ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা – ২

মধ্যযুগের বন্ধনহীন বা বে-শরা মতবাদ সকলের ইতিহাস খুঁজিতে গেলেও মধ্যযুগের অনেক আগে যাইতে হয়। বাউলরা বলেন, সব কৃত্রিম ধর্মেরই আদি আছে; সহজ মুক্ত ধর্ম চিরকালের। দাদূর শিষ্য সুন্দরদাস তাঁর ‘সহজানন্দ’ গ্রন্থে এই কথাই বলিয়াছেন। বাউলরা বলেন তাঁদের এই সহজধর্ম বেদেরও আগের। অথর্বের ব্রাত্যরাও তখনকার দিনের বাউল। যাক, সে তো বহু আগের কথা।

কবীর দাদূ সুন্দরদাস রজ্জব প্রভৃতি সকল সাধকই সেই নিত্যকালের সহজের কথা বলিয়াছেন।

বাংলা, নেপাল ও উত্তরপূর্ব ভারতে যে নাথপন্থের ও যোগিপন্থের সাধকদের প্রভা মুসলমানদের বহু পূর্ব হইতে ছিল তাঁহারাও শাস্ত্রাদি হইতে অনেক পরিমাণে স্বাধীন ছিলেন।

গোরখনাথ, মীননাথ ও সিদ্ধাগণের প্রভাব পরবর্তীকালের ধর্মে কিছু কম হয় নাই। কবীর নানক প্রভৃতি সাধকদের ধর্মেও এই সব নাথপন্থের প্রভাব সুস্পষ্ট। এই পন্থের ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের গান যোগী গায়ক বা ভর্থরীরা ভারতের সকল প্রদেশে ছড়াইয়াছেন। বাংলার গোপীচাঁদের গান পাঞ্জাবে সীমান্ত প্রদেশে সিন্ধুদেশে কচ্ছে গুজরাতে মহারাষ্ট্রে কর্ণাটেও শুনিয়াছি। এই নাথপন্থ ও যোগীদেশ ধর্মসম্বন্ধে এখন অনুসন্ধান চলিয়াছে, তাই এখানে আর কিছু বলার প্রয়োজন নাই।

উত্তরপূর্ব ভারতের ধর্ম ও নিরঞ্জনপন্থের প্রভাবও মধ্য-ভারতের মতবাদগুলির উপর যথেষ্ট। ধর্ম ও নিরঞ্জনপন্থীসম্বন্ধে অনেক যোগ্য লোক ইতঃপূর্বেই আলোচনা করিয়াছেন, এখনও আলোচনা চলিতেছে। কাজেই এখানে তাহারও কোনো উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। উড়িষ্যায় নিরঞ্জনপন্থের প্রভাব এখনো আছে এবং সেখান হইতে এই ধর্মমত মধ্যভারত পর্যন্ত গিয়া এখনো প্রবল আছে। উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাব রাজপুতানায় এক সময়ে এই মতবাদের খুবই প্রচলন ছিল, কবীর প্রভৃতির বাণীতে তাহা বেশ বুঝা যায়। নাথযোগিমত, নিরঞ্জনমত এখনো উত্তর-পশ্চিমে যোধপুর কচ্ছ সিন্ধু প্রভৃতি দেশে বিলক্ষণ আছে। যোগীদের তীর্থ বারপন্থের স্থান ও মঠাদি ভারতের নানা স্থানে দেখিলেই তাহা বুঝা যায়।

মধ্যযুগের কথা বলিতে গেলেই প্রথমে বলিতে হয় গুরু রামানন্দের কথা। এই যুগের গুরুই তিনি। আনুমানিক ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৪৭০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর সময়।

রামানুজ দাস হরিবর (১৮৫৭ খ্রী) তাঁর ‘ভক্তমাল-হরিভক্তি-প্রকাশিকায়’ লিখিয়াছেন যে, রামানুজ যাঁহাদের উপদেশে প্রেমভক্তি পাইলেন তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন বিষ্ণুচিত্ত ও ভক্ত শঠকোপ। শঠকোপ ও বিষ্ণুচিত্ত উভয়ে ছিলেন অতি নীচবংশীয়। তবু রামানুজী সম্প্রদায় আচার বিচারের ভারে ভারগ্রস্ত ছিল। হরিবরের মতে রামানন্দ রামানুজ হইতে পঞ্চম শিষ্য। রামানুজী সম্প্রদায়ের রন্ধনে ভোজনে জল আনায় খাওয়ায় স্পর্শ করায় এত বাঁধাবাধি যে তাঁহাদিগকে আচারী সম্প্রদায় বলে। রামানন্দ ভক্তির ব্যাকুলতায় যখন ভারতবর্ষময় ঘুরিয়া বেড়ান তখন এসব নিয়ম রক্ষা করেন নাই। তাই তাঁহার সম্প্রদায় তাঁহাকে ত্যাগ করে, যদিও সম্প্রদায়ে তাঁর স্থান অতি উচ্চে ছিল। হরিবর বলেন—

“রামানন্দ বুঝিলেন, ভগবানের শরণাগত হইয়া যে ভক্তির পথে আসিল তাহার পক্ষে বর্ণাশ্রম-বন্ধন বৃথা, কাজেই ভগবদ্‌ভক্ত খাওয়া-দাওয়ায় কেন বাছাবাছি করিবে? ঋষিদের নামেই যদি গোত্র-পরিবার হইয়া থাকে তবে ঋষিদেরও পূজিত পরমেশ্বর ভগবানের নামে কেন সবার পরিচয় হইবে না? সেই হিসাবে সবাই তো ভাই, সবাই এক জাতি। ভক্তিদ্বারাই শ্রেষ্ঠতা, জন্ম দ্বারা নহে।” (ভক্তমাল-হরিভক্তি-প্রকাশিকা, পৃ: ৮১-৮২)

রামানন্দ তাঁর কৃত্রিম উচ্চাস্থান ছাড়িয়া প্রেম ও ভক্তির সহজ স্থানে নামিয়া আসিলেন এবং জাতি ও ধর্মনির্বিশেষে ধর্ম উপদেশ দিতে লাগিলেন।

সংস্কৃত ছাড়িয়া তিনি হিন্দীতে উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন; কাজেই ধর্ম আর কেবল পণ্ডিত বা উচ্চ শ্রেণীরই রহিল না। ধর্মের সহজ উৎসবক্ষেত্রে সকলেরই ডাক পড়িল। ইহাই হইল হিন্দী সাহিত্যের সূত্রপাত। রামানন্দের প্রধান দ্বাদশজন শিষ্যের নাম-

১. রবিদাস চামার

৩. কবীর জোলা মুসলমান

৩. ধন্না জাঠ

৪. সেনা নাপিত

৫. পীপা রাজপুত

৬. ভবানন্দ

৭. সুখানন্দ

৮. আশানন্দ

৯. সুরসুরানন্দ

১০. পরমানন্দ

১১. মহানন্দ

১২. শ্রীআনন্দ

কাজেই দেখিতে পাওয়া যায় এই দলের মধ্যে নানা জাতিরই ভক্ত আছেন। ভক্তরা বলেন শেষের দিকের ভক্তরা রামানন্দের সঙ্গে রামানুজ-সম্প্রদায় হইতে চলিয়া আসেন।

রামানন্দের এই মুখ্য দ্বাদশজন ছাড়া আরো বহু বহু শিষ্য ছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে নীচ জাতির সংখ্যাই বেশি। রামানন্দের মতে ভক্তগণ যখন ভগবানের আশ্রয় নেন তখন তাঁদের পূর্ব সব পরিচয় তাঁহাতে লীন হইয়া যায়। তাঁহার ভক্তদের মধ্যে আমরা নারীরও নাম পাই। ভক্তমাল প্রভৃতি গ্রন্থে কবীরের দীক্ষা যে কেমন হঠাৎ রামানন্দের অজ্ঞাতসারে ঘটিয়া গেল তাহা বুঝাইতে গিয়া কত বাজে গল্পেরই অবতারণা হইয়াছে! কিন্তু তাহা মানিয়া লইলেও বাকী শিষ্যদের কথা কি বলা যায়? এই বিষয়ে রবিদাসী প্রভৃতি সম্প্রদায়-গ্রন্থে চমৎকার সব বিবরণ আছে, তাহা এখানে দেওয়া সম্ভবপর নহে। রামানন্দের লিখিত হিন্দী বাণী পাওয়া সহজ নহে। শিখদের গ্রন্থ-সাহেবে রামানন্দের যে বাণী আছে তাহাতে দেখা যায় তিনি বলিয়াছেন ‘কেন আর ভাই মন্দিরে যাইতে আমায় ডাক, তিনি বিশ্বব্যাপী, আমার হৃদয়-মন্দিরেই তাঁর দেখা পাইয়াছি।’

অনেক বৈদেশিক সমালোচক তাঁর এসব বাণী দেখিলেও মানিতে চান না যে, তিনি মূর্তিপূজা ও জাতিভেদের প্রতি আস্থা ত্যাগ করিয়াছিলেন। কারণ তাঁরা বলেন, এখনকার রামানন্দী সম্প্রদায়ে তো সেসব আছে। যুক্তি যদি এমন হয় তবে দয়ার অবতার ভগবান্ যিশুকেও বলিতে হয় তিনি দয়া ও অহিংসার অবতার ছিলেন না- তিনি সাম্রাজ্যবাদের উপদেষ্টা ও অস্ত্রশস্ত্র-পরায়ণ হিংসা ও যুদ্ধের গুরু ছিলেন। আজিকার অবস্থা দেখিয়া তখনকার আদর্শের বিচার করা চলে না।

রামানন্দ যদিও প্রচলিত রাম নাম ব্যবহার করিয়াছেন তবু তাঁর ঈশ্বর এক, প্রেমময় নিরঞ্জন। তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম নহেন; তিনি মনের মানুষ প্রেমের বন্ধু।

তাঁর মতামত শুধু তাঁর সম্প্রদায়কে নহে, সকল মতামতের লোককেই জাগ্রত করিতে লাগিল। তাই সাধকদের মধ্যে কথা আছে—

ভক্তি দ্রাবিড় উপজী লায়ে রামানন্দ।
প্রগট কিয়ো কবীরনে সপ্তদ্বীপ নৌখণ্ড ॥

ভক্তি উপজিল দ্রাবিড় দেশে, এদেশে আনিলেন রামানন্দ। কবীর তাহা সপ্তদ্বীপ নবখণ্ড পৃথিবীতে প্রকাশ করিয়াছিলেন।

প্রথমে তাঁর সম্প্রদায়ের বাহিরে সদন ভক্ত ও নামদেবের নাম করিতে চাই। সদন ভক্ত ছিলেন জাতিতে কসাই। ভক্তমালে আছে, তাঁর মাংস বিক্রয় করিবার তুলাদণ্ডে ওজনের জন্য একটি শালগ্রাম থাকিত। শালগ্রামের এই দুর্গতি দেখিয়া এক সাধু তাহা প্রার্থনা করেন। সদন তৎক্ষণাৎ সাধুকে শিলাটি দেন। রাত্রে সাধু স্বপ্নে দেখেন দেবতা বলিতেছেন, আমাকে সেই সদনের বাড়ি রাখিয়া আইস। আমি তাঁর সহজভাবে ভক্তিতে মুগ্ধ। সাধু তাহাই করিলেন।

কেমন করিয়া কাম-ক্রোধ জয় করিয়া দেহদুঃখ সহ্য করিয়া সদন ধর্মজীবনে অগ্রসর হন সে কথা ভক্তমালে আছে। পরিশেষে পুরীধামে জগন্নাথদেব স্বয়ং তাঁহাকে আপনার আসনে ডাকিয়া লন। শিখদের গ্রন্থ-সাহেবে সনদজীর দুইটি গান উদ্ধৃত আছে।

সিন্ধুদেশে ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি এক কসাই সদ্‌না ভক্ত বিরাজমান ছিলেন। নামদেবের কথা পূর্বে বলা হইয়াছে। ১৩৬৩ খ্রীষ্টাব্দে মহারাষ্ট্র দেশে দজী বংশে তাঁর জন্ম। তাঁর রচিত অনেকগুলি ভজন গ্রন্থ-সাহেবে আছে। রামানন্দের মত ইনি ও দক্ষিণ দেশ হইতে ভক্তিবাদ উত্তর-ভারতবর্ষে লইয়া যান ও পাঞ্জাব বটালার নিকট ঘোমান গ্রামে গিয়া বাস করেন। ১৪৪৬ খ্রীষ্টাব্দে সৈয়দবংশীয় শেষ রাজা আলম শাহ তাঁহার মঠ করাইয়া দেন ও মঠের জন্য ভূবৃত্তি দান করেন। এখন গুরুদাসপুর জেলায় যে নামদেবী-সম্প্রদায় দেখা যায় তাঁহারা নামদেবের শিষ্য বোহর দাসের বংশ। তাঁহারা বলেন, বিষ্ণুস্বামী নাকি নামদেবের শিষ্য ছিলেন।

বুলন্দ শহরে বস্ত্রে-ছাপ-দেওয়া ব্যবসায়ী এক হীনজাতীয় নামদেব জন্মিয়াছিলেন।

মাঝাড়ে ধুনিয়া বা তুলাধুনকরের বংশে আর এক নামদেব জন্মগ্রহণ করেন।

কবীরের নাম করিবার আগে রামানন্দের অন্যান্য শিষ্যদের নাম করা যাক।

রামানন্দের মুখ্য দ্বাদশজন শিষ্যের বাহিরে অনন্তানন্দের নাম। রাজপুতানা জয়পুরে আমেরের নিকট গলতায় তাঁর মঠ এখনো প্রতিষ্ঠিত আছে। তাঁর শিষ্য কৃষ্ণদাসজীর জন্ম হিমালয় কুল্লু দেশে। আমেরের রাজা পৃথ্বীরাজ যোগিমতের ছিলেন, তিনি পরে কৃষ্ণদাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

এই কৃষ্ণদাসের শিষ্য অগ্রদাস ও কীল্হ। উভয়েই উত্তম কবি ছিলেন। কেবলরাম, হরিনারায়ণ, পদ্মনাভ, গদাধর, দেবদাস, কল্যাণদাস প্রভৃতি বহু ভক্ত এই শাখার। অগ্রদাসের বাণী—

‘সকল দেরন দেরা সো ঈশ্বর ভগবান ভজো।’

সকল দেবতার দেবতা ঈশ্বর ভগবানকে ভজনা কর।

‘জো দিন যায় আনন্দমেঁ জীবন কা ফল সোই।’

যে দিন আনন্দে গেল তাহাতেই জীবনের সাফল্য।

‘অগ্র কহে হরি মিলনকো তনমন ডারো খোই।’

অগ্রদাস বলেন হরিকে পাইবার জন্য তনুমন তাঁহার মধ্যে হারাইয়া ফেল।

এই সব বাক্য সাধুদের মধ্যে খুব চলিত।

অগ্রদাসের শিষ্য নাভাজী। নাভা ডোমের ছেলে। দারিদ্র্যবশতঃ বিধবা মাতা তাঁহাকে ফেলিয়া দেন; অগ্রদাস অনাথ বালককে পালন করেন ও নূতন দৃষ্টি দান করেন। এই ডোমবংশে জন্মের কথা গোপন করিতে গিয়া অনেকে বলেন নাভার জন্ম হনুমানের বংশে।

গুরু আজ্ঞা করেন, “নাভা, তুমি ভক্তদের জীবনী লেখ।’ নাভা বলেন, ‘আমি মূর্খ, আমার কি সাধ্য?’ শেষে গুরুর আজ্ঞায় ভক্তমাল রচনা করেন।

মাধ্বী সম্প্রদায়ের প্রিয়াদাস ভক্তমালের টীকা করিয়া উহাকে অনেকটা পূর্ণতর করেন।

প্রিয়াদাসের পৌত্র বৈষ্ণবদাস। তাঁহার সহায়তায় লালদাসজী ‘ভক্ত উরবসী’ নামে আর একটি টীকা করিয়া ভক্তমালকে আরও পূর্ণ করেন। লালদাসজীর পূর্ব নাম লক্ষ্মণদাস। ইঁহার বাসস্থান কান্ধেলে। রাধাবল্লভী সম্প্রদায়ের বল্লভ লালজীর শিষ্য হইয়া লালদাস নাম গ্রহণ করিলেন।

১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে রোহতকের লালা গুমানী লাল ভক্তমালকে আরও একটু বিশদ করেন।

১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে মীরাপুরবাসী রামপ্রসাদ ভক্তমাল সহজ ভাষায় লেখেন।

এই ভক্তমালে কৃষ্ণ ও রামপন্থী শাস্ত্রানুমোদিত আচারশীল ভক্তদের কথাই বেশী তাই নানক, দাদু, রজ্জব প্রভৃতির নাম তাহাতে নাই। হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাবুদ্ধিহীন সাধকদের বিবরণ নাভার ভক্তমালে মিলে না।

তবে নাভার ভক্তমাল ছাড়া রাঘবদাসজী প্রভৃতি আরও অনেক ভক্তের লেখা ভক্তমাল আছে। মঠে এবং সাধুদের স্থানেও বহু ভক্তের জীবনী রক্ষিত আছে।

অগ্রদাসের গুরুভাই কীল্হ গুজরাতের সুবেদার সুমেরদেবের পুত্র। ইঁহার নাম শুনিয়া মথুরাতে রাজা মানসিংহ ইঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন ও ইঁহার সাধনায় চমৎকৃত হন।

খাকী সম্প্রদায় বলেন তাঁহাদের প্রবর্তক কীল্হ। ফরক্কাবাদ অযোধ্যা হনুমানগড় ও জয়পুরে তাঁহাদের স্থান আছে।

রবিদাসের জন্ম কাশীর এক মুচী বা চামারের ঘরে। ভক্তমাল-হরিভক্তি-প্রকাশিকা’ মতে রবিদাস জুতা সেলাই করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেন। রামানন্দের কৃপায় নবজীবন পাইলেও তিনি তাঁর ব্যবসা ত্যাগ করিলেন না। এক সাধু তাঁহাকে পরশপাথর দিতে চাহিলেও তিনি তাহা গ্রহণ করেন নাই। তিনি বলিলেন, আমার এই স্বোপার্জিত বৃত্তি ও সরল জীবনযাত্রাই ভাল।

ভগবানের সাধনা ও সাধুগণের সেবার জন্য রবিদাস কোনো মতে একটি মঠ করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণেরা রাজার কাছে নালিশ করিলেন—মুচী হইয়া এই ব্যক্তি সকল জাতির ধর্ম নষ্ট করিতেছে। রাজা তাঁহাকে তিরস্কার করিতে ডাকাইয়া তাঁর উজ্জ্বল মুখভাব ও প্রেমছবি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গেলেন।

চিতোরের রানী ঝালী তাঁর শিষ্যা হন। ব্রাহ্মণেরা রুষ্ট হইয়া রাজার কাছে নালিশ করিলেন। রাজার আজ্ঞায় ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠ করিয়া ভগবানকে বিচলিত করিতে পারিলেন না; রবিদাস তাঁর সরল ভজনে ভগবানকে বিচলিত করিলেন।

কথিত আছে রানী ঝালী গুরু রুবিদাসকে এক যজ্ঞ উপলক্ষে আনাইলেন। ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, আমরা এখানে পাক করা দ্রব্য খাইব না। তাঁহারা নিজেরা পাক করিয়া সকলে খাইতে বসিয়া নাকি দেখেন প্রতি দুইজনের মধ্যে রবিদাস খাইতে বসিয়াছেন।

ভক্তদের মতে মীরাবাঈ রবিদাসের শিষ্যা ছিলেন।

রবিদাসের ভজন প্রেমে ও ব্যাকুলতায় পূর্ণ। ত্রিশটির অধিক তাঁহার ভজন গ্রন্থ- সাহেবে গৃহীত হইয়াছে।

রবিদাসের নামে ভারতের সর্বত্র মুচীরা নিজেদের রুইদাসী বলে; এই গৌরবে তাহারা গৌরবান্বিত।

রবিদাস বলেন—

‘রাম কহত সব জগ ভুলানা সো য়হ রাম ন হোই—’

সকল লোক যে রামনামে ভুলিয়াছে আমার রাম সে রাম নহে।

‘সব ঘট অংতর রমসি নিরংতর মৈঁ দেখন নাহি জানা—’

সকল ঘটে তুমি নিরন্তর বিরাজমান। আমিই তোমাকে দেখিতে শিখি নাই।

‘চলত চলত মেরো নিজমন থাক্যৌ অব মোসে চলা ন জাঈ–’

তাঁহার জন্য চলিয়া চলিয়া আমার নিজ মন ক্লান্ত হইয়াছে—আর তো ঘুরিয়া মরা যায় না।

‘জা কারণ মৈঁ দূর ফিরতো সো অব ঘটমেঁ পাঈ। ‘

যাঁহার জন্য দূরে দূরে ঘুরিয়া মরিয়াছি তাঁহাকে এখন এই ঘটের মধ্যেই পাইলাম।

ভগবানের জন্য যে ব্যাকুলতা তাহা কি শাস্ত্র বা বেদপাঠে যায়?

‘কোটি বেদ বিধি উচরৈ বাকী বিথা ন জাঈ।’

কোটি বেদ বিধি উচ্চারণ করিয়াও তাহার ব্যথা যায় না।

তাহাকে দেখিতে পাইলে দেখি—

‘বিমল একরস উপজৈ ন বিনসৈ উদৈ অস্ত তহঁ নাঁহী।
বিগতাবিগত ঘটৈ নহি কবহুঁ বসত বসৈ সব মাহী ॥’

সেই বিমল একরসের উৎপত্তিও নাই, বিনাশও নাই। তাহা বিগতাবিগত, তাহার ক্ষয় নাই, এই বস্তু সকলের অন্তরে বিরাজিত।

তখন দেখি চরাচরে সর্বত্র তাঁর পূজা। যেখানে যাই সেইখানেই তোমার পূজা চলিয়াছে।

‘জহঁ জ্যঁ জাউ তুম্হরী পূজা।’

রবিদাস অতিশয় সেবাপরায়ণ ছিলেন। যখনই কোনো সাধুভক্তগণের মিলন হইত বা তীর্থস্থানে সকলে যাইতেন তখন সকলকে সেবা করিবার ভার ছিল রবিদাসের। তরুণ ও যুবক দলের সঙ্গেই তাঁর বেশী যোগ ছিল। তাঁদের লইয়া তিনি নানাবিধ সেবার কর্ম করিতেন। এজন্য অনেকে অভিযোগ করিতেন যে রবিদাসই তো এই সব ছেলেদের মতিগতি বিগড়াইয়া দিল। এই সব সেবার প্রসঙ্গে রবিদাসের যে সব প্রার্থনা ও প্রণতি পাওয়া যায় তাহা অপূর্ব।

সেনা ভক্ত ছিলেন জাতিতে নাপিত; রামানন্দের কৃপায় তিনি নবজীবন প্রাপ্ত হন। ভক্তিজীবন লাভ করিয়াও সেনা রাজার ক্ষৌরকারের কাজ করিতেন। রাজা সেনার ভক্তিজীবনের পরিচয় পাইয়া তাঁর শিষ্য হন। সেনা ছিলেন বাঁধূ নগরের অধিবাসী। এখনো সেখানকার রাজার ভক্ত সেনার বংশীয়দের কাছে দীক্ষা লইয়া থাকেন।

ভবানন্দ ছিলেন পণ্ডিত। গুরু রামানন্দের আজ্ঞায় তিনি বেদান্ত শাস্ত্র সহজবোধ্য হিন্দীতে লেখেন, তাঁহার গ্রন্থের নাম ‘অমৃতধার’। চৌদ্দটি অধ্যায়ে বেদান্তের সত্যগুলি হিন্দীতে সাধারণ লোককে বুঝাইবার জন্য লিখিত হইয়াছে।

ধন্না ছিলেন জাতিতে জাঠ। ১৪১৫ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি তাঁর জন্ম। বাল্যকালে এক ব্রাহ্মণের কাছে তিনি কিছু উপদেশ পান; তখন হইতে তিনি যাহা কিছু ভোগ করিতেন তাহা ভগবানের সঙ্গে একত্র প্রেমে ভোগ করিতেন। ইহার অধিক সেই ব্রাহ্মণের কাছে জ্ঞান চাহিলে তিনি তাঁহাকে কাশীতে রামানন্দের নিকট যাইতে আদেশ করেন। রামানন্দ তাঁহার অনুরাগ দেখিয়া নীচ জাতি জাঠ বলিয়া আপত্তি করিলেন না। জাঠরা কৃষক। যখন সবাই কহিল—’ধন্না, ভক্ত হইয়া তোর কি লাভ হইল? ইহা অপেক্ষা চাষ করিলে তুই একগুণ বীজে দশগুণ শস্য পাইতিস।’ ধন্না বলিলেন, ‘যে ক্ষেত্রে আমি এখন সেবা করিতেছি তাহাতে আমি সহস্রগুণ ফল পাইতেছি।’ গ্ৰন্থ- সাহেবে ইঁহার রচিত ভজন আছে।

পীপার জন্ম ১৪২৫ খ্রীষ্টাব্দে; তিনি জাতিতে রাজপুত। রাজপুতানার অন্তর্গত গামরোহগড়ের তিনি রাজা ছিলেন। কাঠিয়াবাড়ের সাধুদের মতে রাজ্যের নাম গঢ়গাংগড় বা গগরৌংগঢ়। ইনি প্রথমে শাক্ত ছিলেন, পরে রামানন্দের কাছে ভক্তিপথের উপদেশ পাইয়া রাজ্য ত্যাগ করিয়া যান। পীপা যখন রাজ্য ত্যাগ করিয়া যান তখন রাণীরা সঙ্গে যাইতে চাহেন। পীপা রাজী হন না। রামানন্দ বলিলেন, যদি ইঁহারা রাজ- ঐশ্বর্য ত্যাগ করিয়া সহজ ভাবে তোমার সঙ্গে যান তবে বাধা দিবার কি আছে? এই সর্তে ছোট রানী সীতা সঙ্গে গেলেন।

কথিত আছে, পীপা সমুদ্রে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া ভগবানের সাক্ষাৎ পান। পীপার অঙ্গে ভগবানের ছাপ লাগিয়া থাকে। সেই অবধি দ্বারকায় পীপার মঠে ভক্তদের অঙ্গে ভগবানের মুদ্রার ছাপ দেওয়া হয়।

দ্বারকার পথে চিঘড় ভক্ত এত দরিদ্র ছিলেন যে পরিধেয় বস্ত্র বেচিয়া পীপার সেবা করেন। পীপা সারঙ্গ বাজাইয়া ও রানী সীতা গান ও নৃত্য করিয়া অর্থসংগ্রহ করিয়া তাঁহাদের কিছু সাহায্য করিয়া যান।

দ্বারকার পথে পীপাবটে তাঁর এক বড় মঠ আছে। এই মঠ অতিথিসেবার জন্য খ্যাত। শিখ সাধুদের ধর্ম-উৎসবে পীপার গান শুনিতে পাওয়া যায়। গ্রন্থ-সাহেবে তাঁহার ভজন আছে।

সুখানন্দ স্বভাবতঃই ভক্ত ও প্রেমিক ছিলেন, তাই রামানন্দের সঙ্গে পুরাতন সম্প্রদায় হইতে চলিয়া আসিলেন। সুখানন্দের পূর্বপুরুষেরা নাকি তন্ত্রশাস্ত্রের মতাবলম্বী ছিলেন। এইজন্য সুখানন্দ কৃত গ্রন্থকে অনেকে ভক্তিতন্ত্র বলেন। ইনি দিনরাত ভগবানের প্রার্থনায় মজিয়া থাকিতেন। গুরুর আদেশে সুখানন্দ সকল প্রকার কর্মই করিতেন—কিন্তু কর্মের সঙ্গে তাঁহার অন্তরে ভগবানের নাম চলিত এবং তাঁহার দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া যাইত। সাধকদের মধ্যে তাঁহার বাণীর খুব আদর আছে। কর্ম ছিল তাঁর জপমালা।

সুরসুরানন্দ রামানন্দের সংস্পর্শে আসিয়া নবজীবন পাইলেন। ভক্ত হইয়া তিনি সাধনার নিমিত্ত যখন সংসার ত্যাগ করিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন তখন তাঁহার স্ত্রী তাঁহার সঙ্গে যাইতে চাহিলেন। তিনি অস্বীকৃত হওয়ায় তাঁহার স্ত্রী গুরু রামানন্দের কাছে গিয়া নিজ আবেদন জানাইলেন। রামানন্দ সুরসুরানন্দকে কহিলেন—’তোমার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া যাইবার হেতু কি? তিনি ভক্তিমতী, তোমার আদর্শে শ্রদ্ধান্বিতা, তাঁহাকে লইয়া কেন সাধনার্থ যাও না?’ সুরসুরানন্দ কহিলেন—’তিনি সুন্দরী ও তরুণী, সুতরাং পথে নানা বিঘ্ন বাহির হইতে আসিতে পারে।’ রামানন্দ কহিলেন——তুমি পুরুষ, স্বীয় পৌরুষে তাঁহাকে সকল বিঘ্ন হইতে রক্ষা করিবে। নহিলে অন্যের উপর এই দায় ফেলিয়া যাওয়ায় কি কোনো পৌরুষ আছে?’ তাই সুরসুরানন্দ নিজ পত্নী-সহ সাধনায় গেলেন। বিধর্মী দুষ্টলোকেরা বিঘ্ন করিবার চেষ্টা করিলেও তাহাতে কৃতকার্য হয় নাই— ভগবান্ স্বয়ং প্রচণ্ডরূপ হইয়া তাঁহাকে রক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার স্ত্রীর নাম ‘হরিভক্তি- প্রকাশিকা’ মতে সুরসরিজী।

মধ্যযুগে যাঁহার সাধনা সর্বাপেক্ষা সকলের চিত্তে আপন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল তিনি রামানন্দশিষ্য কবীর। কবীরের পর উত্তর-ভারতে সংস্কারমুক্ত যে কোনো ধর্মমত মধ্যযুগে হইয়াছে তাহার প্রত্যেকটির উপর প্রত্যক্ষতঃ অপ্রত্যক্ষতঃ কবীরের প্রভাব অসামান্য।

কবীর-কসৌটী-কারের মতে দেখা যায় ১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দে কবীরের মৃত্যু। তিনি নাকি ১২০ বৎসর আয়ু পাইয়াছিলেন, তদনুসারে তাঁর জন্ম হয় কাশীতে ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে। য়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা কসৌটীতে দেওয়া মৃত্যু তারিখ মানিতে রাজি কিন্তু জন্ম তারিখ নয়। কেবল হান্টার ( Hunter) বলিয়াছেন ১৩০০-১৪২০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কবীরের সময়। বিল (Beal) বলেন যে, ১৪৯০ পর্যন্ত কবীর জীবিত ছিলেন। খ্রীষ্টীয় মিশনারীরা কবীরের মৃত্যুকালে প্রামাণ্য ধরিয়া ১৪৪০-১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁহার সময় ধরিয়াছেন। কিন্তু নাগরী প্রচারিণী সভার শ্রীযুক্ত শ্যামসুন্দর দাস একখানি পুরাতন কবীর-বাণীর পুঁথি পাইয়াছেন—তাহা ১৫০৪ খ্রীষ্টাব্দের লেখা। এবং ‘ভারত ব্রাহ্মণের’ মতে কবীরের জন্মকাল পাওয়া গিয়াছে ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দ, ও মৃত্যুকাল ১৪৪৮ খ্রীষ্টাব্দ। সর্বোপরি ডাক্তার ফ্যুরের (Fuhrer) লিখিত ‘উত্তরপশ্চিম-প্রদেশ ও অযোধ্যার স্থাপত্যকীর্তি ও শিলালেখমালা’ (Monumental Antiquities and Inscriptions in the North-Western Provinces and Oudh) গ্রন্থে আছে যে, বস্তী জেলার অন্তর্গত খিরনী নগরের পূর্বভাগে অমী নদীর তীরে বিজলী খাঁ স্থাপিত কবীরের একটি রৌজা পাওয়া গিয়াছে। তাহাতে স্থাপনের তারিখ আছে ১৪৫৭ খ্রীষ্টাব্দ। আবার ১৫৬৭ খ্রীষ্টাব্দে নবাব ফিদই খাঁ রৌজাটি সংস্কার করিয়া দেন। কাজেই ভারত ব্রাহ্মণের লিখিত ১৪৪৮ খ্রীষ্টাব্দ কবীরের মৃত্যুই প্রামাণ্য। মৃত্যুর দুই বৎসর পরেই রৌজা স্থাপিত হয় এবং বিজলী খাঁ-ই ইহার দুই বৎসর পূর্বে কবীরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে মগহরে কবীরের সমাধি-মন্দির প্রস্তুত করেন। মুসলমান সাধকের চিত্তের উপর কবীরের কতখানি প্রভাব ছিল তাহা এই ঘটনা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়।

সন্দেহ নাই যে কবীর মুসলমান জোলার পুত্র। এই কথাটি গোপন করিবার জন্য ভক্তমাল ও তাহার টীকাকার হইতে আরম্ভ করিয়া পরবর্তী সব হিন্দুলেখকই প্রভূত চেষ্টা করিয়াছেন। কবীর যে জোলা সে তাঁর নিজ বচনেই প্রমাণিত, তারপর তাঁর নাম। তবু হিন্দুলেখকেরা বলেন, তিনি মুসলমানের ঘরে পালিত হইলেও ছেলে ব্রাহ্মণেরই। কেহ কেহ বলেন তিনি তো সত্য নিরঞ্জন পুরুষ, তাঁহার আবার জন্ম কি? তিনি লীলা করিতে কাশীর নিকট লহরতালাও সরোবরে কমলে শুইয়াছিলেন। জোলা নীরু ও তাঁর পত্নী নীনা তাঁহাকে পাইয়া পিতামাতা রূপে লালন করেন মাত্র।

যাক সে কথা, দাদূপন্থের নানা গ্রন্থে এবং আরও বহু বহু সাক্ষ্য অনুসারে ইহা স্পষ্ট বুঝা গিয়াছে কবীর ছিলেন মুসলমান জোলারই ছেলে। ঐতিহাসিক আবুল ফজল ও দবিস্তান বলেন,কবীর জোলার বংশেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা বলেন, ‘তবু তাঁহাকে ঠিক মুসলমান বলা যায় না, কারণ তিনি মুরহিদ বা ঈশ্বরবিশ্বাসী ভক্ত ছিলেন।’ হিন্দু জোলারাই অনেকে মুসলমান হইয়া গিয়াছিল। এই শ্ৰেণী হিন্দু সমাজে যেরূপ নিরক্ষর ও অশিক্ষিত ছিল মুসলমান হইয়াও প্রায় সেইরূপই কুসংস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত। এমন বংশে ভগবান্ এত বড় মহাপুরুষের জন্ম দিয়া তাঁহার আপন সত্যের জয়ই ঘোষণা করিলেন।

তিনি রামানন্দের কাছে নবচেতনা লাভ করিলেন, তাঁর কাছে ধর্মসাধনা গ্রহণ করিলেন; জাতিভেদ পৌত্তলিকতা তীর্থ ব্রত মালা তিলক প্রভৃতি কিছুরই ধার ধারিলেন না। সকল কুসংস্কারের মূলে তিনি প্রচণ্ড বলে আঘাত করিলেন। সুযোগ থাকিলে সেই সব বিষয় তাঁর নিজের বাণী হইতেই সুন্দররূপে দেখাইয়া দেওয়া যাইত।

অন্ধকারে রামানন্দ তাঁর গায়ে পা দিয়া রাম রাম করিয়া উঠিলে কবীর সেই মন্ত্ৰ গ্রহণ করিলেন, এ সব বাজে কথা। কারণ, রামানন্দ আচার মানিয়া চলেন নাই বলিয়াই তাঁর নূতন পন্থের আরম্ভ। তাঁর বহু শিষ্যই সমাজবিধি অনুসারে বর্জনীয়।

রামানন্দের কাছে সাধনা লইয়াও কবীর হিন্দু-মুসলমান সকল দলের ভক্ত ও জ্ঞানীদের সঙ্গেই আলাপ করিয়া বেড়াইতেন। সূফীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেখ তক্কীর সঙ্গে কবীরের বেশ একটু ঘনিষ্ঠতা হয়—তক্কী ছিলেন সূফীদের সুররর্দী শাখার অন্তর্ভুক্ত।

সাধনার জীবন লইয়াও কবীর বিবাহ করিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল লোই। তাঁর পুত্র হইলেন কমাল, ইহা ভিন্ন কমালী নামে তাঁর এক কন্যাও ছিলেন। এসব কথা এখন ভক্তেরা চাপিয়া যাইতে চান।

এই কমাল একজন ভক্ত ও গভীর চিন্তাশীল সাধক ছিলেন। কবীরের মৃত্যুর পর যখন কমালকে সকলে বলিল, তুমি তোমার পিতার শিষ্যদের লইয়া সম্প্রদায় গড়িয়া তোল, তখন কমাল বলিলেন, আমার পিতা চিরজীবন ছিলেন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে—আর আমিই যদি সম্প্রদায় স্থাপন করি তবে পিতার সত্যকে হত্যা করা হইবে। ইহা একপ্রকার পিতৃহত্যা, সে কাজ আমার দ্বারা সম্ভব হইবে না। তখন অনেকে বলিলেন—

ডুবা বংশ কবীরকা জো উপজা পৃথ্ব কমাল।

অর্থাৎ, পুত্র কমাল জন্মিয়াই কবীরের বংশ ডুবিল। এই কথাটির অবশ্য আরো নানা ভাবে প্রয়োগ আছে।

কবীরের কন্যা কমালীর সঙ্গে একজন ব্রাহ্মণের বিবাহ হয়।

পরবর্তীকালে কবীরের মতবাদ প্রধানতঃ দুই ভাগে ভাগ হইয়া গেল। কবীরের বাণীর সংগ্রহ ‘বীজক’ নামে খ্যাত তাহা গ্রহণ করিয়া সুরত গোপাল কাশীতে কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁহারা ক্রমে ক্রমে শাস্ত্রের দিকে ও বিশেষতঃ বেদান্তাদির দিকে ঝুঁকিতে লাগিলেন। এই বীজকের বিখ্যাত টীকাকার বঘেলখণ্ডের রাজা বিশ্বনাথ সিংহজী; তাঁহার কৃত টীকার নাম বঘেলখণ্ডী টীকা।

কবীরের বাণিয়া শিষ্য ধর্মদাস গিয়া ছত্রিশগড়ে কবীর-সম্প্রদায় স্থাপন করিলেন। তাঁহারা কবীর-সাগর প্রভৃতি অন্যান্য সংগ্রহও আদর করেন এবং বীজকের ত্রিজ্যা টীকার সমাদর করেন।

ধর্মদাস বিবাহিত ছিলেন, তিনি সস্ত্রীকই সাধনার জগতে আসিলেন। তাঁহার শাখার গুরুদের আজিও বিবাহিত হইতে হয় এবং তাঁহাদের সন্তানরাই পরে গুরু হন। কুদরমাল হইতে সরিয়া আসিয়া এখন ইঁহাদের প্রধান মঠ দামাখেড়ায়। এই মঠের শেষ মহান্ত দয়ানাম সাহেব অপুত্রক মারা গিয়াছেন। ধর্মদাসের কথা পরে বলা যাইবে।

এই ছত্রিশগড়ী শাখারই খুব প্রভাব। ইঁহাদের সংখ্যা ইঁহারা বলেন বিয়াল্লিশ লক্ষ। সুরতগোপালী বা কাশীর মঠের অনুগত ভক্তসংখ্যা খুবই কম। কবীরের মৃত্যুস্থান মগহরে তাঁর ভক্ত বিজলী খাঁ স্থাপিত একটি মুসলমান সমাধিও আছে।

কবীর যখন মারা যান তখন তাঁর মৃতদেহ লইয়া হিন্দুরাজা বীরসিংহ ও মুসলমান বিজলী খাঁ পাঠানের মধ্যে ঝগড়া হয়। বীরসিংহ চান হিন্দুমতে দেহ দাহ করিতে, বিজলী খাঁ চান গোর দিতে। কিন্তু মৃতদেহের আবরণ মোচন করিয়া নাকি দেখা গেল কতকগুলি ফুল মাত্র পড়িয়া আছে। তার অর্ধেক মুসলমান ভক্তেরা মগহরে কবর দেন আর বাকী অর্ধেক হিন্দুরা কাশীতে আনিয়া দাহ করেন। মগহরে এখনো কবীরের পন্থায় দীক্ষিত মুসলমান সাধক কেউ কেউ আছেন।

এই দেহ লইয়া বিবাদ কেন হইল বুঝা যায় না। কারণ হিন্দুশাস্ত্রানুসারেও তো সাধকদের দেহ দাহ করার নিয়ম নাই।

কবীরের বাণীর সব একত্র করিলে একটি বিরাট্ সংগ্রহ হয়। তাহাতে একই কথার অনেক সময় পুনরুক্তি দেখা যায়—কেন না, তাঁর মুখের একই বাণী নানা জনে নানা ভাবে লইয়াছে বা একই সত্য পাত্রানুসারে তিনি এক আধটু পরিবর্তিত করিয়া বলিয়াছেন। আবার কবীরের অতি গভীর এমন সব বাণী ও কথা সাধুদের মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছে যাহা বীজক বা সাগর প্রভৃতি সংগ্রহে প্রকাশিত হয় নাই।

কবীর সহজ জীবনযাত্রারই পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি জোলার কাজই করিতেন; কাপড় বুনিয়া বাজারে বিক্রয় করিতেন। সাধনা অর্থে তিনি শ্রমবিমুখতা বুঝিতেন না। তিনি বলিয়াছেন, এমন শ্রম করিবে যাহাতে ভিক্ষার উপর নির্ভর না করিয়া নিজের চলে এবং সম্ভব হইলে অপরকেও সহায়তা করা যায়।

কহৈঁ কবীর অস উদ্যম কীজৈ।
আপ জীয়ৈ ঔরন কো দীজৈ ॥

তাঁর মতে সকলেই উপার্জন করিবে, পরস্পরকে সাহায্য করিবে, কেহই অসঙ্গরূপে সঞ্চয় করিবে না। অর্থ উপার্জন করিয়া লোকসেবায় অর্থস্রোত চলন্ত রাখিলে কোনো বিকার ঘটিতে পারে না। এই স্রোত বন্ধ হইলেই নানা বিকার ঘটে, নানা দুঃখ ও অন্যায়ের সৃষ্টি হয়। এই সব মতামত লইয়া দাদূ পরে তাঁহার ‘ব্রহ্মসম্প্রদায়’ স্থাপন করিয়াছিলেন।

হিন্দু বা মুসলমান কোনো সমাজেরই অর্থহীন বাহ্য আচারকে তিনি গ্রহণ করেন নাই। মিথ্যা আচারকে আঘাত করিবার অসাধারণ শক্তি তাঁর ছিল। কথিত আছে, তাঁর গুরু রামানন্দের মৃত্যু হইলে শ্রাদ্ধার্থ সব শিষ্যরা তাঁহার কাছে দুগ্ধ চাহিতে আসিলেন। তিনি মরা গরুর অস্থি পঞ্জরের কাছে আসিয়া দুগ্ধ চাহিলেন। লোকেরা তিরস্কার করিলে তিনি কহিলেন, মরা মানুষের খাদ্য হিসাবে মরা গরুর দুধই ভালো।

কাশীতে তিনি চিরদিন ছিলেন। কাশীতে মৃত্যু হইলে মুক্তি হয় ইহা সকল হিন্দুর ধারণা। তাই তিনি মৃত্যুর পূর্বে বলিলেন, আমাকে কাশী হইতে দূরে লইয়া যাও। তাই সকলে তাঁহাকে বস্তী জেলায় মগহরে লইয়া গেল; সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

‘নির্ভয়জ্ঞান’ গ্রন্থে এক সংস্কারমুক্ত অভিমানী মুসলমান বংশজাত জ্ঞানীর কথা আছে। তিনি সর্বত্র ভ্রমণ করিতেন বলিয়া তাঁর নাম হয় জাহানগস্ত। কবীরের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়া প্রাঙ্গণে একটি শূকর দেখিয়া তিনি ঘৃণায় চলিয়া যাইতেছিলেন। কবীর বলিলেন, ‘বাবা, এখনো তোমার এই সব সংস্কার আছে? শূকর তো মলিনতা, অন্তরে কি তাহা নাই?’ জাহানগস্ত লজ্জিত হইলেন।

ইতিহাসসম্মত হউক বা না হউক ভক্তদের ইতিহাসে আছে, হিন্দু-মুসলমান উভয়ের অভিযোগে শিকন্দর সাহ লোদী তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠান। অভিযোগকারীর কাট্রায় উভয় দলকে একত্র দেখিয়া কবীর উচ্চ হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘ঠিকই হইয়াছে, তবে ঠিকানায় একটু ভুল হইয়াছে।’ বাদশাহ বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপার কি?’ কবীর কহিলেন, “হিন্দু-মুসলমানকে মিলানোই আমার লক্ষ্য ছিল। সবাই বলিত তাহা অসম্ভব; আজ তাহা সম্ভব দেখিলাম। তোমার মত জগতের রাজার সিংহাসনের তলেই যদি তাহা সম্ভব হইয়া থাকে তবে বিশ্বের অধিপতির সিংহাসনতলে কি আরও প্রশস্ত স্থান মিলিবে না?’ বাদশাহ লজ্জিত হইয়া কবীরকে ছাড়িয়া দিতে বলিলেন। অথচ ‘ফিরিস্তা’ মতে কাজী পীলা সেখ বৃদের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় শিকন্দর সাহ ব্রাহ্মণ বূদনের প্রাণদণ্ড করেন। ব্রাহ্মণের অপরাধ—সে বলিয়াছিল ভগবানের কাছে সকল ধর্মই সমান।

গোরক্ষনাথ নাথপন্থ নিরঞ্জনপন্থ বৈষ্ণবভাব ও ব্রহ্মবাদের বিস্তর প্রভাব কবীরের বাণীতে পাওয়া যায়। গোরক্ষনাথের সঙ্গে তাঁহার যে আলাপ পাই তাহা বোধ হয় সেই পন্থী কোনো সাধুর সঙ্গে আলাপ লইয়া লেখা। সেকালের সকল মতের সাধকদের সঙ্গে আলাপই তাঁর সম্প্রদায়ে রক্ষিত আছে।

সরল হৃদয়ের কথা সহজ ভাষায় তিনি ব্যক্ত করিয়াছেন—তাই তাঁর সরল বাণীর অপার শক্তি। চলিত হিন্দী ভাষাতেই তিনি উপদেশ করেন। তিনি ত আর পণ্ডিত নন— সংস্কৃতের ধার তিনি ধারিতেন না।

তাই কবীর বলিয়াছেন —

সংস্কৃত কূপ জল কবীরা ভাষা বহতা নীর।
হে কবীর, সংস্কৃত হইল কূপজল; ভাষা হইল প্রবহমান জলধারা।

তিনি নানাভাবের সাধকদের সঙ্গে মিলনের পিপাসায় ভারতের নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়াছেন। পুরী প্রভৃতি স্থানে তো দীর্ঘকালই তিনি ছিলেন।

‘কবীর মনশূর’ প্রভৃতি গ্রন্থমতে কবীর মক্কা বগ্দাদ সমরখণ্ড বোখারা প্রভৃতি স্থানে সাধকদের সঙ্গে দেখা করিয়াছেন। বগ্‌দাদ তখন সাধকদের উদার চিন্তার একটি প্রসিদ্ধ ক্ষেত্র ছিল।

বাবা নানক বগ্‌দাদে যে স্থানে গিয়াছিলেন সেটি নাকি এখন একটি পবিত্রস্থান। তাহাতে তুর্কী ভাষায় শিলালেখ আছে। ৯১৭ হিজরায় বাবা সেখানে যান—এখনো সৈয়দ বংশীয় বাবার ভক্তের বংশধর সেই স্থান রক্ষা করেন। ১৯১৯-এর ৯ই এপ্রিলের বগ্দাদের আরবী কাগজ ‘দউল-সালাম’-এ এই বিষয়টি ও শিলালিপির প্রতিলিপি বাহির হইয়াছে।

গুজরাতে নর্মদা তীরে কবীর যখন যান তখন তত্ত্ব ও জীব নামে দুই ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেখানে কবীরের নামে প্রসিদ্ধ এক বিরাট্ বটবৃক্ষ আছে—নর্মদা-তীরে ভরুচ হইতে তাহা বারো তেরো মাইল দূরে শুক্লতীর্থের কাছে একটি দ্বীপ জুড়িয়া বিরাজমান। এখানে নাকি তাঁর স্পর্শে মৃত তরু প্রাণ পাইয়াছিল।

পুরাতন হইলেই একটি কথাকে কবীর সত্য বলিয়া মানিয়া লইতে রাজী ছিলেন। তিনি সত্যকে পরখ করিয়া লইতেন। এজন্য তাঁর পরখ-বাণী আছে। নীতি উপদেশের বাণী আছে। তদনুসারে সাধনা করিয়া তত্ত্ব জানিতে হয়—তাই সাধনা ও তত্ত্বের বাণী আছে। সর্বশেষের অবস্থা হইল প্রেমের। সেই প্রেমের বাণীও কবীরের আছে।

পরিসর ও সুযোগ থাকিলে কবীরের বাণী তুলিয়া দিয়া দেখাইতে চেষ্টা করিতাম তাঁর বাণী কত গভীর ও মধুর।

তাঁহার উপদেশের মোট কথা এই—সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য সব কৃত্রিম বাধা পরিত্যাগ করিয়া সত্য হও, সহজ হও। সত্যই সহজ। সেই সত্যকে বাহিরে খুঁজিয়া বেড়াইবার দরকার নাই। তীর্থে ব্রতে আচারে তিলকে মালায় ভেখে সাম্প্রদায়িকতায় সত্য নাই। সত্য আছে অন্তরে, তার পরিচয় মেলে প্রেমে ভক্তিতে দয়ায়। কাহারও প্রতি বৈরভাব রাখিবে না, হিংসা করিবে না—কারণ, প্রতি জীবে ভগবান্ বিরাজিত। বিভিন্ন ধর্মের নামভেদের মধ্যেও সেই এক ভগবানের জন্য একই ব্যাকুলতা—কাজেই ঝগড়া বৃথা। হিন্দু-মুসলমান বৃথাই এই ঝগড়া করিয়া মরিল। অহংকার দূর করিয়া, অভিমান ত্যাগ করিয়া, কৃত্রিমতা ও মিথ্যা পরিহার করিয়া সকলকে আত্মবৎ মনে করিয়া ভগবৎপ্রেমে ভক্তিতে চিত্ত পরিপূর্ণ কর—তবেই সব সাধনা সফল হইবে। জীবন ক্ষণস্থায়ী, বৃথা কাল নষ্ট না করিয়া ভগবানের শরণাপন্ন হও। বাহিরে যাইবার দরকার নাই, তোমার অন্তরেই তিনি আছেন; সেখানেই সহজে তাঁহাকে পাইবে। শাস্ত্র তীর্থ আচার ও তর্কের পথে বৃথা ঘুরিয়া মরিবে।

কবীর বৃথা কায়াকষ্টের পক্ষপাতী ছিলেন না। পবিত্রভাবে সহজ জীবন যাপন করিয়াই সাধনা চলে, এই তাঁর মত। তিনি বলেন নিজের মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ড, কাজেই বাহিরে না ঘুরিয়া অন্তরে বিশ্বতত্ত্বকে প্রত্যক্ষ কর, বিশ্বনাথ সেখানে বিরাজমান। বাহিরে ভিতরে কোনো প্রভেদ নাই—সকল ভেদ ভগবানের মধ্যে যোগ লাভ করিয়াছে। সকলের সঙ্গে যোগেই পরিপূর্ণ সত্য ও সার্থকতা লাভ হয়।

কবীরের অনেক বাণীই গান। মধ্যযুগের প্রায় সকল ভক্তই গানপ্রিয়; কবিতা ও গানেই ইঁহারা আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন। কবীর নিজে যেমন উত্তম রচয়িতা ছিলেন তেমনি উত্তম গায়কও ছিলেন।

কবীরপন্থীদের মধ্যে শ্বাসে শ্বাসে নামজপ প্রচলিত আছে। জাতিভেদ পৌত্তলিকতা সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে কবীর অগ্নিময়ী বাণী উচ্চারণ করিয়া গিয়াছেন।

এখন কবীরপন্থী ধর্মদাসী সম্প্রদায়ে যে চৌকা পদ্ধতি আছে তাহা দেখিয়া তান্ত্রিকদের চক্র মনে হয়। চৌকায় যদিও নীতিবহির্ভূত কিছুই নাই তবু ইহা বাহ্য অনুষ্ঠান তো বটে। ব্যক্তিগত সাধনাকে সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত করিতে গিয়া তান্ত্রিকরা যে কারণে চক্রের প্রয়োজন বুঝিয়াছেন কবীরপন্থীরাও সেই কারণে চৌকার প্রয়োজন মনে করিয়াছেন। এক ভাবের ভাবুক সাধকরা যদি সামাজিক ভাবে মাঝে মাঝে একত্র না হন তবে সাধনা দুর্বল হইয়া আসে।

বাবা নানক সম্বন্ধে মেকলিফ ট্রাম্প প্রভৃতি পণ্ডিতেরা এত আলোচনা করিয়াছেন এবং নানকের শিষ্যদের মধ্যে এত পণ্ডিত ও কৃতবিদ্যা লোক আছেন যে নানক ও শিখধর্ম সম্বন্ধে নূতন কথা বলিবার আমার আর বিশেষ কিছু নাই। তাই শুধু দু একটি কথা বলিতে চাই।

১৪৬৯ খ্রীষ্টাব্দে নানক লাহোরের নিকট তলরণ্ডীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শস্যবিক্রেতা ছিলেন। ভক্তগণের মতে নানকের যখন যুবা বয়স তখন বৃদ্ধ কবীরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কবীর তাঁহাকে দেখিয়া তুষ্ট হইয়া বলেন ভবিষ্যতের জন্য আর আমার ভয় নাই। সমর্থ মানুষকে দেখিয়া আমি চলিয়া যাইতেছি।

কবীরের ভাবের দ্বারা নানক অনেক পরিমাণে প্রভাবান্বিত হন। নানকের বাণীর মূল সত্যগুলি অনেকটা কবীরের সত্যের সঙ্গে মেলে। গ্রন্থসাহেবে কবীরের অনেক বাণী গৃহীত হইয়াছে।

গায়ক মর্দানাকে লইয়া নানক বহু স্থান ভ্রমণ করিয়াছেন। নানক যে বগ্‌দাদ গিয়াছিলেন তাহা কবীরের প্রসঙ্গেই বলা হইয়াছে। সে ভ্রমণে মর্দানা তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। নানকের বাণীগুলি পাঞ্জাবী মিশ্রিত হিন্দীতে রচিত। নানক অতিশয় সংগীতপ্রিয় ও নিজে সংগীতরচয়িতা ছিলেন।

নানক পৌত্তলিকতা জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে যথেষ্ট বলিয়াছেন। প্রেমের পথে আত্মবিসর্জনই হইল তাঁর মতে প্রথম সাধনা। সব কৃত্রিম ছাড়িয়া এক পরমেশ্বরকেই ভজনা করিতে হইবে। অন্তরের মধ্যেই অন্বেষণ করিলে সকল রত্ন মেলে।

নারীর প্রতি তাঁর মত বুঝা যায় এই বাণী দেখিলে—যাঁহার গর্ভে মানবের চালকেরা (রাজা) জন্মগ্রহণ করেন তাঁহাকে কেন মন্দ বল?

‘মিথ্যা আপনাকে আপনি ক্ষয় করে, সত্যই শেষ পর্যন্ত জয়ী।’

নানকের জপজীর বাণীগুলি কবীরের বাণী হইতে তবু একটু বেশী হিন্দুভাবাপন্ন— যদিও মুসলমান ভক্তেরা বলেন নানক সৈয়দ হুসেন নামক এক মুসলমান সাধকের কাছে মুসলমান সাধনা শিক্ষা করেন। বগ্দাদে নানকস্থানে নাকি তাঁর বাণী-সংগ্রহ আরবী ভাষায় আছে। তাহা যদি সত্য হয় তবে তাঁহাকে সূফীও বলা চলে। (‘টেম্পল অফ গুরু নানক ইন বাগ্দাদ’—রামদাস বিসনদাস লখানী)

নানকের পর আরও নয় জন বিখ্যাত গুরু শিখধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

ষষ্ঠগুরু অর্জুন ১৬০৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘আদিগ্রন্থ’ সংগ্রহ করেন। আদিগ্রন্থের সঙ্গে পরবর্তী গুরুদের বাণী যোগ করিয়া গ্রন্থসাহেব রচিত হয়। ইহাতে রামানন্দ, নামদেব, কবীর, রবিদাস, পীপা, সেখ ফরীদ প্রভৃতি ভক্তদের বাণী আছে তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। তা ছাড়া নানক, অঙ্গদ, অমরদাস, রামদাস, অর্জুন, তেগ বাহাদুর প্রভৃতি গুরুর পদ আছে— গুরু গোবিন্দের একটি দোঁহাও আছে। এই গ্রন্থের আরম্ভে নানক-রচিত জপজী—তার পর সব পদ রাগ অনুসারে ভাগ করা। ইহাই মধ্যযুগের দাদূ রজ্জব প্রভৃতি সকল ভক্তের গান বা সবদ বিভাগের পদ্ধতি। এই রাগাবলীর পরে আছে ভোগ বা স্তব এবং দোঁহা বা শ্লোক-সংগ্রহ। গোবিন্দ ছাড়া আর সকলেই নানকের নামে পদরচনা করিয়াছেন। ভোগ অঙ্গে ত্রিলোচনকৃত পদ ও জয়দেবকৃত পদ আছে। জয়দেবের বাণীতে ভাষাটি সংস্কৃতমিশ্রিত ভাষা।

মুসলমান রাজাদের অত্যাচার ও আক্রমণের প্রতিকার করিতে দশম গুরু গুরগোবিন্দ শিখ খাসা সৈন্য রচনা করেন। দাদূর খাসা কিন্তু এই খাসা নহে। ব্রজভাষায় ও পাঞ্জাবীতে গুরু গোবিন্দের অনেক বাণী আছে।

গুরু গোবিন্দের মৃত্যুর পর ১৭৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ভাই মণি সিংহ গুরু গোবিন্দের বাণীগুলি একত্র করেন। পুরাতন গ্রন্থসাহেব হইতে এই সংগ্রহ যে বিভিন্ন তাহা বুঝাইবার জন্য ইহার নাম দেন ‘দশম গুরুর গ্রন্থসাহেব’। এই গ্রন্থের বাণীগুলিতে আধ্যাত্মিক ভাব অপেক্ষা বীর ও পৌরুষ ভাবই বেশী।

মালিক মুহম্মদ জায়সীর কথা পূর্ব আলোচনায় বলা হইয়াছে। তবু এখানে বলি, তিনি কবীরের ভাবের দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত। তাঁহার ‘পদুমাবতী’ অতি উদার ধর্মভাবের সহিত লেখা। ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দে গ্রন্থখানি লেখা হয়। তাঁহার চারি বন্ধুর মধ্যে দুই জন ভোজপুররাজ জগৎদেবের সভাসদ ছিলেন। তার মধ্যে মিয়া সলোনে ছিলেন আসলে সলোনে সিংহ। মিয়া শুনিয়া মনে হয় মুসলমান। জায়সী চিন্তিয়া সম্প্রদায়ের সাধক মহীউদ্দিনের শিষ্য। সংস্কৃতেও ইনি পণ্ডিত ছিলেন। পদ্মাবতী ভক্তদের কাছে পারমার্থিক উপদেশের জন্য সমাদৃত। তাঁর সমাধিস্থানে এখনো বহু ভক্ত একত্র হন।

কবীরপন্থের দুই ধারা। কাশীর ধারা সুরতগোপালের স্থাপিত। কবীর-চৌড়ায় ইঁহাদের মুখ্যস্থান। পুরী দ্বারাবতী ও মগহরেও ইঁহাদের স্থান আছে। ইঁহাদের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

ধর্মদাসী শাখার প্রধান স্থান ছত্রিশগড়ে। ইঁহাদের সম্প্রদায়ে এখন বিয়াল্লিশ লক্ষ লোক। কাশীর শাখার লোকসংখ্যা বেশী নয়। ছত্রিশগড়ী শাখার কবীরপন্থী নেপালে, সিকিমে, হিমালয়-প্রদেশে, পঞ্জাবে, সিন্ধুদেশে, গুজরাতে, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে, বিহারে ও ভারতের বাহিরেও আছে। তাহার কারণ ইঁহাদের মধ্যে শাস্ত্রীয় ভাবের বন্ধন কম, মানবীয় ভাব একটু বেশী। কাশী শাখা বীজক ও তাহার বঘেলখণ্ডী টীকাই মানে। এই শাখা ‘কবীর-সাগর’ ও অন্যান্য গ্রন্থ এবং বীজকের ত্রিজ্যা টীকা বেশী মান্য করে।

ধর্মদাসের জন্ম বাংধোগড় নগরে। তিনি জাতিতে কসৌধন বাণিয়া। ভক্তরা বলেন ১৪৪৩ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি তাঁর জন্ম। বাল্যকাল হইতেই তিনি ভক্তিমান্, তখন মূর্তিপূজা করিতেন। ইনি যখন যুবা, তখন মথুরায় কবীরের সঙ্গে দেখা হয়, তিনি তাঁর সকল ভ্রম দূর করিয়া এক সত্য পরমেশ্বরের প্রেমভক্তিতে ধর্মদাসকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ‘অমরসুখনিধানে’ সেই কথোপকথন লিখিত আছে। ‘ভারত ব্রাহ্মণের’ মত যদি গ্ৰহণ করা যায় তবে কবীরের মৃত্যুকালে ইঁহার বয়স শুধু পাঁচ বৎসর দাঁড়ায়।

ঘটরামায়ণ-মতে কবীরের সঙ্গে তাঁর দেখা কাশীতেই হয়। সেইখানেই তিনি তাঁর মূর্তিপূজার ভ্রম দূর করেন।

ধর্মদাসের স্ত্রী ও জ্যেষ্ঠপুত্র চূড়ামণি দাসও কবীরের ধর্মমত গ্রহণ করিলেন। ধর্মদাস ধনী ছিলেন, তিনি সকল বৈভব বিতরণ করিয়া সাধনার জীবন গ্রহণ করিলেন।

ধর্মদাসের মৃত্যুর পর নারায়ণ ও চূড়ামণি দাস এই সম্প্রদায়ের প্রধান হইলেন। ইঁহারা গুরু হইলেও বিবাহিত। ইঁহাদের পুত্ররাই পিতার গদীতে বসেন। তাই ইঁহাদের গদীকে বংশগদী বলে। ইঁহাদের শেষগুরু দয়ানাম সাহেবের মৃত্যুতে সম্প্রদায়ের রক্ষা লইয়া খুব গোলমাল চলিয়াছে।

ভগ্‌গূ প্রবর্তিত কবীরপন্থের এক শাখা আছে ত্রিহুত জেলায় ধনৌলী গ্রামে। ভগ্‌গূর মঠ উড়িষ্যার কটকে। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের স্থান সাসারামের নিকট মক্মনী গ্রামে। টকসারী সম্প্রদায়ের স্থান বরোদায়। নিত্যানন্দ কমলানন্দ ও চতুর্ভুজ কবীরের আজ্ঞায় ভক্তিস্থান দ্রাবিড়ে সাধনার্থ যান।

কবীরের পুত্র কমাল খুব বড় সাধক ও খুব উচ্চশ্রেণীর কবি ছিলেন। সাধুদের কাছে তাঁর দুই একটি পদ যাহা মিলে তাহা চমৎকার।

কবীর কমাল জমাল বিমল বুঢ এবং তাঁহার শিষ্য (কোন কোন মতে কমালেরই শিষ্য) দাদূ। সুধাকর দ্বিবেদী মহাশয় মনে করেন দাদূর জন্ম কাশীতে মুচী বংশে। অন্য মতে তাঁর জন্ম গুজরাত আমেদাবাদে। তাঁর অনুবর্তীরা প্রমাণ করিতে চান তিনি নাগর ব্রাহ্মণের বংশে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর লেখায় দেখা যায়, তিনি জাতিতে তূলা-ধুনকর ছিলেন। এখন এ বিষয়ে জনগোপাল-কৃত ‘জীবন-পরচী’ ও তেজানন্দ-কৃত গ্রন্থ প্রভৃতি বহু গ্রন্থ দেখিয়া নিশ্চয় করিয়াছি যে তিনি মুসলমান ধুনকর ছিলেন। ধুনকর হিন্দু-মুসলমান দুই দলই ছিল। মুসলমানরাও ঐ হিন্দুশাখা হইতেই ধর্মান্তর গ্রহণ করে এবং শিক্ষা নাই বলিয়া সেইরূপই কুসংস্কারাচ্ছন্ন। কিন্তু নিজ প্রতিভায় সাধুসঙ্গগুণে ও সাধনায় তাঁর অসামান্য দৃষ্টি খুলিয়া যায়। তাঁর পূর্ব নাম ছিল দাউদ। তাঁর স্ত্রীর নাম হবা (Eve)। তাঁর দুই পুত্র গরীব দাস ও মস্কীন দাস, দুই কন্যা নানী বাঈ ও মাতা বাঈ।

১৬০৩ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করিয়া ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দে জ্যৈষ্ঠমাসের কৃষ্ণাষ্টমী শনিবারে রাজপুতানা নরাণায় দাদূ দেহত্যাগ করেন। এখানেই এখন ইঁহাদের প্রধান মঠ।

মৈত্রীর সহিত সকল ধর্মের একত্র মিলনের জন্য ইনি ‘ব্রহ্মসম্প্রদায়’ বা ‘পরব্রহ্মসম্প্রদায়’ স্থাপন করেন।

হিন্দু মুসলমান ও সকল ধর্মকে এক উদার মৈত্রীভাবের দ্বারা যুক্ত করিবার এক বড় আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল। তাঁর বাণী যেমন গভীর তেমনি উদার। বাণীতে বার বার কবীরের গুণগান করিয়াছেন।

দাদূ শাস্ত্র মানেন নাই, আত্মানুভবকেই বড় মানিয়াছেন। অহমিকা ত্যাগ করিয়া এক ঈশ্বরের শরণাপন্ন হইয়া সকলকে ভাইবোনের মত দেখিবে ইহাই তাঁর উপদেশ। অন্তরেই ভগবানের ধাম, প্রেমেই সেখানে তাঁহাকে পাওয়া যায়। ভক্তিতে ঈশ্বরের সহিত যুক্ত হইবে। তাঁর কাছে কিছু প্রার্থনা না করিয়া বরং তাঁর বিশ্বসেবার সঙ্গে নিজ সেবা মিলাইলে যোগ গভীরতর হইবে। সত্য অজেয়, সত্য জীবনে লুকানো যায় না। দুর্নীতি মলিনতা ত্যাগ করিয়া সরলভাবে তাঁর ইচ্ছার অধীন হইবে——ইহাই যোগ। নম্র, নিরভিমান, দয়ালু, সেবা-পরায়ণ হইবে। নির্ভয় হইবে, উদ্যমী বীর হইবে। সম্প্রদায়বুদ্ধি ত্যাগ করিবে। তীর্থ ব্রত মূর্তিপূজা বাহ্য আচার ও চিহ্ন ধারণ সব ব্যর্থ ক্ষমাশীল হইবে। ভগবদ্‌বিশ্বাসে দৃঢ় হইবে। সদ্‌গুরু মিলিলে সাধনা সহজ হয়। ইনি সহজভাবে খুব দৃঢ়-বিশ্বাসী ছিলেন। ইঁহার প্রার্থনাগুলি অতি মধুর ও গভীর। ইনি গৃহী ছিলেন এবং গৃহী হইয়া সাধনা করা পছন্দ করিতেন।

ইঁহার লেখা ইঁহার শিষ্য জগন্নাথ ‘হড়ড়ে বাণী’ নামে সংগ্রহ করেন। শিষ্য রজ্জব ইঁহার লেখা সাঁইত্রিশটি অঙ্গে এবং সাতাশটি রাগে ভাগ করিয়া সংগ্রহ করেন। তাহা ছাড়া ‘কায়াবেলী’ গ্রন্থও আছে। এই সংগ্রহের নাম ‘অঙ্গবন্ধু’।

ইঁহার আজ্ঞায় শিষ্যেরা নিজ সাধনার জন্য নানা সম্প্রদায়ের ভক্তদের লেখা একত্র করিতেন। জয়পুরে সাধু শঙ্কর দাসের কাছে তাঁর গুরুর ব্যবহৃত এক প্রাচীন বিশাল ভজনগ্রন্থ পাই। তাহাতে আটষট্টি জন ভক্তের পদ আছে।

তাহাতে মুসলমান ভক্তেরও অনেক নাম আছে। যথা—

গরীব দাসজী।

কাজী কাদমজী।

সেখ ফরিদজী।

কাজী মুহম্মদজী।

সেখ বহারদজী।

বখনাজী।

রজ্জবজী।

প্রভৃতি মুসলমান সাধকের পদ আছে।

গ্রন্থসাহেবে রামানন্দের একটি মাত্র পদ থাকিলেও এই গ্রন্থে রামানন্দের তিনটি পদ পাইয়াছি।

রজ্জবের সংগ্রহ ‘সর্বাঙ্গী’ ও জগন্নাথ-কৃত সংগ্রহ ‘গুণগঞ্জনামা’ ভারতীয় সাধকদের নানা অপূর্ব বাণীর সংগ্রহ।

ইঁহার শিষ্যদের মধ্যে রজ্জবজী বখনাজী ওয়াজিন্দ খাঁ প্রভৃতি অনেকে মুসলমান। আকবরের সঙ্গে তাঁহার চল্লিশ দিন ব্যাপী আলাপ হয়। তাহার বিবরণ ভক্তরা রাখিয়াছেন। তাহার পরই নাকি আকবর মুদ্রায় নিজের নাম দিয়া এক পিঠে ‘জল্লজুলালুহু’ ও অন্য পিঠে ‘আল্লাহুআকবর’ অঙ্কিত করেন। তাঁহার সময় আমেরের রাজা ছিলেন ভগবন্ত দাস।

দাদূর শিষ্যদের মধ্যে—

জগজীবনজী। দ্যৌসা নগরবাসী।

সুন্দর দাসজী (বড়)। বিকানীর রাজবংশে জন্ম।

সুন্দর দাসজী (ছোট)। দ্যৌসায় জন্ম, কবি।

ক্ষেত্রদাসজী।

রজ্জবজী। কবি ও সাধক, তাঁর স্থান সাঙ্গানের ও ফতেহপুর।

গরীবদাসজী। দাদূর জ্যেষ্ঠপুত্র।

জাইসাজী।

মাধোদাসজী। যোধপুর, গুলরগ্রামবাসী।

প্রয়াগদাসজী বীহাণী। ভীড্‌বাণা ও ফতেহপুরে থাকিতেন।

বখনাজী।

বনওয়ারীদাসজী। উত্তরাধী শাখার প্রবর্তক।

শঙ্করদাসজী। যোধপুর, বুশেরাগ্রামবাসী।

মোহনজী। প্রায়ই সাঙ্গানেরে বাস করিতেন।

মস্কিনদাসজী। দাদূর কনিষ্ঠ পুত্র।

জনগোপালজী। জয়পুর শেখাবাটীর আন্ধীগ্রামে মঠ

জগন্নাথজী। দাদূর নিত্যসঙ্গী, গুণগঞ্জনামার সংগ্রহকারী।

হরিদাসজী। নিরঞ্জনী।

নিশ্চলদাসজী। পরে বেদান্তী হন।

এই সব ভক্ত প্রত্যেকে এক-একজন দিপাল। রবীন্দ্রনাথ রজ্জবের প্রার্থনা ও বাণী দেখিয়া বলেন, ‘জগতের কোন সাহিত্যে এমন গভীর ও মধুর প্রার্থনা দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না।’

ইঁহাদের নাম দিলাম মাত্র। রজ্জবের কিছু পদ দিবার ইচ্ছা ছিল। স্থান ও কালের অভাবে দেওয়া অসম্ভব।

দাদূর সম্প্রদায়ে হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর লোক গৃহীত হইয়াছেন। মুসলমান বংশে জাত বহু গুরু দাদূ-সম্প্রদায়ে আছেন। এখনো দাদূর রজ্জব-শাখায় হিন্দু বা মুসলমান যিনিই সাধনায় বড় হন তাঁহাকেই সকলে প্রাধান্য ও গুরুর স্থান দেন।

জয়পুর শীকরে, শেখাবাটীতে, খেতরীর অন্তর্গত চূড়ী গ্রামে, জয়পুর কালভৈরাতে, ভীরানীনগরে, জয়পুরের অন্তর্গত মাল্সীপুরে, পাটিয়ালার অন্তর্গত নারনৌল নগরে এখনো রজ্জবের বহু ভক্ত ও মঠাদি আছে। ইদানীং এই সম্প্রদায়ে অনেকে ‘সাধু’ অনেকে ‘বিরক্ত’। সংসারীদের মধ্যে পণ্ডিত উপাধিধারীও অনেকে আছেন।

রজ্জব বলেন, চারিদিকের অন্ধকারের মধ্যে যে দীপ আলোক দিবে তাহা আমাদের অন্তরে।

দেহকে বৃথা কষ্ট দিয়া শুষ্ক বৈরাগ্যে তোমার অন্তরের শত্রু কি দমন করিতে পার? না কোন আলোক পাও?

রজ্জব বলেন—

জীবন-মস্‌জিদের মধ্যে নমাজ ও প্রণতি পূর্ণ কর। মনই সেখানে মাঝে মাঝে নানা গোলমাল আনিয়া উপস্থিত করে। সেই শান্ত ভজনালয় হইতে এই কাফের মনকে বাহির করিয়া দাও।

জীবনের সব দিককে সব ভাবকে পূর্ণ করিয়া সাধনা পূর্ণ কর। বাঘ বিড়াল প্রভৃতি জন্তু কয়েকটি বাচ্চা প্রসব করে, তার দুই একটাকে প্রবল করিতে অন্যগুলিকে মারিয়া খাওয়ায়, তেমনি সাধনার যদি একটি দুইটি ভাব পুষ্ট করিতে জীবনের অন্য ভাবগুলিকে বধ করা হয় তবে বাঘ-বিড়ালের সাধনাই হয়। দয়া পুষ্ট করিতে গিয়া কেহ যদি পৌরুষ নষ্ট করিয়া ক্লীব হইয়া যায় তবে সে সাধনার বলিহারি! বীরদের উপরেই সংসারের সব নূতন সৃষ্টির ভার। কাপুরুষেরা জগতে কি সৃষ্টি করিতে পারে?

যত মনুষ্য তত সম্প্রদায়। এমন করিয়াই বিধাতা বৈচিত্র্য রচনা করিয়াছিলেন। অথচ সকলের সব প্রণতি মিলিয়া একটি মহা প্রণতিধারা হরিসাগরের দিকে চলিয়াছে।

নারায়ণের পদোদ্ভবা গঙ্গা। প্রতি ভক্তের হৃদয়ে যদি ভগবানের চরণ থাকে তবে সকল হৃদয় হইতে একটি একটি ভাবগঙ্গা বাহির হইতেছে। জগতের এই সকল গঙ্গাকে মিলিত করিয়া যে মহাতীর্থ, সেখানে স্নানেই মুক্তি।

প্রতি বিন্দুতে সিন্ধুর ডাক আছে। তবু একলা একটি বিন্দু সাগরের দিকে রওয়ানা হইলে পথেই সে শুকাইয়া মরিবে। সকল বিন্দু একত্র হইলে যে ভক্তির গঙ্গা হয় তাহাতে পথের সব বাধা ও শুষ্কতা দূর হইয়া যায়। জগতের সকল ভাবের ধারা একত্র করিয়া মানবের সব শুষ্কতা দূর কর।

‘সকল বসুধাই বেদ, পরিপূর্ণ সৃষ্টিই কোরান। কতকগুলি শুষ্ক কাগজের সমষ্টিকে পরিপূর্ণ জগৎ মনে করিয়া পণ্ডিত ও কাজীরা ব্যর্থ হইতেছেন। সাধকের অন্তরই কাগজ। তাহাতে প্রাণের অক্ষরে সকল সত্য দীপ্যমান; সকল হৃদয়ের মিলনে যে বিরাট্ মানব- ব্রহ্মাণ্ড তাহাতে পরিপূর্ণ বেদ কোরান ঝলমল করিতেছে। বাহিরের কৃত্রিমতার বাধা দূর করিয়া সেই প্রাণকোটী-ব্রহ্মাণ্ডের সত্য পড়িয়া দেখ; মৃত কাগজে প্রাণহীন অক্ষরের পাঠকই জগতে দেখা যায়। জীবনে জীবনে যে প্রাণময় বেদ, হে রজ্জ্ব, পড়িতে হইলে তাহাই পড়।’

কবি সুন্দরদাসের প্রধান পাঁচ শিষ্য—শ্যামদাসজী, দামোদরদাসজী, দয়ালদাসজী, নির্মলদাসজী, নারায়ণদাসজী। এই রকম প্রত্যেকেরই শিষ্যক্রমে অনেক বড় বড় ভাব ও চিন্তার নেতা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।

কবীরের মতবাদ রাজপুতানা, পাঞ্জাব, সিন্ধু দিয়া ক্রমে কাঠিয়াওয়াড় ও গুজরাত গিয়া পৌঁছিল। যখন কবীর-সম্প্রদায় গুজরাতে পৌঁছিল, তখন তাঁর নাকি সেখানে বারো শাখা। তার মধ্যে সত্য-কবীর, নাম-কবীর, দান-কবীর, মঙ্গল-কবীর, হংস-কবীর, উদা বা উদাসী-কবীর প্রভৃতি সম্প্রদায়। গুজরাতের দিকে কবীর পন্থের সৎকবীর শাখা অনেকটা উদার রহিল কিন্তু উদা সম্প্রদায় অত্যন্ত আচারবিচারপরায়ণ ও অত্যধিক শুচিতাগ্রস্ত। নিজেদের সম্প্রদায়ের লোক ছাড়া ইহার কাহারও উনন, বাসন, এমনকি জলপানের ঘটিও ব্যবহার করে না, মাজিয়া দিলেও না। এমনকি, ভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বজাতীয় বা উচ্চজাতীয় লোকের ‘ভাণ্ডবাসন’ বা ছোঁয়া জিনিস বা জল ইহার ব্যবহার করে না। সুরত, ভরুচ প্রভৃতি দিকে, বরোদা, ছোট উদয়পুর প্রভৃতি রাজ্যে উদাপন্থী আছে, তাহাদের ছেলেরা এই শুচিতার জন্য কোনো বিদ্যালয়ে গিয়া লেখাপড়া করিতে পারিতেছে না। কবীরের কোনো উচ্চ ভাব বা আদর্শ আজ ইঁহাদের মধ্যে নাই। ভারতে পূজ্য হইবার সহজ পন্থা এই শুচিতাবাদ মাত্র ইহাদের এখন একমাত্র সম্বল।

কাঠিয়াওয়াড়ে কবীরের যে শাখা তাঁহার জীবন্ত ভাব ও উদারতা লইয়া কাজ করিতেছিল, তাহার প্রধান নেতার নাম ভান সাহব। তাঁহার সময় আনুমানিক ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দ। তিনি জাতিতে লোহাণা। কনখিলোড় গ্রাম হইতে তিনি বারাহী গ্রামে যাইয়া বাস করেন। তাঁর পিতার নাম কল্যাণ, মায়ের নাম অম্বা। ইনি সৎকবীর-সম্প্রদায়ের লোক।

তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কুররজী রবিদাসজী শ্যামদাসজী শঙ্করদাসজী মাধবদাসজী চরণদাসজী দয়ালদাসজী গরিবদাসজী কৃষ্ণদাসজী খুব প্রধান স্থানীয় ছিলেন। তাঁর পুত্র ক্ষেমদাসজীও প্রসিদ্ধ সাধক ছিলেন। কিন্তু বোধ হয় সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন তাঁর অন্ত্যজ-জাতীয় শিষ্য জীবনদাসজী ও ত্রিকমদাসজী—ভান বলিতেন এই মণ্ডলকে লইয়া আমি দেশের সর্ববিধ দুর্গতি ও হৃদয়ের অন্ধকার জয় করিব। তাই লোকেরা এই মণ্ডলকে ঠাট্টা করিয়া বলিত ভান ফৌজ বা ভানের সৈন্যদল।

রবি সাহব ছিলেন জাতিতে বণিক, একজন ঋণীর বাড়ী তাগাদা করিতে আসিয়া ভান সাহবকে তথায় দেখেন ও তাঁর প্রভাবে তাঁর কাছে ধর্মদীক্ষা গ্রহণ করিয়া নবজীবন প্রাপ্ত হন।

ভানের অষ্টপদ সংসারের অনিত্যতা, নিরঞ্জন বিভু ভগবানের সর্বব্যাপিত্ব প্রভৃতি কবীর-মতের কথাই বেশী।

তাঁর মৃত্যুর সম্বন্ধে কথা আছে যে, ভগবানের নামে তিনি আপনাকে নিমজ্জিত করিয়া দিয়াছিলেন।

কাঠিয়াওয়াড়ের লাখনকার ভক্ত বাবা মোহনদাসের মতে কবীর মতের সাধক লৌলংগ্রীর শিষ্য ভান সাহব। লৌলংগ্রীর অন্য শিষ্য আংবো ছট্টোর স্থান এখন দুধরেজ।

ভানের পুত্র ক্ষেমদাসজী, তাঁর শিষ্য অন্ত্যজ ভক্ত ত্রিকমজী ও অন্ত্যজ জীবনদাসজী তাঁর শিষ্য।

ভানের শিষ্য রবি সাহব, তাঁর শিষ্য মোরার। মোরারের স্থান মোরার খম্বালিয়া কাঠিয়াওয়াড়ে ভক্তদের একটি প্রধান তীর্থস্থান।

অনেকের মতে ভানের শিষ্য ভীমভক্ত। তাঁর শিষ্য ঢেঁঢ়-জাতীয় জীবনদাসজী। গোণ্ডালের নিকট ঘোঘা-বদর তাঁর স্থান। তাঁহার চামড়া ভিজাইবার কুণ্ডটি এখন ভক্তদের একটি তীর্থস্থান। জীবনের শিষ্য কড়িয়া (রাজমিস্ত্রী) জাতীয় প্রেমদাসজী, চারি ক্রোশ দূর হইতে প্রতি রাত্রে জীবনদাসের কাছে আসিয়া ভগবৎপ্রসঙ্গ ও ভক্তিকথা শুনিতেন। গুরু বর দিতে চাহিলে তিনি প্রেম-ভক্তি বর চান। গুরু বলিলেন, তাহা তো তোমার পূর্ব হইতেই আছে। তখন প্রেমদাস বলিলেন, তুমি যাহা ভাল মনে কর তাহাই দাও। গুরু বলিলেন, আমার তো বংশ নাই। তোমার বংশ দিয়াই আমার সাধনার ধারা চলিবে প্রেমের কন্যা ছিল, পরে তাঁর পুত্রও হয়। সেই ধারাই এখন গুরু।

অন্ত্যজ জীবনদাসজীর এক শিষ্য ছিলেন রাজপুত-জাতীয় অর্জুনদাসজী। তিনিও সমর্থ সাধক ছিলেন। ইঁহাদের গান ভক্তদের মধ্যে খুব আদৃত। সে সব দেশে ভজনীয়ারা তাহা ভক্তিভরে গান করেন। স্থানাভাবে তাহার নমুনা দেওয়া গেল না।

জুনাগড় লাইনের বনথলী স্টেশন হইতে তিন ক্রোশ দূরে মোরার সাহবের খম্বালিয়া। গণ্ডালে দেবপাড়ায় জীবনদাসজী ভজনীয়ার স্থান। বাঁকানোর রবিসাহস- সম্প্রদায়ের সাধক রতনদাসের স্থান। এখানে অনেক কড়িয়া-জাতীয় ভক্ত আছেন। রাঢ়রানের নিকট দুধরেজে কড়িয়া ভক্তের মঠ। কচ্ছ বাগডে, মালিয়া শাহপুরে, ধ্ৰাংগধায় এই সব ভক্তদের অনেক মঠ আছে।

ভারনগর প্রভৃতি স্থানে কাঠিয়াওয়াড়ে কবীরপন্থী আছেন। কিন্তু তাঁহারা প্রায় সেই সব দেশেরই শাখার ভক্ত।

দাদূর সকল শাখা প্রশাখা ছাড়াও কবীরের প্রভাব আরও নানা শাখায় ভারতের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িল।

কবীরের শিষ্য জ্ঞানীদাস কয়েকটি সাধক সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। কাঠিয়াওয়াড়ের মার্গী সম্প্রদায় বলেন, নিত্য সাধনার মার্গে থাকাই সত্য সাধনা। সাধনায় অবসান অর্থাৎ সিদ্ধি বলিয়া কিছু নাই। তাঁহারা গৃহস্থ সাধক

মূলপন্থী মত প্রবর্তন করেন সাহীবদাস। বাবালাল সম্প্রদায় পঞ্জাব ও মলরায় আছে। ইঁহারাও কবীরের সত্যের কাছে ঋণী। দারাশিকোহের সঙ্গে বাবালালের আলাপের কথা পরে বলা হইবে।

সাধ সম্প্রদায় আছে ফরক্কাবাদে। তাঁহারাও কবীরের ভাবে সাধনা করেন।

জগজীবনের সৎনামী সম্প্রদায়, গাজীপুরের শিবনারায়ণী সম্প্রদায়, চরণদাসী, পল্‌টুসাহেবী, মলুকদাসী, প্রাণনাথী, দরিয়া সাহবী প্রভৃতি সম্প্রদায় কবীরের ভাবেই ভাবিত।

এইগুলি পরে ক্রমে বলা যাইতেছে।

তবে কবীরের মতবাদ প্রচারিত হইবার পূর্বে বাংলা ও উড়িষ্যায় নাগপন্থ ও নিরঞ্জনপন্থের প্রচার ছিল। পরে উড়িষ্যার মহিমাপন্থ ও কুম্ভীপটিয়া মতবাদ প্রবর্তিত হয়। উড়িষ্যার কুম্ভীপটিয়া মত মুকুন্দদেব কর্তৃক স্থাপিত। ইঁহারা মূর্তি মন্দির ও ব্রাহ্মণের শাসনবিরোধী। জাতিবিশেষের শ্রেষ্ঠতা ইঁহারা মানেন না। একবার ইঁহারা জগন্নাথদেবের মন্দির ভাঙ্গিয়া দিতে গিয়াছিলেন। এই মতবাদের সঙ্গে কবীর বা পশ্চিমের সাধকদের অনেক মিল থাকিলেও ইঁহারা একেবারে ঐ সাধনা হইতে স্বাধীনভাবে অগ্রসর হইয়াছেন।

উড়িষ্যার অনন্তকুলীরা যে কোনো জাতির কন্যা বিবাহ করেন ও সকল জাতির সঙ্গে পংক্তিভোজন করেন।

উড়িষ্যার বিন্দুধারীদের মধ্যে যে কোনো জাতির শিষ্য হইতে পারা যায়। গুরু জ্ঞানী হইলেই হইল।

বাংলাদেশের খুসীবিশ্বাসী, সাহেবধনী, রামবল্লভী, জগমোহনী, বলয়ামী, ন্যাড়া, সহজী, আউল, বাউল, দরবেশ, সাঈ, সংযোগী, যদ্ধপতিয়া, কর্তাভজা প্রভৃতি দলের উপর বাংলা মগধের সহজমত, নাথমত, নিরঞ্জনমতের প্রভাব যথেষ্ট; মুসলমান ভাব ও সাধনাও অনেকটা আছে। কবীর-দাদূ প্রভৃতির শিক্ষাও কিছু কিছু আসা অসম্ভব নহে। এ সব সম্প্রদায় বাংলাদেশের, কাজেই পাঠকদের কতকটা জানার কথা। ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ে অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় ইঁহাদের পরিচয় দিয়াছেন, তাই এখানে আর কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। ইঁহারা জাতি পংক্তি প্রতিমা ও শাস্ত্র মানেন না। হিন্দু বা মুসলমান বলিয়াও ইঁহাদের কোনো বাদবিবাদ নাই।

সিন্ধের সূফীদের নাম পূর্বে করা হইয়াছে বলিয়া এখানে আর তাঁহাদের নাম করিলাম না। নহিলে এখানে তাঁহাদের নাম করা উচিত ছিল।

এখানে উত্তর-পশ্চিম ও দিল্লী প্রদেশের হিন্দু-মুসলমানে মিলিয়া যে একরকম নূতন সূফী মত গড়িয়া তুলিয়াছিলেন তাঁহাদের নাম করা উচিত।

দিল্লীতে বাবরী (১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি) সাহব নামে এক সূফী সাধক ছিলেন। তাঁর শিষ্য ছিলেন বীরু সাহব। তিনি জন্মতঃ হিন্দু। তাঁর শিষ্য হন সূফী ভক্তয়ারী শাহ। ইঁহার সময় আনুমানিক ১৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৭২৫ খ্রীষ্টাব্দ।

মুসলমান হইলেও ইঁহার রচনায় আল্লার সঙ্গে রাম হরি আরতি দেহতত্ত্ব শূন্যতত্ত্ব প্রভৃতি গভীর ভাব বিদ্যমান। হিন্দু বা মুসলমানের কোনো সংকীর্ণতাই ইঁহার নাই। ইঁহার গানে গুরুর চরণরজের অঞ্জন দিবার কথা আছে। সৃষ্টি হইল শূন্যের কাগজে তাঁর প্রেম-কলমের লেখা। যে এই রস প্রত্যক্ষ করে নাই, তাহাকে যুক্তি দ্বারা বুঝান অসম্ভব। মানব ব্রহ্মসাগরেরই বুদ্বুদ্‌—ইত্যাদি কথা চমৎকার পদে রচিত আছে।

য়ারীর শিষ্য বুল্লা সাহব, সুফী শাহ, সেখন শাহ, হস্ত মুহম্মদ শাহ ও কেশবদাস। কেশবদাসের সময় আনুমানিক ১৬৯৩ হইতে ১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দ। কেশবদাসের পদ বিশেষতঃ তাঁর ‘অমী ঘুঁট’ বা অমৃত পান সাধকদের মধ্যে সমাদৃত। তিনি সাধক য়ারীর কাছে অজপা মন্ত্র পাইয়া নিজকে ও নিজের জীবনকে ধন্য মানিয়াছেন। সেই সাধনার বলে জগতকে নুতন দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন। কেশব বলিতেছেন-

কোটি ব্রহ্মা-বিষ্ণুর যে রস ধ্যেয় সেই অমৃত রস আর আমার মধ্যে ধরিতেছে না।

সেই ভগবানের স্বরূপে দৃষ্টি খুলিয়া গিয়াছে। এখন আর সৌন্দর্য শোভা বিশ্বে ধরিতেছে না।

সকল সংশয়-দ্বিধা ভাসাইয়া দিয়া সেই ভগবানের চরণে লুটাইয়া পড়াই হইল সাধনা।

বুল্লা জাতিকে কুনবী বা চাষী। ইনি য়ারীর শিষ্য ও কেশব-দাসের সমসাময়িক। ইনি প্রথমে ইহার শিষ্য গুলাল সাহবের চাষীদাস ছিলেন। চাষ করিতে গিয়া ইনি ধ্যানে মগ্ন থাকিতেন। এই কথা শুনিয়া গুলাল রুষ্ট হন। একদিন আসিয়া দেখেন, বুল্লা কাজ করিতেছেন। তবে তাঁর মন কোনো এক অতীন্দ্রিয় লোকে। গুলাল একটু লজ্জিত হইলেন। বুল্লা কহিলেন, “তুমি দেহের প্রভু, দেহ তোমার কাজ করিতেছে। হৃদয় নন রহিয়াছে হৃদয়েশ্বরের কাছে।” ইহার প্রেমভক্তির পরিচয় পাইয়া গুলাল ইহার শিষ্য হন। ইহার প্রার্থনা ব্রহ্মস্তব অসীম রসপানানন্দা-বর্ণনা মুক্তির খেলা আরতি স্তব প্রভৃতি চমৎকার।

ইঁহার লেখায় পাই—পূরব দেশের এক ব্রাহ্মণ অবধূত ইহার অঙ্গনে ইঁহাকে পরাব্রহ্মরসে পরমতত্ত্ব পূজায় সহজ অসীম তত্ত্বের গানে মাতাইয়া গেলেন।

গাজীপুরের ভুরকুড়ায় ইঁহার সাধনার স্থানে এখনো মঠ বিদ্যমান।

গুলাল বুল্লার শিষ্য, গুরুর প্রায় সমবয়সী, তবে গুরুর আগেই মারা যান, ইনি জাতিতে ছাত্রী। পূর্বে ধনী ছিলেন—সাধনার গুণে ইঁহার সব অভিমান যায়। ইনি গাজীপুর বসহরি তালুকের জমিদার ও গৃহস্থাশ্রমী ছিলেন। ইঁহার উপদেশবাণী ও আত্মজাগরণের পদ খুব গভীর ও মধুর। ইঁহার প্রার্থনা ও প্রেমপদ বড়ই হৃদয়স্পর্শী। আরতি রেতা হোলী বসন্ত বারমাসা হিংডোলা প্রভৃতিতে রচিত ইঁহার বাণী আদৃত। ব্রহ্মযোগের কথা ইনি অতি সুন্দরভাবে লিখিয়াছেন।

বুল্লার আর এক শিষ্য হইলেন জগজীবন সাহব। ইঁহার ‘জ্ঞানপ্রকাশ’ গ্রন্থ রচনার কাল ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দ। গ্রায়ারসনের মতে তাঁর জন্ম ১৬৮২ খ্রীষ্টাব্দে। তিনি কবীরপন্থী।

ইনি জাতিতে চন্দেল ছত্রী। সরযূনদীতীরে বরাবঙ্কী জেলার সর্দহা গ্রামে ইঁহার জন্ম। বাল্যকালেই বুল্লা সাহবের সঙ্গে তাঁহার দেখা হয়, তখনই ইনি তাঁর শিষ্য হইতে চান। বুল্লা বলিলেন, কানে মন্ত্র দিবার প্রয়োজন কি?

তবু তাঁর সংস্পর্শে ও দয়াতে জগজীবনের জীবন বদলাইয়া গেল। তাঁহার হৃদয় জাগ্রত হইল।

জগজীবন যে সাধনা পথ প্রবর্তন করেন তাহাকে সত্যনামী বা সৎনামী বলে। গ্রামের লোক অত্যন্ত বিরুদ্ধতা করিলে ইনি সর্দহা ছাড়িয়া দুই ক্রোশ দূরবর্তী কোট্রা গ্রামে গিয়া বাস করেন।

জগজীবন গৃহী ছিলেন, গোণ্ডার রাজার পুত্রের সঙ্গে ইঁহার কন্যার বিবাহ হয়।

জগজীবনের ‘জ্ঞানপ্রকাশে’ ‘প্রথম গ্রন্থে’ ও ‘আগম পদ্ধতিতে’ হরপার্বতীর কথাবার্তার প্রণালীতে রচিত উপদেশ আছে। ‘প্ৰেম-গ্রন্থে’ প্রার্থনা ও সাধনার কথা। ‘মহাপ্রলয়’ গ্রন্থে ভক্তের ও ভক্তির স্বরূপ বর্ণনা আছে। ইঁহার ‘অঘ বিনাশ’ প্রসিদ্ধ গ্রন্থ

ভগবানের কৃপাই যে শ্রেষ্ঠ সাধনা তাহাই তিনি বলিয়াছেন এবং সুনাতি ও সহজ জীবনের উপদেশ দিয়াছেন; তাহাতে লোকে পাগল বলে বলুক। হিন্দু-মুসলমানকে মৈত্রীতে ও সাধনার যোগে একত্র হইতে বলিয়াছেন।

তাঁহার শিষ্য দুলমদাসজী জলালীদাসজী ও দেবীদাসজী লিখিত বাণীগুলি খুব সুন্দর। কবীরের মত ইহার কিছু হেঁয়ালি আছে। অনেক প্রার্থনাও ইহার আছে। ইঁহার অনেক শিষ্য নিম্ন জাতীয় ভক্ত ও একাধিক শিষ্য মুসলমান।

ইঁহার শিষ্য দুলমদাসের স্থান ছিল রায়বেরিলী জেলায়। ইঁহার রচিত আত্মতত্ত্ব সাধনা পবিত্রতা ভক্তি ও ভগবৎকৃপা বিষয়ক পদগুলি বেশ গভীর।

এই সৎনামী সম্প্রদায়ের পূর্বে আওরংজেবের বিরুদ্ধে (১৬৭২ খ্রীঃ) এক সৎনামী সাধ সম্প্রদায় দাঁড়াইয়াছিল। তাঁহারা নিজকে সাধ বলিতেন। তাঁহারা রবিদাস হইতে আগত এক শাখা।

১৭৫০ খ্রীস্টাব্দে সৎনামী সম্প্রদায় আবার সংস্কৃত হইয়া পুনর্গঠিত হয়।

বীর ভানের সাধ সম্প্রদায় ১৬৫৮ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। ইঁহার বাণী অনেকটা দাদূ ও কবীরের বাণীর সঙ্গে মেলে। নানকের আদি গ্রন্থের নামে তার নাম ‘আদি উপদেশ’। উহাতে শব্দ ও শাখী দুইই আছে। বীর ভানের গুরু ছিলেন একজন ব্রহ্মবাদী সিদ্ধ পুরুষ।

১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ মধ্যে ভক্ত চামার ঘাসী দাস একটি সম্প্রদায় প্রবর্তন করেন। তাহার নাম সৎ নাম। ইহা ছত্রিশগড়ের দিকে খুব প্রবল হইয়া উঠে। ইঁহাদের ভক্তরা সব চামার শ্রেণীর।

ইঁহারা প্রায়ই ক্ষেত্রের চাষের ভৃত্য। গিরোড় গ্রামে ইঁহাদের প্রধান স্থান। ঐ স্থানটি পূর্বে বিলাসপুর জেলায় ছিল, এখন রায়পুরে।

১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে ইঁহাদের সংখ্যা দেখা যায় চারি লক্ষ। ইঁহারা মাছ মাংস ও মদ্য স্পর্শ করেন না। জগজীবনী সৎনামীদের মত বেগুনও ইঁহাদের ত্যাজ্য। ইঁহারা মূর্তি প্রতিমা পূজা ত্যাগ করিয়াছেন।

ইঁহারা ব্রাহ্মণের প্রাধান্য মানেন না। নিজেরা যদিও চামার তবু উচ্চতর বর্ণের বর্ণগত শ্রেষ্ঠতা মানেন না। ইঁহাদের মতে শ্রেষ্ঠতা চরিত্রে, ভক্তিতে ও পবিত্র আচরণে।

চামার জাতির সাধকদের কথা বলিতে গেলে লালবেগ বা লালগিরের নাম করিতে হয়। ইঁহারা নিজেদের অলনামী বা অলরিও বলেন। দশনামীদের মত ইঁহারা গিরি উপাধি লইয়াছেন। ইঁহারা বলেন, তুলসীদাসের পূর্বের এই মত। বিকানীরে ইঁহাদের খুব প্রভাব। ইঁহারা প্রতিমা পূজা করেন না। অলখ পরমেশ্বরের ধ্যান ও সাধনা করেন। হিংসাত্যাগ, দান, পবিত্রতাই ধর্ম। পরলোকের দুশ্চিন্তা ছাড়িয়ে সাধনা করিলে ইহলোকেই পূর্ণানন্দ লাভ হয়—ইহাই ইঁহাদের মত।

ইঁহাদের মতে স্বর্গ নরক প্রভৃতি ভবিষ্যৎ ভাবনা নিরর্থক। স্বর্গ নরক সবই নিজের মধ্যে। বর্তমানের মধ্যেই অনন্ত ভবিষ্যৎকে সাধনায় অনুভব করিতে হইবে। সাধনার দ্বারা ইহলোকেই পূর্ণানন্দ অনুভব করাই পরমপুরুষার্থ।

ইঁহাদের সাধুরা কম্বলের আলখাল্লা ও টুপী ধারণ করেন। পরস্পরে ‘অলখ কহো’ বলিয়া সম্ভাষণ করেন। উচ্চজাতিদের উচ্চতা ইঁহারা মোটেই মানেন না, এই বিষয়ে ইঁহারা উড়িষ্যার অপ্রাচীনপন্থ কুম্ভীপটিয়াদের (১৮৫০—মুকুন্দদাস) মত। মন্দিরে ইঁহাদের প্রবেশ নাই বলিয়া ইঁহারা বলেন মন্দির প্রভৃতি হীনস্থানে গেলে সত্যভ্রষ্ট হইতে হয়।

ইঁহাদের সাধুরা অতি শান্তভাবে ভিক্ষা করেন, না দিলে অতি শান্তভাবে চলিয়া যান।

এই মতের সাধুরা শান্তচিত্ত যোগী বলিয়া সাধারণের কাছে সম্মানিত। ইঁহাদের মতে চিন্তায় বাক্যে সেবায় অর্থে সর্বতোভাবে পরোপকার করা প্রত্যেকের পক্ষে কর্তব্য।

উত্তর-পশ্চিমে এই সম্প্রদায়ীরা বলেন ইঁহাদের গুরু লালবেগ হইলেন স্বয়ং শিবরূপ।

স্বর্গ বা ভবিষ্যতের লোভের দ্বারা চালিত হওয়াকে ইঁহারা ঘৃণা করেন। সাধনার লক্ষ্য হইল পবিত্র শান্ত সমাহিত হইয়া ইহলোকেই পূর্ণানন্দ অনুভব করা। বর্তমানই হইল তিনকালের সার। অনন্তকালের পরমানন্দ রস নিংড়াইয়া বর্তমানের পেয়ালা ভরপুর করিয়া পান করাই ইঁহাদের সাধনা।

ভীখা হইলেন গুলাল সাহবের শিষ্য। আজমগড় জেলায় খানপুর বোহনা গ্রামে ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি উচ্চব্রাহ্মণকুলে ইঁহার জন্ম।

ধর্মের পিপাসায় ইনি কাশী যান। যেখানে কিছু না পাইয়া গুলাল সাহবের নাম শুনিয়া তাঁর কাছে যাইয়া তৃপ্ত হন। তিনি মুসলমানের শিষ্যধারায় দীক্ষিত, ইহা জানিয়াও ব্রাহ্মণ ভীখা তাঁহার কাছে দীক্ষা নেন। তাঁহার নিজের লেখাতেই এসব কথা আছে।

বুল্লার সাধনাস্থান ভুরকুড়াতে গুলাল থাকিতেন। ইনিও সেখানেই রহিলেন ও দেহত্যাগ করিলেন। গুরুর মৃত্যুর পর ইনিই সকলকে উপদেশ দিতেন।

এই ভীখার শিষ্য গোবিন্দ সাহব। ইনি ফৈজাবাদ অহিরৌলীর অধিবাসী ছিলেন। গোবিন্দের শিষ্য পলটু সাহব। গাজীপুর ও বালিয়া জেলায় ভীখার বহু অনুরাগী সাধক আছেন।

ভীখার বাণীতে দেখা যায়, ‘শাস্ত্র ব্যর্থ, প্রেমেই সাধনা।’ ইনি বলেন, “নিরভিমান হইয়া সাধক প্রেমে সহজ হইবে, বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হইবে। ভাবের দ্বারা সকল চরাচর পূর্ণ; যেদিন সত্য দৃষ্ট হয়, সেদিন সর্বত্র শোভা; সেদিন আর ভেদ নাই। তখন বাহির- ভিতরের ঝগড়া মিটিয়া জীবন সার্থক হয়।’ ইঁহার অনুতাপ ও প্রার্থনা বাণী খুব সুন্দর।

গোবিন্দের শিষ্য পল্‌টুকে অনেকে দ্বিতীয় কবীর বলেন। কবীরের ভাবের সঙ্গে তাঁহার ভাবের গভীর মিল আছে। ইনি শাহ আলমের সময় জীবিত ছিলেন। ফৈজাবাদ জেলার নগপুর জলালপুর গ্রামে বাণিয়া বংশে ইঁহার জন্ম। ইনি গৃহী ছিলেন। ইঁহার বংশীয় লোক এখনো ঐ গ্রামে আছেন। গ্রামের লোকেরা সারাজীবন তাঁহাকে জ্বালাইয়া মারিয়াছে। ইঁহার লেখায় দেখি—তাঁহার সময় পেটের দায়ে সন্ন্যাসী ঢের ছিলেন। অনেক বৈরাগী তখন রীতিমত ব্যবসায় করিতেন।

ইঁহার কুণ্ডলিয়া ছন্দে কাব্য খুবই চমৎকার ভাষায় লেখা।

পল্‌টু বলেন,

‘নীচ জাতিকে নষ্ট করিল উচ্চ জাতিরা, এবং নিজেরাও নষ্ট হইল। যে সত্যকে দেখিয়াছে তার আর দেশ-বিদেশ নাই। প্রত্যক্ষ সত্য বড় নহে, অন্তরে দেখা সত্যই বড়। সাধকের সংযম ও বীর্য চাই। ভগবান্ কোনো সম্প্রদায়-বিশেষের সম্পত্তি নহেন। জাতি-পঙ্ক্তির ক্ষুদ্র পরিচয় ছাড়। নম্রতায় দোষ নাই। মধুর হও, সেবাব্রত হও। সহজ সত্যকে সহজ না হইলে পাওয়া যায় না। সত্য আছে অন্তরে-বাহিরে খোঁজা বৃথা।’

“যে মানবের মধ্যে দেবতাকে না দেখিল সে মন্দির হইতে দেবতাকে নির্বাসন দিল।’

ইঁহার মতাবলম্বী লোক বিস্তর। ভারতের সর্বত্র এই সম্প্রদায়ের সাধক আছেন।

সৎনামী বলিয়া পরিচয় না দিলেও দরিয়া সাহব ভগবানকে সত্যনাম বলিয়া ঘোষণা করিতেন। সেইজন্য সৎত্নামীদের কথা ও সৎত্নামী জগজীবনের পরবর্তী ভক্তদের কথার পরই সত্যনামভক্ত বিহারী দরিয়া সাহবের কথা বলা যাইতেছে।

উজ্জয়িনী-রাজবংশীয় এক ক্ষত্রিয়-ধারা বক্সারের কাছে জগদীশপুরে আসিয়া রাজত্ব করেন। সেই বংশে ভক্ত সাধক পীরন শাহ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুণ্ড্র দরিয়া সাহবের জন্মস্থান তাঁহার মাতুলালয় ধারকান্ধা গ্রামে। ধারকান্ধা ডুমরাওয়ের সাত ক্রোশ দক্ষিণে আরা জেলায়। ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে ভাদ্রকৃষ্ণ-চতুর্থীতে তাঁর তিরোভাব। সম্ভবতঃ ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার জন্মকাল। তাঁহার মাতা মুসলমান দরজী-বংশীয়া।

ক্ষত্রিয়রাজকুলসম্ভব পীরন শাহ রাজরোষ হইতে ভাইদের বাঁচাইতে গিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেন, এই কথা সুধাকর দ্বিবেদী মহাশয় বলেন, ভক্তরা এ কথা মানেন না। ‘জ্ঞানদীপক’ গ্রন্থে দরিয়া সাহব নিজ জীবনের কথা কিছু কিছু দিয়াছেন, তাহাতেও এ কথা নাই।

যতদূর বুঝা যায়, সূফীসাধনায় আকৃষ্ট হইয়া পীরন শাহ সূফী হন। তখনই তাঁর নাম হয় পীরন শাহ। তাঁর পুত্রের উপর কবীরের প্রভাবই বেশী, অল্পবয়সে তাঁর বিবাহ হয় এবং যুবা-বয়সেই ভক্তিভাব প্রকাশ হয়। ত্রিশ বৎসর বয়সে তিনি উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন।

ইঁহারা মুসলমানদের মত দাঁড়াইয়া নত হইয়া প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেন। তাহাকে ইঁহারা কোর্নিশ্ বলেন। মুসলমানদের মত বসিয়া যে প্রার্থনা করেন, তাহার নাম শির্দা বা শিদা।

ইঁহারা লিখিত কোনো শাস্ত্র ব্রত তীর্থ আচার বাহ্য নিয়ম ভেখ মন্ত্র প্রভৃতি মানেন না। মূর্তি বা অবতারের পূজা ইঁহারা করেন না, জাতিভেদ মানেন না। জীবহিংসা মদ্যপান মৎস্য-মাংস-ভোজন প্রভৃতি ইঁহাদের নিষিদ্ধ। এই পন্থের সাধুরা মাটির বদনার মত কমণ্ডুল বা ভরুকা ব্যবহার করেন। ইঁহার ছত্রিশ জন প্রধান শিষ্য ছিলেন। দিলদাস সর্বাপেক্ষা সমর্থ সাধক ছিলেন। ইঁহাদের প্রধান চারি আখড়া বা স্থান; ছাপড়ার মধ্যে মীর্জাপুরে, মুজফরপুরে, মনুরাচৌকীতে, দংসী ও তেলপায়।

দরিয়া সাহব কখনো কখনো আরা জেলার হরদীতে, গাজীপুর বাইসীতে, বস্তী জেলার কবীরের মৃত্যুস্থান মগহরে ও কাশীতে যাইতেন। কবীরের স্থানগুলি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। তবু সেখানে তীর্থ করার উপদেশ তিনি দেন নাই।

ইঁহাদের সম্প্রদায়ে সাধু মহান্তরা হিন্দু-মুসলমানের সাধনার যোগ ও মৈত্রীর কথা এখনো বলেন।

ইঁহাদের প্রধান গ্রন্থ ‘জ্ঞানদীপক’। মধ্যযুগের সকল ভক্তের মত দরিয়া সাহবও সংগীতপ্রিয় ছিলেন। ইঁহার রচিত বসন্ত হোলী মল্লার বেহাগড়া প্রভৃতি রাগের সুন্দর গান আছে। ইঁহার প্রার্থনা ও বন্দনা খুব সুন্দর।

দরিয়া সাহব বিহারীর কথা বলিবার সঙ্গে মারবাড়ের দরিয়ার কথা বলা উচিত। ইনি প্রায় বিহারী দরিয়া সাহেবেরই সমসাময়িক। ইঁহারও জন্ম মুসলমান মাতার উদরে—ইনি নিজেই বলেন ধুনকর বংশে। ১৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ইঁহার জন্ম ও ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু। পিতার মৃত্যু হওয়ায় মাতামহ কমীরের গৃহে ইনি পালিত। মেড়তার অন্তর্গত রৈন গ্রামে কমীরের বাসস্থান। ইনি বিকানীর খিয়ান্‌সর গ্রামের ভক্ত সাধক প্রেমদাসজীর শিষ্য।

ইঁহার প্রধান শিষ্য ছিলেন সুখরামদাস, তিনি জাতিতে শিকল-নির্মাতা লৌহকার। মারবাড়রাজ মহারাজ বখ্ত সিংহ নাকি সুখরামের কাছে উপদেশ পাইয়া রোগমুক্ত হন।

অনেকে মনে করেন ইনি দাদূরই অবতার। তবে দাদূর উপদেশের প্রভাব ইঁহার লেখায় খুব বেশী। ইঁহার বাণীও দাদূর মত অঙ্গে অঙ্গে ভাগ করা। তবে সাঁইত্রিশটি অঙ্গের স্থানে অঙ্গসংখ্যা পনেরোটি এবং অনেক অঙ্গের নামও এক।

রাজপুতানায় এই মতের বহু বহু ভক্ত আছেন এবং অনেক স্থানে ইঁহাদের মঠ ও সাধনা-স্থান আছে।

ইঁহারা রামনাম পরব্রহ্ম প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেন। ইঁহাদের ব্রহ্ম-পরিচয় অঙ্গে যোগের গভীর কথা আছে। গৃহী উদাসী—দুই ভাবের সাধুকেই ইঁহারা মানেন। ইঁহার গান হিন্দু-মুসলমান সাধকদের মধ্যেও বেশ সমাদৃত।

এক কসাই সদনা পূর্বকালে সাধনা করিয়া ধন্য হইয়াছিলেন। সিন্ধুদেশে এক সদনার জন্ম। অনেকে মনে করেন উভয়েই এক।

কাশীতে সপ্তদশ শতাব্দীতে এক সদনা বা সাধনভক্ত জন্মগ্রহণ করেন। কসাই বলিয়া তাঁহারও নাম হয় সদনা। তিনি বৈষ্ণব-ভাবাপন্ন ছিলেন। রামানন্দী মতের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল। ইঁহার সম্প্রদায়ে বেদশাস্ত্র, তীর্থব্রত ও মূর্তিপূজার প্রতি কোন আস্থা নাই। জাতির জোরে উচ্চতা হয়, এ কথা ইঁহারা মানেন না। ইঁহাদের মধ্যে কবীর ও দাদূপন্থী ভাবের প্রভাব আছে। ইন্দ্রিয় জয় করা ও শান্ত দান্ত হওয়াই ইঁহাদের মতে সাধনার প্রধান কথা।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে লালদাসের জন্ম। রাজপুতানার লুণ্ঠনপ্রিয় মেও জাতির মধ্যে তাঁর জন্ম। আলওয়ারে তাঁর জন্মস্থানে ইঁহাদের প্রধান মঠ। মেও প্রভৃতি জাতিতে তাঁর ভক্তসংখ্যা বেশী। ইঁহারা জপ ও কীর্তন পরায়ণ। ইঁহাদের বাণীতে দাদূর প্রভাব বিশেষ লক্ষিত হয়। কবীরের উপদেশের সঙ্গেও ইঁহাদের বাণী অনেকটা মেলে।

ছাপড়া জেলায় মাঝী গ্রামে শ্রীবাস্তব কায়স্থবংশে ১৬৫৬ খ্রীষ্টাব্দে ভক্ত ধরণীদাসের জন্ম। ধরণীদাসের পিতার চাষবাস ছিল। ধরণীদাস নিজে জমিদারের দেওয়ানী করিতেন।

সেবানন্দ সাধুর সঙ্গে পরিচয় হইয়া তাঁর অধ্যাত্ম দৃষ্টি খুলিয়া যায়। তিনি সংসার ত্যাগ করিয়া সেই গ্রামেই কুটিরে দীনভাবে বাস করিতে থাকেন।

তাঁর দুই গ্রন্থ ‘সত্যপ্রকাশ’ ও ‘প্রেমপ্রকাশ’ অনেকটা কবীরের ভাবে পূর্ণ। তাঁর আরতি ও প্রার্থনা-বাণী সাধুরা সমাদর করেন।

তিনি বলেন—কর্মের মূল্য কেবল আদর্শকে প্রত্যক্ষ জগতে সিদ্ধ করিবার জন্য। জীবজাহান অর্থাৎ মানব ও জগৎ সকল ব্যাপিয়া এক খোদাই বিরাজিত। হৃদয়ের প্রভু দূরে নাই, বেদনা বিনা তাঁহার দর্শন মিলে না। তীর্থব্রতাদি বাহ্য বস্তুর ব্যর্থতা তিনি বার বার দেখাইয়াছেন। তিনি বলেন—প্রেমের ব্যথা, সত্য ব্যাকুলতা জীবনে চাই।

ইঁহার শিষ্য সদানন্দ পরে সম্প্রদায়ের নেতা হন।

ঘাসীদাসী লালদাসী জীবনদাসী প্রভৃতিদের মতবাদ ভারতে নানা নিম্নশ্রেণীর মধ্যে মানবজীবনের মহত্ত্ববোধ জাগ্রত করিতে লাগিল। কাজেই ভারতের নানা স্থানে নিম্নশ্রেণীর সাধকদের উদ্ভব হইতে লাগিল।

এখানে পঞ্জাবের সুথরাসাহী ভক্তের নাম করা যাইতে পারে। জন্মমাত্র ইঁহাকে ইঁহার পিতা নাকি মলিন বা কুথরা বলিয়া ত্যাগ করেন। গুরু হরগোবিন্দ তাঁহাকে সুথরা বা পবিত্র বলেন। কিন্তু এইরূপ ব্যাখ্যা কাল্পনিক, আসলে তিনি সুতার বা ছুতার বংশে উৎপন্ন। লাহোরে কাশ্মীর দরজার বাহিরে ইঁহাদের মঠ। পাঠানকোটের কাছে বরহানপুরে ইঁহার আদি স্থান। হরগোবিন্দ ইঁহাকে রক্ষা না করিলে তিনি মুসলমান অনাথালয়ে রাজব্যবস্থায় নীত হইতেন। তিনি গুরুকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। তিনি বেশ বীর ছিলেন। আওরংজেব ইঁহাকে বড় দুঃখ দেন। পরে ইনি যখন হিন্দু ও মুসলমান দুই সাধনাই নিজের মধ্য হইতে দেখাইলেন, তখন বিরুদ্ধবাদীরা নিবৃত্ত হইলেন।

ইঁহার প্রধান শিষ্য ঝংগড়া শাহ। ইঁহাদের লাহোরের মঠে ভাদ্র অমাবস্যায় মেলা হয়। দিল্লীতে পুরাণীমণ্ডীতে ইঁহাদের এক মঠ আছে। অন্যস্থানের সুথরাসাহীরা তাঁহাদের অপাংক্তেয় মনে করেন। তাঁহারা নাকি মুসলমান-সংস্পর্শে দূষিত।

পূরণ ভগতের স্থান পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে। এখানেও বহু ভক্ত লোক সাধনার্থ যান।

ভারতের বহু স্থানে গরীবদাস নামে অনেক সাধক হইয়াছেন। দাদূর পুত্র গরীবদাসের কথা বলা হইয়াছে। ছুরাণীর গরীবদাসের কথা পরে বলা হইবে। পাঞ্জাবে এক গরীবদাস ছিলেন। ইনি একেশ্বরবাদী ও হিন্দু-মুসলমান সাধনার মিলনের পক্ষপাতী ছিলেন।

ছজ্জু ভগতের স্থান লাহোরে। ইঁহার মধ্যে কবীরপন্থী ও শিখ প্রভাব লক্ষিত হয়। ইনি খানিক পরিমাণে হিন্দু-মুসলমান ভাবের সমন্বয় করিতে চাহিলেও প্রচলিত হিন্দু- সমাজের আচার-ব্যবহারের দিকে ইঁহার কতকটা পক্ষপাত ছিল।

ধর্মের পিপাসায় ব্যাকুল হইয়া বাবালাল লাহোরে আসেন ও তথায় চৈতন্য স্বামী বা বাবা চেতনের সঙ্গ লাভ করেন। ইঁহার জন্মস্থান মালবায়। ১৫৯০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি খত্রী কুলে তাঁর জন্ম হয়। তিনি রামনাম ব্যবহার করিলেও তাহা দ্বারা কোনো বিশেষ অবতার বা সাম্প্রদায়িক দেবতা বুঝিতেন না। রাম বা হরি বা ভগবানের দ্বারা তিনি সকল সম্প্রদায়ের উপাস্য এক পরম দেবতাকেই বুঝিয়াছেন। তিনি বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী ছিলেন। কবীর ও দাদূর মত তিনি বিশ্বাস করিতেন। তিনি বলেন,

‘শম দম চিত্তশুদ্ধি দয়া পরসেবা সহজ ভাব সত্যদৃষ্টি “অহম্ ক্ষয়” প্রভৃতি দ্বারা ভক্তি ও প্রেমের পথে ভগবানকে লাভ করা যায়। তাঁর প্রেমে জীবন ভরিয়া উঠে। ভগবানের সঙ্গে প্রেমযোগের আনন্দ বাক্যে বলিয়া বুঝানো যায় না।’ একজন তাঁহাকে প্রশ্ন করেন, সেই যোগানন্দ কি প্রকার? তাহাতে তিনি বলেন, যদি তাহা বাক্যে বুঝাইবার মত হইত তবে তাহার জন্য সাধনা করার কোনোই প্রয়োজন থাকিত না। বিষয়-বিরতি অর্থে তিনি অশনবসন ত্যাগ করিয়া দেহ-দুখ বুঝিতেন না। তিনি বলিতেন, বিস্মৃতি ও মোহ অচেতনতা-ত্যাগই বিরতি। ভগবান্ হইলেন আনন্দসিন্ধু, প্রতি জীব তাঁর এক এক বিন্দু। এই যে পার্থক্য ইহার মূলে জীবের ‘আধারঘটাত্মক’ অহম্। এই অহম্‌কে লোপ করিলেই যোগ হইবার সম্ভাবনা। মৃত্যুতে এই বিচ্ছেদমূল ঘটের অবসান হয় না, সাধনায় তাহা ক্ষয় করা চাই।

সূফী ভাবও ইঁহার প্রচুর ছিল। দারাশিকোহের সঙ্গে ইঁহার গভীর যোগ ছিল। ১৬৪৯ খ্রীষ্টাব্দে দারার সঙ্গে তাঁহার যে সব গভীর ধর্মালোচনা হইয়াছিল তাহার সুন্দর বিবরণ ‘নাদির উন নিকাত’ নামে পারসী গ্রন্থে লিখিত আছে।

দারাশিকোহের কথা পূর্বেও বলা হইয়াছে। এখানে তাঁহার বিষয় আরও কিছু বলা দরকার। তখনকার ধর্মসাধকদের অনেকের সঙ্গেই তাঁহার আলাপ ছিল। আর তাঁহার মতামতের প্রভাব তখনকার অনেক সাধকদের মধ্যে পড়িয়াছে। ভারতীয় ভক্তরা তাঁহাকে একজন সাধক বলিয়াই জানেন। সর্বধর্মের ভ্রাতৃত্ব, সর্বমানবের মৈত্রী তাঁর জীবনের স্বপ্ন ছিল। অকালে তাঁহার মরণ হওয়ায় তাঁহার মনের সব সংকল্প অপূর্ণই রহিয়া গেল। ভারতে ধর্মের যে মৈত্রীর কথা তিনি ভাবিতেছিলেন তাহা ভাঙিয়া গেল। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সাধনায় সাধনায় বিদ্বেষ জ্বলিয়া উঠিল। ভারতের সাধনা খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল। আজও সেই দুর্গতির অবসান হইল না। ·

দারা যে কেবল হিন্দু-মুসলমান সমস্যা লইয়াই ছিলেন তাহা নহে। শিক্ষা দীক্ষা সাধনা এবং ধর্মে পুরুষ ও নারীকে পরস্পরের বাধাস্বরূপ না করিয়া কি প্রকারে পরস্পরের সহায়স্বরূপ করা যায়, ইহাও তাঁহার মনে সর্বদা জাগিতেছিল। তত্ত্বজ্ঞ সাধক, সূফী ও সন্ন্যাসী, হিন্দু ও আরবী, সংস্কৃত ও পারস্য ভাষার পণ্ডিত লইয়া, গ্রীকদর্শন ও বেদান্তদর্শনের মর্মজ্ঞদের লইয়া, তিনি দিল্লীর প্রাসাদে যে এক অপরূপ উৎসবসভা জমাইয়া তুলিতেন নারীদেরও তাহাতে যোগ দিবার ব্যবস্থা ছিল। এই সভায় ‘রসগঙ্গাধর’-রচয়িতা জগন্নাথ মিশ্র তাঁর সংস্কৃত কাব্য শুনাইতেন। এই সভায়ই একজন শ্রোত্রী ছিলেন দিল্লী মুঘল প্রাসাদের এক বাদশাজাদী, তিনি সংস্কৃতে বিলক্ষণ রসজ্ঞা ও জগন্নাথের প্রতি অনুরাগিণী ছিলেন। তাঁর আন্তরিক প্রীতির সংবাদ পাইয়াই কবি জগন্নাথ মিশ্র দূর হইতে তাঁহার প্রতি প্রীতিযুক্ত হন।

জগন্নাথের কাব্যরসে তুষ্ট হইয়া একবার দারা তাঁহাকে বলিয়াছেন,

‘তোমার কি প্রার্থনা বল, তুমি যাহা চাও তাহাই পূর্ণ করিব।’ কবি বলিলেন, ‘ঐ কন্যাটিকে চাই।’ দারা কহিলেন, ‘কন্যা কি তোমার প্রতি অনুরাগিণী?’ কবি কহিলেন, ‘খোঁজ করিয়া জানুন।’ দারা সন্ধান করিয়া কহিলেন, “কবি, তোমার কথা সত্য, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করিব বটে, কিন্তু তোমাকে আমি হারাইব। দিল্লী তোমায় ছাড়িতে হইবে।’

দারা রাত্রিতে উভয়কে অশ্বযোগে দূরস্থানে পৌঁছাইয়া দেওয়াইলেন। কবি কাশীতে গেলেন, গিয়া দেখেন কোনো মন্দিরে আর তাঁর প্রবেশাধিকার নাই। আর কিছু না জানিলেও কাশীর লোকেরা জানিয়াছিল জগন্নাথ বিধর্মী কন্যাকে সঙ্গে আনিয়াছেন। তখন তীর্থের মধ্যে তাঁর কাছে একমাত্র মুক্ত রহিল গঙ্গা। জগন্নাথের ‘গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ গঙ্গাস্তব তাই এত মর্মস্পর্শী। পরে তিনি কাশী ছাড়িয়া বিন্ধ্যপর্বততলে গঙ্গাতরে দূর্গাখোহে গিয়া বাস করেন। দারার ইতোমধ্যে মৃত্যু ঘটে। জগন্নাথ ও তাঁর স্ত্রীও দীর্ঘকাল দারার বিরহ সহ্য করেন নাই। দূর্গাখোহতেই তাঁহাদের মৃত্যু ঘটে। জগন্নাথের ‘ভামিনী-বিলাস’ এই যবনকন্যার সৌন্দর্যরসেরই প্রকাশ।

ইহা তো গেল একটি মানবপ্রেমের ঘটনা। কিন্তু পারমার্থিক ও জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে নারীদের সাহচর্য দারার স্বপ্নের মধ্যে ছিল। এই সব ‘ভাবের পাগলামি’ দারার অনুবর্তী ও সহচরদের মধ্যেও অনেকটা সংক্রামিত হইয়াছিল।

দারার এই সব ভাবের স্পর্শে অনেকে উদার সার্বভৌম সাধনার সাধকও হইয়া উঠিলেন। তার মধ্যে একজনের নাম এখন করা যাইতেছে, তিনি চরণদাস।

দারার প্রভাব দারার সহচরদের সহায়তার শিবনারায়ণ প্রভৃতি সম্প্রদায়েও গিয়া পৌঁছিল। তাঁহার সঙ্গে চরণদাসের সাক্ষাৎ ঘটে নাই। দারার ভাবের প্রতি অনুরাগী সুখানন্দের সংস্পর্শে আসিয়া চরণদাসের মত ও জীবন পরিবর্তিত হইয়া যায়। এই সুখানন্দ ছিলেন কবীরের প্রতি ভক্তিমান্ ও দারাশিকোহের অনুরাগী।

রাজপুতনার আলবার রাজ্যে ডহরা বা ডেহরা গ্রামের রেরাড়ীবাসী এক বণিকূলে ১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দের ভাদ্র মাসে চরণদাসের জন্ম। রণদাসের পূর্বের নাম ছিল রণজিৎ।

ডেহরা গ্রামে যখন রণজিৎ বালক মাত্র তখন তাঁর পিতা জঙ্গলে নিরুদ্দেশ হইয়া যান, কি বাঘের হাতে মারা যান। তাঁহার মাতামহ এই খবর শুনিয়া রণজিৎকে তাঁহার মাতা সহ দিল্লীতে লইয়া আসিলেন এবং রাজকার্যে প্রবেশ করাইবার জন্য শিক্ষা দিতে লাগিলেন। যখন রণজিতের উনিশ বৎসর বয়স, সুখানন্দের সংসর্গে তখন তাঁর মতিগতি বদলাইয়া গেল, ত্রিশ বৎসর বয়সে চরণদাস ধর্মোপদেশ দিতে লাগিলেন। তাঁহার ভক্তেরা বলেন শুকদেব গোস্বামী নাকি তাঁহাকে দীক্ষা দিয়া যান।

দয়াবাঈ ও সহজোবাঈ চরণদাসের জ্ঞাতি আত্মীয়া। পূর্ব হইতেই চরণদাসের সঙ্গে ইঁহাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল, চরণদাস ধর্মজীবন লাভ করিলে উঁহারা তাঁহার কাছে সাধনার উপদেশ চাহিলেন। নারীদের সাধনাও অধ্যাত্মরাজ্যে অমূল্য, এই কথা মনে করিয়া তিনি ইঁহাদের উপদেশ দিলেন।

চরণদাসের মৃত্যুর পর মুক্তানন্দই সম্প্রদায়ের নেতা হইলেন। চরণদাসের শিষ্য রামরূপজী ‘গুরুভক্তিপ্রকাশ’ গ্রন্থে চরণদাসের সম্বন্ধে অনেক কাহিনী লিখিয়াছেন। তাঁহার শিষ্য রামস্নেহী খুব ভক্ত ও সমর্থ সাধক ছিলেন।

চরণদাসের সম্প্রদায় নৈতিক পবিত্রতার জন্য বিখ্যাত। বল্লভাচার্যমতের নানা কদাচার সমাজে প্রবেশ করিয়াছিল। তখন চরণদাসের উপদেশে প্রভূত উপকার হইল। চরণদাসের মতে এই দশটি কার্য নিষিদ্ধ—১. মিথ্যাবচন, ২. কুবচন অর্থাৎ অশ্লীলবচন, ৩. কটুবচন অর্থাৎ গালি, ৪. বৃথাবচন অর্থাৎ তর্ক, ৫. চৌর্য, ৬. ব্যভিচার, ৭. হিংসা, ৮. অকল্যাণচিন্তা, ৯. বিদ্বেষ, ১০ অহংকার।

চরণদাসের মতে এই কয়টি কার্য পালনীয়—গার্হস্থ ধর্ম ও সামাজিক ধর্ম, সৎসঙ্গ, সাধুসঙ্গ, গুরুতে ভক্তি, বিশ্বমূল শ্রীহরিতে ভক্তি। ইঁহাদের মধ্যে বৈরাগী দুই রকমের সাধুই আছেন, তাঁহাদের বস্ত্র হলদে। চরণদাসের মতে বেশভূষা ভব্য, ভদ্র ও পবিত্র হইবে।

বল্লভমতের নানাবিধ বিকার ও ব্যভিচার দূর করিবার জন্য চরণদাসকে অনেক শ্রম করিতে হয়। ইনি সংস্কৃত গীতা ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদ করান। নিজে ‘সন্দেহসাগর’ ও ‘ধর্ম জাহাজ’ (তুলনীয় দারার ‘শাফিনাৎ-ই-আউলিয়া’) এই দুই গ্রন্থ লেখেন। ইঁহার শিষ্যা সহজোবাঈ ‘সহজ প্রকাশ’ ও ‘ষোলতত্ত্ব-নিৰ্ণয়’ গ্রন্থে লেখেন। চরণদাসের শিষ্যসেবকদের রচিত ভাষাগ্রন্থ অনেক আছে। দয়াবাঈ ‘দয়াবোধ’ ও ‘বিনয়মালিকা’ গ্রন্থ রচনা করেন।

চরণদাস বলেন, এই বিশ্ব ব্রহ্মময়। তুলসী, শালগ্রাম প্রভৃতি প্রতীক ব্যর্থ। চরিত্র, নীতি ও সদাচার সাধনার প্রথম ও প্রধান কথা, প্রেমভক্তি সাধনার প্রাণ। কিন্তু প্রেম ও ভক্তি যদি কর্মে ও সেবায় প্রকাশিত না হয় তবে সে প্রেমভক্তি নিষ্ফল। হৃদয়ের ভাব সত্য হয় আচরণে। কোনো কোনো অংশে মাধ্বমতের এক আধটুকু ছায়া থাকিলেও প্রধানত তাঁর উপদেশে কবীরের প্রভাবই বেশী।

দিল্লীতে চরণদাসের সমাধিও চরণদাসীদের প্রধান মঠ। সেখানে শ্রীপঞ্চমীতে মেলা হয়। দিল্লীতে ইঁহাদের আরও মঠ আছে, চরণদাসের জন্মস্থান ডহরায় মঠ আছে। কিন্তু ইঁহার পিতৃস্থান বাহাদুরপুরের মঠই বড়। দুয়াব প্রদেশেই ইঁহাদের মঠের সংখ্যা বেশী I ইঁহাদের নিত্যব্যবহার্য ধর্ম-উপদেশ-সংগ্রহে একটি অধ্যায় উপনিষদের, আর একটি অধ্যায় ভাগবতের বাণীতে পূর্ণ। তাহার ভাষা প্রাঞ্জল ও গম্ভীর।

ইঁহার সময় মুসলমান রাজ্য নষ্ট হইতে বসিয়াছে। নাদির শাহ ও আবদালীর আক্রমণ এবং পানিপথের যুদ্ধ ইঁহার জীবনকালেই ঘটে। মুহম্মদ শাহ, অহমদ শাহ দ্বিতীয় আলমগীর, শাহ আলমের রাজত্ব দেখিয়া ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মারা যান।

যদি চরণদাস তাঁহাকে ধর্মসাধনায় গ্রহণ না করিতেন তবে চরণদাসের কুলে জন্মিয়াও সহজোবাঈ চরণদাসের মহিমা বুঝিতে পারিতেন না। ইঁহার ‘সহজপ্রকাশ’ গ্রন্থ উত্তর ভারতের ভক্তেরা বেশ সমাদর করেন। পাঞ্জাব, রাজপুতানা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ইঁহার অনুরাগী অনেক সাধু আছেন।

ইনি লিখিয়াছেন, গুরুর কৃপায় জীবনের সার্থকতা কি বুঝিলাম। কুটুম্বগণের হাতে অশেষবিধ দুঃখ সহিয়াছেন, তবু সেজন্য তাঁহার কোন ক্ষোভ ছিল না। তাঁহার লেখা দেখিয়া মনে হয়, তখন ভাক্ত সাধু ও লোভী আত্মীয় স্বজনের ব্যবহার দেখিয়া ইঁহার মন বড় ব্যথিত হইয়া গিয়াছিল।

দয়াবাঈ চরণদাসের আর এক শিষ্যা। ‘দয়াবোধ’ ও ‘বিনয়-মালিকা’ ইঁহার রচনা। দয়াবোধে দাদূর বাণী সংগ্রহের প্রণালীতে গুরুমহিমা, নাম-স্মরণ, সাধনার বীর্য, প্রেম, বৈরাগ্য, সাধুমহিমা ও শ্বাস জপের অঙ্গ আছে। বিনয়মালিকা দয়ার রচিত মর্মস্পর্শী প্রার্থনা-মালায় পূর্ণ।

দক্ষিণ ভারতের ভক্ত নারী আণ্ডাল ও রাজপুতানার মীরা বাঈয়ের নাম পূর্বে করিয়াছি। ভক্ত নারী আরও অনেকে আছেন। তাঁহাদের নাম করা হয় নাই। এখানে দুই এক জনের নাম করা যাইতেছে।

কবীরের সমসাময়িক গোপকন্যা ক্ষেমা অতি গভীর সাধিকা ছিলেন। এই ক্ষেমা বা ক্ষেমশ্রীর সঙ্গে আলাপে স্বয়ং কবীরও অনেক উপকার পাইয়াছেন। ইঁহার একটি বাণী, প্রাণের স্বরূপ বর্ণনা—রবীন্দ্রনাথ তাঁর Creative Unity গ্রন্থে অনুবাদ করিয়াছেন, তাহা এতই সুন্দর।

কবীরের কয়েকজন নারী শিষ্যা ছিলেন, তার মধ্যে গঙ্গাবাঈ একজন। কবীরের কন্যা কমালীও বেশ গভীর সাধিকা ছিলেন। রামানন্দেরও নারী শিষ্যা ছিলেন। তাঁহাদের কিছু কিছু বচন এখনো সাধুদের মুখে মুখে চলিত আছে। এখানে সে সব কথা বলার অবসর নাই। তবু দাদূর কন্যাদের একটু পরিচয় না দিলে অন্যায় হইবে।

দাদূর দুই কন্যা নানীবাঈ ও মাতাবাঈ। ১৬৩৫-১৬৪০ খ্রীষ্টাব্দ মধ্যে ইঁহাদের জন্ম। দাদূ ইঁহাদিগকে বড় করিয়া ধর্ম উপদেশ ও শিক্ষা দিয়াছিলেন। আমেরে ইঁহাদিগকে বয়স্থা অথচ অবিবাহিতা দেখিয়া মানসিংহের পিতা জয়পুরের রাজা ভগবন্তদাস একটু বিরুদ্ধভাব প্রকাশ করায় দাদূ আমের ত্যাগ করিয়া নরাণায় আসিয়া বাস করেন। দাদূর ইচ্ছা ছিল ইঁহারা বিবাহিত হইয়া গৃহস্থ হন। ইঁহারা ব্রহ্মচারিণী থাকিয়া সাধনা করিতে চাহিলেন। ইঁহাদের বাণী এখন দুর্লভ। তবু সাধুদের কাছে যাহা কিছু মিলে তাহা অতিশয় চমৎকার।

ভক্তমালে ব্রজ গোপিকা ছাড়া আরও কুড়ি পঁচিশটি ভক্ত নারীর কথা আছে। ভক্তমাল সর্বজনবিদিত গ্রন্থ। তাঁহাদের নাম এখানে করিবার বিশেষ প্রয়োজন নাই।

কবীরের ও তাঁর অনুরাগী ভক্তদের কথা বলিতে গিয়া মলুকদাসের নাম এতক্ষণ করা হয় নাই। তাঁর উপর কবীর অপেক্ষা কবীর-গুরু রামানন্দের প্রভাবই বেশী, তবে তিনি বা তাঁহার শিষ্যরা বিবাহ করিয়া গৃহস্থ হইতেন; এই হিসাবে তাঁহারা কবীরের উপদেশই প্রধানতঃ অনুসরণ করিয়াছেন।

এলাহাবাদ জেলায় কড়া গ্রামে মলুকদাসের জন্ম। পিতার নাম সুন্দরদাস। তিনি ক্ষত্রীবংশীয় ছিলেন। ১৫৭৪-১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ মধ্যে তাঁর জন্ম হয়।

বাল্যকাল হইতে মলুকদাস দয়ালু ও পরদুঃখকাতর। রাস্তার কাঁটাটি দেখিলে তাহা সরাইয়া রাখিতেন, যেন লোকে দুঃখ না পায়। এই অতি-দয়ালুতার জন্য ব্যবসায় করিতে গিয়া তিনি নিষ্ফল হন।

পরে ইনি দ্রাবিড়দেশীয় ভক্ত বিলিদাসের শিষ্য হন। মলুক গৃহস্থ ছিলেন। তাঁহার একটি কন্যা হইয়াছিল। কিন্তু স্ত্রী ও কন্যা উভয়ে অল্প বয়সেই মারা যান।

লালদাস প্রভৃতি ইঁহার বারো জন শিষ্য ছিলেন। মৃত্যুর পর ইঁহার ভাইপো রামসনেহী মণ্ডলের প্রধান হইলেন। ১৬৮২ খ্রীষ্টাব্দে ইনি দেহত্যাগ করেন।

বিহার হইতে মূলতান এমনকি কাবুল পর্যন্ত উত্তর ভারতে নানা স্থানে ইঁহাদের মঠ ও ভক্ত আছেন। জয়পুর এবং ওজরাতেও ইঁহাদের মঠ ও ভক্ত দেখিয়াছি। নেপালেও ইঁহাদের ভক্ত আছেন। ভগবানের উপর মলুকদাসের অসাধারণ নির্ভর

মূর্তি ও প্রতিমাপূজা, বাহ্য আচার, তীর্থ ব্রতাদির বিরুদ্ধে ইনি স্বয়ং প্রচার করিলেও ইঁহার সম্প্রদায়ে কতক পরিমাণে সে দোষ প্রবেশ করিয়াছে।

ইঁহার লেখা ‘ভক্তবৎসল’, ‘রত্নখান’ ও ‘দশরত্ন গ্রন্থ’ ভক্তি ও প্রেমের বাণীতে ভরপূর। ইহা ছাড়া তাঁহার অনেক সুন্দর উপদেশ ভক্তদের মুখে মুখেও চলিত আছে।

কবীরের মত ইনিও দেহ-কর্ষণের নিষ্ফলতা উপদেশ দিয়া বাহ্য আচার ও সাম্প্রদায়িক আড়ম্বর ত্যাগ করিতে বলিয়াছেন।

১৭১৮ খ্রীষ্টাব্দে গরীবদাসের জন্ম। তাঁহার জন্মস্থান পাঞ্জাবের অন্তর্গত রোহতক্ জেলায় ছুরাণী গ্রামে।

তিনি স্বপ্নে কবীরকে দেখিতে পান এবং স্বপ্নে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। কবীরের ভাবেই তিনি ভরপূর। ইনি জাঠকুলে জন্মগ্রহণ করেন। চাষবাস ছিল ইঁহার বৃত্তি ইঁহার বাণী ও কবীরের বাণী একত্র করিয়া এই সম্প্রদায়ের বাণী সংগ্ৰহ।

গরীবদাস গৃহস্থ ছিলেন এবং ইঁহার বংশীয় গৃহস্থ গুরুরাই এই সম্প্রদায়ে মহান্ত হন।

এই ছুরাণী গ্রামে ফাল্গুন মাসের শুক্লাদশমীতে প্রতি বৎসর ভক্তদের এক প্রকাণ্ড মেলা বসে।

ইনি নারীদেরও ধর্ম সাধনা দিতেন। ১৭৭৮ সালে ইনি দেহত্যাগ করেন।

ইঁহার শিষ্যদের মধ্যে সলোতজী বিশেষ সমর্থ সাধক ছিলেন।

ইঁহার বাণীর প্রথম অংশ দাদূর বাণীর মত অঙ্গভাগ করা। তাহাতে পনেরোটি অঙ্গ আছে। অঙ্গগুলির নামও দাদূরই মত। হিন্দু-মুসলমান উভয় ভাবের পদে আছে। ইনি আল্লা, রাম, হরি—সব রকম নাম ব্যবহার করিয়াছেন। বাহ্য ক্রিয়া-আচার ছাড়িয়া ইঁহার মতে অন্তরে প্রবেশ করিয়া প্রেম-ভক্তিকে আশ্রয় করিলে তবেই সাধনা সত্য হয়। ইঁহার প্রার্থনা-বাণীও অতিশয় মর্মস্পর্শী।

শিবনারায়ণ সম্প্রদায়ে হিন্দু-মুসলমান উভয় ভাবের সম্মিলন ঘটিয়াছে। বালিয়া জিলায় চন্দ্রবার গ্রামে রাজপুত-বংশে শিব-নারায়ণের জন্ম। ১৭১০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি তাঁর জন্ম। ইনি পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে খুব তীব্রভাবে বলিয়াছেন। ভারতের বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদীদের মধ্যে ইনি একজন প্রধান। ইঁহাদের মতে ঈশ্বর সর্বগুণাতীত নিরাকার। মদ্য, মাংস, মৎস্য ইঁহারা বর্জন করেন। একান্ত ভক্তি, নির্মল চিত্ত ও চরিত্র, শম, দম ও মৈত্রী সাধনার জন্য একান্ত প্রয়োজন—এই কথাই ইঁহারা বলেন। ইঁহারা স্নানকালে মন্ত্ৰ জপ করেন। সকল ধর্মের ও সকল জাতির লোকই এই সম্প্রদায়ে আসিতে পারে। মাঘী শুক্লাপঞ্চমীতে ইঁহাদের বড় মেলা বসে।

কথিত আছে ইনি দারাশিকোহের ভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। দারার কোনো কোনো ভক্তের সঙ্গে ইঁহার পরিচয় ঘটে। হিন্দু-মুসলমান উভয় ভাবই ইঁহাদের সাধনাতে আছে। বাদশাহ মুহম্মদ শাহ নাকি এই ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন, তাঁর রাজত্বকাল ১৭১৯-১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দ। সমসাময়িক কবি বলী আল্লাহ, কবি আরূ ও কবি নাজী শিবনারায়ণের সাধনার প্রতি শ্রদ্ধা রাখিতেন। ইনি নিজে বিস্তর লিখিয়াছেন। ষোলখানি গ্রন্থ ইঁহার রচনা।

তাবা গ্রামের কাছে অনেক চামার ও দোসাদ জাতি আছে যাহারা এই সম্প্রদায়ের শিষ্য। তাহারা মৃতদেহ গোর দেয়। ইহাদের অনুবর্তীদের মধ্যে মুসলমান এবং খ্রীষ্টানও আছেন। আরা জেলায় এই সম্প্রদায়ের খ্রীষ্টান শিষ্য আছেন।

বুল্লেশাহ ও সৎনামী বুল্লাসাহব ভিন্ন ব্যক্তি। কেহ কেহ বলেন বুল্লেশাহের জন্ম ১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দে, কনস্টান্টিনোপল নগরে। ইতি জাতিতে সৈয়দ। অল্পবয়সে ইঁহার তীব্র আধ্যাত্মিক ক্ষুধা জাগ্রত হয়। স্বদেশে তাহা না মিটায় ভারতের সাধকদের খ্যাতি শুনিয়া পদব্রজে পাঞ্জাবে আসেন। সেখানে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সাধনায় প্রবীণ সাধক ইনায়ত শাহের সঙ্গ লাভ করেন। কয়েকজন হিন্দু সাধকদের সঙ্গও লাভ করেন। লাহোরের নিকট কসূর গ্রামে তিনি সাধনায় বসিয়া যান। মৌলবীরা সর্বদা ইঁহাকে আক্রমণ করিতেন, কারণ ইনি অনেক সময় কোরানের তীব্র সমালোচনা করিতেন। কিন্তু মৌলবীরা ইঁহাকে আঁটিয়া উঠিতে পারিতেন না। ইনি বিবাহ করেন নাই। কসূরেই ইনি দেহত্যাগ করেন। সেখানে ইঁহার সমাধি আছে। বিস্তর সাধক ভক্ত যাত্রী সেখানে যান। ইনি এমন চমৎকার পাঞ্জাবী ভাষায় তাঁর বাণী রাখিয়া গিয়াছেন যে, জন্মতঃ তিনি পাঞ্জাবী নহেন এরূপ চিন্তা করাও কঠিন। তবে অল্প বয়সেই তিনি পাঞ্জাবে আসেন তাই ভাষা চমৎকার আয়ত্ত করিয়াছিলেন।

বুল্লেশাহ বলেন—

‘হে বুল্লা, লোকেরা বলে, তুই গিয়া না হয় মসজিদের মধ্যে বস্; মসজিদের মধ্যে বসিলে কি লাভ যদি অন্তরের মধ্যে নমাজ না আসে?’

‘হে বুল্লা, ধর্মস্থানে থাকে সব দস্যু, ঠাকুরদ্বারায় (দেবমন্দিরে) থাকে সব ঠগ, মসজিদের মধ্যে বসিয়া আছে সব বদমায়েস; প্রেমময় আছেন এ সকলের বাহিরে।’

‘খোদাকে না পাইবে মসজিদে, না পাইবে কাবায়, না কোরান-কেতাবে, না নিয়মবদ্ধ নমাজে। এমনি সহজে যদি-বা কিছু বুঝিতে পারি, গোল বাধাইয়া দেন সব পণ্ডিতেরা।’

‘হে বুল্লা, মক্কা গেলেও মুক্তি নাই, যে পর্যন্ত হৃদয় হইতে অহমিকা দূর না হয়; গঙ্গায় গিয়াও মুক্তি নাই, শত শত ডুবই দাও না কেন? মুক্তি তখনই মিলিবে, যখন অহম্‌কে লুটাইয়া দিবে।

‘হে বুল্লা, অন্তরের মধ্যে আল্লাকে পাইয়া নিত্য পরমানন্দ পরম শান্তি পাইয়াছি। নিত্য মৃত্যু হইতে নিত্য জীবন পাইয়াছি, নিত্যই অগ্রসর হইয়া চলিয়াছি।’

‘হে বুল্লা, প্রভুর প্রেমেই মত্ত থাকিস্। লক্ষ লক্ষ নিন্দা তোর হয় তো হোক। লোকেরা যখন তোকে বলিবে ‘কাফের’ ‘কাফের’, তখন তুই ববি ‘ঠিক কথা, ঠিক কথা’।’

রামসনেহী—রাজপুতানার সাধক সন্তরাম বা রামচরণের এই সম্প্রদায়। ইঁহার জন্ম জয়পুর সুরাসেন গ্রামে, ১৭১৫ হইতে ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ধর্ম-উপদেশ করিতে আরম্ভ করেন। রামসনেহী অর্থ রামস্নেহী বা রামের প্রেমিকা। তাঁহারা প্রেমের দ্বারা ভগবানকে সাধনা করেন, পৌত্তলিকতা মানেন না। রাজপুতানায় ইঁহাদের অনেক মঠ আছে। গুজরাতে আমেদাবাদে বড়োদায় সুরাতে বল্সারেও ইঁহাদের মঠ আছে। অল্পদিন পূর্বেই যোধপুরে ইঁহাদের মঠে মহান্ত দুল্হাদাস খুব সাধক লোক ছিলেন।

কাঠিয়াওয়াড়ে প্রাণনাথের জন্ম। ভারতের নানা স্থানে ঘুরিয়া অবশেষে তিনি বুন্দেলখণ্ডে পান্না রাজ্যে বাস করেন। ১৭০০ হইতে ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তিনি জীবিত ছিলেন। প্রাণনাথীরা খুব উদার। হিন্দু-মুসলমান উভয়বিধ সাধনাই ইঁহারা সম্মান করেন এবং সকল ধর্মের মৈত্রীই ইঁহাদের লক্ষ্য। প্রাণনাথ হিন্দু ও মুসলমান উভয় শাস্ত্রেই প্রবীণ ছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের মিলন চিরজীবন আকাঙ্ক্ষা করিয়াছেন। বুন্দেলখণ্ডের রাজা ছত্রশাল (১৬৫০-১৭৩৩ খ্রীস্টাব্দ) তাঁর অনুরাগী ছিলেন। ইঁহাদের হিন্দু ও মুসলমান উভয় দলের শিষ্যই আছেন। তাঁহারা নিজ নিজ ঘরে ভিন্ন ভাবে ও নিজ নিজ মতে থাকিলেও সাধনা স্থানে প্রেমে ভক্তিতে মৈত্রীতে একত্র সাধনা করেন। ঈশ্বরকে ইঁহারা ধাম বলেন। তাই এই সম্প্রদায়কে ‘ধামী’ও বলে। প্রাণনাথের বাণীতে মুসলমান সাধনার শব্দের বড়ই বাহুল্য।

সুনীতি, চরিত্রের বিশুদ্ধি, পরোপকার, মানুষের সেবা, দয়া ইঁহাদের সাধনার অঙ্গ। ইঁহারা খুবই উদার। হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর শিষ্যরা একত্র বসিয়া পঙ্ক্তিভোজন করেন। ইঁহাদের প্রধান গ্রন্থ ‘কুলজুম’ হিন্দু-মুসলমান ভাবে পূর্ণ। ইঁহারা বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী।

তুলসী সাহবের জন্ম ১৭৬৩ হইতে ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। ইনি ছিলেন জাতিতে ব্রাহ্মণ—পেশওয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র। রাজ্য ও সংসার ত্যাগ করিয়া হাথ্রসে আসিয়া বাস করেন, তাই তাঁহার নাম তুলসী সাহব হাসী। ইঁহার স্ত্রীর নাম ছিল লক্ষ্মীবাঈ। ইঁহার এক পুত্র হয়। রাজ্যে অভিষিক্ত হইবার সময় উপস্থিত হইলে ইনি সংসার ত্যাগ করেন। ইঁহার ছোট ভাই ছিলেন বাজীরাও। তাঁর সঙ্গে দেখা করিতে ইনি একবার বিঠুরে গিয়াছিলেন।

ইনি মুসলমান ও হিন্দু উভয় শাস্ত্রের ও সাধনার মর্মজ্ঞ ছিলেন। তিনি বলিতেন, বাহ্য আচারে কর্মে কিছু নাই। সব সাধনাই অন্তরে। আপনার সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের সত্যযোগই হইল সাধনা। উভয় শাস্ত্রেরই মিথ্যা সংস্কারকে তিনি তীব্র আঘাত করিতেন।

একবার গঙ্গাতীরে স্নানরত এক ব্রাহ্মণ শূদ্রকে দূরে সরিয়া বসিতে বলায় তিনি বলেন—

‘কেমন শাস্ত্র তোমার? বিষ্ণুপদোদ্ভবা যদি এত পবিত্র, বিষ্ণুপদোদ্ভব শূদ্র কেন তবে এত অপবিত্র?’

তাঁর বহু ভক্ত ও অনুরাগী ছিলেন। তার মধ্যে রামকৃষ্ণ নামে এক মেষপালক বড় ভক্ত ছিলেন। সুরস্বামী তাঁহার প্রধান শিষ্য। ১৮৪৩ হইতে ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তাঁহার মৃত্যু হয়। তাঁহার প্রধান গ্রন্থ ‘ঘটরামায়ণ’ ও ‘রত্মসাগর’। ইঁহার ‘শব্দাবলী’ও সমাদৃত। তাহাতে অনেক সুন্দর কাহিনী আছে।

এখানে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনন্তপন্থী ও আপাপন্থীর নাম করা উচিত। অনন্তপন্থীরা অনন্ত ভগবানের উপাসক। রায়বেরিলি ও সীতাপুরে ইঁহাদের স্থান। বৈষ্ণব ভাবেই ইঁহাদের সাধনা।

প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্বে খেরী জেলায় স্বর্ণকার মুন্নাদাস আপাপন্থ স্থাপন করেন। ইঁহারা ভাক্তকে প্রাধান্য দেন। ইঁহারা তিলক মালা কৌপীন ধারণা, জাতিভেদ প্রভৃতি মানেন না। মুন্নাদাসের গুরু ছিল না, নিজেই তিনি গুরু হন বলিয়া এই পন্থের নাম আপাপন্থী, অযোধ্যায় মাড়বায় ইঁহাদের প্রধান মঠ।

গোবিন্দপন্থী। এই পন্থ ভক্ত গোবিন্দদাস কর্তৃক স্থাপিত। ইঁহারা বৈষ্ণবভাবে সাধনা করেন। ফৈজাবাদ জেলায় অহরৌলীতে তাঁর সমাধিস্থানে অগ্রহায়ণ মাসে বড় মেলা হয়।

ভক্ত দেধরাজ। মধ্যযুগের সর্বশেষে এই একজন সমর্থ ভক্তের নাম করা উচিত। ইনি নারনৌল জেলায় ধারসু-গ্রামবাসী পূরণ ব্রাহ্মণের পুত্র। ১৭৭১ খ্রীষ্টাব্দে ইঁহার জন্ম। দারিদ্র্যবশত তেরো চৌদ্দ বৎসর বয়সে ইনি আগ্রা যাত্রা করেন। তখন মাধবজী রাও সিন্ধিয়া সেখানে রাজা। দেওয়ান ধর্মদাসের বাড়ী ইনি চাকুরিতে প্রবৃত্ত হন ও হিন্দু- মুসলমান সর্বশ্রেণীর সাধকদের সঙ্গে সেখানে মেলামেশা করেন। ধর্ম-জীবন লাভ হওয়ায় তেত্রিশ বৎসর বয়সে ইনি স্বাধীন ও উদার মত প্রচার করিতে আরম্ভ করেন। জাতিভেদের বিরুদ্ধে তিনি প্রচার করেন ও নিজে বৈশ্য কন্যাকে বিবাহ করেন। পরে দেশে গিয়া বাস করেন ও সেখানে প্রচার চালান। নারনৌলের অধিপতি ঝাঝরের নবাব নজাবত আলী তাঁর শাস্ত্রবিরুদ্ধ মতের জন্য তাঁহাকে কারারুদ্ধ করেন। কারাগারে বহুদিন তিনি বহু দুঃখ পান। ঝাঝর রাজ্যে গোলমাল হওয়ায় অবশেষে কারাগার হইতে তাহারা সব কয়েদীকেই বাহির করিয়া দেয়। তিনি তখন খেতরী জেলায় ছুরাণী গ্রামে বাস করিয়া প্রচার আরম্ভ করেন। গরীব দাসের কথায় একবার ছুরাণী গ্রামের উল্লেখ করা গিয়াছে। একাশি বৎসর বয়সে ছুরাণীতে তাঁর মৃত্যু হয়।

এখন এই সম্প্রদায়ের প্রধান স্থান গুরগাঁও জেলায় ভীবানীতে। দেধরাজের শিষ্য ছিলেন গঙ্গারাম। তাঁর পুত্র ছিলেন রামচন্দ্র। তাঁর শিষ্য সন্তরামের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।

ঝাঝর নারনৌল গুরগাঁওতে এই মতের সাধক আছেন। ইঁহারা বলেন, ঈশ্বর এক অপরূপ অপ্রতিম নিত্য সর্বব্যাপী। ইঁহারা প্রতিমা মূর্তি প্রতীক বা জাতিভেদ মানেন না। স্ত্রী-পুরুষের এই সাধনায় সমান অধিকার। দেধরাজ তখনকার দিনেও পরদা প্রথার বিরুদ্ধে ঘোর যুদ্ধ করেন, তাই ইঁহাদের নারীরা পরদা মানেন না—অন্ততঃ ধর্মমন্দিরে পরদা নাই। উপাসনার সময় মেয়েরা গান করেন। মেয়েদের কণ্ঠ খুব ভাল। ইঁহাদের সাধকদিগকে বাউলদের মত ভক্তিতে নৃত্য করিতে দেখিয়াছি।

হিন্দু-মুসলমান উভয় সাধনাতে ইঁহাদের শ্রদ্ধা আছে। মহাভারত-রামায়ণ হইতে ইঁহারা নীতি উপদেশ গ্রহণ করেন, তবে সে সব শাস্ত্রকে অভ্রান্ত বলিয়া মানেন না। পরমেশ্বরকে রাম হরি প্রভৃতি নানা নামে উল্লেখ করেন। চলিত ভাষাতেই ইঁহাদের বাণী। মেয়েরা পরদা মানেন না বলিয়া ইঁহাদিগকে নংগা বা ন্যাংটা ও এই পন্থকে ‘নাংগীপন্থ’ও বলে।

রামমোহন রায়ের অল্প পূর্বে বর্তমান কালের শিক্ষা না পাইয়াও ইঁহারা অভ্রান্ত শাস্ত্র, জাতিভেদ, পৌত্তলিকতা না মানিয়া সকল ধর্মের ভ্রাতৃত্ব স্বীকার করিয়া এক অপ্ৰতিম ঈশ্বরে উপাসনা ঘোষণা করিয়াছেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে, ইঁহাদের মধে মেয়েদের পরদা নাই। উপাসনাকালে মেয়েরা গান করেন ও মেয়েদের অধিকার পুরুষদের সমতুল্য। সকলেই ঈশ্বরের সন্তান বলিয়া অধিকার পুরুষদের সমতুল্য। সকলেই ঈশ্বরের সন্তান বলিয়া সর্ব পুরুষ ও নারী ভাই ও ভগিনী এই মত ইঁহারা প্রচার করেন। এই সব কথা সকলের প্রণিধানের যোগ্য।

এইখানেই রাজা রামমোহনকে পুরোবর্তী করিয়া বর্তমান নবযুগের আরম্ভ হইল।

বাংলাদেশের আউল বাউল দরগা সাঙ্গ সংযোগী কর্তাভজা প্রভৃতিদের কথা এখানে আর বলিলাম না, তার কারণ ইঁহাদের সঙ্গে পাঠকদের কতকটা পরিচয় আছে এবং এখানে পরিসরের অভাব। কর্তাভজা বা সত্যধর্মবাদীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই-ই আছেন। মুসলমান গুরুর কাছে ব্রাহ্মণ দীক্ষা গ্রহণ করিতে পারেন। বাংলা উড়িষ্যা প্রভৃতি স্থানে একসময় নাথপন্থ নিরঞ্জনপন্থ প্রভৃতি প্রবল স্বাধীন মতবাদ ছিল। ক্রমে তাহারা নিজেদের মহত্ত্ব হারাইয়া শাস্ত্রাশ্রিত হিন্দুসমাজের পার্শ্বে নানা উপায়ে কোনোমতে একটু স্থান ভিক্ষা করিতেছে। সে সব কথা বলিবার অবসর এখানে নাই।

বহু বহু ভক্ত ও তাঁদের সাধক-মণ্ডলের নাম করিতে বাধ্য হইয়াছি। তাহার এক একটির বিষয় বলিতে গেলেই এক প্রবন্ধে কুলায় না। তাই এখানে অনেক স্থলে নামের পর নামে এই সব কথা কেবল তালিকার মত হইয়া উঠিয়াছে। অথচ অনেক স্থলে তাঁহাদের আদর্শ ও সাধনা একই রকমের। তবু বার বার সে সব প্রয়াসের উল্লেখ না করিয়া উপায় নাই। নানা সাধনায় মৈত্রী দ্বারা সকল ধর্মের মধ্যে একটা ভ্রাতৃত্ব ও যোগ স্থাপন করিবার ইচ্ছা সবারই ছিল। বার বার সাধকের পর সাধক এই চেষ্টা করিয়াছেন, বার বার আংশিকভাবে সফল বা নিষ্ফল হইয়াছেন, তবু চেষ্টার বিরাম নাই। এই প্রয়াস বুঝাইবার জন্যই এত বার এত নামের উল্লেখ করিতে হয়। ইহার দ্বারা সকল ধর্মের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের জন্য, সর্ব সাধন ও মানবের সঙ্গে যোগের জন্য তাঁহাদের অন্তরের ব্যাকুলতা বুঝা যায়। মনে হয়, যেন এই মৈত্রীই ভারতের ভগবন্নির্দিষ্ট শাশ্বত সাধনা। যত দিনে ইহা পূর্ণ হয় ততদিন ভারতের মুক্তি নাই। ভারতের আত্মা যেন কায়ার পর কায়া ত্যাগ করিয়া ও গ্রহণ করিয়া তাহার সাধনার মুক্তি খুঁজিতেছে। এই সব ভাবের প্রবাহ নানা লোকের মধ্যে নানা ভাবে দূর দূরান্তরে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, বার বার তাঁহাদের নাম উল্লেখ ব্যতীত তাহা বুঝাইবার উপায় নাই। ইহা সত্ত্বেও যে সব ভক্তের দেহান্তে তাঁহাদের অনুবর্তী সম্প্রদায় বা সাধক-মণ্ডল গড়িয়া উঠে নাই এই আলোচনায় তাঁহাদের নাম করা হয় নাই। তাই গভীর সাধক কমাল ও জ্ঞানদাসের মত বহু বহু ভক্তের নাম এখানে বাদ দিতে হইল। কারণ তাঁহারা কোন movement বা সাধনার মণ্ডলী রাখিয়া যান নাই। মধ্যযুগের ‘লোকবেদপন্থী’ ও ‘অনুভৌসাচ-পন্থী’ উভয়বিধ সাধকদের মধ্যে কেবল এমন সব লোকের নাম করা গেল যাঁহারা তাঁহাদের সাধনার ধারা ভক্তদের মধ্যে রাখিয়া গিয়াছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *