বিস্কুটের গুঁড়ার মতো বিকেলে

বিস্কুটের গুঁড়ার মতো বিকেলে

ছপ ছপ শব্দ তুলে আমরা ভেজা ঘাসের ওপর পা ফেলে হাঁটতে থাকি।

এ বছর বসন্ত এসেছে টানা দুদিনের বৃষ্টি পেরিয়ে। রবিবারে রোদ উঠলেও বাতাস মিহি।

আরেকটু সামনে মাটি নরম। জুতার ছাপ বসে যাচ্ছে গাঢ় করে। সামনের পথটুকু হঠাৎ দুটা বাঁক নিলেই আমি পেছনে তাকিয়ে বললাম, কোনদিকে যাওয়া যায়?

আমার সঙ্গী খুব সাবধানে পা ফেলে আগাতে আগাতে আন্দাজে বলল, ডানে!

আমরা দুজন এরপর ডানদিকে আগাতে থাকলাম। এদিকে লেকের পানি নেই। পাতা মরে যাওয়া বিশাল বিশাল নগ্ন গাছ। যাদের গা বিকেলের আলোতে নীল আকাশ পেছনে ফেলে চকচক করছে। আরেকটু দূরে বেশ কিছু বাড়ি। এরপর কাঠের ব্রিজ, নুড়িপথ। সেখানে ভেজা ভাব একটু কম।

ব্রিজ পেরিয়ে আবার বেঁকে যায় পথ। বাঁদিকে দৌড়ে যেতে থাকে দুটা ছেলে। কাদা-পানির মধ্যে হালকা শব্দ তুলে যায় ওরা। মাথার ওপর অল্প কিছু পোকা ওড়ে।

এবার কোনদিক? প্রশ্ন করি আমি।

আবার ডানে। ক্রু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলে ও।

এ পথে একদিকে নুড়িপাথর ফেলে দেওয়া ছোট্ট ঝরনা, অন্যদিকে বাঁকানো সরু পথ। নতুন পাতা না গজিয়ে ওঠা ডালপালার স্তূপ। এক-দুইটা পাখি এ ডালে ও ডালে বসে যায়। ওদের পালক কমলা রঙের। আমি সম্প্রতি শুনে ফেলা একটা গান গুনগুনিয়ে উঠি। আমার সঙ্গী বিরক্ত হয়ে সূর্যের দিকে তাকায়। তারপর গলা উঁচিয়ে বলে, কোথায় যাচ্ছি?

-জানি না আসলে। এভাবে হেঁটে হেঁটে যেতে থাকলে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই যাওয়া যায়? একটু হেসে উত্তর দিই।

-ভাল্লাগে না এসব। এত্ত অ্যামবিগিউটি! চলে যাব আমি…

এ কথা বলেও আমার পিছু নেয় ও। আমি মনে মনে হাসি। আমরা আরও মিনিট বিশেক হাঁটি। সোজা পথ। কাঠের ব্রিজ। লেকের পানি। কিছু গাছ। কেউ কেউ কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কেউ বা অবেলায় ছিপ ফেলেছে পানিতে। ঘুরেফিরে একই দৃশ্য। হাঁটতে হাঁটতে লেকের একদম শেষপ্রান্তে চলে আসি। এরপর হয় আবার আগের পথ ধরে ফিরে যাওয়া যায় কিংবা সামনে এগিয়ে, একটু ঘুরে পার্কিং লটের কাছে যাওয়া যায়।

কী করব?

ভাবতে গিয়েই চোখ পড়ে আকাশে। একি! মহাযুদ্ধের লড়াকু সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে কেউ, তার আরেকটু দূরে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া মারমেইড কিংবা ডলফিনের লেজ, কাঁচা হাতে আঁকা বিড়ালমুখ আর সাদা রঙের কিছু বিচ্ছিন্ন হাওয়াই মিঠাই পুরো আকাশ জুড়ে ছেয়ে আছে।

আমার সঙ্গী পেছন থেকে হঠাৎ বলে ওঠে, এই জায়গাটা ভালোই।

আমি উত্তর দিই না। ওদিকে ডলফিনের লেজ এখন রাজহাঁসে পরিণত হচ্ছে অল্প অল্প করে।

আমার সঙ্গী আবার বলে, কয়টা ট্রেইল এখানে? এখানেই আসো রোজ?

কোনোরকমে উত্তর দিই, হয়তো…

কোথা থেকে যেন বাতাস উড়ে আসে। গাছের ডালে মৃদু শনশন শব্দ। মহাযুদ্ধের লড়াকু সৈনিকের একটা হাত হঠাৎ একটু একটু করে ঝাপসা হতে থাকে, যেন মস্তবড় গোলার টুকরা লেগেছে মাথায়। বিস্কুটের গুঁড়ার মতো তাকে অল্প অল্প করে পড়ে যেতে দেখি। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেদ করে, সারি বেঁধে উড়ে যেতে থাকে কিছু পাখি। আমার সঙ্গী পকেট থেকে মোবাইল বের করে নানাভাবে পাখিদের ছবি তুলে যায়। আকাশের সেই বিড়ালমুখ শেষ বিকেলের আলোতে দুপাশে ছড়াতে ছড়াতে চওড়া হাসি দিতে থাকে। আর আমি সুনসান লেকের ধারে প্রতিধ্বনি তুলে চেঁচিয়ে উঠি,

-আমি–যা-দেখি… তুমি–তা –দেখো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *