আর্সেন লুপাঁ ইন প্রিজন
অনুবাদ : নিঝুম
সিন নদীর তীর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে অথচ নদীর ঠিক মাঝ বরাবর পাহাড়ের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মালাকুইস পরিবারের ছোট্ট সামন্ত দুর্গটি দেখেনি-এমন পর্যটক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ধনুকের মত বাঁকানো খিলান যুক্ত সেতু দ্বারা দুর্গটি তীরের সাথে যুক্ত। দুর্গটির চারপাশে নলখাগড়া বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে প্রশান্ত নদীর স্রোত। আর দোয়েল পাখির দল স্যাঁতস্যাঁতে পাথরের টুকরোগুলোর ওপর বসে ডানা ঝাপটিয়ে বেড়াচ্ছে।
মালাকুইস দুর্গটির নামটা যেমন দাঁতভাঙা, তেমনই দুর্গটির ইতিহাসও এর নামের মতোই ঝঞ্ঝাট পূর্ণ, আর সেই ইতিহাস দুর্গের জটিল ডিজাইনের মতোই জটিল। অগণিত যুদ্ধ, অবরোধ, হামলা, লুটপাট আর গণহত্যার মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে সেই ইতিহাস। এখানে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা শুনে যে-কোনো নির্দয়ের কঠোর হৃদয়টাও কেঁপে উঠবে। দুর্গটির সাথে কত যে রহস্যময় লোককথা আর কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে তারও ইয়ত্তা নেই! কথিত আছে যে, একটি বিখ্যাত ভূ-সুড়ঙ্গ এই দুর্গ থেকে শুরু হয়ে জুমিজেস মঠ হয়ে রাজা সপ্তম চার্লসের জমিদার বাড়িতে গিয়ে ঠেকেছে। সপ্তম চার্লসের সেই জমিদার বাড়িটি রাজার প্রিয় উপপত্নী অ্যাগনেস সোরেলের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
মহাবীর এবং বিখ্যাত দস্যুদের স্মৃতিবিজরিত প্রাচীন সেই দুর্গটিতে এখন যিনি বাস করেন তার নাম ব্যারন নাথান কাহর্ন। শেয়ার বাজারে তিনি শয়তান ব্যারন’ নামেই বেশি পরিচিত। শেয়ার মার্কেটে নেমে রাতারাতি বদলে যায় তার ভাগ্য। অর্জন করেছে অঢেল সম্পত্তি। মালাকুইস পরিবারের সর্বস্বান্ত এবং সর্বশেষ মালিকরা এই প্রাচীন দুর্গটি একদম পানির দামে ব্যারনের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। পানির দরে কিনে নিয়ে এই দুর্গে-ই কাহর্ন তৈরি করেছে আসবাবপত্র, চিত্রকর্ম, খোদাইকৃত মূর্তি আর চিনামাটির পাত্রের এক অভূতপূর্ব সংগ্রহশালা। তিন জন বৃদ্ধ চাকরের সাথে সে একাই বাস করে এখানে। বাইরের কেউ কখনও এ জায়গা মাড়ায় না বললেই চলে। শুধুমাত্র টাকার জোরে নিলাম-ঘর থেকে তিনটি রুবেনের চিত্রকর্ম, দুটি ওয়াত্তোর চিত্রকর্ম, অশ্বচালনার জিন-সহ যেসব দুর্লভ ও অমূল্য প্রত্ন বস্তু কিনে সে এই দুর্গটি সাজিয়েছে, তা অনেকে চোখেও দেখেনি।
শয়তান ব্যারন সবসময় ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়। ভয়টা অবশ্য নিজের জন্য নয়। তার ভয় সেসব সম্পদের জন্য, যেসব সম্পদ সে চরম ভক্তি ও ধৈর্যের সাথে পরম যত্নে বছরের পর বছর আগলে রেখেছে যক্ষের মতো। কোনো চতুর বণিকও কখনও বলতে পারবে না যে, ব্যারন কখনও তার পছন্দে বা সিদ্ধান্তে ভুল করেছে। ব্যারন তার সম্পদগুলো ভালোবাসে কৃপণের মতো তীব্রভাবে, প্রেমিকের মতো চিরন্তন ঈর্ষায়। প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় সেতুর দুই প্রান্তের লোহার গেট এবং প্রবেশদ্বার বন্ধ করে তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। গেটগুলোতে কেউ স্পর্শ করা মাত্রই দুর্গের ভেতরের বৈদ্যুতিক ঘণ্টাগুলো তীব্রভাবে বেজে ওঠে।
সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক বৃহস্পতিবারে এক ডাকপিয়ন সেতুর মাথায় গেটের সামনে এসে হাজির হলো এবং যথারীতি ব্যারন নিজে এসে ভারী প্রবেশদ্বার খুলে দিলো। ব্যারন মিনিটখানেকের জন্য পিয়নকে এমন ভাবে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল যেন লোকটি একেবারে অপরিচিত কেউ। যদিও লোকটির সদানন্দ মুখ আর সরল চোখ বহু বছর ধরেই ব্যারনের পরিচিত লোকটি হেসে বলল,
“আমি-ই এসেছি মঁসিয়ে ব্যারন। আমার টুপি আর পোশাক পরে অন্য কেউ আসেনি।”
“কখন কে কী ঘটিয়ে ফেলে কে বলতে পারে!” বিড়বিড় করে বলল ব্যারন।
লোকটি ব্যারনের হাতে একগাদা পত্রিকা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই দেখুন মঁসিয়ে ব্যারন, আপনার জন্য নতুন কিছু এনেছি।”
“নতুন কিছু?”
“হ্যাঁ, একটা চিঠি। তাও রেজিস্টার করে পাঠানো চিঠি।”
ব্যারন নিঃসঙ্গতা প্রিয় মানুষ। বন্ধুবান্ধব ও ব্যাবসায়িক কাজ ব্যতীত অপরিচিত কারও কাছ থেকে কখনোই সে চিঠি পায়নি। তাই হুট করে এখন চিঠি পাওয়ার ব্যাপারটা তার কাছে কিছুটা অবিশ্বাস্য আর অনেকটা সন্দেহজনক ঠেকল। তার কাছে এটা অশুভ লক্ষণ বলে মনে হলো। কে এই রহস্যময় চিঠিদাতা যে তার নিস্তরঙ্গ জীবনের নিঃসঙ্গতার প্রশান্তি বিনষ্ট করতে সাহস করেছে?
“আপনাকে একটা সই করতে হবে মঁসিয়ে ব্যারন। “
ব্যারন স্বাক্ষর করে চিঠিটা নিল। ডাকপিয়ন রাস্তার মোড়ে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কয়েক মিনিট ইতস্তত পায়চারি করে সেতুর খিলানে হেলান দিলো সে। তারপর খামটা খুলল। ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ, তার হেডিংয়ে লেখা:
সাঁৎ কারাগার, প্যারিস।
সে স্বাক্ষরটার দিকে তাকাল:
আর্সেন লুপাঁ।
চিঠিটা পড়তে শুরু করল ব্যারন:
‘মঁসিয়ে ব্যারন,
আপনার দূর্গের গ্যালারিতে ফিলিপ দ্য শ্যাম্পেন-এর নিপুণ হাতে আঁকা যে ছবিটা রয়েছে, সেটি আমারও খুবই পছন্দের। আপনার রুবেনের চিত্রকর্ম আর ওয়াত্তোর ছোটো চিত্রকর্মটির ও ভীষণ ভক্ত আমি। বৈঠকখানার ডান দিকে রাজা ত্রয়োদশ লুই-এর সুরম্য টেবিল, বেউভাই-এর পর্দা, গেরিডন সাম্রাজ্যের রাজা জ্যাকবের নামলিপি আর রেনেসাঁ সিন্দুকও আমার চোখে পড়েছে। বৈঠকখানার বাঁ দিকে রয়েছে বাক্স ভর্তি অলংকার আর ছোটো ছোটো ছবি।
আপাতত আমি এগুলো পেলেই সন্তুষ্ট; আমি জানি এগুলো পাঠাতে আপনাকে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। তাই আমি চাই, আপনি খুব যত্নের সাথে জিনিসগুলো প্যাক করে ডাকমাশুল দিয়ে আট দিনের মাঝেই বাতিগনোল স্টেশনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন। অন্যথায় ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে আমি নিজেই জিনিসগুলো সরানোর ব্যবস্থা করব। কিন্তু তা যদি করতেই হয়, তবে আমি কিন্তু ওপরে উল্লেখিত জিনিসগুলো নিয়েই সন্তুষ্ট হব না।
আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। আশা করছি আপনার একান্ত অনুগত এই অধমের ওপর বিশ্বাস রাখবেন আপনি।
-আর্সেন লুপাঁ
পুনশ্চঃ অনুগ্রহ করে ওয়াত্তোর বড় চিত্রকর্মটি পাঠাবেন না। যদিও আপনি জিনিসটার জন্য ৩০ হাজার ফ্রাঁ ব্যয় করেছেন, কিন্তু এটি নকল। আসল চিত্রকর্মটি বারাসের পরিচালনা পর্ষদ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে লাগা অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গিয়েছিল। গারাত-এর স্মৃতি মনে করুন। পঞ্চদশ লুই-এর চাবির গোছাটার ব্যাপারেও আমার কোনো আগ্রহ নেই, ওটা আসল কিনা, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।’
চিঠিটা ব্যারনকে খুবই বিচলিত করে তুলল। চিঠিতে যদি অন্য কারও স্বাক্ষর থাকত, তবে সে এতটা ভয় পেত না- কিন্তু এখানে যে স্বয়ং আর্সেন লুপাঁর স্বাক্ষর।
নিয়মিত সংবাদ পাঠক হিসেবে ব্যারন এই শহরের সব অপরাধ সম্পর্কে-ই জানে। আর্সেন লুপাঁ নামধারী এই রহস্যময় চোরের কীর্তিকলাপও তাই তার অজানা নয়। ব্যারন অবশ্য জানে যে, লুপাঁকে তার শত্রু গাঁইমার্দ আমেরিকায় গ্রেপ্তার করে সাঁৎ-এর কারাগারে বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু সে এটাও জানে যে, আর্সেন লুপাঁ চাইলেই যে-কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। আর তাছাড়া দুর্গের সঠিক বিবরণ, চিত্রকর্ম ও আসবাবপত্রগুলোর অবস্থানের বর্ণনাই ব্যারনকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। যেসব জিনিস তার চেনাশোনা মানুষজনও কোনোদিন চোখেও দেখেনি, সেসব জিনিসের ব্যাপারে সে জানল কী করে!
ব্যারন চিন্তিত মনে চোখ তুলে দূর্গটির সীমারেখার দিকে তাকাল। এর খাড়া পাথুরে পাদদেশ আর চারিদিকের সুগভীর জলরাশির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সে তার ঘাড় নাড়ল। নাহ, সহসা কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। দুনিয়ার কোনো মানুষেরই তার অমূল্য সংগ্রহশালা আগলে রাখা এই দুর্ভেদ্য দুর্গে প্রবেশ করার ক্ষমতা নেই।
দুনিয়ার কেউ হয়তো পারবে না, কিন্তু আর্সেন লুপাঁ? দরজা, দেওয়াল, টানা-সেতু কি তাকে আটকাতে পারবে? আর্সেন লুপাঁ যেখানে একবার প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে কি ভীষণ বাঁধা আর সুপরিকল্পিত সতর্কতা কোনো কাজে এসেছে?
সেই সন্ধ্যায়-ই সে রুয়েনের সরকারি উকিলের ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠিয়ে দিলো। চিঠির সাথে ভয় দেখানো আর্সেন লুপাঁর চিঠিটা জুড়ে দিয়ে সহায়তা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করল।
উত্তর আসতে সময় লাগল না:
‘আর্সেন লুপাঁ সাঁৎ-এর কারাগারে কঠোর পাহারায় মধ্যে বন্দি অবস্থায় আছে। সেখান থেকে এ-রকম চিঠি লেখার মতো কোনো সুযোগ তার নেই। তাই অনায়াসে বলা যায় যে, চিঠিটা নিতান্তই একটা ফাঁপর বাজি। যা-ই হোক, আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিঠিটি একজন হস্তলিপি-বিশেষজ্ঞের নিকট পাঠানো হয়েছিল। তিনি জানালেন, সামান্য সাদৃশ্য থাকলেও, চিঠিটি বন্দির লেখা নয়।’
‘সামান্য সাদৃশ্য’ এ শব্দটা-ই ব্যারনের চোখে পড়ল, আর সেটাই তার মনের সন্দেহকে আরও উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার কাছে মনে হলো এ দুটো শব্দই যথেষ্ট। তার ভয় ক্রমেই বাড়তে লাগল। লুপাঁর চিঠিটা সে বারবার পড়ল। ‘আমি নিজেই জিনিসগুলো সরানোর ব্যবস্থা করব।’ আর সেই নির্দিষ্ট তারিখটি হলো: ২৭ সেপ্টেম্বর রাত।
সন্দেহ প্রবণ স্বভাবের কারণে ব্যারন তার চাকরদেরকেও এ ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারছিল না। জীবদ্দশায় এই প্রথমবারের মতো সে কারও সাথে কথা বলে পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। নিজ জেলার পুলিশের কাছে পরিত্যক্ত হওয়ায় নিজের অর্থ-সম্পদের জোরে আত্মরক্ষার আশাও সে করল না। তাই সে প্যারিসে গিয়ে কোনো গোয়েন্দা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিল।
দু’দিন পেরিয়ে গেল। তৃতীয় দিনে ‘রেভিল দ্য কদেবেক’ নামক সংবাদপত্রটি হাতে নিয়েই সে খুশিতে লাফিয়ে উঠল বললেও বেশি বলা হয় না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটা সংবাদ তাকে যে স্বস্তি দিল সেই স্বস্তি চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে কোনোদিন পায়নি সে:
‘আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে অভিজ্ঞ গোয়েন্দা গাঁইমার্দ এখন আমাদের শহরে। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি কুখ্যাত আর্সেন লুপাঁকে গ্রেপ্তার করে বিশ্বজোড়া নন্দিত হয়েছেন। তিনি এখানে বিশ্রাম ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে এসেছেন। বর্তমানে তিনি সিন নদীতে মাছ ধরে সময় কাটাচ্ছেন।’
গাঁইমার্দ! আহা, এই মানুষটির সাহায্যই তো ব্যারন কাহর্ন চাইছিল। গাঁইমার্দের মতো ধৈর্যশীল আর চতুর গোয়েন্দা ছাড়া আর কে পারবে আর্সেন লুপাঁর পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে? সে-ই তো উপযুক্ত ব্যক্তি।
ব্যারন আর সময়ক্ষেপণ করল না। কদবেক শহরটি তার প্রাসাদ থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে। নিরাপত্তাহীনতার ঘুম ছুটে যাওয়া একটা লোকের জন্য এ দূরত্ব অতি সামান্য-ই।
অনেক চেষ্টার পরও গোয়েন্দাপ্রবরের ঠিকানা জোগাড়ে ব্যর্থ হওয়ার পর, ব্যারন সরাসরি চলে গেল জাহাজ ঘাটের পাশে; ‘রেভিল’ পত্রিকার অফিসে। সে প্রতিবেদনটির লেখককে খুঁজে বের করল।
প্রতিবেদক তাকে ব্যাখা করল:
“গাঁইমার্দকে খুঁজছেন? নিশ্চিত কোথাও বসে চুপচাপ মাছ ধরছেন গোয়েন্দা মহাশয়। তার সাথে দেখাটা তো হয়েছিল ওই মাছ ধরতে গিয়েই। সৌভাগ্যবশত, ছিপের ওপর লেখা তার নামটা চোখে পড়ে গিয়েছিল। নইলে কি আর চিনতে পারতাম? ওই তো, ওই যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।”
“খড়ের টুপি পরা ছোটোখাটো ওই লোকটার কথা বলছেন? উনিই গাঁইমার্স?”
“হ্যাঁ। লোকটা খুব স্বল্পভাষী, আর ভীষণ অমিশুক প্রকৃতির।“
.
পাঁচ মিনিট পর ব্যারন বিখ্যাত গোয়েন্দা গাঁইমার্চের সামনে হাজির হলো। সে নিজের পরিচয় দিয়ে আলাপ জমাবার চেষ্টা করল, কিন্তু আলাপ তেমন জমল না। তারপর ভনিতা ছেড়ে সে সরাসরি নিজের কেস সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল। অপর জন ধীর-স্থির আর মনযোগী হয়ে শুনল, কিন্তু ছিপ থেকে দৃষ্টি ফেরাল না। ব্যারনের গল্প বলা শেষ হলে ঘুরল গাঁইমার্দ। ব্যারনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে সে বলল,
“মঁসিয়ে, যাকে লুট করবে, তাকেই সাবধান করা তো চোরদের রীতি নয়। বিশেষ করে আর্সেন লুপাঁ তো কখনোই এ ধরনের বোকামি করবে না।
“কিন্তু….”
“মঁসিয়ে, বিশ্বাস করুন, আমার যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহও থাকত, পুনরায় আর্সেন লুপাঁকে গ্রেপ্তার করার আনন্দটা আমি কখনোই মিস করতাম না। দুর্ভাগ্যবশত সেটা পারছি না কারণ লোকটা ইতোমধ্যেই কারাগারে বন্দি। কারাগারে বন্দি কাউকে গ্রেফতার করা যায় না, আবার সেখান থেকে চুরি- ডাকাতির হুমকি দিয়ে চিঠিও লেখা যায় না।”
“যদি পালিয়ে যায়?”
“সাঁৎ থেকে কেউ পালাতে পারে না।”
“কিন্তু সে…”
“সে তো আর বাকিদের থেকে আলাদা নয়।“
“তবুও…”
“বেশ, সে যদি পালিয়েই যায়, তবে ভালোই হয়; ব্যাটাকে আবার পাকড়াও করার আনন্দ পাব আমি। আপনি এখন বাড়ি গিয়ে নিশ্চিতে ঘুমান। মাছগুলোকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন অযথাই।”
কথাবার্তা সেখানেই শেষ হলো। ব্যারন প্রাসাদে ফিরে এলো। গাঁইমার্দের উদাসীনতা দেখে সে বুঝে গেল, এর কাছে সাহায্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। নিজেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। সে হুড়কো পরীক্ষা করল, চাকরদের ওপর নজর রাখল। পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টা স্বাভাবিকভাবে কেটে গেলে সে নিজেকে প্রায় মানিয়ে-ই ফেলেছিল যে, তার ভয় নিছকই অমূলক। আর বিখ্যাত গোয়েন্দা গাঁইমার্দ তো বলেই দিয়েছে, চোরেরা যাকে লুট করে, তাকে কখনও সতর্ক করে না।
নির্দিষ্ট দিন এগিয়ে এলো। সেপ্টেম্বরের ছাব্বিশ তারিখ চলে আসলো, কিন্তু কিছুই ঘটল না। কিন্তু তিনটের দিকে হঠাৎ ঘণ্টা বেজে উঠল। একজন বালক টেলিগ্রাম নিয়ে এসেছে:
‘বাতিগনোল স্টেশনে কোনো মাল পৌঁছেনি। আগামীকাল রাতে প্রস্তুত থাকবেন। – আর্সেন।’
টেলিগ্রামটি ব্যারনকে নিস্তেজ হয়ে আসা উত্তেজনাটা এমন অবস্থায় নিয়ে গেল যে, সে ভাবতে লাগল লুপাঁর উদ্ভট চাহিদাটা মেনে নেওয়াই তার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা।
যা-ই হোক, সে দ্রুত কদবেকে ছুটে গেল। গাঁইমার্দ ঠিক আগের জায়গাতেই একটি টুলের ওপর বসে মাছ ধরছিল। কোনো কথা না বলে ব্যারন টেলিগ্রামটি তার হাতে তুলে দিলো।
“বেশ, কাহিনি কী?” গোয়েন্দা জিজ্ঞেস করল।
“কাহিনি কী মানে? সেটা তো আগামীকাল ঘটবে।”
“আগামীকাল কী ঘটবে?”
“চুরি। আমার সংগ্রহগুলো লুট হবে।”
গাঁইমার্দ তার ছিপ রেখে ব্যারনের দিকে ঘুরে বসল। তারপর অধৈর্যের সাথে বলল,”আহা। আপনি কি মনে করেন এমন সামান্য ঘটনার জন্য আমি নিজের মাথা ঘামাব?”
“আগামীকাল রাতটা দুর্গে কাটানোর জন্য আপনি কত টাকা চান?”
“একটা পয়সাও না। আমাকে একা থাকতে দিন।”
“আপনার মূল্যটা বলুন। আমি একজন ধনী ব্যক্তি এবং আমি সেটা পরিশোধ করতে পারব।”
প্রস্তাবটা গাঁইমার্দকে কিছুটা বিভ্রান্ত করল যেন। সে শান্তস্বরে বলল, ”আমি এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি। আপনার কেসটা নিতে পারব না।”
“কেউ জানবে না এ ব্যাপারে। আমি কথা দিচ্ছি আমি ব্যাপারটা গোপন রাখব।”
“ওহ, আসলে কিছুই ঘটবে না।”
“আচ্ছা, তিন হাজার ফ্রাঁ। চলবে তো?”
এক মুহূর্ত ভেবে গোয়েন্দাপ্রবর বলল,
“আচ্ছা বেশ। তিন হাজার ফ্রাঁ’র বিনিময়ে থাকলাম না হয় আপনার দুর্গে। তবে আমি আপনাকে আবার বলে দিচ্ছি যে, আপনি আসলে টাকাটা পানিতে ফেলছেন।”
“আমি পরোয়া করি না।”
“সেক্ষেত্রে… কিন্তু দিনশেষে লুপাঁর মতো শয়তানের ব্যাপারে কিছু বলা যায় না। হয়তো তার আদেশের অপেক্ষায় পুরো একটা চোরের দল আছে। আপনি আপনার চাকরগুলোর ব্যাপারে নিশ্চিত তো?”
“আমার বিশ্বাস….”
“তাহলে তাদের ওপর নির্ভর না করাই ভালো। আমি আমার সাহায্যের জন্য দু’জন লোকের কাছে টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি। এখন আপনি চলে যান। অন্যদের সামনে আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখা না যাওয়াই মঙ্গলজনক। কাল রাত নটায় দেখা হবে।”
***
আর্সেন লুপাঁর বলা নির্দিষ্ট দিনে ব্যারন কাহন তার যুদ্ধের বর্মগুলো সজ্জিত করল, অস্ত্রগুলো পলিশ করল, এবং একজন প্রহরীর ন্যায় পুরো দুর্গ তন্নতন্ন করে খুঁজল। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু দেখতে তো পেল-ই না বা শুনতেও পেল না।
রাত সাড়ে আটটার দিকে সে তার চাকরদের ছুটি দিয়ে দিলো। চাকরার মূল দুর্গ থেকে আলাদা একটা দালানে ঘুমায়। একটু পরেই ব্যারন পায়ের শব্দ শুনতে পেল। শক্তসমর্থ, পেশিবহুল, ষাঁড়ের মতো দেখতে দুইজন সহকারী নিয়ে হাজির হয়েছে গাঁইমার্দ। প্রবেশদ্বার এবং কক্ষগুলোর অবস্থান-সহ কেসের সাথে সম্পর্কিত আরও কিছু তথ্য জেনে নিয়ে গাঁইমার্দ সব দরজা ও জানালা বন্ধ করে দিল যাতে বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। সে দেয়ালগুলো পর্যবেক্ষণ করল, পর্দাগুলো তুলে দেখল। অবশেষে দুই বৈঠকখানার মাঝে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে সে তার সহকারীদের মোতায়েন করে একটু স্থির হয়ে বসল।
“কোনো আজেবাজে কাজ করবে না। এখানে ঘুমোতে আসিনি আমরা। সামান্য শব্দ হলেই বড়ো ঘরের জানালা খুলে আমাকে ডাকবে। পানির দিকেও নজর রেখো। দশ মিটার খাঁড়া পাহাড় ওই শয়তানদের জন্য কোনো বাধা-ই নয়।”
গাঁইমার্দ তার সহকারীদের ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে চাবিটা নিজের কাছে রেখে দিলো। তারপর ব্যারনকে বলল,
“এখন আমাদের জায়গায় যাই, চলুন।”
নিজের জন্য পুরু দেওয়ালের ছোটো একটা কক্ষ বেছে নিয়েছিল গাঁইমার্দ। ঘরটিতে দুটো বড়ো দরজা রয়েছে। এক সময় এটা প্রহরীদের ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একটা পিপহোল সেতুর দিকে, আরেকটা বড়ো ঘরের দিকে। আরেক কোনায় একটা সুড়ঙ্গ মুখ দেখা যাচ্ছে।
“আমার বিশ্বাস মঁসিয়ে ব্যারন, আপনি আমাকে বলেছিলেন যে, এই সুড়ঙ্গটাই দুর্গে প্রবেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ পথ। আর এটা কতকাল ধরে বন্ধ তা কেউ জানে না।”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আর্সেন লুপাঁর কাছেও দুর্গে প্রবেশের আর কোনো ভূগর্ভস্থ পথ রইল না। আমরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারি এখন।”
তিনটি চেয়ার একসাথে বসিয়ে আরাম করে বসল গাঁইমার্দ। তারপর পাইপটা ধরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল,
“সত্যিই মঁসিয়ে ব্যারন, এরকম সাধারণ একটা কাজের জন্য আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে আমার লজ্জা লাগছে। আমি আমার বন্ধু লুপাঁকে এই গল্পটা শোনাব। সে এটা দারুণভাবে উপভোগ করবে।”
ব্যারন হাসল না। সে উদ্বিগ্ন হয়ে কান খাড়া করে ছিল, কিন্তু ক্রমাগত হৃৎস্পন্দনের শব্দ ছাড়া তার কানে কিছুই প্রবেশ করেনি। মাঝে মাঝে-ই সে সুড়ঙ্গ মুখে ঝুঁকে তার ভীত চোখ দিয়ে এর গভীরতা পর্যবেক্ষণ করছিল। ঘড়ির সময় এগিয়ে চলল; এগারোটা, বারোটা, একটা
হঠাৎ গাঁইমার্দের হাত চেপে ধরল ব্যারন। কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে উঠল গাঁইমার্দ।
ব্যারন ফিসফিস করে বলল, “শুনতে পেলেন?”
“হ্যাঁ।”
“ওটা কী?”
“সম্ভবত আমার নাক ডাকার শব্দ শুনেছেন।”
“না, না। ভালো করে কান পেতে শুনুন। “
“ওহ, হ্যাঁ। একটা মোটর গাড়ির হর্নের শব্দ।”
“তো?”
“তো, লুপাঁ একটা মোটর গাড়ি করে এখানে আসবে, এটা অকল্পনীয়। তারচেয়ে একটা কামান নিয়ে এসে আপনার দুর্গ ধ্বংস করে দিলেই তো পারে। মঁসিয়ে ব্যারন, জায়গায় ফিরে আসুন। আমি ঘুমোতে গেলাম, শুভরাত্রি।”
এটাই ছিল একমাত্র সতর্কবার্তা। গাঁইমার্দ পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ল, এরপর থেকে ব্যারন তার নাক ডাকার শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেল না।
সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো দু’জন। নদীর বুক চিরে বয়ে আসা এক স্নিগ্ধ ভোরের কোমলতা দুর্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কাহন উচ্ছ্বসিত হয়ে আর গাঁইমার্দ সবসময়ের মতো শান্তভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। তারা কোনো শব্দ শুনল না, সন্দেহজনক কিছু দেখলও না।
“আমি আপনাকে কী বলেছিলাম মঁসিয়ে ব্যারন? সত্যিই, আপনার প্রস্তাবটা গ্রহণ করা উচিত হয়নি আমার। আমার লজ্জা লাগছে।”
সে তালা খুলে গ্যালারিতে প্রবেশ করল। দুই চেয়ারের ওপর শরীর ঝুঁকিয়ে, হাত ঝুলিয়ে ঘুমিয়ে আছে গোয়েন্দার দুই সহকারী।
“তোমরা ঘুমাচ্ছ কেন?” সে উচ্চস্বরে বলল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই ব্যারন আর্তনাদ করে উঠল,”চিত্রকর্মগুলো কোথায়! মূর্তিগুলো?”
শূন্য দেওয়ালে গাঁথা পেরেক আর ঝুলন্ত সুতার দিকে তাকিয়ে ব্যারন স্তব্ধ হয়ে গেল। ওয়াত্তোর চিত্রকর্ম উধাও হয়ে গেছে। রুবেনস-এর চিত্রগুলোও চুরি হয়ে গেছে। পর্দাগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। ক্যাবিনেটে কোনো অলংকার-ই নেই!
“রাজা সপ্তদশ লুই-এর ঝাড়বাতি, দ্বাদশ শতাব্দীর কুমারী মূর্তি, কিছু নেই। সব চুরি হয়ে গেছে!”
হতাশায় সে এদিক-সেদিক দৌড়াতে লাগল ব্যারন। একটু ধাতস্থ হতেই সে সবগুলো জিনিসের ক্রয়মূল্য হিসাব করতে লাগল, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলল। হাতাশায় যেন পাগল হয়ে গেল ব্যারন। রাগে মেঝেতে পা ঠুকল, দুঃখে হাহাকার করে উঠল। এমন ভাব করতে লাগল যেন আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।
শেষ পর্যন্ত একটা জিনিস তার কাণ্ডজ্ঞান ফেরাতে পারল, তা হলো গাঁইমার্দের স্থবির হয়ে থাকার দৃশ্য। বিখ্যাত গোয়েন্দা নড়ছিল না। যেন পাথরের মূর্তি। উদাস চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। জানালাগুলো লক্ষ করছে? সব বন্ধ। দরজার তালাগুলো দেখছে? সবগুলো-ই অক্ষত। ছাদে কোনো ফাটল নেই, মেঝেতেও গর্ত নেই। সবকিছু একদম নিখুঁত-ই আছে। একটা সূক্ষ্ম সুপরিকল্পিত উপায়ে অত্যন্ত শৃঙ্খলা, সাবধানতা আর চতুরতার সাথে চুরিটা সম্পন্ন হয়েছে।
“আর্সেন লুপাঁ… আর্সেন লুপাঁ।” সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল।
হঠাৎ-ই প্রচণ্ড আক্রোশে নড়ে উঠল গাঁইমার্দের পাথরের মূর্তি। তীব্র বেগে দুই সহকারীকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল। দুই সহকারী তবুও নড়ল না।
“শয়তান লুপাঁ!” চেঁচিয়ে উঠল গাঁইমাৰ্ছ, “এটা কী করে সম্ভব?”
সে তাদের ওপর ঝুঁকে একদম কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করল। তারা ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু তাদের আচরণ স্বাভাবিক ছিল না।
“ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।” ব্যারনের উদ্দেশ্যে বলল সে।
“কে করল এই কাজ?”
“নিশ্চয়ই আর্সেন লুপাঁ, নয়তো তার দলের কেউ। এই ঘটনা তার কাজেরই স্বাক্ষর বহন করে।”
“আমি একদম হেরে গেলাম, আর কিছুই করার রইল না।”
“কিচ্ছু করার নেই আর।” গাঁইমার্দ সম্মতি প্রদান করল।
“এ তো ভয়ংকর, অবিশ্বাস্য। “
“থানায় অভিযোগ দায়ের করুন।”
“তাতে লাভ কী?”
“আহা! চেষ্টা তো করা যাবে। আইনেরও তো কিছু উপায় আছে।”
“আইন? বাহ! সে তো অনর্থক। আপনি আইনের লোক। আপনার উচিত এ মুহূর্তে কোনো ক্লু খুঁজে বের করা, কোনো সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করা। কিন্তু আপনি নড়ছেনও না।”
“আর্সেন লুপাঁর ব্যাপারে কোনো সূত্র খুঁজে বের করব? শুনুন মঁসিয়ে, আর্সেন লুপাঁ কখনও ব্লু ফেলে যায় না। সে কোনো সুযোগই রেখে যায় না। এখন তো আমার সন্দেহ হচ্ছে, সে আমেরিকায় স্বেচ্ছায় আমার হাতে ধরা দিয়েছে কিনা।”
“তাহলে তো আমার চিত্রকর্মের আশা ছেড়েই দিতে হয়! সে আমার সংগ্রহের মুক্তোগুলোও চুরি করেছে। আমাকে যদি এগুলো ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ সে দিত! যদি অন্য কোনো উপায় নাও থাকে, চোর অন্তত তার দামটা তো বলুক!”
গাঁইমার্দ মনযোগ দিয়ে ব্যারনের কথা শুনল। তারপর বলল,
“এটা খুবই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। আপনি এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকবেন তো?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু আপনি হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
“আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।”
“কী বুদ্ধি?”
“যদি অফিসিয়াল তদন্ত সফল না হয়, তখন সেটা ভাববো। তবে একটা কথা দিতে হবে, যদি আমার সহায়তা চান, তবে আমার ব্যাপারে কোথাও টু শব্দটিও করা যাবে না।”
দাঁতে দাঁত চেপে সে আরও বলল,
“তবে এটা সত্য যে, এখানে আমার আর গর্ব করার কিছু রইল না।”
সহকারী দু’জন যেন ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পাচ্ছে; সামনের মানুষগুলোর দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছে। গাঁইমার্দ তাদের কিছু প্রশ্ন করল কিন্তু কিছুই মনে করতে পারল না ষণ্ডামার্কা দুই সহকারী।
“কিন্তু তোমরা তো অন্তত কাউকে দেখেছ?”
“না, কাউকেই দেখিনি। “
“তোমরা কি মনে করতে পারছ না?”
“না, কাউকেই মনে করতে পারছি না।”
“তোমরা কি কিছু খেয়েছিলে?”
তারা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর একজন উত্তর দিল,
“হ্যাঁ, সামান্য পানি খেয়েছিলাম শুধু।”
“ওই পানির বোতল থেকে?”
“হ্যাঁ।”
“আমিও খেয়েছিলাম।” অপর জন বলল।
গাঁইমার্দ বোতলটা শুঁকল, একটু পানি মুখে নিল। বিশেষ কোনো গন্ধ বা স্বাদ পেল না সে।
“চলো,” সে বলল, “এখানে অযথাই সময় নষ্ট করছি আমরা। আর্সেন লুপাঁর কেস পাঁচ মিনিটে সমাধান করা কারও কম্ম নয়। কিন্তু আমি শপথ করে বলছি, আমি আবারও গ্রেপ্তার করব শয়তানটাকে।”
সেদিন-ই সাঁৎ-এর কারাগারের বন্দি কয়েদি আর্সেন লুপাঁর নামে গুরুতর চুরির অভিযোগ দায়ের করল ব্যারন কাহর্ন।
***
ব্যারন যখন দেখলো মামলা সংক্রান্ত কাজে তার দুর্গ সশস্ত্র পুলিশ, প্রসিকিউটর, বিচারক, মেজিস্ট্রেট, পত্রিকার রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার আর কৌতূহলী মানুষে ভরে গেছে, তখন মামলার করার জন্য আফসোস করতে লাগল সে।
ক্রমশ মামলাটি গণমানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আর আর্সেন লুপাঁর নাম মানুষের কল্পনাকে উপজীব্য করে এত বেশি ছড়িয়েছে যে, পত্রিকাগুলোও নানা আজগুবি গল্প ছাপাচ্ছে আর সাধারণ মানুষ সেগুলোই গোগ্রাসে গিলছে।
ব্যারন কাহর্নকে দেওয়া আর্সেন লুপাঁর হুমকির চিঠিগুলো ‘একো দ্য ফ্রান্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরপর-ই জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। কেউ অবশ্য জানে না উক্ত পত্রিকাটি কিভাবে চিঠিগুলো হাত করল।
সেটা নিয়েও নানান কল্পকথা ছড়াতে লাগল। কেউ কেউ সেই বিখ্যাত ভূ- সুড়ঙ্গের কথাও ছড়িয়ে দিলো।
সরকারি উকিলগুলোও সেদিকে তল্লাশি শুরু করে দিলো। তারা ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত খুঁজল, প্রতিটা পাথর পরীক্ষা করা হলো, দেওয়ালের তক্তা আর চিমনি থেকে শুরু করে জানালার ফ্রেম, সিলিংয়ের গার্ডার পর্যন্ত খোঁজা হলো। টর্চের আলোয় বিশাল কুঠুরিতে মালাকুইসের মালিকদের সংগ্রহ করে রাখা যুদ্ধাস্ত্র আর খাদ্যসামগ্রীও তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। পাথুরে পাহাড়টার কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত ঠুকেঠুকে পরীক্ষা করা হলো। কিন্তু সবই বৃথা গেল। তারা গোপন ভূ-সুড়ঙ্গেও কোনো চিহ্নও খুঁজে পেল না। কেউ কেউ তো ঘোষণা-ই করল, কোনো গোপন রাস্তার অস্তিত্বও নেই সেখানে।
কিন্তু কৌতূহলী জনগণ বলতে লাগল, চিত্রকর্ম আর আসবাবগুলো তো আর ভূতের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। সেগুলো বাস্তব এবং ধাতব উপাদান। সেগুলো নিয়ে গেলে দরজা-জানালা দিয়েই আনা-নেওয়া করতে হয়, আর যারা নিয়ে গেছে তারাও দরজা-জানালা দিয়েই নিয়ে গেছে। কিন্তু তারা কারা? তারা কীভাবে দুর্গে প্রবেশ করল? আর কীভাবেই বা বের হয়ে গেল?
রুয়েন-এর পুলিশ অফিসারেরা নিজেদের অক্ষমতা বুঝতে পেরে প্যারিসের গোয়েন্দাদের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠাল। গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মঁসিয়ে দুদো একদল সেরা গোয়েন্দাদের সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি স্বয়ং আটচল্লিশ ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করলেন, কিন্তু সফলতার দেখা পেলেন না। অবশেষে তিনি গাঁইমার্দের শরণাপন্ন হলেন। এই গাঁইমার্দ অসংখ্য জটিল কেসে তার সফলতার প্রমাণ দিয়েছে। এমনকি যেসব কেসে কেউ কোনো আগামাথা খুঁজে পায়নি সেসব কেসও সমাধান করেছে সে।
গাঁইমার্দ নিঃশব্দে উপরওয়ালার নির্দেশনা শুনল। তারপর মাথা নেড়ে বলল,
“আমার মতে, দুর্গে তল্লাশি করা মানে পণ্ডশ্রম করা। সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে অন্য কোথাও।”
“তাহলে কোথায়?”
“আর্সেন লুপাঁর কাছে।”
“আর্সেন লুপাঁর কাছে! তার মানে তুমি মনে করো যে, এই চুরিতে তার হাত রয়েছে?”
“আমি তাই মনে করি। আরেকটু এগিয়ে বলতে চাই, আমি এটা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি।
“দেখো গাঁইমার্দ, এটা হাস্যকর। আর্সেন লুপাঁ কারাগারে।”
“আমি মানছি যে আর্সেন লুপাঁ কারাগারে, তাকে কঠোর পাহারায় রাখা হয়েছে। কিন্তু তার পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে হাতে হাতকড়া পরিয়ে মুখে রুমাল গুঁজে রাখলেও আমার অভিমত একই থাকবে।”
“নিজের কথায় এত অনড় থাকছ কীভাবে, গাঁইমার্দ?”
“কারণ, সমগ্র ফ্রান্সের মধ্যে আর্সেন লুপাঁ-ই একমাত্র ব্যক্তি, যে এত বিশাল মাপের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সফলতার সাথে তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে।”
“এসব তোমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, গাঁইমার্দ।”
“কিন্তু সত্যই বলছি। দেখুন, তারা কী করেছে? ভূ-সুড়ঙ্গের পথ খুঁজেছে, পাথর সরিয়েছে বা এ ধরনের আরও আজেবাজে কাজ করেছে। কিন্তু লুপাঁ এ- ধরনের সেকেলে পদ্ধতিতে কাজ করে না। সে আধুনিক চোর, যে সময়ের চেয়ে এগিয়ে আছে।”
“তুমি তাহলে কী করতে চাইছ?”
“আমি তার সাথে ঘণ্টাখানেক সময় কাটানোর জন্য আপনার কাছে অনুমতি চাইছি।”
“এই কারাগারে?”
“হ্যাঁ, আমেরিকা থেকে ফেরার পথে তার সাথে আমার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আমি ঝুঁকি নিয়েই বলতে পারি যে, যদি সে নিজেকে বিপদে না ফেলে আমাকে সামান্য তথ্যও দিতে পারে, তবে আমাকে অকারণে ভোগানোর লোক সে নয়।”
.
দুপুরের সামান্য পরেই আর্সেন লুপাঁর সেলে প্রবেশ করল গাঁইমার্দ। নিজের সেলে আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে-ই ছিল লুপাঁ। মাথাটা তুলে সে সানন্দে চিৎকার করে উঠল,”আরে! গাঁইমার্দ যে! একদম সশরীরে! স্বেচ্ছায় এখানে আসার পর আমি অনেক কিছু আশা করেছিলাম। কিন্তু আপনি সশরীরে আমার সাথে দেখা করতে আসবেন সেটা আশা করিনি।“
“সবই তোমার দয়া, আর্সেন লুপাঁ।”
“মোটেই না। আপনি জানেন, আমি আপনাকে কতটা সম্মান করি।”
“শুনে গর্ববোধ করছি।”
“আমি তো সবসময়ই বলি, গাঁইমার্দ আমাদের সেরা গোয়েন্দা। তিনি তো প্রায়-দেখুন আমি কত স্পষ্টভাষী-তিনি তো প্রায় শার্লক হোমসের সমকক্ষ। কিন্তু আমি সত্যিই দুঃখিত যে আপনার মতো বিরাট একজন গোয়েন্দাকে এই মুহূর্তে এই টুলটি ছাড়া অন্য কিছু এগিয়ে দিতে পারছি না। এমনকি কোনো পানীয়ও নয়। এক গ্লাস বিয়ারও নয়। তবে এতটুকু বলে রাখি পরেরবার দেখা হলে যত্ন-আত্তির কমতি হবে না, কারণ এখানে আমি ক্ষণিকের অতিথি মাত্র।”
গাঁইমার্স হেসে লুপাঁর এগিয়ে দেওয়া টুলে বসল। বন্দি লুপাঁ কথা চালিয়ে যেতে থাকল,
“ঈশ্বরের দোহাই, আপনার মতো একজন ভালো মানুষের মুখ দেখলে কী যে ভালো লাগে! যেসব শয়তান গোয়েন্দারা দিনে দশ বার আমার সেলে এসে আমার পকেট চেক করে আর আমি পালানোর কোনো ফন্দি আঁটছি কিনা জানতে চায়, তাদের দেখে দেখে আমি ক্লান্ত!”
“তারা তাদের দায়িত্ব অনুযায়ী সঠিক কাজটাই করে।”
“এমন কেন? তারা যদি আমাকে নিজের মতো একা থাকতে দিত, তাহলে-ই আমি সন্তুষ্ট হতাম।”
“অন্যদের টাকায় দিনযাপন করতে।”
“তা তো বটেই। সেসব তো জানা কথাই। কিন্তু যা-ই হোক, আমি আসলে মজা করছি। তবে আপনি যে খুব ব্যস্ত মানুষ তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। চলুন, সময় নষ্ট না করে কাজের কথায় আসি, গাঁইমার্দ। আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?”
“কাহর্নের ঘটনাটার ব্যাখা দাও।” গাঁইমার্দ স্পষ্টভাবে সরাসরি আসল কথায় চলে গেল।
“আহ! একটু অপেক্ষা করুন। আমাকে একটু ভালোভাবে মনে করতে দিন… আহ, হ্যাঁ, এই তো মনে পড়েছে। কাহর্নের ঘটনা, মালাকুইসদের প্রাসাদ, সিন নদী, রুবেনসের দুটো চিত্রকর্ম, ওয়াত্তোর একটা চিত্রকর্ম, আরও কিছু সামান্য জিনিসপত্র। “
“সামান্য?”
“এসব তো ছোটোখাটো অগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু আপনার এতে আগ্রহ আছে, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। তো এই কেসে কীভাবে আপনাকে সহায়তা করতে পারি, বন্ধুবর গাঁইমার্দ?”
“তদন্তের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কতটা এগিয়েছে, তা তোমাকে বলার প্রয়োজন আছে কি?”
“মোটেই না। আমি পত্রিকা পড়েছি আর একথা হলফ করেই বলতে পারি যে, আপনারা খুব বেশিদূর এগুতে পারেননি।”
“আর সে কারণেই তোমার দর্শন নিতে এসেছি।”
“আপনার সেবায় আমি সদা প্রস্তুত!”
“একদম প্রথম থেকে বলো, ব্যারন কাহর্নের দুর্গের ঘটনা কি তুমি-ই ঘটিয়েছ?”
“পুরোটা আমার কাজ।”
“হুমকির চিঠি? টেলিগ্রাম?”
“সবই আমার কাজ। সত্যি বলতে, রসিদগুলোও আমার কাছেই আছে।”
বিছানা আর টুলের পাশে সাদা কাঠের তৈরি মসৃণ একটা টেবিল আছে। পুরো কক্ষ জুড়ে এই সামান্য কয়েকটা আসবাবপত্র-ই কয়েদিদের সম্বল। আর্সেন টেবিলটার ড্রয়ার খুলে দুই টুকরো কাগজ বের করে গাঁইমার্দের হাতে দিলো।
“আরে!” গাঁইমার্দ অবাক হয়ে বলল, “আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে, তল্লাশি করা হচ্ছে নিয়মিত। আর এখন দেখছি তুমি পত্রিকা পড়, ডাকঘরের রসিদ সংগ্রহে রাখো।”
“আসলে এই লোকগুলো খুবই বোকা। তারা আমার পোশাকের লাইনিং খুলে দেখে, আমার জুতোর সোল পরীক্ষা করে, দেওয়ালে শব্দ করে যাচাই করে, কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে চায় না যে, এরকম সাধারণ জায়গায় কোনোকিছু লুকিয়ে রাখার মতো নির্বোধ আর্সেন লুপাঁ নয়।”
গাঁইমার্দ হেসে ফেলল,”কী যে মজার একটা মানুষ তুমি! সত্যিই হতবুদ্ধি করে দিয়েছ একেবারে। আচ্ছা, এসব ছাড়ো। তুমি আমাকে পুরো ঘটনাটা বিস্তারিত বলো তো।”
“উঁহুঁ, উঁহুঁ, এত তাড়াতাড়ি বলে দিলে হয়! আমি আমার সব গোপন কথা আপনাকে বলে দিব, আমার ছোটোখাটো ট্রিকসগুলো জানিয়ে দিব। ব্যাপারটা তো এত সহজ হওয়া উচিত নয়।”
“তাহলে কি তোমার কাছে আসাটা উচিত হয়নি আমার?”
“না, গাঁইমার্দ, আমি সেটা বলতে চাইনি। আর আপনি যখন বলছেন…” আর্সেন লুপাঁ দু-তিন বার সেলে পায়চারি করে গাঁইমার্দের সামনে এসে থামল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“ব্যারনকে লেখা আমার চিঠি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?”
“আমার ধারণা তুমি নিছকই মজার করার জন্য কাজটা করেছ।”
“আহ! মজার করার জন্য! শুনুন গাঁইমার্দ, আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে আরও ভালোভাবে চেনেন। আমি, স্বয়ং আর্সেন লুপাঁ, এ ধরনের ছেলেমানুষি খেলা খেলে সময় নষ্ট করব? অন্য কোনো উপায়ে ব্যারনকে লুট করতে পারলে কি আমি চিঠিটা লিখতাম? আসল কথাটা হলো, চিঠিটা ছিল জরুরি। খুবই জরুরি। যন্ত্র চালানোর জন্য মোটর যেমন আসল কাজটা করে, এই কেসে ওই চিঠিটাও ছিল তেমন। মূল চালিকা শক্তি। এখন আমাকে মালাকুইসদের দুর্গে ডাকাতি করার পরিকল্পনাটা বলতে দিন। আপনার শোনার ইচ্ছে আছে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“বেশ, এবার ব্যারনের দুর্গের মতো একটা দুর্গের কথা ভাবুন যেটা দুর্ভেদ্য আর কড়া পাহারায় রাখা। এখন দুর্গটায় প্রবেশ করা কঠিন বলেই কি দুর্গের মধ্যে থাকা অসাধারণ সব জিনিসের প্রতি আমার সব আকর্ষণ আর আগ্রহ ত্যাগ করে চুরির পরিকল্পনা বাতিল করে দিব?”
“স্পষ্টত-ই না।”
“তবে কি আদিম যুগের মতো একদল দুঃসাহসী যোদ্ধা নিয়ে দুর্গ আক্রমণ করা উচিত হবে?”
“সেটা বোকামি হবে।”
“তাহলে কি চোরের মতো চতুরতার সাথে প্রবেশ করতে পারব?”
“অসম্ভব।”
“তবে আমার জন্য একটা পথ-ই খোলা রইল। উক্ত দুর্গের মালিক যদি নিজেই আমাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানায়!”
“মালিক নিজের বাড়ি চুরি করার জন্য চোরকে আমন্ত্রণ জানাতে যাবে কেন? সে কি পাগল?”
“আগে পুরো ঘটনা শুনুন! ধরা যাক, একদিন দুর্গের মালিক একটা চিঠি পেল। চিঠিতে তাকে জানিয়ে দেওয়া হল যে, আর্সেন লুপাঁ নামের এক চোর তাকে লুট করবে। তখন সে কী করবে?”
“প্রসিকিউটরের নিকট অভিযোগ জানিয়ে একটা চিঠি পাঠাবে।”
“তিনিও তখন উপহাসের হাসি হাসবেন, কারণ আর্সেন লুপাঁ তখন কারাগারে বন্দি। তখন তার মতো সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন আর ভীত হয়ে পড়বে। তার সামনে যে প্রথমে আসবে, তার কাছেই সে সহায়তা চাইবে। তাই নয় কি?”
“খুব সম্ভবত তাই করবে।”
“আর যদি সে স্থানীয় কোনো পত্রিকায় পড়ে যে, বিখ্যাত এক গোয়েন্দা তার কাছাকাছি কোনো শহরে ছুটি কাটাচ্ছে…”
“সে ওই গোয়েন্দার সন্ধান করবে। “
“অবশ্যই। কিন্তু অপর দিকে ধরে নেওয়া যাক, এই ব্যাপারটা আর্সেন লুপাঁ আগেই বুঝতে পেরে তার কোনো এক বন্ধুকে কদেবেকে পাঠিয়ে দিলো স্থানীয় পত্রিকা ‘রেভিল দ্য কদেবেক’ এর সম্পাদকের সাথে আলাপ জমাতে। এখানে আপনার জানা প্রয়োজন যে, ব্যারন এই পত্রিকাটির গ্রাহক। এখন সেই বন্ধুটি সম্পাদকের সাথে আলাপের সময় আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো যে, সে নিজেই সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা, সে ছুটি কাটাতে কদেবেকে গিয়েছে। তারপর কী ঘটবে বলে মনে হয়?”
“সম্পাদক ‘রেভিল দ্য কদেবেক’ পত্রিকায় কদেবেকে সেই গোয়েন্দার উপস্থিতি সম্পর্কে সংবাদ ছাপিয়ে দিবে।”
“ঠিক তাই। এরপর দুটো সম্ভাবনার মধ্যে যে-কোনো একটি ঘটবে: হয় মাছটা; মানে কাহর্ন টোপটা গিলবে না। সে যদি টোপটা না গেলে তাহলে কিছুই ঘটবে না। অথবা দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটবে, যেটা ঘটার সম্ভবনাই অধিক। সে দৌড়ে এসে লোভীর মতো টোপটা গিলবে। সেক্ষেত্রে ব্যারন আমারই বিপক্ষে লড়তে আমার-ই এক বন্ধুর সাহায্যের আবেদন জানাবে।”
“সত্যিই অসাধারণ বুদ্ধি!”
“অবশ্য নকল গোয়েন্দাটি শুরুতে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানাবে। তার পরপর-ই আর্সেন লুপাঁর টেলিগ্রাম আসবে। ভীত ব্যারন আবার আমার বন্ধুর নিকট গিয়ে অনুনয়-বিনয় শুরু করবে এবং তাকে কাজের জন্য পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলবে। আমার বন্ধুটি তখন প্রস্তাবে রাজি হবে এবং তার সাথে দু’জন সহকারী নিয়ে যাবে। রাত হলে ব্যারন কাহর্নকে যখন তার ত্রাণকর্তা মানে আমার বন্ধু চোখে চোখে রাখবে, সেই সময় ওই সহকারী দু’জন চুরির মালগুলো সরিয়ে ফেলবে। জানালার নিচেই ভাড়া করা একটি ছোট্ট লঞ্চ অপেক্ষা করবে। তারা দড়ি দিয়ে বেঁধে মালগুলো লঞ্চে নামিয়ে দিবে। একদম সহজ না ব্যাপারটা?”
“অবিশ্বাস্য! চমৎকার!” গাঁইমার্দ বলল, “এই সাহসী আর অভিনব পরিকল্পনাটার প্রশংসা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। কিন্তু কে সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা যার নাম আর খ্যাতি শুনেই ব্যারন আকৃষ্ট হয়ে তোমার ফাঁদে পা দিল?”
“তেমন গোয়েন্দা মাত্র একজন-ই আছে; মাত্র একজন-ই।”
“সে কে?”
“আর্সেন লুপাঁর চিরশত্রু-খ্যাতিমান গোয়েন্দা গাঁইমার্দ!”
“আমি?”
“স্বয়ং আপনি গাঁইমার্দ। আর সত্যি বলতে ব্যাপারটা মজার ছিল। আপনি যদি সেখানে যান আর ব্যারন আপনার সাথে কথা বলতে রাজি হয়, তাহলে দেখবে যে শেষ পর্যন্ত আপনার নিজেকেই গ্রেপ্তার করতে হবে, যেভাবে আপনি আমেরিকায় আমাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। যা-ই হোক, এটাকে একটা মজাদার প্রতিশোধ বলে ধরে নিতে পারেন।”
আর্সেন লুপাঁ হো হো করে হেসে উঠল আর গোয়েন্দাপ্রবর বিরক্তিতে নিজের ঠোঁট কামড়াতে লাগল। ঠাট্টাটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার। একজন গার্ড কক্ষে প্রবেশ করল। এ সুযোগে গাঁইমার্দ নিজেকে সামলে নিল। গার্ডটি লুপাঁর জন্য কাছের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে এসেছে (কারাগারে বাইরের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনার অনুমতি ছিল আর্সেন লুপাঁর জন্য)। সে টেবিলের ওপর খাবার রেখে চলে গেল। লুপাঁ রুটির টুকরো মুখে দিয়ে বলতে লাগল,
“একটু বিশ্রাম নিন প্রিয় গাঁইমার্দ। মালাকুইস দুর্গে যাওয়ার প্রয়োজন নেই আমি আপনাকে চমৎকার একটি তথ্য দিচ্ছি, কাহর্নের মামলাটি খুব শীঘ্রই তুলে নেওয়া হচ্ছে।”
“কিছু মনে করো না, লুপাঁ! জেলে থাকতে থাকতে বুদ্ধিটা একটু ভোঁতা হয়ে গেছে তোমার! মামলা তুলে নেওয়ার মত কোনো ব্যাপার ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি মাত্রই সাঁৎ কারাগারের চীফের সাথে দেখা করে এসেছি।”
“তাতে কী হয়েছে? মঁসিয়ে দুদো কি আমার কাজ সম্পর্কে আমার নিজের চেয়েও বেশি জানে না কি? আমার কাজের খবর দয়া করে আমার কাছ থেকেই শুনুন, গাঁইমার্দ। নকল গাঁইমার্দে সাথে ব্যারনের বেশ সদ্ভাব-ই হয়ে গিয়েছিল। আমার সাথে তার অন্যরকম লেনদেনের হিসাব-ই তাকে ব্যাপারটা চাপা রাখতে বাধ্য করবে। বর্তমানে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে, পর্যাপ্ত অর্থের বিনিময়ে সে তার চিত্রকর্ম-সহ অন্য সব মালামাল ফেরত পাবে। পাশপাশি সে তার মামলাটিও উঠিয়ে নিবে। ফলে, সেখানে চুরির আর কোনো প্রশ্নই থাকছে না, তাই প্রসাশনকেও মামলার তদন্ত বাদ দিতে হবে।”
গাঁইমার্দ হতভম্ব হয়ে বন্দির দিকে তাকিয়ে রইল
“তুমি এত কিছু জানলে কী করে?”
“মাত্রই আমি আমার প্রত্যাশিত টেলিগ্রামটা পেয়েছি।”
“এইমাত্র তুমি টেলিগ্রাম পেয়েছ?”
“এইমাত্রই পেয়েছি, প্রিয় বন্ধু। ভদ্রতার খাতিরেই আমি এটা আপনার সামনে পড়তে চাইনি। কিন্তু আপনি যদি অনুমতি দেন….”
“তুমি কি আমার সাথে মজা করছ, লুপাঁ?”
“প্রিয় বন্ধু, অনুগ্রহ করে ওই ডিমটার ওপরের অংশটা ভেঙে ফেলুন। তাহলে নিজেই দেখতে পাবেন যে, আমি আপনার সাথে মজা করছি কিনা।”
গাঁইমার্দ যন্ত্রের মতো লুপাঁর নির্দেশ পালন করল। সে ছুরির ফলা দিয়ে ডিমের খোসাটা ভেঙে ফেলল। বিস্ময়ের একটা ধ্বনি অজান্তেই বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। খোসাটার ভেতরে একটা নীল কাগজের টুকরা। লুপাঁর অনুরোধে সে কাগজের ভাঁজ খুলল। একটা টেলিগ্রাম, বরং বলা যায় একটা টেলিগ্রামের অংশ। তা থেকে পোস্ট-মার্ক তুলে ফেলা হয়েছে। পড়তে শুরু করল গাঁইমার্স:
‘চুক্তি সম্পন্ন। এক লাখ দেওয়া হয়েছে। সব ঠিক আছে।’
“এক লাখ দেওয়া শেষ?” গাঁইমার্দ বলল।
“হ্যাঁ, এক লাখ ফ্রাঁ। অতি সামান্য, তবে আপনি তো জানেন, সময়টা খুব বাজে যাচ্ছে… আর আমাকেও বেশ বড়োসড়ো কিছু ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর আমার বাজেটের পরিমাণটা আপনি যদি জানতেন… একটা শহর চালানোর মতো বাজেট দরকার হয় আমার।”
গাঁইমার্দ উঠে দাঁড়াল। চেহারার মলিন ভাবটা কেটে গেছে। এক মুহূর্ত ভেবে সে পুরো ঘটনাটা ভেতরে ভেতরে আরেকবার আওড়ালো। অন্তত একটা দুর্বল পয়েন্ট ধরার জন্য। তারপর বন্দির প্রতি সম্মানের সুরেই সে বলল,
“সৌভাগ্যবশত: তোমার মতো ডজনখানেক লোককে আমাদের সামলাতে হয় না। যদি তাই করতে হতো, তবে আমাদের তল্পিতল্পা-সহ দোকান গুটিয়ে পালাতে হতো।”
আর্সেন লুপাঁ বিনয়ের সাথে জানাল,
“আসলে কারাগারে থাকতে থাকতে একঘেয়েমিতায় পেয়ে বসেছে। আড়মোড়া ভাঙার জন্য এমন কিছু করা প্রয়োজন ছিল।”
“কী?” গাঁইমার্দ শুধালো, “তোমার বিচার, আত্মপক্ষ সমর্থন, জেরা-মনকে এ কীভূত করার জন্য এসব-ই কি যথেষ্ট নয়?”
“না। কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিচারের সময় আমি উপস্থিত থাকব না।”
“মানে?”
লুপাঁ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে আবারও বলল, “বিচারের সময় আমি উপস্থিত থাকব না।”
“সত্যি-ই!”
“হ্যাঁ, আমার প্রিয় মঁসিয়ে গাঁইমার্দ, সত্যি। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন না যে, আমি এই কারাগারে পচে মরব। এমন ভাবনাও আমার জন্য অপমানজনক। আর্সেন লুপাঁ ঠিক ততদিন-ই কারাগারে থাকবে, যতদিন সে থাকতে চাইবে। তার চাইতে এক মিনিটও বেশি নয়।”
“তাহলে তো এখানে প্রবেশ না করলেই সবচেয়ে ভালো হতো, তাই না?” গোয়েন্দাপ্রবর ব্যঙ্গের স্বরে বলল।
“আহা মঁসিয়ে গাঁইমার্দ, আমাকে ব্যঙ্গ করছেন? আপনার মনে রাখা উচিত যে, আমাকে গ্রেপ্তারের সম্মানটা আপনি-ই পেয়েছ। আমার সুযোগ্য বন্ধু, শুনুন তাহলে। সে-সময় যদি একটা জরুরি কাজে মনোনিবেশ করতে না হতো, তবে আপনি কেন, কেউ-ই আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারত না।”
“তুমি আমাকে অবাক করলে!”
“একটা নারী আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, গাঁইমার্দ। আর আমি ওই নারীকে ভালোবাসতাম। একজন নারী যখন ভালোবেসে কারও দিকে তাকায়, সে চাহনির অর্থ কি আপনি পুরোপুরি বুঝতে পারেন? আমি তাকে ছাড়া দুনিয়ার কাউকে-ই পরোয়া করি না। আর সে কারণেই আমি এখানে।“
“যদি অনুমতি দাও তবে বলি, তুমি কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এখানে আছ।’ “প্রথমত আমি সেসব ভুলে যেতে চাচ্ছি। একদম হাসবেন না; এটা খুবই আনন্দদায়ক অভিযান ছিল, আর সেসব আমার কাছে সুখস্মৃতির মতোই। যা-ই হোক, আমি স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছি। জীবন এখন এতই একঘেয়ে যে, আনুষ্ঠানিকভাবেই একটা বিশ্রাম নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। আর আমি আমার ক্লান্ত নার্ভগুলোকে শান্ত করার জন্য এই কারাগারের মতো কার্যকর সমাধান খুঁজে পেয়েছি।”
“আর্সেন লুপাঁ, যতই হোক, তুমি আসলে কোনো খারাপ লোক নও।”
“ধন্যবাদ।” লুপাঁ বললো, “গাঁইমার্দ, আজ শুক্রবার। পরের বুধবার বিকেল চারটায় আমি রু পার্গোলেসে আপনার বাসায় বসে সিগারেট ফুঁকব।”
“প্রিয় আর্সেন লুপাঁ, আমি তোমার আশায় পথ চেয়ে থাকব।”
পুরোনো বন্ধুর মতোই করমর্দন করল দু’জন। প্রতিপক্ষ এই দু’জন একে অপরের সত্যিকারের মূল্য দিতে জানে। তারপর গোয়েন্দাপ্রবর দরজার দিকে পা বাড়াল।
“গাঁইমার্দ!”
গাঁইমার্দ ঘুরে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”
“আপনি ভুলে আপনার ঘড়িটা ফেলে যাচ্ছেন।”
“আমার ঘড়ি?”
“হ্যাঁ, এটা এখন আমার পকেটে।”
লুপাঁ ঘড়িটা ফেরত দিলো।
“ক্ষমা করবেন… এটা আমার বদভ্যাস। তারা আমার ঘড়িটা নিয়েছে বলে আমি আপনারটা নিয়ে নিব, এটা উচিত হচ্ছে না। আর তাছাড়া আমার কাছে একটা ক্রোনোমিটার আছে যেটা সবসময় সঠিক সময় জানায়। সেটা দিয়েই আমার কাজ খুব ভালোভাবে চলে যাবে।”
ড্রয়ার থেকে ভারী চেইনে ঝুলানো একটা বড়ো সোনার ঘড়ি বের করে আনল লুপাঁ।
“এটা কার পকেট থেকে এলো?” গাঁইমার্দ জিজ্ঞেস করল।
আর্সেন লুপাঁ ঘড়ির খোদাইয়ের দিকে দ্রুত নজর বুলাল।
“জে.বি… কে হতে পারে?… ওহ! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। জুলি বোভিয়ের। আমার মামলার বিচারক। চমৎকার লোক!…’