দ্য অ্যারেস্ট অভ আর্সেন লুপাঁ
অনুবাদ: কুদরাত জাহান
সুন্দরভাবে শুরু হওয়া সেই যাত্রাটার সমাপ্তিটা ছিল বেশ অদ্ভুত। জাহাজ হিসেবে ‘লা প্রোভেন্স’ বেশ ভালো। ট্রান্স-আটলান্টিক স্টিমশিপটার গতিও যেমন ভালো, যাত্রীদের জন্যও তেমন আরামদায়ক। আর জাহাজের ক্যাপ্টেনও বেশ সজ্জন ব্যক্তি। আর যাত্রার সঙ্গী হিসেবে জাহাজের যাত্রীরাও এক কথায় অসাধারণ, সকলেই বেশ মিশুক আর অভিজাত। যাত্রাপথে নতুন সঙ্গীদের সাথে পরিচিত হওয়া আর নানান রকম আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে দিয়ে আমাদের যাত্রাপথের সময় বেশ ভালোই যাচ্ছিল। যাত্রাপথে জাহাজগুলো যেন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কর্মব্যস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতাটা বেশ ভালোই উপভোগ করছিলাম আমরা। পৃথিবীর ঝঞ্ঝাট থেকে বহু দূরে আমরা একদল অপরিচিত মানুষ যেন সবাই সবার সঙ্গ উপভোগ করার চেষ্টা করছি।
এই যে জাহাজের অপরিচিত যাত্রীরা সবাই সবার সাথে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করছে, কখনও ভেবে দেখেছেন এই আন্তরিকতার কতটুকু মন থেকে আসা, আর কতটুকু লোক দেখানো? যে মানুষগুলো কয়েকদিন আগেও কেউ কাউকে চিনতও না, জাহাজে ওঠার পর তারা প্রচণ্ড আন্তরিকতা দেখায়, একসাথে ক্রুদ্ধ সাগরকে মোকাবেলা করে, একসাথে সামলায় পাহাড় সমান ঢেউ আঘাত, উন্মত্ত জলরাশির গর্জন আর সীমাহীন নিঃসঙ্গতার বেদনা। সবমিলিয়ে বেশ অদ্ভুত একটা ব্যাপার। এজন্যই বোধহয় সমুদ্রযাত্রাগুলো আমাদের মধ্যে ভয় আর আনন্দের মিশ্রিত একটা অনুভূতি নিয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকে।
কিন্তু সমুদ্রযাত্রা আর আগের মতো নেই। জাহাজগুলো এখন আর গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপ নয়। বিরাট আটলান্টিকের অসীম জলরাশির মধ্যেই একটা বন্ধন আগের সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোকে একটা অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে। এই বন্ধনের নাম ওয়ারলেস টেলিগ্রাফ। এই বন্ধনের মাধ্যমে কোনো এক রহস্যজনক উপায়ে মূল ভূখণ্ডের খবর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা আমাদের কাছে পৌঁছে যায়। আমরা সবাই খুব ভালোভাবে জানি, টেলিগ্রাফের বার্তাগুলো কোনো তারের মধ্যে দিয়ে আসে না। এই রহস্য যেন বর্ণনার অতীত, কিছুটা যেন রোমান্টিক। নতুন এই বিস্ময় যেন বাতাসের ডানাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালিত করার অতিপ্রাকৃত এক ক্ষমতা দিয়েছে আমাদের। যাত্রার প্রথমদিন থেকেই মনে হচ্ছিল, কেউ আমাদের অনুসরণ করছে, দূর থেকে পথ দেখাচ্ছে, ক্রমাগত দূরে চলে যেতে থাকা পৃথিবীর ছোটো ছোটো খবর আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। আমার নিজেরও দু’জন বন্ধুর সাথে কথা হলো যাত্রাপথে-ই। অন্যান্য যাত্রীরাও তাদের বন্ধু-স্বজনদের নানান রকম শুভেচ্ছা আর বিদায়ী শুভকামনা পেলেন।
যাত্রার দ্বিতীয় দিনে, ভীষণ এক ঝড়ের মধ্যে, আমরা ওয়ারলেস টেলিগ্রাফে একটা বার্তা পেলাম। আমরা তখন ফ্রেঞ্চ কোস্ট থেকে পাঁচশ মাইল দূরে। বার্তাটা ছিল,
‘আর্সেন লুপাঁ আপনাদের জাহাজে। প্রথম কেবিনে। সোনালি চুল। ডান হাতে একটা ক্ষত চিহ্ন। যে নাম নিয়ে জাহাজে উঠেছে সেটা হলো র…’
ঠিক এমন সময় প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমক। ওয়ারলেস টেলিগ্রাফের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বার্তার বাকি অংশ আর জানা হলো না। আর্সেন লুপাঁ যে নাম নিয়ে আমাদের জাহাজে উঠেছে সেই নামটার প্রথম অক্ষরটাই শুধু জানা গেল।
অন্য কারও খবর হলে সেটা নিশ্চয়ই টেলিগ্রাফিক অপারেটর কিংবা জাহাজের অফিসারেরা সযত্নে গোপন করতেন। কিন্তু সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশের পর খবরটা প্রচার করে দেওয়া হলো। ওই দিনই ব্যাপারটা প্রতিটা জমজমাট আড্ডার প্রধান আলোচনায় পরিণত হলো। বিখ্যাত আর্সেন লুপাঁ যে আমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে, সেটা কারোরই জানতে বাকি রইল না।
আর্সেন লুপাঁ লুকিয়ে আছে আমাদের মাঝে! গত কয়েকমাস ধরে যেই চোরের কাণ্ডকারখানা লিখে লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলছে সংবাদপত্রগুলো, সেই রহস্যময় ব্যক্তিটি সশরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের নাকের ডগা দিয়ে! আমাদের চৌকষ গোয়েন্দা গাঁইমার্দকেও বেশ নাস্তানাবুদ করেছে এই লুপাঁ। আর্সেন লুপাঁ কিন্তু মোটেও কোনো ছিঁচকে চোর নয়। সম্ভ্রান্ত আর নীতিবান চোর। বড়ো কোনো গ্যালারি কিংবা বিখ্যাত কোনো প্রাসাদ ছাড়া দাঁও মারতে দেখা যায়নি তাকে।
অদ্ভুত এক নীতি মেনে চলা এই চোর মহাশয় একবার ব্যারন শোরম্যানের প্রাসাদে ঢুকে কিছু না নিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে শোরম্যানের প্রাসাদে তার রেখে যাওয়া কার্ডটা পাওয়া যায়। সেখানে খোদাই করে লেখা ছিল:
‘আর্সেন লুপাঁ, জেন্টলম্যান-বার্গলার, প্রাসাদে অরিজিনাল ফার্নিচার আসলে আবার ফিরে আসবে।’
শোফার, গোয়েন্দা, জুয়াড়ি, রাশিয়ান ডাক্তার, স্প্যানিশ বুলফাইটার, ব্যাবসায়িক পর্যটক, বলিষ্ঠ তরুণ কিংবা অথর্ব বৃদ্ধের মতো হাজারো ছদ্মবেশ নিতে পারে এই রহস্যময় চোর।
পরিস্থিতিটা যে কী পরিমাণ চমকপ্রদ সেটা কল্পনা করুন একবার :
ট্রান্স-আটলান্টিক স্টিমারের সীমিত পরিসরে ঘোরাঘুরি করছে আর্সেন লুপাঁ। দুনিয়ার এক কোনায় এই জাহাজের আনাচে কানাচে চলছে তার পদচারণা। এই ডাইনিং সেলুন, কিংবা স্মোকিং রুমে, কিংবা ওই মিউজিক রুমে! কে জানে, আমার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটাই হয়তো সে। টেবিলে আমার পাশে যে বসেছিল, আমার স্টেটরুমে আমার সাথে যে থাকে…..
“এই অবস্থা পাঁচ দিন ধরে চলবে!” পরের সকালেই চেঁচিয়ে উঠলেন মিস নেলি আন্ডারডাউন। “অসহ্য লাগছে! ওকে যদি গ্রেপ্তার করা যেত!”
দুর্ভাগ্যবশত এর পরেই ওনার চোখ পড়ল আমার ওপর, “আর এই যে আপনি, মঁসিয়ে ডি’আন্দ্রেজি, ক্যাপ্টেনের সাথে তো খুব দহরম-মহরম আপনার; ভেতরের খবর জানেন নিশ্চয়ই?”
মিস নেলির আগ্রহ জাগাতে পারে এমন কোনোকিছু যে আমি জানি, সেটা ভেবে হলেও সম্ভবত খুশি হওয়া উচিত ছিল আমার। উনি হলেন এমন একজন নারী যিনি যে-কোনো পরিস্থিতিতে মানুষের নজর কেড়ে নিতে সক্ষম। রূপ কিংবা সম্পদের আকর্ষণ যে অমোঘ, সেটা তো সবাই জানে। আর ওনার আছে এই দুটোই।
প্যারিসে ফরাসি মায়ের কাছে বেড়ে উঠেছেন তিনি, পড়াশোনাটাও এখানেই। সাথে আছেন তার বান্ধবী লেডি জেরল্যান্ড।
প্রথমে তাকে একটু পটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু এই সমুদ্রযাত্রায় একত্রে থাকতে থাকতে তার সুন্দর আচরণ বেশ মনে ধরে গেল আমার। কিছুটা শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠায় পটানোর চিন্তাটা উবে গেল মাথা থেকে। তাছাড়া, উনি আমার আগ্রহের প্রতিদানও দিতেন দারুণভাবে। আমি মজার কোনো গল্প বললে হাসি ফুটে উঠত তার মুখে, আমার গল্পগুলোও মন দিয়ে শুনতেন তিনি। তবে আমার চেয়ে চৌকস এবং শাণিত রুচির এক তরুণের মাঝে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুঁজে পেলাম আমি। আমার ছেলেমানুষি আর হাস্যরস মেশানো কথাবার্তার বদলে সেই মিতভাষী ভদ্রলোকের সূক্ষ্ম রসিকতাগুলোই যেন বেশি মুগ্ধ করত ওনাকে। মিস নেলির মুগ্ধ ভক্তদের একজন হয়ে বসে আছেন তিনিও। সবার মাঝে হঠাৎ আমাকে প্রশ্নটা করায় বেশ গর্ববোধ হলো।
বেশ আরাম করে জাহাজের ডেকে পেতে রাখা চেয়ারে বসে আছি আমরা। আগের রাতের তুমুল ঝড়ের পরে আজকে আকাশ একদম ঝকঝক করছে। মন ভালো করে দেওয়া আবহাওয়া।
“এ ব্যাপারে আমি খুব বেশি জ্ঞান রাখি না, মাদামোয়াজেল,” জবাব দিলাম আমি। “কিন্তু আমরা কি আর্সেন লুপাঁর একান্ত ব্যক্তিগত শত্রু ডিটেকটিভ গাঁইমার্দের মতো এই রহস্যের তদন্ত করতে পারব না?”
“আরে মঁসিয়ে, একটু বেশিই এগিয়ে যাচ্ছেন মনে হয়!”
“মোটেই না, মাদামোয়াজেল। সবার আগে একটা প্রশ্ন করি। আপনার কাছে কি এই সমস্যাটাকে খুব বেশি জটিল মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, খুবই জটিল।“
“এই সমস্যা সমাধানের চাবি যে আমাদের কাছে, সেটা ভুলে গেছেন?”
“কী চাবি?”
“প্রথমত, লুপাঁ নিজেকে ‘মঁসিয়ে র’ নামের কিছু একটা বলে পরিচয় দিচ্ছে…”
“সূত্র হিসেবে এটা খুবই সামান্য।”
“দ্বিতীয়ত, সে একা একা ভ্রমণ করছে।”
“এ জেনে কি আপনার কোনো লাভ হবে?” জিজ্ঞেস করলেন নেলি।
“তৃতীয়ত, তার চুলের রং সোনালী।”
“তো?”
“আমাদেরকে প্রথমে যাত্রীদের একটা তালিকা বানাতে হবে। তারপর একজন একজন করে বাদ দিতে হবে।
যাত্রীদের তালিকাটা আছে আমার পকেটে। ওটা বের করে একবার চোখ বুলালাম আমি। তারপর বললাম:
“এই জাহাজে ‘র’ আদ্যাক্ষরওয়ালা পুরুষ যাত্রী আছেন মাত্র তেরো জন।”
“মাত্র তেরো জন?”
“হ্যাঁ, প্রথম কেবিনে। এই তেরো জনের মধ্যে নয় জনের সাথে নারী, শিশু কিংবা কাজের লোক আছে। তারমানে একা একা ভ্রমণ করছে মাত্র চার জন প্রথম জন হলেন দ্য মারকুইস ডে র্যাভারডান…
“আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সেক্রেটারি,” বাধা দিলেন মিস নেলি। “ওনাকে চিনি আমি।”
“মেজর রসন,” বলে যাচ্ছি আমি।
“উনি আমার আঙ্কেল হন,” বলল কে যেন।
“মঁসিয়ে রিভোল্টা। “
“আমি!” চমকে উঠে বললেন এক ইতালিয়ান, ঘনকালো দাড়ি দিয়ে মুখ ঢাকা তার।
হাসিতে ফেটে পড়লেন মিস নেলি। “একটা পাগলেও ওনাকে সোনালি-চুলো বলবে না।”
“বেশ, তাহলে,” বললাম আমি। “তাহলে আমরা মোটামুটি একমত যে এই তালিকার সর্বশেষ জন-ই হলেন সেই কুখ্যাত আর্সেন লুপাঁ।”
“তার নাম কী?”
“মঁসিয়ে রোজাইঁ। কেউ চেনেন তাকে?”
জবাব দিলো না কেউ। পাশে বসা মিতভাষী তরুণটির দিকে ফিরলেন মিস নেলি। মেজাজ গরম হলো আমার।
“তো, মঁসিয়ে রোজাইঁ,” বললেন নেলি। “জবাবটা এবার আপনিই দিয়ে দিন!”
সবগুলো চোখ ঘুরে গেছে তার দিকে। লোকটার চুলের রং সোনালি। আমি নিজেও চমকে গেছি বেশ, অস্বীকার করব না। আর মিস নেলির করা প্রশ্নটির পরে নেমে আসা থমথমে নীরবতা-ই প্রমাণ করে যে, এখানে থাকা বাদবাকি সবাই বেশ সতর্ক হয়ে গেছে। যাহোক, এরকম আশঙ্কা নিশ্চয়ই একেবারেই বানোয়াট। কারণ, এরকম নিরীহ এক ভদ্রলোকের পক্ষে লুপাঁ হওয়া অসম্ভব।
“জবাবটা আমিই দিয়ে দিচ্ছি না কেন?” মুখ খুললেন ভদ্রলোক। “কারণ, নিজের নাম, সোনালি চুল, একাকী ঘোরার বৈশিষ্ট্য তিনটে বিবেচনা করে তো আমারও নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমাকে মনে হয় গ্রেপ্তার করা উচিত।”
কেমন অদ্ভুত স্বরে কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক। তার পাতলা ঠোঁটজোড়া স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই কাছাকাছি হয়ে গেছে। ফ্যাকাশে মুখ আর লালচে চোখজোড়া দেখে অবাক লাগল। কথাটা নিশ্চয়ই মজা করেই বলেছেন, তবে লোকটার হাবভাব যে আকর্ষণীয় তাতে সন্দেহ নেই।
“কিন্তু আপনার তো ক্ষতচিহ্নটা নেই, তাই না?” তাকে বেশিক্ষণ মজা নিতে দিলেন না মিস নেলি।
“তা ঠিক,” জবাব দিলেন ভদ্রলোক। “ক্ষতটা নেই আমার গায়ে।”
তারপর হাতা গুটিয়ে নিজের কাফ খুলে বাহুটা আমাদের সবাইকে দেখালেন তিনি। তাতে অবশ্য সন্তুষ্ট হলাম না আমি। কারণ ডানহাতের বদলে বাঁ হাত দেখাচ্ছেন তিনি। ব্যাপারটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাব, এ সময়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কে যেন।
“হায় হায়! আমার রত্নপাথর, গহনা, মুক্তা সবকিছু কে যেন চুরি করেছে!” লেডি জেরল্যান্ড। মিস নেলির সেই বান্ধবী। ছুটতে ছুটতে আমাদের কাছে এসে এক নিঃশ্বাসে হড়বড় করে বলতে শুরু করলেন তিনি
সবগুলো রত্ন খোয়া যায়নি অবশ্য। শুধু নির্দিষ্ট কিছু জিনিস নিয়ে গেছে চোর। ডায়মন্ড সানবার্স্ট, পাথর বসানো পেনড্যান্ট, ব্রেসলেট আর নেকলেস থেকে সেরা রত্নগুলো খুলে নিয়ে গেছে সে। বেছে বেছে মূল্যবানগুলোই নিয়েছে, যেগুলো আকারে বড়ো কিন্তু কম দামি, সেগুলো রেখে গেছে। পাথরবিহীন অলংকারগুলো এখন পড়ে আছে টেবিলের ওপরে। নির্মমভাবে রত্ন কেটে নেওয়া অলংকারগুলোর দিকে তাকালাম আমি। পাপড়িবিহীন ফুলের মতো ন্যাড়া লাগছে ওগুলোকে।
সকালবেলা লেডি জেরল্যান্ড চা খাচ্ছিলেন যখন, তখনই নিশ্চয়ই ঘটেছে ঘটনাটা। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন একটা রুম থেকে চুরিটা হয়েছে, যেখানে সবসময়-ই মানুষের আনাগোনা চলে। চোর নিশ্চয়ই দরজা খুলে রেখেই রত্নভর্তি বাক্সটি খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। তারপর হ্যাট-বক্সের নিচে লুকানো বাক্সটি বের করে সেখান থেকে মুক্তাগুলো খুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু যে ঘরে নিয়মিত এত লোকের যাতায়াত সেখান থেকে এত অল্প সময়ের মধ্যে এই কাজটা করল কীভাবে?
মুহূর্তের মধ্যেই সবাই একটা সিদ্ধান্তে চলে এলো। এই কাজ আর্সেন লুপাঁ ছাড়া আর কারও হতে পারে না।
সেদিন দুপুরে খাওয়ার সময়ে টেবিলে রোজাইঁয়ের ডানে এবং বাঁয়ে কেউ বসল না। জাহাজের ক্যাপ্টেন তাকে গ্রেপ্তার করেছেন, এ-রকম গুজবও শোনা গেল সন্ধ্যা নাগাদ। কথাটা শুনে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমরা।
আবার আগের মতো নাচ-গান, খেলাধুলায় মত্ত হলো সবাই। বিশেষ করে মিস নেলি এত বেশি হাসাহাসি করতে লাগলেন যে, রোজাহঁকে তিনি আসলেই পছন্দ করতেন কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ হতে লাগল আমার। তার দারুণ রসবোধ আর ব্যক্তিত্ব আরও একবার মন জয় করে নিলো আমার। ওইদিন মাঝরাতে ব্যগ্র হয়ে নিজের আবেগ-অনুভূতির কথা তাকে জানালাম। অসন্তুষ্ট মনে হলো না তাকে।
কিন্তু পরদিন-ই আমাদের সবাইকে হতবাক করে ছেড়ে দেওয়া হলো রোজাহঁকে। তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ মেলেনি। তার জমা দেওয়া ডকুমেন্টও না-কি জাল নয়। বোর্ডউর এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীর ছেলে তিনি। তাছাড়া, তার হাতে কোনো ক্ষত তো দূরের কথা, একটা কাটা দাগও নেই।
“ডকুমেন্টস আর বার্থ সার্টিফিকেট নকল করা তো আর্সেন লুপাঁর জন্য দুধভাত,” রোজাইঁ-বিরোধীদের পছন্দ হলো না ব্যাপারটা। “আর ক্ষতচিহ্নটার কথা বলছেন? হয় ওটা ওর কখনোই ছিল না, কিংবা থাকলেও সেটা মুছে ফেলেছে।”
তারপর জানানো হলো, চুরির সময়ে রোজাইঁ না-কি জাহাজের ডেকে ঘোরাঘুরি করছিলেন। এর জবাবে তার বিরোধীরা বলল, লুপাঁ এতই ধুরন্ধর যে, কোনো জায়গায় উপস্থিত না থেকেও তার পক্ষে চুরি করা সম্ভব। তাছাড়া, সবকিছু বাদ দিলেও একটা প্রশ্নের জবাব কেউ-ই দিতে পারল না। সোনালি চুল,র’ দিয়ে নাম আর একাকী জাহাজে উঠেছেন, এমন মানুষ রোজাইঁ ছাড়া আর কে আছে? রোজাইঁ যদি লুপাঁ না-ই হবে, তবে টেলিগ্রামটা আসলে কার দিকে নির্দেশ করেছিল?
নাশতার কয়েক মিনিট আগে রোজাইঁ আমাদের দলের দিকে এগিয়ে এলেন। তাকে দেখে উঠে চলে গেলেন মিস নেলি আর লেডি জেরল্যান্ড।
ঘণ্টাখানেক পরে নাবিক, স্টুয়ার্ড এবং যাত্রীদেরকে একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট সার্কুলার পড়তে দেওয়া হলো। সেখানে লেখা আছে, আর্সেন লুপাঁকে কিংবা রত্নচোরকে ধরতে পারলে তাকে দশ হাজার ফ্রাঁ উপহার দেবেন মঁসিয়ে রোজাইঁ।
“আর কেউ যদি আমাকে সাহায্য করতে না পারে, তাহলে আমি একাই ধরবো ওই হারামজাদাকে,” ঘোষণা করলেন রোজাইঁ।
রোজাইঁ বনাম আর্সেন লুপাঁ। কিংবা বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, আর্সেন লুপাঁ বনাম আর্সেন লুপাঁ। খেলা জমে উঠতে সময় লাগল না।
পরের দুই দিনে তেমন কিছু ঘটল না। আমরা সারা দিনভর রোজাইঁকে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। তিনি এখানে-সেখানে তল্লাশি চালাতে লাগলেন এবং সবাইকে নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন নিজেও বেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখলেন। চোরের নিজের রুম ছাড়া যে-কোনো জায়গাতেই রত্নগুলো লুকিয়ে রাখা সম্ভব, এই থিওরির ওপর ভিত্তি করে জাহাজের এমাথা-ওমাথা আঁতিপাঁতি করে খোঁজা হলো, স্টেটরুমগুলোও বাদ গেল না।
“ওরা মনে হয় খুব শীঘ্রই কিছু একটা খুঁজে পাবে,” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মিস নেলি। “ও যত বড়ো জাদুকরই হোক, ছোট্ট একটা জাহাজে হীরা আর মুক্তোর মতো জিনিস কতটাই আর লুকিয়ে রাখতে পারবে।”
“তা তো বটেই,” জবাব দিলাম আমি। “তবে ওনার উচিত আমাদের হ্যাট আর ভেস্টের লাইনিংয়ের ভেতরে আর আমাদের সাথে থাকা জিনিসগুলোও ভালোভাবে খুঁজে দেখা।”
অতঃপর নিজের ৯ বাই ১২ কোডাক ক্যামেরা, যেটা দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গীতে তার ছবি তোলা হয়েছে, সেটা দেখিয়ে যোগ করলাম: “এ-রকম আকারের একটা যন্ত্রে কেউ লেডি জেরল্যান্ডের সকল রত্ন লুকিয়ে রাখতে পারবে। সে ছবি তোলার ভান করতে থাকলে কেউ-ই তাকে সন্দেহ করবে না। “
“কিন্তু আমি শুনেছি যে সব চোরই না-কি কোনো-না-কোনো ব্লু রেখে যায়।”
“সেটা হয়তো অনেকের ক্ষেত্রেই সত্য,” জবাব দিলাম আমি। “একজন বাদে। সে হলো লুপাঁ।”
“কেন?”
“কারণ সে শুধু চুরির দিকে মন দেয় না, তার পরিচয় ফাঁস হতে পারে এ- রকম কোনো পরিস্থিতি থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারে।”
“কয়েক দিন আগে আরেকটু বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল আপনাকে। “হ্যাঁ, আসলে চোখের সামনে ওর কারিকুরি দেখে একটু দমে গেছি বলতে পারেন।”
“সব মিলিয়ে এখন আপনার মতামত কী? “
“আমার মতে, অযথাই সময় নষ্ট করছি আমরা।”
আমার কথাই ফলল আপাতত। এত জোর তদন্তের পরেও কোনো সূত্র-ই মিলল না। ইতোমধ্যে-ই, ক্যাপ্টেনের হাতঘড়িটা গায়েব হয়ে গেল। রেগে আগুন হলেন তিনি। চোর ধরার প্রয়াস বেড়ে গেল দ্বিগুণভাবে, রোজাইঁয়ের ওপরেও ভালোমতো নজর রাখা শুরু হলো। কিন্তু পরের দিনেই তার ঘড়িটা পাওয়া গেল সেকেন্ড অফিসারের কলার বক্সে।
এই ঘটনায় আকাশ থেকে পড়ল সবাই। এবার আর্সেন লুপাঁর চরিত্রের রসিক দিকটির সাথেও পরিচয় ঘটল আমাদের। চুরির কাজটাকে সে শিল্পে পরিণত করেছে, আর এই শিল্পের বড়ো সমঝদারও বনে গেছে। সে আমাদের মনে করিয়ে দিলো সেই লেখকের কথা, নিজের লেখা নাটক দেখার সময়ে হাসতে হাসতে হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন যিনি। মুখ বিষণ্ণ করে চুপচাপ ঘুরে বেড়ানো রোজাহঁকে যখনই দেখছিলাম, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠছিল। এ-রকম চৌকস অভিনয় করা সোজা কথা না।
পরেরদিন সন্ধ্যায় ডেকে পাহারারত অফিসার জাহাজের অন্ধকারতম কোনা থেকে একটা গোঙানির শব্দ শুনতে পেলেন। এগিয়ে গিয়ে একটা লোককে পড়ে থাকতে দেখলেন তিনি। তার মাথা একটা পুরু ধূসর স্কার্ফ দিয়ে মোড়ানো, হাত দুইটা মোটা রশি দিয়ে বাঁধা। রোজাইঁ। চোর তাকে মারধর করে ফেলে রেখে গেছে। তার কোটের সাথে পিন দিয়ে আটকে রাখা একটা কার্ড পাওয়া গেল। সেখানে লেখা: ‘মঁসিয়ে রোজাইঁয়ের কাছ থেকে খুশিমনে দশ হাজার ফ্রাঁ উপহার গ্রহণ করল আর্সেন লুপাঁ।’ অবশ্য তার খোয়া যাওয়া পকেট-বুকে বিশ হাজার ফ্রাঁ ছিল।
এর পরেও অনেকে এর জন্য রোজাইঁকেই দোষ দিতে লাগল। তিনি না-কি নিজেই নিজের ওপর আক্রমণের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু একে তো তার পক্ষে নিজের হাত এভাবে বাঁধা সম্ভব না, তার ওপর কার্ডের হাতের লেখাটাও তার সাথে মেলে না। তবে লেখাটা লুপাঁর-ই, পুরানো খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল তার লেখা, সৌভাগ্যবশত সেই পুরোনো খবরের কাগজের একটা কপি জাহাজেও পাওয়া গেল। সেটার সাথে কার্ডের লেখার অবিকল মিল পাওয়া গেল।
রোজাইঁ যে আসলেই কোনো জেন্টলম্যান বার্গলার নন, এটা প্রমাণিত হলো অবশেষে। আর আমাদের মাঝে যে লুপাঁ লুকিয়ে আছে, সেটাও বেশ ভীতিপ্রদ উপায়ে প্রমাণিত হলো।
যাত্রীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চরম আকারে। একা একা স্টেটরুমে যেতে কিংবা জাহাজের মধ্যে ঘুরতেও দ্বিধা বোধ করতে লাগলেন সবাই। ভয়ে একে অপরের কাছাকাছি থাকা শুরু করলাম আমরা। কিন্তু একে অপরের মাঝে বেড়ে যাওয়া এই ঘনিষ্ঠতার মাঝেও ছায়া ফেলছিল অবিশ্বাস।
আর্সেন লুপাঁ এখন যে কেউ-ই হতে পারে। তার অতিমানবীয় ক্ষমতা নিয়ে আমাদের কল্পনা ডানা মেলল আকাশে। হয়তো কোনো ছদ্মবেশ নেওয়া-ই তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কে জানে, সম্মানিত মেজর রসন কিংবা অভিজাত মার্কুই র্যাডোভারডানই হয়তো লুপাঁ। কিংবা তার নাম হয়তো ‘র’ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শুরু হয়েছে। কে জানে বউ, বাচ্চা আর কাজের লোক নিয়েই সে আমাদের সাথে চলছে কিনা!
আমেরিকা থেকে তারযোগে তেমন কোনো খবর এলো না। অন্তত ক্যাপ্টেন আমাদেরকে কিছু জানালেন না। এই ব্যাপারটায় অবশ্য নিশ্চিন্ত হতে পারল না কেউ-ই।
স্টিমারে আমাদের শেষ দিনটা যেন কাটতেই চাচ্ছিল না। অজানা বিপদের শঙ্কায় গুটিয়ে রইলাম আমরা। আগের মতো তুচ্ছ কিছু করে নিশ্চয়ই ক্ষান্ত দেবে না সে। এইবার হয়তো সে সামান্য চুরি কিংবা হামলা না করে বড়ো কিছু করবে। কে জানে, হয়তো কারও প্রাণ-ই নিয়ে নেবে। জাহাজ এখন তার হাতের মুঠোয়, প্রশাসন একদম অসহায় হয়ে গেছে তার কাছে। সে যা খুশি তাই করতে পারে। আমাদের জানমাল সবই তার কাছে জিম্মি।
এই অসহনীয় সময়টাও বেশ ফুরফুরে ভাবে কাটল আমার। কারণ, মিস নেলি আমাকে আস্থার দৃষ্টিতে দেখছেন। এমনিতেই উনি একটু নার্ভাস ধরনের, তার ওপর এসব পিলে চমকে দেওয়া ঘটনাকে সামনা-সামনি দেখে বারবারই আমার কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন তিনি। আর তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তো আমি সবসময়-ই সদা প্রস্তুত। মনে মনে আমি জোর একটা ধন্যবাদ দিলাম আর্সেন লুপাঁকে। সে ছাড়া কী করে মিস নেলির এত কাছে আসতাম আমি? তার কারণেই সুখের স্বপ্ন গাঁথার সুযোগ পেয়েছি আমি। মিস নেলি যে আমাকে অপছন্দ করেন না, সেটাও টের পেয়েছি। তার হাসিমাখা চোখজোড়া অনুপ্রেরণা দেয় আমাকে, তার কণ্ঠের কোমলতা মনে আশা জাগায়।
আমেরিকান উপকূল চোখে পড়ল আমাদের। চোর ধরার সকল প্রচেষ্টা আপাতদৃষ্টিতে বাদ দেওয়া হয়েছে। যে শুভক্ষণে প্রহেলিকার সমাধান পাওয়া যাবে, সেই শুভক্ষণের জন্য উদ্বিগ্নচিত্তে অপেক্ষা করছি আমরা।
আসলে কে এই আর্সেন লুপাঁ? কোন নাম নিয়ে, কার বেশ ধরে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে সে? অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে উপস্থিত হলো। আমি যদি আরও একশ বছরও বাঁচি, তারপরেও এই ঘটনাটি বিন্দুমাত্র মুছবে না আমার স্মৃতি থেকে।
“মিস নেলি, আপনি তো একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন!” নিজের সঙ্গীর দিকে চেয়ে চমকে উঠলাম আমি।
আমার হাতের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছেনও যেন।
“আপনিও তো দেখছি আগের চেয়ে একদম বদলে গেছেন,” জবাব দিলেন নেলি।
“একবার ভেবেই দেখুন ব্যাপারটা কতটা রোমাঞ্চকর! আর এই সময়টা আপনার সাথে কাটাতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। আশা করি আপনার স্মৃতি কোনোভাবে—”
কিন্তু আমার কথা তো শুনছেন না তিনি। একইসাথে ভয় আর উত্তেজনা খেলা করছে তার চেহারায়। জাহাজের গ্যাংওয়ে নামিয়ে দেওয়া হলো। আমরা ওটা বেয়ে নামতে যাওয়ার সময় হঠাৎ ইউনিফর্মধারী কাস্টম অফিসাররা এসে হাজির হলেন সেখানে। মিস নেলি বিড়বিড় করে বললেন:
“সমুদ্র যাত্রার সময় লুপাঁ জাহাজ থেকে পালিয়েছে শুনলে অবাক হবো না।”
“হয়তো অপমানের চেয়ে মৃত্যুই তার কাছে শ্রেয়তর মনে হয়েছে। তাই গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা জেনে আটলান্টিকে ঝাঁপ দিয়েছে সে।”
“ওহ, হাসবেন না তো!”
হঠাৎ করে একটু গম্ভীর হয়ে গেলাম আমি। তার দিকে তাকিয়ে বললাম : “গ্যাংওয়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছোটখাটো বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে দেখছেন?”
“ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি? গায়ে জলপাই-সবুজ কোট?”
“উনিই হলেন গাঁইমার্দ।”
“গাঁইমার্দ?”
“হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা যিনি আর্সেন লুপাঁকে যে-কোনো মূল্যে পাকড়াও করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আহ! সেজন্যই বুঝি আটলান্টিকের এ পার থেকে কোনো সংবাদ পাইনি আমরা। গাঁইমার্দ চলে এসেছেন এখানে!”
“তাহলে কী মনে হয় আপনার? উনি কি আর্সেন লুপাঁকে গ্রেপ্তার করবেন?”
“কে জানে? আর্সেন লুপাঁর ক্ষেত্রে কখনোই স্বাভাবিক কিছু ঘটে না।”
“ওহ!” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন নেলি। এ-ধরনের দুর্ধর্ষ ব্যাপারে নারীদের এ-রকম আগ্রহ দেখানোটা একটু বিরলই বলা যায়। “ওকে গ্রেপ্তার হতে দেখলে খুব ভালো লাগবে আমার।”
“সেটার জন্য আপনাকে আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। গাঁইমার্দকে আমরা যেমন দেখেছি, আর্সেন লুপাঁও তেমন দেখেছে। সে নিশ্চয়ই সহজে স্টিমার থেকে নেমে পড়বে না।”
যাত্রীরা স্টিমার থেকে নেমে পড়ছে এখন। নিজের ছাতায় ভর দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে গাঁইমার্দ। গ্যাংওয়ে ধরে হুড়োহুড়ি করে নামতে থাকা জনতাকে যেন পাত্তাই দিচ্ছে না সে। মার্কুই ডে র্যাভারডান, মেজর রসন, রিভোল্টা-সহ অনেকেই নেমে গেছে ইতোমধ্যে-ই। অবশেষে উদয় হলো রোজাইঁ বেচারা।
“হয়তো ওই আসলে লুপাঁ,” আমার দিকে চেয়ে বললেন নেলি। “কী মনে হয় আপনার?”
“আমার মনে হয় গাঁইমার্দ আর রোজাইঁকে একসাথে দেখতে বেশ মজাই লাগবে। ক্যামেরাটা নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলুন তো, আমার হাত ভরতি।”
তার হাতে ক্যামেরাটা তুলে দিলাম আমি। কিন্তু ছবি তুলতে দেরি করে ফেললেন নেলি। রোজাইঁ ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছেন গোয়েন্দাকে। গাঁইমার্দের পিছে দাঁড়িয়ে থাকা এক আমেরিকান অফিসার সামনে ঝুঁকে তার কানে কানে কী যেন বললেন। শ্রাগ করলেন ফরাসি গোয়েন্দা। তাকে পেরিয়ে গেলেন রোজাইঁ। হে ঈশ্বর, আর্সেন লুপাঁ তাহলে কোন জন?
“হ্যাঁ,” আমার মনের কথাটা শুনতে পেয়েই যেন বললেন নেলি, “তাহলে লুপাঁ কোন জন?”
মাত্র জনা বিশেক লোক আছে এখন জাহাজে। তাদের দিকে তাকিয়ে যাচাই করার চেষ্টা করলেন তিনি। এদের কেউ-ই লুপাঁ নয়, এ-রকম আশঙ্কা করছেন হয়তো।
“আমরা আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না,” আমি বললাম তাকে।
গ্যাংওয়ের দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। তার পিছু নিলাম আমি। দশ কদম হাঁটতে না হাঁটতেই গাঁইমার্দ এসে পথরোধ করলেন আমাদের।
“আচ্ছা, কী হয়েছে?” উত্তেজিত স্বরে বললাম আমি।
“এক সেকেন্ড, মঁসিয়ে, এত তাড়া কীসের আপনার?”
“মাদামোয়াজেলকে এগিয়ে দিচ্ছি আমি।”
“এক সেকেন্ড,” আবার বললেন তিনি। গলায় কর্তৃত্বের স্বর। তারপর সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন:
“আপনিই আর্সেন লুপাঁ, তাই না?”
হেসে ফেললাম আমি। “না, আমি অতি সামান্য বার্নার্ড ডি’আন্দ্রেজি।”
“কিন্তু বার্নার্ড ডি’আন্দ্রেজি তো তিন বছর আগেই মেসিডোনিয়ায় মারা গেছেন।”
“বার্নার্ড ডি’আন্দ্রেজি যদি মরে গিয়েই থাকেন, তাহলে তো আমার এখানে থাকার কথা না। আপনি ভুল করছেন আসলে। এই যে আমার পেপারস।”
“ওগুলো ওনার পেপারস, আর সেগুলো আপনার কাছে কীভাবে এলো, সেটাও বলে দিতে পারব আমি। “
“বোকার মতো কথা বলছেন কেন!” চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “আর্সেন লুপাঁ তো ‘র’ দিয়ে শুরু এরকম কোনো নাম নিয়ে চলছে…”
“হ্যাঁ, ওটাও আপনার আরেক ধাপ্পাবাজি। এসব ভুয়া সূত্র দিয়ে হাভ্রের ওদেরকে বোকা বানিয়েছেন। ভালোই দেখাচ্ছিলেন, কিন্তু এইবার ভাগ্য আপনার পক্ষে নেই।”
এক মুহূর্ত দ্বিধা করলাম আমি। তারপর আমার ডানহাতে জোরে আঘাত করলেন গাঁইমার্দ। যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠলাম। এখনও না সেরে ওঠা ক্ষতটার ঠিক ওপরেই মেরেছেন তিনি। টেলিগ্রামে এটার কথাই বলা হয়েছিল।
আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গতি রইল না আমার। মিস নেলির দিকে ফিরলাম আমি। সব কথাই কানে গেছে ওনার। আমাদের একবার চোখাচোখি হলো। হাতের কোডাক ক্যামেরাটার দিকে একবার তাকালেন উনি। তারপর এমন একটা ভঙ্গি করলেন যাতে বুঝলাম যে ওনার কিছুই বোঝা বাকি নেই আর। হ্যাঁ, কালো চামড়ার ভাঁজের নিচে থাকা খালি জায়গাতেই আমি রোজাইঁয়ের বিশ হাজার ফ্রাঁ আর লেডি জেরল্যান্ডের মুক্তো আর হীরাগুলো রেখেছি। সাবধানতাবশত ওই ছোট্ট যন্ত্রটা তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমি। গাঁইমার্দ আমাকে গ্রেপ্তার করার সময় কিছুই পাবেন না।
গাঁইমার্দ কিংবা তার সহকারীদের কব্জায় আটকে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হওয়া কিংবা সবার চোখে থাকা বিদ্বেষ পূর্ণ দৃষ্টির দিকে নজর ছিল না আমার। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে আমার মাথায় তখন কেবল একটা চিন্তাই ঘুরছিল: মিস নেলি কি আমার সবকিছু ফাঁস করে দেবেন?
চুরির যথাযথ প্রমাণ ছাড়া এরা কেউ আমার কিছুই করতে পারবেন না। কিন্তু মিস নেলি যদি ওগুলো এদের হাতে তুলে দেন? উনি কি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন? উনি কি সেই শত্রুতে পরিণত হবেন, যাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না? না কি আমার প্রতি থাকা সহানুভূতিটা কিছুটা নরম করে দিয়েছে তাকে?
আমার সামনে দিয়ে চলে গেলেন উনি। কিছু বললাম না, মাথা ঝাঁকালাম কেবল। অন্য যাত্রীদের সাথে আমার কোডাক ক্যামেরা হাতে নিয়ে চলে গেলেন তিনি। মনে হলো, সবার সামনে হয়তো আমাকে অপমান করতে চাচ্ছেন না উনি, একটু আড়ালে গিয়ে হয়তো ঠিকই বলে দেবেন।
গ্যাংওয়ে ধরে কয়েক ফুট নেমে ইচ্ছা করেই একটু হোঁচট খেলেন নেলি আর তার হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে তলিয়ে গেল জাহাজ আর ঘাটের মাঝে থাকা সমুদ্রের পানিতে। তারপর গ্যাংওয়ে ধরে হেঁটে গিয়ে দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন। আমার জীবন থেকেও যেন হারিয়ে গেল চিরতরে।
এক মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গেলাম আমি। তারপর গাঁইমার্দকে অবাক করে দিয়ে বিড়বিড় করে বললাম:
“আফসোস যে আমি মানুষটা তেমন সৎ নই।”
.
এভাবেই নিজের গ্রেপ্তার হওয়ার গল্পটা আমাকে শোনাচ্ছিলেন স্বয়ং আর্সেন লুপাঁ। ওইদিন আরও কিছু ঘটনা ঘটায় আমাদের মাঝে কিছুটা হৃদ্যতার সম্পর্ক-ই স্থাপিত হয়েছিল বলা যায়। সে-সব পরে কোনো এক সময়ে বলব। হ্যাঁ, আমার আসলেই মনে হয় যে আর্সেন লুপাঁ আমাদের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সম্পর্কটিকে সম্মানের চোখে দেখেন। সেই বন্ধুত্বের খাতিরেই আমাকে মাঝে মাঝে ডাকেন তিনি।
এরপর আমার লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায় ছড়িয়ে দেন তার তারুণ্যোচিত উচ্ছ্বাস। তার উদ্দীপনা সংক্রমিত করে আমাকেও। বরাবর-ই ভাগ্যদেবীর প্রসন্ন চেহারা দেখা মানুষটার আনন্দ দেখতে ভালোই লাগে আমার।
তিনি দেখতে কেমন? আমি তার চেহারার বর্ণনা দিই কীভাবে? এ পর্যন্ত বিশ বার দেখা হয়েছে তার সাথে, এর প্রতিবারে-ই ভিন্ন ভিন্ন মানুষ হয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। একবার নিজেই বলেছিলেন: ‘আমি যে আসলে কে, তা নিজেই ভুলে গেছি। আয়নার দিকে তাকালে এখন আর নিজেকে চিনতে পারি না।’ তিনি নিঃসন্দেহেই একজন দুর্দান্ত অভিনেতা। আর তার ছদ্মবেশ নেওয়ার ক্ষমতাকে অতিমানবীয় বললে একটুও বেশি বলা হয় না। অনায়াসেই তিনি আরেকজন মানুষের কণ্ঠ আর ভাবভঙ্গি অনুকরণ করতে পারেন।
“কেন আমাকে নির্দিষ্ট একটা রূপ নিয়েই থাকতে হবে?” বললেন লুপাঁ। “সবসময় একই রকম একঘেয়ে ব্যক্তিত্ব ধরে রাখার ঝুঁকিকে এড়ানোর সুযোগ পেলে তা ছাড়ব কেন? আমার কাজই আমার পরিচয় দেবে।”
তারপর কিছুটা গর্বভরে যোগ করলেন:
“সবচেয়ে ভালো হবে কখন, জানেন? যখন মানুষ আমার চেহারা দেখে নিশ্চিত করে বলতে পারবে না আমি লুপাঁ কিনা। কিন্তু আমার কাজ দেখে একবারেই বলে দিতে পারবে: ‘এই কাজ লুপাঁ ছাড়া আর কারও হতে পারে না।”