[পর্ব-১]
পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দুটি ভাব—ঐশ্বর্য ও মাধুর্য। যে সকল লীলাকথা শুনে ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম জাগে, তিনি কত বড় ও মহান মনে হয়, তাকে বলে ঐশ্বর্যভাব। আর যে সকল লীলাকথা শুনে তাঁকে অত্যন্ত প্রিয়জন ও কাছের লোক বলে মনে করা হয়—তা হল মাধুর্যভাব। মাধুর্যভাবেই ভগবান কারো পুত্র, কারো সখা, কারো প্রেমের পাত্ররূপে অপরূপ লীলা করেছেন। মাধুর্যভাবের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ হল রাসলীলা। এটি হল ভাগবতের ভক্তিপ্রেমের শ্রেষ্ঠ পরাকাষ্ঠা। রাসলীলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অংশস্বরূপা গোপীদের সাথে প্রেমাবশে একাত্ম হয়েছেন। মানে সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ এই লীলায় পবিত্র গোপীদের স্বরূপানন্দের আস্বাদন করিয়েছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং আপ্তকাম, সচ্চিদানন্দ, নিত্যতৃপ্ত—তাঁর স্ব-স্বভাবে কোনো অভাব নেই। কিন্তু ভক্তবৎসল, ভক্তাধীন। ব্রজের গোপীরা হলেন তাঁর ভক্ত, তাঁর প্রতি প্রেমপরায়ণ, তাঁতে সমর্পিতা। বলা হয় গোপীরা হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই অংশস্বরূপা—অগ্নি ও দাহিকাশক্তি যেমন আলাদা নয়, তেমনি গোপীরাও শ্রীকৃষ্ণ থেকে পৃথক সত্তা নয়—কেবল লীলা বিলাসের জন্যই আলাদা হয়েছেন। কিন্তু আলাদা হলেও কিন্তু স্ব-ইচ্ছাতে তাঁদের মিলন সম্ভব হয়নি। তা হয়েছিল যোগমায়া দেবীর কৃপাপ্রসাদে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভাগবতে এক্ষেত্রে শক্তিদেবীর উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।
ঘটনা হল কিশোর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ যমুনাতীরে বিচরণ করার সময় অপূর্ব বাঁশি বাজাতেন। আর তা শ্রবণে প্রেমপরায়ণা গোপীদের মনে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গভীর ভালবাসা জন্মায়। এইসময় শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল মাত্র এগারো বছর। কিন্তু তাঁর সুন্দর সৌষ্ঠব অঙ্গ ও দেহগত লাবণ্য সকলের মনকেই গভীরভাবে আকর্ষণ করত। তা শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনে প্রেমবতী গোপীরা তাঁকে পতিরূপে পাবার কামনা করে। এর ফলে তাঁরা বৃন্দাবনস্থিতি কাত্যায়নী দেবীর মন্দিরে পূজা দেয় এবং ব্রত গ্রহণ করেন। ওই ব্রত শেষে গোপীরা তীরে বস্ত্র রেখে যমুনাতে স্নান করার সময় শ্রীকৃষ্ণ তা কৌতুকবশে লুকিয়ে রাখেন। পরে তাঁরা কাকুতি-মিনতি করলে রসরাজ কৃষ্ণ তাঁদের কাছে ডেকে বস্ত্র ফেরত দিয়ে দেন। তবে গোপীদের প্রেমাভাব দেখে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং আগামী পূর্ণিমা রাত্রিতে তাঁদের মনোবাসনা পূরণ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। এই ইচ্ছাই শেষে রাসলীলার শুভ সূচনা করে। রাসলীলা হল ভাগবতের প্রাণ। ভাগবতের দশম স্কন্ধের ২৯ থেকে ৩৩ পর্যন্ত পাঁচটি অধ্যায়ে এই মধুর প্রেমলীলার বর্ণনা আছে—যা অত্যন্দ্র মনোগ্রাহী এবং আনন্দময়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গোপীদের এই আনন্দনৃত্যের অনুষ্ঠানকেই রাসোৎসব বলা হয়। ভারত তথা বঙ্গদেশেও রাস উৎসব এক বিশেষ জনপ্রিয় উৎসব। শরৎকালে আশ্বিন ও কার্তিক মাসে এই রাসোৎসব অনুষ্ঠানের বিধান আছে।
কিন্তু এই উৎসব কোথায় কিভাবে সম্পন্ন হয়েছিল? না—প্রথমে বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে গোপীদের নিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। রাসলীলার প্রধান বৈশিষ্ট্য কী? আনন্দ ও অপার্থিব প্রেমলাভ। ‘রাসনৃত্য’ বলতে বোঝায় অসংখ্য নর্তকীর সঙ্গে একজন নটের মণ্ডলাকারের নৃত্য। এই নৃত্য অতি মনোহর ও অপার্থিব—কারণ নৃত্যের মাঝে প্রত্যেক নর্তকী তাঁদের নটের সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে মিলিত হন—এই নট কিভাবে এতগুলি নর্তকীর সঙ্গে একই সঙ্গে নৃত্য ও আনন্দ করছে তা কেউ ভেবে পায় না। এ কারণে রাসনৃত্য হল অলৌকিক ও অপ্রাকৃত আনন্দ। এমনটা গোলক ছাড়া আর কোথাও সম্ভব হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাসলীলায় মদনমোহন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এখানে কামদেব অপ্রাকৃত প্রেমের কাছে সম্পূর্ণ বশীভূত। তাই রাসলীলাকে কামহারক লীলা বলা হয়। কারণ যে কামদেব বা মদন বিশ্বের সবকিছুকে মোহিত করে মানসপিতা ব্রহ্মার সৃষ্টিকাজ সম্পন্ন করেন, সেই মদন নিজেই এখানে মোহিত হয়ে গেছেন ভগবানের লীলা দেখে—মদনের ভয়ঙ্কর গর্ব এখানে চূর্ণ হয়। মদন অপার্থিব প্রেমের কাছে পরাজয় স্বীকার করেন। তাই কৃষ্ণভক্তিপরায়ণ মহাপণ্ডিত শ্রীধর স্বামী বলেছেন যে, ”যদি কেউ দেহগত কামনা-বাসনার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে চাও, তাহলে গোপীমণ্ডল মণ্ডিত রাসবিহারী মদনমোহনের চরণে শরণাগত হও এবং শ্রদ্ধাভক্তিতে রাসলীলা স্মরণ কর।” প্রসঙ্গত বলা যায় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য শেষ বয়সে পুরীর গম্ভীরায় বসে প্রত্যেকটা দিন রাসপঞ্চাধ্যায়ী পাঠ শুনে গেছেন। এ-কারণে আমার মনে হয়েছে শ্রীকৃষ্ণভক্তি লাভ করতে হলে ভাগবত অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে রাসপঞ্চাধ্যায়টাও স্মরণ-মনন করা দরকার। এতে মনের অযথা কামনা-বাসনা নাশ হয় এবং মনটায় ভগবৎ ভক্তি বৃদ্ধি পায়। তখন শুদ্ধ পবিত্র মনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিবিম্ব স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়ে ওঠে। এখন ‘রাসলীলা’র ভূমিকা রূপে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও ভালবাসার জন পরম শ্রেষ্ঠ ভাগবতাচার্য শ্রীমৎ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজজির বক্তব্যটি এখানে তাঁর সুযোগ্য শিষ্য বন্ধুবর শ্রদ্ধেয় বন্ধুগৌরব ব্রহ্মচারী মহারাজের অনুমতিক্রমে সংযোজন করে দিলাম—যাতে ‘বৃন্দাবনের রাসলীলা’ পড়ার পূর্বে রাসলীলার যথাযথ তাৎপর্য সকলে সহজে বুঝতে পারেন। জয় বৃন্দাবন বিহারীলাল কি জয়। এখন পড়ুন পরমশ্রদ্ধেয় ব্রহ্মচারী মহারাজজির বক্তব্য—
আজ শ্রীকৃষ্ণের শ্রীরাসপূর্ণিমা। রাস কথাটি সম্বন্ধে আজ একটু বলব। ‘রাস’ কথাটি এসেছে ‘রস’ থেকে। রসের আস্বাদনই হল ‘রাস’। একটা সন্দেশ খেলে ভাল লাগে মিষ্টি লাগে। এতে রসের আস্বাদন হয়। কিন্তু সন্দেশ তো আর আমরা সবসময় খেতে পারি না। খেতে খেতে মুখ একসময় লেগে যায়। তখন একটু ঝাল খেলাম, টক খেলাম। তাই এই আস্বাদন স্থায়ী নয়। তাহলে যেটা থাকে সেটা রস। যেটা থাকে না সেটা রস না। সন্দেশটা খেলাম দশটা-বিশটা তারপর পেট ভরে গেল, অন্য কিছু খেলাম; তাই সবই আপেক্ষিক।
কিন্তু ভালবাসার আস্বাদনটা স্থায়ী। ভালবাসার আস্বাদনের কোনটা স্থায়ী? এই যে মা ছেলেকে এত ভালবাসেন। দেখা যায় মাও মরে গেল, ছেলেও মরে গেল। তাহলে এত ভালবাসা গেল কোথায়? ভাই বোনকে ভালবাসে, স্ত্রী তার স্বামীকে ভালবাসেন। মরে গেল আর নেই। তাহলে এত ভালবাসা কোথায় গেল?
তাহলে আমাদের এমন একটা ভালবাসা খুঁজতে হবে যার নাশ হয় না কোনো দিন। সেই স্থায়ী ভালবাসার যে আস্বাদন তারই নাম ‘রাস’। আমাদের জাগতিক ভালবাসার মধ্যে এটি পাওয়া যায় না।
বিভিন্ন শাস্ত্রে পাওয়া যায় এবং শাস্ত্রকারেরা ব্যক্ত করেছেন যে ভগবানের সঙ্গে মানুষের যে ভালবাসা সেটা হল স্থায়ী। কিন্তু দেখা যায় আমাদের যে ভালবাসা সে ভগবানের সঙ্গেই হোক বা মানুষের সঙ্গে, দোষযুক্ত। এই ভালবাসার সবচেয়ে দোষ হল স্বার্থ। অর্থাৎ নিজের সুখ-সুবিধা। এখানে মানুষ ভালবাসে, কত লোক দেশকে ভালবাসে মনে হচ্ছে। স্বার্থ আছে, নাম হবে, খ্যাতি হবে। এই ফাঁকে কিছু টাকা কামিয়ে নেব। তাই যেখানে ভালবাসার মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বার্থ আছে সেখানেই দোষ আছে। নিজের আত্মসুখ অনুসন্ধানই হল ভালবাসার সবচেয়ে বড় দোষ। এতে ভালবাসা থাকে না। দেখা গেল আপনার দ্বারা আমার স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটল, যতই ভালবাসা থাক আপনাতে, আপনার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ঘটবেই। তাই জাগতিক যে ভালবাসা, তা আত্মসুখ অনুসন্ধান দ্বারা দেখা যায় দোষযুক্ত।
প্রকৃত ভালবাসা পাওয়া যায় সেখানেই যেখানে আমার সুখ-শান্তির কিছুমাত্র চিন্তা থাকে না, যাকে ভালবাসি কেবল তার চিন্তা ছাড়া। এই ভালবাসা জগতে নেই। আর নেই বলেই ভগবান তার একটি Ideal বা আদর্শ দেখবার জন্য এসেছিলেন, একটি নির্মল, নিঃস্বার্থ, নির্দোষ ভালবাসা জগৎকে দেখাবার জন্য। এই তত্ত্বের যে যতখানি কাছে যাবে তার ভালবাসা ততখানি নির্মল হবে। শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ গোলোকের পরিকর নিয়ে এসেছিলেন সেখানে তাঁর বাবা ছিলেন, মা ছিলেন, দাদা ছিলেন, ভালবাসার প্রেয়সী ছিলেন। গোলোকের কথা বইতে পাওয়া যায়, দেখেনি কেউ।
মা যে ছেলেকে ভালবাসে তা হল নির্দোষ। এই ভালবাসা দেখা গেল গোপাল ও মা যশোদার ভালবাসার মধ্যে। এই ভালবাসা একেবারে নির্দোষ। এর মধ্যে এতটুকু নিজের সুখকামনা নেই। মায়ের বা বয়স্য সখাদের ভালবাসা এত নির্মল করে দেখানো হয়েছে যে, আত্মসুখকামনা বিন্দুমাত্র নাই। এই ভালবাসা হল ব্রজ-ভালবাসা। মানুষের মধ্যেও এই ভাব দেখা যায়। তবে তা সবসময় থাকে না। কারণ আমাদের ভালবাসার মধ্যে আরো একটি দোষ আছে। সেই দোষ হল আমিত্বভাব। অর্থাৎ আমার ছেলে বলে ভালবাসি, তোমার ছেলে বলে নয়। যদি এমন কোনো মা পাওয়া যায় যে, ছেলে মাত্রেই ভালবাসে তাহলে বলব এখানে ব্রজের মাতৃত্ব এসেছে। মা যে ছেলেকে ভালবাসে সেখানে কোনো দোষ নেই কিন্তু যখন মা বলবে ‘এটা আমার ছেলে’ তখনই সেই ভালবাসায় দোষ প্রবেশ করে। এখন আপনার ছেলের পাশে অপর একটি ছেলে আছে। একসঙ্গে থাকে, খেলা করে। তার প্রতি তো আপনার একইরকম ভালবাসার উদয় হয় না। বরঞ্চ কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হিংসা হয়। কিন্তু হিংসা হলে তো ভালবাসা থাকে না। তাই আমার ছেলে, আমার ভাই, আমার পত্নী, এই আমার আমার ভাব যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ মনে সংকীর্ণতা থেকে যায়।
তাই শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ এমন একটি ভালবাসা দেখিয়েছিলেন যেন ‘পরকীয়া’। শ্রীকৃষ্ণ মা যশোদার নিজের ছেলে নন, দাদা বলরামও নন। কিন্তু তিনি দুই ভাইকে সমানভাবে ভালবেসেছিলেন। এমনকি শ্রীকৃষ্ণের বয়স্য রাখাল বালকদেরও তিনি সমানভাবে ভালবাসতেন। এইভাবে ভালবাসা একমাত্র সম্ভব হয়েছিল কারণ এতে ‘আমার আমার’ ভাব বিন্দুমাত্র ছিল না। শ্রীবৃন্দাবনে বাৎসল্যে, সখ্যে ও মধুরে এই তিনটি রসেই এই ভালবাসার প্রকট ঘটেছিল। সখ্যে ও বাৎসল্যে এই ভালবাসার পরিপূর্ণতাটা ঠিকমতন আসে না। বাৎসল্যে নিজেকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেওয়া যায় না। যে রসে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দেওয়া যায়, আত্মসুখবাঞ্ছা বিন্দুমাত্র থাকে না, সেটি হল উন্নত ও উজ্জ্বল। তা মধুর রসে আছে। উন্নত উজ্জ্বল কথাটি শাস্ত্রে আছে।
এইভাবে ধীরে ধীরে শাস্ত্র আলোচনা করলে দেখা যায় ‘উন্নত’ অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ‘উজ্জ্বল’ যার মালিন্য নেই এই দুই মধুর রসেই আছে। জাগতিক প্রেম উন্নতও নয়, উজ্জ্বলও নয়। এইভাবে বাছতে বাছতে শাস্ত্র দিয়ে, নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে বসে ধ্যান করলে চিন্তা করলে বুঝতে পারা যাবে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণে যে শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসা সেটি হল ‘উন্নত উজ্জ্বল রস’। এই রসের সংবাদ ব্রজে আছে। ব্রজে এই লীলা হয়েছিল। আমরা ভাল করে জানতাম না। মহাপ্রভু এসে ভালভাবে জানিয়ে দিয়ে গেছেন। মহাপ্রভু জানিয়েছেন বই দেখে নয়, আলোচনা করে নয়, নিজ জীবনে এই রস আস্বাদন করে। তাঁর এই আস্বাদন শাস্ত্রকারেরা চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে যতটুকু ব্যক্ত করতে পেরেছেন তার থেকে জানা গেল যে ‘উন্নত উজ্জ্বল রস’ ব্রজলীলাতে অর্থাৎ শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলাতে আছে। এটি মেনে নিতে হবে না, বিচার করলেই বুঝতে পারা যাবে। এই যে একটি আদর্শ প্রেম, তার যে আস্বাদন সেটিই হল ”রাস”।
এখন প্রশ্ন হল, এসব জেনে আমাদের লাভ কী? লাভ বিস্তর। রাধার যে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেম বা গোপীদের যে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেম তার ছিটে কণা আমাদের মধ্যেও আছে। সেই প্রেমবীজকে কৃষ্ণপ্রীতির দ্বারা প্রস্ফুটিত করতে হবে। একটা ক্ষুদ্র বীজ ঠিক মতন আলো, বাতাস ও জল পেলে যেমন একটা বিরাট মহীরুহে পরিণত হয় ঠিক তেমন ভগবান প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে প্রেম দিয়েছেন তা ঠিক পথে গেলে জীবের কৃষ্ণপ্রাপ্তি হয়। এ প্রেম ভগবান সবাইকে দিয়েছেন। পশু পাখির মধ্যেও দিয়েছেন। বাঘ যে এত হিংস্র জন্তু, কই, সে তো তার বাচ্চাদের খায় না। বিড়াল তার বাচ্চাদের পা কামড়িয়ে দেয়, কই দাঁত তো বসায় না। তাই প্রাণী মাত্রেই এক বিন্দু ভালবাসা আছে; একমাত্র মানুষেই এত পরিপূর্ণতা ব্যক্ত হয়েছে।
কিন্তু মানুষের যেখানে এই ভালবাসা দেওয়া দরকার সেখানে সে দেয় না। যেমন আপনার অনেক অর্থ আছে কিন্তু কোথায় দিলে যে সমাজের কল্যাণ হবে, বিশ্বের কল্যাণ হবে তা সে জানে না। দেখুন, সামান্য পুজোয় লক্ষ লক্ষ টাকার বাজি মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। এছাড়া আলো প্যান্ডেল এসবের কথা তো বাদই দিলাম। যে টাকা বাজিতে খরচ হয় সে টাকা দরিদ্র লোকদের দেবে না। তাই অর্থ আছে কিন্তু সে অর্থ কোথায় দিলে যে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ হবে তা আমরা জানি না। ঠিক তেমন হৃদয়ের মধ্যের ভালবাসা কোন দিকে দিলে যে তার সদব্যবহার হবে সেটা আমরা বুঝতে পারি না। তাই তারই একটা আদর্শ দেখলাম শ্রীবৃন্দাবনে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সমর্পিত ভালবাসার পরিপূর্ণ রসের আস্বাদন হয়েছিল।
এই ভালবাসার কথা যদি আমরা ভাবনা করি, চিন্তা করি, স্মরণ করি, শ্রবণ করি তাহলে আমাদের হৃদয়ে যে প্রেমের ক্ষুদ্র বীজ আছে তা আলো বাতাস পাবে। সেই বীজ কৃষ্ণকথা, কৃষ্ণলীলা, তাঁর সৌন্দর্য মাধুর্য, তাঁর ভক্তবাৎসল্য স্মরণ-চিন্তন-আস্বাদন দ্বারা পরিস্ফুট হয়। আর তা না হলে সেই ভালবাসা সংকীর্ণ হতে হতে হিংসায় পরিণত হয়। এর থেকে জন্ম নেয় বিদ্বেষ। এতে মানুষের ক্ষতি হয়, সংসারের ক্ষতি হয়। একটা ভাল বস্তু যদি নষ্ট হয়ে যায় তার থেকে ক্ষতির আর কি আছে? তাই মানুষ তার হৃদয়ের ভালবাসা শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করলেই তা সার্থক। আর কৃষ্ণকে সেই ভালবাসা উজাড় করে দেওয়ার উপায় হল তাঁর রূপ, গুণ, তাঁর মাধুর্য, তার সৌন্দর্য পুনঃপুনঃ স্মরণ করা। অর্থাৎ ভক্তিপথের সাধনপথের যতগুলি প্রণালী আছে এই সবগুলি যদি শ্রীকৃষ্ণার্থে হয় তাহলেই সেই ভালবাসা পরিস্ফুট হবে। যাঁদের হয়েছিল পরিপূর্ণভাবে তাঁদের দেখা গিয়েছিল শ্রীবৃন্দাবনে। যাঁদের দেখে আপনি বুঝবেন ভালবাসা এইরকম হয়।
শ্রীবৃন্দাবনের এই ভালবাসার কথা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম বলে মহাপ্রভু এসে তা আস্বাদন করেছেন। রাধাভাবে বিভাবিত হয়ে গম্ভীরায় তিনি যখন ছিলেন রাধার শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যে অনুরাগ, তা যে কত গভীর, তা যে কত তীব্র তা তিনি আস্বাদন করেছেন। মহাপ্রভু এসে না আস্বাদন করলে আমরা কেবল ভাগবত পড়ে তা বুঝতে পারতাম না। এইজন্য বৈষ্ণবমহাজন পদ লিখেছেন—
”যদি গৌর না হইত, কেমনে হইত
কেমনে ধরিতাম দে’।
রাধার মহিমা, প্রেমরস সীমা
জগতে জানাত কে।।”
জানিয়েছেন শ্রীল শুকদেব। কিন্তু শুকদেব যে জানিয়েছেন তা আমরা নিতে পারিনি। মহাপ্রভু এসে তা নতুন করে জানিয়েছেন। এটিই হল মহাপ্রভুর মহাদান। এই দানের সঙ্গে মহাপ্রভু দিলেন নাম যা দিয়ে এই দান ধরে রাখতে হবে। যেমন আপনাকে অনেকগুলি ফুল দেওয়া হল আপনি সেগুলি একসঙ্গে ধরে রাখবেন কিভাবে? তাই সুতো দিয়ে গেঁথে রাখলেন। তেমনই মহাপ্রভু এই প্রেমকে ধরে রাখার জন্য নাম রূপ সুতো দিলেন। নাম সাধন কর, নাম আস্বাদন কর। আর এই নাম আস্বাদন করবার জন্য বন্ধুসুন্দর এসেছেন। তিনি একেবারে রসানন্দে তন্ময় হয়েছিলেন। মহাপ্রভু গম্ভীরায় ছিলেন বারো বছর। তবে তিনি বের হতেন। শ্রীজগন্নাথ দর্শনে যেতেন। রায় রামানন্দ স্বরূপ দামোদর এঁদের সঙ্গে কথা বলতেন। রথের সময় নৃত্যাদি করতেন। কিন্তু জগদ্বন্ধুসুন্দর একেবারে নিরবিচ্ছিন্ন ষোল বছর আট মাস এই রাধাপ্রেম আস্বাদনে ডুবে ছিলেন। এই সময়ে তিনি যা আস্বাদন করেছিলেন তার কিছু ভাব তাঁর লিখিত পদ সমূহের মধ্যে আছে। গৌরসুন্দর কিছু লিখে যাননি। আটটি শ্লোক বলেছিলেন শ্রুত হয়। প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দর লিখেছিলেন রাধার প্রেমের কি আস্বাদন। রাধাভাবে মণ্ডিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের গৌররূপে কি আস্বাদন? গৌর কি আস্বাদন করেছিলেন গৌর তা প্রকাশ করেননি, নিতাই কিছু করেছিলেন এবং নিতাই গৌর এক তনু হয়ে বন্ধুসুন্দর সেই আস্বাদন তাঁর পদপদাবলীতে লিখে গেছেন। প্রভু জগদ্বন্ধুর গৌরের পদ লিখেছেন—
”গোরা রা রা রা রা বলে
ধা বলিতে পড়ে ঢলে”
এই ভাব চৈতন্যচরিতামৃতে বা চৈতন্যভাগবতে দেখা যায় না। এখানে প্রভু তাঁর নিজের কথাই বলেছেন। জগদ্বন্ধুসুন্দরও ”রাধা” বলতে পারতেন না। ”রা” বলে ধা বলতে গেলেই তাঁর ভাব-সমাধি হত। চৈতন্যজীবনী-গ্রন্থে এইসব নেই। জগদ্বন্ধুসুন্দর পদ লিখেছেন—
”ছিল গোকুলে বিলাস, হল নবদ্বীপে বাস,
জগদ্বন্ধু বলে কালে কালে কত কিবা হবে হায়।”
এখানে তিনি তাঁর নিজের আসবার কথা লিখেছেন। প্রভু রাধা নাম উচ্চারণ করতে পারতেন না। এক ভক্ত ছিল রাধিকা। তাকে ডাকতেন শ’রিকা বলে। যদি রাধা বলতে হত তবে বলতেন ”তোদের অমুক” ”তোদের ভানুদুলালী”। উচ্চারণ করলেই বিভোর হয়ে যেতেন। অত্যন্ত বিশুদ্ধ, কঠোর ব্রহ্মচর্য ও তপস্যাযুক্ত মন না হলে বন্ধুসুন্দরের রসাস্বাদনে নিমজ্জিত হওয়া খুবই কঠিন। তাই বন্ধুসুন্দরের মধ্যে নিমজ্জিত হলেই সেই ”উন্নত” ও ”উজ্জ্বল” রসের আস্বাদন ঘটবে যে আস্বাদন হয়েছিল শ্রীবৃন্দাবনে।
তা হলে দেখা গেল শ্রীবৃন্দাবন হল ”আস্বাদন ভূমি”, আর সব ”আস্বাদনের আস্বাদন”। ব্রজের যে আস্বাদন তা আস্বাদন করেছেন গৌরসুন্দর আবার গৌরের আস্বাদনের যে অভিনবত্ব তা আস্বাদন করেছেন বন্ধুসুন্দর। গৌর যে কত সুন্দর, গৌর যে কত মধুর, তাঁর কথা যে কত আনন্দদায়ক তা গৌর নিজে বুঝেননি। নিতাই কিছু বুঝেছিলেন এবং নিতাই-গৌর মিলিত তনু বন্ধুসুন্দর তা আস্বাদন করেছেন।
রাধাভাব আস্বাদনের স্বাদ ছিল শ্যামসুন্দরের। শ্রীরাধা হলেন হ্লাদিনী শক্তি। শ্রীরাধার কতগুলি ভাব ও রূপ বুঝতে হবে রাস দেখতে হলে। বর্তমান বিজ্ঞান স্বীকার করেছেন একটি শক্তি থেকে জগৎ হয়েছে। এই শক্তিকে বেদ বলেছেন ”আনন্দ শক্তি”। বেদে আছে—
”যতো বাচো নিবর্তন্তে মনসা সহ।
আনন্দ ব্রহ্মণো বিদ্যা ন বিভেতি কদাচন।।”
আনন্দ থেকেই জগৎ হয়েছে। আনন্দ থেকেই জগৎ বেঁচে আছে, এটা বই পড়ে জানতে হয় না। জগৎ যদি আনন্দশূন্য হত তাহলে মানুষ বাঁচতে পারত না। শ্রুতিতে আছে ”কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদ্যেষঃ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ।”
কোথাও যদি আনন্দ না থাকত তাহলে মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসও নিতে পারত না। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে যে পরিশ্রম হয় সেটাও মানুষ করতে চাইত না যদি কোথাও আনন্দ না পেত।
আমাদের সাধারণ জীবনেই দেখি, একজন লোক সকালে উঠে বর্ধমান থেকে কলকাতায় এসে অফিস করে, তারপর সারাদিন খেটে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরে। এত সে খাটে কিভাবে? কোথাও তো একটা আনন্দ আছে। বাড়ি ফিরে গেলে ছেলে বাবা বলে কোলে এল, স্ত্রী এল, বন্ধুবান্ধবেরা এল। এর মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। আর এই আনন্দের জন্যই সে সারা দিন ধরে পরিশ্রম করে। এই আনন্দ হল একটি শক্তি। ভগবানের এই আনন্দশক্তিরই নামই হল ”রাধা”। ভগবানের আরো অনেক শক্তি আছে। আমার আপনারও অনেক শক্তি আছে। বাক্শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, চিন্তাশক্তি। কিন্তু শ্রেষ্ঠ শক্তি হল ”আনন্দশক্তি”। তাহলে বিজ্ঞান যে শক্তির কথা স্বীকার করেছেন সে শক্তি রাধাকৃষ্ণের মধ্যে আছে।
রাধার যে কি মহিমা, সে যে কত মধুর তা জানতে শ্রীকৃষ্ণের লালসা হয়েছিল, এটি দেখানো হয়েছে চৈতন্য-চরিতামৃতে। ”গৌরকথায়” এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের যে বাঞ্ছা শ্রীরাধাকে জানতে তা তিনি গৌররূপে পূরণ করেন। আবার গৌরের যে আস্বাদন তা বন্ধুসুন্দর আস্বাদন করে বিভোর হয়েছিলেন। ষোল বছর আটমাস তিনি সেই রস নীরব ও নিশ্চুপ হয়ে আস্বাদন করেছেন। তিনি ভগবান, ভগবান হয়েই এসেছিলেন। অন্যান্য সাধকদের দেখা যায় ভজন-সাধন করতে। তিনি কিছুই করেননি। তাঁর যে ঈশ্বরভাব তিনি তাতেই স্থিত হয়ে ছিলেন এবং কঠোর ব্রহ্মচর্য দ্বারা ব্রজের সেই উন্নত উজ্জ্বল রস আস্বাদন করেছেন। রস আস্বাদনের এই হল মূল কথা। ভগবানের আনন্দ শক্তি ভগবান যখন নিজে আস্বাদন করেন সেটাই হল রাস।
সন্দেশ আমরা সকলেই খাই। সন্দেশ যখন দোকানে থাকে তখন তার আস্বাদন আপনি পান না। আপনার সামনে ধরা হল, তখনও আপনি পান না। কিন্তু যখনই আপনি সেটা তুলে মুখে দিলেন, আপনার জিহ্বার সঙ্গে সেটা যখন মাখামাখি হয়ে গেল তখনই তার স্বাদ আপনি পেলেন, সন্দেশটা আপনার মিষ্টি লাগল। তাহলে সন্দেশটিকে জিহ্বার সঙ্গে মাখামাখি হতে হবে। ঠিক তেমনি রাসের আস্বাদন পেতে হলে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীরাধার, ভগবানের সঙ্গে ভক্তের বা গোপীদের একেবারে মাখামাখি হয়ে যেতে হবে।
রসশাস্ত্রে দুটি শব্দ আছে ”আশ্রয় ও বিষয়”। আশ্রয় কথাটির মানে হল ভালবাসা যার মধ্যে থাকে, আর যাকে ভালবাসা হয় সে হল বিষয়। অর্থাৎ বিশ্বজগতের যিনি ‘আশ্রয়’, রসশাস্ত্রে তিনি ‘বিষয়’। তাই বাৎসল্য রসের আশ্রয় শ্রীকৃষ্ণ নন, যশোদা; সখ্য রসের আশ্রয় সুবল সুদাম, মধুর রসের শ্রীমতী। শ্রীকৃষ্ণ যখন বিশ্বপতি তখন তিনি আশ্রয়, যখন প্রেমের ঠাকুর তখন তিনি বিষয়। রাধারানী আশ্রয় হলে শ্রীকৃষ্ণ বিষয় হলেন। রাধারানী এত বড় যে তাঁকে আশ্রয় না করলে শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়াতে পারবেন না। তাই রাধাকে বাদ দিলে কৃষ্ণকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই শ্রীমতী হলেন আশ্রয়স্থল।
প্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ”আপনার গুরু কে?” প্রভু উত্তর দিয়েছিলেন, ”তোদের ভানুনন্দিনী”। শ্রীমতী শ্রীকৃষ্ণের গুরু, গৌরের গুরু, আবার গোপীদেরও গুরু। প্রশ্ন আসে, তিনি কেন গুরু হলেন? শ্রীকৃষ্ণের লালসা ছিল শ্রীরাধাকে জানবার। রাধার কি মাধুর্য, তাকে ভালবেসে আস্বাদন করে রাধার কি সুখ এইসব জানবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ পাগল হয়েছিলেন, তাহলে এটা রাধারই চিন্তা। যিনি ইষ্ট, যাঁকে পেলে জীবন ধন্য হবে তিনিই তো গুরু। তাই রাধাই শ্রীকৃষ্ণের গুরু, তিনি গৌরেরও গুরু, আবার নিতাই-এরও গুরু। বন্ধুসুন্দর এইভাবে আস্বাদন করতেন। রাধারানী দুইভাগ হয়েছিলেন রাধারানী ও চন্দ্রাবলী। এখন খেলতে গেলে তো দুইভাগ হতেই হবে। সে আপনি ফুটবল-ক্রিকেটই বলেন বা ঘরে বসে তাস-পাশাই বলেন। এক দলে তো আর খেলা না। তাই লীলা আস্বাদনের জন্যই চন্দ্রাবলী সৃষ্টি হয়েছেন। ইনি রাধারই শক্তি। লীলা আস্বাদনে তিনি হলেন শ্রীরাধার opposition (বিরুদ্ধপক্ষ)। শ্রীকৃষ্ণ যখন মথুরায় চলে গেলেন তখন আর কোনো ভেদ নেই, দুইজনেই কাঁদছেন। চন্দ্রাবলী এসে দেখলেন রাধা যতখানি শ্রীকৃষ্ণবিরহে কাতর হয়েছেন আমি তো তত হইনি। তখন চন্দ্রাবলী বুঝতে পারলেন আমার চেয়ে রাধার ভালবাসা অনেক গভীর এবং যদি কোনোদিন শ্রীকৃষ্ণ শ্রীবৃন্দাবনে আসেন তবে তিনি রাধার জন্যই আসবেন। রাধারানী চন্দ্রাকে বললেন, ”আমি তো মরে যাচ্ছি। আমার কৃষ্ণ আসবেন। তিনি বলে গেছেন কালই আসবেন। তাই আমার নীলরতন আমি তোদের দিলাম। কৃষ্ণ ও কৃষ্ণনাম অভিন্ন তাই তোদের কৃষ্ণনাম দিয়ে গেলাম”—এই বলে চন্দ্রাবলীর কর্ণে রাধারানী দিলেন কৃষ্ণনাম। এই নাম শুনতে-শুনতে চন্দ্রাবলী তন্ময় হয়ে গেলেন। তিনি হলেন নিত্যানন্দ আর রাধারানীর মধ্যে কৃষ্ণ প্রবেশ করে তিনি গৌররূপ ধারণ করলেন। তাহলে নিতাই, গৌর, রাধা, কৃষ্ণ, চন্দ্রাবলী সব একই কথা।
রাধা-কর্তৃক নাম দানে চন্দ্রাবলীর দেহে তাহলে রাধা গুরু হলেন। রাধা কৃষ্ণের গুরু, গৌরের গুরু, নিতাই-এর গুরু এবং গোপীদেরও গুরু। এই বিশ্বসংসারে সবারই গুরু। তিনি আনন্দশক্তি। মানুষ যেখানে আনন্দ পায় সেখানে ছুটে যায়, সেখানে সে স্থির হয়ে যায়। মানুষের মধ্যেও সেই আনন্দ আছে। এই আনন্দই হল রাধারানী। তিনি আশ্রয় এই আশ্রয়ের সঙ্গে যখন বিষয়ের অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের গাঢ় মিলন হয় তখন সেটাই হল ”রাস”।
রস আস্বাদনের সেই ইচ্ছা পরিপূর্ণ হয়েছিল শ্রীবৃন্দাবনে। ‘হয়েছিল’ আমাদের ভাষায়। শাস্ত্রের ভাষায় হচ্ছে, এর কোনো বিরাম নেই। ভালবাসা অবিনশ্বর, এর কোনো বিরাম নেই। খাওয়ার সুখ নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু ভালবাসা থেকেই যায়। সংসারে অবশ্য মৃত্যুতে বিরতি হয়। কিন্তু আমরা বলি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হয়। গুরু-অনুগত হয়ে ভজন করলে, সাত্ত্বিক ভাবে থাকলে শাস্ত্রে বলে এই ভালবাসা জন্মে জন্মে থেকে যায়। তাহলে এই প্রেম দেখা গেল নির্দোষ ও স্থায়ী বস্তু। আর তারই প্রকট মূর্তি শ্রীরাধা।
রাধা ও কৃষ্ণ একই বস্তু, রস আস্বাদনের জন্য বিভেদ হয়েছেন। তাঁদের আবার যে পরিপূর্ণ মিলন সেই মিলনের নামই হল রাসলীলা। এই লীলা হয়েই চলেছে। অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু যুগল-কিশোরের লীলা শেষ হয় না। এই জন্য সংসারের একমাত্র নিত্যবস্তু হল যুগলকিশোর ও তাঁদের প্রেম। রাধা-কৃষ্ণ আলাদা হয়ে আস্বাদন করেন, আবার মিলতে-মিলতে যখন একেবারে এক হয়ে যান তখন গৌর হয়ে যান। আবার নিতাই গৌর পৃথকরূপে আস্বাদন করেন, আবার গাঢ় আলিঙ্গনে একেবারে এক তনু হয়ে বন্ধুসুন্দর রূপে আস্বাদন করেন। এই আস্বাদন অনন্তকালের জন্য স্থায়ী। প্রত্যেকক্ষণেই হচ্ছে। এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রকট হয়েছিলেন দ্বাপর যুগের শেষভাগে ব্রজধামে। এখন আছেন অন্য ধামে। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড আছে। রাত্রে তো আমরা সূর্য দেখতে পাই না। তাই বলে কি সূর্য নেই? আবার দেখুন সূর্য একটি তারা। এমন আরো অনেক তারা আছে। তাদের ঘিরে সৌরজগৎ আছে। এইসব চিন্তা করলে বিজ্ঞানও মূক হয়ে যায়। এই যে milky way বা galaxy দেখতে পাওয়া যায় এগুলি এক একটা ব্রহ্মাণ্ড। এগুলি যে কত বড় তা আমরা কল্পনার মধ্যেও আনতে পারব না। তাই এই লীলা কোনো না কোনো ব্রহ্মাণ্ডে হয়েই চলেছে। আমরা যদি তা স্মরণ করি সেটাই হল লীলা।
শ্রীবৃন্দাবনে যেখানে এই লীলা আস্বাদন ঘটেছিল সেখান থেকেও এই লীলার উৎপত্তি হয়নি। আবার যেখানে এই লীলাটা হয় সেখানে তিনি থেকে যান। প্রকটলীলা কিছুটা অপ্রকট হয়ে ভক্তের স্মরণ, চিন্তন ও ধ্যানে অবস্থান করেন। ব্রজে এই লীলা নিত্য। একদিন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কিছুই ছিল না। আবার একদিন মহাপ্রলয়ে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু যুগলকিশোরের এই লীলা নিত্য ও অনন্তকাল থাকবে। এটি constant। তাই রাসলীলার যে আস্বাদন হয় তা আছে বলেই।
বৃন্দাবন তিন প্রকারের—ধাম বৃন্দাবন, নিত্য বৃন্দাবন ও লীলা বৃন্দাবন। আমরা যেখানে যাই সেটা হচ্ছে ধাম। এর মধ্যে আছে নিত্য বৃন্দাবন এবং তার মধ্যে লুকিয়ে আছে লীলা বৃন্দাবন। একেবারে শুদ্ধ ভাবচক্ষু ও প্রেমচক্ষু না হলে লীলা বৃন্দাবন দেখা যায় না। যেমন অর্জুনকে জ্ঞানচক্ষু দিয়ে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। তেমনি সাধকদের একটি ভাবচক্ষু বা প্রেমনয়ন আছে যার দ্বারা তাঁরা লীলা বৃন্দাবন দর্শন করেন। গোলোকেও এই লীলা হয়ে চলেছে। গোলোক কোথায় তা আমরা জানি না। সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্র। আবার সূর্য তার সৌরজগৎকে নিয়ে কোনো centre-কে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেই centre আবার কোনো centre-কে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে যেখানে একেবারে স্থির সেটাই গোলোক। এই গোলোকের কথা শাস্ত্রে আছে। সেই গোলোকের ভগবান যখন ভূলোকে আসেন তখনও সেখানে এই লীলা নিত্য।
শাস্ত্রকারেরা সাধকেরা গোলোকের এই লীলা স্মরণ করেন না। কারণ, সেখানে কেবলই মিলন, বিরহ নেই। এইজন্য এই লীলা আস্বাদন করে কোনো চমৎকারিতা লাভ হয় না। এই বিরহ আস্বাদন করতেই ভগবান মর্ত্যে আসেন। বন্ধুসুন্দর এই বিরহ আস্বাদন করতে এসেছিলেন। ভক্তেরা তাঁকে বিরহের গান শোনাতেন, দশমদশার গান। তিনি এই বিরহে তন্ময় হয়েছিলেন এখনো আছেন দশাশ্রয়ে। রাসলীলার মধ্যেও বিরহ আছে। বিরহ এই লীলাকে উদ্বুদ্ধ করে।
ভগবান হলেন আনন্দঘন। সেই আনন্দঘনের যে আনন্দশক্তি, সেই শক্তির সঙ্গে আনন্দঘন পুরুষের যখন চরম আস্বাদন ঘটে তারই নাম হল রাস। ঠিক যেমন সন্দেশের সঙ্গে জিহ্বার মাখামাখি। এই হল রাসের তত্ত্বকথা। এই আস্বাদনকে যতটুকু ভাষায় প্রকাশ করা যায় তা শুকদেব সংস্কৃত ভাষায় বলেছেন। পরে শ্রীরূপ ও সনাতন গোস্বামী তার ভাষ্য করেছেন এবং সেই রস বাইরে এনেছেন। অর্থাৎ যে রস এতদিন গুপ্ত ছিল তা বাইরে এসেছে। সাধু মহাজনেরা এই রস আস্বাদন করেছেন এবং আমাদেরও এই রস আস্বাদন করতে হবে। কারণ আস্বাদন হতে বড় আর কিছুই নাই।
রাস আস্বাদন হল শ্রীরাধা-গোবিন্দের মিলনের একেবারে চরমতম অবস্থা। এই সময় তাঁরা এক হন। এক হন, আবার দুইও থাকেন। একে আমাদের বৈষ্ণবশাস্ত্রকারেরা বলেছেন ”ভেদাভেদ”। এখানে একটা প্রশ্ন আসে, ”ভেদ হলে অভেদ হবে কেন? আবার অভেদ হলে ভেদ হবে কেন?” এইজন্য শ্রীজীব গোস্বামী বিধান দিয়েছেন ”অচিন্ত্য”। বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারবেন না। রস আস্বাদন করুন তাহলে বুঝতে পারবেন। ভেদাভেদ হয়। দুধ ও চিনি একসঙ্গে মিশানো। দুটোর স্বাদই বুঝতে পারবেন। এটি এমনই একটি রস আস্বাদন যেখানে রাধা-গোবিন্দ সর্বাঙ্গভাবে মিলনে এক হয়েও আছেন আবার দুই হয়েও আছেন। এটি তর্কবিচারে বোঝা যায় না। সেই জন্য শ্রীজীব গোস্বামী বলেছেন ”অচিন্ত্য” বা চিন্তার অতীত। একমাত্র আস্বাদনের মধ্য দিয়েই ভাবকে ধরা যায়। বন্ধুসুন্দর লিখেছেন। ”শ্রীরাধাগোবিন্দ গাঢ় আলিঙ্গনে মিশে যাচ্ছেন। তখন ললিতা রাধাকে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে বললেন, ‘মিশে গেলে সুখ পাবি না। যদিও এতে এক হয়ে যাবি, তবে এতে ক্ষতি হবে, দুঃখও পাবি।’ দুঃখ কি হবে? ‘কৃষ্ণচন্দ্রের শ্রীবদন তো আর দেখতে পাবি না।’ শ্রীমতী বললেন, ‘তাহলে আর আমার এক হয়ে কাজ নাই’।” যতখানি মিশে গেলেন ততখানি গৌর হলেন, যতখানি বাকি ছিল ততখানি গদাধর হলেন।
তাই মিলনে একটা সুখ আছে, পৃথক থেকেও একটা সুখ আছে। পৃথক থেকে তাঁর শ্রীবদন দেখা যায় তাঁকে ছোঁয়া যায়, তাঁকে আদর করা যায়। কিন্তু এক হয়ে গেলে তা আর হয় না, তাই এক না, দুইও না, এমনই এক অবস্থা যার নাম ভেদাভেদ। রাসে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর হ্লাদিনী শক্তির যে আস্বাদন হয় তা ভেদাভেদ। কৃষ্ণ রাধাকে আস্বাদন করবার জন্য বহু হলেন, আবার রাধা কৃষ্ণকে আস্বাদন করবার জন্য বহু হলেন। রাধা কৃষ্ণের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলেন কৃষ্ণের অপর পাশে তিনি নেই। তাই তিনি বহু হয়ে কৃষ্ণের অপর পাশে দাঁড়ালেন। কৃষ্ণ দেখলেন দুই রাধার অপর দুই পাশে তার স্পর্শ নেই, তাই তিনি আরো দুই রূপ ধারণ করে রাধার অপর দুই পাশে দাঁড়ালেন, আবার কৃষ্ণের অপর দুই পাশে দুই গোপী দাঁড়ালেন, আবার গোপীদের দুই পাশে কৃষ্ণ দাঁড়ালেন। এইভাবে হতে হতে রাসমণ্ডলী গঠিত হল। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ আস্বাদন করবার জন্য রাধা বহু হলেন, আবার শ্রীকৃষ্ণ বহু হলেন শ্রীরাধাকে আস্বাদন করবার জন্য। এই হল রাসলীলা।
”অঙ্গনামঙ্গনাম্ অন্তরা মাধবঃ”
দুই দুই গোপী এক এক কৃষ্ণ, এক এক গোপী দুই দুই রাধা। এর অর্থ হল, আমি আপনাকে আদর করতে দুই হাত দিয়ে ধরতে পারছি না, আপনি যদি আমাকে একসঙ্গে বেষ্টন করেন তাহলে আমাদের আলিঙ্গন পরিপূর্ণ হয়। রাধা শতকোটি হয়ে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেন। আবার শ্রীকৃষ্ণ শতকোটি হয়ে রাধাকে আলিঙ্গন করলেন। এইভাবে রাধা কৃষ্ণের আস্বাদন যেদিন হয়েছিল, সেটাই হল রাস। রাধার এক চোখ দিয়ে, দুই হাত দিয়ে কৃষ্ণকে সেবা করে সুখ হচ্ছে না। তাই তিনি শতকোটি হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণও একইভাবে রাধাকে আস্বাদন করবার জন্য বহু হলেন। তাঁরা কোটি হয়ে একে অপরকে আস্বাদন করতে লাগলেন। অগণিত কৃষ্ণের জন্য অগণিত রাধা। এইভাবে কৃষ্ণ, রাধা, কৃষ্ণ, রাধা ও তাঁর গোপিনিগণ। রাধা ও গোপী একই, ঠিক যেমন একই গাছের ডাল, শাখা-প্রশাখা, পত্র ও পুষ্প।
তাহলে কি দাঁড়াল? আনন্দশক্তির সঙ্গে আনন্দঘন পুরুষের যে চরমতম আস্বাদন, যার উপর আমরা আর কল্পনার মধ্যেও আনতে পারব না, যা বৃন্দাবনে ব্যক্ত হয়েছিল সেই পূর্ণিমার রাত্রে, সেটাই হল রাস। এটি নিত্য, আপনি যদি এই লীলা স্মরণ করেন, আস্বাদন করেন, ভজন করেন, আপনি আপনার হৃদয়ের মধ্যে এর আভাস পাবেন, দর্শন পাবেন, তাই লীলা-স্মরণ, লীলা-আস্বাদন ও লীলা-ভজন থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই। প্রভু বলেছেন—
”শূন্য থেকো না, সদা স্মরণ বই।”
অর্থাৎ সর্বদা স্মরণে থেকো। কি স্মরণে থাকব?
”অন্য ভাবিও না, গুরুগোবিন্দ বই।”
গোবিন্দ ভজনা কর। আর গোবিন্দ যিনি মিলিয়ে দিয়েছেন সেই গুরু ভাবনা কর, এই দুই ভাবনাতে যখন আপনার হৃদয় ভরে যাবে তখনই এই লীলা আপনি আস্বাদন করতে পারবেন।
রাসলীলার তত্ত্বটা কী—আস্বাদনটা কি—এটা মানুষের একটু হৃদয়ঙ্গম হলেই সে সার্থক। তাহলেই সে ধন্য হয়ে যায়। রাধাকৃষ্ণের পরস্পরের আস্বাদনের চমৎকারিতা সর্বাধিকভাবে ব্যক্ত হয়েছে এই লীলাতে। এই লীলার আস্বাদন হল পরিপূর্ণতম। পূর্ণের আবার ‘তর’ হয় ‘তম’ হয়, সুন্দরতা যতখানি যেতে পারে। অর্থাৎ অসমোর্ধ্ব সৌন্দর্য যে লীলাতে দেখানো হয়েছে সেটাই হল রাসলীলা।
এই লীলা আস্বাদন করবার ক্ষুদ্র কণার কণা ক্ষমতা আমাদের মধ্যেও ভগবান দিয়েছেন। এইজন্যই আমাদের সাধন-ভজন করবার ইচ্ছা জাগে, সাধন ভজন করলে তাতে ফল লাভ হয়, ভগবানের সান্নিধ্য লাভ হয় কারণ তাকে অনুভব করার যোগ্যতা তিনি নিজেই আমাদের দিয়েছেন। যেমন আলো সৃষ্টি করেছেন তেমন চক্ষু সৃষ্টি করেছেন, যেমন শব্দ সৃষ্টি করেছেন তেমন কর্ণ সৃষ্টি করেছেন। আমরা কিছুই করিনি সবই আছে জগৎ ভরা। ভগবান আমাদের চক্ষুকর্ণ দিয়েছেন তা অনুভব করবার জন্য।
তাই বিশ্বের সমস্ত বস্তুকে আস্বাদন করবার জন্য ভগবান যেমন আমাদের ক্ষমতা দিয়েছেন তেমন সবচেয়ে আনন্দঘন যে পুরুষ তাঁকে আস্বাদন করবার ক্ষমতা থেকেও তিনি আমাদের বঞ্চিত করেননি। এটিই হল আমাদের প্রতি তাঁর পরম করুণা। কৃষ্ণচিন্তা, কৃষ্ণভাবনা, কৃষ্ণের রাধাকে আস্বাদন, রাধার কৃষ্ণকে আস্বাদন, রাধাকৃষ্ণ গাঢ় মিলনে গৌরের লীলা আস্বাদন, নিতাই গৌরের মিলনে বন্ধুসুন্দরের লীলা আস্বাদন। এইসব স্মরণ, মনন ও চিন্তন করতে পারলে আমার আপনার জীবনে ভগবানের দেওয়া যে প্রেমকণা আছে তার সদব্যবহার হবে। জীবনে পরিপূর্ণতা আসবে। রাসলীলার মূর্তি হলেন আমাদের বন্ধুসুন্দর, রাসরসবিলাসের মূর্তি হলেন গৌরসুন্দর। এই রসলীলার ভিতরে ঢুকে একেবারে তন্ময় হয়ে ডুবে ছিলেন শ্রীরূপ, সনাতন, শ্রীজীব গোস্বামী আদি ভক্তজনেরা। এইজন্য তাঁদের শ্রীচরণে আমরা শতকোটি দণ্ডবৎ জানাই, প্রার্থনা করি, তোমাদের আস্বাদনের এক কণিকাও যেন আমরা পাই। আমাদের জীবনের মাত্র কয়েক শ’ বছরের মধ্যে আমরা মীরাবাঈকে দেখেছি। কী তাঁর সঙ্গীতপ্রেম! তাঁর কৃষ্ণপ্রেম! তিনি তাঁর গিরিধারীলালের জন্য সংসার ত্যাগ করলেন, স্বামী ত্যাগ করলেন। ঠিক যেন একজন গোপী। এই কলিযুগেই আমরা এঁদের পেয়েছি। এইভাবে এই মহাসমুদ্র-ভাবের এককণা ছিটেফোঁটাও যদি আমরা পাই তাহলেই জীবের সার্থকতা।
আমার আপনার জীবনে গুরুকৃপায় শ্যামসুন্দর-রাধারানীর কৃপায় একটুখানি রস আস্বাদন হোক। আমার আপনার জীবন ধন্য হয়ে যাক।
জয় জগদ্বন্ধু বোল। হরি হরি বোল।
—০—
সেদিনটা ছিল শারদ পূর্ণিমা। গগনে পূর্ণ চন্দ্র বিরাজমান। বন্য কুসুম সব প্রস্ফুটিত। সুমিষ্ট মায়াবী বাতাস। মমতামাখানো চন্দ্রিমা উঁকি দেয় দূরাকাশে। তার নয়নাভিরাম রূপে ঢলঢল যমুনার সোনামাখা জল। স্নিগ্ধ কোমল তরুলতার কোলে কোলে অজানা ভালোলাগার পেলব স্পর্শ। গন্ধভরা পুষ্পশাখে অলিকুলের সুমিষ্ট গুঞ্জন, পক্ষীর কলতান। চন্দ্রিমার মধুর জ্যোছনায় চারদিকে কী অপরূপ শোভা—আর মল্লিকা, মালতী, যূথীরা সেই আলতো আলোভরা সুমধুর রাতে ছুটে চলেছে প্রস্ফুটিত হতে, আপনাকে বিকশিত করতে—মেলে দিতে অসীমের কোলে। বনপ্রকৃতির এমন অপরূপ শোভায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল কোনো অচেনা জগতের বার্তা—যা মানব-মানবীর মনে আবেগের, আহ্বানের, স্নেহের, আদরের আর প্রণয়ের বাঁধ ভেঙে দেয়। আর যে ঘরে থাকা যায় না। ভাবল যশোদা দুলাল কৃষ্ণ। শুয়েছিল পালঙ্কে। একটু আগেই বলরামের সঙ্গে গোষ্ঠ থেকে ফিরেছে গৃহে। মা যশোদা বাৎসল্যভরে যত্ন করে স্নান করে খাইয়ে বিছানায় পাঠিয়েছে গোপালকে। কিন্তু মনে তার চিন্তার স্রোতটা থেমে নেই। তিল তিল করে মনের খাতায় ফুটে উঠছে একটার পর একটা মুখ। কখনো প্রেমনয়না রাধার চকিত মুখচ্ছবি ফুটে উঠছে চিত্তে কখনো-বা ললিতার আত্মসমর্পিত ভঙ্গিমা। কিংবা চোখ বুজে ধ্যানে রতা বিশাখার মুখটা। কৌশলী কৃষ্ণ ধরে ধরে অষ্ট নায়িকার ভাবভঙ্গিমা কেবলই ভাবে। তার ভালো লাগে চন্দ্রাবলীর বিনয় ও নম্রতার ভাবও। তবে রাধা যেন সৃষ্টিছাড়া। আপনহারা। দেহে দেহবোধ নেই। মনে মনবোধ নেই। সব হারিয়ে গেছে বাঁশরীর ডাকে। দূর বহু দূরে। নীলাকাশের কোলে। কৃষ্ণ নয়নের অপরিসীম প্রেমের অন্তরালে। সখীদের দুঃখভরা মুখগুলি চেতনায় ভেসে উঠতেই কৃষ্ণ বিছানা ছেড়ে উঠল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ শারদ পূর্ণিমা। কথা দেওয়া ছিল তো আগেই। যে আগামী শারদ পূর্ণিমাতে মিটবে তাদের মনের আশা। সেদিন প্রকট হবে আমার প্রেমাধীনতার চিরন্তন রূপ। আর এখনই হল সেই চির আকাঙ্খিত সময়। এই দিনের জন্যই কত উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগেই কেটেছে নিশিদিন গোপীদের। না—আর ঘরে থাকা ঠিক হবে না। পূর্ব আকাশের অরুণিমা যেন ডাকছে। চনমনে হয়ে উঠল কৃষ্ণ। সহসা তুলে নিল হাতের মোহন মূরলীটি। আর আড়চোখে একবার সামনের পথটা দেখেই পা বাড়াল গৃহের বাহিরে। মা যশোদা দাসীদের নিয়ে রাতের অন্নব্যাঞ্জন তৈরিতেই ব্যস্ত। কৃষ্ণগোপাল যে সন্ধ্যাবেলায় তাঁকে ফেলে কোথায় বেরিয়ে গেল তা তাঁর খেয়াল করার সময়ই হল না।
এদিকে হাতে বাঁশি নিয়ে কৃষ্ণ হনহন করে এগিয়ে চলেছে বনপথ দিয়ে। জ্যোছনাভরা সন্ধে, মধুর সন্ধ্যাতারা তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। বনবীথিকায় ডালে ডালে সুরভিত পুষ্পরা চকিত হয়ে উঠছে বারে বারে। কম্পিত কলেবরে পক্ষীরা ডেকে চলেছে মাঝেমধ্যে। কৃষ্ণ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে কদম গাছটির তলায় ত্রিভঙ্গভাবে দাঁড়াল। তারপর একবার কাজল নয়নে দেখে নিল চারপাশটা। পরক্ষণেই বাঁশিটা মুখের কাছে নিয়ে এল। মুহূর্তের ফুঁয়েতেই বংশীধ্বনি বেজে উঠে তৈরি করল অনাস্বাদিত অপরূপ এক মাদকতাময় সুর। যার সুরমূর্ছনা ছন্দে ছন্দে নৃত্য করতে করতে ব্রজগোপীদের কানে গিয়ে পৌঁছাল। উতলা করে তুলল তাদের হৃদিকে। তারা ছটফট করতে লাগল অভিসারের জন্য। কৃষ্ণসকাশে, কৃষ্ণপ্রেমের অতলে ভাসতে।
ইতিমধ্যে একমাস যাবৎ তারা খুব ভোরে নিত্য যমুনার জলে স্নান করে কাত্তায়নী ব্রত উদ্যাপন করে চলেছে। কঠোর এই ব্রত সাধনের মূল লক্ষ্যই হল যশোদানন্দনকে মধুরভাবে স্পর্শ করা, আলিঙ্গন করা, তাঁর অনন্ত সত্তার মধ্যে তাদের ক্ষুদ্র মনসত্তাকে চিরতরে বিসর্জন দেওয়া। কৃষ্ণ কৈশোরে উত্তীর্ণ হলেও চেতনার দিক দিয়ে পূর্ণ। নিঃষ্পাপ। অনন্ত প্রেমময়তায় তার দেহ-মন মাখামাখি। অসীম সুরে তার মনোবীণা সর্বদাই বাঁধা। তাই বাঁশিতেও বেজে চলেছে অসীমের সুরমূর্ছনা। সেই সুরের জাদুতে গোপী-চিত্ত সচকিত, পুলকিত, স্পর্শকাতর ও আন্দোলিত।
এদিকে কৃষ্ণ বাঁশিতে তান দিতেই সমগ্র প্রকৃতি এক অপরূপ শোভা ধারণ করল। তাঁর সুন্দর বদন, অপার্থিব দৃষ্টি, চাঁদের জ্যোৎস্নার মতো মুক্ত হাসি, প্রাণমাতানো ভ্রুভঙ্গি এবং মনোহরা বিলাস চারপাশে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। ফলে বনানী থেকে শুরু করে যমুনার জল, লতাগুল্ম, পশুপাখি, মৃগ, ময়ূর-ময়ূরী সবই পুলকিত হয়ে উঠতে লাগল। তাঁর মোহনবেণুতে এখন কি সুরশক্তি আছড়ে পড়ছে? নয়নমণি শ্যামসুন্দর এখন কোন রকমের বংশীধ্বনি করছেন? গোপীচিত্ত তন্ময়ভাবে কোন বংশীধ্বনি শ্রবণ করে চলেছেন? এ সুর যে হৃদয়কে দলিত মথিত উন্মাদ করে দেয়, যোগীর যোগ ভেঙে যায়, ধ্যানীর ধ্যান ভেঙে মূক হয়ে বসে থাকে—কেমন এ বংশীধ্বনি—কেন এত মধুর সুর, এত অভিনব রাগ, তাল, লয়, ছন্দই-বা কৃষ্ণ শিখল কী করে? এ সুর শুনলে সংসারে লাগে বিতৃষ্ণা, মনে দেয় অনন্তের দোলা, থাকে না কর্তব্য পালনের ইচ্ছা, পরিজনদের সঙ্গে থেকে হয় না আনন্দ। সত্যি, আজকের এই মোহন বেনুর ধ্বনি গোয়ালের গোরুগুলিকে তৃণ খাওয়া ত্যাগ করিয়েছে, বৃক্ষশাখে পক্ষীগণ নয়ন মুদে অবশ হয়ে গেছে, হরিণ-হরিণীরা দুরন্তপনা ছেড়ে একে-অপরের নয়নকে সকরুণ সুরে বিদ্ধ করছে। বাঁশির তানে ঢেউ তোলা যমুনা স্থির হয়ে ওঠে, শিলা যেন গলে যায়, শুষ্ক তরুশাখায় দেখা দেয় অঙ্গুর, ভ্রমর যেন গুঞ্জন করতে করতে পাগলপারা হয়ে ওঠে। এ কেমন অচেনা বংশী ধ্বনি? তবে কি এটি ভালোবাসা? দেহাতীত খাঁটি প্রেমের চিরন্তন ডাক? যা প্রত্যেকে পেতে চায় অহরহ নীরবে, সারাজীবন ধরে।
আসলে অনন্তমনা কৃষ্ণ আজ বাজিয়েছে ‘আকর্ষণীয়’ বংশীধ্বনি। এ ধ্বনি যার কানেই যাবে সেই কৃষ্ণপ্রেমে আকর্ষিত হয়ে অবশ হয়ে তার দিকে গমন করবে। এই ধ্বনিতে কৃষ্ণ আগেও বাঁশি বাজিয়েছে। আজও বাজিয়ে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও বাজাবে। কিন্তু বধিরমনা আমাদের কানে এ বাঁশির ডাক কী করে পৌঁছাবে? এছাড়া কৃষ্ণ সম্মোহিনী এবং আনন্দিনী বংশীধ্বনি করতেও খুব পটু। কৃষ্ণের সম্মোহিনী মনোরম মূরলীধ্বনি শুনে বনের পশু-পাখি পর্যন্ত অনন্তের সুরছন্দে অবশ হয়ে যায়—তো গোপী চিত্ত আর কী কথা—তারাও সমস্ত কাজ ফেলে, দেহ, গেহ, আত্মীয়-পরিজন রেখে কৃষ্ণময় হয়ে থাকতো। তখন তাদের মন জগতের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ শোভা থেকে বহু দূরে বিরাজ করত। সেসময়ে সমস্ত কিছু সীমার মধ্যেই অসীমের প্রগাঢ় অনুভব তাদের মানসলোকে ধরা পড়ত। মনে হত এ পৃথিবীতে তাদের আসা সংসারের কর্ম কোলাহলে বেঁচে থাকার জন্য নয়, নীরব প্রেমের অনন্ত মাধুর্যে মনোবীণাকে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যই তাদের জন্ম হয়েছে। সেসময়ে তাদের খুবই সুন্দর ও আনন্দময় লাগত। আর ললনাদের প্রেমরূপা অবস্থার মধ্যেই তো সুন্দর ও মধুর লাগে। সব নারীদের মধ্যেই সুপ্ত দেবীবোধ কমবেশি জাগ্রত থাকে। প্রেমমাধুর্য সেই দেবী প্রতিমাতে মানবীয় সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহের রেখাচিত্র এঁকে দেয় যা নম্র আননকে করে অর্থপূর্ণ ও বাঙময়। অপরদিকে কৃষ্ণ ‘আনন্দিনী’ বংশীধ্বনি করলে ধরাতল মহানন্দে ভরপুর হয়ে উঠত। দুঃখিত-তাপিত বনের পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, তরুলতা পর্যন্ত আনন্দিনী বংশীধ্বনির আওয়াজে আহ্লাদে গদগদ করত। যমুনার জল সুউচ্চ তরঙ্গে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে নৃত্যরত হত। গাভীসকল আনন্দে সচকিত হয়ে উঠত এবং গোপ-গোপীদের চিত্তে এক মধুরতম আনন্দের ভাব প্রবাহিত হয়ে যেত। বলতে কি এই বংশীধ্বনির মাদকতা বৃন্দাবনের সকলকে মোহিত করে রেখেছিল। আর তার ফলে কৃষ্ণকে সকলেই খুব শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের চোখে দেখত। এটা বৃন্দাবনের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের ক্ষেত্রেই সত্য ছিল। কৃষ্ণ এ-সময়ে প্রাক-যৌবনের কিশোর। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। মুখে অসীমের আনন্দ। চোখ দুটি প্রেম ও করুণামাখা। লাবণ্য সারা গায়ে। বাহুযুগল সুদূর প্রসারিত। বক্ষস্থল নীলকান্ত মণিতে সুশোবিত। পদযুগল সুবিন্যস্ত। তার উপর সুন্দর ভূষণাদিতে অপরূপ শোভা ধারণা করত। এসময়ে যে-ই তাকে দেখত তারই নয়ন ফিরত না। তার উপর কদম গাছের তলে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে বাঁশিতে যখন সে সুর দিত তখন তাঁকে অদ্ভুত মনোহর লাগত। আর আকর্ষণীয় বংশীধ্বনির মোহিনী শক্তিতে সকলের চিত্তই কৃষ্ণতে গিয়ে আছড়ে পড়ত। কৃষ্ণ অনন্তময়তায় পূর্ণ। আনন্দ দিয়েই তৈরি তাঁর দেহ, মন, আত্মা। সেখানে কোনো অপূর্ণতা নেই। চির অবিনশ্বর পূর্ণ অনুভূতিতে কৃষ্ণমন আপ্লুত। আর এক্ষণে সেই পূর্ণতাই বংশীধ্বনিতে সুর তুলে এগিয়ে গেছে গোপপল্লীতে। সেই অপরূপ বংশীধ্বনি শুনেই গোপীদের মনগুলিতে যেন সহসা বিদ্যুতের মতো শিহরণ জাগল। তাঁরা কেউ চোখ বুঝে, কেউ চোখ খুলে, কেউ সবটা মন দিয়ে, কেউ হৃদয়ের অন্তস্থলে বংশীধ্বনির অমৃতসুধা পান করতে লাগল। আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ, বাতাসে পুষ্পের মৃদু-মন্দ গন্ধতে সমস্ত পার্থিবতা কোথায় যেন সরে গেছে। হঠাৎ গোপীরা অনুভব করল তাদের মনটা যেন সংসার সংস্কার শূন্য হয়ে যাচ্ছে। নিত্যকার ভালোবাসার অভিনয় করার সংসারের মোহজালটা অপসারিত হয়ে গেছে কোথাও। মনের মোহ-মায়া খসে পড়তেই কোনো গোপীর মনে ভেসে উঠল এ সংসার কত অসার। বিবাহের আগে স্বামী সান্নিধ্যের কত স্বপ্ন, কত কল্পনা, কত ছবি আঁকা হত মনে নিত্য নব নব—কত তার শোভা, কত তা মনোলোভা—কিন্তু এ কী দেখছি আজ—দাম্পত্য সম্পর্কের মোহ-মায়া-প্রেমের পাশাপাশি সবই কেমন ছলনা, নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতায় বাঁধা। নিত্যদিনের সংসারের ক্লান্তিকর যন্ত্রণায় প্রেম যেন মাথা কুটে মরছে। এ তো মানিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া একটি অভ্যাস। একটি সামাজিকতা, একটি বেঁচে থাকার উপকরণ। অথচ মন চায় উন্মত্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে। গোপীমনের এই অন্তহীন সুপ্ত আবেগ, অপরিসীম উন্মাদনা এবং নিশিদিন কৃষ্ণচেতনার অনুভূতিগুলি যেন এক্ষণে সব বাঁধ ভেঙে গেল। তাদের মনে মায়ার বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ল এবং যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল অভিসারের জন্য তৈরি হয়ে গেল।
দেখা যায় এই সংসারে ছোট-বড় মেয়ে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা এক বিচিত্র লজ্জাবোধ ঘোরে ফেরে। কিন্তু এক্ষণে সেসব দেখা গেল না। তাই কোনো গোপী সামান্য বস্ত্রখণ্ড পড়তে পড়তে পূর্ণ প্রসাধন না করেই বেরিয়ে পড়ল। কারও এক চোখে কাজল, অন্য চোখে কাজল পড়েনি, কিন্তু কোনো হুঁশ নেই, সে চলল, পথ তাকে ডাকছে। প্রেম তার চিত্তে মাদল বাজিয়েছে। কোনো গোপী স্বামীকে খেতে দিয়ে তাঁরই কাছে বসেছিল, কিন্তু বংশীধ্বনি কর্ণগোচর হতেই ‘তুমি খাও’ বলে ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে গেল, কোনো গোপী শিশুসন্তানকে ‘স্তন্যপান’ করাতে মগ্ন ছিল কিন্তু তার পক্ষেও প্রেমবিহ্বলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হল না। নরম শয্যায় মমতাভরে শিশুকে রেখেই সে অভিসারে গেল। কোনো গোপী রন্ধনে ব্যস্ত ছিল। সেবাধর্মে তার মন সর্বদাই প্রশংসনীয়। কিন্তু তাঁর স্বামী দেখল আজ গৃহিনীর রন্ধনে মন নেই, কানাইয়ার বাঁশি শুনে তরকারিতে নুন দিতে গিয়ে চিনি দিয়ে দিচ্ছে, কখনও-বা তপ্ত বাসনে হস্ত স্পর্শ করে আঁতকে উঠছে—কেমন যেন আবেগ বিহ্বল ভাব। পাগলপারা হয়ে পড়েছে সে—দীর্ঘদিনের চেনাজানা এমন স্ত্রীর এই অদ্ভুত আচরণ মেলাতে পারল না স্বামী—ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখল—স্ত্রী তার রাঙাচোখে ক্রন্দন করতে করতে ভর-সন্ধ্যাবেলায় গৃহ থেকে বেরিয়ে গেল। স্বামী সজোরে পথ আটকাল। কিন্তু তা প্রতিহত করে হনহন করে চলে গেল বনবীথিকার পথ ধরে। আকাশের লালিত্যভরা চাঁদিমা তার পথের হল সঙ্গী, দূরের কুহুকুহু রবের কোকিলা হল তার বুকের ভরসা, হৃদয়ের স্পন্দন, অনুরাগের প্রেরণা।
আজ সন্ধ্যায় কৃষ্ণপ্রেমের তীব্র উন্মাদনা সব গোপীরাই কেন এমন প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করল? কেন তারা সংসার ধর্ম, সেবাধর্ম, দেহধর্ম পালন ত্যাগ করে কৃষ্ণ অভিমুখে ছুটে গেল? কেন তারা কেউ গো-দহনে, কেউ রন্ধনে, কেউ পরিবেশনে, কেউ সন্তানকে স্তন্যদানে, কেউ পতিসেবায়, কেউ প্রসাধনে ব্যস্ত থেকেও মুহূর্তেই সব ত্যাগ করে বনপথ ধরে কৃষ্ণবাঁশির সুর হৃদয়ে নিয়ে ধেয়ে গেল যমুনাপুলিনে? কী ছিল তাদের মনোসংযোগের রহস্য? তারা গেল সব এক পথ ধরে—বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে—কেউ কাউকে পথে স্পষ্টভাবে দেখতেও পেল না—অথচ সুনির্দিষ্ট স্থানে এসে সবাই সবাইকে দেখে বিস্ময়ে ও পুলকে আহ্লাদিত হয়ে উঠল।
আসলে গোপীদের মনের সবটা কৃষ্ণেই অনুরক্ত ছিল। কৃষ্ণ নামে তাদের তীব্র আসক্তি, কৃষ্ণরূপ দর্শনে পাগল তাদের মন। কৃষ্ণলীলার অনুধ্যানে নিশিদিন কাটে তাদের জীবন। কেবল দেহটাই পড়ে থাকত গোপদের সংসারে। কিন্তু চিত্ত-মন-বুদ্ধি সবই সমর্পিত হয়েছিল কৃষ্ণপ্রাণে। তাই তাদেরও প্রাণবীণা কৃষ্ণপ্রেমে সর্বদা ঝঙ্কারিত হত। তাদের প্রাণ-মন কৃষ্ণের সঙ্গে অদৃশ্য সূত্রে গাঁথা ছিল এবং চাঁদের প্রভাবে সমুদ্রের জোয়ার-ভাঁটার মতোই সেখানে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার ঢেউ উঠত।
আহা! গোপী চিত্তে কি কৃষ্ণপ্রেম—এই ভরসন্ধ্যায়—যমুনাপুলিনে শ্যামসুন্দর বাঁশি বাজাল আর গোপীরা যে যার ঘরবাড়ি সংসারধর্ম ত্যাগ করে নিধুবনে এসে উপস্থিত হল! তবে কি সব গোপীই অভিসারে এসেছিল? না—তা নয়। যারা নিত্যসিদ্ধা—যারা জগতের বুকে প্রেমদীপকে যুগে যুগে জ্বালিয়ে রাখার জন্য কৃষ্ণের সঙ্গেই জন্ম নিয়েছিল তারাই কেবল এল। আর সাধনসিদ্ধরা পূর্ব পূর্ব জন্ম থেকে সাধনা করে প্রেমলাভ করতে তৎপর বলে বংশীধ্বনি শুনেও নিজেদের সংযত করে ফেলল। তারা ভাবল কানাইয়ার বংশীধ্বনিতে এত মাদকতা কেন? আজ কি বিশেষ দিন? যশোদার দুলাল সত্যিই অপূর্ব! তার জন্য মনটা সর্বদাই হাহাকার করে। কিন্তু একটু যে তার কাছে যার তারও সময় নেই। বরং স্বামী-পুত্রদের সেবা করে ঘরের কোণেই কৃষ্ণের স্মরণ-মনন করি, ধ্যান করি কৃষ্ণরূপ, পান করি কৃষ্ণ অধরামৃত, নাম করি কৃষ্ণের, অনুধ্যান করি কৃষ্ণলীলা। তারা মনকে বুঝিয়ে তাই করতে লাগল। ফলে অচিরেই তারা কৃষ্ণের অপ্রাকৃত সত্তার মধ্যে প্রবেশ করে তলিয়ে গেল। তাদের গুণময় দেহে আর প্রাণ ফিরে এল না। তারা সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণময় হয়ে গেল।
আর নিত্যসিদ্ধা গোপীদের কী হল? তারা উপস্থিত হল কৃষ্ণসকাশে। দেখতে লাগল প্রাণভরে তাদের প্রিয় মাধবকে এবং অনুভবে পেল প্রেমালাপের হাতছানি। এই এক স্পর্শকাতর জিনিস—প্রেমালাপ—যা মানুষের জীবনে ক্ষণে আসে, ক্ষণে যায়। এই হয়তো আপনার চেয়ে আপন হল, কিন্তু পরক্ষণেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল। বড় ক্ষণিক এ বন্ধুত্ব, বড় অল্পের এই চেনাজানার সম্পর্কটা। আসলে আমাদের মায়াভরা সংসারে পরস্পরের প্রতি যে আকর্ষণ তার পরিণতি বেশিদূর নিয়ে যেতে পারে না, তা একটি বৃত্তের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে, তার বাইরে অনন্ত জগতের দিকে মননকে নিয়ে যেতে দেয় না, সুদূরপ্রসারিত দৃষ্টি মেলে দূরাকাশের দিকে তাকাতে দেয় না। প্রেম হল বহ্নি, ছাইচাপা আগুন। যেমন দিনের আলোতে রাতের তারারা আকাশেই থাকে, কিন্তু চাপা থাকে সূর্য আলোতে—তেমনি প্রেম চিত্তে থাকে, কিন্তু বাসনার মলিনতা তাকে চেপে ধরে, উন্মুক্ত হতে দেয় না তার ফোয়ারাকে। এই প্রেম হল মৃত্যুঞ্জয়, ত্যাগের মধ্যেই হয় প্রেমের পরিপূর্ণতা। তাই প্রেম বস্তু সুন্দরতম, সাধনালব্ধ, অপার্থিব, সুষমামণ্ডিত। এই পরম সুন্দর প্রেমকে কায়মনোবাক্যে পেতে হলে মনের আকাশে কামবেগকে শুদ্ধচিন্তা সহযোগে প্রশমিত করতে হয়। কামনার ফল্গুধারাকে কর্মে রূপায়িত না করে ভাবুকতাকে আশ্রয় করে থাকতে হয়। তবেই প্রেমের সূচনায় ছদ্মবেশি কাম যে দৈহিক মিলনের আর্জি জানায় তাকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। এ প্রেমের সাধনা সত্যের সাধনা, ধৈর্য্যের ও স্থৈর্যের সাধনা। শ্রদ্ধা ও ত্যাগ হল এই সাধনার ভিত্তি। ধীরে ধীরে চলতে হয় এই পথে। তবেই একদিন মদনদেব কৃপা করে পথ ছেড়ে দেন। আর তখনই মানবচিত্ত গোপীময় হয়ে ওঠে এবং মানবাত্মা দৈহিক মিলনের ঊর্ধ্বে উঠে এক স্বর্গীয় রাজ্যের সন্ধান পায় যা অনির্বচনীয় স্বাদে ও অনুভবে। এই বাক্যহীন প্রেমসুধা পান করলে মনে যুগপৎ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-উৎকণ্ঠা, মিলন-বিরহের, উথাল-পাথাল ঢেউ ওঠে। এই প্রেমের কথা বেশি শুনলে কেউ সুখসাগরে সাঁতার কাটে, কেউ দুঃখে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, কেউ আশমানে আনন্দে পাখি হয়ে উড়ে যায়, কেউ হতাশায় মাথা নত করে নির্বাক হয়ে বসে থাকে, কেউ ভালোলাগার আবেগে আত্মহারা হয়, কেউ ঘৃণায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে, কেউ আবার প্রেমের গান গেয়ে নেচে নেচে বেড়ায়—অদ্ভুত শক্তি এই প্রেমের। প্রেম যেন শক্তি স্বয়ং। জল একে তরল করতে পারে না, আগুন তাপ দিয়ে গলিয়ে দিতে পারে না, বায়ু শুষ্ক করার ক্ষমতা রাখে না। প্রেম এমনই অবিনশ্বর, অমলিন। প্রত্যেক মানুষের মণিকোটরে এমনই কতগুলি ভালোবাসার পরশ আছে যার স্মৃতি সতত জেগে থাকে এবং আনমনা হলেই অনুভূতিতে ফিসফাস করে কথা বলে তা। দেহাতীত অস্তিত্ব নিয়ে এই অনির্বচনীয় প্রেমই কণ্টকপূর্ণ সংসারে জীবনটাকে সতেজ গোলাপের মতো প্রস্ফুটিত করে তোলে। যদি প্রেম না থাকত তাহলে কী যে হত?
তাই মানবজীবনে প্রেম আছে, প্রেমই মনকে করে সুন্দর, উজ্জ্বল ও আশাব্যঞ্জক। মর্ত্যলোকে কত অগণিত মনে নিত্য প্রেমের ফুলঝুরি চলছে। অন্তরে প্রেমে জেগে আছে তাই হয়তো কারও ভোরের আকাশটা এত সুন্দর লাগল। প্রেমের প্রেরণাতেই ওই দূরাকাশের ফুটফুটে চাঁদ মনের কোণে কী গভীর স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয় নিত্যদিন। কত অজানা ভাব তখন আছড়ে পড়ে মনের কোণে কোণে। প্রেমের বহ্নিশিখায় মনরূপ পতঙ্গ সর্বদা ধেয়ে যায় এবং জ্বলেপুড়ে মরে। গোপীচিত্ত আজ এমন প্রেমেই উতলা হয়ে উঠেছে। গোপী মন বুঝেছে সংসার আছে, স্বামী আছে, সন্তান আছে, সম্ভার আছে—কিন্তু কোথাও যেন উষ্ণতা নেই, আবেগে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাকুলতা নেই। এ গতানুগতিক জীবনে দুঃখ আছে, সুখ আছে কিন্তু ভালোবেসে বিরহের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার অবিনশ্বর অনুভূতিটা যেন হারিয়ে গেছে আজ, উথাল-পাথাল করা সেই প্রাক-যৌবনের স্বপ্নগুলি এখন কোথায় গেল? কোনো গোপী হয়তো ভাবছে এই সংসারে প্রেম-ভালোবাসাগুলি বড়োই মায়ামমতা মাখানো, মোহময়—যা মুগ্ধ করে রাখে অন্তরকে, কিন্তু প্রসারিত করে না হৃদয়কে, প্রাণসত্তাকে—এই ভালোবাসা দাবি করে সুখের, ভোগের, অধিকারের, কিন্তু দেয় না স্বীকৃতি, মর্যাদাবোধ—এই ভালোবাসা যেন আমাদের সত্তাকে তিলে তিলে অবমাননা করে, ধুলিসাৎ করে দেয় তার মহত্বকে, গৌরবময়তাকে। অথচ আমরা সবাই তো চাই বেঁচে থাক আমাদের সত্তাটুকু, রক্ষিত হোক মর্যাদাবোধ, ঘরে-বাইরে, আত্মীয়-পরিজনদের কাছে। প্রিয়জনের কাছে। কিন্তু তা আর বাস্তবে হল কই? তাই নিশিদিন নীরবে গোপীমন কাঁদে বেদনার অভিঘাতে, গহনে, গোপনে। আসলে মায়ামোহভরা সংসারে ভালোবাসা কখনো নিখুঁতভাবে ধরা দেয় না। এ জগতে কেউ কাউকে সম্পূর্ণরূপে পায় না, পেতে পারে না। বোঝাও হয় না পূর্ণরূপে সবকিছু। আর প্রেম তো অধরা। এ জিনিস বড়ো দুরন্ত। পদে পদে সরে সরে যায়। অবশ্য তীব্র ঘাত-প্রতিঘাতে, সুখ-দুঃখ বার্তা বিনিময়ের ফাঁকে ফাঁকে কখন যে জীবনে ভালোবাসা পুষ্ট হয়ে ওঠে তাও টের পাওয়া যায় না। হয়তো হঠাৎই আবিষ্কার করা গেল ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়েছে দেহের শিরা-উপশিরায়, রক্তের ধমনীতে, মনের অণু-পরমাণুতে—আর তখনই বোঝা যায় মায়ামোহের শতেক চিন্তা ও কর্মের গর্ভে জন্ম হয়েছে অনাস্বাদিত এক জিনিসের, মধুর এক অনুভবের, প্রকৃত জীবনবোধের—যা প্রেরণা দেয় কর্মে, চিন্তায়, ভালোবাসায়, বেঁচে থাকতে জীবনে। সুন্দরভাবে, সুন্দরকে আশ্রয় করে। ভালোতে বাসা বেঁধে, পরস্পরকে ভালোবেসে। এটাই হয়তো প্রেম—যা তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করে সুগন্ধি ধূপের মতো—যা আপনাকে হারিয়ে দেবালয়ের আনাচে-কানাচে, বাতাসে বাতায়নে ছড়িয়ে থাকে—সুবাস রূপে, আরও কিছুক্ষণ, কিছু বছর—হয়তো সারাজীবন ধরে—কত মানুষই না এমন সুবাসের ঘ্রাণ মেখে সংসারের পথে এগিয়ে চলেছে, জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে আনন্দে, মধুর স্মৃতিতে। মধুময় হয়ে। মধুময় ওগো তুমি ভালোবাসা।
বলতে কি আমাদের মনের এই এক দোষ যেখানে সে চলে যায় সেখানকার রঙেই রাঙা হয়ে ওঠে। অথচ মন তো যাবেই, তাকে বেঁধে রাখা যায় না। আর মনপাখি যেখানে উড়ে গিয়ে বসবে সেখানকার সবকিছু সে খুঁজতে চাইবে, বুঝতে চাইবে—এই খোঁজা ও বোঝার মধ্যেই তার জীবনধারণ, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নিকেশ। তাই মায়াভরা এই সংসারে চলতে চলতে মন কেবলই হিসেব-নিকেশে মেতে ওঠে ভালোবেসে কী পেলাম, আর কী সে পায়নি? মনের এই সতর্ক বার্তাতেই প্রেম ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়—আর পথ চলতে পারে না, ভয়ে কাঁপতে থাকে। কিন্তু প্রেমও কি ভয় পেলে ছেড়ে কথা বলবে? সেও গলায় বিষের হাঁড়ি ঝুলিয়ে গরলে পরিণত হয় এবং তার ঝাঁঝালো গন্ধে তখন টেঁকা দায়। আর সম্পর্কের মধ্যে প্রেমের এই বিষক্রিয়াতেই ঘরে ঘরে বিবাহবিচ্ছেদ, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, মনোমালিন্য, ভুল বোঝাবুঝি, খুনোখুনি, আত্মহত্যা আরও কত কী যে ঘটে যাচ্ছে তা আর লিখে কাজ নেই। অথচ ভালোবাসা ছিল, আছে ও থাকবে। সম্পর্ক আছে ও থাকবে। তাহলে প্রত্যেকের ভেতরে যে ভালোবাসার চোরা স্রোত বইছে তার কী হবে? এ জগতে সকলেই তো কোনোকিছুর সঙ্গে মনে-প্রাণে টানাটানি অনুভব করছে। এমনকি বনের পশুপাখি বৃক্ষলতাও পরস্পর টানাটানি অনুভব করে কখনো আনন্দে মগ্ন হচ্ছে আবার কখনো-বা দুঃখে বেদনাময় হয়ে যাচ্ছে। সৃষ্টির এমন কোনো জিনিস নেই যা একে অপরকে টানছে না। এই অনির্বচনীয় টানেই না এমন পূর্ণিমা রাতে গোপীরা কৃষ্ণসকাশে এসেছে। কৃষ্ণময় হতে।
অবশ্য গোপীদের প্রিয় অভিসারে আসার এই সাধনা কিছু ক্ষণিকের নয়। যুগে যুগে তারা নিজেদের শুদ্ধ করেছে এ জন্যে। মনের মলিনতা দূর করে শুদ্ধচিত্তে কৃষ্ণের রহস্যময় বংশীধ্বনির তাৎপর্য বুঝেছে। তবেই না এই শুভক্ষণে তাদের দেহ-মন-প্রাণ সবই প্রিয়তমের সঙ্গে মিলতে উপনীত হয়েছে। আর প্রকৃতির সবকিছুই যেন তাদের সাধনার সিদ্ধিকে এক্ষণে আলোকিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই এই চন্দ্রিমাভরা মধুর রাত, মিঠা বাতাস, ভ্রমণের গুঞ্জন, পক্ষীর কূজন, যমুনার স্নিগ্ধ স্পন্দন, হরিণীর সচকিত নয়নে চেয়ে থাকা, পশুদের আনন্দভরে রাতজাগা, কীটপতঙ্গের হরষে নেচে বেড়ানো, লতাপাতায় কুসুমে ভরে ওঠা, সুগন্ধে দিকসকল মাতিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। সমস্ত প্রকৃতিই আজ প্রেমবিকাশে অদ্ভুত মনোরম হয়ে উঠেছে। রসিক কৃষ্ণ যেন সেটাই অনুভব করছে। গোপীরা পড়িমরি করে এসে গেছে। তারা সব কৃষ্ণকে ঘিরে রয়েছে। কৃষ্ণও কী নিপুণভাবে বাঁকানয়নে গোপীদের সব দেখতে লাগল—চোখ তার নেচে বেড়ায় অষ্টসখীর নয়নতারার দিকে—প্রথমেই তার চোখে পড়ল চন্দ্রাবলীর শ্রীবদন—চন্দ্রাবলী বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ। এঁর মনে তদীয়ময়তা প্রেমের ভাব। তাই চন্দ্রার মনে অহংবোধের চিহ্ন নেই। সে ভাবে আমি দেহমন সব কৃষ্ণচরণে সমর্পণ করেছি, আমি কৃষ্ণের, কৃষ্ণের ভালোবাসার অধীন। তারপর কৃষ্ণের চোখে পড়ল শ্যামলীর আনন্দময় মুখখানি। শ্যামলা মনে মনে কখনও ভাবে ‘আমি কৃষ্ণের, কৃষ্ণপ্রেমের জন্যই বেঁচে থাকা’, আবার কখনও ভাবে ‘কৃষ্ণ আমার, আমার জন্যই কৃষ্ণের আনন্দ।’ এই গোপীর মিশ্রিত ভাব। তদীয়ময় ভাব আবার মদীয়ময় ভাব। এবার কৃষ্ণ সচকিতে লক্ষ্য করল তাদের—যারা নিবিড় কালো নয়নে কৃষ্ণকে দেখছিল এতক্ষণ। এঁরা বিশাখা, ললিতা। শান্তসমাহিতা, কৃষ্ণচিন্তায় তন্ময় ভাব, দেহ-মনে প্রশান্তির অভিব্যক্তি। কিন্তু এবার কার মধুময় হাসিতে, প্রেমভরা নয়ন মাধুর্যে, কৃষ্ণ দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেল? ইনি মদীয়ময়তা ভাবের নারী। ইনি ভাবেন কৃষ্ণ আমার, আমি কৃষ্ণের নই। আমার জন্যই কৃষ্ণজীবন ধারণ, কৃষ্ণলীলার সার্থকতা। ইনি রাধা—রাধারানী। কৃষ্ণের চেয়ে বয়সে সাত বছরের বড়। বিশ্বের যত সৌন্দর্যে আছে সব যেন তাঁর অঙ্গে মূর্ত হয়ে উঠেছে আজ। কৃষ্ণের ভাবতরঙ্গ রাধা অঙ্গে ঢেউ তুলছে। তাই রাধা কৃষ্ণমনা, কৃষ্ণমগ্না, কৃষ্ণমাধুর্য ভরা অনুপমা প্রেমপ্রতিমা। এক্ষণে সন্ধাকাশে রাধার প্রেম অভিব্যক্তি বড়ই নয়ন মনোহর হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণ জানে কী পূর্বরাগে, কী রূপানুরাগে, কী মানে, কী অভিসারে রাধার মতো কেউ নয়। এমন প্রেমময়ী রাইকিশোরী কল্যাণী নারী সেও আজ এসেছে। সত্যিই কুল, গৌরব, স্বামীধর্ম, লজ্জা, আত্মমর্যাদা, তাড়ন-ভর্ৎসনা, লোকনিন্দা সব দূরে ফেলে চলে এসেছে রাধাও, অন্যান্য গোপীদের মতোই। কৃষ্ণ অভিসারে। কৃষ্ণসুখে মজতে।
আসলে রাধার নিয়তিই তাকে নিয়ে এসেছে নিধুবনে। রাধা সংসারে গৃহিনী। আয়ান ঘোষ তার স্বামী। দেবতার মতন। রাধা স্বামীরূপী দেবতাকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে। এ এমন এক দাম্পত্য ভালোবাসা যা সহজাত, সহমর্মিতার বোধে পূর্ণ। মানুষ যেমন সাগরকে ভালোবাসে, হিমালয়কে ভালোবাসে, রাতের জ্যোছনাকে ভালোবাসে স্থিরপ্রত্যয়ে রাধাও তেমনি আয়ানকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসায় শ্রদ্ধা ও গভীরতা আছে, কিন্তু বিহ্বলতা বা ব্যাকুলতা নেই। এই শান্ত প্রেমবহ্নিতে জীবন কাটানো যায়, কিন্তু জীবনের অর্থ ঠিক বোঝা যায় না। তাই রাধার অন্তরে প্রেম নিয়তই বেদনায় ব্যথিত হয়ে ওঠে। কখনও-বা দুঃখ-কাতরতায় তা গভীর জীবন-জিজ্ঞাসায় মেতে ওঠে। তখন আকুল হয়ে পড়ে রাধা। আর কেবলই মনে পড়ে কৃষ্ণের কথা। রাধা তার সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে বুঝতে পারে এই সংসারে সে আয়ানের স্ত্রী হয়ে আছে, কিন্তু মন কৃষ্ণচেতনায় চির নিবদ্ধ। এইভাবে স্ত্রীর অভিনয় করা তার জীবনে বিধাতা প্রদত্ত অভিশাপ ছাড়া আর কী! কথাগুলি ভাবতেই রাধা আপনভাবে হেসে ওঠে মনে মনে। বিচিত্র লাগে তখন জগৎটা তার কাছে। চারপাশের মানুষজন, মানবীয় সম্পর্কগুলি কেমন অর্থশূন্যও মনে হয়। এমন প্রগাঢ় চিন্তাতেই রাধা আজ সন্ধাকালে আচ্ছন্ন হয়েছিল। তার সমস্ত সত্তা যেন সেসময়ে কৃষ্ণের প্রতি এক ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। যেমন দুর্বার স্রোতধারা নদী আপনগতিতে সাগরে ধেয়ে যায় রাধার মনের সমস্ত চিন্তাগুলিও তেমনি কৃষ্ণপ্রেমে ধেয়ে যাচ্ছিল। আর দেহটা শিথিল হয়ে পড়েছিল পালঙ্কে। আয়ান দূরেই বসে ভগবৎ আরাধনায় ছিলেন। তার মধ্যে রাধার প্রতি সর্বদা এক কঠিন রহস্যময় প্রেম ও সুগভীর ঔদাসীন্য কাজ করে। এর সুগভীর অর্থটা যে কী তা রাধারানীও সবটা বুঝতে পারে না। তবে স্বামীর কোনো কষ্ট হোক রাধা চাইত না। যতই হোক সে তো ভারতীয় নারী। স্বামী দেবতা তার কাছে সর্বদা পূজার মতোই আরাধনার যোগ্য।
রাধা নিধুবনে এসেই মধুর নয়নে কৃষ্ণসুধা পান করতে করতে ভাবছিল সন্ধ্যার এসব কথাগুলিই। তখন সে পালঙ্কে অলসভরে শুয়েছিল। হঠাৎ বহুদূর থেকে ভেসে এল এক সুমধুর বংশীধ্বনি। যা তার মরমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বিহ্বল করে তুলেছিল তাকে। তার সমগ্র সত্তা, দেহ মনকে এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতিতে ভরিয়ে দিয়েছিল। তখন তার এতই হালকা লাগছিল নিজেকে যেন কল্পনাই করা যায় না। হঠাৎ তার অনুভব হল কৃষ্ণের আকর্ষণীয় বাঁশির ধ্বনি তার মনের সমস্ত কিছু চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। ওই অসীম প্রেম উদ্দীপক সুরের ছোঁয়ায় তার চিত্ত বিকল হয়েছে, মনে চিন্তার সাবলীলতা থাকছে না। রাধা জানে ওই সুর ঠিক কি চাইছে তার কাছে, তার জীবনের কোনো অর্থ এই সুর বহন করে নিয়ে যেতে চাইছে। ভাবতে ভাবতেই চোখটা অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল রাধার। ভেতরটা যেন আর বাধ মানছে না। মৃদু মৃদু কাঁপছে চিত্ত দীপ। সহসা রাধা যেন তৃতীয় নয়নে দেখতে পেল চন্দ্রিমাভরা জ্যোছনা রাতের অপরূপ কদম বৃক্ষটি। যার তলে ত্রিভঙ্গ হয়ে শ্যামসুন্দর বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। তাঁর কোঁকড়া চুলের ময়ূরপঙ্খী মুকুটের শোভাটি কী অপূর্ব! তদুপরি গলে বনমালা, সারা গায়ে চন্দনের সুগন্ধ, মুখে সুমধুর হাসি, দৃষ্টিতে প্রেমতন্ময়তা। রাধার চোখ বুজে এল। সমস্ত অন্তরটা তার কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধায় প্রেমে আপ্লুত হয়ে উঠল। ঘরে থাকা দায় হল তার। হঠাৎ তার মনোবীণায় বেজে উঠল কৃষ্ণপ্রেমের মাধুর্যময়তা। মনটা যেন ফিসফিস করে বারে বারে বলে উঠল—কৃষ্ণ মম জীবন, কৃষ্ণ মম প্রাণ, কৃষ্ণ আমার বধুঁয়া। আর তখনই এই ভরা সন্ধ্যায় আয়ানকে ফেলে যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভাবনার স্রোতটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল এবং সবকিছু ফেলে রেখে চলেই এল সে যমুনাপুলিনে। কৃষ্ণ এতক্ষণ সেই প্রেমপিয়াসী রাধাকেই দেখছিল। তাঁর অপাপবিদ্ধ নয়নে নয়ন রেখে কৃষ্ণ যেন অনুভব করল এই নারীর দেহমনের অপরূপ দোলাচল যার আলোয় সমস্ত প্রকৃতিকেই অপূর্ব বিভায় আলোকিত করেছে। এর নয়ন ভোলানো স্নিগ্ধ সৌন্দর্য প্রতিধ্বনি হচ্ছে পাহাড়ে-পর্বতে-বৃক্ষে-লতায়-চন্দ্রমায়-তারায়-আকাশে-বাতাসে-কুসুমে-কাননে। প্রেম যে এমন প্রত্যক্ষ সৌন্দর্য ও মাধুর্য নিয়ে মাটির পৃথিবীতে ধরা দেয় তা আগে কেউ দেখেনি। রাধা দর্শনেই তাই কৃষ্ণমনে আনন্দের দোলা। যার দর্শনেই মনের এত সুখ তার কণ্ঠের গানে, মুখের হাসিতে, নয়নের চাহনিতে, চলনের ছন্দে না জানি আরও কত কত সুখ। সবকিছু দেখে কৃষ্ণ মধুরভাবে একটু হাসল। তারপর তির্যকভাবে মুখে মৃদু হাসি খেলিয়ে সহসা বলে বসল—”হে ভাগ্যবতীগণ, তোমাদের আসাটা ভালো হয়েছে কি? আর তোমরা এত রাতে এখানে এলেই বা কেন? কত ভয়ঙ্কর হিংস্র জীবজন্তুরা এই অন্ধকারের ঘুরে বেড়াচ্ছে, তোমরা স্ত্রীলোক—এইসময়ে এখানে আসা কেন? গৃহে তোমাদের মা-বাবা-পতি-পুত্র-ভাই-বন্ধুরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। তারা নিশ্চয়ই তোমাদের খোঁজে এতক্ষণ বেরিয়ে পড়েছে। তোমরা এখনই গৃহে ফিরে যাও। তারপর যে যার কর্তব্য পালন কর। স্বামী-পুত্র ফেলে স্ত্রীলোকের কি এখানে আসা উচিত হয়েছে? তোমাদের কি কোনো লোকলজ্জা নেই?”
সত্যিই গোপীরা ভাগ্যবান। তারা সব ফেলে আপনাকে ভুলে কৃষ্ণের কাছে হাজির হয়েছে। কৃষ্ণ মিলন সুখ প্রার্থনা করছে। আর আমাদের মতো মানুষের মন? কৃষ্ণসুখে কিছুতেই সুখী হতে চায় না। তবে কি আমরা সব পাপী-তাপী মানুষ? না—তা নয়। মানুষও ভগবানকে চায়। সৎ ও প্রেমপূর্ণ হতে চায়। যে মুহূর্তে মানুষ সত্যবাদী, ন্যায়বান, সংযমী হওয়ার চেষ্টা করে তখনই তারা পরমাত্মারূপী চিরন্তন কৃষ্ণের দিকে গমন করে। তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মনগুলি তখন গোপীর মতোই সত্যপ্রেম অন্বেষী এবং অনন্ত সকাশে যাওয়ার চেষ্টা করে। বলতে কি এই প্রকৃতিতে সবকিছুই সুন্দরভাবে সাজানো আছে। সমাজে একপ্রকার নরনারী দেখা যায় যারা পরিবারে-সমাজে-দেশের সর্বত্র স্বার্থপরতা, মিথ্যাচার ও শৃঙ্খলাহীনতা দেখে নিজেদেরও সেরকম করে গড়ার চেষ্টা করে। তারা ভাবে স্বার্থপর, হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর, কর্তব্যবোধহীনতা না হলে এ-যুগে আর বাঁচা যায় না, সংসারে চলা যায় না। আবার এসব দেখেও অগণিত নরনারী ভাবে সমাজসংসার রসাতলে যাক তবু আমি আমার সত্য নিয়ে, মূল্যবোধ নিয়ে, ত্যাগ নিয়ে, সেবা নিয়ে, পবিত্রতা নিয়ে, নৈতিকতা নিয়ে বেঁচে থাকব—তাতে যদি মাটির পৃথিবীতে কিছুই না পেলাম তাতেও তত যায় আসে না—তবু সত্য থাক, ধর্ম থাক, দয়া থাক, ভালোবাসা থাক—এখনও এমন নরনারী আমাদের গৃহে-সমাজে সর্বত্রই বিরাজ করছে। তাই কিছু নরনারী আছে তারা ভাবনার সত্য, ভালোবাসায় নিখাদ, আর তাদেরই যদি গোপীমন বলি অসত্য তো বলা হয় না। এমন গোপীমনা নর-নারীর সেরাগুলিরই তো পরে চৈতন্য, মীরাবাঈ, সুরদাস, নানক, কবীর, রামকৃষ্ণ, সারদা নামে বিশ্বজনমনে শ্রদ্ধা পায়, পূজিত হয়। তবে এ-সংসারে প্রত্যেক নারীই গোপী—তারা প্রেমে পূর্ণতা চায়, অন্তরে সত্য সংবেদন চায়, বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মা হয়ে যেতে চায় তাদের তৃষিত প্রাণ-মন-সত্তা। এ যেমন গভীরভাবে প্রত্যেক নারীজীবনে সত্য, তা অধিকাংশ পুরুষের কাছেও অসত্য কিছু নয়।
এখানে আগত গোপীদেরও তাই ইচ্ছা। চন্দ্রাবলী, রাধিকা, শৈবা, বিশাখা, ললিতা সহ সমবেত সকল মহামনা গোপীরাই রাইকিশোরের কথা শুনে চমকে উঠলেন। থর থর করে কেঁপে উঠল তাদের চিত্ত। কেউ কেউ কষ্টে কেঁদেই ফেলল। ভাবল—এ কী নিষ্ঠুর পরিহাস! নারী হয়ে জন্মানোই কি বিধাতার অভিশাপ! আমরা তো অন্যায় কিছু করিনি—যাকে মনে চিন্তা করি, প্রাণ দিয়ে অনুভব করি, হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি সেই চিরন্তন সুন্দরকে কাছে পাওয়ার বাসনার মধ্যে কি কিছু অন্যায় আছে? না—খারাপ কিছু থাকতে পারে? কৃষ্ণ সুন্দর, কৃষ্ণ মঙ্গলময়, কৃষ্ণ সতেজ, কৃষ্ণ সত্য, কৃষ্ণ বাঁধভাঙা জীবনের মুক্তির জয়গান, কৃষ্ণ সীমায়িত সংস্কার ভেঙে ফেলার তীব্র বজ্রধ্বনি, কৃষ্ণ শ্রদ্ধা-বিশ্বাস-প্রেমের মূর্তপ্রতীক, জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার উন্মাদনা, আনন্দের ছন্দ, অসীমের বার্তা—এমন মুক্তমনা অনন্ত প্রেমের দ্যোতক কৃষ্ণচরণে নিজেদের সমর্পণ করে আমাদের যদি যমুনার জলে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তবু দেব কিন্তু বদ্ধগৃহে আর ফিরে যাব না। ভাবল এসব গোপীরা। আর সেইসঙ্গে তাদের অন্তরে ধরা পড়ল কৃষ্ণের অতুলনীয় শোভা, অনিন্দ্যকান্তি মুখমণ্ডল, ভুবনভোলানো প্রেম-নয়ন—এমন ভুবনভোলানো মোহনরূপে চিত্ত সংলগ্ন করে সংসারের কোন নারী না প্রেমানলে পুড়তে চাইবে? কোন নারীই না এমন পরমদুর্লভ রূপসৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করে প্রেমসাগরে ডুব দিতে চাইবে? তাছাড়া, তারা তো কৃষ্ণকে সুন্দর ভেবে ভালোবাসে, প্রেমের প্রেরণা বলেই ভালোবাসে—এর মধ্যে সীমায়িত শরীর চেতনা তো তাদের কিছুই নেই। কৃষ্ণপ্রেমে বরং তারা দেহবোধ বিস্মৃত হয়েছে, মনের বাসনার মলিনতা ধুয়ে মুছে দিয়ে তাদের অন্তরকে মায়াতীত করেছে। সুতরাং তাদের অন্তর যে স্বতঃস্ফুর্তভাবেই কৃষ্ণপ্রেমের অনন্ত মূর্ছনায় আকৃষ্ট হয়েছে তাতে আর দোষের কি আছে? এসময়ে আকাশের বাঁকা চাঁদ যেন বিদ্রুপভরে সকৌতুকে কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করল—ওই চন্দ্রবদনা গোপীদের এত কষ্ট দিচ্ছ কেন? তোমাকে তো শুধু গোপীরাই ভালোবাসেনি—বনের হরিণীরাও তোমার মোহনমূরলী ধ্বনি শুনে আকৃষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা—তখন কী মনোহর হয় না তাদের চাহনি? কৃষ্ণদর্শনে সেই হরিণীর চক্ষে কি প্রেমের বন্যা বহে যায় না? গোচারণে ধেনুগুলি তোমার বংশধ্বনি শুনে পাগলের মতো তোমার দিকে ধেয়ে কি যায় না? তোমার বাঁশি শুনে কি তারা উর্ধ্বপুচ্ছ হয়ে নাচে না? তোমার অপরূপ প্রেমনয়ন দেখে ময়ূরেরা কি বিস্ময়ে হতবাক হয় না? ভ্রমণগুলি ফুল ছেড়ে কি তোমাকে বেষ্টন করে গুনগুন করে না? বনের বানরগুলি কি চঞ্চলতা ছেড়ে তোমার বাঁশির সুরমাধুর্যে মোহিত হয়ে ওঠে না? পাখিগুলি কি পরস্পর কূজন ত্যাগ করে তোমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে না? লতাবৃন্তে পুষ্পগুলি কি হরষে পুলকিত হয়ে তোমাকে স্বাগত জানায় না? আর বাতাস কি তোমাকে আলিঙ্গনে আপ্লুত করে না? যমুনা কি নেচে নেচে তোমার পদপ্রান্তে উপনীত হতে ছটফট করে না? আর আমি কি মৃদু হেসে জোছনা ছড়িয়ে তোমার কোমল গায়ে মাখামাখি করি না? তাহলে গোপীদেরই কেন দোষ হবে, সংসারে কেন অধর্ম হবে, লোকনিন্দার অপবাদ কেন থাকবে? তারাও তো প্রকৃতি। প্রকৃতি মাতাই তো তাদের মন দিয়েছে কোমলতা দিয়েছে, দিয়েছে স্নেহ, মায়া-মমতা। অনুরাগে পূর্ণ করে দিয়েছে তাদের হৃদয়। যদি তাদের এই উন্মাদ হৃদয়দুয়ার এভাবে বন্ধ করে দাও তাহলে তারা কোথায় যাবে? তারা কি করবে?
এই নৈসর্গিক ভর্ৎসনা শুনে কৃষ্ণ সচকিত হয়ে দেখল কোন কোন গোপী বেদনায় ক্রন্দন শুরু করে দিয়েছে। তবু যেন তাদের কত ভালো লাগছে কৃষ্ণের। গোপীচিত্তে জমা রয়েছে অনুরাগ। আর কৃষ্ণ-হৃদয়েও পূর্ণ ভালোবাসা। তাই পরস্পরের অনুরাগের আকর্ষণেই প্রকৃতিটা আজ বড় মায়াময় হয়ে উঠেছে। অপরদিকে এই মায়াভরা জ্যোছনার শোভাতে অনেক গোপী কৃষ্ণের বাক্যবানে লজ্জা ও সংকোচে যেন মরমে মরে যেতে লাগল। কোন কোন গোপীর আবার তীব্র অশ্রুতে চোখের কাজল ও কুমকুম ধুয়ে যেতে লাগল। তাদের মনে একটা বিষম চিন্তা দেখা দিল। তারা ভাবল কৃষ্ণ যদি এই নিশীথে তাদের ফেলে রেখে পালিয়ে যায়, তাহলে কী হবে? সুতরাং ক’জন বুদ্ধিমতী গোপী ভাবল—না, এভাবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, বরং কানাইকে কিছু বলি—এদের মধ্যেই ক’জন এগিয়ে গিয়ে কানুর নয়নে স্থির নয়ন রেখে দৃঢ়প্রত্যয়ে বলল, ”দেখ কৃষ্ণ, আমরা যেসব গৃহে, সমাজে বাস করি, সর্বত্র কি মন নিবেদন করেছি? আমাদের মাতা-পিতা-স্বামী-পুত্র-পরিজন আছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্কও আছে, তবু সত্যিকারের কি কোনো প্রেমের অনুপ্রেরণা তাদের কাছ থেকে পাচ্ছি? সবকিছুই তো মমতাভরা কমবেশি চাওয়া-পাওয়ার হিসেব-নিকেষে বাঁধা। কেবল তোমাকেই যখন চিন্তা করি তখন মুক্ত হয়ে যাই, তাইতো আমরা বলি যদি এই মরুভূমি-সম সংসারে কারও বক্ষে সত্যিকারের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা-উচ্ছলতা আছে তা হল যশোদা নন্দনের। আর বাকি সবই সীমায়িত চেতনায় বদ্ধভাবাপন্ন। তাইতো মুক্তির আনন্দে আমরা তোমার কাছে ছুটে এসেছি, তুমি আমাদের অমন করে চলে যেতে বলো না। আমাদের জীবনে তুমি অনন্তকাল প্রেমের দীপশিখা হয়ে জ্বলতে থাকো। আর আমরা তো তোমায় ভালোবেসে আত্মসুখ চাই না, মনকে তৃপ্তি দিতেও চাই না। আমাদের মনের ইচ্ছা তোমার সুখে সুখী হওয়া, তোমার আনন্দে আনন্দিত হওয়া, তোমার বেদনায় ক্রন্দন করা, তোমার বিরহে আত্মহারা হওয়া, তোমার মিলনে পুলকিত হওয়া—আমরা তোমার, তুমি আমাদের—দয়া করে আমাদের গ্রহণ করো। চলে যেতে বলো না। আহা! তোমার অপার্থিব নিঃষ্পাপ মুখ, সহাস্য দৃষ্টি, সুদৃঢ় বাহুযুগল, মিষ্টি হাসি, সুমধুর বচন শুনে আমরা তোমার দাসী হতে এসেছি, হে দীননাথ, হে আর্তিহরণ অখিলবন্ধু, তুমি আমাদের সন্তপ্ত হৃদয়ে তোমার করপদ্ম স্থাপন করে এই অসহ্য যন্ত্রণা লাঘব করে দাও।” কৃষ্ণ দেখল গোপীদের মধ্যে কেউ কেউ এসব কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই অশ্রুতে ভেসে যেতে লাগল, তাদের দেহে-মনে শোক উথলে উঠল, দীর্ঘ উষ্ণ নিঃশ্বাসে তাদের নিকটের বাতাসটা যেন বেদনায় হাহাকার করতে লাগল। অনেকের সুতীব্র অশ্রুজলে চোখের কাজল ধুয়ে বক্ষস্থল ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল এবং অসহ্য দুঃখে অধোবদন কালিমায় লিপ্ত হল। এসময়ে আর একজন গোপী আবেগে ক্রন্দন করতে করতে গদগদ কণ্ঠে বলল, ”হে মাধব, তোমাকে ছেড়ে এক পাও বাড়তে ইচ্ছা করছে না, আর আমরা ব্রজে ফিরে গিয়েই বা কী করব? হে কৃষ্ণ! তোমার অপার্থিব প্রেমনয়ন ও সুমধুর বাঁশি শুনে আমাদের হৃদয় বড় ব্যাকুল হয়েছে, তোমার কাছে এই প্রার্থনা—তুমি মনের এই অসীম ব্যাকুলতা দূর করে আমাদের গ্রহণ কর, আর যদি তা না কর তাহলে তোমার বিরহানলে আমাদের এই দেহ তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, আমরা সকলে এখনই ধ্যানযোগে দেহত্যাগ করে তোমার চরণপ্রান্তে মিলিত হব।”
গোপীদের প্রাণছোঁয়া মনমাতানো কথা শুনে সহসা গোবিন্দের ভাবান্তর হল। তার দেহ-মন জুড়ে বেজে উঠল অসীম কালের শাশ্বত প্রেমবীণা যার অনির্বচনীয় মোহময় সুর সমগ্র মন-চেতনাকে এক স্বর্গীয় সুষমায় ভরিয়ে তুলল। আর বনফুলের মিষ্টি পাগলকরা গন্ধের সঙ্গে তা মিশে ছড়িয়ে পড়ল গোপীদের বেদনাময় চিত্তে—ফলে মুহূর্তেই সব গোপীমন অনুরাগে ভরা কৃষ্ণচেতনায় বিহ্বল হয়ে উঠল এবং গোপীরা নিজেদের কৃষ্ণকায়া ছাড়া তখন আর কিছুই যেন ভাবতে পারল না। এমন সময় নিজ আনন্দ আস্বাদনের জন্য কৃষ্ণ সমগ্র গোপীদের সত্তাকে আবিষ্ট করল এবং গোপীরাও সকলে কৃষ্ণের আনন্দদায়িনী হ্লাদিনী শক্তিরূপে চিত্রার্পিত ছায়ার মতো কৃষ্ণপাশে গোলাকারভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আকাশে-বাতাসে-জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বেজে উঠল একাত্মতার আনন্দ গান। আর তা নির্জন বনভূমি জুড়ে আছড়ে পড়ে আবিষ্ট করে তুলল সকলকে এক ভাববিহ্বলতায়। এমন অদ্ভুত ভাববিহ্বল জ্যোস্নালোকে অন্তর্যামী কৃষ্ণ সব গোপীচিত্ত প্রত্যক্ষ করে একটা অদ্ভুত আশ্চর্যের হাসি হাসল। আর তা প্রতিধ্বনিত হতে হতে সাড়া বনতল ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এক অনুরাগিনী গোপী এইসময় সপ্রেম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কৃষ্ণকে এক সুন্দর বৈজয়ন্তীমালা পড়িয়ে দিল।
কৃষ্ণ সেই মালা পর গোপীদের মাঝে তারকাবেষ্টিত রাতে মধুর চন্দ্রের ন্যায় অদ্ভুতভাবে শোভা পেতে লাগল। সহসা রমণীগণ মধুর হাস্যময় কটাক্ষ নিক্ষেপ করে কানুকে মাঝে রেখে মধুর স্বরে গান গাইতে গাইতে নৃত্য করতে লাগল। লীলাময় কৃষ্ণ সেসময় প্রেমাবেগে কোনো গোপীকে স্পর্শ, কোনো গোপীকে আলিঙ্গন, কোনো গোপীর কেশগুচ্ছ ধরে আদর করতে করতে গান গেয়ে মহাবিক্রমে নৃত্য করতে লাগল। এমন সময় রাশি রাশি কদম্বের পাপড়ি স্বতঃর্স্ফুতভাবে বৃক্ষশাখা থেকে ঝরে পড়তে লাগল তাদের মাথার উপর। কাঁপতে লাগল আকাশের চাঁদ, বনের বাতাস, যমুনার জল, দূরের তারা, বৃক্ষ, লতা, পুষ্প সবকিছুই। হঠাৎ লীলাময় কৃষ্ণের জ্যোতির্ময় দেহ থেকে এক অদ্ভুত সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল এবং তার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে প্রত্যেক গোপীই কৃষ্ণকে আপন কণ্ঠলগ্ন হিসাবে অনুভব করতে লাগল। সহসা এক প্রেমপরায়ণ গোপী আবেগভরে বলে উঠল, ”ওগো প্রিয়, তোমার আমার হিয়ার পরশে আজ কেন সবকিছু সুন্দর হয়ে উঠল? কেন পূর্ণিমার চাঁদিমাভরা জোছনাটা এমন করে নেচে উঠল? কেন যমুনা এমন উত্থাল হল? বনের কুসুমেরা হরষে কেন মাতাল হল? ভ্রমর কেন গুঞ্জন করে নেচে বেড়াল? ওগো নাথ, তুমি এত সুন্দর, এত আনন্দময়! তোমার চিন্তা, তোমার স্পর্শ এত মধুময়?” হঠাৎ গোপীরা আরো অনুভব করল এক দিব্যশক্তি তাদের সকলকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে এবং মুহূর্তেই তাদের মানসলোক থেকে স্থান-কাল-পাত্র-ক্ষণ-মিনিট-ঘণ্টা-দিন-মাস-যুগ সবকিছুই উধাও হয়ে গেল। মহাকাশের বুকে সহসা বৈকুণ্ঠলোকে পৌঁছে তারা যেন মুক্তির আনন্দে আত্মহারা হল। আর মনের আনন্দে তখন বেশি করে শুরু করল উদ্দাম মনোহর নৃত্য যার উন্মাদনায় পাখা মেলে পাখি হয়ে আকাশে উড়ে গেল গোপীদের আপন আপন বদ্ধ মন, অনুভূতি। তারা মুহূর্তেই হল আপনহারা, পাগলপারা। সকলেই যেন সেসময়ে অনুভব করতে লাগল যে, তারা হল স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষের শাখে এক-একটি ফুটন্ত ফুল যা শুধু প্রেম দিয়েই তৈরি, প্রেমতেই ভরপুর, প্রেমেই যার জন্ম, প্রেমেতেই যার বেঁচে থাকা আর প্রেমেতেই হারিয়ে যাওয়া।
এদিকে প্রেম বৃন্দাবনের পথে পথে চলতে প্রেমের মধ্যেই পড়ল এই মনটা, অনুভূতির প্রতিটি রূপ ও ছন্দ—সবকিছুরই অন্তরে প্রেমময় হয়ে গেল। কেবল থেকে থেকে তখনও বেজে চলেছে কৃষ্ণের আকর্ষণীয় বংশীধ্বনির অপ্রতিহত মনোহর সুরটা অন্তরে—যা প্রতিনিয়ত আজও বেজে চলেছে আমার মনের সবখানে, সর্বদা, প্রতি পলে পলে …।
[পর্ব-২]
আমাদের জীবনে এমন অনেক ভালোলাগা মুহূর্ত আসে যখন সবকিছুকেই খুব আপনজন বলে মনে হয়। বিগত স্মৃতির প্রতারণা বা অবিশ্বাসের ঘটনাগুলির মধ্যেও তখন একটা অর্থ খুঁজে বুদ্ধিটা বেশ তৃপ্তি বোধ করে। মনে হয় হয়তো এই শুভ ফলটার জন্যই সে ঘটনাটা ঘটেছিল। অতটা অসহায় লাগছিল। কিংবা জীবনের চলার পথে সুখের মতো দুঃখও প্রয়োজন, আনন্দের সঙ্গে বেদনাবোধ এবং প্রেমের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখারও যেন কোথাও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই জীবন হল অভিজ্ঞতার পরতে পরতে একটা বৃত্তকে সম্পূর্ণ করা যা মনের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠগুলিকে জ্ঞানালোক দিয়ে পূর্ণ করে দেয়। যা প্রকৃতির অদৃশ্য পুস্তকটিকে পাঠ করে আমাদের অজান্তেই আমরা সমৃদ্ধ ও দীপ্তময় হয়ে উঠি। তাই ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্ম অধিকার বোধ যেমন সর্বদা সুপ্ত থাকে, তেমনি হারানোর ভয়ও মনকে তাড়িত করে বেড়ায়। এই দুরন্তপনা দোলাচলের ফলেই না প্রেম বড় মহার্ঘ্য জিনিস রূপে সংসারের বুকে যুগে যুগে বিরাজমান রয়েছে। আর প্রেমের মতো এমন অমূল্য স্মৃতি ছাড়া হৃদয়কে কে প্রসারিত করতে পারে? তাই প্রেম বড় রহস্যে ভরা, সযত্নে সুরক্ষিত করে রাখার জিনিস—নচেৎ প্রেমবস্তু তলে তলে উধাও হয়ে যায়।
বলতে কি সাধারণ প্রেমের পিছনে পিছনে গর্ববোধ এবং অধিকার চেতনা দারুণভাবে ছুটে আসে। অহং থেকে জন্ম নেয় গর্ব এবং নিজের প্রতি অত্যধিক আত্মবিশ্বাস থেকে তৈরি হয় অধিকারবোধ। মনে হয় এই দুনিয়ার সবকিছুই পাওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। বিধাতা আমাকে বিশেষভাবে তৈরি করেছে। আমার নমুনা আমি নিজেই, আমার মতো আর একটা পাও কি না খুঁজে দেখো তো তুমি? এমন কথা তো আমরা ঘরে ঘরেই প্রিয়জনদের বলে থাকি। এসব শুনে বিধাতা অলক্ষ্যে থেকে হাসেন। কেমন এই হাসির ধরণ? উদাহরণ দিয়ে বলি, যেমন একজন খুব একটা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি কিনে এনে ভালো করে বাঁধিয়ে বাড়ির বসার ঘরে টাঙিয়ে রাখল। বাড়ির সকলে, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন যখনই কেউ ওই ঘরে আসে তখনই ছবিটি তার নজর কেড়ে নেয় এবং জিজ্ঞাসা করে সকলে জানতে চায়—কে এটা নিয়ে এসেছে, কতই না ছবিটি সুন্দর? না—ওর মনে সৌন্দর্যবোধের একটা মাত্রা আছে। এইসব নানাকিছু বলে যাওয়ার পর যে ব্যক্তি ছবিটি কিনেছিল সে কেবলই গোপনে গোপনে একা একা ছবিটা দেখে এবং হারিয়ে যায় কোন অদৃশ্য সৌন্দর্যালোকে। আর প্রতিবারই ছবিটির মধ্যে নব নব ভালোলাগার অর্থ খুঁজে পায়। ক্রমে ক্রমে ছবিটার প্রতি তার সূক্ষ্ম অধিকার বোধ জন্মাল। সে ভাবল ছবিটি আমি কিনে এনেছি। এটাকে আমি আমার নিজস্ব ঘরে টাঙিয়ে রাখব এবং দিনরাত সর্বদা দরজা বন্ধ করে একা একা দেখব। এর সৌন্দর্য উপভোগ করব। সে ব্যক্তি করলও তাই। কিন্তু যতই সে এটাকে নিজের ভেবে, নিজের বোধে দেখতে লাগল ততই যেন ছবিটির উদার সৌন্দর্যের মধ্যে খুঁত পেল মনে মনে। তার কেবলই মনে হতে লাগল ছবিটা এই দিকের রঙটা এমন হলে ভালো হত। গাছগুলির পাতায় পাতায় কেমন যেন সতেজতার অভাব। আর তার মনের এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটাও তার সঙ্গে একাত্মবোধ হতে পারছিল না দিনে দিনে এবং সেই ব্যক্তিও ছবিটার মধ্যে হঠাৎ আর কোনো অর্থও খুঁজে পেল না। ক্রমে ক্রমে ছবিটির সঙ্গে তার মনের সংযোগ কেটে গেল যদিও ছবিটি তার ঘরে, দেওয়ালে টাঙানো রইল, তার অধিকারে রইল। কিন্তু পরস্পরের জীবন থেকে হারিয়ে গেল সব রঙ, মাধুর্য, অনুভূতি, স্পন্দনময়তা। কেন এমনটা হল? না—ওই সূক্ষ্ম অধিকারবোধ জনিত নিজের মতো করে পাওয়ার তীব্র প্রবণতা—যা তলে তলে মনকে মহামনা না করে এক সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন করেছে। প্রকৃতিমাতা এরূপ অবস্থায় যেন বলে, ”তোকে কোথায় সৌন্দর্য উপভোগ করে ভালোবাসতে বললুম, আর তুই কিনা তার মর্যাদাকে অবহেলা করে নিজের মনকে কলঙ্কিত করলি—আর নিজেও অবহেলিত হয়ে সবকিছু হারিয়ে ফেললি।” বলতে কি এখানেই সহজ ভালোবাসার সমাধিটা রচনা হয়ে যায়।
এইরকম অধিকাংশ সংসারেই হয়। অন্তর্যামী কৃষ্ণও রাসনৃত্যে গোপীদের প্রেমে আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর মনে গোপীদের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার কোনো অন্ত ছিল না। গোপীরাও কৃষ্ণপ্রেমের মধুর আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তাঁদের মনেও জাগতিকতার লেশমাত্র সেসময়ে ছিল না। কৃষ্ণ স্পর্শে তাঁদের অন্তরের এতদিনকার অতৃপ্তিবোধ, ব্যর্থতা, হতাশা ও আত্মগ্লানির ভাব মুহূর্তে দূরীভূত হয়ে গেল। ছড়িয়ে পড়ল প্রবল আনন্দ, দেহ ও মনে। পরিপূর্ণতার স্রোত যেন উপচে পড়তে লাগল। ললিতার, শৈবার, বিশাখার চোখে-মুখে। সকলের হৃদয়েই সেসময়ে প্রেমের নির্ঝরিণী স্রোত। অনন্তময়তায় হৃদয়ের মাখামাখি যা শুধু আনন্দ হয়ে, সুখ হয়ে, উল্লাস হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল দূরের ওই বৃক্ষশাখে, লতাগুল্মে, যমুনার সলিলে। কিন্তু সহসা অন্তর্যামী কৃষ্ণ এ কী দেখল? এক্ষণে যা তাঁর তৃতীয় নয়নে ধরা পড়ল তার জন্য কখনো প্রস্তুত ছিল না কৃষ্ণ। তাঁর সূক্ষ্ম মন এসব দেখে এত সুখ ও মাধুর্যরসের মধ্যেই হাঁফিয়ে উঠতে লাগল। তাঁর মনে হল এত খুশির মধ্যে নিরানন্দের কালো মেঘ কোনো কোনো গোপী চিত্তকে কেন অধিকার করল? চন্দ্রাবলী, বৃন্দে, ললিতার চোখে-মুখে এ কিসের প্রতিবিম্ব? কেন এমন মাৎসর্যের মৃদু ছবি তাদের চিত্রপটে ভেসে উঠেছে? কৃষ্ণ চাহনিতে অনন্ত বিস্ময়। যে মন অহংহারা হয়, যে মন আত্মসমর্পণের মাধুর্যে ভরা থাকে, যে মন নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েই আনন্দে মাখামাখি থাকে সেই গোপীমনেও কৃষ্ণপ্রেমে গরবিনী হওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠেছে! সংসারে সাধারণ নারীরা যেমন স্বামীর সুখে, অসীম ঐশ্বর্যে, অনন্ত ভালোবাসায় আহ্লাদিত হয়, অহংকার করে—এখানেও সেই সব পাওয়ার করুণ অথচ বিবর্ণ অহংকার গোপীদের মনে কালো রেখাপাত করেছে। কেবলমাত্র একজন অত্যন্ত কৃষ্ণপ্রেমিকা গোপী ছাড়া সকলেরই প্রায় এক অবস্থা। আর ভালো লাগল না কৃষ্ণের। নিজের উদ্যমকে বারেবারে আহত করতে লাগল গোপীদের মনের সুপ্ত অহংকার, আভিজাত্যবোধ। ভালোবাসা যেন ফিকে হয়ে আসছিল। তাই এই প্রবল আনন্দ-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে সরিয়ে নিতেই কৃষ্ণের মন চাইল এবং অদ্ভুত এক মুন্সিয়ানায় এক গোপীর হাত ধরে কৃষ্ণ আবছা অন্ধকারে বনের মধ্যে কোথাও যেন মিলিয়ে গেল।
অন্যান্য গোপীরা তখনও মহানন্দে নেচে চলেছে। কারও কোনো হুঁশ নেই। কিছুক্ষণ এভাবে চলল। তারপরই সহসা সকলের মনে ফেলে আসা গৃহ, পতি, সন্তান, পরিজনদের চিত্র ভেসে উঠতে লাগল এবং এমন দৃশ্যায়ন মনের মধ্যে হতেই তাঁরা থমকে দাঁড়াল। কিন্তু কৃষ্ণকে আর কেউই দেখতে পেল না। বরং যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময়ে সকলেই তাঁরা একে-অপরের মুখের দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে থাকতে লাগল। এতক্ষণ তাঁরা পূর্ণতার আনন্দে হাবুডুবু খাচ্ছিল। শূন্যতাভরা হৃদয়ে পূর্ণকে পাওয়ার মধ্যে যে এত উন্মাদনা আছে তা তাঁরা আগে এমন করে কেউই বোঝেনি। কিন্তু এক্ষণে অন্তর থেকে সেই পূর্ণ আনন্দ, পূর্ণ প্রেম, পূর্ণ সমর্পণ সব উধাও হয়ে গেছে। কৃষ্ণ যে তাদের এভাবে বিহ্বল করে অপ্রস্তুতে ফেলে চলে যাবে তা তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না। এখন কী করণীয় এই জোছনাভরা নিশিতে? ভাবতে ভাবতে বুকের শূন্যতা থেকে চোখে এল ভয়, ভাবনা ও উদ্বেগ। কোনো কোনো গোপীর অন্তরে এলো দুঃখের কান্না। তারা পরস্পর বলাবলি করে কানাইকে খুঁজে বার করতে দলে দলে এগিয়ে যেতে সংকল্প করল।
কিন্তু কৃষ্ণ রাসনৃত্য ছেড়ে উধাও হয়ে গেলেন কেন? আসলে কৃষ্ণ লক্ষ্য করেছিলেন অপার্থিব নৃত্যের মাঝে গোপীদের মুখগুলি গর্ব ও অভিমানে ভরে যাচ্ছিল। কোনো কোনো গোপী নৃত্য করতে করতেই মনে মনে ভাবছিলেন—আমার মতো সুখী এই সংসারে আর কে আছে? আমি কৃষ্ণসান্নিধ্য লাভ করে অতুল ঐশ্বর্য পেয়ে গেছি, আমার মতো শ্রেষ্ঠ আর কে আছে? অন্য একজন গোপী ভাবছিলেন, ”আহা! কৃষ্ণ আমাদের কত ভালোবাসে, কত অনুগ্রহ করল, কতই না আনন্দ পেলাম আজ—আমাদের কি সুখের সীমা আছে, না শেষ আছে?” গোপীদের মনে এমন রহস্যজনক গর্বের চিন্তা হতেই অন্তর্যামী কৃষ্ণ অধীর হয়ে উঠতে লাগল। আবার অন্য কোনো গোপী ভাবতে লাগলেন, ”সত্যিই, জীবনে এমন পরম পাওয়া খুব কমজনের কপালেই হয়! এমনকি কৃষ্ণের সবচেয়ে কাছের ব্যক্তিরা এবং বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীনারায়ণের কাছ থেকে, ইন্দ্রাণী-ব্রহ্মাণীরাও তাদের স্বামীদের কাছে থেকে এতটা প্রেম ও মাধুর্য পায়নি—আমাদের এত আনন্দ রাখব কোথায়!” একসঙ্গে বহু গোপীর মনে গর্ব ও অভিমান দেখে কৃষ্ণ হতাশ হল। তাঁর চোখে ধরা পড়ল যে, গোপীদের দেহটাই এখন এখানে রয়েছে, নাচছে—কিন্তু তাদের মনটা আর আমার সঙ্গে নেই, গোপী মন মান ও গর্বের প্রভাবে কৃষ্ণশূন্য হয়ে গেছে। কৃষ্ণহীন গোপীমনের কথা চিন্তা করে শ্যামসুন্দর শিউরে উঠল এবং রাসস্থলী থেকে অন্তর্ধান করারই মনস্থ করল। আর গোপীরা কি করলেন? গোপীদের সহসা অনুভবে এল যে, তাঁদের মন আর পরমসুন্দর শ্রীকৃষ্ণে নেই তার জায়গায় মনে ভিড় করছে ঈর্ষা। সংসারের এবং দেবলোকের অন্যান্য নারীদের প্রতি। কিংবা মনটায় সংসারের নিত্য মায়া-মমতা এসে ভিড় করেছে। তাই তাদের চিত্তে দোলা দিতে লাগল কখনো স্বামীর গৃহ, স্বামীর স্নেহ-ভালোবাসা, সন্তানের মমতা কিংবা বন্ধুবান্ধব পরিজনদের আকর্ষণ। কৃষ্ণ বিযুক্ত মন-প্রাণের শূন্যতা উপলব্ধি করে গোপীমনে আবার হতাশায় ও বেদনায় আঁকুপাঁকু করতে লাগল। দুরন্ত লজ্জায় নত হয়ে গেল তাদের চোখ ও মুখ। কেঁপে উঠল দুর্নিবার হৃদয়। চোখের কোণে বান ডাকল অশ্রুর। গোপীরা সমবেতভাবে কাঁদতেই লাগল অঝোরে। বেদনায়, ব্যথাভরা মনের যন্ত্রণায়।
এদিকে অনেকটা পথ হাঁটিয়ে নিয়ে এসে একটি কদম্ব বৃক্ষের নীচে কৃষ্ণ রাধাকে গভীরভাবে বারেবারে দেখছিল। রাধাকে সত্যিই আজ বড় সুন্দর লাগছে তাঁর। একমাত্র রাধার মনটাই কৃষ্ণমগ্না ছিল। রাধার চোখে প্রেমের নীরব ভাষা। সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত আত্মসমর্পিত ভঙ্গিমা। তার উপর উজ্জ্বল হাসির আভায় মুখটা বড় স্নিগ্ধময় হয়ে উঠেছে রাধার। আকাশের চন্দ্রিমা আর রাধার চন্দ্রবদনের মধ্যে কৃষ্ণ কোথাও যেন পার্থক্য খুঁজে পেল না। এই নির্জন রাতে কৃষ্ণকে একা পেয়ে বারেবারে আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠছিল রাধা। তার জীবনে যেন সব চাওয়া পূর্ণ হল এক্ষণে। কৃষ্ণ এক অদ্ভুত আবেশে বাঁ-হাত দিয়ে রাধার কোমর বন্ধনীটা জড়িয়ে ধরল। রাধা মৃদু হেসে বাঁ-হাত দিয়ে কৃষ্ণের বেণুটা নিয়ে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এলো। কৃষ্ণ ডান হাতে বাঁশির শেষ প্রান্তটা ধরে রইল। অদ্ভুত এক অনন্তময়তার যুগল মূর্তি। এক চিরন্তন প্রেম যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এতক্ষণে। আর মহাপ্রেমের বুকে সমস্ত কাল যেন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। বলতে কি রাধাকৃষ্ণের দেহ, মন, চিত্ত ও সত্তার মধ্যে এক আশ্চর্য সুরের তরঙ্গ বহে যেতে লাগল। কৃষ্ণ সান্নিধ্যে রাধার মনের সমস্ত পাপড়িগুলি খুলে পূর্ণরূপে বিকশিত হয়ে গেল। দুই সত্তা পূর্ণ হল এক মহাপ্রেমে যার পরিমাপ করার ভাষা এখনও আবিষ্কার করা হয়নি। তবে এটা শুধুই প্রেম, এটা অনন্ত একাত্মায় মগ্ন দুই মন—এক প্রেমে, এক প্রাণে, এক বিশ্বে এক বিশ্বাতীত অপরূপ অনুভূতিতে—এই বুঝিবা প্রেম, বড় প্রেমময় আনন্দময় এই মুহূর্ত-মগ্ন দুটি হৃদয় আনন্দলোকে অসীম আকাশের তলে, বনবীথিকার মাঝে।
এটাই হল সত্য কথা। আমাদের জীবনেও সংসার অরণ্যে চারিদিকে ভালোবাসার মুখগুলি ঘোরাফেরা করে। সকাল থেকে আমরাও আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-বান্ধব-পাড়াপ্রতিবেশীর মুখ দেখি—কিন্তু ভালোবাসার রঙ এক-একটা মুখে একভাবে ধরা দেয়, কখনও সমভাবে সব ভালোবাসা মনে উৎফুল্ল জাগায় না। ভালোবাসার মতো এমন মাধুর্যময়তা আর কিসে আছে? এই সংসারে পিতা পুত্রকে অপত্যস্নেহে ভালোবাসে, স্বামী স্ত্রীকে মধুরভাবে ভালোবাসে, বন্ধু অপর বন্ধুকে সখ্যভাবে ভালোবাসে, মা সন্তানকে বাৎসল্যভাবে ভালোবাসে, ভৃত্য প্রভুকে দাস্যভাবে ভালোবাসে—সবাই সবাইকে ভালোবাসে, কিন্তু তার রঙ ও চরিত্র আলাদা। আর ভালোবাসা এমন ভিন্নধর্মী বলেই মনে হয় সংসারটা মধুর লাগে এবং জীবনের আনন্দের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেয়। এটা সত্যিই ভাববার ব্যাপার। কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধুর প্রেম কোনো কারণে বিরক্তিতে ভরে গেলেও মা সন্তানকে বাৎসল্য ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে আপনার মনের সুখ ও বাঁচার প্রেরণা পায়। অন্যভাবেও এমন বিপরীত চিন্তা ও কর্মের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। যেখানে ভৃত্য প্রভুর কাছে দাস হয়ে থাকলেও, প্রভু পত্নীর কাছে বাৎসল্যের ছোঁয়া পায়, সন্তান স্নেহ লাভ করে—এটাই ভৃত্যকে একটা আলাদা ভালোবাসা ও আনন্দের স্বাদ পাইয়ে দেয়। তাই ভালোবাসা কখন যে কীরূপে কার কাছে হাজির হয় এবং চিরজীবন ধরে পথ চলে তার কোনো হিসেব করা যায় না। এই জীবনে চলার পথে এটা সকলেই উপলব্ধি করে যে, ভালোবাসা হয়ে যায়, ভালোবাসাকে জোর করে, হিসেব-নিকেষ করে কখনোই পাওয়া যায় না। ভালোবাসা ঘটে, ঘটে যায়। কিন্তু কেন ঘটে যায়? কি তার কারণ? এই হল চিন্তার কথা। সত্যিই তার কারণটা কি? আবার তারই-বা কারণটা কি? এসব প্রশ্নের উত্তরগুলি ভারী রহস্যময়। আমরা প্রত্যহ অনেক চেনা ও অচেনা মুখ দেখি। কিন্তু এক একজনের মুখটা মনের ভেতর স্থায়ী দাগ রেখে যায়। হয়তো ক’দিন ওই অপরিচিত মুখটা দেখলাম, কোনো কথাবার্তা নেই, সংযোগ নেই—তবু মনের কোণে ওই প্রথম দেখা ভালোলাগা মুখটার প্রতি একটি মায়ামমতা, ভালোলাগা জেগে থাকে। হয়তো তার সঙ্গে কখনও পরিচয়ই হবে না জীবনে। তবু মনের গোপনে প্রেম সুপ্তভাবে মাথা তোলে—এটা কি সত্যিই রহস্যপূর্ণ ব্যাপার নয়? আবার একসঙ্গে আছে, প্রত্যহ দিন দেখা হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে কিন্তু অভ্যাসের গড়া বা সামাজিকতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তার সঙ্গে এক সম্পর্ক নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি, পথ চলছি। যেখানে শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার নামগন্ধ নেই। বলতে কি ভালোবাসা মাত্রই শ্রদ্ধা ও মহৎ বোধের জন্ম দেয়। কারণ শ্রদ্ধা ও সততার বাঁধন না থাকলে আর যাহোক, সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভূতি কারও হৃদয়ে জন্মায় না। তাই ভালোবাসা বড় সাবধানী এক নাম। তাকে অনেক যত্ন করে, ত্যাগ দিয়ে, নিষ্ঠা দিয়ে গড়ে তুলতে হয়। তবেই সময়ে তার পাপড়িগুলি প্রস্ফুটিত হয়ে চারদিকে সৌরভে ভরে দেয়।
আর এক্ষণে ‘রাধাকৃষ্ণ’কে দেখেই-বা কি বিচার করা যায়? কৃষ্ণ পূর্ণিমার জোছনাতে গোপীদের নিয়ে আনন্দে নৃত্যগীত করছিল। হঠাৎ নারীদের চিত্তদর্পণে মান ও গর্বের প্রতিবিম্ব দেখে অন্তর্ধান করল কৃষ্ণ। যেহেতু রাধার প্রেমে কৃপণতা ছিল না তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছে রাধাকেই। এটাও বোধহয় আর এক গভীরতম সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু কি সেই সত্য চেতনা? আসলে ভালোবাসায় বিকশিত মন নিজে অসীম ও অনন্ত হলেও তার মাধুর্য আস্বাদনে সীমায়িত বস্তু বা ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। প্রতিটি মানুষই চলার পথে নানা অসত্যতা, মিথ্যাচারণ, বিশ্বাসঘাতকতা ও অশুভ আচরণের মধ্যে পড়ে এবং এগুলি তাদের জীবনে বড় ব্যথা ও বেদনা নিয়ে একটা সময়ে মনের কোণে ধরা পড়ে। যা জেগেও থাকে সময়ে-অসময়ে। অথচ মন তো নিজ আনন্দের খোঁজে, সুখের অছিলায় এমন মুখ খোঁজে যা সত্যের, বিশ্বাসের, ভালোবাসার দীপ জ্বালাতে পারে। ঠিক এইসব আদর্শগত মূল্যবোধগুলিই কোনো কোনো মুখের মাঝে, চোখের দৃষ্টিতে বড় বেশি সে সময়ে প্রতিবিম্বিত হয়। আর সেই তৃষিত ব্যক্তিটি তাকেই আপনবোধে গ্রহণ করে স্বপ্ন দেখে, আনন্দ পায়। নিজের জীবনের মূল্যও এর ফলে তখন সে বুঝতে পারে। নিজের মনে আত্মবিশ্বাস ও ভালোভাবে বাঁচার প্রেরণাও ফিরে পায়। ভালোবাসা এমনই একটি পরশমণি যা নিজে অতি মূল্যবান হয়ে সকলকেই তলে তলে মূল্যবান করে। পাঁচ জনের কাছে মহিমান্বিত করে হাজির করে।
এই সংসারে প্রকৃত মধুর প্রেমের সঙ্গে চোখের অশ্রুর এক অদ্ভুত যোগসূত্র আছে। ভালোবেসে যেখানে অশ্রুতে স্নাত হওয়ার জীবন চেতনা নেই সেখানে প্রেমকে অন্তরের নিধি হিসাবে পাওয়া হয়নি। প্রেমের প্রস্রবনে অন্তরে চিন্তার একতানতা তৈরি হয় এবং ভালোবাসার বস্তু যদি মহৎ ভাবের উদ্দীপক তৈরি করে তাহলে মনে সাত্বিক ভাব বৃদ্ধি পায়। বুদ্ধি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মন মার্জিত হয়। ব্যবহার প্রণালী সুন্দর ও মাধুর্যময় হয়ে ওঠে। সারা সৃষ্টিটাই তখন প্রেমিকের দৃষ্টিতে সুন্দর লাগে। অতি সাধারণ বস্তুর মধ্যেও প্রিয়বোধটা বেড়ে যায়। সকলকে আপন ভেবে আনন্দ দিতে ইচ্ছা জাগে। মনে হয় সংসারে যেন নতুন আর একটা জন্ম হয়েছে। হৃদয়ে বিশ্বাসের পরিধিটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। গত দিনের দুঃখ-যন্ত্রণা দেওয়া মুখগুলির প্রতি অন্তরে কেমন করুণার ভাব জেগে ওঠে। সমস্ত প্রাণীদের প্রতিও করুণার ভাব বৃদ্ধি পায় এবং চিত্ত গদগদ হয়ে ওঠে। এমনকি লতাপাতা, পক্ষী, নদী, বাতাস, পৃথিবীকেও জীবন্ত বলে মনে ধারণা জন্মায়। আর এক্ষণে গোপীদেরও তাই হয়েছে। কৃষ্ণ হঠাৎ রাসস্থলী থেকে অন্তর্ধান করেছেন। এতক্ষণ তাঁরা কৃষ্ণের সঙ্গেই ছিলেন। তাঁদের নয়নে ছিল কৃষ্ণবদন, হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেম, বচনে কৃষ্ণবন্দনা, গমনে কৃষ্ণ বিচরণা। তাঁদের অন্তরে সমস্ত চিন্তা শ্যামময় থাকায় যমুনাও শ্যামরূপ ধারণ করেছিল। কুঞ্জবন হয়ে উঠেছিল শ্যাম, চারিদিক শ্যাম, আপন পতি শ্যাম, সন্তান শ্যাম, গোগুলি শ্যাম, বনের হরিণী শ্যাম, কদম্ব বৃক্ষ শ্যাম, কদম ফুল শ্যাম—শ্যাম ছাড়া আর কিছু নয়—কিন্তু যোগমায়ার প্রভাবে তা আর বেশিক্ষণ থাকল না। তাই যেই না গোপীচিত্তে গর্ব ও মান এল অমনিই মনোমোহিনী মাধব কোথায় চলে গেল? গোপীরা পথে বেরিয়ে কেঁদে কেঁদে তাঁকে খুঁজতে লাগল। আর হাহাকার করে বলতে লাগল—কোথায় গেল আমাদের মদনমোহন কৃষ্ণ?
এই গোপীরা কত সুন্দর—কত ভাগ্যবান—তাঁদের প্রাণ-মন-হৃদয় জুড়ে সর্বদা কৃষ্ণরূপের স্ফুরণ হচ্ছে। যে বিষয়ে আমরা সর্বদা চিন্তা করি হৃদয়ে তার স্ফুরণ হওয়ার নামই ধ্যান। গোপীরা সংসারে শত ঝামেলার মধ্যে থেকেও চিত্তকে সর্বদা কৃষ্ণপ্রেমে মজিয়ে রেখেছিল। ফলে তাদের চিত্ত কৃষ্ণমনে চৈতন্য হয়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণকে পাওয়া ছাড়া আর তাদের জীবনে কিছু চাওয়ার ছিল না। বলতে কি মানুষের জীবনে বড় সম্পত্তি হল চিত্ত। চিত্ত হল মনের সেই স্থান যেখানে আমরা দৈনন্দিন জীবনের সঞ্চয়গুলি তুলে রাখি। কেমন হল এই কথাটা? অর্থাৎ আমরা সারাদিনে যা কর্ম করি, চিন্তা করি, আনন্দ করি, দুঃখ-সুখ দিই অপরকে, কিংবা যাই করি না কেন তা চিত্তে গিয়ে সংস্কার রূপে জড়ো হয় এবং পরবর্তী জীবনের গতি নির্ণয় করে। চিত্ত যত সংসারে আসক্ত থাকে মানুষের মনটা তত খণ্ড সুখ পায়। অস্থির হয়ে পড়ে। নিদ্রা ভালো হয় না। জীবনের কোমলতা শুকিয়ে যায়। সর্বদা অহংতাড়িত হয়ে ঘুরে বেড়ায় সেই মানুষ। ‘আমি’ ‘আমার’ ভাবনায় বদ্ধ থেকে সবকিছুকে আঘাত করে। তাইতো চিত্তকে সাবধানে রাখতে হয়। এই চিত্তকে সংযত, মজবুত, শক্তিশালী, সাত্বিক, নির্মল, আনন্দময় ও শান্তিপূর্ণ করে গড়ে তোলার জন্যই তো উপাসনা করার কথা সব শাস্ত্রে বলা হয়েছে। স্বাধ্যায়, জপ, মন্ত্রপাঠ, গুরুকরণ, ইষ্টদেবতা তথা ভগবানের স্মরণ-মনন-নিদিধ্যাসনের ক্রিয়াকেই উপাসনা বলা হয়। এই উপাসনা দীর্ঘকাল শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠাভরে করলে চিত্ত সত্য স্ফুরণযুক্ত হয় কিনা চিত্তে পরমেশ্বরের জীবন্ত অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়। এই সংসারে দেখা যায় কোন মেয়ে পছন্দের ছেলেকে ভালোবাসলে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সেই ছেলেটার চিন্তা, রূপ, গুণ, কর্ম মেয়েটার মনে সর্বদা ধেয়ে আসে, স্বাভাবিকভাবেই এই স্ফুরণ হয়। ভালোবাসাজনিত কারণে চিত্ত একমুখী হয় বলেই এটা সম্ভব হয়, এর জন্য যথেষ্ট সাধনার প্রয়োজন হয় না। ঠিক তেমনি আপন আপন ইষ্টদেবকে গভীরভাবে ভালোবাসলে মানুষের মনে পরমদেবতার রূপ-গুণ-লীলামাধুর্য এমনিতেই স্ফুরণ হতে থাকবে। এই ভালোবাসা এবং স্ফুরণ হল সহজ ও স্বাভাবিক সাধনা। গোপীদের এটাই হয়েছিল। তাদের চিত্ত কৃষ্ণময় হয়ে গিয়েছিল। কেবল দেহটা রাসস্থলীতে নৃত্য করছিল। কিন্তু অহংবশতঃ মানের প্রভাবে গোপী চিত্তগুলি কৃষ্ণবিমুখ হতেই শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্ধান করল যা গোপীদের কাছে মোটেই অভিপ্রেত ছিল না।
এ তো শুধু গোপীদের কথা নয়। এটা হল যুগ-যুগান্তরের সব তপস্বী, সাধু-সন্ন্যাসী, ভক্ত, প্রেমীদের মনের কথা। এই বেশ ভালো করে মনটা ভগবানে বসল, বেশ অতীন্দ্রিয় আনন্দ হচ্ছিল, কিন্তু কোথা থেকে অহংকার এসে মনটা বিষয়ের দিকে নিয়ে গেল। ভগবানে মন বিযুক্ত হল। মনের চঞ্চলতা ভাব এল। মানুষী ভাবে মন সংসারে মেতে রইল, দিব্যভাবের স্রোতটা থেমে গেল। মনের এই ভালো-মন্দ অবশ্য স্বাভাবিক ব্যাপার। এতে হতাশা হতে নেই। মনে প্রকৃতির কোনো প্রারব্ধ কর্মের প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে ভাবতে হয়। তাই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। যাকে অন্তরঙ্গ হিসাবে ভেবে ভালোবাসি তার দ্বারা কিছু না কিছু অনুভব সবসময়ই হয়। হয়তো মুখ দেখলেই মনে আনন্দ হয়, হয়তো কোনো একটা মহৎ স্মৃতি অন্তরে ভেসে উঠল, হয়তো কোনো একদিনের উচ্চ ভাবাবেগ মনে পড়ে গেল। এসবেই মনে ভাবের, পবিত্রতার, প্রেমের স্ফুরণ ঘটে। তাই সাধনা আরম্ভ করলে, ইষ্টকে ভালোবাসা শুরু করলে থেমে যেতে নেই। অন্তরে তার জন্য ভালোবাসার দুর্বার স্রোতটি রেখে দিতে হয় সর্বদা। তবেই সময়ে গুরুকৃপা, ইষ্টকৃপা, শাস্ত্রকৃপা এসে যায়। এটা যেমন গুরু, ইষ্ট, পরমেশ্বরের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি শাস্ত্র ভগবানের বিষয়েও সত্য। দীর্ঘদিন নিষ্ঠাভরে গীতা, চণ্ডী, ভাগবত বা কথামৃত পাঠ করলে উক্ত শাস্ত্রীয় সংস্কারগুলি চিত্তে দারুণভাবে গেঁথে যায় এবং এমনি এমনি শাস্ত্রের উচ্চভাবগুলি, উপদেশগুলি, দিব্য সংস্কারগুলি মনমাঝে খেলা করে। তখন খুব আনন্দ হয়। মনে হয় গীতাশাস্ত্রের মধ্য দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমার হাত ধরেছেন। চণ্ডীর মধ্য দিয়ে জগজ্জননী মা কালী আমায় রক্ষা করে চলেছেন। ভাগবতের মধ্য দিয়ে যেন নিয়ত কৃষ্ণের মধুর মূরলীর আওয়াজ শুনছি। তাই সাধনা করে যেতে হয়, প্রতিকূলতা এলেও থামতে নেই। সাধনার কথা অজ্ঞদের কাছে আলোচনাও করতে নেই। ভক্তিভরে ইষ্টদেবতার চরণে প্রার্থনা করলে সবই তিনি জানিয়ে দেন। চাই কি জ্বলন্ত বিশ্বাস—চাই কি প্রতিদিন শ্রদ্ধায়, পবিত্রতায়, প্রেমে, ব্যাকুলতার সঙ্গে ইষ্ট মিলনের আকাঙ্ক্ষা। এই ভাগ্যবতী গোপীদের এক্ষণে সেই অসীম ব্যাকুলতা মনে জেগেছে।
কেন এই নিদারুণ ব্যাকুলতা এল? না—গোপীদের দেহ-মন-প্রাণ-বুদ্ধির সত্তাগুলি কৃষ্ণময় হয়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণছাড়া তাদের নিজস্ব কোনো ভাবনা ছিল না। গোপীরা স্বামীসঙ্গে থাকলেও পরিবার বা স্বামী-পুত্র নিয়ে বিশেষ কোনো চিন্তা করত না। কৃষ্ণের শরণাগত থেকে কেবল সংসার যাত্রা নির্বাহ করে যেতেন। সাধকেরাও প্রকৃত সাধনকালে অপরের সান্নিধ্যে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। কারণ চিত্তে অন্য ভাবনা এসে পড়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে। চিত্তের মলিনতার বোধই হল নরক দর্শন। চিত্তের মধ্যে যদি সর্বদা অপরের দোষ-ত্রুটি ধরা হয়, সমালোচনা বা নিন্দা করা হয়, নোংরা চিন্তা করা হয়, অর্থ-নাম-যশ বিষয়-বাসনায় যদি চিত্তটা ব্যস্ত থাকে তাহলে মন নেমে যায়। মনের এই কলুষতার নামই দ্রষ্টার নরকে বাস করা। তাই ভক্তিমান সাধক সাধনের সময় প্রথমে নিজেকে বাঁচিয়ে চলেন। কারণ নরনারীর আপন আপন মনের ভাবগুলির সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপ পরমাণু তাদের চারপাশে ছেয়ে থাকে এবং তা সজোরে অপরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। আর তা ক্রমশ চিত্তের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। তাইতো বলা হয়—যে যেমন সঙ্গে থাকে সে ক্রমশ তেমনি হয়ে যায়। এটা মহাজাগতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারই অনুরূপ খেলা। সেজন্য গোপীমন কৃষ্ণভাবনায় সর্বদা আচ্ছন্ন থাকত। আরও দেখা যায় সাধক কাকভুশুণ্ডীর জীবনে। যেখানে কাকভুশুণ্ডীর আশ্রম ছিল সেখান থেকে কয়েক মাইল ব্যাপী রামনামের তীব্র প্রভাব ব্যাপ্ত ছিল। সেই অঞ্চলের অধিবাসী, পশুপাখির অন্তরেও স্বতঃস্ফুর্তভাবে রামনাম হত। এমনকি কোনো মূঢ় ব্যক্তিও যদি কাকভুশুণ্ডীর আশ্রমে এসে যেত তাহলে অজান্তে তার মনে রামনাম নৃত্য করত। এ-কারণেই সাধনস্থলীকে খুব পবিত্রভাবে যত্ন করে রাখতে হয়। যাতে দিব্যভাবের তন্মাত্রা সেই স্থানটিতে সর্বদা সতেজ থাকে। কাকভুশুণ্ডী রামনামের প্রভাবে হিরণ্যগর্ভ অবস্থার উপলব্ধি করেছিলেন। হিরণ্যগর্ভ হল বিশ্বমন। আর যেহেতু সব মনই সূক্ষ্মতমভাবে বিশ্বমনে অন্তর্ভুক্ত তাই কাকভুশুণ্ডীর প্রভাব আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সকল সাধকের জীবনে এটি সত্য, এমনকি সাধারণ মানব-মানবীর জীবনেও। যার অন্তরে যেমন ভাব তেমনি দীপের আলোর মতো তার দেহমনের পরমাণুগুলি চারপাশে ছড়িয়ে থাকে। অত্যন্ত যোগদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি মুহূর্তেই নিজের মন বিশ্লেষণ করে এইসব তন্মাত্রার স্বরূপ বিচার করে বলে দিতে পারেন। এটা কেমন ধারা সত্য ঘটনা? যেমন আমরা আমাদের অন্তরের ভাবগুলি সম্বন্ধে সকলেই জানি—নিজ নিজ মনে আমরা কি ভাবছি তা কি খেয়াল করলে বুঝি না? সবই বোঝা যায়। তেমনি হিরণ্যগর্ভে স্থিত যোগী অপরের মনের ভাবসকলও জ্ঞানচক্ষু দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে পারেন।
যাহোক, হয়েছে কি গোপীদের মনের অহংভাব দেখে কৃষ্ণ অন্তর্ধান করলেন রাসস্থলী থেকে। গোপীদের চিত্ত থেকে এক্ষণে তিনি উধাও হয়ে গেছেন। তাই গোপীমন দীন, হীন হয়ে গেছে। পূর্বের মতো আর মনে আনন্দ নেই। হৃদয়ে তৃপ্তি নেই। সত্যি বলতে কি ভগবানকে ছাড়া যথার্থ তৃপ্তি বা শান্তি এ সংসারে কোথায়? এ-সংসারে লোকে সারাদিন নানা পেশায় কাজ করে কিন্তু দিনশেষে পরিশ্রান্ত হয়ে নানারকম আজেবাজে আনন্দ করে সময় কাটিয়ে দেয়। তাতেও তৃপ্তি পায় না মনে। উকিল সারাজীবন ওকালতি করে পেশায় তৃপ্তি পায় না। শান্তি নেই যথার্থ রাজনৈতিক নেতার, শিক্ষকদের, ডাক্তারদের—সবাই কমবেশি চাওয়া-পাওয়ার জগতে বিভ্রান্ত থাকে। হায়! হায়! ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা, তবু মনে চাহিদার শেষ নেই, প্রাণে শান্তি নেই—কেন এমনটা হয় বাস্তব জগতে? এটাই ভগবানে বিযুক্তি, ভগবানের নামের সংযুক্তিহীন ভাব। ব্যাপক অর্থে এটাও সেই গোপীদের চিত্ত থেকে কৃষ্ণ অন্তর্ধান হয়ে যাওয়ার ব্যাপার। লোকসকলের মনে ভগবানের মানস সন্তান ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা-বিশ্বাস-ভক্তি-ত্যাগ-বৈরাগ্য-তপস্যার’ প্রভাব নেই। তাই চিত্ত সদা চঞ্চল। আর মন ‘আমি’ ‘আমার’ অহংকারে সর্বদা আচ্ছন্ন। এই ভাবে থাকলে রোগ-শোক-দুঃখ-যন্ত্রণা-আঘাত বেশি খেতে হয়। ভগবানের মায়াপ্রকৃতি এমন অভিমানী সন্তানদের দারুণভাবে আঘাত করে। যন্ত্রণা দেয়। তাই জীবনের চলার পথে ধর্মবোধকে আশ্রয় করে থাকতে হয়। ভারতের সনাতন মহাপুরুষদের জীবনচরিত কথা, ভাগবত শাস্ত্রাদির কথা, তত্বজ্ঞ মহাপুরুষদের জীবনের নানা উপলব্ধির কথা, উপদেশের কথা, বিচিত্র সাধনপ্রণালী ও ফলের রহস্য কথা শুনতে হয়। এতে অস্থির চিত্তটা শান্ত হয়। মনটা ভগবানে প্রেমযুক্ত হয়। মানুষের অন্তরমন সর্বদা পূর্ণতা চায়। কিন্তু সংস্কারের বিভিন্ন সংঘাতে তা আমাদের মনকে সর্বদা বুঝতে দেয় না। মনের গহনের এই সংস্কারের চলাফেরা এক আশ্চর্য ব্যাপার। কিছুতেই সংস্কাররাশিকে যেন শেষ করা যায় না। অশুভ সংস্কারের কারণেই গোপীচিত্ত মদ ও গর্বে ‘আমি’ময় হয়ে গিয়েছিল এবং কৃষ্ণকে নিজ নিজ অন্তঃকরণ থেকে হারিয়ে ছিল।
এখন দেখা যাক—কৃষ্ণকে হারিয়ে গোপীদের বিরহ বেদনা কতদূর পৌঁছেছিল? কৃষ্ণ অন্তর্ধান করতেই গোপীরা নিজ মনের মধ্যেই বেশি বেশি করে কৃষ্ণপ্রেম খুঁজতে লাগল এবং সেখানে কৃষ্ণ অনুভূতির রহস্যগুলি যা সঞ্চিত ছিল তাই দিয়েই কৃষ্ণকে অনুসন্ধান করতে লাগল। গোপীমনে কৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য কি কি ছিল? কৃষ্ণের চলার ভাবভঙ্গি, বেণুধ্বনি, সপ্রেম দৃষ্টি, মনকাড়া হাস্য, হৃদয় ভোলানো কথাবার্তা এবং আরও অনেক কিছু যা গোপীচিত্তে স্তরে স্তরে সঞ্চিত ছিল। গোপীরা সংসারে থেকেও কৃষ্ণকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। আর ভালোবাসার জিনিসের সবকিছুই হৃদয়কন্দরের গভীরে সুপ্ত থাকে যা মাধুর্যময় স্মৃতিরূপে বিপদে-আপদের সঞ্চয় হয়। গোপীরা এক্ষণে সেই সঞ্চয়ে হাত দিলেন। তাঁরা সমবেতভাবে কৃষ্ণলীলার অনুধ্যান করতে লাগলেন। কৃষ্ণ কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, জন্মের পর গোকুল থেকে বৃন্দাবনে কেন এসেছিলেন, কংস কেন সব শিশুদের বধ করতে আদেশ দিয়েছিল, পুতনা বিষ স্তন্য পান করতে দিলেও কৃষ্ণকৃপায় কেমনভাবে তার শুভগতি হয়েছিল এসব। এছাড়া কৃষ্ণের অঘাসুর, বকাসুর বধ, দামবন্ধন লীলা, গোবর্ধন পর্বত ধারণ, কালীয় নাগ দমন, গোষ্ঠলীলা, ব্রহ্মমোহন লীলা প্রভৃতি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল। আর সকলে মিলে তা অভিনয় করতে লেগে গেল। কোনো গোপী কৃষ্ণের মতো বাঁশি বাজাতে লেগে গেল, কোনো গোপী কৃষ্ণ অনুকরণে গোবর্ধন পর্বত ধারণ করল, কোনো গোপী কালীয় দমন করতে লেগে গেল, কোনো গোপী শৈশবের কৃষ্ণ হয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে মা যশোদার কাছে যেতে লাগল, কোনো গোপী উচ্চস্বরে কৃষ্ণ গুণগান করতে লাগল। এভাবে কৃষ্ণলীলার স্মরণ, মনন, ধ্যান ও কীর্তন করতে করতে গোপীরা বনপথ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। আকাশের চাঁদিমা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলতে লাগল কৃষ্ণদর্শনে।
[পর্ব-৩]
গোপীদের মতোই এই সংসারে অনেক নারী-পুরুষ খুঁজে চলেছেন প্রকৃত প্রেমকে। কারো কারো ভাগ্যে প্রেম খুঁজতে গিয়ে জোটে অপমান, লাঞ্ছনা এবং তীব্রতম মানসিক আঘাত। অসংখ্য নরনারীর জীবনে প্রেমের ছোঁয়ার কোনো অনুভূতিই নেই। আবার অনেকে অল্প-স্বল্প দুঃখ-বেদনার পর প্রেমকে আপন করে কিছুটা অনুভব করে। কিন্তু কেউই বিনা দুঃখ-যন্ত্রণায় দুর্লভ প্রেমকে আপন অনুভবে আনতে পারে না। আসলে প্রেম জিনিসটা তো আর চোখে দেখা যায় না। অনুভব করা যায়। মনের সংস্কার বা আগাগোড়া চিন্তার তরঙ্গগুলি সত্য ও ন্যায়ের সঙ্গে বাঁধা থাকলে তবেই অধরা প্রেমকে ধরা যায়। আপন মনের মাধুরীতে। প্রেম তাই বড় অভিজাত সম্পদ। কেবলমাত্র মহতের সঙ্গে থাকলেই তাকে মাঝেমধ্যে স্পষ্টরূপে ধরা যায় ব্যবহারিক জগতে। নচেৎ সবই তো স্বার্থে ভরা। হেথা স্বার্থের টানাটানিতে প্রেম যে সর্বদা মাথা খুঁটে মরে। মহতের সঙ্গগুণে মনের বিকাশের সঙ্গেই প্রেম আসে। প্রেম নিজে সুন্দর ও সৎ সেজন্য মনে প্রেমের আগমন হলেই মন সুন্দর হয়। দেহটাও অত্যন্ত চোখে লাগে। শরীরের ইন্দ্রিয়দের মধ্যেও কোমল ভাব লক্ষ করা যায়। অন্তরের গহনে প্রেম বাস করে বলেই ভঙ্গুর পৃথিবীটাকে ভাল লাগে। জীবনে শত দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যেও আনন্দের দীপ জ্বলে মনে। এহেন প্রেম আছে বলেই না সংসারটা এত মায়াভরা লাগে। এত স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোলাগা পরিবারে ছড়িয়ে রয়েছে। তাই নিত্য যাতে মনে প্রীতিভাব বাড়ে তারই তো চেষ্টা করা উচিত।
অতি সুন্দর এই শারদ পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাতে গোপীমনেও সেই প্রেম তরঙ্গের দোলা লেগেছে। গোপী মন চায় প্রেম। তার অন্তরে দুর্বার আকর্ষণ। কৃষ্ণ সুখ সঙ্গ কামনায়। আর গোবিন্দও প্রেমবর্ধনে বড় চতুর। তিনি সম্যক বোঝেন কিভাবে গোপী চিত্তের প্রেমকে অনন্তভাবে বিস্তার করা যায়। সেজন্যই না সুচতুর গোবিন্দ ব্যাকুলচিত্ত গোপীদের রেখে কোথায় সরে পড়েছেন। গোপীরা কৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনি শ্রবণে এসেছিলেন বনে। এই বেণুধ্বনিই তাদের মধ্যে অভিসারিকার শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিল। তারা সব ছুটে এল। নৃত্যগীত হল। আনন্দের চরম সীমায় পৌঁছেও গেল। কিন্তু চরম আনন্দের পর কৃষ্ণ তাদের ছেড়ে চলে যাবে একথা গোপীমনে কল্পনাতেও ঠাঁই পায়নি। তাই গোপীরা ক্রন্দনরত। অভিমানী হয়ে পড়েছেন। মনে তাদের ক্ষোভ। অনুসন্ধানের তীব্র স্পৃহা হৃদয়ে। অনেক গোপীই রাসলীলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মনের ভাব ভালবাসার পাত্রের সঙ্গে একাত্মা হয় যাওয়া। কিন্তু মনটা কৃষ্ণচিন্তা করে গোবিন্দের মনে কিছুটা মিশে গেল। কিন্ত দেহ তো জড়। সে তো আর গলে যাবে না। তাহলে ভালবেসে সর্বদা একাত্মা অনুভব কী করে সম্ভব হবে? না—শ্রবণ, দর্শন, স্মরণ, মনন ও ধ্যান। ভালবাসার পাত্র যদি সুন্দর ও আদর্শবান হয় তাহলে সর্বদাই তার কথা ও গুণাবলী শুনতে ইচ্ছা করে। শুনতে শুনতে মনটা কোমল হয়। চিত্তে তখন প্রীতির স্ফুরণ ঘটে এবং ভালবাসার পাত্রকে চোখে চোখে রাখতে ইচ্ছা করে। তাই দর্শন প্রয়োজন। চোখে দেখলেও মনে একটা অজানা তৃপ্তি আসে। কথা হোক না হোক, সঙ্গ হোক না হোক, তবু তো চোখের দেখা রোজ দেখা যায়। এতেই তৃষিত আত্মা যেন তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। তাই না অনেকে বলে—বাবা! তোমাকে দেখলেও আনন্দ হয়! কিন্তু দুর্বার প্রীতিতে দেখলেই চিন্তা শেষ হয় না। মনে মনে সর্বদা স্মরণ-মনন চলতে থাকে। দেহটা সংসারে কাজে মেতে থাকে। কিন্তু মনে মনে ভালবাসার সুখস্মৃতি অন্তরে ক্রিয়া করে। তখন হৃদয়ে এক অপার্থিব আনন্দের পুলক হয়। এই অপার্থিব সুখস্মৃতি স্ফুরণেই মন আরো গভীরে গিয়ে প্রিয়তমের চিন্তা করে এবং তীব্রভাবে আনন্দ আস্বাদন করে—এটাই ধ্যান। কিন্তু গোপীদের এক্ষণে এত ভাবার সময় নেই। তারা কেবল কৃষ্ণদর্শনে, কৃষ্ণস্পর্শনে, কৃষ্ণ সম্ভাষণেই চিরসুখী হতে চায়। তাই গোপীরা হলেন ধৈর্যহারা, চরম উন্মাদিনী, স্রোতধারা। গোপীরা কি সত্যিই জড় ও জীবনের পার্থক্য ভুলে গেল? ভাবের আবেগে কি তাদের বোধবুদ্ধি সব লোপ পেল? নইলে কেন তারা বনের গাছপালাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে কৃষ্ণ কোথায় গেল? তারা কি পরমসুন্দর কৃষ্ণকে দেখেছে?
সমবেতভাবে কৃষ্ণলীলা অনুধ্যান করতে করতে বনপথ দিয়ে প্রিয়তমকে খুঁজতে গোপীরা এগিয়ে চলেছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ যে ব্যক্তি বা বস্তু মনকে আনন্দের শিখরে তুলে দেয়, অহংকারকে কমিয়ে ভারমুক্ত করে মনকে, সেই রহস্যময় বস্তু বা ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ সব শুদ্ধ মনের। শুদ্ধ মন অহংকার মুক্ত হতে চায়, আত্মসমর্পিত হতে চায়, নিজের প্রকৃত অস্তিত্বকে জানাতে চায়—কিন্তু কার কাছে তারা জানাবে? আত্মসমর্পিত হবে? তাদের প্রকৃত জীবনচেতনাকে তুলে ধরবে? কারণ এই সংসারের বুকে বিশ্বাসের পাত্রগুলি সর্বদাই কেমন যেন চলবান। ধীর বা স্থির নয়। আবার তাদের মধ্যে মহত্বও সর্বদা ধরা পড়ে না। সবাই যেন কেমন আগোছালো। যদিও পোশাকের চাকচিক্যে, বাকবিন্যাসের দৌলতে তা সহজে বোঝা যায় না। কিন্তু একটু একটু মেলামেশার পরই একে-অপরের চোখে ধরা পড়ে যায়। আর তখন যার কাছে সে নিজেকে মেলে দিতে গিয়েছিল তার অবস্থা বিবেচনা করে পিছিয়ে আসে। অন্তরে করুণার ভাব নিয়ে তাকে নিরীক্ষণ করে। যদিও বাইরে তাকে উচ্চ আসনে বসিয়ে রাখে। এ বড় অদ্ভুত ব্যবহার। এরকমভাবে সংসারের নরনারীরা অভ্যস্ত হয়ে রয়েছে। তাই সমর্পিত হওয়ার যথার্থ অনুভব বড়ই কম। আসলে সংসারে সম্পর্কিত নরনারীরা সর্বদাই একে-অপরের কাছ থেকে সবটা ভালবাসা চায়। স্বামী চায় তার স্ত্রী তাকে সবটা মন দিয়ে ভালবাসুক। একটুকুও যেন মন তার বাইরে না থাকে। স্ত্রী ভাবে তার স্বামীর মনের বিন্দুমাত্র অংশ বাইরে থাকা উচিত নয়। আগে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর যেন মোটেই না হয়। স্বামীর যেন সব মনটা, সব ভালবাসাটা আমার উপরই থাকে। কিন্তু যখন দেখে স্বামী বেচারা সব মনটা চেষ্টা করেও দিতে পারছে না তখন নানা ভর্ৎসনা স্ত্রীর কাছ থেকে শুনতে হয়। গঞ্জনাতেও কান ঝালাপালা হয়ে ওঠে। তখন ক্ষণেকের তরে বিবাহের বন্ধন ভাবটা মনে পড়ে যায় পুরুষটির। কিন্তু বেরিয়ে আসার পথ কি? তা কেউই জানে না। প্রকৃত ভালবাসা জন্ম নেয় দেহবোধের বাইরে থেকে। মনটা যত শুদ্ধ হয় ততই স্পন্দনময়তা ও সর্বব্যাপ্তিত্ব ভাবটা বেড়ে যায়। এই অসীম প্রসারিত মনেই ভালবাসায় পূর্ণ থাকে। দেহকে সম্পূর্ণ সত্য ভেবে তাকে নিয়ে বিলাস করার দুর্বার ইচ্ছা তমো ভাব থেকে হয়। দেহকে আত্মা ভাবাই হল তমো গুণ। দেহ ও মনকে ‘আমি’ ‘আমার’ বলে অহংকার করা ও তা দিয়ে সর্বদা নিজের করার বাসনা হল রজো গুণ। আর দেহ-মনকে প্রকৃতির অংশ ভাবা এবং পরমেশ্বরের ইচ্ছায় সবকিছুই সম্পন্ন হচ্ছে—এই বোধে দৃঢ় হয়ে জগতাতীত সত্তাকে স্পর্শ পাওয়ার জন্য দিবারাত্র চেষ্টা করাকেই বলে সত্বগুণ। এই তিন গুণ স্থির কিছুই নয়। ভাবনার প্রাবল্যে গুণত্রয়ের সর্বদাই পরিবর্তন ঘটছে। সত্ব গুণ পর্যাপ্ত হলে গোটা বিশ্বকেই ভগবানের জীবন্ত শরীর বলে মনে হয়। যেহেতু কৃষ্ণচেতনায় গোপীমনের আঁধারটা অনেকটা কেটে গেছে তাই এই পৃথিবী, বৃক্ষসকল সবকিছুকেই তারা প্রাণবন্ত মনে করছে। তাই বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে ‘কৃষ্ণকে তোমরা দেখেছ’ বলে জিজ্ঞাসা করছে। অথচ কৃষ্ণ যখন তাদের কাছে ছিল তখন গোপীমনে সত্বগুণটা সর্বদা ছিল না। রজো ও তমো গুণের বাহুল্যেই না তাদের মনে অহংকার ও ঈর্ষার আবির্ভাব হয়েছিল। আর তা দেখেই তো কৃষ্ণ চলে গেছেন বনবীথিকার পথ ধরে কোথায়। কৃষ্ণ ইচ্ছা করে যায়নি। গোপীদের চিত্ত শুদ্ধতার অভাবের জন্যই এটা হয়েছে। তারা তো জ্ঞানী নয়, ভক্ত। তাদের তো জানার কথা নয় যে সর্বদা কৃষ্ণসান্নিধ্য পেতে গেলে অন্তরে সত্বগুণকে আশ্রয় করে থাকতে হয়। সত্বগুণ যদি চিত্তে না থাকে তাহলে অনন্ত প্রেমদেবতা শ্রীকৃষ্ণ বসবেন কোথায়? আর তার লীলাটাই বা কিভাবে হবে? সমবেত গোপীচিত্তে সত্বগুণটা সরে গিয়েছিল বলেই কৃষ্ণ চোখের বাইরে চলে গেছে। এটা হচ্ছে ধ্রুব সত্য কথা সকল ভগবৎ ভক্তের ক্ষেত্রেই। যদি চিত্তে সত্বগুণ থাকে তবেই ঈশ্বরচেতনায় মনটা পূর্ণ হয়। কিন্তু সত্বগুণ না থাকলে বা প্রারব্ধবশত মনের কাম-ক্রোধজনিত কারণে ব্যক্তিত্বটা অবনমিত হলে আবার আমরা জগতের মধ্যে ভেসে যাই। তখন মনটা মলিনতাবশত জগতের মধ্যে লিপ্ত হয়ে থাকে। জগৎ ছাড়িয়ে জগৎপতি নারায়ণকে ধরে থাকতে পারে না। সেজন্য ঈশ্বরের নাম গুণগান-সাধুসঙ্গ-শাস্ত্রপাঠ করে মনটিকে সংযমে রাখতে হয়। যথার্থ সাধুসঙ্গ ও সৎগ্রন্থ অনুশীলনেই মনের সাত্বিকতা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মনটা আবার কৃষ্ণসান্নিধ্য লাভ করে। আর এটাই হল যথার্থ পরমানন্দ। গোপীদের মন থেকে কৃষ্ণসঙ্গজনিত পরমানন্দটি হারিয়েছিল। তারা নিরন্তর কৃষ্ণনাম ও লীলা অনুধ্যান তা আবার জাগিয়েছে। তাই সত্বগুণটা এক্ষণে বেড়ে গিয়ে সম্মুখস্থ বৃক্ষকে প্রাণবন্ত ভাবছে। আর যা ভাবনা হতে থাকে তাই ক্রমশ কর্মে রূপ পায়। এখানে গোপীদের সত্বগুণের প্রভাবে মনে দিব্য প্রেম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বনের গাছগাছালিতেও কৃষ্ণস্পর্শের পুলক লক্ষ করছে। বস্তুত অন্তরের প্রেমই বাইরের ঘটনাগুলিকে তপ্ত কিংবা শীতল করে প্রকাশ করে। যদি অন্তরে গভীর প্রেম ও বিনম্রভাব থাকে তাহলে সংসারে সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে ঝগড়া হয় না। একে-অপরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও প্রীতির ভাবে দেখে। অন্তরের গুপ্তপ্রেমই বাক্যের মধ্যে রস সৃষ্টি করে বাক্যকে মধুময় ভাবে প্রকাশ করে। আর তা অপরের কর্ণে এসে অদ্ভুত আনন্দময় স্পন্দন সৃষ্টি করে এবং আপনবোধে তাকে আঁকড়ে ধরে। গুপ্তপ্রেমই শব্দকে সুশব্দ, বিদীর্ণ রূপকে অপরূপ, নীরসকে রসময়, অশান্ত পরিস্থিতিতে শান্ত ও সুন্দর রূপে প্রকাশ করে। এমন শক্তিমান প্রেম এলে চিত্ত থেকে ভয় চলে যায়। আর সংসারটাও মুক্তির ক্ষেত্র বলে উপলব্ধি হয়। তখন পার্থিব বিষয়গুলি অপ্রাকৃত বস্তু বলে মনে প্রতীয়মান হয়।
যাইহোক, এই প্রেমকে স্পর্শ করতে গেলে প্রথমে নিজের মধ্যে প্রেমকে জাগাতে হয়। তারপর সর্বভূতে দিনে দিনে প্রেমের বিস্তার করতে হয়। যদি আমরা নিজেদের অবিশ্বাস করি, মলিন ভাবি, শুষ্ক, অনিত্য ও অসত্য ভাবি তাহলে প্রেমচিন্তা মনে কিভাবে বিকশিত হবে? আত্মচিন্তার উপর ভর করেই প্রেমকলা বৃদ্ধি পায়। তাই আত্মভাবে বলীয়ান হওয়া ছাড়া প্রেমের সাবলীলতা থাকে না। গোপীরা এক্ষণে আত্মভাবে বলীয়ান হয়েছেন। যিনি নিখিলবিশ্বের অধীশ্বর, যিনি সর্বভূতে আত্মরূপে বিরাজমান সেই কৃষ্ণরূপ অন্বেষণের মানসে গোপীরা নিকটস্থ বড় বড় গাছেদের জিজ্ঞাসা করলেন, ”হে অশ্বত্থ, হে বট—জানো, নন্দের নন্দন আমাদের প্রেমবিহ্বল করে চলে গেছে, তোমরা তাকে কি দেখেছ—কোন পথ ধরে চলে গেছে?” গোপীরা ভেবেছিল যেহেতু বৃক্ষরা পুরুষ তাই নারীর গভীর মনোবেদনা তারা কিভাবে বুঝতে পারবে? সেজন্যই বোধহয় বৃক্ষরা উত্তর দিচ্ছে না। তার চেয়ে বরং তুলসীকে জিজ্ঞাসা করি। এই ভেবে তারা গোবিন্দ-চরণপ্রিয় তুলসীকে বিনম্রভাবে জিজ্ঞাসা করল, ”ওগো তুলসী! আমাদের প্রাণপ্রিয় কৃষ্ণ কোথায় গেছেন? তুমি কি তাঁকে এ পথ দিয়ে যেতে দেখেছ?” তুলসী কোনো উত্তর দিল না দেখে বিহ্বল গোপীরা ভাবল যে, তুলসী কেন কোনো উত্তর দিচ্ছে না? বুঝেছি তুমিও কৃষ্ণপ্রণয়ে আসক্ত। তাই তোমার মনে হিংসা জমেছে! ঠিক আছে তোমায় উত্তর দিতে হবে না। আমরা বরং মালতি, মল্লিকা, যূথি, পিয়াল, বকুলকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। ওগো মল্লিকে, তোমরা কি নয়নাভিরাম কৃষ্ণকে এ পথ দিয়ে চলে যেতে দেখেছ? মালতিরাও কোনো উত্তর দেয় না দেখে গোপীরা আম, কাঁঠাল, বিল্ব বৃক্ষদের জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু তপস্বীর মতো তারা স্থির রয়েছে দেখে বিদ্রুপ করে গোপীরা বলল—ও! তোমরা বুঝি কৃষ্ণধ্যানে মগ্ন! এই হল প্রেমের চরিত্র। যথার্থ প্রেম হলে সব একাকার হয়ে যায়। জীব-জড়ের ভেদ মুছে যায়। সবকিছুর মধ্যেই তখন প্রেমিকের স্পর্শ আছে বলে মনে হয়। এক্ষণে গোপীদের অন্তর কৃষ্ণপ্রেমে পূর্ণ হয়েছে। তাই বাইরের বনপথের সমস্ত বৃক্ষ-লতাসকল, দূরের নীলাকাশের মাঝে চাঁদের লাবণ্য, মিষ্টি বাতাস সবই প্রেমের মূর্ছনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। স্পর্শকাতরা গোপীরা যখন বৃক্ষলতাদের জিজ্ঞাসা করে কিছু জানতে পারল না তখন পদতলের বসুন্ধরাকে বলে বসল—”ওগো, বসুন্ধরা! বল দেখি তুমি কী তপস্যা করেছিলে, যার জন্য তুমি কৃষ্ণচরণ স্পর্শলাভ করেছ? তোমার অঙ্গের দুর্বারাশি কি কেশরের প্রেমময় স্পর্শে এত আনন্দময় হয়ে উঠেছে? বলো ধরণি, কেশব এখন কোথায় আছে? সে যেখানেই যাক না কেন তোমাকে ছাড়া তো থাকতে পারবে না, তাই বলো—কোথায় গেলে পাব আমাদের প্রাণনিধিকে, প্রেমগোবিন্দকে?” তুলসীর মতো ধরণিও কোনো উত্তর দিল না। তখন ব্যর্থ মনোরথে গোপীরা আবার বনপথ দিয়ে চলতে লাগল। তারকাখচিত সুন্দর রাত্রি। বনের গাছেরা যে যার মতো ফুল ফুটিয়ে চলেছে। ফলে চতুর্দিক অদ্ভুত সুগন্ধে আমোদিত। তদুপরি মিষ্টি কোমল বাতাসে গোপীচিত্তের মধ্যে প্রেমের জোয়ার এসেছে। অকস্মাৎ প্রেমবিহ্বলা গোপীরা কয়েকটি হরিণীর সম্মুখে এসে সোজাসুজি দাঁড়াল। চকিত হরিণীরা প্রেমনয়ন দিয়ে গোপীদের অতি কৌতুকভরে দেখতে লাগল। হরিণীদের অনুপম মনোহর চাহনি দেখে এক গোপী ভাবল—এরা নিশ্চয়ই প্রেমময় কৃষ্ণরূপ দেখেছে, নইলে এদের চক্ষুযুগল এত অপূর্ব মাধুর্যময় কেন হবে? কী সুন্দর সুগভীর মনোহর চাহনি—যেন অসীম প্রেমের সঙ্গে মিলেমিশে আছে—আহা! হরিণীদের যে ভাগ্য হয়েছে আমাদের কেন হল না? কথাটা মনে হতেই ভাববিহ্বল গোপীরা হরিণীদের জিজ্ঞাসা করে বসল—মৃগীগণ! তোমরা এত সুন্দর কী করে হলে বল তো? তোমরা কি আমাদের প্রেমময় কৃষ্ণবদন দর্শন করেছ? যদি না দেখে থাক তাহলে এত সুন্দর চোখের কমনীয় প্রেমের ভাষা তোমরা কি হিসেবে লাভ করলে? নিশ্চয়ই তোমাদের অপরূপ নয়নের সঙ্গে প্রেমচাতুরী ভরা সুন্দরতম শ্যামসুন্দরের নয়নের মিলন ঘটেছিল। গোপীদের কথা শুনে হরিণীর দল প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর পাশ কাটিয়ে বনের ভেতরে চলে গেল। গোপীরা ভাবল—এ তো বেশ হল! তবে কি চতুর শিরোমণি কানাই এদের কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে? হতেও পারে। কিন্তু এখন আমরা কী করি, কোন পথে গেলে কানাইয়ের দেখা পাই? চলতে চলতে চোখে পড়ল ফলভারে আনত এক বৃক্ষকে। সুন্দর শাখাগুচ্ছ ও ফলভারে আনত বৃক্ষগুলি মৃদুমন্দ বাতাসে মধুরভাবে দুলছিল। গোপীরা দেখল—এরা বোধ হয় নত হয়ে পরমমনোহর শ্রীকৃষ্ণের চরণকে প্রণাম করছে। আর কৃষ্ণও তাঁদের মাথা স্পর্শ করে প্রাণঢালা আশীর্বাদ করে চলেছেন। তাই বোধহয় বৃক্ষগুলির মস্তক নত হয়েই আছে। এরপর ভাববিহ্বল গোপীরা আর কী করে? তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আর চলতে পারছেন না। জ্যোৎস্নালোকিত অন্ধকার রাত্রি। মাঝেমধ্যে পাখপক্ষীর ডাক শোনা যায়। তবুও চারদিক বেশ স্পষ্ট করে দেখা যায়। কিন্তু কৃষ্ণ বিরহে গোপীরা এবার কৃষ্ণ অন্বেষণ ছেড়ে দিলেন এবং নিজেরাই কৃষ্ণাত্মিকা হয়ে উঠলেন। তাঁদের অন্তরের সঙ্গে কৃষ্ণের অন্তর সংযুক্ত হয়ে গেল। তাঁরা নিজেদের কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন বোধ করতে লাগলেন এবং গভীর ভাবাবেগে কৃষ্ণের বাল্যলীলার বিভিন্ন অংশগুলি নিজেরাই অভিনয় করতে লাগলেন। কোনো গোপী পুতনার মতো আচরণ করতে লাগলেন। কৃষ্ণানুসরণকারী এক গোপী বাচ্চা কানাই হয়ে তাঁর স্তন পান করতে লাগলেন। অপর এক গোপী বালককৃষ্ণের মতো কাঁদতে কাঁদতে শকটাসুরের অনুকরণকারী অপর এক গোপীকে পদাঘাত করলেন। আবার কোনো গোপী কৃষ্ণ অনুসরণ করে গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে বলছেন—তোমরা ঝড়-বৃষ্টির জন্য আর চিন্তা কর না, আমিই তোমাদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করব। এই দেখ তোমাদের জন্যই গোবর্ধন পর্বত ধারণ করেছি—এই বলে তিনি নিজের অঞ্চলের বস্ত্র এক হাতে উপরে তুলে ধরলেন।
এদিকে আর একজন গোপী কালীয়নাগ হয়েছেন এবং অন্য একজন গোপী কৃষ্ণ হয়ে তাঁর মাথায় পদার্পণ করে তাঁকে দুষ্ট সর্প বলে শাসন করে বলছেন—ওরে দুষ্ট সর্প! তুই এখনই এই হ্রদ থেকে চলে যা; দুষ্টের দণ্ড বিধানের জন্যই তো আমি অবতীর্ণ হয়েছি। অপর একজন গোপী মা যশোধার ভাবে অন্য একজন গোপিনীকে বলে উঠলেন—দেখ, কৃষ্ণ আমার আজ দধিভাণ্ড ভেঙে মাখন চুরি করেছে। আজ আমি একে উদুখলে বেঁধে রাখব। এই বলে কৃষ্ণভাবিনী কোনো গোপীকে—উদুখলের মতো আচরণকারী অপর এক গোপীর সঙ্গে নিজের মালা দিয়ে বেঁধে রাখলেন। কৃষ্ণ অনুসরণকারী গোপীটি ভয় পেয়ে নিজের হাত দিয়ে চোখ দুটি আচ্ছাদন করে যেন অনেক ভয় পেয়ে গেছেন এমন অভিনয় করতে লাগলেন। আবার কোনো কোনো গোপী কৃষ্ণ যেভাবে বাঁশি বাজিয়ে গাভী ও গোবৎসদের ডাকতেন, তেমনভাবেই বাঁশি বাজিয়ে তাদের ডাকতে লাগলেন। এভাবে কৃষ্ণ তন্ময়প্রাপ্ত গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের দামবন্ধন সহ অন্যান্য লীলাগুলি নিপুণভাবে করে যেতে লাগলেন। আসলে প্রকৃত প্রেমের স্বভাবই হল তাই। যাকে যে ভালবাসে চিত্তে সর্বদা তারই ভাবের স্ফুরণ ওঠে। পুরানো সুখ-দুঃখে স্মৃতিগুলি ধরে ধরে চিত্তে নানাবিধ স্ফুরণ ওঠে। কোনো কোনো স্ফুরণের সঙ্গে প্রেমবিলাসের জন্য সংকল্পশক্তির সংযোগ হয় এবং তখন প্রেমিকা প্রেমের দেবতার সঙ্গে কল্পনার মধ্য দিয়ে সুখের স্বর্গে ভাসতে থাকে। প্রেমের এহেন ধর্ম সত্যপ্রেমের ছত্রে ছত্রে লক্ষ করা যায়। গোপীরা তাদের সমস্ত কিছু দিয়ে কৃষ্ণকে ভালবেসেছিল। কৃষ্ণেরই পূর্ণরূপ হতে চেয়েছিল। তাই কৃষ্ণ অন্বেষণের ফাঁকে ফাঁকে তাদের চিত্তে কেবল কৃষ্ণলীলার মাধুর্যরস প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছিল। এই রসে আছে যেমন আনন্দ, তেমনি বিরহ বেদনার তীব্র দুঃখ। প্রেমের দয়িতাকে পাওয়া এবং তাঁর মধ্যে পূর্ণ আত্মসমর্পণের মধ্যে যে স্বর্গীয় শান্তি আছে—তাই বোধহয় অনুভব করতে গোপিনীদের প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছিল। প্রেমিক নারদের কথায় বলা যায়—সেই পরাপ্রেম যিনি লাভ করেছেন তিনি কেবল সেই প্রেমই দর্শন করেন, সেই প্রেমের কথাই শ্রবণ করেন, প্রেমের প্রসঙ্গেই কথা বলেন এবং সেইসব নিয়েই চিন্তা করেন, কর্মে রূপ দেন। আর এইসব করতে করতে প্রেমের গভীর আস্বাদন প্রেমিকার অন্তরে ঘটে যা তার মনকে পার্থিব জগতের রূঢ় বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। প্রকৃত প্রেম হল ‘প্রতিক্ষণ বর্ধনম’ কিনা প্রেম প্রতিমুহূর্তে বেড়ে যায়। যখন প্রকৃত প্রেম লাভ হয় তখন প্রেমিকের সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রেমাস্বাদনে বিভোর থাকতে চায়। এই অবস্থায় প্রেমিক তাঁর দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে সর্বদা প্রেমের পাত্রকে দেখতে ভালবাসে, তাকে নয়নছাড়া করতে অন্তরে ব্যথা লাগে। তার শ্রবণেন্দ্রিয় সর্বদাই প্রেমিকের নাম-গুণগান, প্রশংসা শুনতে ভাল লাগে। কেউ যদি তাঁর ভালবাসার পাত্রের নামে নিন্দা সমালোচনা করে তো তাকে শত্রুর মতো মনে হতে থাকে। তার বাগিন্দ্রিয় সর্বদা প্রেমিকের প্রশংসা করে, তার রূপ-গুণ-ব্যবহারের বিভিন্ন প্রশংসায় মেতে ওঠে, যদিও সে অবস্থায় অন্য নারীর কাছে ব্যক্তিটির সবকিছুই সাধারণ বলে মনে হয়। কিন্তু প্রেমিকার মনশ্চক্ষে এক অনুপম সৌন্দর্যের ভাব ধারণ করে। তাঁর চলন, বলন, ভাষণ, দর্শন, স্পর্শন সবকিছুই অতি মনোহর এবং রোমান্সপূর্ণ বলে মনে ভাবনা হতে থাকে। আর এসব কারণেই প্রেমিক সর্বত্রই তাঁকে দেখতে চায়, সর্বক্ষণই তাঁর বিষয়ে কথা বলতে উৎসুক থাকেন, তাঁর কথা ভিন্ন অন্য কথা ভাবতে বা বলতে মনে ইচ্ছা থাকে না। মন তো তাঁর চিন্তায় প্রতিমুহূর্ত ব্যাপ্ত থাকে। এইরকম অবস্থায় অন্তরে প্রেমের ভাবটা সর্বদা নিশিদিন বেড়ে যায় এবং অন্য কাজকর্ম আর করার ইচ্ছা থাকে না। এই প্রেমের তুলনায় জগতের সবকিছুই প্রেমিকের কাছে তুচ্ছ বলে প্রতিপন্ন হয়, যদি সাধারণ নর-নারীদের মধ্যেই প্রেম পড়লে এমন ভাবটা আসতে থাকে, তাহলে সর্বজন মনোহর চিত্ত কৃষ্ণপ্রেমে পড়ে গোপিনীদের মনের কী অবস্থা হয়েছিল তা বুঝতেই পারছেন। আসল প্রকৃত প্রেমে—বৃন্দাবনী প্রেম হল চিরস্রোতা ক্রম স্ফীতমানা নদীর মতো—যা ফুলেফেঁপে সবেগে সাগরের দিকে ধেয়ে যায়—আর যতই উৎসমুখে ধেয়ে যায় ততই তার গতি বৃদ্ধি পায়, জলরাশি প্রগাঢ় হয়। তখন প্রেমসমুদ্রে ডুব দিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা ছাড়া আর কিই-বা করার থাকে বলুন তো? এই অবস্থায় চিত্তের লক্ষ্য হয় কেবল প্রেমাষ্পদকে সুখী করা। আপনার সম্পূর্ণ আত্মবিলাপই যেন জীবনের সমস্ত পাওয়া বলে বোধ হতে থাকে। প্রেমের এহেন একনিষ্ঠ থাকা চাই। তবে তো জীবনটা স্বর্গীয় আনন্দের খনি হয়ে উঠবে। কিন্তু আমরা চারপাশের দিকে দৃষ্টি দিলে কি দেখতে পাচ্ছি? প্রকৃত প্রেমের খোঁজে চলার মানসিকতা কমে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রেমিক-প্রেমিকা ও প্রেম—এই তিনটির মধ্যেই আবেগসর্বস্ব, আত্মলিপ্সা ও অহমিকা ভাব প্রচ্ছন্ন রয়েছে। এহেন অবিশুদ্ধ প্রেমে প্রিয় পাত্রকে তো সুখী করার লক্ষ্য থাকেই না, বরং মন কেবল নিজানন্দ করতে চায়। আর এ আনন্দলাভ আত্মকেন্দ্রিক জৈব বাসনাযুক্ত, যা শুধু স্বার্থে ভরা, আবেগে কলুষিত—যে আনন্দে বাধা পড়লেই মন সংকীর্ণ হয় এবং ভালবাসা পরিণত হয় চরম বিদ্বেষে, অশান্তিতে, অবমাননায়, অবহেলায়—যা কখনোই কারও জীবনে কাম্য নয়। তাই প্রকৃত প্রেমের খোঁজে জীবনতরীটি সাবধানে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।
যাইহোক, এই প্রেমের ভাষায় মন যেন ভারী হয়ে যায়। তাই চলুন বৃন্দাবনেই মনকে নিয়ে যাই। সেই জ্যোৎস্নার নির্জন রাতে। যমুনার তীরে তীরে। বনবীথিকার ছায়াতলে। যেথায় আবেগ তাঁরা কৃষ্ণলীলার নানা ঘটনার অভিনয় করতে করতে এগিয়ে যায়। অবশ্য হঠাৎ-ই আবার তাঁদের ভাবের পরিবর্তন হল। তাঁরা তরুলতাদের কৃষ্ণসংবাদ জিজ্ঞাসা করতে করতেই বেশ এগিয়ে চলছিলেন এবং কিছুটা গিয়েই অকস্মাৎ একটা সুন্দর পদচিহ্ন দেখে চমকে উঠলেন। তাঁরা গভীরভাবে পদচিহ্ন নিরীক্ষণ করতে করতে চরণের তলায় ধ্বজ, বজ্র, অঙ্কুশ ও যব চিহ্ন দেখতে পেলেন। কিন্তু এই পায়ের ছাপের সঙ্গে আর একজন নারীর পায়ের ছাপ রয়েছে না? হ্যাঁ—ওই তো! কিন্তু এ কার পায়ের ছাপ? কানাই কাকে সঙ্গে নিয়ে এই নির্জন রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে? গোপীরা এইসব কথা বলাবলি করে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে নিজেদের মধ্যে বলতে লাগলেন—এই গোপী কে—যাঁর পায়ের চিহ্ন এখানে রয়েছে—ইনি নিশ্চয়ই গভীরভাবে শ্রীহরির আরাধনা করেছেন—না হলে শ্রীহরি আমাদের সকলকে পরিত্যাগ করে এঁকেই-বা নিয়ে আসবেন কেন? যিনি আরাধনা করেন, তিনিই রাধা—তবে বলা হয় ‘রাধায়তি গোবিন্দং’ কিনা গোবিন্দ যাঁকে আরাধনা করেন—তিনি রাধা। এই রাধার নাম প্রেমের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। রাধার ভগবৎ প্রেম সর্বশ্রেষ্ঠ। যমুনা পুলিনের বিহারে অপর গোপীদের মনে অভিমান এলেও কিন্তু রাধার মন শ্রীকৃষ্ণে বেশ ভালভাবেই নিবিষ্ট ছিল। আর এ-কারণে অন্তর্যামী প্রেমিক কৃষ্ণ সেই গভীর আনন্দমুহূর্তে অন্য গোপীদের ত্যাগ করে রাধারানীকেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। রাধারানী তাই বড় সৌভাগ্যবান, তিনি কৃষ্ণসুখে সুখী হয়েছেন, কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী হয়েছেন। কিন্তু ‘অহং’ যেন মরেও মরে না। তাই গভীর রাতে এই নির্জন প্রান্তরেও তাঁর মধ্যে অহং এল। তিনি নিজেকে অন্য গোপীদের চেয়ে অত্যন্ত ভাগ্যবতী বলে মনে করে আপন মনেই ভাবতে লাগলেন—প্রিয়তম কৃষ্ণ অন্যসব কামাতুর গোপীদের ত্যাগ করে আমাকেই তাঁর সঙ্গে নিয়ে এসেছেন—এখন দেখছি এই নির্জন বনে আমাকেই ভজনা করছেন? আমার ভালবাসা নিশ্চয়ই সকলের চেয়ে খাঁটি এবং আমিই শ্রীকৃষ্ণের একমাত্র ভজনীয় হওয়া উচিত। এই ভাব মনে আসতেই রাধার চিত্তে গর্ব সঞ্চার হল। আর তাই সহসা তিনি বলে উঠলেন—’অহং চলিতু না পারয়ে’—ওগো, আমি আর চলতে পারছি না। তোমার যেখানে ইচ্ছা আমাকে তুমি বয়ে নিয়ে যাও—এই কথা বলা মাত্রই রাধারানীর মনটায় কৃষ্ণচেতনা কমে গেল এবং দেহচেতনা বৃদ্ধি পেল। অন্তর্যামী কৃষ্ণ তা টের পেয়েই বললেন—’স্কন্ধে অবরুহ্যতাম্’—তবে এসো, তুমি আমার কাঁধে আরোহণ কর। এই কথা বলে শ্রীহরি থমকে দাঁড়ালেন এবং শ্রীমতী রাধিকা মহানন্দে শ্রীকৃষ্ণ স্কন্ধে চাপতে যেতেই হঠাৎ শ্রীহরিকে আর সম্মুখে খুঁজে পেলেন না। সহসা ধাক্কা খেয়ে রাধার যেন সম্বিত ফিরে এল। তিনি সেই মুহূর্তে গভীর বনে একাকী অসহায় বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মনে হতে লাগল চোখের সামনে থেকে একটা আলোর জগৎ সরে গেল। তিনি ভীতচিত্ত হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি অতি কাতর হয়ে বিলাপে বলতে লাগলেন, ‘হে নাথ! হে প্রিয়তম! তুমি কোথায় আছ, আমি দীনহীন, আমি তোমার দাসী, আমাকে দয়া করে দেখা দাও প্রিয়।’ এমনভাবে কিছুক্ষণ বিলাপ করার পর তীব্র বিরহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে রাধারানী মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। গভীর নিশীথে কৃষ্ণদয়িতা রাধা বনপ্রান্তরে তাই শায়িত। বনফুলের সুগন্ধে তার চারপাশটা ম-ম করছে। দূরের নিশীথ পক্ষীর ডাক মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কেথায় গেলেন একাকী এত রাতে? তাও ভাববার বিষয় বইকি—আবার কৃষ্ণ এক্ষণে প্রিয়তম রাধারানীকে ত্যাগই-বা করলেন কেন?
আসলে শ্রদ্ধা এবং বিনম্রতাই হল প্রেমের প্রাণশক্তি। এই দুটি কমে গেলে চিত্তে গর্ব ও মানের উদয় হয়। ইতিমধ্যে এই একই কারণে শ্রীকৃষ্ণ অন্যান্য গোপীদের কাছ থেকে অন্তর্ধান করে রাধাকে নিয়ে—এত দূরে এসেছিলেন। রাধার আধার অনেক বড়। তাঁর শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা এবং বিনম্রভাবের তুলনা নেই। তিনি কৃষ্ণের জন্য সংসারের সকল সুখই ত্যাগ করেছিলেন। এক্ষণে আবার সেই রাধাই গর্বে গরবিনী হয়ে উঠলেন। স্বপক্ষ অন্তরঙ্গা এক সখী বলে উঠলেন—আরে! এ যে আমাদের কৃষ্ণবিরহিনী রাধারানী! এ যে দেখছি বৃন্দাবনী প্রেমের মূর্তিমতী শোভা! এঁরই প্রেম বৃন্দাবনে সর্বত্র শোভা পাচ্ছে! গভীর নিশীথে জ্যোৎস্নালোক গায়ে মেখে একদম পড়ে আছে? এর কি দেহে প্রাণ নেই? না—জ্ঞানহারা হয়ে আছে? আহা! সবাই এসো এসো গাছের শাখা ভেঙে নিয়ে আসি—এঁকে বাতাস দিয়ে সতেজ করে তুলি। আর ও সখী তুমি সর্বদা এঁর কানে মধুর কৃষ্ণনাম শোনাও। কৃষ্ণনামের প্রেমমাধুর্যে এঁর নিশ্চয়ই জ্ঞান ফিরে আসবে।
এই কথা বলে বেশ ক’জন সখী রাধারানীর কানের কাছে নিরন্তর কৃষ্ণনাম শোনাতে লাগলেন। অন্য একজন সখী আক্ষেপে বলতে লাগলেন—আমাদের সখীর এই অবস্থা কী করে হলে? শ্রীহরি যদি তাঁকে নিয়েই এলেন তবে এমনভাবে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন কেন? কমবেশি সব সখীরা গভীর আগ্রহ নিয়ে রাধারানীর আধবোঝা অপরূপ নয়নের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রের নির্জনতা ভেঙে হঠাৎ শ্রীমতী রাধারানী চোখ মেলে তাকালেন। আর উপস্থিত সকল কৃষ্ণ অনুরাগিনীদের দেখে বিস্ময়ে পুলকিত হয়ে উঠলেন এবং সকলকে আবার অবাক করে দিয়ে ভাবাবেগে বলে উঠলেন—তুমি কোথায় গেলে? তুমি কোথায় গেলে? উপস্থিত গোপিনীরা নিজেদের চোখে চোখ রেখে ইশারায় হেসে উঠলেন। এসময়ে একজন অন্তরঙ্গা গোপিনী অতি সন্তর্পণে রাধারানীর কাছে জানতে চাইলেন—প্রিয়, তোমার এমন দশা হল কেন? কানাই তোমায় ফেলে রেখে চলে গেলেন কেন? রাধারানী বললেন—কিছুই বলতে পারি না ভাই। তিনি যে আমায় কোথা থেকে কিভাবে এখানে নিয়ে এসে ফেলে রেখে চলে গেলেন তা বলতে পারছি না। তবে এসবের জন্য আমিই দায়ী, আমারই দোষ। তিনি আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন, আমাকে অনেক ভালবাসা দিয়েছেন, কিন্তু আমার দৌরাত্মার জন্যই মনে ব্যথা পেয়ে কানাই দূরে চলে গেছেন। অন্য একজন সখী রাধাকে বললেন—সখী, কৃষ্ণ তোমায় সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন, তবেই না আমাদের সবাইকে পরিত্যাগ করে তোমাকে নিয়েই তিনি বন থেকে বনান্তরে ঘুরতে বেরিয়ে ছিলেন। তোমার কৃষ্ণপ্রেম অনন্ত। তোমার তুলনা তুমিই; সেকারণেই কৃষ্ণ তোমাকে নিয়েই বিহার করতে ভালবাসেন। কিন্তু তাই তোমাকেই তিনি পরিত্যাগ করলেন কেন?
এরকম আরো দু-চারটে কথাবার্তা হল। কৃষ্ণবিরহিনী রাধারানী এখন উঠে বসে আছেন। আর সকলেই তাঁকে ঘিরে সেই বনের মধ্যে বসেছেন। কিন্তু সকলের মনই কৃষ্ণচেতনায় উন্মুখ। তাঁরা সকলেই কৃষ্ণ কৃষ্ণ করছেন। আর এসব দেখে রাধা বলে উঠলেন—আচ্ছা, এইভাবে বসে থাকলে আমরা কি কৃষ্ণকে পাব? না, তিনি আমাদের কাছে আসবেন? তার চেয়ে চল আমরা বনে বনে তাঁকে খুঁজে ফিরি। জ্যোৎস্নালোক আমাদের পথ দেখাক। গোপীরা ভাবলেন—কথা মন্দ নয়, যখন তাদের প্রিয় সখী রাধাকে পাওয়া গেছে, তখন নিশ্চয়ই অদূরে কোথাও কৃষ্ণ নিশ্চয়ই আছেন এবং অচিরেই তাঁকে দেখতে পাওয়া যাবে। এই ভেবে গোপীরা শ্রীরাধাকে নিয়ে জ্যোৎস্নাভরা অতি গাঢ় বনে প্রবেশ করলেন এবং চারদিকে তন্নতন্ন করে প্রাণসখা কৃষ্ণকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে না পেয়ে সম্মুখের আরও একটি গাঢ় অন্ধকারপূর্ণ বনে প্রবেশ করলেন। সেই বনের বৃক্ষদের পরস্পর সন্নিবেশ এতই ঘন যে জ্যোৎস্নার আলোও প্রবেশ করতে পারছে না। এই বনের গহনে কিছুক্ষণ পথ চলে শুদ্ধচিত্তা রাধারানী বলে উঠলেন—এভাবে বনে বনে তাঁকে খোঁজা বৃথা। আমরা তো তাঁকে তন্নতন্ন করে কতই খুঁজলাম, কিন্তু তিনি তো অন্তর্যামী, আমাদের মনোবেদনা বুঝে দয়া করে যদি দেখা না দেন তাহলে কি তাঁকে আমরা ধরতে পারি? তিনি যদি আমাদের ধরা দিতে না চান তাহলে খুঁজে খুঁজে কোনোদিনই তাঁকে দেখতে পাব না। বরং এসো আমরা অন্তরে প্রেমের ভাবটা বাড়িয়ে তুলি। আহা! আমরা যতই বনের মধ্যে তাঁকে খুঁজব, ততই তিনি আরো বনের গভীরে চলে যাবেন, এর ফলে তিনি গভীর বনে অন্ধকারে পথ হারাবেন, গাছে ধাক্কা লেগে কিংবা পায়ে কাঁটা ফুটে ক্ষত-বিক্ষত হবেন। তাঁর মনের গভীরে বেদনার জন্ম হবে। এতে কি আমরা সুখী হব? আমাদের মন কি আনন্দ পাবে? আমরা তো তাঁর আনন্দের জন্যই ঘর ছেড়েছি। তাঁর সুখের জন্যই তো আমাদের আজকে আসা। আর আমরা কি নিজেদের সুখের জন্য, তাঁর সঙ্গের জন্য, তাঁকে কষ্ট দিতে এগিয়ে যাচ্ছি না? তার চেয়ে বরং তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই করুন। তিনি মনের আনন্দে লুকিয়ে থাকুন। আমরা তাঁর কষ্টের কারণ হতে চাই না। এতে বরং তিনি ব্যথা পাবেন, তাঁর দুঃখ-যন্ত্রণা বাড়বে, আর আমরাও শোককাতর হয়ে পড়ব। তার চেয়ে চল—আমরা যমুনা তীরেই ফিরে যাই, সেখানে সমবেতভাবে ব্যাকুল হৃদয়ে ‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বলে ডাকি, তাঁর কথায়, তাঁর ভাবে, তাঁর ভালবাসার স্মৃতিতে ডুবে যাই—এতে নিশ্চয়ই অন্তর্যামী প্রাণসখা কৃষ্ণের চিত্ত বিগলিত হবে এবং স্বয়ং এসেও পড়তে পারেন আমাদের কাছে। রাধারানীর মিষ্টি মাখানো কথাগুলি সকল গোপীচিত্তে আকর্ষণ করল এবং পরমুহূর্তে সকলেই কৃষ্ণবিষয়ক গান করতে করতে যমুনাপুলিনের দিকে যাত্রা করলেন।
[পর্ব-৪]
কৃষ্ণগতপ্রাণা গোপিনীরা প্রিয়তমের ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আবার যমুনার তীরে ফিরে এলেন : যেখানে তাঁরা ইতিমধ্যেই নৃত্যগীত করেছিলেন। কিন্তু এত রাতে তাঁরা এবার কী করবেন? কৃষ্ণকে ফেলে গৃহে ফিরে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই নেই। আবার কৃষ্ণমুখ দর্শনহীন এই জীবনধারণও বিড়ম্বনা বোধ হচ্ছে। তাহলে উপায় কী? এক প্রাজ্ঞ সখী বললেন—এসো, আমরা সকলেই এখন কৃষ্ণ গুণকীর্তন করি। কৃষ্ণলীলা গুণকীর্তনই আমাদের মনের এই অসহ্য দহনকে কমাতে পারে। আসলে প্রকৃত ভগবৎ ভক্ত একটা সময়ে ভগবান ছাড়া আর কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারে না। সব ভাবনাচিন্তা ভুলে থাকার জন্য ভক্ত তখন সর্বদাই ভগবানের ভজনা করেন। একে পরাভক্তি বলে বর্ণনা করা হয়। নারদীয় ভক্তিসূত্রে এমন ভক্তিসাধনের একাদশ প্রকার ভাব আছে যথা—
১। ভগবানের বা প্রিয়তমের লীলামাহাত্ম্যে সূচক বিভিন্ন গুণসমূহের স্মরণ, মনন ও আলোচনার ঐকান্তিক আগ্রহ।
২। তাঁর অসামান্য রূপলাবণ্যের প্রতি অনুরাগ ও আসঙ্গ লিপ্সা।
৩। তাঁর সেবা ও পূজার প্রতি মনের আসক্তি।
৪। তাঁকে নিরন্তর মনে ধরে রাখার জন্য স্মরণ-মননের ইচ্ছা।
৫। প্রভুকে ভৃত্য যেমন সেবা করে তেমনিভাবে তাঁর সেবা করার প্রবল আগ্রহ।
৬। সখারূপে তাঁর প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি।
৭। তাঁকে সন্তানরূপে ভালবেসে তাঁর প্রতি আসক্তি হওয়া।
৮। স্বামী-স্ত্রীর যে সম্বন্ধ তাঁর সঙ্গেও সেইরকম প্রেমের অনুভূতি লাভের ইচ্ছা।
৯। তাঁর কাছে আত্মনিবেদনের তীব্র আকুতি।
১০। তাঁতেই তন্ময় হয়ে থাকার একান্ত অভিলাষ।
১১। তাঁকে না পাওয়ার যে দুঃখ অন্তরে সেই দুঃখ জাগ্রত থাক এই বাসনা।
এই একাদশ ভক্তিসূচক বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা করলে এটা লক্ষ্যণীয় যে, ভালবাসা কারও প্রতি সঠিকভাবে জাগ্রত হলে উক্ত লক্ষণগুলি ক্রমে ক্রমে চিত্তমাঝে ফুটে উঠতে থাকে।
প্রথমে ভালবাসার পাত্রের নাম শ্রবণে মনে আবেগের জন্ম হয়। তাঁর চিন্তা সদা মনের ভেতর হতে থাকে এবং গুণ ও মহিমা শ্রবণ করতে করতে তাঁর প্রতি আসক্তি জন্মায়। আর আসক্তি যত গভীর হতে থাকে ততই আসঙ্গ লিপ্সার জন্ম হয়। ভেতরে একপ্রকার বেদনার আবির্ভাব হয় যা চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে।
এই ভাবের পর প্রেমিকের হৃদয়ে ভালবাসার পাত্রের রূপের প্রতি ক্রমশ অনুরাগ জন্মাতে থাকে। একে রূপাসক্তি বলে ভাবা হয়। এই রূপাসক্তির স্পৃহা মানব-মানবীদের মনের কোণে তীব্রভাবে বর্তমান থাকে। কেবল রূপাসক্তির কারণেই প্রেমের সম্বন্ধ নিবিড়তর হয়। গুণ বর্ণনার চেয়েও অনুপম সৌন্দর্যের মূল্য প্রেমিকদের হৃদয়ে বেশিই থাকে। ফলে কেউ কেউ রূপের পূজা করে, কেউ গুণের পূজা করে, খুব কম জনই ভালবাসার পূজা করে। এখানে গোপিনীরা কৃষ্ণর নাম রূপ আসক্ত তো ছিলই, তবে অন্তরে ভালবাসা দিয়ে পূজা করার ইচ্ছাও তাঁদের মধ্যে গভীরভাবে জাগ্রত হয়েছিল।
এই রূপ ও গুণের আসক্তি ক্রমশ স্মরণাসক্তিতে পরিণত হয়। আসক্তি মানে সদা অনুরক্ত থাকার ইচ্ছা। প্রেমের পাত্রকে স্মরণ করতে করতে এমন একটা অবস্থা আসে যে স্মরণ ছাড়া কোনোভাবেই থাকা যায় না। এই স্মরণ ভাবটায় প্রথমে দাস্যভাব, সখ্যভাব, বাৎসল্যভাবের স্পন্দনটা থাকে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই কান্তাভাব বা মধুরভাবে রূপান্তরিত হয়। মধুরভাবের সম্বন্ধ হল সবচেয়ে নিকটতম। এতেই সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ অনুভব হয় এবং মধুরভাবের মধ্যে সমস্ত ভাব প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান থাকে। মধুরভাবের ভক্তের কাছে ক্রমশ শ্রদ্ধার ভাবটা বৃদ্ধি পায় এবং ভালবাসার পাত্রের কাছে আত্মনিবেদন ভাবে মেতে থাকার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আর তাতেই তন্ময় হয়ে থাকার তীব্র বাসনা জাগে, তাতে মনে দুঃখবেদনা জাগলেও অন্তরে তা ভাল লাগে, এক অনুপম অপার্থিব রসাস্বাদন হতে থাকে। এক্ষেত্রে গোপিনীদেরও তাই হয়েছে। তাঁরা যমুনাতীরে এসে উচ্চৈস্বরে শ্রীকৃষ্ণ গুণগান করতে লাগলেন। গোপীদের এই কৃষ্ণপ্রেমই সাধ্যবস্তু। কারণ কৃষ্ণের প্রতি তীব্র প্রেমবশত তাঁদের সমস্ত ধর্মকর্ম কৃষ্ণচরণে সমর্পিত হয়েছিল এবং কখনও মুহূর্তকালের জন্যও তাঁকে বিস্মৃত হলে তীব্র বিরহে ব্যাকুলতা দেখা দিত। এই ব্যাকুলতা—ভগবানের জন্য এই তীব্র আর্তি বোধই হল প্রেম বৃন্দাবনের গোপন কথা। গোপীরা হলেন প্রেমভক্তির জগতের শিরোমণি। প্রেমের অনুভূতি কেমন হবে, তার প্রকাশে দেহ ও মনের কি অবস্থা হয়, তা গোপীদের জীবনে দেখতে পাওয়া যায়। এইসব গোপীদের অন্তরখানি কৃষ্ণময় ছিল। তাঁরা শেষে সর্ববস্তুতেই কৃষ্ণকে দেখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁদের সমস্ত চিন্তা, কর্ম, সংস্কার ও প্রচেষ্টাতে কৃষ্ণ বর্তমান ছিল। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে। এক মুহূর্তের জন্য তাই কৃষ্ণ বিরহ তাঁদের কাছে মৃত্যুর সমতুল্য ছিল।
এক্ষণে সেই ভাবটাই এসেছে। তাই গোপীমনে জেগেছে নানা প্রশ্ন—কৃষ্ণ কি সত্যই ভগবান? তিনি কি সত্যই মহান? তাই গোপীরা বললেন—হে প্রাণপ্রিয় কৃষ্ণ, তুমি এখানে জন্মেছ বলেই এই ব্রজধাম সেরা পুণ্যভূমি হয়ে উঠেছে এবং সমস্ত সম্পদের অধিষ্ঠাত্রীদেবী লক্ষ্মী স্বয়ং এখানে বিরাজ করছেন। ফলে ব্রজে তো সবাই সুখে আছে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! তোমার জন্য যারা প্রাণ ধারণ করে বেঁচে আছে, তোমার খোঁজে যারা হতশ্রী হয়ে দুঃখবরণ করছে, তাদের প্রতি তোমার দয়া হল না? হে কৃষ্ণ, তুমি দয়া করে দেখা দাও। আমরা তোমাতে সমর্পিত প্রাণ, তাই হয়তো প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে না সত্য, কিন্তু আমরা যে কী গভীরভাবে প্রাণমনে দগ্ধে দগ্ধে শেষ হয়ে যাচ্ছি, তা কি তুমি দেখতে পারছ না? এ তো একপ্রকারের বধ কার্য, তুমি তো দাসীদের বধকার্যে নিয়োজিত হয়েছ। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! আগে কত প্রকারে কত ভাবে তুমি আমাদের রক্ষা করেছ—তোমার জন্যই আমরা কালীয় হ্রদের বিষময় জলপানের নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়েছি। তুমিই তো মহাপাতক অঘাসুর, বৃষাসুর, ময়পুত্র, ব্যোমাসুর, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রানল প্রভৃতি থেকে বারে বারে আমাদের রক্ষা করেছ। তাহলে এখন আবার আমাদের উপেক্ষা করে বধ সাধনে ব্রতী হয়েছ? আমরা তো নিজেদের সুখের জন্য তোমায় ভালবাসি না। তোমার সুখের জন্য, তোমার আনন্দের জন্যই তোমাকে ভালবেসেছি। আর ভালবেসে তোমার কাছ থেকে তো কিছু চাইছি না। কেবল তুমি যাতে আনন্দে থাক, সুখে থাক তাই আমরা সকলে প্রাণমন ভরে চাইছি। কিন্তু আমাদের গভীর এই শুভ চাওয়াকে কিভাবে তুমি উপেক্ষা করতে পার? তুমি যশোদানন্দন কিনা তাতেই সন্দেহ হচ্ছে আমাদের। যে যশোদা অপরের সামান্য দুঃখ দেখলে সদা দুঃখমোচনে তৎপর হতেন সেই তাঁর পুত্র হয়ে তোমার হৃদয় বলে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মায়ের কিছু গুণও কি তুমি পাওনি? লোকেরা বলে তুমি নাকি অন্তর্যামী—কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে আমরা যে তোমার অদর্শনে দুঃখে পুড়ে যাচ্ছি, তা তুমি অনুভব করতে পারছ না কেন? তুমি তো দেখছি দুঃখ-যন্ত্রণার উদাসীন শিরোমণি। শুনেছি ব্রহ্মার প্রার্থনায় তুমি জগতের কল্যাণের জন্য এসেছ। সংসার ভয়ে ভীত নরনারীরা তোমার চরণ আশ্রয় করে থাকলে ভবভয় থেকে মুক্তি পায়। ওগো কৃষ্ণ! তোমার যে পাদপদ্ম সকলের পাপনাশক, গোচারণ কালে গবাদি পশু যে চরণ অনুগমন করে চলে, স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী যে চরণ আশ্রয় করেছেন, যে চরণ মস্তকে ধারণ করে কালীয়নাগের ভক্তি বৃদ্ধি হয়েছে, সেই পূত চরণযুগল আমাদের বক্ষে ধারণ করে মনোগত সমস্ত কামনাকে হরণ করে নাও। একমাত্র তুমিই আমাদের কামনা হও।
হে প্রিয়তম! তোমাকে লোকে ‘ব্রজস্বামীর আর্তি হরণ’ বলে সুখ্যাতি করে, কিন্তু তুমি কেন আমাদের আর্তিনাশ করছ না? কেন আমাদের মনে এত দুঃখ দিচ্ছ? হে কৃষ্ণ, আমরা তো মনে-প্রাণে তোমার চরণস্পর্শ করতে চাই—না, শুধু চরণেই হবে না, তুমি আমাদের স্পর্শ কর। তোমার অনুপম পদ্মহস্ত আমাদের মাথায় রাখ, বক্ষে স্থাপন কর। তোমার কোমল চরণ স্পর্শে, অনুপম আলিঙ্গনের মাধুর্যে আমাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত কলুষতা ধৌত করে দাও, হৃদয়ের কামভাবকে চিরতরে নির্বাপিত করে দাও।
গোপীদের এইরকম তীব্রতম বিরহের মধ্যেই এক সুনিপুণ গোপী বলে উঠলেন, হে কৃষ্ণ! তোমার কথারূপ অমৃত সংসার ত্রিতাপদগ্ধ জীবদের কাছে প্রাণস্বরূপ, তোমার কথা অমৃতসমান, তা সর্বদাই পাপনাশক। তোমার কথা শুনলেই জীবেদের মঙ্গল হয়। জন্ম-জন্মান্তরের পাপরাশি বিলীন হয় এবং মনে পরম পবিত্রতা দান করে। তাছাড়া, তোমার এইসব গুণকথা বিষয়াসক্ত নর-নারীদের চিত্তকে তোমার দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাদের বিভ্রান্ত চিত্তকে ‘কৃষ্ণোন্মুখ’ করে তোলে। এতে তাদের চিত্তজ্বালা কমে এবং প্রাণে শান্তিধারা নেমে আসে। এ কারণেই তো পণ্ডিতরা তোমার কথাকেই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বলে বর্ণনা করেছেন। আর এই জগতে যারা তোমার কথা কীর্তন করেন, তারাই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা, তারা নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে বহু দান করেছিলেন, আর সেই সুকৃতির ফলেই না তোমার কথা কীর্তনে তাদের এত রুচি হয়েছে। কিন্তু তোমার কথামৃত যদি এতই মধুর হবে তবে আমাদের বিরহব্যথা দূর হচ্ছে না কেন? তৃষিত প্রাণে শান্তি আসছে না কেন?
আসলে কৃষ্ণকথা শুনলে কৃষ্ণ পাওয়ার লালসাটা খুব বেড়ে যায়। যেহেতু কৃষ্ণকথা, কৃষ্ণ গুণগাথা, কৃষ্ণ রূপাসক্তি, কৃষ্ণ-কীর্তন অন্তরের জন্ম-জন্মান্তরের পাপরাশিকে নষ্ট করে চিত্তকে শুদ্ধ করে তোলে তাই অন্তরটা তখন শ্রীহরির দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এতে ভক্তের মনের দুঃখটা বেড়ে যায়। আর যতক্ষণ দর্শনাদি না হচ্ছে ততক্ষণ বেদনাটা গাঢ় হয়। এ কারণেই গোপীদের কাছে কৃষ্ণকথা মধুর না হয়ে বিষময় মনে হচ্ছে, কারণ এতে দুঃখ-বেদনার ভাবটা বেড়ে গিয়ে অন্তরটা কৃষ্ণদর্শনের জন্য গভীর ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। কৃষ্ণ মিলন সঙ্গ তীব্রতম গোপী হৃদয়ে দুঃখ দেয়। কারণ এতে মিলনের ইচ্ছা বেড়ে যায়। আবার কৃষ্ণ বিচ্ছেদেও দুঃখ। কারণ এতে বিরহের যন্ত্রণাটা বাড়ে। তাই কৃষ্ণচিন্তনে গোপীদের মনে সদা ক্ষোভের সঞ্চার করছে। একারণে গোপীরা বললেন—হে কৃষ্ণ! প্রিয়জনদের দুঃখ দেওয়াই তোমার কাজ। তুমি যখন গোচারণের জন্য গৃহ হতে বনে চলে যাও, তখন রুক্ষ পাথরে কিংবা কণ্টকে তোমার নরম চরণে ব্যথা লাগবে—এই ভেবে ভেবেই আমরা ঘরে অস্থির হয়ে পড়ি। আবার গোচারণ হতে ফিরে এলে তোমায় একটু দেখার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকি, কিন্তু তুমি উপেক্ষার ভাব নিয়ে আমাদের সঙ্গে ব্যবহার কর। যেন আমরা তোমার আপনার নয়। বলতে কি প্রিয়জনদের দুঃখ দেওয়াই তোমার কাজ। তাই কি মিলনকালে, কী বিরহের সময়ে—সব অবস্থতেই তুমি আমাদের ক্ষোভের কারণ। তোমাকে ভালবেসে এখন আমাদের অন্তরে সুখ নেই। হে নাথ! হে প্রিয়! আমাদের এখানে আসার কারণ তো তোমার অজানা নয়। আমরা তোমার বংশীধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে, তোমার প্রেমলোভে এই নিশীথে স্বামী, পুত্র, পরিবার সব উপেক্ষা করে চলে এসেছি, আর তুমি কিনা তা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছ না? আমাদের পরিত্যাগ করে আপন আনন্দে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছ! হে প্রিয়তম! তোমার পদ্মের চেয়েও নরম সুকোমল চরণ আমরা অতি সন্তর্পণে হৃদয়ে ধারণ করি, পাছে আমাদের কঠিন বক্ষে তোমার পায়ে ব্যথা লাগে—আর তুমি কি না সেই নরম চরণ নিয়ে কণ্টকপূর্ণ বনে একাকী এই রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছ! এতে নিশ্চয়ই কণ্টক বিঁধে তোমার নরম পদতল ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে—আর যে আমরা সইতে পারিনে প্রিয়, তোমার কারণে দুশ্চিন্তায় আমাদের হৃদয় বিগলিত হচ্ছে, চোখে অশ্রু প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। তুমি ফিরে এসো সখা, দেখা দাও—এই কথা বলতে বলতে গোপীরা সমবেতভাবে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগলেন। তাঁদের নিষ্পাপ প্রেমের ক্রন্দনধ্বনি জ্যোৎস্নালেকিত রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে বৃক্ষ থেকে বৃক্ষান্তরে, পাতায় পাতায়, আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।
গোপীদের প্রেমজনিত এই সুমধুর ক্রন্দন বাতাসে ভাসতে ভাসতে অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণের কর্ণগোচর হল। তিনি অন্তর দিয়ে অনুভব করলেন যে, গোপীদের মন থেকে অহংকার ভাবটা চলে গেছে। শুদ্ধ প্রেম ও বিনম্রতার প্রভাবে তাঁদের চিত্ত কোমল হয়ে গেছে। তাই তাঁরা মনের দুঃখে কাঁদছেন কৃষ্ণকে কাছে পাওয়ার জন্য। এই কান্না তাই মধুরতম, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ কান্না। কারণ এটা তো বিষয়লাভের জন্য কান্না নয়, দেহসুখের জন্য কান্না নয়। এই কান্না হল ভগবান লাভের জন্য কান্না। যুগ যুগ ধরে তপস্যা করে চিত্ত শুদ্ধ হলেই তবে অন্তরটা ভগবৎমুখী হয় এবং শেষে গভীর প্রেমে তীব্র ব্যাকুলতাবশত ভগবান লাভের জন্য কান্নাটা অন্তরের গভীর থেকে আসে। শ্রীকৃষ্ণ বুঝলেন—গোপিনীদের এই রোদন যথার্থ, তাঁদের অন্তরে কৃষ্ণদর্শনের লালসাটা প্রবল হয়েছে, কৃষ্ণদর্শন লালসার জন্যই তাঁরা কাঁদছেন, তাঁদের অন্তরের তীব্র ব্যাকুলতাটা দেখা দিয়ে প্রশমিত করতেই হবে। এই কথা ভেবেই নয়নাভিরাম শ্রীকৃষ্ণ বনমালী এবং পীতাম্বর ধারণ করে সহসা গোপীদের সামনে উপস্থিত হলেন। তাঁর সহাস্য বদন, প্রেমপূর্ণ নয়ন, অপরূপ হাবভাব দেখে গোপীরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। চতুর কৃষ্ণ এমনভাবে তাঁদের সামনে আবির্ভূত হলেন যেন কিছুই হয়নি। তিনি আড়ালেই ছিলেন। দূর থেকে তাঁদের নিরীক্ষণ করছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের বদনমণ্ডল সহসা অনন্ত সৌন্দর্যের আকার হল কেন? ইনি তো সাক্ষাৎ মন্মথনাথ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন দেখছি। ঠিক তাই। শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের কাছে এক্ষণে মদনকে পরাস্ত বা মোহিত করে দিয়েই আবির্ভূত হয়েছেন। এজন্য শ্রীকৃষ্ণের আর এক নাম হল মদনমোহন। মদন হলেন কামের দেবতা। তিনি জগতের সকল নরনারীদের হৃদয়ে কামভাবকে সুবৃদ্ধি করে প্রেমভাবের মর্যাদাহানি করতে সর্বদা বদ্ধপরিকর। সেজন্যে মানবীয় প্রেমের স্বর্গীয় রূপটা যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে সহস্র সহস্র বাধা এসে হাজির হয়। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আপ্তকাম, নিত্যতৃপ্ত, অখণ্ড আনন্দময় পুরুষ। তাঁর আনন্দের জন্য তো গোপিনীদের কোনো দরকারই নেই। তবে তিনি এহেন লীলা করছেন কেন? আনন্দবিলাসের জন্য। গোপিনীরা হলেন হ্লাদিনী শক্তি, শ্রীকৃষ্ণেরই অংশ। শ্রীকৃষ্ণ যোগমায়া শক্তিকে আশ্রয় করে প্রেমমাধুর্য আস্বাদন করার জন্যই এই রাসলীলায় নৃত্য করেছেন। এঁর উদ্দেশ্য হল গোপিনীদের নিজস্ব স্বরূপের আনন্দ আস্বাদন করানো। গোপী হৃদয়ের অন্তস্থলে লুকিয়ে আছে অনন্ত প্রেম যা পবিত্র স্বর্গীয় তরঙ্গ—যা অনন্ত, অসীম এবং অবর্ণনীয় কিন্তু তা প্রস্ফুটিত হওয়ার পথ পাচ্ছিল না। ভক্তবাৎসল্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রেমময়ী গোপীদের ভালবেসে আপনহারা করিয়ে এই স্বর্গীয় প্রেমানন্দ দান করলেন। যা মর্ত্যজগতে অমর, অক্ষয় প্রেমরূপে সুখ্যাতি লাভ করেছে। এ কারণে বৈষ্ণব কবিরা ‘রাসলীলা’র অনুধ্যানকে মনুষ্য হৃদয়ের দুর্জয় কামকে চিরতরে বিনাশ করার ঔষধ বলে প্রতিপন্ন করেছেন।
বস্তুত ত্রিলোক বিজয়ী কামদেবের গর্ব চূর্ণ করার জন্যই ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্ন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাসলীলা করেছিলেন। তাহলে এই লীলা কি মানব-মানবীদের জীবনে মহাপ্রতাপশালী কামকে বিনাশ করে দৈবভাবের পথের এগিয়ে যাওয়ার সোপান? আসলে ক্ষুধা, তৃষ্ণার মতো কামপ্রবৃত্তিও নর-নারীদের জীবনে বাস্তব সত্য ঘটনা। কিন্তু কামাশ্রিত জীবনে শ্রদ্ধা, ভক্তি কিংবা ভগবৎপ্রেমের বিকাশ ঘটে না। তাই মানবাত্মার পূর্ণতা পেতে কামদেবতা মদনদেবকে পরাস্তকারী মদনমোহনকে উপাসনা করতে হবে। যদি সত্য পথ অবলম্বন করে, শুদ্ধ চিত্তে থেকে গোপীমণ্ডল পরিবৃত মদনমোহনকে চিন্তা করা যায়, নিরন্তর তাঁর স্মরণ-মনন ও অনুধ্যান করা যায়, তাহলে অন্তরে শুদ্ধ প্রেমের বিকাশ হবে।
যাহোক, মদনমোহন শ্রীকৃষ্ণ পীতাম্বর বসনে এবং গলায় স্নিগ্ধ বনমালা ভূষণে হঠাৎ হাসি হাসি মুখে গোপিনীদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। গোপীরা তো সহাস্যে কৃষ্ণকে সম্মুখে আগমন করতে দেখে সকলে একসঙ্গেই উৎফুল্ল বদনে উঠে দাঁড়ালেন। আর বিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে, তাঁদের দেওয়া পারিজাত ফুলের মালাটি এখনও কৃষ্ণের গলায় সতেজ রয়েছে। তবে কি কৃষ্ণ কাছেই কোথায় ছিলেন? একরাশ প্রশ্ন ও বিস্ময় নিয়ে গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে অভ্যর্থনা করার জন্য তাঁর কাছে হাজির হলেন। গোপিনীরা যে যেখানে ছিলেন সবাই একসঙ্গে তাঁকে অভিনন্দিত করতে ছুটে এলেন। কিন্তু কাছে এসেই এক এক গোপী এক-এক ভাবে কৃষ্ণের সঙ্গে ব্যবহার করতে লাগলেন। গোপীরা মনের দিক দিয়ে ছিলেন তিন স্বভাবের নারী। একপ্রকার ভাবতেন কৃষ্ণ শুধুই আমার, অন্য কারো নয়, তাই তিনি আমার কাছেই আসবেন। এঁরা ‘আমার ভাবাপন্ন’ গোপী। আর একশ্রেণির গোপীরা ভাবতেন ‘আমি কেবলই কৃষ্ণের, আমিই শুধুই তাঁর, তাঁর কাছেই ছুটে যাব সর্বদা।’ এঁরা হলেন ‘তোমার ভাবাপন্ন’ গোপী। আর এঁদের মধ্যবর্তী হলেন ধীর, স্থির ও শান্তভাবাপন্ন গোপী। এঁরা হলেন তটস্থা গোপী কিনা উঠে দাঁড়িয়ে কেবল শ্রদ্ধাভরে লীলা আস্বাদন করতেই ভালবাসেন।
রাসেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন অনেক গোপী। তাঁর মধ্যে নিমেষেই শ্রীরাধা-ললিতা-বিশাখা-চন্দ্রাবলী-শ্যামলা-শৈবা-পদ্মা প্রমুখকে সহজেই অনুভব করা যায়। তিনি হৃদয়ভরে গোপীদের নিরীক্ষণ করতে থাকলে সহসাই এক গোপী সহাস্যে কৃষ্ণের করকমল নিজ করে ধারণ করে অতি বিনম্রভাব দেখিয়ে তাঁর অনুগত হয়ে উঠলেন। শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্রাবলীর এমন সুন্দর ভাব দেখে প্রসন্ন হলেন। অপর একজন সুন্দর গোপী কৃষ্ণের চন্দনচর্চিত হাত নিজের কাঁধে টেনে নিলেন। কৃষ্ণ-শ্যামলার ‘আমি তোমার’ মনের ভাবটি স্পষ্ট বুঝতে পেরে একটু মৃদু হাসলেন। সামান্য দূর থেকে এসে অন্য এক গোপী শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে চর্বিত তাম্বুলের একটু অংশ নিজের মুখে গ্রহণ করলেন। কৃষ্ণ তো তাঁর এমন ব্যবহারে বেশ মজা পেলেন। আর শৈব্যাও ভগবানের চর্বিত পান গ্রহণ করে হৃদয়ে বিরহের জ্বালাটা একটু কমাতে পারলেন। অপর একজন বিরহকাতরা গোপী শ্রীকৃষ্ণের চরণতলে বসে নিজের বুকে কৃষ্ণচরণটি ক্ষণকাল ধারণ করে রাখলেন। পদ্মার বরাবর একনিষ্ঠ প্রেম দেখে কৃষ্ণ খুশিই হলেন। আর একজন অতি সুন্দরী গোপিনী কৃষ্ণ আসার পর থেকেই তীব্র অভিমানে প্রণয়কোপে বারবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন। ইশারায় ক্রোধ প্রকাশ করছিলেন। হঠাৎ তিনি কাছে এসে দাঁত দিয়ে প্রিয়তমের ঠোঁটটা কামড়াতে লাগলেন। তাঁকে বক্ষ সংযুক্ত করে ভীষণভাবে তাড়না করতে লাগলেন। প্রেমিকাশ্রেষ্ঠ রাধারানীর এমন ‘আমার কৃষ্ণ ভাবটা’ দেখে শ্রীহরি মনের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। অপর একজন গোপী দূর থেকে অনিমেষ নয়নে কৃষ্ণ মুখকমল দর্শন করেও তৃপ্তি পেলেন না, বরং আরো দর্শনের আশায় স্থির নয়নে প্রিয়তমকেই দেখতে লাগলেন। ইনি রাধার প্রিয়পাত্র সখি ললিতা। অপরদিকে শান্ত-স্নিগ্ধ এক গোপী যোগীদের মতো একবার কৃষ্ণরূপ দর্শন করেই সহসা চোখ বন্ধ করে কৃষ্ণের ধ্যান করতে লাগলেন। ইনি হলেন তটস্থা ভাবের গোপী বিশাখা। এভাবে আরো অনেক গোপী নিজ নিজ ভাবে কৃষ্ণকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজেদের মনের বিরহ বেদনা দূর করলেন।
পুরুষশ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ তার প্রিয়তমা গোপীদের দ্বারা নানাভাবে সম্মানিত হয়ে এরপর গজরাজের মতো সম্মুখের দিকে চলতে লাগলেন। গোপীরা কৃষ্ণগতপ্রাণা হয়ে তাঁকে অনুসরণ করলেন। কৃষ্ণ সামান্য এগিয়ে এলেই সুন্দর যমুনাতটে গোপীরা নিজেদের সুগন্ধ মিশ্রিত উত্তরীয় বসন বিছিয়ে দিলেন। তাঁদের মনোগত ইচ্ছা প্রাণকৃষ্ণ এখানেই উপবেশন করুন। কৃষ্ণ নয়ন মেলে দেখলেন চতুর্দিকে গোপীদের আনত বদন, প্রেমপূর্ণ নয়ন। তদুপরি অনুভব করলেন মৃদুমন্দ মিষ্টি বাতাস, ফুলের অপরূপ গন্ধ এবং রাতজাগা ভ্রমরের সুমধুর ধ্বনি। এদিকে আকাশের শরৎকালীন চন্দ্রজ্যোতিতে জায়গাটা জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয়ে গেছে। শান্ত-স্নিগ্ধ যমুনার ছোট ছোট ঢেউগুলি তীরে এসে লাগছে। তার মৃদুমন্দ শব্দে এক অপার্থিব বাতায়ন সৃষ্টি হয়েছে। আর এসময়ে কুন্দ ও মন্দার পুষ্পসকল ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে তাদের অপরূপ গন্ধ বিকিরণ করে চারিদিক আমোদিত করে তুলেছে। কৃষ্ণ এমন পরম মনোহর স্থানে গোপীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বসে পড়লেন। বরাবরই গোপীরা কৃষ্ণের ঐশ্বর্যের ভাবটা অত মনে রাখে না। কৃষ্ণ তাদের বাল্যকালের বন্ধু। সেই কত শৈশবে তাদের সঙ্গে কৃষ্ণের সখ্যতা জন্মেছে। সখ্যতা গাঢ় হতে হতে ভালবাসা এসেছে। এখন ভালবাসা গভীর প্রণয়ে পরিণত হয়েছে। তাই কৃষ্ণ তাদের প্রণয়বন্ধু, সবচেয়ে আপনার লোক। তারা নিজেদের চোখের জল ও প্রেম দিয়েই তাঁর পূজা করেন। প্রেমই এই পূজার শ্রেষ্ঠ দ্রব্য। তাই কৃষ্ণপ্রেমে আত্মহারা গোপীরা এরপর শ্রীহরির চরণ দুখানি নিজেদের ক্রোড়ে সম্মানের সঙ্গে টেনে নিলেন। আর অতি যত্নভরে তাঁর হাত ও পা টিপতে টিপতে প্রণয়কোপে একজন জিজ্ঞাসা করে বসলেন—হে কৃষ্ণ! তোমার ব্যবহারে আমাদের মনে সংশয় এসেছে। তুমি আমাদের সংশয় মুক্ত কর। আচ্ছা বলতো—সংসারে এমন কিছু লোক আছে, যাদের ভালবাসলেই তারাও ভালবাসে; আবার একপ্রকার লোক আছে, যাদের ভাল না বাসলেও তারা ভালবাসবে; অন্য একপ্রকারের লোক আছে, যাদের কেউ ভালবাসলেও ভালবাসে না, আবার না ভালবাসলেও ভালবাসে না, তুমি এদের মনের ভাবটা আমাদের বুঝিয়ে দাও কিনা বুদ্ধিমান গোপীরা পরোক্ষভাবে শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন—তুমি এই শ্রেণির লোকের মধ্যে কোন প্রকারের তা আমাদের বল।
অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের মনের ভাব বুঝতে পারলেন এবং আরো ধারণা করলেন গোপীদের প্রেম ব্যবহারের কোনো তুলনা নেই। তাঁরা প্রথমে আমাকে নানাভাবে সংবর্ধনা জানালেন। তারপর উত্তরীয় বিছিয়ে বসতে দিয়ে মধুর বচন বলে নিজেদের কোলে চরণ নিয়ে তার সেবা করতে লাগলেন। এতে আমার চিত্ত কিছুটা প্রসন্ন হলে তবেই প্রণয় কুশলতার গূঢ় অভিপ্রায়টা তারা আমায় জানালেন। শ্রীহরি জানেন গোপীরা তাঁকে প্রাণ-মন দিয়ে ভালবাসেন। শুধু কি তাই? ভালবাসার পূর্ণতার জন্য তাঁরা সর্বদা মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত থাকেন। এহেন গোপীপ্রেমের গভীরতা যে কতখানি তা আমারই ধারণা নেই। তাই গোপীদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ইহজনমেও তাঁদের প্রেমের ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। এইসব মনে মনে ভেবে শ্রীকৃষ্ণ হাস্যমুখে বলতে লাগলেন—হে সখিরা, যারা পরস্পর পরস্পরকে শুধুমাত্র ভজনা করে, তাদের আচরণ স্বার্থপূর্ণ। এই ভালবাসা কেবল স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। এতে ভালবাসার ধর্ম নেই, বন্ধুত্বও নেই। তাই তোমরা জেনে রাখো আমি ওই দলের মধ্যে নই। আর তোমরা বলছ সেইসব লোকেদের কথা যাদের ভাল না বাসলেও, তারা অন্যদের ভালবাসে। এমন ব্যক্তিরা হলেন স্নেহশীল পিতা-মাতা ও সাধুসন্তরা। পিতামাতাকে ভাল না বাসলেও এঁরা অন্তর থেকে নিজ সন্তানদের কল্যাণের জন্য সর্বদা ভালবাসেন। আর ভগবানের সাধনা করে সাধুমহাত্মা শুদ্ধচিত্ত ও দয়াবান হয়ে যান। তাঁর সংসারের সকলের হিতের জন্য কেউ তাদের ভাল না বাসলেও তাঁরা সকলকে ভালবাসেন। আমার ভালবাসা কিন্তু এঁদের চেয়েও মহৎ। কারণ পিতামাতারা তো কেবল নিজ সন্তানের জন্যই মঙ্গল কামনা করেন, অন্যদের বেলায় দেখা যায় না। আমি কিন্তু জগতের সকল জীবেদের জন্যই কল্যাণ কামনা করে থাকি। যেহেতু জগৎময় আমার স্নেহ ব্যাপ্ত রয়েছে, তাই আমার স্নেহ, দয়াভাব কারো সঙ্গেই তুলনা হতে পারে না। অপরদিকে সংসারে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাদের ভালবাসলেও ভালবাসে না, আবার না ভালবাসলেও ভালবাসে না। এঁরা হলেন আত্মারাম, আপ্তকাম, অকৃতজ্ঞ এবং গুরুদ্রোহী ব্যক্তিরা। আমি কিন্তু এঁদের একজনের মতও নয়। যাঁরা আত্মারাম তাঁরা আত্মার আনন্দে ভরপুর থাকেন বলে সদাই অন্তর্মুখী জীবনযাপন করেন এবং কাউকে ভালবাসা দিতে ইচ্ছা করেন না। আমি আত্মারাম সত্য, কিন্তু সমস্ত জগতের অন্তর-বাহির দেখতে পাচ্ছি এবং ভক্তের অধীনে থাকতেই ভালবাসি। আর আছেন আপ্তকাম বা পূর্ণকাম মুনিরা যাঁদের আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। এজন্যই তাঁদের আর বাইরের জগতের সঙ্গে মিশতে ইচ্ছা হয় না। আমি আপ্তকাম সত্য, কিন্তু ভক্তের প্রেমে আমি বাঁধা হয়ে থাকতে চাই। তাই আমি ভক্তাধীন, ভক্তবৎসল। এ-কারণে আপ্তকাম মুনিদের সঙ্গে আমার তুলনা হতে পারে না। অপরদিকে আমাকে তোমরা অকৃতজ্ঞ ও গুরুদ্রোহীও বলতে পার না। কারণ যেসকল ভক্ত আমাকে ডাকে, আমি তাদের কথা মনে রাখি এবং সময়েই তাদের কর্মের ফল প্রদান করে থাকি। তাই আমি কখনোই অকৃতজ্ঞ নয়। অপরদিকে আমাকে গুরুদ্রোহী পাষণ্ড বলা যায় না। কারণ আমি নিজেই তো পাষণ্ড দলন করে শাস্তি বিধান করি। তাই সমাজের কোনো প্রকৃতির লোকের সঙ্গেই আমার মিল তোমরা খুঁজে পাবে না।
কৃষ্ণের এহেন বিজ্ঞ বচনে গোপীরা পরস্পর কটাক্ষে এবং ভ্রূ-বিলাসের মধ্যে দিয়ে হেসে উঠলেন। এতে শ্রীহরি আরো সপ্রতিভ হয়ে বলে উঠলেন, দেখ, সখিরা! গরিব লোক হঠাৎ দৈবলব্ধ ধন পেয়ে তা হারালে যেমন সবকিছু ভুলে সর্বদাই ধনের চিন্তা করে, তেমনি আমার ভজনকারী ব্যক্তিরা যাতে আমাকে না ভুলে নিরন্তর আমার স্মরণ-মনন করে, তাই তাদের একবার দেখা দিয়েই আমি অন্তর্হিত হই। যাতে আমার প্রতি তাদের অনুরাগটা বাড়ে। আসলে আমার প্রতি ভক্তের লালসা বৃদ্ধি করার জন্যই আমি ইচ্ছা করে দূরে দূরে থাকি যাতে অন্তরে আমার প্রতি তাদের অনুরাগটা তীব্রতর হয়। আহা! তোমাদের প্রেমের তুলনা নেই। তোমরা সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে আমায় ভালবেসেছ। এজন্য তোমরা পতি-পুত্র, আত্মীয়পরিজন, লোকাচার, শাস্ত্রাচার, দেহধর্ম সবকিছুই ত্যাগ করেছ। আমার প্রতি তোমাদের অনুরাগ চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। এজন্য তোমরা সবকিছুই অনায়াসে ত্যাগ করতে পেরেছ। তোমরা সংসারের সর্বস্ব ত্যাগ তো করেইছ, উপরন্তু লোকনিন্দা এবং অপবাদ সব উপেক্ষা করে এই জ্যোৎস্না রাতে ছুটে এসেছ। তাই তোমাদের প্রেম সমস্ত বিধিনিষেধ ভেঙে দিয়েছে। তোমাদের প্রেম ভাবটার কোনো তুলনা নেই। আসলে তোমাদের প্রেমমাধুর্যটা আড়াল থেকে একটু আস্বাদন করছিলাম। আমি তোমাদের চোখের আড়াল থেকেই তোমাদের ভজনা করছিলাম। তোমাদের ভাববিহ্বলতা আস্বাদন করে আনন্দে ভরপুর হচ্ছিলাম। তোমরা আমার প্রিয়জন, তোমাদের আনন্দে, সুখে-দুঃখে আমি আছি। তাই আমাকে আর তোমরা দোষারোপ করো না। তোমাদের অন্তরে ব্যথা দেওয়া আমার কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না। দেখ, তোমাদের আমার প্রতি যে ভালবাসার—যে টানটা রয়েছে, একমুখী হয়েছে তা আমার নেই। আমাকে তো বহুদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। যেসব ভক্ত আমাকে একটুও ডাকে, আমার নাম করে, প্রতিদানে আমাকে তাদের কৃপা করতে হয়। কিন্তু তোমাদের প্রেমের একনিষ্ঠতা কত, তোমরা আমার ভালবাসা লাভের জন্য কত ব্যাকুলভাবে ছুটে এসেছ! তোমাদের এই সদাচার, এই প্রেমের ঋণ আমি কোনোদিনই পরিশোধ করতে পারব না। আমি তোমাদের ভালবাসার কাছে চিরঋণী, হে প্রিয় সখিরা—তোমরা তোমাদের মহৎ প্রেমের উদারতা দিয়ে এই ঋণ পরিশোধ করে নিও।
পরমপ্রেমিক শ্রীকৃষ্ণের মুখে অতি বিনম্রভাবে এমন প্রাণমাতানো কথাগুলি শুনে উপস্থিত সব গোপীদের চিত্ত কোমলতায় বিগলিত হয়ে উঠল। তাঁদের অন্তর থেকে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যে অভিমান ছিল তা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল এবং সকলেই সহসা আনন্দ করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন। কোনো কোনো গোপী নিজেদের আলুথালু কেশরাশিকে শক্ত করে বাঁধলেন, কেউ বা নিজেদের কটিদেশের বসনকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে নিলেন আর পরস্পরের হাত ধরে অতি প্রীতিভরে প্রাণসখার সঙ্গে আনন্দ করতে মনস্থ করলেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ গোপীমধ্যে পরিবৃত হয়ে সহসা উঠে দাঁড়ালেন এবং সশক্তিক গোপীদের সঙ্গে আনন্দে নৃত্য করতে তৎপর হয়ে উঠলেন।
[পর্ব-৫]
এদিকে শ্রীকৃষ্ণ উঠে দাঁড়াতেই সমগ্র পরিমণ্ডল অপার্থিব রসমাধুর্যে পূর্ণ হয়ে উঠল। চন্দ্রালোকিত জ্যোৎস্না রাত্রির মৃদুমন্দ বাতাসের শীতল স্পর্শে গোপীমন আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠল। আর যোগেশ্বর কৃষ্ণ সহসা নিজেকে বহু কায়ে পরিণত করে দুইজন গোপীর মাঝে কণ্ঠলগ্ন করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এসময়ে প্রত্যেক গোপীই মনে মনে ভাবছিলেন প্রিয়তম আমার কাছেই আছেন। গোপীরা আপন সখা কৃষ্ণকে নিজের কাছে পেয়ে তাঁকে নিয়েই নৃত্যে মত্ত হয়ে উঠলেন এবং কেউ কাউকে দেখতে পর্যন্ত ইচ্ছা করলেন না। এভাবে প্রেম বৃন্দাবনের পবিত্র যমুনাতটে শুরু হল অপার্থিব রাসনৃত্য। রাস কথার অর্থ হল রস। বিশুদ্ধ চিত্তে নৃত্য ও গীতের মধ্যে যে অপার্থিব আনন্দ উপলব্ধি হয় তা মনে একধরণের স্বর্গীয় মাধুর্যের আস্বাদন ঘটায় যা রাসনৃত্যের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। অনেকে বলেন, বহু নর্তকী একসঙ্গে হয়ে যে বিশেষ নৃত্য করেন সেই নৃত্যের নাম রাস। তবে এটি হল গৌণ অর্থ। প্রধান অর্থ হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাজাগতিক সত্তার স্পর্শ পেয়ে গোপীদের মন অনন্তভাবে প্রসারিত হয়ে উঠেছিল এবং ভগবানের সর্বব্যাপী প্রেমস্পর্শে তা আপনহারা হয়ে বিশ্বব্যাপী সূক্ষ্ম তন্মাত্রার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ফলে রাসনৃত্যের মহানন্দের তরঙ্গ স্বর্গের দেবদেবী ও গন্ধর্বলোকে পৌঁছে গিয়েছিল। সেকারণে স্বর্গের দেবদেবীরাও সপত্নী বিমানে চড়ে রাসনৃত্য দেখতে সেখানে হাজির হলেন। তাঁরা স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন এবং দুন্দুভি বাজাতে লাগলেন। এমনকি নৃত্যগীতে দারুণ পারদর্শী গন্ধর্বেরা পর্যন্ত আপন ধর্মপত্নীদের নিয়ে ভগবানের পবিত্র মহিমা কীর্তনে মেতে উঠলেন।
রাসোৎসবের আনন্দ ক্রমশ চরম আকার ধারণ করল। শত শত গোপিনীদের বলয়, নূপুর ও কিঙ্কিনীর আওয়াজ হতে লাগল। অপরূপ দেবকীনন্দন স্বর্ণবর্ণা গোপীদের মাঝে নীলকান্ত মণির মতো শোভা পেতে লাগলেন। তাঁর অনন্য নৃত্যভঙ্গি, কটাক্ষ এবং মৃদুমন্দ হাস্য গোপী হৃদয়ের প্রেমবর্ধনে সহায়ক হচ্ছিল। ভগবান কৃষ্ণের সঙ্গে নৃত্যের ছন্দ মিলনে গোপীদের পদবিন্যাস, করচালন ও সহাস্য ভ্রূভঙ্গিতে এক অপার্থিব মাধুর্য ঝরে পড়তে লাগল। অনবরত নৃত্য আনন্দের ফলে গোপীদের দেহবোধ ক্রমশ লুপ্ত হয়ে এল। ফলে গোপিনীদের বক্ষঃস্থলের বসন শিথিল হল, গলে কুন্ডল দুলতে লাগল, মুখকমলে স্বেদবিন্দু দেখা দিতে লাগল। কোনো কোনো গোপীর আবার মাথার চুলের সঙ্গে লাগানো করবীর মালা খসে পড়তে লাগল, হাতের ফুলবালার বাঁধনও হালকা হল। কৃষ্ণপ্রিয়া গোপীরা নৃত্য মাঝে প্রাণপ্রিয়র স্পর্শে আনন্দে পুলকিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে কৃষ্ণগুণগান করতে লাগলেন। তাঁদের সমবেত কণ্ঠের সুমধুর সঙ্গীত ধ্বনি জগত পরিব্যাপ্ত হল। আবার কোনো গোপী শ্রীকৃষ্ণের কণ্ঠের সঙ্গে নিজের কণ্ঠ মিলিয়ে সমানে সমানে গান ধরলেন। আবার কোনো গোপী বিশুদ্ধ ধ্রুবতালে গান ধরলে শ্রীকৃষ্ণ তা শুনে মোহিত হলেন এবং সঙ্গে প্রশংসা করে তাঁকে সাধুবাদ দিলেন। এই সময়ে প্রণয়কাতর এক গোপী নৃত্যে পরিশ্রান্ত হয়ে পার্শ্বস্থিত কৃষ্ণের কাঁধে ভর দিয়ে নিজের দেহের ভারটা লাগালেন। শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত প্রেমময়ী শ্রীরাধার এমন ভাব দেখে পুলকিত হলেন। কোনো গোপী আবার নিজের কাঁধে স্থাপিত শ্রীহরির চন্দনচর্চিত ও পদ্মগন্ধ মিশ্রিত বাহু আঘ্রাণ করে অতি রোমাঞ্চে শ্রীকৃষ্ণের বাহুদ্বয় চুম্বন করতে লাগলেন। কোনো গোপী আবার আনন্দে নিজের রাঙা গাল শ্রীকৃষ্ণের সুগন্ধময় গালে স্থাপন করলে কৃষ্ণ চর্বিত তাম্বুল তার মুখে দিয়ে দিলেন। এভাবে অন্যান্য গোপীরাও নিজ নিজ ভাব অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করতে লাগলেন। গোপিনীরা কাত্যায়নী ব্রত উদযাপন করার মধ্য দিয়ে দেবীর কাছে শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার প্রার্থনা করেছিলেন। যোগমায়া দেবীর ইচ্ছায় এবং তৎপরতায় এক্ষণে সেই ব্রত ফলপ্রসু হতে চলেছে। গোপীরা নৃত্যগীতে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মঙ্গলময় করকমল দিয়ে তাঁদের মুখমণ্ডল মার্জনা করে দিলেন এবং আপন বাহুডোরে জড়িয়ে তাঁদের গভীর আলিঙ্গন করলেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের উন্মাদনায় অচিরেই গোপীদের দেহবোধ চলে গেল এবং তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের গুণসমূহ উচ্চস্বরে কীর্তন করতে লাগলেন।
ওদিকে ব্রজসুন্দরীদের সঙ্গে পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের এমন অপরূপ লীলাদর্শনে দেবস্ত্রীরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। আকাশের চন্দ্র এই লীলা দর্শন করে নক্ষত্রাদির সঙ্গে পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে নিজের গতি ভুলে গেল। ফলে সেই রজনী অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে গেল।
এদিকে বহুক্ষণ নৃত্যগীতে গোপিনীরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিতে সকলেই ক্লান্ত দূরীকরণের জন্য যমুনার জলে প্রবেশ করলেন। গোপিনীরা সহাস্যে কৃষ্ণের সঙ্গে জলক্রীড়া করতে আরম্ভ করে দিলেন। তাঁরা চতুর্দিক থেকে জল ছিটিয়ে কৃষ্ণকে অভিষিক্ত করলেন। এসময়ে আকাশ থেকে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করে ভগবানের স্তব-গান করতে লাগলেন। অতঃপর জলক্রীড়া শেষ হলে গজরাজের মতো শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে তীরে উঠে এলেন এবং পুষ্প সুরভিত উপবনে তাঁদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আকাশের নক্ষত্ররা তখনও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। তবে ভোরের পাখিরা মাঝেমধ্যেই ডেকে উঠছে। প্রকৃতির ইঙ্গিতে রাত্রি যে সমাগত হয়ে ব্রাহ্মমুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে তা বোঝা গেল। শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন গোপীরা সেই সন্ধ্যাবেলায় বংশীধ্বনি শুনে সংসারের সবকিছু ফেলে তার কাছে ছুটে এসেছিল। আপন আপন স্বামী, পুত্র, দেহ, গেহ, মান, সম্মান, কর্তব্য, লাজ, লজ্জা সবকিছুই উপেক্ষা করে তাঁরা কৃষ্ণাভিমুখে ধাবিত হয়েছিল। এক্ষণে তাঁদের সেই কৃষ্ণ-চাওয়াটা পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং আর তাঁদের এখানে থাকার দরকার নেই। এই কথা ভেবেই সুচতুর শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের বললেন—তোমরা এবার নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাও। আর এখানে থাকা উচিত নয়। কৃষ্ণকথার তাৎপর্য বুঝে গোপীরাও প্রাণপ্রিয় কৃষ্ণকে বন্দনা করে গৃহের অভিমুখে রওনা দিলেন।
এই প্রেম বৃন্দাবনের পথের পথিক হলাম আমরা সবাই। গোপীরা হলেন জীবাত্মার প্রতীকস্বরূপ এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা। জীবচেতনা যতদিন খণ্ড থাকবে ততদিন পূর্ণতা লাভের জন্য ভগবানের দিকে দৌড়তে থাকবে মন। অনেক অশুদ্ধ চিত্ত ব্যক্তিরা ভাবেন শ্রীকৃষ্ণ পরস্ত্রীর সঙ্গে সারাক্ষণ প্রেম ভালবাসা করলেন—এটা তাঁর মতো একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া কি যথার্থ ছিল? এসবে কি সনাতন ধর্ম লঙ্ঘন হল না? আসলে শ্রীকৃষ্ণকে আমাদের মতো সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে ভাবলে ভুল হবে। তিনি স্বয়ং নারায়ণ। ধর্মস্থাপন করতে এবং অশুভ শক্তি বিনাশ করতেই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর সমস্ত কর্মই অপ্রাকৃত এবং দিব্যভাবনায় ভরপুর। বলা হয় শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরমপুরুষ, নিত্যতৃপ্ত, আত্মারাম, নির্বিকার, সচ্চিদানন্দস্বরূপ ভগবৎ বিগ্রহ। তাঁর মধ্যে অপূর্ণতা থাকতেই পারে না। তিনি ভক্তাধীন। ভক্তের ইচ্ছাপূরণে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকেন। গোপিনীরা ছিলেন বাল্যকাল থেকেই তাঁর ভক্ত। তাঁরা মধুরভাবে শ্রীকৃষ্ণকে স্বামীরূপে চেয়েছিলেন। ভক্তবৎসল ভগবান রাসলীলার মধ্য দিয়ে গোপীদের এই মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন মাত্র। এ-কারণে রাসলীলা চৈতন্যময় জ্ঞানস্বরূপ বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভক্তিবিগ্রহস্বরূপ গোপীদের অপার্থিব মিলনকাহিনি। শ্রীকৃষ্ণ হলেন পূর্ণকাম পরমাত্মা। আর গোপীরা হলেন জীবাত্মা। তাই এই লীলা হল ভক্তি ও ভালবাসার মধ্য দিয়ে জীবাত্মা ও পরমাত্মার একীভূত হওয়ার ঘটনা। অপরদিকে ভক্ত গোপীদের ভগবানের কাছে প্রেম-ভালবাসার মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণের কাহিনি রূপেও রাসলীলাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
বৈষ্ণব শাস্ত্রকারেরা গোপীদের শ্রীকৃষ্ণের অংশ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁরা বলেন, কৃষ্ণ হলেন অগ্নিস্বরূপ এবং গোপীরা হলেন তাঁর দাহিকা শক্তি। আগুন থাকলেই যেমন দাহিকা শক্তি থাকবে, তেমনি পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আনন্দবিধানের জন্যই তাঁর অংশসম্ভূতা হ্লাদিনী শক্তিরূপে গোপিনীদের জন্ম হয়েছিল। সেকারণে বস্তুত গোপীরা কখনোই শ্রীকৃষ্ণ থেকে আলাদা ছিল না। মর্ত্যলোকের অসংখ্য মানব-মানবীরা যাতে ভগবানকে গভীরভাবে ভালবাসতে পারে তা শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এই রাসলীলার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গোপীরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অন্তরঙ্গ লীলাবিলাসের জন্যই দেহধারণ করেছিলেন। আর এ-কাজে যোগমায়া তাঁদের সহায়ক হয়েছিলেন। কারণ কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে যখন গোপীরা ছুটে এসেছিলেন এবং রাসনৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন, সে সময়ে যোগমায়া দেবী এক অপরূপ মায়া সৃষ্টি করেছিলেন। যার প্রভাবে গোপীদের পতিরা মায়ায় মোহিত হয়ে আপন আপন স্ত্রীদের নিজের কাছেই দেখেছিলেন। ফলে তারা দেবকীনন্দনের প্রতি কখনোই কোনো দোষারোপ করেননি। এসব কারণে ব্রহ্মর্ষি শুকদেব বলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ কোনো পরস্ত্রীর সঙ্গে রাত্রিযাপন করেননি, তিনি আপনার প্রতিবিম্বের সঙ্গেই খেলা করেছিলেন। নারী হল পুরুষের প্রতিবিম্ব। লীলার সরচরী।
আমাদের অবশ্য এতসব বিচারে কাজ নেই। আমরা হলাম ভক্ত। লীলাপুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের কর্মের সমালোচনা করার শক্তি আমাদের নেই। তিনি অতিমানব, অসীম শক্তিশালী, বীর, তেজস্বী এবং স্বয়ং কামদেব তাঁর কাছে পরাভূত হয়ে হাত জোড় করে আছেন। আমরা তো সেখানে অতি সামান্য কামনা-বাসনাময় জীব মাত্র। তাই সর্বশক্তিমান প্রেমময় শ্রীকৃষ্ণের চরণে ভক্তিলাভই আমাদের লক্ষ। এই রাসলীলায় দেখা যায় যে, ভগবানকে ভালবাসলে তিনি আমাদের ভালবাসা গ্রহণ করেন। তাঁর স্বর্গীয় সান্নিধ্য দান করেন। তাছাড়া, গোপীদের ভগবানের জন্য মিলিত হওয়ার জন্য অন্তরের ব্যাকুলতা কত! তার ছিটেফোঁটাও যদি আমাদের অন্তরে জাগে তাহলে জীবনটাই ধন্য হয়ে যায়। দেখা যায় ভগবান কৃষ্ণের প্রতি ঐকান্তিক টানে গোপীরা সমস্ত কিছু ত্যাগ করেছিলেন। এমনকি বিরহ-বেদনায় মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। ভগবানের জন্য এমন প্রবল আকর্ষণ ও ভালবাসা থাকলেই তাঁকে দর্শন করা যায়। সেজন্য গোপীরা আমাদের কাছে নমস্য ও অতি শ্রদ্ধার পাত্র। কারণ তাঁরা না থাকলে কামকাঞ্চনাসক্ত মানুষ ভগবানকে কতটা ভালবাসা যেতে পারে তার কিছুই বুঝতে পারত না। সেকারণে কৃষ্ণ ভগবান তাঁর অন্তরঙ্গ সখীদের নিয়ে কৃপা করে যে লীলা রেখে গেছেন তা বারবার অনুধ্যান করা কর্তব্য। কারণ এর ফলে চিত্ত কৃষ্ণমুখী হয় এবং মনটা কৃষ্ণপ্রেমের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ভগবানকে পাওয়ার জন্য এই ব্যাকুলতা বড়ই প্রয়োজন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য রাধারানীর ভাব আশ্রয় করে কৃষ্ণপ্রেমের জন্য এই অপরূপ ব্যাকুলতার নিদর্শন আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
বস্তুত লীলাপুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের সমস্ত লীলা মাধুর্যের যথার্থ তাৎপর্য বুঝতে গেলে আমাদের সাধন-ভজন করতে হবে। নিয়মিত ভাগবত পাঠ, স্মরণ, মনন ও অনুধ্যান করা প্রয়োজন। এছাড়া, অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে হরিনাম সংকীর্তন শোনা ও গাওয়া দরকার। নইলে কৃষ্ণলীলার যথার্থ মাধুর্য ও রহস্য আমরা অনুধাবন করতে পারব না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় অচ্যুত কিনা যাঁকে কেউ তাঁর অনন্ত ভাব ও মর্যাদা থেকে চ্যুত করতে পারে না। কাজেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বভাব ধর্ম সর্বদা বজায় রেখেই তাঁর নিজেরই সত্তাস্বরূপ গোপীদের সঙ্গে বিহার করেছিলেন। আসলে গোপীরা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণের নিগূঢ় প্রেমরহস্য কেউই যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পারবেন না। কারণ কৃষ্ণ নামগুণগান করে, কৃষ্ণ অঙ্গ স্পর্শে যাঁদের দেহবোধ তিরোহিত হয় এবং চিত্ত-মন ও বুদ্ধি কৃষ্ণময় হয়ে যায়, তাদের দ্বারা সংগঠিত লীলা কি কখনো ব্যভিচার দোষে দুষ্ট হতে পারে? তা কখনোই সম্ভব হয় না। এ-কারণে রাসলীলার সম্যক উপলব্ধি কোনো মর্ত্যমানবের পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব নয়। তাছাড়া যেখানে দেহবোধ শূন্য ব্রহ্মর্ষি মুনি শুকদেব এই লীলা বর্ণনা করছেন মৃত্যুপথযাত্রী পরীক্ষিৎকে, সেখানে জাগতিক কোনো ভাবনার স্থান পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
তাই প্রেম বৃন্দাবনের আলোকে রাসলীলা তত্ব ব্যাখ্যার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস নিন্দনীয় নয়। কারণ যাঁর নাম করলে মানুষের চিত্ত থেকে পাপ দূরীভূত হয়ে যায়, যাঁর স্মরণ-মনন ও অনুধ্যানে মানব-মানবীদের হৃদয়ে শুদ্ধ প্রেম জাগ্রত হয়, সেই লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম বহুবার এই লীলায় উচ্চারিত হয়েছ। ফলে কৃষ্ণপ্রেম লাভে উন্মুখ লেখকের সঙ্গে পাঠক-পাঠিকাদের চিত্ত সুদ্ধ হয়েছে, বুদ্ধি মার্জিত হয়েছে এবং অন্তরে শুদ্ধ প্রেমলাভের ব্যাকুলতাও ক্রমশ জড়িত হবে। এ-কারণেই শুদ্ধভক্তি লাভ করার জন্য পুনঃপুনঃ ভক্ত-ভগবানের অনুপম লীলাকাহিনি এই ভাগবত অধ্যয়ন করতে হয়। অতি শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে ভাগবতের প্রধান অংশসম্ভূত এই রাসলীলা শ্রবণ, কীর্তন ও অনুধ্যানে মানবচিত্তের জন্ম-জন্মান্তরের কামনা-বাসনার নিঃশেষ রূপে ক্ষয় হয়ে যায়। ভগবান যেহেতু সর্ববিকার মুক্ত, নিত্যশুদ্ধ ও জ্যোতির্ময়—তাই তাঁর লীলা আখ্যান পড়লে আমাদের অন্তরে কামবেগের চির বিনাশ ঘটে। গোস্বামী প্রভুরা তাই একবাক্যে বলেছেন যে, এই রাসলীলার উদ্দেশ্য হল কামভাব দূরীকরণ এবং ভগবানের চরণে আত্মনিবেদনের তীব্র প্রচেষ্টাস্বরূপ। আর এই দুটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে গেলে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নিয়ে রাসলীলা শ্রবণ, মনন ও অনুধ্যান করতে হবে। শুদ্ধচিত্তে এই লীলা অনুধ্যানের ফলে হৃদয়ে ভগবৎ ভক্তি জাগ্রত হবে। গোপিনীদের মতো তীব্র ব্যাকুলতা নিয়ে ভগবানের দিকে দৌড়ে যেতে মনের ইচ্ছা জাগ্রত হবে। আর এই ইচ্ছা অন্তঃকরণে দৃঢ় হলেই কামদেবের পতন অবশ্যম্ভাবী। তাই রাসলীলার স্মরণে তথা প্রেম বৃন্দাবনের পথে পথে হাঁটলে ভক্তরা ভয়াবহ কামরোগ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বর্গীয় প্রেমে ভাসবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর ফলে তাঁদের জীবন সুন্দর, আনন্দপূর্ণ ও শান্তিতে ভরে উঠবে। জয় শ্রীহরি।