দ্য কুইন’স নেকলেস

দ্য কুইন’স নেকলেস

অনুবাদ : লুৎফুল কায়সার

খুব বেশি না, বছরে মাত্র দু-তিন বার, বিশেষ কোনো উপলক্ষ্য যেমন-অস্ট্রিয় দূতাবাসের বল নাচের আসর কিংবা লেডি বিলিংটোনের পার্টিতে, ড্রেয়ুথের কাউন্টেসের ফর্সা গলায় শোভা পেত দ্য কুইন’স নেকলেস।

এই বিখ্যাত নেকলেসটি বোমার এন্ড বেসেঞ্জ কোর্ট জুয়েলার্স বানিয়েছিল মাদাম দ্যু বেরির জন্য। পরবর্তীতে হোয়াংয়ের জমিদার এটি উপহার দিয়েছিলেন ফ্রান্সের রানি মেরি অ্যান্তনিয়েত্তিকে। লা মঁতের কাউন্টেস ১৭৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যাবেলা টুকরো টুকরো করে ফেলেছিলেন এটাকে, সাথে ছিলেন ওনার স্বামী কাউন্ট লা মঁত আর রেটুথ দি ভিলেত্তি।

এরপরেও নেকলেসের কাঠামোটা অক্ষতই ছিল। তবে ওর ওপরে বসানো মূল্যবান চারটি রত্ন খুলে পড়ে গিয়েছিল। কাঠামোটা কী মনে যেন রেখে দিয়েছিলেন দি ভিলেত্তি। পরবর্তীতে উনি ওটা বিক্রি করে দেন গ্যাস্তন ড্রেয়ুথের কাছে। ভদ্রলোক ছিলেন ড্রেয়ুথের তৎকালীন কাউন্টের ভাইপো। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডের জেফরি জুয়েলার্স’র সাথে যোগাযোগ করে চারটি রত্ন আনিয়ে নেন, আগেরগুলোর মতো দামি না হলেও এগুলোও বেশ সুন্দর ছিল!

নতুন রত্নগুলো লাগানোর পরেও নেকলেসটা না-কি ঠিক তেমনই দেখাত যেমনটা ওটা আগে ছিল।

সেই থেকে একশ বছর ধরে নেকলেসটি ড্রেথের কাউন্ট পরিবারের কাছেই আছে। ভেতরে ভেতরে ব্যাপারটা নিয়ে বেশ গর্বিত তাঁরা। দিনকাল বদলেছে, আগের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই, জমিদারির আয়েও টান পড়েছে। কিন্তু সব পরিস্থিতিতেই নেকলেসটা আগলে রেখেছে তাঁরা। বর্তমান কাউন্ট এই ব্যাপারে আরও এককাঠি সরেস। ক্রেডিট লায়োনাইস ব্যাংকের একটা বিশেষ কুঠরিতে রাখেন তিনি নেকলেসটা। যেদিন ওনার স্ত্রীর নেকলেসটা পরতে ইচ্ছা হয়, তার আগের দিন বিকালে কাউন্ট নিজে গিয়ে নিয়ে আর্সেন, পরের দিন সকালে আবার নিজেই রেখে আর্সেন।

যা-ই হোক, ক্যাস্টিলের প্রাসাদের পার্টিটা বেশ ভালোই হলো। নেকলেসটার কারণে সবার চোখ কাউন্টেসের ওপর থেকে সরছিল-ই না। এমনকি পার্টিটা যার সম্মানে দেওয়া হয়েছিল, সেই ডেনমার্কের রাজা ক্রিশ্চিয়ানও বেশ কয়েকবার প্রশংসা করেছেন কাউন্টেসের সৌন্দর্যের। পার্টির আলোগুলোকে ছাপিয়ে যেন চমকাচ্ছিল সেই নেকলেসের রত্নগুলো। মহিলারাও ঈর্ষাভরা চোখে দেখছিলেন কাউন্টেসকে… এত ভারী একটা নেকলেস পরে এইভাবে পার্টি মাতিয়ে রাখা কেবল ওনার পক্ষেই সম্ভব।

মানুষের মুখে স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে? কাউন্টেরও বেশ খুশি লাগছিল। কিছুক্ষণ পর ফাউবুর্গ সেইন্ট জার্মেইনে নিজেদের পুরনো প্রাসাদে ফিরলেন তাঁরা। শয়ন কক্ষে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন কাউন্ট। আহা, কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে! মহিলা এমনিতেই অনেক সুন্দরী, সেখানে ওই নেকলেসটা যেন যোগ করেছে নতুন মাত্রা। গলা থেকে খুব সাবধানে নেকলেসটা খুললেন কাউন্টেস, যেমন করে ছোটো বাচ্চারা নিজেদের নতুন খেলনার বাক্স খোলে… তারপর ওটাকে দিলেন কাউন্টের হাতে।

“আহা, কী যে সুন্দর নেকলেস।,” আহ্লাদি কণ্ঠে বলে উঠলেন কাউন্ট, যেন এই প্রথম ওটাকে দেখছেন।

তারপর লাল চামড়ার একটা বাক্সে নেকলেসটা ঢুকিয়ে, ঘরের সাথে লাগোয়া সাজঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। বিছানার বরাবর সাজঘরের দরজা। ঘরের মধ্যে বেশ মজবুত একটা তাক। বাক্সটাকে তাকের একদম ওপরে দুটো হ্যাটের বাক্সের মাঝখানে লুকিয়ে রাখলেন তিনি। আশেপাশে লিনেন কাপড়ের স্তুপ, কেউ সহজে খুঁজে পাবে না নেকলেসের বাক্সটা।

ব্যাংকে জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই নেকলেসটা লুকিয়ে রাখেন তিনি।

পরেরদিন সকাল নটার আগেই উঠে পড়লেন কাউন্ট। নেকলেসটা ব্যাংকে জমা দিয়ে এসে তারপর সকালের নাস্তা করার ইচ্ছা তাঁর। তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে এক কাপ কফি খেয়ে নিলেন তিনি, তারপর কোচোয়ানকে বললেন গাড়ি বের করতে। কিন্তু একটা ঘোড়া যেন এগোতেই চাইছিল না।

ওনার সামনেই ঘোড়াটাকে বেশ ভালো করে দলাই-মলাই করলা সহিস। এবার সব ঠিকঠাক।

তারপর আবার শয়নকক্ষে ফিরলেন তিনি। কাউন্টেস কেবল ঘুম থেকে উঠেছেন, ওনার চুল ঠিক করে দিচ্ছে একজন পরিচারিকা। গত রাতে পার্টি থেকে ফেরার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আর ঘর থেকে বের হননি কাউন্টেস।

“কোথাও যাচ্ছ না কি?” কাউন্টকে দেখেই বলে উঠলেন তিনি।

“হ্যাঁ, ওই একটু ব্যাংকে।“

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আগে আগেই চলে যাওয়া ভালো।”

সাজঘরে ঢুকলেন কাউন্ট।

“এই, তুমি কি ওটা নিয়েছ না কি?” কিছুক্ষণের মধ্যে সাজঘর থেকে কাউন্টের গলা শোনা গেল।

“কোনটা,” খানিকটা চমকে উঠলেন কাউন্টেস, “ওহ… না তো, আমি তো ও ঘরে যাই-ই-নি আর।

“কী বলো, তুমি না নিলে কে নিল?”

তাড়াতাড়ি সাজঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন কাউন্ট, প্রচণ্ড উত্তেজনায় লাল হয়ে আছে ওনার মুখ,

“তুমি নাওনি… সত্যিই… তাহলে… কী?”

তাড়াতাড়ি উঠে কাউন্টের সাথে সাজঘরে ঢুকে পড়লেন কাউন্টেস। দুজনে মিলে তন্ন-তন্ন করে খুঁজলেন ঘরের প্রতিটি কোনা আর মেঝে। কিন্তু কোথাও বাক্সটা নেই!

“আর খুঁজে কাজ নেই,” হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন কাউন্ট, “আমি ওটা তাকের ওপরেই রেখেছিলাম।”

“ঠিক বলছো তো? হয়তো অন্য কোথাও রেখে ভুলে গেছ?”

“না, ওখানেই রেখেছি, স্পষ্ট মনে আছে আমার।”

একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আনলেন কাউন্ট। দিনের বেলাতেও সাজঘরটা বেশ অন্ধকার। দুজনে মিলে মেঝেতে জমে থাকা লিনেনের স্তুপ আর নানান জিনিসপত্র সরিয়ে ফেললেন। আবার সবকিছু ভালো করে দেখলেন।

কিন্তু না… কোথাও নেই বাক্সটা! নেকলেসটা এই ঘরে নেই।

দেরি না করে সাথে সাথে স্থানীয় পুলিশের প্রতিনিধি মঁসিয়ে ভালব্রেকে খবর পাঠালেন কাউন্টেস। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লেন তিনি।

সব শুনে তিনি কাউন্টকে বললেন, “আপনি নিশ্চিত, রাতের বেলা কেউ আপনাদের শয়নকক্ষে ঢোকেনি?”

“একদম, আমার ঘুম বেশ পাতলা। তেমন কিছু হলে সবার আগে আমি-ই জেগে উঠতাম। তাছাড়া ঘরে তো হুড়কো এঁটে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আমার স্ত্রী ঘণ্টা বাজিয়ে পরিচারিকাকে ডাকলো, আমিও হুড়কো খুলে বেরিয়ে গেলাম।”

“আচ্ছা এই একটা দরজা ছাড়া ওই সাজঘরে যাওয়ার আর কোনো উপায় আছে?”

“না।”

“কোনো জানালা?”

“আছে, তবে ওটা বন্ধ।’

“চলুন তো দেখি।”

আবার মোমবাতি নিয়ে সাজঘরে ঢুকলেন তাঁরা। ভালো করে জানালাটা খেয়াল করলেন অফিসার, নিচের দিকটা একটা ছোট্ট তাকের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে, তবে তাকটা বেশ সরু, জানালার ওপর বা নিচ, কোনো পাল্লাই স্পর্শ করে নেই ওটা।

“এই জানালার ওপাশে কী?”

“ভেতরের একটা ছোট্ট উঠান।”

“এই তলার ওপর আর কটা তলা রয়েছে আপনাদের প্রাসাদে?”

“আরও দুটো তবে, তার মধ্যে একটাতে প্রাসাদের চাকর-বাকররা থাকে, ওই তলা বরাবর এই উঠানের ওপর ঝাঁঝরি দেওয়া রয়েছে, সে কারণে উঠানে ঠিকমতো সূর্যের আলো পৌঁছে না। এজন্য জানালা খুললেও এই ঘরটা অন্ধকার-ই থাকে।“

তিন জন মিলে জানালার সাথে লেগে থাকা তাকটা সরালেন। বেশ শক্ত করে আঁটা রয়েছে জানালার হুড়কো। কেউ যদি এদিক দিয়ে পালিয়ে থাকে তবে এমনটা হওয়ার কথা না।

“হুম,” মাথা নাড়লেন কাউন্ট, “সম্ভবত চোর বা চোরেরা আমাদের ঘরের দরজা দিয়েই পালিয়েছে।”

“কিন্তু তেমনটা হলে তো সাজঘরের দরজা বাহির থেকে লাগানো থাকত না,” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন অফিসার।

চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি, তারপর কাউন্টেসকে বললেন, “আপনাদের কোনো চাকর বা পরিচারিকা কি জানে যে নেকলেসটা আপনি গতরাতে পরেছিলেন?”

“তা তো জানবেই, ওদের সামনে দিয়েই তো পার্টিতে গেলাম। কিন্তু কেউ এটা জানে না যে নেকলেস এই ঘরে লুকানো ছিল।”

“সত্যি-ই? কেউ জানে না?”

“হ্যাঁ জানে না… কিন্তু… “

“একটু ভেবে বলুন মাদাম, ব্যাপারটা খুবই স্পর্শকাতর।”

“হেনরিয়েটার কথা ভাবছিলাম,” কাউন্টের দিকে ঘুরে বললেন কাউন্টেস। “হেনরিয়েটা! ও কী করে জানবে আমরা ওটা ওই ঘরে রেখেছিলাম?”

“এত নিশ্চিত কী করে হচ্ছো?”

“এই হেনরিয়েটা কে?” বলে উঠলেন অফিসার।

“মেয়েটা আমার সাথে স্কুলে পড়ত,” বললেন কাউন্টেস, “গরীব একটা লোককে বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল ওকে, স্বামীর মৃত্যুর পর একদম অসহায় হয়ে পড়েছিল ও, শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রাসাদেই ওকে আশ্রয় দিলাম। ছেলেকে নিয়ে এখানেই থাকে ও, সুচ-সুতার কাজ খুব ভালো পারে। আমাদের অনেক কাজই করে দেয়।”

“উনি কোন তলায় থাকেন?”

“এই তলাতেই… বারান্দার একদম শেষপ্রান্তে… আর আমার মনে হয়… ওর রান্নাঘরের জানালাটা…”

“ওই উঠানের দিকেই, তাই না?”

“হ্যাঁ, আমাদের এই সাজঘরের জানালার বিপরীতেই ওই জানালা।”

“চলুন, দেখা করা যাক ওনার সাথে।”

সবাই মিলে এগিয়ে গেলেন হেনরিয়েটার ঘরের দিকে। বিছানায় বসে চুপচাপ সেলাই করছিলেন হেনরিয়েটা, পাশে বসে কী যেন পড়ছিল তাঁর ছ- বছরের ছেলে রাউল। ভালো করে ঘরটা দেখলেন অফিসার। পুরনো-মলিন একটা ঘর… কোনো ফায়ারপ্লেস নেই, লাগোয়া একটা ছোট্ট সাজঘর। ওটাকেই রান্নাঘর হিসাবে ব্যবহার করেন হেনরিয়েটা। জাঁকজমকে ভরা প্রাসাদটাকে যেন ব্যঙ্গ করে চলেছে ঘরটার হতদরিদ্র পরিবেশ

নেকলেস চুরি যাওয়ার খবর শুনে বেশ অবাক-ই হলেন হেনরিয়েটা, গতরাতে তিনি না-কি নিজ হাতেই কাউন্টেসকে সাজিয়ে ওই নেকলেস পরিয়ে দিয়েছিলেন।

“হে ঈশ্বর,” চমকে উঠলেন তিনি, “কী করে চুরি হলো ওটা!”

“আপনি কি রাতে কিছু বুঝেছিলেন? বা কাউকে সন্দেহ করেন?” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন অফিসার, “এমনও তো হতে পারে যে চোর আপনার রান্নাঘরের জানালা দিয়েই ঢুকেছে?”

“আরে না না,” হেসে ফেললেন হেনরিয়েটা, যেন বুঝতেই পারছেন না যে অফিসার তাঁকেও সন্দেহ করছেন, “আমি তো কাল থেকে ঘরেই আছি, আরেকটা ব্যাপার কি খেয়াল করেননি?”

রান্নাঘরে গিয়ে জানালাটা খুলে দিলেন তিনি।

“দেখুন, এই জানালা থেকে ওই জানালার কার্নিশ অন্তত তিন মিটার দূরে, এখান থেকে ওখানে যাওয়া সম্ভব না। “

“আমি তো বলেছি যে চোর আপনার জানালা দিয়ে ঢুকেছে, এটা তো বলিনি যে আপনার জানালা দিয়ে ওই জানালাতে গেছে, তাই না?”

“কিন্তু নেকলেসটা তো ওই সাজঘরেই থাকে, তাই না?”

“আপনি কী করে জানলেন?”

“কী যে বলেন না, ওটা বাড়িতে আনলে ওখানেই রাখা হয়। এটা অনেক আগে থেকেই আমার জানা, আমার সামনেই ওনারা এই ব্যাপারে আলোচনা করেছেন…”

মুখটা লাল হয়ে উঠল হেনরিয়েটার, সম্ভবত এই প্রথম তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। আশপাশ দিয়ে-ই ঘুরছিল ওনার ছেলে, তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে কাছে টেনে নিলেন তিনি। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো রাউল।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কাউন্ট আর অফিসার।

“আপনি কি হেনরিয়েটাকে সন্দেহ করছেন? আমার মনে হয় না ও এমনটা করেছে। ও অনেক ভালো একটা মেয়ে… এমন কাজ করতে-ই পারে না!”

“হুম, আমারও তাই মনে হয়। মহিলাকে দেখে মনে হলো না উনি এত নিখুঁতভাবে একটা জিনিস চুরি করতে পারেন। ভেবেছিলাম হয়তো নেকলেসটা দেখে উনি লোভ সামলাতে পারেননি… কিন্তু না…আমারও মনে হচ্ছে না উনি ওটা নিয়েছেন।”

অফিসার আর এগোলেন না ব্যাপারটা নিয়ে। তাই ব্যাপারটা চলে গেল অঞ্চলের মুখ্য হাকিমের কাছে। তিনি প্রাসাদে এসে সব চাকর-বাকরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, সাজঘরের দরজা আর সেই জানালাটা বেশ ভালোভাবে পরীক্ষা করা হলো, নিচের সেই উঠানের প্রতিটি কোনা তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো।

কিন্তু লাভের খাতায় শূন্য, কোনো সূত্রই পাওয়া গেল না। সাজঘরের হুড়কোটা বেশ ভালো করেই লাগানো ছিল আর জানালা বাইরে থেকে খোলা অসম্ভব।

সন্দেহের তীর আবার গিয়ে পড়ল হেনরিয়েটার ওপর।

ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা শুরু হলো। তাঁর অতীত জীবন নিয়েও বেশ ভালোই খোঁজ নিলেন হাকিম। দেখা গেল, গত তিন বছরে মাত্র চারবার প্রাসাদের বাইরে গেছেন তিনি, তাও যথাযথ কারণেই। দেখা গেল যে কাউন্টের প্রাক্তন সহপাঠী হলেও এই প্রাসাদে তাঁর তেমন কোনো বিশেষ জায়গা নেই। বরং কাউন্টেসের একজন বিশেষ পরিচারিকা হিসেবে-ই আছেন তিনি, দামি কাপড়গুলো সেলাই করেন।

কাউন্টেসকে প্রশ্ন করে হাকিম বুঝলেন যে হেনরিয়েটাকে একজন গৃহকর্মী ছাড়া আর বিশেষ কিছুই মনে করেন না তিনি। এক সপ্তাহ চলল তদন্ত, কিন্তু হাকিম তেমন বিশেষ কোনো সূত্র-ই পেলেন না।

অবশেষে তিনি কাউন্টকে বললেন, “কে বা কারা জিনিসটা নিয়েছে সেটা বোঝা তো দূরের কথা, কী করে নেকলেসটা চুরি হলো সেটাই বুঝতে পারছি না আমরা। দুটো জায়গায় এসে আটকে গেছি আমরা; একটা দরজা আর জানালা। দুটোই ছিল বন্ধ। এই হলো রহস্য, নেকলেসটা হাওয়া… কিন্তু দরজা আর জানালা তো বন্ধ! তাহলে চোর ঢুকলো কী করে? আর বের হলোই বা কী করে?”

.

চারমাস পেরিয়ে গেল।

কাউন্টের জমিদারির অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। তাই হাকিম ভেবে নিলেন যে কাউন্ট আর কাউন্টেস কাউকে না জানিয়ে-ই নেকলেসটা বিক্রি করে দিয়েছেন। বংশের মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য পরে চুরির নাটক সাজানো হয়েছে, অভিজাতদের মধ্যে এমন ঘটনা অহরহ-ই দেখা যায়।

অবশেষে এভাবেই বন্ধ হয়ে গেল কাউন্টেসের নেকলেস হারানোর কেস। ওদিকে নেকলেসটা হারানোর পর যেন ভয়ংকর এক অভিশাপে নিমজ্জিত হলো ড্রেয়ুথের কাউন্ট পরিবার। আর্থিক টানা-পোড়েন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করল। পাওনাদারেরা মাঝে মাঝেই হানা দিতে লাগল তাদের প্রাসাদে, প্রায় সব স্থাবব-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে তাদের ঋণ শোধ করতে লাগলেন কাউন্ট। কিন্তু তাতেও সব হলো না। জমিদারিই নিলামে উঠে যাওয়ার উপক্রম হলো… ঠিক এই সময়েই উত্তরাধিকার সূত্রে দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের দুটো বড়ো জমিদারি পেয়ে গেলেন কাউন্ট।

সে যাত্রায় বেঁচে গেল সবকিছু।

কিন্তু তাঁদের সেই ঠাটবাট আর রইল না, সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ ঋণ শোধ করতেই চলে গিয়েছিল। কাউন্টেসের সব রাগ গিয়ে পড়ল তাঁর প্রাক্তন সহপাঠী হেনরিয়েটার ওপর। একদম সরাসরি তিনি নেকলেস চুরির দায়ে অভিযুক্ত করলেন মহিলাকে, তাকে ওই ঘর থেকে বের করে চাকর-বাকরদের সাথে থাকতে দেওয়া হলো।

পরের দিন প্রধান খানসামা এসে হেনরিয়েটাকে জানালো যে তাকে চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।

প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন হেনরিয়েটা।

এরপর দীর্ঘকাল আর তেমন কিছু-ই হয়নি। এলাকায় আর ভালো লাগত না, তাই নানান দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন কাউন্ট আর কাউন্টেস। কিন্তু কয়েক মাস পর ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। কাউন্টেসের নামে একটা চিঠি এলো, তাতে হেনরিয়েটার সই রয়েছে। ওতে লেখা রয়েছে-

‘মাদাম,

আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। যে উপকার আপনি করলেন, তা বলে বোঝাতে পারব না। ওটা আপনি-ই তো আমাকে পাঠিয়েছেন, তাই না? আমি জানি আপনি-ই পাঠিয়েছেন, আপনি ছাড়া তো কেউ আমার বর্তমান ঠিকানা জানে না। আর যদি আপনি না পাঠিয়ে থাকেন তবে অহেতুক বিরক্ত করার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। অতীতে আপনারা আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’

এই চিঠির অর্থ কী? প্রাসাদে থাকার সময়ে হেনরিয়েটা অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পায়নি কাউন্টেসের কাছ থেকে। কে কী পাঠিয়েছে? কীসের জন্য ধন্যবাদ দিলেন তিনি?

হেনরিয়েটা কী পেয়েছে সেটা জানতে চেয়ে পালটা চিঠি পাঠালেন কাউন্টেস। জবাবে হেনরিয়েটা জানালেন যে কয়েকদিন আগে ডাকে একটা খাম পেয়েছেন, খামের মধ্যে এক হাজার ফ্রাঁ সমমূল্যের দুটো ব্যাংক নোট। উত্তরের সাথে খামটাও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, ওতে প্যারিসের পোস্টমার্ক অদ্ভুত একটা ঠিকানা দেওয়া, খোঁজ নিয়ে জানা গেল প্যারিসে অমন কোনো জায়গা নেই। তাহলে এই দু’হাজার ফ্রাঁ এলো কোথা থেকে? কে দিলো ওনাকে এত টাকা? কেন দিলো?

পরের বছর অমন আরেকটা খাম পেলেন হেনরিয়েটা, তারপরের বছর আরেকটা… এভাবেই টানা ছয় বছর অচেনা কেউ একজন টাকা পাঠিয়ে চলল তাঁকে। এর মধ্যে পঞ্চম আর ষষ্ঠ বছরে দু’হাজারের জায়গাতে চার হাজার ফ্রাঁ এসেছিল। ছয় বছরে আসা এই খামগুলোর মধ্যে একটা খামকে বায়েজাপ্ত করেছিল ডাকবিভাগ, ওতে না-কি প্রয়োজনীয় সিল-স্বাক্ষর ছিল না। শেষ দুটো খাম বেশ ভালোভাবে-ই পৌঁছেছিল। প্রথমটার গায়ে সেইন্ট জার্মেইনের একটা ঠিকানা পরেরটার গায়ে সুহেনের। বলা বাহুল্য দুটো ঠিকানাই ভুয়া।

একটার গায়ে প্রেরকের নাম লেখা- অ্যানেত, আরেকটার গায়ে লেখা–পেকার্ড।

তো, এই ষষ্ঠ বছরেই হেনরিয়েটার মৃত্যু হলো। কে উনাকে টাকা পাঠাত সেই রহস্য অজানাই রয়ে গেল।

***

নেকলেসটা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ফ্রান্সের জনমনে বেশ ভালোই ছড়িয়ে পড়েছিল। সমাজের মধ্যবিত্ত লোকেরা আবার উচ্চবিত্তদের এসব ব্যাপারে আলোচনা করে বেশ মজা পায়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো যে নেকলেসের কারণে অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে মহা হট্টগোল হয়েছিল, ঠিক তার পরের শতকেও ওই নেকলেসের কারণে-ই একটা পরিবারের সম্মান ডুবতে বসেছে। যা-ই হোক, আমি এখন এমন কিছু রহস্যের ব্যাপারে বলবো যা কাউন্টের খুব কাছের কিছু মানুষ-ই জানে, ওদের কাছ থেকে ব্যাপারটা প্রকাশ না করার শপথ নিয়েছিলেন তিনি। দিনের শেষে সব শপথই একটা সময়ে ভাঙতে হয়। এই শপথ ভাঙা থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তবে শপথ ভাঙাই ভালো। দুদিন আগে সকালবেলার সংবাদপত্রে একটা অদ্ভুত চিঠি ছাপা হয়েছে, যা ওই নেকলেসটার অন্তর্ধান রহস্যতে হুট করেই নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে।

তাই বাধ্য হয়েই সব রহস্যের জট খুলতে এগিয়ে আসতে হচ্ছে আমায়। পাঁচ দিন আগে কাউন্টের প্রাসাদে বিরাট এক ভোজসভার আয়োজন হয়েছিল। বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত লোক এসেছিল দাওয়াতে। আত্মীয়দের মধ্যে ছিলেন কাউন্টের দুই ভাতিঝি। এছাড়া ছিলেন—এজেভিলের শহর কাউন্সিলের সভাপতি, বশর নির্বাহী কর্মকর্তা, স্যার ফ্লোরিয়ানি; যার সাথে কাউন্টের সিসিলিতে পরিচয় হয়েছিল, রোজিয়ার্সের মারকুইস এবং কাউন্টের ক্লাবের কিছু বন্ধু।

রাতের খাবারের পর সবাইকে কফি দেওয়া হলো। এক কোণায় দাঁড়িয়ে পুরুষেরা চুরুট ফুঁকতে লাগলো। নানান বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল, হুট করেই একজন গত কয়েক বছরের বিখ্যাত অপরাধগুলো নিয়ে কথা তুলল। এই সুযোগে রেজিয়ার্সের মারকুইস কাউন্টকে সেই নেকলেসটা নিয়ে খোঁচা মারলেন।

ধীরে ধীরে প্রায় সবাই যোগ দিলো আলোচনায়। এক এক জনের এক এক কথা। যেন এক একটা অপরাধ বিশেষজ্ঞ এসে হাজির হয়েছে। যদিও বেশিরভাগের ধারণা-ই পুরো ভিত্তিহীন।

ফ্লোরিয়ানি চুপচাপ ছিলেন।

“তো মঁসিয়ে,” বলে উঠলেন কাউন্টেস, “আপনি চুপ কেন? সবাই এত কিছু বলছে, আপনিও কিছু একটা বলুন।”

“ওহ, এই নিয়ে আমার কোনো মতামত নেই মাদাম।”

কিন্তু অতিথিরা মানবে না! ফ্লোরিয়ানির বাবা ছিলেন পার্লেমোর একজন প্রশাসক, তার সাথে নানান অপরাধের তদন্ত করেছেন তিনি। এসব ব্যাপারে তাঁর মতামত শুনতে মোটামুটি সবাই আগ্রহী।

“দেখুন,” হেসে ফেললেন তিনি, “জানি অনেক কঠিন কেস সমাধানেই আমি সহযোগীতা করেছি। কিন্তু তাই বলে তো আমি আর শার্লক হোমস নই! আর তাছাড়া ওই নেকলেস চুরির ব্যাপারে আমি খুবই কম জানি।”

সবাই কাউন্টের দিকে ঘুরল। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি ফ্লোরিয়ানিকে ধীরে ধীরে সবকিছু খুলে বললেন। মন দিয়ে চুপচাপ শুনে গেলেন ফ্লোরিয়ানি।

“ব্যাপারটা অদ্ভুত… তবে আপাতদৃষ্টিতে অত জটিল মনে হয় না,” অবশেষে বললেন তিনি।

ধীরে ধীরে পার্টিতে উপস্থিত লোকেরা ফ্লোরিয়ানির আরও কাছাকাছি ঘেঁষে এলো।

বলে চললেন তিনি, “কোনো অপরাধীকে ধরার আগে বুঝতে হয় যে অপরাধটা কী করে সংঘটিত হয়েছে… এই কেসটাতে চোরের ঢোকার মাত্র দুটোই রাস্তা রয়েছে, ঘরের দরজা কিংবা সাজঘরের জানালা। এখন কথা হলো কাউন্টকে না জাগিয়ে চোরের পক্ষে সাজঘরের হুড়কো খোলা সম্ভব না, তাই ধরেই নেওয়া যায় সে জানালা দিয়ে ঢুকেছিল…”

“জানালা ভালো করে লাগানো ছিল,” বলে উঠলেন কাউন্ট, “পরে গিয়েও দেখেছি, ওটা লাগানোই ছিল। “

“হয়তো সে একটা সেতুর মতো বানিয়েছিল,” কাউন্টের কথাতে কান না দিয়েই বলে যেতে লাগলেন ফ্লোরিয়ানি, “হেনরিয়েটার রান্নাঘর থেকে ওই সাজঘরের জানালা বরাবর একটা মই ফেলে দিলেই কিন্তু সহজেই যাওয়া যাবে…”

“আবারও বলছি, জানালা লাগানো ছিল… ভেতর থেকে!”

চুপচাপ কিছুক্ষণ কাউন্টের দিকে চেয়ে রইলেন ফ্লোরিয়ানি, তারপর বললেন, “জানালা তো লাগানো, কিন্তু জানালার ওপরের দিকে ছোট্ট ঘুলঘুলির মতো নেই? ওটাতে তো আর তালা লাগানো যায় না!”

“আপনি কী করে জানলেন?”

“দুটো কারণে… ওই সময়ে বানানো প্রায় সব প্রাসাদের জানালার উপরিভাগেই এটা থাকত আর এটা না থাকলে কোনোভাবেই চুরি করা সম্ভব না!”

“হুমম, ছিল, তবে ওটাও তো লাগানো ছিল।”

“ভালো করে খেয়াল করেছেন?”

“উমম… না, এই চিন্তা আসলে তখন মাথায় আসেনি!”

“ভুল করেছেন, ভালো করে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারতেন যে ওটা খোলা হয়েছিল।”

“কিন্তু কী করে?”

“কোনোভাবে একটা ছোটো লাঠির মতো জিনিস ভেতরে ঢুকিয়ে ঘুলঘুলিটার আংটা সরিয়েই ওটা খুলে ফেলা যায়।”

“কিন্তু, লাঠি ঢুকবে কী করে?”

“ছোট্ট একটা ফুটোই যথেষ্ট, আগুন খোচানোর চিকন লাঠি খুব সহজেই ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।”

হেসে ফেললেন কাউন্ট, “বাহ বাহ! আপনি তো বেশ ভালো ধারণা করতে পারেন। কিন্তু ওখানে কোনো ফুটো নেই…”

“আছে।”

“না, ফুটো থাকলে আমার দেখতে পেতাম।”

“ভালো করে খুঁজলে না পাবেন? খোঁজেন-ই তো নি। একটা ফুটো অবশ্যই আছে, তবে সেটা ওপরের দিকে।”

গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন কাউন্ট, তারপর সোজা এগিয়ে গেলেন সামনে, তারপর আবার ফিরে এলেন ফ্লোরিয়ানির কাছে।

“বুঝলেন, ওই ঘটনার পর ওই সাজঘরে আর কেউ যায়নি, সবকিছু আগের মতোই আছে।”

“বাহ, তাহলে তো ভালোই। আপনি নিজেই গিয়ে দেখুন।”

“আজব লাগছে, এত বড়ো বড়ো কর্মকর্তারা এলেন, দেখলেন কেউ ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না, আপনি শুধু কাহিনি শুনেই বুঝে ফেললেন?”

“মাফ করবেন কাউন্ট, আমার যা মনে হয়েছে তাই বলেছি।”

“এখনই দেখতে যাচ্ছি…”

তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে ওপরের তলায় উঠে গেলেন কাউন্ট। পুরো হলঘর চুপচাপ, একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শুনতে পাচ্ছিল সবাই। সবাই অপেক্ষা করছে কাউন্টের ফিরে আসার।

অবশেষে ফিরলেন তিনি, মুখটা ফ্যাকাশে।

“আমি দুঃখিত,” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন তিনি, “স্যার ফ্লোরিয়ানি ঠিকই বলেছেন।”

“তাই না কি?” চমকে উঠলেন কাউন্টেস।

“হ্যাঁ! কাচে একটা ছোট্ট ফুটা আছে ওখানে… ওপরের দিকে!”

এগিয়ে এসে ফ্লোরিয়ানির কাঁধে হাত রাখলেন তিনি, “মঁসিয়ে আপনার অনুমান শক্তি অসাধারণ! আরেকটু খুলে বলুন দেখি… ব্যাপারটা…”

মৃদু হেসে কাউন্টের হাতটা সরিয়ে দিলেন ফ্লোরিয়ানি।

তারপর আবার বলতে লাগলেন, “হুম তো আমার মতে, চোর জানত যে কাউন্টেস ওই রাতে নেকলেসটা পরে বের হবেন, তাই সে আগে থেকেই তৈরি ছিল। সন্ধ্যাবেলাতেই সে এই জানালা থেকে ওই জানালাতে যাওয়ার রাস্তা বানিয়ে নেয়। তারপর ঘাপটি মেরে বসেছিল, আপনারা ঘুমাতে যেতে-ই জানালার কাচে ফুটো করে ঘুলঘুলির আংটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।”

“চোর অন্য দিকের জানালা দিয়ে এই জানালায় এসেছিল, তাই না? তা এলো কী করে? অনেকটা দূরে তো এই জানালা, আর তাছাড়া ও ঘুলঘুলি খোলার প্রমাণ আছে, কিন্তু জানালা তো খোলেনি… চোর ঢুকলো কী করে?”

“জানালা খোলেনি চোর, সে ঘুলঘুলি দিয়েই ঢুকেছিল।”

“অসম্ভব! ওইটুকু জায়গা দিয়ে কোনো মানুষ ঢুকতেই পারে না!”

“যদি চোর কোনো ছোটো বাচ্চা হয়ে থাকে?”

“মানে কী?”

“ওই ঘুলঘুলি দিয়ে বড়ো কেউ ঢুকতে পারবে না, কিন্তু ছোটো বাচ্চা তো পারবে, তাই না?”

“বাচ্চা!”

“হ্যাঁ, হেনরিয়েটার একটা ছেলে ছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ, ওর নাম রাউল।”

“সম্ভাবনা আছে যে সেই চুরিটা করেছে।”

“কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

“প্রমাণ? বেশ ভালোই প্রমাণ আছে…”

একটু থামলেন ফ্লোরিয়ানি, তারপর আবার বলতে লাগলেন, “ওই জানালা থেকে এই জানালার আসার সেতুটা কী করে বানালো চোর? বাইরে থেকে তো কিছু আনেনি, আনলে আপনারা দেখতেন।

হেনরিয়েটার রান্নাঘরে তাক ছিল না? বাসন-কোসন রাখার জন্য?”

“দুটো তাক ছিল, মানে আমার যতটা মনে পড়ে।”

“তাক দুটো দেওয়ালের সাথে লাগানো তাই না? দুটো তাকেরই ওপরের কাঠ পরীক্ষা করেছেন? ওগুলো কি লেগে আছে? না কোনোভাবে খসানো হয়েছে? যদি খসানো হয়ে থাকে তবে এটা নিশ্চিত যে বাচ্চাটা ওই দুটো কাঠকে প্রথমে খসিয়েছে, তারপর জোড়া লাগিয়ে ওই জানালা থেকে এই জানালার কার্নিশে রেখেছে। এরপর সে ওই সেতু বেয়ে এসে পড়েছে। ওদের স্টোভও ছিল… সেটার আগুনকে খোঁচানোর লাঠিটাও সাথে এনেছিল। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে জানালার কাছে একটা ছোট্ট ফুটো করে সেটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঘুলঘুলির আংটা সরিয়ে দেয় সে। তারপর ঢুকে যায়…”

কোনো কথা না বলে আবার ওপরে দৌড় দিলেন কাউন্ট। এবার আর তেমন চিন্তিত মনে হলো না কাউকে। সবাই ধরেই নিয়েছিল যে ফ্লোরিয়ানির কথাই সঠিক।

তাই যখন কাউন্ট এসে ঘোষণা করলেন, “ওনার কথাই ঠিক, বাচ্চাটাই চোর… দেখে এলাম! সবকিছু ফ্লোরিয়ানির যেমন বলেছেন তেমনই পেলাম।, তখন কেউ-ই আর তেমন অবাক হলো না।

“তাক আর স্টোভ দেখে এসেছেন তো না কি?” হাসলেন ফ্লোরিয়ানি।

 “হ্যাঁ, তাকের কাঠ দুটো খোলা… স্টোভের লাঠিটাও একপাশে পড়ে আছে।”

“এর পেছনে নিশ্চয় ওর মায়ের শয়তানি বুদ্ধি ছিল,” রেগে উঠলেন কাউন্টেস, “ওই বুদ্ধি দিয়ে বেচারা ছেলেটাকে এসব কাজ করিয়েছে…”

“না,” মাথা নাড়লেন ফ্লোরিয়ানি, “ওর মা এই ব্যাপারে কিছু জানেন না।

“ফালতু কথা, অত ছোটো ছেলের মাথায় এসব কী করে আসবে? সারাদিন মা কানপড়া দিত হয়তো….”

“না না, ছেলেটা যখন চুরি করে তখন ওর মা ঘুমাচ্ছিল।”

“আচ্ছা, ওই ঘরটা তো আমরা ভালো করে দেখেছিলাম,” বলে উঠলেন কাউন্ট, “নেকলেসটা কেন পাইনি? কোথায় রেখেছিল ও?”

“আসলে আপনি যখন অফিসারকে নিয়ে ওদের ঘরে যান, তখন কেবলই স্কুল থেকে এসেছিল ছেলেটা। আপনাদের কথা শুনেই নেকলেসটা সরিয়ে ফেলে ও। তখন ওর মায়ের পিছে সময় নষ্ট না করে ওর পড়ার টেবিলটা ভালো করে দেখলেই পেয়ে যেতেন!”

“হুম, হেনরিয়েটার কাছে বছরে যে টাকাগুলো আসত, ওগুলো কীসের টাকা? আপনার কী মনে হয়? এটাই কি ওর চুরিতে জড়িত থাকার প্রমাণ নয়?”

“জড়িত থাকলে উনি আবার টাকা পাওয়ার কথা আপনাদের চিঠি লিখে কেন জানাবেন? আসলে নেকলেসটা হারানোর পর আপনারা ওনার ওপর কড়া নজর রেখেছিলেন। কিন্তু বাচ্চাটার ওপর? এমন যদি হয়ে থাকে যে বাচ্চাটা সাহস করে পাশের শহরে গিয়ে নেকলেসটার কয়েকটা রত্ন বিক্রি করে ফেলল? তারপর বলে দিলো যেন টাকাগুলো ওর মাকে বিভিন্ন ঠিকানার কথা লিখে বছর বছর পাঠানো হয়? ব্যাপারটা ওইটুকু বাচ্চার পক্ষে একটু জটিল-ই… তবে ছেলেটা অনেক চালাক ছিল।”

ফ্লোরিয়ানির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কাউন্ট। কেন যেন মনে হচ্ছে চোর ছেলেটা আর ওর মায়ের প্রতি লোকটার বেজায় সহানুভূতি! অন্যরাও ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল।

“বাহ শুনে বেশ ভালো লাগল, আপনার কল্পনাশক্তি বেশ ভালো,” হেসে উঠলেন তিনি।

“না, আমি যা যা বললাম সব-ই বাস্তব… এমনটাই ঘটেছিল।”

“এত নিশ্চিত কী করে হচ্ছেন? ওদের চেনেন না কি?”

“আসলে আপনার কাহিনি শুনতে শুনতে ওই মা আর ছেলের জীবনের সাথে নিজেও খানিকটা জড়িয়ে গেছিলাম বুঝলেন। হতভাগ্য মা… বেচারি ছিল অসুস্থ। মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্যই চুরিটা করেছিল ছেলেটা। চিকিৎসা হলোও খানিকটা… কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাঁচলেন না মহিলা। তারপর বহু বছর কেটে গেল… ছেলেটা এখন বড়ো হয়েছে। কল্পনা, তাই না? এমনটা-ই তো বললেন? আরেকটু কল্পনা করি? ধরে নিন, ছেলেটা সেই প্রাসাদে এলো যেখানে ও বড়ো হয়েছে… সেই মানুষগুলোর মুখোমুখি হলো যারা ওর মাকে চোর অপবাদ দিয়েছিল! আহা, কী যে কষ্ট ছেলেটার, ভাবতে কেমন লাগে কাউন্ট?”

পুরো হলঘর স্তব্ধ। কাউন্ট আর কাউন্টের মুখ থমথমে, ফ্লোরিয়ানির কথাগুলো যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রাসাদের প্রতিটি দেওয়ালে। এ এক অপার্থিব সংকেত!

“আপনি আসলে কে মঁসিয়ে?” থমথমে গলায় বললেন কাউন্ট

“আমি? স্যার ফ্লোরিয়ানি… যার সাথে আপনার পার্লেমোতে দেখা হয়েছিল, যাকে আপনি নিজের প্রাসাদে দাওয়াত দেওয়ার যোগ্য মনে করেছেন!”

“তাহলে এত কিছু জানলেন কী করে?”

“আন্দাজ, এই কিছুটা সময় কাটালাম আরকি। আজ হেনরিয়েটার ছেলে যদি এখানে থাকত তবে সে হয়তো আপনাদের এভাবেই সব খুলে বলত, ওর মায়ের অসুখের কথা… আশ্রয় হারানোর কথা… এই বাড়ির পরিচারিকার চাকরি হারানোর কথা… ছেলেটাকেও অনেক ভুগতে হয়েছে আসলে।”

কেমন যেন কেঁপে উঠলো ফ্লোরিয়ানির গলাটা, কাউন্টেসের দিকে ঘোলাটে দৃষ্টিতে চেয়ে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। উপস্থিত অনেকেরই আর সন্দেহ রইল না যে এই ভদ্রলোকই আসলে হেনরিয়েটার ছেলে। নইলে এত নিখুঁতভাবে সে কী করে বলল?

চিন্তায় পড়ে গেলেন কাউন্ট। কী করবেন এখন তিনি? পুলিশে খবর দেবেন? সংবাদপত্রের লোকেদের জানাবেন? কিন্তু কী করে প্রমাণ হবে যে এই লোকই ওই ছেলেটা? সে তো অনেককাল আগের কথা। না, এর চাইতে ব্যাপারটাকে গুরত্ব না দেওয়া-ই মনে হয় ভালো হবে।

“হুম, আপনার ব্যাখ্যা ভালোই লাগল,” হাসলেন তিনি, “ওই ছেলেটার খবর-টবর আন্দাজ করতে পারেন? এখনও কি অমন নিখুঁতভাবে চুরি করে? না কি বাদ দিয়েছে?”

“না না, বাদ কেন দেবে।”

“ব্যাপারটা আসলেই অদ্ভুত! ছয় বছর বয়সে সেই বিখ্যাত নেকলেস চুরি করা! বড়ো বড়ো চোরেরাও ওর কাছে শিশু!”

“ছেলেটা আসলেই বুদ্ধিমান। আসলেই ওর কাজে কোনো খুঁত ছিল না। জানালার কাচে ওর হাতের ছাপ পড়ে গেছিল, তাই কাচের ওপর জমে থাকা ধুলো পুরোটাই মুছে দিয়েছিল সে। আপনারা কেউ সেটা খেয়াল করেননি! খুব সহজেই বেঁচে গেছে ছেলেটা। ও ভাবল নেকলেসটা চুরি করবে… তারপর করেও ফেলল!”

“যেন ভাগ্য-ই ওটা তুলে দিয়েছে ওর হাতে।

“ওর দুই হাতে আরকি, ছোটো বাচ্চা, অত ভারি নেকলেস এক হাতে ধরবে কী করে?” হেসে উঠলেন ফ্লোরিয়ানি।

সবাই অবাক হয়ে খেয়াল করছে ফ্লোরিয়ানিকে। উনি-ই যে সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি তা বুঝতে আর কারোই বাকি নেই। কিন্তু চুরি করার পর কী হয়েছিল? কী করে সে এত সম্ভ্রান্ত একজন লোকে পরিণত হলো?

এগিয়ে গিয়ে মাথার হ্যাটটা খুলে কাউন্টেসকে বিদায়ী সম্ভাষণ জানালেন ফ্লোরিয়ানি, নিজের অজান্তেই যেন কেঁপে উঠলেন কাউন্টেস।

“মাদাম, আপনি কি আমাকে ভয় পান?” হেসে ফেললেন ফ্লোরিয়ানি।

“ন…না,” কোনোমতে নিজেকে সামলালেন কাউন্টেস, “এমন দায়িত্ববান ছেলের কাহিনি শুনে বেশ ভালোই লাগছে। আমার নেকলেসটা হয়তো যোগ্য লোকের কাছেই গেছে। তা আপনার কী মনে হয়? ছেলেটা কি বংশগতভাবে চুরিবিদ্যার দীক্ষা লাভ করেছিল? নইলে এত দক্ষভাবে…”

কেমন যেন কেঁপে উঠলেন ফ্লোরিয়ানি, তারপর বললেন, “তা জানি না, তবে চুরি করার ব্যাপারটা ওর কাছে অনেকটা নেশার মতোই। নইলে ওই নেকলেসের জন্য এতটা ঝুঁকি সে নিত না…”

“কেন?”

“ওতে লাগানো বেশিরভাগ হীরা-ই ছিল নকল। শুধুমাত্র ইংল্যান্ড থেকে কেনাগুলো বাদ দিয়ে। ওগুলোই একটার পর একটা বিক্রি করেছে সে… টাকার প্রয়োজনে আরকি।“

“তারপরেও… এটা রানির নেকলেস। আর ওই ছোড়াটা এটার যোগ্য নয়।”

“দিনের শেষে ওটা শুধুই একটা গর্বের চিহ্ন ম্যাডাম… অর্থহীন গর্ব!”

খানিকটা খেপে উঠেছিলেন যেন কাউন্ট, ওনার হাতটা ধরলেন কাউন্টেস।

“শুনুন মঁসিয়ে, ওই ছেলেটার যদি বিন্দুমাত্র মান-সম্মান থেকে থাকে…”

মৃদু হাসি ফুটে উঠল ফ্লোরিয়ানি মুখে। চমকে গেলেন কাউন্টেস।

“হ্যাঁ, ওর তো মান-সম্মানের বড়ো-ই অভাব,” হেসে ফেললেন ফ্লোরিয়ানি।

কাউন্টেস বুঝতে পারলেন যে তার গর্ব আর অহংকারকে রীতিমতো ব্যঙ্গ করছেন ফ্লোরিয়ানি। আসলে তো এই নেকলেসের হকদার তারাও নন! এটি ছিল ফরাসি রাজপরিবারের সম্পদ।

“আচ্ছা শুনুন,” আস্তে করে বললেন তিনি, “কিংবদন্তি বলে যে রেটুথ দ্য ভিলেত্তি এটার কাঠামোকে রক্ষা করেছিলেন শুধুই সৌন্দর্য দেখে। উনি বুঝতে পেরেছিলেন এটার গুরত্ব… ওই ছেলেটা কি এসব বুঝবে?”

“নেকলেসের কাঠামোটা এখনও ঠিক আছে,” হাসলেন ফ্লোরিয়ানি, “আমি নিশ্চিত, ছেলেটা এর মর্ম বোঝে।”

“ওর সাথে দেখা হলে দয়া করে বলবেন, যে কাঠামোটা ড্রেয়ুথের কাউন্ট পরিবারের মর্যাদার চিহ্ন! হ্যাঁ, রত্নগুলো হয়তো আর নেই, কিন্তু কাঠামোটা তো আছে তাই না? ওটাও কিন্তু আমাদের মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ।”

“বলে দেবো মাদাম,” হ্যাট খুলে অভিবাদন জানালেন ফ্লোরিয়ানি।

তারপর কাউন্ট আর বাকি সব অতিথির কাজ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি।

***

চার দিন পর, নিজের শয়নকক্ষে লাল রঙের একটা বাক্স পেলেন কাউন্টেস। অবাক হয়ে বাক্সটা খুললেন তিনি, ভেতরে সেই নেকলেসটা!

নানান মানুষের জীবনে নানান উদ্দেশ্য থাকে, কিছু মানুষের কাজ করার পদ্ধতিটা হয়তো একটু দৃষ্টিকটু, হয়তো আইনের চোখে ব্যাপারটা অপরাধ। কিন্তু দিনের শেষে একটু-আধটু প্রচারণাতে তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না!

কাউন্টেস যেদিন নেকলেসটা পেলেন তার ঠিক পরের দিনই ‘একো দ্য ফ্রান্স’ পত্রিকাতে নিচের লাইনগুলো ছাপা হলো-

‘বিখ্যাত কুইন’স নেকলেস ড্রেয়ুথ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন আর্সেন লুপাঁ। ভদ্রলোক কাউকে কখনোই তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন না। অসাধারণ এই ভদ্রতা দেখানোর জন্য ওনার প্রশংসা না করে আমরা পারছি না!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *