বৃন্দাবনের পথে উদ্ধব
পরমসুন্দর শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাধার কুঞ্জদ্বারে উপনীত। কিন্তু সৌভাগ্য-গর্বে প্রেমময়ী রাধা তাঁর প্রতি ভ্রূক্ষেপও করছেন না—দেখে বিশাখা তাঁকে বললেন, ‘হে সখি! সখ্যগণের সঙ্গ ত্যাগ করে, তোমার সঙ্গে মিলনের জন্য উৎসুকা চন্দ্রাবলী প্রভৃতি প্রেয়সীগণকেও অনাদর করে এই হরি তোমার দ্বারে উপস্থিত হয়ে তোমারই মুখতটে স্থিরদৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর তুমি কিনা হাস্যবদনে নীচের দিকে চোখ রেখে যূথিকা ফুলের মালা গাঁথতেই তন্ময় হয়ে আছ। তাঁর প্রতি একবার গভীর অনুরাগপূর্ণ কটাক্ষও নিক্ষেপ করছ না।’ অন্তর্যামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রণয়িনীর মানের আতিশয্য দেখে অবিলম্বে সেই স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলেন। টনক ফিরল শ্রীরাধার। ভ্রূযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করে তাঁর দিকে সহসা দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বললেন, ‘হে মাধব, যদি তুমি আমার হৃদয় হতে চলে যেতে পার, তাহলেই তোমার যথার্থ পৌরুষ বুঝতে পারব।’ তারপরই বিশাখার দিকে প্রেমাণুরঞ্জিত নয়ন মেলে শ্রীরাধা বললেন—
‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পিরিতি লাগি থির নাই বান্ধে।।’ (জ্ঞানদাস)
রাধার এই প্রেমানুভূতি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ এবং সীমাহীন। কেমন ছিল রাধার আন্তর অনুভব? ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় বিশ্বের সকল পুরুষ মানুষের মনে অহরহ এই প্রশ্ন উঠছে। মিলনবিরহময় রাধাপ্রেমের স্বরূপ এবং গভীরতা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও পরিমাপ করে উঠতে পারেননি। অথচ রাধার প্রেমরহস্য অনুভব করার কী আগ্রহই না তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছিল। প্রেম বিষয়ে প্রেমরাজ কৃষ্ণের গুরুস্থানীয়া হলেন গোপীরা। গোপীদের মধ্যে রাধার প্রেম আবার সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি কৃষ্ণে আবাল্য অনুরক্তা। নাম শ্রবণেই এঁর মনে পূর্বরাগ হয়। পূর্বরাগে কৃষ্ণের-এর মুরলী-ধ্বনি শুনে চিত্ত ব্যাকুলিত হয়ে ওঠে, সখীদের সঙ্গে কৃষ্ণ নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে পূর্বরাগ গভীরতা লাভ করে মন কৃষ্ণরূপ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চিত্তে উদবেগ ও নানাবিধ ভালোবাসাজনিত বিকারের জন্ম হয়। তবে এই বিরহ ও মিলনের অতি সূক্ষ্মতম আনন্দ অনুভূতি, যা রাধার হৃদয়ে আছড়ে পড়ছে তা সহজ ও স্পষ্ট নয়। আবার অসত্যও কিছু নয়। এসবের ঠিক ব্যাখ্যা করাও যায় না, আবার অন্তর দিয়ে রাধাপ্রেম বোঝবার লোভও সামলানো যায় না। অপরদিকে কিঞ্চিৎ পরিমাণেও প্রেম লাভ করতে হলেও রাধারানিকেই আশ্রয় করতে হয়। কারণ পুরুষকৃষ্ণ সহ মানুষেরা তাঁদের নিজের প্রেম অনুভবের স্বরূপ সম্যকরূপেই জানেন—কিন্তু তাঁদের চেয়ে পৃথক এক নারীরূপা মানবীর অন্তর অনুভূতি তাঁরা জানেন কি? এই সম্পূর্ণ শুদ্ধ প্রেমসুখ লাভের বাসনা কার মনেই না জাগে? সুতরাং গভীর শুদ্ধবোধ নিয়ে রাধাপ্রেমের স্বরূপের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে :
‘রাধা পূর্ণশক্তি, কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র পরিমাণ।।
মৃগমদ তার গন্ধ যৈছে অবিচ্ছেদ।
অগ্নি জ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।।
রাধা কৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ।।’
অর্থাৎ প্রেমকে একটি অদ্বিতীয় শক্তি হিসেবে চিন্তা করলে মনে যেরূপ ভাবনা ওঠে শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপত তাই ছিলেন। এক ও অদ্বিতীয় প্রেমসম্পন্ন তিনি— তাঁর অনুভূতিতে দ্বৈত বোধ নেই। সীমাহীন প্রেমে তিনি চিরন্তন নিমগ্ন। নিজে প্রেমসুখ নিজ অন্তরেই উপলব্ধি করতেন। কিন্তু আরও প্রেমজনিত আনন্দলাভের বাসনায় তিনি তাঁর অনন্ত প্রেমের কিছু অংশ অন্তরের গহন থেকে বাইরে এনে পৃথক করলেন—প্রেমকে দ্বিখণ্ডিত করলেন। সৃষ্টি হল অপূর্ব রহস্যময় স্বর্গীয় অনুভূতি—বিরহ ও মিলন। এই মিলন-বিরহ হল প্রেমের পরিণাম—প্রেম ছিল এক, হল দুই। দুইয়ের রানি হলেন ওই শ্রীরাধা। শ্রীকৃষ্ণের ল্হাদিনীশক্তি যা কৃষ্ণেচ্ছায় রাধারূপে আপামর নরকারীকে প্রেমধর্ম শেখাতে বৃন্দাবনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই রাধাচরিত্রের আদি-মধ্য-অন্ত সবই প্রেমের এক-একটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত সুরভিত পুষ্প—যা মনের মাঝে ধীরে-সুস্থে চয়ন করলে হৃদিমাঝে বৃন্দাবনের আবির্ভাব ঘটায়, যেখানে নিত্য শ্রীকৃষ্ণের মধুর বংশীধ্বনি অহরহ শোনা যায়। এই মুরলীধ্বনি রাধাচিত্তকে পাগল করে তুলেছিল—খণ্ড প্রেমকে অখণ্ড প্রেমসত্বায় মেলানোর দৈবপ্রয়াসই হল বংশীধ্বনি। রাধারানি এর যথার্থ অর্থ অনুভব করেছিলেন—তাঁর আচরণেও প্রকট হয়ে উঠেছিল বংশীর সুরলহরীর সূক্ষ্ম ক্রিয়াসকল। তাইতো রাধার মনোব্যথার ব্যথী হয়ে অমরকবি চণ্ডীদাস লিখলেন—
‘রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহার কথা।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে
না চলে নয়ানতারা।।
বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে
যেমত যোগিনী পারা।’
কবির মতো আমরাও কমবেশি সকলে বুঝি যে, রাধার অন্তরে প্রকৃত প্রেমের জন্ম হয়েছে। তাই ওইরূপ ব্যবহার তিনি করে চলেছেন। আমরা কল্পনায় প্রেমের সীমাকে যতদূর নিয়ে যেতে পারি, তার চেয়েও অতিরিক্ত অসীম প্রেমের অধিকারিণী হলেন স্বয়ং শ্রীরাধা। বিশ্বের সমস্ত নারীর অন্তরের শুদ্ধ প্রেমটিকে একত্র করলে যে পরিমাণ ‘মহান এবং বৃহৎ প্রেমের সৃষ্টি হয়’ তার চেয়েও রাধার প্রেম ছিল সমধিক। তাই রাধাপ্রেম দুর্লভ বস্তু—আর এটাই হল সাধ্য-সাধনার বস্তু। মর্ত্যলোকের ইতিহাসে এই গভীরতম প্রেম আর কোনও নারী-হৃদয়ের মধ্যে ফুটে ওঠেনি।
এখন প্রশ্ন হল—প্রেম কী বস্তু? এর উত্তরে সহজ করে বলা যায় যে, বোবাকে রসগোল্লা খেতে দিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়—কেমন লাগল হে? তখন সে চোখে-মুখে আনন্দ ফুটিয়ে কী যেন বোঝাতে চেষ্টা করে—তবে যিনি রসগোল্লা স্বয়ং খেয়েছেন তিনি অবশ্যই বুঝে যাবেন ও কী বলতে চাইছে— ‘মূকাস্বাসদনবৎ’ কিংবা ‘অনির্বচনীয়া’। তবে পণ্ডিতরা আমাদের মতো কেন প্রেমের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে ছাড়বেন? তাই এক পণ্ডিত বললেন, ‘যা চিত্তকে সম্যকভাবে মসৃণ করে এবং যাতে মমত্বের আতিশয্য থাকে এবং গাঢ়তা প্রাপ্ত ভাবকেই প্রেম বলে।’ কেউ কেউ আবার বলেছেন, ‘বিনষ্ট হবার বাহ্য এবং অন্তরঙ্গ বহু কারণ থাকলেও পরস্পর মানসিক প্রীতিপূর্ণ ভাববন্ধন যখন কোনও মতেই ধ্বংস হয় না, তাকেই প্রেম বলে।’ প্রেমিকশ্রেষ্ঠ নারদ বলছেন, ‘প্রকৃতির তিন গুণের অতীত এক অতি সূক্ষ্মতম আন্তর অনুভূতি, যা সর্বদাই অসীমের দিকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে তাই হল প্রেম।’ আসলে প্রেম হল একটি অপার্থিব শক্তি। এই দুর্বার আকর্ষণ শক্তি দুটি আত্মার মধ্যে এক স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে আসে—যা একই সঙ্গে অসীম, আনন্দপূর্ণ ও মাধুর্যময়। আত্মার মধ্যে ভালোবাসা পূর্ব থেকেই বর্তমান থাকে। কেবল দুটি সত্তার পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহানুভূতির মধ্যে তার বৈশিষ্ট্য হৃদয়মাঝে বিকশিত হয় এবং এই স্বর্গীয় অনুভূতির বিকাশের ফলে সব কিছুই সুন্দর, প্রেমপূর্ণ ও মধুময় বলে মনে হয়। পাশ্চাত্য মনিষী এরিক ফ্রম-এর মতে, ‘সত্যিকার ভালোবাসা হল সৃজনশীলতার অভিব্যক্তি—যার মধ্যে থাকে আদর, যত্ন, সম্মান, দায়িত্ব ও জ্ঞান। ভালোবাসার পাত্র যাতে সুখ-সমৃদ্ধিতে থেকে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য এটা তার একটা সক্রিয় প্রয়াস, যা তার ভালোবাসার ক্ষমতার মধ্যেই দৃঢ়ভাবে নিহিত আছে।’ স্বামী বিবেকানন্দ চিরন্তন প্রেমে স্থিরবিশ্বাসী ছিলেন। প্রেম সম্পর্কে তাঁর তেজস্বী উক্তি—’সর্বশক্তিময় প্রেমের উপর আস্থা রাখ। তুমি কি কখনও ভালবেসেছ? তুমি তো তাহলে সর্বশক্তিমান। জগৎ চায় সেইসব মানুষকে যাদের হৃদয়ে আছে জ্বলন্ত প্রেম ও স্বার্থশূন্যতা। … যিনি ঈশ্বরকে কামনা করেন, তিনিই ভালবাসা পান আর তাঁকেই ভগবান নিজেকে উজাড় করে দেন। ভালবাসা পারস্পরিক আদান-প্রদানের বস্তু। এটি ভাবের বস্তু এবং এটি ছাড়া পরমানন্দের আস্বাদ মেলে না। ভালবাসার অফুরন্ত শক্তি মানবজীবনকে মধুরতম করে তোলে। নিঃস্বার্থ ভালবাসা হল স্বাস্থ্যপ্রদ এক স্বর্গীয় প্রেরণা শক্তি—যা একজন অসৎ মানুষকে সম্পূর্ণভাবে মহত্তম দেবমানুষে রূপান্তরিত করে দিতে পারে।’ শ্রীরাধার মধ্যে এই নিঃস্বার্থ এবং কামনাশূন্য প্রেম প্রথম থেকেই বিদ্যমান ছিল। শ্রীকৃষ্ণের রূপ-গুণ-সৌন্দর্য মাধুর্য আস্বাদনের ইচ্ছা অন্তরে বলবতী হতেই পূর্বনিহিত ভাব ও প্রেমের উচ্ছ্বাস তাঁর দেহ-মনকে অবশ করে দেয়। কৃষ্ণপ্রেমের জন্য ত্যাগ ও দুঃখ সহিষ্ণুতার চরম সীমায় ক্রমশ তিনি উপনীত হন। অবশেষে প্রেমের শক্তিতে জয়লাভ করে তিনি নিজেকেই স্বয়ং কৃষ্ণ হিসেবে অনুভব করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রেমের চরম সীমায় নায়কের, আমি পুরুষ নই এবং নায়িকার পক্ষে আমি নারী নই, এরূপ ভ্রম ঘটে—প্রেম এখানে এক অদ্ভুত অপ্রাকৃত আনন্দরসে রূপান্তরিত হয়ে যায়। দেহবোধহীন, দ্বৈত অস্তিত্বহীন প্রেম এখানে সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত অনুভূতিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এর উপরে প্রেমের আর গতি নেই। বৈষ্ণবশাস্ত্রে প্রেমের এই লক্ষণকে ‘মহাভাব’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে—দ্বাপরের শ্রীরাধা, কলিযুগে মহাপ্রভু, শ্রীরামকৃষ্ণ এবং স্বয়ং সারদার মধ্যে সেই মহাভাবের পূর্ণ প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি।
শ্রীরাধার প্রেমের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, সুদর্শন পুরুষ দর্শন করলেই নারীর চিত্তে অদ্ভুত সব বিকারের জন্ম হয়। কাজেই সর্বমনোহর পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের জন্য রাধাচিত্ত যে বিগলিত হবেই—এতে আর সন্দেহ কোথায়! এখন প্রশ্ন হল—শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এমন কী ছিল, যা রাধাকে কৃষ্ণময় করে তুলেছিল? বস্তুত, প্রেমরাজ মধুর রসবিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে পুরুষজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণগুলি চরম মাত্রার চেয়েও অধিক মাত্রায় বর্তমান ছিল। তিনি অসংখ্য অপার্থিব গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর দেহের সৌন্দর্য, যৌবনের লালিত্য তথা নয়নের মাধুর্য সকলকে পাগল করে তুলত। তিনি ছিলেন অসম্ভব মধুর সর্বসুলক্ষণযুক্ত, বলীয়ান, নবতারুণ্যে ভরপুর, শাস্ত্রজ্ঞ, যুক্তিপরায়ণ, প্রিয়ংবদ, কৃতজ্ঞ, প্রেমবশ, দয়াসিন্ধু, দক্ষ, কেলিসৌন্দর্য পারঙ্গম পরম পুরুষ। কৃষ্ণের যথার্থ সৌন্দর্য-বর্ণনা অসম্ভব। তবুও বলা যায়, তাঁর মুখমণ্ডল ছিল অপার্থিব মনোহর, অপূর্ব প্রেম ও করুণাময় নয়নযুগল, আজানুলম্বিত বাহুদ্বয়, স্কন্ধে কুঞ্চিত কেশজাল, ভ্রূলতা ঈষৎ উন্নত ও সুকোমল, অধরোষ্ঠ সর্বদা মৃদুহাস্যময়, বক্র কটাক্ষদর্শনে পারঙ্গম, মস্তকে ময়ূরপুচ্ছ, কণ্ঠে মুক্তাবলি হার, করে কঙ্কন, সর্বাঙ্গে হরিচন্দ্র, কটিতে পীতাম্বর, বাম হস্তে বংশী, দেহকান্তি জলপূর্ণ মেঘমালার ন্যায় শ্যামল, দয়াসিন্ধু, সদা প্রেমরসে বিভোর। অতুলনীয় পুরুষচরিত্রের রহস্যময় এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। একবার যার উপর তিনি প্রেমদৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন, তিনি চিরকালের জন্য কৃষ্ণময় হয়ে যেতেন।
কৃষ্ণের প্রিয়াদের মধ্যে রাধা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠা। তিনি ছিলেন এক অপূর্ব সৌন্দর্যশালিনী সর্বগুণান্বিতা অসাধারণ নারী। গভীর রূপলাবণ্যময় দেহশোভার অধিকারিণী শ্রীরাধিকা ছিলেন মধুরমন্দ, স্মিতহাস্য, স্বল্পবাক, কর্মদক্ষা, বিনীতা, করুণাময়ী, বিদগ্ধা, লজ্জাশীলা ও ধৈর্য-সমন্বিতা, মানিনী ছাড়াও অসংখ্য গুণের অধিকারিণী। এইজন্যই শ্রীরাধিকা হলেন ব্রজকান্তাগণের শিরোমণি—তিনি শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনীশক্তি—একই আত্মা, দুই দেহ। রাধা আর কৃষ্ণ—অনন্ত প্রেমের যুগলবিলাসমূর্তি।
কৃষ্ণ প্রিয়াদের প্রেমের দুটি রূপ লক্ষ্যণীয়—স্বকীয়া এবং পরকীয়া। স্বকীয়া কৃষ্ণপ্রেয়সীদের সংখ্যা ষোল হাজার একশো আট। তাঁদের মধ্যে আটজন মাত্র কৃষ্ণের মুখ্য বিবাহিতা ধর্মপত্নী ছিলেন। তাঁরা হলেন রুক্ষ্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দী, শৈব্যা, ভদ্রা, কৌশল্যা এবং মাদ্রী। রুক্ষ্মিণী ও সত্যভামা হলেন যথাক্রমে ঐশ্বর্য ও সৌভাগ্যের দিক দিয়ে সকলের শ্রেষ্ঠা। শ্রীমতী রাধারানি ছিলেন সম্পর্কে কৃষ্ণের মামিমা, অর্থাৎ মামা আয়ান ঘোষের বিবাহিতা স্ত্রী। কিন্তু তিনি ছিলেন পরকীয়া প্রেমের শ্রেষ্ঠতম পার্থিব উদাহরণ। গোপিনীরা সকলেই ছিলেন পরকীয়া প্রেমের যথার্থ প্রেমিকা। এই গোপ-গোপীরা বাল্যকাল থেকেই সুন্দরপুরুষ কৃষ্ণরূপে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে ভালোবেসেছিলেন। পরবর্তীকালে গোপিনীদের গোপদের সঙ্গে বিবাহ হলেও গোপিনীদের বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। তাই গোপিনীরা দুঃখ করে বলতেন, ‘যাঁরা আমাদের কুমারী অবস্থায় আমাদের সঙ্গে গোপনে প্রণয়ে মিলিত হত, তাদের সঙ্গেই আমাদের বিবাহ হয়েছে (অর্থাৎ গোপদের সঙ্গে), কিন্তু তখনকার পরকীয়া প্রীতিরসে যে অনির্বচনীয় সুখ ও আনন্দের অনুভূতি সর্বদা হৃদয়ে জাগরুক ছিল, তা ধর্মানুগত দাম্পত্য জীবনে আর পাই না’ বলাবাহুল্য, পরকীয়া প্রেমের প্রতি নারী হৃদয়ের দুর্বার আকর্ষণ তাদের চেতনায় এক অপার্থিব আনন্দ সৃষ্টি করে। এখন প্রশ্ন হল, পরকীয়া প্রেম কাকে বলে? পরকীয়া অর্থাৎ তীব্র প্রেমের বশে যারা ইহকাল, পরকাল, শাস্ত্র, গুরুবাক্য, সমাজ সংসার গ্রাহ্য না করে পুরুষবিশেষে আসক্ত হয় এবং প্রেমিক পুরুষটির সঙ্গে কোনো কালেই পরিণয়-বন্ধনে আবদ্ধ হয় না—তারাই পরকীয়া প্রেমের নায়িকা। এই ধরনের নায়িকারা কুমারী, কন্যা বা বিবাহিতা স্ত্রী কিংবা বিধবা নারী সকলেই হতে পারেন। পরকীয়া নায়িকার শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হল এঁরা চিরকাল এক প্রেমিকেই আসক্ত থাকে এবং তাঁকে আশ্রয় করেই জীবন কাটাতে ভালোবাসেন। পরকীয়া প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হল মধুরভাব, যা শ্রেষ্ঠ রস হিসেবে বৈষ্ণবশাস্ত্রে পরিচিতি লাভ করেছে। তাই বৃন্দাবনের গোপিনীরা কৃষ্ণের জন্য পরকীয়া প্রেম অবলম্বন করে শ্রেষ্ঠতা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। গোপদের ধর্মপত্নী এই নারীদের মনে আপন গৃহ ও পতির প্রতি কোনও অনুরাগ ছিল না। কৃষ্ণের মধুর বংশীধ্বনি কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই এঁরা গৃহসুখ পরিহার করে কৃষ্ণ সকাশে ছুটে যেতেন। কৃষ্ণের অনন্ত প্রেমের গভীরে আপন সত্বাকে চিরতরে বিলুপ্ত করার জন্য এইসব নারীরা গুরুজন, আত্মীয়স্বজন, কুলশীল, বধূগৌরব, সমাজ, ধর্ম সব ত্যাগ করেছেন। তারপর লজ্জা, আত্মমর্যাদা, সম্ভ্রম তথা সর্বস্ব ত্যাগ করে চরম প্রেম উন্মাদনায় উপনীত হয়েছেন। এইসব আপনভোলা প্রেমিকারাই হলেন কৃষ্ণের মুখ্যতম প্রেয়সিবৃন্দ। পরকীয়া নায়িকাদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন শ্রীরাধা, ললিতা, বিশাখা, চিত্রা, চম্পকলতা, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দুলেখা, বঙ্গদেবী ও সুদেবী। পরকীয়া প্রেমের স্বভাব কুটিল গতি। কারণ এই প্রেমের নায়িকারা নায়কের বয়স, রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য ও মাধুর্যকে আশ্রয় করে মধুর রসে নিজেদের মনকে সর্বদা নানাভাবে মজিয়ে রাখতে ভালোবাসে।
কৃষ্ণপ্রিয়া শ্রীরাধা প্রেমে পাগলপারা হয়ে বলছেন, ”হে কৃষ্ণ! প্রাণনাথ, প্রাণপ্রিয়, হে আর্তিনাশন, হা ব্রজনাথ—অখিলসুন্দর, রসসাগর—ফিরে এসো, ফিরে এসো ত্বরা—একটিবার এসে দেখা দিয়ে যাও নাথ, প্রাণসখা মোর—তোমা বই যে কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না, কিছুই ভাবি না—তোমার অভাবে আজ আমরা সবাই শোকের, দুঃখের অতলগভীরে তলিয়ে যাচ্ছি, প্রাণ যে আর রহে না নাথ।”—গোপী-হৃদয়ের কী মর্মন্তুদ ব্যথা! কী নিষ্ঠুর দীর্ঘশ্বাস!! ব্রজনারীগণের হৃদয় কৃষ্ণকে ভেবে ভেবে যেন পাথর হয়ে গেছে। কৃষ্ণ তখন তাঁদেরই কাছে ছিল। যখন-তখন বাঁশি বাজিয়ে কাছে ডেকে নিত। তাঁরা দু’নয়ন ভরে দেখত সখার গায়ের রং। সে রং ছিল ঘন মেঘের মতো নীল। তপ্ত সোনার মতো উজ্জ্বল রেশমি কাপড়ে তাঁর লাবণ্যময় তনু ছিল আবৃত। আজানুলম্বিত বাহু। অপরূপ প্রেমপূর্ণ আঁখি। অনুপম কটাক্ষ। সহাস্যযুক্ত মনোহর মুখমণ্ডল। মাথায় শোভমান নীল কুন্তল। কর্ণযুগল অতি উজ্জ্বল মকর-কুন্তল আবৃত। অধর পাকা বিল্ব ফলের মতো রক্তিমাভ। পদ্মের মতো মনোহর চোখ দুটিতে ছিল অনন্ত প্রেমের নিয়ত হাতছানি। সীমা থেকে অসীমের দিকে নিয়ে যাওয়ার মাদকতা। এই পরম প্রেমরূপকে ভালোবেসে নিজেদেরকে হারিয়েছিল গোপীরা। অর্পণ করেছিল তাঁদের সর্বত্র। দেহ-মন-যৌবন। জাতি-কুল-শীল। লজ্জা-মান-ভয়। দয়িতার প্রতি তীব্র প্রেমাকর্ষণে তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন কৃষ্ণময়। কৃষ্ণপ্রাণাগতা। যাদের মন এমন কৃষ্ণপ্রেমে ছিল সদা পূর্ণ—সদা অনন্ত কৃষ্ণপ্রেমে প্রবহমান হৃদয়—সেই হৃদি আকর্ষণকারী রহস্যময় বংশীধারী সখা কৃষ্ণ কিনা একবাক্যে ব্রজধাম ছেড়ে চলে গেলেন! আমাদের কথা একবারও তাঁর মনে হল না, না—আর নয়—এ দেহ এবার ত্যাগ করব। সখী, এ তাপ, এ দুঃখ, এ বিরহ আর সহ্য হয় না। এ ব্যর্থ জীবন, যৌবন—এখনই ত্যাগ করব। আমি আর পারছি না।
ললিতা বললেন, ‘রাধে! দেহ ত্যাগ করলেই বুঝি তুই কৃষ্ণকে পাবি? তোর মনের ব্যথা বুঝি ঘুচবে?’
রাধিকা বললেন, ‘হ্যাঁ রে, আমি শুনেছি পৌর্ণমাসী দেবীর কাছে। তিনি বলেছেন—’মানুষ যে সংকল্প করে দেহ ত্যাগ করে মৃত্যুর পর সেখানেই তার গতি হয়।’ আহা! এটা বড়ো ভরসার কথা। আমি কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী, প্রাণনাথের প্রেমকটাক্ষে বন্দিনী—চিরবিরহিণী—আমি দয়িতার সঙ্গে মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এখনই দেহ ত্যাগ করব। তোরা সব শোন—মৃত্যুর পর আমার দেহতে যেটুকু মাটির অংশ থাকবে, সেটুকু মথুরার যে পথে প্রাণবন্ধু নিত্য যাতায়াত করেন, সে-ই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিবি। যেন তাঁর সুকোমল চরণযুগল সদা বক্ষে ধারণ করতে পারি।’ তারপর রাধা ভাবে বললেন—
—হ্যাঁ রে ললিতা, প্রাণনাথকে আমরা কি ভালোবাসার কথা বলেছিলাম মনে আছে?
ললিতা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন—’তুই যেমন, কত কথাই তো বলেছি, কোনটা আবার তোর এক্ষণে মনে পড়ল?’
রাধিকা বললেন—’সেই যে লো—রাস-পূর্ণিমার দিন যখন প্রাণনাথ হঠাৎ মাঝপথে চলে গেল—আমরা তাঁর বিরহে উন্মাদ হয়ে পড়েছিলাম। প্রথমে তাঁর বাঁশি শুনে বনে বনে ছুটে গিয়েছিলাম। সে ডাক ছিল কত মধুর, কত তীব্র, যেন ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো/আকুল করিল প্রাণ।’ সেই বাঁশি উতলা হয়ে পাগল করে তুলল আমাদের হৃদয়, মুহূর্তে ছুটে গেলাম তাঁর কাছে। দেখলাম তাঁর অপরূপ দেহমাধুর্য, সুললিত পদবিক্ষেপ, সুবিমল হাসি, সরস কথা, স্নেহভরা নিরীক্ষণ, মধুর স্বর এবং হৃদয়বিদারক আলিঙ্গন। কিন্তু আমরা তাঁর প্রেমের গরবে গরবিনী হওয়া মাত্রই তিনি রাসমঞ্চ থেকে কোথায় যে চলে গেলেন! তারপর তাঁকে শুধুই খুঁজেছি। বনে বনে বৃক্ষদের ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছি। মাধবীলতা, কুন্দ, অশোক ফুলকে আদর করে ডেকে তাঁর কথা শুধিয়েছি। পাথুরে রাস্তার কাছে গিয়ে হা-হুতাশ নিয়ে বিলাপ করে বলেছি—”আমাদের কর্কশ বক্ষের উপর হে প্রাণনাথ কৃষ্ণ, তোমার কোমল চরণকমল রাখলে পাছে তুমি ব্যথা অনুভব করো, এই ভয়ে আমরা ব্যাকুল হই—কত সন্তর্পণে ধীরে ধীরে বুকের মধ্যে তোমার সুকোমল মনোহর পদ্মফুলের মতো লোভনীয় চরণপদ্ম রাখি। আর সেই চরণ কিনা এখন বনে বনে একাকী কষ্ট করে বিচরণ করছে! একথা ভাবতে গেলেও আমাদের মাথা ঘুরে যাচ্ছে। হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। তবে কি আমাদের কঠিন বক্ষস্পর্শে প্রিয়তমের চরণতল কঠিন হয়ে গেছে?”
বিশাখা বললেন—’রাধে, এখন আর এসব কথা ভেবে কি লাভ বল? শ্রীকৃষ্ণে প্রেম করে যে অনন্ত সুখ পাওয়া যায়, যে কৃষ্ণপ্রেমেসুখে মন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়—সেই পূর্ণচন্দ্র প্রাণনাথ আমাদের ছেড়ে মথুরায় চলে গেলেন? বলতে বলতেই কৃষ্ণদর্শনে ব্যাকুল হয়ে বিশাখা কেঁদে উঠলেন। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারলেন না।’
রাধিকা বললেন—”ললিতা শোনো, মরার পর আমার দেহ-মাটির অংশ যেমন মথুরার পথে ছড়িয়ে দিবি, তেমনি দেহান্তে যে জল থাকবে তা শ্যামসুন্দর মথুরায় যে দীঘিতে স্নান করে তার জলে মিশিয়ে দিবি। আমার দেহের জলভাগ সেই জলের সাথে মিশে যাবে আর প্রাণপ্রিয় শ্যামসুন্দর তাতে স্নান করলে সেই জলভাগ তাঁর অধরে চুম্বন করবে। এতেও আমি মরে শান্তি পাব। তেমনি দেহের তেজাংশ মথুরেশের দর্পণে, বায়ু অংশ তালবৃন্তে এবং আকাশ অংশ যে গৃহে প্রাণসখা রাত্রিযাপন করে, সেই গৃহের আকাশের সাথে একাকার হয়ে যাক। এই আমার মরণের সংকল্প সার্থক হল। দেখছি—মরেই কৃষ্ণকে পাব, তাঁর অপ্রাকৃত সত্তার সাথে আমি একাত্মা হব। সুতরাং, কৃষ্ণের জন্য মরণেই দেখছি আমার সব সুখ, নয় কি?” রাধারানি ভাবে প্রলাপ বকছেন।
ক্ষণকাল নীরব থেকে রাধা আবার নিজ থেকে বলে উঠলেন— ”না, না, —বোধহয় মরণে সব সুখ হয় না। তিনি তো বলে গেছেন—আবার ফিরে আসবেন, কিন্তু এখনও এলেন না কেন?” শ্রীমতী অন্তরে রাশি রাশি কৃষ্ণপ্রেম অনুভব করে আবার অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
এই ব্যথা-বেদনা যেন সবার অজান্তে সহসা বৃন্দাবন থেকে মথুরায় পৌঁছে শ্রীকৃষ্ণের অন্তরে আঘাত করল। অন্তর্যামী ভগবান তিনি। প্রেম-ভালোবাসার জগতে যত অনুভূতি আছে, সবই তাঁর মনের গোচর। সুতরাং চঞ্চল হয়ে উঠল শ্রীকৃষ্ণের চেতনা। আজ তাঁর মন বড়োই বৃন্দাবনমুখী হয়েছে। অন্তরে সর্বদা ভাসছে গোপীদের মুখ, তাঁদের অপরূপ নম্র কটাক্ষ, প্রেমপূর্ণ বচন, আত্মসমর্পিত মুখভঙ্গিমা এবং অপার্থিব প্রেম-ব্যবহার। বড়োই বিরহ-বেদনায় অস্থির হয়ে উঠেছেন গোপীবল্লভ আজ। তাঁকে কী যেন পাগল করে তুলেছে। অন্তরের অজানা বেদনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অথচ কেবলই সেই বেদনার স্পন্দনগুলি অস্তিত্বকে পীড়া দিয়ে চলে। পাগলপারা গোপীনাথ জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ উদ্ধবকে শেষমেশ ডেকেই পাঠালেন। তাঁকেই ব্রজধামের খবর আনার জন্য পাঠাবেন। না—আর এক মুহূর্ত দেরি নয়।
এ বড়ো মায়াভরা সংসার। এখানে আমাদের ক্ষুদ্র-বৃহৎ মনগুলি যেখানে একটু প্রীতি ভালোবাসা বেশি পায়, আন্তরিকতা পায় সেখানেই নিজেকে অর্পণ করে বসে। বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাতে ভালোবাসে। মানুষের এই হল স্বভাব। সবসময় বেশি বেশি ভালোবাসা পেতে পছন্দ করে। যেখানে প্রীতি-ভালোবাসা তাকে সম্মান জানায়, মর্যাদা দেয়, উন্নত করে সেখানেই মানুষ পরিশেষে নিজেকে সমর্পণ করে। কম ভালোবাসা, ক্ষুদ্র অনুভূতির বন্ধনে নর-নারী দীর্ঘকাল থাকতে চায় না। বেশি ভালোবাসার পাত্রকেই আঁকড়ে ধরতে চায়। মানুষের এই ভালোবাসা অবশ্য কিছুটা স্বার্থপর। কারণ এখানে প্রীতির আদান-প্রদান ঘটে। কেউ যতখানি গভীরভাবে কাউকে ভালোবাসে, সে ততখানি ভালোবাসাই তার কাছ থেকে ফিরে পেতে চায়। সত্যি কি এটি খাঁটি ভালোবাসা? আসলে এটি তা নয়। ভালোবাসা অনন্ত। তা কেবল বিলিয়ে দিয়েই আনন্দ। প্রেমের কোনো হিসেব-নিকেশ নেই। প্রেম অনন্ত। প্রেম পরমানন্দময়। প্রেম সর্বসুখকর এক মাধুর্যময় রসানুভূতি। সমগ্র মহাজগৎ প্রেমেই উৎপত্তি, প্রেমেই স্থিতি এবং প্রেমেতেই লয় পায়। প্রেম সত্য, প্রেম সুন্দর, প্রেম মঙ্গলময়। প্রেমই মর্ত্যলোকে সর্বশ্রেষ্ঠ চাওয়া এবং পাওয়া।
তবে মানব-মানবীর হৃদয়ে প্রেমানুভূতি হল অনির্বচনীয় একটি আবেগ—যা পরস্পর দুটি হৃদয়কে স্থান-কাল-পাত্র ছাড়া করে। প্রেমের অভিব্যক্তিতে এক মন অপর মনে ধরা পড়ে। একের অনুভূতি অপর মনের গোচরে আসে। একের সুখে অপরে সুখী হয়। একের দুঃখে অপরে দুঃখী হয়। এক হৃদয়, এক মন এবং এক অনুভূতি হল প্রেমের প্রাণ। শ্রদ্ধা এবং সত্য হল প্রেমের গতিশক্তি। দুটি হৃদয়ের ভাববন্ধন যখন অজর, অমর ও শাশ্বত হয় তখনই প্রেমানুভূতি হয়। প্রকৃত প্রেম হল দুই সত্তার—একের অনুভূতি, যা ধ্বংস হওয়ার বহু কারণ থাকলেও বিনাশপ্রাপ্ত হয় না। প্রকৃত প্রেম মর্ত্যলোকের ভাগ্যবান নর-নারীর জীবনেই ঘটে। একদা গোপীরা যমুনাপুলিনে কৃষ্ণের চরণসেবা করতে করতে গোপীনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—”হে কৃষ্ণ! সংসারে এমন কিছু লোক আছে, যাঁদের ভালোবাসলে তাঁরাও ভালোবাসেন। কেউ কেউ আছেন এমন ভদ্রলোক, যাঁদের ভালো না বাসলেও তাঁরা কিন্তু সর্বদা ভালোবাসেন। আবার এমন অনেক রহস্যময় লোক আছেন, তাঁদের ভালোবাসলেও তাঁরা ভালোবাসেন না, আবার না ভালোবাসলেও ভালোবাসেন না। কেন এমন হয় বলতো? হে কৃষ্ণ! তুমি কোন শ্রেণির—আমরা অবলা নারী, এসব বুঝতে পারি না—তুমি এগুলি ভালো করে বুঝিয়ে দাও আমাদের।” গোপীরা ঠোঁট বেঁকিয়ে কৃষ্ণের দিকে চেয়ে রইল।
রসসাগর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি বিলক্ষণ জানেন তাঁকে প্রাণাপেক্ষা ভালোবেসে এই নারীগণ মনের গহনে দিবারাত্র কান্নাকাটি করেন। এঁরা যে এমনভাবে অসহায়ের মতো সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন—এসব তাঁদের দীর্ঘকালীন বিরহের তীব্র অভিমান থেকে জাত। প্রেমিকাদের এমন প্রশ্নে কৃষ্ণ মুচকি হেসে বললেন—”শোনো, যারা পরস্পর পরস্পরের রূপ-গুণ দর্শন করে পরস্পরকে ভজনা করে, ভালোবাসে—তারা কিন্তু নিজেরা নিজেদের সুখের জন্যই একে অপরকে ভালোবাসে। এসব স্বার্থপূর্ণ আচরণ। ওইরকম ভালোবাসায় সঠিক বন্ধুত্ব থাকে না। প্রেমের তীব্র ঐক্য অনুভূতি হৃদয়ে ধরা পড়ে না। সেজন্য মনে রেখো—আমি এই দলের লোক নই। কারণ আমার দয়া-ভালোবাসা বিশ্বের সকলের জন্য। ভক্ত-অভক্ত সবার আমার স্নেহের ভাগীদার। যারা ব্যাকুল হয়ে আমার ভজনা করে তারা আমার ভালোবাসা প্রগাঢ়ভাবে অনুভব করে। আবার দ্বিতীয় শ্রেণির লোকও আমায় বলতে পারো না। কারণ, কেউ আমায় ভালো বাসুক আর নাই বাসুক আমি জগতের সমস্ত জিনিসকে অতি প্রীতির চোখে দেখি। কেবল ভক্তের ভজন অনুসারে ফল প্রদান করে থাকি। এজন্য একটু পার্থক্য দেখা যায়। এই সংসারে দয়ালু ব্যক্তিকে কেউ আপন না ভাবলেও তারা কিন্তু সকলকে নিজ গুণে স্নেহ করেন। আমি দয়ালু ব্যক্তি ও পিতামাতারও ওপরে। কারণ আমি ত্রিগুণাতীত। অহেতুকভাবে প্রীতি করাই আমার স্বভাব। আবার আপ্তকাম আত্মারাম মুনিরা সদা অন্তর্মুখী থাকেন বলে জগতের ভালোমন্দে খুব একটা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষ খুব কমই এঁদের ভালোবাসার অনুভূতি নিজ হৃদয়ে লাভ করেন। প্রিয়তমারা শোনো—আমি কিন্তু এইসব শ্রেণিরও যোগী নই। আমি জগতের সকল জীবের কথা চিন্তা করি। তোমাদের কথাও সর্বদা ভাবি। হে অবলাগণ! তোমরা আমার জন্য লোকাচার, শাস্ত্রাচার, ধন, জন, কুল, আত্মীয়স্বজন সব ত্যাগ করে এসেছ। আমি তোমাদের ভালোবাসার ঋণ কখনও পরিশোধ করতে পারব না। আর তোমাদের ত্যাগ করে কোথাও যাইনি। কেবল আমার প্রতি তোমাদের অনুরাগ আরও বৃদ্ধির জন্য অদৃশ্য হয়েছিলাম এবং তোমাদের বিলাপ শুনে আনন্দ করছিলাম। তোমরা আমার সবচেয়ে কাছের প্রিয়জন, আমিও তোমাদের চিরকালের প্রিয়জন। কেন মিথ্যা দোষারোপ করছ? দয়িতার মুখে এমন প্রাণমাতানো কথা শুনে তখনকার মতো গোপীরা আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন এবং বিরহজনিত দুঃখ ভুলে গিয়েছিলেন।”
গোপীদের সঙ্গে এমন বিরহ-মিলনের কত কথাই না আজ কৃষ্ণের মনে পড়ছে। স্মৃতির স্পন্দনগুলি কেঁপে কেঁপে উঠছে আর উতলা হয়ে যাচ্ছেন মথুরেশ শ্রীকৃষ্ণ। তাই সত্বর উদ্ধবকে নিকটে ডাকলেন। উদ্ধব কৃষ্ণের খুল্লতাত দেবভাগের পুত্র। শৈশবকাল থেকেই উদ্ধব দারুণ কৃষ্ণভক্ত। কৃষ্ণপূজা, কৃষ্ণ-অর্চনা, কৃষ্ণনাম-গুণগানে উদ্ধবের জুড়ি মেলা ভার। কৃষ্ণকে না খাইয়ে তিনি কখনও মুখে অন্ন তুলতেন না। অতি অল্পকাল থেকেই তিনি কৃষ্ণের রূপলাবণ্য, লীলামাধুর্য নিয়ে ধ্যান করে দেহবোধ বিস্মৃত হয়ে যেতেন। তাঁর দেহের শিরায়-উপশিরায় কৃষ্ণপ্রেম প্রবাহিত। কৃষ্ণচেতনা, কৃষ্ণময়তায় উদ্ধব শ্রেষ্ঠ। এজন্য উদ্ধবকে দেখতেও লাগত অনেকটা শ্রীকৃষ্ণের মতো। কথায় বলে—যা ভাববে, তাই হয়ে যাবে। উদ্ধব সর্বদা কৃষ্ণকেই ভাবতেন তাই তাঁর চোখ-মুখ-কথাবার্তা-বাচনভঙ্গি অনেকটা কৃষ্ণের মতো হয়ে গিয়েছিল। এই উদ্ধব ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অতি বিশ্বস্ত শিষ্যসম সখা, মন্ত্রী। যাদবেরা সকলেই উদ্ধবকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখত। অতি বিচক্ষণ, শাস্ত্রজ্ঞ এবং উদার-হৃদয় ছিলেন উদ্ধব। কৃষ্ণভক্তিতে অতুলনীয় উদ্ধব নিজেকে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর দেহবর্ণ, অঙ্গের গঠন-প্রকৃতি, আচার-ব্যবহার কৃষ্ণ-সদৃশ ছিল। আর হবে নাই বা কেন? কারণ, শ্রীকৃষ্ণের যাবতীয় প্রসাদী দ্রব্য যেমন দেহের বসন-ভূষণ, মালা, চন্দন, ময়ূরপুচ্ছ, উত্তরীয়, অন্ন সবই সখা কর্তৃক প্রথমে গৃহীত হলে তবে উদ্ধব ধারণ করতেন। তাই শ্রীকৃষ্ণের প্রসাদী বস্ত্রে ও ভাবে সজ্জিত উদ্ধবকে সহসা কেউ দেখলে কৃষ্ণ বলে ভুল করত। এছাড়াও উদ্ধব ছিলেন একজন জ্ঞানী ভক্ত। প্রেমী ভক্তের অবস্থা তাঁর অজানা ছিল। হয়তো প্রচ্ছন্ন জ্ঞানের অহংকারও তাঁর মনে ছিল এবং জগতের সকলের চেয়ে তাঁর মনই সর্বদা শ্রীকৃষ্ণে বেশি নিবিষ্ট, এমন বোধ তাঁর চেতনায় সদা জাগরুক ছিল। এজন্য দর্পহারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকেই ব্রজধামে গোপীদের সংবাদ আনার জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ ভক্ত উদ্ধবই গোপীপ্রেমের মাহাত্ম্য ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। সব দিক থেকে বিবেচনা করেই শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে বললেন—”উদ্ধব, তুমি ব্রজে গমন করো। সেখানে গিয়ে ক’দিন থেকে আমার পিতামাতা ও গোপ-গোপিনীদের প্রীতিবিধান করো। গোপীরা আমার বিরহতাপে প্রাণান্তকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। তারা আমার জন্য সমস্ত কিছু ত্যাগ করেছে। আমিই তাদের প্রাণ। আমার সুখেই তাদের সুখ, আমার আনন্দেই তাদের আনন্দ। তাদের সব মনটা আমাতেই স্থিত। তারা আপন আপন দেহহারা, মনহারা, অনুভূতি-হারা। তাদের শুধু দেহটি পড়ে আছে ব্রজধামে। উদ্ধব—তুমি তাদের বলো—তারাও আমার প্রাণ, আমার মন, আমার অস্তিত্ব। আমি যে তাদের ত্যাগ করে মথুরায় আছি—এ শুধু থাকাই। এ রাজকর্তব্য। আমি কোনো কাজেই তেমন আনন্দ ও উৎসাহ পাই না। মন-প্রাণ সব পড়ে আছে বৃন্দাবনের পথে পথে। গোপীদের প্রেমভরা হৃদয়ের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। আহা! আমাকে একটু না দেখতে পেলে তারা যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যেত। ক্ষণকাল তাদের কাছে শতযুগ বলে মনে হত। আমার দর্শনের, আমার কটাক্ষের, আমার হাস্যের, আমার অধর চুম্বনের নিমিত্তের ব্যবধানটুকু তারা সহ্য করতে পারত না। এজন্য বিধাতাকেই তারা নিন্দা করে বসত। এমন মদগতপ্রাণা গোপনারীদের ছেড়ে এসে দীর্ঘকাল ধরে এই মথুরায় পড়ে আছি, কার আর এসব ভালো লাগে বলো?”
সখার মনোকষ্ট দেখে উদ্ধব বিহ্বল হয়ে গেলেন এবং বেদনা-ভরা কথাগুলি শুনতে শুনতে তাঁর দু’চোখ থেকে তপ্ত অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। এতে অপ্রস্তুত হয়ে উঠলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাই কথা থামিয়ে বললেন—”তাহলে ঘুরে এসো সখা ব্রজধাম। সকলকে সান্ত্বনা দিও।”
কৃষ্ণের নির্দেশ পেয়ে উদ্ধব তৈরি হলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজ হাতে উদ্ধবকে সাজিয়ে দিলেন। নিজ অঙ্গের আভরণ ও পুষ্পমালা উদ্ধবের গলায় পরিয়ে দিলেন। কপালে দিলেন চন্দনের তিলক। তারপর অনুপম স্নেহে করলেন আলিঙ্গন। মধুর স্পর্শে উদ্ধব আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু ক’দিনের কৃষ্ণসেবায় বঞ্চিত থাকবেন বলে অন্তরে চাপা দুঃখও তাঁর অনুভব হল। তবে অন্তর্যামী ভগবান উদ্ধবের মনের ব্যথা-কষ্ট অনুভব করে সহসা বলে উঠলেন—”উদ্ধব, ব্রজধাম গেলে ভাবছ তুমি আমার সঙ্গ-হারা হবে? না, উদ্ধব—আমি ব্রজধামেই অনন্তকাল আছি। কখনোই বৃন্দাবন ছাড়া আমি থাকি না। আর ব্রজধামে গেলে তোমার যে অনুভূতি ও জ্ঞান হবে— সেটাই হল আমাকে সত্যকারের পাওয়া। তাছাড়া, তুমি তো আমার সবচেয়ে প্রিয়জনদের কাছেই যাচ্ছ—তাদের জীবনের অতি প্রিয়তম প্রাণের কথাগুলি শুনতে এবং আমার প্রাণের কথা শোনাতে।” এই বাক্যের মাধ্যমে কৃষ্ণ যেন বললেন—হৃদি-বৃন্দাবনেই আমি চিরন্তন বাস করি। হৃদি-বৃন্দাবনেই প্রেমের শ্রীহরিরূপে যুগ-যুগান্তর ধরে লীলা করে চলেছি আমি। শুধু অন্তর্মুখী হয়ে সে সুললিত মধুর প্রেমধ্বনি শুনলেই হল।
সখার প্রেমপূর্ণ কথাগুলি শুনে উদ্ধব আর কিছু চিন্তা করার অবকাশ পেলেন না। তবে পায়ে হেঁটেই ব্রজধামে যাওয়া স্থির করলেন। কিন্তু কৃষ্ণের আদেশে রথেই যাত্রা করতে হল উদ্ধবকে। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ চলেছেন। নানারকম কথাবার্তা বুঝিয়ে বলছেন। তারপর এক জায়গায় এসে শ্রীকৃষ্ণ থেমে গেলেন। উদ্ধবের রথ এগিয়ে চলল ব্রজধামের দিকে।
কিছুক্ষণ হল সূর্য অস্ত গেছে। প্রকৃতিদেবী দিনমানের কর্মমুখরতা কাটিয়ে শান্ত ও স্নিগ্ধরূপ ধারণ করেছেন। এমন সময়ে ব্রজভূমিতে হঠাৎ প্রকট হলেন যোগমায়া। অঘটন-পটীয়সী মায়শক্তি। যোগমায়ার প্রভাবে বৃন্দাবনের রূপ ঠিক কৃষ্ণ থাকাকালীন যেমন ছিল তেমনই ধারণ করল। ব্রজে প্রবেশ করেই উদ্ধব বৃন্দাবনের সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলেন। অসংখ্য নাম না-জানা বৃক্ষে হরেক ফুল ফুটে রয়েছে। ফুলের গন্ধে চারিদিক ম-ম করছে। পুষ্প, ফলে সুশোভিত প্রকৃতির সর্বত্র। ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জন। গাছের শাখায় শাখায় কোকিলের কুহু-কুহু রবে কান পাতা দায়। অপরূপ দীঘিতে মন কেমন করা নানা রঙের পদ্মফুল। জলহংসীরা পরস্পর হেলেদুলে একে-অপরকে সোহাগ ও আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে। অসংখ্য পাখির কলতানে ব্রজভূমি যেন ইন্দ্রের অমরকাননের মতো হয়ে উঠেছে। একপাশ দিয়ে কুলু-কুলু স্বরে বয়ে চলেছে যমুনা। যেদিকেই দৃষ্টি পড়ছে উদ্ধবের সেদিকেই যেন অনন্তের হাতছানি। সমস্ত পরিবেশ স্বাস্থ্যকর, উজ্জ্বল ও প্রেমবিকাশের মন কেমন করা রোমাঞ্চে ভরপুর। সহসা রথ দাঁড় করিয়ে বিহ্বল উদ্ধব চমকে উঠলেন—ওই তো রাখাল বালকেরা রাস্তা দিয়ে গো-পালের পিছনে পিছনে ছুটে যাচ্ছে। আহা! রাখালদের কী আনন্দ—কেউ উল্লাসে নৃত্য করছে, কেউ শিঙ্গা বাজাচ্ছে, কেউ আবার আমার কানাইয়ের মতো মধুর সুর-লহরিতে পঞ্চমের তান ধরছে। গোরুগুলি কী অসাধারণ। গো-বৎসগুলির চোখ কতই না মায়াভরা! এসব চিন্তা করতে করতে ভাব হল উদ্ধবের। চোখ তাঁর ছলছল করে উঠল। অশ্রু যেন আর বেগ মানতে চাইছে না। বিহ্বল হল উদ্ধব। পাগল হল উদ্ধবের মন। রথ থেকে নেমে এলেন ব্রজের পথে। মাটিতে। ব্রজরেণু মাখার বাসনায় দিলেন ধুলাতে গড়াগড়ি। সর্বাঙ্গ তাঁর ধূলিধূসরিত হয়ে উঠল। ধূলিমাখা বসন-ভূষণে কৃতার্থ হলেন উদ্ধব। আজ তাঁর জীবন যেন সার্থক হল।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একটু আগেই পথের ধুলো উড়িয়ে গোরুর দল বাড়ি ফিরেছে, চারদিক এখনও ধুলোয় ঢেকে। তাই বোধহয়, উদ্ধবের রথের প্রতি কারও তেমন দৃষ্টিপাত হল না। চুপি চুপি অন্যের কাছে সংবাদ নিয়ে উদ্ধব সোজা নন্দরাজের গৃহে উপনীত হলেন। নন্দরাজ অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে আলিঙ্গন করলেন উদ্ধবকে। সামান্য কুশল জিজ্ঞাসার পরই অতিথি-সেবায় নন্দরাজ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। উদ্ধব এই অবকাশে কৃষ্ণের বাল্য গৃহটাকে দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠলেন—চতুর্দিকে অগোছালো, আঙ্গিনায় যেন কতদিন ঝাড়ু পড়েনি, মাকড়সার জাল এখানে সেখানে। সর্বত্র অমার্জিত, ধূলিধূসরিত—একি কৃষ্ণ বিরহের চাপা দীর্ঘশ্বাস—আহা! কী নিদারুণ করুণ পরিণতি!
এদিকে নন্দরাজ সামান্য পরমান্ন রন্ধন করে উদ্ধবকে সেবা করালেন। তারপর কৃষ্ণের কুশল জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। নন্দরাজা বিহ্বল হয়ে বলতে লাগলেন—”আচ্ছা, উদ্ধব! সেই নবজলধর গোপাল আমার, তার প্রিয় মা যশোধরার কথা কি একবারও স্মরণ করে? তার বিরহে কাতর শ্রীদাম-সুদাম বন্ধুদের কথা একবারও কি কৃষ্ণের মনে হয়? যে গোপগণ তাকে কোলে কোলে নিয়ে বন থেকে বনান্তরে ঘুরে বেড়াত তার চিত্ত কি এমন কঠিন হল যে তাদের কথা ভেবেও একবার দেখতে এল না? ধেনুগণকে যে ছেলে আদর করে খাওয়াত, তাদের স্নান করিয়ে মুখে তৃণগ্রাস দিলে গাভীগুলি অপলক নয়নে কানাইয়ের দিকে চেয়ে থাকত—সেই পলকহারা গাভীগুলি কৃষ্ণের জন্য যে দুঃখে নিত্য অশ্রুবিসর্জন করছে, এ-কথা কি তোমার সখার মনে একদম জাগেনি? যে গিরিরাজ গোবর্ধনকে কৃষ্ণ ছাতার মতো তুলে ধরেছিল সেই গিরিরাজ তার বিরহে কেমন পাগলপারা হয়ে গেছে—এ অনুভব করার শক্তি কি অন্তর্যামী কৃষ্ণ হারিয়ে ফেলেছে? তাছাড়া, যে গোপিনীরা তাকে ভালোবেসে সব ত্যাগ করে পথে দাঁড়াল—কেঁদে কেঁদে বিরহ-বেদনায়-শোকে এক-একটি পাথর হয়ে কুঞ্জবনে পড়ে রইল—তাদের কথা আমার প্রেমময় হরি কীভাবে একেবারে ভুলে গেল? উদ্ধব—তুমি বলো, বলো আমার গোপাল কেমন আছে? আমার গোপালের মধুর কণ্ঠ অম্লান আছে তো? আহা! কী সুন্দর তার মুখখানি, কী সুন্দর হাসিটি, কী সুন্দর নাসিকাটি, কী সুন্দর অপার্থিব প্রেমের দৃষ্টি—হ্যাঁ গো, আবার কবে ওই হৃদয়-জুড়ানো প্রাণের দুলালের সাথে মিলব, কবে তার চাঁদমুখখানি দেখব?”
উদ্ধব দেখলেন—নন্দরাজা কৃষ্ণকথা বলতে বলতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছেন। নয়নে অশ্রুর প্লাবন বইছে। আহা! বাৎসল্যভাবে নন্দরাজা যে কৃষ্ণপ্রেম বুকে বহন করে চলেছেন—এর তুলনা জগতে মেলা ভার। কিন্তু যশোদা গেলেন কোথায়?
এই কথা উদ্ধব ভাবতেই নন্দরাজা বলে উঠলেন—যশোদার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। মথুরা হতে কৃষ্ণসখা এসেছে, কৃষ্ণ তো আসেনি—এই কথা বলতে বলতেই আমার সামনেই সেই যে জ্ঞান হারাল, তখন থেকে মূর্চ্ছিতা হয়ে পাশের ঘরেই পড়ে আছে। তাই আমাকেই তোমার সব ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
যশোদার কৃষ্ণপ্রেম জগৎ বিখ্যাত। কৃষ্ণপ্রেমে বাৎসল্যরসের উদ্দীপনায় তাঁর স্তনযুগল থেকে এমনি এমনিই দুগ্ধধারা বইত। মুখে ‘হা কৃষ্ণ, প্রাণকৃষ্ণ, বাছা কৃষ্ণ’ বলতে বলতে নয়ন অশ্রুধারায় প্লাবিত হয়ে যেত। কাজেই এমন যিনি প্রেমময়ী মা যশোদা, তাঁর সাথে বার্তালাপ করা যে সহজ নয় তা মরমে মরমে উদ্ধব অনুভব করলেন। উদ্ধব আবার ভাবলেন—নন্দরাজা বা যশোদার এমন আবেগপ্রবণ হওয়ারই-বা কি আছে? কৃষ্ণ তো সামান্য মানুষ নন। তিনি স্বয়ং ভগবান। সর্বজীবের উৎস, নিয়ন্তা, নিখিল বিশ্বের স্বামী। সুতরাং, একটু কৃষ্ণের স্বরূপ নিয়ে নন্দরাজাকে উপদেশ দিলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। উদ্ধব বললেন—”হে গোপরাজ! শ্রীকৃষ্ণ আপনাদের পুত্র একথা একভাবে ঠিক কিন্তু অন্যভাবে আবার বেঠিক। কারণ বাৎসল্যভাবেই আপনাদের এমন দৃষ্টি হয়েছে। আসলে তিনি হলেন স্বয়ং নারায়ণ। সকলের আত্মার আত্মা। তিনি জগতের সকলের পিতা, মাতা, বন্ধু, সখা সবই। এই যা কিছু স্থাবর, জঙ্গম, ছোটো-বড়ো দৃশ্য দেখছেন সকলের অন্তরেই শ্রীকৃষ্ণ বসে আছেন। তিনি পরমাত্মা, সর্বব্যাপী—সচ্চিদানন্দ।”
দেখা গেল ভক্ত নন্দরাজা উদ্ধবের তত্বজ্ঞান কিছুই যেন বুঝতে পারলেন না। কোনো কথাই তাঁর কানে গেল না। ‘আমি কৃষ্ণের পিতা’— এই নিবিড় অনুভূতি থেকে নন্দরাজের মনকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্ধব ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ হলেন কারণ নন্দরাজা এখনও ‘কৃষ্ণ, কৃষ্ণ’ করে অঝোরে কেঁদে চলেছেন। আবার বলে চলেছেন একনাগাড়ে—”বল, বল, কবে আমার কৃষ্ণ আসবে? কবে তার এমন হাস্যময়, লাস্যময়, প্রীতিময়, প্রেমপূর্ণ বদনখানি দেখতে পাব?” ধৈর্যহারা নন্দরাজকে উদ্ধব আর কিই-বা বলবেন। তাই সত্বর যাতে আসে সেই চেষ্টা করব—এমনভাবে সান্ত্বনা দিতে দিতে আশার সঞ্চার করতে লাগলেন। গভীর রাত্রি হল। দু’জনে কৃষ্ণকথায় বেহুঁশ হয়ে পড়েছেন। খেয়াল নেই। রাত কেটে গেছে। ভোরে পাখ-পাখালি ডাকতেই উদ্ধবের সম্বিত ফিরে এল।
গতকাল মথুরা থেকে আসার সময় যোগমায়া ব্রজভূমিতে যে নিজ আনন্দের মূর্তি উদ্ধবকে প্রত্যক্ষ করিয়েছিলেন আজ তিনিই দেখাবেন বিরহ-বেদনার প্রতিচ্ছবি। গোপীদের মহাভাবময় বিরহ অবস্থা। ভগবানের জন্য ভক্তের চিরন্তন ব্যাকুলতার শেষ পরিণতি।
উদ্ধব কৃষ্ণপ্রেমী। তাঁর মনের ইচ্ছা সখা কৃষ্ণকে চিন্তা করে করে ব্রজের গোপ-গোপনীরা, রাখাল বালকেরা সব কেমন আছে—তাই নিজ চক্ষে দেখবেন, হৃদয় দিয়ে অনুভব করবেন। এজন্য আজ সাত-সকালেই নন্দরাজাকে প্রণাম করে একটু বেড়াতে বেরিয়েছেন। স্নান-আহ্নিকও করবেন এবং একটু ব্রজের শোভাও দেখবেন।
উদ্ধব চলেছেন। মন ভারাক্রান্ত। সারা রাত ঘুম নেই। কিছুটা পথ আসতে আসতেই শুনেছেন গোপীদের দধি মন্থনের নানা শব্দ। গোপীদের কেউ কেউ গো-দহন করতে করতেই প্রাণগোবিন্দের রূপ-গুণ-সৌন্দর্য-মাধুর্য নিয়ে গান গাইছিল। কেউ-বা আবার ‘কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ’ নাম করেই চলেছে। বোধ হচ্ছে প্রভাতে মালা জপছে। দেখতে দেখতে গ্রামের গোপ-গোপিনীর ছেলেরা উদ্ধবকে ঘিরে ধরে নিজেদের মধ্যে বলতে লাগল—’ইনি কে? রূপে-গুণে একদম আমাদের শ্যামসুন্দরের মতো। বয়সটি ঠিক যেন নবকিশোর। চোখ দুটি অপরূপ। প্রেমপূর্ণ। অধরে মিষ্টি হাসি। গায়ের বসন-ভূষণ-সুগন্ধ সবই দেখছি আমাদের শ্যামের মতো।” ছেলেরা এসব বলাবলি করলেও সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে উদ্ধব গোপনারীদের দিকে চেয়ে চেয়ে কুঞ্জবনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তখন সূর্যদেব আকাশে উঁকি দিচ্ছেন। সারা ব্রজভূমি যেন কেমন বিরহকাতর। গতকালের উৎসবমুখর ব্রজধাম কোথায় যেন সরে গেছে। প্রকৃতির এমন নিদারুণ পরিবর্তন কী করে যে হল, তা জ্ঞানী উদ্ধবের মাথায় আসছে না। উদ্ধব দেখলেন—ব্রজভূমির নারীরা যেন সব অপার্থিব। চোখে-মুখে করুণ ভাব। হতাশার দীর্ঘশ্বাসে তাদের দেহে যেন লাবণ্যহীনতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্রজরমণীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছুটা যেন শিথিল হয়ে পড়েছে। কেশপাশ মলিন, অযত্নে আলুথালু। পরিহিত বস্ত্রখণ্ডে মলিনতাই বা কত। এঁরা কি নিত্য-স্নানাদি করেন না? প্রসাধন-প্রিয় ব্রজনারীরা কি সেসব ভুলে গেছেন? সব চক্ষুগুলিই যেন কেমন উদ্ভ্রান্ত। আমার মধ্যে তাঁরা যেন কাউকে খুঁজছেন। আঁখি সব চঞ্চল, পিপাসার্ত। আকাশে-বাতাসে চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন করুণ সুরে বেজে চলেছে। কৃষ্ণহারা এমন ছন্নছাড়া গোপিনীদের আরও ভালো করে দেখতে কুঞ্জবনে হাজির হলেন উদ্ধব।
উদ্ধবের সাজপোশাক দেখে এবং গায়ের সুঘ্রাণ পেয়েই গোপিনীরা তাঁকে কৃষ্ণের লোক বলে বুঝতে পারলেন। তাই একজন গোপী এগিয়ে এসে বললেন—”আচ্ছা, যদুপতি সখা—তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করি—এই বহু দামি বেশভূষা পরে তুমি নিজেই দুঃখিনীদের কাছে এসেছ, না—তোমার প্রভু নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়ে বনবাসী কাঙালিনীদের কাছে তার ঐশ্বর্য দেখাবার জন্য তোমায় পাঠিয়ে দিয়েছে? দেখ—শ্রীদাম-সুবল মথুরা থেকে ফিরে এসে তোমার নাম-পরিচয় আমাদের কাছে বলেছে। তোমার রূপ-গুণ-বেশভূষা অনেকটা কৃষ্ণের মতো। তুমি নাকি খুবই কৃষ্ণপ্রিয়। কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ সখা। এক রসের রসিক। আচ্ছা, বলতো রাজপুত্তুর সখা—কোন প্রেম চিরকাল থাকে, আর কোন প্রেম নষ্ট হয়ে যায়? আমরা ভাবি যে প্রেমে পাওয়ার বাসনা থাকে তা বিনাশ হয়ে যায়, আর যে প্রেমে কেবল দেওয়ার ইচ্ছাই বর্তমান থাকে তা চিরকাল থাকে। অহেতুকী প্রীতিই অবিনাশী। চিরটা কাল থাকে। আমরা সবদিক থেকে ভেবে-চিন্তে দেখেছি—তোমার প্রভুর সাথে আমাদের প্রীতি ছিল অহেতুকী—এমন নিঃষ্পাপ অহেতুকী প্রেমের সম্বন্ধ কীভাবে তোমার প্রভুর অন্তর থেকে একেবারে মুছে গেল? কোন যাদুবলে এমন অভাগিনীদের তোমার প্রভু মন থেকে একেবারে সরিয়ে আনন্দে আছে?”
এই কথা বলে এক রসিক গোপী উদ্ধবকে নানারকম প্রীতির কথা বলতে লাগলেন। কোন প্রীতি সহজে নষ্ট হয়ে যায়—সেসব কথা। যেমন ভ্রমর আর ফুটন্ত ফুলের ভালোবাসা। ভ্রমর ফুলকে ভালোবেসে কত গুনগুন করে, মাঝেমধ্যে চুম্বন করে, কিন্তু যেই মধু খাওয়া শেষ হল অমনি হাওয়া। এখানে ফুলের সাহচর্য লাভে ভ্রমরের মনে মধু খাওয়ার বাসনা ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। সংসারেও এরূপ স্বার্থপ্রণোদিত কামনা-বাসনাভরা ভালোবাসা সর্বত্র দেখা যায়। তাছাড়া, এই জগতে লক্ষ্য করলেই উপলব্ধি হয় যে, এখানে গণিকারা নির্ধন পুরুষকে, প্রজারা অক্ষম রাজাকে, শিষ্যরা অধ্যয়ন শেষে আচার্যকে, পুরোহিতরা দক্ষিণা পেলে যজমানকে, অতিথিরা ভোজন শেষে গৃহস্থকে, পশুরা বন দগ্ধ হলে অরণ্যকে, গাছের ফল শেষ হলে পাখিরা গাছকে ত্যাগ করে চলে যায়। সুতরাং, স্বার্থ ফুরোলেই প্রীতি যে বিনাশ পায়, তা বোঝাই যায়। কিন্তু আমরা তো কৃষ্ণকে কোনো বিশেষ স্বার্থপূরণের অভিলাষ নিয়ে ভালোবাসিনি। তবে কী কারণে কৃষ্ণ আমাদের ত্যাগ করে গেল। এমন অকৃত্রিম প্রেমে বিচ্ছেদ এল কোথা থেকে? আর আমরাও-বা সেই অকৃত্রিম প্রেমের তীব্র বিরহানলে অহরহ পুড়ছি কেন? আমাদের নিঃস্বার্থ মহান প্রেমবন্ধনে এমন কলঙ্ক লাগলে যে, জগতের কেউই আর প্রাণনাথকে কোনোদিন ভালোবাসবে না—এই ভেবেই আমরা শঙ্কিত হচ্ছি বারবার—বল উদ্ধব, এমন কেন হল?
এইসব কথা বলতে বলতেই উদ্ধবের সামনেই গোপিনীরা কৃষ্ণের মধুর রূপ ও লীলা বর্ণন করতে করতে গান গাইতে লাগল। সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ভাব-তন্ময়তা বৃদ্ধি পেল। তীব্র ক্রন্দনের সাথে সাথেই গোপীরা কুঞ্জবনের ভেতরে প্রবেশ করল। উদ্ধব তাদের পিছু পিছু গেলেন। কিন্তু সহসা তিনি অষ্টসখী পরিবৃতা এক নারীকে দেখে চমকে উঠলেন। ইনিই যে মহাভাবময়ী রাধারানি তা উদ্ধবের জানতে আর বাকি রইল না। উদ্ধব বুঝলেন—এঁরই নাম সখার কাছে অহরহ শুনেছি। ঘুমের মধ্যেও সখা যাঁর নাম-গুণগান করেন, স্বপ্ন দেখেন, ইনিই তিনি—প্রেমময়ী রাধা। যতই দেখছেন, ততই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন। কৃষ্ণপ্রেয়সী গোপীদের কৃষ্ণপ্রেমের গভীরতা, দয়িতার প্রতি তাঁদের আবেগ-উৎকণ্ঠা-অভিমান এবং লজ্জাশূন্য হয়ে সর্বস্ব সমপর্ণের ভাব দেখে উদ্ধবের মন যুগপৎ অভিভূত এবং বিস্মিত। তাঁর প্রাণের সখাকে জীবনের একমাত্র প্রেমাস্পদ ভেবে কারও দেহে-মনে এতসব ভাব হতে পারে তা উদ্ধবের কল্পনায় ছিল না। জ্ঞানী উদ্ধব বৃন্দাবনের স্বর্গীয় প্রেমের গোপীভাবকে শত শত প্রণাম করে আপ্লুত হয়ে গেলেন।
বৃন্দাবনের ভাব দিব্য প্রেমভাব। এই ভাবের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবুক হলেন শ্রীমতি রাধারানি। তাঁর হৃদি-বৃন্দাবনের একমাত্র প্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ। রাধার অন্যান্য সখীগণ এবং ব্রজধামের সকল নারীদেরই অন্তর জগতের ভালোবাসার জিনিস হল শ্যামসুন্দর। হেথায় সকল নারীর অন্তরেই শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন। এই প্রেম-জোয়ারে ভাসতে ভাসতে গোপীদের ভাব-মহাভাব হয়। বৈষ্ণব রসিক শাস্ত্রকারেরা প্রেমকে আখের রসের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁরা বলেন, আখের রস গাঢ় হলে খাওয়ার গুড় হয়। গুড়কে গাঢ় করলে হয় চিনি। চিনি গাঢ় হয়ে হয় মিছরি। মিছরি থেকে হয় সিতামিছরি প্রভৃতি। তেমনি প্রেমবস্তু ক্রমশ গাঢ়তাপ্রাপ্ত হয়ে হয় স্নেহ। তারপর ক্রমে ক্রমে মান-প্রণয়-রাগ-অনুরাগ-ভাব-মহাভাব প্রভৃতি অনুভবে পরিণত হয়। শ্রীমতি রাধারানির মহাভাব হয়েছিল। মহাভাব হল প্রেমের অষ্টম ধাপ। যাঁর মহাভাব হয় তিনি ভাগ্যবতী। তাই কৃষ্ণপ্রেমে মহাভাবময়ী রাধা সর্বশ্রেষ্ঠা নায়িকা। প্রেমের এমন মহামহিমাময় ভাবতরঙ্গ দেখে উদ্ধব নিজেকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কারণ প্রেমে যে এতদূর ভাব-তন্ময়তা হতে পারে তা তাঁর অভিজ্ঞতায় ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হল—প্রেম কী? বৈষ্ণব পণ্ডিতদের মতে, ধ্বংস হওয়ার অনেক কারণ থাকলেও যে ভাববন্ধন কোনোভাবেই নষ্ট হয় না তাই হল প্রেম। প্রেমে দুই সত্তার মধ্যে গভীর বোঝাপড়া থাকে এবং সংস্কারগত মিল থাকে। তাই প্রেম অবিনাশী। তবে অনন্ত প্রেমের উচ্ছ্বাস কেবল শুদ্ধসত্ব নরনারী তথা ভক্ত ও ভগবানের মধ্যেই দেখা যায়।
সাধারণত কৃষ্ণের সাথে তাঁর পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতির সম্পর্কজনিত ভালোবাসাকে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়, যেমন—
(১) শান্তভাব—সনক, সনন্দন ঋষিরা শান্তভাবে কৃষ্ণকে ভালোবেসে ছিল। পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এই ভালোবাসা ছিল পার্থিব মমতা-বর্জিত।
(২) দাস্যভাবে—ভক্ত উদ্ধব, বিদুর, কালীয়নাগ, সাত্যকি প্রমুখ ভক্তগণ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রীতিমিশ্রিত দাস্যভাবে সম্পর্ক তৈরি করেছিল।
(৩) সখ্যভাব—শ্রীদাম, সুদাম, সুবল, অর্জুন, দ্রৌপদী প্রমুখেরা কৃষ্ণকে সখা বলে সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েছিলেন এবং প্রীতিভরে অবলোকন করেছিলেন।
(৪) বাৎসল্যভাব—নন্দরাজা, যশোদা, বসুদেব, দেবকী, রোহিনী শ্রীকৃষ্ণকে সন্তান জ্ঞানে দয়া ও করুণরসের প্রীতিবন্ধনে আপন করেছিলেন।
(৫) মধুরভাব—রাধা, বিশাখা, ললিতা, শৈব্যা, ভদ্রা, চিত্রা, ইন্দুলেখা প্রমুখ গোপিনীরা কান্তাভাবে মধুররসে শ্রীকৃষ্ণকে ভজনা করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণে গভীর প্রেমপূর্ণ গোপিনীদের মধুরভাবের প্রেমরসকে তিনটি রূপে বর্ণনা করা হয়। যেমন—
(ক) সাধারণী প্রেম—যে প্রেমে নায়িকা নায়ককে ভালোবেসে আপন সুখ চরিতার্থ করতে চায় তাহল সাধারণী প্রেম। যেমন—কুঞ্জা, নাগরিকার প্রমুখ গোপিনীগণের কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসা।
(খ) সমঞ্জসা প্রেম—যে প্রেমে নায়ক ও নায়িকার মেলামেশার ফলে পরস্পর সুখ ও আনন্দলাভের বাসনা বর্তমান থাকে, তাই হল সমঞ্জসা প্রেম। রুক্মিনী, সত্যভামা প্রভৃতি শ্রীকৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নীগণের মধ্যে এই ধরনের প্রেম বর্তমান ছিল। এঁরা ছিলেন কৃষ্ণের স্বকীয়া পিরিতের নায়িকা।
(গ) সমর্থা প্রেম—যে প্রেমে দয়িতার সুখের জন্য সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে নায়িকারা চিত্তজ্বালা উপশম করে তাই হল সমর্থা প্রেম। এখানে ‘প্রেমিকের’ সুখ ও আনন্দ ইচ্ছাই একমাত্র বড়ো ব্যাপার, আত্মতৃপ্তির কোনো স্থান নেই। রাধারানি, ললিতা, চন্দ্রাবলী প্রমুখ পরকীয়া নায়িকারাই ছিল সমর্থা প্রেমের অধিকারিণী। সমর্থা প্রেমই শ্রেষ্ঠ এবং সতত বর্ধনশীল।
বৈষ্ণব শাস্ত্রানুযায়ী—
(১) সমর্থা প্রেম—সমর্থা প্রেম কেবল মহাভাব পর্যায়ে যেতে পারে এবং সমর্থা প্রেম থেকে স্নেহ-মান-প্রণয়-রাগ-অনুরাগ-ভাব হয়ে মহৎ মহাভাবের ক্রমোন্নতি ঘটে।
(২) স্নেহ—প্রেমের গাঢ়তর বন্ধনে স্নেহ উৎপন্ন হয়। স্নেহে সর্বদা প্রেমিকের কথা মনে হয়। তখন সর্বদা নায়িকার মনে নায়কের রূপ, লাবণ্য, হাসি, প্রেমপূর্ণ কটাক্ষ দেখতে ইচ্ছা করে। স্নেহের উদয়ের ফলে রাধা ও অন্যান্য গোপীরা সর্বদা কৃষ্ণকথা শোনার জন্য ব্যাকুল হতেন। কিন্তু কিছুতেই কান কৃষ্ণকথা শুনে তৃপ্তি হত না। নাসিকা সর্বদা কৃষ্ণগন্ধ গ্রহণ করতে ছটপট করত। কৃষ্ণনাম জপ করে রসনা কখনোই ক্লান্তি অনুভব করত না। তাই কবিরা গেয়েছেন—”না জানি কতেক মধু/শ্যাম নামে আছে গো/বদন ছাড়িতে নাহি পারে।”
(৩) মান—নায়িকাদের স্নেহ যখন নায়কের আদর-যত্নে আরও গাঢ়তাপ্রাপ্ত হয়, তখনই নায়িকার অন্তঃকরণে মানের বিকাশ ঘটে। মানে প্রেমিকার মনে অনুপম মাধুর্যরসের জন্ম হয়। মানাবস্থায় নায়িকার মনের বক্র প্রেমের অন্তরালে নায়ককে ভ্রূকুটি, ক্রোধ ও তিরস্কার প্রকাশ করে স্বাধীন আচরণ করে আনন্দ পায়।
(৪) প্রণয়—মান গাঢ়তাপ্রাপ্ত হয়ে নায়িকা যখন নায়কের সঙ্গে অভিন্ন মননশীল হয়ে ওঠে তখনই জন্ম হয় প্রণয়ের। প্রণয়ে পরস্পর দুটি মন, দুটি বুদ্ধি, দুটি প্রাণ একাত্মা লাভ করে। প্রণয়াবেগে শ্রীকৃষ্ণ রাধারানির চরণে মস্তক রাখলে রাধার সংকোচ তো হয়নি বরং মানগর্বে গরবিনি হয়েছিলেন রাইকিশোরী।
(৫) রাগ—প্রণয়ের চরম উৎকর্ষ ঘটলে চিত্তে ভালোবাসাজনিত অত্যন্ত বেদনাবোধকেও নায়িকার যখন সুখ বলে অনুভূত হয় তখনই রাগের লক্ষণ ফুটে ওঠে। নায়িকার অন্তরে রাগের জন্ম হলে লোকনিন্দা, গঞ্জনা কিংবা কোনো ভয়ই আর প্রেমিকার মনের কাছে ঘেঁষতে পারে না। তখন কেবলই তার মনে হয়, ”তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার/গলায় পরিতে সুখ।” রাগে নায়িকার চিত্ত সর্বদা ভালোবাসার পাত্রের কথাই চিন্তা করে।
(৬) অনুরাগ—রাগের চরমপরিণতিতে নায়িকার মনে যখন নিত্য নব নব ভাবে, নানারূপে নায়ককে আস্বাদনের সাধ জাগে এবং তেমন সামর্থ্যেরও উদয় হয় তখনই জন্ম হয় অনুরাগের। অনুরাগে রাধা ও কৃষ্ণ পরস্পর পরস্পরের কাছে বশীভূত হয়। এ-সময় প্রিয়সঙ্গহীনতা একদম সহ্য হয় না। মনে হয় ‘যুগায়িতং নিমিষেণ’—এক নিমেষের সঙ্গছাড়াকে এক যুগ বলে মনে অনুভূত হয়।
(৭) ভাব—অনুরাগ শেষসীমায় উপনীত হলে নায়িকা নিজের মনের আবেগ যখন আর সামলাতে পারে না তখনই ভাবের উদয় হয়। ভাবে তাই হাসে-কাঁদে-নাচে-গায়। ভাবে স্বতন্ত্রতা বোধ থাকে না। ভাবে নায়িকার চিত্তবৃত্তি নায়কের সাথে একাত্মা প্রাপ্ত হয় এবং ক্ষণকাল মন সঙ্গচ্যুত হলেই চরম বিরহ দেখা দেয়। সেজন্য ভাবে অশ্রু, কম্প, পুলক, স্বেদ, বিবর্ণতা, স্বরভঙ্গ, স্তম্ভ ও প্রলয় (মূর্ছা) এরূপ অষ্টসাত্বিক বিকার দেখা যায়। রাধারানি, মহাপ্রভু, শ্রীরামকৃষ্ণ, মা আনন্দময়ী প্রমুখের ভাব তথা মহাভাব হয়েছিল।
(৮) মহাভাব—ভাবের অষ্ট সাত্বিক বিকারগুলি একই সঙ্গে যখন ভক্তহৃদয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে তখনই হয় মহাভাব। মহাভাবে নায়ক-নায়িকাতে তথা ভক্ত ও ভগবানের চিত্তদ্বয় এমনভাবে একীভূত হয়ে যায় যে, কল্পনাতেও ভেদ-ভাবনা সম্ভব হয় না। রাধা ও কৃষ্ণের অনির্বচনীয় সুন্দর যুগলমূর্তি হল মহাভাবের শাশ্বত প্রকাশ। স্বর্গীয় প্রেমের চিরন্তন রূপ। এখানে পরস্পরের প্রেমে দুটি হৃদয়, দুটি মন, দুটি প্রাণ, দুটি সত্তা মিলেমিশে একাত্মা হয়ে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। অপরূপ সুন্দরী রাধার আঁখিযুগল চিরনবীন কিশোর কৃষ্ণের অনন্ত প্রেমে চিরকালের জন্য বাঁধা পড়েছে। এই রূপে বিচ্ছেদ নেই, বিরহ নেই, মিলনও নেই—আছে শুধু এক ও অদ্বৈত প্রেমানুভূতি। এই প্রেম চিরসুন্দর, চিরমাধুর্যময়, চিরআনন্দময়। এই জগতের মধ্যে প্রেমই একমাত্র চালিকাশক্তি, স্বর্গীয় দিব্যরূপ। জীবের হৃদি-বৃন্দাবনে এমন প্রেম সাগরের শাশ্বত প্রেমিক হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি সর্বদা প্রেম হয়ে আমাদের সকলের মধ্যেই বিরাজ করছেন। শুধু তাঁকে আপনবোধে অনুভব করা চাই।
শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে ব্রজে পাঠিয়েছেন ব্রজগোপীদের ভগবৎ বিরহজনিত ভাব দেখার জন্য। উদ্ধব জ্ঞানী। তাঁর মনে গর্ব যে, তিনিই শ্রীকৃষ্ণকে বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু গোপীদের ভাব-মহাভাব অবস্থার দেহগুলি দেখার পর উদ্ধবের নিজের লজ্জা লাগছে। নিজেকে খুবই ক্ষুদ্র বলে মনে হচ্ছে আর ভাবছেন—কত গভীর প্রেম, কত তীব্র মিলন-বিরহের অনুভূতি থাকলেই এমনটা হওয়া সম্ভবপর। ভক্ত উদ্ধব যতই চিন্তা করছেন, ততই বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছেন। কৃষ্ণপ্রেমের পুলকে তাঁরও চক্ষু বুজে আসছে। তিনি অবশ হয়ে ব্রজলীলা মাধুর্য আরও আরও আস্বাদন করতে যত্নবান হবেন স্থির করলেন। আর তাই তক্ষুণি সংকল্প করলেন—আমি আজীবন অন্তরে জাগ্রত রাখব যে, এই উদ্ধব জন্ম আমার শেষ হলে যেন মধুর বৃন্দাবনের পথের পাশে লতা-গুল্ম হয়ে জন্মাতে পারি। কেন উদ্ধবের এই সংকল্প? না—গোপীপ্রেমের অতি মহত্তম স্বভাব দেখে উদ্ধবের ব্রজগোপীদের চরণে শত শত প্রণাম জানাতে—তাঁদের চরণতলে প্রণত হতে অন্তরে তীব্র সাধ জেগেছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ-সখা উদ্ধবকে যে গোপীরা পদধূলি দেবেন না তা একেবারে নিশ্চিত। তাই ইহজন্মে এই সাধ মেটাবার উপায়ান্তর না দেখেই উদ্ধব পরজন্মে লতাগুল্ম হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ উদ্ধব ভাবলেন, যদি বৃন্দাবনের পথের পাশে লতাগুল্ম হয়ে জন্মাই তাহলে ব্রজগোপীরা যখন শ্যামসুন্দরের মধুর বংশীধ্বনি শুনে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে প্রাণসখার দিকে ছুটে যাবে তখন পথিপার্শ্বে আমি উদ্ধব যে লতাগুল্ম হয়ে পড়ে আছি তা জানতে না পেরে তাঁদের পবিত্র চরণ আমার দেহ স্পর্শ করেই ছুটতে থাকবে। আর সেই অবকাশে তাঁদের মহা দুর্লভ পদধূলি পেয়ে জীবন আমার পরম পবিত্র ও ভক্তিময় হয়ে যাবে।
প্রায় দশ মাস ব্রজে থেকে মথুরায় ফিরে গিয়েছিলেন উদ্ধব। যাওয়ার সময় ব্রজের নন্দবাবা ও গোপিনীরা শ্রীকৃষ্ণের জন্য পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন বনফুল, ময়ূরপুচ্ছ, বিভিন্ন রকমের ফলমূল, দুগ্ধ ও ঘৃতাদির নানা দ্রব্য, বস্ত্রখণ্ড প্রভৃতি। তবে কৃষ্ণপ্রেমে-শোকে ভারাক্রান্ত প্রেমময়ী রাধা উদ্ধবকে দিয়েছিলেন একটি পত্র, তাতে লেখা ছিল ব্রজবুলিতে এরকম ভাবনা—”হে ব্রজচাঁদ, তুমি বৃন্দাবন অন্ধকার করে এখন মথুরার আকাশে উদিত হয়েছ, কিন্তু গায়ে দাগ লাগবে বলে তোমার ব্রজনারীদের পরিত্যাগ করো না। আকাশে চাঁদ যেমন তার গায়ের কলঙ্ককে স্বীয় বুকে নিয়েই উদিত হয় এবং গগনপথে বিচরণ করে, তাতে চাঁদকে কেউ দোষারোপ করে না—তেমনি আমরাও তোমার অঙ্কাশ্রিত, তোমার স্নিগ্ধ বুকে আমাদের রাখলে কোনো কলঙ্ক হবে না জেনো।” রাধার পত্রটি দেখে উদ্ধব বলে উঠলেন, ‘তবে কি একবার আপনাদের প্রাণবল্লভকে বৃন্দাবনে সত্বর আসার জন্য অনুরোধ করব?’
শ্রীরাধা এই কথা শুনে গম্ভীরভাবে বললেন—”না, তার দরকার নেই। উনি সবদিকে নিশ্চিত হয়ে যদি আসতে পারেন, তাহলেই যেন আসেন। আমরা শুধু ওঁকে পেলেই সুখী হই না—ওঁর মুখের হাসি, আনন্দাপ্লুত উজ্জ্বল নয়ন না দেখলে দুঃখে মরে যাই। ওঁর আনন্দময় জীবন ও ভারমুক্ত স্নিগ্ধ হাসি দেখলেই আমরা সুখী হই।” ক্ষণকাল নিঃস্তব্ধ। তারপর সকলের কাছে বিদায় নিয়ে অদ্ভুত ব্রজপ্রেম-রহস্যের কথা ভাবতে ভাবতে উদ্ধব চললেন মথুরার পথে।
কিন্তু আমার প্রাণের কথা হল—আমাদের মনগুলিও কীভাবে গোপী বা উদ্ধবের মতো অহরহ কৃষ্ণপ্রেমে বিগলিত হয়ে উঠবে? কেমন করে আমাদের পাষাণ হৃদয়ে প্রেমগঙ্গা প্রবাহিত হবে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই একথা বলেছেন অন্যভাবে—”ধ্যায়তো বিষয়ান পুংসঃ সঙ্গস্তেষু-পূজায়তে/সঙ্গাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহবিজায়তে।” অর্থাৎ বিষয় চিন্তা করতে করতে মানুষের মনে যেমন বিষয়ের প্রতি আসক্তি জন্মায় ও বিষয়ের স্মৃতি প্রগাঢ় হয় তেমনি ভগবানের (রাম, কৃষ্ণ বা রামকৃষ্ণের) চিন্তা করতে করতে তাঁদের রূপ-গুণ লীলা মাধুর্যের প্রতি মনে আসক্তি জন্মায়। ভগবানে আসক্তি থেকে তাঁকে অন্তরে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা জন্মায়। ভগবানে অনুরাগজনিত কারণে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা জন্মালে বিষয়ে বৈরাগ্যের উদয় হয়। বিষয়ে যত বৈরাগ্য হয় ততই ভগবানে আসক্তি ও প্রেম আসে। ভগবানকে নিকটে বোধ হয়। ঈশ্বরের নৈকট্যবোধ তথা প্রেমের ফলে বিষয়-স্মৃতি মন থেকে চলে যায় এবং মনের সমস্ত সাংসারিক সংকল্প-বিকল্প বন্ধ হয়ে হৃদয়ে ভগবানের তথা কৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ ও শরণাগতির ভাব আসে। এ-সময়ে জীবের অহংকার ঘুচে যায় এবং ভগবৎ প্রেমে তনু, মন, প্রাণ সবই সমর্পিত হয়ে পরমানন্দ সাগরে মানুষ বিহার করে। শ্রীমদভাগবতে ভগবানে ভক্তিলাভ করার উপায় হিসেবে আরও বলা হয়েছে—
”শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম্।
অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্।”
অর্থাৎ বিষ্ণু (বা কৃষ্ণের) নাম-রূপ-গুণ-মাহাত্ম্য শ্রবণ, নামকীর্তন, কৃষ্ণলীলার স্মরণ-মনন, মনে মনে তাঁর সেবা, তাঁর পূজা, স্তোত্রপাঠ, দাস্যভাবে কর্ম করে তাঁতে সমর্পণ, সখ্যভাবে তাঁতে বিশ্বাস এবং তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ—এই নয় লক্ষণযুক্ত যে ভক্তি—সেই নবধা ভক্তি ক্রমাগত অভ্যাস করলেই ভগবানে প্রেমভক্তি লাভ করা অনায়াসেই সম্ভবপর হয়। ভাগ্যবান পরীক্ষিৎ হরিকথা শ্রবণ করে, শুকদেব হরিকথা কীর্তন করে, প্রল্হাদ অনবরত হরি স্মরণ করে, বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীদেবী হরিসেবা করে, মহারাজ পৃথু হরির অর্চনা করে, গজেন্দ্র মহারাজ হরিকে আর্তিভাবে ডেকে, অক্রুর হরিবন্দনা করে, অর্জুন হরিকে সখ্যসেবা করে, মহারাজ বলি হরিকে সর্বস্ব নিবেদন করে, শ্রীদাম-সুদাম-উদ্ধব হরিকে সর্বতোভাবে আপন বন্ধু ভেবে ভালোবেসে, নন্দরাজ-যশোদা বাৎসল্য প্রেমে এবং রাধারানি প্রমুখ সখীরা হরিকে কান্তাভাবে মধুর প্রেমে লাভ করেছিলেন। আমাদেরও প্রত্যেকের অন্তরে আছে প্রেম ও সেবাভাব—সেই প্রেমের রাজ্যে—হৃদি-বৃন্দাবনের সেই প্রেমপূজায় প্রেমিক শ্রীকৃষ্ণকে বসিয়ে আন্তরিকভাবে ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ নাম করলেই শতধারে তাঁর প্রেম-করুণা আমাদের প্রতি প্রবাহিত হবে। তাই তাঁর কাছে আমাদের প্রার্থনা—
”রাখ, মিনতি রাখ হে গিরিধারীলাল
মম আঁখির আগে রহ শ্যামগোপাল।।
তব চরণতলে মোর এই তনু মন—
প্রণামী ফুলের মতো লহ নিবেদন,
জনমে জনমে আমি প্রেমের কাঙাল।।”