ব্ল্যাক পার্ল

ব্ল্যাক পার্ল

অনুবাদ : জাবেদ রাসিন

ঘণ্টার বিকট শব্দে জেগে উঠল অ্যাভিনিউ হোশের নয় নম্বর বাড়িটি। প্রহরীর স্ত্রী দরজার তারটা টেনে নিয়ে গজগজ করতে লাগল :

“আমি ভেবেছিলাম সবাই ভেতরে আছে। তিনটা বেজে গেছে মনে হচ্ছে।”

“সম্ভবত ডাক্তারের কাছে কেউ এসেছে।” তার স্বামী বিড়বিড় করে বলল।

“তিন তলায়, বাম পাশের ফ্ল্যাট। কিন্তু ডাক্তার তো রাতে বাইরে যাবেন না।” দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুকের উদ্দেশ্যে বলল মহিলাটি

“রাতে তাকে অবশ্যই যেতে হবে।” মহিলাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সে। প্রহরী তাকে ডাক্তারের অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিলো।

আগন্তুক হলরুমে প্রবেশ করে একতলা, দোতলা, তিন তলার সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরে উঠতে লাগল, কিন্তু ডাক্তারের দরজার সামনে না থেমে পঞ্চম তলায় উঠে গেল। সেখানে থেমে সাথে নিয়ে আসা দুটো চাবি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করল; একটি চাবি সেই তালার খাঁজে না বসলেও আরেকটি বেশ ভালোভাবে বসে গেল।

“আহ! চমৎকার!” সে বিড়বিড় করে বলল, “কাজটা সহজ হয়ে গেল। কিন্তু কাজ শুরু করার আগেই বেরিয়ে যাওয়ার উপায় ভেবে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাকে বুঝতে হবে… ডাক্তারকে জাগিয়ে তুলে তারপর তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে কতটুকু সময় লাগতে পারে?… সর্বোচ্চ কয়েক মিনিট।”

দশ মিনিট পর, সে ডাক্তারের নামে অভিযোগ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। প্রহরী তার জন্য দরজা খুলে দিলো এবং ঠিক পেছনেই তালা লাগানোর ক্লিক শব্দ শুনতে পেল। কিন্তু দরজার তালাটি আসলে লাগেনি, কারণ বেরিয়ে যাওয়ার সময় লোকটি খুব দ্রুত একটা ছোট্ট লোহার টুকরো এমনভাবে তালাটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে তালার ভেতর আংটা ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর লোকটি চুপচাপ আবার ফিরে এলো। বাড়িতে প্রবেশ করল। কিন্তু এবার প্রহরী কিছুই জানতে পারল না। নিঃশব্দে সে আরও একবার পঞ্চম তলায় উঠে গেল। পাশের ঘরে, বৈদ্যুতিক লণ্ঠনের আলোয় সে তার টুপি এবং ওভারকোট একটি চেয়ারে রেখে অন্যটিতে বসল এবং ভারী জুতা বদলে চপ্পল পায়ে গলিয়ে নিল।

“আহ! হয়ে গেছে—বেশ সহজ ছিল! কেন যে আরও বেশি বেশি লোক চুরির মতো লাভজনক এবং আনন্দদায়ক একটা কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে না, সেটা ভেবেই অবাক হই! একটু যত্নের সাথে আর চটজলদি করতে জানলে চুরির কাজটা খুব আনন্দদায়ক পেশা হয়ে উঠতে পারে। তবে খুব শান্ত এবং একঘেয়ে হওয়া যাবে না, নাহয় এটি ক্লান্তিকর হয়ে উঠবে।”

অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের পরিকল্পনার বিস্তারিত নকশাটি মেলে ধরল সে।

“আমি এখন কোথায় আছি সেটা আগে বুঝে নিতে হবে। এখানে, আমি যে লবিতে বসে আছি তা দেখতে পাচ্ছি। রাস্তার সামনে, ড্রইং-রুম, খাসকামরা এবং ডাইনিং-রুম। আহ! এখানে একটি করিডোর আছে; করিডোরটি সোজা একটা বেড চেম্বারে চলে গেছে। তিন মিটার দূরত্বে, আমি কাউন্টেসের চেম্বারের সাথে সংযোগকারী ওয়ারড্রোব-ক্লোজেটের দরজায় চলে আসব।”

সে নকশাটি গুটানোর পর লণ্ঠন নিভিয়ে দিলো, এবং করিডোরের নিচের দিকে এগিয়ে গিয়ে দূরত্ব গণনা শুরু করল, ঠিক এভাবে:

“এক মিটার…. দুই মিটার…. তিন মিটার…. এই যে দরজাটা…. ঈশ্বর, এটা কত সহজ! একটি ছোটো সাধারণ হুড়কো এখন আমাকে চেম্বার থেকে আলাদা করে রেখেছে, এবং আমি জানি যে হুড়কোটি মেঝে থেকে ঠিক এক মিটার তেতাল্লিশ সেন্টিমিটার ওপরে অবস্থিত। তাই, একটি ছোট ছিদ্র করতে যাচ্ছি যেন এই হুড়কোর বাধা অতিক্রম করতে পারি।”

পকেট থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বের করল সে। তারপর হঠাৎ করেই তার মাথায় একটি ভাবনা খেলে গেল:

“এমনও তো হতে পারে যে কোনো কারণে দরজাটি হয়তো বন্ধ করা হয়নি। একটু চেষ্টা করে দেখা যাক।”

সে নব ঘুরিয়ে দিতেই দরজা খুলে গেল।

“সাহসী লুপাঁ আমার, আজ ভাগ্য তোমার সাথে আছে… এখন কী করতে হবে? কক্ষগুলোর অবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে; ভাবতে হবে যে কাউন্টেস কোথায় মুক্তা লুকিয়ে রাখতে পারে। তারপর একবার এই কালো মুক্তা নিরাপদে পেয়ে গেলে, তোমাকে নিশ্চুপ হয়ে গাঢ় অন্ধকারে মিশে যেতে হবে।”

আর্সেন লুপাঁ দ্বিতীয় দরজাটি খোলার জন্য পুরো আধ ঘন্টা কাজ চালিয়ে গেল—এটি মূলত কাঁচের একটি দরজা যেটি কাউন্টেসের বেডচেম্বারের দিকে গেছে। কিন্তু সে এত দক্ষতা এবং সতর্কতার সাথে কাজটি করেছিল যে কাউন্টেস জেগে থাকলেও সামান্য একটু শব্দও শুনতে পেত না। হাতে ধরে রাখা কক্ষের নকশা অনুসারে, তাকে কেবল একটি হেলান-চেয়ারের পাশে যেতে হবে এবং ওটার পেছনেই বিছানার কাছে একটি ছোটো টেবিল রাখা আছে, টেবিলে একটা চিঠিপত্রের বাক্স আছে আর সেই বাক্সে-ই কালো মুক্তা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সে হেলান-চেয়ারের অবস্থান আন্দাজ করে কার্পেটের ওপর সাবধানে হেঁটে গেল। যতই বাক্সের কাছে পৌঁছাচ্ছিল ততই হৃদয়ের কম্পন বাড়তে থাকল, সেটাকে থামানোর জন্য একটু বিরতি নিল লুপাঁ। যদিও সে ভয় পাচ্ছে না, তবে চারপাশটা যেন বড্ড বেশি নীরব, আর এটাই কীভাবে যেন উদ্‌বেগের কারণ হয়েছে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। এটাই তাকে বিস্মিত করল, সে তো ভয় পায়নি। তাহলে কেন তার বুকের গভীরে একটা শঙ্কা জেগে উঠতে শুরু করেছে? তবে কি ঘুমন্ত কাউন্টেস তাকে প্রভাবিত করছে কোনোভাবে?

চুপচাপ কান পেতে শুনতে লাগল সে। ঘুমন্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। হাতড়ে হাতড়ে সে আর্মচেয়ারটি খুঁজল এবং খুঁজেও পেল; তারপর, ধীর পায়ে সতর্কতার সাথে টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো, হাত দুটো প্রসারিত করে সামনে কী আছে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। তার ডান পাশটা টেবিলের একটি পায়া স্পর্শ করেছে। এইতো! এখন, তাকে কেবল উঠে মুক্তা নিয়ে পালাতে হবে। বুকের মধ্যে বন্য জন্তুর উত্তেজনা এবং হৃৎপিন্ডটা এতো বেশি শব্দ করতে লাগল যে একবার মনে হলো হৃদয়ের এই ধুকপুকানির শব্দ-ই কাউন্টেসকে জাগিয়ে দেবে কিনা। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির জোরে সে তার হৃৎপিণ্ডকে শান্ত করতে সক্ষম হলো এবং মেঝে থেকে যখনই উঠতে যাবে ঠিক তখনই হাতে কিছু একটার স্পর্শ টের পেল, মোমবাতি বলেই মনে হলো তার কাছে, একটি উলটে যাওয়া মোমবাতি। এক মুহূর্ত পরে, তার হাত আরেকটি বস্তুর স্পর্শ পেল: একটি ঘড়ি, চামড়া দিয়ে আবৃত।….

আচ্ছা! কী ঘটেছে? সে বুঝে উঠতে পারছে না। সেই মোমবাতি, সেই ঘড়ি; কেন ওই জিনিসগুলো তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় ছিল না! ওহ! নিস্তব্ধ এই ভয়ংকর রাতে কী হচ্ছে এখানে?

হঠাৎ তার মনে হলো, কান্না মতন কিছু একটা তাকে এড়িয়ে গেল। অদ্ভুত আর অবর্ণনীয় কিছু একটা তাকে ছুঁয়ে গেল! “না! না!” সে ভাবল, “এটা হতে পারে না। এটা আমার উত্তেজিত মস্তিষ্কের কিছু কল্পনা।” বিশ-ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য সে স্থির, আতঙ্কিত হয়ে রইল। তার কপাল ঘামে ভিজে উঠেছে আর তার আঙুলগুলো এখনও সেই ভয়ঙ্কর জিনিসটি স্পর্শ করে আছে।

সে আবার তার হাত সামনের দিকে প্রসারিত করার উদ্যোগ নিল। আরও একবার, তার হাত সেই অদ্ভুত জিনিসটি স্পর্শ করল। জিনিসটা কী সেটা অনুভব করার চেষ্টা করল সে। কিছুক্ষণের মধ্যে-ই বুঝতে পারল যে এটি চুল, মানুষের চুল এবং একটি মানুষের মুখ; সেই মুখটি ছিল প্রায় বরফের মতো ঠান্ডা।

পরিস্থিতি যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন, আর্সেন লুপাঁর মতো একজন ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই, সে দ্রুত তার লণ্ঠন জ্বালাল। তার সামনে একজন রক্তে রঞ্জিত মহিলা শুয়ে আছে, তার ঘাড়ে এবং কাঁধে ক্ষত। সে তার ওপর ঝুঁকে ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখল, মারা গেছে।

“মারা গেছে! মহিলাটি মারা গেছে!” একটু উত্তেজনায় বিভ্রান্ত হয়ে বারবার বকে যেতে লাগল সে।

লুপাঁ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই স্থির চোখ আর বীভৎস মুখের দিকে। রক্তের স্রোত মেঝেতে বিছানো গালিচা ভিজিয়ে ঘন কালো জমাটবদ্ধ গেছে। সে উঠে বৈদ্যুতিক বাতিটি জ্বালিয়ে দিলো। তারপর চারপাশে ধ্বস্তাধস্তির চিহ্ন দেখতে পেল। বিছানাটার ভীষণ বেহাল দশা। মেঝেতে মোমবাতি আর ঘড়ি পড়ে আছে, তাতে সময় দেখাচ্ছে এগারোটা বিশ; তারও খানিকটা দূরে একটি উলটে যাওয়া চেয়ার; এবং সর্বত্র রক্তের দাগ।

“আর কালো মুক্তা?” সে বিড়বিড় করল।

চিঠিপত্রের বাক্সটি যেখানে থাকার কথা সেখানেই ছিল। সে অধীর আগ্রহে এটি খুলল। রত্নের বাক্সটি ভেতরে ছিল ঠিক-ই, কিন্তু খালি, ভেতরে কোনো রত্ন ছিল না।

“ভাগ্য নিয়ে বড়ো-ই গর্ব করছিলে তুমি, লুপাঁ। কাউন্টেস ঠান্ডা ও মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, কালো মুক্তাও হাওয়া হয়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সটকে পড়াই ভালো, নতুবা গুরুতর সমস্যায় পড়তে পারো।”

তবুও সে নড়ল না।

“এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত? হ্যাঁ, অবশ্যই। আর্সেন লুপাঁ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি হলে তাই করত। এখন, সবকিছু ভালো করে বুঝতে হবে। এমন একটি ঘটনায় যদি নিজেকে পুলিশ কমিশনার হিসেবে ভাবি এবং এই বিষয়ে তদন্ত শুরু করি, তবে কী করতে হবে? হ্যাঁ, কিন্তু তা করার জন্য আমার মগজটা আরও পরিষ্কার করা দরকার। আমার মাথাটা এখন জটলা পাকিয়ে গেছে।”

সে আর্মচেয়ারে বসে শক্ত হাতে নিজের পুড়তে থাকা কপালটা চেপে ধরল।

***

অ্যাভিনিউ হোশের হত্যাকান্ডটি প্যারিসের জনসাধারণকে বিস্মিত এবং বিভ্রান্ত করেছে, এবং অবশ্যই, রহস্যের পর্দা যদি আর্সেন লুপাঁ নিজেই না সরিয়ে ফেলত তবে আমার পক্ষে কখনোই ঘটনাটি বর্ণনা করা সম্ভব হতো না। মামলার আসল সত্য কেউ জানতে পারেনি।

বোই-এ তার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে-লিওটিন জাল্টি যে একসময়ের বিখ্যাত গায়িকা এবং কাউন্ট ডি’অ্যান্ডিলোট-এর বিধবা স্ত্রী ছিল তা কেউ জানত না। এই সেই জাল্টি, যার বিলাসিতা প্রায় বিশ বছর আগে পুরো প্যারিসকে চমকে দিয়েছিল; যে তার হীরা এবং মুক্তার মহিমার জন্য ইউরোপীয় খ্যাতি অর্জন করেছিল। লোকে কানাঘুষা করত যে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন এবং অসংখ্য অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানির সোনার খনির সমমূল্যের জিনিস সে গায়ে পরে ঘুরত। দক্ষ স্বর্ণকাররা জাল্টির জন্য আগেকার দিনের রাজা-রানিদের মতো ফরমায়েশির কাজ করত। অথচ তার সমস্ত সম্পদ গ্রাস করার সেই দুঃখজনক পরিণতির কথা কে ভুলতে পেরেছে? সেই সব অসাধারণ সংগ্রহের মধ্যে বিখ্যাত কালো মুক্তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কালো মুক্তা! যদি সে এটা ছেড়ে দিত-তাহলে হয়তো তার সৌভাগ্য ফিরে আসতো।

কিন্তু সে অমূল্য গয়না বিক্রি করার চেয়ে তার সঙ্গী, বাবুর্চি আর একজন ভৃত্যকে নিয়ে একটি সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টে থাকাটাকেই বেছে নিয়েছিল। এর একটা কারণ ছিল অবশ্য; কারণটি সে প্রকাশ করতে ভয় পায়নি: কালো মুক্তাটি একজন সম্রাটের উপহার ছিল! জীবনের কঠিনতম সময়েও সে এটিকে ছেড়ে দেয়নি। দিনের বেলায় সে এটি পরত, এবং রাতে নির্দিষ্ট জায়গায় লুকিয়ে রাখত।

এই সমস্ত তথ্য পত্রিকার কলামে বার বার ছাপা হচ্ছে, কৌতূহল জাগাচ্ছে। বলতে আশ্চর্যজনক হলেও যাদের কাছে এই রহস্যের চাবিকাঠি রয়েছে তাদের কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট, সম্ভাব্য হত্যাকারীর গ্রেপ্তার শুধুমাত্র ব্যাপারটিকে জটিল করেছে এবং উত্তেজনাকে দীর্ঘায়িত করেছে। দুদিন পওে সংবাদপত্রগুলো নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি প্রকাশ করে:

‘কাউন্টেস ডি’অ্যান্ডিলোটের সেবক ভিক্টর ড্যানেগ্রের গ্রেপ্তারের তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। চিফ ডিটেকটিভ দুদো-ই চিলেকোঠায় ভিক্টরের বিছানার মধ্যে তার ব্যবহৃত ওয়েস্টকোটটি খুঁজে পেয়েছিলেন, তাতে রক্তের বেশ কয়েকটি ছাপ লেগে ছিল। এছাড়াও, ওই পোশাকের একটি বোতাম মিসিং ছিল যা ভিকটিমের বিছানার নিচে পাওয়া গিয়েছিল।

ধারণা করা হয়, রাতের খাবারের পরে, তার নিজের ঘরে যাওয়ার পরিবর্তে, ড্যানেগ্রে ওয়ারড্রোব-ক্লোসেটের ভেতরে ঢুকে যায় এবং কাচের দরজা দিয়ে কাউন্টেসকে মূল্যবান কালো মুক্তা লুকিয়ে রাখতে দেখে ফেলে। এটি কেবল একটি তত্ত্ব, যা এখনও কোনো প্রমাণ দ্বারা যাচাই করা হয়নি। এছাড়াও, আরেকটি অস্পষ্ট ব্যাপার আছে। সকাল সাতটায়, ড্যানেগে বুলেভার্দ দ্য কোরসেলেসে অবস্থিত একটি তামাকের দোকানে গিয়েছিল; দারোয়ান এবং দোকানদার উভয়েই এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে, কাউন্টেসের সঙ্গী এবং বাবুর্চি, যারা হলের শেষপ্রান্তে ঘুমায়, তারা উভয়েই বলেছে যে, তারা যখন আটটায় উঠল তখন অ্যান্টেচেম্বারের দরজা এবং রান্নাঘরের দরজা তালাবদ্ধ ছিল। এই দুই ব্যক্তি বিশ বছর ধরে কাউন্টেসের সেবায় নিয়োজিত এবং সন্দেহের ঊর্ধ্বে। প্রশ্ন হলো: কীভাবে ড্যানেগ্রে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল? তার কাছে কি আরও একটা চাবি ছিল? এই বিষয়গুলো পুলিশ তদন্ত করবে।’

প্রকৃতপক্ষে, পুলিশের তদন্ত মূল রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেনি। তদন্তে জানা গিযেছিল যে ভিক্টর ড্যানেগ্রে ছিল একজন বিপজ্জনক অপরাধী, মাতাল এবং চোরাকারবারি। কিন্তু, তদন্ত এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রহস্য আরও গভীর হয় এবং নতুন জটিলতা দেখা দেয়। প্রথমত, কাউন্টেস-এর চাচাতো বোন এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী মাদামোয়াজেল ডি সিনক্লেভস ঘোষণা করেছিল যে কাউন্টেস তার মৃত্যুর এক মাস আগে তাকে একটি চিঠি লিখেছিল যাতে কালো মুক্তাটি কীভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা বর্ণনা করেছিল। চিঠিটা হাতে পাওয়ার পরদিন-ই সেটা হারিয়ে যায়। কে চুরি করেছিল সেটা?

আবার, দারোয়ান সেদিন এক ব্যক্তির জন্য দরজা খুলে দিয়েছিল যে ডাক্তার হারেলের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। ওদিকে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি সাক্ষ্য দেন যে কেউ তার দরজার বেল বাজায়নি। তাহলে সেই ব্যক্তিটি কে ছিল? একজন সহযোগী?

একজন সহযোগীর তত্ত্ব তখন সাংবাদিক. জনতা এবং বিখ্যাত গোয়েন্দা গাঁইমার্দ লুফে নিল।

বিচারককে তিনি বললেন, “লুপাঁ এই ঘটনার সাথে যুক্ত আছে।”

“বাহ!” বিচারক বলে উঠলেন, “আপনার মাথার ভেতরে শুধু লুপাঁ-ই ঘুরে, আপনি তাকে সর্বত্র দেখতে পান।”

“আমি তাকে সর্বত্র দেখি, কারণ সে সব জায়গাতেই আছে।”

“বরং বলুন যে, আপনি যখনই এমন কিছুর মুখোমুখি হন যা আপনি ব্যাখ্যা করতে পারেন না; তখনই তাকে দেখতে পান। এছাড়াও ঘড়ির থেমে যাওয়া কাঁটা মোতাবেক অপরাধটি যে এগারোটা বিশে ঘটেছিল, আপনি সেটাও উপেক্ষা করেছেন। অথচ প্রহরীর সাক্ষ্যমতে উল্লেখিত আগন্তুকের আগমন ঘটে রাত তিনটায়।”

আইনের কর্তারা তো সন্দেহভাজন ব্যক্তির অপরাধ প্রতিষ্ঠিত করতে প্রায়শই সাক্ষ্যপ্রমাণ আর তদন্ত বিকৃত করে। প্রাথমিক সূত্রের সমর্থনে নতুন কিছু আবিষ্কৃত না হওয়া সত্ত্বেও বিচারক তদন্ত বন্ধ করে দেন, এবং কয়েক সপ্তাহ পরে বিচারকার্য পুনরায় শুরু হয়। মামলাটি ধীর এবং ক্লান্তিকর ছিল, আবার পাবলিক প্রসিকিউটরও অসতর্কভাবে মামলাটি উপস্থাপন করেন। এই পরিস্থিতিতে, ড্যানেগ্রের উকিলের জন্য কাজটি সহজ ছিল। সে মামলা চলাকালীন মামলার ত্রুটি এবং অসঙ্গতিগুলি তুলে ধরে এবং যুক্তি দেয় যে আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করার জন্য প্রমাণগুলো যথেষ্ট নয়। খুন এবং চুরির পর কক্ষটি পুনরায় তালাবদ্ধ করার চাবিটি কোথায়? কেউ কি ড্যানেগ্রেকে চাবি তৈরি বা ব্যবহার করতে দেখেছে? ঘাতকের ছুরিটি কোথায়? কেউ কি দেখেছে সেটা?

বন্দির উকিল যুক্তি দিয়েছিলেন, “যে-কোনো ঘটনাতেই প্রসিকিউশনকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে বন্দি হত্যা করেছে। প্রসিকিউশনকে অবশ্যই দেখাতে হবে যে রহস্যময় ব্যক্তি ভোর তিনটায় বাড়িতে প্রবেশ করেছিল সে দোষী নয়। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা বাজে তো চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। আততায়ী ঘড়ির কাঁটা যে-কোনো সময় তার ইচ্ছামতো ঘুরিয়ে দিতে পারে এবং এইভাবে অপরাধের সঠিক সময় সম্পর্কে আমাদেভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।”

ভিক্টর ড্যানেগ্রে খালাস পায়।

শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে সে কারাগার থেকে বের হয়। ছয় মাসের কারাবাসে দুর্বল ও হতাশ হয়ে পড়েছে সে। জুরিদের জিজ্ঞাসাবাদ আর কারাগারের নির্জনতা একত্রিত হয়ে তাকে স্নায়বিক ভয়ে ভীত করে দিয়েছে, রাতে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। মানসিক এবং শারীরিকভাবে বেশ বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে সে।

অ্যানাতোল ডুফোর ছদ্মনামে সে মনমাত্রে পাহাড়ের মাথায় ছোটো একটি ঘর ভাড়া নেয়। যেখানে যা-ই কাজ পেত, তা-ই করে সে দিনাতিপাত করত। তিনবার সে চাকরি পেয়েছিল, কিন্তু তিনবার-ই তার পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর চাকরি চলে যায়। মাঝে মাঝে, তার মনে হতো কেউ তাকে অনুসরণ করছে—গোয়েন্দাদের কেউ হতে পারে; সন্দেহ নেই যে তাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে। সে প্রায়ই অনুভব করত-আইনের শক্ত হাত দিয়ে কেউ তার কলার চেপে ধরেছে।

একদিন সন্ধ্যায়, সে যখন পাশের একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খাচ্ছিল, তখন এক লোক ঢুকে একই টেবিলে বসল। প্রায় চল্লিশ বছর বয়সি লোকটি বেশ পরিচ্ছন্ন একটি ফ্রক-কোট পরেছিল। সে স্যুপ, সবজি এবং এক বোতল ওয়াইন অর্ডার করল। স্যুপ শেষ করার পরে লোকটি ড্যানেগ্রের দিকে চোখ ফেরাল এবং তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ড্যানেগ্রে চমকে উঠল। সে নিশ্চিত যে তাকে কয়েক সপ্তাহ ধরে অনুসরণ করা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন এই ব্যক্তি। কী চায় সে? ড্যানেগ্রে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাকে সমর্থন জানাতে অস্বীকার করল। লোকটি নিজের গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে নিয়ে ড্যানেগ্রের গ্লাসটিও ভরিয়ে দিলো। তারপর তার গ্লাস তুলে নিয়ে বলল:

“তোমার স্বাস্থ্যের জন্য, ভিক্টর ড্যানেগ্রে।”

ভিক্টর তোতলাতে লাগলো, “আমি!…. আমি….. না, না…. আমি কসম কাটছি…”

“কসম কাটবে যে তুমি কাউন্টেসের চাকর নও?”

“কোন চাকর? আমার নাম ডুফোর। আমার মালিককে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।“

“হ্যাঁ, এই রেস্তোরাঁর মালিকের কাছে অ্যানাতোল ডুফোর, কিন্তু আইনের কর্তাদের কাছে ভিক্টর ড্যানেগ্রে।”

“এটা সত্যি না! কেউ একজন আপনাকে মিথ্যা বলেছে।”

আগন্তুক তার পকেট থেকে একটি কার্ড নিয়ে ভিক্টরের হাতে দিলো, যাতে লেখা: “গ্রিমাউদান, গোয়েন্দা বাহিনির প্রাক্তন পরিদর্শক। ব্যক্তিগত ব্যাবসা নিৰ্বাহক।“

ভিক্টর কাঁপতে কাঁপতে বলল:

“আপনি পুলিশের সাথে যুক্ত?”

“না, এখন নয়, কিন্তু ব্যাবসার প্রতি আমার একটা ভালো লাগা আছে এবং আমি এটাকে আরও লাভজনক করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমি সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকি এবং সুযোগ কাজে লাগাই—যেমন তোমার কেসটি।”

“আমার কেস?”

“হ্যাঁ, তোমার। আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি যে এটি খুব চমৎকার একটি সুযোগ, যদি তুমি আমার সাথে কাজ করতে চাও।”

“কিন্তু আমি যদি না চাই?”

“উঁহুঁ! আমি যা চাই সেটা প্রত্যাখ্যান করার মতো অবস্থায় নেই তুমি।”

“আপনি কী চান?” ভয়ে ভিক্টর স্তব্ধ হয়ে গেল।

“আচ্ছা, আমি তোমাকে কয়েকটি কথা জানাবো। আমি কাউন্টেস ডি’অ্যান্ডিলোট-এর উত্তরাধিকারী মাদামোয়াজেল ডি সিনক্লেভসের কাছ থেকে এসেছি।”

“কীসের জন্য?”

“কালো মুক্তা পুনরুদ্ধার করতে।”

“কালো মুক্তা?”

“যেটা তুমি চুরি করেছ।”

“কিন্তু আমি এটা নেইনি।”

“তোমার কাছেই আছে।”

“যদি থাকত, তাহলে আমি-ই হতাম গুপ্তঘাতক।”

“তুমি-ই গুপ্তঘাতক।“

ড্যানেগ্রে জোর করে হাসি দেখানোর চেষ্টা করল।

“সৌভাগ্যবশত আমার জন্য জুরিবোর্ড তেমনটা ভাবেনি, মহাশয়। জুরি সর্বসম্মত হয়ে খালাসের রায় দেয়। এবং যখন একজন মানুষের পরিষ্কার নীতিবোধ থাকে এবং তার পক্ষে বারো জন ভালো মানুষ থাকে তখন—”

প্রাক্তন পরিদর্শক তাকে হাত দিয়ে ধরে বললেন:

“এসব গত্বাঁধা কথা বলে লাভ নেই। এখন, আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো। খুঁজে নিবে কোনগুলো তোমার বিবেচনা করার যোগ্য। এখন শোনো ড্যানেগ্রে, হত্যার তিন সপ্তাহ আগে তুমি চাকরদের রান্নাঘরের দরজার চাবিটি ২৪৪, রুই ওবারক্যাম্পফ-এর আউটার্ড নামের একজন তালাঅলার কাছ থেকে বানিয়ে নিয়েছিলে।”

“এটা মিথ্যা-পুরোপুরি মিথ্যা!” গর্জে উঠল ভিক্টর। “কেউ সেই চাবিটি দেখেনি। এমন কোনো চাবি-ই নেই।”

“এই যে এখানে।”

ক্ষণিকের নীরবতার পর গ্রিমাউদান বলে গেল:

“যেদিন তুমি কাউন্টেসকে তোমার কেনা ছুরিটি দিয়ে হত্যা করেছিলে; সেদিন-ই তুমি ডুপ্লিকেট চাবির অর্ডার দিয়েছিলে। যেটা ত্রিভুজাকার ফলকের সর্বশেষ সীমা পর্যন্ত খাঁজকাটা ছিল।”

“এসব অর্থহীন কথা। আপনি এমন কিছু অনুমান করছেন যা আপনি জানেন না। কেউ কখনও ছুরিটি দেখেনি।”

“এই যে এখানে।”

ভিক্টর ড্যানেগ্রে পিছু হটল। প্রাক্তন পরিদর্শক বলে যেতে লাগল:

“এর ওপর কিছু মরিচার দাগ আছে। আমি কি তোমাকে বলব এগুলো কীভাবে সেখানে এলো?”

“আচ্ছা!… আপনার কাছে একটা চাবি আর একটা ছুরি আছে। কে প্ৰমাণ করতে পারে যে সেগুলো আমার-ই?”

“তালাঅলা, এবং মুহুরি যার কাছ থেকে তুমি ছুরিটি কিনেছ। আমি ইতোমধ্যে-ই তাদের স্মৃতি চাঙ্গা করে দিয়েছি, এবং তুমি যখন তাদের মুখোমুখি হবে, তারা তোমাকে চিনতে ব্যর্থ হবে না।”

তার বক্তৃতা ছিল শুষ্ক, কঠিন, দৃঢ় এবং নির্ভুল। ড্যানেগ্রে ভয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্‌বিগ্ন হলেও, বাইরে উদাসীন ভাব বজায় রাখার জন্য মরিয়া হয়ে সংগ্রাম করছিল।

“আপনার কাছে কি শুধু এই প্রমাণগুলো-ই আছে?”

“উঁহুঁ! না, একদম-ই না। আরও অনেক আছে। উদাহরণস্বরূপ, অপরাধের পরে, তুমি যেভাবে প্রবেশ করেছিলে, ঠিক সেভাবেই প্রস্থান করেছ। কিন্তু, ওয়ারড্রোব-রুমের মাঝখানে, হঠাৎ ভয় পেয়ে, তুমি দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়েছিলে।”

“আপনি সেটা কীভাবে জানেন? কেউ এই ধরনের জিনিস জানতে পারে না,” মরিয়া হয়ে যুক্তি দেখাল ভিক্টর।

“পুলিশ অবশ্য এ বিষয়ে কিছুই জানে না। তারা কখনোই মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়াল পরীক্ষা করার কথা ভাবে না। কিন্তু যদি তারা তা করত, তবে তারা সাদা প্লাস্টারে একটি ম্লান লাল দাগ খুঁজে পেত। তুমি রক্তে ভেজা অবস্থায় ভুলবশত চাপ দিয়ে তোমার বুড়ো আঙুলের ছাপ দেওয়ালে ফেলে এসেছিলে। এখন, তুমি ভালো করেই জানো যে, বার্টিলন সিস্টেমের অধীনে, বুড়ো আঙুলের চিহ্ন হলো শনাক্তকরণের অন্যতম প্রধান উপায়।”

ভিক্টর ড্যানেগ্রেকে ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছে; ঘামের বড়ো ফোঁটা তার মুখ বেয়ে টেবিলের ওপর পড়ল। বন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই অদ্ভুত লোকটির দিকে; যে তার অপরাধের গল্পটি এমন বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণনা করছিল যেন সে এই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। পরাস্ত এবং শক্তিহীন ভিক্টর তার মাথা নত করল। সে অনুভব করেছিল যে এই বিস্ময়কর ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা অর্থহীন। তাই সে বলল:

“আমি আপনাকে মুক্তা দিলে আমাকে কত দেবেন?”

“কিছু-ই না।”

“উঁহুঁ! আপনি মজা করছেন! নাকি আপনি বলতে চাচ্ছেন যে আমি আপনাকে কয়েক হাজার মূল্যের একটি বস্তু দেবো অথচ বিনিময়ে কিছু-ই পাব না?”

“তুমি তোমার জীবন পাবে, এটা কি কিছুই না?”

হতভাগা লোকটা কেঁপে উঠল। তারপর গ্রিমাউদান মৃদু সুরে যোগ করল:

“দেখো, ড্যানেগ্রে, তোমার কাছে সেই মুক্তার কোনো মূল্য নেই। এটা বিক্রি করা তোমার পক্ষে বেশ অসম্ভব; তাহলে এটা রেখে লাভ কী?”

“এখানে দালাল আছে…. এবং, একদিন আমি এটা বিক্রি করতে সক্ষম হব।”

“কিন্তু সেদিন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

“কেন?”

“কারণ ততক্ষণে তুমি পুলিশের হাতে থাকতে পারো, এবং আমি যদি-ছুরি, চাবি, বুড়ো আঙুলের ছাপ-এর প্রমাণ দিতে পারি—তখন কী হবে তোমার?”

ভিক্টর বিভ্রান্ত হয়ে তার হাতের ওপর মাথা রাখল। সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল; এবং একই সময়ে, ক্লান্তি এবং হতাশার অনুভূতি তাকে কাবু করে ফেলছিল। সে বিড়বিড় করে বলল,

“আপনাকে কখন দিতে হবে?”

‘আজ রাতে—এক ঘণ্টার মধ্যে।”

“আমি যদি না দিই?”

“যদি তুমি না দাও, আমি এই চিঠিটি প্রসিকিউটর অভ রিপাবলিক-এর নিকট পাঠাব; যে চিঠিতে মাদামোয়াজেল ডি সিনক্লেভেস তোমাকে হত্যাকারী হিসেবে বর্ণিত করেছেন।”

ড্যানেগ্রে দুই গ্লাস ওয়াইন দ্রুত ঢেলে পরপর পান করে বলে উঠল:

“বিল পরিশোধ করুন, এবং আমাকে যেতে দিন। বিরক্তিকর ব্যাপার- স্যাপার যথেষ্ট হয়েছে আমার সাথে।”

রাত নেমেছে। দু’জন লোক রু লেপিক-এর নিচে নেমে এলো এবং প্লেস দ্য লে’টোইলের বাইওে থেকে বুলেভার্দের দিকে এগুতে লাগল। তারা নীরবে তাদের অনুসৃত পথে চলার সময় ভিক্টর একটি থেমে থাকা ঘোড়ার গাড়িতে নিজের বিমর্ষ হওয়া চেহেরা দেখল। যখন তারা পার্ক মনসেউতে পৌঁছাল, তখন সে বলল:

“আমরা বাড়ির কাছাকাছি।”

“পার্বলেউ! গ্রেপ্তারের আগে তুমি একবার-ই বাড়ি থেকে বের হয়ে তামাকের দোকানে গিয়েছিলে।”

“এই যে এখানে।” ড্যানেগ্রে নিস্তেজ কণ্ঠে বলল।

তারা কাউন্টেসের বাড়ির বাগানের প্রাচীর ধরে চলে গেল এবং একটি রাস্তা পার হলো যার এক কোণে তামাকের দোকান ছিল। আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে ড্যানেগ্রে থামল; তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠায়; নিজেকে সামলে নিতে একটি বেঞ্চে গিয়ে বসল।

“আচ্ছা! এখন কী?” তার সঙ্গী দাবি করল।

“এটা এখানে।”

“কোথায়? এদিকে এসো, বাজে বকার সময় এখন নেই!”

“এখানে আমাদের সামনে।”

“কোথায়?”

“দুটি শান বাঁধানো পাথরের মধ্যে।”

“কোন দুটো?”

“খুঁজে নিন।”

“কোন পাথর?”

ভিক্টর কোনো উত্তর দিলো না।

“আহ; আমি দেখছি!” গ্রিমাউদান বলে উঠল, “তুমি কি এখন তথ্যের জন্য অর্থ প্রদান করতে বলছো?”

“না… কিন্তু… আমি ভয় পাচ্ছি; হয়তো আমি না খেতে পেরে মারা যাব।”

“তাই! তাহলে এই কারণে তুমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছ। ঠিক আছে, আমি তোমার প্রতি কঠোর হব না। তুমি কত চাও?”

“আমেরিকাতে স্টিয়ারেজ পাস কেনার জন্য যত প্রয়োজন।”

“ঠিক আছে।”

“এবং সেখানে কাজ না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে একশ ফ্রাঁ সাথে রাখতে হবে।”

“দুইশ দেবো। এখন মুক্তা কোথায় বলো।”

“নর্দমা থেকে ডানদিকে শান বাঁধানো পাথরগুলো গণনা করুন। মুক্তাটি দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশের মধ্যে।”

“খাঁজের মধ্যে?”

“হ্যাঁ, সাইডওয়াকের কাছেই।

গ্রিমাউদন চারদিকে তাকাল কেউ দেখছে কিনা। কিছু ট্রাম-গাড়ি আর পথচারী যাচ্ছিল। কিন্তু, তারা কিছু সন্দেহ করবে না। সে তার পকেট ছুরি খুলে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ পাথরের মাঝে ছুঁড়ে দিলো।

“এবং যদি ওটা সেখানে না থাকে?” সে ভিক্টরকে বলল।

“ওটা অবশ্যই সেখানে থাকবে, যদি না কেউ আমাকে নিচে নামতে দেখে এবং লুকিয়ে ফেলে।”

“কতটা নিচে?” সে জিজ্ঞাসা করল।

“প্রায় দশ সেন্টিমিটার।”

সে ভেজা মাটি খুঁড়ছে। তার ছুরির মাথা কোনো কিছুতে আটকে যায়। আঙুল দিয়ে গর্তটা বড়ো করে সে। তারপর কালো মুক্তাটিকে এর নোংরা লুকানোর জায়গা থেকে বের করে আনে।

“বেশ! এখানে দুইশ ফ্রাঁ আছে, আর আমি তোমাকে আমেরিকার টিকিট পাঠিয়ে দেবো।”

পরেরদিন, এই নিবন্ধটি ‘একো দ্য ফ্রান্স’-এ প্রকাশিত হয়েছিল এবং সারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো দ্বারা অনুলিপি করা হয়েছিল:

‘গতকাল, বিখ্যাত কালো মুক্তাটি আর্সেন লুপাঁর দখলে এসেছিল। তিনি এটি কাউন্টেস ডি’অ্যান্ডিলোট-এর হত্যাকারীর কাছ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে, সেই মূল্যবান রত্নটি প্রদর্শন করা হবে লন্ডন, সেন্ট পিটার্সবার্গ, কলকাতা, বুয়েনস আয়ার্স এবং নিউইয়র্কে।

আর্সেন লুপাঁ তার অ্যাজেন্টদের মাধ্যমে তার কাছে সমস্ত প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন।’

***

“এবং এভাবেই সর্বদা অপরাধের শাস্তি হয় এবং ভালো কাজ পুরস্কৃত হয়,” আর্সেন লুপাঁ আমাকে কালো মুক্তার পূর্বোক্ত ইতিহাস বলার পরে বলেছিল।

“এবং এভাবেই আপনি, গোয়েন্দাদের প্রাক্তন পরিদর্শক গ্রিমাউদানের ছদ্মনামে, অপরাধীকে তার অপরাধের ফল ভোগ করা থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন।”

“ঠিক। এবং আমি স্বীকার করি যে ব্যাপারটি আমাকে অসীম তৃপ্তি দেয়। কাউন্টেস ডি’অ্যান্ডিলোট-এর কক্ষে আমি যে চল্লিশ মিনিট পার করেছিলাম, তার মৃত্যুর কথা জানার পরে, আমার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল। এই চল্লিশ মিনিটের মধ্যে, আমি সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে ছিলাম, আমি শান্তভাবে হত্যার দৃশ্যটি বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে-অপরাধটি অবশ্যই বাড়ির একজন চাকর দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। আমি আরও সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মুক্তা পেতে হলে সেই চাকরকে গ্রেপ্তার করতে হবে, এবং তাই আমি ওয়েস্টকোটের বোতামটি ছিঁড়ে দিয়েছিলাম; আমার কাছে তার অপরাধের কিছু বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রাখা দরকার ছিল, তাই আমি মেঝেতে যে ছুরিটি এবং তালার মধ্যে যে চাবিটি পেয়েছি তা নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি দরজা বন্ধ করে তালা দিয়েছি, এবং দেওয়াল থেকে তার আঙুলের চিহ্ন মুছে ফেলেছি। আমার মতে, এটি সেই চমকগুলোর মধ্যে একটি ছিল-”

“প্রতিভাধর,” আমি বাধা দিয়ে বললাম।

“প্রতিভাধর, যদি আপনি মনে করেন। কিন্তু, আমি নিজের প্রশংসা করি, যা সাধারণ কোনো মানুষ হলে পারত না। তাৎক্ষণিকভাবে, সমস্যার দুটি উপাদান ছিল—একটি গ্রেপ্তার এবং অন্যটি খালাস; শিকারকে পিষে ফেলে নত করার জন্য আইনের ভয়ঙ্কর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা অথবা তাকে এমন অবস্থায় নামিয়ে আনা যেখানে, সে নিশ্চিত হবে যে আমি তার জন্য ফাঁদ পেতেছিলাম!”

“বেচারা শয়তান—”

“বেচারা শয়তান, এটা বললে তুমি? ভিক্টর ড্যানেগ্রে, একজন গুপ্তঘাতক! কালো মুক্তা যদি তার কাছে থাকত; হয়তো সে অপরাধের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যেত। এমনকি, এখনও সে বেঁচে আছে! শুধু একবার চিন্তা করুন: ভিক্টর ড্যানেগ্রে বেঁচে আছে!”

“আর তোমার কাছে কালো মুক্তা আছে।”

সে তার মানিব্যাগের একটি গোপন পকেট থেকে মুক্তাটি বের করল, পরীক্ষা-নিরীক্ষার করে এটির দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকাল এবং ভালোবেসে আঙুল দিয়ে আদর করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল:

“হয়তো কোনো এক শীতল রাশিয়ান রাজপুত্র, কিংবা দাম্ভিক কোনো নির্বোধ রাজা একদিন এই অমূল্য রত্নের অধিকারী হবে! অথবা, হতে পারে কিছু আমেরিকান ধনকুবেরেরও এই অসাধারণ সৌন্দর্যের মালিক হওয়া ভাগ্য রয়েছে; যা একবার লিওনটাইন জাল্টির সুন্দর হৃদয় এবং কাউন্টেস ডি’অ্যান্ডিলোটকে শোভিত করেছিল।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *