বাইরে

বাইরে

ভয় করে? না। আনন্দ হয়? না। রক্তের মধ্যে একটা ঘূর্ণি লাগে। মদের মতো, মদের নেশার মতো। রক্তের মধ্যে একটা ভয়ংকর দাপাদাপি শুরু হয়। যতক্ষণ হাসিটা বাজে, ততক্ষণ নয়। তারপরে। যখন হাসিটা থামে। গলগল করে হাঁড়িয়া গলায় ঢেলে দেবার পরে, একটু শ্বাসরুদ্ধ করে থাকা, একটু ঝিম মেরে থাকা, তিক্ত ঝাঁজ স্বাদটাকে একটু ধাতস্থ করে নেবার পরে যেমন হয়, সেইরকম।

তারপরে যেরকম পুবে ঝড়টা আসে ওই পুব-উত্তরের নীল গাই রং ভুটিয়া পাহাড়ের লাখ ভেরী বাজিয়ে। থালঝোরা অরণ্যের কোমরে একটা নিষ্ঠুর হ্যাঁচকা দিয়ে। আর এই গোটা আপার টুণ্ডু রেঞ্জের খয়ের-শিশু-শালের ঠোকাঠুকি দাপাদাপি গর্জন শুরু হয়, সেইরকম। সেই রকম, কিন্তু শব্দ নেই। সেই রকম, কিন্তু অবিচল স্থির।

হুঁ, আমার বুকটা জঙ্গল। বরহম ভাবে, আমার প্রাণটা, আমার মনটা জঙ্গল। আমি জঙ্গল। হুই উদলাঝোরা, হুই চাপরামারি, হুই নাগরাকাটা, হিলাঝোরা, টুণ্ডু আর পাংঝোরার উতরাইয়ের মাটি শিকড়ের থাবায় থাবায় জড়িয়ে-ধরা অন্ধকার জঙ্গলের মতো তার বুকটা। ঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষ্যাপা জঙ্গলের মতো। বুকের মধ্যে গর্জায় দাপায় নিঃশব্দে।

হাসিটা জানে, ওর লহরে ঝড় আছে। দাপানি আছে, গর্ভানি আছে। যে হাসে, সে জানে। সে এখনও হাসছে। সারিবদ্ধ পাঁচটি হাতির দু’নম্বরের পিঠে সে দুলছে, আর হাসছে। অবহেলায় পা ছড়িয়ে, হাতির পিঠে, হাতের ভর দিয়ে বসে আছে। যেন বিছানার ওপর বসে আছে এলিয়ে। সিথিটা তার বাঁকা। একটু সিঁদুর ছোঁয়ানো আছে সেখানে। নীল ডোরা শাড়িতে গাছকোমর বাঁধা। খাটো লাল জামাটা কোমর অবধি আসেনি। কাঁধ থেকে নামতে গিয়েই বোধহয় ফেটে গেছে। না কি জামাটাই ছেঁড়া পুরনো। নিটোল শক্ত হাতে গোছ গোছ রঙিন কাচের চুড়ি। নাকে একটি ঝুটো পাথর-বসানো পিতলের নাকছাবি। বয়সে আষাঢ়। কূলে কূলে প্রথম-চল-খাওয়া নদীর মতো। হাট করে গা খুলে না রাখতে পারলেও, পাঁচ নুড়ি নিয়ে, পাঁচ ফুল খেলতে বসলে বেমানান হত না। কিন্তু বাণ খেয়েছে রাঙি। রাঙি ওর নাম। সবাই ডাকে রাঙ্গি। বিশ্বরহস্যের প্রথম বাণ খেয়ে, ওই অচেতন হাসিটি হাসতে শিখেছে। পুরুষের দিকে তাকিয়ে।

লুঙ্গিটাকেই টেনে কাছা করতে গিয়ে যার লোমশ উরত খোলা, হাফ শার্ট গায়ে, অঙ্কুশ নিয়ে রাঙির হাতির কাঁধে বসা লোকটি রাঙির বর। নাম দুলাল।

দুলালের গা ঘেঁষে বসে আছে রাঙি। দুলালও ফিরে ফিরে দেখছে বরহমকে। কী যেন বলছে রাঙিকে দুর্বোধ্য ভাষায়। আর রাঙি, বিশাল পশুটার দোলায়িত পিঠের ওপর পা ছড়িয়ে, পিছন ফিরে বসে হাসছে। দুটো হাতির পিছনে, একলা বরহ। সবচেয়ে উঁচু শালের মাথায় হানা বিদ্যুতের মতো রাঙির চোখ হানছে বরহমকে।

হুঁ, আমি চালসার জঙ্গল। বাজ কেন জঙ্গল পোড়ায়, আমি জানি না। ভয় করে না। সুখ হয় না। হুই গরুবাথানের বুক গড়িয়ে যেমন লাখ ভালু’র তেড়ে আসা ঝড় নামে, তেমনি একটা মাতন লাগে বরহমের বুকে। তার মরতে ইচ্ছে করে। বলি দেবার কালে ঢাকের শেষ মাতনের কাঠি বাজে তার হৃৎপিণ্ডে। এটা যদি ভয়, তবে ভয়। এটা যদি সুখ, তবে সুখ।

আই, আমি একটা হটাবাহার মানুষ হে। এই পাঁচটা হাতির মতো, পিলখানার ছাপ মারা আমার সারা গায়ে। পাগলা হাতির মতো। এ চা-বাগানের দেশে আমাকে কেউ ঠাঁই দেবে না। দুটো পয়সা মজুরি বাড়াবার জেদ আমি সবার আগে করেছিলাম। ওই উঁচুতে চালোনির বাগানে। পাথর ভাঙে, আমার পিঠ ভাঙে না। কাঠ পোড়ে, আমার শরীর পোড়ে না। হাতি খ্যাদার মতো করে ধরেছিল আমাকে। মেরে ফেলে দিয়েছিল জঙ্গলের খাদে। তবু বাঁচতে দেখে, বাগান থেকে বাগানে হটাবাহার ঘোষণা করে দিয়েছিল। কোনও বাগান আর কাজ দেবে না। বরহম মুণ্ডা হটাবাহার। ফরেস্টের বাবু বলে, তুই হটাবাহার?’ হ। তবে কাজ নাই, বাগানের ম্যানেজার গোসা করবে। জঙ্গলের কাঠ কাটা ঠিকাদার জিজ্ঞেস করে, তুই হটাবাহার?’ হঁ৷ তবে কাজ নাই, তুই লোক ভাল না।

জঙ্গলটা অজগর। তার পাকে পাকে আমার মরণ দেখলাম। ওঝার কাজ করলে হীরালাল। আমার ধর্মবাপ। এক কুপ ওভারশিয়ার। কাঠ কাটা ঠিকাদার তার হুকুমে চলে। এ গাছ কেটো না। এ গাছ কাটো। সরকারের হুকুম তার মুখে। সে জঙ্গল চেনে। আট মাস কাজ, চার মাস বসা। বেতন পঞ্চাশ। কাজে ওভারশিয়ার। জাতে কোচ। তিনপুরুষের জঙ্গলে বাস। এখন এই চালসায় আছে কিছু ক্ষেত জমি। আর কিছু নেই। বউ ছিল একটি। কোন এক ভাটিয়ার (চাকুরিজীবী ও ব্যবসায়ী মধ্যবিত্ত বাঙালিকেই বোধহয় বোঝায়) সঙ্গে নাকি পালিয়ে গেছে। সে নিজে কখনও বলে না। লোকে বলে।

এই হীরালাল, বরহমের ধর্মবাপ।

হু, আমার ধর্মবাপ। যে জন্ম দেয়, তার চেয়ে বেশি। লোকটা হাঁড়িয়া না হলে থাকতে পারে না। পচুই ছাড়া চলে না। একটা ফোলা ফোলা মুখ। লাল লাল। কয়েক গাছি গোঁফ। তাও পাকা। ছোট ছোট দুটি চোখ, জ্বলজ্বল করে। চিতা বাঘের মতো ঘুরে বেড়ায় বনে বনে। সেই প্রথম চোখ তুলে তাকিয়েছিল, বরহমের দিকে। বলেছিল, হেই, তুই হটাবাহার?

–হুঁ।

বাগান কাজ দেয় না?

না।

–ফরেস্ট কাজ দেয় না?

না।

–ঠিকাদার?

না।

–বউ বাচ্চা আছে নাকি?

না, কিছু নাই।

–তুই হটাবাহার?

–হু।

–তুই আমার কাছ থাক। আমার ভাত খা। আমার কাপড় পর। আমার জোতজমি দ্যাখ, বসত কর। পেটভাতা পাবি। কী রে হটাবাহার, রাজি?

কোনও জবাব দিতে পারেনি বরহম। বাইরের লোকের কাছে সারা রাত মার-খাওয়া মোষ যেমন নিজের প্রভুর কাছে এসে দাঁড়ায় তেমনি করে দাঁড়িয়েছিল। সেই দিন সেই সময়েই মনে মনে বলেছিল, আমার ধর্মবাপ তুমি। আই বাপ, তুমিও কি একটা হটাবাহার? সে কোন বাগানের দুনিয়ায়? কোন বনের সংসার থেকে? আমি দেখলাম, তুমি যেন কীসের শোধ নিচ্ছ আমাকে ঠাঁই দিয়ে। প্রতিশোধ। হুঁ, তুমি রাজা হটাবাহার। এইটা জীবন।

হে মা, তোর গান আমার মনে পড়ে। তোর কথা আমার মনে পড়ে। আমার জন্ম দিয়েছিলি তুই। বিন্নাগুড়ির বাগানে। আমার মাতৃভূমি জঙ্গলের রূপকথা তুই শোনাতিস বাগানের পাতা টিপতে টিপতে; সে এক দেশ! অনেক অনেক দূর। অনেক উঁচু দান্তাবুরু, তার চেয়ে উঁচু ছাগুতুবুরুর (বুরু-পাহাড়) দেশ। বুরুগুলো সব আসমান-ছোঁয়া শাল-পিয়াল কুসুম-ছাওয়া আঁধার জঙ্গল। (ছোটনাগপুরের অরণ্য পর্বতময় অঞ্চল) লোকে বলে সরকারি বন। ছাগুতুর নীচে ছিল এক গাড়া (পাহাড়ি সরু নদী)। নাম তার রায়ুন গাড়া। তার জল ছিল অমৃতের মতো। হাতি, বাঘ, হরিণ, ময়ূর, মানুষমানুষী, সবাই আমরা খেতাম সেই জল। সেখানে আমার জন্ম। সেইখানে আমি প্রথম স্বপ্ন দেখি তোকে। কারণ সেখানে আমি বড় হয়েছি। সেইখানে প্রথম জোয়ান শুকরমকে দেখে আমি মেয়ে হয়েছি। কিন্তু শুকরমকে পেলাম না। এক বন থেকে আর-এক বনে এলাম। চা বাগানের কাজে। স্বপ্ন আমার ফলল, তোকে পেলাম। কিন্তু আমার জীবন বদলাল না। হেই আমার সোনা মাণিক,

নে জীবোন গাতিড
নে জীবোন কাহী নামোগা ॥

জীবন আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এ জীবোন আর বদল হবে না। কাক্সা পিতল ফোবঃ জান রে। কানসা পিতল বদল নামোগা। কাঁসা পিতল ভাঙলে, জানিস বদল করা যায়। নে জীবোন কাহী বদলাআে।

মায়ের মিঠে গলার গুনগুনানি বেজে উঠেছিল তার কানে। সে মনে মনে বলেছিল, হে মা, আমি তোমার পেট থেকে প্রথম হটাবাহার হয়েছি। আর এই আমার ধর্মবাপ। মন বলছে, যেন রাজা হটাবাহার। এর আর বুঝি কোনওদিন বদল হবে না।

আই, আমি একটা হটাবাহার মানুষ! আমার বুকে কেন দক্ষিণ বন হিলাঝোরার ঝড়? সকলের মাথা-ছাড়ানো শাল গাছটা কি আমি? হাতি পোষার বউয়ের চোখের চিকুর কেন হানে বরহমকে? জান বুঝি, তার হাসিতে ঝড় ওঠে একটা জঙ্গলে, তাই?

হুঁ, আমার বুকটা হুই পুবের ডাইনা জঙ্গল। কিন্তু দুলালের বিদ্রূপ-দর্পিত চোখের আড়ালে ওটা কী? একটা শাণিত অঙ্কুশের মতো? যেন বাগানের ম্যানেজারের বাংলোর বেয়নেট বন্দুকধারী পাহারাদারের মতো?

আইন হক খুন।

আইন হক খুন একেবারে প্রথম হাতিটার পিঠে বসে আছে, আরও গম্ভীর, আরও ভার নিয়ে। কাঁচপোকা দাড়িওয়ালা, মাথার চুল ছোট করে ছাটা, পেটা পেটা কালো শরীরে একটা ছেঁড়া ঝোলা জামা গায়ে হাতির দোলায় দুলছে মাহীর। রাঙির বাবা।

কিন্তু রাঙি এক হাত থেকে আর-একহাতে ভার বদলায়। কোমর নতুন নতুন বাঁকে বেঁকে ওঠে। চোখের নজর আড় করে, ঠোঁট কুঁচকে ভ্যাংচায়।

আর ঝড় ওঠে। ঝড় কি আইন মানে, না হক মানে, না খুন মানে? ঝড় কি অঙ্কুশ মানে, না ম্যানেজারের বাংলোর পাহারাদার মানে? বরহমের বিশাল কালো শক্ত শরীরটা খাড়া হয়ে ওঠে। বুকের ঝড় চকিত হয় চোখে। সে চোখ ফেরাতে পারে না রাঙির ওপর থেকে। একটা শব্দহীন আর্তনাদ বাজে তার কানে। আই বরহ, তোর বুক ফেটে যায়।

পরমুহূর্তেই তার বুকের মধ্যে ধর্মবাপের ডাক শুনতে পায়, অই, অই রে হটাবাহার, ফিরে যাবার। মতলব তোর। এইবার মরবি। মরণ ঘনিয়েছে তোর।

হ, এইটা মরণ। বহরমের যেন মরতে ইচ্ছা করে। কারণ জীবনটা আর ফিরবে না।

সেই উঁচু জায়গাটায় এসে হাতিগুলো দাঁড়াল। মূর্তি নদীর পারে। যেখানে হাতিগুলিকে প্রায়ই চরতে নিয়ে আসা হয়।

কার্তিক মাস। আকাশ নীল। ঘর-ছাড়া উদাস মন সাদা মেঘ দু-এক টুকরো এখানে ওখানে। পশ্চিম-উত্তরের আকাশে গেছে সূর্য। দার্জিলিং-এর ধূসর অবয়ব দেখা যায়।

ডান দিকে নদী বাঁয়ে বাঁক নিয়ে নেমে গেছে। কাঁচা রাস্তাটার বাঁয়ে ঘন শাল বন। গভীর, অন্ধকার নীরন্ধ্র যেন। নদী-সঙ্গী হয়ে নেমে গেছে। দার্জিলিং-এর রোদ বর্শার মতো খোঁচা খোঁচা হয়ে ঢুকছে, বনের খানে খানে।

হাতি থেকে নামতে গিয়ে থামল বরহ। মাহীর নামছে না। তাই দুলাল রাঙিও নামছে না। নদীর কূল ধরে, লোমশ ভ্রূ কুঁচকে মাহীর তাকিয়ে রইল দক্ষিণের জঙ্গলে।

একটা হাতি ডাকল, কঙ্ক!

মাহীন্দর ফিরে তাকাল। বরহম দেখল, তার আগের হাতিটা ডাকছে। সারির চার নম্বর। চামড়ায় এখনও ভাঁজ পড়েনি একটু। গায়ে এখনও অল্প বয়স–অর্জুন গাছের বাঁধুনি আর চেকনাই। বয়স নাকি মোটে বিয়াল্লিশ। আষাঢ় পেরোনো যৌবন হস্তিনীটার, শাওনের অকূল। নাম দিলালী। বরহম কালিনীর পিঠে। দিলালীর আগে সুলতান। রাঙি আর দুলাল রাজার পিঠে। মাহীন্দরের অঙ্কুশ ঠেকে আছে। পাঠানের কাঁধে। এই ওদের নাম।

দিলালীর ডাক শুনে মাহীর ফিরে তাকাল। কোথা থেকে একটা ছুটকো বাতাসে তার দাড়িতে লাগল ঝাপটা। মাহীর হেসে উঠল।

দুর্বোধ্য চিটাগাং-এর ভাষায় আরও কিছু মগ-সুর দিয়ে জিজ্ঞেস করল দুলাল, হল কী?

মাহীন্দর বলল, একটা চমক লাগল হে! দিলালীটাও ডাকল। কিন্তু, কিছু নয়। অই বরহ!

হ,

–আর যাওয়া যায়?

হঁ। যত খুশি।

কুনঠাঁই?

 –পাংঝোরা, খরিয়ার, কাকুরজিলোরা, সুল্লাপাড়া, ভোকোলমারদি ধূপঝোরা,..হুই দেখা যায়।

 দেখা যায়? বাপ বেটি জামাই, তিনজনেই দূর দিগন্তব্যাপী দক্ষিণের ঢালু জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল।

দুলাল বলল, দেখা যায়?

হ, দেখা যায়। আমি দেখতে পাই। হুই যায় চালসার রেল লাইন পুব-পছিমে। আওরি লাম, সুল্লাপাড়া হাটের রাস্তাটা মিলবে। বন বাংলো আছে। রাস্তাটা পুবে গেছে। কাকুরজিলোরা আর ভোকোলমারদির বীচে। তবে লদীটা মিলবে, জলঢক্কা।

জলঢক্কা?

 দুলাল আবার জিজ্ঞেস করল।

–হঁ৷ লদী। অখনও জল অনেক। রেল লাইনটার কোলে রাস্তা। উঁচায় রয় লাগরা কাটা। সেলকাঁপাড়া আর টু, পার হলে চাঙমারি! বীচে কারণ–

কারণ? –হুঁ, জায়গার নাম। –সব দেখা যায়! বিদ্রুপে বেঁকে উঠল দুলালের গোঁফ। কিন্তু দেখতে পায় বরহ। চোখ বুজলেও দেখতে পায়। এই গোটা অরণ্য অঞ্চলের প্রতিটি রেঞ্জ তার চেনা। পায়ে হেঁটে ঘোরা।

হ, চোখে ভাসে।

–চোখে জাদু আছে নাকি?

রাঙি হেসে উঠল খিলখিল করে। বরহমের আর জবাব দেওয়া হল না। জাদু দেখতে লাগল সে। রাঙির কালো চোখের ছটায়। ঠোঁটের ওপর চাপা-দেওয়া ঘোরানো হাতে। তালুতে মেহেদি রং বাহারে। আষাঢ় অঙ্গে অঙ্গে শাওনের বান লক্ষণ দেখে।

হুঁ, আমার চোখে জাদু লেগেছে। রাঙির লাল জামাটা আমি জগতের রক্তের মতো দেখি। কাপড়ের নীল ডোরাগুলিকে দেখি জগৎ-জড়ানো শত পাক নাড়ি। আই, আমি মায়ের পেট থেকে প্রথম হটাবাহার হয়েছি। আবার আমার ফিরতে ইচ্ছা করে। হেই ধর্মবাপ, আমার মরতে ইচ্ছা করে। আবার যেতে ইচ্ছা করে ফিরে রক্তে নাড়িতে। হুঁ, এ হটাবাহারটার চোখে জাদু লেগেছে হে।

একটা তীব্র গর্জনে সংবিৎ ফিরল বরহমের। মাহীন্দরের চোখে ক্ষ্যাপা বুড়ো চিতার অঙ্গার ঝিলিক। দুলালের চোখে সুতীক্ষ্ণ অঙ্কুশ উদ্যত। মাহীন্দরের ডাক গর্জন হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। মাহীন্দর পাঠানকে চালাল দক্ষিণে। পিছে রাজা। সুলতান দিলালী কালিনী পরে পরে।

তবু রাঙির শরীর কাঁপছে হাসির চাপা হিল্লোলে। বাপের স্নেহ উথলে ওঠে মেয়ের হাসিতে। বরের সোহাগ উসে ওঠে বউয়ের হাসির লহরে। কিন্তু আমার বুকটা খাই-রান্তির জঙ্গল। সেখানে ঝড় ওঠে। ঝড় কি কারুর গর্জন মানে?

কালো বন, লাল নদী। মাঝের পথ ধরে দক্ষিণে এগিয়ে চলে আগে মাহীন্দর। বলল, আরও কয়খান রশি ঘুর দিয়া আসি।

দুলাল বলল, চলেন।

হুঁ, এই পথে, আট মাস আগে আরও নীচে প্রথম জঙ্গল হয়েছিল বরহমের বুক ঝড় লেগেছিল জঙ্গলে। আরও নীচে। বামন ডাঙার নীচে, নাথোয়ার বাগানের ওপরে, ধুপগুড়ি থেকে যে কাঁচা রাস্তা ওপরে উঠে, পুবে বাঁক নিয়ে চলে গেছে। ভুটান সীমান্তে। সেই রাস্তা। ডাইনা আর জলঢাকা নদী যেখানে প্রায় গলাগলি করতে গিয়ে করেনি, সেইখানে। ডেয়ো ঢাকনা ঘর গৃহস্থালী, ছাগল মুরগি পায়রা, বউ বেটা বেটি জামাই, মাহীন্দরের গোটা সংসার পাঁচ হাতির পিঠে।

–হো-ই, ছাইলসা বনবাংল যাই। রাস্তা কোন্ দিকে?

চালসার বনবাংলোয় যাবে। হা করে তাকিয়েছিল হটাবাহার লোকটা। কোথা থেকে আসছে এরা।কুথা থিকা আসিলা হে? মাহুত বটে?

–হাঁ। ছটিগাঁ। পিলখানা, সরকারি পিলখানা থেকে আসছি। হুকুমপত্তর আছে। হুকুমপত্র? তা থাকতে পারে। হাতির পিঠে সংসার দেখছিল বরহ তাকিয়ে তাকিয়ে। একটা বাচ্চা কাঁদছিল ট্যাঁ ট্যাঁ করে। তার পরেই, হিলিবিলি বিজলি মালা ঝলকে উঠেছিল। ছোট একটা কেউটের মতো রাঙির কপালে পাক দিয়ে পড়েছিল এক গুছি রুক্ষ চুল। বন রং বরহমের দিকে তাকিয়েছিল। সাদা ঝকঝকে দাঁতে হেসে উঠেছিল চোখাচোখি হতেই।

হাসিটা যখন বেজেছিল, ততক্ষণ শক্ত করে থাকতে হয়েছিল। তারপরে আর বাধা মানেনি। ফাল্গুনের সকালবেলায় বুক যেন ডাইনার শালবন হয়ে উঠেছিল। ঝড় উঠেছিল। দাপিয়েছিল বুকের মধ্যে। মনে মনে বলেছিল, আই, আমি একটা হটাবাহার মানুষ হে। আমার বুকে যেন ঝড় উঠল?

জোত জমিনের কাজ ছিল না। বরহম ধর্মবাপের কাছে ছুটি নিয়ে, চাল চিড়ে বেঁধে, ঘুরতে ঘুরতে হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়েছিল নাথোয়া। চেনালোক পুরনো লোকদের সঙ্গে একটু একথা সেকথা বলাবলি করার জন্য। সে বলেছিল, রথ দেখায়ে লিয়ে যেতে পারি। চালসা আমার জায়গা।

মাহীর একমুহূর্ত ভেবেছিল। চোখাচোখি করেছিল দুলালের সঙ্গে। তারপরে একটা মোটা কাছি হাতির পিঠের ওপর থেকে ফেলে দিয়ে বলেছিল, আস।

দড়ি ধরে উঠতে গিয়ে আবার একবার তাকিয়েছিল রাঙির দিকে। আন মান বোঝার বয়স কোথায়? রাঙির চোখের তারায় যেন বাজি ধরেছিল তার প্রবৃত্তি। তার প্রবৃত্তি আবার খিলখিলিয়ে উঠেছিল জয়ের উল্লাসে।

হে মা, তোর গান আমার মনে পড়েনি। নে জীবোন কাহী বদলাতআ। আমি পথ থেকে ফিরলাম। পথ ভুলিয়ে ডেকে নিয়ে যাওয়া বাগিয়া বোঙার মায়া হাতছানি দেখল হটাবাহারটা। নাথোয়ার জঙ্গলের ঝড় প্রথম দাপিয়ে পড়ল আমার বুকে।

তারপর কথাবার্তা, জিজ্ঞেসাবাদ। কী জন্যে আসা এই চালসায়? লড়াইয়ের ভয়ে, বিদেশি দখলদারের আশঙ্কায়। চাটগাঁ দখল হলে, সম্পত্তি যেন না যায় শত্রুর হাতে। তাই সময় থাকতে সরকার তার হাতি পাঠিয়ে দিয়েছিল তরাইয়ের গভীর অরণ্যে। বোমার আঘাতে এই অস্থাবর সম্পত্তি নাশ যাতে না হয়।

হুঁ, এদের এক সাল আগে থেকেই লোক আসছিল। সারবন্দি ট্রাক আর ফৌজ আসছিল। সেই সঙ্গে অনেক মানুষ। দূর দূর শহরের ভীত আতঙ্কিত মানুষের দল আসছিল বনের আশেপাশে।

হীরালাল বলেছিল, সব শালা জঙ্গলে পলায়ে আসছে।

ক্যানে, উয়াদের ভয় নাই জঙ্গলে?

–না, অখন আর নাই।

বাঘের ভয় নাই?

–নাঃ।

— ক্যানে? সাপ হাতি ভালু, কুছুর ডর নাই? জংলি কুত্তা মুতে দেয় যদিন গায়ে?

না, ওদের এখন আর জঙ্গলের কিছুকে ভয় নাই। তার চে’ বড় ভয় এখন শহরে। তাই জঙ্গলে চলে আসছে সব।

ক্যানে আই বাপ, উয়ারা হটাবাহার নিকিয়ে?

এক রাশ পচুঁইয়ের গন্ধ ছেড়ে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠেছিল হীরালাল।–অই রে শালা, অই রে ব্যাটা!

হাসি থামতে চায়নি হীরালালের। যদিও বরহমের মনে কোনও দিন প্রশ্ন জাগেনি, এক-ই লোককে একজন শালা আর ব্যাটা বলতে পারে কি না। হীরালাল বলেছিল, তা মিছে বলিস নাই। ওরা তাড়া খেয়ে আসছে এখানে। শহরে আর ঠাঁই নাই।

তারপর? আরও কথাবার্তা হয়েছিল মাহীন্দরের সঙ্গে। তারপর আর কী? সরকার মাইনে দেবে। যতদিন থাকতে বলবে চালসায়, ততদিন থাকতে হবে। যুদ্ধ থেমে গেলে, জিতে গেলে, আবার ফিরে যাওয়া। জাত কী? মাহুত? না। হাতিপোষা বলা যায়। আর ধর্ম? চৌকো তাবিজ আছে গলায়। সিঁদুর-মাখা লক্ষ্মীর ছবি আছে পুঁটলিতে। মুরগি আছে খাঁচায় কিন্তু ছোট ছোট রুদ্রাক্ষের মালা ছিল রাঙির মা লক্ষ্মীর গলায়। তবু দাড়ি ছিল, মেহেদি ছিল মেয়েমানুষের হাতে। সুরমা ছিল চোখে। বাঁকা সিথেয় হায়া যায়নি। কিন্তু সিঁদুরের প্রতি টান আছে রক্তে। পীর আছে, সত্যনারায়ণের সত্য আছে।

পাঁচ হাতি আর পরিবার নিয়ে বেরিয়েছিল মাহীর কার্তিকের শুরুতে। চাটগাঁ থেকে দার্জিলিং-এর তরাই। পৌঁছেছিল ফাল্গনের শেষে। নদনদী পাহাড় আর কত গ্রাম শহর ডিঙিয়ে এসেছিল। সরকারের হুকুম। পথে কত লোক হাতি দেখেছিল। কত বউ জোকার দিয়েছিল। কত ছেলেমেয়েরা পিছনে পিছনে চিৎকার করেছিল, হাতি হাতি, পায়ের তলায় বোড়োই বীচি!..

সরকারের হুকুমনামা দেখেছিলেন চালসার রেঞ্জার সাহেব। আগে থেকে হুকুম ছিল জলপাইগুড়ির ডিভিসনাল অফিস থেকে। বনবাংলোর কাছেই, হাতি আর হাতিপোষাদের ঠাঁই করে দিতে হয়েছিল।

ঠাঁই হয়েছিল। সংসার গোছানো হয়েছিল হাতি পোষাদের। কিন্তু পাঁচ নুড়ি নিয়ে বসে, পাঁচ ফুলের খেলা খেলেনি রাঙি। শাওন যে আসে? আষাঢ়ের বিস্তার বুকে ভবিষ্যতের কোন খেলার রঙ্গ? বানের আগে জলঢাকার কলকলানিতে কী শোনা যায়? দুলালের বুকের পাথর ছপছপিয়ে, আরও উঁচু পাড়ের মাটি ভাসাতে চাইছিল রাঙি। হাসিটা আর থামেনি। অঙ্গার দপদপিয়ে উঠছিল মাহীর আর দুলালের চোখে।

হুঁ, আমার প্রাণটা, আমার মনটা জঙ্গল হয়ে উঠেছিল। মেঘ-গুড়গুড় দুপুরে, তাই, ঝি-ঝি-ডাকা জঙ্গলে, গা-ভরতি চার-পাঁচটা জোঁক নিয়ে রাঙি আলোমালো করে বরহমের গায়ে এসে পড়েছিল। আন না মান না, লতা জড়িয়ে ধরেছিল। কোথায় গিয়ে ঢুকেছিল বুঝি কোন কোমর-ডোবা জলা জংলায়। একটি একটি করে জোঁক টেনে টেনে তুলে দিয়েছিল বরহম। তারপর রক্তাক্ত শরীরটা রাঙির কেঁপে কেঁপে উঠেছিল হাসিতে। ভয় নয়, চোখে বিদ্যুৎ হেনে, থম-ধরা জঙ্গলটাকে যেন একটা ঝটকায় দুলিয়ে। ছুটে চলে গিয়েছিল।

আই, আমার বুকটা গোটা তরাইয়ের জঙ্গল মা। তোমার গান আমি ভুলে গেলাম। চিতা-বেরুনো-সাঁঝবেলায় বড় গাছের ডালে উঠে রাঙি নামতে পারেনি। ডাক দিয়ে বলেছিল, অই, অই মানুষটা, আমি নামতে পারি না। হোই করজুয়ানা! এই বরহমকে শক্তি দাও। নইলে রাঙি উঠতে পেরেছিল, আমার কাঁধে পা না দিয়ে নামতে পারে নাই। সাঁঝবেলার চালসা জঙ্গলের কালো পাতা লাল হয়ে উঠেছিল রাঙির হাসিতে। হেসে বলেছিল, যেন পাঠানের কান্দা। যেন হাতি পাঠানের কাঁধ।

হুঁ, ক্যানে রাঙি? আমি একটা হটাবাহার। আমার মরণ ক্যানে তোর হাতে নিস্? আ! আ! মায়ের শরীর থেকে কেন হটাবাহার হয়েছি? এত জঙ্গল কেন জন্মাল মাটিতে? কুসুম পাতা কেন লাল হল? নাগনিশা ফুল কেন ফুটল? আ! আ! রাঙির জীবনটা রাঙির। তার জীবনের নিয়মের শিকল বুঝি এমনি ঝনঝনিয়ে বাজে, এমনি করে মারে আমাকে।

হীরালাল ঘেঁকিয়ে উঠেছিল।–তুই হাতি চরাতে কেন যাস ওদের সঙ্গে?

 হেই ধর্মবাপ, আমি থাকতে পারি না।

তুই জোতজমি দেখিস না।

আই বাপ আমার মন পুড়ে যায়।

তুই মরবি রে হটাবাহার?

 হুঁ, তাই মরণ কাটি পড়ে ঢাকের পিঠে।

কঙ্ক! কঙ্ক!

সংবিৎ ফিরল বরহমের। চকিত হল মাহীর। দিলালী ডাকছে। কালো বন লাল নদী। তার মাঝখানে দিলালী দাঁড়িয়ে পড়তে চাইল। সারি থেকে একটু সরে গেছে বাঁ দিকে। কেন?

মূর্তি নদীর জলে বাঁকা রোদ। তার ছটা লেগেছে গাছে গাছে। খরিয়ার বন্দর জঙ্গল যেন নিথর হয়ে গেল। শুধু ঝিঁঝির ডাক। মাহীর বলল, কী হল দিলালীর?

সেই মুহূর্তেই পাঠানের সর্বাঙ্গ আন্দোলিত হল। সে ডাক দিল, কুররর কুররর কুররর কঙ্কো!

 হাতির দল যেন বিচলিত হয়ে উঠল। কেবল দিলালী ছাড়া।

সহসা দেখা গেল, সামনের পথে, ঘন কৃষ্ণনীল বন্য ঐরাবতের আবির্ভাব। নিভাঁজ বলিষ্ঠ শরীরে তার সূর্যছটায় যেন নীল কিরণধারা চলকে যাচ্ছে। দূর ভুটিয়া পাহাড়ে যেন রোদ পড়েছে। শাণিত সূচ্যগ্র দুই দাঁতে তার বিধে রেখেছে সূর্যকে।

তারপর আরও। গম্ভীর শালবনের ভিতর থেকে দলে দলে বেরিয়ে এসে পথরোধ করল বন্য হাতির পাল।

পাঠান পিছনে হটল। আর পাঠান রাজা সুলতান, তিনজনেই চিৎকার করে উঠল। সেই সঙ্গে মাহীরও, হেই দুলাল, দিলালীকে সামলাও ছিনালিটার মতলব ভাল না।

মিথ্যে নয়। দিলালী দল থেকে সরে গেছে। তার চোখে কোথাও ভয় ও রাগের চিহ্ন নেই।

বরহমের ভয় করছিল না। বন্য হাতির সামনে জীবনে সে অনেকবার পড়েছে। কিন্তু তার বুকের ঝড় দ্বিগুণ হল। আই দিলালী! ভালবাসার সাধ তোর। মন পাগল করেছিস?

দুলাল রাজাকে চালিয়ে একেবারে দিলালীর ঘাড়ে এনে ফেলেছে। মাহীর ততক্ষণে পাঠানের পিঠ থেকে বিচুলির বড় গদিটা তুলেছে টেনে।

বন্য হাতির দল বিচলিত নয় একটুও। কিন্তু আক্রমণের উদ্যোগ নেই একেবারেই। বরং যেন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, অবাক হয়ে, এই পোষা অকালবৃদ্ধ ধূসর কোঁচকানো-চামড়া স্বজাতীয়দের দেখতে লাগল। যাদের গায়ে তারা মানুষের গায়ের দুর্গন্ধ পাচ্ছিল। দুর্গন্ধ মানুষের গায়ে, মাংসাশী পশুদের মতোই। কারণ মানুষ মাংসাশী।

কিন্তু এদিককার চিৎকার একটুও থামল না। রাজা পাঠান সুলতান, মাহীর দুলাল রাঙি, সমানে চিৎকার করে চলেছে। দুলাল রাজাকে দিয়ে ঠেলে দিলালীর মুখ ঘুরিয়ে দিল উলটো দিকে। মাহীন্দরের হাতে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল বিচুলির গদি।

বন্য হাতির দল যেন একটু চকিত হল। কিন্তু ছোটাছুটি করল না। আস্তে আস্তে অদৃশ্য বনের মধ্যে। কেবল তেমনি স্থির অবিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেই দাঁতালো ঘন কালো বিশাল হাতিটি। সে দলের সঙ্গে অদৃশ্য হল না।

আই বাপ, তুই যেন উঁচানীচা টুণ্ডু রেঞ্জের রাজা। এত হাতি দেখেছি। তোকে তো কোনও দিন কোথাও দেখিনি।

ততক্ষণে পাঁচ হাতি উলটো দিকে ফিরে চলেছে। পাঠান আর রাজার মাঝখানে দিলালী।

দিলালী আবার ডাকল, কঙ্ক!

মুহূর্তে পাঠান আর রাজা যেন ক্রুদ্ধ হুংকারে প্রতিবাদ করে উঠল।–রিং কং! কুররর!

মাহীন্দর চিৎকার করে বলে উঠল, দিলালী অনেক আগে টের পেয়েছিল। তাই আমার চমক লেগেছিল তখন। যেন কী শুনলাম আচমকা। কী যেন দেখলাম।

দুলাল বলল, কিন্তু বুনো দাঁতালোটা এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

–থাকুক। জলদি। জলদি চল।

হুঁ, ঠায় খাড়া হয়ে রয়েছে বুনো দাঁতাল। শুড় নীচে। কুলো কান নড়ছে একটু একটু। কিন্তু স্থির। যেন দল ভুলে গেছে। বন ভুলে গেছে। বরহমের মনে হল, বুনো দাঁতালোটার দু চোখে বুঝি পলক নেই। ক্যানে? উয়ার বুকে কি খরিয়ার জঙ্গলের ঝড় লেখেছে?

কাচের চুড়ির ঝনৎকারে ফিরে তাকাল বরহম। রাঙির দুটি চোখ। দুটি ঠোঁটে মূর্তি নদীর ধনুক বাঁক। অমন করে হেসে, কী দেখছে সে? বুনোনা দাঁতালোকে, না বরহমকে।

রাঙি বলে উঠল, আ মরি কী সং! বুনোটা যে ঠায় খাড়া রইল।

 দুলাল বলল, শালার খোয়ারি হয়েছে।

বরহমের চোখে চোখ রেখে, খিলখিল করে হেসে উঠল রাঙি। বর আর বাপের সামনে সে বরহমের সঙ্গে কথা বলে না। শুধু চোখের তারায় বেঁধে। শুধু ঠোঁটের কুঞ্চনে মোচড়ায়।

বরহম গলার শির ফুলিয়ে একটা আদিম চিৎকারে গান গেয়ে উঠল,

কুম্বার চাটু পোবঅ জান রে
কুম্বার স্তানে কা রুয়াড়া।
নে জীবোন গাতিড।….

আই রে হটাবাহার, কুমারের মাটির কলসি ভাঙলে আর তা কখনও ফিরে আসে না। জীবনটা আর ফিরবে না।

গান নয়, যেন বুকের ঝড়কে শাসাতে লাগল বরহম। স্তব্ধ করতে চাইল। কিন্তু রাঙি আরও হেসে উঠল বরহমের সেই বিকট চিৎকার শুনে। দুলাল তার দেশিভাষায় বলে উঠল, ও ব্যাটার খোয়ারি হয়েছে দেখছি।

পরমুহূর্তেই সে চিৎকার করে মাহীন্দরকে বলল, হেই বাবা, বুনো দাঁতালোটা আসছে পিছে পিছে।

বরহম দেখল। আসছে সেই বিশাল নীল হাতি, খুব ধীরে ধীরে। তবু তার চিৎকার থামল না, নে জিবোন কাহী বদলাআে। নে জীবোন কাহী নামোগা।

তার দুর্বোধ্য চিৎকারে আর মাহীর দুলালের অঙ্কুশের আঘাতে হাতির দল দৌডুতে আরম্ভ করেছে। দিলালীকে মাঝে রেখে। ছুটছে সবাই।

বন-বাংলার সীমানায় এসে শ্লথগতি হল হাতিগুলি। বুনো হাতিটা অদৃশ্য হয়ে গেছে আবার। কিন্তু আমার বুকের ঝড় কেন বাড়ছে? হে মা, আমি একটা হটাবাহার মানুষ। আমার বুকের তরাই জুড়ে এ কি পাগলা ঝড়?

বাংলোর একটু দূরেই মাহীর আর পাঁচ হাতির আস্তানা। কিন্তু তারা বাংলোর সীমানায় ঢুকে, রেঞ্জারবাবুর সঙ্গে বুনো হাতির গল্প শুরু করল। বরহম কালিনীর পিঠ থেকে নেমে ছুটল ঘরে। মাহীন্দরের আস্তানার পাশে, নয়ানজুলির ওপারে হীরালালের ঘর। বলদ দুটিকে আগে মাঠ থেকে নিয়ে এল বরহম। খেতে দিল তাদের গোয়ালে ঢুকিয়ে। তারপর চাল ধুয়ে, ভাত বসাল কাঠের উনুনে।

একটু পরেই অন্ধকার নামল। জোনাকিরা ডাকের সংকেতে জ্বলে উঠল ঝিকিমিকি করে। রাঙির হাতে টিমটিমে হ্যারিকেন ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল তাদের ঘরের আশেপাশে। মায়ের কাজ করে দিচ্ছে। প্যাঁকাটি এনে দিচ্ছে, জল তুলে আনছে কুয়ো থেকে। আর চারদিক খোলা বড় টিনের শেডের পাথর ও গাছের গুঁড়ির শিকলের সঙ্গে দিলালীদের বাঁধছে শ্বশুর-জামাই।

বরহমের কালো শরীরে চ্যালা কাঠের আগুন নেচে বেড়াচ্ছে। তার মুখে, তার মাথায় আগুন খেলা। করছে।

হুঁ, ঝড় কেন বাড়ছে আমার বুকে? সে দেখল, টিমটিমে আলোটা এগিয়ে আসছে। আসতে আসতে থামল নয়নজুলির কাছে, মান্দারের তলায়। কোমর বেয়ে, বুকে উঠল আলোটা। আই, রাঙির লাল জামাটা আমি রক্তের মতো দেখি। আলোটা মুখের ওপর উঠল। এই জগৎটা রাঙির মুখে দেখি। ফিরে যাবার ডাক দিল আমাকে রাঙির চোখ।

বরহম নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। আর পিছন থেকে ডাক শুনল, যাস না।

হীরালাল এসেছে কখন, দেখেনি বরহম। ধর্মবাপ ডাকল তাকে। রাজা হটাবাহারের ডাক।

যাব না?

 না, নিয়ম নাই রে, হটাবাহার।

 আই বাপ, আমার মন মানে না আজ।

আজ তুই বুনো দাঁতাল হয়েছিস।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ফিরে তাকাল বরহম।–বুনো দাঁতাল?

হ্যাঁ।

তবে কি ওই বুনো দাঁতালটা ঝড় বাড়িয়েছে আজ বরহমের বুকে? দিলালীর মধ্যে সে রাঙিকে দেখতে পেয়েছে।

আই ধরম বাবা, দিলালী ক্যানে বুনো দাঁতালটাকে পায় না হে?

না, বুনো দাঁতালটা পাবে না দিলালীকে। নিয়ম নাই।

ক্যানে নিয়ম নাই?

এইটা জীবন।

বরহম দেখল, রাঙি শুকনো কাঠের বোঝা বুকে জড়িয়ে ফিরে চলেছে।

আই বাপ, নে জীববানে কাহা নামোগা। তবে মন কেন হল রে?

আরে ব্যাটা, তাই তুই হটাবাহার হয়েছিস।

হুঁ, তাই বরহম হটাবাহার। উনুনের আগুন উসকে দিল সে। ঘরের ভিতরে রাখা পচুঁইয়ের ভাঁড় নিয়ে বসল হীরালাল।

তাই বরহম হটাবাহার। কিন্তু সে চিৎকার করে গেয়ে উঠল,

কাচীম লেলে মদা গীসোতবা?
এনাচী অবেনেবেন উড়ুক্ত তনা?

দেখছ না, ফুল ফুটছে। এ জন্যে তোমরা চিন্তা করছ কেন? কেন চিন্তা করছ বরহম? সে আবার ফিরে যাবে কুসুমে ফুলে লতায় গন্ধে, রক্তে নাড়িতে।

বরহমকে পচুই খেতে দিল হীরালাল। রাত গম্ভীর হল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রতিবেশীরা। শেয়াল চিতারা বেরুল শিকারে। কার বুকে ঘুমায় রাঙি?

হীরালাল খেল! খেয়ে মাটির ওপর পড়েই ঘুমোতে লাগল। আর কেবলি ঘুমন্ত বিড়বিড় করল, এই, আমি চিরদিন দরজার বাইরে। আমি চিরদিন দরজার বাইরে পড়ে আছি।

যেন কপাটে ধাক্কা দিতে দিতে, মাথা কুটতে কুটতে, লোকটা জ্বলে মরছে। হাঁপিয়ে উঠছে। লোকটা বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আই ধর্মবাপ, আমি জানি তুমি রাজা হটাবাহার। আমি একটা হটাবাহার মানুষ। কিন্তু নিয়মটা যদি জীবন, আমি জীবন কেন মানি?

সহসা তরাইয়ের আদিম অন্ধকার খান্ খান্ হল তীক্ষ্ণ ভীত ক্রুদ্ধ ধাতব ঝংকার বৃংহিতে।–রিং কং রিং কং কঙ্কো, কঙ্কো!…শিকল উঠল বেজে ঝঝনিয়ে। মাহীন্দরের ঘরে শোরগোল উঠল। রেঞ্জারবাবু আর কর্মচারীরা জেগে উঠল হইচই করে।

অন্ধকারের মধ্যেও বরহম স্পষ্ট দেখতে পেল সেই বুনো দাঁতালকে। সে এসেছে। আকাশ আড়াল করে সে দাঁড়িয়েছে টিনের শেডের সামনে। নক্ষত্র বিদ্ধ হয়ে আছে তার দাঁতে। দিলালীর কাছে এসেছে। সে। পাঠান আর রাজার মাঝখানে, পাষাণে শিকল বাঁধা দিলালী। বোঝা গেল, কার শক্তিশালী শুড় পিছন থেকে আঘাত করছে পোষা পুরুষদের।

ইতিমধ্যেই বাতি বেরুল, আগুন জ্বলল। টিন বাজল একটা আদিম ভীরু শব্দে, ট্যাম ট্যাম ট্যাম…মানুষের চিৎকার ভেদ করে, রেঞ্জারবাবুর ছররা গুলির বন্দুকটা ধমকে উঠল, ঠাস ঠাস। বরহম দেখল সেই বিশাল কৃষ্ণ বুনো দাঁতালের গায়ে, ছররা গুলি যেন ভুট্টার খইয়ের মতো ছিটকে চলে গেল। কিন্তু মানুষের ভিড় দেখে পালাতে হয় তাকে। যাবার আগে, পাঠানের গায়ে তার দাঁত রক্তাক্ত গভীর ক্ষত রেখে গেল।

শুধু দিলালী স্থির যেন নিস্পৃহ। হয় তো গাঢ় অন্ধকারে বনের গভীরে তার দৃষ্টি শুধু অনুসরণ করছে। শুধু অন্বেষণ করছে মুক্ত অরণ্য, স্বাধীন জীবন অশেষ মিলন। কঠিন দাঁতের সোহাগ বুঝি তার চামড়ার অনুভবে।

শোরগোল কমল। কিন্তু চোখে চোখে ভয়। সবাই জড়ো হল রেঞ্জারবাবুকে ঘিরে। নিঃশব্দ পায়ে বরহম গিয়ে দাঁড়াল সকলের পিছনে। হীরালালের সাড় নেই।

সকলের ভয়, আবার যদি রাত্রেই আসে। এ অভিসারের সময় কখন কীভাবে আসবে, কেউ জানে না।

ক্যানে, বুনো দাঁতালটা দিলালীকে গুঁড়ে জড়াতে পাবে না?

রেঞ্জারবাবু খোঁচা ভ্রূর তলায় বিদ্যুৎ হানল। বললেন, আর কয়েকটা দিন দেখা যাক কী করে। এখনও সময় হয়নি।

কীসের সময় হয়নি এখনও? রেঞ্জারবাবুর চোখে, ঠোঁটের কোণে কঠিন দৃঢ়তা। বরহম রাঙিকে দেখল। ঘুমভাঙা চোখে ত্রাস। আলুথালু কাপড়। রাঙি বরহমের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। কী দেখছে রাঙি? বুনো দাঁতালকে?

বরহম হঠাৎ এগিয়ে এল।–আই রেঞ্জারবাবু, আমি একটা কথা বলি। উয়াকে খালাস করে দেন।

কাকে?

–দিলালীকে।

–কেন?

–উয়াদের মনটা চায়।

রেঞ্জারবাবু হেসে উঠলেন। সবাই হেসে উঠল। এমন উদ্ভট অনিয়মের কথা কেউ কোনও দিন শোনেনি।

কিন্তু দুলাল হাসেনি। তার দু চোখে যেন পাঠানের রাগ। বরের চোখে রাগ। তাই বুঝি রাঙিও হাসেনি। দুলাল হাত ঝটকা দিয়ে বলল, ও সব আইনে নাই।

আইনে নাই? আইনে কী আছে?

দুলাল যেন রাগে গর্জে উঠল, ও শালাকে মরতে হবে। আইনে আছে।

আইনে আছে। আইন হক খুন। তিনে মিলে, দুলালের চোখে জিঘাংসা। বাংলোর ম্যানেজারের বন্দুক তার হাতে উদ্যত। হটো, হটো, আর এক পা নয়।

হে মা, ছাগুতুবুরুর ইচ্ছেটা তরাইয়ের রক্ত দিয়ে গড়া। এ আইনটা আমি জানি না। জীবনটা যদি আইন, তবে আমি জীবন কেন রাখি?

.

ধানক্ষেতে টহল দিয়ে, চালসা ইস্টিশনের ওপরে, মেটেলির পথে উঁচু চড়াইতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল বরহম। দূরে দূরে লোয়ার টুণ্ডু রেঞ্জ আকাশে গিয়ে মিশেছে। ভুটান ডিঙিয়ে সূর্যটা এখন তরাইয়ের মাথায়। ছায়া ছোট হয়ে গেছে। সবখানে রোদ। ওই চালসার বনে বনে ঢাকা বন-বাংলার সীমানায়। ডাহুকি পাখি ডাকছে।

মাঠে কাজ নেই। আমনের পাকার অপেক্ষা। হীরালাল হয় তো বনে গেছে। বরহম দাঁড়াল উঁচু চড়াইয়ে। নীচে রেল লাইন। তার পরে বন। চালসার বন। ডাহুকি ডাকছে।

আই আমি একটা হটাবাহার মানুষ। আমার বুকে কেন ঝড় উঠল? উদালাঝোরার কালো বুকে, জলঢাকার লাল বুকে? আ! আমি তোর গান আর গাইব না মা। ফুল ফুটেছে, তোমরা দেখনি? কাচীম লে লে মদা গীসোবা?

পথ ছেড়ে, জঙ্গল মাড়িয়ে হুড়মুড় করে নামতে লাগল বরহম। বুনো দাঁতালটা নাকি? ফুল ফুটেছে, তোমরা দেখনি? আমাকে ফিরতে হবে, দুলালের চোখে আমি চোখা খোঁচা অঙ্কুশ দেখেছি। আমার ঘাড় দিয়ে তার অঙ্কুশের ধার দেখতে হবে। তার অঙ্কুশটা আইন। জীবনটা যদি আইন, তবে জীবন কেন থাকে?

রাঙি থমকে দাঁড়াল। ঘরের পিছনে, থুপি থুপি পাতা রোয়াইলের তলায় ঘুরে ঘুরে, খুদ ছড়িয়ে ছড়িয়ে সে বাদশাকে খাওয়াচ্ছিল। ধবধবে সাদা, লাল টকটকে ঝুঁটি, দস্যি মোরগটা তার প্রিয় বাদশা। রাঙি থমকে দাঁড়াল। হেসে উঠতে গিয়ে যেন ত্রাসের মুখে চাপা দিল আঁচল। তবু দুটি অস্পষ্ট নিক্কন বাজল। দুবার তাকাল ঘরের দিকে ফিরে। সেখানে শ্বশুর জামাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। তামাকের গন্ধ আসছে বাতাসে। বাতাসে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে এল বরহম। মোরগটা ককিয়ে উঠল। সরে গেল দূরে। রাঙি ঘরের দিকে তাকায় আবার।

আই, আমি একটা হটাবাহার রাঙি। আমার মায়ের পেট থেকে প্রথম হটাবাহার। ওই রাজা হটাবাহারটার মতো, আমিও পড়ে আছি। আমি আর এ যন্ত্রণা সইতে পারি না। তুই আমাকে ডেকেছিস। আমি বৃন্তে ফিরে যেতে চাই।

বরহম নিঃশব্দ আকুতি দু চোখে ভরে আরও দু পা এগোল।

বাণ ছোঁড়া ধুলোর মতো, রাঙি খুদ ছুঁড়ে মারল বরহমের গায়ে। মেরে ঘরের দিকে তাকাল। তারপর হাসল ঠোঁট টিপে। জামা নেই, চুল খোলা, অবাঁধা নদীর বাঁধ ভাঙো ভাঙো। দুর্বা ঘাসের ওপর নিঃশব্দ পা ফেলে ফেলে রাঙি বাংলোর দিকে এগুল। বাংলোর দিকে, যেখানে সেগুনের কিছু চারা গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিরিঝিরি জঙ্গল যেখানে।

বরহম দেখল। সে যেন মরণের হোমন ডাক শুনতে পেল।

 দুলাল। হয় তো বিজনের বউয়ের খোঁজে এসেছিল। কিংবা একটা চমক খেয়েছিল রক্তে।কী চাই? ঘরের পাছে কী আছে হে?

আড়চোখে সে দেখল রাঙির দিকে। রাঙি ফিরে তাকাল না। এ যেন সেই হস্তিনীটা। দুই মত্ত হস্তীর দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের সময়ে যে আলস্যে গায়ের পোকা বাছে শুড় দিয়ে। কচি পাতা খায় চিবিয়ে চিবিয়ে। সংকোচ হয় তো আছে, ভয় নেই রাঙির।

কী চায় বরহম? যা চায়, তাই সে বলল। চলে-যাওয়া রাঙির দিকে একবার তাকিয়ে বলল, দিলালীটাকে খালাস দিয়ে দাও। উয়াদের মন

কথা শেষ হওয়ার আগেই দুলালের গলায় ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, হুশিয়ার! হুশিয়ার!

ক্যানে?

 মাহীর ছুটে এল।কী হয়েছে, কী ব্যাপার?

রাঙির মা এল শিশু কোলে করে। যে শিশুর নাম রাখা হয়েছে চালসা। কারণ চালসায় এসে ছেলেটা পেটে এসেছিল। এখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে।

আইন আর হকের দাবিতে লাফিয়ে বরহমের কাছে এল দুলাল। চিৎকার করে বলল, হেই বাবা, ওকে হুঁশিয়ার কর।

কিন্তু একটু নড়ল না বরহম। হীরালালের ছেঁড়া খাকি হাফ প্যান্ট আর ছিন্নভিন্ন খাকি শার্টে ওর কালো কুচকুচে শরীর ঢাকা পড়েনি। গজচোখের দৃষ্টি রাখল দুলালের চোখে চোখে। বলল, ক্যানে হে?

বরহমের চোখের দিকে তাকিয়ে আঘাত করতে পারল না দুলাল। সে আরও জোরে চেঁচিয়ে বলল, মনে করেছিস, আইন নেই?

রেঞ্জারের অফিসের লোকজন এসে পড়ল।

কী হয়েছে অ্যাঁ? দিলালীকে ছেড়ে দিতে বলে? দুর্বোধ্য লাগে সকলের। হটাবাহারটা নেশা করেছে নাকি? ক্ষেপে গেল নাকি একেবারে?

সবাইকে ঠেলে সরিয়ে এল হীরালাল। অই, শালা, অই হটাবাহার।

গোল লাল চোখ হীরালালের জ্বলছে। মুখটা এখন আরও ফুলে উঠেছে। সকাল থেকে নেশা করেছে। সে। থাবা বাড়িয়ে বরহমের জামাটা ধরে টানল।-আয়, ব্যাটা ঘরে আয়। মরণের সাধ হয়েছে তোর?

টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরে। ঘর মানেই ধান। কোনও গোলা নেই। ঘরের মধ্যেই ধান, সিদ্ধ করে রাখা। তার মধ্যেই ঠাঁই, ঘর গৃহস্থালী। বরহমকে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল সে।

–অই, তুই ফিরে যেতে চাস?

–হুঁ।

–তুই হটাবাহার না?

হ।

–তুই জানিস না, লড়লে হটাবাহার হয়?

হ।

-আর ভালবাসলে? আইন তোকে শেষবার মারবে। আগে হটাবাহার। তারপরে মরণ।

 –হঁ৷ আই বাপ, আমি আর বাইরে থাকতে পারি না।

–থাকতে হবে। সবাই আছে।

–তবে, আই বাপ, তবে যে সবাই ভালবাসে?

না। নাঃ। ও মরণটার সুখ কেউ জানে না। খেলা করে। ভালবাসার খেলা। তুই ধান ব্যাছ। পয়সা নে। পয়সা নিয়ে মালবাজার যা। ভালবাসা খেলে আয়।

বরহম আর্তনাদ করে উঠল, না। আই ধরমবাবা, পারব না।

তবে তুই বুনো দাঁতাল হোস না। হাঁড়িয়া খা। নতুন ধান উঠলে মাঠে যা। কাজ কর। ভালবাসিস না। ভালবাসলে মরণ। ভালবাসা নিয়ম নয়। আইন নয়।

চুপ করে রইল বরহম। তবে ঝড় কেন উঠল?

.

সন্ধ্যার অন্ধকার তখনও নামেনি। ঠিক দুলালের মতো চিৎকার করে উঠল পাঠান। কী, কী চাইরে তোর শয়তান। কুররর…কুররর, রিং কং রিং কং।

সেই কৃষ্ণ নীল বুনো দাঁতাল। একেবারে টিনের শেডের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পোষা পুরুষগুলি চিৎকার করে উঠল। কিন্তু বুনো দাঁতালের গুঁড় গিয়ে ঠেকল দিলালীর গায়ে। যাবে তো? তোমার জন্যে এসেছি।

দিলালী শুড় দিয়ে স্পর্শ করল বুনো দাঁতালের গুঁড়া-মুক্ত করো। আমাকে মুক্ত করো এই পাষাণ শিকল থেকে।

সুলতান শুড় ছুঁড়ে মারল বুনো দাঁতালকে। ইতিমধ্যে চিৎকার, টিন বাজানো, রেঞ্জারবাবুর ছররা গুলি। সুলতানের গায়ে একটি সুদীর্ঘ রক্তাক্ত দাগ টেনে দিয়ে, ছুটে অদৃশ্য হল বুনো দাঁতাল।

তবে ঝড় কেন উঠল? লড়লে হটাবাহার। ভালবাসলে মরণ। কিন্তু ফুল ফুটেছে তোমরা দেখনি? আমি ফিরে যাব।

রাত গভীর। হীরালাল ঘুমোয়। রাঙি কী করে? শ্বশুর জামাই আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে বাইরে। মশালের আলো।

নাড়িতে রক্তে ফুলে গাছে আকাশে মাটিতে ফিরে যাব।

সহসা যেন কেউ পিচকারি থেকে জল ছিটিয়ে দিল মশালের আর কাঠের আগুনে। অন্ধকার হয়ে গেল। আকাশ জুড়ে সেই বুনো দাঁতাল আবার এসেছে। শুড় ভরে নিয়ে এসেছে জল।

মাহীন্দর আর দুলাল চিৎকার করে দৌড়ে পালাল। আবার টিন বাজল। আবার মানুষের চিৎকার। পোষা কাপুরুষের ভীরু বৃংহিত, রিং কং রিং কং…

পরমুহূর্তেই একটি তীব্র গর্জন, কঙ্ক! আর টিনের শেড যেন মড়মড় করে উঠল। আবার ছররা, আবার আগুন।

ক্রোধে ও ঘৃণায় বুনো দাঁতাল এসে দাঁড়াল খোলা জায়গায়। ছোট ছোট জীবগুলি যেখানে মাছির। মতো ভ্যান ভ্যান করছিল। একবার দেখল সবাইকে। তারপরে অদৃশ্য হল অন্ধকারে।

কিন্তু ভোর হওয়ার আগে আবার এল বুনো দাঁতাল। টিনের শেডের একটা মোটা খুঁটি মটমট শব্দে ভেঙে পড়ল। ঢেউ টিনে শব্দ হল প্রচণ্ড মেঘগর্জনের মতো। যেদিকটায় পাঠান আছে, সেই দিকের থাম ভেঙে পড়ল।

আবার চিৎকার। বুনো দাঁতাল ঘুরে দাঁড়াল। যেখানে মাহীন্দর আর দুলাল আগুন নিয়ে বসেছিল, সেই দিকে ছুটে গেল। ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিল ঘরের বেড়ার গায়ে। ঘরটা কেঁপে উঠল।

মাহীন্দর চিৎকার করে বলল, হেই লক্ষ্মী, চিৎকার করিস না, সাড়া দিস না ঘর থেকে। ছেলেমেয়ে সামলে রাখ।

বুনো দাঁতাল সরে এল আবার শেডের দিকে। হাতি আর মানুষের কলরবে চালসার জঙ্গল বিমূঢ় হয়ে গেল। বুনো দাঁতালও বিমূঢ়। সহসা সে রেঞ্জারবাবুর ছররা গুলির বন্দুকটা লক্ষ্য করে ছুটল। বন্দুক পড়ে গেল হাত থেকে। রেঞ্জারবাবু ছুটলেন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে।

ফিরে এল আবার বিশাল কালো রুদ্রটা। শেডের মধ্যে ঢুকেই তার তীক্ষ্ণ দাঁত অনেকখানি বিদ্ধ করল পাঠানকে। দাঁত খুলে নেওয়া মাত্র রক্ত ছুটল ফিনকি দিয়ে। পাঠান যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। চোখে তার বিভীষিকা। দাঁতালের গুঁড় গিয়ে পড়ল দিলালীর পা বাঁধা শিকলে।

হেই বুনো দাঁতাল, দিলালীকে তুই নিয়ে যা।

–পারবে না।

হীরালাল যেন নির্বিকার গলায় গুঙিয়ে উঠল।–ও মরবে।

-মরবে?

–হাঁ। হটাবাহার হবে।

হটাবাহার হবে?

–হাঁ।

জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে দিল দুলাল দাঁতালের গায়ে। চিৎকার করে বলল, শিকল ছিঁড়ছে, শিকল।

আগুন গায়ে লাগতেই বুনো দাঁতাল ফিরল। কঙ্ক, কঙ্কো!… ঘৃণিত আগুন। বিশাল দেহ নিয়ে সে ছায়ার মতো দ্রুত অদৃশ্য হল।

তারপরে পাঠানের পরিচর্যা। বাংলোতে স্থানান্তরিত করা হল মাহীন্দরের পরিবারকে। আবার যদি আক্রমণ হয়, এ ঘরটা হয় তো ছাড়বে না।

কিন্তু সারাদিন ধরে বনের পথ আর মাঠ-ঘাট বস্তি থেকে সংবাদ আসতে লাগল, বুনো দাঁতালের ক্ষ্যাপামির।

–আই বাপ, এটা কী ধরম রে? বুনো দাঁতাল ক্যানে পায় না দিলালীকে?

নিয়ম নেই। অই, নিয়ম নেই। তুই তো মা’র গানটা ভুলে গেছিস?

না জীবোন গাতিড। নে জীবোন কাহী নামোগা।

–তুই গানটা গা।

না।

–তুই বুনো দাঁতাল হতে চাস?

–আই বাপ, কাচীম লে লে মদা গীসোবা, আমি ফুলে যাব।

 ফুলে যাবি?

–হাঁ। মাটিতে আসমানে যাব। আমি গাছ হব। আমি রক্তে মিশে যাব।

 হীরালাল চিৎকার করে ওঠে, অই, তুই বুনো দাঁতাল হবি?

 বরহম চুপ করে। সে রাঙির কথা শুনতে চায়। রাঙি জানে, সে বুনো দাঁতাল হবে কি না।

রাত্রের মধ্যে চারবার আক্রমণ করল বুনো দাঁতাল। পরদিন, দিনের বেলাতেও সেই অভিসারের রুদ্র অভিযান শুরু হল।

রেঞ্জারবাবুর জিপ ছুটল জলপাইগুড়ি। ডিভিশনাল অফিসের ঘোষণাপত্র নিল আগে, বুনো দাঁতাল আউট ল। পশুরক্ষা আইনের আওতা থেকে সে বহিষ্কৃত। ভালবেসে দুর্বিনীত হয়েছে পশুটা।

অই দ্যাখ, বুনো দাঁতাল হটাবাহার হয়ে গেছে!

–হটাবাহার?

–হাঁ, হটাবাহার। হটাবাহার হলে কী হয়?

–সবাই তাকে মারে। খেতে দেয় না। কাজ দেয় না।

এবার ওকে মারবে।

 –ক্যানে, উয়ার একটা ধরম বাবা নাই?

 পচুঁইয়ের হাঁড়িটা মুখে ঠেকিয়ে বীভৎস গলায় ঘোষণা করল হীরালাল, না।

–কোনও রাজা হটাবাহার নাই ওর?

না। ও ভালবেসেছে। ও মরবে।

 মরবে। হটাবাহার দাঁতালটা এবার মরবে। পরদিন সকালবেলা এল চা বাগানের দুই সাহেব। অগ্রহায়ণের রোদ ওদের গায়ে লাল আগুনের মতো দেখাল। বড় বড় দুটি বন্দুক ওদের হাতে। আইন নিয়ে এসেছে ওরা খুনের জিঘাংসা খুশি হয়ে উঠেছে ওদের চোখে।

ওরা জিজ্ঞেস করল। কোনখান দিয়ে সে আসে?

 বন থেকে যে পথ বাংলোয় ঢুকেছে, সেই পথে।

কখন আসে?

যে-কোনও মুহূর্তে আসতে পারে।

বাংলোর সীমানা থেকে সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হল। চার হাতিকে সরিয়ে দেওয়া হল টিনের শেড থেকে। শুধু দিলালী রইল। কারণ বুনো দাঁতালটা দিলালীকে চায়। তারপর লাল লাল মানুষ দুটো কোথায় অদৃশ্য হয়। শুধু ঝিঁঝি ডাকতে লাগল। ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে শুধু দিলালীর প্রতীক্ষা স্তব্ধ হয়ে রইল। শুধু প্রতীক্ষা, সেই বিশাল কৃষ্ণনীল প্রাণের দয়িতের।

বরহম ছটফটিয়ে উঠল ঘরের মধ্যে। হীরালাল তাকে ধরে রাখল। অই, হটাবাহার, তুই তোর মরণটা দেখ।

না। আমার বুকের ধুকধুকিটা চলে।

–এটা তোর মরণ। তুই দেখ। ওই দেখ, বুনো দাঁতালটা আসছে।

 আসছে। কিন্তু পদক্ষেপ ধীর। সন্দিগ্ধ, অস্বস্তিকর। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য আগমন। কঙ্ক, কুররর। দিলালী, বিপদ কিছু আছে?

কঙ্ক! কঙ্ক! আছে।

থাকবেই। তবু আসতে হবে। কারণ ভালবেসে সে বন্ধুদের দলচ্যুত। আইনের আশ্রয়চ্যুত। হয় তো শত্রুরা আরও অনেক ষড়যন্ত্র করেছে। হয়তো এই মুহূর্তে পা ধসে যাবে। পড়ে যেতে হবে কোনও গভীর গর্তে। কিংবা একটা গাছ-ই ফাঁদ হয়ে জড়িয়ে ধরবে। কিংবা অদৃশ্য থেকে ছুটে আসবে সেই মৃত্যুর হুল

অটোমেটিক সাইড হ্যাঁমার গর্জে উঠল দু দিক থেকে। একমুহূর্তে থমকে গেল বুনো দাঁতাল। মনে হল তার হৃৎপিণ্ডে যেন কীসে কামড়ে ধরল।

সে চোখ তুলে দেখল দিলালীর দিকে। ছুটল দিলালীকে লক্ষ্য করে।

 কিন্তু সাইড হ্যাঁমারের গর্জন থামল না। অগুনতি অসংখ্য শব্দে চালসার বন কাঁপল। সমস্ত পাখি উড়ল আকাশে। অরণ্যের সারা জীবজগতে ছুটোছুটি পড়ে গেল বুঝি।

বুনো দাঁতালের গলায় দুর্বোধ্য চিৎকার উঠল, আংক্! আংক! কিন্তু সে থামল না। ছুটল। ছুটতে ছুটতে, টিনের শেডের মধ্যে ঢুকল। তখন বিশাল কালো শরীরের জায়গায় জায়গায় রক্তের ফিনিক। বুনো দাঁতালটা মুখ থুবড়ে পড়ল দিলালীর পায়ের ওপর।

দিলালী একবার ডাকল, কঙ্ক। শুড় বাড়িয়ে দিল বুনো দাঁতালের গায়ে। তার পাষাণ শিকলের মুক্তি শেষ নিশ্বাস ফেলছে। তার এলায়িত শুড়ের উষ্ণ নিশ্বাস, দিলালীর পায়ে লাগছে।

উৎসবের কলরোল ফেটে পড়ল বাংলোর উঠোনে।

হীরালাল পচুঁইয়ের ভাঁড়টা বরহমের মুখে উপুড় করে ধরল। মুখের মধ্যে গেল কিছু কিছু বাইরে গড়িয়ে পড়ল।

হীরালালের গলা কোলা ব্যাং-এর মতো শোনাল, হটাবাহারটা মরল। তুই দেখলি?

–হঁ৷ দেখলাম।

–এটা তোর মরণ।

না, আমার বুকের ধুকপুকিটা চলে। আমি রাঙির কাছে যাব।

 রাঙি একটা মানুষ।

–হ, রাঙি একটা মানুষ। আই বাপ, মনের মানুষ যে।

-মনের মানুষ?

–ই, মনের মানুষ। আমি রাঙির কাছে যাব।

 হীরালালের দৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়ে উঠল। সে যেন বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকাল বরহমের দিকে। যেন ভয় পেয়ে, চাপা গলায় বলল, তবে তুই যাস না। অই হটাবাহার, তুই তোর মা-র গানটা গা।

–ক্যানে? আই বাপ?

–না, তুই কখনও ফিরতে পারবি না, তোকে বাইরে পড়ে থাকতে হবে। তোকে কপাটে নাড়া দিয়ে ঘুরতে হবে। তুই মরবি না।

বরহম প্রায় চিৎকার করে উঠল, ক্যানে?

না। মনের মানুষ নাই জগতে।

–আই বাপ, বলিস না।

না নাই।

বরহম ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রাঙি? কোথায় রাঙি? হত্যা উৎসবের ভিড়ের মধ্যে গেল না সে। ওখানে রাঙি নেই। রাঙি কোথায়?

আই, আমি একটা হটাবাহার হে। ঝড় লেগেছে। সেই বাতাসে ভর করে আমি ফিরে যেতে চাই। হে মা, তোর গান আমি গাইব না।

রাঙি কোথায়? ওই ওখানে, ভিড়ের বাইরে, সেগুন চারার জঙ্গলে, ঝি ঝি ডাকা নির্জনে। দিলালীর কান্নাটা কাঁদছে রাঙি?

রাঙি আরও ঘন ঝোপে ঝাড়ে গেল। আরও, যেখানে বারোমাসের সন্ধ্যাচণ্ডী মলিন হয়ে আছে। দিনের আলোয়। শেষ ঘাস ফুল যেখানে বিষণ্ণ হয়েছে অগ্রহায়ণে।

রাঙি চোখ তুলে তাকাল বরহমের দিকে। হাসল। এ হাসি নিঃশব্দ। এ হাসির কোনও ভূমিকা নেই। এ হাসির কোনও পাড়-ভাসানো উচ্চ তরঙ্গ নেই। এই হাসি পাড়ভোবানো, নিঃশব্দ। এ হাসি আকণ্ঠ। এ হাসি তারপরে শুধু চোখের জলে গড়িয়ে পড়তে পারে নিঃশব্দে।

রাঙি দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল বরহমকে। নির্ভয়ে জড়িয়ে ধরল, একটি পরম পাওয়ার গম্ভীর সোহাগে ও গভীর স্নেহে। কিন্তু বুনো দাঁতালের শক্তি কোথায় বরহমের হাতে। তার বুকের মধ্যে কাঁপতে লাগল। সে জানু পেতে বসল রাঙির পায়ের কাছে।

রাঙিও বসল। চোখে চোখে তাকাল বরহমের।

আই হটাবাহার, তোর বুকে ঝড়, তুই বোবা কেন হয়ে গেলি?

 রাঙির মেহেদীরাঙানো হাত তরাইয়ের বন্য বিশাল শক্ত শরীরটায় বুলিয়ে দিল। তার চোখে জল দেখা দিল। তবু সে হাসল। সে তরাইয়ের প্রান্ত পাথরে ঠোঁট ছোঁয়াল। এ কোন রাঙি! রাঙি তবু নিঃশব্দে হাসল।

তারপর রাঙি চোখের ইশারায় দেখিয়ে দিল বাংলোর দিকে। বহরম দেখল। বুনো দাঁতালের দাঁত দুটি কাটা হয়ে গেছে। তার সর্বাঙ্গে রক্ত। ছোট্ট চোখ দুটি উদ্দীপ্ত। যেন সপ্রশ্ন চোখে তাকিয়ে আছে দিলালীর দিকে। সে কাত হয়ে পড়ে আছে। তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে, দিলালী আর রাজা টেনে নিয়ে চলেছে। মাটি হেঁচড়ে হেঁচড়ে রক্তাক্ত পাহাড়টাকে টেনে নিয়ে চলেছে। ফেলে দিয়ে আসবে দূরে। অনেক দূরে। পশুপাখিতে খাবে। তারপরে হাড়গুলি ছাড়িয়ে নিয়ে অবশিষ্ট পুঁতে দেওয়া হবে মাটিতে।

রাঙি আঙুল তুলে বলল, দেখেছ?

বরহম বলল, হঁ রাঙি!

 রাঙি তার মেহেদীরাঙানো হাতে মুঠো করে ধরতে চাইল বরহমের আরণ্যক পাথর শরীর। বিশাল থাবা দুটি আছড়ে ফেলল তার বুকের চূড়ায়। তারপর চুপিচুপি যেন বলল, চলে যাও। চলে যাও।

কুথা হে রাঙি?

–যেখানে তোমার খুশি।

–আই রাঙি, আমার মরণ হল না। রাঙির শ্বাস দ্রুত হল। তারপরে রুদ্ধ হল। রাঙি বড় হতে লাগল। শরীর ছাড়িয়ে, ছাড়িয়ে, উঠে উঠে, অনেক উঁচু থেকে বলল, সত্সারে শরীলটা না মরে? মনের মরণ নাই।

রাঙি চলে গেল ঘরের দিকে। বরহম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে চলে যেতে বলেছে। আই হটাবাহার! রাঙি একটা মানুষ। মনের মানুষ হে। আই হটাবাহার, তুই তোর মায়ের গানটা গা। আই আমি একটা হটাবাহার, কিন্তু মানুষ। আমি আমার মায়ের গানটা গাই,

নে জীবোন কাহী নামোগা।

কারণ, জীবনটা সেই দরদের মতো, যে দরদটা কখনও সারে না।