
আকৃতি প্রকৃতি রাধা সভে মনে করে ॥৪

প্রভুর প্রিয় গদাধর সখী-ললিতার অভিনয় করেন। তাঁহাকে দেখিয়া মনে হইত—

সাক্ষাৎ ললিতা ইহো নহে গদাধর।৫

[১-২. প্রেমদাসের চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৩য় অঙ্ক, পৃ. ৩৮।

৩. প্রেমদাসের চৈতন্যচন্দ্রোদয়, পৃ. ৩৮।

৪. ঐ পৃ. ৪৬।

৫. প্রেমদাসের চৈতন্যচন্দ্রোদয়, পৃ. ৪৭।]

শ্রীমন্ নিতানন্দের অভিনয় দেখিয়া মনে হইত–

নিত্যানন্দ নহে, ইহা জরতীর খেলা।১

এইসব অভিনয়ে মহাপ্রভু প্রভৃতি নটগণও এমন অভিভূত হইয়া উঠিতেন যে মনে হইত তাঁহারা একাধারে নট হইয়া অভিনয় করিতেছেন এবং সামাজিক হইয়া নাটকের রসও সম্ভোগ করিতেছেন। কাজেই এইসব অভিনয়স্থলে নট ও সামাজিকদের যে চিরপ্রচলিত প্রভেদ আছে তাহা আর থাকিত না। ভাবরসে অনুপ্রাণিত মহাপ্রভু প্রভৃতি ভুলিয়াই যাইতেন যে তাঁহারা অভিনয়মাত্র করিতেছেন। কবিকর্ণপুর এই লীলারও একটি সুন্দর বিবরণ দিয়াছেন —

‘রসজ্ঞ কৃতিগণ ভাল করিয়াই জানেন যে অভিনয়কালে সাধারণত সামাজিকেরাই অর্থাৎ দর্শকেরাই অভিনয়-রসের দ্বারা আবিষ্ট হন। নটদের তো আবিষ্ট হইবার কথা নয়। কিন্তু অলৌকিক এইসব অভিনয়লীলায় এইরূপ কোনো প্রভেদ টিকিতে পারিত না। কাজেই এখানে অভিনেতারা সামাজিক ও নট দুই ভাবেরই ভাবুক হইয়া ভাবামৃতরসে অভিভূত হইয়া পড়িতেন।”

সামাজিকানাং হি রসো নটানাং
নৈবেতি পন্থাঃ কৃতিষু প্রসিদ্ধঃ।
হন্তোভয়ত্বে রসবিত্ত্বমেষা
মলৌকিকে বস্তুনি কো বিরোধঃ ॥২

[১. প্রেমদাসের চৈতন্যচন্দ্রোদয়, পৃ. ৪৭

২. চৈতন্যচন্দ্রোদয়, ৩য় অঙ্ক।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *