জীবিকা

জীবিকা

যা লিখছি, তাকে ঠিক গল্পই বলা যাবে কি না আমি জানিনে। এবং অতিশয়োক্তি না করেও বলতে পারি, বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট কলেজে, সাহিত্যসভার আমন্ত্রণে, আমি বক্তৃতার কোনও কথাই খুঁজে পাইনি। এই গল্পটিই বলেছিলাম। এক বাঙালি শিল্পীর চরিত্র-চিত্রণও সেটা বলা যায়।

আজই বিশেষ করে কেন সে কথা মনে পড়ল, সেটাও আমার নিজের কাছে খুব বিচিত্র লাগছে। শুধু বিচিত্র বলছি কেন। বরং বলাই ভাল, এটা আমার স্পর্ধা কি না, সে সংশয়ও আছে। আজ ষোলোই সেপ্টেম্বর। গত পরশুদিন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি, আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয়, পণ্ডিত, দার্শনিক ডাঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ যে কলেজে গিয়েছিলেন, বছর ছয়েক আগে সে-কলেজেই আমি গিয়েছিলাম। আমার যাওয়াটা এত তুচ্ছ যে, এ রাজকীয় ঘটনার সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। শিয়ালদহ থেকে বহরমপুর স্টেশন পর্যন্ত, সমস্ত মানুষই ১৪ই সেপ্টেম্বর তা প্রত্যক্ষ করেছেন। করাই স্বাভাবিক। এবং কৃষ্ণনাথ কলেজে উপরাষ্ট্রপতি যা বলেছেন, তা আমাদের ভিতরের অবচেতন অনুভূতিরই কথা। গোটা ভারতের ভিতরের সত্যকে এমন করে উদঘাটন করা। তেমন যোগ্যতা যে আমার কানাকড়িও নেই, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবু যে কৃষ্ণনাথ কলেজে তাঁর উপস্থিতির সংবাদ পড়ে আমার সে-কাহিনী মনে পড়ে গেল, সেটা আসলে, আমার তুচ্ছ উপস্থিতিতে আজ আমি অনেক গৌরবান্বিত বোধ করছি। আমি পাশের জেলার প্রতিবেশী বন্ধু হিসেবেই গিয়েছিলাম। আমি সেই অগণিত সাধারণেরই একজন, অসাধারণের ছিটেফোঁটা স্পর্শ পেলেও নিজেকে যে যুক্ত করে গৌরব করতে চায়।

আর এই ভেবেও আফসোস হচ্ছে, সেই গল্প বলার ঝোঁকটা কখনও কাটাতে পারলাম না। আমি তো ধার করেও ছুটি, দেশ কাল এবং সাহিত্যের ওপরে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা বলতে পারতাম। কিন্তু কথাই আছে, স্বভাব যায় না মলে।

আজ আবার সেই তুচ্ছ গল্পটিরই পুনরাবৃত্তি করছি। আমার ঝুলিতে এই তুচ্ছতাটুকু ছিল। তাই তুলে, উপরাষ্ট্রপতির পায়ে দিই আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে।

কী মাস সেটা, তাও মনে নেই। তবে ক্ষণে বর্ষা, ক্ষণে রোদ, মুর্শিদাবাদের সবুজে সেদিন আলোছায়ার বিচিত্র খেলা। আর বাংলাদেশ, তার বিচিত্র রূপের কথা বলতে গেলেই গলার কাছে একটি আশ্চর্যজনক আনন্দদায়ক বেদনা যেন সব রুদ্ধ করে দিতে চায়। রানির মতো ধনরত্নের সত্যিই তো কোনও বৈশিষ্ট্য তার নেই। মা বলে ডাকতে গেলে কি এমনি হাসি কান্নায় সব ভরে ওঠে? আর আমরা, আমরা এই কয়েক কোটি ভাইয়েরা আমাদের মায়ের থেকে কি কম বিচিত্র?

কয়েকজন ছাত্র বন্ধুর সঙ্গে প্রস্তাব হয়ে গেল, দুপুরেই বহরমপুর থেকে মুর্শিদাবাদের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া হবে। এবং সেটা ঘোড়ার গাড়িতে। যে কখনও অমন করে যায়নি, তাকে কেমন করে বোঝাব, সে-যাওয়াটা কী? পালকি গাড়ি আমাদের ছুটল সেই পথ ধরে, যে পথে বহু ঐতিহাসিক যাত্রার পদচিহ্ন এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে।

কিন্তু ইতিহাস থাক। মাইলের পর মাইল জুড়ে অমন পদ্মফুলের বিল আর কোথাও দেখিনি। কিন্তু সে পদ্ম থাক, বিল থাক। সেদিন হাজারদুয়ারির প্রাঙ্গণে তার দেখা পেলাম।

একদিকে গঙ্গা, আর একদিকে প্রান্তর জুড়ে বৃদ্ধ ইতিহাসের অবনত মাথা। ইংরেজদের তৈরি পোষানবাবের প্রাসাদের মধ্যে আছে জাদুঘর। দেখতে যাবার আগে, একটি জংধরা কামানের গায়ে হাত দিলাম। ভাবলাম, এ কামানটি হয়তো একদা বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। ঠিক সেই সময়েই শুনতে পেলাম, ও কামানটা বেইমানের কামান বাবু। ওটা আমাদের নয়।

সেই ভরাট প্রায় সুরেলা গলা শুনে চোখ তুলে তাকালাম। একটি মাঝারি লোক। হয়তো চাষি। পরনে একটি এক-রং লুঙ্গি। গায়ে বোতামখোলা ময়লা হাফ শার্ট। হাতে একটি বোধহয় হাঁড়ি, মুখে সরা ঢাকা, নতুন একখানি গামছা দিয়ে বাঁধা। বয়স বুঝি পঁয়ত্রিশের মতো। উশকো খুশকো চুল। দুটি ভাসাভাসা সুন্দর চোখ। দৃষ্টিতে কোথাও তীক্ষ্ণতা নেই, তীব্রতা নেই। একটি আশ্চর্য গভীরতা আছে।

জিজ্ঞেস করলাম, কী বললেন?

কাছে এল লোকটি। বলল, বলছি কী বাবু, এ কামানটা সিরাজের কামান নয়। এটা কী বাবু, জানেন? এটা হল আপনার সিরাজ-মারা কামান, ইংরাজের দেওয়া তাঁবেদার নবাবের কামান। বুঝলেন কি না বাবু? আপনি হয়তো উলটা ভেবে বসে থাকবেন, তাই বললাম। বাবু। টো বেইমানের কামান।

লোকটি আমার চোখের দিকে তাকাল। দুটি কথা বলল, আর মুহূর্তে আমার মনোহরণ করল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি জানেন?

একটি আশ্চর্য সুর তার গলায়। ইতিহাসের ব্যথিত হাসিটি দেখলাম তারই ঠোঁটে। বলল, জানব না বাবু? জন্মে ইস্তক তো এই দেখছি। এই যে মোকাম দেখছেন এখন জাদুঘর, আর এই যে কামান দেখছেন, এ যে বাবু বেইমানির পুরস্কার।

অবাক লাগল লোকটির কথা শুনে। তার কথার উচ্চারণ ও সুর খাঁটি মুর্শিদাবাদি। অনেকটা বুঝি বাউলের গানের মতো। লিখে তাকে ব্যক্ত করা যায় না। আর তার বলার মধ্যে কেমন একটি করুণ হাসিভরা বিষণ্ণতা।

তারপরই সে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে আসছেন আপনারা বাবু? সবচেয়ে যেটা সোজা, সেটাই বললাম, কলকাতা।

সে বলল, ভাল করেছেন বাবু এসে। একটু দেখেন সব ঘুরে ফিরে। আসছেন তিন চারজন, সব ঘুরে ফিরে দেখে যান। একটা কথা বলব বাবু?

.

এই অনুমতি চাওয়ার মধ্যে একটি সুন্দর গ্রামীণ আভিজাত্য ছিল। আর কী মিষ্টি তার বলার ধরন। নাম কী এর? মনোহর?

বলুন।

বলছি কী যে, আপনার পকেটে দেখছি কলম রয়েছে। আমার পোস্টকার্ডে একখানি ঠিকানা লিখে দিতে পারবেন ইংরেজিতে?

নিশ্চয়।

 পকেটে হাত দিয়ে সে পোস্টকার্ডখানি বার করে বললে, না, মানে, আবার বিরক্ত হবেন কি না, তাই ভাবলাম। আপনার বন্ধু জাদুঘরে যাবার টিকিট কাটতে গেলেন তো। যদি দেরি হয়ে যায়। না হয় ফিরে এসেই লিখে দেবেন।

আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, না। দিন লিখে দিচ্ছি।

পোস্টকার্ডখানি কামানের ওপর রেখে লিখতে গিয়েও কেন যেন পারলাম না। কামানটা বেইমানের। এ কথাটি বার বার মনে হতে লাগল। তাই সামনের দেয়ালের দিকে অগ্রসর হতে গেলাম, লোকটির গা ঘেঁষে।

লোকটি যেন একটু চমকে উঠেই, হাঁড়িটা সরিয়ে নিল। আমি তাকালাম। সে হাসল। বলল, সাবধানের তো মার নাই বাবু, কার নসিবে কখন কী থাকে, তা কি বলা যায়?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন বলুন তো?

সে বলল, না ভয় কিছু নয়। এই হাঁড়িটার কথা বলছি। মুখ আমি সরা দিয়ে ঢেকে রেখেছি। গামছা দিয়ে বেঁধেছি। তা ছাড়া আসল বস্তুটি আছেন আমার কাছে। কোনও ভয় নাই।

কী আছে আপনার ওই হাঁড়িতে?

–একখানা কালী গোখরো বাবু।

আমার গাটা যেন কেমন করে উঠল। আমি বললাম, কালী গোখরো?

–হ্যাঁ বাবু। খবর ছিল কিনা কাল রাতে, ওই গঙ্গার ওপারে এক গাঁয়ে। বাইরের থেকে উনি একজনের ঘরে গিয়ে বসেছিলেন। সারারাত এয়াঁর সঙ্গে ঝুটোপুটি লড়াই গেছে বাবু। তবে মা ধরা দিলেন ভোরবেলা। এই ধরে নিয়া আসছি। বিষ ঝাড়াই না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস নাই। তাই সাবধান হলাম একটু।

ইতিমধ্যে জাদুঘরে যাবার তাড়া দিল বন্ধুরা। যদিও তারাও লোকটির সঙ্গে আলাপে ভিড়ে পড়েছিল।

লোকটি বলল, নিন, ঠিকানাটা লিখে দিন বাবু একটু কষ্ট করে। লিখুন জনাব ইদ্রিস শেখ। গ্রাম। পোস্ট অফিস জেলা।

লিখতে লিখতেও আমার মনটা কালী গোখরোর দিকেই চলে গেছে। ঠিকানা লিখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সাপ ধরেন বুঝি?

সে বলল, সব সময় নয় বাবু। এক গুরুর সঙ্গ করেছিলাম, বিদ্যেখানি জানা আছে। তা বাবু। বিদ্যের কথায় না আছে, যত করিবে দান তত যাবে বেড়ে? মানুষের বিপদ-আপদের কথা শুনলে তো চুপ করে থাকা যায় না। থাকা যায় কি বাবু?

বললাম, না। কিন্তু আমি আপনার কালী গোখরো দেখব।

–দেখবেন বাবু?

–হ্যাঁ, দেখান না একটু।

 –হাজারবার দেখাব বাবু আপনাকে।

 বলেই সে যেন কেমন মুগ্ধ স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে তাকাল আমার দিকে। বলল, বাবু, একটা কথা বলব?

আমার যেমন মন ঠিক সেই ভেবেই পকেটে হাত দিলাম। পয়সা, নিশ্চয় পয়সা। বললাম, বলুন।

 সে বলল, আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে বাবু।

আমি মুঠো করে পয়সা তুললাম, যাতে সে দেখতে না পায়। কিন্তু সেও পকেট থেকে একটি সরু গাছের ডাল বার করল। বলল, বাবু, এটা আপনাকে দিলাম, আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে।

–এটা কী?

ইনিই সব বাবু। সংসারে মনসার ভয়টা বাবু ছোট মনে করবেন না। কিন্তু এটি সঙ্গে থাকলে, আপনার কোনও ভয় নাই। এটি রাখেন আপনি বাবু, আপনাকে দিলাম। মনসা আপনার কখনও কিছুটি করতে পারবে না। খালি একটি কথা বাবু, মনে করে রাখবেন, বুঝলেন?

কী?

–সেটা হল কি বাবু, সব জীবের একটি জীবধর্ম আছে তো? আছে না বাবু?

 —-আছে।

মা মনসারও জীবধর্ম আছে। সেইটে মনে রাখবেন, ওয়াঁর জীবধর্মের বেলায় ও ওষুধটি আপনি কাজে লাগাবেন না। তা হলে জীবের দুঃখু হয়। হয় না বাবু?

–হ্যাঁ, হয়।

তাই বলছিলাম কী যে, যেখানেই মনসা বিপদ ঘটাবেন, সব জায়গায় আপনি যেতে পারবেন। কিন্তু ধর্ম বজায় রেখে যাবেন বাবু। এ ওষুধ সঙ্গে নিয়ে যাবেন, রুগিকে ছোঁয়াবেন, বেটে খাওয়াতেও পারেন। বিশ্বাস অবিশ্বাস বাবু আপনার হাতে। আর একটা কথা বলি বাবু?

বলুন।

–বিপদের কথা শুনলে যাবেন না। ডাকলে যাবেন। আপনার মা আছেন বাবু?

—আছেন।

-মায়ের হাতে একটু দুধ খেয়ে যাবেন।

যদিও মনসা নিয়ে আমার মনে কোনও কুসংস্কার নেই, সাপকে আমি সাপের মতোই হিংস্র দেখি। তবু লোকটির কথার মধ্যে যেন একটি জাদু ছিল। অবিশ্বাস করেও, তাকে আমি বিদ্রূপ করতে পারলাম না। তার কথার মধ্যে যেন কী ছিল।

দুধ খাওয়ার কথায় আমি বললাম, কেন?

সে বলল, বাবু, মায়ের বাড়া কে আছেন সংসারে। তাঁর হাতের দুধ খেলে বাবু সব লড়াইয়ে জয় হয়। এটা জানবেন।

জাদুঘরের টানটা ভুলতে পারছিলাম না। কিন্তু চলেই বা যাই কেমন করে? আমার মন তো মানে না। কারণ লোকটি দু চোখ মেলে যে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বললাম, এই ওষুধের জন্য আপনাকে কী দিতে হবে?

সে মস্ত বড় জিভ বার করে হাসল। বলল, আরে বাবা! কী বলেন বাবু। অমন পাপ কখনও করতে আছে? ওটা আমাদের সাপুড়ে ধর্মে বারণ। ও বিষহরির দান। ও কি কিছু দিয়ে পাওয়া যায় বাবু? আপনাকে আমি দিলাম। আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে বাবু।

কেন? মুর্শিদাবাদের এ ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসা অনেক মানুষের মধ্যে, আমাকেই কেন ভাল লাগল? কিন্তু সেকথা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।

লোকটি নিজেই তাড়াতাড়ি বলল, যান বাবু, জাদুঘর দেখে আসেন। সিরাজের তলোয়ারখানা দেখবেন বাবু। আলিবর্দির চারনলা পিস্তল দেখতে চাইবেন কিন্তু।

তা তো দেখবই। কিন্তু লোকটি শুধু দান করেই চলে যাবে। বললাম, আপনি কালী গোখরো দেখালেন না তো?

অমায়িক হেসে বলল, জাদুঘর দেখে আসেন বাবু, কালী-গোখরো আপনাকে না দেখিয়ে বাড়ি যাব না। আমি থাকব আপনার জন্য।

মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। হয়তো লোকটি এখনও কিছুই খায়নি। তার মুখটি কেমন করুণ দেখাচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসা তার চোখের মধ্যে আমি যেন একটি লুকোনো কান্না দেখতে পেলাম। কেন, কে জানে। আমাকে যেন সে কেমন একটি বেদনাদায়ক সম্মোহনে বেঁধে ফেললে।

বললাম, না না, আপনি কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন। আপনি

সে বলল, বাবু, বাড়ি আমার কাছেই। যখন খুশি যেতে পারব। আপনি ঘুরে আসেন। একটু এদিক ওদিক যেতে পারি। এখানকার কাউকে জিজ্ঞেস করবেন, দুলাল আলি কোথা গেল, বলে দেবে।

দুলাল আলি?

–হ্যাঁ বাবু। আমার নাম।

 যেন মিলিত হিন্দু মুসলমানের নাম বলে আমার মনে হল। বললাম, এমন নাম তো কখনও শুনিনি।

দুলাল আলি হাসল। বলল, আমার বড় ভায়ের নাম কালআলি। আমরা দু’ভাই। বাবার নাম কেষ্টআলি। তবে জাদুঘর থেকে বেরিয়ে যদি কাউকে আমার কথা জিজ্ঞেস করেন, সে যদি বলে, কোন দুলাল আলি যে গান গায়?’ তবে বলবেন, হ্যাঁ।

দুলালের ভাসা ভাসা চোখ দুটিতে লজ্জা চাপতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, গান জানেন বুঝি আপনি?

দুলাল বলল, বলতে লজ্জা করে বাবু। কিছু মনে যেন করবেন না। আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে। আপনাকে যদি সময় থাকে, তবে আপনাকে একখানি গান শোনাব বাবু। শুনবেন তো?

আমি বললাম, নিশ্চয়; আপনি বসুন তা হলে, আমি ঘুরে আসছি।

হাঁ বাবু যান, ঘুরে দেখে আসেন। আর মোহনলালের তলোয়ারখানিও দেখে আসবেন বাবু। বললে দেখাবে, না বললে হবে না। মোহনলালের তলোয়ার না দেখলে, জীবন বেরথা বাবু।

দুলাল আলি সত্যি জাদু করল। তাকে পিছনে রেখে দিয়ে জাদুঘরের টান কমে গেল আমার। যদিও তার কথা অনুযায়ী সব জিনিসই দেখলাম। কিন্তু আলিবর্দি, সিরাজ, মোহনলাল, মিরজাফর, ক্লাইভ আজ থাক। প্রায় দেড়ঘণ্টা পরে, প্রাসাদ ঘুরে যখন বাইরে এলাম, ভাবলাম, দুলাল আলি এতক্ষণ নিশ্চয় চলে গিয়েছে।

কিন্তু সে একটি বেঞ্চিতে শুয়ে ছিল। যেন আমার পায়ের শব্দ চিনে ফেলছিল। উঠে বসে, সেই মনোহরণ হাসিটি হাসলে। বললে, দেখলেন বাবু?

–হ্যাঁ।

এবার কোথায় যাবেন?

আপনার গান শুনব, আপনার কালীগোখরো দেখব।

দুলাল আলি হেসে বলল, চলেন তা হলে ওই মাঠের মাঝখানটিতে গিয়ে বসি।

বন্ধুদের সঙ্গে দুলালকে নিয়ে গঙ্গার ধার ঘেঁষে মাঠে গিয়ে বসলাম।

দুলাল বলল, আগে গেয়ে নিই বাবু, কেমন? ইচ্ছে বাবু অনেক ছিল। রাত পোহালে পেটের চিন্তা, তাই ওস্তাদের ঘর করেও গানের লাইনে যেতে পারলাম না। যাই হোক, শোনেন।

ভৈরবী সুরে একটি প্রেমের গান গাইল সে।

আমি ছাড়িতে পারি না
এ বড় বেদনা।
সখি তোমারো যাতনা
রাখিতে পার না
হৃদয় বড় অকুলানো হে।

গানের শেষে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, বিয়ে করেছেন?

 দুলাল সলজ্জ হেসে বলল, বাবু অন্যায় করেছি, মন মানেনি, তাই দু’সন হল ও আকামখানি করেছি।

–আকাম কেন?

–আকাম নয় বাবু? কাল রাতে তাঁকে কাঁদিয়ে বেরিয়েছি। এখনও তার চুলোয় কাঠ পড়েনি।

বলতে বলতেই সে হাঁড়ির নতুন গামছা খুলে, সরা তুলে নিল। মুহূর্তে যেন একটি কালো কুচকুচে আগুনের শিখা ফুঁসে উঠল। কালী গোখরোই বটে। আমরা সবাই প্রায় লাফ দিয়ে সরে গেলাম।

দুলাল চিৎকার করে বলল, আইরে মা মনসা, অমন করিস কেন লো?

বলে সরা দিয়ে সাপের মাথাটি নামিয়ে দিল। সাপটি মাথা নামিয়ে নিল হাঁড়ির মধ্যে। তারপরে আমার দিকে ফিরে, প্রায় মধুর স্বরে ডাকল, আসেন বাবু, আপনি আসেন।

আমার সারা গায়ে যেন কালো কুচকুচে সাপটার স্পর্শ লাগছিল। আমি বললাম, থাক না, এখানেই তো বেশ আছি।

দুলালের দু চোখে সম্মোহন। তার সেই ভাসাভাসা চোখ দুটিতে জাদু ফুটিয়ে বলল, কোনও ভয় নাই আমার বাবুর। আমি আছি না? আসেন।

গেলাম পায়ে পায়ে। সে তার পাশটি দেখিয়ে বলল, বসেন আমার কাছে। আমি তার গা ঘেঁষে। বসলাম। দুলাল প্রায় আমার কানে কানে বলল, বাবু, আপনাকে আমার বড় ভাল লেগেছে। আমি আপনাকে আর একটি দ্রব্য দেব। আপনি নেবেন তো?

-কী দ্রব্য?

–নেবেন তো?

নেব।

তখন দুলাল তার পকেট থেকে ছোট একটি থলি বার করে, তার ভিতর থেকে যেন কী একটি জিনিস খুঁটে বার করল। বলল, হাত পাতেন বাবু।

হাত পাতলাম। সে আমার হাতে কী একটি জিনিস দিয়ে বলল, একবার দেখে মুঠ করেন।

দেখলাম। বুঝলাম না কিছুই। অতি ক্ষুদ্র একটি জিনিস। জিজ্ঞেস করলাম, কী এটা?

দুলাল বলল, দেখতে কেমন জিনিসটি দেখেছেন বাবু? শিবলিঙ্গের মতন নয়?

দেখলাম, সত্যি তাই। প্রায় হুবহু একটি খুব ছোট, শিবলিঙ্গেরই মতো জিনিসটি। কিন্তু পাথর নয়, কোনও ধাতু নয়, মাটি নয়। এটা কী?

দুলাল বলল, বাবু এটি শিবফল। এর নাম শিবফল। অর্জুনের ফুলের ভিতরে ইনি থাকেন। এ পাওয়া কঠিন। সব সাপুড়ের কাছে যাবেন না। মনসার অব্যর্থ ওষুধ, এর ওপরে আর কিছু নাই জানবেন। কিন্তু এর একটা নিয়ম আছে বাবু, সেটা দয়া করে, কষ্ট করে মানবেন। মানবেন তো বাবু?

কী সেটা?

–মা মনসার একটু পুজো দেবেন বাবু। মনে যা-ই থাক, এক বারটি ডেকে একটু পুজো দেবেন। বলবেন, তুমি আমায় দিয়েছ, আমি তোমাকে দিলাম। তোমার আমার এই রফা।

বলেই সে হাঁড়িতে একটা খোঁচা দিল। আবার সেই কালো আগুনের শিখা ফুঁসে লকলকিয়ে উঠল আমার বুক পার হয়ে।

আমি সরে যাচ্ছিলাম। দুলাল বলল, যাবেন না বাবু, একটুখানি পেত্যয় করেন। এই নাগিনীর মাথায় আপনি শিবফলের হাত রাখেন।

আমার বুকের রক্ত তখন হিম। গলা শুকিয়ে কাঠ। বললাম, পারব না ভাই।

–পারবেন বাবু। আপনি আমার বাবু, আমি আছি না? আপনাকে যে জিনিস দিয়েছি, আপনার কোনও ভয় নাই। বিষ দাঁত ওর ভাঙা হয় নাই বাবু, ওর জিভে বিষ আছে। তবু বলি, আপনি হাতখানি রাখেন ওঁয়ার মাথায়। একবার দেখেন।

আমি দুলালের চোখের দিকে তাকালাম। সেই সম্মোহনের হাসি। আমি হাত এগিয়ে নিয়ে গেলাম সেই উদ্যত, সদ্যধরা কালী গোখরোর মাথায়। স্পর্শ করলাম। আর মনে হল আমার শিরদাঁড়ায় যেন কিলবিলিয়ে কিছু নামছে।

দুলাল বলল, দেখেন বাবু।

দেখলাম সাপটি ফণা গুটিয়ে হাঁড়িতে নামছে। দুলাল আমার হাতটি ধরে, হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে, চেপে ধরল একেবারে সাপটির মাথায়। প্রায় যেন চুপিচুপি বলল, কোনও ভয় নাই। কোনও ভয় নাই। আপনি বলেন, বলেন, আমার হাতে কী আছে, তুমি দেখ।’ বলেন বাবু।

আমি বললাম।

দুলাল আবার বলল, বলেন, মা, আমি তোর পুজো দেব।’

তখন আমার হাতের তলায় কালী গোখরো কিলবিল করছে। আমি বললাম।

দুলাল বলল,বাবু, কোনও ভয় নাই। একটা নিয়ম হল পুজোর কথাটি বলতে হয়। কত পুজো দেব, সেটাও মাকে বলে দেন। যা আপনার মন চায়। এক পয়সা, দু পয়সা, যা মন চায়।

কেন জানি না; তখন আমার মনটা কেন যেন নিঃশঙ্ক হয়ে গেছে অনেকখানি। বললাম টাকা দেড়েক দেব।

দুলালের ভাসা ভাসা চোখ দুটি হাসিতে ভরে উঠল। বলল, জানি আমি, বাবুর আমার দিল অনেক বড়।

আমি হাত তুলে নিলাম। আমর বন্ধুরা উৎকণ্ঠিতভাবেই হাসছিল। আমি দুলালের চোখের দিকে তাকালাম। আমি দেখলাম আমার সামনে এক অসামান্য শিল্পী। এক আশ্চর্য কথার জাদুকর। কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকের ঘরে বসে ওই কথাশিল্পী কোনওদিন তার বইয়ের সংস্করণের হিসেব করবে না। কিন্তু চিরদিন মনোহরণ করবে। এমন অধ্যবসায় আমরা কতটুকু দেখেছি। বেইমানের কামান দিয়ে দুলাল শুরু করেছিল, এখন দেখলাম, দুলালের চোখের ওপরে এক অসহায় আর্ত ক্ষুধার্ত শিল্পীকে।

বললাম, পুজো আর কে দেবে? টাকাটা আপনি নিন, আপনি পুজো দেবেন। দুলালের দুটি ভাসা-চোখে অপার আলো। বলল, আপনি বললে তো আমি না করতে পারব না বাবু।

টাকা দেড়টি তার হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় হলাম। আমি জানি বুদ্ধির দরবারে আমি একটু ইমোশনাল। দুলালের হাসিটি তখন প্রায় কান্নায় রূপান্তরিত হচ্ছে এবার যে তার ঘরের চুলোয় আগুন জ্বলবে, সেই জন্যে।

আমার বন্ধুরা আমাকে অনুসরণ করল। একটু দূরেই লুঙ্গি পরে খালি গায়ে একটি লোক দাঁড়িয়েছিল। দেখলাম তার মুখে বাঁকা হাসি, চোখে বিদ্রূপ। সে বলল, দুলালের মনসার পুজো দিলেন বাবু?

-হ্যাঁ।

–আর বললে বুঝি, সদ্য ধরে নিয়ে আসা বিষদাঁতওয়ালা কালী গোখরো?

–হ্যাঁ।

–শালা, সেই বুড়ি সাপটা দেখিয়ে চিরদিন এক খেলাই দেখিয়ে গেল। জমি নেই, জিরেত নেই, এখন ওই হয়েছে পেশা!

আমরা লোকটার কাছ থেকে সরে গেলাম। জমি নেই, জিরেত নেই, তাই দুলাল এখন কথার জাদুকর। দুলালকে আমি শিল্পী বলেই জানি। আর এই ভূমিহীন কৃষক দুলালকে দিয়ে আমি আজ নতুন করে উপরাষ্ট্রপতির বাণীর সারমর্মটুকু বুঝলাম, আমাদের দেশের সংকট বাইরে নয়, ভিতরেই।

হ্যাঁ ভিতরেই, এমন কী আমাদের এই বাংলার ভিতরেও; এই দুলালের মতো মানুষেরা যখন আছে।

জীবিকা

জীবিকা

জীবিকা

ঘটনাটা বাস্তব। তবু গল্প করেই বলা যাক।

.

দৃশ্যটি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য নয়। মেয়েটি অন্ধকার মাঠের উপর দিয়ে চলেছে, এবং বুকের উপর আঁচল ঢাকা আড়ালে, ডান হাতে যেটি মুঠি পাকিয়ে ধরে আছে, সেটি একটি জীবন্ত সাপের মাথা। মাথা নয়, গলার কাছে ধরে আছে। অন্ধকারেও, সাপের কালো চকচকে রং দেখে বোঝা যায়, ভয়ংকর কালী গোখরো। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। স্ফীত নাসারন্ধ্রের নীচেই, তার চেরা জিব চিকুর হানার মতো লকলক করে।

মেয়েটির হাতে একটা প্যাঁচ দিয়ে, বাকি অংশটা ডানার নীচে দিয়ে, পিঠে বেয়ে কোমর জড়িয়ে আছে। যেমন করে আলগা কষি চেপে ধরে রাখা হয়, মেয়েটি সেই ভাবেই নাভির কাছে বাঁ হাত দিয়ে সাপের ল্যাজের অংশ ধরে আছে। মাঝে মাঝে গায়ের কাপড় খুলে পড়ায়, বাঁ হাত দিয়ে মেয়েটি কোমরসুদ্ধ গা ঢেকে নিচ্ছে। যেন সে সাপটাকে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যাতে কেউ দেখতে না পায়। এমনকী, সাপটা থেকে থেকে ফোঁস ফোঁস করে উঠলে, সে হাতের ঝাপটা দিচ্ছে আর ধমকের সুরে শব্দ করছে, আহ, চুপ।

মেয়েটির গায়ে জামা নেই। একটা সস্তা দামের ডুরে শাড়ি ছাড়া গোটা গায়েই কিছু নেই। বয়স সম্ভবত বাইশ-চব্বিশের বেশি নয়। আপাতদৃষ্টিতে, দুদিন আগে বাঁধা রুক্ষু খোঁপায় ময়লা কাপড়ে শুকনো মুখে যতটা দুর্ভাগ্য ফুটে উঠেছে, ওর শক্ত উদ্ধত শরীর যেন ঠিক সেই দুর্ভাগ্যকে মেনে নিতে পারেনি। তেলে জলে চিকন চাকন না হলেও, ওর ধুলা রুক্ষু শরীরে একটা দীপ্তি আছে। সধবার চিহ্ন আছে ওর সিথেয়। বাসি সিঁদুরের দাগ তেমন উজ্জ্বল নয়। কপালের ফোঁটা প্রায় মুছেই গিয়েছে। আভাস লক্ষিত হয় মাত্র। হাতে লোহা আর একগাছা কাচের চুড়ি। অলংকারের মধ্যে, আর আছে একমাত্র কাঁচ বসানো একটি পিতলের নাকছাবি। চোখা নয়, বোঁচা হলেও নাকছাবিটা যেন ওর নাকে হিরার চেয়ে দামি হয়ে উঠেছে। কারণ ওর বোঁচা বোঁচা নাকখানিকে ওতেই যেন শাণিত করেছে। ডাগর ভাসা ভাসা চোখ, কালো মেয়ে। বাংলা দেশের গাঁয়ে ঘরে দুর্দশাগ্রস্ত আর দশটা মেয়েকে যেমন পথে ঘাটে দেখা যায়।

চৈত্র মাস। মাঠের হাওয়ায় একটা শন শন শব্দ বাজে। বর্ধমানের এই দুর গ্রাম সীমার মাঠে, চৈত্রের হাওয়ায় বেশ গা জুড়োনো আমেজ। এমনকী, একটু বা শীত শীতও লাগে। ধান কাটার পরে, এখন অনেক মাঠই এরকম শূন্য। বৃষ্টির তৃষ্ণায়, দিনে দিনে মাঠ শত মুখ খুলছে। চারদিকে ফাটাফুটি বাড়ছে। আকাশ পরিষ্কার। তারাগুলোকে দেখে মনে হয়, নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। অন্ধকার, তাই, দিনের বেলা হলে দেখা যেত মাটি ধুলা ভারী, মেয়েটির পায়ে পায়ে উড়ছে।

মেয়েটি যে মাঠ ভেঙে আসছে, তার পিছনে একটা গ্রাম অন্ধকারের মধ্যে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। সামনে আর একটা গ্রাম ক্ৰমে স্পষ্ট হচ্ছে। সামনের গ্রামে, কোথায় যেন একটা আলো দেখা যায়। একটা কুকুর দূর থেকে অনবরত ডাকছে। কিন্তু অন্য কোনও কুকুর সাড়া দিচ্ছে না।

মেয়েটির দৃষ্টি ইতিউতি, ত্রাসে চমকানো। যেন ও কিছু চুরি করে নিয়ে চলেছে। দূরের এদিকে ওদিকে বারে বারে চায়, যেন কেউ দেখতে না পায়। কালী গোখবোর মাথাটা প্রায় ওর বুকের কাছে, আঁচলের মধ্যে। চেরা জিভ প্রায়ই ওর কোমল উদ্ধত বুকে চেটে দিচ্ছে। তাতে মেয়েটির কোনও বিকার নেই। কিন্তু সাপটা যখনই, মেয়েটির হাতের মুঠির মধ্যে ফুলে ফুলে ঠেলে উঠতে চাইছে বা ফোঁস ফোঁস করে উঠছে, মেয়েটি তখনই জোরে টিপে ঝাঁকুনি দেয়, আর রুখে বলে, দেখবি, দেব দু ঘা।

সাপটা, ভীষণ কালী গোখরোটা এ সব কথা বোঝে কিনা কে জানে, তবে ধমক বা ঝাঁকুনি খেলেই শান্ত হয়ে যায়।

এবার মাঠের শেষ, সামনে একটা খালের মতো। জল নেই, শুকনো খাল বলা যায়। অনেকটা শুকনো নয়ানজুলির মতো। এপারে ওপারে কোমর সমান বাবলার জঙ্গল। মেয়েটি এখানে একবার থমকে দাঁড়ায়। ওপারের গ্রামটার দিকে তাকায়।

দূর থেকে যে আলোটা দেখা যাচ্ছিল, সেটা এখন আরও স্পষ্ট দেখা যায়। এই মাঠের দিকে মুখ করা একটা ঘরের নিচু দাওয়ায় আলোটা রয়েছে। আলোর কাছে, অস্পষ্ট হলেও একজন মানুষ দেখা যায়। একটু বোঝা যায় না। কথা বললেও এতদূর থেকে শোনবার উপায় নেই। বাড়িটার সামনে পুকুর, পুকুরের পরে পোড়ো জমি। গুটিকয় গাছ। তারপরে একটা ছোট মাঠ এই খাল ধারে এসে ঠেকেছে।

মেয়েটির ডাইনে পুকুর এবং আলো। ও বাঁয়ে তাকাল। সামনে গ্রামের প্রান্তে বাঁশঝাড় এবং একটা মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। মেয়েটির চোখে চকিত চিন্তা দেখা গেল। তার পরেই যেন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবলাবন দিয়ে কাঁটা বাঁচিয়ে নেমে গেল। শুকনো খাল পার হয়ে, মাথা নিচু করে, হনহনিয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। বাঁশঝাড়ের কাছে, মন্দিরের আড়ালে ও একটু দাঁড়াল। বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে একটা কুপির শিখা দেখতে পেল।

কুপিটা জ্বলছে, মাটির দেয়ালের গায়ে একটা জানালায়। এমনকী সেখান থেকে রান্নার ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দও পাওয়া যায়। ওটা কোনও বাড়ির রান্নাঘর। অন্য কোথাও, কাছেই কে যেন খুঞ্জনি বাজিয়ে অনেকটা ঘুম ঘোরে ঢুলে ঢুলে, অস্পষ্ট স্বরে গান করছে। গানের কথা বোঝা যায় না।

মেয়েটি ঠোঁটে ঠোঁট টিপল। বুকের কাছে ধরা কালী গোখরাকে দুবার ঝাঁকুনি দিল। চোখ ঘুরিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর মন্দিরের আড়াল থেকে বেরিয়ে, বাঁশঝাড়ের বাঁ দিক ঘুরে একটা ছোট পুকুরের ধারে এল। পুকুরটাকে ঘিরে গুটিকয় বাড়ি। বোঝা যায়, পুকুরটি কয়েকটি বাড়িরই খিড়কির দিকে পড়েছে। সব বাড়িগুলোতেই, কান পাতলে মেয়ে পুরুষ শিশুর গলা শোনা যায়। মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সব বাড়ির খিড়কি দরজাই বন্ধ। বর্ধমানে খিড়কিকে নাচ দুয়ার বলে।

মেয়েটি তাড়াতাড়ি হেঁটে, পাঁচিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। জঙ্গল সর্বত্রই। বাবলা বা আসশ্যাওড়া। লুকোবার অসুবিধা নেই। মেয়েটি পাঁচিলের ধার দিয়ে যেতে যেতে, তৃতীয় বাড়িটির সামনে দাঁড়াল। যেখানে দাঁড়াল সেখানে পাঁচিল নিচু, ভিতরের উঠোন দেখা যায়। উঠোনেরই এক পাশে মরাইয়ের পাশেই উঁচু দাওয়ায় একজন মধ্যবয়েসি পুরুষ বসে আছেন। সামনে হ্যারিকেন জ্বলছে। একটি ছোট ছেলে বই সামনে নিয়ে পড়ছে।

মেয়েটি কালী গোখবোর মাথাটি মুখের কাছে তুলে নিয়ে এল। চুপিচুপি বলল, এখানে দিয়ে যাচ্ছি, কেমন?

সাপটা চেরা জিভ দিয়ে মেয়েটির মুখে বুলিয়ে দিল। মেয়েটি বলল, নককি সোনা আমার।

বলে কোমরের পাঁচ খুলে, ল্যাজ ধরে সাপটাকে ঝুলিয়ে দিল। তারপর দড়ির মতো ধরে পাঁচিল টপকে ফেলে দিল। দিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়াল।

ছেলেটি পড়ছে। মাঝবয়সি লোকটি ঝিমোচ্ছে। রান্নাঘরে বউ ঝিদের গলা শোনা যাচ্ছে। মেয়েটি পিছন ফিরে যে পথে যেভাবে এসেছিল, সেই পথে সেইভাবেই ফিরে গেল।

ঘণ্টাখানেক পরের ঘটনা। শশীকান্ত বাঁড়ুজ্জে আঁতকে ওঠেন। সবেমাত্র খেয়েদেয়ে একটু দাওয়ায় বসেছেন। ছেলেটি পড়াশুনো করে খেয়ে শুতে গিয়েছে। ওঁর সামনে হ্যারিকেনের আলোয় তিনি দেখতে পেলেন, তাঁর হাত তিনেক দূর দিয়ে, কালান্তক যমের মতো একটি সুদীর্ঘ কালো সাপ ঘরের দিকে যাচ্ছে। তিনি লাফ দিয়ে উঠোনে পড়েই চিৎকার দিলেন, ওরে খেলে রে। খেলে রে। এ যে মস্ত কালী গোখরো।

সঙ্গে সঙ্গে একটা হইচই। ঘরের ভিতর থেকে ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে এল। বাড়ির লোক সব উঠোনে জড়ো হয়ে চিৎকার আরম্ভ করল। আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও ছুটে এল। সকলের হাতেই লাঠিসোঁটা বর্শা শাবল। যে যা পেয়েছে নিয়ে এসেছে।

সাপটা গোলমাল ও ছুটোছুটি দেখে, ফোঁস করে গর্জন করে ফণা তুলল। পঞ্চা বাউরি লাঠি তুলতেই, শশী বাঁড়ুজ্জে তার হাত চেপে ধরলেন। আরও সবাই বারণ করল, যেন হঠাৎ আঘাত করা না হয়। কারণ ঠিকমতো আঘাত না লাগলে, এ নাগ কার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলা যায় না।

বাড়ির মেয়েরা তো প্রায় কান্নাকাটিই শুরু করল। কী হবে এখন, কে জানে। সাপটা খানিকক্ষণ ফণা ধরে স্থির হয়ে রইল। লক্ষ তার হ্যারিকেনের দিকে। মারা হবে কি হবে না, এই তর্কে সবাই যখন ব্যস্ত, সহসা সাপটা ফণা গুটিয়ে, কিলবিল করে একেবারে চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকল।

সবাই আবার চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ঘরে যাবার সাহস কারুর হল না। তখন দুঃসাহসী পঞ্চা বাউরি লাফ দিয়ে দাওয়ায় উঠে ঘরের শিকল তুলে দিল। ঘরে কেউ ছিল না, অতএব কিছুটা নিশ্চিন্ত। কারণ ঘর থেকে সাপের বেরুবার আর কোনও রাস্তা নেই। দাওয়ার দিকে একটিমাত্র জানালা সেটাও বন্ধই ছিল। এখন ভাবনা হল, এ সাপের গতি কী করা যায়।

প্রথমে এটা বাস্তুসাপ কি না, এ সিদ্ধান্তে আসা গেল না। এবং ঘরে ঢুকে যাওয়ায় কেউই আর সাপ মারার সাহস পেল না। তখন পাশের গাঁয়ে হিদে মালকে খবর দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না। এ তল্লাটে হিদে মালই একমাত্র সাপুড়ে আছে। যে কোনও ভয়ংকর সাপ নাকি সে ধরতে পারে। কিন্তু এতবড় একটা কালী গোখরো চোখের সামনে দেখে, উত্তরের মাঠ ডিঙিয়ে, এই রাতের বেলায় কেউ হিদে মালকে ডাকতে যেতে চাইল না। সামান্য একটা ছায়া নড়ে উঠলেও, সবাই চমকে চমকে উঠছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

বাড়িতে আরও দুটি ঘর রয়েছে। সেই সব ঘরেও কেউ সাহস করে ঢুকতে চায় না। যতগুলো বাতি ছিল, সব জ্বালিয়ে শশীকান্ত বাঁড়ুজ্যের গোটা পরিবার প্রায় উঠোনে বসেই রাত কাটাবার মনস্থ করল।

ছোট ছেলেমেয়েদের ঘোষালদের পাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। একা একটি সাপেই গোটা বাড়িটাকে যেন শ্মশানের থেকে ভয়ংকর করে তুলল।

পরের দিন ভোরবেলা, কাক ডাকতে না ডাকতে পঞ্চা বাউরি, কার্তিক রাখালকে নিয়ে মাঠ পেরিয়ে চলে গেল হিদে মালকে ডাকতে। চৈত্রমাসের সকাল, দেখতে দেখতে রোদ উঠে যায়। রোদ ওঠার পর হিদে মাল এল। মাল বলতে অনেক সময় এ অঞ্চলে সাপুড়েই বোঝায়। তবে সাপে কাটলে এরা ওঝা ধন্বন্তরীর কাজও করে। হিদে, অর্থাৎ হৃদয় মালর এ অঞ্চলে বেশ সুনাম আছে। হিদে মাল এসে উঠোনে দাঁড়াল। বৃত্তান্ত সব শুনল। কালো কুচকুচে হিদে মালর বয়স বছর তিরিশের কাছাকাছি। এক মাথা রুক্ষু চুল। মোটা ঠোঁটগুলো ফাটা ফাটা। খালি গা। পরনে একটা ময়লা ছোট কাপড়। গোটা গায়ে খড়ি উঠেছে। যেন পেটে দানা নেই, রাতে ঘুম নেই। হাতে একটি দু হাত পরিমাণ সরু গাছের ডাল। ডালটির সামনের দিকে মুখ বিভক্ত। অনেকটা গুলতি কাঠের মতো।

সব শুনে, সবাইকে দূরে সরিয়ে দিল। বাঁড়ুজ্যে মশাইকে ডেকে বলল, একটা ধোয়া পাত্রে পোটাক কাঁচা দুধ দিতে বলেন।

সকাল বেলা কাঁচা দুধের অভাব নেই। দুধ এল। হিদে মাল দুধ সামনে নিয়ে কী সব বিড়বড় করল। তারপরে দুধের ঘটি আলগা করে ধরে, ঢক ঢক করে সব দুধটুকু খেয়ে নিল। নিয়ে দাওয়ায় উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে বলল, দ্যাখ মা, তোর কাজ তুই করবি, আমার কাজ আমি। ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করা, এখানে তোমার থাকা চলবে না। পেটে আমার মায়ের দুধ।

বলেই সে ঝনাৎ করে শিকল খুলে ফেলল। উঠোনে আতঙ্কগ্রস্তদের ভিড়। শিকল খুলে ফেলতেই কেউ কেউ পিছিয়ে গেল। আর তখনই সবাই শুনতে পেল, ঘরের মধ্যে হিল হিল শব্দ হচ্ছে।

হিদে মাল আগে গাছের ডালটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, নিচু হয়ে বসল। বসে, হামা দিয়ে সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল, ফোঁস ফোঁস করলে হবে কী, তোমার জায়গা অন্যত্তর মা।

বলে সে চিৎকার করে জানালে। ওই গো বাবু। এ যে পেকাণ্ড একটা কালী গোখরো, এ যে গোটা গাঁ সুদ্ধ খেয়ে ফেলতে পারে।

উঠোনের সব থর থর করে কাঁপছে। হিদে মালের গলা আবার শোনা গেল, তাড়াতাড়ি একটা নয়া হাঁড়ি সরা আনতে বলেন বাবু, আর একখানা নয়া গামছা।

তৎক্ষণাৎ হুকুম হয়ে গেল। কয়েকজন ছুটল হাঁড়ি সরা গামছা সংগ্রহে।

এ বিবরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। সবাই সভয়ে দেখল, প্রায় ঘণ্টাদেড়েকের চেষ্টায় হিদে মাল কালী গোখরোকে প্রথমে ঘরের বাইরে ধাওয়া করে নিয়ে এল। নিয়ে আসতেই সবাই যখন সেই গোখরো দেখে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল, হিদে মাল তখনই তার ল্যেজ চেপে একেবারে উঁচু করে ধরল। কিন্তু সাপের ফোঁসানি যায় না, সে কোমর বেঁকিয়ে উঠতে চায়। হিদে মালর সর্বাঙ্গে দরদর ঘাম তার চোখ দুটিও সাপের মতো দপদপ করে জ্বলছে। বলেন দ্যাখেন বাবু কত বড় সাপ। এর নিশ্বাসে বিষ।

শশী বাঁড়ুজ্যে হাঁকলেন, আর দেখবার দরকার নেই, তুমি তাড়াতাড়ি ওটা হাঁড়িতে পুরে ফ্যালো।

হিদে সেই কালো নাগের সঙ্গে অনেক কথা বলে, ছড়া কেটে হাঁড়িতে পুরে সরা ঢাকা সুদ্ধ নতুন গামছা দিয়ে গোটা হাঁড়ি বেড়ে মুখ বেঁধে দিল।

তারপরে এল হিদে মালর জলখাবার। বাঁড়ুজ্যে মশাই দুপুরে খেয়ে যেতে বললেন। হিদে জানাল, খেয়ে আর যাব না বাবু মা মা ঠাকুরুনেরা যা ভাল মন্দ রান্না করবেন, সব পাতায় বেঁধে বাড়ি নিয়ে যাব। ঘরে আরও দুটো পেরাণী আছে তো।

অর্থাৎ ভাল মন্দ রান্নার পরিমাণ একটু বাড়িয়েই দিতে হবে। ঘরে আরও দুটি প্রাণীর উল্লেখ সেইজন্যেই। তা ছাড়াও, হিদে মাল বলতে ভুলল না, ঠাকুরমশাই, এ যা সাপ গো দেবতা, একটু ছুঁলে আর চোখ তাকাতে হত না আমার। দশটা টাকা দেবেন, আর একখানা ধুতি।

বাড়ুজ্যে মশাইয়ের কাছে সেটা একটু বেশি মনে হওয়াতে, তিনি নগদ পাঁচ টাকা আর ধুতিতে রাজি হয়ে গেলে। তবে ধুতিটা দিতে দু-একদিন দেরি হবে। এ ছাড়া নয়া গামছাটা তো মাল ভায়া পাবেই।

.

এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্তই। সাপের হাঁড়ি নিয়ে, উত্তরের মাঠ পেরিয়ে প্রায় পড়ন্ত বেলায় হিদে মাল ঘরে এসে পৌঁছল। গ্রামের প্রান্তে, ডোমপাড়ার কাছেই তার ঘর। সেখানে তার বউ স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করছিল। কোলে বছর তিনেকের বাচ্চা। স্বামীকে দেখেই বলল, এসেছ? ছেলেটা খিদেয় একেবারে নেতিয়ে পড়েছে।

হিদে বউকে বলল, তোর হাল তো তার চে ভাল নয় দেখছি। নে, হাঁড়িটা ধর!

 বলে সে সাপের হাঁড়িটা নিজেই নিয়ে ঘরে ঢোকে।

বউ সাপের হাঁড়ি রেখে, নতুন গামছাটা একবার দ্যাখে। ছেলেকে ঝাঁকিয়ে জাগায়, বলে, ওঠ সোনা দ্যাখ বাবা ভাত নিয়ে এসেছে।

বাপ আর ভাত শুনেই ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে তাকায়। তাকে বসিয়ে দিয়ে, বউ খাবারের হাঁড়ি খোলে। তা মন্দ না। প্রায় হাঁড়ি ভরতি ভাত আছে। মাটির ভাঁড়ে ডাল, অম্বল, নিরিমিষ কুমড়োর তরকারি। দু টুকরো চারা মাছের ঝাল। হাঁড়িটাকে জড়িয়ে যে কলাপাতা ছিল, তাই সাব্যস্ত করে পেতে, বউ ভাত বেড়ে দিল স্বামীকে আর ছেলেকে। ইতিমধ্যে হিদে বউয়ের তুলে রাখা জলে হাত মুখ ধুয়ে আসে।

হিদে মালের ঘরও সেইরকম। চালের খড় ঝুর ঝুর করছে। আকাশ দেখা যায়। দেয়ালের ফাটল, মাটি পড়েনি কতদিন। বাতাস দিলে ধুলা আসে ঘরে।

তা আসুক। হিদে মাল খায়। বউ গিয়ে নতুন গামছা বাঁধা হাঁড়িটা খোলে। সরা তুলতেই সাপ ফণা তুলে দাঁড়ায়। বউ ফণার নীচেয় ধরে। সাপটাকে গালের কাছে নিয়ে আসে। এখনও তার গায়ে সেই ডুরে শাড়িটাই আছে। সাপটা যেন তার জিভ দিয়ে চেটে চেটে দেখে নেয়, এ সেই কাল রাত্রের মানুষটিই কি না। যে তাকে বাঁড়ুজ্যেদের বাড়িতে পাঁচিলের পাশে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল।

বউ সাপটাকে বুকের কাছে নিয়ে এসে স্নেহ নিবিড় চোখে দ্যাখে। স্বামীর সামনে তার বুক খোলা। সাপ সেই বুকেও জিভ দিয়ে লেহন করে। নককি সোনা, আজ তোমাকে দুটো ইঁদুর ধরে দেব আমি, তুমি মেরে খেয়ো।

হিদে মাল ভাত চিবুতে চিবুতে এই দৃশ্য দেখে। বলে, বামুনকে ঠকিয়ে এলাম। তা কী করব। এক ফোঁটা জমি নাই। কাজ কাম পাই না। মা মনসায় পেট বাঁচায়।

তারপরে যেন হঠাৎ মনে পড়ে। কষি থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে বউকে বলে, নে রাখ ঠাকুর দিয়েছেন।

বউ সাপটিকে সরা ঢাকা দিয়ে রেখে, স্বামীর কাছে এসে নোটটি নিয়ে আঁচলে বাঁধে। বলে, তা হতে পারে পাপ। রাত করে যখন ছুটে যাই, পাপের কথা মনে থাকে না। ছেলেটাকে বাঁচাতে তখন তো।

হিদে মাল বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, নে, এখন আর চোখের জল ফেলিস না। দুটো খেয়ে নে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *