চক্র

চক্র

চাকা আবিষ্কারের আগে পৃথিবী কেমন ছিল তা আমি জানতে পারিনি। তবে আমার পৃথিবী পুরোপুরি বদলে গেল এক মঙ্গলবার সকালে, স্কুলে যাওয়ার আগে পাঁচ বছরের অয়ন গম্ভীরভাবে একটি চাকা আমাকে দেখিয়ে বলল,

বাবা ওটা ধরবে না। আমি ক্লাস করে বাসায় এসে, এই চাকা দিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস বানাব।

অয়নের মাথার চুল ঠিক করতে করতে আমি বললাম,

বাবা বলছ কেন? মাকে কখনো বাবা ডাকতে নেই সোনা। মা বলে ডাকো।

অয়ন আমার কথার উত্তর দিল না, আগের মতোই গম্ভীর মুখে স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসে উঠে গেল। দুঃসংবাদটা এলো আরও ঘণ্টা তিনেক পর। কিছু আততায়ী জোর করে স্কুল আঙ্গিনায় ঢুকে একনাগাড়ে গুলি করে চলেছিল। হত্যা করেছিল অজস্র শিশু ও তাদের শিক্ষকদের। টেলিভিশনে খবরটা দেখামাত্রই আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গেলাম স্কুলে। আতংকে আমার নিশ্বাস থেমে যাচ্ছে, বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি। স্কুলের সামনে গিয়ে দেখি চারপাশে পুলিশ ও সাংবাদিকদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। স্কুলের ভেতরে কাউকেই যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ভেতরের সব দরজা বন্ধ। অয়নের কথা একে ওকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারলাম না। এদিকে বাতাসে কান্নার শব্দ ও মানুষের কোলাহল তীব্র হচ্ছে।

কেউ ভেতরে যাবেন না, আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দিন প্লিজ। এক পুলিশ অফিসার একটু পরপর চিৎকার করে বলে যাচ্ছে একই কথা।

আমি অস্থিরভাবে খুঁজতে থাকি অয়নকে। দূরে, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের মাঝে ও নেই। স্কুলের ভেতরেও থাকার কথা না। আর কোথায় থাকতে পারে ও-এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি, অয়নের স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল রুমাল দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছতে মুছতে পার্কিং লটের দিকে আগাচ্ছে। মরিয়া হয়ে তার দিকে ছুটে যাই। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,

স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি অয়নের মা। অয়ন আমার ছেলে। ক্লাস টু সেকশন বি।

আমার কথা শুনেই দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। তারপর রুমাল দিয়ে আরেক দফা ঘাম মুছলেন।

অয়নকে কি দেখেছেন? ও ঠিক আছে? পুলিশ কাউকেই ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বলি আমি।

ভাইস প্রিন্সিপাল কী যেন বলতে গিয়েও একটু থেমে গেলেন। তার গোঁফ জোড়া ফুলে উঠল। কফ জড়ানো স্বরে উনি বললেন,

অয়নকে তো ওর মা এসে নিয়ে গিয়েছে বাসায়। উনি পাশের এলাকাতেই ছিলেন। গোলাগুলি শেষ হওয়ার পর প্রথম ব্যাচে যে শিশুদের নিরাপদে স্কুল

সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে অয়নও ছিল।

এসব কী বলছেন আপনি? রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠলাম আমি। আমি অয়নের মা। আমি…

ভাইস প্রিন্সিপাল কফ জড়ানো স্বরে জোর করে কোমলতা আনার চেষ্টা করতে করতে বলেন,

আপনি বাড়ি যান। এখানে বেশিক্ষণ থাকা আপনার জন্য ঠিক না।

ভাইস প্রিন্সিপাল কথাটা শেষ করেই হনহন করে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানেই। এরপর কী মনে করে ছুটতে শুরু করলাম নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। গেটের কাছে যাওয়ার সাথে সাথেই সিকিউরিটি গার্ড গফুর আমার সামনে দাঁড়িয়ে খাতা কলম বাড়িয়ে দিল।

আসোলামু আয়ালাইকুম। কার কাছে যাবেন আর আপনার নাম ঠিকানা এইখানে লিখুন।

গফুর, আমি, আমি… আমার ফ্ল্যাটে যাব। সেভেন-এ।

নিজের নাম শুনে গফুর একটু চমকে তাকায়, তারপর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে বলে, ইন্টারকমে কল করতেছি, আপনি ততক্ষণে নিজের নাম, ঠিকানা লিখেন।

গফুরের এমন আচরণ ও স্পর্ধা দেখে রাগে ক্রোধে কোনো কথাই বলতে পারি না আমি বেশ কিছুক্ষণ। এরপর গা কাঁপতে থাকে আমার। ঝড়ের মতো চিন্তা কাজ করে মাথায়। আমাকে নিজের ফ্ল্যাটে যেতে হবে, অয়নকে কেউ যদি সত্যি স্কুল থেকে নিয়ে নেয় তা হলে সেকি বাসায় দিয়ে গেছে নাকি জানতে হবে। ও বাসার ঠিকানা জানে। স্কুল থেকে বাড়ি আসার পথ চেনে। একাও যদি রওনা দেয় তাও সবার আগে ওর বাসাতেই আসার কথা। অয়ন জানে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি আমি সিঁড়ির পাশে মানিপ্ল্যান্ট গাছের নিচে রাখি। ও নিশ্চয় বাড়ি ফিরেছে।

হ্যালো ম্যাডাম। উনি তো বলতেছেন এটা উনার ফ্ল্যাট। সেভেন-এ। হ্যাঁ হ্যাঁ এইটাই বলতেছেন। না, আগে কোনোদিন দেখি নাই উনাকে। ইন্টারকমে কথা বলতে বলতে গফুর কেমন করে যেন তাকায় আমার দিকে। আমার ইচ্ছে করে ভারী কিছু দিয়ে গফুরের মাথায় আঘাত করে ওর খুলি টুকরো টুকরো করে ফেলি। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে ঠান্ডা কণ্ঠে বলি,

গফুর তুমি কার সাথে কথা বললে?

আপনি নাম ঠিকানা লিখলেও আপনাকে ভেতরে যাইতে দেওয়া যাইব না।

তুমি কার সাথে ফোনে কথা বললে, বলো।

ফ্ল্যাট সেভেন-এ এর ম্যাডামের সাথে। উনি বলছেন, আজকে কোনো মানুষই যেন উনার ফ্ল্যাটে না আসে।

এটা আমার ফ্ল্যাট, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? প্রতিদিন আমাকে তুমি দেখোনি এই বিল্ডিং থেকে বের হয়ে অফিসে যেতে, আমার ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে? অয়নকে চিনো না তুমি? বলো?

একটানা আমার কথা শুনে গফুর বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি দেখতে পাই ওর চোখের মণি বড় হচ্ছে, যেন ঠেলে বের হয়ে আসবে। এবার আমি কণ্ঠস্বর নরম করে ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলি,

আমাকে যেতে দাও। অয়ন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

গফুর কিছু মুহূর্ত নীরব থাকে। তারপর দ্বিধা জড়ানো ভাব নিয়ে বলে, *অনুমতি ছাড়া যাইতে তো দিতে পারব না। আপনি চাইলে ইন্টারকমে কথা বলে আগে অনুমতি নিয়া নেন। ম্যাডাম বললেই যেতে দেব।

এটুকু কথা বলেই সে আবার কল করে। আমি ফোন হাতে নিয়ে বলি, হ্যালো।

ওপাশ থেকে অপরিচিত এক কণ্ঠ কর্কশভাবে বলে ওঠে, দেখুন, আপনাকে মনে হয় না আমি চিনি। এটা কিন্তু আপনার ফ্ল্যাট না। আপনি ভুল করছেন। হয়তো নিচের তলায় আপনার ফ্ল্যাট। শুধু শুধু এখানে কল করে বিরক্ত করবেন না প্লিজ। এটুকু বলেই লাইন কেটে দেয় সে।

হঠাৎ করে পুরো পৃথিবী টলে ওঠে আমার। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকি। তারপর গফুরের দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো মিনতি করি।

ফ্ল্যাট নং সিক্স-এতে লাইন দিতে পারবে একটু?

প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে সাথে সাথেই ইন্টারকমে সিক্স-এ তে কল করে সে। আমি ভেতরে ভেতরে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে যাই। ফোনের রিসিভারটা কানে ঠেকিয়ে রাখি শক্ত করে, যেন এভাবে চেপে ধরে রাখলেই পৌঁছে যেতে পারব নিজের বাসায়।

হ্যালো। আরেকটি অচেনা কণ্ঠ কথা বলে ওঠে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে।

এটা কি সিক্স-এ?

হ্যাঁ। কে বলছেন আপনি? ওপাশ থেকে বেশ ভদ্র স্বরে জিজ্ঞেস করে একজন।

কাঁপাকাপা স্বরে নিজের নাম বলি আমি। তারপর জানাই এই ফ্ল্যাটটি আমার।

কোথাও নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে আপনার। ছোট শিশুদের কোনো কিছু করা থেকে বিরত রাখার মতো নরম কণ্ঠে বলে ওঠেন তিনি। আমি এই ফ্ল্যাটে আছি গত নয় বছর ধরে। এটা আমার বাসা। আপনার নাম পর্যন্ত কোনোদিন শুনিনি।

কেন যেন একটা চিৎকার করতে গিয়েও পারি না। মনে হয় কেউ আমার গলা চেপে ধরে আছে শক্ত করে। হালকাভাবে রিসিভারটা রেখে দিই। হতাশা, ক্রোধ, অসহায়ত্ব আর নাম না জানা কোটি কোটি অনুভূতি এসে আমার ওপর আছড়ে পড়তে শুরু করে। আমি এখন কোথায় যাব?

গফুর এতক্ষণ কিছুটা দূর থেকে আমাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। এবার একটু গলা খাঁকরে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল,

যদি ভুল না কইরে থাকি, আপনে এই বিল্ডিংয়ে না, উল্টাপাশের বিল্ডিংটায় থাকেন। ওইখানের সেভেন-এ ফ্ল্যাটে খোঁজ নিয়া দেখেন। আমি বুঝতে পারতেছি আপনি বিপদে পড়ছেন কিন্তু এইটা আপনার ঠিকানা না।

এইটা আমার ঠিকানা না… কথাটা বিড়বিড় করতে করতে আমি উঠে দাঁড়াই। বেরিয়ে আসি গেটের বাইরে। এলোপাতাড়ি হাঁটতে থাকি রাস্তার অন্যপাশে যাওয়ার জন্য। আচমকা অয়নের মুখ ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে। সাথে সাথেই যেন কিছুটা শক্তি ফিরে পাই। নিজের শরীরকে টানতে টানতে বড় রাস্তার মাঝে নিয়ে যাই। ট্র্যাফিক সিগন্যালের লালবাতি জ্বলে ওঠার আগেই রাস্তা পার হই দ্রুত। হঠাৎ করেই মনে হয় আসলেই আমি ভুল বিল্ডিংয়ে চলে গিয়েছিলাম। হয়তো ওদের কথাই ঠিক। সামনের বিল্ডিংয়েই আমার ফ্ল্যাট। জোরে জোরে পা চালাতে থাকি। এই বাড়িটায় কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই। আরও ভালো হলো। আমাকে থামানোর কেউ নেই। লিফটের কাছে গিয়ে দেখি লিফট তিনতলায় আটকে আছে আর নিচে নামছে না। কে জানে হয়তো ইলেক্ট্রিসিটি নেই কিংবা লিফট নষ্ট। কী আসে যায়? পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত ওপরে উঠতে থাকি। নিজের বাসায় আমাকে ফিরতেই হবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঘামতে থাকি দরদর করে। এই তত আর কিছুদূর। তিন-চার-পাঁচ… প্রায় চলেই এসেছি। অল্প একটু থেমে ঘনঘন নিশ্বাস নিই। তারপর আবার দ্রুত আগাতে থাকি নিজ গন্তব্যে। আশ্চর্যের বিষয়! ফ্ল্যাট নং সেভেন এর জায়গায় শেষ হয়ে গেছে বিল্ডিংটা। আর কোনো বাসা নেই। শুধু একটা বিশাল ছাদ। পানির ট্যাঙ্ক। বিচ্ছিন্ন কিছু ফুল গাছ। তা হলে তো এটা আমার বাসা নয়। আমি কি তা হলে আগেই সঠিক ঠিকানায় ছিলাম? ঠিক তখনই আমার কানের ভেতরে যেন কার ছুটে চলার শব্দ শুনতে পাই। যেন কেউ ডাকছে। আমাকে। দূর থেকে, বহু দূর থেকে। পায়ে পায়ে সেই ডাকের পিছু নিয়ে ছাদের রেলিংয়ের কাছে চলে আসি।

রাস্তার অন্যপাশে আমার চেনা বিল্ডিংটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নির্ভয়ে।। আর সেভেনথ ফ্লোরের ফ্ল্যাটটার বারান্দায় একটি ছোট্ট ছেলে গাড়ির চাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার মায়ের হাত ধরে। কিন্তু আমি ওদের কাউকেই চিনি না। এমন সময় কে যেন বাতাসের মতো আমার কানে কানে এসে বলে যায়, এইটাও কিন্তু আপনার ঠিকানা না, আসলে আপনি পৃথিবীতেই নেই…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *