বিষের ঝাড়

বিষের ঝাড় 

মান্ধাতার আমলের পুরনো নোনাধরা দোতলা বাড়িটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে এমনভাবে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ার মুহূর্তে হঠাৎ ঠেকো দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। বাড়িটা পুবমুখো। সেদিকের সদর দরজার মাথার ঠিক উপর দিয়ে একটা অশ্বথের শিকড় বাড়িটার একটা অংশ দীর্ঘদেহ অজগরের মতো বেড় দিয়ে সেই পশ্চিমে ডালপালা পত্রপল্লবে ঝাঁকড়া হয়ে ঝুঁকে পড়েছে। বাদবাকি একটা অংশ ভেঙে-চুরে একটি মস্ত স্তূপ হয়ে উঠেছে আধলা ইটের। বাড়িটার চারপাশ ঘিরে আছে আগাছা জঙ্গলে; আর বড় বড় আম জামের ছায়ায় কেমন একটা ভুতুড়ে অন্ধকার থমথমিয়ে আছে। পুবদিকে ভাঙাচোরা ফাটল-ধরা রকটা ছাগল-বিষ্ঠায় ভরা। সদর দরজাটার সামনেই একগাদা গোবর। আগাছার মাঝখান দিয়ে একটি সরু পথ দরজা থেকে পাড়ার গলিপথটায় গিয়ে মিশেছে। 

সন্ধ্যা প্রায় ঘনায়। বাড়িটারও রূপ বদলায়। ঝুপসিঝাড়ের কোল থেকে অন্ধকার গলে গলে পড়ে বাড়িটাকে ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে। 

মনে হয় বাড়িটাতে মানুষ নেই। অথচ পোড়ো বাড়ির মতো বাতাস এখানে হাহাকার তোলে না। নৈঃশব্দ্য নিরেট নয়, যেন ছটফট করছে। সেই ছটফটানি টের পাওয়া যায় আচমকা শিশুকণ্ঠের দুর্বোধ্য স্বরে কিংবা যেন হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় ভেসে-আসা কিশোরী গলার গানের সুরে। আর সে সুরের কোনও বৈচিত্র্য নেই। একই সুর, একই কথা। ধনধান্যে পুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…। 

সদর দরজার চৌকাঠ আছে, পাল্লা নেই। সেই দরজা দিয়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে এল হারাধন চক্রবর্তী, এ বাড়ির বাসিন্দা। মালিক নয়, ভাড়াটিয়া। মালিকেরা চার শরিক, চার মুলুকে থাকে। মাঝে মাঝে তারা এসে তম্বি করে হারাধনের উপর এবং যাবার সময় শুনিয়ে যায়, দাঁড়াও মামলাটা হোক, তখন তোমাকে দেখব। কিন্তু মামলা আর তাদের হয় না, সেজন্য কোনও গতিও হয় না ভাগের মায়ের। সেই পড়ে-থাকা ভাগের মায়ের কোল আঁকড়ে পড়ে আছে হারাধন। 

দুই পুরুষের ভাড়াটে তারা। এক পুরুষ ভাড়াটা কড়ায় গণ্ডায় শোধ করে গেছে, কারণ তখন চার শরিকের একটা বাপ ছিল। শরিক বলে কথা নয়, হারাধন ভাড়া দিতে পারে না। সে বলে, মুরোদ বড় মান, তার ভেঁড়া দুটো কান। মামলা হয়ে যদি কোনও বিলিব্যবস্থা হয়ে যায়, তবু ওই চার শরিকের বাড়িটা ভাগাভাগি করে গড়তে হবে তো! সে হবেও না, আর এ বাড়ি না ধসলে আমারও ছেরাদ্দ হবে না।’ 

সুতরাং এ সব বৈষয়িক বিষয়ে হারাধন মাথা ঘামায় না। 

দরজার মুখে পিছল মাটির উপর গোবর দলাটা দেখেই খিঁচিয়ে ওঠার মতো তার এক পাটি অসমান দাঁত বেরিয়ে পড়ল, হিংস্র জানোয়ারের যেমন সামান্য বিরক্তিতে ভয়ংকর দাঁতগুলো এক বার ঝকমকিয়ে ওঠে। তা ছাড়া হারাধনের সিংহরাশি কি না জানা নেই, চেহারার মধ্যে পশুপতির ছাপ আছে খানিকটা। তবে উপবাসী এবং সেইজন্যে ক্ষ্যাপাটে পশুপতি। দাঁত খিঁচিয়েই আছে। শক্ত মোটা হাড়ের চামড়া লম্বাও নেহাত কম নয়, কিন্তু মাংস নেই। তার মাঠের মতো পাথুরে কপালটার ঠিক মাঝখান থেকে সূক্ষ্মাগ্র তীরের মতো উঠে সারা মাথায় সিংহের পাকানো কেশরের মতো চুল ছড়িয়ে পড়েছে। এককালে এ চুল কালো ছিল। এখন হয়েছে খানিকটা মেটে আর জায়গায় জায়গায় পাক ধরে সাদা কালোর মাঝামাঝি ধোঁয়া ধূসর বর্ণ। নাকটা মন্দ ছিল না কিন্তু নীচের দিকে একেবারে থ্যাবড়া হয়ে গেছে। চোখ দুটো সামান্য গোলাকৃতি, তাতে গাছের শিকড়ের মতো লাল ছাড়ের ছড়াছড়িতে কিছুটা হিংস্র হয়ে উঠেছে। অনবরত কুঞ্চনের ফলে ঠোঁটের ডানপাশটা কুঁচকে বেঁকেই থাকে। শরীরটা সব সময়েই ঝুঁকে থাকে সামনের দিকে। পরিশ্রম হলে তো কথাই নেই। তখন এই চার শরিকের বাড়িটার। মতো হারাধনকেও মনে হয় মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়ে কোনও রকমে চলেছে। আর এই হারাধন, যার। আঠারো বিশে হয়তো শরীর ছিল সটান, আজ তার জঙঘা থেকে ঠ্যাং দুটো নেমেছে যেন পাকা বাঁশের বাঁকা গোড়া। গোড়ালিতে গোড়ালি ঠেকলে দু-পায়ের মাঝখানে একটা বিরাট ফাঁক থেকে যায়। বয়স মাত্র চল্লিশের কোঠা ধরব ধরব করছে। এই হল হারাধন চক্রবর্তী। সব নয়, চেহারায়। কাজের মধ্যে গল্প, সর্বদর্শন, এবং ডাক্তারি। হ্যাঁ, ডাক্তারিটাই প্রধান। ডাক্তারিও আজব, সৃষ্টিছাড়া। তার কোনও ডিসপেনসারি নেই, তার ঘরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না একটা ওষুধের শিশি বা কোনও সরঞ্জাম। সে তো অনেক দূরের কথা, ঘরের মানুষের রোগে এক ফোঁটা ওষুধ কেউ হারাধনকে হাতে করে আনতে দেখেনি। কোনও রোগীকে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়নি আজ অবধি ওই চার শরিকের ফাটা ভাঙা রকের উপর, হারাধন ডাক্তারের অপেক্ষায়। তার জীবনে সে কারও নাড়ি দেখেনি, দেখেনি জিভ চোখ বা পেট টিপে। তবু হারাধন ডাক্তার। পাড়ার ফক্কড় ছোঁড়াগুলি বলে, ডবল এম বি। পাড়ার এম বি ডাক্তার বলেন, ব্যাটা আমেরিকা-ঘোরা ভি-ডি স্পেশালিস্ট। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার নন্দদুলাল বলেন, মরা হ্যাঁনিম্যানের ভূত হারাধন। ওর জুড়ি নেই। বলেই অবশ্য তাড়াতাড়ি জরি দিয়ে বোনা হ্যাঁনিম্যানের কোটের কলারের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেন হাত জোড় করে। অর্থাৎ হ্যাঁনিম্যানের আত্মা যেন ক্ষুণ্ণ না হন। 

আর হারাধন মাঝে মাঝে চৌমাথার জনারণ্যের ভিড়ে কিংবা দু ধারে কারখানার উঁচু পাঁচিলে আড়াল করা শহরের পাকা সড়কে আচমকা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রায় দেড় ফুট ঠ্যাং ফাঁক করে। ঠোঁট কুঁচকে মনে মনে বলে, এঃ সত্যি সত্যি ডাক্তার হয়ে গেছি!….

তারপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউসের চিমনি চারটের দিকে, আশেপাশের কারখানা বাড়িগুলোর দিকে। দুনিয়াজোড়া মানুষ এসে একটা গতি করে নিয়েছে এখানে কিন্তু তার। সামনে সমস্ত ফটক বন্ধ হয়ে গেছে কেবলি। বাপ ছোটকাল থেকে যজমানের বাড়ি নিয়ে নিয়ে ঘুরেছে। ছেলেকে একটি অকালকুষ্মাণ্ড করে দিয়ে মরেছে। সে বলে, শালা মন্তর বলাটাও ভাল করে শিখিয়ে। দিয়ে যায়নি! যজমানি করা দূরের কথা, হপ্তায় নারায়ণপুজোটার জন্যও কেউ ডাকে না। দুটো চাল কলা এলেও বা…। না, সে তার জীবনের প্রথম দিকেই শেষ হয়ে গিয়েছে। বাপের মৃত্যুর পর যজমানেরা ডেকেও জিজ্ঞেস করেনি। বলেছে, বামুনের ঘরের আকাট। ও কোষাকুষিতে হাত দিলে তা অপবিত্র হবে। 

গোবর দলাটার দিকে আর একবার দেখে সে উপরের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন ডাকতে উদ্যত হয়ে থেমে গেল! তার কানে এল সেই গানের কলি, ধনধান্যেপুষ্পে ভরা…নিজেই সে উবু হয়ে তাড়াতাড়ি খাবলা খাবলা গোবর হাতে তুলে নোনা-ধরা ইটের গায়ে চাপটি মেরে দিল। বাড়ির পেছনে পানা পুকুরটায় হাত ধুয়ে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে চলতে শুরু করল বড় রাস্তার দিকে। আশেপাশে দেখে না, সামনে মুখ তোলে না। দূর থেকে দেখে মনে হয় পিঠে বোঝা নিয়ে বুঝি একটা মানুষ আসছে। 

আশপাশ থেকে নানান কথা ছিটকে আসে ওকে উদ্দেশ করে। উৎকট কুৎসিত সব মন্তব্য। সিনেমার ধারের চা-খানার কাছ থেকে একজন চেঁচিয়ে ওঠে 

হারাধনের দশটি রোগী, ঘোরে বাজার ময়। 
একটি মল গরমি রোগে রইল বাকি নয়।

হারাধন নির্বিকার। কোনওদিকে দৃকপাত না করে রোজকার মতো লাইটপোস্ট গুনতে গুনতে এগোয় সে। সতেরো, আঠারো…। তেত্রিশটা হলেই ডানদিকের অন্ধকারে হারিয়ে-যাওয়া গলিটার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এমনি রোজ। কেমন করে যেন এটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বোধ হয় সামনে তাকায় না বলেই। 

অচেনা লোককে হঠাৎ হকচকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় গলিটার মোড়ে। মনে হয় একটা অন্ধকার গুহা, তার মধ্যে দূরে দূরে কতকগুলি জোনাকি জ্বলছে পিটপিট করে। আর অশরীরী ছায়ার মতো যেন কারা ঘোরাফেরা করছে সেখানে। ভিড় করে আছে কারা সারবন্দি হয়ে গুহার গায়ে পাথরের মূর্তির মতো। নিঝুম নয়। হাসি, গান, গল্প, মারধোর, কান্না, হাঁক, হল্লা, কী নেই! তবু যেন হাওয়া নেই, আকাশ নেই গলিটার মাথায়। রুদ্ধশ্বাস দমবন্ধ, পাথরে ঠেসে ধরতে চাইছে। 

সেলাম হো ডগদরবাবু। জং-ধরা গলায় প্রথমেই একজন অভিনন্দন জানায় হারাধনকে। 

লোকটাকে এ মহল্লার মালিক বলা চলে। মোষের মতো বিশাল কালো লোমশ চেহারা, গলায় সোনার সরু চেন, কানে দুটো সোনার মাকড়ি। 

হারাধন তার কথার জবাব না দিয়েই এগুল।

মাতাল মেয়ে-গলার বেসুরো গান এক কলি শোনা গেল 

প্রেমের বাজারে যাব গো সজনী, 
দেখে শুনে আনব প্রেমের পশরাখানি।…

কে একজন মুখে জিভ দিয়ে তবলা বাজিয়ে উঠল, তাক ডিমা ডিম। 

শ্লথগতি হয়ে এল হারাধনের। দাঁতে দাঁত চেপে প্রায় ভেংচে উঠল চাপা গলায়, প্রেমের পশরাখানি! 

বাউনবাবা নাকি গো।’ একটা মধ্যবয়সি মেয়েমানুষ রকের উপর হারাধনের কাছে এসে দাঁড়াল। এই তোমার জন্যেই বসে আছি। সময় আর তোমার হয় না আজকাল। 

সামান্য আলোর একটা রেখা পড়েছে হারাধনের মুখে। মুখটা তার আরও বিকৃত হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো তীক্ষ্ণ, খোঁচা খোঁচা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে হিংস্র জন্তুর মতো। বলল, কেন, এখনও তো মরনি, তবে এত তাড়াতাড়ি কেন? 

উর্বশী নাচুনির বোন না আমরা? আমাদের কি মরণ আছে?’ মোটা গলায় হাসল মেয়েমানুষটি। 

তবে আর তাড়া কীসের। তোদের না মেরে তো আমি মরছি না।’ বলে হারাধন লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফাঁক করে এগুল সামনের অন্ধকারের দিকে। 

কী হল, আসবে না? মেয়েমানুষটি আবার বলল।

আসছি, পুতুলের ঘরটা ঘুরে। 

আশপাশ থেকে অনেক মেয়েই বাউনবাবাকে ডেকে ওঠে, অকারণ দুটো কথা বলে জবাবের প্রত্যাশা না করে। যে সব পুরুষেরা ভিড় করেছে, তাদের কেউ কেউ মুখ লুকোবার চেষ্টা করছে। হারাধনকে দেখে, কয়েকটা পাড়ার ছোকরা ছুটে পালায় এদিক ওদিক দুড়দাড় করে। 

হারাধন এ পাড়ায় বাউনবাবা’ বলে পরিচিত, আসলে এখানেই সে ডাক্তারি করে। সে কয়েক বছর আগের কথা। হারাধনের তখন ছ-মেয়ের পর একটি ছেলে হয়েছে। তার বিশিষ্ট বন্ধু, ইতর শ্রেণীর মহাপুরুষ বলে যার খ্যাতি সেই পরাণ ভটচায় এসে বলল, দেখ হেরো, কারখানার দরজা ধাক্কিয়ে তো সে মন্দিরের দরজা খুলতে পারলিনে, মাঠের ঘোড়াও তোকে খালি ল্যাং মেরেই গেল আর বড় বড় কথা বলে কার পেট ভরাবি? তার চে এক কাজ কর। উঁচ ফুড়তে পারবি?’ 

হারাধন প্রথমটা ঠাওর করতে পারেনি। বলেছিল, উঁচ যুঁড়ব মানে? 

মানে ডাক্তারি করতে হবে।’ বলে পরাণ ভটচায বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, বাজার ঘরের মেয়েদের তো চিকিৎসার কোনও বালাই নেই। অথচ সবগুলোই ব্যামোতে ভোগে। ওদের যারা কর্তা, তারা রোজের টাকাটা উঠিয়ে খালাস। কে মল বাঁচল সে সব ওরা দেখে না। তা মেয়েগুলোর তো আর রোগ পুষে রাখা চলে না। রোজগার করতে হবে যে! লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু পয়সা ওরা রেখে দেয়, সেটা দিয়েই। ওষুধ কেনে। তবে কর্তারা তা জানে, বিশেষ কিছু বলে না। আর বাজারের ডাক্তারদের খাই মেটানো ওদের পক্ষে সম্ভবও নয়। আমি ওদের বুদ্ধি দিয়েছি, তোরা পয়সা দিয়ে বাপু ওষুধগুলো কিনে আনিস, আমি ছুঁড়ে দেব। যা হয় দিস আমাকে, আর যদ্দিন পারিস রোগ সারিয়ে বেঁচে থাক। তা ফলটা কিছু খারাপ হয়নি রে। তবে বাজার সবখানেই মন্দা। খদ্দের আছে কাঁড়ি কাঁড়ি, পয়সা নেই। চুঁচ ফোঁড়াও কিছু খারাপ নয়, লক্ষণটা একটু বুঝে নেওয়া। সে দু-দিন দেখলেই হয়ে যাবে। বাজারের ডাক্তারে তাও। দেখে না। 

হারাধন প্রথমটা পরাণ ভটচাযের কথা বিশ্বাস করতে পারেনি। খোঁচা খোঁচা দাঁতগুলো বের করে হাসবার চেষ্টা করেছিল পরাণের রসিকতায়। কিন্তু পরাণ রসিকতা করেনি। রেগে বলেছিল, তবে ঘর-ভরা মা ষষ্ঠীর কৃপা নিয়ে বসে থাকা ঘোড়ার লাথি আর পাঁচজনের ভিক্ষেতে শালা পো-পেটা পড়ে থাকগে। ব্যাটা বামুনের ঘরের আকাট হয়েছিস, বেশ্যার ডাক্তার হতে পারবিনে? 

সত্যি, ঘোড়া ঠিক দৌড়াতে পারলে ভাগ্য ফেরে, তার ল্যাং খাওয়া যায়। গয়লার ছেলে কেনও একটু চা দিতে হলে জাত নিয়ে গালাগালি দেয়। কেউ কেউ তাকে দু-চার আনা পয়সা দিত, যাদের ঘোড়ার টিপ ধরে দিত সে। যারা পেয়েছে এক আধবার, তারা হারাধনকে একটু ভাল নজরেই দেখে। তা ছাড়া মিছে মামলার হক-দার সাক্ষী সে বাঁধা, সত্য বই মিথ্যা না বলবার প্রতিজ্ঞা বোধ করি তার জীবনের গোড়া থেকেই শুরু হয়েছিল। তবু বড়মানুষ ছোটজাতের যজমানি হারাধন নেয়নি। বামুনে শুয়োরের ব্যবসা করে, তা বলে কি রাঢ়ী কখনও বারেন্দ্র হয়, না, নিজেকে ভঙ্গ করে। আর খিদের সময়। নিজের সন্তানদের কাড়াকাড়ি, বাপ হয়ে বাটপাড়ি, তার ফাঁকে ফাঁকে বউয়ের মাটির পুতুলের মতো চোখ জোড়ার বিচিত্র অবাক অলস চাউনি, এ সব ভেবে গয়লা কেনোর আর-না-চাওয়ার দিব্যি-দেওয়া। চা গিলে সে উঠেছিল এসে পরাণ ভটচাযের কাছে। 

সেই থেকে শুরু। পরাণ ভটচায সব ভার বুঝিয়ে দিয়ে কবে কোথাও উধাও হয়ে গেছে, রয়ে গেছে হারাধন। মেয়েরা পরাণকে বলত ভটচায, কেননা সে ছিল তাদের বন্ধু। হারাধন বন্ধু হয়েও বাপ। হয়েছে। তাই সে হয়েছে বামুনবাবা। 

এখানকার বস্তির বাইরে থেকে ভেতরটা বোঝা যায় না। সেখানে আছে অনেকগুলো হ্যারিকেনের আলো, একটা লম্বা চওড়া কাঁচা উঠোন, তার মাঝখানে তুলসীমঞ্চ ও ছোট ফোকরের মধ্যে জ্বলছে সন্ধ্যাপ্রদীপ। বাইরের চেয়েও বেশি লোক, বেশি হল্লা হাসি গান। চারপাশ জুড়ে ঘর। 

উঠোনটা ভেজা ছিল। তার উপরে একটা মাতাল পড়ে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে আর গান গাইছে।

প্রথম প্রথম এ সব চেয়ে দেখেছে হারাধন। এখন দেখা দূরের কথা, মনেই থাকে না। সে দেখে খালি মেয়েগুলোকে, চেনে মেয়েগুলোকে, কথা বলে কেবল ওদেরই সঙ্গে এবং কোনওদিনও হেসে কথা বলেনি। যেটা হাসি বলে মনে হয়েছে সেটাকে দাঁত খিঁচোনো বলাই ভাল। 

পুতুল ঘরের মধ্যে কাত হয়ে শুয়ে মুখের কাছে একটা বালিশ নিয়ে গান করছিল। হারাধনকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। 

হারাধন মুখ খিঁচিয়েই আছে। বলল, গান হচ্ছে? বলি কোন সুখে। 

ব্যামোর। ম্লান হেসে বলল পুতুল। ব্যামোতে মানুষ গান গায় তা বুঝি জান না, বাউনবাবা?

 জানি না বইকী। পাগলে ছেলে মলেও হাসে। ঢিল খেলেও হাসে। এখন ওষুধ বের কর দিনি।

হারাধন এখন একজন প্রকৃতই ডাক্তার। বলল, খেয়েছিস কখন?

 সেই দুকুরবেলা। 

খ্যাঁক করে উঠল হারাধন, মিছে কথা বলিস কেন? গাদা বমি করে মরবি। বিকেলে কিছু খাসনি? 

পুতুল অমনি আদুরে মেয়েটির মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, সে তো কোন বেলায় দুটি মুড়ি আর চা খেয়েছি।’ 

তবু কতক্ষণ আগে?

তা চার ঘণ্টা হবে।

 ঠিক তো?’

তো কী, তোমাকে মিছে বলব?’ 

পাগল, তা কখনও বলতে পারিস। দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল হারাধনের বিকৃত মুখটা বিস্ফারিত করে। 

আবার চকিতে গম্ভীর হয়ে পুতুলের নাড়ি দেখল গভীর অভিনিবেশ সহকারে। এটুকুও সে জানে বোঝা গেল। তারপর পকেট থেকে একখানি ছোট পিজবোর্ডের বাক্স বার করে সিরিঞ্জ নিল, স্পিরিট তুলো বার করল, টকাস করে ভাঙল ইনজেকশনের অ্যামপিউল। 

পুতুল তাড়াতাড়ি হাঁক দিল, ও পুঁটি, একদুস আমাকে ধরবি আয় ভাই।

 পুঁটির জবাব এল, হ্যাঁ, পেখম রাত্তির, আমার কি দরজা ছেড়ে যাওয়া চলে?

পুতুলের গলায় আরও খানিক ভয় ও মিনতি ফুটে ওঠে, তোর পায়ে পড়ি পুঁটি।

হারাধন সিরিঞ্জে ওষুধ পুরতে পুরতে বলে উঠল, এখনও মরণের ভয়? বাঁচতে সাধ?

তা বাউনবাবা, মরতে পারলে কি আর গঙ্গার জল কিছু কম ছিল?

 থাক।’ বলে নিঃশেষিত অ্যামপিউলটি ফেলে দিয়ে চোখ তুলে সে পুতুলের দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য তার মুখের আঁকাবাঁকা রেখাগুলো উঠল সরল হয়ে। বলল, একটু দেখেশুনে মানুষ ঘরে তুলতে পারিসনে, অ্যাঁ?’ 

পুতুলের মুখটি পুতুলের মতোই হয়ে উঠল। তা কি হয় বাউনবাবা? খদ্দের কানা হোক, খোঁড়া হোক, সে যে ভরসা! পরমুহূর্তেই মুখটা বিকৃত করে বলল, তা রোগ ব্যামো কি মুখপোড়াদের ধরা যায়। 

পুঁটি এল মুখ গোঁজ করে। উপায় তো নেই। ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে, এমন দিন সবারি আসে। পুঁটিকে এক দিন ধরতে হবে হয়তো পুতুলকে এসে। 

একটা পাকা ডাক্তারের মতো শিরা খুঁজে প্যাঁক করে হারাধন উঁচ ঢুকিয়ে দিল। কষ্ট হলে বলিস। 

ইনজেকশনের পর, খানিকক্ষণ পড়ে থেকে পুতুল চার আনা পয়সা বাড়িয়ে দিল হারাধনের দিকে। ওষুধ এনে এই ছিল বাউনবাবা, পরে আবার দেব। 

হারাধনের ক্রুদ্ধ মুখটার দিকে চাওয়া যায় না। চিবিয়ে বলে, তোরা মরবি কবে, কবে?

নিশ্চুপ পুতুল তেমনি পড়ে রইল। হারাধন তার হাত থেকে ছোঁ মেরে পয়সা চার আনা নিয়ে গেল বেরিয়ে। 

বাইরে গজগজ করছে পুঁটি। কে জানে এই দশ মিনিটের মধ্যে হয়তো একটা খদ্দের মিলত তার।

একটা লোককে কয়েকটা মেয়ে মিলে পিটছে। লোকটা নাকি পয়সা ফাঁকি দেয়। 

অবসর নেই কিছু দেখবার হারাধনের। সে চষছে সারা মহল্লাটা। পাকা বাঁশের মতো বাঁকা পা বকের মতো ফেলে ফেলে, ঘর থেকে ঘরে। 

কিন্তু তার চেয়েও দ্রুত হুতোশে মন দৌড়চ্ছে মেয়েদের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, দুরু দুরু বুকে শিকারির মতো অপলক চোখে তারা পথের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কে যে শিকারি, তা বোঝবার যো নেই। যে দেখছে, না, যে দেখাচ্ছে? 

গান তেমনি চলছে, প্রেমবাজারে যাব লো…। আর দম-দেওয়া পুতুলের মতো হারাধন ফিসফিস করে চলেছে ভেংচে। প্রেম না পেম।…কেউ ওষুধ কিনে রাখেনি, কেউ না। অথচ রোজই বলে, রাখবে। তারপরে আর পয়সা থাকে না। থাকলেও নেশা করে বসে থাকে, নয়তো কিছু খেয়ে বসে থাকে। ভাল-মন্দ। কিন্তু বেশির ভাগই পয়সা জমাতে পারেনি। একটা অজানা রাগে তার আঙুলের টিপুনিতে সিকিটাই না ভেঙে যায়। 

চণ্ডী, চণ্ডী কোথায়? সে তো মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিল ওষুধ এনে রাখবে।’…চণ্ডীর দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল আর চামচিকের মতো ফুড়ুৎ করে একটা লোক গেল ছুটে বেরিয়ে। 

চণ্ডীর গায়ে কাপড় নেই। হারাধন বিকৃত মুখটা ফিরিয়ে বলল, কাপড় পর। 

মদ খায়নি, তবু যেন নেশাচ্ছন্ন চণ্ডী তার কালো মোটা শিথিল শরীরটা ঢাকল ধীরে ধীরে, নিস্তেজ গলায় ডাকল, এস বাউনবাবা। 

ঢুকেই হারাধন তার দাঁত বের করে খিঁচিয়ে উঠল, তবে তোর ব্যামো সারবে কী করে? খুব তো এনতার…’ 

বাধা দিয়ে বলে উঠল চণ্ডী, কোথায় বাবা, সবে তো দুজন। 

কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে হারাধনের। মনে হল এখুনি এক ঘুষিতে অর্বাচীন চণ্ডীর মুখটা ভেঙে ফেলবে। কিন্তু মুখ কই? 

চণ্ডীর তো মুখ নেই! মাটির ডেলা তো একটা। বলল, ওষুধ এনেছিস?

এনেছি।’

বার কর।

সেই এক কথা, এক ভাব, এক ব্যাপার।

 ইনজেকশনের শেষে একটা পুঁটলি বাড়িয়ে ধরল চণ্ডী হারাধনের দিকে। এইগুলো নেও বাউনবাবা, পয়সা নেই। 

কী এগুলো?

চাল একসের।

চাল? হঠাৎ যেন হারাধনের শূন্য পেটটা পাক দিয়ে উঠে মুখটা রসালো হয়ে উঠল। ভাতের গন্ধ লাগল যেন তার নাকে। তবু বলল, চাল কলা আমার বাপ আনত মন্তর পড়ে, আমি কী করব? 

খাবে। নিরুপায় গলায় বলল চণ্ডী, এর জনেই তো সব বাউনবাবা। শরীলে যে এত বিষ ধরি…’ 

কিন্তু কী যে মোহিনী গন্ধ চালের! হারাধন ততক্ষণে একমুঠো চাল কটর মটর করে চিবোতে আরম্ভ করেছে। তার চিবোনো মুখের খুশি দেখে মনে হল সে সব ভুলে গেছে বুঝি। তারপর হঠাৎ চণ্ডীর দিকে নজর পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে চালের দলাটা গিলে ফেলল কোঁৎ করে। মুখটা বিকৃত করে বলল, শালা চাল নিতে হবে? আচ্ছা, তাই সই। 

বলে পুঁটলিটা নিয়ে আবার ফিরে বলল, তোর চাল আছে তো?

 চালিয়ে নেব কোনওরকমে। চণ্ডী এলিয়ে পড়ল বলতে বলতে।

মুখটাকে আরও কুঞ্চিত করে পুঁটলিটা মাটিতে রেখে বলল হারাধন, তবু বাঁচতে হবে। 

হেসে ফেলল চণ্ডী, তোমার কী কথা মাইরি, বাউনবাবা। বাঁচতে না হলে তুমিই বুঝিন এ হুঁড়িদের দেখতে? 

হয়েছে, থাক।’ খ্যাঁক করে উঠে হারাধন বলল, ওর থেকে দুটো রেখে বাকিটা আমাকে দিয়ে দে।

 চণ্ডী সংশায়ান্বিত চোখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি রাগ করবে না তো বাবা?

হারাধন তখন আপন মনে বিড়বিড় করছে, শালা পরাণ ভটচায কি আপদের কাজে রেখে গেল আমাকে। এর থেকে আমার…’ 

অমনি তার মনে আবার প্রশ্ন ওঠে, কী? চেয়ে চিন্তে, মিছে ধার করে আর মরীচিৎকার মতো ঘোড়ার পেছনে পেছনে ছুটে জীবনধারণ? না-ই বা হল। কিন্তু এ কোন বিদঘুঁটে জীবনের সঙ্গে বাঁধা পড়েছে তার ভাগ্য? একদল প্রতিমুহূর্তে গণ্ডুষ গণ্ডুষ বিষ পান করছে, কী ক্ষমতা আছে হারাধনের সে বিষ সে শুষে নেবে?

চণ্ডী এক কুনকে চাল রেখে আবার পুঁটলিটা তুলে দিল হারাধনের হাতে। হারাধন চলে যেতে যেতে বলল, দু-একটা রাত একটু কামাই দে, কামাই দে। 

চণ্ডীর সেই মাটির ড্যালা মুখটাতে যেন আচমকা আগুন ধরে গেল। সত্যিই একটা মুখ ফুটে উঠল এবার এবং বিতৃষ্ণায় রাগে ঘৃণায় তা যেন জ্বরবিকৃত। এ জীবনে কামাই দেওয়া আর হবে না। এক রাত্রিও থামতে পারা যাবে না। এ শরীরের বিশ্রাম নেই। পারলে কি নিজের মুখের ভাত কেউ তুলে দেয়!…’। 

কোলাহল লেগেছে ঝগড়ার। একটা ছুতোর অপেক্ষা মাত্র। ঝগড়া তাদের, যাদের পসার নেই আর যাদের আছে তাদের মধ্যে। 

সরলা বসে আছে রকের উপর। সেজেছে, রং মেখেছে, কাজল টেনেছে চোখে, কপালে বসিয়েছে টিপ। কিন্তু পথের ধারে যায়নি। কাপড় এলিয়ে খাটো জামাটা শরীরটাকে আরও কটুদৃশ্য করে তুলেছে। হারাধনের দিকে তাকিয়ে আছে ভিক্ষুকের মতো যন্ত্রণাকাতর মুখে। 

হারাধন পাথরের মতো শক্ত মুখে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। কিন্তু খানিকটা গিয়ে হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে খেঁকিয়ে উঠল, তাকিয়ে আছিস কেন, কীসের জন্যে? আমি কি ভগবান যে তোর রোগ সারিয়ে দেব? ওষুধ না পেলে কিছু হবে না।’ 

সরলা কাছে এসে বলল, কী করব বাউনবাবা, রোজগারে কুলোয় না যে? 

রেগে কটুক্তি করে উঠে হারাধন, শালা ভিক্ষুকের ডেরা নাকি এটা? তাদেরও তো রোজগার আছে, আর…। আমি কী করব? আমার কী আছে? 

এক, একই ব্যাপার ঘরে বাইরে। কোনও যেন ফারাক নেই ঘরের বউটার সঙ্গে এদের। তার রোগ নেই, কিন্তু সেও যেন এমনি অবস্থায়, প্রাণভীত চোখে হারাধনের সামনে এসে দাঁড়ায়।…চালের পুঁটলিটা শক্ত করে ধরে সে সরে গেল। 

উপায় নেই। আগুনের হলকা লেগে যেন সরলা ছুটে পথের উপর চলে যায়।

বাবা। বাউনবাবা।…’ 

কচি গলার ডাক শুনে ধ্বক করে উঠল হারাধনের বুক। যেন তার সেজো মেয়েটি এসে ইজের পরে দাঁড়িয়েছে তার সামনে? রোগা লম্বা, সরল রেখার মতো অপুষ্ট কাঁচা মেয়েটা। ক্রুদ্ধ নিষ্ঠুর বাউনবাবার প্রকৃতি ওর জানা নেই, তাই হারাধনের হাত জাপটে ধরে মেয়েটা বলে উঠল, শরীলে আমার রোগ হয়েছে, সারিয়ে দেও, সারিয়ে দেও। 

হারাধনের মনে হল কে যেন গান গাইছে কচি গলায়, ধনধান্যে পুষ্পেভরা।… 

এই-এই ছোকরি।’ হাঁকছে সেই মোটা লোমশ চেহারা, গলায় সোনার চেন-দেওয়া লোকটা। মেয়েটা শুনল না সে ডাক। লোকটা হেসে উঠল। আচ্ছা, আচ্ছা ডাক্তার, কাল এসে ওকে দাবাই দিয়ে যেও, আমি আনিয়ে রাখব। চলে আয় ছোঁকরি, চলে আয়।… 

মেয়েটা শুনল না।

 কিষণ! মোটা লোকটা জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠল। 

সেই ডাক শুনে চকিতে মেয়েটা কাদার মতো দলা পাকিয়ে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল। কিষণ এখানকার বেয়াদপ মেয়েদের যম। মোটা লোকটা কেশো গলায় হেসে উঠল, তুমি ডাক্তার, মেয়েগুলোর মাথা খাচ্ছ!…’ 

দড়াম করে একটা ঘরের দরজা খুলে রানি একটা সুবেশ ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে এল চেঁচাতে চেঁচাতে। আরে আমার কোথাকার পুঁটকে ভাতার এলরে। দ্যাখো দিনি কাণ্ড। বলে আমার নেই সময়, ছোঁড়া কাজ মিটিয়ে পালাবি, তা না, বলে তুমি কেন বেবুশ্যে হয়েছ? এ কি যাত্রার ঢং রে বাবা। এখন আমি ওর সঙ্গে গল্প ফাঁদি আর কী। কেন হয়েছি সে তোর বাড়িতে জানে।’.বলে অগোছাল রানি অশ্রাব্য কটুক্তি শুরু করল। 

ছেলেটার দিকে এক মুহূর্ত দেখে হারাধন এগিয়ে গেল সেদিকে। নরম শান্ত নবীন যুবক। হারাধন তার চিবুক ধরে বলল, কাকে খুঁজছ বাবা? চন্দ্রমুখী, না, পিয়ারিবাইজি?

ছেলেটা সন্ত্রস্ত বড় বড় চোখে হারাধনের দিকে তাকিয়ে রইল। তার হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপছে, ঠোঁট দুটো নড়ে চড়ে উঠছে। 

হারাধন তার খোঁচা খোঁচা দাঁতে বোধ হয় হেসে বলল, এরা সব মেয়ে কুলি, ফুরনে খাটে। ও সব গল্পেই ভাল জমে, নয়তো জায়গা বাছতে হয়। এখানে সে সময় নেই। বাড়ি যাও, বাবা। 

ছেলেটার চোখে তখন প্রায় জল দেখা দিয়েছে। সে প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল। 

রানি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ছোঁড়ার মরণ ধরেছে! চন্দ্রমুখীটা কে বাউনবাবা?

 সে এক গল্পের বেবুশ্যে। শরৎ চাটুয্যের নাম শুনেছিস? 

নরসিং চাটুজ্যেকে তো চিনি, ও নাম তো জানি না।

হারাধন বলল, তিনি বেবুশ্যেদের গল্প লিখতেন, খুব নামী লোক ছিলেন রে। পরমুহূর্তেই মুখটা ঘোঁচ করে বলল, তা বলে তিনি তোদের মতো হাভেতেদের কথা লেখেননি উনি; যাদের কথা লিখতেন, তাদের একটা প্রাণ ছিল। 

সে পেরাণ নিয়ে তোমরা থাক গে, জান থাকলে বাঁচি। মুখ বেঁকিয়ে রানি সরে গেল।

জান থাকলে বাঁচি।’ বিড়বিড় করতে করতে হারাধন এগোয়। ছোঁড়াটা বোকা, তাই এখানে এসেছে প্রেমের সন্ধানে। ব্যাটা মুখে দুটো তুলে দিয়ে প্রেম কর, জমবে। সবই জমবে। তা না, নভেলিয়ানা! চালের পুঁটলিটা নাকের কাছে ঘষতে ঘষতে পথে এল হারাধন। 

সারাক্ষণ ঘুরে তার বারো আনা আর ওই চালটুকু রোজগার হয়েছে। তাও আট আনা পয়সা ভবিষ্যতের জন্য একটা মেয়ে জমা রেখেছে। 

প্রেমবাজারে যাব লো সজনী…’ সেই গান চলছে। হারাধন অন্ধকারে ঠাওর করে দেখলে, গান গাইছে মতিবালা। বয়স বেশি নয়, কিন্তু চামড়াগুলো ছাইপানা হয়ে কুঁচকে ঝুলে পড়েছে, চুলগুলো হয়েছে পাঁশুটে, দাঁত নেই একটাও। চোখ আছে দুটো সাপের মতো। বলল, কে, বাউনবাবা? এই আঁধারে বসে গাইছি। দেখি যদি কেউ আসে।’ 

হারাধন মুখ ভেংচে বলল, প্রেমের শখ এখনও মেটেনি?’ 

মতি মাড়ি বের করে বলল, যা পেলেম না, তা মিটবে কী করে? আর পেটটা তো ভরাতে হবে। গান শুনে এক বার উঁকি তো দেবে। 

দিলই বা।

তখন ঘরে না যায়, দুটো পয়সা চেয়ে নেব।’

 তবু মরবে না।’…ছিটকে গলিটা থেকে বেরিয়ে এল হারাধন। এক, দুই…লাইটপোস্ট গুনতে আরম্ভ করেছে সে। রাতটা এখন ফাঁকা। দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘাড় গুঁজে হেলে পড়ে ছায়া ফেলে চলেছে হারাধন। মাঝে মাঝে হঠাৎ থমকে পড়ছে। কেবল মনে হচ্ছে সামনে এসে কে যেন দাঁড়াচ্ছে। কে? কেউ না। রাতে পুলিশের বুটের শব্দ আসছে। তবু যেন একটা কীসের দেওয়াল এসে পথরোধ করছে বার বার হারাধনের।…হঠাৎ মনে হল রাস্তাটা একটা কুৎসিত ব্যাধির মতো দলা পাকিয়ে উঠে এসেছে তার সামনে। ধাক্কা দেওয়ার মতো এগিয়ে গেল সে। আঙুলে যেন সিরিঞ্জ ধরেছে। ফিসফিস করে উঠল, দেব শালা ছুঁচ ফুড়ে? দেওয়া যায় না ইনজেকশন করে এক হাতে দুনিয়াটাকে সাপটে ধরে?..ঊনত্রিশ ত্রিশ… 

গলিটাতে ঢুকে তার গতি শ্লথ হয়ে আসে। ঘাড়টা আরও খানিক ঝুঁকে পড়ে। বাঁকা পায়ের পদক্ষেপের তালে তালে যেন সে বলছে, ধরণী দ্বিধা হও! দ্বিধা হও!

গলিটাতে আলো নেই, কিন্তু শুক্লপক্ষের চাঁদ ছিল আকাশে। অষ্টমীর চাঁদ বোধ করি। এক বিচিত্র কুহেলিকাপূর্ণ আলো আঁধারে ভরা সমস্ত গলিটা। কোথায় একটা গো-সপিণী উলু দেওয়ার মতো লু লু করে ডেকে উঠছে গো-সাপকে। 

ডোবার ধারের সরু ধার দিয়ে ঝুপসিঝাড়ে ছাওয়া হেলে পড়া বাড়িটার সামনে এসে হারাধন দাঁড়াল। ভুতুড়ে বাড়ি, ছিটেফোঁটা ঝাপসা আলোয় মনে হয় নিশ্বাস আটকে হেলে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে ভূতটা। 

হারাধনের পায়ের শব্দে কীসে যেন ফোঁস করে উঠল। সে দেখল দেওয়ালের ফাটলে অর্ধেক বেরিয়ে আছে কাল নাগ, চকচক করছে রং। কিন্তু হারাধন যেন চেনা মানুষ। মাথা নামিয়ে তাড়াতাড়ি গর্তে ঢুকে গেল। বাস্তু সাপ এটা। একজোড়া আছে। ওরা চার শরিককে চেনে না, চেনে হারাধনকে। পোড়ো বাড়িতে ভূতের মতো নিঃসাড়ে ঢুকল হারাধন। ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। উঠোনটাতে আগাছার ঝাড়–তার ব্যাপ্তি উপরে ও নীচে সর্বত্র। উপরের সব ঘরগুলোই ভাঙা আধ ভাঙা, একটা ঘর আস্ত। হারাধন সে ঘরে গিয়ে ঢুকল। দাঁতগুলো তার বেরিয়ে পড়েছে। বুক খোলা জামাটার ফাঁক দিয়ে ঝুলে পড়েছে পৈতেটা।

ঘরটাতে জানলা ও ভাঙা ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে। সেই আলোয় দেখা গেল সারি সারি তার নটি ছেলেমেয়ে শুয়ে আছে। আটটি মেয়ে, একটি ছেলে। বড় মেয়ে দুটোর সারা গায়ে রং-এর জাদু লেগেছে। হারাধনের মুখের এলোমলো কোঁচগুলো যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল। সে উবু হয়ে সকলের ধার দিয়ে এক বার হাত বুলিয়ে গেল। ছেলেটার কাছে এক মুহূর্ত থমকাল। 

আলোয় যেন নীল দেখাচ্ছে ছেলেটার মুখটা। ছেলে মাত্র একটি। মুখের কষ বেয়ে নাল পড়ছে। অঘোরে ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়ে গেল।..কিছুদিন আগে পাড়ার কে দু-কোয়া কাঁঠাল দিয়েছিল ছেলেটাকে। ছেলেটা ডোবার ধারে বসে তা খাচ্ছিল। হারাধন হঠাৎ কী মনে করে খেলাচ্ছলে কাককে দিয়ে দেবে বলে ক্ষ্যাপাতে ক্ষ্যাপাতে কপ করে কাঁঠালের কোয়াটা মুখে দিয়ে গিলে ফেলেছিল।…আর ছেলেটার সে কী চিল চেঁচানি! হারাধন ভয় পেয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল তার বউয়ের সেই একজোড়া অপলক চোখের অলস চাউনি। তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সে ছুটে গিয়েছিল গয়লা কেনোর দোকানে একটা বিস্কুট দিয়ে ঠাণ্ডা করতে। 

কিন্তু বউটা কোথায়? একেবারে অন্য গলায়, নরম সুরে সে ডাকল, নবউ! নবউ কোথায় গেলিরে?’ 

সে ডাকে যেন সারা ঘরটায় একটা মায়া ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু কোনও জবাব এল না। হারাধন ঘরে থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক করে পুবদিকের ছাদটার দিকে গেল। 

সেখানে জামরুল গাছটার পাশে, আলসের ধারে নবউ নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে।..হঠাৎ দেখলে মনে হয়, ন-বউ অপরিসীম সুন্দরী। এই আলোয় গায়ের রং যেন ধপধপ করছে, রূপময়ী হয়ে উঠছে নবউ। মাথায় ঘোমটা নেই, ময়লা কাপড়ে শরীরটা ঢেকে রেখেছে।… 

কিন্তু সামনে এলে দেখা যায়, সমস্ত শরীরটা একটা সরল রেখা। কোথাও তার নেই উঁচু নিচু বঙ্কিম রেখা। মুখটা কঙ্কালের মতো সাদা ও ছোট। সেই হাড়কপালে একটা মস্ত লাল টিপ। চোখ দুটো যেন পোয়াতি গাভীর। 

হারাধন চালের পুঁটলিটা রেখে বউয়ের হাত ধরে ডাকল–কী করছিস এখানে ন-বউ, খুঁজে আর পাই না।’ 

ন-বউ তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হারাধনের দিকে ফিরে দু হাত ধরে তাকে বসায়, জামাটা খুলে নেয়, বলে, কখন এসেছ? 

এই তো কিছুক্ষণ! হারাধন একটা নিশ্বাস ফেলে ন-বউয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, চাঁদ দেখছিস? 

চাঁদ কোথায়?’ ন-বউ অবাক হয়ে দেখল সত্যিই তো চাঁদ রয়েছে আকাশে।

 হারাধন বলল, চোখেও পড়েনি, না রে? এ সব বুঝি আর চোখেই পড়বে না কোনওদিন। ন-বউ, এ বাড়িটার মতোই আকাশটা কোনওদিন ভেঙে পড়বে। 

নবউয়ের মুখটা যন্ত্রণাকাতর হয়ে উঠল। হারাধনের হাড় বের করা মুখটা হাত বুলিয়ে বলল, তোমার যে শরীরটা’– 

বলিস নে। বাধা দিয়ে বলে উঠল হারাধন। বলিস নে ন-বউ। তুই গায়ে হাত দিয়ে বসেছিস। আমি যে তোদের দিকে আর তাকাতে পারিনে।..এই তো রোজগার করেছি বারো আনা পয়সা তিন পো চাল। কী দিয়ে তোদের ছোঁব, বল। 

বুঝি রাত থেমে গেছে, চাঁদ ঢেকে গেছে, হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

 ন-বউ বলল, তা হলে তোমাকে দুটি রান্না করে দিই?’

 আজ আর নয়, কাল দিস। চল ঘরে যাই।বলে ন-বউয়ের হাত ধরে কাছে টেনে নিল সে।

ন-বউ উঠল কিন্তু তবু দাঁড়িয়ে রইল। হারাধন ডাকল, চল, রাত যে পুইয়ে এল? 

যেন দারুণ অপরাধিনীর মতো ন-বউ হঠাৎ হারাধনের পায়ের কাছে পড়ে ফুঁপিয়ে উঠল, উঠানের ওই তেলাকুচোর ঝাড়টা তুমি কেটে দিও।

হারাধন অবাক হয়ে বলল, কেন রে? 

ওখান থেকে কী একটা ফল খেয়ে আমাদের ছেলেটা মরে গেছে।…’

হারাধনের মনে হল সত্যি আকাশটা ভেঙে পড়েছে তার মাথায়, বাড়িটা টলছে, চাঁদটা ছিটকে পড়ছে আকাশ থেকে। নবউ তখন বলছে, সন্ধ্যাবেলা কেবলি খেতে চাইছিল আর কাঁদছিল। ওদের জন্য কখানা রুটি করছিলাম। সেই ফাঁকে…খোকার খিদে মানল না।…দেখলাম, কী খেয়ে যোবা ছেলে শুয়ে আছে।…

হারাধনের চোখের উপর ভেসে উঠল ছেলেটার নীল মুখ, নাল গড়াচ্ছে। যেন আকাশের বুক থেকে বলল, ও! তবে জন্মের মতো দেখে এসেছি তাকে?… তবু চল নবউ, সে যে একলা রয়েছে।… আমার যে আরও জ্যান্ত আটটা মেয়ে রয়েছে। 

পরদিন ছেলেকে শ্মশানে পুঁতে এসে হারাধন পৈতেটা কোমরে গুঁজে একটা মস্ত ঠ্যাঙ্গা দিয়ে। ঝাড়টাকে পিটে পিটে দুমড়ে দিতে লাগল। 

সেই ঝাড়ে ঘা লেগে ছরকুটে যেতে লাগল সবুজ লাল সব বিচিত্র ফল। পালাল কতগুলো ঢোঁড়া হেলে সাপ, পোকামাকড়। শিকড়ে ঘা লেগে সারা বাড়িটার দেয়ালের বিস্তৃত শিরা-উপশিরায় টান পড়ে যেন নড়ে উঠল বাড়িটা। 

ন-বউ উপরে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে তাই দেখছে। মেজো-মেয়েটা কোলের বোনটাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে দোলাচ্ছে আর সরু মিষ্টি গলায় গাইছে, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা…